মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনী
- মুহাম্মাদ (সাঃ) এর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
নাম : হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
অন্যান্য সর্বাধিক প্রচলিত প্রিয় নাম সমূহ: মুহাম্মদ (সাঃ), মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ (সাঃ), আহমাদ (সাঃ), আবুল কাসিম (সাঃ), রাসূল (সাঃ), নবী (সাঃ), মহানবী (সাঃ)
পিতা : হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিব (রাঃ)
মাতা : হযরত আমিনা (রাঃ)
জন্ম : ২৯ আগস্ট ৫৭০ সাল/খ্রিস্টাব্দ
জন্মস্থান : বাক্কা, আরব (অধুনা মক্কা, মক্কা প্রদেশ, সৌদি আরব)
নবুয়াত লাভ : ৪০ বছর বয়সে (৬১০ সাল/খ্রিস্টাব্দ)
জীবনকাল : ৬৩ বছর
ওফাত (পরলোকগমণ) : ৮ জুন ৬৩২ সাল/খ্রিস্টাব্দ
ওফাত (পরলোকগমণ) এর স্থান : ইয়াসরিব (মদিনা), আরব (অধুনা মদিনা, হেজাজ, সৌদি আরব)
সমাধি স্থান : মদিনা (মসজিদে নববীর সবুজ গম্বুজের নিচের সমাধিক্ষেত্র), সৌদি আরব
স্থানাঙ্ক : ২৪°২৮′০৩.২২″ উত্তর ০৩৯°৩৬′৪১.১৮″ পূর্ব
মুহাম্মাদ (সাঃ) এর স্ত্রীগণ/বিবিগণ/দাম্পত্য সঙ্গী :
(প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ (রাঃ) বেঁচে থাকাকালীন কোন বিবাহ করেন নি, একসঙ্গে চার এর অধিক স্ত্রী ছিল না, ইসলাম প্রচারের সুবিধার্থে/স্বার্থে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করে ছিলেন, সবাই কে প্রতি সমান ইনছাফপূর্ণ হক/অধিকার আদায় করে ছিলেন যার জন্য কোন দিন কোন স্ত্রী তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তো দুরের কথা মনঃক্ষুর্ণও হননি)
খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ (রাঃ) (৫৯৫-৬১৯)
সাওদা বিনতে জামআ (রাঃ) (৬১৯-৬৩২)
আয়িশা (রাঃ) (৬১৯-৬৩২)
হাফসা বিনতে উমর (রাঃ) (৬২৪-৬৩২)
জয়নব বিনতে খুযায়মা (রাঃ) (৬২৫-৬২৭)
উম্মে সালামা হিন্দ বিনতু আবি উমাইয়া (রাঃ) (৬২৯-৬৩২)
জয়নব বিনতে জাহশ (রাঃ) (৬২৭-৬৩২)
জুওয়াইরিয়া বিনতে আল-হারিস (রাঃ) (৬২৮-৬৩২)
রামালাহ বিনতে আবি সুফিয়ান (রাঃ) (৬২৮-৬৩২)
রায়হানা বিনতে জায়েদ (রাঃ) (৬২৯-৬৩১)
সাফিয়া বিনতে হুওয়াই (রাঃ) (৬২৯-৬৩২)
মায়মুনা বিনতে আল-হারিস (৬৩০-৬৩২)
মারিয়া আল-কিবতিয়া (৬৩০-৬৩২)
সন্তান-সন্তানাদিগণ :
পুত্রগণ : কাসিম (রাঃ), আবদুল্লাহ (রাঃ), ইবরাহিম (রাঃ)
কন্যাগণ : জয়নব (রাঃ), রুকাইয়াহ (রাঃ), উম্মে কুলসুম (রাঃ), ফাতিমা (রাঃ)।
আত্মীয় : আলী (রাঃ), উমর (রাঃ), আবু বকর (রাঃ), আবু সুফিয়ান (রাঃ)।
সূচি / অধ্যায় সমূহ :
১। মুহাম্মাদ সাঃ এর জন্ম, পূর্ণনাম ও পরিচিতি
১.১। প্রাক-ইসলামী আরব
২। মুহাম্মাদ সাঃ এর জীবনের উপর তথ্যসূত্র
২.১। হাদিস
৩। মুহাম্মাদ সাঃ এর ইসলামী চরিতাভিধান অনুসারে জীবনী
৩.১। জন্ম
৩.২। শৈশব ও কৈশোর কাল
৩.৩। নবুয়ত-পূর্ব জীবন
৩.৪। নবুওয়ত প্রাপ্তি
৪। মক্কী জীবন
৪.১। গোপন প্রচার
৪.২। প্রকাশ্য দাওয়াত
৪.৩। মক্কায় বিরোধিতার সম্মুখীন
৪.৪। ইথিওপিয়ায় হিজরত
৪.৫। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ইসলাম গ্রহণ
৪.৬। একঘরে অবস্থা
৪.৭। দুঃখের বছর ও তায়েফ গমন
৪.৮। মি’রাজ বা উর্দ্ধারোহণ
৫। মদিনায় হিজরত
৬। মাদানী জীবন
৬.১। স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও সংবিধান প্রণয়ন
৬.২। মক্কার সাথে বিরোধ ও যুদ্ধ
৬.৩। মদিনার ইহুদিদের সাথে সম্পর্ক
৬.৪। হুদাইবিয়ার সন্ধি
৬.৫। বিভিন্ন রাষ্ট্রনায়কদের কাছে পত্র প্রেরণ
৬.৫.১। প্রেরিত দূতগণের তালিকা
৬.৬। মক্কা বিজয়
৬.৭। মক্কা বিজয়ের পর
৬.৮। মৃত্যু
৭। মুহাম্মাদ সাঃ এর ওফাত পর
৮। সংস্কারক হিসেবে মুহাম্মাদ সাঃ
৯। ইসলামী বর্ণনামতে মুহাম্মাদ সাঃ এর অলৌকিকত্ব
১০। অমুসলিমদের দৃষ্টিভঙ্গি
১১। আরও দেখুন
১২। পাদটীকা
১৩। তথ্যসূত্র
১৪। গ্রন্থপঞ্জী
১৫। বহিঃসংযোগ
১৫.১। সাধারণ
১৫.২। মুসলিম রচিত
১৫.৩। আহ্মদীয়া রচিত
১৫.৪। অমুসলিম রচিত
১ । মুহাম্মাদ সাঃ এর জন্ম, পূর্ণনাম ও পরিচিতি :
মুহাম্মাদ সাঃ বর্তমান সৌদি আরবে অবস্থিত মক্কা নগরীর কুরাইশ বংশের বনু হাশিম গোত্রে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ আগস্ট বা আরবি রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ জন্ম গ্রহণ করেন। محمد (সাহায্য) মোহাম্মদ এবং মুহম্মদ নামেও পরিচিত; তুর্কি : মুহাম্মেদ), পূর্ণ নাম : মুহাম্মাদ ইবনে ʿআবদুল্লাহ ইবনে ʿআবদুল মুত্তালিব ইবনে হাশিম (ابو القاسم محمد ابن عبد الله ابن عبد المطلب ابن هاشم) হলেন ইসলামের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব এবং ইসলামী বিশ্বাস মতে আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত সর্বশেষ নবী সাঃ, (আরবি: النبي আন-নাবিয়্যু), তথা “বার্তাবাহক” (আরবি : الرسول আর-রাসুল), যার উপর ইসলামী প্রধান ধর্মগ্রন্থ আল-কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। অধিকাংশ ইতিহাসবেত্তা ও বিশেষজ্ঞদের মতে, মুহাম্মাদ সাঃ ছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় নেতা। তার এই বিশেষত্বের অন্যতম কারণ হচ্ছে আধ্যাত্মিক ও জাগতিক উভয় জগতেই চূড়ান্ত সফলতা অর্জন। তিনি ধর্মীয় জীবনে যেমন সফল তেমনই রাজনৈতিক জীবনেও। সমগ্র আরব বিশ্বের জাগরণের পথিকৃৎ হিসেবে তিনি অগ্রগণ্য; বিবাদমান আরব জনতাকে একীভূতকরণ তার জীবনের অন্যতম সফলতা। ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে (হস্তিবর্ষ) মক্কা নগরীতে জন্ম নেওয়া মুহাম্মাদ সাঃ মাতৃগর্ভে (৬মাস) থাকাকালীন পিতা হারা হন ৬বছরের শিশু বয়সে মাতাকে হারিয়ে এতিম হন এবং প্রথমে তার পিতামহ আবদুল মুত্তালিব ও পরে পিতৃব্য আবু তালিবের নিকট লালিত পালিত হন। হেরা পর্বতের গুহায় ৪০ বছর বয়সে তিনি নবুওয়াত লাভ করেন। জিবরাঈল ফেরেশতা এই পর্বতের গুহায় আল্লাহর তরফ থেকে তার নিকট ওহী নিয়ে আসেন। তিন বছর পর ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে মুহাম্মাদ প্রকাশ্যে ওহী প্রচার করেন, এবং ঘোষণা দেন “আল্লাহ্ এক” ও তার নিকট নিজেকে সঁপে দেওয়ার মধ্যেই জাগতিক কল্যাণ নিহিত, এবং ইসলামের অন্যান্য নবীদের মত তিনিও আল্লাহর প্রেরিত দূত।
তৎকালীন আরবের ভৌগলিক, সামাজিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা
আরবের ভৌগোলিক অবস্থান এবং গোত্রসমূহ (مَوْقَعُ الْعَرَبِ وَأَقْوَامُهَا)
নাবী (সাঃ)-এর জীবন চরিত বলতে বুঝায় প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ প্রদত্ত সেই বার্তা বিচ্ছুরিত আলোক রশ্মির বাস্তবায়ন বা রূপায়ণ যা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মানব জাতির সম্মুখে উপস্থাপন করেছেন এবং যার মাধ্যমে মানুষকে ভ্রষ্টতার গাঢ় অন্ধকার থেকে উদ্ধার করে শাশ্বত আলোকোজ্জ্বল পথের উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং মানুষের দাসত্ব ও শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে আল্লাহর দাসত্বে প্রবিষ্ট করেছেন। এমনকি ইতিহাসের চিত্রকেই পাল্টিয়ে দিয়েছেন এবং মানবজগতের জীবনধারায় আমূল পরিবর্তন আনয়ন করেছেন।
সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব ও নাবী (সাঃ)-এর পবিত্র জীবন ধারার পূর্ণাঙ্গ প্রতিচ্ছবি অঙ্কন ততক্ষণ পর্যন্ত সম্ভব নয় যতক্ষণ না আল্লাহর বাণী অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বের ও পরের অবস্থার তুলনামূলক বিচার বিশ্লেষণ না করা হয়। এ প্রেক্ষাপটে প্রকৃত আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে আলোচ্য অধ্যায়ে প্রাক ইসলামিক আরবের ভৌগোলিক সীমারেখা, আরব ভূমিতে বসবাসরত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অবস্থা ও অবস্থান এবং তাদের ক্রমোন্নতির ধারা এবং সে যুগের রাষ্ট্র পরিচালনা, নেতৃত্ব প্রদান ও গোত্রসমূহের শ্রেণীবিন্যাশকে বিভিন্ন দীন-ধর্ম, সম্প্রদায়, আচার-আচরণ, অন্ধবিশ্বাস এবং রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক চিত্রসহ পাঠক-পাঠিকার সামনে তুলে ধরা প্রয়োজন।
একারণেই আমি এ বিষয়সমূহকে বিশেষভাবে বিভিন্ন স্তরবিন্যাশে উপস্থাপন করেছি।
ফুটনোটঃ
আরবের অবস্থান
‘আরব’ শব্দটি ‘বালুকাময় প্রান্তর’ উষর ধূসর মরুভূমি বা লতাগুল্ম তৃণশষ্যবিহীন অঞ্চল অর্থে ব্যবহৃত হয়। স্মরণাতীত কাল থেকেই বিশেষ এক বৈশিষ্ট্যগত অর্থে আরব উপদ্বীপ এবং সেখানে বসাবাসকারী সম্প্রদায়ের জন্য এ পরিভাষাটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
আরবের পশ্চিমে লোহিত সাগর ও সিনাই উপদ্বীপ, পূর্বে আরব উপসাগর ও দক্ষিণ ইরাকের এক বড় অংশ এবং দক্ষিণে আরব সাগর যা ভারত মহা সাগরের বিস্তৃত অংশ, উত্তরে শামরাজ্য এবং উত্তর ইরাকের কিছু অংশ। উল্লেখিত সীমান্ত সমূহের কোন কোন ক্ষেত্রে কিছুটা মতবিরোধ রয়েছে। সমগ্র ভূভাগের আয়তন ১০ লক্ষ থেকে ১৩ লক্ষ বর্গ মাইল পর্যন্ত ধরা হয়েছে।
আভ্যন্তরীণ ভৌগোলিক এবং ভূপ্রাকৃতিক উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই আরব উপদ্বীপ অত্যন্ত গুরুত্ব এবং তাৎপর্য বহন করে। এ উপদ্বীপের চতুর্দিক মরুভূমি বা দিগন্ত বিস্তৃত বালুকাময় প্রান্তর দ্বারা পরিবেষ্টিত। যে কারণে এ উপদ্বীপ এমন এক সুরক্ষিত দূর্গে পরিণত হয়েছে যে, যে কোন বিদেশী শক্তি বা বহিঃশত্রুর পক্ষে এর উপর আক্রমণ পরিচালনা, অধিকার প্রতিষ্ঠা কিংবা প্রভাব বিস্তার করা অত্যন্ত কঠিন। এ নৈসর্গিক কারণেই আরব উপদ্বীপের মধ্যভাগের অধিবাসীগণ সেই সুপ্রাচীন এবং স্মরণাতীত কাল থেকেই সম্পূর্ণ স্বাধীন থেকে নিজস্ব স্বাতন্ত্রগত বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে চলতে সক্ষম হয়েছে। অথচ অবস্থানের দিকে দিয়ে এ উপদ্বীপটি এমন দু’পরাশক্তির প্রতিবেশী যে, ভূপ্রকৃতিগত প্রতিবন্ধকতা না থাকলে এ পরাশক্তিদ্বয়ের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকা আরববাসীগণের পক্ষে কখনই সম্ভবপর হতো না।
বহির্বিশ্বের দিক থেকে আরব উপদ্বীপের অবস্থানের প্রতি লক্ষ করলেও প্রতীয়মান হবে যে, দেশটি পুরাতন যুগের মহাদেশ সমূহের একেবারে মধ্যস্থল বা কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত এবং জল ও স্থল উভয় পথেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও মহাদেশের সঙ্গে সংযুক্ত। এর উত্তর পশ্চিম সীমান্ত হচ্ছে আফ্রিকা মহাদেশ গমনের প্রবেশ পথ, উত্তর পূর্ব সীমান্ত হচ্ছে ইউরোপ মহাদেশে প্রবেশের প্রবেশদ্বার এবং পূর্ব সীমান্ত হচেছ ইরান ও মধ্য এশিয়া হয়ে চীন ভারতসহ দূর প্রতীচ্যে গমনামনের দরজা। এভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও মহাদেশ থেকে সাগর ও মহাসাগর হয়ে আগত জল পথ আরব উপদ্বীপের সঙ্গে চমৎকার যোগসূত্র রচনা করেছে। বিভিন্ন দেশের জাহাজগুলো সরাসরি আরবের বন্দরে গিয়ে ভিড়ে। এরূপ ভৌগোলিক অবস্থান ও সীমারেখার প্রেক্ষিতে আরব উপদ্বীপের উত্তর ও দক্ষিণ সীমান্ত ছিল বিভিন্ন সম্প্রাদয়ের ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি ও মত বিনিময়ের লক্ষ্যস্থল বা কেন্দ্রবিন্দু।
ফুটনোটঃ
আরব সম্প্রদায়সমূহ
জন্মসূত্রের ভিত্তিতে ইতিহাসবিদগণ আরব সম্প্রদায় সমূহকে তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। যথা:
আরবের বায়িদাহ : এঁরা হল ঐ সমস্ত ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাচীন গোত্র এবং সম্প্রদায় যা ধরাপৃষ্ঠ থেকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এবং এদের খোঁজ খবর সম্পর্কিত নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রমাণাদির সন্ধান লাভ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এ সম্প্রদায়গুলো হচ্ছে যথাক্রমে আদ, সামূদ, ত্বাসম, জাদীস, ইমলাক্ব, উমাইম, জুরহুম, হাযূর, ওয়াবার, ‘আবীল, জাসিম, হাযারামাওত ইত্যাদি।[1]
আরবে ‘আরিবা : এরা হচ্ছে ঐ সমস্ত গোত্র যারা ইয়াশজুব বিন ইয়া‘রুব বিন ক্বাহত্বানের বংশোদ্ভূত। এদেরকে ক্বাহত্বানী আরব বলা হয়।
আরবে মুস্তা’রিবা : এরা হচ্ছেন ঐ আরব সম্প্রদায় যারা ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশধারা থেকে আগত। এদেরকে আদনানী আরব বলা হয়।
আরবে ‘আরিবা অর্থাৎ ক্বাহত্বানী আরবদের প্রকৃত আবাসস্থল ছিল ইয়ামান রাজ্য। এখানেই তাদের বংশধারা এবং গোত্রসমূহ সাবা বিন ইয়াশযুব বিন ইয়া‘রুব বিন ক্বাহত্বান এর বংশধর থেকে বহু শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। এর মধ্যে পরবর্তীকালে দু’গোত্রই অধিক প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। সেগুলো হল : হিমইয়ার বিন সাবা ও কাহলান বিন সাবা। বনী সাবা’র আরো এগারটি বা চৌদ্দটি গোত্র ছিল যাদেরকে সাবিউন বলা হতো। সাবা ব্যতীত তাদের আর কোনো গোত্রের অস্তিত্ব নেই।
(ক) হিমইয়ার : এর প্রসিদ্ধ শাখাগুলো হচ্ছে-
(১) কুযা’আহ : এর প্রশাখাসমূহ হল বাহরা, বালী, আলক্বায়ন, কালব, উযরাহ ও ওয়াবারাহ।
(২) সাকাসিক : তারা হলেন যায়দ বিন ওয়ায়িলাহ বিন হিমইয়ার এর বংশধর। যায়দ এর উপাধি হল সাকাসিক। তারা বনী কাহলানের ‘সাকাসিক কিন্দাহ’র অন্তর্ভুক্ত নয় যাদের আলোচনা সামনে আসছে।
(৩) যায়দুল জামহুর : এর প্রশাখা হল হিমইয়ারুল আসগার, সাবা আল-আসগার, হাযূর ও যূ আসবাহ।
(খ) কাহলান : এর প্রসিদ্ধ শাখা-প্রশাখাগুলো হচ্ছে হামদান, আলহান, আশ’য়ার, ত্বাই, মাযহিজ (মাযহিজ থেকে আনস ও আন্ নাখ‘, লাখম (লাখম হতে কিন্দাহ, কিন্দাহ হতে বনু মুআ‘বিয়াহ, সাকূন ও সাকাসিক), জুযাম, আ‘মিলাহ, খাওলান, মাআ‘ফির, আনমার (আনমার থেকে খাসয়াম ও বাখীলাহ, বাখীলাহ থেকে আহমাস) আযদ (আযদ থেকে আউস, খাজরায, খুযা’আহ এবং জাফরান বংশধরগণ। এঁরা পরে শাম রাজ্যের আশেপাশে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং আলে গাসসান নামে প্রসিদ্ধ লাভ করেন।
অধিকাংশ কাহলানী গোত্র পরে ইয়ামান রাজ্য পরিত্যাগ করে আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণভাবে তাদের দেশত্যাগের ঘটনা ঘটে ‘সাইলে আরিমের’ কিছু পূর্বে। ঐ সময়ের ঘটনা, যখন রোমীয়গণ মিশর ও শামে অনুপ্রবেশ করে ইয়েমেরনর অধিবাসীদের ব্যবসা-বাণিজ্যের জলপথের উপর একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করে এবং স্থলপথের যাবতীয় সুযোগ সুবিধারও চিরতরে অবসান ঘটে। এর ফলে কাহলানীদের ব্যবসা-বাণিজ্য একদম উজাড় হয়ে যায়। যার সাক্ষ্য পবিত্র কুরআনে এসেছে, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
{لَقَدْ كَانَ لِسَبَإٍ فِيْ مَسْكَنِهِمْ آيَةٌ جَنَّتَانِ عَنْ يَمِيْنٍ وَّشِمَالٍ كُلُوْا مِن رِّزْقِ رَبِّكُمْ وَاشْكُرُوْا لَهُ بَلْدَةٌ طَيِّبَةٌ وَّرَبٌّ غَفُوْرٌ فَأَعْرَضُوْا فَأَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ سَيْلَ الْعَرِمِ وَبَدَّلْنَاهُمْ بِجَنَّتَيْهِمْ جَنَّتَيْنِ ذَوَاتَى أُكُلٍ خَمْطٍ وَأَثْلٍ وَشَيْءٍ مِّنْ سِدْرٍ قَلِيْلٍ ذٰلِكَ جَزَيْنَاهُمْ بِمَا كَفَرُوْا وَهَلْ نُجَازِيْ إِلَّا الْكَفُوْرَ وَجَعَلْنَا بَيْنَهُمْ وَبَيْنَ الْقُرٰى الَّتِيْ بَارَكْنَا فِيْهَا قُرًى ظَاهِرَةً وَّقَدَّرْنَا فِيْهَا السَّيْرَ سِيْرُوْا فِيْهَا لَيَالِيَ وَأَيَّامًا آمِنِيْنَ فَقَالُوْا رَبَّنَا بَاعِدْ بَيْنَ أَسْفَارِنَا وَظَلَمُوْا أَنفُسَهُمْ فَجَعَلْنَاهُمْ أَحَادِيْثَ وَمَزَّقْنَاهُمْ كُلَّ مُمَزَّقٍ إِنَّ فِيْ ذٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّكُلِِّ صَبَّارٍ شَكُوْرٍ} [سورة سبأ:15: 19]
‘‘সাবার অধিবাসীদের জন্য তাদের বাসভূমিতে একটা নিদর্শন ছিল- দু’টো বাগান; একটা ডানে, একটা বামে। (তাদেরকে বলেছিলাম) তোমাদের প্রতিপালক প্রদত্ত রিযক ভোগ কর আর তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। সুখ-শান্তির শহর আর ক্ষমাশীল পালনকর্তা। কিন্তু তারা (আল্লাহ হতে) মুখ ফিরিয়ে নিল। কাজেই আমি তাদের বিরুদ্ধে পাঠালাম বাঁধ-ভাঙ্গা বন্যা, আর আমি তাদের বাগান দু’টিকে পরিবর্তিত করে দিলাম এমন দু’টি বাগানে যাতে জন্মিত বিস্বাদ ফল, ঝাউগাছ আর কিছু কুল গাছ। অকৃতজ্ঞতাভরে তাদের সত্য প্রত্যাখ্যান করার জন্য আমি তাদেরকে এ শাস্তি দিয়েছিলাম। আমি অকৃতজ্ঞদের ছাড়া এমন শাস্তি কাউকে দেই না। তাদের এবং যে সব জনপদের প্রতি আমি অনুগ্রহ বর্ষণ করেছিলাম সেগুলোর মাঝে অনেক দৃশ্যমান জনপদ স্থাপন করে দিয়েছিলাম এবং ওগুলোর মাঝে সমান সমান দূরত্বে সফর মনযিল করে দিয়েছিলাম। (আর তাদেরকে বলেছিলাম) তোমরা এ সব জনপদে রাতে আর দিনে নিরাপদে ভ্রমণ কর। কিন্তু তারা বলল- হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের সফর-মঞ্জিলগুলোর মাঝে ব্যবধান বাড়িয়ে দাও। তারা নিজেদের প্রতি যুলম করেছিল। কাজেই আমি তাদেরকে কাহিনী বানিয়ে ছাড়লাম (যে কাহিনী শোনানো হয়) আর তাদেরকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিলাম। এতে প্রত্যেক ধৈর্যশীল কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য নিদর্শন রয়েছে। (সূরাহ সাবা : ১৫-১৯)
হিমইয়ারী ও কাহলানী গোত্রদ্বয়ের বংশদ্বয়ের মধ্যে বিরাজমান আত্মকলহ ও দ্বন্দ্ব ছিল তাদের অন্যতম প্রধান কারণ। যার ইঙ্গিত বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া যায়। এ সকল সূত্র থেকে যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় যে, আত্মকলহের কারণে জীবন যাত্রার বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানাবিধ জটিল সমস্যার উদ্ভব হওয়ায় কাহলানী গোত্রসমূহ স্বদেশভূমির মায়া-মমতা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়, কিন্তু হিমইয়ারী গোত্রসমূহ স্বস্থানে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকে।
যে সকল কাহলানী গোত্র স্বদেশের মায়া-মমতা কাটিয়ে অন্যত্র গমন করে তাদের চারটি শাখায় বিভক্ত হওয়ার কথা নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায় :
১। আযদ : এঁরা নিজ নেতা ইমরান বিন ‘আমর মুযাইক্বিয়ার পরামর্শানুক্রমে দেশত্যাগ করেন। প্রথম দিকে এঁরা ইয়ামানের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করতে থাকেন। তাঁদের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাত্রার প্রাক্কালে নিরাপত্তার ব্যাপারে সুনিশ্চিত হওয়ার জন্য অগ্রভাগে অনুসন্ধানী প্রহরীদল প্রেরণ করতেন। এভাবে পথ পরিক্রমা করতে করতে তাঁরা অবশেষে উত্তর ও পূর্বমুখে অগ্রসর হওয়ার এক পর্যায়ে বহু শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে পড়েন এবং এখানে-সেখানে পরিভ্রমণ করতে করতে বিভিন্ন স্থানে স্থায়ীভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করে নেন। তাঁদের এ দেশান্তর এবং বসতি স্থাপন সংক্রান্ত বিবরণ নিম্নরূপ :
ইমরান বিন ‘আমর : তিনি উমানে গমন করেন এবং তার গোত্র সেখানেই বসবাস করেন। এঁরা হলেন আযদে উমান।
নাসর বিন আযদ : বনু নাসর বিন আযদ তুহামায় বসতি স্থাপন করেন। এঁরা হলেন আযদে শানুয়াহ।
সা‘লাবাহ বিন ‘‘আমর : তিনি প্রথমত হিজায অভিমুখে অগ্রসর হয়ে সা‘লাবিয়া ও যূ ক্বার নামক স্থানের মধ্যস্থানে বাসস্থান নির্মাণ করে বসবাস করতে থাকেন। যখন তাঁর সন্তান সন্ততি বয়োঃপ্রাপ্ত হন এবং বংশধরগণ শক্তিশালী হয়ে উঠেন তখন মদীনা অভিমুখে অগ্রসর হয়ে মদীনাকেই বসবাসের জন্য উপযুক্ত স্থান মনে করে সেখানে বসতি স্থাপন করেন। ঐ সা‘লাবাহর বংশধারা থেকেই উদ্ভব হয়েছিল আউস এবং খাযরাজ গোত্রের তথা মদীনার আনসারদের।
হারিসাহ বিন ‘‘আমর : অর্থাৎ খুযা’আহ এবং তাঁর সন্তানাদি। এঁরা হিজায ভূমিতে চক্রাকারে ইতস্তত পরিভ্রমণ করতে করতে মার্রুয যাহরান নামক স্থানে শিবির স্থাপন করে বসবাস করতে থাকেন। তারপর হারাম শরীফের উপর প্রবল আক্রমণ পরিচালনা করে বানু জুরহুমকে সেখান থেকে বহিস্কার করেন এবং নিজেরা মক্কাধামে স্থায়ী বসতি স্থাপন করে বসবাস করতে থাকেন।
‘ইমরান বিন ‘‘আমর : তিনি এবং তাঁর সন্তানাদি ‘আম্মানে’ বসতি স্থাপন করেছিলেন। তাই তাঁদেরকে ‘আযাদে আম্মান’ বলা হতো।
নাসর বিন ‘আমর : এঁর সঙ্গে সম্পর্কিত গোত্রগুলো তুহামায় বসতি স্থাপন করেছিলেন। এঁদেরকে ‘আযাদে শানুআহ’ বলা হতো।
জাফনা বিন ‘‘আমর : তিনি শাম রাজ্যে গমন করে সেখানে বসতি স্থাপন করেন এবং সন্তানাদিসহ বসবাস করতে থাকেন। তিনি হচ্ছেন গাসসানী শাসকগণের প্রখ্যাত পূর্ব পুরুষ। শাম রাজ্যে গমনের পূর্বে হিজাযে গাসসান নামক ঝর্ণার ধারে তাঁরা কিছুদিন বসবাস করেছিলেন, তাই তাঁদের বংশধারাকে গাসসানী বংশ বলা হতো। কিছু ছোট ছোট গোত্র হিজাজ ও শামে হিজরত করে ঐ সকল গোত্রের সাথে মিলিত হয়। যেমন কা‘ব বিন ‘আমর, হারিস বিন ‘আমর ও আউফ বিন ‘আমর।
২। লাখম ও জুযাম গোত্র : তারা পূর্ব ও উত্তর দিকে গমন করে। এ লাখমীদের মধ্যে নাসর বিন রাবী’আহ নামক এক ব্যক্তি ছিলেন যিনি হীরাহর মুনাযিরাহ বংশের শাসকগণের অত্যন্ত প্রভাবশালী পূর্বপুরুষ ছিলেন।
৩। বানু ত্বাই গোত্র : এ গোত্র বানু আযদ গোত্রের দেশ ত্যাগের পর উত্তর অভিমুখে অগ্রসর হয়ে আযা’ এবং সালামাহ দু’পাহাড়ের পাদদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। এ গোত্রের নামানুসারে পাহাড় দুটি ‘বানু ত্বাই’ গোত্রের নামে পরিচিতি লাভ করে।
৪। কিন্দাহ গোত্র : এ গোত্র সর্বপ্রথম বাহরাইনে বর্তমান আল আহসায় শিবির স্থাপন করেন। কিন্তু সেখানে আশানুরূপ পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে ‘হাযরামাওত’ অভিমুখে যাত্রা করেন। কিন্তু সেখানেও তেমন কোন সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করতে না পারায় অবশেষে নাযদ অঞ্চলে গিয়ে বসতি গড়ে তোলেন। সেখানে তাঁরা একটি অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ বিশাল রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন। কিন্তু সে রাষ্ট্র বেশী দিন স্থায়ী হয় নি, অল্প কালের মধ্যেই তার অস্তিত্ব চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
কাহলান ব্যতিত হিময়ারেরও অনুরূপ একটি কুযা’আহ গোত্র রয়েছে। অবশ্য যাঁরা ইয়ামান হতে বাস্তুভিটা ত্যাগ করে ইরাক সীমান্তে বসতি স্থাপন করেন তাঁদের হিময়ারী হওয়ার ব্যাপারেও কিছুটা মতভেদ রয়েছে। এদের কিছু গোত্র সিরিয়ার উচ্চভূমি ও উত্তর হিজাজে বসতি স্থাপন করল।[2]
আরবে মুস্তা’রিবা : এঁদের প্রধান পূর্বপুরুষ ইবরাহীম (আঃ) মূলত ইরাকের উর শহরের বাসিন্দা ছিলেন। এ শহরটি ফোরাত বা ইউফ্রেটিস নদীর তীরে কুফার সন্নিকটে অবস্থিত। প্রত্নতাত্ত্বিকগণ কর্তৃক ঐ শহরটির ভূগর্ভ খননের সময় যে সকল শিলালিপি পুঁথি-পুস্তক ও দলিলাদী উদ্ধার করা হয়েছে তার মাধ্যমে এ শহর সম্পর্কে নানা মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি প্রকাশিত হয়েছে। অধিকন্তু, এ সবের মাধ্যমে ইবরাহীম (আঃ), তাঁর উর্ধ্বতন বংশধরগণ এবং তথাকার বাসিন্দাগণের ধর্মীয়, সামাজিক আচার অনুষ্ঠান এবং অবস্থা সম্পর্কে বহু নতুন নতুন তথ্য উদঘাটিত এবং নব দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আমরা আরও বিলক্ষণ অবগত রয়েছি যে, ইবরাহীম (আঃ) এ স্থান থেকে হিজরত করে হার্রান শহরে আগমন করেছিলেন তারপর সেখানে থেকে তিনি আবার ফিলিস্ত্বীনে গিয়ে উপনীত হন এবং সে দেশকেই তাঁর নবুওয়াতী বা আল্লাহর আহবানজনিত কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেন। আল্লাহ সুবহানাহূ তা‘আলা তাঁকে পরম সম্মানিত ‘খলিলুল্লাহ’ উপাধিতে ভূষিত করে তাঁর উপর রিসালাতের যে সুমহান দায়িত্ব ও কর্তব্য অর্পণ করেছিলেন সেখান থেকেই দেশের অভ্যন্তরভাগে এবং বহির্বিশে ব্যাপক সম্প্রচার এবং প্রসারের জন্য তিনি সর্বতোভাবে আত্মনিয়োগ করেছিলেন।
ইবরাহীম (আঃ) একদা মিশর ভূমিতে গিয়ে উপনীত হন। তাঁর সাথে তাঁর স্ত্রী সারাহও ছিলেন। মিশরের তৎকালীন বাদশাহ ফেরাউন তাঁর মন্ত্রীর মুখে সারাহর অপরিসীম রূপগুণের কথা শুনে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হন এবং অসদুদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে স্বীয় যৌন লিপ্সা চরিতার্থ মানসে তাঁর দিকে অগ্রসর হন। এদিকে একরাশ ঘৃণার ক্ষোভানলে বিদগ্ধপ্রাণা সারাহ আবেগকুলচিত্তে আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা জানালে তৎক্ষণাৎ তিনি তা কবূল করেন এবং এর অবশ্যম্ভাবী ফলশ্রুতি হিসেবে ফেরাউন বিকারগ্রস্ত হয়ে হাত-পা ছোড়াছুঁড়ি করতে থাকেন। অদৃশ্য শক্তিতে শেষ পর্যন্ত তিনি একদম নাজেহাল এবং জর্জরিত হতে থাকেন।
তাঁর এ ঘৃণ্য ও জঘণ্য অসদুদ্দেশ্যের ভয়াবহ পরিণতিতে তিনি একেবারে হতচকিত এবং বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়েন। এভাবে অত্যন্ত মর্মান্তিক অবস্থার মধ্য দিয়ে তিনি অনুধাবন করেন যে ‘সারাহ’ কোন সাধারণ নারী নন, বরং তিনি হচ্ছেন আল্লাহ তা‘আলার উত্তম শ্রেণীভুক্ত এক মহিয়সী মহিলা।
‘সারাহর’ এ ব্যক্তি-বিশিষ্টতায় তিনি এতই মুগ্ধ এবং অভিভূত হয়ে পড়েন যে তাঁর কন্যা হাজেরাকে[3] সারার খেদমতে সর্বতোভাবে নিয়োজিত করে দেন। হাজেরার সেবা যত্ন ও গুণ-গরিমায় মুগ্ধ হয়ে তারপর তিনি তাঁর স্বামী ইবরাহীম খলিলুল্লাহ (আঃ)-এর সঙ্গে হাজেরার বিবাহ দেন।[4]
ইবরাহীম (আঃ) ‘সারাহ’ এবং হাজেরাকে সঙ্গে নিয়ে নিজ বাসস্থান ফিলিস্ত্বীন ভূমে প্রত্যাবর্তন করেন। তারপর আল্লাহ তা‘আলা হাজেরার গর্ভে ইবরাহীম (আঃ)-কে পরম ভাগ্যমন্ত এক সন্তান দান করেন। হাজেরার গর্ভে ইবরাহীম (আঃ)-এর ঔরসজাত সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ায় তিনি কিছুটা লজ্জিত এবং বিব্রতবোধ করতে থাকলেন এবং নবজাতকসহ হাজেরাকে নির্বাসনে পাঠানোর জন্য উপর্যুপরি চাপ সৃষ্টি করে চললেন। ফলে তিনি হাজেরা ও নবজাত পুত্র ইসমাঈলকে সঙ্গে নিয়ে হিজায ভূমিতে এসে উপনীত হলেন। তারপর রায়তুল্লাহ শরীফের সন্নিকটে অনাবাদী ও শষ্যহীন উপত্যকায় পরিত্যক্ত অবস্থায় তাঁদের রেখে দিলেন। ঐ সময় বর্তমান আকারে বায়তুল্লাহ শরীফের কোন অস্তিত্বই ছিল না। বর্তমানে যে স্থানে বায়তুল্লাহ শরীফ অবস্থিত সেই সময় সে স্থানটির আকার ছিল ঠিক একটি উঁচু টিলার মতো। কোন সময় প্লাবনের সৃষ্টি হলে ডান কিংবা বাম দিক দিয়ে সেই প্লাবনের ধারা বয়ে চলে যেত। সেই সময় যমযম কূপের পাশে মসজিদুল হারামের উপরিভাগে বিরাট আকারের একটি বৃক্ষ ছিল। ইবরাহীম (আঃ) স্ত্রী হাজেরা এবং শিশু পুত্র ইসমাঈল (আঃ)-কে সেই বৃক্ষের নীচে রেখে গেলেন।
সেই সময় এ স্থানে না ছিল কোন জলাশয় বা পানির কোন উৎস, ছিল না কোন লোকালয় বা জনমানব বসতি। একটি পাত্রে কিছু খেজুর এবং একটি ছোট্ট মশকে কিছুটা পানি রেখে ইবরাহীম (আঃ) আবার পাড়ি জমালেন সেই ফিলিস্তিন ভূমে। কিন্তু দিন কয়েকের মধ্যেই ফুরিয়ে গেল খেজুর, ফুরিয়ে গেল পানিও। কঠিন সংকটে নিপতিত হলেন হাজেরা এবং শিশু পুত্র ইসমাঈল। কিন্তু এ ভয়াবহ সংকটেরও সমাধান হয়ে গেল আল্লাহ তা‘আলার অসীম মেহেরবানীতে অলৌকিক পন্থায়। সৃষ্টি হল আবে হায়াত যমযম ধারা। ঐ একই ধারায় সংগৃহীত হল দীর্ঘ সময়ের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পণ্য সামগ্রী।[5]
কিছুকাল পর ইয়ামান থেকে এক গোত্রের লোকজনেরা সেখানে আগমন করেন। ইসলামের ইতিহাসে এ গোত্রকে ‘জুরহুম সানী’’ বা ‘দ্বিতীয় জুরহুম বলা হয়ে থাকে। এ গোত্র ইসামাঈল (আঃ)-এর মাতার নিকট অনুমতি নিয়ে মক্কাভূমিতে অবস্থান করতে থাকেন। এ কথাও বলা হয়ে থাকে যে প্রথমাবস্থায় এ গোত্র মক্কার আশপাশের পর্বতময় উন্মুক্ত প্রান্তরে বসতি স্থাপন করেছিলেন। সহীহুল বুখারী শরীফে সুস্পষ্টভাবে এতটুকু উল্লেখ আছে যে, মক্কা শরীফে বসবাসের উদ্দেশ্যে তাঁরা আগমন করেছিলেন ইসমাঈল (আঃ)-এর আগমনের পর কিন্তু তাঁর যৌবনে পদার্পণের পূর্বে। অবশ্য তার বহু পূর্ব থেকেই তাঁরা সেই পর্বত পরিবেষ্টিত প্রান্তর দিয়ে যাতায়াত করতেন।[6]
পরিত্যক্ত স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে ইবরাহীম (আঃ) সময় সময় মক্কাভূমিতে আগমন করতেন। কিন্তু তিনি কতবার মক্কার পুণ্য ভূমিতে আগমন করেছিলেন তার সঠিক কোন বিবরণ বা হদিস খুঁজে পাওয়া যায় নি। তবে ইতিহাসবিদগণের অভিমত হচ্ছে যে, তিনি চার বার মক্কায় আগমন করেছিলেন, তাঁর এ চার দফা আগমনের বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত হল:
১. কুরআনুল মাজীদে বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা স্বপ্নযোগে ইবরাহীম খলিলুল্লাহ (আঃ)-কে দেখালেন যে তিনি আপন পুত্র ইসমাঈল (আঃ) কে কুরবাণী করেছেন। প্রকারান্তরে এ স্বপ্ন ছিল আল্লাহ তা‘আলার একটি নির্দেশ এবং পিতাপুত্র উভয়েই একাগ্রচিত্তে সেই নির্দেশ পালনের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন মনে প্রাণে।
{فَلَمَّا أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِيْنِ وَنَادَيْنَاهُ أَنْ يَا إِبْرَاهِيْمُ قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا إِنَّا كَذٰلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِيْنَ إِنَّ هٰذَا لَهُوَ الْبَلَاء الْمُبِيْنُ وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيْمٍ} (سورة صافات ٣٧ : ١٠٣-١٠٧)
‘পিতা যখন পুত্রকে কুরবাণী করার উদ্দেশ্যে কপাল-দেশ মাটিতে মিশিয়ে উপুড় করে শুইয়ে দিলেন তখন আল্লাহ তা‘আলার বাণী ঘোষিত হল, ‘হে ইবরাহীম! তোমার স্বপ্নকে তুমি সর্বতোভাবে সত্যে পরিণত করেছ। অবশ্যই আমি সৎকর্মশীলগণকে এভাবেই পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চিতরূপে এ ঘটনা ছিল আল্লাহর তরফ থেকে এক মহা অগ্নি পরীক্ষা এবং আল্লাহ তা‘আলা বিনিময়ে তাঁদেরকে স্বীয় মনোনীত একটি বড় রকমের প্রাণী দান করেছিলেন।’’[7]
‘মাজমুআহ’ বাইবেলের জন্ম পর্বে উল্লেখ আছে যে, ইসমাঈল (আঃ) ইসহাক্ব (আঃ)-এর চাইতে ১৩ বছরের বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন এবং কুরআন শরীফের হিসাব অনুযায়ী ঐ ঘটনা ইসহাক্ব (আঃ)-এর পূর্বে সংঘটিত হয়েছিল। কারণ, ইসমাঈল (আঃ)-এর বিস্তারিত বর্ণনার পর ইসহাক্ব (আঃ)-এর জন্ম প্রসঙ্গে সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। এ ঘটনা থেকেই একথা প্রতিপন্ন এবং সাব্যস্ত হয় যে ইসমাঈল (আঃ)-এর যৌবনে উপনীত হওয়ার আগে কমপক্ষে একবার ইবরাহীম (আঃ) মক্কা আগমন করেছিলেন। অবশিষ্ট তিন সফরের বিবরণ সহীহুল বুখারী শরীফের এক দীর্ঘ বর্ণনার মধ্যে পাওয়া যায় যা ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে সরাসরি বর্ণিত হয়েছে।[8] তার সংক্ষিপ্তসার হচ্ছে নিম্নরূপ :
২. ইসমাঈল (আঃ) যখন যৌবনে পদার্পণ করলেন তখন জুরহুম গোত্রের লোকজনদের নিকট থেকে আরবী ভাষা উত্তমরূপে আয়ত্ত করেন এবং সবদিক দিয়েই সংশ্লিষ্ট সকলের শুভ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। এরপর কিছু সময়ের মধ্যেই এ গোত্রের এক মহিলার সঙ্গে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যান। এমন এক অবস্থার মধ্য দিয়ে যখন সময় অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছিল তখন তাঁর নয়নমনি ইসমাঈল (আঃ) কে শোক সাগরে ভাসিয়ে হাজেরা জান্নাতবাসিনী হয়ে যান। (ইন্না লিল্লাহ…..রাজিউন)
এ দিকে পরিত্যক্ত পরিবারের কথা স্মৃতিপটে উদিত হলে ইবরাহীম (আঃ) পুনরায় মক্কা অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। সহধর্মিণী হাজেরা তখন জান্নাতবাসিনী। তিনি প্রথমে গিয়ে উপস্থিত হলেন ইসমাঈল (আঃ)-এর গৃহে। কিন্তু তাঁর অনুপস্থিতির কারণে পিতা-পুত্রের মধ্যে সাক্ষাৎকার আর সম্ভব হল না। দেখা-সাক্ষাৎ এবং কথাবার্তা হল পুত্র বধূর সঙ্গে। আলাপ আলোচনার এক পর্যায়ে পুত্রবধূ সাংসারিক অসচ্ছলতার অভিযোগ অনুযোগ পেশ করলে তিনি এ কথা বলে উপদেশ প্রদান করেন যে, ‘ইসমাঈল (আঃ)-এর আগমনের পর পরই যেন এ দরজার চৌকাঠ পরিবর্তন করে নেয়া হয়’। পিতার উপদেশের তাৎপর্য উপলব্ধি করে ইসমাঈল (আঃ) তাঁর স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দ্বিতীয় এক মহিলার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এ মহিলা ছিলেন জুরহুম গোত্রের মুযায বিন ‘আমর এর কন্যা।[9]
৩. ইসমাঈল (আঃ)-এর দ্বিতীয় বিয়ের পর ইবরাহীম (আঃ) পুনরায় মক্কা গমন করেন, কিন্তু এবারও পুত্রের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ সম্ভব হয়নি। পুত্রবধূর নিকট কুশলাদি অবগত হতে চাইলে তিনি আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করেন। এতে সন্তুষ্ট হয়ে ইবরাহীম (আঃ) দরজার চৌকাঠ স্থায়ী রাখার পরামর্শ দেন এবং পুনর্বার ফিলিস্ত্বীন অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন।
৪. এরপর ইবরাহীম (আঃ) আবার মক্কা আগমন করেন তখন ইসমাঈল (আঃ) যমযম কূপের নিকট বৃক্ষের নীচে তীর তৈরি করছিলেন। এমতাবস্থায় হঠাৎ পিতাকে দেখতে পেয়ে তিনি যুগপৎ আবেগ ও আনন্দের আতিশয্যে একেবারে লাফ দিয়ে উঠলেন এবং পিতা ও পুত্র উভয়ে উভয়কে কোলাকুলি ও আলিঙ্গনাবস্থায় বেশ কিছু সময় অতিবাহিত করলেন। এ সাক্ষাৎকার এত দীর্ঘসময় পর সংঘটিত হয়েছিল যে সন্তান-বৎসল, কোমল হৃদয় ও কল্যাণময়ী পিতা এবং পিতৃবৎসল ও অনুগত পুত্রের নিকট তা ছিল অত্যন্ত আবেগময় ও মর্মস্পর্শী। ঐ সময় পিতা পুত্র উভয়ে মিলিতভাবে ক্বাবা’হ গৃহ নির্মাণ করেছিলেন। এ ক্বাবা’হ গৃহের নির্মাণ কাজ পরিসমাপ্তির পর সেখানে পবিত্র হজ্জ্বব্রত পালনের জন্য ইবরাহীম (আঃ) বিশ্ব-মুসলিম গোষ্ঠিকে উদাত্ত আহবান জানালেন।
আল্লাহ তা‘আলা মুযায-এর কন্যার গর্ভে ইসমাঈল (আঃ)-এর ১২টি অথবা ৯টি সুসন্তান দান করেন। তাঁদের নাম হচ্ছে যথাক্রমে- নাবিত্ব বা নাবায়ূত, ক্বায়দার, আদবাঈল, মিবশাম, মিশমা‘, দুমা, মীশা, হাদদ, তাইমা ইয়াতুর, নাফিস, ক্বাইদুমান।
ইসমাঈল (আঃ)-এর ১২টি সন্তান থেকে ১২টি গোত্রের সূত্রপাত হয় এবং সকলেই মক্কা নগরীতে বসতি স্থাপন করেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁদের জীবনযাত্রা ছিল ইয়ামান, মিশর, সিরিয়া প্রভৃতি দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর নির্ভরশীল। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে এ গোত্রগুলো ক্রমান্বয়ে আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং এমন কি আরবের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। আল্লাহ তা‘আলার অত্যন্ত প্রিয় এবং মনোনীত এক মহাপুরুষের রক্তধারা থেকে এ সকল গোত্রের সৃষ্টি হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁরা কিন্তু কালচক্রের আবর্তনে সৃষ্ট যবনিকার অন্তরালেই অজ্ঞাত অখ্যাত অবস্থায় থেকে যান। শুধুমাত্র নাবিত্ব এবং ক্বায়দারের বংশধরগণই কালচক্রের আবর্তনে সৃষ্ট গাঢ় তিমির জাল থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে সক্ষম হন। কালক্রমে উত্তর হিজাযে নাবিত্বীদের সাহিত্য ও শিল্প সংস্কৃতির যথেষ্ট উৎকর্ষ সাধিত হয়। শুধু তাই নয়, তাঁরা একক শক্তিশালী জাতি এবং বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন, এবং আশপাশের জনগোষ্ঠীগুলোকে তাঁদের অধিনস্থ করে নিয়ে তাঁদের কাছ থেকে নিয়মিত ট্যাক্স বা করও আদায় করতে থাকেন। এঁদের রাজধানী ছিল বাতরা। এঁদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো সৎ সাহস কিংবা শক্তি আশপাশের কারো ছিল না।
তারপর কালচক্রের আবর্তনে রুমীদের অভ্যূদয় ঘটে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁরা এতই উন্নতি সাধন এবং এত বেশী শক্তি সঞ্চয় করে যে তখন নাবিত্বীদের শক্তি-সামর্থ্য এবং শৌর্যবীর্য্যের কথা রূপকথার মতো কল্প কাহিনীতে পর্যবসিত হয়ে যায়। মাওলানা সৈয়দ সুলাইমান নদভী স্বীয় গবেষণা, আলোচনা ও গভীর অনুসন্ধানের পর একথা প্রমাণ করেছেন যে গাসসান বংশধর এবং মদীনার আনসার তথা আওস ও খাজরায গোত্রের কেউই ক্বাহত্বানী আরবের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না, বরং ঐ অঞ্চলের মধ্যে নাবিত্ব বিন ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশধরগণের যাঁরা অবশিষ্ট ছিলেন কেবল তাঁদেরই অবস্থান আরব ভূমিতে ছিল।[10]
ইমাম বুখারী এ মতরে দিকেই আকৃষ্ট হয়ে তার সহীহুল বুখারীতে নিম্নোক্তভাবে অধ্যায় রচনা করেছেন,
نسبه اليمن إلي اسماعيل عليه السلام
‘ইয়ামানীদের সাথে ইসমাঈল (আঃ)-এর সম্পর্ক’। এর সম্পর্কে ইমাম বেশ কিছু হাদীস দ্বারা প্রমাণ দিয়েছেন। হাফেয ইবনু হাজার আসকালানী ক্বাহত্বানীদেরকে নাবিত্ব বিন ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশধর হওয়ার মতটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
মক্কা নগরীর পুণ্য ভূমিতেই ক্বায়দার বিন ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশবৃদ্ধি হয় এবং কালক্রমে তাঁরা সেখানে প্রগতির স্বর্ণ-শিখরে আরোহণ করেন। তারপর কালচক্রের আবর্তনে এক সময় তাঁরা অজ্ঞাত অখ্যাত হয়ে পড়েন। তারপর সে স্থানে আদনান এবং তাঁর সন্তানাদির অভ্যূদয় ঘটে। আরবের আদনানীগণের বংশ পরম্পরা সূত্র বিশুদ্ধভাবে এ পর্যন্তই সংরক্ষিত রয়েছে।
আদনান হচ্ছে নাবী কারীম (সাঃ)-এর বংশ তালিকায় ২১ তম উর্ধ্বতন পুরুষ। কোন কোন বর্ণনায় বিবৃত হয়েছে যে নাবী কারীম (সাঃ) যখন নিজ বংশ তালিকা বর্ণনা করতেন তখন আদনান পর্যন্ত গিয়ে হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যেতেন, আর একটুও অগ্রসর হতেন না। তিনি বলতেন যে, ‘বংশাবলী সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা ভুল বলেছেন।[11] কিন্তু আলেমগণের মধ্যে এক দলের অভিমত হচ্ছে, আদনান হতে আরও উপরে বংশপরম্পরা সূত্র বর্ণনা করা যেতে পারে। নাবী কারীম (সাঃ) এ বর্ণনাকে ‘দুর্বল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর অনুসন্ধান অনুযায়ী আদনান এবং ইবরাহীম (আঃ)-এর মধ্যবর্তী স্থানে দীর্ঘ ৪০টি পিঁড়ির ব্যবধান বিদ্যমান রয়েছে।
যাহোক, মা’আদ্দ এর সন্তান নাযার সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তিনি ছাড়া মা’আদ্দের অন্য কোন সন্তান ছিল না। কিন্তু এ নাযার থেকেই আবার কয়েকটি পরিবার অস্তিত্ব লাভ করেছে। প্রকৃতপক্ষে নাযারের ছিল চারটি সন্তান এবং প্রত্যেক সন্তান থেকেই এক একটি গোত্রের গোড়াপত্তন হয়েছিল। নাযারের এ চার সন্তানের নাম ছিল যথাক্রমে ইয়াদ, আনমার, রাবী’আহ এবং মুযার। এদের মধ্যে রাবী’আহ এবং মুযার গোত্রের শাখা-প্রশাখা ব্যাপকভাবে বিস্তৃত লাভ করে। অতএব, রাবী’আহ হতে আসাদ ও যুবাই’আহ; আসাদ হতে ‘আনযাহ ও জালীদাহ; জালীদাহ হতে অনেক প্রসিদ্ধ গোত্র যেমন- আব্দুল ক্বায়স, নামির, বনু ওয়ায়িল গোত্রের উৎপত্তি; বাকর, তাগলিব বনু ওয়ায়িলের অন্তর্ভুক্ত; বনু বাকর হতে বনু ক্বায়সম বনু শায়বাহন, বুন হানীফাহসহ অন্যান্য গোত্র অস্তিত্ব লাভ করে। আর বনু’ আনযাহ হতে বর্তমান সৌদি আরবের বাদশাহী পরিবার আলে সউদ-এর উদ্ভব।
মুযারের সন্তানগণ দুইটি বড় বড় গোত্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সে গোত্র দু’টো হচ্ছে:
(১) ক্বায়স আ‘ইলান বিন মুযার, (২) ইলিয়াস বিন মুযার।
ক্বায়স আ‘ইলান হতে বনু সুলাইম, বনু হাওয়াযিন, বনু সাক্বীফ, বনু সা’সা’আহ ও বুন গাত্বাফান। গাত্বাফান হতে আ‘বস, যুবইয়ান, আশজা‘ এবং গানি বিন আ‘সার গোত্র সমূহের সুত্রপাত হয়।
ইলিয়াস বিন মুযার হতে তামীম বিন মুররাহ, হুযাইল বিন মুদরিকাহ, বনু আসাদ বিন খুযাইমাহ এবং কিনানাহ বিন খুযাইমাহ গোত্রসমূহের উদ্ভব হয়। তারপর কিনানাহ হতে কুরাইশ গোত্রের উদ্ভব হয়। এ গোত্রটি ফেহর বিন মালিক বিন নাযার বিন কিনানাহ এর সন্তানাদি।
তারপর কুরাইশ গোত্র বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হয়েছে। এর মধ্যে মশহুর শাখাগুলোর নাম হচ্ছে- জুমাহ, সাহম ‘আদী, মাখযুম, তাইম, যুহরাহ এবং কুসাই বিন কিলাব এর বংশধরগণ। অর্থাৎ আব্দুদ্দার বিন কুসাই, আসাদ বিন আব্দুল ওযযা এবং আবদে মানাফ এ তিন গোত্রই ছিল কুসাইয়ের সন্তান।
এঁদের মধ্যে আব্দে মানাফের ছিল চার পুত্র এবং চার পুত্র থেকে সৃষ্টি হয় চারটি গোত্রের, অর্থাৎ আব্দে শামস, নওফাল, মোত্তালেব এবং হাশিম। এ হাশিম গোত্র থেকেই আল্লাহ তা‘আলা আমাদের প্রিয় নাবী মুহাম্মাদ (সাঃ) কে নাবী ও রাসূলরূপে মনোনীত করেন।[12]
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন যে, আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম (আঃ)’র সন্তানাদির মধ্য থেকে ইসমাঈল (আঃ) কে, ইসমাঈল (আঃ)-এর সন্তানাদির মধ্যে থেকে কিনানাহকে মনোনীত করেন। কিনানাহর বংশধারার মধ্য থেকে কুরাইশকে, কুরাইশ থেকে বনু হাশিমকে এবং বনু হাশিম থেকে আমাকে মনোনীত করেন।[13]
ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সৃষ্টি করেন এবং আমাকে সর্বোত্তম দলভুক্ত করেন। তারপর গোত্রসমূহ নির্বাচন করা হয় এবং এক্ষেত্রেও আমাকে সর্বোত্তম গোত্রের মধ্যে শামিল করা হয়। তারপর পারিবারিক মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য করা হয় এবং এক্ষেত্রেও আমাকে অত্যন্ত মর্যাদাশীল পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অতএব, আমি আমার ব্যক্তিসত্তায় যেমন উত্তম, বংশ মর্যাদার ব্যাপারেও তেমনি সব চাইতে উত্তম।[14]
যাহোক, আদনানের বংশধরগণ যখন অধিক সংখ্যায় বৃদ্ধি পেতে লাগলেন তখন জীবিকার অন্বেষণে আরব ভূখন্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েন। এ প্রেক্ষিতে আব্দুল ক্বায়স গোত্র, বাকর বিন ওয়ায়েলের কয়েকটি শাখা এবং বনু তামীমের বংশধরগণ বাহরায়েন অভিমুখে যাত্রা করেন এবং সেখানে বসতি স্থাপন করে বসবাস করতে থাকেন।
বনু হানীফা বিন সা‘ব বিন আলী বিন বাকর গোত্র ইয়ামামা অভিমুখে গমন করেন এবং তার কেন্দ্রস্থল হুজর নামক স্থানে বসতি স্থাপন করেন। বাকর বিন ওয়ায়েল গোত্রের অবশিষ্ট শাখাসমূহ ইয়ামামা থেকে বাহরায়েন, সাইফে কাযেমা, বাহর, সওয়াদে ইরাক, উবুল্লাহ এবং হিত প্রভৃতি অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন।
বনু তাগলব গোত্র ফোরাত উপদ্বীপ অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে বসবাস করতে থাকেন। অবশ্য তাঁদের কোন শাখা বনু বকরের সঙ্গেও বসবাস করতে থাকেন। এ দিকে বনু তামীম গোত্র বসরার প্রত্যন্ত অঞ্চলকে বসবাসের জন্য উপযুক্ত ভূমি হিসেবে মনোনীত করেন।
বনু সুলাইম গোত্র মদীনার নিকটবর্তী স্থানে বসতি স্থাপন করেন। তাঁদের আবাসস্থল ছিল ওয়াদিউল কুরা হতে আরম্ভ করে খায়বার এবং মদীনার পূর্বদিক দিয়ে অগ্রসর হয়ে হাররায়ে বনু সুলাইমের সাথে মিলিত দু্ই পাহাড় পর্যন্ত বিস্তৃত।
বনু আসাদ তাঁর বসতি স্থাপন করেন তাইমার পূর্বে ও কুফার পশ্চিমে। ওঁদের ও তাইমার মধ্যভাগে বনু ত্বাই গোত্রের এক বোহতার পরিবারের আবাদ ছিল। বনু আসাদের কর্ষিত ভূমি এবং কুফার মধ্যকার পথের দূরত্ব ছিল পাঁচদিনের ব্যবধান।
বনু যুবইয়ার গোত্র বসতি স্থাপন ও আবাদ করতেন তাইমার নিকটে হাওয়ানের আশপাশে।
বনু কিনানাহ গোত্রের লোকজন থেকে যান তেহামায়। এদের মধ্য থেকে কুরাইশগণ বসতি স্থাপন করেন মক্কা এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল সমূহে। এ সব লোক ছিলেন বিচ্ছিন্ন ধ্যান-ধারণার অধিকারী। তাঁদের মধ্যে কোন নিয়ম শৃঙ্খলা ছিল না। এভাবেই তাদের জীবনধারা চলে আসছিল। তারপর কুসাই বিন কিলাব নামক এক ব্যক্তি তাঁদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং সঠিক পরিচালনাদানের মাধ্যমে তাঁদেরকে প্রচলিত অর্থে মর্যাদা ও সম্মানের আসনে উন্নীত করেন এবং ঐশ্বর্যশালী ও বিজয়ী করেন।[15]
ফুটনোটঃ[1] ১৯৯৪ সালে লেখক কর্তৃক সম্পাদিত কপিতে জুরহুম, হাযূর, ওয়াবার, ‘আবীল, জাসিম, হাযারামাওত নামগুলো বৃদ্ধি করেছেন। যা পুরাতন কপিতে নেই।
[2] গোত্র সমূহের বিস্তারিত বিবরণাদির জন্য দ্রষ্টব্য আল্লামা খুযরীরঃ ‘মোহাযারাতে তাবীখিল উমামিল ইসলামিয়াহ’ ১ম খন্ড ১১-১৩ পৃঃ এবং ‘কালার জাযীরাতুল আরব’ ২৩১-২৩৫ পৃঃ। দেশত্যাগের ঘটনাবলীর সময় এবং কারণ বির্ধারণের ব্যাপারে ঐতিহাসিক উৎসবের মধ্যে যথেষ্ট মত পার্থক্য রয়েছে। বিভিন্ন দিক আলোচনা পর্যালোচনা করে যা সঠিক বিবেচনা করা হয়েছে তাই এখানে লিপিবদ্ধ হলো।
[3] কথিত আছে যে হাজেরা দাসী ছিলেন কিন্তু আল্লামা সুলাইমান মানসুরপুরী ব্যাপক গবেষণা ও অনুসন্ধান কাজ চালিয়ে সাব্যস্ত করেছেন যে তিনি দাসী ছিলেন না। তিনি ছিলেন ফেরাউনের মেয়ে মুক্ত এবং স্বাধীন। দ্রষ্টব্য রহামাতুল্লিল আলামীন, ২য় খন্ড ৩৬-৩৭ পৃঃ
[4] উলেখিত গ্রন্থের ৩৪ পৃষ্ঠার বিস্তারিত ঘটনা দ্রষ্টব্য সহীহা বুখারী ১ম খন্ড ৪৮৪ পৃ দ্রঃ।
[5] ‘সহীহুল বুখারী শরীফ ১ম খন্ড আম্বিয়া পর্ব, পৃঃ ৪৭৪-৪৭৫।
[6] ‘সহীহুল বুখারী শরীফ ১ম খন্ড আম্বিয়া পর্ব, পৃঃ ৪৭৫।
[7] সূরাহ সাফফাতঃ [(২৩) ১০৩-১০৭]
[8] সহীহুল বূখারী শরীফঃ ১ম খন্ড ৪৭৫-৪৭৬ পৃঃ।
[9] ‘‘কালব জাযীরাতুল আরব’’ ২৩০ পৃঃ।
[10] সৈয়দ সোলাইমান নদভীঃ তারিখে আরযুল কুরআন ২য় খন্ড ৭৮-৮৬ পৃঃ এবং ডঃ এম মজীবুর রহমানঃ মদীনার আনসারঃ পৃঃ ১৩-২৩।
[11] ইবন্ জাবীর তারাবীঃ তারীখূল উমাম ওয়ালি মূলক ১ম খন্ড ১৯১-১৯৪ পৃঃ। ‘আল ই’লাম’’ ৫ম খন্ড ৬ পৃঃ।
[12] আল্লামা খুযরীঃ মুহাযারাত ১ম খন্ডঃ ১৪-১৫পৃঃ।
[13] সহীহুল মুসলিম শরীফঃ ২য় খন্ডঃ ২৪৫ পৃঃ জামে তিরমিযী ২য় খন্ডঃ ২০১ পৃঃ।
[14] তিরমিযী শরীফ ২য় খন্ডঃ ২০১ পৃঃ।
[15] আল্লামা খুযরী মুহাযারাত ১ম খন্ড ১৫-১৬ পৃঃ।
সমসাময়িক আরবের বিভিন্ন রাজ্য ও নেতৃত্ব প্রসঙ্গ (الحُكْـمُ وَالْإِمَـارَةُ فِي الْعَـرَبِ )
আরব উপদ্বীপে নাবী সাঃ-এর দাওয়াত প্রকাশের প্রাক্কালে দু’প্রকারের রাজ্য শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল।
১. মুকুট পরিহিত সম্রাট। তবে তারা প্রকৃত পক্ষে সম্পূর্ণ স্বাধীন বা মুক্ত ছিলেন না।
২. গোত্রীয় দলনেতাগণ। মুকুট পরিহিত সম্রাটগণের যে মর্যাদা ছিল অন্যান্য খ্যাতিসম্পন্ন গোত্রীয় দলনেতাগণেরও সেই মর্যাদা ছিল। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁদের যে বিশেষ বৈশিষ্ট্যটি ছিল তা হচ্ছে, তাঁরা ছিলেন সম্পূর্ণ স্বাধীন। যে সকল সাম্রাজ্যে মুকুটধারী সম্রাটগণের প্রশাসন কায়েম ছিল সেগুলো হচ্ছে শাহানে ইয়ামান, শাহানে আলে গাসসান (শামরাজ্য) এবং শাহানে হীরাহ (ইরাক)। অবশিষ্ট অন্যান্য সকল ক্ষেত্রেই ছিল গোত্রীয় দলনেতার প্রশাসন।
ইয়ামান সাম্রাজ্য (المُلْكُ بِالْيَمَنِ) :
আরবে ‘আরিবার অন্তর্ভুক্ত যে সকল সম্প্রদায় প্রাচীনতম ইয়ামান সম্প্রদায় হিসেবে চিহ্নিত ছিল তারাই ছিল সাবা সম্প্রদায় ভুক্ত। প্রাচীন ‘উর’ (ইরাক) ভূখন্ডের বহু পুরাতন ধ্বংসপ্রাপ্ত শহরের ধ্বংসস্তুপ থেকে যে সকল তথ্য প্রমাণাদি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে তাতে খ্রীষ্টপূর্ব আড়াই হাজার বছর পূর্বের সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখিত হয়েছে। কিন্তু খ্রীষ্টপূর্ব একাদশ শতকে তাঁদের অভ্যূদয় সূচিত হয়েছিল বলে তথ্য প্রমাণাদিসূত্রে অনুমিত হয়েছে। গবেষণালব্ধ তথ্যাদির ভিত্তিতে তাঁদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে যে ধারণা করা হয়ে থাকে তা হচ্ছে নিম্নরূপ:
১. খ্রীষ্টপূর্ব ৬২০ হতে ১৩০০ অব্দ পর্যন্ত।
এসময়ে কিছু নির্দিষ্ট দেশসমূহে তাদের রাজত্ব ছিল বলে জানা যায়। যাওফ’এ অর্থাৎ নাযরান ও হাজরামাওত এর মধ্যবর্তী স্থানে তাদের আধিপত্য প্রকাশ পায়। অতঃপর তানমূ অধিকৃত হয় এবং পরবর্তীতে তাদের সাম্রাজ্য ব্যাপকভাবে প্রশস্ত হয় ও বিস্তার লাভ করে এমন কি তাদের রাজনৈতিক প্রভাব উত্তর হিযাজের ‘মা‘আন ও উ‘লা’ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
কথিত আছে যে, তাদের কলোনী বা উপনিবেশ আরববিশ্বের বাইরেও বিস্তার লাভ করে। ব্যবসায় ছিল তাদের প্রধান জীবিকা। অতঃপর মায়ারিবের সেই বিখ্যাত বাঁধ নির্মাণ করা হয় যা ইয়ামানের ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় ছিল। তাদেরকে পৃথিবীর প্রভূত কল্যাণ দেয়া হয়েছিল। কুরআনে এসেছে, {حَتّٰى نَسُوْا الذِّكْرَ وَكَانُوْا قَوْمًا بُوْرًا} ‘পরিণামে তারা ভুলে গিয়েছিল (তোমার প্রেরিত) বাণী, যার ফলে তারা পরিণত হল এক ধ্বংশপ্রাপ্ত জাতিতে।’
সেই সময়কালে শাহানে সাবার মর্যাদাসূচক উপাধি ছিল ‘মোকাররবে সাবা’। তাঁর রাজধানী ছিল সিরওয়াহ- যার ধ্বংসপ্রাপ্ত অট্টালিকা চিহ্ন আজও মায়ারেব শহর থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে ৫০ কিলোমিটার পথের দূরত্বে ও ‘সনয়া’ থেকে ১৪২ কিলোমিটার পূর্বে দেখতে পাওয়া যায় এবং তা খারিবা নামে প্রসিদ্ধ রয়েছে। এ রাজ্য বংশানুক্রমে ২২ থেকে ২৩ জন বাদশা দেশ শাসন করেন।
২. খ্রীষ্টপূর্ব ৬২০ অব্দ থেকে ১১৫ অব্দ পর্যন্ত।
এসময় কালে তাদের রাজত্বকে ‘সাবা সাম্রাজ্য’ বলা হতো। ‘সাবা’ সম্রাটগণ মোকাররব উপাধি পরিত্যাগ করে ‘রাজা’ (বাদশা) সম্মানসূচক উপাধি গ্রহণ করেন এবং ‘সারওয়াহ’ এর পরিবর্তে মায়ারেবকে সাম্রাজ্যের রাজধানী ঘোষণা দেন। সেই শহরের ধ্বংসস্তুপ আজও ‘সনয়া’ নামক স্থানের ১৯২ কিলোমিটার পূর্বে পরিদৃষ্ট হয়।
৩. খ্রীষ্টপূর্ব ৩০০ থেকে ১১৫ অব্দ পর্যন্ত।
এ সময়ে তাদের রাজত্বকে ‘প্রথম হিমইয়ারী’ বলা হয়। কেননা সাবা রাষ্ট্রের উপর ‘হিময়ার’ গোত্র প্রাধান্য লাভ করে ও সাবা রাজ্য সংকুচিত হয়ে পড়ে। তাদের রাজ্যকে ‘সাবা ও যূ রায়দান’ বলা হয়। আর তারা মায়ারেবের পরিবর্তে ‘রায়দানকে’ রাজধানী করেন। পরে রাজধানীর নাম ‘রায়দান’ পরিবর্তন করে ‘জিফার’ রাখা হয়। এ শহরের ধ্বংসাবশেষ আজও ‘ইয়ারিম’ শহরের নিকটে এক গোলাকার পর্বতে পরিদৃষ্ট হয়।
এ সময় থেকেই সাবা সম্প্রদায় এর পতন শুরু হয়ে যায়। নাবেতীয়গণ প্রথমে হিজাযের উত্তর প্রদেশে নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করে নিয়ে সাবা সম্প্রদায়ের বসতি স্থাপনকারীদের সেখান থেকে বহিস্কার করেন। অধিকন্তু রুমীগণ মিশর, শাম এবং হেজাজের উত্তরাঞ্চল দখল করে নেয়ার ফলে সমুদ্রপথে তাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এভাবে ক্রমান্বয়ে তাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্য সংকুচিত হতে হতে শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে ক্বাহত্বানী গোত্র সমূহও নিজেদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং কলহে লিপ্ত হয়ে পড়ার ফলে নিজ নিজ আবাস স্থল পরিত্যাগ করে তাঁরা নানা দিকে ছড়িয়ে পড়েন।
(৪) ৩০০ খ্রীষ্ট্রাব্দের পর থেকে ইসলামের আবির্ভাব পর্যন্ত।
এ সময়ে তাদের রাজত্বকে ‘দ্বিতীয় হিমইয়ারী’ বলা হয় এবং তাদের রাজ্য ‘সাবা, যূ রায়দান, হাজরামাওত ও ইয়ামনত’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ইয়ামানের মধ্যে অব্যাহতভাবে অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা ঘটতে থাকে। একের পর এক বহু বিপ্লব ও গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হতে থাকে এবং এর ফলে বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপের অবাঞ্ছিত সুযোগ সৃষ্টি হয়ে যায়। এমন কি এ পর্যায়ে এমন এক অবস্থার উদ্ভব হয় যার ফলশ্রুতিতে ইয়ামানের স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়ে যায়। পক্ষান্তরে সেই যুগের রুমীগণ এডেন দ্বীপে সৈন্য সমাবেশ করে তার উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করেন। তারপর হিময়ার ও হামদানের পারস্পরিক আত্মকলহের সুযোগ নিয়ে হাবশীগণ রুমী গোত্রের সহায়তায় তাঁদের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেন ৩৪০ খ্রীষ্টাব্দে। হাবশীগণের এ দখলদারিত্ব স্থায়ী থাকে ৩৭৮ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত। এর পর ইয়ামানের স্বাধীনতা এক প্রকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়ে গেল। কিন্তু মায়ারিবের মশহুর বাঁধে শুরু হল ফাটল। সেই ফাটল ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে পেতে অবশেষে ৪৫০ অথবা ৪৫১ খ্রীষ্টাব্দে বাঁধটি ভেঙ্গে যায়। এ বাঁধের ভাঙ্গনের ফলে ভয়াবহ প্লাবনের সৃষ্টি হয়ে যায়, যার উল্লেখ কুরআন শরীফের (সুরা সাবা) সায়লে আরেম নামে উল্লেখিত হয়েছে। এ ভয়াবহ প্লাবনের ফলে গ্রামের পর গ্রাম উজার হয়ে যায় এবং বহু গোত্র নানা দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে।
পরবর্তীকালে ৫২৩ খ্রীষ্টাব্দে পুনরায় ভিন্ন ধাঁচের এক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়। ইয়ামানের ইহুদী সম্রাট ‘যূনওয়াস’ নাজরানের খ্রীষ্টানদের উপর এক ন্যাক্কারজনক আক্রমণ পরিচালন করে খ্রীষ্ট ধর্ম পরিত্যাগ করে ইহুদী ধর্ম গ্রহণ করার জন্য তাঁদের উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন। কিন্তু খ্রীষ্টানগণ কোনক্রমেই এতে সম্মত না হওয়ায় ‘যূনওয়াস’ কতগুলো গর্ত খনন করে তাতে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করেন এবং সেই সকল অগ্নিকুন্ডে খ্রীষ্টানদের নিক্ষেপ করেন। কুরআন শরীফের সূরাহ বূরুজের {قُتِلَ أَصْحَابُ الْأُخْدُوْدِ} শেষ অবধি আয়াত দ্বারা এ লোমহর্ষক ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
এ ঘটনার ফল এ দাঁড়ায় যে রুমীয় সম্রাটগণের নেতৃত্বে খ্রীষ্টানগণ আরব উপদ্বীপের শহর ও নগরের উপর বার বার আক্রমণ চালিয়ে বিজয়ী হতে থাকেন। এতে উৎসাহিত হয়ে ইহুদীদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য তাঁরা সংকল্পবদ্ধ হয়ে যান এবং এ প্রতি আক্রমণে অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা দানের জন্য হাবশীগণকে সরবরাহ করা হয়। রুমীগণের সহযোগিতা লাভের ফলে হাবশীগণ বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেন এবং ৫২৫ খ্রীষ্টাব্দে ইরয়াতের নেতৃত্বে ৭০ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হন এবং পুনরায় ইয়ামানের উপর রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন। হাবশা সম্রাটের গর্ভনর হিসেবে ইরয়াত ইয়ামানের শাসন কাজ পরিচালনা করতে থাকেন। কিন্তু আবরাহা বিন সাবাহ আল আশরাম নামে তাঁর অধীনস্থ এক সৈনিক ৫৪৯ খ্রীষ্টাব্দে তাঁকে হত্যা করে নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন এবং অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে হাবশ সম্রাটের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলতে সক্ষম হন এবং খুশী করেন। ইনি ছিলেন সেই আবরাহা যিনি ক্বাবা’হ গৃহ ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে বিশাল হস্তী বাহিনী সহ ক্বাবা’হ অভিমুখে অভিযান পরিচালনা করেন এবং শেষ পর্যন্ত আল্লাহর পক্ষী বাহিনী কর্তৃক সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস প্রাপ্ত হন। আসমানী গ্রন্থ আল কুরআনে এ ঘটনা ‘আসহাবে ফীল’ (হস্তীবাহিনী) নামে প্রসিদ্ধ রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা ফীলের ঘটনার পর সনয়া ফিরে আসার পর তাকে ধ্বংশ করেন। তারপর তার পুত্র ইয়াকসূম সিংহাসনে আরোহন করেন। এরপর রাজত্ব করেন দ্বিতীয় পুত্র মাসরূক। তাদের উভয়ের সম্পর্কে বলা হয়েছে, তারা ছিল তাদের পিতার থেকেও খারাপ এবং ইয়ামানবাসীকে নিপীড়ন-নির্যাতন ও যুলূম-অত্যাচারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত নিকৃষ্ট স্বভাবের।
আসহাবে ফীলের ঘটনার পর ইয়ামানবাসীগণ পারস্যরাজ্যের সাহায্যপুষ্ট হয়। এবং হাবশীগণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ইয়ামানবাসীগণ সাইফ বিন যূ ইয়াযান হিময়ারীর সন্তান মা’দীকারবের নেতৃত্বে হাবশীগণকে সে দেশ থেকে বহিস্কার করে মুক্ত স্বাধীন সম্প্রদায় হিসেবে মাদী করেককে সম্রাট মনোনীত করেন। এ ছিল ৫৭৫ খ্রীষ্টাব্দের ঘটনা।
স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতালাভের পর মা’দীকারাব কিছু সংখ্যক হাবশীকে নিজের খেদমত এবং রাজদরবারের জাঁকজমক বৃদ্ধির কার্যে নিয়োজিত করেছিলেন। কিন্তু তাঁর এ অবিমৃষ্যকারিতা প্রসূত ভ্রান্ত নীতির কারণে ‘দুগ্ধ কলা সহকারে সর্প পালন’ প্রবাদ বাক্যটি এক মর্মান্তিক সত্যে পরিণত হয়ে যায়। প্রতারণা করে ঐ হাবশীগণ একদিন মা’দীকারাবকে হত্যা করার মাধ্যমে যূ ইয়াযান পরিবারের শাসন ক্ষমতাকে চিরদিনের জন্য স্তব্ধ করে দেয়। আর দেশটি পারস্য সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে পরিণত হয়। এরপর থেকে পারস্য বংশোদ্ভূত কয়েকজন গভর্ণর একাদিক্রমে ইয়ামান প্রদেশের শাসন সংক্রান্ত কর্মকান্ড পরিচালনা করতে থাকেন। অবশেষে সর্বশেষ পার্সী গভর্ণর বাযান ৬২৮ খ্রীষ্টাব্দে ইসলাম গ্রহণ করলে ইয়ামান পারস্য শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে ইসলামী জীবনধারা ও শাসন সৌকর্যের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় লাভ করে।[1]
ফুটনোটঃ[1] সৈয়দ সোলাইমান নদভী (রহঃ) ‘তারিখে আবযুল কুরআন’’ ১ম খন্ড ১৩৩ পৃঃ থেকে শেষ পযন্ত বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রমাণাদির আলোকে সম্প্রদায়ের বিভিন্ন বিবরণসহ আলোচনা করেছেনত, মওদূদী (রহ.)ও তাফহীমুল কুরআনের চতুর্থ খন্ডে ১৯৫-১৯৮ পৃষ্ঠায় বিবরণাদি একত্রিত করেছেন। কিন্তু ইতিহাসের উৎস হিসেবে এ সব ক্ষেত্রে বেশ মত বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি কোন কোন গবেষক বিবরণাদি পূর্ববর্তীগণের কাহিনী বলে বর্ণনা করেছেন। {إِنْ هٰذَا إِلَّا أَسَاطِيرُ الْأَوَّلِينَ} (٨٣) سورة المؤمنون
হীরাহর সাম্রাজ্য (الْمُلْكُ بِالْحِيْرَةِ )
ইরাক এবং উহার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে কুরুশকাবির (৫৫৭-৫২৯ খ্রীষ্টাব্দপূর্বাব্দ) এর সময় হতেই পারস্যবাসীগণের শাসন ব্যবস্থা চলে আসছিল। এ সময়ের মধ্যে তাঁদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো শক্তি কিংবা সাহস কারোরই ছিল না। তারপর খ্রীষ্টাব্দপূর্ব ৩২৬ অব্দে ইসকান্দার মাক্বদূনী পারস্য রাজ প্রথম দারাকে পরাজিত করে পারস্য শক্তিকে সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত করে ফেলে। এর ফলে সাম্রাজ্য ভেঙ্গে টুকরো টুকরো এবং সর্বত্র বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়ে যায়। এ বিশৃঙ্খল অবস্থা চলতে থাকে ২৩০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত। ঐ সময় ক্বাহত্বানী গোত্রসমূহ দেশত্যাগ করে ইরাকের এক শস্য-শ্যামল সীমান্ত অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। এ দিকে আবার দেশত্যাগী আদনানীগণ বিদ্রোহ ঘোষণা করে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে যায়। তারপর যুদ্ধে জয়লাভ করে তাঁরা ফোরাত নদীর উপকূলভাগের এক অংশে বসতি স্থাপন করেন।
এসব হিজরতকারীদের মধ্যে প্রথম সম্রাট ছিলেন ক্বাহত্বান বংশের মালিক বিন ফাহম তানূখী। তিনি আনবারের অধিবাসী ছিলেন বা আনবারের নিকটবর্তী স্থানে। এক বর্ণনা মতে তারপর তার ভাই ‘আমর বিন ফাহম রাজত্ব করেন। অন্য বর্ণনা মতে জাযীমাহ বিন মালিক বিন ফাহম। তার উপাধি ছিল ‘আবরাশ ও ওয়াযযাহ’।
অন্য দিকে ২২৬ খ্রীষ্টাব্দে আরদশীর যখন সাসানী সাম্রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করেন তখন ধীরে ধীরে পারস্য সাম্রাজ্যের হৃত গৌরব ও ক্ষমতার পুনরুদ্ধার হতে থাকে। আরদশীর পারস্যবাসীকে একটি সুশৃঙ্খল জাতিতে পরিণত করেন এবং দেশের সীমান্ত অঞ্চলে বসবাসকারী আরবদের অধীনস্থ করেন। এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কুযা’আহ গোত্র শাম রাজ্যের দিকে গমন করেন। পক্ষান্তরে হীরা এবং আনবারের আরব বাসিন্দাগণ বশ্যতা স্বীকারের ব্যাপারে নমনীয় মনোভাব গ্রহণ করেন।
আরদশীর সময়কালে হীরাহ, বাদিয়াতুল ইরাক এবং উপদ্বীপবাসীগণের রাবীয়ী এবং মুযারী গোত্রসমূহের উপর জাযীমাতুল ওয়ায্যাহদের আধিপত্য ছিল। এ থেকে এটাই বুঝা যায় যে, আরববাসীদের উপর আরদশীর সরাসরি আধিপত্য বিস্তার করতে চাননি। তিনি এটা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, আরববাসীগণের উপর সরাসরি আধিপত্য বিস্তার করার কিংবা সীমান্ত এলাকা থেকে তাদের লুঠতরাজ বন্ধ করা খুব সহজে সম্ভব হবে না। এ প্রেক্ষিতে তিনি একটি বিকল্প ব্যবস্থার কথা চিন্তা করেছিলেন এবং তা ছিল, যদি গোত্র থেকে একজন শাসক নিযুক্ত করা হয় তাহলে তাঁর স্বগোত্রীয় লোকজন এবং আত্মীয়-স্বজনদের পক্ষ থেকে সমর্থন ও সাহায্য লাভ সম্ভব হতে পারে।
এর ফলে আরও যে একটি বিশেষ সুবিধা লাভের সম্ভাবনা ছিল তা হল, প্রয়োজনে রুমীয়গণের বিরুদ্ধে তাঁদের নিকট থেকে সাহায্য গ্রহণের সুযোগ থাকবে। অধিকন্তু, শাম রাজ্যের রোম অভিমুখী আরব অধিপতিদের বিরুদ্ধে ঐ সকল আরব অধিপতিদের দাঁড় করিয়ে পরিস্থিতিকে কিছুটা অনুকূল রাখা সম্ভব হতে পারে। এ প্রসঙ্গে একটি বিষয় বিশেষভাবে সময়ের জন্য মৌজুদ রাখা হতো যার দ্বারা মরুভূমিতে বসবাসকারী বিদ্রোহীদের দমন করা সহজসাধ্য হতো।
২৬৮ খ্রীষ্টাব্দের সময় সীমার মধ্যে জাযীমা মৃত্যুমুখে পতিত হন এবং ‘আমর বিন ‘আদী বিন নাসর লাখমী (২৬৮-২৮৮ খ্রীষ্টাব্দ) তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি ছিলেন লাখম গোত্রের প্রথম শাসনকর্তা ও তিনিই সর্বপ্রথম হীরাহকে স্বীয় বাসস্থান হিসেবে গ্রহণ করেন এবং শাবূর আরদশীর এর সম-সাময়িক। এরপর কুবায বিন ফাইরুযের (৪৪৮-৫৩১ খ্রীষ্টাব্দ) যুগ পর্যন্ত হীরাহর উপর লাখমীদেরই শাসন কায়েম ছিল। কুবাযের সময় মাজদাকের আবির্ভাব ঘটে। তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা নরপতি। কুবায এবং তাঁর বহু প্রজা মাজদাকের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। কুবায আবার হীরাহর সম্রাট মুনযির বিন মাউস সামায়ের (৫১২-৫৫৪ খ্রীষ্টাব্দ) নিকট এ মর্মে সংবাদ প্রেরণ করেন যে, তিনি যেন সেই ধর্মগ্রহণ করে নেন। কিন্তু মুনযির ছিলেন যথেষ্ট আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্ন প্রকৃতির ব্যক্তি। প্রেরিত পয়গামের কোন গুরুত্ব না দিয়ে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এর ফল এটা দাঁড়ায় যে, কুবায তাঁকে তাঁর পদ হতে অপসারণ করে তাঁর স্থানে মাযদাকের এক শিষ্য হারিস বিন ‘আমর বিন হাজর ফিন্দীর হাতে হীরাহর শাসনভার অর্পণ করেন।
কুবাযের পর পারস্যের রাজ্য শাসনভার এসে পড়ে কিসরা আনুশেরওয়ার (৫৩১-৫৭৮ হাতে। ঐ ধর্মের প্রতি তাঁর মনে ছিল প্রবল ঘৃণা। তিনি মাযদাক এবং তাঁর অনুসারীগণের এক বড় দলকে হত্যা করেছিলেন। তারপর পুনরায় মুনযিরের প্রতি হীরাহর শাসনভার অর্পিত হয় এবং হারিস বিন ‘আমরকে তাঁর দরবারে আগমণের জন্য আহবান জানানো হয়। কিন্তু তিনি বনু কালব গোত্রের দিকে পলায়ন করেন এবং সেখানেই বসবাস করতে থাকেন।
মুনযির বিন মাউস সামার পরে নু’মান বিন মুনযিরের (৫৮৩-৬০৫ খ্রীষ্টাব্দ) কাল পর্যন্ত হীরাহর রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব তাঁরই বংশধরের উপর ন্যস্ত করেন। আবার যায়দ বিন আদী ঊবাদী কিসরার নিকট নু’মান বিন মুনযির সম্পর্কে মিথ্যা অভিযোগ করলে কিসরা রাগান্বিত হয়ে নু’মানকে নিজ দরবারে তলব করেন। নু’মান গোপনে বনু শায়বাহন গোত্রের দলপতি হানী বিন মাসউদের নিকট গিয়ে নিজ পরিবারের সদস্যবৃন্দ এবং সহায় সম্পদ তাঁর হেফাজতে দিয়ে কিসরার নিকট যান। কিসরা তাঁকে জেলখানায় আটক করে রাখেন এবং সেখানেই তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন। এ দিকে কিসরা নু’মানকে কয়েদ খানায় আটকের পর তাঁর স্থানে ইয়াস বিন ক্বাবিসাহ তায়ীকে হীরাহর শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন এবং হানী বিন মাস’ঊদের নিকট থেকে নু’মানের রক্ষিত আমানত তলব করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। কিছুটা সূক্ষ্ণ মর্যাদাসম্পন্ন লোক হানী তলবী আমানত প্রদান করতে শুধু যে অস্বীকারই করলেন তাই নয় বরং যুদ্ধ ঘোষণা করে বসলেন। তারপর যা হবার তাই হল। ইয়াস নিজের সুসজ্জিত বাহিনী, কিসরার বাহিনী এবং মুরযবানের পুরো বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হলেন মোকাবিলা করার জন্য। ‘যূ ক্বার’’ নামক ময়দানে উভয় দলের মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে বনু শায়বাহন বিজয়ী হন এবং পারস্যবাসীগণ অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করেন। ইতিহাসে এ যুদ্ধ অতীব গুরত্বপূর্ণ এ কারণে যে, আজমীদের বিরুদ্ধে আরবীদের এটাই ছিল প্রথম বিজয়। এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল নাবী কারীম (সাঃ)-এর জন্মের পর।
ইতিহাসবিদগণ এ যুদ্ধের সময়কাল নিয়ে মতভেদ করেছেন। কেউ বলেছেন, রাসূলে কারীম (সাঃ)-এর জন্মের অল্প কিছুকাল পর। অথচ হীরাহর উপর ইয়াসের আধিপত্য লাভের অষ্টম মাসে নাবী কারীম (সাঃ) দুনিয়াতে তশরীফ আনয়ন করেন। আবার কেউ বলেছেন, নবুওয়াতের কিছুকাল পূর্বে। এটাই সঠিকতার নিকটবর্তী। কেউ বলেছেন, নবুওয়াতের কিছুকাল পর। কেউ বলেছেন, হিজরতের পর। কেউ বলেছেন, বদর যুদ্ধের পর ইত্যাদি।
ইয়াসের পর কিসরা এক পার্সীকে হীরাহর শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। তার নাম আযাদবাহ বিন মাহিব্ইয়ান বিন মিহরাবান্দাদ। তিনি ১৭ বছর (৬১৪-৬৩১ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত) শাসন করেন। কিন্তু ৬৩২ খ্রীষ্টাব্দে লাখমীদের অধিকার পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মুনযির বিন নু‘মান মা’রুব নামক এ গোত্রের এক ব্যক্তি শাসন কাজ পরিচালনে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। কিন্তু এ দায়িত্ব পালনের সময়ানুক্রমে যখন সবেমাত্র অষ্টম মাস অতিক্রান্ত হয়েছিল এমতাবস্থায় তখন ইসলামের বিশ্ববিশ্রুত বীর কেশরী সিপাহ সালার খালিদ বিন ওয়ালীদ ইসলামের উপচে পড়া প্রবহমান প্লাবনধারার অগ্রদূত হিসেবে হীরায় প্রবেশ করেন।
ফুটনোটঃ
শাম রাজ্যের শাসন (المُلْكُ بِالشَّامِ)
যে যুগ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে সেই যুগে এক স্থান থেকে স্থানান্তরের হিজরত করে যাওয়ার এক হিড়িক সৃষ্টি হয়েছিল আরব গোত্র সমূহের মধ্যে। কুযা’আহ গোত্রের কয়েকটি শাখা শাম রাজ্যের সীমানা অতিক্রম করে গিয়ে বসতি স্থাপন করেন সেখানে। বনু সুলাইম বিন হুলওয়ানদের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক ছিল। বনু যাজ’আম বিন সুলাইম নামক যে গোত্রটি যাজা’য়িমাহ নামে পরবর্তী কালে প্রসিদ্ধ লাভ করেছিল তা ছিল ওদের অন্তর্ভুক্ত। কুযা’আহর সেই শাখাকে রুমীগণ আরব মরুভূমিতে যাযাবরগণ কর্তৃক পরিচালিত লুটতরাজের কবল থেকে নিস্কৃতি লাভ ও লুটতরাজ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে এবং পার্সীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য নিজেদের পৃষ্ঠপোষক বানিয়েছিল। এ উদ্দেশ্যে তাঁদেরই এক ব্যক্তির মাথায় রাজ্য শাসনের মুকুট পরিধান করিয়েছিল।
এরপর থেকে বেশ কিছু কাল যাবৎ তাঁরই পরিচালনাধীন রাজ্যের শাসন সংক্রান্ত কর্মকান্ড পরিচালিত হতে থাকে। এদের মধ্যে সব চাইতে প্রসিদ্ধ শাসক ছিলেন সম্রাট যিয়াদ বিন হাবুলাহ। অনুমান করা হয় যে যাজায়েমাহ গোত্র কর্তৃক পরিচালিত রাজ্য শাসন ব্যবস্থা দ্বিতীয় খ্রীষ্টাব্দের পুরোটা জুড়েই চলছিল। তারপর সেই অঞ্চলে গাসসানী গোত্রের বংশধরগণের আগমনের কথাবার্তা চলতে থাকে। এ প্রসঙ্গে এটা বলাই বাহুল্য যে ইতোমধ্যেই গাসসানীগণ বনু যাজাআমাকে পরাজিত করে তাঁদের ক্ষমতা ও সহায় সম্পদ ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। এহেন পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে রুমীগণ গাসসানী বংশের শাসককে শাম অঞ্চলের জন্য আরবীয়দের সম্রাট হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন। গাসসানীদের রাজধানী ছিল ‘বসরা’। রুমীয় কর্মকান্ডের পরিচালক হিসেবে শাম অঞ্চলে পর্যায় ক্রমে সে পর্যন্ত তাঁদেরই রাজত্ব চলতে থাকে, যে পর্যন্ত ফারুকী প্রতিনিধিত্ব কালের মধ্যে ১৩ হিজরীতে ইয়ারমুক যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং গাসসানী বংশের শেষ শাসক জাবলা বিন আইহাম ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন[1]। (যদিও তার অহংবোধ ইসলামী সাম্যকে বেশী সময় পর্যন্ত সহ্য করতে না পেরে সে স্বধর্ম ত্যাগী হয়ে যায়।)
ফুটনোটঃ[1] মুহাযারাতে খুযরী, ১ম খন্ড ৩৪ পৃঃ তারীখে আরযুল কুরআন ২য় খন্ড ৮০-৮২ পৃঃ।
হিজাযের নেতৃত্ব (الإِمَارَةُ بِالْحِيْرَةِ)
এটা সর্বজনিতবিদিত বিষয় যে, মক্কায় জনবসতির সূত্রপাত হয় ইসমাঈল (আঃ)-এর মক্কাবাস থেকে, অতঃপর ১৩৭ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি জীবিত[1] থাকেন এবং আজীবন মক্কাবাসীগণের সর্দার ও বায়তুল্লাহ শরীফের অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন[2]। তাঁর ওফাত প্রাপ্তির পর তাঁর এক সন্তান মক্কার অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেন। কেউ বলেন, দু’সন্তানই- প্রথমে নাবিত্ব ও পরে ক্বায়দার মক্কার অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেন। আবার কেউ এর বিপরীতও বলেছেন। তারপর তাঁর নানা মুযায বিন ‘আমর জুরহুমী রাজ্যের শাসনভার নিজ হাতে গ্রহণ করেন। এভাবে মক্কার নেতৃত্ব বনু জুরহুম গোত্রের হাতে চলে যায় এবং এক যুগ পর্যন্ত তা তাঁদের হাতের মুঠোর মধ্যেই থাকে। যেহেতু ইসমাঈল (আঃ) পিতার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বায়তুল্লাহ শরীফের নির্মাণ কাজ করেছিলেন, সেইহেতু তাঁর সন্তানাদি বিশেষ এক মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত থাকেন। যদিও নেতৃত্ব কিংবা অধিকার লাভে তাঁদের কোন অংশীদারিত্ব ছিল না[3]।
তারপর দিনের পর দিন এবং বৎসরের পর বৎসর অতিবাহিত হতে থাকল। কিন্তু ইসমাঈল (আঃ) সন্তানগণ যেন মাতৃগর্ভেই রয়ে গেলেন। জনসমাজে তাঁরা অজ্ঞাত অখ্যাতই রয়ে গেলেন। পক্ষান্তরে বুখতুনসসরের খ্যাতি প্রকাশিত হওয়ার পূর্ব মূহুর্তে বনু জুরহুম গোত্রের শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং মক্কার আকাশে আদনানীদের রাজনৈতিক নক্ষত্রের দ্যুতি চমকাতে আরম্ভ করে। এর প্রমাণ হচ্ছে, বুখতুনসসর জাতে ‘ইরক্ব নামে স্থানে আরবদের সঙ্গে যে ভীষণ লড়াই করেছিলেন তাতে আরব সৈন্যদের সেনাপতি জুরহুমী ছিলেন না[4] বরং স্বয়ং আদনান ছিলেন সেনাপতি।
খ্রীষ্টপূর্ব ৫৮৭ অব্দে বুখতুনসসর আবার যখন মক্কা আক্রমণ করেন তখন আদনানীগণ পলায়ন করে ইয়ামান চলে যান। সেই সময় ইয়ারমিয়াহ অধিবাসী বারখিয়া যিনি বনি ইসরাঈলগণের নাবী ছিলেন তিনি আদনানের সন্তান মা’আদ্দকে তাঁর সঙ্গে নিয়ে শাম দেশের হার্রানে চলে যান এবং বুখতুনসসরের প্রভাব বিলুপ্ত হয়ে গেলে মা’আদ্দ পুনরায় মক্কায় ফিরে আসেন। মক্কায় প্রত্যাবর্তনের পর জুরহুম গোত্রের মাত্র এক জনের সঙ্গেই তাঁর সাক্ষাৎ হয়। তিনি ছিলেন জাওহাম বিন জালহামাহ। মা’আদ্দ তাঁর কন্যা মুয়া‘নাহকে বিবাহ করেন। তাঁর গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণ করেন নিযার[5]।
এরপর থেকে মক্কায় জুরহুম গোত্রের অবস্থা খুব খারাপ হতে থাকে। তাঁদেরকে প্রকট অসচ্ছলতার মধ্যে নিপতিত হতে হয়। ফলে তাঁরা বায়তুল্লাহর হজ্বতীর্থ যাত্রীদের উপর নানা প্রকার অন্যায় উৎপীড়ন শুরু করে দেয়। খানায়ে ক্বাবা’হহর অর্থ আত্মসাৎ করতেও তাঁরা কোন প্রকার দ্বিধাবোধ করেন না[6]।
এদিকে বনু আদনান গোত্র তাঁদের এ জাতীয় কর্মকান্ডের উপর গোপনে গোপনে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে থাকেন এবং তাঁদের উপর ভয়ানক ক্ষুব্ধ ও কুপিত হয়ে উঠেন। তাই, যখন বনু খুযা’আহ গোত্র মারুয যাহরানে শিবির স্থাপন করেন এবং লক্ষ্য করেন যে বনু আদনান গোত্র বনু জুরহুমকে ঘৃণার চোখে দেখছেন তখন এ সুযোগ গ্রহণ করে এক আদনানী গোত্রকে (বনু বাকর বিন আবদে মানাফ বিন কিনানাহ) সঙ্গে নিয়ে বুন জুরহুম গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আরম্ভ করে দেন এবং মক্কা থেকে তাঁদেরকে বিতাড়িত করে ক্ষমতা দখল করে নেন। এ ঘটনাটি ঘটে দ্বিতীয় খ্রীষ্ট শতাব্দীর মধ্য ভাগে।
বনু জুরহুম গোত্র মক্কা ছেড়ে যাবার সময় যমযম কূপের মধ্যে নানা প্রকার জিনিসপত্র নিক্ষেপ করে তা প্রায় ভরাট করে ফেলেন। যে সব জিনিসপত্র তাঁরা যমযম কূপের মধ্যে নিক্ষেপ করেন, তার মধ্যে ছিল কিছু সংখ্যক ঐতিহাসিক নিদর্শন। মুহাম্মাদ বিন ইসহাক্বের বিবরণ মতে ‘আমর বিন হারিস বিন মুযায জুরহুমী[7] খানায়ে ক্বাবা’হর দুটি হরিণ,[8] কর্ণারে গ্রোথিত পাথরটি (হাজারে আসওয়াদ বা কালোপাথর) বাহির করে নিয়ে তা কূপের মধ্যে নিক্ষেপ করেন। তারপর নিজ গোত্র বনু জুরহুমকে সঙ্গে নিয়ে ইয়ামানে চলে যান। মক্কা হতে বহিস্কার এবং সেখানকার রাজত্ব শেষ হওয়ার কারণে তাঁদের দুঃখের অন্ত ছিল না। এ প্রেক্ষিতেই ‘আমর নীচের কবিতাটি আবৃত্তি করেন,
كأن لم يكن بين الحَجُوْن إلى الصَّفَا
**
أنيـس ولـم يَسْمُـر بمكـــة سامـــر
بلــى نحــن كــنا أهـلــها فأبـادنـا
**
صُرُوْف الليالى والجُدُوْد العَوَاثِر [9]
‘হাজূন থেকে সাফা পর্যন্ত নিশিতে গল্প বলার কেউ ছিল না, কেন নেই? আমরাতো এরই অধিবাসী, সময়ের পরিবর্তনে আজ আমরা ভাগ্যাহত, হায়, আমাদের সর্বহারা বানিয়ে দিয়েছে’
ইসমাঈল (আঃ)-এর যুগ ছিল যীশু খ্রীষ্টের জন্মের আনুমানিক দু’হাজার বছর পূর্বে। সেই হিসেবে মক্কায় জুরহুম গোত্রের অস্তিত্ব ছিল প্রায় দু’হাজার একশত বছর পর্যন্ত এবং তাঁদের রাজত্ব কাল ছিল প্রায় দু’হাজার বছর পর্যন্ত।
মক্কার উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর বনু বাকরকে প্রশাসনিক দায়-দায়িবতে অন্তর্ভুক্ত না করেই বুন খুযা’আহ এককভাবে প্রশাসন পরিচালনা করেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এবং মর্যাদাসম্পন্ন তিনটি পদের অংশীদারিত্ব বনু মুযার গোত্র লাভ করেছিলেন। পদগুলো হচ্ছে যথাক্রমে নিম্নরূপ:
১. হাজীদের আরাফা থেকে মুজাদালেফায় নিয়ে যাওয়া এবং ইয়াওমুন নাফার অর্থাৎ ১৩ই (যিলহজ্জের শেষ দিন) মিনা থেকে রওয়ানা হওয়ার জন্য হাজীদের লিখিত আদেশ প্রদান। এ সম্মানের অধিকারী ছিলেন ইলিয়াস বিন মুযার বংশধরের মধ্যে বনি গাওস বিন মুররাহ যাদের বলা হতো ‘সূফাহ’। এ মর্যাদার ব্যাখ্যা হচ্ছে, ১৩ই জিলহজ্জ তারিখে যতক্ষণ না সুফাহর কোন একজন লোক সকলের আগে কংকর নিক্ষেপ কাজ সম্পন্ন করতেন ততক্ষণ হজ্জযাত্রীগণ কংকর নিক্ষেপ করতে পারতেন না। অধিকন্তু, হজ্জযাত্রীগণ যখন কংকর নিক্ষেপ কাজ সম্পন্ন করতেন এবং মিনা হতে রওয়ানা হওয়ার ইচ্ছা করতেন তখন সুফাহর লোকেরা মিনার একমাত্র পথ ‘আক্বাবাহর দু’পাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে যেতেন এবং যতক্ষণ না তাঁদের সকলের যাওয়া শেষ হতো ততক্ষণ সেই পথে অন্যদেরকে যেতে দেয়া হতো না। তাঁদের চলে যাওয়ার পর অন্যান্য লোকদের জন্য পথ ছেড়ে দেয়া হতো। যখন সুফাহ বিদায় নিল তখন এ সম্মান বনু তামীমের এক পরিবার বনু সা’দ বিন যায়দ মানাতের অনুকূলে গেল।
২. ১০ই জিলহজ্জ্ব তারিখ ‘ইফাজাহর জন্য’ সকালে মুজদালেফা থেকে মিনার দিকে যাত্রা করার ব্যাপারটি ছিল বনু আদওয়ানের এখতিয়ার্ভুক্ত এক মহা সম্মানের প্রতীক।
৩. হারাম মাসগুলোকে এগিয়ে নিয়ে আসা কিংবা পেছিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি ছিল উচ্চ সম্মানের প্রতীক। এ সম্মানের ব্যাপারটি ছিল বনু কিনানাহ গোত্রের অন্যতম শাখা বনু ফুক্বাইম বিন আদীর এখতিয়ার্ভুক্ত[10]।
মক্কার উপর বনু খুযা’আহ গোত্রের কর্তৃত্ব প্রায় তিনশত বছর যাবৎ প্রতিষ্ঠিত ছিল[11]। এ সময়ের মধ্যে আদনানী গোত্রসমূহ মক্কা এবং হিজায সীমান্ত অতিক্রম করে নাজদ, ইরক, বাহরাইন ইত্যাদি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েন। মক্কার আশপাশে কেবলমাত্র কুরাইশদের কয়েকটি শাখা অবশিষ্ট ছিল। তারা হলেন, ‘হুলূল’ ও ‘সিরম’। অবশ্য এদের ঘরবাড়ি বলতে তেমন কিছুই ছিল না। ছড়ানো ছিটানো এবং বিচ্ছিন্ন অবস্থায় এরা ভিন্ন ভিন্ন পাড়ায় বসবাস করতেন। বনু কিনানাহ গোত্রের মধ্যেও বিক্ষিপ্ত অবস্থায় তাদের কয়েকটি ঘড়বাড়ি ছিল। কিন্তু মক্কার প্রশাসন কিংবা বায়তুল্লাহর অভিভাবকত্বে তাঁদের কোন অংশ ছিল না। এমন এক সময়ে কুসাই বিন কিলাব গোত্র আত্মপ্রকাশ করে[12]।
কুসাই সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তিনি যখন মায়ের কোলে ছিলেন তখন তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। এরপর তাঁর মা বনু উযরা গোত্রের রাবী’আহ বিন হারাম নামক এক ব্যক্তির সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যান। এ গোত্র শাম রাজ্যের কোন এক অঞ্চলে বসবাস করত। কাজেই কুসাইয়ের মা কুসাইকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে চলে যান। বয়োঃপ্রাপ্তির পর কুসাই মক্কায় ফিরে আসেন। সেই সময় খুযা’য়ী গোত্রের হুলাইল বিন হাবশিয়া খুযা’য়ী ছিলেন মক্কার অভিভাবক। কুসাই হুলাইল কন্যা হুব্বাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিলে তিনি তা মঞ্জুর করেন এবং উভয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যান[13]। এর কিছু দিন পর হুলাইল মৃত্যু মুখে পতিত হলে মক্কা এবং বায়তুল্লাহর অভিভাবকত্ব নিয়ে খুযা’আহ এবং কুরাইশদের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধোত্তর মক্কায় কুসাইরা হয়ে উঠেন মধ্যমণি। মক্কা এবং বায়তুল্লাহর অভিভাকত্ব অর্পিত হয় তাঁরই হাতে।
খুযা’আহ এবং কুরাইশদের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধের কারণ সম্পর্কে তিন ধরণের বর্ণনা পাওয়া যায়। এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে, যখন কুসাইয়ের সন্তানাদি খুব উন্নতি লাভ করল, তাঁদের হাতে সম্পদের প্রাচুর্য পরিলক্ষিত হল এবং মান-সম্মানও বৃদ্ধি পেতে লাগল এবং এ দিকে হুলাইল যখন মৃত্যুবরণ করলেন তখন কুসাই এটা উপলব্ধি করলেন যে, মক্কার প্রশাসন এবং ক্বাবা’হর অভিভাবকত্বের ব্যাপারে বনু খুযা’আহ ও বকরের তুলনায় তার দাবীই অগ্রাধিকারযোগ্য। তিনি এ ধারণাও পোষণ করতে থাকলেন যে কুরাইশগণ হচ্ছেন ইসমাঈলীয় বংশোদ্ভুত খাঁটি আরব এবং ইসামাঈলীয় বংশের অন্যান্যদের সরদার।
এ প্রেক্ষিতে তিনি কুরাইশ এবং বনু কেননার কিছু সংখ্যক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির সঙ্গে এ মর্মে আলাপ-আলোচনা করেন যে, কেন বনু বাকর এবং বনু খুযা’আহকে মক্কা থেকে বহিস্কার করা হবে না? আলোচনায় অংশগ্রহণকারীগণ এ ব্যাপারে তাঁর মতের সঙ্গে অভিন্নমত পোষণ করেন[14]।
দ্বিতীয় বিবরণ হচ্ছে, বনু খুযা’আহর কথানুযায়ী হুলাইল নিজেই কুসাইকে অসীয়ত করেন যে, তিনিই মক্কার শাসনভার গ্রহণ করবেন এবং ক্বাবা’হর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু খুযা’আহ এ সম্মানজনক পদে কুসাইকে অধিষ্ঠিত করতে অস্বীকার করলে উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে[15]।
তৃতীয় বিবরণ হচ্ছে, হুলাইল তাঁর কন্যা হুব্বার হাতে বায়তুল্লাহর অভিভাবকত্ব ন্যস্ত করেন এবং আবূ গুবশান খুযা’য়ীকে তাঁর প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন। হুব্বার প্রতিনিধি হিসেবে আবূ গুবশান খুযা’য়ীই হয়ে যান ক্বাবা’হর দায়িত্বশীল ব্যক্তি। এ দিকে হুলাইল যখন মৃত্যুবরণ করেন তখন কুসাই এক মশক মদের বিনিময় আবূ গিবশানের নিকট থেকে ক্বাবা’হর অভিভাবকত্ব ক্রয় করে নেন। কিন্তু খুযা’আহ সম্প্রদায় এ জাতীয় ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যাপারটি অনুমোদন না করে বায়তুল্লার ব্যাপারে কুসাইকে বাধা প্রদান করতে থাকেন। কুসাইও কিন্তু ছাড়বার পাত্র নন। বনু খুযা’আহকে মক্কা থেকে বহিস্কার করার মানসে কুরাইশ এবং বনু কিনানাহকে একত্রিত করে তাঁদের সহায়তা লাভের জন্য আবেদন জানালেন। কুসাইয়ের আহবানে সাড়া দিয়ে তাঁরাও একাত্মতা ঘোষণা করলেন।[16]
কারণ যাই হোক না কেন, ঘটনার রূপটি ঠিক এ রকম ছিল যে, হুলাইল যখন মৃত্যুবরণ করলেন সুফা তখন তাই করতে চাইলেন যা তিনি সর্বদা করে আসছিলেন। কুসাই তখন কুরাইশ এবং কিনানাহর লোকজনদের সঙ্গে নিয়ে ‘আক্বাবাহর যে স্থানে তাঁরা সম্মিলিত হয়েছিলেন সেখানে উপস্থিত হয়ে বললেন যে, ‘খানায়ে ক্বাবা’হর অভিভাবকত্বের জন্য তোমাদের তুলনায় আমরা অধিকতর যোগ্য এবং আমাদের দাবী অগ্রগণ্য।’
কিন্তু কুসাইয়ের কথায় কর্ণপাত না করে তাঁরা যুদ্ধ ঘোষণা করে বসলেন। এ যুদ্ধে কুসাই তাঁদের পরাজিত করে তাঁর ইপ্সিত মান-মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেন। এ দিকে কুসাই এবং সুফার মধ্যকার বিরোধের সুযোগ নিয়ে বনু খুযা’আহ ও বনু বাকর অসহযোগিতার পথ অবলম্বন করলে কুসাই তাঁদের ভয় প্রদর্শন করে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেন। কিন্তু এ দু’গোত্রের লোকজন তাঁর কথার কোন গুরুত্ব না দিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করে বসেন। এভাবে উভয় পক্ষই এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পড়েন। এ যুদ্ধে উভয় পক্ষেরই বহু লোকজন হতাহত হয়।
জানমালের প্রভূত ক্ষয়-ক্ষতির পরিপ্রেক্ষিতে আপোষ-নিষ্পত্তির মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের জন্যে শেষ পর্যন্ত উভয় পক্ষের মধ্যেই আগ্রহ পরিলক্ষিত হয় এবং উভয় পক্ষই একটি চুক্তি সম্পাদনে সম্মত হন। এ লক্ষ্যে বনু বাকর গোত্রের ‘ইয়ামার বিন আওফ’’ নামক এক ব্যক্তিকে মধ্যস্থতাকারী মনোনীত করা হয়। সমস্যার সকল দিক পর্যালোচনা করে তিনি রায় দেন যে, মক্কার শাসন এবং খানায়ে ক্বাবা’হর অভিভাবকত্বের ব্যাপারে খুযা’আহর তুলনায় কুসাই অধিকতর যোগ্যতার অধিকারী। অধিকন্তু তিনি আরও ঘোষণা করেন যে, এ যুদ্ধে কুসাই যত রক্তপাত ঘটিয়েছেন তার সবই অর্থহীন এবং পদদলিত বলে ঘোষণা করছি। তাছাড়া এ সিদ্ধান্তও ঘোষিত হল যে, খুযা’আহ ও বন্ধু বাকর যে সকল লোকজনকে হত্যা করেছেন তাঁদের জন্য দিয়াত প্রদান এবং খানায়ে ক্বাবা’হর অভিভাবকত্ব অকুণ্ঠচিত্তে কুসাইয়ের হাতে সমর্পণ করতে হবে। সেই বিচারের রায়ের কারণে ইয়ামারের উপাধি হয়েছিল ‘শাদ্দাখ’[17]। শাদ্দাখ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ‘পদ দলিতকারী ব্যক্তি’’।
এ আপোষ-নিষ্পত্তি এবং চুক্তির ফলে মক্কার উপর কুসাই ও কুরাইশদের পূর্ণ কর্তৃত্ব লাভ সম্ভব হয় এবং বায়তল্লার ধর্মীয় নেতার মহা-সম্মানিত পদটিও কুসাই লাভ করেন। এর ফলে খানায়ে ক্বাবা’হ পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে আরবের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত লোকজনদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক স্থাপিত হতে থাকে। মক্কার উপর কুসাইয়ের আধিপত্যের ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল খ্রীষ্টিয় পঞ্চম শতকের মধ্যভাগে, অর্থাৎ ৪৪০ খ্রীষ্টাব্দের কোন এক সময়ে [18]।
মক্কার শাসন ক্ষমতা লাভের পর কুসাই শাসন ব্যবস্থার কিছুটা সংস্কারমুখী কাজকর্মের দিকে মনোনিবেশ করেন। মক্কার আশপাশে বসবাসরত কুরাইশগণকে মক্কায় নিয়ে এসে তিনি পুরো শহরটাকে তাঁদের মধ্যে বন্টন করে দেয়ার মাধ্যমে প্রত্যেক বংশের লোকজনদের বসবাসের জন্য স্থান নির্ধারণ করে দেন। তবে যাঁরা মাসকে আগে পিছে করতেন তাঁদের, এমন কি আলসফওয়ান, বনু আদওয়ান এবং বনু মুররা বিন আওফ প্রভৃতি গোত্র সমূহের লোকজনদের তাঁদের স্ব-স্ব পদে রাখেন। কারণ, কুসাই মনে করতেন যে, এ সকল কাজকর্মও ধর্মকর্মের অন্তর্ভুক্ত এবং এ সব ব্যাপারে রদ-বদল সঙ্গত নয়[19]।
কুসাইয়ের সংস্কারমুখী কর্মকান্ডের এটাও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল যে, তিনি ক্বাবা’হ হারামের উত্তরে দারুন নাদওয়া স্থাপন করেন (এর দরজা ছিল মসজিদের দিকে)। দারুন নাদওয়া ছিল প্রকৃতই কুরাইশদের সংসদ সেখানে গুরুত্বপূর্ণ এবং উল্লেখযোগ্য বিষয়াদির বিচার-বিশেষণ করা হতো। কুরাইশদের জন্য এটা ছিল একটি অত্যন্ত কল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠান।
করাণ, এ দারুন নাদওয়াই ছিল তাঁদের ঐক্যের প্রতীক এবং এখানেই তাঁদের বিক্ষিপ্ত ও বিতর্কিত সমস্যাবলী ন্যায়সঙ্গত উপায়ে মীমাংসিত হতো[20]।
কুসাইয়ের শ্রেষ্ঠত্ব ও দলনেতৃত্বের প্রেক্ষাপটে নিম্নলিখিত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বসমূহ পালনের অধিকার তিনি লাভ করেনঃ
১. দারুন নাদওয়ার অধিবেশনের সভাপতিত্ব : এ সকল অধিবেশনে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি সম্পর্কে পরামর্শ করার পর সিদ্ধান্ত নেয়া হতো। সেখানে সমাজের লোকজনদের কন্যাদের বিবাহ-শাদীর আয়োজনও করা হতো।
২. লিওয়া : অর্থাৎ যুদ্ধের পতাকা কুসাইয়ের হাতেই বেঁধে রাখা হতো।
৩. ক্বিয়াদাহ : এটা হল কাফেলার নেতৃত্ব দেয়া। মক্কার কোন কাফেলা ব্যবসা বা অন্য কোন উদ্দেশ্যেই হোক তার অথবা তার সন্তানদের নেতৃত্ব ছাড়া রওয়ানা হতো না।
৪. হিজাবাত : এর অর্থ হচ্ছে খানায়ে ক্বাবা’হর রক্ষণাবেক্ষণ। কুসাই নিজেই খানায়ে ক্বাবা’হর দরজা খুলতেন এবং আনুষঙ্গিক যাবতীয় দায়-দায়িত্ব তিনি নিজেই পালন করতেন।
৫. সিক্বায়াহ : এর অর্থ হচ্ছে পানি পান করানো। হজ্জযাত্রীদের পানি পান করানোর একটা সুন্দর রেওয়াজ প্রচলিত ছিল। এ উদ্দেশ্যে জলাধার বা চৌবাচ্চায় পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকত। সেই পানিতে পরিমাণ মতো খেজুর ও কিসমিস দিয়ে বেশ সুস্বাদু পানীয় বা শরবত তৈরি করা হতো। হজ্জযাত্রীগণ মক্কায় আগমন করলে তিনি তাঁদের সেই পানীয় পান করাতেন[21]।
৬. রিফাদাহ : অর্থাৎ হজ্জযাত্রীদের মেহমানদারিত্ব। হজ্জযাত্রীগণের আপ্যায়ন ও মেহমানদারীর জন্য খাদ্যদ্রব্য তৈরী করে খাওয়ানোর একটা রেওয়াজও প্রচলিত ছিল। এ উদ্দেশ্যে কুসাই কুরাইশগণের উপর একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের চাঁদা নির্ধারণ করে তা সংগ্রহ করতেন। সংগৃহীত অর্থের সাহায্যে খাদ্যদ্রব্য তৈরী করে আর্থিক দিক দিয়ে অসচ্ছল কিংবা যাঁদের নিকট খাদ্যবস্তু থাকত না এমন সব হজ্জযাত্রীদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হতো[22]।
উল্লেখিত কাজকর্মগুলো প্রত্যেকটি ছিল উচ্চমার্গের সম্মানের প্রতীক এবং কুসাই ছিলেন এ সবের প্রতিভূ। কুসাইয়ের প্রথম পুত্রের নাম ছিল আবদুদ্দার। কিন্তু তা সত্ত্বেও কুসাইয়ের জীবদ্দশাতেই দ্বিতীয় পুত্র আবদে মানাফ সম্মান ও নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হন।
এ কারণে কুসাই তাঁর পুত্র আব্দুদ্দারকে বললেন, যদিও কেউ কেউ সম্মান ও নেতৃত্বের ব্যাপারে তোমার চাইতেও অধিক মর্যাদাসম্পন্ন রয়েছে তবুও তোমাকে আমি কোনভাবেই খাটো করে রাখতে চাইনা। আমি চাই বিভিন্ন ক্ষেত্রে তুমি তাঁদের সমকক্ষ হয়ে থাকবে। এ আশ্বাসের প্রেক্ষিতে প্রথম পুত্র আব্দুদ্দারের অনুকূলে তাঁর নেতৃত্বেও সম্মানের বিষয়গুলো অসিয়ত করেছিলেন। অর্থাৎ দারুন নাদওয়ার অধিবেশনে সভাপতিত্ব করার অধিকার, খানায়ে ক্বাবা’হর রক্ষণাবেক্ষণের অধিকার, যুদ্ধের পতাকা বহনের অধিকার, হজ্জযাত্রীগণকে পানি পান করানো, হজ্জযাত্রীগণের মেহমানদারীর দায়িত্ব ইত্যাদি সব কিছুরই অধিকার আব্দুদ্দারকে অসিয়ত করলেন। কুসাই ছিলেন খুবই উন্নত মানের ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতা। কাজেই, কেউ কখনো তাঁর বিরোধিতা করত না এবং তাঁর কোন প্রস্তাব কিংবা সিদ্ধান্ত কেউ কখনো প্রত্যাখ্যানও করত না। তাঁর মৃত্যুর পরও ধর্মের অন্তর্ভুক্ত করণীয় কর্তব্য বলে মনে করা হতো। এজন্য পুত্রগণ তাঁর মৃত্যুর পরেও দ্বিধাহীন চিত্তে অসিয়তগুলো মেনে চলেছিলেন।
কিন্তু আবদেমানাফ যখন ইনতেকাল করলেন তখন তাঁর পুত্রগণ উল্লেখিত পদ সমূহের ব্যাপারে আব্দুদ্দারের সন্তানের সঙ্গে রেষারেষি আরম্ভ করলেন। যার ফলে কুরাইশগণ দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়লেন এবং দু’দলের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিল। কিন্তু ভয়াবহ পরিণতির কথা চিন্তা করে উভয় পক্ষই সংযম প্রদর্শন করে একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এ চুক্তির ফলে নেতৃত্ব ও মান মর্যাদার বিষয়গুলো উভয় পক্ষের মধ্যে বন্টিত হয়ে গেল। সিক্বায়াহ ও রিফাদাহ ও ক্বিয়াদাহ এ পদ তিনটি দেয়া হল বনু আবদে মানাফকে। দারুননাদওয়ার সভাপতিত্ব, লেওয়া ও হেজাবাতের দায়িত্ব বনু আব্দুদ্দারের হাতেই রয়ে গেল।
বলা হয়ে থাক, দারুন নাদওয়ার দায়িত্বে উভয় গোত্রই শরীক ছিল। বনু আবদে মানাফ আবার তাঁদের প্রাপ্ত পদগুলোর জন্য নিজেদের মধ্যে লটারী করলেন। ফলে সিক্বায়াহ ও রিফাদাহ আবদে শামস এর ভাগে পড়ে। তখন থেকে হাশিমই সিক্বায়াহ ও রিফাদাহ এ দুটি বিষয়ে নেতৃত্ব দান করতে থাকেন এবং তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। হাশিমের মৃত্যু হলে তাঁর সহোদর মুত্তালিব বিন আবদে মানাফ তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। কিন্তু মুত্তালিবের পর তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র আব্দুল মুত্তালিব (যিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দাদা) এ পদের অধিকর্তা হিসেবে কাজ করতে থাকেন। এমন কি যখন ইসলামের যুগ আরম্ভ হলো তখন আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব এ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।[23] বলা হয়, কুসাই পদসমূহ তার সন্তানদের মাঝে বন্টন করেন। অতঃপর তাদের সন্তানগণ উল্লেখ বর্ণনানুসারে পদসমূহের উত্তরাধীকারী হয়। আল্লাহ সর্বজ্ঞ।
এতদ্ব্যতীত আরও কিছু সংখ্যক পদ ছিল যা কুরাইশরা নিজেদের মধ্যে বিলিবন্টন করে নিয়েছিলেন। সেই সকল পদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকান্ড পরিচালনা এবং ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কুরাইশগণ একটি ছোট রাষ্ট্র, বরং বলা যায় যে একটি রাষ্ট্রমুখী সমাজ কাঠামো প্রবর্তন করে নিয়েছিলেন। বর্তমানে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় যে গণতান্ত্রিক ধারা অনুসৃত হয়ে থাকে কতটা যেন সেই ধাঁচ ও ছাঁচের প্রশাসনিক কাঠামো ও সমাজ ব্যবস্থা তৎকালীন মক্কায় গড়ে তোলা হয়েছিল। যে পদগুলোর কথা ইতোপূর্বে বলা হল সে পদগুলো হচ্ছে যথাক্রমে নিম্নরূপ :
১. ঈসার : এতে ভবিষ্যৎ কথনধারা নিরূপণ এবং ভাগ্য নির্ণয়ের জন্য মূর্তির পাশে রক্ষিত তীরের মালিকানার ব্যবস্থা ছিল। এ পদের অধিকর্তা ছিলেন বনু জুমাহ।
২. ধন-সম্পদের ব্যবস্থাপনা : মূর্তির নৈকট্য লাভের জন্য যে কুরবানী এবং মানত বা মানসী উৎসর্গ করা হতো এ হচ্ছে তারই ব্যবস্থাপনা। বিবাদ বিসম্বাদ এবং মামলা মোকদ্দমা মীমাংসার ব্যাপারটিও ছিল এর সঙ্গে সংশিষ্ট। এ সংক্রান্ত দায়িত্ব অর্পিত ছিল ‘বনু সাহম’ গোত্রের উপর।
৩. শূরা : এ সম্মানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গোত্র ছিলেন বনু আসাদ।
৪. আশনাক : এ অধিদপ্তরের কাজ ছিল শোনিতপাতের খেসারত এবং জরিমানার ব্যবস্থা। এর দায়িত্ব অর্পিত ছিল বনু তাইম গোত্রের উপর।
৫. উকার : এর কাজ ছিল জাতীয় পতাকা ধারণ। এ অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন বনু উমাইয়া গোত্র।
৬. কুব্বাহ : এ পদটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ অধিদপ্তরের দায়িত্ব-কর্তব্য ছিল সৈন্যদের শিবির স্থাপন এবং সৈন্য পরিচালনা। এ দায়িত্ব অর্পিত ছিল বনু মাখযুম গোত্রের উপর।
৭. সাফারাত : এ অধিদপ্তরের কর্তব্য ছিল পরিষ্কার-পরিচ্ছনতা সংক্রান্ত কর্মকান্ড সম্পাদন। এর দায়িত্বপ্রাপ্ত গোত্র ছিলেন বনু আদী।[24]
ফুটনোটঃ[1] পয়দায়েশ মোজমুআ বাইবেল ২৫-১৭।
[2] কালবে জাযীরাতুল আরব ২৩০-২৩৭ পৃঃ । ইবনে হিশাম ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশধর থেকে কেবলমাত্র নাবিত্বকে নেতৃত্বদানের কথা উল্লেখ করেছেন।
[3] ইবনে হিশাম ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশধর থেকে কেবলমাত্র নাবিত্বকে নেতৃত্বদানের কথা উল্লেখ করেছেন।
[4] কালবে জাযীরাতুল আরব ২৩০ পৃঃ।
[5] রহমাতুল্লিল আলামীন ২য় খন্ড ৪৮ পৃঃ।
[6] কালবে জাযীরাতুল আরব ২৩১ পৃঃ।
[7] ইনি ঐ মুযায জুরহুমী নান যাঁর উল্লেখ ইসমাঈল (আঃ)-এর ঘটনাতে আছে।
[8] মাসউদী লিখেছেন যে, অতীতে পারস্যবাসীগণ খানায়ে ক্বা‘বার জন্য প্রচুর সম্পদ ও মোতি পাঠাতেন। সাসান বিন বাবুক সোনার তৈরি দুটি হরিণ, মুক্তার তরবারী এবং অনেক সোনা প্রেরণ করে। আমর সেই সবকে যমযম কূপে নিক্ষেপ করে দিয়েছিলেন। মুরাওাযযাহাব ১ম খন্ড ২০৫ পৃঃ।
[9] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১১৪-১১৫ পৃঃ।
[10] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৪ ও ১১৯-১২০ পৃঃ।
[11] ইয়াকুতঃ মাদ্দাহ মক্কা।
[12] আল্লামা খুযরী মুহাযাবাত ১ম খন্ড ৩৫ পৃঃ। ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১১৭ পৃঃ।
[13] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১১৭-১১৮ পৃঃ।
[14] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১১৭-১১৮ পৃঃ।
[15] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১১৭-১১৮ পৃঃ।
[16] রহামাতুল্লিল আলামীন ২য় খন্ড ৫৫পৃঃ।
[17] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১২৩-১২৪ পৃঃ।
[18] কালবে জাযীরাতুল আরব ২৩২ পৃঃ।
[19] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১২৫ পৃঃ
[20] মহাযাবাত খুযরী ১ম খন্ড ৩৬ পৃঃ এবং আখবারুল কিরাম ১৫১পৃঃ।
[21] মুহাযারাতে খুযরী ১ম খন্ড ৩৬ পৃঃ।
[22] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৩০ পৃঃ।
[23] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১২৯-১৩২, ১৩৭, ১৪২, ১৭৮-১৭৯ পৃঃ।
[24] তারীখে আবযুল কুরআন ২য় খন্ড ১০৪-১০৬ পৃঃ।
সমসাময়িক আরবের বিভিন্ন রাজ্য ও নেতৃত্ব প্রসঙ্গ (الحُكْـمُ وَالْإِمَـارَةُ فِي الْعَـرَبِ )
ইতোপূর্বে ক্বাহত্বানী ও আদনানীদের নিজ নিজ বাস্তুভিটা পরিত্যাগ করে যাওয়া সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে এবং এ সকল গোত্রের মাঝে যে আরব ভূ-খন্ড বণ্টিত হয়েছিল সে প্রসঙ্গও আলোচনা করা হয়েছে যে সবগুলো আরব রাষ্ট্রই সংগঠিত হয়েছিল এ সকল গোত্রের সমন্বয়ে। অধিকন্তু, তাঁদের নেতৃত্ব এবং দলপতিত্বের স্বরূপ এরূপ ছিল যে, যে সকল গোত্র হীরাহর আশপাশে বসবাসরত ছিল তাদেরকে হীরাহ বা ইরাক রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত ধরা হয়েছে এবং যে সকল গোত্র বাদিয়াতুস শামে বসতি স্থাপন করেছিলেন তাঁদেরকে গাসসানী শাসকদের অন্তর্ভুক্ত ধরা হয়েছে। এ সম্পর্কে যেভাবে যতটুকুই বলা হোকনা কেন, তা হবে শুধু কথার কথা। এ সকল গোত্র, উপগোত্র, তাঁদের বসবাস, দেশত্যাগ এবং দেশে পুনরাগমন সম্পর্কে কোন ঐতিহাসিক সূত্র কিংবা আলোচনাকেই চূড়ান্ত বলে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।
উপর্যুক্ত গোত্রসমূহ ছাড়া আরও যে সকল গোত্র দেশের অভ্যন্তরে বসবাস করত তাঁদের সম্পর্কেও কিছুটা আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। সকল দিক দিয়েই এ সব গোত্র স্বাধীন ছিল। এদের মধ্যে দলপতি ব্যবস্থা চালু ছিল। গোত্রের জনসাধারণ নিজেরাই তাদের দলপতি নির্বাচিত করত। তাঁরা নিজ গোত্রকে একটি ছোট রাষ্ট্র এবং গোত্রপতিকে রাষ্ট্রপ্রধানের মর্যাদা প্রদান করত। গোত্রীয় রাষ্ট্রের অস্তিত্ব, স্থিতিশীলতা ও অখন্ডতা, সার্বভৌমত্ব, গোত্রটি জনগণের নিরাপত্তা, বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করা ইত্যাদি সব ব্যাপারেই গোত্রীয় সম্মিলিতভাবে কাজ করত।
যে কোন গোত্র সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে যুদ্ধ ঘোষণা, যুদ্ধ পরিচালনা কিংবা সন্ধি-চুক্তি সম্পাদন করতে পারত। যুদ্ধ কিংবা শান্তি যে কোন অবস্থাতেই গোত্রের লোকজনকে গোত্র পতির নির্দেশ মেনে চলতে হতো, কোন অবস্থাতেই তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করা চলত না। এমনকি কোন কোন দলপতির অবস্থা এমনটিও হতো যে, যদি তিনি রাগান্বিত হতেন তাহলে তৎক্ষণাৎ সহস্রাধিক তলোয়ার কোষমুক্ত হয়ে যেত। সে ক্ষেত্রে জিজ্ঞাসার কোন অবকাশই থাকত না যে গোত্রপতির রাগান্বিত হওয়ার কারণটি কী?
কোন কোন ক্ষেত্রে আবার নেতৃত্বের প্রশ্নে দলপতির চাচাত ভাইদের সঙ্গে রেষারেষি এবং দ্বন্ধও শুরু হয়ে যেত। এ কারণে দলপতিকে কতগুলো নিয়ম বিধি মেনে চলতে হতো। সেগুলো হচ্ছে যথাক্রমে:
১. স্বগোত্রীয় লোকজনদের সঙ্গে কথাবার্তা এবং আলাপ আলোচনার ক্ষেত্রে দলপতিকে সংযমের পরিচয় দিতে হবে এবং উদার মনোভাব অবলম্বন করতে হবে।
২. রাষ্ট্রীয়- অর্থ সম্পদ ব্যয় করার ব্যাপারে তাঁকে মিতব্যয়ী হতে হবে। কোনক্রমেই তিনি প্রয়োজনাতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করবেন না।
৩. মেহমানদারী করার ব্যাপারে তাঁকে অগ্রনী ভূমিকা পালন করতে হবে।
৪. কাজকর্মের ক্ষেত্রে তাঁকে অবশ্যই দয়া ও ধৈর্যশীলতার সঙ্গে কাজকর্ম করতে হবে।
৫. গোত্রীয় বীরত্বের প্রতিভূ হিসেবে তাঁকে বীরত্বের বাস্তব নমুনা প্রদর্শন করতে হবে।
৬. যে কাজ করলে লজ্জিত হতে হবে এমন সব কাজকর্ম করা থেকে তাঁকে বিরত থাকতে হবে।
৭. সাধারণ লোকজনদের দৃষ্টিতে একটি কল্যাণমুখী সমাজ এবং বিশেষভাবে কবিগণের দৃষ্টিতে একটি সুন্দর ও চরমোৎকর্ষের পথে অগ্রসরমান সমাজ জীবনের জন্য অব্যাহতভাবে কাজ করে যেতে হবে। কবিগণকেই সমাজের মুখ্য মুখপাত্র মনে করা হতো। এভাবে গোত্রপতিকে তাঁর প্রতিদ্বন্ধীগণের তুলনায় উচ্চাসন বা উচ্চ মর্যাদা লাভের জন্য বিধিবদ্ধ আচরণ ধারার অনুসরণের অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে ন্যায়ভিত্তিক জীবন যাপন করতে হতো।[1]
দলপতিগণের নিকট থেকে সমাজ যেমন অনেক কিছু আশা করত, অপরপক্ষে তেমনি আবার সমাজ দলপতিগণের জন্য কিছু কিছু সুযোগ সুবিধারও ব্যবস্থা করত। সে সম্পর্কে জনৈক কবি তাঁর ছন্দ-সৌকর্যের মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন:
لك المِرْبَاع فينـا والصَّفَايا ** وحُكْمُك والنَّشِيْطة والفُضُوْل
‘‘আমাদের নিকটে তোমার জন্য গণীমতের সম্পদের এক চতুর্থাংশ (‘১/৪) এবং যা তুমি পছন্দ করবে এবং সেই মাল যার তুমি মীমাংসা করবে এবং বিনা পরিশ্রমে অর্জিত সম্পদ এবং বিলিবন্টন থেকে যা অবশিষ্ট রয়ে যাবে।’’
মিরবা’ : মালে গণীমতের এক চতুর্থাংশ (১/৪)
সফী : ঐ সম্পদ যা বন্টনের পূর্বেই দলপতি নিজের জন্য নির্ধারিত করে রাখেন।
নাশীতাহ : এ সম্পদ যা মৌলিকস্তর অর্থাৎ সাধারণ লোকজনের নিকট পৌঁছার পূর্বেই পথিমধ্যে দলপতি গ্রহণ করেন।
ফুযূল : ঐ সম্পদ যা গাজীদের সংখ্যানুপাতে বন্টন করা সম্ভব না হওয়ার কারণে অবশিষ্ট থেকে যায়। বন্টনের পর অবশিষ্ট উট ঘোড়া ইত্যাদি সম্পদ দলপতিগণের প্রাপ্য হয়ে থাকে।
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১২৯, ১৩২, ১৩৭, ১৪২, ১৭৮ ও ১৭৯ পৃষ্ঠা।
রাজনৈতিক অবস্থা (الحَالَةُ السِّيَاسِيَةُ):
আরব উপদ্বীপের গোত্রসমূহ এবং গোত্রপতিগণ সম্পর্কে ইতোপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। এখন সমসাময়িক রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করা প্রয়োজন বলে আমাদের বিশ্বাস।
আরব উপদ্বীপের তিন দিকের সীমান্তবর্তী দেশসমূহের রাজনৈতিক অবস্থা দারুণ অস্থিতিশীল, বিশৃঙ্খল এবং পতনোন্মুখ ছিল। সমাজের মানবগোষ্ঠী হয় মনিব, নয়তো দাস, কিংবা হয় রাজা, নয়তো প্রজা, এ দু’শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। মনিব, রাজা, দলপতি, নরপতি যে উপাধিতেই ভূষিত থাকুন না কেন, সমাজ-জীবনের যাবতীয় কল্যাণ বা সুযোগ-সুবিধা নির্ধারিত থাকত তাদেরই জন্য বিশেষ করে বহিরাগত নেতাদের জন্য। অপরপক্ষে, দলপতি বা নরপতিগণের যাবতীয় আরাম-আয়েশ, সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধির আয়োজন ও উপকরণাদির জন্য প্রাণপাত প্ররিশ্রম করতে হতো জনসাধারণ এবং দাসদাসীগণকে। আরও সহজ এবং সুস্পষ্টভাবে বললে বলা যেতে পারে যে, প্রজারা ছিল যেন শস্যক্ষেত্র স্বরূপ যেখান থেকে সংস্থান হতো রাষ্ট্রের যাবতীয় আয়-উপার্জনের। রাষ্ট্র নায়কগণ এ সকল উপার্জন তাঁদের ভোগ-বিলাস, কাম-প্রবৃত্তি চরিতার্থ এবং অন্যান্য নানাবিধ দুষ্কর্মে ব্যবহার করতেন। সাধারণ মানুষের ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছার কোনই মূল্য থাকতনা। শত ধারায় বর্ষিত হতে থাকত তাঁদের উপর অত্যাচার-উৎপীড়নের অগ্নিধারা। এক কথায়, স্বৈরাচারী শাসন বলতে যা বোঝায় তা চরমে পৌঁছেছিল সেই সব অঞ্চলে। কাজেই, অসহায় মানুষের মুখ বুজে সে সব সয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না।
সেসব অঞ্চলের আশপাশে বসবাসকারী গোত্রগুলোকেও মাঝে মাঝে এসব অনাচার উৎপীড়নের শিকার হতে হতো। উল্লেখিত স্বৈরাচারী দলপতিগণের ভোগলিপ্সা, স্বার্থান্ধতা এবং অর্থহীন অহংবোধের বিষ-বাষ্পে বিপর্যন্ত হয়ে তাঁদেরকে ছুটে বেড়াতে হতো দিগ্বিদিকে। এ দলপতিগণ তাঁদের হীন স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে আরও একটু অগ্রসর হয়ে কখনো ইরাকীদের হাতকে শক্তিশালী করত, কখনো বা তাল মিলিয়ে চলত শামবাসীদের সঙ্গে।
যে সকল গোত্র আরব ভুখন্ডের অভ্যন্তরভাগে বসবাস করত তাদের জীবনযাত্রার ক্ষেত্রেও নানাবিধ সমস্যা এবং বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করত। গোত্রে গোত্রে বিবাদ-বিসম্বাদ, বংশপরম্পরাগত শত্রুতা, ধর্মীয় মতবিরোধ, গোষ্ঠিগত বিদ্বেষ ইত্যাদি নানাবিধ কারণে পরিবেশ থঅকত উত্তপ্ত। প্রত্যেক গোত্রের লোকজন সর্বাবস্থায় নিজ নিজ গোত্রের পক্ষে থাকত, তা সত্যের উপর বা বাতিলের উপর যা-ই হোক না কেন। প্রতিষ্ঠিত হোক তা যাচাই বাছাইর্য়ের কোন প্রশ্নই থাকত না। যেমনটি তাদের মুখপত্রে বলা হয়েছেঃ
وما أنا إلا من غَزَِّية إن غَوَتْ ** غويت، وإن ترشد غزية أرشد
‘আমিও তো গাযিয়া গোত্রের একজন। যদি সে ভ্রান্ত পথে চলে তবে আমিও ভ্রান্ত পথে চলব এবং যদি সে সঠিক পথে চলে তবে আমিও সঠিক পথে পরিচালিত হব।
আরবের অভ্যন্তরে এমন কোন পরিচালক ছিলেন না যিনি তাঁদের কণ্ঠকে শক্তিশালী করবেন এবং এমন কোন আশ্রয়স্থল ছিল না বিপদ-আপদ কিংবা সমস্যা -সংকুল সময়ে যেখানে তাঁরা আশ্রিত হতে পারবেন এবং প্রয়োজনে যার উপর তাঁরা নির্ভরশীল হতে পারবেন।
তবে হ্যাঁ, এটা নিঃসন্দেহ যে, উপদ্বীপ রাষ্ট্র হিজাযকে কোন মতে সম্মানের আসনে আসীন বলে মনে করা হতো এবং ধর্মকেন্দ্র ও ধর্মীয় আচার-আচরণের পরিচালক ও রক্ষক হিসেবে ধারণা করা হতো। প্রকৃতপক্ষে এ রাষ্ট্র ছিল পার্থিব পরিচালন ও ধর্মীয় পুরোহিত তত্ত্ববিদদের এক এক প্রকার মিশ্রিত রূপ। এর দ্বারা আরববাসীদের উপর ধর্মীয় পরিচালনার নামে তাঁদের মর্যাদার উচ্চাসন অর্জিত হতো এবং হারাম শরীফ ও হারাম শরীফের আশ-পাশের শাসন কাজ নিয়মিত পরিচালিত হতো। তাঁরাই বায়তুল্লাহর পরিদর্শকগণের জন্য প্রয়োজন পরিপূরণের ব্যবস্থাপনা এবং ইবরাহীম শরীয়তের হুকুম আহকাম চালু রাখার ব্যবস্থা করতেন। কিন্তু এ রাষ্ট্র এতই দুর্বল ছিল যে, আরবের যাবতীয় আভ্যন্তরীণ দায়-দায়িত্বের গুরুভার বহনের ক্ষমতা তার ছিল না। এ সত্যটি হাবশীদের আক্রমণের সময় সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়ে যায়।
ফুটনোটঃ
আরবে ধর্মকর্ম এবং ধর্মীয় মতবাদ প্রসঙ্গে (دِيَانَاتُ الْعَـرَبِ):
আরবে বসবাসকারী সাধারণ লোকজন ইসমাঈল (আঃ)-এর দাওয়াত ও প্রচারের ফলে ইবরাহীম (আঃ) প্রচারিত দ্বীনের অনুসারী ছিলেন। এ কারণেই তাঁরা ছিলেন আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী এবং একমাত্র আল্লাহরই উপাসনা করতেন। কিন্তু কাল প্রবাহে ক্রমান্বয়ে তাঁরা আল্লাহর একত্ববাদ এবং খালেস দ্বীনী শিক্ষার কোন কোন অংশ ভুলে যেতে থাকেন, কিংবা সে সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়েন। কিন্তু এত সব সত্ত্বেও আল্লাহর একত্ববাদ এবং দ্বীনে ইবরাহীম (আঃ)-এর কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য অবশিষ্ট থেকে যায় যে পর্যন্ত বনু খুযা’আহ গোত্রের সর্দার ‘আমর বিন লুহাই জন সমক্ষে এসে উপস্থিত না হন। ধর্মীয় মতাদর্শের লালন ও পরিপোষণ, দান খয়রাত এবং ধর্মীয় বিষয়াদির প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগের কারণে লোকজন তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধাপোষণ করতে থাকেন। অধিকন্তু, তাঁকে বড় বড় আলেম এবং সম্মানিত অলীদের দলভুক্ত ধরে নিয়ে তাঁর অনুসরণ করতে থাকেন।
এমন অবস্থার এক পর্যায়ে তিনি শাম দেশ ভ্রমণে যান এবং সেখানে গিয়ে মূর্তি পূজা-অর্চনার জাঁকালো চর্চা প্রত্যক্ষ করেন। শাম দেশ বহু পয়গম্বরের জন্মভূমি এবং আল্লাহর বাণী নাযিলের ক্ষেত্র হওয়ায় ঐ সকল মূর্তি পূজাকে তিনি অধিকতর ভাল এবং সত্য বলে ধারণা করেন। তাই দেশে প্রত্যাবর্তনের সময় তিনি ‘হুবল’ নামক মূর্তি সঙ্গে নিয়ে আসেন এবং খানায়ে ক্বাবা’হর মধ্যে তা রেখে দিয়ে পূজো অর্চনা শুরু করেন। সঙ্গে সঙ্গে মক্কাবাসীগণকেও পূজা করার জন্য আহবান জানান। মক্কাবাসীগণ তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে মূর্তি হোবলের পূজা করতে থাকেন। কাল-বিলম্ব না করে হিজাযবাসীগণও মক্কাবাসীগণের পদাংক অনুসরণ করতে থাকেন। কারণ, তাঁরাও এক কালে বায়তুল্লাহর অভিভাবক এবং হারামের বাসিন্দা ছিলেন।[1] এভাবে একত্ববাদী আরববাসী অবলীলাক্রমে মূর্তিপূজার মতো এক অতি জঘণ্য এবং ঘৃণিত পাপাচার ও দুষ্কর্মে লিপ্ত হয়ে পড়েন। এভাবে আরব ভূমিতে মূর্তিপূজার গোড়াপত্তন হয়ে যায়।
হুবাল ছিল মানুষের আকৃতিতে তৈরী লাল আকীক পাথর নির্মিত মূর্তি। তার ডান হাত ভাঙ্গা ছিল। কুরাইশগণ হুবালকে এ অবস্থাতেই প্রাপ্ত হয় এবং পরে তারা উক্ত হাতকে স্বর্ণ দিয়ে মেরামত করে। এটাই ছিল মুশরিকদের প্রথম এবং সবচেয়ে বড় ও সম্মানিত মূর্তি।
‘হুবাল’ ছাড়া আরবের প্রাচীনতম মূর্তিগুলোর মধ্যে ছিল ‘মানাত’ মূর্তি। এটি ছিল বনু হুযাইল ও বনু খুযা’আহর উপাস্য। লোহিত সাগরের তীরে কুদাইদ নামক ভূখন্ডের সন্নিকটস্থ মুসাল্লাল নামক স্থানে তা প্রতিষ্ঠিত ছিল।[2] মুশাল্লাল হল পাহাড় থেকে নেম আসা একটি সরু পথ যা কুদাইদের দিকে চলে গেছে। অতঃপর ‘লাত’ মূর্তিকে ত্বায়িফবাসী উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করে। এটি ছিল বনু সাক্বীফ গোত্রের উপাস্য এবং তা তাফিয়ের মসজিদের বামপাশে মিনারের নিকট স্থাপিত ছিল। এরপর ‘যাতে ইরক’ এর উচ্চভূমি শামের নাখলাহ নামক উপত্যকায় ‘উযযা’ নামক মূর্তির পূজা চলতে থাকে। এ মূর্তি ছিল কুরাইশ, বনু কিনানাহসহ অন্যান্য অনেক গোত্রের উপাস্য।
এ তিনটি ছিল আরবের সব চাইতে বড় এবং বিখ্যাত মূর্তি। এর পর হিজাযের বিভিন্ন অংশে শিরক ও মূর্তি পূজার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটতে থাকে।
কথিত আছে যে এক জিন ‘আমর বিন লুহাই এর অনুগত ছিল। সে বলল যে, নূহ সম্প্রদায়ের মূর্তি ওয়াদ্দ, সুওয়া, ইয়াগুস, ইয়াউক্ব এবং নাসর জিদ্দার ভূমিতে প্রোথিত রয়েছে। এ মূর্তির খোঁজ পেয়ে আমর বিন লুহাই জিদ্দায় যান এবং মাটি খনন করে মূর্তিগুলোকে বাহির করেন। তারপর সেগুলোকে তুহামায় নিয়ে যান এবং পরবর্তী হজ্জ মৌসুমে মূর্তিগুলো বিভিন্ন গোত্রের হাতে তুলে দেন। এভাবে একেকটি মূর্তি গোত্রগুলোর অধিকারে এসে যায়। পরবর্তী পর্যায়ে বিভিন্ন গোত্রের জন্য নির্ধারিত মূর্তিসমূহের বর্ণনা নিম্নরুপ :
ওয়াদ্দ : এ মূর্তি হলো ‘বনু কালব’ এর আরাধ্য মূর্তি। যারা ইরাকের নিকটবতী শামের অন্তর্গত দাওমাতুল জান্দালের জারাশ নামক স্থানের বাসিন্দা।
সুওয়া’ : এ মূর্তি হলো হিযাজের রুহাতৃ নামক স্থানের বনু হুযাইল বিন মুদরিকাহ’র। এ স্থান মক্কার নিকটবর্তী সাহিলের দিকে অবস্থিত।
ইয়াগুস : সাবার নিকটস্থ যুরফ নামক স্থানের বনু গুত্বাইফের মুরাদ গোত্রের উপাস্য।
ইয়াউক্ব : ইয়ামানের খাইওয়ান বস্তির বনু হামদানের মূর্তি। খাইওয়ান হলো হামদানের শাখাগোত্র।
নাসর : হিমইয়ার নামক স্থানের হিমইয়ারীদের অন্তর্গত আলে যুল কিলা’র উপাস্য।
তারা এসকল মূর্তির উপর ঘর নির্মাণ করে এগুলোকে কাবাহর মতো সম্মান করতো ও তাতে গিলাফ দিয়ে ঢেকে দিত। কাবাহতে হাদী বা কুরবানির পশু প্রেরণের মতো ঐসব তাগুতের সম্মানার্থে তারা সেখানেও হাদী প্রেরণ করতো এগুলোর উপর কা’বাহর শ্রেষ্ঠত্ব জানা সত্ত্বেও।
আর এ সকল পথে যেসব গোত্র যাতায়াত করতো তারাও এগুলোর ন্যায় মূর্তি বানিয়ে অনুরূপ গৃহ নিৰ্মাণ করে। এগুলোর মধ্যে যুল খালাসাহ হলো দাওস, খাস’আম ও বুজাইলাহ গোত্রের মূর্তি। তারা ছিল মক্কা ও ইয়ামান এর মধ্যবতী তাবালাহ স্থানের অধিবাসী। ফিলস হলো বনু তাই এবং তাই এর দু’টি পাহাড়- সালামাহ ও আযা’র নিকটে বসবাসকারী লোকেদের মূর্তি। এরকমই একটি হলো রিয়াম। যা ইয়ামান ও হিমইয়ার বাসীর জন্য সন’আয় নির্মিত একটি উপাসনা ঘর। রাযা- বনু রাবী’আহ বিন কা’ব বিন সা’দ বিন যায়দ ও মানাত বিন তামীম এর উপাসনা ঘর। কায়াবাত ওয়ায়িলের দু’পুত্র বাকর ও সানদাদের তাগলিব গোত্রের।
দাওসের যুল কাফফাইন নামক আরেকটি মূর্তি ছিল। বনু বাকর, বনু মালিক, বনু মালকান- যারা কেনানাহর বংশধর তাদের সা’দ নামক আরেকটি মূর্তি ছিল। উযরাহ গোত্রের একটি মূর্তি ছিল যাকে বলা হতো শামস এবং বনু খাওলানের গুমইয়ানিস নামক একটি মূর্তি ছিল।
এভাবে মূর্তি ছড়িয়ে পড়তে পড়তে একসময় সমগ্র আরব উপদ্বীপ মূর্তিতে ছেয়ে যায়। এমনকি শেষ পর্যন্ত প্রত্যেক গোত্র ও ঘরে ঘরে তা স্থান করে নেয়। তারপর মক্কার মুশরিকগণ একের পর এক মূর্তি দিয়ে মসজিদুল হারামকেও পরিপূর্ণ করে তোলেন। কথিত আছে যে, মক্কা বিজয়ের পূর্বে মসজিদুল হারামে ৩৬০টি মূর্তি ছিল। মক্কা বিজয়ের পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার লাঠি দিয়ে মূর্তিগুলোকে ধ্বংস করেছিলেন। একের পর এক তিনি যখন মূর্তিগুলোকে লাঠি দিয়ে আঘাত করছিলেন তখন সেগুলো পড়ে যাচ্ছিল। তারপর তিনি সেগুলোকে মসজিদুল হারামের বাইরে নিয়ে গিয়ে জ্বালিয়ে দেয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন এবং তা জ্বালিয়ে দেয়া হয়[3]। অধিকন্তু কা’বাহর অভ্যন্তরভাগে কিছু মূর্তি ও ছবি ছিল। তার মধ্যে একটি হলো ইবরাহীম (আঃ) ও অপরটি হলো ইসমাঈল (আঃ) আকৃতিতে তৈরি। এ উভয় মূর্তির হাতে ভাগ্য নির্ণায়ক তীর ছিল। মক্কা বিজয়ের দিন এসব মূর্তিকে নিশ্চিন্ন করে দেয়া হয় এবং ছবিগুলোকে মুছে দেয়া হয়।
এসব মূর্তির ব্যাপাবে মানুষ গভীর তমসাচ্ছন্ন ও বিভ্রান্তিতে ছিল। এমনকি আবূ রাযা উতারিদী (রা.) বলেন, ‘আমরা পাথরের পূজা করতাম। অতঃপর যখন এর চেয়ে ভাল মানের পাথরের সন্ধান পেতাম তখন আগেরটির পূজা পরিত্যাগ করে এবং নতুন পাথরটির পূজা আরম্ভ করে দিতাম। আবার পূজা করার মতো কোন পাথর না পেলে কিছু মাটি স্তুপাকারে একত্রিত করতাম। তারপর দুদ্ধবতী ছাগল নিয়ে ঐ স্তুপের উপর দোহন করে তা ত্বাওয়াফ করতাম।
মোট কথা মূর্তিপূজা ও অংশীবাদিতা দ্বীনের ক্ষেত্রে সব চেয়ে নিকৃষ্ট অনাচার এবং পাপাচার হওয়া সত্ত্বেও তৎকালীন আরববাসীগণের অসার অহংকার ও ভ্রান্ত ধারণা ছিল যে, তারা দ্বীনে ইবরাহীম (আঃ)-এর উপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।
এ জঘণ্য শিরক ও মূর্তিপূজা চালু হওয়া এবং লোকেদের মাঝে বিস্তার লাভের কিছু প্রেক্ষাপট রয়েছে তা হলো : যখন তারা ফেরেশতা, নাবী-রাসূল ও ওলী-আওলীয়া, পরহেযগার-দ্বীরদার এবং ভালকাজে প্রতিষ্ঠিত সৎকর্মশীল লোকদেকে প্রত্যক্ষ করল এবং এও প্রত্যক্ষ করল যে, তারা হলেন আল্লাহর প্রিয় সৃষ্টি, সম্মান-মর্যাদায় আল্লাহর প্রিয়পাত্র এতদসত্ত্বেও যখন তাদের হাতে বিশেষ কোন কারামাত প্রকাশ পেল এবং এমন অসম্ভব কাজ সম্পন্ন হলো যা সাধারণত মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় তখন তারা মনে করল যে, আল্লাহ তাআলা ঐ সকল লোকের হাতে তার কিছু ক্ষমতা, কুদরত ও নিজেদের ইচ্ছেমত কিছু করার শক্তি দান করার মাধ্যমে তাদেরকে বিশেষত্ব দান করেছেন। আর তাদের এ ক্ষমতা ও মর্যাদার কারণে তারা আল্লাহ তাআলা ও সাধারণ মানুষের মাঝে মধ্যস্ত তা ও করার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। সুতরাং এ সকল ব্যক্তি বা বস্তুর মাধ্যম ব্যতীত কারও পক্ষে আল্লাহর দরবারে সরাসরি নিজেদের প্রয়োজন বা আবেদন-নিবেদন পেশ করা সম্ভব নয় এবং তাদের মর্যাদার কারণে আল্লাহ তাআলা তাদের সুপারিশকে ফিরত দেন না। ঠিক অনুরূপভাবে ঐ সব ব্যক্তি বা বস্তুর মাধ্যম ব্যতিত আল্লাহর কোন ইবাদতও প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয়। কেননা তারা বিশেষ মর্যাদার বলে তাকে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করিয়ে দেবে।
তাদের মাঝে এ ধারণা যখন বদ্ধমূল হলো ও তাদের মনে তা স্থায়ী আসন লাভ করল তখন ঐ সব ব্যক্তি বা বস্তুকে তাদের অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করে আল্লাহ ও নিজেদের মাঝে মধ্যস্ততাকারী সাব্যস্ত করল এবং প্রভুর নিকট নৈকট্যলাভের যাবতীয় বিষয়কে তাদের দায়িত্বে ছেড়ে দিল। অতঃপর তাদের সম্মানার্থে তাদের ছবি, ভাষ্কর্য ও প্রতিমা তৈরি করল। এসকল ছবি ও প্রতিমা কখনোও তাদের উদ্দিষ্ট ব্যক্তির হুবহু আকৃতিতে তৈরি করতো। আবার কখনো তাদের খেয়াল-খুশিমতো আকৃতি দিয়ে তৈরি করতো। অতঃপর এসব ছবি ও প্রতিমাকেই তারা উপসনার যোগ্য মূর্তি বলে নামকরণ করতো।
কখনো তারা এসবের ছবি বা প্রতিমা তৈরি করতো না বটে তবে তাদের কবর বা সমাধিস্থল, বাসস্থান, অবতরণস্থল বা বিশ্রামস্থলকে পবিত্রতম স্থান হিসেবে দিয়ে সেগুলোর উদ্দেশ্যে মানত ও নযর নিয়ায ইত্যাদি উৎসর্গ করতো। আর সেখানে তারা খুব বিনয় ও আনুগত্য প্রকাশ করতো এবং তাদের ঐসব স্থানকে তারা মূর্তির নামে নামকরণ করতো। এ দিকে আবার জাহেলিয়া যুগের লোকজনদের মূর্তি পূজার বিশেষ বিশেষ রীতি পদ্ধতিও প্রচলিত ছিল। এসবের অধিকাংশই ‘আমর বিন লোহায়েরই মন গড় তৈরি। ইবনে লুহাই প্রবর্তিত মূর্তিপূজকের দল মনে করত যে, দ্বীনের ক্ষেত্রে তিনি যে রীতিপদ্ধতির কথা বলেছেন তা ইবরাহীম (আঃ) প্রবর্তিত দ্বীন এর পরিবর্তন কিংবা বিলোপসাধন নয়। বরং সেটা হচ্ছে ভালোর জন্য কিছু কিছু নবতর সংযোজনের মাধ্যমে সর্বযুগের সকল মানুষের উপযোগী একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান প্রবর্তন। জাহেলিয়াত যুগের লোকেরা তাদের মন গড়া দ্বীনের ক্ষেত্রে যে রীতি পদ্ধতির প্রচলন করে নিয়েছিলেন তা হচ্ছে যথাক্রমে নিম্নরূপ :
১. মূর্তিপূজকগণ দরগার খাদেমের মতো মূর্তির পাশে বসে তাদের নিকট আশ্রয় অনুসন্ধান করতেন, উচ্চকণ্ঠে তাদের আহবান জানাতেন, অভাব মোচন ও বিপদাপদ হতে উদ্ধারের জন্য অনুনয় বিনয় সহকারে তাদের নিকট প্রার্থনা জানাতেন। প্রার্থনাকারীগণ মনে করতেন যে, মূর্তিরূপী এ সকল দেবদেবী তাঁদের প্রার্থনা করার জন্য আল্লাহর নিকটে সুপারিশ পেশ করবে যা তাদের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে।
২. তাঁরা মূর্তির উদ্দেশ্যে হজ্জ সম্পন্ন করতেন, মূর্তিকে তাওয়াফ এবং সিজদাহহ করতেন এবং তাদের সামনে অত্যন্ত ভক্তি ও বিনয়াবনত আচরণ করতেন।
৩. মূর্তিদের জন্য বিভিন্ন প্রকারের মানত এবং কুরবাণী উৎসর্গ করা হতো। উৎসর্গীকৃত জীবজানোয়ারগুলোকে মূর্তির বেদীমূলে তার নাম নিয়ে জবেহ করা হতো। ঘটনাক্রমে অন্য কোথাও জবেহ করা হলেও মূর্তির নাম নিয়েই তা করা হতো। তাঁদের এ উসর্গীকৃত পশু জবেহ করা প্রসঙ্গে দুটি রীতির কথা আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদের মধ্যে উল্লেখ করেছেন:
{وَمَا ذُبِحَ عَلَى النُّصُبِ} [المائدة: 3]
‘‘ আর যা কোন আস্তানায় (বা বেদীতে) যবহ করা হয়েছে।’’ (মায়িদা ৫ : ৩)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে:
:{وَلاَ تَأْكُلُوْا مِمَّا لَمْ يُذْكَرِ اسْمُ اللهِ عَلَيْهِ} [الأنعام:121]
‘‘যাতে (যবহ করার সময়) আল্লাহর নাম নেয়া হয়নি তা তোমরা মোটেই খাবে না।’’ (আল আন‘আম ৬ : ১২১)
৪. মূর্তি পূজকগণ পূজার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে খাদ্য ও পানীয় দ্রব্যের কিছু অংশ, উৎপাদিত শস্যাদি এবং পালিত পশুদলের কিছু অংশ মূর্তির জন্য নির্দিষ্ট করে রাখত। এ ক্ষেত্রে আরও একটি আকর্ষণীয় ও প্রনিধানযোগ্য ব্যাপার ছিল, উৎপাদিত শস্যাদি এবং পালিত পশুদলের কিছু অংশ আল্লাহর নামেও নির্দিষ্ট করে রাখা হতো। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এমনটি হতে দেখা যেত যে আল্লাহর নির্দিষ্ট করে রাখা দ্রব্যাদি মূর্তির জন্য রেখে দেয়া দ্রব্যাদির সঙ্গে মিশিয়ে তা মূর্তির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে দেয়া হতো, কিন্তু মূর্তির জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা দ্রব্যাদির সঙ্গে মিশিয়ে কখনই তা আল্লাহর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হতো না। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন:
{وَجَعَلُوْا لِلهِ مِمِّا ذَرَأَ مِنَ الْحَرْثِ وَالأَنْعَامِ نَصِيْبًا فَقَالُوْا هٰذَا لِلهِ بِزَعْمِهِمْ وَهَـذَا لِشُرَكَآئِنَا فَمَا كَانَ لِشُرَكَآئِهِمْ فَلاَ يَصِلُ إِلَى اللهِ وَمَا كَانَ لِلهِ فَهُوَ يَصِلُ إِلٰى شُرَكَآئِهِمْ سَاء مَا يَحْكُمُوْنَ}[الأنعام:136]
‘‘ আল্লাহ যে শস্য ও গবাদি পশু সৃষ্টি করেছেন তাত্থেকে তারা আল্লাহর জন্য একটা অংশ নির্দিষ্ট করে আর তারা তাদের ধারণামত বলে এ অংশ আল্লাহর জন্য, আর এ অংশ আমাদের দেবদেবীদের জন্য। যে অংশ তাদের দেবদেবীদের জন্য তা আল্লাহর নিকট পৌঁছে না, কিন্তু যে অংশ আল্লাহর তা তাদের দেবদেবীদের নিকট পৌঁছে। কতই না নিকৃষ্ট এ লোকদের ফায়সালা!’’ (আল আন‘আম ৬ : ১৩৬)
৫. মূর্তির নৈকট্য লাভের আরও একটি রীতি ছিল যে, মুশরিকগণ শস্যাদি এবং চতুষ্পদ জন্তুর মধ্যে বিভিন্ন প্রকৃতির মানত মানতো আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেনঃ
{وَقَالُوْا هٰـذِهِ أَنْعَامٌ وَحَرْثٌ حِجْرٌ لاَّ يَطْعَمُهَا إِلاَّ مَنْ نَّشَاءُ بِزَعْمِهِمْ وَأَنْعَامٌ حُرِّمَتْ ظُهُوْرُهَا وَأَنْعَامٌ لاَّ يَذْكُرُوْنَ اسْمَ اللهِ عَلَيْهَا افْتِرَاءً عَلَيْهِ} [ الأنعام:138].
‘তারা তাদের ধারণা অনুসারে বলে, এ গবাদি পশু ও ফসল সুরক্ষিত। আমরা যার জন্য ইচ্ছে করব সে ছাড়া কেউ এগুলো খেতে পারবে না। এ সব তাদের কল্পিত। কিছু গবাদি পশুর পিঠে চড়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে, কিছু গবাদি পশু যবহ করার সময় তারা আল্লাহর নাম নেয় না।’ [আল আন‘আম (৬) : ১৩৮]
৬. সে সব চতুষ্পদ জন্তুগুলোর মধ্যে ‘বাহীরা, সায়িবাহ, ওয়াসীলা এবং হামী’ নামে পশু ছিল।
সাঈদ বিন মুসায়্যিব বলেন, ‘বাহীরাহ’ হল এমন উল্লী যার স্তনকে মূর্তির নামে উৎসর্গ করা হয়েছে। সুতরাং কোন মানুষ তার থেকে দুধ দোহন করতো না। ‘সায়িবাহ’ এমন উষ্ট্রী যা দেবদেবীর নামে ছেড়ে দিত। ফলে কেউ তাতে আরোহন করতো না। ‘ওয়াসিলাহ’ বলা হয় এমন উষ্ট্রীকে যার প্রথম গর্ভ থেকে স্ত্রী উট জন্ম নেয়। অতঃপর দ্বিতীয়বারও স্ত্রী উট জন্ম নেয়। মাঝখানে পুরুষ উট না জন্মে এরকম পরপর স্ত্রী উট জন্ম নিলে তারা সে উটকে মূর্তির নামে ছেড়ে দিত। ‘হামী’ বলা হয় এমন পুরুষ উটকে যার বীজ দ্বারা দশটি উষ্ট্রীর গর্ভধারণ হয়েছে। সংখ্যা পুর্ণ হলে ঐ উটকে দেবদেবীর নামে ছেড়ে দিত। ঐ উটের উপর কেউ আরোহন করতো না।
ইবনে ইসহাক্ব বলেন যে, ‘বাহীরা’ সায়্যিবাহরই’ মেয়ে সন্তানকে বলা হয় এবং সেই উটকে ‘সায়িবাহ’ বলা হয় যার গর্ভ থেকে দশ বার কন্যা সন্তান ভূমিষ্ট হয়েছে, এর মধ্যে কোন পুত্র সন্তান ভূমিষ্ট হয় নি। এমন অবস্থা বা প্রকৃতির উটকে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেয়া হতো। এর পৃষ্ঠদেশে কেউ আরোহণ করত না, এর লোম কর্তন করত না এবং মেহমান ব্যতীত অন্য কেউই তার দুগ্ধ পান করত না।
এরপর সেই উট যখন মেয়ে সন্তান প্রসব করত তখন তাঁর কান চিরে দেয়া হতো এবং তাকেও তার মায়ের সঙ্গে মুক্তভাবে চলা ফেরার জন্য ছেড়ে দেয়া হতো। এর পৃষ্ঠদেশে কেউ সওয়ার হতো না, তার লোম কাটা হতো না এবং মেহমান ব্যতীত অন্য কেউই তা দুগ্ধও পান করত না। একে বলা হতো ‘বাহীরা’ এবং তার মাকে বলা হতো ‘সায়িবাহ’।
‘ওয়াসীলাহ’ বলা হতো সেই ছাগীকে যে ছাগী একাদিক্রমে দুটি দুটি করে পাঁচ দফায় দশটি কন্যা সন্তান প্রসব করে এবং এর মধ্যে কোন পুত্র সন্তান প্রসব করে না। সেই ছাগীকে এ কারণে ওয়াসীলা বলা হয় যে, সে তার সবগুলো মেয়ে সন্তানকে একে অন্যের সঙ্গে জড়িয়ে দিয়েছে। এর পর সেই ছাগী যে বাচ্চা প্রসব করবে তাকে শুধু পুরুষ লোকেরাই খেতে পারবে, মহিলারা খেতে পারবে না। তবে যদি তা কোন মৃত বাচ্চা প্রসব করে তবে পুরুষ এবং মহিলা সকলেই তা খেতে পারবে।
সেই উটকে ‘হামী’ বলা হয় যার প্রজননের মাধ্যমে পর পর একাদিক্রমে দশটি কন্যা সন্তান জন্মলাভ করেছে এবং এ সবের মধ্যে কোন পুত্র সন্তান জন্মলাভ করে নি। এ জাতীয় উষ্ট্রের পৃষ্ঠদেশ সংরক্ষিত থাকত, অর্থাৎ এর প্রষ্ঠদেশে আরোহণ নিষিদ্ধ ছিল। এর লোমও কর্তন করা হতো না। শুধুমাত্র প্রজননের উদ্দেশ্যে উটের পালের মধ্যে ওকে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেয়া হতো, অন্য কোন কাজে ওকে ব্যবহার করা হতো না। জাহেলিয়াত আমলের মূর্তি পূজার সেই সকল রীতি পদ্ধতির প্রতিবাদ করে আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেনঃ
{مَا جَعَلَ اللهُ مِنْ بَحِيْرَةٍ وَلاَ سَآئِبَةٍ وَلاَ وَصِيْلَةٍ وَلاَ حَامٍ وَلٰـكِنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا يَفْتَرُوْنَ عَلَى اللهِ الْكَذِبَ وَأَكْثَرُهُمْ لاَ يَعْقِلُوْنَ} [المائدة:103]
‘আল্লাহ না নির্দিষ্ট করেছেন বাহীরাহ্, না সাইবাহ্, না ওয়াসীলাহ্, না হাম বরং যারা কুফুরী করেছে তারাই আল্লাহর নামে মিথ্যা আরোপ করে তা আবিষ্কার করেছে, তাঁদের অধিকাংশই নির্বোধ। ’’ (আল-মায়িদাহ ৫ : ১০৩)
{وَقَالُوْا مَا فِيْ بُطُوْنِ هٰـذِهِ الأَنْعَامِ خَالِصَةٌ لِّذُكُوْرِنَا وَمُحَرَّمٌ عَلٰى أَزْوَاجِنَا وَإِن يَكُن مَّيْتَةً فَهُمْ فِيْهِ شُرَكَاء} [ الأنعام:139]
‘তারা আরো বলে, এ সব গবাদি পশুর গর্ভে যা আছে তা খাস করে আমাদের পুরুষদের জন্য নির্দিষ্ট, আর আমাদের স্ত্রীলোকদের জন্য নিষিদ্ধ, কিন্তু তা (অর্থাৎ গর্ভস্থিত বাচ্চা) যদি মৃত হয় তবে সকলের তাতে অংশ আছে। তাদের এ মিথ্যে রচনার প্রতিফল অচিরেই তিনি তাদেরকে দেবেন, তিনি বড়ই হিকমাতওয়ালা, সর্বজ্ঞ।’’ (আল-আন‘আম ৬ : ১৩৯)
যেভাবে উল্লেখিত পশুগুলোর বর্ণনা দেয়া হয়েছে, যেমন- বাহীরা, সায়িবাহ ইত্যাদি এবং এ ছাড়া আরও বর্ণনা করা হয়েছে[4] তা ইবনে ইসহাক্বের উল্লেখিত ব্যাখ্যার কিছু বিপরীত এবং কিছুটা অন্য ধরণের বলে মনে হয়। সাঈদ বিন মুসাইব (আঃ) কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যে, এ পশুগুলো মুশরিকদের তাগুত মূর্তি সমূহের জন্য ছিল।[5]
বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন :
(رَأَيْتُ عُمَرَو بْنَ عَامِرِ بْنِ لُحَى الْخُزَاعِى يَجُرُّ قَصَبَهُ [أَيْ أَمْعَاءَهُ ] فِي النَّارِ)
‘‘আমি আমর বিন লুহাইকে জাহান্নামের মধ্যে তার নাড়ি-ভুড়ি টানতে দেখেছি।’’ কেননা ‘আমর বিন লুহাই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি ইবরাহীম (আঃ)-র দ্বীনে পরিবর্তন আনয়ন এবং মূর্তির নামে চতুষ্পদ জন্তু উৎসর্গ করার ব্যবস্থা করেছিলেন।[6]
আরববাসীগণ মূর্তিকে কেন্দ্র করে এতসব কিছু করত এ বিশ্বাসে যে, আল্লাহর নৈকট্য লাভে এরা তাদেরকে সাহায্য করবে। যেমনটি কুরআন কারীমে বলা হয়েছে যে,
{مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُوْنَا إِلَى اللهِ زُلْفٰى} [الزمر: 3]
(মুশরিকগণ বলত) ‘আমরা তাদের ‘ইবাদাত একমাত্র এ উদ্দেশেই করি যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর নৈকট্যে পৌঁছে দেবে।’’ (আয-যুমার ৩৯ : ৩)
আরও ইরশাদ হয়েছেঃ
{وَيَعْبُدُوْنَ مِن دُوْنِ اللهِ مَا لاَ يَضُرُّهُمْ وَلاَ يَنفَعُهُمْ وَيَقُوْلُوْنَ هَـؤُلاء شُفَعَاؤُنَا عِندَ اللهِ} [يونس:18]
‘‘আর তারা আল্লাহকে ছেড়ে ‘ইবাদাত করে এমন কিছুর যা না পারে তাদের কোন ক্ষতি করতে, আর না পারে কোন উপকার করতে। আর তারা বলে, ‘ওগুলো আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশকারী।’’ (ইউনুস ১০ : ১৮)
আরবের মুশরিকগণ ‘আযলাম’ অর্থাৎ কথন সম্পর্কে ফলাফল নির্ণয়ের জন্য তীরও ব্যবহার করত (আযলাম হচ্ছে যালামুন এর বহু বচন এবং যালাম ঐ তীরকে বলা হয় যার উপর পালক লাগানো হতো না)। ভবিষ্যৎ কথন সম্পর্কিত ফলাফল নির্ণয়ের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত তীরগুলো ছিল তিন প্রকারের:
প্রথম : এ শ্রেণীভুক্ত তীরগুলোর গায়ে (نعم) ‘হ্যাঁ’’ কিংবা (لا) না অথবা (غفل) ‘ব্যর্থ’ লেখা থাকত। এ শ্রেণীভুক্ত তীরগুলো সাধারণত ভ্রমণ, বিয়ে-শাদী এবং অনুরূপ অন্য কোন কার্যোপলক্ষ্যে ব্যবহৃত হতো। বিশেষ একটি পদ্ধতিতে তীর বাছাই পর্ব সম্পাদিত হতো। কর্মপন্থা নির্ণয়ের উদ্দেশ্যে বাছাইকৃত তীর গোত্রে ‘হ্যাঁ’’ লেখা থাকলে পরিকল্পিত কাজ আরম্ভ করা হতো। কিন্তু বাছাই করতে গিয়ে ‘না’’ লিখিত তীর বাহির হলে পরিকল্পিত কাজটি এক বছরের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হতো এবং আগামীতে আবার এ কাজের জণ্য গুণাগুণ বা লক্ষণ নির্ধারক বাহির করা হতো। আর যদি ‘ব্যর্থ’ লিখিত তীর বের হতো তবে আবার একইভাবে বাছাই করা হতো যতক্ষণ পর্যন্ত ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ লিখিত তীর বের হতো।
দ্বিতীয় : এ শ্রেণীভুক্ত তীরগুলোর কোনটির গায়ে লেখা থাকত ‘পানি’’ কোনটির গায়ে লেখা থাকত ‘দিয়াত’’ এবং অন্যান্যগুলোর গায়ে লেখা থাকত অন্য কোন কিছু।
তৃতীয় : এ শ্রেণীভুক্ত তীরগুলোর মধ্যে কোনটির গায়ে লেখা থাকত ‘তোমাদের অন্তর্ভুক্ত’’, কোনটির গায়ে লেখা থাকত ‘তোমাদের ছাড়া’’, হয়তো বা কোনটির গায়ে লেখা থাকত ‘মুলসাক’ (যার অর্থ হচ্ছে মিলিত)। উল্লেখিত তীরগুলোর ব্যবহার ছিল এরূপ- কারো বংশ পরিচয়ের ব্যাপারে যখন সন্দেহের সৃষ্টি হতো তখন তাকে একশত উটসহ হুবাল নামক মূর্তির নিকট নিয়ে যাওয়া হতো। উটগুলো তীরধারী সেবায়েতের (ঋষি) নিকট সমর্পণ করা হতো। তিনি সবগুলো তীর একত্রিত করে ঝাঁকুনি দিয়ে দিয়ে ঘুরাতে থাকতেন। তারপর তার মধ্য থেকে একটি তীর বাহির করে আনা হতো। তীর গাত্রে ‘তোমাদের অন্তর্ভুক্ত’ লিখিত তীরটি যদি বাহির হতো তবে তাঁকে তাঁদের গোত্রের একজন সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে স্থান দেয়া হতো। অপরপক্ষে যদি ‘তোমাদের বাহিরের’ লিখিত তীরটি বাহির হতো তখন তাঁকে ‘হালীফ’ হিসেবে স্থান দেয়া হতো। কিন্তু যদি ‘মুলসাক’ লিখিত তীরটি বাহির হতো তাহলে তাঁকে তাঁর নিজস্ব স্থানেই রাখা হতো। সেই গোত্রীয় ব্যক্তি কিংবা ‘হালীফ’ হিসেবে স্থান দেয়া হতো না।[7]
তারা এ তীর দ্বারা ভাগ্যের ভাল মন্দ যাচাই করতো। মূলত এটা এক প্রকার জুয়া খেলা। এর ধরণ হলো, তারা এ মাধ্যমে উটের গোশতের কার ভাগে পড়বে তা নির্ধারণের জন্য তীর ঘুরাতো। এ উদ্দেশ্যে তারা বাকীতে উট ক্রয় করে তা জবাই করে ২৮ অথবা দশ ভাগে ভাগ করতো। অতঃপর এ ব্যাপারে তীর ঘুরাতো। যার মধ্যে (الرابح) ‘রাবিহ’ ও (الغفل) ‘গুফল’ নামের তীর থাকতো। যার ক্ষেত্রে (الرابح) তীর বের হতো সে উটের গোশতের অংশ পেত। আর যার ক্ষেত্রে (الغفل) তীর বের হতো সে ব্যর্থ ও হতাশ হতো এবং ঐ উটের মূল পরিমাণ জরিমানা পরিশোধ করতে হতো।
আরবের মুশরিকগণ তথাকথিত ভবিষ্যদ্বক্তা যাদুকর এবং জ্যোতিষ শাস্ত্রবিদগণের ভবিষ্যদ্বাণী, কলাকৌশল এবং কথাবার্তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করতেন। যিনি আগামীতে অনুষ্ঠিতব্য ঘটনাবলীর ভবিষ্যদ্বাণী করতেন এবং গোপন তত্ত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়াদি অবগত আছেন বলে দাবী করতেন তাঁকে বলা হতো ‘কাহিন’। কোন কোন কাহিন এরূপ দাবীও করতেন যে, একটি জিন তাঁর অনুগত রয়েছে এবং সে তাঁকে সংবাদটি সংগ্রহ ও পরিবেশন করে থাকে। কোন কোন কাহিন আবার এরূপ দাবীও করতেন যে, অদৃশ্যের খবরাখবর নেয়ার মতো যথেষ্ট বিদ্যাবুদ্ধি তাঁর রয়েছে এবং তিনি তা নিয়েও থাকেন।
তৎকালীন সমাজে আরও এক ধরণের লোক ছিলেন যাঁরা মানুষের কথা ও কর্মের উপর অনুসন্ধান চালিয়ে তাঁদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতেন। এরা ‘আররাফ’ নামে অভিহিত ছিলেন। তাঁদের দাবী ছিল, কোন লোক যখন কোন কিছু ব্যাপারে অবগত হওয়ার জন্য তাঁর নিকট আগমন করেন তখন তাঁর অবস্থা, কিছু কিছু পূর্ব লক্ষণ এবং আনুষঙ্গিক কথাবার্তার মাধ্যমে ঘটনার স্থান বা ঠিকানা এবং ঘটনার সঙ্গে সংশিষ্ট ব্যক্তি কিংবা ব্যক্তিগোষ্ঠির খোঁজখবর তিনি দিতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- অপহৃত সম্পদ, অপহরণের স্থান ও সময়, হারানো পশু কিংবা অন্য কোন কিছু সম্পর্কিত খোঁজ খবর।
জ্যোতিষ শাস্ত্রবিদ : আকাশ মন্ডলে তারকা রাজির গতিবিধি, উদয়াস্ত, আগমন-প্রত্যাগমন ইত্যাদি লক্ষ্য করে ভবিষ্যতের আবহাওয়া কিংবা ঘটতে পারে এমন ঘটনা, কিংবা দুর্ঘটনা সম্পর্কে আভাস ইঙ্গিত প্রদান হচ্ছে জ্যোতিষীগণের কাজ।[8] জ্যোতিষীগণের চিন্তা-চেতনা এবং গণনার প্রভাব আজও যেমন জন-সমাজে লক্ষ্য করা যায় সেকালেও তেমনটি ছিল। কিন্তু বিশেষ তফাৎ ছিল, তারকারাজির অবস্থা ও অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে বৃষ্টি বাদলের পূর্বাভাষ দেয়া হলে তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, এ তারকাই তাঁদের বৃষ্টি বর্ষণ করেছে। তাঁদের মঙ্গলামঙ্গলের মূলে রয়েছে এ তারকারা। এভাবে তাঁরা জঘণ্য শির্ক করে বসতেন।[9]
ত্বিয়ারাহ : আরবের মুশরিকগণ কোন কাজকর্ম আরম্ভ করা পূর্বে কাজের ফল ‘ভালো’ কিংবা ‘মন্দ’ হতে পারে তা যাঁচাই করে নেয়ার জন্য কতিপয় মনগড়া রেওয়াজের প্রচলন করে নিয়েছিল। এরূপ যাচাইয়ের এ প্রথাকে বলা হতো ত্বিয়ারাহ। এতে তাঁদের স্বকীয় ধারণা-প্রসূত যে সকল কাজকর্ম করা হতো তা হচ্ছে-
যখন তাঁরা কোন কাজ করার ইচ্ছা করতেন তখন তা আরম্ভ করার পূর্বে কোন পাখিকে উড়িয়ে দেয়া হতো কিংবা হরিণকে তাড়া করা হতো। পাখি কিংবা হরিণ যদি তাঁদের ডান দিক দিয়ে পলায়ন করত তাহলে এটাকে শুভ লক্ষণ মনে করে তাঁরা তাড়াতাড়ি কাজ আরম্ভ করে দিতেন। কিন্তু বাম দিক দিয়ে পলায়ন করলে সেটাকে অশুভ লক্ষণ মনে করে কাজ করা থেকে বিরত থাকত। অনুরূপভাবে কোন পশু কিংবা পাখিকে যদি রাস্তায় আঁচোড় কাটতে দেখা যেত তাহলে সেটাকে অমঙ্গলের পূর্ব লক্ষণ বলে মনে করা হতো।
অশুভ কোন কিছুর প্রভাব কাটানোর জন্য খরগোশের পায়ের গোড়ালির উপরের হাড় ঝুলিয়ে রাখা হতো। সপ্তাহের কোন কোন দিন অশুভ, কোন কোন মাস অশুভ, কোন কোন চতুষ্পদ জন্তু অশুভ, কোন কোন মহিলার দর্শন অশুভ, দিন-রাত্রির কোন কোন সময় অশুভ, কোন কোন বাড়িঘর অশুভ ইত্যাদি নানা কুসংস্কার তাঁদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। কলেরা, বসন্ত ইত্যাদি মহামারীকে কোন অশুভ শক্তির পাঁয়তারা বলে মনে করা হতো। অধিকন্তু, মানাবাত্মা পেঁচায় পাওয়ার ব্যাপারটিও তাঁরা বিশ্বাস করতেন। তাঁদের এ বিশ্বাস ছিল যে কোন লোককে কেউ হত্যা করলে যতক্ষণ তাঁর প্রতিশোধ গ্রহণ না করা হয় ততক্ষণ সে আত্মার শান্তি লাভ হয় না। সেই আত্মা পেঁচায় পরিণত হয়ে জনশূন্য প্রান্তরে ঘোরাফিরা করতে থাকে[10] এবং ‘পিপাসা পিপাসা’ অথবা ‘আমাকে পান করাও’ ‘আমাকে পান করাও’ বলে আওয়াজ করতে থাকে। যখন সেই হত্যা প্রতিশোধ গ্রহণ করা হয় তখন সে শান্ত হয়।
ফুটনোটঃ[1] শাইখ মুহাঃ আব্দুল নাজদী (রহঃ) মুখতাসার সীরাতুর রাসূল (সাঃ) ১২ পৃঃ।
[2] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ২২২ পৃঃ।
[3] শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব নাজদী মুখতাসার সীরাতুর রাসূল (সা.) ১৩, ৫০-৫৪ পৃঃ।
[4] সীরাতে ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৮৯-৯০ পৃঃ।
[5] সহীহুল বুখারী শরীফ ১ম খন্ড ৪৯৯ পৃঃ।
[6] প্রাগুক্ত
[7] মুহাযারাতে খুযরী ১ম খন্ড ৫৬পৃঃ। ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১০২-১০৩ পৃঃ।
[8] মিরআতুল মাফাতীহ শারাহ মিশকাতুল মাসাবীহ (লক্ষ্ণৌমুদ্রণ ২য় খন্ড ২-৩ পৃঃ।
সহীহুল মুসলিম শরীফ নাবাবী শারাহ সহ ঈমান পর্ব বাবু বয়ানে কুফরি মান কালা মোতেবনা বিন নাওই ১ম খন্ড ৯৫ পৃঃ।
[9] সহীহুল মুসলিম শরীফ নাবাবী শারাহ সহ ঈমান পর্ব বাবু বয়ানে কুফরি মান কালা মোতেবনা বিন নাওই ১ম খন্ড ৯৫ পৃঃ।
[10] সহীহুল বুখারী শরীফ ২য় খন্ড ৮৫১, ৮৫৭ পৃঃ (ব্যাখ্যা সহ)।
দ্বীনে ইবরাহীমীতে কুরাইশগণের বিদ‘আত সংযোজন:
দ্বীনে ইবরাহীমীতে কুরাইশদের সংযোজিত ও অনুসৃত বিদ‘আত সমূহই ছিল জাহেলিয়াত আমলের আরববাসীগণের ধর্ম বিশ্বাস ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মূলরূপ। ইবরাহীম (আঃ) প্রবর্তিত সত্য ধর্মের কোন কোন আচার অনুষ্ঠানের কিছু কিছু অংশ তখনো অবশিষ্ট ছিল। অর্থাৎ ইবরাহীম (আঃ) প্রবর্তিত দ্বীনকে তাঁরা সম্পূর্ণ রূপে ছেড়ে দেননি, ফলে বায়তুল্লাহর প্রতি তাঁরা যথারীতি সম্মান প্রদর্শন এবং ত্বাওয়াফ করতেন, ওমরা এবং হজ্জ পালন করতেন, আরাফা এবং মুযদালিফায় অবস্থান করতেন এবং হাদয়ীর পশু কুরবাণী করতেন।
সনাতন ইসলামের কিছু কিছু রীতিনীতি এবং আচার অনুষ্ঠানাদি পালন করলেও প্রকৃতপক্ষে ধর্ম বিশ্বাসের ক্ষেত্রে তাঁরা এত বেশী শির্ক-বিদ’আতের সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন যে, সত্য ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানগুলো সম্পূর্ণ অর্থহীন হয়ে পড়েছিল। আরববাসীগণ আরও যে সব বিদ‘আতের প্রচলন করে নিয়েছিল তা হচ্ছে যথাক্রমে নিম্নরূপ :
১. কুরাইশরা দাবী করতেন যে, তাঁরা হচ্ছেন ইবরাহীম (আঃ)-এর বংশধর এবং তাঁরাই হচ্ছেন হারাম শরীফের সংরক্ষক ও অভিভাবক এবং মক্কার প্রকৃত অধিবাসী। কোন ব্যক্তিই তাঁদের সমকক্ষ নয় এবং কারো প্রাপ্য তাঁদের প্রাপ্যের সমান নয়। এ সব কারণে তাঁরা নিজেরাই নিজেদেরকে ‘হুমস’ (বীর এবং শক্তিশালী) আখ্যায় আখ্যায়িত করতেন। কাজেই, তাঁরা এটা মনে করতেন যে, হারাম সীমানার বাইরে অগ্রসর হওয়া তাঁদের উচিত না। তাই হজ্জ মৌসুমে তাঁরা আরাফাতে যেতেন না এবং সেখান থেকে তাঁরা তাওয়াফে ইফাযাও করতেন না। তাঁরা মুযদালিফায় অবস্থান করতেন এবং সেখান থেকেই তাওয়াফে ইফাযা করে নিতেন। তাঁদের সেই বিদ‘আত সংশোধনের জন্য আল্লাহ ইরশাদ করেছেন :
{ثُمَّ أَفِيْضُوْا مِنْ حَيْثُ أَفَاضَ النَّاسُ} [البقرة:199]
‘তারপর তোমরা ফিরে আসবে যেখান থেকে লোকেরা ফিরে আসে।’ (আল-বাক্বারাহ ২ : ১৯৯) [1]
২. এদের আরও একটি বিদ‘আতের ব্যাপার ছিল, তাঁরা বলতেন যে, হুমসদের (কুরাইশ) জন্য ইহরামের অবস্থায় পণীর এবং ঘী তৈরি করা ঠিক নয় এবং এটাও ঠিক নয় যে, লোম নির্মিত গৃহে (অর্থাৎ কম্বলের শিবিরে) প্রবেশ করবে। এটাও ঠিক নয় যে, ছায়ায় অবস্থানের প্রয়োজন হলে চামড়ার তৈরি শিবির ব্যতীত কোথাও অন্য কোন কিছুর ছায়ায় আশ্রয় নেবে।[2]
৩. তাঁদের আরও একটি বিদ‘আতের ব্যাপার ছিল যে, তাঁরা বলতেন যে, হারামের বাহির থেকে আগত হজ্জ উমরাহকারীগন হারামের বাহির হতে খাদ্যদ্রব্য কিংবা অনুরূপ কোন কিছু নিয়ে আসলে তা তাঁদের জন্য খাওয়া ঠিক নয়।[3]
৪. আরও একটি বিদ‘আতের কথা জানা যায় এবং তা হচ্ছে, তাঁরা হারামের বাহিরের বাসিন্দাদের প্রতি নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন যে, হারামের মধ্যে প্রবেশ করার পর হুমস হতে সংগৃহীত বস্ত্র পরিধান করে তাঁদের প্রথম ত্বাওয়াফ করতে হবে। এ প্রেক্ষিতে হুমসের বস্ত্র সংগৃহীত করা সম্ভব না হলে পুরুষেরা উলঙ্গ অবস্থাতেই ত্বাওয়াফ করত এবং মহিলারা পরিধানের কাপড় চোপড় খুলে ফেলে দিয়ে একটি ছোট রকমের খোলা জামা পরিধান করতেন এবং ঐ অবস্থাতেই ত্বাওয়াফ করতেন। ত্বাওয়াফ কালে তাঁরা কবিতার এ চরণ আবৃত্তি করতেন :
اليـوم يبـدو بعضـه أو كله ** ومـا بدا منـه فـلا أحلـه
‘অদ্য কিছু অথবা সম্পূর্ণ লজ্জাস্থান উলঙ্গ হয়ে যাবে, কিন্তু যা খুলে যায় আমি তা দেখা বৈধ বলে সাব্যস্ত করি না।’
এ সমস্ত অশ্লীলতা থেকে পরহেজ করে চলার জন্য আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন:
{يَا بَنِيْ آدَمَ خُذُوْا زِيْنَتَكُمْ عِندَ كُلِّ مَسْجِدٍ} [الأعراف:31]
‘হে আদাম সন্তান! প্রত্যেক সলাতের সময় তোমরা সাজসজ্জা গ্রহণ কর। (আল-আ‘রাফ ৭ : ৩১)
অপরদিকে, যদি কোন মহিলা কিংবা পুরুষ নিজেকে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন মনে করে হারামের বাহির থেকে আনা পোষাকে ত্বাওয়াফ করে নিত তাহলে ত্বাওয়াফের পর এ পোষাক তাঁকে ফেলে দিতে হতো। এর ফলে তাঁরা না নিজে উপকৃত হতেন না অন্য কেউ।[4]
৫. বিদ‘আতের আরও একটি ব্যাপার ছিল, ইহরাম অবস্থায় তাঁরা দরজা দিয়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করতেন না। ঘরে প্রবেশ করার জন্য তাঁরা ঘরের পিছন দিকে একটা বড় ছিদ্র করে নিয়ে সেই ছিদ্র পথে আসা-যাওয়া করতেন। অবোধ এবং আহাম্মকের মতই এ কাজকে তাঁরা পুণ্যময় কাজ বলে মনে করতেন। এ ধরণের কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য আল্লাহ তা‘আলা কুরআন কারীমে ইরশাদ করেছেন :
{وَلَيْسَ الْبِرُّ بِأَنْ تَأْتُوْا الْبُيُوْتَ مِن ظُهُوْرِهَا وَلٰـكِنَّ الْبِرَّ مَنِ اتَّقَى وَأْتُوْا الْبُيُوْتَ مِنْ أَبْوَابِهَا وَاتَّقُوْا اللهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ} [البقرة:189]
‘তোমরা যে গৃহের পেছন দিক দিয়ে প্রবেশ কর, তাতে কোন পুণ্য নেই, বরং পুণ্য আছে কেউ তাকওয়া অবলম্বন করলে, কাজেই তোমরা (সদর) দরজাগুলো দিয়ে গৃহে প্রবেশ কর এবং আল্লাহকে ভয় করতে থাক, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।’ (আল-বাক্বারাহ ২ : ১৮৯)
উপরোল্লেখিত আলোচনা সূত্রে আমাদের মানসিক দৃষ্টিপটে দ্বীনের যে চিত্রটি চিত্রিত হল সেটাই ছিল সাধারণ আরববাসীগণের দ্বীনের স্বরূপ। মূর্তিপূজা, শির্ক, বিদ‘আত, কল্পনা, কুসংস্কার, অশ্লীলতা, ইত্যাদির আবরণে চাপা পড়ে গিয়েছিল ইবরাহীম (আঃ) প্রবর্তিত সত্য ও সনাতন ইসলাম।
এ ছাড়া আরবীয় উপদ্বীপের বিভিন্ন অঞ্চলে ইহুদীবাদ, খ্রীষ্টবাদ, প্রাচীনতম পারসীক যাজকতাবাদ এবং সাবাঈধর্ম স্থান দখলের সুযোগ সক্রিয় ছিল। তাই সে সবেরও সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এবং ঐতিহাসিক পটভূমি সম্পর্কে আলোচনা করা হল:
ইহুদী মতবাদ : আরব উপদ্বীপে ইহুদীদের কমপক্ষে দু’টি যুগ অতিবাহিত হয়েছিল। প্রথম যুগটি সেই সময়ের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল যখন ফিলিস্ত্বীনে বাবেল এবং আশুরের রাষ্ট্র বিজয়ের কারণে ইহুদীগণকে দেশত্যাগ করতে হয়েছিল। বাহিনী কর্তৃক ব্যাপকভাবে ইহুদীদের ধরপাকড়, বুখতুনসসরের হাতে ইহুদীবসতি ধ্বংস ও উজাড়, তাঁদের উপাসনাগারের ক্ষতিসাধন এবং বাবেল থেকে ব্যাপকভাবে দেশান্তরের ফলে একদল ইহুদী ফিলিস্ত্বীন ছেড়ে গিয়ে হিজাযের উত্তরাঞ্চলে বসতি স্থাপন করে।[5]
দ্বিতীয় পর্যায় আরম্ভ হয় যখন টাইটাস রুমীর নেতৃত্বে রুমীগণ ৭০ খ্রীষ্টাব্দে জোর করে ফিলিস্ত্বীন দখল করে নেয়। সেই সময় রুমীগণের বহু ইহুদী বসতি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং তাঁদের উপাসনাগারের ক্ষতি সাধিত হয়। এর ফলে বহু ইহুদী গোত্র হিজাযে পালিয়ে আসে এবং ইয়াসরিব, খায়বার এবং তাইমায় গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। সেই সকল স্থানে তাঁরা স্থায়ী বসতি স্থাপন করেন এবং কেল্লা ও গড় নির্মাণ করেন।
উল্লেখিত দেশত্যাগী ইহুদীদের মাধ্যমে আরববাসীগণের মধ্যে এক প্রকার ইহুদী প্রথা চালু হয়ে যায়। এ আরব ইহুদী সংমিশ্রণের সূত্রপাত হয় ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে, ইসলামের প্রাথমিক যুগে দ্রুত পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক অবস্থা ও ঘটনা প্রবাহের প্রেক্ষাপটে তা বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে। ইসলামের আবির্ভাবকালে উল্লেখযোগ্য ইহুদী গোত্রগুলো ছিল যথাক্রমে খায়বার, নাযীর, মুস্তালাক্ব, কুরাইযাহ এবং ক্বায়নুক্বা। বিখ্যাত সামহুদী ‘ওয়াফাউল ওয়াফা’ গ্রন্থে ১১৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন যে তৎকালে ইহুদী গোত্রগুলোর সংখ্যা বিশেরও (২০) কিছু বেশী ছিল।[6]
ইয়ামানে ইহুদী মতবাদ বেশ বিস্তার লাভ করে। এখানে এর বিস্তার লাভের মূল হোতা ছিলেন তুব্বান আস’আদ আবূ কারাব। এ ব্যক্তি যুদ্ধ করতে করতে ইয়াসরিবে গিয়ে উপস্থিত হন। সেখানে তিনি ইহুদী মতবাদ গ্রহণ করেন এবং বনু কুরাইযাহর দু’জন ইহুদী বিদ্বানকে সঙ্গে নিয়ে ইয়ামান যান। এভাবে ইয়ামানে ইহুদী মতবাদ বিস্তার লাভ করেন।
আবূ কারাবের পর তাঁর পুত্র ইউসুফ যূ নাওয়াস ইয়ামানের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। শাসনভার গ্রহণ করার পর তিনি নাজরানবাসী খ্রীষ্টানগণের উপর হামলা চালান এবং ইহুদী মতবাদ চাপিয়ে দেয়ার জন্য প্রবল চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন। কিন্তু প্রবল চাপ সত্ত্বেও খ্রীষ্টানগণ ইহুদী মতবাদ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন যার ফলশ্রুতিতে যুনাওয়াস গর্ত খনন করে সেই গর্তে অগ্নিকুন্ড তৈরি করেন এবং যুবা, বৃদ্ধ, পুরুষ-মহিলা, নির্বিশেষে অনেককে সেই অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করে হত্যা করেন। বলা হয়ে থাকে যে, বিশ থেকে চল্লিশ হাজার লোক এ নারকীয় ঘটনার শিকার হয়েছিলেন। এ নারকীয় ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল ৫২৩ খ্রীষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে। কুরআন মাজীদের সূরাহ বূরুজে এ ঘটনার উল্লেখ রয়েছে।[7]
{قُتِلَ أَصْحَابُ الْأُخْدُوْدِ النَّارِ ذَاتِ الْوَقُوْدِ إِذْ هُمْ عَلَيْهَا قُعُوْدٌ وَهُمْ عَلٰى مَا يَفْعَلُوْنَ بِالْمُؤْمِنِيْنَ شُهُوْدٌ} [البروج: 4- 7]
‘‘ধ্বংস হয়েছে গর্ত ওয়ালারা ৫. (যে গর্তে) দাউ দাউ করে জ্বলা ইন্ধনের আগুন ছিল, ৬. যখন তারা গর্তের কিনারায় বসেছিল ৭. আর তারা মু’মিনদের সাথে যা করছিল তা দেখছিল।’ (আল-বুরূজ ৮৫ : ৪-৭)
খ্রীষ্টীয় মতবাদ : খ্রীষ্টীয় মতবাদ সম্পর্কে যতটুকু জানা যায় তা হল, আরবের শহরগুলোতে ওদের আগমনের ব্যাপারটি ঘটেছিল হাবশী এবং রুমীগণের জবর দখলের পর বিজয়ীদের মাধ্যমে। ইতোপূর্বে বলা হয়েছে যে, ইয়ামানের উপর হাবশীগণের প্রথম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় ৩৪০ খ্রীষ্টাব্দে কিন্তু তাদের এ রাজত্ব বেশিদিন টিকেনি। তাদের হাত হতে তা ৩৭০ থেকে ৩৭৮ খ্রিস্টাব্দ সময়ে হাতছাড়া হয়ে যায়। এ মধ্যবর্তী সময়ে খ্রীষ্টান মিশনারীগণ ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার কাজ চালাতে থাকেন। প্রায় সেই সময়েই এমন এক বুজর্গ ব্যক্তি নাজরানে আগমন করেন যাঁর প্রার্থনা আল্লাহর নিকটে কবুল হতো বলে কথিত আছে। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সম্মানিত ও কেরামতওয়ালা পুরুষ। তাঁর নাম ছিল ফাইমিউন। অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি নাজরানে খ্রীষ্টীয় মতবাদের প্রচার কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। নাজরানবাসীগণের উপর তাঁর প্রচার কাজের প্রভাব অত্যন্ত কার্যকরভাবে প্রতিফলিত হতে থাকে। তাঁরা তাঁর কাছে এমন কিছু কেরামত দেখতে পান যা তাদের বিশ্বাসের ভিত্তিমূলকে অধিকতর দৃঢ় করে তোলে। এরপর তাঁরা সকলেই খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেন।[8]
অতঃপর দ্বিতীয়বার হাবশগণ ৫২৫ খ্রিস্টাব্দে নূ নাওয়াস কর্তৃক খ্রীস্টানদের গর্তের মধ্যে পুড়িয়ে মারার মতো পৈশাচিক কর্মকান্ডের প্রতিশোধস্বরূপ আবরাহাহ আল-আশরাম রাষ্ট্রের শাসনভার গ্রহণ করেন। রাষ্ট্র নায়কের আসনে সমাসীন হওয়ার পর নতুন উদ্যমে খ্রীষ্টীয় মতবাদের প্রচার ও প্রসার কাজে তিনি আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর এ প্রচেষ্টার ফলশ্রুতিই হচ্ছে ইয়ামানে অন্য একটি কা’বাহ গৃহনির্মাণ এবং তাঁর নির্মিত কাবা’হ গৃহে হজ্জ পালনের জন্য আরববাসীগণকে আহবান জানানো। শাসক আবরাহা শুধু অন্য একটি ক্বাবা’হ গৃহ নির্মাণ এবং হজ্জ পালনের আহবান জানিয়েই ক্ষান্ত হননি। তিনি খানায়ে ক্বাবা’হকে সমূলে ধ্বংস করাতো দূরের কথা, আল্লাহ তা‘আলার গজবে পড়ে বিশাল এক হস্তী বাহিনীসহ তিনি নিজেই সমূলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। যেমনটি কুরআন কারীমের সূরাহ ‘ফীলে’ বলা হয়েছে। সূরাহ ফীলের এ ঘটনা সর্ব যুগের সকল মানুষের শিক্ষা লাভের জন্য একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে।
অপরদিকে রুমীয় অঞ্চল সমূহের সন্নিকটস্থ হওয়ার কারণে আলে গাসসান, বনু তাগলিব, বনু তাই এবং অন্যান্য আরব গোত্রসমূহে খ্রীষ্টীয় মতবাদ বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। হীরাহর আরব সম্রাটগণও খ্রীষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন বলে জানা যায়।
মাজুসী মতবাদ : মাজুসী মতবাদ সম্পর্কে যতটুকু জানা যায় তা হচ্ছে, পারস্যের সন্নিকটস্থ আরব ভূমিতে এ মতবাদ বেশ প্রাধান্য এবং প্রতিষ্ঠা লাভ করে, যেমন- আরবের ইরাকে, বাহরাইনে (আল আহসা), হাজার এবং আরব উপসাগরীয় সীমান্ত অঞ্চলে। তাছাড়া ইয়ামানে পারস্য শাসনামলেও বিচ্ছিন্নভাবে দু-একজন মাজুসী মতবাদ গ্রহণ করেছিলেন।
সাবী মতবাদ : এরপর অবশিষ্ট থাকে সাবী মতবাদের কথা। এটা এমন একটি মতবাদ যার অনুসারীরা নক্ষত্র ও তার বিভিন্ন কক্ষপথ এবং তারকারাজির প্রভাবকে এমনভাবে স্বীকৃতি দিত যে এগুলোকেই বিশ্ব পরিচালনা করে বলে বিশ্বাস করতো। ইরাক এবং অন্যান্য দেশের প্রাচীন শহর-নগরের ধ্বংসস্তুপ খননের সময় যে সকল দলিল-দস্তাবেজ হস্তগত হয়েছে তা থেকে এটা বুঝা যায় যে, তা ইবরাহীম (আঃ)-এর কালদানী সম্প্রদায়ের মতবাদ। প্রাচীন শাম এবং ইয়ামানের বহু অধিবাসী এ মতবাদের অনুসারী ছিলেন। কিন্তু পরবর্তী কালে যখন ইহুদী মতবাদ এবং তারও পরে খ্রীষ্টীয় মতবাদ বিস্তার লাভ করে তখন এ সাবী মতবাদের ভিত্তিমূল শিথিল হয়ে পড়ে এবং প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ ক্রমান্বয়ে নির্বাপিত হওয়ার সম্মুখীন হয়ে পড়ে। কিন্তু তবুও ইরাকে এবং আরব উপসাগরীয় সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এ মতবাদের কিছু সংখ্যক অনুসারী থেকে যায়।[9]
আবার আরবের কতক স্থানে কিছু সংখ্যক নাস্তিক্য মতবাদের অনুসারীদের দেখা যেত। তারা হীরাহর পথে এখানে আসে। যেমন কুরাইশদের কতক লোককে পারস্যে পাওয়া যায় যারা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে তথায় গিয়েছিল।
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৯৯ পৃঃ, সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ২২৬ পৃঃ।
[2] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ২০২ পৃঃ।
[3] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ২০২ পৃঃ।
[4] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ২০৩ পৃঃ এবং সহীহুল বুখারী শরীফ ১ম খন্ড ২২৬ পৃঃ।
[5] কালবে জাজীরাতুল আরব ২৫১ পৃঃ।
[6] কালবে জাজীরাতুল আরব ২৪১ পৃঃ।
[7] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ২০-২২ পৃঃ ২৭, ৩১, ৩৫-৩৬ পৃঃ। অধিকন্তু তাফসীর গ্রন্থে সূরাহ বুরুজের তাফসীর দ্রষ্ঠব্য।
[8] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৩১-৩৪ পৃঃ।
[9] তারিখে আরযুল কুরআন ২য় খন্ড ১৯৩-২০৮ পৃঃ।
ধর্মীয় অবস্থা (الحالة الدينية):
পৌত্তলিকতা, অশ্লীলতা, শিরক, বিদ’আত ও বহুত্ববাদের জমাট অন্ধকার ভেদ করে চির ভাস্বর ও চির জ্যোতির্ময় ইসলাম নামক সূর্য যখন নবায়িত আলোর বন্যায় উদ্ভাসিত হয়ে আত্মপ্রকাশ করল তখন প্রচলিত সকল বিশ্বাস এবং মতবাদের অনুসারীগণ একদম হতচকিত হয়ে পড়ল। সর্বশেষ আসমানী কিতাব মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের সুললিত শাশ্বত বাণী এবং মহানাবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর উদাত্ত কণ্ঠের তৌহীদী ঘোষণা সকল ভ্রান্ত বিশ্বাসের ভিত্তিমূলকে করে তুলল প্রকম্পিত। যে সকল মুশরিক ও পুতুল পুজক শির্ক ও পৌত্তলিকতার পাপপংকে নিমজ্জিত থেকেও দাবী করত যে, তাঁরা দ্বীন-ই ইবরাহীম (আঃ)-এর উপর প্রতিষ্ঠিত তাঁদের বিশ্বাসের ভিত্তিমূলে চরম আঘাত হানল।
ইবরাহীম (আঃ) প্রবর্তিত সত্য ধর্মের অনুসারী বলে দাবী করলেও প্রকৃতপক্ষে দ্বীন-ই-ইবরাহীমী (আঃ)-এর কোন বৈশিষ্ট্যই তাঁদের চিন্তা চেতনা ও ধ্যান-ধারণায় ছিল না। তারা নানা প্রকার অশ্লীলতা ও পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়ে। অবতীর্ণ আল্লাহর বাণীর আলোকে নাবী কারীম (সাঃ) যখন আল্লাহর একমাত্র মনোনীত ধর্ম ইসলামের শাশ্বতরূপ এবং ইবরাহীম (আঃ) প্রবর্তিত দ্বীনের সঙ্গে এর বিভিন্ন সম্পর্কের প্রসঙ্গটি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন তখন তাঁদের দ্বীন সম্পর্কিত দাবীর অসারতা দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট হয়ে উঠল।
ইহুদীবাদের অবস্থাও ছিল ঠিক একইরূপ। অসার বাহ্যাড়ম্বর সর্বস্ব স্বেচ্ছাচার ছাড়া তেমন আর কিছুই ছিল না ইহুদীদের মধ্যে। ইহুদী পুরোহিতগণ আল্লাহকে ভুলে গিয়ে নিজেরাই চেয়েছিলেন প্রভুর আসনে সমাসীন হতে। ধর্মের আবরণে তাঁরা চেয়েছিলেন পার্থিব প্রতিষ্ঠা। ধর্মের দোহাই দিয়ে তাঁরা চাইতেন সাধারণ মানুষের উপর তাঁদের স্বকীয় মতামত সম্পর্কিত প্রভাব বিস্তার করতে। তাঁদের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল সম্পদ সংগ্রহ করে সম্পদের পাহাড় রচনা করা। সম্পদ সংগ্রহ করতে গিয়ে তার ধর্ম-কর্ম যদি চুলায় যায় তা যাক, অবিশ্বাস কিংবা অধর্ম যদি বিস্তার লাভ করে তা করুক, তাতে কিছুই আসে যায় না। এ-ই ছিল ইহুদীবাদের সত্যিকার রূপ।
খ্রীষ্টান ধর্মও সত্য বিবর্জিত শির্ক এবং পৌত্তলিকতায় ভরপুর হয়ে পড়েছিল। আল্লাহর একত্ববাদের পরিবর্তে তৃত্ববাদের ধারণা তাঁদের মনে বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল এবং এ ভ্রান্ত ধারণাই আল্লাহ এবং মানবকে এক আজব সংমিশ্রণের বন্ধনে আবদ্ধ করেছিল। অধিকন্তু, যে আরববাসীগণ এ ধর্ম গ্রহণ করেছিল প্রকৃতপক্ষে তাদের উপর এ ধর্মের কোন প্রভাব প্রতিফলিত হয় নি। কারণ, এর আদর্শের সঙ্গে তাঁদের প্রচলিত জীবন যাত্রা-প্রণালীর কোন মিল ছিলনা আর তারা তাদের প্রচলিত জীবন-পদ্ধতি পরিত্যাগ করতে পারছিলেন না।
অবশিষ্ট আরবদের অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের অবস্থা মুশরিকগণের মতই ছিল। কারণ, তাঁদের অন্তঃকরণ একই ছিল, বিশ্বাসসমূহে পরস্পর সাদৃশ্য ছিল এবং রীতিনীতিতে সঙ্গতি ছিল।
আরবের তৎকালীন অবস্থা
সামাজিক অবস্থা :
তৎকালীন আরব সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর লোকজন ববসাব করত। অবস্থা এবং অবস্থানের কথা বিবেচনা করলে লক্ষ্য করা যায় যে, জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে যথেষ্ট ভিন্নতা রয়েছে। অভিজাত শ্রেণীর পরিবারে পুরুষ এবং মহিলাগণের পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল মর্যাদা এবং ন্যায়-ভিত্তিক ব্যবস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত। বহু ব্যাপারে মহিলাদের স্বাধীনতা দেয়া হতো, তাঁদের যুক্তি-সঙ্গত কথাবার্তার যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হতো এবং তাঁদের ব্যক্তি বৈশিষ্ট্যকে মর্যাদা দেয়া হতো। অভিজাত পরিবারের মহিলাদের রক্ষণাবেক্ষণ এবং মান সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখার ব্যাপারে সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখা হতো। মহিলাদের মান মর্যাদার ব্যাপারে হানিকর বা অবমাননাকর পরিস্থিতিতে সঙ্গে সঙ্গে তলোয়ার কোষমুক্ত হয়ে খুন-খারাবি শুরু হয়ে যেত।
তৎকালীন আরবে প্রচলিত রেওয়াজ মাফিক কোন ব্যক্তি নিজের উদারতা কিংবা বীরত্বের প্রশংসাসূচক কোন কিছু বলতে চাইলে মহিলাদের সম্বোধন করেই তা বলা হতো। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মহিলারা ইচ্ছা করতে পারত। পক্ষান্তরে পুরুষদের উত্তেজিত ও উদ্বোধিত করে সহজেই যুদ্ধাগ্নিও প্রজ্জ্বলিত করে দিতে পারত।
কিন্তু এতসব সত্ত্বেও প্রকৃতপক্ষে পুরুষ প্রধান সমাজ কাঠামোই আরবে প্রচলিত ছিল। পরিবার প্রধান বা পরিবারের পরিচালক হিসেবে পুরুষদেরই প্রাধান্য ছিল এবং তাঁদের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হিসেবে স্বীকৃত এবং গৃহীত হতো। পারিবারিক জীবন যাত্রার ক্ষেত্রে পুরুষ স্ত্রী এবং সম্পর্ক বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হতো। বর-কনে উভয় পক্ষের অভিভাবকগণের সম্মতিক্রমে কনের অভিভাবকগণের তত্ত্বাবধানে বিবাহ পর্ব অনুষ্ঠিত হতো। অভিভাবকগণের অগোচরে ইচ্ছামাফিক বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার অধিকার মহিলাদের ছিল না।
এক দিকে যখন সম্ভ্রান্ত এবং অভিজাত পরিবারসমূহের জন্য প্রচলিত ছিল এ ব্যবস্থা, অপরপক্ষে তখন সাধারণ মানুষের মধ্যে নারী পুরুষের সম্পর্ক এবং মেলামেশার ক্ষেত্রে এমন সব ঘৃণ্য ব্যবস্থা এবং জঘন্য প্রথা প্রচলিত ছিল যাকে অশ্লীলতা, পাশবিকতা এবং ব্যভিচার ছাড়া অন্য কিছুই বলা যেতে পারে না। উম্মুল মুমিনীন আয়িশাহ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত তথ্যাদি সূত্রে জানা যায় যে, অন্ধকারে যুগে আরব সমাজে বিবাহের চারটি প্রথা প্রচলিত ছিল। এর মধ্যে একটি হচ্ছে তো সেই প্রথা যা বর্তমান যুগেও জনসমাজে প্রচলিত রয়েছে। এ প্রথানুসারে বিভিন্ন দিক বিবেচনার পর একজন তাঁর অধীনস্থ মহিলার জন্য অন্য এক জনের নিকট বিয়ের প্রস্তাব বা পয়গাম পাঠাতেন। তারপর উভয় পক্ষের মধ্যে বোঝাপড়ার মাধ্যমে স্বীকৃতি লাভের পর বর কনেকে ধার্য মোহর দিয়ে বিয়ে করত।
নারী-পুরুষের মিলনের দ্বিতীয় প্রথাকে বলা হতো ‘নিকাহে ইসতিবযা’। নারী-পুরুষের মিলনের উদ্দেশ্য থাকত জ্ঞানী, গুণী ও শক্তিধর কোন সুপুরুষের সঙ্গে সঙ্গম ক্রিয়ায় লিপ্ত হওয়ার মাধ্যমে উৎকৃষ্ট শ্রেণীর সন্তান লাভ। এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে যখন কোন মহিলা ঋতু জনিত অপবিত্রতা থেকে পবিত্র হতেন তখন তাঁর স্বামী তাঁকে তাঁর পছন্দ মতো কোন সুপুরুষের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য প্রস্তাব পাঠাতে বলতেন। এ অবস্থায় স্বামী তাঁর নিকট থেকে পৃথক হয়ে থাকতেন, কোন ক্রমেই তাঁর সঙ্গে সঙ্গম ক্রিয়ায় লিপ্ত হতেন না। এদিকে স্ত্রী প্রেরিত প্রস্তাব স্বীকৃতি লাভ করলে গর্ভ ধারণের সুস্পষ্ট আলামত প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত তার সঙ্গে সঙ্গম ক্রিয়ায় লিপ্ত হতে থাকতেন। তারপর গর্ভ ধারণের আলামত সুস্পষ্ট হলে তিনি তাঁর স্বামীর সঙ্গে মিলিত হতেন। হিন্দুস্থানী পরিভাষায় এ বিবাহকে ‘নিয়োগ’ বলা হয়।
তথাকথিত ‘বিবাহ’ নামক নারী-পুরুষের মিলনের তৃতীয় প্রথা ভিন্নতর রূপের একটি জঘণ্য ব্যাপার। এতে দশ থেকে কম সংখ্যক ব্যক্তির সমন্বয়ে একটি দল একত্রিত হতো এবং সকলে পর্যায়ক্রমে একই মহিলার সঙ্গে সঙ্গম ক্রিয়ায় লিপ্ত হতো। এর ফলে এ মহিলা গর্ভ ধারণের পর যথা সময়ে সন্তান প্রসব করত। সন্তান প্রসবের কয়েক দিন পর সেই মহিলা তাঁর সঙ্গে যাঁরা সঙ্গম ক্রিয়ায় লিপ্ত হয়েছিলেন তাঁদের সকলকে ডেকে নিয়ে একত্রিত করতেন। প্রচলিত প্রথায় বাধ্য হয়েই সংশিষ্ট সকলকে সেখানে উপস্থিত হতে হতো। সেখানে উপস্থিত হওয়ার ব্যাপারে অমত করার কোন উপায় থাকতনা। মহিলার আহবানে যখন সকলে উপস্থিত হতেন তখন সকলকে লক্ষ্য করে মহিলা বলতেন যে, ‘আপনাদের সঙ্গে সঙ্গম ক্রিয়ার ফলেই যে আমার এ সন্তান ভূমিষ্ট হয়েছে এ ব্যাপারটি আপনারা সকলেই অবগত আছেন।’
তারপর সমবেত লোকজনদের মথ্য থেকে এক জনকে লক্ষ্য করে বলতেন ‘হে অমুক, আমার গর্ভজাত এ সন্তান হচ্ছে আপনারই সন্তান।’ মহিলার ঘোষণাক্রমে সন্তানটি হতো তাঁরই সন্তান এবং সংশিষ্ট সকলেই এর স্বীকৃতি প্রদান করতে বাধ্য থাকতেন।
নারী-পুরুষের ‘বিবাহ ও মিলন’ নাম দিয়ে আরও একটি জঘন্য রকমের অশ্লীল রেওয়াজ জাহেলিয়াত যুগের আরব সমাজে প্রচলিত ছিল। এতে কোন মহিলাকে কেন্দ্র করে বহু লোক একত্রিত হতেন এবং পর্যায়ক্রমে তাঁর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতেন। এরা হচ্ছেন পতিতা প্রবৃত্তির পেশাবলম্বিনী মহিলা। কাজেই, যৌন সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে কোন লোক তাঁদের নিকট আগমন করলে তাঁরা আপত্তি করতেন না। এদের বাড়ির প্রবেশ দ্বারে পেশার প্রতীক হিসেবে নিশান দিয়ে রাখা হতো যাতে ইচ্ছুক ব্যক্তিরা নির্দ্বিধায় গমনাগমন করতে পারেন। যৌনক্রিয়ার ফলে গর্ভ ধারণের পর যখন কোন মহিলা সন্তান প্রসব করতেন তখন তাঁর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনকারী সকল পুরুষকে একত্রিত করা হতো। তারপর যে ব্যক্তি মানুষের অবয়ব প্রত্যক্ষ করে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম এমন ব্যক্তিকে সেখানে আহবান জানানো হতো। সেই ব্যক্তি উপস্থিত সকলের অবয়ব নিরীক্ষণান্তে তাঁর বিবেচনা মতো এক জনের সঙ্গে সন্তানপির যোগসূত্র বা সম্পর্ক স্থাপন করে দিতেন। তিনি বলতেন, ‘এ সন্তান আপনার’’। যাঁকে লক্ষ্য করে এ রায় দেয়া হতো তিনি তা মানতে বাধ্য থাকতেন। এভাবে নব জাতকটির একজন পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত হয়ে যেত। তিনিও শিশুটিকে তাঁর ঔরসজাত সন্তান বলেই মনে করতেন।
যখন আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে রাসূল রূপে প্রেরণ করলেন তখন জাহেলিয়াত যুগের সর্ব প্রকার অশ্লীল বৈবাহিক ব্যবস্থার অবসান ঘটল। বর্তমানে ইসলামী সমাজে যে বিবাহ প্রথা প্রচলিত রয়েছে আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশে রাসূলে কারীম (সাঃ) আরব সমাজে সেই ব্যবস্থাই প্রতিষ্ঠিত করেন।[1]
আরও কোন কোন ক্ষেত্রে আরবের নারী-পুরুষদের অন্য রকম সম্পর্কের কথা জানা যায়। তৎকালে, অর্থাৎ জাহেলিয়াত আমলে নারী-পুরুষ সম্পর্ক বন্ধনের ব্যাপারটি এমন প্রথার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল যা তলোয়ারের ধার এবং বল্লমের ফলার সাহায্যে প্রতিষ্ঠালাভ করত। এতে গোত্রীয় যুদ্ধ বিগ্রহের ক্ষেত্রে বিজয়ী গোত্র বিজিত গোত্রের নারীদের আটক রেখে যৌন সম্ভোগে তাদের ব্যবহার করত। এ সকল মহিলার গর্ভে যে সকল সন্তান জন্মলাভ করত তাদের কোন সামাজিক মর্যাদা দেয়া হতো না। সামাজিক দৃষ্টিকোন থেকে সারা জীবন তাদেরকে খাটো হয়েই থাকতে হতো।
জাহেলিয়াত আমলে একই সঙ্গে একাধিক অনির্দিষ্ট সংখ্যক স্ত্রী গ্রহণের রেওয়াজ প্রচলিত ছিল। একই সঙ্গে দু’সহোদরাকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করে সংসার করাটা কোন দোষের ব্যাপার ছিল না। পিতার মৃত্যুর পর এবং পিতা কর্তৃক তালাক প্রাপ্তা বিমাতাকে বিবাহ প্রথাও তৎকালে চালু ছিল।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
{وَلاَ تَنكِحُوْا مَا نَكَحَ آبَاؤُكُم مِّنَ النِّسَاء إِلاَّ مَا قَدْ سَلَفَ إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَمَقْتًا وَسَاء سَبِيْلاً حُرِّمَتْ عَلَيْكُمْ أُمَّهَاتُكُمْ وَبَنَاتُكُمْ وَأَخَوَاتُكُمْ وَعَمَّاتُكُمْ وَخَالاَتُكُمْ وَبَنَاتُ الأَخِ وَبَنَاتُ الأُخْتِ وَأُمَّهَاتُكُمُاللاَّتِيْ أَرْضَعْنَكُمْ وَأَخَوَاتُكُم مِّنَ الرَّضَاعَةِ وَأُمَّهَاتُ نِسَآئِكُمْ وَرَبَائِبُكُمُ اللاَّتِيْ فِيْ حُجُوْرِكُم مِّن نِّسَآئِكُمُ اللاَّتِيْ دَخَلْتُم بِهِنَّ فَإِن لَّمْ تَكُوْنُوْا دَخَلْتُم بِهِنَّ فَلاَ جُنَاحَ عَلَيْكُمْ وَحَلاَئِلُ أَبْنَائِكُمُ الَّذِيْنَ مِنْأَصْلاَبِكُمْ وَأَن تَجْمَعُوْا بَيْنَ الأُخْتَيْنِ إَلاَّ مَا قَدْ سَلَفَ إِنَّ اللهَ كَانَ غَفُوْرًا رَّحِيْمًا} [سورة النساء: 22، 233]
‘যাদেরকে তোমাদের পিতৃপুরুষ বিয়ে করেছে, সেসব নারীকে বিয়ে করো না, পূর্বে যা হয়ে গেছে হয়ে গেছে, নিশ্চয়ই তা অশ্লীল, অতি ঘৃণ্য ও নিকৃষ্ট পন্থা। – তোমাদের প্রতি হারাম করা হয়েছে তোমাদের মা এবং মেয়ে, বোন, ফুফু, খালা, ভাইঝি, ভাগিনী, দুধ মা, দুধ বোন, শ্বাশুড়ী, তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যার সাথে সঙ্গত হয়েছ তার পূর্ব স্বামীর ঔরসজাত মেয়ে যারা তোমাদের তত্ত্বাবধানে আছে, কিন্তু যদি তাদের সাথে তোমরা সহবাস না করে থাক, তবে (তাদের বদলে তাদের মেয়েদেরকে বিয়ে করলে) তোমাদের প্রতি গুনাহ নেই এবং (তোমাদের প্রতি হারাম করা হয়েছে) তোমাদের ঔরসজাত পুত্রের স্ত্রী এবং এক সঙ্গে দু’ বোনকে (বিবাহ বন্ধনে) রাখা, পূর্বে যা হয়ে গেছে হয়ে গেছে, নিশ্চয়ই আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল, দয়ালু।’ (আন-নিসা ৪ : ২২-২৩)
স্ত্রীকে পুরুষদের তালাক প্রদানের অধিকার ছিল কিন্তু এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোন সময় সীমা ছিল না অতঃপর ইসলাম তা নির্দিষ্ট করে দেয়।[2]
সেই আমলে ব্যভিচারের মতো একটি অতি ঘৃণ্য ও জঘন্য পাপাচারে লিপ্ত হতে প্রায় সকল শ্রেণীর মানুষকেই দেখা যেত। কোন গোষ্ঠী কিংবা গোত্রের খুব নগণ্য সংখ্যক লোকই এ নারকীয় দুষ্কর্ম থেকে মুক্ত থাকত। অবশ্য এমন কিছু সংখ্যক নারী-পুরুষও চোখে পড়ত যাঁদের আভিজাত্যানুভূতি ও সম্ভ্রম বোধ পাপাচারের এ পঙ্কিলতা থেকে তাঁদেরকে বিরত রাখত। অত্যন্ত দুঃসহ অবস্থার মধ্য দিয়ে নারীদের জীবন যাপন করতে হতো। অবশ্য দাসীদের তুলনায় স্বাধীনাদের অবস্থা কিছুটা ভালো ছিল।
সমাজে দাসীগণকে অত্যন্ত দুঃসহ অবস্থার মধ্য দিয়ে কালাতিপাত করতে হতো। তৎকালীন সমাজে এমন মনিবের সংখ্যা খুব কমই ছিল যিনি দাসীদের নিয়ে নানা অনাচার, যথেচ্ছাচার ও পাপাচারে লিপ্ত না হতেন। এ সব অনাচার ও পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারে কোন লজ্জাবোধ কিংবা সংশয়ের সৃষ্টি হতো না। যেমন ‘সুনানে আবূ দাউদ’ গ্রন্থে বর্ণিত আছে এক দফা এক ব্যক্তি খাড়া হয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে লক্ষ্য করে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ), অমুক ব্যক্তি আমার পুত্র। অজ্ঞতার যুগে আমি তার মার সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়েছিলাম।
প্রত্যুত্তরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘ইসলামে এমন দাবীর কোন সুযোগ কিংবা মূল্য নেই। অন্ধকার যুগের যাবতীয় প্রথা পদদলিত ও বিলুপ্ত হয়েছে। এখন পুত্র তাঁরই গণ্য হবে যার স্ত্রী আছে অথবা দাসী আছে। আর ব্যভিচারীর জন্য রয়েছে পাথর।
সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) এবং আবদ ইবনে যাম’আহর মধ্যে যাম’আহর দাসী পুত্র আব্দুর রহমান বিন যাম’আহর ব্যাপারে যে বিবাদ সংঘটিত হয় তা হচ্ছে একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা এবং এ ব্যাপারটি অবশ্যই অনেকের জানা কথা।[3]
অন্ধকার যুগে পিতা পুত্রের সম্পর্কও বিভিন্ন প্রকারের ছিল। সে সম্পর্কে ইতোপূর্বে কিছু কিছু আলোচিত হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এমনটি হয়তো বা বলা সঙ্গত হবে না যে সন্তান বাৎসল্যের ব্যাপারে তাদের কিছুটা ঘাটতি ছিল। নীচের কবিতার চরণটি প্রণিধানযোগ্যঃ
إنمـــا أولادنـــا بيننــا ** أكبادنا تمشـى على الأرض
‘‘আমাদের সন্তান আমাদের কলিজার টুকরো, যারা জমিনের উপর চলাফেরা করছে।’
পক্ষান্তরে, কন্যা সন্তানদের ব্যাপারে নারকীয় দুষ্কর্ম করতে তাঁরা একটুও দ্বিধাবোধ করতেন না। সমাজের লোক লজ্জা ও নিন্দা এবং তাঁদের জন্য ব্যয় নির্বাহের ভয়ে অনটন ও অনাহার এবং দুর্ভিক্ষের কারণে পুত্র সন্তানদেরও হত্যা করতেও তাঁরা কুণ্ঠা বোধ করতেন না।
আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে :
{قُلْ تَعَالَوْاْ أَتْلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمْ عَلَيْكُمْ أَلاَّ تُشْرِكُوْا بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَلاَ تَقْتُلُوْا أَوْلاَدَكُم مِّنْ إمْلاَقٍ نَّحْنُ نَرْزُقُكُمْ وَإِيَّاهُمْ وَلاَ تَقْرَبُوْا الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَلاَ تَقْتُلُوْا النَّفْسَ الَّتِيْحَرَّمَ اللهُ إِلاَّ بِالْحَقِّ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُوْنَ} [الأنعام: 151]
‘‘বল, ‘এসো, তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্য যা নিষিদ্ধ করেছেন তা পড়ে শোনাই, তা হচ্ছে, তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করো না, পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার কর, দরিদ্রতার ভয়ে তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না, আমিই তোমাদেরকে আর তাদেরকে জীবিকা দিয়ে থাকি, প্রকাশ্য বা গোপন কোন অশ্লীলতার কাছেও যেয়ো না, ন্যায়সঙ্গত কারণ ছাড়া কাউকে হত্যা করো না। এ সম্পর্কে তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যাতে তোমরা চিন্তা-ভাবনা করে কাজ কর।’ (আল-আন‘আম ৬ : ১৫১)[4]
কিন্তু পুত্র সন্তান হত্যার ব্যাপারে যে জনশ্রুতি রয়েছে তার যথার্থতা নির্ণয় করা বা প্রত্যয়ণ করা একটি অত্যন্ত মুস্কিল ব্যাপার। কারণ, গোত্রীয় বিরোধ এবং যুদ্ধবিগ্রহের সময় স্বপক্ষকে শক্তিশালী করা এবং যুদ্ধে জয়লাভ করার ব্যাপারে অন্যদের তুলনায় আপন আপন সন্তানেরাই অধিকতর নির্ভরযোগ্য বলে প্রামাণিত হতো। এ প্রেক্ষিতে পুত্র সন্তানগণের সংখ্যাধিক্যই আরববাসীগণের কাম্য হওয়া স্বাভাবিক।
অবশ্য এ জনশ্রুতিটি যে কোন ঐতিহাসিক সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত নয় এমনটি বলাও বোধ হয় সমীচীন হবে না। কারণ, ক্ষমতালিপ্সা, গোত্রপতিগণের জন্য পুত্র সন্তানগণের সংখ্যাধিক্য কাম্য হতে পারে। কিন্তু অনাহারী, অর্ধাহারী, নিরীহ গোবেচারা গরীব দুঃখীদের জন্য পুত্র সন্তানের আধিক্য কোন ক্রমেই কাম্য হতে পারে না। এরূপ ক্ষেত্রে দুর্ভিক্ষ কিংবা দুঃসময়ে পুত্র সন্তান হত্যার ব্যাপারটিকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না।
যতদূর জানা যায় তৎকালীন আরব সমাজে সহোদর ভাই, চাচাতো ভাই এবং গোষ্ঠী ও গোত্রের লোকজনদের পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপারটি ছিল অত্যন্ত শক্ত ও মজবুত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। এর কারণ হচ্ছে, বহু গোত্রে বিভক্ত এবং গোত্রে গোত্রে রেষারেষিক্লীষ্ট আরব সমাজে গোত্রীয় ঐক্যের সুদৃঢ় বন্ধনের উপর নির্ভর করেই টিকে থাকতে হতো আরববাসীগণকে। গোত্রের মান-মর্যাদা ও নিরাপত্তা রক্ষার ব্যাপারে জীবন উৎসর্গ করতেও তাঁরা কুণ্ঠিত হতেন না। গোত্র সমূহের অভ্যন্তরে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সামাজিকতার মূলতত্ত্ব গোত্রীয় চেতনা এবং আবেগ ও অনুভূতিকে সজীব ও সক্রিয় রাখার ব্যাপারে সহায়ক হতো। সাম্প্রদায়িকতা এবং আত্মীয়তাই ছিল গোত্রীয় নিয়ম-শৃঙ্খলার উৎস। তাঁরা সেই উদাহরণকে শাব্দিক অর্থে বাস্তবে রূপদান করতেন, যেমনঃ
(اُنْصُرْ أَخَاكَ ظَالِمًا أَوْ مَظْلُوْمًا)
(নিজ ভাইকে সাহায্য কর সে অত্যাচারী হোক কিংবা অত্যাচারিত হোক)।
ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বিভিন্ন গোত্রের লোকজনের মধ্যে উৎকট এ গোত্রীয় চিন্তাধারা প্রচলিত ছিল। ইসলাম সেই সকল ধারণার মূলোৎপাটন করেছে। অত্যাচারী এবং অত্যাচারিত উভয়কেই সাহায্য করার বিধান ইসলামে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে অত্যাচারীকে সাহায্য করার অর্থ হল তাঁকে অন্যায় ও অনাচার থেকে বিরত রাখা। অবশ্য, মর্যাদা এবং নেতৃত্ব কর্তৃত্বের ব্যাপারে একে অন্যের আগে অগ্রসর হওয়ার যে আকুতি ও আকঙ্খা একই ব্যক্তি কর্তৃক বহুবার তা বাস্তবে পরিণত করতে চাওয়ার কারণেই গোত্র সমূহের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহের দামামা বেজে উঠত। আওস ও খাযরাজ, আবস ও যুবইয়ান, বাকর ও তগলিব এবং অন্যান্য গোত্রের সংঘটিত ঘটনাবলীর ক্ষেত্রে যেমনটি লক্ষ্য করা যায়।
পক্ষান্তরে যতদূর জানা যায়, বিভিন্ন গোত্র বা গোষ্ঠির পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপারটি ছিল অপেক্ষাকৃত শিথিল বন্ধনের উপর প্রতিষ্ঠিত। প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন গোত্রের সকল ক্ষমতাই ব্যয়িত হতো পরস্পর পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহে। তবে দ্বীনী ব্যবস্থা এবং অশ্লীল কথনের সংমিশ্রণে গঠিত কতিপয় রীতিনীতি ও অভ্যাসের মাধ্যমে কোন কোন ক্ষেত্রে পারস্পরিক লেনদেন, সহযোগিতামূলক কাজকর্ম সংক্রান্ত চুক্তি, প্রতিজ্ঞাপত্র এবং আনুগত্যের বিধি বিধান সমন্বিত ব্যবস্থাধীনে গোত্রগুলো পরস্পর একত্রিত হতেন। সর্বোপরি, হারাম মাসগুলো তাঁদের জীবিকার্জন ও জীবন নির্বাহের ব্যাপারে বিশেষভাবে সহায়ক ছিল। এ মাসগুলোতে তারা পরিপূর্ণ নিরাপত্তা দিত কেননা এ মাসগুলোকে তারা অত্যন্ত মর্যাদা প্রদান করতো। যেমন আবূ রযা ‘উতারিদী বলেন, যখন রজব মাস সমাগত হতো তখন আমরা বলতাম, منصل الأسنة তখন এমন কোন তীর বা বর্শা থাকতো না যা অকার্যকর করার জন্য তা থেকে আমরা লোহার ফলক খুলে ফেলতাম না এবং রজব মাসে আমরা এগুলো দূরে নিক্ষেপ করতাম। অন্যান্য হারাম মাসগুলোতেও একই অবস্থা বিরাজ করতো।
জাহেলিয়াত যুগের আরব সমাজের সামাজিক অবস্থার সারকথা বলতে গেলে শুধু এটুকুই বলতে হয় যে স্থিরতা এবং কুপমন্ডুকতাই সমাজ জীবনের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। অজ্ঞতা, অশ্লীলতা, স্বেচ্ছাচারিতা ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ছিল সমগ্র সমাজ। অসত্য ও অন্যায়ের নিকট সত্য ও ন্যায় হয়ে পড়েছিল সম্পূর্ণরূপে পর্যুদস্ত। সাধারণ মানুষকে জীবন যাপন করতে হতো পশুর মত। বাজারের পণ্যের মতো ক্রয়-বিক্রয় করা হতো মহিলাদের এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তাঁদের সঙ্গে ব্যবহার করা হতো মাটি ও পাথরের মতো। গোত্র কিংবা রাষ্ট্র যাই বলা হোক না কেন, প্রশাসনের মূল ভিত্তি ছিল শক্তিমত্ততা। প্রশাসন পরিচালিত হতো শক্তিধরগণের স্বার্থে। দুর্বলতর শ্রেণীর সাধারণ লোকজনের কল্যাণের কথা কস্মিনকালেও চিন্তা করা হতো না। প্রজাদের নিকট থেকে গৃহীত অর্থসম্পদে কোষাগার ভরে তোলা হতো এবং প্রতিদ্বন্দ্বীগণের বিরুদ্ধে সৈন্যদলের মহড়া এবং যুদ্ধবিগ্রহের উদ্দেশ্যেই তা সংরক্ষিত হতো।
ফুটনোটঃ[1] সহীহুল বুখারী, ‘অভিভাবক ছাড়া বিবাহ হবে না’’ অধ্যায় ২য় খন্ড ৭৬৯ পৃঃ এবং আবূ দাউদ, নেকাহর পদ্ধতিসমূহ অধ্যায়।
[2] আবূ দাউদ মুরাযায়াত বাদা ত্বাতালিকাতিস সালাম ৬৫ পৃঃ ‘আত্তালাকু মার্রতানে’’ সংশিষ্ট তাফসীর গ্রন্থ দ্রষ্টব্য।
[3] সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৯৯৯, ১০৬৫ পৃঃ, আবূ দাউদ ‘আল আওলাদুলিল ফিরাশ’’ অধ্যায় দ্রষ্টব্য।
[4] কুরআন মাজীদ : ১৬/৫৮, ৫৯, ১৭/৩১, ৮১।
অর্থনৈতিক অবস্থাঃ
জাহেলিয়াত যুগের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো এবং অর্থনৈতিক অবস্থা ও ব্যবস্থাকে কোনক্রমেই সামাজিক অবস্থার চাইতে উন্নত বলা যেতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে তেজারত ব্যবসা-বাণিজ্যই ছিল আরব অধিবাসীগণের জীবন ও জীবিকার প্রধান অবলম্বন। কিন্তু দেশ থেকে দেশান্তরে গমনাগমন, মালপত্র পরিবহন, বাণিজ্যে উদ্দেশে ভ্রমণ পর্যটনের জন্য নিরাপত্তা ও শান্তি-শৃঙ্খলা ইত্যাদি ব্যাপারগুলো এতই সমস্যা সংকুল ছিল যে, নির্বিঘ্নে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করা ছিল এক দুষ্কর ব্যাপার। তৎকালে মরুপথে গমনাগমন এবং মালপত্র পরিবহনের একমাত্র মাধ্যম ছিল উট। উটের পিঠে চড়ে যাতায়াত এবং মালপত্র পরিবহনের ব্যবস্থাটি ছিল অত্যান্ত সময়-সাপেক্ষ ব্যাপার। তাছাড়া, পথও ছিল অত্যন্ত বিপদসংকুল। সব দিক দিয়ে সুসজ্জিত বড় বড় কাফেলা ছাড়া পথ চলার কথা চিন্তাই করা যেত না। কিন্তু তা সত্ত্বেও যে কোন সময় দস্যুদল কর্তৃক আক্রান্ত এবং যথা-সর্বস্ব লুণ্ঠিত হওয়ার ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে থাকতে হতো কাফেলার সকলকে। অবশ্য, হারাম মাসগুলোতে তাঁরা কিছুটা নির্ভয়ে ও নির্বিঘ্নে ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজকর্ম চালিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু তা ছিল সময়ের একটি সীমিত পরিসরে সীমাবদ্ধ। কাজেই, বাণিজ্য-নির্ভর হলেও নানাবিধ কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য তাঁরা তেমন সুবিধা করতে পারতেন না। তবে হারাম মাসগুলোতে ‘উকায, যুল মাজায, মাজান্নাহ এবং আরও কিছু প্রসিদ্ধ মেলায় বেচা-কেনা করে তাঁরা কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারতেন।’
আরব ভূখন্ডে শিল্পের প্রচলন তেমন এতটা ছিল না। শিল্প কারখানার ব্যাপারে পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় আরব দেশ আজও পিছনে পড়ে রয়েছে তুলনামূলকভাবে, সেকালে আরও অনেক বেশী পিছনে পড়ে ছিল। শিল্পের মধ্যে বস্ত্র, চর্ম শিল্প, ধাতব শিল্প, ইত্যাদি শিল্পের প্রচলন চোখে পড়ত। অবশ্য, এ শিল্পগুলো ইয়ামান, হীরা এবং শামরাজ্যের সন্নিকটস্থ অঞ্চলগুলোতেই প্রসার লাভ করেছিল অপেক্ষাকৃত বেশী। কিন্তু সুতোকাটার কাজে সকল অঞ্চলের মহিলাদেরই ব্যাপৃত থাকতে দেখা যেত। আরব ভূখন্ডে অভ্যন্তর ভাগের লোকেরা প্রায় সকলেই পশু পালন কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করত। মরু প্রান্তরের আনাচে-কানাচে যে সকল স্থানে কৃষির উপযোগী ভূমি পাওয়া যেত সে সকল স্থানে কৃষির ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে সমস্যাটি সব চাইতে জটিল ছিল তা হচ্ছে, মানুষের দারিদ্র দূরীকরণ এর মাধ্যম জীবনমান উন্নয়ন, মহামারী ও বোগব্যাধি দূরীকরণ কিংবা অন্য কোন কল্যাণমূলক কাজে অর্থ-সম্পদের খুব সামান্য অংশই ব্যয়িত হতো। সম্পদের সিংহ ভাগই ব্যয়িত হতো যুদ্ধবিগ্রহের কাজে। কাজেই, জনজীবনে সুখ, শান্তি বা স্বাচ্ছন্দ্য বলতে তেমন কিছুই ছিল না। সমাজে এমন এক শ্রেণীর লোক ছিল যাদের দুবেলা দু মুঠো অন্ন এবং দেহাবরণের জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় বস্ত্রখন্ডের সংস্থানও সম্ভব হতো না।
নীতি-নৈতিকতা :
মরুচারী আরববাসীগণের নীতি-নৈতিকতা ও চরিত্রের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী দুইটি ধারার বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। এক দিকে লক্ষ্য করা যায় জুয়া, মদ্যপান, ব্যভিচার, হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি, হত্যা, প্রতিহিংসা পরায়ণতা ইত্যাদি জঘন্য মানবেতর ক্রিয়াকলাপ, অন্যদিকে লক্ষ্য করা যায় দয়া-দাক্ষিণ্য, উদারতা, অতিথিপরায়ণতা প্রতিজ্ঞাপরায়ণতা এবং আরও অনেক উন্নত মানসিক গুণাবলীর সমাবেশ। তাঁদের মানবেতর ক্রিয়াকলাপ এবং আচরণ সম্পর্কে ইতোপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। এ পর্যায়ে তাঁদের চরিত্রের বিভিন্ন মানবিক দিক এবং সমস্ত গুণাবলী সম্পর্কে আলোচনা করা হলঃ
১. দয়া-দাক্ষিণ্য ও উদারতাঃ অন্ধকার যুগের আরববাসীগণের দয়া-দাক্ষিণ্য সম্পর্কিত জনশ্রুতি ছিল সর্ব যুগের মানুষের গর্ব করার মতো একটি বিষয়। নীতি- নৈতিকতার ক্ষেত্রে ভ্রষ্টতার নিম্নতম পর্যায়ে পৌঁছলেও দয়া-দাক্ষিণ্য কিংবা বদান্যতার ব্যাপারে বিশ্ব মানব গোষ্ঠীর মধ্যে তাঁরা ছিলেন সকলের শীর্ষস্থানে। শুধু তাই নয় এ নিয়ে তাঁদের রীতিমত প্রতিযোগিতা চলতো এবং এ ব্যাপারে তাঁরা এ বলে গর্ব করতেন যে, ‘আরবের অর্ধভাগ তার জন্য উপহার হয়ে গিয়েছে।’ এ গুণকে কেন্দ্র করে কেউ কেউ নিজের প্রশংসা নিজেই করেছে আবার কেউ করেছে অন্যের প্রশংসা।
তাঁদের বদান্যতা বাস্তবিক পক্ষে এতই উঁচু মানের ছিল যে তা মানুষকে বিস্ময়ে অভিভূত করে ফেলে। কোন কোন ক্ষেত্রে এমনটিও দেখা গিয়েছে যে, কঠিন শীত কিংবা ক্ষুধার সময়ও কারো বাড়িতে যদি মেহমান আসতেন এবং তাঁর জীবন ও জীবিকার জন্য অপরিহার্যরূপে প্রয়োজনীয় একটি উট ছাড়া আর কোন সম্বলই নেই, তবুও এমন এক সংকটময় মুহূর্তেও তাঁর উদারতা এবং অতিথিপরায়ণতা তাঁকে এতটা প্রভাবিত করে ফেলত যে, অগ্র-পশ্চাৎ চিন্তা না করে তৎক্ষনাৎ সেই উটটি জবেহ করে মেহমানের মেহামান দারিত্বে তিনি লিপ্ত হয়ে পড়তেন। অধিকন্তু, তাঁদের দয়া-দাক্ষিণ্য এবং উদারতার অন্যন্য চেতনায় তারা বড় বড় শোনিত পাতের মূলসূত্র কিংবা তদ্সংক্রান্ত আর্থিক দায়-দায়িত্ব অবলীলাক্রমে আপন স্কন্ধে তুলে নিয়ে এমনভাবে মানুষকে ধ্বংস ও রক্তপাতের বিভীষিকা থেকে রক্ষা করত যে অন্যান্য নেতা কিংবা দলপতিগণের তুলনায় তা অনেক বেশী গর্বের ব্যাপারে হয়ে দাঁড়াত।
এ প্রসঙ্গে একটি মজার ব্যাপার ছিল, দয়া-দাক্ষিণ্যের অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করে তাঁরা যেমন গর্ববোধ করতেন তেমনি মদ্যপান করেও গর্ববোধ করতেন। মদ্যপান একটি গর্বের বিষয় সেই অর্থে মদ্যপান করে তাঁরা গর্ববোধ করতেন না, বরং এ জন্য গর্ববোধ করতেন যে, উদারতার উদবোধক হিসেবে তাদের উপর বিশেষভাবে প্রাধান্য বিস্তার করত যার ফলশ্রুতিতে কোন ত্যাগ স্বীকারকেই তাঁরা বড় মনে করতেন না। এর প্রকৃত কারণ হচ্ছে, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় মানুষ অসাধ্য সাধন করতে পিছপা হয় না। এজন্য এরা আঙ্গুর ফলের বৃক্ষকে ‘কারম’ এবং আঙ্গুর রসে তৈরি মদ্যকে ‘বিনতুল কারম’ (কারমের কন্যা) বলতেন। জাহেলিয়াত যুগের কবিগণের কাব্যে এ জাতীয় প্রশংসা এবং গৌরবসূচক রচনা একটি উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে রয়েছে। আনতার বিন সাদ্দাদ আবসী তাঁর নিজ মুয়াল্লাকায় বলেছেনঃ
অর্থঃ ‘নিদাঘের উত্তাপ স্তিমিত হওয়ার পর বাম দিকে রক্ষিত হলুদ বর্ণের এক নকশাদার কাঁচ পাত্র হতে যা ফুটন্ত এবং মোহরকৃত মদপূর্ণ ছিল, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন মদ্য আমি পান করলাম এবং যখন আমি তা পান করি তখন নিজের মাল লুটিয়ে দিই, কিন্তু আমার মান-ইজ্জতপূর্ণ মাত্রায় থাকে। এর উপর কোন চোট কিংবা আঘাত আসে না। তারপর যখন আমি সজ্ঞানে থাকি, কিংবা যখন আমার জ্ঞান ফিরে আসে তখনো আমি দান করতে কুণ্ঠিত হই না, এবং আমার দয়া-দাক্ষিণ্য যা কিছু সে সব সম্পর্কে তোমরা অবহিত রয়েছ।’’
তাঁরা জুয়া খেলতেন এবং মনে করতেন যে, ‘এটাও হচ্ছে তাঁদের দয়া-দাক্ষিণ্যের একটি পথ। কারণ, এর মাধ্যমে তাঁরা যে পরিমাণ উপকৃত হতেন তার অংশ বিশেষ, কিংবা উপকৃত ব্যক্তিদের অংশ থেকে যা অবশিষ্ট থেকে যেত তা অসহায় এবং মিসকীনদের মধ্যে পান করে দিতেন। এ জন্যই কুরআন কারীমে মদ এবং জুয়ার উপকারকে অস্বীকার করা হয়নি। বরং এ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে,
{وَإِثْمُهُمَآ أَكْبَرُ مِن نَّفْعِهِمَا} [البقرة:219]
‘‘কিন্তু এ দু’টোর পাপ এ দু’টোর উপকার অপেক্ষা অধিক’।’ (আল-বাক্বারাহ ২ : ২১৯)
২. প্রতিজ্ঞাপরায়ণতাঃ অন্ধকার যুগের আরববাসীগণের অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল প্রতিজ্ঞা পরায়ণতা। ওয়াদা পালন বা অঙ্গীকার রক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, কিংবা অন্য কোনভাবে তাঁরা যাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত থাকতেন তাঁদের জন্য সন্তানগণের রক্ত প্রবাহিত করা, কিংবা নিজ বাস্তভিটা বিলুপ্ত করার মতো অতীব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারকেও তাঁরা সামান্য কিছু মনে করতেন। এর যথার্থতা উপলব্ধির জন্য হানি বিন মাস’উদ শাইবানী, সামাওয়াল বিন আদিয়া এবং হাজেব বিন যুরারাহ তামীমী এর ঘটনাবলীই যথেষ্ট।
৩. ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদাবোধঃ জাহেলিয়াত যুগের আরববাসীগণের অন্যতম ব্যক্তি বৈশিষ্ট্য ছিল পার্থিব সব কিছুর উপর নিজের মান ইজ্জতকে প্রাধান্য দেয়া এবং কোন প্রকার অন্যায় অত্যাচার সহ্য না করা। এর ফলে এরূপ দাঁড়িয়েছিল যে, তাঁদের উৎকট অহংবোধ এবং মর্যাদাবোধ সীমা অতিক্রম করে গিয়েছিল। বিশেষ কোন কারণে তাঁদের এ অহং ও মর্যাদাবোধ এর উপর সামান্যতম আঘাত কিংবা অপমান এলেও তাঁরা উত্তেজিত হয়ে পড়তেন এবং তরাবারি, বর্শা, ফলা ইত্যাদি নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পড়তেন। এ সংঘর্ষে লিপ্ত হতে গিয়ে তাঁদের প্রাণহানির ব্যাপারে কোনই উৎকণ্ঠা থাকত না। প্রাণের তুলনায় মান-মর্যাদাকেই তাঁরা অধিকতর মূল্যবান মনে করতেন।
৪. সংকল্প বাস্তবায়নঃ প্রাক ইসলামি আরববাসীগণের আরও একটি বৈশিষ্ট্য ছিল এ রকম যে, কোন কাজ-কর্মকে মান-সম্মান ও পুরুষের প্রতীক মনে করে যখন তাঁরা সেই কর্ম সম্পাদনের লক্ষ্যে সংকল্পবদ্ধ হতেন তখন তাঁরা প্রাণ বাজী রেখে সেই কর্ম সম্পাদনের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তেন। পার্থিব কোন শক্তিই তাঁদেরকে এ সংকল্প থেকে বিরত রাখতে পারত না।
৫. ভদ্রতা, ধৈর্য্য ও গাম্ভীর্যঃ ভদ্রতা-শিষ্টতা ও ধৈর্য্য-গাম্ভীর্য আরববাসীগণের নিকট খুবই প্রিয় ও প্রশংসনীয় ছিল। এ সকল মানসিক গুণাবলীকে কোন সময়েই তাঁরা খাটো করে দেখতেন না, কিন্তু তাঁদের উগ্র স্বভাব, উৎকট অহংবোধ ও প্রতিহিংসা পরায়ণতার কারণে খুব কম ক্ষেত্রেই এর যথার্থতা রক্ষা করতে তাঁরা সক্ষম হতেন।
৬. সরলতা ও অনাড়ম্বরতাঃ ইসলাম পূর্ব আরববাসীগণের সংস্কৃতি ধারা থেকে অবগত হওয়া যায় যে, তাঁদের জীবন যাত্রা ছিল অত্যন্ত সহজ সরল এবং অনাড়ম্বর। তাঁদের চিন্তা ও চেতনার মধ্যে ঘোর-প্যাঁচ কিংবা জটিলতার লেশমাত্র থাকত না। উদার, উন্মুক্ত অগ্নিখরা মরু প্রকৃতির মতই তাঁদের মন ছিল উন্মুক্ত, কিন্তু মেজাজ ছিল তীক্ষ্ণ। এ কারণে প্রকৃতিগতভাবেই তাঁরা ছিলেন সৎ এবং সততা প্রিয়। ধোঁকাবাজী এবং বিশ্বাস ভঙ্গের মতো কোন ব্যাপার ছিল তাঁদের সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। গচ্ছিত ধন বা আমানত রক্ষার ব্যাপারটিকে তাঁদের পবিত্রতম দায়িত্ব হিসেবেই তাঁরা গণ্য করতেন।
আমরা সর্বান্তঃকরণে বিশ্বাস করি যে, এ পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলে আরব ভূমির অবস্থান, আরব ভূমির ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগত বিশেষ বিশেষ সুযোগ-সুবিধা, আরববাসীগণের উদার-উন্মুক্ত মানবিক চেতনা, অতিথি পরায়ণতা, সহজ, সরল ও অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা এবং আমানত গচ্ছিত রাখার অনপনেয় উপযুক্ততার প্রেক্ষাপটে আরব ভূমিকে ইসলাম প্রচারের কেন্দ্রবিন্দু, আরব জাতিকে আল্লাহর পবিত্রতম আমানত ইসলামকে হেফাজত করার উপযুক্ত মানবগোষ্ঠি, আরবী ভাষাকে আল্লাহর বাণী ধারণ ও বহনের উপযুক্ত ভাষা এবং আরব সম্প্রদায়ের মধ্যে সকল দৃষ্টিকোণ থেকে সর্বোত্তম ব্যক্তিটিকে নবুওয়াত ও রিসালাতের উপযুক্ত বিবেচনা সাপেক্ষে ইসলামের আয়োজন ও বাস্তবায়ন ধারা সূচিত হয়েছিল।
আর সম্ভবত আরবদের এসব চারিত্রিক বৈশিষ্টে বিশেষ করে প্রতিশ্রুত পূর্ণ করা ছাড়াও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও উপকারী বৈশিষ্ট্য তা হলো আত্মমর্যাদাবোধ ও সংকল্পে অটল থাকা। আর এ সব মহৎ গুণাবলী ও স্বচ্ছ পরিষ্কার দৃঢ় সংকল্প ব্যতীত অন্যায় অত্যাচার, ফিতনা ফাসাদ দূরীভূত করা এবং একটি ইনসাফপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। উল্লেখিত এসব চারিত্রিক গুণ ছাড়াও তাদের অনেক উত্তম রয়েছে গুণ যারা অনুসন্ধান করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়।
রাসুল (স) এর বংশ পরম্পরা
পয়গম্বরী বংশাবলী (نَسَبُ النَّبِيِّ ﷺ ):
পরম্পরাগত সূত্রে নাবী কারীম (সাঃ)-এর বংশাবলীকে তিন পর্যায়ে ভাগ করে নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। এর প্রথম পর্যায় হচ্ছে আদনান পর্যন্ত যার বিশুদ্ধতা সম্পর্কে চরিতবেত্তা এবং বংশাবলী বিশেষজ্ঞা বিভিন্ন মত পোষণ করে থাকেন। এর দ্বিতীয় পর্যায় হচ্ছে আদনান হতে উপরে ইবরাহীম (আঃ) পর্যন্ত। দ্বিতীয় পর্যায়ের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে চরিতবেত্তা এবং বংশাবলী বিশেষজ্ঞগণের মধ্যে দ্বিমত বা মতান্তর রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারটিকে কেউ কেউ মুলতুবী রেখেছেন, কেউ কেউ বা আবার কথাবার্তাও বলেছেন। তৃতীয় পর্যায়ের সময়কাল হচ্ছে ইবরাহীম (আঃ) থেকে আদম (আঃ) পর্যন্ত। বিশেষজ্ঞগণের অভিমত হচ্ছে, তৃতীয় পর্যায়ের আলোচনা এবং সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে কিছুটা ভুলভ্রান্তি রয়েছে। উপরে উল্লেখিত পর্যায় তিনটি সম্পর্কে কিছুটা বিস্তৃত আকারে নিম্নে আলোচনা করা হল।
প্রথম পর্যায়ঃ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল মুত্তালিব (শায়বাহ) বিন হাশিম (‘আমর) বিন আবদে মানাফ (মুগীরাহ) বিন কুসাই (যায়দ) বিন কিলাব বিন মুররাহ বিন কা‘ব লুওয়াই বিন গালিব বিন ফিহর (তাঁর উপাধি ছিল কুরাইশ এবং এ সূত্রেই কুরাইশ বংশের উদ্ভব) বিন মালিক বিন নাযর (ক্বায়স) বিন কিনানাহ বিন খুযায়মাহ বিন মুদরিকাহ (আমির) বিন ইলিয়াস বিন মুযার বিন নিযার বিন মা’আদ্দ বিন আদনান।[1]
দ্বিতীয় পর্যায়ঃ আদনান থেকে উপরের দিক অর্থাৎ আদনান বিন উদাদ বিন হামায়সা’ বিন সালামান বিন ‘আওস বিন বুয বিন ক্বামওয়াল বিন উবাই বিন ‘আউওয়াম বিন নাশিদ বিন হিযা বিন বালদাস বিন ইয়াদলাফ বিন ত্বাবিখ বিন যাহিম বিন নাহিশ বিন মাখী বিন ‘আইয বিন আ’বক্বার বিন উবাইদ বিন আদ-দু’আ বিন হামদান বিন সুনবর বিন ইয়াসরিবী বিন ইয়াহযুন বিন ইয়ালহান বিন আর’আওয়া বিন ‘আইয বিন দীশান বিন ‘আইসার বিন আফনাদ বিন আইহাম বিন মুক্বসির বিন নাহিস বিন যারিহ বিন সুমাই বিন মুযী বিন ‘আওযাহ বিন ‘ইরাম বিন ক্বাইদার বিন ইসামাঈল বিন ইবরাহীম (আঃ)।[2]
তৃতীয় পর্যায়ঃ ইবরাহীম (আঃ) হতে উপরে ইবরাহীম বিন তারিহ (আযর) নাহুর বিন সারু’ অথবা সারুগ বিন রাউ’ বিন ফালাখ বিন ‘আবির বিন শালাখ বিন আরফাখশাদ বিন শাম বিন নূহ (আঃ) বিন লামিক বিন মাতাওশালখ বিন আখনুন (কথিত আছে এ নাম ছিল ইদরিস (আঃ)-এর নাম) বিন ইয়াদ বিন মাহলায়ীল বিন ক্বায়নান বিন আনূশ বিন শীস বিন আদম (আঃ)।[3]
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১ ও ২ তালকীহ ফুহুমি আহলিল আসার ৫ ও ৬ পৃষ্ঠা, রাহমাতুল্লিল আলামীন ২য় খন্ড ১১-১৪ ও ৫২ পৃষ্ঠা।
[2] খুব সূক্ষ্ণ অনুসন্ধানের পর আল্লামা মানসুরপুরী বংশাবলীর অংশ কালবী এবং ইবনে সা’দের বর্ণনা দ্বারা একত্রিত করেছেন, দ্রষ্টব্য রহমাতুল্লিল আলামীন ২য় খন্ড ১৪-১৭ পৃঃ। এ অংশের ঐতিহাসিক সূত্রে মত বিরোধ।
[3] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ২-৪ পৃঃ তালকীহুল ফহুম ৬ পৃঃ খোলাসাতুস সিয়র ৬ পৃঃ রহমাতুল্লিল আলামীন ২য় খন্ড ১৮ পৃঃ কোন কোন না নিয়ে ঐ সুত্রগুলোতে মতভেদ আছে এবং কোন কোন সূত্রে কোন কোন নাম ছুটে গেছে।
নাবী পরিবার পরম্পরা (الأُسْرَةُ النَّبَوِيَّةُ):
নাবী কারীম (সাঃ)-এর পরিবার উপরের দিকে তাঁর প্রপিতামহ হাশিম বিন আবদে মানাফ থেকে পারিবারিক পরিচয় প্রদানের মূলসূত্র ধরার কারণে তা হাশেমী পরিবার নামে প্রসিদ্ধ ছিল। নাবী কারীম (সাঃ) সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভের জন্য তাঁর পিতামহ, প্রপিতামহ, অর্থাৎ পূর্বতন কয়েক প্রজন্মের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণের জীবনী সম্পর্কে আলোচনার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। এ প্রেক্ষিতেই পরবর্তী আলোচনাঃ
হাশেমঃ আমরা ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি যে, যখন বনু আবদে মানাফ এবং বনু আবদুদ্দারের মধ্যে হারামের সঙ্গে সংশিষ্ট পদ সমূহ বন্টনের ব্যাপারে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল তখন আবদে মানাফের সন্তানদের মধ্যে হাশিমকেই ‘সিক্বায়াহ’ এবং রিফাদাহ অর্থাৎ হজ্জযাত্রীগণকে পানি পান করানো এবং তাঁদের মেহমানদারী করার মর্যাদা প্রদান করা হয়। হাশিম ছিলেন অত্যন্ত সম্মানিত ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিত্ব। তিনিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি ‘শোরবা’ বা ঝোলের সঙ্গে রুটি মিশ্রিত করে মক্কায় হজ্জযাত্রীগণকে খাওয়ানোর বন্দোবস্ত করেন। তাঁর আসল নাম ছিল ‘‘আমর’। কিন্তু শোরবা বা ঝোলের সঙ্গে রুটি ভেঙ্গে মিশ্রিত করার কারণে ‘হাশিম’ নামে তাকে ডাকা হতে থাকে। কারণ, হাশিম অর্থ হচ্ছে যিনি কোন কিছু ভেঙ্গে ফেলেন। আবার এ হাশিমই হচ্ছেন প্রথম ব্যক্তি যিনি কুরাইশদের জন্য গ্রীষ্ম ও শীত কালে ব্যবসা-সংক্রান্ত দুইটি ভ্রমণ-পর্যটনের গোড়াপত্তন করেন। তাঁর সম্পর্কে জনৈক কবি বলেছেনঃ
عمرو الذي هَشَمَ الثريدَ لقومه
**
قَومٍ بمكة مُسِْنتِين عِجَافِ
سُنَّتْ إليه الرحلتان كلاهما
**
سَفَرُ الشتاء ورحلة الأصياف
অর্থঃ ‘এ ‘আমরই এমন ব্যক্তিসত্তা যিনি দুর্ভিক্ষ পীড়িত দুর্বল স্বজাতির জন্য মক্কায় ‘শোরবা বা ঝোলের মধ্যে রুটির টুকরো ভিজিয়ে ভিজিয়ে খাইয়েছিলেন এবং শীত ও গ্রীষ্মের দিনে ভ্রমণের ব্যবস্থা করেছিলেন।’
তাঁর ব্যক্তি জীবন এবং পরবর্তী ইতিহাসের সঙ্গে সংশিষ্ট একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল এটা যে, ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে শাম রাজ্যে যাওয়ার পথে যখন তিনি মদীনায় পৌঁছলেন তখন সেখানে বনু নাজ্জার গোত্রের সালামাহ বিনতে ‘আমর নাম্নী এক মহিলাকে বিবাহ করেন এবং কিছুকাল সেখানে অবস্থান করেন। তারপর স্বীয় স্ত্রীকে গর্ভবতী অবস্থায় তাঁর পিত্রালয়ে রেখে দিয়ে তিনি শাম রাজ্যে চলে যান এবং সেখানে গিয়ে ফিলিস্ত্বীনের গায্যাহ শহরে পরলোক গমন করেন।
এদিকে সালামাহর গর্ভজাত সন্তান যথা সময়ে ভূমিষ্ট হন। বর্ষপঞ্জীর হিসেবে সে বছরটি ছিল ৪৯৭ খ্রীষ্টাব্দ। নবজাত শিশুর মাথার চুল ছিল সাদা তাই সালামাহ তাঁর নাম রাখেন শায়বাহ।[1] সালামাহ নিজ পিত্রালয়ে সযত্নে তাঁর লালন পালন করতে থাকেন। সেদিনের এ শিশুটিই ছিলেন পরবর্তী কালে আখেরী নাবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর পিতামহ এবং অভিভাবক আব্দুল মুত্তালিব। শিশু আব্দুল মুত্তালিব দিনে দিনে শশীকলার মত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে উঠলেও দীর্ঘদিন যাবৎ হাশিম পরিবারের কেউই তাঁর জন্মের কথা জানতে পারেন নি। হাশিম ছিলেন ৯ জন সন্তান-সন্ততির জনক। ৯ জনের মধ্যে ৪ জন ছেলে ও ৫ জন মেয়ে। তাঁদের নাম হচ্ছে যথাক্রমে আসাদ, আবূ সাইফী, নাযলাহ, আব্দুল মুত্তালিব এবং শিফা, খালিদাহ, যা’ঈফাহ, রুক্বাইয়া ও জান্নাহ।[2]
আব্দুল মুত্তালিবঃ পূর্বোক্ত আলোচনা থেকে আমরা বিলক্ষণ অবগত হয়েছি যে, ‘সিক্বায়াহ’ এবং ‘রিফাদাহ’ সম্পর্কিত পদের দায়িত্ব অর্পিত ছিল হাশিমের উপর। হাশিমের মৃত্যুর পর সেই দায়িত্ব অর্পিত হয় তাঁর ভাই মুত্তালিবের উপর। তিনিও দলের মধ্যে বিভিন্ন সদগুণাবলী এবং মান-মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। তাঁর কথা অমান্য করা কিংবা নড়চড় করার ক্ষমতা দলের অন্য কারো ছিল না। বদান্যতার জন্যও তিনি প্রসিদ্ধ ছিলেন। বদান্যতার কারণেই কুরাইশগণ তাঁর নাম রাখেন ‘ফাইয়ায’। যখন শায়বাহ অর্থাৎ আব্দুল মুত্তালিব দশ বছর বয়সে উপনীত হন তখন মুত্তালিব তাঁর সম্পর্কে অবগত হয়ে নিয়ে আসার জন্য ইয়াসরিব গমন করেন। সেখানে পৌঁছার পর যখন তিনি শায়বাহকে দেখতে পান তখন তাঁর চক্ষুদ্বয় থেকে অশ্রুধারা প্রবাহিত হতে থাকে। তারপর তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে উষ্ট্র পৃষ্ঠে আরোহণ করে নেন এবং মক্কা অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন।
কিন্তু শায়বাহ তাঁর মাতার অনুমতি ব্যতিরেকে মক্কা যেতে অস্বীকার করায় তাঁকে নিয়ে যাওয়ার জন্য মুত্তালিব তাঁর মাতার নিকট অনুমতি প্রার্থী হন। কিন্তু শায়বাহর মাতা তাঁকে অনুমতি দিতে অস্বীকার করলে মুত্তালিব তাঁকে এ কথা বুঝিয়ে বলেন যে, ‘এ ছেলে তাঁর পিতার রাজত্বে এবং আল্লাহর হারাম শরীফের দিকে যাচ্ছেন। নিশ্চিতরূপে এ হচ্ছে তাঁর চরম সৌভাগ্যের ব্যাপার।’’
এ কথা শ্রবণের পর শায়বাহকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁর আম্মা অনুমতি প্রদান করেন। অনুমতি লাভের পর মুত্তালিব তাঁকে তাঁর উটের পিঠে বসিয়ে মক্কা অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকেন। মক্কায় পৌঁছলে শায়বাহকে মুত্তালিবের পাশে দেখে মক্কাবাসীগণ বলেন যে, এ বালক হচ্ছে ‘আব্দুল মুত্তালিব’ অর্থাৎ মুত্তালিবের দাস। তদুত্তরে মুত্তালিব বলেন, ‘না না, এ হচ্ছে আমার ভ্রাতুষ্পুত্র, আমার ভাই হাশিমের ছেলে।’ এর পর থেকে মুত্তালিবের নিকট লালিত হতে থাকেন।
শায়বাহ যখন যৌবনে পদার্পণ করেন তখন কোন এক সময় রোমান সাম্রাজ্যের ইয়ামানে মুত্তালিব পরলোক গমন করেন। তাঁর মৃত্যুর পর আব্দুল মুত্তালিব পরিত্যক্ত পদ সমূহের অধিকার লাভ করেন। কালক্রমে আব্দুল মুত্তালিব নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে এমন মান-মর্যাদা লাভ করেন যে, তাঁর পিতা কিংবা পিতামহ কেউই এত মান-সম্মানের অধিকারী হতে সক্ষম হন নি। একজন গুণী ব্যক্তি হিসেবে কাওমের লোকেরা সকলেই তাঁকে একান্ত আন্তরিকতার সঙ্গে ভালবাসতেন এবং সমীহ করে চলতেন।[3]
মুত্তালিব যখন পরলোক গমন করেন তখন নাওফাল বল প্রয়োগ করে আব্দুল মুত্তালিব চত্ত্বর দখল করে নেন। আব্দুল মুত্তালিবের একার পক্ষে তাঁর চাচার সঙ্গে মুকাবিলা করা সম্ভব না হওয়ার কারণে কুরাইশ গোত্রের কোন কোন লোকের নিকট তিনি সাহায্য প্রার্থী হন। কিন্তু তাঁরা এ কথা বলে আপত্তি করেন যে, তাঁর এবং তাঁর চাচার বিরোধের ব্যাপারে কোন কিছু করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। নিরুপায় হয়ে আব্দুল মুত্তালিব বনু নাজ্জার গোত্রের তাঁর মামা গোষ্ঠির নিকট কিছু কবিতা লিখে পাঠান যার মধ্যে নিহিত ছিল সাহায্যের করুণ আবেদন। এ আহবানে সাড়া দিয়ে তাঁর মামা আবূ সা‘দ বিন আদী আশি জন অশ্বারোহী নিয়ে মক্কা অভিমুখে অগ্রসর হন এবং আবতাহ নামক স্থানে অবতরণ করেন। আব্দুল মুত্তালিব সেখানে গিয়ে তাঁর মামার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁকে গৃহে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানান। কিন্তু নাওফালের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া না হওয়া পর্যন্ত আবূ সা‘দ তাঁর গৃহে যেতে অস্বীকৃতি জানান। তারপর তিনি অগ্রসর হয়ে নাওফালের নানার নিকট গিয়ে দাঁড়ান।
নাওফাল তখন হাতীম নামক স্থানে কয়েকজন কুরাইশদের সাথে উপবিষ্ট ছিলেন। আবূ সা‘দ তলোয়ার কোষমুক্ত করে বললেন, ‘এ পবিত্র ঘরের প্রভুর শপথ, তোমরা যদি ভাগ্নেকে তাঁর অধিকার ফিরিয়ে না দাও তাহলে এ তলোয়ার তোমার বক্ষদেশ বিদীর্ণ করবে।’ কোন ইতস্তত না করে নাওফাল বললেন, ‘ঠিক আছে আমি তাঁর অধিকার ফেরত দিলাম।’ এ কথা শ্রবণের পর আবূ সা‘দ কুরাইশদের কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে এ ব্যাপারে সাক্ষী থাকা এবং প্রয়োজনবোধে সাক্ষ্য প্রদানের জন্য অনুরোধ জানান। তারপর তিনি আব্দুল মুত্তালিবের গৃহে গমন করেন এবং সেখানে তিন দিন অবস্থান ও উমরাহ পালনের পর মদীনা প্রতাবর্তন করেন।
এ ঘটনার পর নাওফাল বনু হাশিমের বিরুদ্ধে বনু আবদে শামস এর সাথে পরস্পর সাহায্য ও সহযোগিতামূলক এক চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এ দিকে বনু খুযা’আহ গোত্র যখন লক্ষ্য করলেন যে, বনু নাজ্জার গোত্র আব্দুল মুত্তালিবকে সাহায্য করেছে তখন তাঁরা বললেন যে, ‘আব্দুল মুত্তালিব যেমন তোমাদের সন্তান, তেমনি আমাদেরও সন্তান। অতএব, তাঁকে সাহায্য করা অধিকভাবে আমাদেরই কর্তব্য।’ কারণ আবদে মানাফের মায়ের সম্পর্ক ছিল খুযা’আহ গোত্রের সঙ্গে। এ প্রেক্ষিতে বনু খুযা’আহ গোত্র দারুণ নাদওয়ায় গিয়ে বনু আবদে শামস এবং বনু নাওফালের বিরুদ্ধে বনু হাশিমের সঙ্গে সাহায্য ও সহযোগিতার এক চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এ চুক্তিতে এমন সব অঙ্গীকার করা হয়েছিল যা পরবর্তী পর্যায়ের ইসলামী যুগে মক্কা বিজয়ের জন্য খুবই সহায়ক হয়েছিল। বিস্তারিত বিবরণ যথাস্থানে উল্লেখিত হবে।[4]
বায়তুল্লাহর সঙ্গে সংশিষ্ট হওয়ায় আব্দুল মুত্তালিবের সঙ্গে দুইটি বিশেষ ঘটনার সম্পর্ক রয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ‘যমযম’ কূপের খনন কাজ সম্পর্কিত ঘটনা এবং অন্যটি হচ্ছে ‘হস্তী বাহিনী’ সম্পর্কিত ঘটনা। ঘটনা দুটি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলঃ
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৩৭ পৃঃ রাহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ২৬ পৃঃ/ ২য় খন্ড ২৪ পৃঃ।
[2] রাহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ১০৭ পৃঃ।
[3] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৩৭-১৩৮ পৃঃ।
[4] শায়খুল ইসলাম মুহাম্মাদ আবুল ওয়াহহাব নাজদী (রহঃ) মুখাতাসার সীরাতে রাসূল ৪১-৪২ পৃঃ।
যমযম কূপ খননঃ
এ ঘটনার সার সংক্ষেপ হচ্ছে আব্দুল মুত্তালিব স্বপ্নযোগে অবগত হন যে, তাঁকে যমযম কূপ খননের নির্দেশ দেয়া হচ্ছে এবং স্বপ্নযোগে তার স্থানও নির্দিষ্ট করে দেয়া হচ্ছে। তারপর ঘুম থেকে জেগে উঠে তিনি খনন কাজ আরম্ভ করে দেন। খনন কাজ চলাকালে কূপ থেকে ঐ সমস্ত জিনিস উত্তোলন করা হয় বনু জুরহুম গোত্র মক্কা ছেড়ে যাওয়ার প্রাক্কালে কূপের মধ্যে যা নিক্ষেপ করেছিলেন। নিক্ষিপ্ত দ্রব্যের মধ্যে ছিল কিছু সংখ্যক তলোয়ার ও লৌহবর্ম এবং দুইটি সোনার হরিণ। আব্দুল মুত্তালিব তলোয়ারগুলো দ্বারা ক্বাবা’হ গৃহের দরজা ঢালাই করেন, সোনার হরিণ দুটি দরজার সঙ্গে সন্নিবেশিত করে রাখেন এবং হজ্জযাত্রীগণকে পানি পান করানোর ব্যবস্থা করেন।
যমযম কূপ খনন কালে আরও যে ঘটনাটির উদ্ভব হয়েছিল তা হচ্ছে যখন কূপটি প্রকাশিত হয় তখন কুরাইশগণ আব্দুল মুত্তালিবের সঙ্গে বিবাদ আরম্ভ করেন এবং দাবী করেন যে, খনন কাজে তাঁদেরকেও অংশ গ্রহণ করতে দিতে হবে।
আব্দুল মুত্তালিব বললেন, ‘যেহেতু এ কূপ খননের জন্য তিনি স্বপ্নযোগে আদিষ্ট হয়েছেন সেহেতু এ খনন কাজে তাঁদের অংশ গ্রহণ করতে দেয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু অন্যান্য কুরাইশগণও ছাড়বার পাত্র নন। এ ব্যাপারে মতামত গ্রহণের জন্য তাঁরা বনু সা‘দ গোত্রের এক মহিলা ভবিষ্যদ্বক্তার নিকট যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং এ উদ্দেশ্যে মক্কা থেকে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু পথের মধ্যে তাঁরা এমন কতিপয় নিদর্শন প্রত্যক্ষ করেন যাতে তাঁদের নিকট এটা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, সর্ব শক্তিমান আল্লাহ তা‘আলা যমযম কূপের খনন কাজ আব্দুল মুত্তালিবের জন্যই নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। তাই তাঁরা আর অগ্রসর না হয়ে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করেন। এ প্রেক্ষিতেই আব্দুল মুত্তালিব মানত করেছিলেন যে আল্লাহ তা‘আলা যদি অনুগ্রহ করে তাঁকে দশটি পুত্র সন্তান দান করেন এবং সকলেই বয়োপ্রাপ্ত হয়ে জীবনের এ স্তরে গিয়ে পৌঁছে যে তাঁরা আত্মরক্ষা করতে সক্ষম তাহলে তিনি তাঁর একটি সন্তানকে বায়তুল্লাহর জন্য উৎসর্গ করবেন।[1]
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৪২-১৪৭ পৃঃ।
হস্তী বাহিনীর ঘটনাঃ
দ্বিতীয় ঘটনার সংক্ষিপ্ত সার হচ্ছে, আবরাহা সাবাহ হাবশী (তিনি নাজ্জাশী সম্রাট হাবশের পক্ষ হতে ইয়ামানের গভর্ণর ছিলেন) যখন দেখলেন যে, আরববাসীগণ ক্বাবা’হ গৃহে হজ্জব্রত পালন করছেন এবং একই উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশ থেকে লোকজন সেখানে আগমন করছেন তখন সানআয় তিনি একটি বিরাট গীর্জা নির্মাণ করলেন এবং আরববাসীগণের হজ্জব্রতকে সেদিকে ফিরিয়ে আনার জন্য আহবান জানালেন। কিন্তু বনু কিনানাহ গোত্রের লোকজন যখন এ সংবাদ অবগত হলেন তখন তাঁরা এক রাত্রে গোপনে গীর্জায় প্রবেশ করে তার সামনের দিকে মলের প্রলেপন দিয়ে একদম নোংরা করে ফেললেন। এ ঘটনায় আবরাহা ভয়ানক ক্রোধান্বিত হন এবং প্রতিশোধ গ্রহণ কল্পে ক্বাবা’হ গৃহ ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে ষাট হাজার অস্ত্র সজ্জিত সৈন্যের এক বিশাল বাহিনীসহ মক্কা অভিমুখে অগ্রসর হন। তিনি নিজে একটি শক্তিশালী হস্তীপৃষ্ঠে আরোহণ করেন। সৈন্যদের নিকট মোট নয়টি অথবা তেরটি হস্তী ছিল।
আবরাহা ইয়ামান হতে অগ্রসর হয়ে মুগাম্মাস নামক স্থানে পৌঁছলেন এবং সেখানে তাঁর সৈন্যবাহিনীকে প্রস্তুত করে নিয়ে মক্কায় প্রবেশের জন্য অগ্রসর হলেন। তারপর যখন মুজদালেফা এবং মিনার মধ্যবর্তী স্থান ওয়াদিয়ে মুহাস্সারে পৌঁছলেন তখন তার হাতী মাটিতে বসে পড়ল। ক্বাবা’হ অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার জন্য কোন ক্রমেই তাকে উঠানো সম্ভব হল না। অথচ উত্তর, দক্ষিণ কিংবা পূর্ব মুখে যাওয়ার জন্য উঠানোর চেষ্টা করলে তা তৎক্ষণাৎ উঠে দৌঁড়াতে শুরু করত। এমন সময়ে আল্লাহ তা‘আলা এক ঝাঁক ছোট ছোট পাখী প্রেরণ করলেন। সেই পাখীগুলো ঝাঁকে ঝাঁকে পাথরের ছোট ছোট টুকরো সৈন্যদের উপর নিক্ষেপ করতে লাগল। প্রত্যেকটি পাখি তিনটি করে পাথরের টুকরো বা কংকর নিয়ে আসত একটি ঠোঁটে এবং দুইটি দু’পায়ে। কংকরগুলোর আকার আয়তন ছিল ছোলার মতো। কিন্তু কংকরগুলো যার যে অঙ্গে লাগত সেই অঙ্গ ফেটে গিয়ে সেখান দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হতে হতে সে মরে যেত।
এ কাঁকর দ্বারা সকলেই যে আঘাত প্রাপ্ত হয়েছিল তা নয়। কিন্তু এ অলৌকিক ঘটনায় সকলেই ভীষণভাবে আতংকিত হয়ে পড়ল এবং প্রাণভয়ে পলায়নের উদ্দেশ্যে যখন বেপরোয়াভাবে ছুটাছুটি শুরু করল তখন পদতলে পিষ্ট হয়ে অনেকেই প্রাণত্যাগ করল। কংকরাঘাতে ছিন্নভিন্ন এবং পদতলে পিষ্ট হয়ে পলকে বীরপুরুষগণ মৃত্যুর কবলে ঢলে পড়তে লাগল। এদিকে আবরাহার উপর আল্লাহ তা‘আলা এমন এক মুসিবত প্রেরণ করলেন যে তাঁর আঙ্গুল সমূহের জোড় খুলে গেল এবং সানা নামক স্থানে যেতে না যেতেই তিনি পাখির বাচ্চার মতো হয়ে পড়লেন। তারপর তাঁর বক্ষ-বিদীর্ণ হয়ে হৃদপিন্ড বেরিয়ে এল এবং তিনি মৃত্যু মুখে পতিত হলেন।
মক্কা অভিমুখে আবরাহার অগ্রাভিযানের সংবাদ অবগত হয়ে মক্কাবাসীগণ প্রাণভয়ে নানা দিকে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পলায়ন করে পাহাড়ের আড়ালে কিংবা পর্বত চূড়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। তারপর যখন তাঁরা অবগত হলেন যে, আবরাহা এবং তাঁর বাহিনী সমূলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে তখন তাঁরা স্বস্তির নিংশ্বাস ত্যাগ করে আপন আপন গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন।[1]
অধিক সংখ্যক চরিতবেত্তাগণের অভিমত হচ্ছে এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্মলাভের মাত্র ৫০ কিংবা ৫৫ দিন পূর্বে মুহাররম মাস। অত্র প্রেক্ষিতে এটা ধরে নেয়া যায় যে ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিল ৫৭১ খ্রীষ্টাব্দে ফ্রেব্রুয়ারী মাসের শেষ ভাগে কিংবা মার্চ মাসের প্রথম ভাগে। হস্তী বাহিনীর এ ঘটনা ছিল আগামী দিনের নাবী (সাঃ) এবং ক্বাবা’হ শরীফের জন্য আল্লাহর সিদ্ধান্ত ও সাহায্যের এক সুস্পষ্ট নিদর্শন। এর পিছনে আরও যে একটি কারণ ছিল তা হচ্ছে নাবী কারীম (সাঃ) তাঁর আমলেই দেখলেন যে বায়তুল মুক্বাদ্দাস ছিল মুসলিমদের ক্বিবলাহহ এবং সেখানকার অধিবাসীগণও ছিল মুসলিম। কিন্তু তা সত্ত্বেও এর উপর আল্লাহর শত্রুদের অর্থাৎ মুশরিকগণের শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। এর সুস্পষ্ট প্রমাণ হচ্ছে বুখতুনাসসরের আক্রমণ (৫৮৭ খ্রীষ্ট পূর্ব অব্দে) এবং রোমানগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা (৭০ খ্রীষ্টাব্দে)। পক্ষান্তরে ক্বাবা’হর উপর খ্রীষ্টনদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় নি। যদিও তাঁরা তৎকালে মুসলিম ছিলেন এবং ক্বাবা’হর অধিবাসীগণ ছিলেন মুশরিক।
অধিকন্তু, এ ঘটনা এমন এক সময়ে সংঘটিত হয়েছিল যে, এ সংক্রান্ত সংবাদটি তৎকালীন সভ্য জগতের অধিকাংশ অঞ্চলে (রোমান সাম্রাজ্য, পারস্য সাম্রাজ্য ইত্যাদি) খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কারণ, হাবশী এবং রোমীয়গণের মধ্যে গভীর সম্প্রীতির সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। অপর দিকে পারস্যবাসীগণের দৃষ্টি রোমীয়গণের উপর সমভাবে নিপতিত ছিল এবং শেষ পর্যন্ত অবস্থা এ দাঁড়ায় যে, পারস্যবাসীগণ অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ইয়ামান দখল করে বসে।
যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে তখন রোমান এবং পারস্য এ দুইটি রাষ্ট্রই তৎকালীন পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য অংশের প্রতিনিধিত্ব করত এবং যেহেতু হস্তীবাহিনীর ঘটনাটি এ দু’রাষ্ট্রের সকলের নিকটেই সুবিদিত ছিল সেহেতু বলা যায় যে সমগ্র পৃথিবীর দৃষ্টি ক্বাবা’হ গৃহের অলৌকিকত্বের প্রতি নিবদ্ধ হয়ে গেল। বায়তুল্লাহর উচ্চ সম্মান ও সুমহান মর্যাদা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত সুস্পষ্ট নিদর্শন স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করার পর একথা তাঁদের মনে দৃঢ়ভাবে স্থান লাভ করল যে, এ গৃহকে সংরক্ষণ ও পবিত্রকরণ এবং এর সুমহান মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার ব্যাপারেই আল্লাহ তা‘আলা এ অলৌকিক ব্যবস্থা অবলম্বন করেছিলেন। অতএব ভবিষ্যতে এখানকার অধিবাসীগণের মধ্য থেকে কেউ যদি নবুয়ত দাবী করেন তবে সেই ঘটনার প্রেক্ষাপটে তা হবে আইন-সঙ্গত এবং বাঞ্ছনীয় ব্যাপার এবং তা হবে পার্থিব ব্যবস্থাপনার উর্ধ্বে খোদায়ী রাজত্বের ভিত্তি যা ঈমানদারদের সাহায্যার্থে অবতীর্ণ হয়েছিল গায়েবী সূত্র থেকে।
আব্দুল মুত্তালিবের ছিল সর্বমোট দশটি সন্তান। তাঁদের নাম ছিল যথাক্রমেঃ হারিস, জুবাইর, আবূ তালেব, আব্দুল্লাহ, হামজাহ, আবূ লাহাব, গায়দাক্ব, মুক্বাবভিম, যেরার, এবং ‘আব্বাস। কেউ কেউ বলেছেন যে তাঁর ছিল ১১টি সন্তান, একজনের নাম ছিল কুসাম। অন্য কেউ বলেছেন যে, ১৩টি সন্তান ছিল। অন্য দু’জনের নাম হল, ‘আব্দুল ক্বাবা’হ এবং ‘হাযল’। কিন্তু দশ জনের কথা যাঁরা বলেছেন তাঁরা বলেন যে, ‘মুক্বাবভিমেরই’ অপর নাম ছিল ‘আব্দুল ক্বাবা’হ এবং ‘গায়দাক্বেরর’ অপর নাম ছিল ‘হাযল’। তাঁদের মতে কুসাম নামে আব্দুল মুত্তালিবের কোন পুত্র সন্তান ছিল না। আব্দুল মুত্তালিবের কন্যা ছিল ৬ জন। তাঁদের নামগুলো হচ্ছে যথাক্রমেঃ উম্মুল হাকীম (তাঁর অপর নাম বায়যা), বাররাহ, আতিকাহ, সাফিয়্যাহ, আরওয়া এবং উমাইয়া।[2]
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৫৬ পৃঃ।
[2] তালকীহুল ফহুম ৮-৯ পৃঃ এবং রহমাতুল্লিল আলামীন ২য় খন্ড ৫৬-৬৬ পৃঃ।
আব্দুল্লাহ (রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতা):
তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সম্মানিত পিতা। তার (আব্দুল্লাহর) মাতার নাম ছিল ফাত্বিমাহ। তিনি ছিলেন ‘আমর বিন আয়েয বিন ইমরান মাখযুম বিন ইয়াকযাহ বিন মুররাহর কন্যা। আব্দুল মুত্তালিবের সন্তানগণের মধ্যে আব্দুল্লাহ ছিলেন সব চাইতে সুন্দর এবং সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী। তিনি ছিলেন পিতার অত্যন্ত প্রিয়পাত্র। তাঁর লকব বা উপাধি ছিল যবীহ। যে কারণে তাঁকে যবীহ বলা হতো তা হচ্ছে আব্দুল মুত্তালিবের প্রার্থিত পুত্র সংখ্যা যখন ১০ জন হল এবং তাঁরা সকলেই আত্মরক্ষা করার যোগ্যতা অর্জন করলেন তখন আব্দুল মুত্তালিব তাঁদের নিজ মানত সম্পর্কে অবহিত করেন (তাঁদের পক্ষ থেকে এক জনকে আল্লাহর নামে উৎসর্গ করার ব্যাপারে) তাঁরা সকলেই এ প্রস্তাবে স্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন।
কথিত আছে, আব্দুল মুত্তালিব ছেলেদের মধ্যে কাকে কুরবানী করা যায় এ ব্যাপারে লটারি করলেন। লটারিতে আব্দুল্লাহর নাম উঠল অথচ তিনি ছিলেন তার সবচেয়ে প্রিয়পাত্র। এমতাবস্থায় আব্দুল্লাহ মুত্তালিব বললেন, হে আল্লাহ! সে-ই নাকি একশত উট? অতঃপর আবার আবদুল্লাহ ও একশতক উটের মধ্যে লটারী করলে একশত উটের নাম উঠে। আবার এও কথিত আছে যে, আব্দুল মুত্তালিব ভাগ্য-নির্ণায়ক তীরের উপর তাঁদের সকলের নাম লিখেন এবং হুবাল মূর্তির সেবায়েত বা তদারককারীগণের পন্থায় চক্রাকারে ঘোরানো ফেরানোর পর নির্বাচনগুটিকা বা লটারীর গুটি বের করেন। লটারীতে আব্দুল্লাহর নাম উঠে যায়। আব্দুল মুত্তালিব আব্দুল্লাহর হাত ধরে তাঁকে নিয়ে যান ক্বাবা’হ গৃহের নিকট। তাঁর হাতে ছিল যবেহ কাজে ব্যবহারোপযোগী একটি ধারালো অস্ত্র। কিন্তু কুরাইশগণের মধ্যে বনু মাখযুম অর্থাৎ আব্দুল্লাহর নানা গোষ্ঠীর লোকজন এবং আব্দুল্লাহর ভাই আবূ ত্বালিব এ ব্যাপারে তাঁকে বাধা প্রদান করেন। তাঁর মানত পূরণে বাধাপ্রাপ্ত আব্দুল মুত্তালিব বললেন তাহলে মানতের ব্যাপারে তাঁর করণীয় কাজ কী হতে পারে? এতদ্বিষয়ে বিশেষ জ্ঞানের অধিকারিনী বা তত্ত্ব বিশারদ কোন মহিলার নিকট থেকে এ ব্যাপারে পরামর্শ গ্রহণের জন্য তাঁরা তাঁকে উপদেশ প্রদান করেন। আব্দুল মুত্তালিব জনৈক তত্ত্ববিশারদের নিকট গিয়ে এ ব্যাপারে তাঁর পরামর্শ চাইলে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য আব্দুল্লাহ এবং ১০ টি উটের মধ্যে লটারী বা নির্বাচনগুটিকা ব্যবহারের পরামর্শ দেন। নির্বাচনী গুটিকায় যদি আব্দুল্লাহর নাম উঠে যায় তাহলে ১০টি উটের সঙ্গে আরও ১০টি উট যোগ করে নির্বাচনী গুটিকা ব্যবহার করতে হবে যে পর্যন্ত না আব্দুল্লাহর নামের স্থানে ‘উট’ কথাটি প্রকাশিত হয় সে পর্যন্ত একই ধারায় নির্বাচনী গুটিকা ব্যবহার করে যেতে হবে যতক্ষণ না আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়ে যান। তারপর উটের যে সংখ্যা নির্ধারক নির্বাচনী গুটিকা ব্যবহার করা হবে সেই সংখ্যক উট আল্লাহর নামে উৎসর্গ করতে হবে।
সেখান থেকে প্রত্যাবর্তনের পর আব্দুল মুত্তালিব, আব্দুল্লাহ ও ১০টি উটের মধ্যে নির্বাচনী গুটিকা ব্যবহার করেন। কিন্তু এতে আব্দুল্লাহর নামই প্রকাশিত হয়। তত্ত্ববিশারদের নির্দেশ মুতাবেক দ্বিতীয় দফায় উটের সংখ্যা আরও বেশী বৃদ্ধি করে তিনি নির্বাচনী গুটিকা ব্যবহার করেন। কিন্তু এতেও আব্দুল্লাহর নামই উঠে যায়। কাজেই পরবর্তী প্রত্যেক দফায় ১০টি উটের সং্যখা বৃদ্ধি করে তিনি নির্বাচনী গুটিকা ব্যবহার করে যেতে থাকেন। এ ধারায় চলতে চলতে যখন একশত উট এবং আব্দুল্লাহর নাম নির্বাচনী গুটিকায় ব্যবহার করা হয় তখন উট কথাটি প্রকাশিত হয়। এ প্রেক্ষিতে আব্দুল মুত্তালিব আব্দুল্লাহর পরিবর্তে ১০০ টি উট আল্লাহর নামে উৎসর্গ করেন। উৎসর্গীকৃত পশুর গোশত্ কোন মানুষ কিংবা জীবজন্তুর খাওয়ার ব্যাপারে কোন বাধা-নিষেধ ছিল না। উল্লেখিত ঘটনার পূর্বে আরব এবং কুরাইশগণের মধ্যে শোনিতপাতের খেসারত বা মূল্য ছিল ১০টি উট। কিন্তু এ ঘটনার পর এর বর্ধিত সংখ্যা নির্ধারিত হয় ১০০টি উট। ইসলামও এ সংখ্যাকে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। প্রিয় নাবী (সাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন যে, ‘আমি দু’ যবীহর সন্তান’, ‘একজন ইসমাঈল (আঃ) এবং অন্য জন হচ্ছেন আমার পিতা আব্দুল্লাহ।[1]
আব্দুল মুত্তালিব স্বীয় সন্তান আব্দুল্লাহর বিবাহের জন্য আমিনাহহকে মনোনীত করেন। তিনি ছিলেন ওয়াহাব বিন আবদে মানাফ বিন যুহরা বিন কিলাবের কন্যা। বংশ পরম্পরা এবং মর্যাদার দিক দিয়ে তাঁকে কুরাইশ গোত্রের মধ্যে উন্নত মানের মহিলা ধরা হতো। তাঁর পিতা ছিলেন বিখ্যাত বনু যুহরা গোত্রের দলপতি। বিবাহের পর আমিনাহ মক্কায় স্বামী গৃহে আগমন করেন এবং স্বামীর সঙ্গে বসবাস করতে থাকেন কিন্তু অল্প দিন পরেই আব্দুল মুত্তালিব ব্যবসা উপলক্ষ্যে খেজুর আনয়নের উদ্দেশ্যে আব্দুল্লাহকে মদীনা প্রেরণ করেন। তিনি সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।
কোন কোন চরিতবিদ বলেন যে, ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে আব্দুল্লাহ শামদেশে গমন করেছিলেন। এক কুরাইশ কাফেলার সঙ্গে মক্কা প্রত্যাবর্তনের পথে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন ও মদীনায় অবতরণ করেন। সেই অসুস্থতার মধ্যেই সেখানে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। নাবেগা জা’দীর বাড়িতে তাঁর কাফন দাফনের ব্যবস্থা করা হয়। সেই সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ২৫ বছর। অধিক সংখ্যক ইতিহাসবিদদের অভিমত হচ্ছে তিনি পিতার মৃত্যুসময় জন্ম গ্রহণ করেন নি। আর অল্প সংখ্যক ঐতিহাসিকের অভিমত হচ্ছে, পিতার মৃত্যুর দু’মাস পূর্বেই নাবী কারীম (সাঃ) জন্ম গ্রহণ করেছিলেন।[2] যখন তাঁর মৃত্যু সংবাদ মক্কায় পৌঁছল তখন আমিনাহ অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় একটি শোকগাথা আবৃত্তি করেছিলেন। শোক গাথাটি হচ্ছে-
عَفَـا جانبُ البطحـاءِ من ابن هـاشـم
**
وجاور لَحْدًا خارجـًــا في الغَــمَاغِم
دَعَتْـــه المنــايا دعــوة فأجـابـهــا
**
وما تركتْ في الناس مثل ابن هاشم
عشيـة راحـوا يحمــــلــون سريـره
**
تَعَاوَرَهُ أصــحــابــه في التزاحـــم
فإن تـك غـالتـه الــمنـايا ورَيْبَهـا
**
فقـد كـان مِعْطـاءً كـثير التراحم
অর্থঃ ‘বাতহার জমিন হাশিমের পুত্রকে হারালো, সে চিৎকার ও গোলমালের মাঝে সমাধিতে সুখস্বপ্নবৎ পরিতৃপ্ত হয়ে গেল। মৃত্যু মানুষের মধ্যে ইবনে হাশিমের মত কোন ব্যক্তিকে ছাড়ে নাই। (কতই দুঃখ জনক ছিল) যখন সেই সন্ধায় লোকেরা তাঁকে মৃতের খাটে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। যদিও মৃত্যু এবং মৃত্যুর ঘটনাবলী তাঁর অস্তিত্বকে শেষ করেছে। তবুও তাঁর উন্নততর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসমূহকে মুছে ফেলতে পারবে না। তিনি ছিলেন বড়ই দয়াবান এবং কোমল অন্তঃকরণের অধিকারী।[3]
মৃত্যুকালে তিনি যে সব সহায়-সম্পদ রেখে গিয়েছিলেন তা ছিল যথাক্রমে ৫টি উট, এক পাল ছাগল এবং একটি হাবশী দাসী যার নাম ছিল বরকত ও উপনাম উম্মে আয়মান। এ উম্মে আয়মানই নাবী কারীমকে দুগ্ধ খাইয়েছিলেন।[4]
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৫১-১৫৫ পৃঃ রহমাতুল্লিল আলামীন ২য় খন্ড ৮৯-৯০ পৃঃ। মোখতাসারে সীরাতে রাসূল শাইখ আব্দুল্লাহ নাজদী ১২, ২২, ২৩।
[2] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৫৬-১৫৮ পৃঃ ফিকহুস সীরাত মুহাম্মাদ গাযালী ৪৫ পৃঃ রহমাতুল্লিল আলামীন ২য় খন্ড ৯১ পৃঃ।
[3] তাবাকাতে ইবনে সা‘দ ১ম খন্ড ৬২ পৃঃ।
[4] শাইখ আব্দুল্লাহ মুখতাসারুস সীরাত ১২ পৃঃ তালকীহুল ফোহম ১৪ পৃঃ সহীহুল মুসলিম ২য় খন্ড ৯৬ পৃঃ।
সৌভাগ্যময় জন্ম এবং নবুয়ত পূর্ব পবিত্র জীবন
সৌভাগ্যময় জন্ম (المولـــد):
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মক্কায় বিখ্যাত বনু হাশিম বংশে ৯ই রবিউল আওয়াল (ফীলের বছর) সোমবার দিবস রজনীর মহাসন্ধিক্ষণে সুবহে সাদেকের সময় জন্মলাভ করেন। ইংরেজী পঞ্জিকা মতে তারিখটি ছিল ৫৭১ খ্রীষ্টাব্দে ২০শে অথবা ২২শে এপ্রিল। এ বছরটি ছিল বাদশাহ নওশেরওয়ার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার চল্লিশতম বছর। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মুহাম্মাদ সুলায়মান মুনসুরপুরী সাহেব (রহঃ) এর অনুসন্ধানলব্ধ সঠিক অভিমত হচ্ছে এটাই।[1]
ইবনে সা‘দ হতে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মা বলেছেন যখন তাঁর জন্ম হয়েছিল তখন আমার শরীর হতে এক জ্যোতি বের হয়েছিল যাতে শামদেশের অট্টালিকাসমূহ আলোকিত হয়েছিল। ইমাম আহমাদ (রঃ) ইরবায বিন সারিয়া কর্তৃক অনরূপ একটি বর্ণনা উল্লেখ করেছেন।[2] নাবী (সাঃ)-এর জন্মের সময় কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা নবুওয়াতের পূর্বাভাস স্বরূপ প্রকাশিত হয়। কিসরাপ্রাসাদের চৌদ্দটি সৌধচূড়া ভেঙ্গে পড়ে, প্রাচীন পারসীক যাজকমন্ডলীর উপাসনাগারগুলোতে যুগ যুগ ধরে প্রজ্জ্বলিত হয়ে আসা অগ্নিকুন্ডগুলো নির্বাপিত হয়ে যায়, বাহীরা পাদ্রীগণের সরগম গীর্জাগুলো নিস্তেজ ও নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। এ বর্ণনা হচ্ছে ইমাম বায়হাক্বী, তাবারী এবং অন্যান্যদের।[3] তবে এগুলোর কোন সঠিক ভিত্তি নেই এবং তৎকালীন কোন ইতিহাসও এর সাক্ষ্য দেয় না।[4]
সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর পরই আমিনাহহ আব্দুল মুত্তালিবের নিকট তার পুত্রের জন্ম গ্রহণের শুভ সংবাদটি প্রেরণ করেন। এ শুভ সংবাদ শ্রবণ মাত্রই তিনি আনন্দ উদ্বেল চিত্তে সূতিকাগারে প্রবেশ করে নব জাতককে কোলে তুলে নিয়ে কা‘বাগৃহে গিয়ে উপস্থিত হন। তারপর অপূর্ব সুষমামন্ডিত এ শিশুর মুখমন্ডলে আনন্দাশ্রু সজল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করতে থাকেন এবং তার সার্বিক কল্যাণের জন্য প্রার্থনা করতে থাকেন। একান্ত আনন্দ মধুর এ মুহূর্তেই তিনি এটাও স্থির করে ফেলেন যে এ নব জাতকের নাম রাখা হবে মুহাম্মাদ। আরববাসীগণের নামের তালিকায় এটা ছিল অভিনব একটি নাম। তারপর আরবের প্রচলিত প্রথানুযায়ী সপ্তম দিনে তাঁর খাতনা করা হয়।[5]
তাঁর মাতার পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে সর্বপ্রথম দুগ্ধ পান করিয়েছিলেন আবূ লাহাবের দাসী সুওয়ায়বা। ঐ সময় তার কোলে যে সন্তান ছিল তাঁর নাম ছিল মাসরুহ। নাবী কারীম (সাঃ)-এর পূর্বে সুওয়ায়বা হামযাহ বিন আব্দল মুত্তালিবকে এবং পরে আবূ সালামাহ বিন আব্দুল আসাদ মাখযুমীকেও দুগ্ধ পান করিয়েছিলেন।[6]
ফুটনোটঃ[1] মাহমুদ পাশা- তারীখে খুযরী ১ম খন্ড ৬২ পৃঃ। মুহাম্মাদ সুলায়মান মানসুরপুরী, রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ৩৮-৩৯ পৃঃ। এপ্রিলের তারিখ সম্পর্কে মতভেদ হচ্ছে খ্রীষ্টীয় পঞ্জিকার গোলমালের ফল।
[2] শাইখ আব্দুল্লাহ মুখতাসারুস সীরাহ ১২ পৃঃ ও ইবনে সা‘দ ১ম খন্ড ৬৩ পৃঃ।
[3] মুখতাসারুস সীরাহ ১২ পৃঃ।
[4] মুহাম্মাদ গাযালী সীরাত ৪৬ পৃঃ (ইমাম বায়হাকীর মত। কিন্তু মুহাম্মাদ গাযালী এটার শুদ্ধতা সম্পর্কে দ্বিমত পোষণ করেন।)
[5] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৫৯-১৬০ পৃঃ তারীখে খুযরী ১ম খন্ড ভিন্ন একটি বর্ণনা মতে তিনি খাতনাকৃত অবস্থায়ই জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। তালকীহুল ফোহুম ৪ পৃঃ কিন্তু ইবনে কাইয়েম বলেন যে, এ ব্যাপারে কোন প্রামাণ্য হাদীস নেই। যাদুল মা’আদ ১ম খন্ড ১৮ পৃঃ।
[6] তালকীহুল ফোহুম ৪ পৃঃ শাইখ আব্দুল্লাহ মুখতাসারুস সীরাহ ১৩ পৃঃ।
বনু সা‘দ গোত্রে লালন পালন (فِيْ بَنِيْ سَعْدٍ ):
দুগ্ধপোষ্য শিশুদের লালন পালনের ব্যাপারে তৎকালীন নগরবাসী আরবগণের মধ্যে একটি বিশেষ প্রথা প্রচলিত ছিল। সেই প্রথাটি ছিল শহর-নগরের জনাকীর্ণ পরিবেশ জনিত আধি-ব্যাধির কুপ্রভাব থেকে দূরে উন্মুক্ত গ্রামীন পরিবেশে শিশুদের লালন-পালন করার মাধ্যমে তারা যাতে বলিষ্ঠদেহ এবং মজবুত মাংসপেশীর অধিকারী হয় এবং বিশুদ্ধ আরবী ভাষা শিখতে সক্ষম হয় তদুদ্দেশ্যে দুগ্ধ পানের জন্য বেদুঈন পরিবারের ধাত্রীগণের হাতে শিশুদের সমর্পণ করা। এ প্রথানুযায়ী অব্দুল মুত্তালিব শিশু মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে দুগ্ধ পান করানোর উদ্দেশ্যে ধাত্রী অনুসন্ধান করেন এবং শেষ পর্যন্ত হালীমাহ বিনতে আবূ যুয়ায়বের নিকট তাকে সমর্পণ করেন। এ মহিলা বনু সা‘দ বিন বাকর গোত্রের একজন খাতুন ছিলেন। তার স্বামীর নাম ছিল হারিস বিন আব্দুল উযযা এবং উপনাম ছিল আবূ কাবশাহ। তিনিও বনু সা‘দ গোত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন।
হালীমাহ ও হারিস দম্পতির কয়েকটি সন্তান ছিল। তারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দুগ্ধ সম্পর্কিত ভ্রাতা ও ভগিনীর সম্মান লাভ করে। তাদের নাম হচ্ছে যথাক্রমেঃ আব্দুল্লাহ, আনীসাহ, হুযাফা অথবা জুযামাহ। হুযাফা শায়মা নামে অধিকতর পরিচিত ও প্রসিদ্ধ ছিলেন। এ শায়মাই রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর লালন-পালনের ব্যাপারে মাতা হালীমাহ সাহায্য করতেন বলে কথিত আছে। অধিকন্তু, তাঁর চাচাতো ভাই আবূ সাফিয়্যাহহন বিন হারিস বিন আব্দুল মুত্তালিবও হালীমাহর সূত্র ধরে দুগ্ধ সম্পর্কিত ভাই ছিলেন। নাবী কারীম (সাঃ)’র চাচা হামযাহ বিন আব্দুল মুত্তালিবকেও বনু সা’দ গোত্রের এক মহিলা দুগ্ধ পান করিয়েছিলেন। হালীমাহ গৃহে থাকা অবস্থায় এ মহিলাও একদিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে দুগ্ধ পান করিয়েছিলেন। এ প্রেক্ষিতে নাবী কারীম (সাঃ) এবং হামযাহ (রাঃ) দুধভাই সম্পর্কে সম্পর্কিত হয়ে যান। প্রথম সূত্রে সুওয়াইবার সম্পর্কের মাধ্যমে এবং দ্বিতীয় সূত্রে বনু সা’দ গোত্রে সেই মহিলার মাধ্যমে।[1]
দুগ্ধ পান কালে হালীমাহ নাবী কারীম (সাঃ)-এর অলৌকিক ও বরকতময় অনেক দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে আশ্চর্যান্বিত ও হতবাক হয়ে যান। হালীমাহর বর্ণনা সূত্রে ইতিহাসবিদ ইবনে ইসহাক্ব বলেন যে, হালীমাহ এবং তার স্বামী তাদের একটি দুগ্ধপোষ্য সন্তানসহ বনু সা’দ গোত্রের এক দল মহিলার সঙ্গে অর্থের বিনিময়ে দুগ্ধপান করবে এমন শিশুর সন্ধানে মক্কা যান। সেই সময় আরব ভূমিতে দুর্ভিক্ষজনিত দারুন খাদ্য ও অর্থ সংকট বিরাজমান ছিল।
হালীমাহ বলেন, ‘আমি আমার একটি সাদা মাদী গাধার পিঠে সওয়ার হয়ে চলছিলাম। আমার সঙ্গে উটও ছিল। কিন্তু কি আল্লাহর মহিমা যে, উটের ওলান থেকে এক বিন্দুও দুধ বাহির হচ্ছিলনা। আমার বুকেও শিশুটির জন্য এক বিন্দু দুধ ছিলনা। এ দিকে ক্ষুধার তাড়নায় শিশুটি এতই ছটফট করছিল যে, সারাটি রাত আমরা ঘুমাতে পারি নি। এমতাবস্থায় আমরা বৃষ্টি ও সচ্ছলতার আশা-ভরসা নিয়ে প্রহর গুণছিলাম। কিন্তু অবস্থার তেমন কোন উন্নতি না হওয়ায় অবশেষে উপায়ান্তর না দেখে পুনরায় আমরা পথ চলা শুরু করলাম।’
‘আমি আমার মাদী গাধাটির উপর সওয়ার হয়ে পথ চলতে থাকলাম। গাধাটি ছিল খুবই দুর্বল, তার দুর্বলতা এবং শক্তি হীনতার কারণে সে এতই ধীরে ধীরে চলতে থাকল যে, এতে কাফেলার অন্যেরা অত্যন্ত বিরক্ত এবং বিব্রত বোধ করতে থাকল। যা হোক, এমনভাবে এক অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যদিয়ে আমরা মক্কায় গিয়ে উপস্থিত হলাম। তারপর আমাদের দলে এমন কোন মহিলা ছিল না যার নিকট শিশু নাবী (সাঃ)- কে দুগ্ধ পান করানোর প্রস্তাব দেয়া হয় নি। কিন্তু যখনই তারা জানতে পারল যে, শিশুটি পিতৃহীন ইয়াতীম তখনই তারা তাকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করল। কারণ, দুগ্ধদানের জন্য দুগ্ধপোষ্যের পিতার নিকট থেকে উত্তম বিনিময় লাভের প্রত্যাশা সকলেরই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তেমন কোন সম্ভাবনাই নেই। মা বিধবা, দাদা বৃদ্ধ, এ শিশুকে লালন-পালন করে তার বিনিময়ে কীইবা এমন পাওয়ার আশা করা যেতে পারে? ইতস্তত করে এ সব কিছু ভেবে চিন্তে দলের কেউই তা নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করল না।’
‘এদিকে দলের অন্যান্য মহিলা যারা আমার সঙ্গে এসেছিল তারা সকলেই একটি করে শিশু সংগ্রহ করে নিল। অবশিষ্ট রইলাম শুধু আমি। আমার পক্ষে কোন শিশু সংগ্রহ করা সম্ভব হল না। ফিরে যাওয়ার সময় যতই ঘনিয়ে আসতে লাগল আমার মনটা ক্রমান্বয়ে ততই যেন কষ্টকর ও ভারাক্রান্ত হয়ে উঠতে থাকল। অবশেষে আমি আমার স্বামীকে বললাম, ‘আমার সঙ্গিনীরা সকলেই দুধপানের জন্য সন্তান নিয়ে ফিরছে আর আমাকে শূন্য হাতে ফিরে যেতে হচ্ছে এ যেন আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। তার চাইতে বরং আমি সেই ইয়াতিম ছেলেটিকেই নিয়ে যাই (যা করেন আল্লাহ)।’
স্বামী বললেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, কোন অসুবিধা নেই, তুমি গিয়ে তাকেই নিয়ে এসো। এমনটিও হতে পারে যে, আল্লাহ এর মধ্যেই আমাদের জন্য কোন বরকত নিহিত রেখেছেন। এমন এক অবস্থা এবং মন-মানসিকতার প্রেক্ষাপটে শিশু মুহাম্মাদ (সাঃ)- কে দুধ পান করানোর জন্য আমি গ্রহণ করলাম।’
তারপর হালীমাহ বললেন, ‘যখন আমি শিশু মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে নিয়ে নিজ আস্তানায় ফিরে এলাম এবং তাঁকে আমার কোলে রাখলাম তখন তিনি তাঁর দু’সীনা আমার বক্ষের সঙ্গে মিলিত করে পূর্ণ পরিতৃপ্তির সঙ্গে দুগ্ধ পান করলেন। তাঁর দুধভাই অর্থাৎ আমার গর্ভজাত সন্তানটিও পূর্ণ পরিতৃপ্তির সঙ্গে দুগ্ধ পান করল। এরপর উভয়েই ঘুমিয়ে পড়ল। এর পূর্বে তার এভাবে ঘুম আমরা কক্ষনোই দেখিনি।
অন্য দিকে আমার স্বামী উট দোহন করতে গিয়ে দেখেন যে, তার ওলান দুধে পরিপূর্ণ রয়েছে। তিনি এত বেশী পরিমাণে দুধ দোহন করলেন যে, আমরা উভয়েই তৃপ্তির সঙ্গে পেট পুরে তা পান করলাম এবং বড় আরামের সঙ্গে রাত্রি যাপন করলাম। পূর্ণ পরিতৃপ্তির সঙ্গে রাত্রি যাপন শেষে যখন সকাল হল তখন আমার স্বামী বললেন, ‘হালীমাহ! আল্লাহর শপথ, তুমি একজন মহা ভাগ্যবান সন্তান লাভ করেছ।’ উত্তরে বললাম, ‘অবস্থা দেখে আমারও যেন তাই মনে হচ্ছে।’
হালীমাহ আরও বলেন যে, ‘এরপর আমাদের দল মক্কা থেকে নিজ নিজ গৃহে ফেরার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। শিশু মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে বুকে নিয়ে আমার সেই দুর্বল এবং নিস্তেজ মাদী গাধার উপর সওয়ার হয়ে আমিও তাদের সঙ্গে যাত্রা শুরু করলাম। কিন্তু আল্লাহর শপথ আমার সেই দুর্বল গাধাই সকলকে পিছনে ফেলে দ্রুত বেগে সকলের অগ্রভাগে এগিয়ে যেতে থাকল। অন্য কোন গাধাই তার সাথে চলতে পারল না। এমনকি অন্যান্য সঙ্গিনীরা বলতে থাকল, ‘ওগো আবূ যুওয়াইবের কন্যা! ব্যাপারটি হল কী বল দেখি। আমাদের প্রতি একটু অনুগ্রহ করো! এটা কি সেই গাধাটি নয় যার উপর সওয়ার হয়ে তুমি এসেছিলে?’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, আল্লাহর শপথ, এটা সেই গাধাই যার উপর সওয়ার হয়ে আমি এসেছিলাম।’
তারা বলল, ‘নিশ্চয়ই, এর সঙ্গে বিশেষ রহস্যজনক কোন ব্যাপার ঘটেছে।’
এমন এক রহস্যময় অবস্থার মধ্য দিয়ে অবশেষে আমরা বনু সা’দ গোত্র নিজ বাড়িতে এসে উপস্থিত হলাম। ইতোপূর্বে আমার জানা ছিল না যে, আমাদের অঞ্চলের মানুষের চাইতে অন্য কোন অঞ্চলের মানুষ অধিকতর অভাবগ্রস্ত ছিল কিনা, কিন্তু মক্কা থেকে আমাদের ফিরে আসার পরবর্তী সময়ে আমাদের বকরীগুলো চারণভূমি থেকে খেয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে দুগ্ধ পরিপূর্ণ ওলান সহকারে বাড়িতে ফিরে আসত। দুগ্ধবতী বকরীগুলো দোহন করে আমরা তৃপ্তিসহকারে দুধ পান করতাম। অথচ অন্য লোকেরা দুধ পেত না এক ফোঁটাও। তাদের পশুগুলোর ওলানে কোন দুধই থাকত না। এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পশুপালের মালিকেরা তাদের রাখালদের বলতেন, ‘হতভাগারা যেখানে বনু যুওয়াইবের কন্যার রাখাল পশুপাল নিয়ে যায় তোমরা কি তোমাদের পশুপাল নিয়ে সেই চারণভূমিতে যেতে পার না?’
এ প্রেক্ষিতে আমাদের রাখাল যে চারণভূমিতে পশুপাল নিয়ে যেত অন্যান্য লোকের রাখালরাও সেই ভূমিতে পশুপাল নিয়ে যেত। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের পশুগুলো ক্ষুধার্ত ও অভুক্ত অবস্থায় ফিরে আসত। সে সকল পশুর ওলানে দুধও থাকত না। অথচ আমাদের বকরীগুলো পরিতৃপ্তি এবং ওলানে পূর্ণমাত্রায় দুধসহকারে বাড়িতে ফিরত। প্রত্যেকটি কাজে কর্মে আল্লাহ তা‘আলার তরফ থেকে সব কিছুর মধ্যেই আমরা বরকত লাভ করতে থাকলাম।
এভাবে সেই ছেলের পুরো দুটি বছর অতিবাহিত হয়ে গেল এবং আমি তাঁকে স্তন্য পান করানো বন্ধ করে দিলাম। অন্যান্য শিশুদের তুলনায় এ শিশুটি এত সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে থাকলেন যে, দু’বছর পুরো হতে না হতেই তাঁর দেহ বেশ শক্ত ও সুঠাম হয়ে গড়ে উঠল। লালন-পালনের মেয়াদ দু’বছর পূর্ণ হওয়ায় আমরা তাঁকে তাঁর মাতার নিকট নিয়ে গেলাম। কিন্তু তাঁকে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে আমাদের সংসার জীবনে সচ্ছলতা ও বরকতের যে সুফল আমরা ভোগ করে আসছিলাম তাতে আমরা মনের কোণে একটি গোপন ইচ্ছা পোষণ করে আসছিলাম যে, তিনি যেন আরও কিছুকাল আমাদের নিকট থাকেন। তাঁর মাতার নিকট আমাদের গোপন ইচ্ছা ব্যক্ত করে বললাম যে, তাঁকে আরও কিছু সময় আমদের সঙ্গে থাকতে দিন যাতে তিনি সুস্বাস্থ্য ও সুঠাম দেহের অধিকারী হয়ে ওঠেন। অধিকন্তু, মক্কায় মহামারীর প্রাদুর্ভাব সম্পর্কেও আমরা কিছুটা ভয় করছি। আমাদের বারংবার অনুরোধ ও আন্তরিকতায় আশ্বস্ত হয়ে তিনি মুহাম্মাদ (সাঃ)- কে পুনরায় নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সম্মতি দান করলেন।[2]
ফুটনোটঃ[1] যাদুল মা’আদ ১ম খন্ড ১৯ পৃঃ।
[2] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৬২-১৬৪ পৃঃ।
বক্ষ বিদারণ (شَقُّ الصَّدْرِ):
এভাবে দুগ্ধ পানের সময়সীমা অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরও বালক নাবী (সাঃ) বনু সা‘আদ গোত্রে অবস্থান করতে থাকলেন। দ্বিতীয় দফায় বনু সা‘আদ গোত্রে অবস্থান কালে জন্মের ৪র্থ কিংবা ৫ম[1] বছরে তাঁর বক্ষ বিদারণের ঘটনাটি ঘটে। আনাস (রাঃ) হতে সহীহুল মুসলিমে ঘটনাটির বিস্তারিত বিবরণ বর্ণিত হয়েছে। ব্যাপারটি হচ্ছে একদিন বালক নাবী (সাঃ) যখন সঙ্গী-সাথীদের সঙ্গে খেলাধূলা করছিলেন এমন সময় জিবরাঈল (আঃ) সেখানে এসে উপস্থিত হন। তারপর তাঁকে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে চিৎ করে শুইয়ে দিলেন এবং তাঁর বক্ষ বিদীর্ণ করে হৃৎপিন্ডটি বের করে আনলেন। তারপর তার মধ্য থেকে কিছুটা জমাট রক্ত বের করে নিয়ে বললেন, ‘এটা হচ্ছে শয়তানের অংশ যা তোমার মধ্যে ছিল।’ তারপর হৃৎপিন্ডটিকে একটি সোনার তস্ত্তরীতে রেখে যমযমের পানি দ্বারা তা ধুয়ে তা যথাস্থানে প্রতিস্থাপন করে কাটা অংশ জোড়া লাগিয়ে দিলেন। এ সময় তাঁর খেলার সঙ্গী-সাথীগণ দৌড়ে গিয়ে দুধমা হালীমাহকে বলল যে, মুহাম্মাদ (সাঃ) নিহত হয়েছেন। হালীমাহ এবং তাঁর স্বামী এ কথা শুনে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ও অস্থির হয়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে নাবী (সাঃ)-এর মুখমন্ডলে মালিন্য এবং পেরেশানির ভাব লক্ষ্য করলেন। এ অবস্থার মধ্যে তাঁরা তাঁকে বাড়িতে নিয়ে এসে তাঁরা সেবাযত্নে লিপ্ত হলেন।[2] আনাস (রাঃ) বলেন, আমি তাঁর বক্ষে ঐ সেলাইয়ের চিহ্ন দেখেছি।
ফুটনোটঃ[1] এটাই হল সাধারণ চরিতকারকগণের মত। কিন্তু ইবনে ইসহাক্বের বর্ণনানুযায়ী জানা যায় যে, ঘটনাটি হয়েছিল তৃতীয় বছরে। ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড ১৬৪-১৬৫ পৃ.।
[2] সহীহুল মুসলিম, বাবুল ইসরা, ১ম খন্ড ৯২ পৃ.।
স্নেহময়ী মাতৃক্রোড়ে (إِلٰى أُمِّهِ الْحُنُوْنِ):
বালক নাবী (সাঃ)-এর বক্ষ বিদারণের ঘটনায় দুধমা হালীমাহ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তাঁকে তাঁর মার নিকট ফেরত দেন। এভাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ছয় বছর বয়স পর্যন্ত মা হালীমাহর ঘরে বড় হন।[1] দুধমা’র ঘর থেকে প্রাণের টুকরো নয়নমণি সন্তানকে ফেরত পাওয়ার পর আমিনাহ ইয়াসরিব গিয়ে তাঁর স্বামীর কবর যিয়ারত করার মনস্থ করেন। তারপর শশুর আব্দুল মুত্তালিবের ব্যবস্থাপনায় শিশুপুত্র মুহাম্মাদ (সাঃ) এবং পরিচারিকা উম্মু আয়মানকে সঙ্গে নিয়ে মক্কা-মদীনার মধ্যবর্তী পাঁচশ’ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে মদীনায় পৌঁছেন। সেখানে এক মাস অবস্থানের পর মক্কায় ফেরার উদ্দেশ্যে তিনি মদীনা থেকে যাত্রা করেন। সামনে মক্কা অনেক দূরের পথ, পেছনে মদীনা তুলনামূলক কম দূরত্বে অবস্থিত। পথ চলার এমন এক পর্যায়ে আমিনাহ হয়ে পড়লেন অসুস্থ। ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকল তাঁর অসুখ। তারপর তিনি ইয়াতিম শিশু নাবী (সাঃ) এবং আত্মীয়-স্বজনকে শোক সাগরে ভাসিয়ে আবওয়া নামক স্থানে মৃত্যুবরণ করেন।[2]
ফুটনোটঃ[1] তালকীহুল ফোহুম, ৭ পৃ. ও ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড ১৬৮ পৃ.।
[2] ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড ১৬৮ আলকীহুল ফোহুম, ৭ পৃ.। তারীখে খুযরী, ১ম খন্ড ৬৩ পৃ. ফিকহুস সীরাত, গাযালী ৫০ পৃ.।
পিতামহের স্নেহ-ছায়ার আশ্রয়ে (إِلٰى جَدِّهِ العَطُوْفِ):
পিতার মৃত্যুর পর রইলেন স্নেহময়ী মা, মাতার মৃত্যুর পর বেঁচে রইল বৃদ্ধ দাদা। মায়ের মৃত্যুর পর শোকাভিভূত দাদা নিয়ে এলেন পিতা-মাতাহীন পুত্রকে নবুয়ত ও রিসালাতের নিকেতন মক্কায়। প্রাণের চেয়ে বেশী প্রিয় পুত্র আব্দুল্লাহ’র মৃত্যুতে আব্দুল মুত্তালিব যতটা ব্যথা অনুভব করেছিলেন, তার চাইতে অনেক বেশী ব্যথা অনুভব করলেন পুত্রবধূ আমিনাহর মৃত্যুতে। কারণ, আব্দুল্লাহ’র মৃত্যুর পর শিশু মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর অবলম্বন ছিলেন তাঁর মা আমিনাহ। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পর তাঁর যে আর কোন অবলম্বনই রইল না। এ দুঃখ তাঁর শতগুণে বেড়ে গেল। অন্য দিকে তেমনি আবার ইয়াতিম শিশুটির জন্য তাঁর স্নেহসুধাও শত ধারায় বর্ষিত হতে থাকল। মনে হতো যেন ঔরসজাত সন্তানের চাইতেও বেশী মাত্রায় তিনি তাঁকে স্নেহ করতে লাগলেন।
ইবনে হিশামের বর্ণনায় আছে যে, কা’বাহ ঘরের ছায়ায় আব্দুল মুত্তালিবের জন্য বিশেষ একটি আসন বিছানো থাকত। আব্দুল মুত্তালিব এ আসনে বসতেন এবং সন্তানগণ বসতেন সেই আসনের পার্শ্ববর্তী স্থানে। পিতার সম্মানার্থে তাঁর কোন সন্তান এ আসনে বসতেন না। কিন্তু শিশু নাবী (সাঃ) সেখানে আগমন করে সেই আসনেই বসতেন। এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে তাঁর চাচাগণ তাঁর হাত ধরে তাঁকে সেই আসন থেকে নামিয়ে দিতেন। কিন্তু আব্দুল মুত্তালিবের উপস্থিতিতে শিশু নাবী (সাঃ)-কে সেই আসন থেকে নামানোর চেষ্টা করা হলে তিনি বলতেন, ‘ওকে তোমরা এ আসন থেকে নামানোর চেষ্টা করো না, ওকে ছেড়ে দাও। কারণ, আল্লাহর শপথ! এ শিশুকে সাধারণ শিশু বলে মনে হয় না। ও হচ্ছে ভিন্ন রকমের এক শিশু, অনন্য এক ব্যক্তিত্ব’। তারপর তাঁকে নিজের কাছেই বসিয়ে নিতেন সে আসনে, তাঁর গায়ে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে সোহাগ করতেন এবং তাঁর চাল-চলন ও কাজকর্ম দেখে আনন্দ প্রকাশ করতেন।[1]
নাবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর বয়স যখন আট বছর দু’মাস দশ দিন তখন তাঁর দাদা আব্দুল মুত্তালিব মৃত্যুবরণ করলেন। নাবী (সাঃ) এ দুঃখ-শোকের মুহূর্তে দুঃখ-বেদনার বোঝা লাঘব করতে এগিয়ে এলেন চাচা আবূ ত্বালিব। হৃষ্টচিত্তে তিনি আপন কাঁধে তুলে নিলেন বালক মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর লালন-পালনের সকল দায়িত্ব। বৃদ্ধ আব্দুল মুত্তালিব মৃত্যুর আগে আবূ তালেবকে সেই অসিয়তই করে গিয়েছিলেন।[2]
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৬৬ পৃঃ।
[2] তাকীহুল ফোহুম ৭ পৃঃ এবং ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৪৯ পৃঃ।
স্নেহশীল পিতৃব্যের তত্ত্বাবধানে (إِلٰى عَمِّهِ الشَّفِيْقِ):
পিতার অন্তিম অসিয়তের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আবূ ত্বালিব অত্যন্ত যত্নসহকারে ভ্রাতুষ্পুত্র ও ভবিষ্যতের নাবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে লালন-পালন করতে থাকেন। আবূ ত্বালিব তাঁকে যে আপন সন্তানাদির অন্যতম হিসেবে লালন-পালন করতে থাকেন তা-ই নয়, বরং নিজ সন্তানের চেয়ে অধিক স্নেহ-মমতা দিয়েই তাঁকে প্রতিপালন করতে থাকেন। অধিকন্তু, পিতা আব্দুল মুত্তালিবের মতই তিনিও তাঁকে নানাভাবে সম্মান প্রদর্শন করতে থাকেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত এভাবে তিনি বিচক্ষণ চাচার অধীনে লালিত-পালিত হতে থাকেন। তাঁর চাচার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ঘটনাবলী প্রসঙ্গক্রমে পরবর্তী পর্যায়ে আলোচনা করা হবে।
ফুটনোটঃ
চেহারা মুবারক হতে রহমত বর্ষণের অন্বেষণ (يُسْتَسْقَى الْغَمَامُ بِوَجْهِهِ):
ইবনে আসাকের, জালহুমাহ বিন ‘উরফুতাহ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, ‘আমি একবার মক্কায় আগমন করলাম। দুর্ভিক্ষের কারণে মানুষ তখন অত্যন্ত নাজেহাল এবং সংকটাপন্ন অবস্থায় নিপতিত ছিলেন। কুরাইশগণ আবূ ত্বালিবকে বললেন, ‘হে আবূ ত্বালিব! আরববাসীগণ দুর্ভিক্ষজনিত চরম আকালের সম্মুখীন হয়েছেন। চলুন সকলে বৃষ্টির জন্য আল্লাহ তা‘আলার নিকটে দু‘আ করি’’। এ কথা শ্রবণের পর আবূ ত্বালিব এক বালককে (বালক নাবী (সাঃ))-কে সঙ্গে নিয়ে বাহির হলেন। ঐ বালককে আকাশে মেঘাচ্ছন্ন এমন এক সূর্য বলে মনে হচ্ছিল যা থেকে ঘন মেঘমালা যেন এখনই আলাদা হয়ে গেল। সেই বালকের আশপাশে আরও অন্যান্য বালকও ছিল, কিন্তু এ বালকটির মুখমন্ডল থেকে এ বৈশিষ্ট্য যেন ছড়িয়ে পড়ছিল।
আবূ ত্বালিব সে বালককে হাত ধরে কাবা গৃহের নিকট নিয়ে গেলেন এবং ক্বাবা’হর দেয়ালের সঙ্গে তাঁর পিঠ লাগিয়ে তাঁকে দাঁড়িয়ে থাকতে বললেন। বালক তাঁর চাচার হাতের আঙ্গুল ধরে দাঁড়িয়ে থাকলেন। সে সময় আকাশে এক টুকরো মেঘও ছিল না। অথচ কিছুক্ষণের মধ্যেই মেঘে মেঘে আকাশ ছেয়ে গিয়ে আঁধার ঘনিয়ে এল এবং মুষল ধারে বৃষ্টিপাত শুরু হল। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এত বেশী হল যে উপত্যকায় প্লাবনের সৃষ্টি হয়ে গেল এবং এর ফলে শহর ও মরু অঞ্চল পুনরায় সতেজ-সজীব হয়ে উঠল। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আবূ ত্বালিব মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর যে প্রশংসা গীতি গেয়েছিলেন তা হচ্ছে:
وأبيضَ يُستسقى الغَمَام بوجهه ** ثِمالُ اليتامى عِصْمَةٌ للأرامل
অর্থঃ ‘তিনি অত্যন্ত সৌন্দর্যমন্ডিত। তাঁর চেহারা মুবারক দ্বারা রহমতের বৃষ্টি অন্বেষণ করা হয়ে থাকে। তিনি ইয়াতিমদের আশ্রয়স্থল এবং স্বামী হারাদের রক্ষক।’[1]
ফুটনোটঃ[1] শাইখ আব্দুল্লাহ মুখতাসারুস সীরাহ ১৫ ও ৬ পৃষ্ঠা।
বাহীরা রাহেব (بَحِيرَى الرَّاهِب):
কথিত আছে যে, (এ বর্ণনা সূত্র কিছুটা সন্দেহযুক্ত) নাবী (সাঃ)-এর বয়স যখন বার বছর (ভিন্ন এক বর্ণনায় বার বছর দু’মাস দশদিন)[1] সেই সময়ে ব্যবসা উপলক্ষে চাচা আবূ ত্বালীবের সঙ্গে তিনি শাম দেশে (সিরিয়া) গমন করেন এবং সফরের এক পর্যায়ে বসরায় গিয়ে উপস্থিত হন। বসরা ছিল শাম রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত একটি স্থান এবং হুরানের কেন্দ্রীয় শহর। সে সময় তা আরব উপদ্বীপের রোমীয়গণের আয়ত্বাধীন রাষ্ট্রের রাজধানী ছিল। এ শহরে জারজিস নামক একজন খ্রীষ্টান ধর্মযাজক (রাহেব) বসবাস করতেন। তাঁর উপাধি ছিল বাহীরা এবং এ উপাধিতেই তিনি সকলের নিকট পরিচিত এবং প্রসিদ্ধ ছিলেন। মক্কার ব্যবসায়ী দল যখন বসরায় শিবির স্থাপন করেন তখন রাহেব গীর্জা থেকে বেরিয়ে তাঁদের নিকট আগমন করেন এবং আতিথেয়তায় আপ্যায়িত করেন। অথচ এর আগে কখনও তিনি এভাবে গীর্জা থেকে বেরিয়ে কোন বাণিজ্য কাফেলার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন নি। তিনি কিশোর নাবী (সাঃ)-এর অবয়ব, আচরণ এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য দেখে বুঝতে পারেন যে, ইনিই হচ্ছেন বিশ্বমানবের মুক্তির দিশারি আখেরী নাবী (সাঃ)। তারপর কিশোর নাবী (সাঃ)-এর হাত ধরে তিনি বলেন যে, ‘ইনি হচ্ছেন বিশ্ব জাহানের সরদার। আল্লাহ তাঁকে বিশ্ব জাহানের রহমত রূপী রাসূল মনোনীত করবেন।’
আবূ ত্বালিব এবং কুরাইশের লোকজন বললেন, ‘আপনি কিভাবে অবগত হলেন যে, তিনিই হবে আখেরী নাবী?’ বাহীরা বললেন, ‘গিরি পথের ঐ প্রান্ত থেকে তোমাদের আগমন যখন ধীরে ধীরে দৃষ্টিগোচর হয়ে আসছিল আমি প্রত্যক্ষ করলাম যে, সেখানে এমন কোন বৃক্ষ কিংবা প্রস্তরখন্ড ছিল না যা তাঁকে সিজদা করে নি। এ সকল জিনিস নাবী-রাসূল ছাড়া সৃষ্টিরাজির অন্য কাউকেও কখনো সিজদা করে না। অধিকন্তু, ‘মোহরে নবুওয়াত’ দেখেও আমি তাঁকে চিনতে পেরেছি। তাঁর কাঁধের নীচে কড়ি হাড্ডির পাশে সেব ফলের আকৃতি বিশিষ্ট একটি দাগ রয়েছে, সেটাই হচ্ছে ‘মোহরে নবুওয়াত’। আমাদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেল সূত্রে আমরা এ সব কিছু অবগত হতে পেরেছি।’ অতঃপর তিনি তাদেরকে আতিথেয়তায় আপ্যায়িত করেন।
এরপর বাহীরা আবূ ত্বালিবকে বললেন, ‘এঁকে সঙ্গে নিয়ে আর বিদেশ ভ্রমণ করবেন না। শীঘ্রই একে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যান। কারণ, এর পরিচয় অবগত হলে ইহুদী ও রুমীগণ এঁকে হত্যা করে ফেলতে পারে।
এ কথা জানার পর আবূ ত্বালিব তাঁকে কয়েকজন গোলামের সাথে মক্কা ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।[2]
ফুটনোটঃ[1] একথা ইবনে জাওযী তালকিহুল ফোহুম ৭ পৃঃ।
[2] মুখতাসারুস সীরাহ ১৬ পৃঃ, ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৮০-১৮৩ পৃঃ। তিরমিযী ও অন্যান্য বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে যে বিলাল (রাঃ)-এর সাথে তাঁকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তা ছিল ভুল। কেন না তখনো বিলালের জন্ম হয়নি। আর জন্ম হয়ে থাকলে আবূ তালিব আবূ বকর (রাঃ)-এর সঙ্গে ছিলেন না। যাদুল মা’আদ ১/১৭।
ফিজার যুদ্ধ (حرب الفجار او حرب الفجار):
নাবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর বয়স যখন বিশ বছর তখন ওকায বাজারে একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধের একপক্ষে ছিলেন কুরাইশগণ এবং তাঁদের মিত্র বনু কিনানাহ। বিপক্ষে ছিলেন ক্বায়স আয়লান। এ যুদ্ধ ‘ফিজার যুদ্ধ’ হিসেবে খ্যাত। কেননা বনু কিনানাহর বার্রায নামে এক ব্যক্তি ক্বায়স আয়লানের তিন লোককে হত্যা করে। এ খবর ওকাযে পৌছলে উভয় দলের মাঝে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে যুদ্ধ বেধে যায়। কুরাইশ-কিনানা মিত্রপক্ষের সেনাপতি ছিলেন হারব বিন উমাইয়া। কারণ, প্রতিভা এবং প্রভাব-প্রতিপত্তির ফলে তিনি কুরাইশ ও কিনানাহ গোত্রের মধ্যে নিজেকে মান-মর্যাদার উচ্চাসনে প্রতিষ্ঠিত করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রথম দিকে কিনানাহদের উপর ক্বায়সদের সমর্থন ছিল বেশী, কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে কিনানাহদেরই সমর্থন হয়ে যায় বেশী। অতঃপর কুরাইশের কতক ব্যক্তি উভয় পক্ষের নিহতদের বিষয়ে সমঝোতার লক্ষ্যে সন্ধির প্রস্তাব দেন এবং বলেন যে, কোন পক্ষে বেশি নিহত থাকলে অতিরিক্ত নিহতের দিয়াত গৃহীত হবে। এতে উভয়পক্ষ সম্মত হয়ে সন্ধি করে এবং যুদ্ধ পরিত্যাগ করে পরষ্পর শত্রুতা বিদ্বেষ ভুলে যায়। একে ফিজার যুদ্ধ এ জন্যই বলা হয় যে, এতে নিষিদ্ধ বস্তুসমূহ এবং পবিত্র মাসের পবিত্রতা উভয়ই বিনষ্ট করা হয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কিশোর বালক অবস্থায় এ যুদ্ধে গমন করেছিলেন। এ যুদ্ধে তিনি তীরের আঘাত থেকে তাঁর চাচাদের রক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিলেন।[1]।
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, কালবে জাযীরাতুল আরব ৩২০ পৃঃ এবং তারীখে খুযরী ১ম খন্ড ৬৩ পৃঃ।
হিলফুল ফুযূল বা ন্যায়নিষ্ঠার প্রতিজ্ঞা (حِلْفُ الْفُضُوْلِ):
ফিজার যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা ও ভয়াবহতা সুচিন্তাশীল ও সদিচ্ছাপরায়ণ আরববাসীগণকে দারুণভাবে বিচলিত করে তোলে। এ যুদ্ধে কত যে প্রাণহানি ঘটে, কত শিশু ইয়াতীম হয়, কত নারী বিধবা হয় এবং কত সম্পদ বিনষ্ট হয় তার ইয়ত্তা করা যায় না। ভবিষ্যতে আরববাসীগণকে যাতে এ রকম অর্থহীন যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে না হয় সে জন্য আরবের বিশিষ্ট গোত্রপতিগণ আব্দুল্লাহ বিন জুদয়ান তাইমীর গৃহে একত্রিত হয়ে আল্লাহর নামে একটি অঙ্গীকারনামা সম্পাদনা করেন। আব্দুল্লাহ বিন জুদ’আন ছিলেন তৎকালীন মক্কার একজন অত্যন্ত ধণাঢ্য ব্যক্তি। অধিকন্তু, সততা, দানশীলতা এবং অতিথি পরায়ণতার জন্য সমগ্র আরবভূমিতে তাঁর বিশেষ প্রসিদ্ধি থাকার কারণে আবরবাসীগণের উপর তাঁর যথেষ্ট প্রভাবও ছিল। এ প্রেক্ষিতেই তাঁর বাড়িতেই অঙ্গীকারনামা সম্পাদনের এ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়।
যে সকল গোত্র আলোচনা বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন তার মধ্যে প্রধান গোত্রগুলো হচ্ছে বনু হাশিম, বনু মুত্তালিব, বনু আসাদ বিন আব্দুল উযযা, বনু যুহরা বিন কিলাব এবং বনু তামীম বিন মুররাহ। বৈঠকে একত্রিত হয়ে সকলে যাবতীয় অন্যায়, অনাচার এবং অর্থহীন যুদ্ধ-বিগ্রহের প্রতিকার সম্পর্কে আলাপ আলোচনা করেন। তখনকার সময়ে নিয়ম ছিল গোত্রীয় কিংবা বংশীয় কোন ব্যক্তি, আত্মীয়-স্বজন অথবা সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ কোন ব্যক্তি শত অন্যায়-অনাচার করলেও সংশ্লিষ্ট সকলকে তাঁর সমর্থন করতেই হবে তা সে যত বড় বা বীভৎস অন্যায় হোক না কেন। এ পরামর্শ সভায় এটা স্থিরীকৃত হয় যে, এ জাতীয় নীতি হচ্ছে ভয়ংকর অন্যায়, অমানবিক ও অবমাননাকর। কাজেই, এ ধরণের জঘন্য নীতি আর কিছুতেই চলতে দেয়া যেতে পারে না। তাঁরা প্রতিজ্ঞা করলেন:
(ক) দেশের অশান্তি দূর করার জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব।
(খ) বিদেশী লোকজনের ধন-প্রাণ ও মান-সম্ভ্রম রক্ষা করার জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব।
(গ) দরিদ্র, দুর্বল ও অসহায় লোকদের সহায়তা দানে আমরা কখনই কুণ্ঠাবোধ করব না।
(ঘ) অত্যাচারী ও অনাচারীর অন্যায়-অত্যাচার থেকে দুর্বল দেশবাসীদের রক্ষা করতে প্রাণপণ চেষ্টা করব।
এটা ছিল অন্যায় ও অনাচারের বিরুদ্ধে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য অঙ্গীকার নামা। এ জন্য এ অঙ্গীকারনামা ভিত্তিক সেবা সংঘের নাম দেয়া হয়েছিল ‘হিলফুল ফুযূল’ বা ‘হলফ-উল ফুযূল’।
একদা এ প্রসঙ্গের উল্লেখ কালে তিনি দৃপ্তকণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আজও যদি কোন উৎপীড়িত ব্যক্তি বলে, ‘হে, ফুযুল অঙ্গীকারনামার ব্যক্তিবৃন্দ! আমি নিশ্চয়ই তার সে আহবানে সাড়া দিব।
অধিকন্তু, এ ব্যাপারে অন্য এক প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘আব্দুল্লাহ বিন জুদ’আনের বাসভবনে আমি এমন এক অঙ্গীকারনামায় শরীক ছিলাম যার বিনিময়ে আমি আসন্ন প্রসবা উটও পছন্দ করি না এবং যদি ইসলামের যুগে এরূপ অঙ্গীকারের জন্য আমাকে আহবান জানানো হয় তাহলেও ‘আমি উপস্থিত আছি কিংবা প্রস্তুত আছি’ বলতাম।[1]
‘হলফ-উল-ফুযুল’ প্রতিষ্ঠার অন্য একটি প্রাসঙ্গিক প্রত্যক্ষ পটভূমির কথাও জানা যায় এবং তা হচ্ছে, জুবাইদ নামক একজন লোক মক্কায় এসেছিলেন কিছু মালপত্র নিয়ে ব্যবসার উদ্দেশ্যে। আস বিন ওয়ায়িল সাহমী তাঁর নিকট থেকে মালপত্র ক্রয় করেন কিন্তু তাঁর প্রাপ্য তাঁকে না দিয়ে তা আটক রাখেন। এ ব্যাপারে তাঁকে সাহায্যের জন্য তিনি আব্দুদ্দার, মাখযুম, জুমাহ, সাহম এবং আদী এ সকল গোত্রের নিকট সাহায্যের আবেদন জানান। কিন্তু তাঁর আবেদনের প্রতি কেউই কর্ণপাত না করায় তিনি জাবালে আবূ কুবাইশ পর্বতের চূড়ায় উঠে উচ্চ কণ্ঠে কিছু কবিতা আবৃত্তি করেন যার মধ্যে তাঁর নিজের অত্যাচার-উৎপীড়নের মুখোমুখি হওয়ার বিষয়টিও বর্ণিত ছিল। আবৃত্তি শ্রবণ করে জুবাইর বিন আব্দুল মুত্তালিব দৌড়ে গিয়ে বলেন, ‘এ লোকটি অসহায় এবং সহায় সম্বলহীন কেন? তাঁরই অর্থাৎ জুবাইরের প্রচেষ্টায় উপরোক্ত গোত্রগুলো একত্রিত হয়ে একটি সন্ধিচুক্তি সম্পাদন করেন এবং পরে আস বিন ওয়ায়িলের নিকট থেকে জুবাইরের পাওনা আদায় করে দেয়া হয়।’[2]
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৩৩ ও ১৩৫ পৃঃ, মুখতাসারুস সীরাহ ৩০-৩১ পৃঃ।
[2] মুখতাসারুস সীরাহ ৩০-৩১ পৃঃ।
দুঃখময় জীবন যাপন (حَيَاةُ الْكَدْحِ):
নাবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর বাল্য, কৈশোর এবং প্রথম যৌবনে পেশাভিত্তিক সুনির্দিষ্ট কোন কাজ-কর্মের কথা পাওয়া যায় না। তবে নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে জানা যায় যে, বনু সা‘দ গোত্রে দুধমা’র গৃহে থাকাবস্থায় অন্যান্য বালকদের সঙ্গে ছাগল চরানোর উদ্দ্যেশে মাঠে গমন করতেন।[1] মক্কাতেও কয়েক কীরাত অর্থের বিনিময়ে তিনি ছাগল চরাতেন।[2]
অধিকন্তু, কৈশোরে চাচা আবূ ত্বালীবের সঙ্গে বাণিজ্য উপলক্ষে তিনি সিরিয়া গমন করেছিলেন। বর্ণিত আছে যে, তিনি (সাঃ) সায়িব বিন আবূ মাখযূমীর সাথে ব্যবসা করতেন এবং তিনি একজন ভাল অংশীদার ছিলেন। না তোষামোদী ছিলেন, না ঝগড়াটে ছিলেন। তিনি যখন মক্কা বিজয়ের সময় আগমন করেন তখন তাকে সাদর সম্ভাষন জানান এবং বললেন, হে আমার ভাই এবং ব্যবসায়ের অংশীদার।
তারপর যখন তিনি পঁচিশ বছর বয়সে পদার্পণ করেন তখন খাদীজাহ (রাঃ)-এর সম্পদ নিয়ে ব্যবসার উদ্দেশ্যে শাম দেশে গমন করেন। ইবনে ইসহাক্ব হতে বর্ণিত আছে যে, খাদীজাহ (রাঃ) বিনতে খুওয়াইলিদ এক সম্ভ্রান্ত সম্পদশালী ও ব্যবসায়ী মহিলা ছিলেন। ব্যবসায়ে অংশীদারিত্ব এবং প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী লভ্যাংশের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে তিনি ব্যবসায়ীগণের নিকট অর্থলগ্নী করতেন। পুরো কুরাইশ গোত্রই জীবন জীবিকার জন্য ব্যবসা-বাণিজ্যে লিপ্ত থাকতেন। যখন খাদীজাহ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সত্যবাদিতা, উত্তম চরিত্র, সদাচার এবং আমানত হেফাজতের নিশ্চয়তা সম্পর্কে অবগত হলেন তখন তিনি মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নিকট এক প্রস্তাব পেশ করলেন যে, তিনি তাঁর অর্থ নিয়ে ব্যবসার উদ্দেশ্যে তাঁর দাস মায়সারার সঙ্গে শাম দেশে গমন করতে পারেন। তিনি স্বীকৃতিও প্রদান করেন যে, অন্যান্য ব্যবসায়ীগণকে যে হারে লভ্যাংশ বা মুনাফা প্রদান করা হয় তাঁকে তার চাইতে অধিকমাত্রায় মুনাফা প্রদান করা হবে। মুহাম্মাদ (সাঃ) এ প্রস্তাব গ্রহণ করলেন এবং তার অর্থ সম্পদ নিয়ে দাস মায়সারার সঙ্গে শাম দেশে গমন করলেন।[3]
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৬৬ পৃঃ।
[2] সহীহুল বুখারী, আল এজারত্ব বাবু রাইল গানামে আলা কাবারিতা ১ম খন্ড ৩০১ পৃঃ।
[3] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৮৭-১৮৮ পৃঃ।
খাদীজাহ (রাঃ) এর সঙ্গে বিবাহ (زِوَاجُهُ بِخَدِيْجَةَ):
সিরিয়া থেকে যুবক নাবী (সাঃ)-এর প্রত্যাবর্তনের পর ব্যবসা বাণিজ্যের খতিয়ান করা হল। হিসাব নিকাশ করে আমানতসহ এত বেশী পরিমাণ অর্থ তিনি পেলেন ইতোপূর্বে কোন দিনই তা পাননি। এতে খাদীজাহ (সাঃ)-এর অন্তর তৃপ্তির আমেজে ভরে ওঠে। অধিকন্তু, তাঁর দাস মায়সারার কথাবার্তা থেকে মুহাম্মাদ (সাঃ) মিষ্টভাষিতা, সত্যবাদিতা, উন্নত চিন্তা-ভাবনা, আমানত হেফাজত করার ব্যাপারে একাগ্রতা ইত্যাদি বিষয় অবগত হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাবোধ ক্রমেই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে থাকে এবং তাঁকে পতি হিসেবে পাওয়ার একটা গোপন বাসনা ক্রমেই তাঁর মনে দানা বেঁধে উঠতে থাকে। এর পূর্বে বড় বড় সরদার, নেতা ও প্রধানগণ অনেকেই তাঁর নিকট বিয়ের প্রস্তাব পাঠান কিন্তু তিনি কোনটিই মঞ্জুর করেন নি। অথচ মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে স্বামী রূপে পাওয়ার জন্য তিনি যার পরনাই ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। তিনি নিজ অন্তরের গোপন বাসনা ও ব্যাকুলতার কথা তাঁর বান্ধবী নাফীসা বিনতে মুনাবিবহ এর নিকট ব্যক্ত করলেন এবং বিষয়টি নিয়ে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর সঙ্গে আলোচনা করার জন্য তাঁকে অনুরোধ জানালেন। নাফীসা খাদীজাহ (রাঃ)-এর প্রস্তাব সম্পর্কে নাবী কারীম (সাঃ)-এর সঙ্গে আলোচনা করলেন। নাবী কারীম (সাঃ) এ প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করে বিষয়টি চাচা আবূ ত্বালীবের সঙ্গে আলোচনা করলেন। আবূ ত্বালিব এ ব্যাপারে খাদীজাহ (রাঃ)-এর পিতৃব্যের সঙ্গে আলোচনার পর বিয়ের প্রস্তাব পেশ করেন এবং এক শুভক্ষণে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহপ্রাপ্ত দুইটি প্রাণ বিশ্বমানবের অনুকরণ ও অনুসরণযোগ্য পবিত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যান। বিবাহ অনুষ্ঠানে বনু হাশিম ও মুযারের প্রধানগণ উপস্থিত থেকে অনুষ্ঠানের সৌষ্ঠব বৃদ্ধি করেন।
নাবী কারীম (সাঃ) এবং খাদীজাহ (রাঃ)-এর মধ্যে শুভ বিবাহপর্ব অনুষ্ঠিত হয় শাম দেশ থেকে প্রত্যাবর্তনের দু’মাস পর। তিনি সহধর্মিনী খাদীজাহকে মোহরানা স্বরূপ ২০টি উট প্রদান করেন। ঐ সময় খাদীজাহ (রাঃ)-এর বয়স হয়েছিল ৪০ বছর। বংশ-মর্যাদা, সহায়-সম্পদ, বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সমাজের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়া। তিনি ছিলেন উত্তম চরিত্রের এক অনুপমা মহিলা এবং নাবী কারীম (সাঃ)-এর প্রথমা সহধর্মিনী। তাঁর জীবদ্দশায় তিনি আর অন্য কোন মহিলাকে বিবাহ করেন নাই।[1]
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সন্তানদের মধ্যে ইবরাহীম ব্যতীত অন্যান্য সকলেই ছিলেন খাদীজাহ (রাঃ)-এর গর্ভজাত সন্তান। নাবী দম্পতির প্রথম সন্তান ছিলেন কাসেম, তাই উপনাম হয় ‘আবুল কাসেম’। তারপর যথাক্রমে জন্মগ্রহণ করেন যায়নাব, রুকাইয়্যাহ, উম্মে কুলসুম, ফাত্বিমাহ ও আব্দুল্লাহ। আব্দুল্লাহর উপাধি ছিল ‘ত্বাইয়িব’ এবং ‘ত্বাহির’।
নাবী কারীম (সাঃ)-এর সকল পুত্র সন্তানই বাল্যাবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তবে কন্যাদের মধ্যে সকলেই ইসলামের যুগ পেয়েছেন, মুসলিম হয়েছেন এবং মুহাজিরের মর্যাদাও লাভ করেছেন। কিন্তু ফাত্বিমাহ (রাঃ) ব্যতীত কন্যাগণ সকলেই পিতার জীবদ্দশাতেই মৃত্যু বরণ করেন। ফাত্বিমাহ (রাঃ)-এর মৃত্যু হয়েছিল নাবী কারীম (সাঃ)-এর ছয় মাস পর।[2]
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৮৯-১৯০ পৃঃ। ফিক্বহুস সীরাহ ৫৯ পৃঃ ও তালকিহুল ফোহুম ৭ পৃঃ।
[2] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৯০-১৯১ পৃঃ, ফিক্বহুস সীরাহ ৬০ পৃঃ। ফাতহুল বারী ৭ম খন্ড ১৫০ পৃঃ। তারীখের বই সমূহে কিছু মতভেদের কথা উলেখিত হয়েছে। তবে আমার নিকট যা অধিক গ্রহণযোগ্য তা এখানে লিপিবদ্ধ করলাম।
ক্বাবা’হ গৃহ পুনঃ নির্মাণ এবং হজরে আসওয়াদ সম্পর্কিত বিবাদ মীমাংসা (بِنَاءُ الْكَعْبَةِ وَقَضِيَّةُ التَّحْكِيْمِ):
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন পঁয়ত্রিশ বছরে পদার্পণ করেন তখন কুরাইশগণ ক্বাবা’হ গৃহের পুনঃনির্মাণ কাজ আরম্ভ করেন। কারণ, ক্বাবা’হ গৃহের স্থানটি চতুর্দিকে দেয়াল দ্বারা পরিবেষ্টিত অবস্থায় ছিল মাত্র। দেয়ালের উপর কোন ছাদ ছিল না। এ অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করে কিছু সংখ্যক চোর এর মধ্যে প্রবেশ করে রক্ষিত বহু মূল্যবান সম্পদ এবং অলঙ্কারাদি চুরি করে নিয়ে যায়। ইসমাঈল (আঃ)-এর আমল হতেই এ ঘরের উচ্চতা ছিল ৯ হাত।
গৃহটি বহু পূর্বে নির্মিত হওয়ার কারণে দেয়ালগুলোতে ফাটল সৃষ্টি হয়ে যে কোন মুহূর্তে তা ভেঙ্গে পড়ার মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। তাছাড়া সেই বছরেই মক্কা প্লাবিত হয়ে যাওয়ার কারণে ক্বাবা’হমুখী জলধারা সৃষ্টি হয়েছিল। তাছাড়া প্রবাহিত হওয়ায় ক্বাবা’হগৃহের দেওয়ালের চরম অবনতি ঘটে এবং যে কোন মুহূর্তে তা ধ্বসে পড়ার আশঙ্কা ঘণীভূত হয়ে ওঠে। এমন এক নাজুক অবস্থার প্রেক্ষাপটে কুরাইশগণ সংকল্পবদ্ধ হলেন ক্বাবা’হ গৃহের স্থান ও মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার উদ্দেশ্যে তা পুনঃনির্মাণের জন্য।
ক্বাবা’হ গৃহ নির্মাণের উদ্দেশ্যে সকল গোত্রের কুরাইশগণ একত্রিত হয়ে সম্মিলিতভাবে কতিপয় নীতি নির্ধারণ করে নিলেন। সেগুলো হচ্ছে যথাক্রমেঃ ক্বাবা’হ গৃহ নির্মাণ করতে গিয়ে শুধুমাত্র বৈধ অর্থ-সম্পদ (হালাল) ব্যবহার করা হবে। এতে বেশ্যাবৃত্তির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ, সুদের অর্থ এবং হক নষ্ট করে সংগৃহীত হয়েছে এমন কোন অর্থ নির্মাণ কাজে ব্যবহার করা চলবে না। এ সকল নীতির প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন করে নির্মাণ কাজ আরম্ভ করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা হল।
নতুন ইমারত তৈরির জন্য পুরাতন ইমারত ভেঙ্গে ফেলা প্রয়োজন। কিন্তু আল্লাহর ঘর ভেঙ্গে ফেলার কাজে হাত দিতে কারো সাহস হচ্ছে না, অবশেষে ওয়ালীদ বিন মুগীরাহ মাখযুমী সর্বপ্রথম ভাঙ্গার কাজে হাত দিলেন এবং অন্যেরা ভীত-সম্ভ্রন্ত চিত্তে তা প্রত্যক্ষ করতে থাকলেন। কিন্তু কিছু অংশ ভেঙ্গে ফেলার পরও যখন তাঁরা দেখলেন যে তাঁর উপর কোন বিপদ আপদ আসছে না তখন সকলেই ভাঙ্গার কাজে অংশ গ্রহণ করলেন। যখন ইবরাহীম (আঃ)-এর ভিত্তি পর্যন্ত ভেঙ্গে ফেলা হল তখন নির্মাণ কাজ শুরু হল। প্রত্যেক গোত্র যাতে নির্মাণ কাজে অংশ গ্রহণের সুযোগ লাভ করে তজ্জন্য কোন্ গোত্র কোন্ অংশ নির্মাণ করবেন পূর্বাহ্নেই তা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এ প্রেক্ষিতে প্রত্যেক গোত্রই ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রস্তর সংগ্রহ করে রেখেছিলেন। বাকূম নামক একজন রুমীয় মিস্ত্রির তত্ত্বাবধানে নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলছিল। নির্মাণ কাজ যখন কৃষ্ণ প্রস্তরের স্থান পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছল তখন নতুনভাবে এক সমস্যার সৃষ্টি হল। সমস্যাটি হল ‘হাজারে আসওয়াদ’ তথা ‘কৃষ্ণ প্রস্তর’টি স্থাপন করার মহা গৌরব অর্জন করবেন তা নিয়ে। এ ব্যাপারে ঝগড়া ও কথা কাটাকাটি চার বা পাঁচ দিন চললো।
সকলেই নিজে বা তাঁর গোত্র কৃষ্ণ প্রস্তরটি যথাস্থানে স্থাপন করার দাবীতে অনড়। সকলেরই এক কথা, এ কাজটি তাঁরাই করবেন। কেউই সামান্য ছাড় দিতেও তৈরি নন। সকলেরই একই কথা, একই জেদ। জেদ ক্রমান্বয়ে রূপান্তরিত হল রেষারেষিতে। রেষারেষির পরবর্তী পর্যায় হচ্ছে রক্তারক্তি। এ ব্যাপারে রক্তারক্তি করতেও তাঁরা পিছপা হবেন না। সকল গোত্রের মধ্যেই চলছে সাজ সাজ রব। শুরু হয়েছে অস্ত্রের মহড়া। একটু নরমপন্থীগণ সকলেই আতঙ্কিত কখন যে যুদ্ধ বেধে যায় কে তা জানে।
এমন বিভীষিকাময় এক অবস্থার প্রেক্ষাপটে বর্ষীয়ান নেতা আবু্ উমাইয়া মাখযূমী এ সমস্যা সমাধানের একটি সূত্র খুঁজে পেলেন। তিনি সকলকে লক্ষ্য করে প্রস্তাব করলেন যে, আগামী কাল সকালে যে ব্যক্তি সর্ব প্রথম মসজিদুল হারামে প্রবেশ করবেন তাঁর উপরেই এ বিবাদ মীমাংসার দায়িত্ব অর্পণ করা হোক। সকলেই এ প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করলেন। আল্লাহর কী অপার মহিমা! দেখা গেল সকল আরববাসীর প্রিয়পাত্র ও শ্রদ্ধেয় আল-আমিনই সর্ব প্রথম মসজিদুল হারামে প্রবেশ করেছেন। নাবী কারীম (সাঃ)-এর এভাবে আসতে দেখে সকলেই চিৎকার করে বলে উঠল :
هٰذَا الْأَمِيْنُ، رَضَيْنَاهُ، هٰذَا مُحَمَّدٌ،
আমাদের বিশ্বাসী, আমরা সকলেই এর উপর সন্তুষ্ট, তিনিই মুহাম্মাদ (সাঃ)।
তারপর নাবী কারীম (সাঃ) যখন তাঁদের নিকটবর্তী হলেন তখন ব্যাপারটি সবিস্তারে তাঁর নিকট পেশ করা হল। তখন তিনি এক খানা চাদর চাইলেন। তাঁকে চাদর দেয়া হলে তিনি মেঝের উপর তা বিছিয়ে দিয়ে নিজের হাতে কৃষ্ণ প্রস্তরটি তার উপর স্থাপন করলেন এবং বিবাদমান গোত্রপতিগণকে আহবান জানিয়ে বললেন, ‘আপনারা সকলে চাদরের পার্শ্ব ধরে উত্তোলন করুন। তাঁরা তাই করলেন। চাদর যখন কৃষ্ণ প্রস্তর রাখার স্থানে পৌছল তখন তিনি স্বীয় মুবারক হস্তে কৃষ্ণ প্রস্তরটি উঠিয়ে যথাস্থানে রেখে দিলেন। এ মীমাংসা সকলেই হৃষ্টচিত্তে মেনে নিলেন। অত্যন্ত সহজ, সুশৃঙ্খল এবং সঙ্গত পন্থায় জ্বলন্ত একটি সমস্যার সমাধান হয়ে গেল।
এ দিকে কুরাইশগণের নিকট বৈধ অর্থের ঘাটতি দেখা দিল। এ জন্যই উত্তর দিক হতে ক্বাবা’হ গৃহের দৈর্ঘ আনুমানিক ছয় হাত পর্যন্ত কমিয়ে দেয়া হল। এ অংশটুকুই ‘হিজর’ ‘হাতীম’ নামে প্রসিদ্ধ। এবার কুরাইশগণ ক্বাবা’হর দরজা ভূমি হতে বিশেষভাবে উঁচু করে দিলেন যেন এর মধ্য দিয়ে সেই ব্যক্তি প্রবেশ করতে পারে যাকে তাঁরা অনুমতি দেবেন। যখন দেয়ালগুলো পনের হাত উঁচু হল তখন গৃহের অভ্যন্তর ভাগে ছয়টি পিলার বা স্তম্ভ নির্মাণ করা হল এবং তার উপর ছাদ দেয়া হল। ক্বাবা’হ গৃহের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলে একটি চতুর্ভূজের রূপ ধারণ করল। বর্তমানে ক্বাবা’হ গৃহের উচ্চতা হচ্ছে পনের মিটার। কৃষ্ণ প্রস্তর বিশিষ্ট দেয়াল এবং তার সামনের দেয়াল অর্থাৎঃ দক্ষিণ ও উত্তর দিকের দেয়াল হচ্ছে দশ দশ মিটার। কৃষ্ণ প্রস্তর মাতাফের জায়গা হতে দেড় মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। দরজা বিশিষ্ট দেয়াল এবং এর সাথে সামনের দেয়াল অর্থাৎ পূর্ব এবং পশ্চিম দিকের দেয়াল বার মিটার করে। দরজা রয়েছে মেঝে থেকে দু’মিটার উঁচুতে। দেয়ালের পাশেই চতুর্দিকে নীচু জায়গা এক বৃদ্ধিপ্রাপ্ত চেয়ার সমতুল্য অংশ দ্বারা পরিবেষ্টিত আছে যার উচ্চতা পঁচিশ সেন্টিমিটার এবং গড় প্রস্থ ত্রিশ সেন্টিমিটার। একে শাজে বওয়া (চলন্ত দুর্লভ) বলা হয়। এটাও হচ্ছে প্রকৃত পক্ষে বায়তুল্লাহর অংশ। কিন্তু কুরাইশগণ এটাও ছেড়ে দিয়েছিলেন।[1]
ফুটনোটঃ[1] বিস্তারিত জানার জন্য দ্রষ্ঠব্য ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৯২-১৯৭ পৃঃ ফিক্বহুস সীরাহ ৬২ পৃঃ সহীহুল বুখারী মক্কার ফযীলত অধ্যায় ১ম খন্ড ২১৫ পৃঃ, তারীখে খুযরী ১ম খন্ড ৬৪-৬৫ পৃঃ।
নবুওয়াত লাভের পূর্বকালীন সংক্ষিপ্ত চরিত্র (السِّيْرَةُ الْإِجْمَالِيَّةُ قَبْلَ النُّبُوَّةِ) :
বিভিন্ন মানুষের জীবনের বিভিন্ন স্তরে ভিন্ন ভিন্নভাবে যে সকল সদগুণাবলির বিকাশ পরিলক্ষিত হয়ে থাকে সে সবগুলোর চরম উৎকর্ষ সাধন হয়েছিল রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর অস্তিত্বের সবটুকু জুড়ে। তিনি ছিলেন চিন্তা-চেতনার যথার্থতা, পারদর্শিতা এবং ন্যায় পরায়ণতার এক জ্বলন্ত প্রতীক। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে প্রদান করা হয়েছিল সুষমামন্ডিত দেহ সৌষ্ঠব, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, যাবতীয় জ্ঞানের পরিপূর্ণতা এবং উদ্দেশ্য সাধনে সাফল্য লাভের নিশ্চয়তা। তিনি দীর্ঘ সময় যাবৎ নীরবতা অবলম্বনের মাধ্যমে নিরবছিন্ন ধ্যান ও অনুসন্ধান কাজে রত থাকতে এবং বিষয়ের খুঁটিনাটি সম্পর্কে সুদূর প্রসারী চিন্তা ভাবনার মাধ্যমে ন্যায় ও সত্যের উদঘাটন করতে সক্ষম হতেন। তিনি তাঁর সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধি বিবেচনা এবং নির্ভুল নিরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার দ্বারা মানব সমাজের প্রকৃত অবস্থা, দল বা গোত্র সমূহের গতিবিধি ও মন-মানসিকতা, মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়গুলো অনুধাবনের মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হতেন। যার ফলে শত অন্যায়, অশ্লীলতা এবং অনাচার পরিবেষ্টিত সমাজে বসবাস করেও তিনি ছিলেন সবকিছুর উর্ধ্বে, সবকিছু থেকে মুক্ত ও পবিত্র। শরাবপায়ীদের সাথে বসবাস করেও কোনদিন তিনি শরাব স্পর্শ করেন নি, দেবদেবীর আস্তানায় যবেহকৃত পশুর গোশত্ তিনি কখনো খাননি এবং মূর্তির নামে অনুষ্ঠি কোন প্রকার খেলাধূলায় তিনি কখনো অংশ গ্রহণ করেননি।
জীবনের প্রথমস্তর থেকেই তিনি তৎকালীন সমাজে প্রচলিত যাবতীয় মিথ্যা উপাস্যকে ঘৃণা করতেন এবং সে ঘৃণার মাত্রা এতই অধিক ছিল যে, তাঁর দৃষ্টিতে আর অন্য কোন জিনিস এত নিন্দনীয় ও অপছন্দনীয় ছিল না। এমনকি লাত ও উযযার নামে শপথ করার ব্যাপারটি তাঁর কানে গেলে তিনি তা সহ্য করতেই পারতেন না।[1]
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যে আল্লাহর খাস রহমত, হেফাজত, রক্ষণাবেক্ষণ এবং প্রত্যক্ষ পরিচালনাধীনে লালিত পালিত, পরিচালিত এবং নিয়ন্ত্রিত হয়েছেন সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। অতএব, যখনই পার্থিব কোন ফায়দা লাভের দিকে প্রবৃত্তি আকৃষ্ট বা আকর্ষিত হয়েছে অথবা অপছন্দনীয় কিংবা অনুসরণীয় রীতিনীতি অনুসরণের প্রতি আখলাক আকৃষ্ট হয়েছে তখন আল্লাহ তা‘আলার প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রন সেখানে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইবনে আসীরের একটি বর্ণনা সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘আইয়ামে জাহেলিয়াতের লোকেরা যে সকল কাজ করেছে দু’বার ছাড়া আর কখনো সে ব্যাপারে আমার খেয়াল জাগেনি। কিন্তু সে দু’বারের বেলায় আল্লাহ তা‘আলা আমার এবং সে কাজের মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। এর পর কখনো সে ব্যাপার সম্পর্কে আমার কোন খেয়াল জন্মে নি যে পর্যন্ত না আল্লাহ তা‘আলা আমাকে পয়গম্বরীর মর্যাদা প্রদান করেছেন।
এ ঘটনা ছিল, যে বালকের সঙ্গে আমি মক্কার উপরিভাগে ছাগল চরাতাম এক রাত্রে তাকে বললাম, ‘তুমি আমার ছাগলগুলো একটু দেখাশোনা করো, আমি মক্কায় যাই এবং সেখানে অন্যান্য যুবকগণের মতো যৌবন সংশিষ্ট আবৃত্তি অনুষ্ঠানে যোগদান করি।’
সে বলল, ‘ঠিক আছে। এর পর আমি বাহির হলাম এবং তখনো মক্কার প্রথম ঘরের নিকটেই ছিলাম এমন সময় কিছু বাদ্য যন্ত্রের শব্দ এসে কানে পৌঁছল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথা থেকে বাদ্যযন্ত্রের এ শব্দ ভেসে আসছে?’
লোকেরা বলল, ‘অমুকের বিবাহ হচ্ছে, তারই বাজনা বাজছে’’। আমি সেই যন্ত্র সঙ্গীত শ্রবণের জন্য সেখানে বসে পড়লাম। অমনি আল্লাহ তা‘আলার নিয়ন্ত্রণ আমার শ্রবণ শক্তির উপর আরোপিত হল। তিনি আমার কর্ণের কাজ বন্ধ করে দিলেন এবং আমি সেখানে শুয়ে পড়লাম। তারপর সূর্যের তাপে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। তার পর আমি আমার সে বন্ধুর নিকট চলে গেলাম এবং তার জিজ্ঞাসার জবাবে ঘটনাটি তার নিকট বিস্তারিত বর্ণনা করলাম। এর পর আবার এক রাত্রি আমার বন্ধুর নিকট বসেছিলাম এবং মক্কায় পৌঁছে তদ্রুপ ঘটনার সম্মুখীন হলাম। তদন্তর আর কখনো অনুরূপ ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করি নি।[2]
সহীহুল বুখারীতে জাবির বিন আব্দুল্লাহ কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যে, যখন ক্বাবা’হ গৃহের নিমার্ণ কাজ চলছিল তখন নাবী কারীম (সাঃ) এবং আব্বাস (রাঃ) প্রস্তর বহন করে আনছিলেন। আব্বাস (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বললেন, ‘স্বীয় লুঙ্গি আপন কাঁধে রাখ তাহলে প্রস্তর বহন জনিত যন্ত্রণা থেকে মুক্ত থাকবে। কিন্তু তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন। তাঁর দৃষ্টি আকাশের দিকে উঠে গেল এবং তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। জ্ঞান ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে তিনি চিৎকার করতে লাগলেন, ‘আমার লুঙ্গি, আমার লুঙ্গি’’। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর লুঙ্গি বেঁধে দেয়া হল। অন্য বর্ণনা সূত্রে জানা যায় যে, এরপর তাঁর লজ্জাস্থান আর কোন দিনই দেখা যায় নি।[3]
নাবী কারীম (সাঃ)-এর কাজকর্ম ছিল সব চাইতে আকর্ষণীয়, চরিত্র ছিল সর্বোত্তম এবং মহানুভবতা ছিল সর্বযুগের সকলের জন্য অনুসরণ ও অনুকরণযোগ্য। তিনি ছিলেন সর্বাধিক শিষ্টাচারী, নম্র-ভদ্র, সদালাপী ও সদাচারী। তিনি ছিলেন সব চাইতে দয়াদ্র চিত্ত, দূরদর্শী, সূক্ষ্ণদর্শী ও সত্যবাদী। মিথ্যা কখনো তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। তাঁর সত্যবাদিতার জন্য তিনি এতই প্রসিদ্ধ এবং প্রশংসনীয় ছিলেন যে আরববাসীগণ সকলেই তাঁকে ‘আল-আমীন’ বলে আহবান জানাতেন।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ছিলেন আরববাসীগণের মধ্যে সব চাইতে নির্ভরযোগ্য আমানতদার। খাদীজাহ (রাঃ) সাক্ষ্য দিতেন যে, ‘তিনি অভাবগ্রস্তদের বোঝা বহন করতেন, নিঃস্ব ও অসহায়দের জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করতেন। ন্যায্য দাবীদারদের তিনি সহায়তা করতেন এবং অতিথি পরায়ণতার জন্য মশহুর ছিলেন।[4]
ফুটনোটঃ[1] বোহাযযার ঘটনায় এবং মুদ্রণে বিদ্যমান আছে। দ্রষ্ঠব্য ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১২৮ পৃঃ।
[2] হাদীসটি হাকিম ও যাহাবী বিশুদ্ধ বলেছেন। কিন্তু ইবনে কাসীর আল বেদায়া ও নেহায়া গ্রন্থে ২য় খন্ড ২৮৭ পৃঃ একে দুর্বল বলেছেন।
[3] সহীহুল বুখারী ক্বা‘বা নির্মাণ অধ্যায় ১ম খন্ড ৫৪০ পৃঃ।
[4] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৩ পৃষ্ঠা।
নবুয়াত প্রাপ্তি
হেরা গুহার অভ্যন্তরে (فِيْ غَارِ حِرَاءٍ):
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন চল্লিশে পদার্পণ করলেন, ঐ সময় তাঁর এত দিনের বিচার বিবেচনা, বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তা-ভাবনা যা জনগণ এবং তাঁর মধ্যে ব্যবধানের এক প্রাচীর সৃষ্টি করে চলেছিল তা উন্মুক্ত হয়ে গেল এবং ক্রমান্বয়ে তিনি নির্জনতা প্রিয় হয়ে উঠতে থাকলেন। খাবার এবং পানি সঙ্গে নিয়ে মক্কা নগরী হতে দু’মাইল দূরত্বে অবস্থিত হেরা পর্বত গুহায় গিয়ে ধ্যানমগ্ন থাকতে লাগলেন। এটা হচ্ছে ক্ষুদ্র আকার-আয়তনের একটি গুহা। এর দৈর্ঘ্য হচ্ছে চার গজ এবং প্রস্থ পৌনে দু’গজ। এর নীচ দিকটা তেমন গভীর ছিল না। একটি ছোট্ট পথের প্রান্তভাগে অবস্থিত পর্বতের উপরি অংশের একত্রে মিলে মিশে ঠিক এমন একটি আকার আকৃতি ধারণ করেছিল যা শোভাযাত্রার পুরোভাগে অবস্থিত আরোহী শূন্য সুসজ্জিত অশ্বের মতো দেখায়।
পুরো রমাযান রাসূলুল্লাহ (ষাঃ) হেরা গুনায় অবস্থান করে আল্লাহ তা’আলার ইবাদাত বন্দেগীতে লিপ্ত থাকেন। বিশ্বের দৃশ্যমান বস্তুনিচয়ের অন্তরাল থেকে যে মহাশক্তি প্রতিটি মুহুর্তে সকল কিছুকে জীবন, জীবিকা ও শক্তি জাগিয়ে চলেছেন, সেই মহা মহীয়ান ও গরীয়ান সত্ত্বার ধ্যানে মশগুল থাকতেন। স্বগোত্রীয় লোকদের অর্থহীন বহুত্ববাদী বিশ্বাস ও পৌত্তলিক ধ্যান-ধারণা তাঁর অন্তরে দারুন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করত। কিন্তু তাঁর সামনে এমন কোন পথ খোলা ছিল না যে পথ ধরে তিনি শান্তি ও স্বস্তির সঙ্গে পদচারণা করতে সক্ষম হতেন।[1]
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নির্জন-প্রিয়তা ছিল প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা‘আলার ব্যবস্থাপনার একটি অংশ।
এভাবে আল্লাহ তা‘আলা ভবিষ্যতের এক মহতী কর্মসূচীর জন্য তাঁকে প্রস্তুত করে নিচ্ছিলেন। যে আত্মার নসীবে নবুয়তরূপী এক মহান আসমানী নেয়ামত নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে এবং যিনি পথভ্রষ্ট ও অধঃপতিত মানুষকে সঠিকপথ নির্দেশনা দিয়ে করবেন ধন্য তাঁর জন্য যথার্থই প্রয়োজন সমাজ জীবনের যাবতীয় ব্যস্ততা, জীবন যাত্রা নির্বাহের যাবতীয় ঝামেলা এবং সমস্যা থেকে মুক্ত থেকে নির্জনতা অবলম্বনের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য লাভ করা। আল্লাহ তা‘আলা যখন মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে বিশ্বব্যবস্থায় সব চাইতে মর্যাদাশীল ও দায়িত্বশীল-আমানতদার মনোনীত করে তাঁর কাঁধে দায়িত্বভার অর্পণের মাধ্যমে বিশ্বমানবের জীবন বিধানের রূপরেখা পরিবর্তন এবং অর্থহীন আদর্শের জঞ্জাল সরিয়ে শাশ্বত আদর্শের আঙ্গিকে ইতিহাসের পরিমার্জিত ধারা প্রবর্তন করতে চাইলেন, তখন নবুয়ত প্রদানের প্রাককালে তাঁর জন্য একমাসব্যাপী নির্জনতা অবলম্বন অপরিহার্য করে দিলেন যাতে তিনি গভীর ধ্যানের সূত্র ধরে দিব্যজ্ঞান লাভের পথে অগ্রসর হতে সক্ষম হন। নির্জন হেরা গুহার সেই ধ্যানমগ্ন অবস্থায় তিনি বিশ্বের আধ্যাত্মিক জগতে পরিভ্রমণ করতেন এবং সকল অস্তিত্বের অন্তরালে লুক্কায়িত অদৃশ্য রহস্য সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা ও গবেষণা করতেন যাতে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে নির্দেশ আসা মাত্রই তিনি বাস্তবায়নের ব্যাপারে ব্রতী হতে পারেন।[2]
ফুটনোটঃ[1] আল্লামা সুলায়মান মানসুরপুরী, রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ১ম খন্ড ৪৭ পৃষ্ঠা, ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, ২৩৫ ও ২৩৬ পৃষ্ঠা। ফী যিলালিল কুরআন: ২৯/১৬৬ পৃষ্ঠা।
[2] ফী যিলালিল কুরআন: পারা ২৯, পৃষ্ঠা ১৬৬-১৬৭।
জিবরাঈল (আঃ)-এর আগমন (جِبْرِيْلٌ يَنْزِلُ بِالْوَحْيِ):
নাবী কারীম (সাঃ)-এর বয়সের ৪০তম বছর যখন পূর্ণ হল- এটাই হচ্ছে মানুষের পূর্ণত্ব প্রাপ্তির বয়স এবং বলা হয়েছে যে, এ বয়স হচ্ছে পয়গম্বরগণের নবুয়ত প্রাপ্তির উপযুক্ত বয়স-তখন নবুওয়তের কিছু স্পষ্ট লক্ষণ প্রকাশ হতে লাগল। সে লক্ষণগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে স্বপ্নের মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছিল। তিনি যখনই কোন স্বপ্ন দেখতেন তা প্রতীয়মান হতো সুবহে সাদেকের মত। এ অবস্থার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হল ছয়টি মাস যা ছিল নবুওয়তের সময় সীমার ছয়চল্লিশতম অংশ এবং নবুওয়তের সময়সীমা ছিল তেইশ বছর। এরপর তিনি যখন হেরাগুহায় নিরবচ্ছিন্ন ধ্যানে নিমগ্ন থাকতেন এবং এভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এবং বছরের পর বছর অতিবাহিত হতে হতে তৃতীয় বর্ষ অতিবাহিত হতে থাকল তখন আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীর মানুষের উপর স্বীয় রহমত বর্ষণের ইচ্ছা করলেন। তারপর আল্লাহ রাববুল আলামীন জিবরাঈল (আঃ)-এর মাধ্যমে তাঁর কুরআনুল কারীমের কয়েকটি আয়াতে করীমা নাযিল করে মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে নবুওয়তের মহান মর্যাদা প্রদানে ভূষিত করেন।[1]
বিভিন্ন ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত প্রমাণাদি গভীরভাবে অনুধাবন করলেই জিবরাঈল (আঃ)’র আগমনের প্রকৃত দিন তারিখ ও সময় অবগত হওয়া সম্ভব হবে। আমাদের সন্ধানের ভিত্তিতে বলা যায় যে, এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল রমাযান মাসে ২১ তারিখ মঙ্গলবার দিবাগত রাত্রে। খ্রীষ্টিয় হিসাব অনুযায়ী দিনটি ছিল ৬১০ খ্রীষ্টাব্দের ১০ই আগষ্ট। চান্দ্রমাসের হিসাব অনুযায়ী নাবী কারীম (সাঃ)-এর বয়স ছিল চল্লিশ বছর ছয় মাস বার দিন এব সৌর হিসাব অনুযায়ী ছিল ৩৯ বছর ৩ মাস ২২ দিন।[2]
আসুন, এখন আমরা উম্মুল মুমিনীন আয়িশাহ (রাঃ)-এর বর্ণনা থেকে বিস্তারিত বিবরণ জেনে নেই। এটা নৈসর্গিক নূর বা আসমানী দীপ্তির মতো এমন এক আলোক রশ্নি ছিল যা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে অবিশ্বাস ও ভ্রষ্টতার অন্ধকার বিদূরিত হতে থাকে, জীবনের গতিধারা পরিবর্তিত হতে থাকে এবং ইতিহাসের পট পরিবর্তিত হয়ে নতুন নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি হতে থাকে। আয়িশাহ (রাঃ) বলেছেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট ওহী অবতীর্ণ হয়েছিল ঘুমের অবস্থায় স্বপ্নযোগে, তিনি যখন যে স্বপ্নই দেখতেন তা প্রভাত রশ্মির মতো প্রকাশিত হতো। তারপর ক্রমান্বয়ে তিনি নির্জনতা প্রিয় হতে থাকলেন। নিরবাচ্ছিন্ন নির্জনতায় ধ্যানমগ্ন থাকার সুবিধার্থে তিনি হিরা গুহায় অবস্থান করতেন। কোন কোন সময় গৃহে প্রত্যাবর্তণ না করে রাতের পর রাত তিনি এবাদত বন্দেগী এবং গভীর ধ্যানে নিমগ্ন থাকতেন। এ জন্য খাদ্য এবং পানীয় সঙ্গে নিয়ে যেতেন। সে সব ফুরিয়ে গেলে পুণরায় তিনি গৃহে প্রত্যাবর্তন করতেন।
পূর্বের মতো খাদ্য এবং পানীয় সঙ্গে নিয়ে পুনরায় তিনি হেরা গুহায় গিয়ে ধ্যান মগ্ন হতেন। ওহী নাযিলের মাধ্যমে তাঁর নিকট সত্য প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত এভাবেই তিনি হেরাগুহার নির্জনতায় অবস্থান করতে থাকেন।
এমনভাবে একদিন তিনি যখন ধ্যানমগ্ন অবস্থায় ছিলেন তখন আল্লাহর দূত জিবরাঈল (আঃ) তাঁর নিকট আগমন করে বললেন, ‘তুমি পড়’’। তিনি বললেন, ‘পড়ার অভ্যাস আমার নেই।’ তারপর তিনি তাঁকে অত্যন্ত শক্তভাবে ধরে আলিঙ্গন করলেন এবং ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘তুমি পড়’’। তিনি আবারও বললেন, ‘আমার পড়ার অভ্যাস নেই’’। তারপর তৃতীয় দফায় আমাকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করার পর ছেড়ে দিয়ে বললেন ‘পড়-
{اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ خَلَقَ الْإِنسَانَ مِنْ عَلَقٍ اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ} [العلق:1: 3])
অর্থঃ সেই প্রভুর নামে পড় যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে রক্ত পিন্ড থেকে। পড় সেই প্রভূর নামে যিনি তোমাদের জন্য অধিকতর দয়ালু।’’[3]
তারপর ওহীর আয়াতগুলো অন্তরে ধারণ করে নাবী কারীম (সাঃ) কিছুটা অস্থির ও স্পন্দিত চিত্তে খাদীজাহ বিনতে খোওয়ালেদের নিকট প্রত্যাবর্তন করলেন এবং বললেন, ‘আমাকে বস্ত্রাবৃত করো, আমাকে বস্ত্রাবৃত করো।’ খাদীজাহ (রাঃ) তাঁকে শায়িত অবস্থায় বস্ত্রাবৃত করলেন। এভাবে কিছুক্ষণ থাকার পর তাঁর অস্থিরতা ও চিত্ত স্পন্দন প্রশমিত হলে তিনি তাঁর সহধর্মিনীকে হেরা গুহার ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করলেন। তাঁর অস্থিরতা ও চিত্ত চাঞ্চল্যের ভাব লক্ষ্য করে খাদীজাহ (রাঃ) তাঁকে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘কোন ভয় করবেন না, আপনি ধৈর্য ধরুন। আল্লাহ কখনো আপনাকে অপমান করবেন না। আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে আপনি সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলেন। অভাবগ্রস্তদের অভাব মোচনের চেষ্টা করেন। অসহায়দের আশ্রয় প্রদান করেন। মেহমানদের আদর-যত্ন করেন, অতিথিদের আতিথেয়তা প্রদান করেন এবং ঋণগ্রস্তদের ঋণের দায় মোচনে সাহায্য করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ আপনাকে অপদস্থ করবেন না।’
এরপর খাদীজাহ (রাঃ) তাঁকে স্বীয় চাচাত ভাই ওয়ারাকা বিন নাওফাল বিন আসাদ বিন আব্দুল উযযার নিকট নিয়ে গেলেন। জাহেলিয়াত আমলে অরকা খ্রীষ্টান ধর্ম অবলম্বন করেছিলেন এবং ইবরাণী ভাষা পড়তে ও লিখতে শিখেছিলেন। এক সময় তিনি ইবরাণী ভাষায় কিতাব লেখতেন। কিন্তু যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে সে সময় তিনি অত্যন্ত বৃদ্ধ এবং অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। খাদীজাহ (রাঃ) তাঁকে বললেন, ‘ভাইজান, আপনি আপনার ভাতিজার কথা শুনুন। তিনি কী যেন সব কথাবার্তা বলছেন এবং অস্থির হয়ে পড়ছেন।’
অরাকা বললেন, ‘ভাতিজা, বলতো তুমি কী দেখেছ? কী হয়েছে তোমার?
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যা কিছু প্রত্যক্ষ করেছিলেন এবং হিরাগুহায় যেভাবে যা ঘটেছিল সব কিছু সবিস্তারে বর্ণনা করলেন অরাকার নিকট।
আনুপূর্বিক সব কিছু শ্রবণের পর বিস্ময়-বিহবল কণ্ঠে অরাকা বলে উঠলেন, ‘ইনিই তো সেই মানুষ যিনি মুসা (আঃ)-এর নিকটেও আগমন করেছিলেন।’[4]
তারপর বলতে থাকলেন, ‘হায়! হায়! যেদিন আপনার স্বজাতি এবং স্বগোত্রীয় লোকেরা আপনার উপর নানাভাবে জুলম অত্যাচার করবে এবং আপনাকে দেশ থেকে বহিস্কার করবে সেদিন যদি আমি শক্তিমান এবং জীবিত থাকতাম।’
অরাকার মুখ থেকে এ কথা শ্রবণের পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘একী! ওরা আমাকে দেশ থেকে বহিস্কার করবে?’
ওয়ারাকা বললেন, ‘হ্যাঁ, তারা অবশ্যই আপনাকে দেশ থেকে বহিস্কার করবে।’ তিনি আরও বললেন ‘শুধু আপনার কথাই নয়, অতীতে এ রকম বহু ঘটনা ঘটেছে। যখনই জনসমাজে সত্যের বার্তা বাহক কোন সাধক পুরুষের আবির্ভাব ঘটেছে তখনই তার স্বাগোত্রীয় লোকেরা নানাভাবে তার উপর জুলম, নির্যাতন চালিয়েছে এবং তাঁকে দেশ থেকে বহিস্কার করেছে।’ তিনি আরও বললেন, ‘মনে রাখুন আমি যদি সেই সময় পর্যন্ত জীবিত থাকি তাহলে সর্ব প্রকারে আপনাকে সাহায্য করব।’ কিন্তু এর অল্পকাল পরেই ওরাকা মৃত্যু মুখে পতিত হন। এ দিকে ওহী আসাও সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়।[5]
ফুটনোটঃ[1] হাফেয ইবনে হাজার বলেন যে, বায়হাকী এ ঘটনা উদ্ধৃত করেছেন যে, স্বপ্নের সময় ছয় মাস ছিল। অতএব স্বপ্নের মাধ্যমে নবুওয়তের শুরু চলিশ বছর পূর্ণ হবার পরে রবিউল আওয়াল মাসেই হয়েছিল। যা তাঁর জন্ম মাস ছিল। কিন্তু জাগ্রত অবস্থায় তাঁর নিকট রমাযান মাসে ওহী আসা আরম্ভ হয়েছিল। ফাতহুলবারী ১ম খন্ড ২৭ পৃষ্ঠা।
[2] ওহী নাজিল শুরুর মাস দিন এবং তারিখঃ নাবী কারীম (সাঃ)-এর ওহী প্রাপ্তি এবং নবুওয়ত লাভের মহান মর্যাদায় ভূষিত হওয়ার মাস ও দিন তারিখ সম্পর্কে ইতিহাসবিদগণের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। অধিক সংখ্যক চরিতকারগণ এ ব্যাপারে অভিন্ন মত পোষণ করে থাকেন যে মাসটি ছিল রবিউল আওয়াল। কিন্তু অন্য এক দল বলেন যে, মাসটি ছিল রমাযানুল মুবারক। কেউ কেউ আবার এ কথাও বলে থাকেন যে মাসটি ছিল রজব। (দ্রষ্টব্য- শাইখ আবদুল্লাহ রচিত মুখতাসারুস ‘সীরাহ’ পৃষ্ঠা ৭৫) দ্বিতীয় দলের মতটি অধিকতর গ্রহণযোগ্য বলে আমাদের মনে হয়, অর্থাৎ যাঁরা বলেন যে, এটা রমাযান মাসে অবতীর্ণ হয়েছিল তাঁদের মত কারণ, আল্লাহ পাক কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করেছেনঃ
{شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ} ( البقرة : ১৮৫) {إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ} (القدر : ১)
দ্বিতীয় মতটি গ্রহণযোগ্য হওয়ার আরও একটি কারণ হচ্ছে নাবী কারীম (সাঃ) রমাযান মাসেই হেরা গুহায় অবস্থান করতেন এবং এটাও জানা যায় যে, জিবরাঈল (আঃ) সেখানে আগমন করতেন, অধিকমুত যাঁরা রমাযান মাসে ওহী অবতীর্ণ হওয়ার কথা বলেছেন কোন তারীখে তা অবতীর্ণ হয়েছিল সে ব্যাপারেও বিভিন্ন মত ব্যক্ত করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন রমাযান মাসের ৭ তারীখে, কেউ বলেছেন ১৭ তারীখে, কেউ বা আবার বলেছেন ১৮ তারীখে তা অবতীর্ণ হয়েছিল (দ্রষ্টব্য- মুখতাসারুস সীরাহ ৭৫ পৃঃ, রাহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ৪৯ পৃঃ) আল্লামা খুযরী অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বলেছেন যে, তারীখটি ছিল ১৭ই রমাযান (দৃষ্টব্য- তারীখে খুযরী ১ম খন্ড ৬৯ পৃঃ এবং তারীকুত্তাশরীউল ইসলামী ৫-৭ পৃঃ)।
আমার মতে ২১শে রমাযান এ জন্য গ্রহণযোগ্য যে, যদিও এটার স্বপক্ষে কেউ নাই, তবুও অধিক সংখ্যক চরিতকার এ ব্যাপারে এক মত হয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নবুওয়ত প্রাপ্তির দিনটি ছিল সোমবার। এ সমর্থন পাওয়া যায় আবূ কাতাদাহর সেই বর্ণনা থেকে, যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট সোমবারের রোযা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হল, তিনি উত্তর দিয়েছিলেন যে, ‘এ হচ্ছে সেই দিন যেদিন আমি ভূমিষ্ট হয়েছিলাম এবং আমার নিকট ওহী নাযিল করে আমাকে নুবুওয়াত প্রদান করা হয়েছিল।’’(সহীহুল মুসলিম শরীফ ১ম খন্ড ৩৬৮ পৃঃ, মুসনদে আহমাদ ২৯৭ পৃঃ, বায়হাকী ৪র্থ খন্ড ২৮৬ ও ৩০০ পৃঃ, হাকিম ২য় খন্ড ২৬৬ পৃঃ)। সেই রমাযান মাসে সোমবার হয়েছিল ৭, ১৪, ২১ ও ২৮ তারীখগুলোতে। এ দিকে সহীহুল হাদীস সূত্রে এটা প্রমাণিত ও স্বীকৃত হয়েছে যে, পবিত্র কদর রাত্রি রমাযান মাসের শেষ দশ দিনের মধ্যে বিজোড় রাত্রিগুলোকেই ধরা হয়ে থাকে।
এখন আমরা এক দিকে কুরআন কারীম থেকে অবগত হচ্ছি যে, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, {إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ} (القدر : ১) তাছাড়া, আবূ কাতাদার বর্ণিত হাদীস সূত্রে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সোমবার দিবস নবুওয়ত প্রাপ্ত হয়েছিলেন। তৃতীয় সূত্রে পঞ্জিকার হিসেবে জানা যায়, ঐ বছর রমাযান মাসে কোন্ কোন্ তারীখ সোমবার ছিল। অতএব নির্দিষ্টভাবে জানা যায় যে, নাবী কারীম (সাঃ) নবুওয়তপ্রাপ্ত হয়েছিলেন ২১শে রমাযানের রাত্রিতে। সুতরাং এটা ছিল ওহী অবতীর্ণ হওয়ার প্রথম তারিখ।
[3] {عَلَّمَ الْإِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ} পর্যন্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়।
[4] তাবারী ২য় খন্ড ২০৭ পৃঃ। ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ২৩৭-২৩৮ পৃঃ। শেষে কিছুটা অংশ সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। এ বর্ণনার বৈধতা নিয়ে আমার মনে কিছুটা দ্বিধা আছে। সহীহুল বুখারীর বর্ণনাভঙ্গী এবং তার বিভিন্ন বর্ণনার সমন্বয় সাধনের পর আমি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মক্কাভিমুখে প্রত্যাবর্তন এবং অরাকার সাথে সাক্ষাৎ ওহী অবতীর্ণ হওয়ার পর সেদিনই ঘটে ছিল। অবশিষ্ট হেরাগুহার অবস্থান তিনি মক্কা হতে ফিরে গিয়ে পূর্ণ করেছিলেন।
[5] সহীহুল বুখারী- ওহী নাযিলের বিবরণ অধ্যায় ১ম খন্ড ২ ও ৪৩ পৃষ্ঠা। শব্দের কিছু কিছু পরিবর্তনের মাধ্যমে সহীহুল বুখারী কেতাবুত তাফসীর এবং তা‘বিরুর রুইয়া পর্বেও বর্ণিত হয়েছে।
ওহী বন্ধ (فَتْرَةُ الْوَحْىِ):
কত দিন যাবৎ ওহী বন্ধ ছিল সেই ব্যাপারে ইতিহাসবেত্তাগণ কয়েকটি মতামত পেশ করেছেন। সেগুলোর মধ্যে সঠিক কথা হলো ওহী বন্ধ ছিল মাত্র কয়েকদিন। কতদিন যাবৎ ওহী বন্ধ ছিল সে ব্যাপারে ইবনে সা‘দ ইবনে আব্বাস হতে একটি উদ্ধৃতি বর্ণনা করেছেন যা এ দাবীর পৃষ্ঠপোষকতা করে। কোন কোন সূত্রে এ কথাটি প্রচারিত হয়ে এসেছে যে, আড়াই কিংবা তিন বছর যাবৎ ওহী অবতীর্ণ বন্ধ ছিল; কিন্তু তা সঠিক নয়।
এ বিষয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা এবং এতদসম্পর্কিথ বর্ণনা ও বিজ্ঞজনের মতামতসমূহের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাতের ফলে আমার নিকট একটি কিছু অপ্রচলিত বিষয় প্রকাশিত হয়েছে এবং বিজ্ঞজনের মধ্যে এ বিষয়ে দ্বিমত প্রত্যক্ষ করা যায় না তা হলো :
নবুওয়াতের পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হেরা গুহায় কেবলমাত্র একমাস ধরে নির্জনে কাটাতেন; আর সেটি হলো প্রত্যেক বছরের রামাযান মাস। নবুওয়াতের বছর ছিল এ তিন বছরের শেষ বছর। এই রামাযানের পুরো মাস অবস্থানের শেষে আওয়াল মাসের প্রথম সকালে বিশ্বজাহানের নাবী শেষ নাবী ওহী লাভে ধন্য হয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন।
তাছাড়া বুখারী, মুসলিমের বর্ণনা হতে জানা যায় যে, ওহী বন্ধ হওয়ার পর দ্বিতীয় বার ওহী অবতীর্ণ হয় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন নির্জনে পুরো মাস অবস্থানের পর ফিরে আসছিলেন সে সময়।
আমি (সফিউর রহমান) বলছিঃ এ হাদীস সাক্ষ্য দেয় যে, ওহী বন্ধ হওয়ার পর দ্বিতীয়বার ওহী অবতীর্ণ হয় সেই দিন যেদিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যে রামাযান মাসে ওহীপ্রাপ্ত হন সেই মাসের শেষ হওয়ার পর শাওয়াল মাসের প্রথম দিন। কেননা এটাই ছিল হেরা গুহায় তার শেষ অবস্থান। আর যখন এটা প্রমাণিত হলো যে, তাঁর নিকট প্রথম ওহী অবতীর্ণ হয়েছিল ২১ রামাযানে তখন এটা নিশ্চিতরূপেই অবধারিত হয়ে গেল যে, ওহী বন্ধ থাকার সময়কাল ছিল মাত্র ১০ দিন। অতঃপর নবুওয়াতের প্রথম বছর শাওয়াল মাসের প্রথম দিবস শুক্রবার সকালে পুনরায় ওহী অবতীর্ণ হয়। হতে পারে এর রহস্য হচ্ছে রামাযানের শেস দশ দিন নির্জনে অবস্থান এবং ইতিকাফ পূর্ণকরণ এবং শাওয়ালের প্রথম দিবসকে উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য ঈদের দিন হিসেবে বিশেষত্ব দান। আল্লাহ অধীক জ্ঞাত।
ওহী বন্ধ থাকার সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অত্যন্ত চিন্তিত এবং বিচলিত বোধ করতেন। সহীহুল বুখারী শরীফের তাবীর (স্বপ্নের ব্যাখ্যা) পর্বে বর্ণিত হয়েছে যে, ওহী বন্ধ হয়ে গেলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এতই বিচলিত ও বিব্রতবোধ করতেন এবং তাঁর দুশ্চিন্তা ও অস্বস্তিবোধ এতই অধিক বৃদ্ধি পেত যে, পর্বত শিখর হতে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করার জন্য তিনি মনস্থির করে ফেলতেন। কিন্তু এ উদ্দেশ্যে যখনই তিনি পর্বত শীর্ষে আরোহণ করেছেন তখন জিবরাঈল (আঃ) তাঁর দৃষ্টিগোচর হয়েছেন। জিবরাঈল (আঃ) তাঁকে লক্ষ্য করে বলেছেন, ‘হে মুহাম্মাদ (সাঃ) আপনি আল্লাহর সত্যনাবী।’ এতদশ্রবণে তাঁর প্রাণের অস্বস্তি ভাব স্তিমিত হয়ে আসত, মনে লাভ করতেন অনাবিল শান্তি, তারপর ফিরে আসতেন গৃহে। আবারও কোন সময় কিছু বেশীদিনের জন্য ওহী বন্ধ থাকলে একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি হতো।[1]
ফুটনোটঃ[1] সহীহুল বুখারীতে তা‘বীর পর্বে প্রথম প্রথম স্বপ্নযোগে ওহী প্রকাশিত হয় অধ্যয়ে, দ্বিতীয় খন্ড ১০৩৪ পৃঃ দ্রষ্টব্য।
পুনরায় ওহীসহ জিবরাঈল (আঃ)-এর আগমন (جِبْرِيْلٌ يَنْزِلُ بِالْوَحْيِ مَرَّةً ثَانِيَةً):
হাফেয ইবনে হাজার বলেন যে, নাবী (সাঃ) -এর উপর প্রথম ওহী অবতীর্ণ হওয়ার সময় তিনি কিছুটা ভয়-ভীতির সঙ্গে বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়েন। তাঁর মানসিকতার ক্ষেত্রে কিছুটা বিহবলতার ভাবও পরিলক্ষিত হতে থাকে। এ প্রেক্ষিতেই আল্লাহ রাববুল আলামীন কিছুদিন ওহী নাযিল বন্ধ রাখেন, যাতে তিনি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ লাভ করেন।[1] ঠিক তাই হলো, নাবী কারীম (সাঃ) প্রথম ওহী নাযিলের অসুবিধা থেকে মুক্ত হয়ে যখন মন মানসিকতার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক হয়ে উঠলেন, তখন তাঁর এ ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেল যে, তিনি আল্লাহর বার্তা বাহক বা রাসূল মনোনীত হয়েছেন। এবং তাঁর নিকট যিনি ওহী নিয়ে আগমন করেছিলেন তিনি হচ্ছেন আসমানী দূত বা ওহীবাহক। এভাবে রহস্যাবৃত ব্যাপারটি যখন তাঁর নিকট পরিস্কার হয়ে গেল তখনই তিনি পরবর্তী ওহীর জন্য উন্মুখ হয়ে উঠলেন। ওহী গ্রহণের জন্য মানসিকভাবে যখন প্রস্তুত হয়ে গেলেন, তখন জিবরাঈল (আঃ) পুনরায় ওহী নিয়ে আগমন করলেন। সহীহুল বুখারীর মধ্যে জাবির বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট থেকে ওহী নিয়ে আগমন বন্ধের ঘটনা শ্রবণ করেন। ঘটনার বর্ণনা প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,
(جَاوَرْتُ بِحِرَاءٍ شَهْرًا فَلَمَّا قَضَيْتُ جَوَارِىْ هَبَطْتُّ [فَلَمَّا اِسْتَبْطَنْتُ الْوَادِيَ] فَنُوْدِيْتُ، فَنَظَرْتُ عَنْ يَّمِيْنِيْ فَلَمْ أَرَ شَيْئًا، وَنَظَرْتُ عَنْ شِمَالِيْ فَلَمْ أَرَ شَيْئًا، وَنَظَرْتُ أَمَامِيْ فَلَمْ أَرَ شَيْئًا، وَنَظَرْتُخَلْفِيْ فَلَمْ أَرَ شَيْئًا، فَرَفَعْتُ رَأْسِىْ فَرَأَيْتُ شَيْئًا، [فَإِذَا الْمَلَكُ الَّذِيْ جَاءَنِيْ بِحِرَاءٍ جَالِسٌ عَلٰى كُرْسِيٍّ بَيْنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ، فَجُئِثْتُ مِنْهُ رُعْبًا حَتّٰى هَوِيْتُ إِلَى الْأَرْضِ] فَأَتَيْتُ خَدِيْجَةَ فَقُلْتُ:[زَمِّلُوْنِيْ، زَمِّلُوْنِيْ]، دَثِّرُوْنِىْ، وَصُبُّوْا عَلَىَّ مَاءً بَارِدًا)، قَالَ : (فَدَثَّرُوْنِىْ وَصَبُّوْا عَلَىَّ مَاءً بَارِدًا، فَنَزَلَتْ : {يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ قُمْ فَأَنذِرْ وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ} [المدثر: 1: 5])
‘‘আমি পথ ধরে চলছিলাম এমন সময় হঠাৎ আকাশ থেকে একটি আওয়াজ আমার শ্রুতিগোচর হল। আকাশের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই আমি সেই ফিরিশতাকে দেখতে পেলাম যিনি আমার নিকট হেরা গুহায় আগমন করেছিলেন। তিনি আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যস্থানে কুরশীতে উপবিষ্ট ছিলেন। ভয়ে বিস্ময়ে আমার দৃষ্টি অবনত হয়ে এল। তারপর আমার সহধর্মিণীর নিকট এসে বললাম, ‘আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দাও।’ তিনি আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দিলেন। তারপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘ওহে বস্ত্র আবৃত (ব্যক্তি)! ২. ওঠ, সতর্ক কর। ৩. আর তোমার প্রতিপালকের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর। ৪. তোমার পোশাক পরিচ্ছদ পবিত্র রাখ। ৫. (যাবতীয়) অপবিত্রতা থেকে দূরে থাক। [মুদ্দাসসির (৭৪) : ১-৫] পর্যন্ত ওহী অবতীর্ণ করেন এরপর থেকে অবিরামভাবে ওহী অবতীর্ণ হতে থাকে।[2]
এ ক’টি আয়াত নবুওয়াতের প্রাথমিক অবস্থায় ওহী বন্ধ হওয়ার কয়েকদিন পর অবতীর্ণ হয়। তার উপর দায়িত্ব অর্পনের দুটি স্তর রয়েছে যা ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করা হলো-
প্রথমত : রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপর নবুওয়াতের প্রচার ও ভীতি প্রদর্শনের দায়িত্ব অর্পন।
এ মর্মে আল্লাহর বাণী : (قُمْ فَأَنذِرْ) অর্থাৎ মানবমণ্ডলী অজ্ঞতা, পাপাচার, পথভ্রষ্টতা, মহান আল্লাহর ব্যতীত বাতিল উপাস্যের ইবাদত করা, তাঁর সত্ত্বা, গুণাবলী, তাঁর হক ও কর্মসমূহের সাথে শিরক বা অংশীস্থাপন করা থেকে যদি বিরত না হয় তবে তাদেরকে আল্লাহর কঠিন আযাব সম্পর্কে ভীতি প্রদর্শন করো।
দ্বিতীয়ত ; রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপর আল্লাহর নির্দেশিত বিষয়সমূহের সাথে তার সত্ত্বার সমন্বয় সাধন করা এবং তার উপর স্বয়ং অটল থাকা। ঐসব বিষয়কে কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই সযত্নে সংরক্ষণ করা। আর যারা আল্লাহ তা’আলার উপর বিশ্বাস স্থাপর করবে তাদের জন্য একটি উত্তম আদর্শ বনে যাওয়া। যথা পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করছেন, (وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ) অর্থাৎ একনিষ্ঠভাবে তার বড়ত্ব ঘোষণা করে এবং তার সাথে আর কাউকে শরীক করো না। এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেন, (وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ) এর বাহ্যিক অর্থ : শরীর ও কাপড়-চোপড়ের পবিত্রতা অর্জন। কেননা যে ব্যক্তি আল্লাহর সামনে দণ্ডায়মান হবে তার জন্য এটা শোভনীয় নয় যে, সে অপবিত্র ও নোংরা অবস্থায় দণ্ডায়মান হবে। আর এখানে প্রকৃতপক্ষে যে পবিত্রতা উদ্দেশ্য তা হচ্ছে, যাবতীয় শিরক ও পাপকৰ্ম থেকে বিরত থাকা এবং উত্তম চরিত্রে ভূষিত হওয়া। (وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ) অর্থাৎ আল্লাহর অসন্তোষ ও শাস্তি অবধারিত হওয়ার কারণসমূহ থেকে নিজেকে বিরত রাখো। অধিকন্তু তার আনুগত্যকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে এবং পাপকৰ্ম পরিহার করো। আল্লাহ বলেন, (وَلَا تَمْنُنْ تَسْتَكْثِرُ) অর্থাৎ তুমি যেসব উত্তম আমল কর না কেন মানুষের নিকট তার প্রতিদান কামনা করো না অথবা এর বিনিময়ে দুনিয়াতে আল্লাহর কাছে এর চেয়ে কোন ভাল ফলাফল আশা করো না।
পরবর্তী আয়াতসমূহে মানুষদেরকে এক আল্লাহর দিকে আহ্বান করা, তাদেরকে তার শাস্তি ও পাকড়াও থেকে ভীতি প্রদর্শন এবং দীনের কারণে মানুষের পক্ষ থেকে যে বিরোধিতার সম্মুখীন হবেন, তাদের দ্বারা অত্যাচারিত-নির্যাতিত হবেন ঐ সব বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, (وَلِرَبِّكَ فَاصْبِرْ) অর্থাৎ আপনি আপনার পরওয়ার দিগরের সন্তষ্টি অর্জনার্থে ধৈর্য্যধারণ করুন।
উল্লেখিত আয়াতসমূহের প্রারম্ভিক সুরে মহান আল্লাহ তা’আলার এক উদাত্ত আহবান সুস্পষ্ট, যে আহবানে নাবী কারীম (সাঃ)-কে নবুওয়াতের মহা মর্যাদাপূর্ণ কাজের জন্য ঘুম থেকে জাগ্রত হতে এবং ঘুমের আচ্ছাদন ও বিছানার উষ্ণতা পরিত্যাগ করে আল্লাহর একত্ববাদের বাণী প্রচারে লিপ্ত হওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে :
يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ قُمْ فَأَنْذِرْ
ওহে বস্ত্র আবৃত (ব্যক্তি)। ২. ওঠ, সতর্ক কর। (আল-মুদাসসির ৭৪ – ১-২)
বলা হয়ে থাকে যে, যে নিজের জন্যই বাঁচতে চায় সে আরাম আয়েশে গা ভাসিয়ে চলতে পারে। কিন্তু আপনাকে এক বিরাট ও মহান দায়িত্বে আত্মনিয়োগ করতে হচ্ছে তখন ঘুমের সঙ্গে আপনার কী সম্পর্ক? আরাম আয়েশের সঙ্গে আপনার কি সম্পর্ক? আপনার গরম বিছানার কী প্রয়োজন? কী প্রয়োজন আপনার সুখময় জীবন যাপনের? আপনি উঠে পড়ুন এবং ঐ মহানকাজে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। আপনার ঘুম এবং আরাম আয়েশের সময় এখন অতিক্রান্ত। এখন আপনাকে অবিরাম পরিশ্রম করে যেতে হবে এবং দীর্ঘ ও কষ্টদায়ক সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করতে হবে।
আল্লাহর পথে আহবান এবং কালেমার দাওয়াত ও তাবলীগী নেসাবের কাজ হচ্ছে অতীব উঁচু দরের কাজ। কিন্তু এ পথে চলার ব্যাপারটি হচ্ছে অত্যন্ত ভয়ভীতিজনক এবং বিপদ-সংকুল। এ কাজ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে শান্তির নীড় ঘর-বাড়ি, সুখময় পারিবারিক পরিবেশ, আরাম-আয়েশ স্নিগ্ধ শয্যা থেকে টেনে বের করে এনে দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা এবং দুঃখ কষ্টের অথৈ সাগরে নিক্ষেপ করে দিল। এনে দাঁড় করিয়ে দিল মানুষের বাহ্যিক পোষাকী আচরণ এবং শঠতাপূর্ণ আভ্যন্তরীণ প্রকৃতিগত দ্বিধা-দ্বন্দ্বের দারুণ টানা-পোড়েনের মাধ্যমে।
তারপর, নাবী কারীম (সাঃ) তার অবস্থা এবং দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ হয়ে গেলেন এবং বিশ বছরেরও অধিককাল যাবৎ সেই জাগ্রত অবস্থার মধ্য দিয়েই অতিবাহিত করলেন। এ দীর্ঘ কাল যাবৎ সুখ-শান্তি, আরাম-আয়েশ বলতে তার আর কিছুই রইল না। সব কিছুকেই তিনি করলেন বিসর্জন। তার জীবন নিজের কিংবা পরিবার পরিজনদের জন্য আর রইল না। তার জীবন রইল আল্লাহর কাজের জন্য দায়বদ্ধ। তার কাজ ছিল আল্লহির প্রতি বিশ্ববাসীকে আহ্বান জানানো। বিশ্বের বুক থেকে সর্বপ্রকার অসত্য, অন্যায় ও মিথ্যার মূলোৎপাটন এবং ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষকে পথ-পদর্শন।
‘আল্লাহর পথে আহ্বান’, ‘সত্যের প্রতিষ্ঠা’ ইত্যাদি কথাগুলো আপাতঃ দৃষ্টিতে ততটা কঠিন কিংবা দুঃসাধ্য মনে নাও হতে পারে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর চেয়ে কঠিন এবং কষ্টসাধ্য কাজ পৃথিবীতে আর কিছুই হতে পারে না। রেসালাতের আমানত হচ্ছে বিশ্বের বুকে সব চেয়ে দায়িত্বপূর্ণ এবং দুর্বহ আমানত। এ আমানত হচ্ছে এক পক্ষে বিশ্বময় মানবের চরম উৎকর্ষ ও বিকাশের আমানত এবং অন্য পক্ষে যাবতীয় বাতিল এবং গায়রুল্লাহর প্রভাব প্রতিহত করে তাকে ধ্বংস করার আমানত। কাজেই তার কাধে যে বোঝা চাপান হয়েছিল তা ছিল সমগ্র মানবতার বোঝা । সমস্ত মতবাদের বোঝা এবং ময়দানে ময়দানে জেহাদ ও তা প্রতিহত করার বোঝা। বিশ বছরেরও অধিক কাল যাবৎ অবিরামভাবে তিনি ব্যাপক ও বহুমুখী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করেন। সেই দীর্ঘ কাল যাবৎ, অর্থাৎ যখন তিনি আসমানী আহবান শ্রবণের মাধ্যমে অত্যন্ত কঠিন ও কন্টকময় দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেন, তখন থেকেই তাকে কোন এক অবস্থা অন্য কোন অবস্থা সম্পর্কে বিন্দুমাত্রও গাফেল কিংবা উদাসীন রাখতে পারে নি। আল্লাহ তা’আলা তাকে আমাদের এবং সমগ্র মানবতার পক্ষ হতে উত্তম বিনিময় প্রদান করুন।[3]
ফুটনোটঃ[1] ফাতহুলবারী ১ম খন্ড ২৭ পৃঃ।
[2] সহীহুল বুখারী- ‘কেতাবূত তাফসীর, বাবু অর রুজযা ফাহজুর’’ (অশালীন কাজ পরিহার করন) অধ্যায় ২য় খন্ড ৭৩৩ পৃঃ। এ প্রসঙ্গে অন্যান্য কিছু অধিক বর্ণিত হয়েছে। নাবী (সাঃ) বলেন, ‘আমি হেরায় এতেক্বাফ করি। যখন আমার এতেক্বাফ সম্পূর্ণ হয় তখন আমি নীচে অবতরণ করি। সে সময় আমি বাতনে ওয়াদী অতিক্রম করি তখন আমাকে ডাক দেয়া হয়। আমি তাকাই ডানে, বামে, সামনে, পিছনে কিন্তু কিছুই দেখতে পাই না। এর পর যখন উপরে দৃষ্টিপাত করি তখন এ ফিরিশতাকে দেখতে পাই।’’
যেবছর রামাযান মাসে গারে হেরায় এতেক্বাফ করেছিলেন এবং যে রমাযান মাসে তাঁর উপর ওহী অবতীর্ণ হয় তা ছিল ৩য় রমাযান, অর্থাৎ শেষ রমাযান। তাঁর নিয়ম ছিল যখন তাঁর রমাযানের এতেক্বাফ পূর্ণ হত তখন তিনি প্রথম শাওয়ালে প্রত্যুষেই মক্কা প্রত্যাবর্তন করতেন। উপরি উল্লেখিত বর্ণনার সঙ্গে এ কথাটি জুড়ে দিলে এটা দাঁড়ায় যে, ইয়া আইউহাল মোদ্দাস্সির (হে বস্ত্রাবৃত ব্যক্তি) ওহীটি প্রথম ওহীর দশ দিন পরে প্রথম শাওয়ালে অবতীর্ণ হয়েছিল। অর্থাৎ ওহী বন্ধের পূর্ণ সময়কাল কাল ছিল ১০ দিন।
[3] ফী- যিলালিল কুরআন (সূরাহ মুযযাম্মিল ও মুদ্দাসসির, পারা ২৯, পৃষ্ঠা নং ১৬৮-১৭১।
ওহীর প্রকারভেদ (أَقْسَامُ الْوَحْىِ):
এখানে আমরা আলোচনার মূল বিষয়াদি থেকে একটু সরে গিয়ে, অর্থাৎ রিসালাত ও নবুওয়াতের বরকতময় বিষয়াদির বিস্তৃত বিবরণ লিপিবদ্ধ করার পূর্বে ওহীর প্রকৃতি ও প্রকারভেদ সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা করার প্রয়োজন বোধ করছি। কারণ, এটাই হচ্ছে রেসালাতের উৎস এবং প্রচারের উপায়। ওহীর প্রকৃতি এবং প্রকারভেদ সম্পর্কে আল্লামা ইবনে কাইয়্যেম যে আলোচনা করেছেন তা নিম্নে লিপিবদ্ধ করা হলঃ
১. সত্য স্বপ্নঃ স্বপ্নের মাধ্যমে নাবী কারীম (সাঃ)-এর উপর ওহী অবতীর্ণ হয়।
২. ফিরিশতা দেখা না দিয়ে অর্থাৎ অদৃশ্য অবস্থান থেকেই রাসূল (সাঃ)-এর অন্তরে ওহী প্রবেশ করিয়ে দেন। এ প্রসঙ্গে নাবী কারীম (সাঃ) যেমনটি ইরশাদ করেছেনঃ
(إن روح القدس نفث في روعى أنه لن تموت نفس حتى تستكمل رزقها، فاتقوا الله وأجملوا في الطلب، ولا يحملنكم استبطاء الرزق على أن تطلبوه بمعصية الله ، فإن ما عند الله لا ينال إلابطاعته)
অর্থঃ ‘জিবরাঈল (আঃ) ফিরিশতা আমার অন্তরে এ কথা নিক্ষেপ করলেন যে, কোন আত্মা সে পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করবে না যে পর্যন্ত তার ভাগ্যে যতটুকু খাদ্যের বরাদ্দ রয়েছে পুরোপুরিভাবে তা পেয়ে না যাবে। অতএব, তোমরা আল্লাহকে সমীহ কর এবং রুজি অন্বেষণের জন্য ভাল পথ অবলম্বন কর। রুজি প্রাপ্তিতে বিলম্ব হওয়ায় তোমরা আল্লাহর অসন্তোষের পথ অন্বেষণে যেন উদ্বুদ্ধ না হও। কারণ, আল্লাহর নিকট যা কিছু রয়েছে তা তাঁর আনুগত্য ছাড়া পাওয়া দুস্কর।
৩. ফেরেশতা মানুষের আকৃতি ধারণপূর্বক নাবী কারীম (সাঃ)-কে সম্বোধন করতেন। তারপর তিনি যা কিছু বলতেন নাবী কারীম (সাঃ) তা মুখস্থ করে নিতেন। এ অবস্থায় সাহাবীগণ (রাঃ)ও ফেরেশতাকে দেখতে পেতেন।
৪. ওহী অবতীর্ণ হওয়ার সময় নাবী কারীম (সাঃ)-এর নিকট ঘন্টার টুন টুন ধ্বনির মতো ধ্বনি শোনা যেত। ওহী নাযিলের এটাই ছিল সব চাইতে কঠিন অবস্থা। টুন টুন ধ্বনির সংকেত প্রকাশ করতে করতে ফিরিশতা ওহী নিয়ে আগমন করতেন এবং নাবী (সাঃ)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। ওহী নাযিলের সময় কঠিন শীতের দিনেও রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কপাল থেকে ঘাম ঝরতে থাকত। তিনি উষ্ট্রের উপর আরোহণরত অবস্থায় থাকলে উট বসে পড়ত। এক দফা এইভাবে ওহী নাযিল হওয়ার সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উরু যায়দ বিন সাবেত (সাঃ)-এর উরুর উপর ছিল। তখন তাঁর উরুতে এতই ভারবোধ হয়েছিল যে মনে হয়েছিল যেন উরু চূর্ণ হয়ে যাবে।
৫. নাবী কারীম (সাঃ) ফিরিশতাকে কোন কোন সময় নিজস্ব জন্মগত আকৃতিতে প্রত্যক্ষ করতেন এবং আল্লাহর ইচ্ছায় সেই অবস্থাতেই তিনি তাঁর নিকট ওহী নিয়ে আগমন করতেন। নাবী কারীম (সাঃ)-এর এ রকম অবস্থা দু’বার সংঘটিত হয়েছিল যা আল্লাহ তা‘আলা সূরাহ ‘নাজমে’ উল্লেখ করেছেন।
৬. পবিত্র মি’রাজ রজনীতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন আকাশের উপর অবস্থান করছিলেন সেই সময় আল্লাহ তা‘আলা নামায এবং অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে সরাসরি হুকুমের মাধ্যমে ওহীর ব্যবস্থা করেছিলেন।
৭. আল্লাহ তা‘আলার সঙ্গে নাবী কারীম (সাঃ)-এর সরাসরি কথোপকথন যেমনটি হয়েছিল, তেমনি মূসা (আঃ)-এর সঙ্গে হয়েছিল। মূসা (আঃ)-এর সঙ্গে যে আল্লাহ তা‘আলার কথোপকথন হয়েছিল কুরআন কারীমে তা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলার সঙ্গে নাবী কারীম (সাঃ)-এর কথোপকথনের ব্যাপারটি হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে (কুরআন দ্বারা নয়)।
কোন কোন লোক পর্দা বা আবরণ ব্যতিরেকে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সাঃ)-এর সামনা-সামনি কথোপকথনের মাধ্যমে ওহী নাযিলের অষ্টম রীতির কথা বলেছেন। কিন্তু ইসলামের পূর্বসূরীদের হতে শুরু করে পরবর্তীদের সময়কাল পর্যন্ত এ পদ্ধতিতে ওহী নাযিলের ব্যাপারে মতভেদ চলে আসছে।[1]
ফুটনোটঃ[1] যাদুল মা’আদ ১ম খন্ড ১৮ পৃঃ। প্রথম এবং অষ্টম রীতির বর্ণনাতে আসল ইবারতের মধ্যে কিছুটা সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে।
গোপনে ইসলাম প্রচার
তিন বছর গোপনে প্রচার (ثَلَاثُ سَنَوَاتٍ مِنْ الدَّعْوَةِ السِّرِّيَّةِ):
সূরাহ মুদ্দাসসিরের প্রথম আয়াত প্রথম থেকে ষষ্ঠ আয়াত পর্যন্ত
يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ (1) قُمْ فَأَنذِرْ (2) وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ (3) وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ (4) وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ (5) وَلَا تَمْنُن تَسْتَكْثِرُ (6) وَلِرَبِّكَ فَاصْبِرْ (7)
‘১. ওহে বস্ত্র আবৃত (ব্যক্তি)। ২. ওঠ, সতর্ক কর। ৩. আর তোমার প্রতিপালকের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর। ৪, তোমার পোশাক পরিচ্ছদ পবিত্র রাখ। ৫. (যাবতীয়) অপবিত্রতা থেকে দূরে থাক। ৬. (কারো প্রতি) অনুগ্রহ করো না অধিক পাওয়ার উদ্দেশে। ৭. তোমার প্রতিপালকের (সস্তুষ্টির) জন্য ধৈর্য ধর। (আল-মুদ্দাসসির ৭৪ : ১-৭)
সূরাহ মুদ্দাসসিরের উপযুক্ত আয়াতসমূহ নাযিল হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পথহারা মানুষদেরকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দেয়ার কাজ শুরু করলেন এমন অবস্থায় যে, তাঁর জাতি কুরাইশদের মূর্তি ও প্রতিমার পূজা-অৰ্চনা ব্যতীত কোন দীন ছিল না। তাদের সঠিক কোন হজ্জ ছিল না, তবে তারা হজ্জ করতো যেভাবে তাদের পিতৃপুরুষদেরকে দেখেছে। তাদের আত্মমর্যাদা ও বংশগৌরব ব্যতীত কোন সৎচরিত্র ছিল না। তাদের কোন সমস্যা তলোয়ার ব্যতীত সমাধান হতো না। তা সত্ত্বেও মক্কা ছিল আরববাসীগণের ধর্মীয় চেতনার কেন্দ্রস্থল। এ মক্কাবাসীই ছিলেন কা’বাহর তত্ত্বাবধায়ক ও খাদেমগণ। এ জন্যই দূরবর্তী স্থানের তুলনায় মক্কায় সংস্কারমুখী কর্মসূচী বাস্তবায়নের ব্যাপারটি ছিল অনেক বেশী কঠিন ও কষ্টকর। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেও প্রাথমিক পর্যায়ে মক্কায় প্রচার ও তাবলীগের কাজকর্ম সন্তর্পণে ও সঙ্গোপনে করার প্রয়োজন ছিল যাতে মক্কাবাসীগণের সামনে আকস্মিকভাবে বৈপ্লবিক কিংবা উত্তেজনামূলক কোন অবস্থার সৃষ্টি হয়ে না যায়।
ফুটনোটঃ
ইসলাম কবুলকারী প্রথম দল (الرَّعِيْلُ الْأَوَّلُ):
এটা খুবই স্বাভাবিক এবং সঙ্গত কথা যে যাঁরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সবচাইতে কাছের, সব চাইতে ঘনিষ্ঠ এবং সব চাইতে নির্ভরযোগ্য ছিলেন সর্ব প্রথম তিনি তাঁদেরই নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করেছিলেন। এ দলের মধ্যে ছিলেন পরিবারের লোকজন, ঘনিষ্ঠ আত্মীয় এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধব। অধিকন্তু, প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি ঐ সকল লোককে সত্যের প্রতি আহবান জানিয়েছিলেন যাঁদের মুখমন্ডলে কল্যাণ এবং সত্য-প্রীতির আভাষ ছিল সুস্পষ্ট। তাছাড়া যাঁরা নাবী (সাঃ)-এর সততা, সত্যবাদিতা এবং পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে সুবিদিত ছিলেন এবং এ কারণে তাঁর প্রতি এত বেশী অনুরক্ত এবং শ্রদ্ধাশীল ছিলেন যে, প্রথম আহবানেই সাড়া দিয়ে তাঁরা ইসলাম কবুল করেন এবং প্রথম মুসলিম হওয়ার এক দুর্লভ গৌরব অর্জন করেন। এদের তালিকার শীর্ষে ছিলেন উম্মুল মু’মিনীন নাবী- পত্নী খাদীজাহতুল কোবরা (রাঃ) বিনতে খুওয়াইলিদ, তাঁর স্বাধীনতা প্রাপ্ত ক্রীতদাস যায়দ বিন হারিসাহ বিন শোরাহবীল কালবী,[1] তাঁর চাচাত ভাই আলী বিন আবূ ত্বালিব যিনি তখনো তাঁর লালন-পালনাধীন শিশু ছিলেন এবং তাঁর সওর গুহার সঙ্গী আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ)। এরা সকলে প্রথম দিনেই মুসলিম হয়েছিলেন।[2]
তারপর আবূ বাকর (রাঃ) ইসলামের প্রচার কাজে বেশ তৎপর হয়ে ওঠেন। তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয়, কোমল-স্বভাব, পছন্দনীয় অভ্যাসের অধিকারী, সচ্চরিত্র এবং দরাজ দিল ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর দানশীলতা, দূরদর্শিতা, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সৎ সাহচর্যের কারণে তাঁর নিকট লোকজনের গমনাগমন প্রায় সব সময় লেগেই থাকত। পক্ষান্তরে তিনি তাঁর নিকট আগমন ও প্রত্যাগমনকারী এবং আশপাশে বসবাসকারীগণের মধ্যে যাঁকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করতেন তাঁর সামনেই ইসলামের দাওয়াত পেশ করতেন। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় উসমান (রাঃ), জোবায়ের (রাঃ), আব্দুর রহমান (রাঃ) বিন আওফ, সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) এবং ত্বালহাহ বিন ওবায়দুল্লাহ (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করেন। এ মহা সম্মানিত ব্যক্তিবর্গই হচ্ছেন প্রথম মুসলিম জনগোষ্ঠি।
প্রাথমিক অবস্থায় যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেন বিলাল হাবশী (রাঃ)-ও ছিলেন সেই দলের অন্তর্ভুক্ত। এর পর ইসলাম কবূল করেন বনু হারিস বিন ফিহর গোত্রের আবূ ‘উবায়দাহ ‘আমির বিন জাররাহ (রাঃ), আবু সালামাহ বিন আব্দুল আসাদ মাখযূমী (রাঃ), আরক্বাম বিন আবিল আরক্বাম (রাঃ), উসমান বিন মাযউন যুমাহী (রাঃ), এবং তাঁর দু’ভাই যথাক্রমেঃ কুদামা এবং আব্দুল্লাহ, উবায়দাহ বিন হারিস বিন মুত্তালিব বিন আবদে মানাফ, সাঈদ বিন যায়দ এবং তাঁর স্ত্রী, অর্থাৎ উমারের বোন ফাত্বিমাহ বিনতে খাত্তাব, খাব্বাব বিন আরাত তামীমী (রাঃ), জা’ফার বিন আবূ ত্বালিব ও তার স্ত্রী আসমা বিনতে ‘উমায়স, খালিদ বিন সাঈদ বিন ‘আস আল উমাবী ও তার স্ত্রী আমীনাহ বিনতে খালাফ, অতঃপর তার ভাই ‘আমর বিন সাঈদ বিন আস, হাতিব বিন হারিস জুমাহী ও তার স্ত্রী ফাতিমাহহ বিনতে মুখাল্লিল ও তার ভাই খাত্তাব বিন হারিস এবং তার স্ত্রী ফুকাইহাহ বিনতে ইয়াসার ও তার ভাই মা’মার বিন হারিস, মুত্তালিব বিন আযহার যুহরী ও তার স্ত্রী রামলাহ বিনতে আবূ ‘আওফ, নাঈম বিন আবদুল্লাহ বিন নুহাম আদবী (রাঃ), এদরে সকলেই কুরাইশ ও কুরাইশের বিভিন্ন শাখা গোত্রের।
কুরাইশ ব্যতীত অন্য গোত্র থেকে প্রাথমিক অবস্থায় ইসলাম গ্রহণকারীরা হলেন, আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ, মাসউদ বিন রাবী’আহ, আব্দুল্লাহ বিন জাহশ আসাদী ও তার ভাই আহমাদ বিন জাহশ, বিলাল বিন রিবাহ হাবশী, সুহাইব বিন সিনান রূমী, ‘আম্মার বিন ইয়াসার আনসী, তার পিতা ইয়াসার ও তার মাতা সুমাইয়া এবং আমির বিন ফুহাইরাহ।
উপরে উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও প্রাথমিক পর্যায়ের মুসলমান মহিলাদের মধ্যে রয়েছেন, উম্মু আইমান বারাকাত হাবশী, উম্মুল ফযল লুবাবাতুল কুবরা বিনতে হারিস হিলালিয়াহ (আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিবের স্ত্রী), আসমা বিনতে আবূ বকর সিদ্দীক (রা.)।
উপরে উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গ প্রথম পর্যায়ের ইসলাম গ্রহণকারী হিসেবে প্রসিদ্ধ। বিভিন্নভাবে অনুসন্ধান ও গবেষণার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে যে, প্রথম পর্যায়ের ইসলাম গ্রহণকারীর গুণে গুণম্বিতদের সংখ্যা পুরুষ-মহিলা মিলে ৩৩০ জন। তবে এটা অকাট্যভাবে জানা যায় নি যে, তারা সকলেই প্রকাশ্যে দাওয়াত চালু হওয়ার পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন নাকি ইসলামের দাওয়াত প্রকাশ্যভাবে চালু হওয়া পর্যন্ত তাদের কেই কেউ ইসলাম গ্রহণে বিলম্ব করেছিলেন।
ফুটনোটঃ[1] ইনি যুদ্ধে বন্দী হয়ে দাসে পরিণত হন। পরে খাদীজা (রাঃ) তাঁর মালিক হন তাঁকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট দেন। এর পর তাঁর পিতা এবং চাচা তাঁকে নিজ বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য আগমন করেন। কিন্তু তিনি বাড়ি না গিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সঙ্গে থাকাকেই বেশী পছন্দ করেন। প্রচলিত প্রথানুযায়ী তারপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে পোষ্য পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। এজন্য তাঁকে যায়েদ বিন মুহাম্মাদ (সাঃ) বলে ডাকা হত। পরে সে প্রথার ইসলাম সমাপ্তি ঘোষণা করে।
[2] রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ৫০ পৃষ্ঠা।
সালাত বা প্রার্থনা (الصَّلَاةُ):
প্রাথমিক পর্যায়ে যে সকল আয়াত অবতীর্ণ হয় তাতে নামাজের নির্দেশেনা বিদ্যমান ছিল । ইবনে হাজার বলেন যে, নাবী কারীম (সাঃ) এবং তাঁর সাহাবাগণ (রা.) মি’রাজের ঘটনার পূর্বে অবশ্যই সালাত পড়তেন। তবে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয হওয়ার পূর্বে সালাত ফরজ ছিল কি ছিল না সে ব্যাপারে মতবিরোধ রয়েছে। কেউ কেউ বলে থাকেন যে, সূর্যের উদয় এবং অস্ত যাওয়ার পূর্বে একটি করে সালাত ফরজ ছিল।
হারিস বিন উসামাহ ইবনে লাহী’আর মাধ্যমে বর্ণনাকারীদের মিলিত পরম্পরা সূত্রের বরাতে যায়দ বিন হারিসাহ বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট যখন প্রথম ওহী অবতীর্ণ হল তখন জিবরাঈল (আঃ) আগমন করলেন এবং তাকে অযুর পদ্ধতি শিক্ষা দিলেন। যখন অযু শেখা সমাপ্ত হল তখন এক চুল্লি পানি লজ্জা স্থানে ছিটিয়ে দিলেন। ইবনে মাজাহও এ মর্মে হাদীস বর্ণনা করেছেন। বারা বিন আযিব এবং ইবনে আব্বাস হতেও ঐ ধরণের হাদীস বর্ণিত হয়েছে। ইবনে আব্বাস হতে বর্ণিত হাদীসে এ কথারও উল্লেখ রয়েছে যে, সালাত প্রাথমিক ফরজকৃত কর্তব্যসমূহের অন্তর্ভুক্ত ছিল।[1]
ইবনে হিশামের বর্ণনায় এ কথা রয়েছে যে, নাবী কারীম (সাঃ) এবং সাহাবীগণ (রা.) সালাতের সময় ঘাঁটিতে চলে যেতেন এবং গোত্রীয় লোকজনদের দৃষ্টির আড়ালে গোপনে সালাত আদায় করতেন। আবূ ত্বালিব এক দফা নাবী কারীম (সাঃ) এবং আলীকে সালাত আদায় করতে দেখেন এবং জিজ্ঞাসা করে প্রকৃত বিষয়টি অবগত হলে এর উপর দৃঢ় থাকার পরামর্শ প্রদান করেন।[2]
প্রথম পর্যায়ের মুসলমানগণ এসব ইবাদত করতেন। সালাত সংশ্লিষ্ট ইবাদত ব্যতীত অন্য কোন ইবাদত বা আদেশ নিষেধের কথা জানা যায় না। সে সময়কার ওহীতে মূলত সে সব বিষয় বর্ণিত হয় যা বিভিন্নভাবে তাওহীদের বর্ণনা, তাদেরকে আত্মশুদ্ধির প্রতি উৎসাহিতকরণ, উন্নত চরিত্র গঠনে উদ্বুদ্ধকরণ, জান্নাত-জাহান্নামের বর্ণনা যেন তা চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে, অন্তরাত্মা পরিশুদ্ধকরণে প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ যা অন্তরের খোরাক হয়, ঈমানদারদের তৎকালীন মানব-সমাজ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক এবং ভিন্নতর এক পরিবেশে পরিভ্রমণ করাতে থাকে।
এভাবে তিন বছর অতিক্রান্ত হয় কিন্তু ইসলামের দাওয়াত গুটিকয়েক ব্যক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। রাসূল (সাঃ)-ও তা লোকসমাজে প্রকাশ করতেন না। তবে কুরাইশরা ইসলামের খবর জানতো ও মক্কাতে ইসলামের কথা ছড়িয়ে পড়ে এবং লোকসমাজে এর মৃদু গুঞ্জন চলতে থাকে। আবার কেউ একে ঘৃণাও করতো এবং মুমিনদের সাথে শত্রুতা ভাব দেখাতো। তবে সামনা সামনি কিছু বলতো না যতক্ষণ পর্যন্ত না রাসূলুল্লাহ তাদের দীন-ধর্মে হস্তক্ষেপ করতেন এবং তাদের ভিত্তিহীন ও মনগড়া ইলাহ মূর্তিসমূহের সমালোচনা না করতেন।
ফুটনোটঃ[1] শাইখ আব্দুল্লাহ মোখতাসার মীরাহ পৃঃ ৮৮৷
[2] ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ২৪৭ পৃঃ।
প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার
প্রকাশ্য দাওয়াতের প্রথম আদেশ (أَوَّلُ أَمْـرٍ بِإِظْهَارِ الدَّعْـوَةِ):
ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ ও পরস্পর সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমে মুমিনদের যখন একটি দল সৃষ্টি হলো এবং রিসালাতের বোঝা বহনের মতো যোগ্যতা অর্জিত হলো ও ইসলাম তার নিজ অবস্থানকে কিছুটা শক্তিশালী করতে সক্ষম হলো তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রকাশ্যভাবে ইসলামের দাওয়াত দেয়া ও বাতিল দীন, উপাস্যদেরকে উত্তম পন্থায় প্রতিহত করতে আদিষ্ট হলেন।
এ বিষয়ে সর্ব প্রথম আল্লাহ তা‘আলার এ বাণী অবতীর্ণ হয়:
{وَأَنذِرْ عَشِيْرَتَكَ الْأَقْرَبِيْنَ} [الشعراء:214]،
‘‘আর তুমি সতর্ক কর তোমার নিকটাত্মীয় স্বজনদের।’ (আশ-শু‘আরা ২৬ : ২১৪)
এটি হচ্ছে সূরাহ শু‘আরার আয়াত এবং এ সূরাহয় সর্ব প্রথমে মূসা (আঃ)-এর ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। এতে মূসা (আঃ)-এর নবুওয়তের প্রারম্ভিক কাল কিভাবে অতিবাহিত হয়েছিল, বনি ইসরাঈলসহ কিভাবে তিনি হিজরত করে ফেরাউনের কবল থেকে পরিত্রাণ লাভ করলেন এবং পরিশেষে কিভাবে স্বদলবলে ফেরাউনকে নিমজ্জিত করা হল সেব কথা বলা হয়েছে। অন্য কথায়, ফেরাউন এবং তাঁর কওমকে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত প্রদান করতে গিয়ে মূসা (আঃ)-কে যে সকল পর্যায় অতিক্রম করতে হয়েছিল এ ছিল সেই কর্মকান্ডের একটি সমন্বিত আলোচনা।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে যখন তাঁর আত্মীয়-পরিজন এবং স্বগোত্রীয় লোকজনদের নিকট দ্বীনের প্রকাশ্য দাওয়াত পেশ করার নির্দেশ দেয়া হল সেই প্রসঙ্গে মূসা (আঃ)-এর ঘটনাবলীর বিস্তারিত বিবরণাদি এ কারণেই তুলে ধরা হল, যাতে প্রকাশ্য দাওয়াতের পর কিভাবে মিথ্যা এবং বাতিলের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হয়ে যায় এবং হক পন্থীদের কিভাবে অন্যায়-অত্যাচারে সম্মুখীন হতে হয় তার একটি চিত্র নাবী কারীম (সাঃ) এবং সাহাবীগণের (রাঃ) সম্মুখে বিদ্যমান থাকে।
দ্বিতীয়তঃ এ সূরাহর মধ্যে নাবী-রাসূলদের মিথ্যা প্রতিপন্নকারী জাতিসমূহ, যথাঃ ফেরাউন ও তার দল ব্যতীত নূহ (আঃ)-এর সম্প্রদায়, আদ, সামুদ, ইবরাহীম (আঃ)-এর সম্প্রদায়, লুত (আঃ)-এর সম্প্রদায় এবং আসহাবুল আইকার পরিণতির কথাও উল্লেখিত হয়েছে। সম্ভবতঃ এর উদ্দেশ্য হচ্ছে যে সকল কওম নাবী-রাসূলদের মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে, তাঁদের উপর তাদের হঠকারিতার পরিণতি, কী কৌশলে আল্লাহ তাঁদের ধ্বংস করে দিতে পারেন, তাদের পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে এবং ঈমানদারগণ অজস্র বিপদাপদ পরিবেষ্টিত থেকেও আল্লাহর রহমতে কিভাবে পরিত্রাণ লাভ করে থাকেন তা তুলে ধরাই হচ্ছে এর নিগূঢ় উদ্দেশ্য।
ফুটনোটঃ
আত্মীয়-স্বজনদের নিকট প্রচারের নির্দেশ (الدَّعْـوَةُ فِي الْأَقْرَبِيْنَ):
প্রথম সম্মেলন : যাহোক, এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর নাবী কারীম (সাঃ) বনু হাশিম গোত্রকে একত্রিত করে এক সম্মেলনের আয়োজন করেণ। সেই সম্মেলনে বনু মুত্তালিব বিন আবদে মানাফেরও এক দল লোক উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনে উপস্থিত লোকদের সংখ্য ছিল পঁয়তালিশ জন। সম্মেলনের শুরুতেই আবূ লাহাব আকস্মিকভাবে বলে উঠলেন, ‘দেখ এঁরা সকলেই তোমার নিকট আত্মীয়- চাচা, চাচাত ভাই ইত্যাদি। বাচালতা বাদ দিয়ে এদের সঙ্গে ভালভাবে কথাবার্তা বলার চেষ্টা করবে। তোমার জানা উচিত যে তোমার জন্য সকল আরববাসীদের সঙ্গে শত্রুতা করার শক্তি আমাদের নেই। তোমার আত্মীয়-স্বজনদের পক্ষে তোমাকে ধরে কারারুদ্ধ করে রাখাই কর্তব্য। সুতরাং তোমার জন্য তোমার পিতৃ-পরিবারই যথেষ্ট। তুমি যদি তোমার ধ্যান-ধারণা এবং কথাবার্তায় অটল থাক তবে এটা অনেক সহজ এবং স্বাভাবিক যে সমগ্র কুরাইশ গোত্র তোমার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবে এবং অন্যান্য আরব গোত্র এ ব্যাপারে সহযোগিতা করবে। তারপর এটা আমার জানার বিষয় নয় যে, স্বীয় পিতৃপরিবারের আর অন্য কেউ তোমার চাইতে বড় সর্বনাশা হতে পারে। আবূ লাহাবের এ জাতীয় অর্থহীন আস্ফালনের প্রেক্ষাপটে নাবী কারীম (সাঃ) সম্পূর্ণ নীরবতা অবলম্বন করলেন এবং ঐ নীরবতার মধ্য দিয়েই সম্মেলন শেষ হয়ে গেল।
দ্বিতীয় সম্মেলনঃ
এরপর নাবী কারীম (সাঃ) স্বগোত্রীয় লোকজনদের একত্রিত করে দ্বিতীয় সম্মেলনের ব্যবস্থা করেন। সম্মেলনে উপস্থিত জনতাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন,
الحَمْدُ لِلهِ، أَحْمَدُهُ وَأَسْتَعِيْنُهُ، وَأُوْمِنُ بِهِ، وَأَتَوَكَّلُ عَلَيْهِ. وَأَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلٰهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ
‘‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য, আমি তাঁর প্রশস্তি বর্ণনা করছি এবং তাঁরই সাহায্য প্রার্থনা করছি। তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপন করছি, তাঁর উপরেই নির্ভর করছি এবং সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউই উপাসনার যোগ্য নয়। তিনি একক এবং অদ্বিতীয়, তাঁর কোন অংশীদার নেই।
তারপর তিনি বলেনঃ
(إِنَّ الرَّائِدَ لَا يَكْذِبُ أَهْلَهُ، وَاللهِ الَّذِيْ لاَ إِلٰهَ إِلاَّ هُوَ، إِنِّىْ رَسُوْلُ اللهِ إِلَيْكُمْ خَاصَّةً وَإِلَى النَّاسِ عَامَّةً، وَاللهِ لَتَمُوْتُنَّ كَمَا تَنَامُوْنَ، وَلَتَبْعَثُنَّ كَمَا تَسْتَيْقِظُوْنَ، وَلَتَحَاسَبْنَ بِمَا تَعْمَلُوْنَ، وَإِنَّهَا الْجَنَّةُأَبَدًا أَوِ النَّارِ أَبَدًا)
‘‘কল্যাণকামী পথ-প্রদর্শক স্বীয় আত্মীয়-পরিজনগণের নিকট কখনই মিথ্যা বলতে পারেন না, সেই আল্লাহর শপথ যিনি ব্যতীত অন্য কোনই উপাস্য নেই। বিশেষভাবে তোমাদের জন্য এবং সাধারণভাবে বিশ্বের সকল মানুষের জন্য আমি আল্লাহর রাসূল হিসেবে প্রেরিত হয়েছি। আল্লাহ জানেন, তোমরা সকলেই সেভাবেই মৃত্যুর সম্মুখীন হবে যেমনটি বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ো এবং সেভাবেই পুনরায় উত্থিত হবে যেমনটি তোমরা ঘুমন্ত অবস্থা থেকে জাগ্রত হও। পুনরুত্থান দিবসে তোমাদের সফলতা সম্পর্কে হিসাব গ্রহণ করা হবে এবং পুণ্যের ফলশ্রুতি হিসেবে চিরস্থায়ী সুখ-শান্তির আবাস স্থল জন্নাতে ও পাপাচারের ফলশ্রুতি হিসেবে কঠিন আযাব ও দুঃখ কষ্টের আবাসস্থল জাহান্নামে প্রবেশ করানো হবে।
এ কথা শুনে আবূ ত্বালিব বললেন, (জিজ্ঞেস করো না) আমরা কতটুকু তোমার সাহায্য করতে পারব, তোমার উপদেশ আমাদের জন্য কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে এবং তোমার কথাবার্তা কতটুকু সত্য বলে আমরা জানব। এখানে সমবেত লোকজন তোমার পিতৃ-পরিবারের সদস্য এবং আমিও অনুরূপ একজন সদস্য। পার্থক্য শুধু এ টুকুই যে, তোমার সহযোগিতার জন্য তাঁদের তুলনায় আমি অগ্রগামী আছি। অতএব, তোমার নিকট যে নির্দেশাবলী অবতীর্ণ হয়েছে তদনুযায়ী কাজ সম্পাদন করতে থাক। আল্লাহ ভরসা, আমি অবিরামভাবে তোমার কাজকর্ম দেখাশোনা ও তোমাকে সহানুভূতি করতে থাকব। তবে আব্দুল মুত্তালিবের দ্বীন ত্যাগ করতে আমি প্রস্তুত নই।
আবূ লাহাব বললেনঃ ‘আল্লাহর শপথ, এ হচ্ছে অন্যায় এবং দুষ্টামি-নষ্টামি। এর হাত অন্যদের আগে তোমরাই ধরে নাও।’
আবূ লাহাবের মুখ থেকে এ কথা শ্রবণের পর আবূ ত্বালিব বললেন, ‘আল্লাহর শপথ করে বলছি, যতক্ষণ আমার দেহে প্রাণ থাকবে আমি তাঁর হেফাযত বা রক্ষণাবেক্ষণ করতে থাকব।[1]
ফুটনোটঃ[1] ইবনুল আসিরঃ ফিকহুস সীরাহ পৃঃ ৭৭ ও ৮৮।
সাফা পর্বতের উপর (عَلٰى جَبَلِ الصَّفَا):
যখন নাবী কারীম (সাঃ) খুব ভালভাবে নিশ্চিত হলেন যে, আল্লাহর দ্বীন প্রচারের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে আবূ ত্বালিব তাঁকে সাহায্য করবেন তখন এক দিবস তিনি সাফা পর্বত শিখরে আরোহণ করে জন সাধারণকে আহবান করলেন, (يَا صَبَاحَاه) হায় প্রাতঃকাল[1] ব’লে তা শ্রবণ করে কুরাইশ গোত্রের লোকেরা সেখানে যখন সমবেত হলেন তখন তিনি সকলকে লক্ষ্য করে আল্লাহর একত্ববাদ, স্বীয় নবুওয়ত এবং পরকালীন জীবনের উপর বিশ্বাস স্থাপনের জন্য অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় সকলকে আহবান জানালেন। এ ঘটনার এক অংশ সহীহুল বুখারীতে ইবনে আব্বাস কর্তৃক এইভাবে বর্ণিত হয়েছেঃ
যখন {وَأَنْذِرْ عَشِيْرَتَكَ الْأَقْرَبِيْ} আয়াত অবতীর্ণ হল তখন নাবী কারীম (সাঃ) সাফা পর্বত শিখরে আরোহন করে কুরাইশ গোত্রের সকলকে লক্ষ্য করে বিশেষ কিছু শব্দ উচ্চারণ করে চিৎকার করতে থাকলেনঃ
يَا بَنِيْ فِهْرٍ، يَا بِنْيِ عَدِىٍّ، (يَا بَنِيْ فُلَانٍ، يَا بَنِيْ فُلَانٍ، يَا بَنِيْ عَبْدِ مَنَافٍ، يَا بَنِيْ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ)
‘‘ওহে বনু ফিহর! ওহে বনু আদী! (ওহে বনু অমুক, ওহে বনু ওমুক, ওহে বনু আবদে মানাফ, ওহে বনু আবদুল মুত্তালিব)
এ আহবান শ্রবণ করে সকলেই সেখানে সমবেত হয়ে গেলেন। এমনকি কোন ব্যক্তির পক্ষে তাঁর উপস্থিতি সম্ভব না হলে ব্যাপারটি সম্পর্কে অবগত হওয়ার জন্য তিনি প্রতিনিধি প্রেরণ করলেন। ফলকথা হচ্ছে কুরাইশ গোত্রের সকলকেই সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। আবূ লাহাবও উপস্থিত ছিলেন।
তারপর নাবী কারীম (সাঃ) বললেন,
(أَرَأَيْتُكُمْ لَوْ أَخْبَرْتُكُمْ أَنَّ خَيْلًا بِالْوَادِىِّ بِسَفْح هٰذَا الْجَبَلِ تُرِيْدُ أَنْ تَغَيَّرَ عَلَيْكُمْ أَكُنْتُمْ مُصَدِّقِىَّ؟)
‘‘হে কুরাইশ বংশীয়গণ! তোমরা বল, আজ (এ পর্বত শিখরে দাঁড়িয়ে) যদি আমি তোমাদিগকে বলি যে, পর্বতের অন্য দিকে এক প্রবল শত্রু সৈন্য বাহিনী তোমাদের যথা- সর্বস্ব লুণ্ঠনের জন্য অপেক্ষা করছে তাহলে তোমরা আমার এ কথার উপর বিশ্বাস স্থাপন করবে কি?
সকলে সমস্বরে উত্তর করল হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, বিশ্বাস না করার কোনই কারণ নেই। আমরা কখনো আপনাকে মিথ্যার সংস্পর্শে আসতে দেখি নি।
তখন গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলতে লাগলেন ,
(إِنِّىْ نَذِيْرٌ لَّكُمْ بَيْنَ يَدْى عَذَابٍ شَدِيْدٍ، إِنَّمَا مَثَلِىْ وَمَثَلُكُمْ كَمَثَلِ رَجُلٍ رَأَي الْعَدُوَّ فَانْطَلَقَ يَرْبَأ أَهْلَهُ) ( أَيْ يَتَطَلِّعُ وَيُنْظَرُ لَهُمْ مِنْ مَكَانٍ مُّرْتَفِعٍ لِئَلاَّ يُدْهِمُهُمْ الْعَدُوُّ) (خَشِىَ أَنْ يَسْبِقُوْهُ فَجَعَلَيُنَادِىْ: يَا صَبَاحَاه)
‘‘যদি তাহাই হয়, তবে শ্রবণ করুন। আমি আপনাদেরকে (পাপ ও আল্লাহ দ্রোহিতার ভীষণ পরিণাম ও তজ্জনিত) অবশ্যম্ভাবী কঠোর দন্ডের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য প্রেরিত হয়েছি ……………………।
অতঃপর সাধারণ ও বিশেষভাবে সকলকে সত্যের পথে আহ্বান জানালেন এবং তাদেরকে আল্লাহর কঠিন শাস্তির ভয় প্রদর্শন করে বললেন
“হে কুরাইশগণ, তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুণ থেকে রক্ষা কর এবং তোমাদের নিজেদেরকে আল্লাহর নিকট সঁপে দিয়ে তার সন্তুষ্টি অর্জন করো।”
“হে বনু কা’ব বিন লুহাই, তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুণ থেকে রক্ষা কর। কেননা আমি তোমাদের কোন উপকার বা ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখি না।”
“হে বনু কা’ব বিন মুররাহ, তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুণ থেকে রক্ষা কর।”
“হে বনু কুসাই সম্প্রদায়, তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুণ থেকে রক্ষা কর। কেননা আমি তোমাদের কোন উপকার বা ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখি না।”
“হে বনু আবদে মানাফ সম্প্রদায়, তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুণ থেকে রক্ষা কর। কারণ, আমি আল্লাহর নিকট তোমাদের উপকার বা অপকার কিছুরই মালিক নই। আমি আল্লাহর নিকট তোমাদের জন্য কোন উপকারে আসবো না ।”
“হে বনু আবদে শামস, তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুণ থেকে বাঁচাও।”
“হে বনু হাশিম, তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুণ থেকে বাঁচাও।”
“হে বনু আব্দুল মুত্তালিব সম্প্রদায়, তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুণ থেকে বাঁচাও। কারণ, আমি তোমাদের উপকার বা অপকার কিছুরই মালিক নই। আমি আল্লাহর নিকট তোমাদের জন্য কোন উপকারে আসবো না। আমার নিকট থেকে তোমরা ইচ্ছমতো কোন সম্পদ চেয়ে পার কিন্তু আমি আল্লাহর নিকট তোমাদের জন্য কোন উপকারে আসবো না।”
“হে বনু আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব, আমি আল্লাহর নিকট তোমাদের জন্য কোন উপকারে আসবো না।”
“হে সাফিয়্যাহ বিনতে আব্দুল মুত্তালিব (রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ফুফু), আমি আপনার জন্য আল্লাহর নিকট কোন উপকারে আসবো না।”
“হে বনু হে ফাত্বিমাহ বিনতে মুহাম্মাদ! তুমি নিজেকে দোযখ থেকে বাঁচাও। কারণ, আমি আল্লাহর নিকট তোমাদের (উপকার-অপকার) কিছুরই মালিক নই। আমি তোমার জন্য আল্লাহর নিকট কিছুই করতে পারবো না। তবে তোমাদের সাথে (আমার) যে আত্মীয়তা রয়েছে তা আমি (দুনিয়াতে) অবশ্যই আর্দ্র রাখব। অর্থাৎ যথাযথভাবে আতীয়তা বজায় রাখবো।”
যখন এ ভীতিপ্রদর্শনমূলক বক্তব্য শেষ হলো সম্মেলন ভেঙ্গে গেল ও লোকজন যার যার মতো চলে গেল, কেউ কোন প্রতিবাদ করল না। কিন্তু আবূ লাহাব মন্দ উদ্দেশ্য নিয়ে নাবী (র)-এর নিকটে এসে বলে উঠলেন, ‘তোর সর্বনাশ হোক! এ জন্য কি তুই এখানে আমাদেরকে সমবেত করেছিস? এর ফলশ্রুতিতে আয়াতে কারীমা অবতীর্ণ হলো :[2]
{تَبَّتْ يَدَا أَبِيْ لَهَبٍ وَتَبَّ} [سورة المسد:1]
‘‘আবূ লাহাবের হাত ধ্বংস হোক।’ (আল-মাসাদ ১১১ : ১)
এভাবে উচ্চকণ্ঠে আহানের উদ্দেশ্য ছিল দীনের দাওয়াতের বাণী পৌছে দেয়া। এর মাধ্যমে রাসূল (সাঃ) তার নিকটস্ত লোকেদের মাঝে এটা পরিস্কার করলেন যে, তাঁর রেসালাতকে সত্যায়ন করার অর্থই হলো, রাসূল (সাঃ) এবং তাদের মধ্যে একটা সৌহাদ্যপূর্ণ জীবনের সূত্রপাত করণ। আর আরবে যে আত্মীয় সম্বন্ধের যে মজবুত ভিত্তি রয়েছে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা সতর্কবাণীর তুলনায় নিতান্তই নগণ্য।
এর প্রতিধ্বনি মক্কার অলি-গলিতে পৌছেই নি এমন সময় নাযিল হলো
فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِينَ
“কাজেই তোমাকে যে বিষয়ের হুকুম দেয়া হয়েছে তা জোরে শোরে প্রকাশ্যে প্রচার কর, আর মুশরিকদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও।” (আল-হিজর : ৯৪)
এ আয়াত অবতীর্ণের পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মুশরিক সমাজে ও অলি-গলি ঘুরে ঘুরে প্রকাশ্যভাবে দাওয়াত দেয়া শুরু করলেন। তাদের নিকট আল্লাহর কিতাব পড়ে শুনাতে থাকলেন, অন্যান্য রাসূলগণ যা দাওয়াত দিতেন তাই প্রচার করতে থাকলেন অর্থ্যাৎ [يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَٰهٍ غَيْرُهُ] “হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তিনি ছাড়া তোমাদের কোন ইলাহ নেই।” এবং দৃষ্টির সামনেই আল্লাহর ইবাদত করতে লাগলেন। অতঃপর তিনি প্রকাশ্য দিবালোকে কুরাইশ নেতাদের সম্মুখে কাবাহ প্রাঙ্গণে সালাত আদায় করতেন। তাঁর দীনের দাওয়াত দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে লাগল এবং একের পর এক লোকজন শান্তির ধর্ম ইসলামে দীক্ষিত হতে থাকলেন। ফলশ্রুতিতে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছেন এবং যারা ইসলাম গ্রহণ করেন নি
এ উভয় দলের বাড়িতে বাড়িতে হিংসা-বিদ্বেষ, শত্রুতা-বিরোধীতা ক্রমে বেড়েই চললো এবং কুরাইশগণ সর্বদিক থেকে মুমিনদের ঘৃণা করতে থাকলেন এবং তাদের সাধ্যমত ইসলামের সাথে মন্দ আচরণ করতে লাগলো।
ফুটনোটঃ[1] তৎকালীন সময়ে আরবের নিয়ম ছিল ভয়ঙ্কর কোন বিপদের আশঙ্কা দেখা দিলে কিংবা কেউ দেশবাসীর নিকট কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিচার কিংবা প্রতিকার প্রার্থী হলে পর্বত শীর্ষে আরোহণ করে (ইয়াসাবাহাহ) হায় প্রাতঃকাল বলে চিৎকার করতে থাকত। এতে লোকজন সেখানে সমবেত হতো।
[2] সহীহুল বুখারী ২য় খণ্ড ৭০২ ও ৭৪৩ পৃঃ, সহীহুল মুসলিম ১ম খণ্ড ১১৪ পৃঃ।
হজ্জ যাত্রীগণকে বাধা দেয়ার বৈঠক (المَجْلِسُ الْاِسْتِشَارِيْ لِكَفِّ الْحِجَاجِ عَنْ اِسْتِمَاعِ الدَّعْوَةِ):
যে সময়ের কথা ইতোপূর্বে বলা হল সেই সময়ে কুরাইশগণের সামনে আরও একটি সমস্যা দেখা দিল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রকাশ্য প্রচার অভিযানের কয়েক মাস অতিবাহিত হতে না হতেই হজ্জের মৌসুম এসে উপস্থিত হল। যেহেতু এ মৌসুমে আরব ভূমির দূর দূরান্ত থেকে বিভিন্ন গোত্রের প্রতিনিধি দলের আগমন আরম্ভ হয়ে যাবে এবং সেহেতু মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁদের নিকটে প্রচারাভিযান শুরু করবেন সেহেতু তাঁর সম্পর্কে সমাগত সকলের নিকট এমন এক কথা বলার প্রয়োজনবোধ করলেন যার ফলে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর উপর ক্রিয়ার সৃষ্টি করবে না। এ প্রেক্ষিতে এ ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা ও সলাপরামর্শের জন্য তাঁরা অলীদ বিন মুগীরার গৃহে সমবেত হলেন। অলীদ বললেন ‘এ ব্যাপারে তোমাদের মতামত ঠিক, কারো যাতে এ নিয়ে তোমাদের পরস্পরের মধ্যে মতবিরোধ কিংবা মত পার্থক্যের সৃষ্টি না হয় এবং তোমাদের একজনের কথাকে অন্যজন যেন মিথ্যা প্রতিপন্ন না করে।’
অন্যেরা বললেন, ‘আপনি একটা মোক্ষম মন্তব্য ঠিক করে দিন তাহলেই তা আমাদের সকলের জন্য গ্রহণযোগ্য হবে।’
তিনি বললেন, ‘না তা হবে না বরং তোমরা বলবে এবং আমি তা শুনব।’
ওলীদের এ কথার পর কয়েকজন সমস্বরে উঠলেন ‘আমরা মন্তব্য করব যে, তিনি কাহিন।’
অলীদ বললেন, ‘না আল্লাহর শপথ তিনি কাহিন (গণক) নয়।
আমরা অনেক কাহিন দেখেছি। ইনি তো কাহিনদের মতো গুনগুন করে গান গান না। ছন্দাকারে কবিতা আবৃত্তি করেন না কিংবা কবিতা রচনাও করেন না।’
অন্যরা বললেন, ‘তাহলে আমরা তাঁকে একজন পাগল বলব।’
অলীদ বললেন, ‘না তিনি তো পাগল নন, আমরা পাগল দেখেছি এবং তাঁর রকম সকম সম্পর্কে জানি। এ লোকের মধ্যে পাগলাদের মতো দম বন্ধ করে থাকা, অস্বাভাবিক কোন কাজকর্ম করা অসংলগ্ন কথাবার্তা বলা কিংবা অনুরূপ কোন কিছুই তো দেখি না।’
অন্যেরা বললেন, ‘তাহলে আমরা বলব যে, তিনি একজন কবি।’
অলীদ বললেন, ‘তাঁর মধ্যে কবির কোন বৈশিষ্ট্য নেই যে, তাঁকে কবি বলা হবে। রযয, হাজয, কারীয, মাকবুয, মাবসুত ইত্যাদি সর্বপ্রকার কাব্যরীতি সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। যাহোক তাঁর কথাবার্তাকে কিছুতেই কাব্য বলা যেতে পারে না।’
অন্যেরা বললেন, ‘তাহলে আমরা তাঁকে যাদুকর বলব।’
অলীদ বললেন, ‘এ ব্যক্তিকে যাদুকরও বলা যেতে পারে না। আমরা যাদুকর এবং যাদু সংক্রান্ত নানা ফন্দি-ফিকির দেখেছি, তারা সত্যমিথ্যা কত কথা বলে, কত অঙ্গ-ভঙ্গি করে কত যে, ঝাড়-ফুঁক করে এবং গিরা দেয় তার ইয়ত্তা থাকেনা। কিন্তু এ ব্যক্তি তো যাদুকরদের মতো সত্য-মিথ্যা কথা বলা, ঝাড়-ফুঁক কিংবা গিরা দেয়া কোন কিছুই করে না।’
অন্যেরা তখন বললেন, ‘আমরা তাহলে আর কী বলব।’
অলীদ বললেন, ‘আল্লাহর শপথ, তাঁর কথাবার্তা বড়ই মিষ্টি মধুর, তাঁর ভিত শিকড় বড়ই শক্ত এবং শাখা-প্রশাখা বড়ই মনোমুগ্ধকর। তোমরা তাঁর সম্পর্কে যাই বল না কেন, যাঁরা তাঁর সংস্পর্শে কিছুক্ষণ থাকবেন তাঁরা তোমাদের কথাবার্তাকে অবশ্যই মিথ্যা মনে করবেন। তারপর কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে পুনরায় তিনি বললেন, ‘তাঁর সম্পর্কে যদি কিছু বলতেই হয় তাহলে খুব জোর যাদুকর বলতে পারো। তাঁর এটা কিছুটা উপযোগী বলে মনে হতে পারে। তিনি এমন সব কথা উত্থাপন করেছেন যা যাদু বলেই মনে হয়। তিনি পিতাপুত্রের মধ্যে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে, ভাই-ভাইয়ের মধ্যে গোত্রে গোত্রে, আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে দিয়েছেন।’
শেষ পর্যন্ত তাঁরা তাঁকে যাদুকর বলার সিদ্ধান্তে একমত হয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলেন।[1]
কোন কোন বর্ণানায় এ কথাও বলা হয়েছে যে, অলীদ যখন তাঁদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দিলেন তখন তাঁরা বললেন, ‘আপনি তাহলে আপনার গ্রহণযোগ্য অভিমত ব্যক্ত করুন।’ প্রত্যুত্তরে অলীদ বললেন, ‘আমাকে তবে কিছু চিন্তা-ভাবনা করার সুযোগ দাও।’ এরপর তিনি বহুক্ষণ ধরে চিন্তা-ভাবনা করতে থাকেন এবং উল্লেখিত অভিমত ব্যক্ত করেন।[2]
এ ব্যাপারে অলীদ সম্পর্কে সূরাহ মুদ্দাসসিরের ১৬ টি আয়াত (১১-২৬) অবতীর্ণ হয়েছে :
{ذَرْنِيْ وَمَنْ خَلَقْتُ وَحِيْدًا وَجَعَلْتُ لَهُ مَالًا مَّمْدُوْدًا وَبَنِيْنَ شُهُوْدًا وَمَهَّدتُّ لَهُ تَمْهِيْدًا ثُمَّ يَطْمَعُ أَنْ أَزِيْدَ كَلَّا إِنَّهُ كَانَ لِآيَاتِنَا عَنِيْدًا سَأُرْهِقُهُ صَعُوْدًا إِنَّهُ فَكَّرَ وَقَدَّرَ فَقُتِلَ كَيْفَ قَدَّرَ ثُمَّ قُتِلَ كَيْفَقَدَّرَ ثُمَّ نَظَرَ ثُمَّ عَبَسَ وَبَسَرَ ثُمَّ أَدْبَرَ وَاسْتَكْبَرَفَقَالَ إِنْ هٰذَا إِلَّا سِحْرٌ يُؤْثَرُ إِنْ هٰذَا إِلَّا قَوْلُ الْبَشَرِسَأُصْلِيْهِ سَقَرَ} [من 11 إلى 26]
‘১১. ছেড়ে দাও আমাকে (তার সঙ্গে বুঝাপড়া করার জন্য) যাকে আমি এককভাবে সৃষ্টি করেছি। ১২. আর তাকে (ওয়ালীদ বিন মুগীরাহ্কে) দিয়েছি অঢেল ধন-সম্পদ, ১৩. আর অনেক ছেলে যারা সব সময় তার কাছেই থাকে। ১৪. এবং তার জীবনকে করেছি সচ্ছল ও সুগম। ১৫. এর পরও সে লোভ করে যে, আমি তাকে আরো দেই। ১৬. কক্ষনো না, সে ছিল আমার নিদর্শনের বিরুদ্ধাচারী। ১৭. শীঘ্রই আমি তাকে উঠাব শাস্তির পাহাড়ে (অর্থাৎ তাকে দিব বিপদের উপর বিপদ)। ১৮. সে চিন্তা ভাবনা করল এবং সিদ্ধান্ত নিল, ১৯. ধ্বংস হোক সে, কিভাবে সে (কুরআনের অলৌকিকতা স্বীকার করার পরও কেবল অহমিকার বশবর্তী হয়ে নবুওয়াতকে অস্বীকার করার) সিদ্ধান্ত নিল! ২০. আবারো ধ্বংস হোক সে, সে সিদ্ধান্ত নিল কিভাবে! ২১. তারপর সে তাকালো। ২২. তারপর ভ্রু কুঁচকালো আর মুখ বাঁকালো। ২৩. তারপর সে পিছনে ফিরল আর অহংকার করল। ২৪. তারপর বলল- ‘এ তো যাদু ছাড়া আর কিছু নয়, এ তো পূর্বে থেকেই চলে আসছে। ২৫. এটা তো মানুষের কথা মাত্র।’ ২৬. শীঘ্রই আমি তাকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করব।’ (আল-মুদ্দাসসির ৭৪ : ১১-২৬)
যার মধ্যে কয়েকটি আয়াতে তাঁর চিন্তার ধরণ সম্পর্কিত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছেঃ
{إِنَّهُ فَكَّرَ وَقَدَّرَ فَقُتِلَ كَيْفَ قَدَّرَ ثُمَّ قُتِلَ كَيْفَ قَدَّرَ ثُمَّ نَظَرَ ثُمَّ عَبَسَ وَبَسَرَ ثُمَّ أَدْبَرَ وَاسْتَكْبَرَ فَقَالَ إِنْ هٰذَا إِلَّا سِحْرٌ يُؤْثَرُ إِنْ هٰذَا إِلَّا قَوْلُ الْبَشَرِ} [المدثر:18: 25]
‘‘১৮. সে চিন্তা ভাবনা করল এবং সিদ্ধান্ত নিল, ১৯. ধ্বংস হোক সে, কিভাবে সে (কুরআনের অলৌকিকতা স্বীকার করার পরও কেবল অহমিকার বশবর্তী হয়ে নবুওয়াতকে অস্বীকার করার) সিদ্ধান্ত নিল! ২০. আবারো ধ্বংস হোক সে, সে সিদ্ধান্ত নিল কিভাবে! ২১. তারপর সে তাকালো। ২২. তারপর ভ্রু কুঁচকালো আর মুখ বাঁকালো। ২৩. তারপর সে পিছনে ফিরল আর অহংকার করল। ২৪. তারপর বলল- ‘এ তো যাদু ছাড়া আর কিছু নয়, এ তো পূর্বে থেকেই চলে আসছে। ২৫. এটা তো মানুষের কথা মাত্র।’ (আল-মুদ্দাসসির ৭৪ : ১৮-২৬)
যা হোক, তাঁরা যে সিদ্ধান্ত করলেন তা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে এখন থেকে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকলেন। কিছু সংখ্যক কাফির মক্কায় আগমনকারী হজ্জযাত্রীগণের পথের পাশে কিংবা পথের মোড়ে মোড়ে জটলা করে নাবী কারীম (সাঃ)-এর প্রচার এবং তাবলীগের ব্যাপারে যা ইচ্ছে তাই বলে হজ্জযাত্রীগণকে বিভ্রান্ত করতে শুরু করলেন। নাবী কারীম (সাঃ) সম্পর্কে তাঁদের সতর্ক করে দিয়ে তাঁর সম্পর্কে বহু কিছু বলতে থাকলেন।[3] এ সব ব্যাপারে আবূ লাহাব অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
হজ্বের মৌসুমে হজ্ব যাত্রীগণের শিবিরে এবং উকায, মাজিন্নাহ ও যুলমাজায বাজারে নাবী কারীম (সাঃ) যখন আল্লাহর একত্ব এবং দ্বীনের তাবলীগ করতেন তখন আবূ লাহাব তাঁর পিছন পিছন গিয়ে বলতেন, ‘এর কথায় তোমরা কান দিয়ো না। সে মিথ্যুক এবং বেদ্বীন হয়ে গিয়েছে।[4]
এভাবে দৌড় ঝাপের ফল হল যে, হজ্ব পালনের পর হাজীগণ যখন নিজ নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন তখন তাঁরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সম্পর্কে ভালভাবে অবগত হয়ে গৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন। তাছাড়া তাঁরা এ কথাও অবগত হয়ে গেলেন যে মুহাম্মাদ (সাঃ) নবুওয়ত দাবী করেছেন। এভাবে হজ্ব যাত্রীগণের মাধ্যমেই নাবী কারীম (সাঃ)-এর নবুওয়ত এবং ইসলামের প্রাথমিক কথাবার্তা সমগ্র আরব জাহানে বিস্তার লাভ করল।
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ২৭১ পৃঃ।
[2] ফী যিলালিল কুরআন: পারা ২৯, পৃষ্ঠা ১৮৮।
[3] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ২৭১ পৃঃ।
[4] তিরমিযী মসনাদে আহমাদ ৩য় খন্ড ৪৯২ পৃঃ ও ৪র্থ ৩৪১ পৃঃ।
বিরুদ্ধাচরণের বিভিন্ন পন্থা (أَسَالِيْبٌ شَتّٰى لِمُجَابَهَةِ الدَّعْوَةِ):
কুরাইশগণ যখন দেখলেন যে, মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে তাঁর দ্বীনের দাওয়াত এবং তাবলীগ থেকে নিবৃত্ত করার কোন কৌশল কার্যকর হচ্ছে না তখন তাঁরা পুনরায় চিন্তাভাবনা করে তাঁর তাবলীগী কর্মকান্ডকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে ফেলার জন্য নানামুখী পন্থা-প্রক্রিয়া অবলম্বন শুরু করলেন। যে সকল পন্থা তাঁরা অবলম্বন করলেন তা হচ্ছে যথাক্রমেঃ
ফুটনোটঃ
প্রথম পন্থা : উপহাস, ঠাট্টা-তামাশা, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, মিথ্যাপ্রতিপন্ন, অকারণ হাসাহাসি (السُّخْرِيَّةُ وَالتَّحْقِيْرُ وَالْاِسْتِهْزَاءُ وَالتَّكْذِيْبُ وَالتَّضْحِيْكُ):
বিভিন্ন অবমাননাকর উক্তি ইত্যাদির মাধ্যমে নাবী কারীম (সাঃ)-কে তাঁরা জর্জরিত এবং অতীষ্ঠ করে তুলতে চাইলেন। এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল মুসলিমগণকে সন্দেহপরায়ণ, বিপন্ন ও ব্যতিব্যস্ত করে তাঁদের উদ্যম ও কাজের স্পৃহাকে নষ্ট করে দেয়া। এ উদ্দেশ্যে মুশরিকগণ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে অশালীন অপবাদ এবং গালিগালাজ করতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। তাঁরা কখনো তাঁকে পাগল বলেও সম্বোধন করতেন। যেমনটি ইরশাদ হয়েছেঃ
{وَقَالُوْا يَا أَيُّهَا الَّذِيْ نُزِّلَ عَلَيْهِ الذِّكْرُ إِنَّكَ لَمَجْنُوْنٌ} [الحجر:6]
‘‘তারা বলে, ‘ওহে ঐ ব্যক্তি যার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে! তুমি তো অবশ্যই পাগল।’ (আল-হিজর ১৫ : ৬)
কখনো কখনো নাবী (সাঃ)-কে যাদুকর বলত এবং মিথ্যার অপবাদও দিত। যেমনটি ইরশাদ হয়েছেঃ
{وَعَجِبُوْا أَن جَاءهُم مُّنذِرٌ مِّنْهُمْ وَقَالَ الْكَافِرُوْنَ هٰذَا سَاحِرٌ كَذَّابٌ} [ص:4]
‘‘আর তারা (এ ব্যাপারে) বিস্ময়বোধ করল যে, তাদের কাছে তাদেরই মধ্য হতে একজন সতর্ককারী এসেছে। কাফিরগণ বলল- ’এটা একটা যাদুকর, মিথ্যুক।’ (স্ব-দ ৩৮ : ৪)
এ কাফিরগণ নাবী (সাঃ)-এর অগ্রভাগে ও পিছনে ক্রোধান্বিত এবং প্রতি হিংসাপরায়ণ দৃষ্টিভঙ্গী ও মন-মানসিকতা নিয়ে ঘোরাফিরা করত। এ প্রসঙ্গে কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছেঃ
{وَإِن يَكَادُ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا لَيُزْلِقُوْنَكَ بِأَبْصَارِهِمْ لَمَّا سَمِعُوْا الذِّكْرَ وَيَقُوْلُوْنَ إِنَّهُ لَمَجْنُوْنٌ} [القلم:51]
‘‘কাফিররা যখন কুরআন শুনে তখন তারা যেন তাদের দৃষ্টি দিয়ে তোমাকে আছড়ে ফেলবে। আর তারা বলে, ‘সে তো অবশ্যই পাগল।’ (আল-ক্বালাম ৬৮ : ৫১)
অধিকন্তু, নাবী কারীম (সাঃ) যখন কোথাও গমন করতেন এবং তাঁর দুর্বল ও মজলুম সাহাবীগণ (রাঃ) তাঁর নিকট উপস্থিত থাকতেন তখন এদের লক্ষ্য করে মুশরিকগণ উপহাস করে বলতঃ
{مَنَّ اللهُ عَلَيْهِم مِّن بَيْنِنَا أَلَيْسَ اللهُ بِأَعْلَمَ بِالشَّاكِرِيْنَ} [الأنعام:53]
‘‘এরা কি সেই লোক আমাদের মধ্যে যাদেরকে আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন, আল্লাহ কি তাঁর কৃতজ্ঞ বান্দাহদের সম্পর্কে অধিক অবগত নন?’ (আল-আন‘আম ৬ : ৫৩)
সাধারণতঃ মুশরিকগণের অবস্থা তাই ছিল যার চিত্র নীচের আয়াত সমূহে তুলে ধরা হয়েছেঃ
{إِنَّ الَّذِيْنَ أَجْرَمُوْا كَانُوْا مِنَ الَّذِيْنَ آمَنُوْا يَضْحَكُوْنَ وَإِذَا مَرُّوْا بِهِمْ يَتَغَامَزُوْنَ وَإِذَا انقَلَبُوْا إِلىٰ أَهْلِهِمُ انقَلَبُوْا فَكِهِيْنَ وَإِذَا رَأَوْهُمْ قَالُوْا إِنَّ هَؤُلَاء لَضَالُّوْنَ وَمَا أُرْسِلُوْا عَلَيْهِمْ حَافِظِيْنَ} [المطففين:29: 333]
‘‘পাপাচারী লোকেরা (দুনিয়ায়) মু’মিনদেরকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করত। ৩০. আর তারা যখন তাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করত তখন পরস্পরে চোখ টিপে ইশারা করত। ৩১. আর তারা যখন তাদের আপন জনদের কাছে ফিরে আসত, তখন (মু’মিনদেরকে ঠাট্টা ক’রে আসার কারণে) ফিরত উৎফুল্ল হয়ে। ৩২. আর তারা যখন মু’মিনদেরকে দেখত তখন বলত, ‘এরা তো এক্কেবারে গুমরাহ্।’ ৩৩. তাদেরকে তো মু’মিনদের হিফাযাতকারী হিসেবে পাঠানো হয়নি।’ (আল-মুত্বাফফিফীন ৮৩ : ২৯-৩৩)
মুশরিকদের উপহাস, ঠাট্টা-বিদ্রুপ, হাসাহাসি ও বিভিন্নভাবে আঘাতের মাত্রা এর বাড়িয়ে দিল যে তা নাবী (সাঃ)-কে মর্মাহত করে তুলল। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন,
قَالَ فَمَا خَطْبُكُمْ أَيُّهَا الْمُرْسَلُونَ
“আমি জানি, তারা যে সব কথা-বার্তা বলে তাতে তোমার মন সংকুচিত হয়। (আল-হিজর ১৫ : ৯৭)
অতঃপর আল্লাহ তা’আলা তার অন্তরকে দৃঢ় করলেন এবং এমন বিষয়ের নির্দেশ প্রদান করলেন, যাতে করে তার অন্তর থেকে ব্যথা-বেদনা দূরীভূত হয়। এ মর্মে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন,
فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَكُنْ مِنَ السَّاجِدِينَ وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتَّىٰ يَأْتِيَكَ الْيَقِينُ
“কাজেই প্রশংসা সহকারে তুমি তোমার প্রতিপালকের পবিত্রতা ঘোষণা কর, আর সাজদাহকারীদের দলভুক্ত হও। আর তোমার রবের ইবাদত করতে থাক সুনিশ্চিত ক্ষণের (অর্থাৎ মৃত্যুর) আগমন পর্যন্ত। (আল-হিজর ১৫ : ৯৮-৯৯)
অধিকন্তু আল্লাহ তা’আলা ইতোপূর্বেই তাঁর প্রিয় হাবীবকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, এ সব ঠাট্টা-বিদ্রুপকারীদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। আল্লাহ বলেন,
إِنَّا كَفَيْنَاكَ الْمُسْتَهْزِئِينَ الَّذِينَ يَجْعَلُونَ مَعَ اللَّهِ إِلَٰهًا آخَرَ ۚ فَسَوْفَ يَعْلَمُونَ
“(সেই) ঠাট্টা-বিদ্রুপকারীদের বিরুদ্ধে তোমার জন্য আমিই যথেষ্ট। যারা আল্লাহর সাথে অন্যকেও ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে, (কাজেই শিরকের পরিণতি কী শীঘ্রই তার জানতে পারবে।” (আল-হিজর ১৫ : ৯৫-৯৬)
আল্লাহ তা’আলা আরো জানিয়ে দিলেন যে, এ অবস্থার শীঘ্রই উন্নতি হবে এবং এ ঠাট্টা-বিদ্রুপ তাদের ক্ষতির কারণ হবে।
وَلَقَدِ اسْتُهْزِئَ بِرُسُلٍ مِنْ قَبْلِكَ فَحَاقَ بِالَّذِينَ سَخِرُوا مِنْهُمْ مَا كَانُوا بِهِ يَسْتَهْزِئُونَ
“তোমার পূর্বেও রাসূলদেরকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা হয়েছে, অতঃপর যা নিয়ে তারা ঠাট্ট-বিদ্রুপ করত তাই তাদেরকে পরিবেষ্টন করে ফেলল।” (আল-আনআম ৬ : ১০)
ফুটনোটঃ
দ্বিতীয় পন্থা : সংশয় সন্দেহের উসকানি ও মিথ্যা দাওয়াতের মুখোশ উন্মোচন (إِثَارَةُ الشُّبُهَاتِ وَتَكْثِيْفِ الدِّعَايَاتِ الْكَاذِبَةِ):
নাবী (সাঃ)-এর শিক্ষা-দীক্ষার বিষয়াদির বিকৃত করে দেখানো, নবী (সাঃ)-এর শিক্ষা-দীক্ষা সম্পর্কে জনমনে সন্দেহ ও সংশয় সৃষ্টি করা এবং মিথ্যা ও অপপ্রচার করা, নাবী (সাঃ)-এর শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যক্তিত্ব ইত্যাদি সব কিছুকে অর্থহীন ও আজেবাজে প্রশ্নের সম্মুখীন করা, এ সবগুলো অনবরত এত অধিক পরিমানে করা যাতে জনসাধারণ তার দ্বীন প্রচারের দিকে ধীর স্থিরভাবে মনযোগ দেয়া কিংবা চিন্তা-ভাবনা করার সুযোগ না পায়। মুশরিকগণ যেমন কুরআন সম্পর্কে বলেছেন: (أَضْغَاثُ أَحْلَامٍ) ‘এসব অলীক স্বপ্ন’ রাত্রে তৈরি করে আর দিনে সে তিলাওয়াত করে (بَلِ افْتَرَاهُ) সে মিথ্যা উদ্ভাবন করেছে অর্থাৎ সে নিজের পক্ষ থেকে বানিয়েছে এবং তারা এও বলে যে, (إِنَّمَا يُعَلِّمُهُ بَشَرٌ) ‘এক মানুষ তাকে (মুহাম্মাদ (সা)-কে) শিখিয়ে দেয়’ (আন-নাহল : ১০৩) তারা বলে, إِنْ هَٰذَا إِلَّا إِفْكٌ افْتَرَاهُ وَأَعَانَهُ عَلَيْهِ قَوْمٌ آخَرُونَ
‘কাফিররা বলে- ‘এটা মিথ্যে ছাড়া আর কিছুই নয়, সে তা (অর্থ্যাৎ কুরআন) উদ্ভাবন করেছে এবং ভিন্ন জাতির লোক এ ব্যাপারে তাকে সাহায্য করেছে’। (আল-ফুরক্বান ২৫ : ৪)
وَقَالُوا أَسَاطِيرُ الْأَوَّلِينَ اكْتَتَبَهَا فَهِيَ تُمْلَىٰ عَلَيْهِ بُكْرَةً وَأَصِيلًا
“তারা বলে, এগুলো পূর্ব যুগের কাহিনী যা সে [অর্থাৎ মুহাম্মাদ (সাঃ)] লিখিয়ে নিয়েছে আর এগুলোই তার কাছে সকাল-সন্ধ্যা শোনানো হয়। (আল-ফুরকান ২৫ : ৫)
কখনো তারা বলত যে, কাহিনদের উপর যেমন জিন ও শয়তান নাযিল তেমনি তার উপরও একজন জিন ও শয়তান নাযিল হয়। একথার প্রতিবাদে আল্লাহ বলেন,
هَلْ أُنَبِّئُكُمْ عَلَىٰ مَن تَنَزَّلُ الشَّيَاطِينُ تَنَزَّلُ عَلَىٰ كُلِّ أَفَّاكٍ أَثِيمٍ
“তোমাদেরকে কি জানাবো কার নিকট শয়তানরা অবতীর্ণ হয়? তারা তো অবতীর্ণ হয় প্রত্যেকটি ঘোর মিথ্যাবাদী ও পাপীর নিকট”। (আশ্ শুআরা ২৬ : ২২১-২২২)
ওটা তো মিথ্যাবাদী পাপীষ্টের উপর নাযিল হয়। তোমরা আমার মধ্যে কোন মিথ্যাচার ও ফাসেকী পাও না। সুতরাং কুরআনকে কিভাবে তোমরা শয়তানের পক্ষ থেকে নাযিলকৃত বল?
কখনো তারা নাবী (সাঃ) সম্পর্কে বলত, তাকে একপ্রকার পাগলামীতে পেয়েছে, সে কিছু খেয়াল করে সে অনুযায়ী প্রজ্ঞাপূর্ণ শব্দ তৈরি করে যেমন কবিরা করে থাকে। তাদের কথার উত্তরে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, وَالشُّعَرَاءُ يَتَّبِعُهُمُ الْغَاوُونَ أَلَمْ تَرَ أَنَّهُمْ فِي كُلِّ وَادٍ يَهِيمُونَ وَأَنَّهُمْ يَقُولُونَ مَا لَا يَفْعَلُونَ
“তুমি কি দেখো না তারা বিভ্রান্ত হয়ে (কল্পনার জগতে) প্রত্যেক উপত্যকায় ঘুরে বেড়ায়? আর তারা বলে যা তারা করে না।” (আশ শুআরা ২৬ : ২২৫-২২৬)
আয়াতে কথিত গুণ তিনটি কবিদের মধ্যে পাওয়া যায়, কিন্তু নাবী (সাঃ)-এর মধ্যে এগুলো অনুপস্থিত। অধিকন্তু তার অনুসারীগণ হলেন, হিদায়াতপ্রাপ্ত, আল্লাহ ভীরু, সৎকর্মশীল তাদের চরিত্রে, কাজে কর্মে সবক্ষেত্রে। তাদেরকে কোন প্রকার বিভ্রান্ত স্পর্শ করে নি। নাবী (সাঃ) কবিদের মতো উদ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ান না বরং তিনি এক-অদ্বিতীয় প্রতিপালক, এক দীন, এক পথের দিকে আহবান করেন। তিনি যা বলেন তা পালন করেন, যা বলেন না তা করেন না। তবে তিনি কিভাবে কবিদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন, আর কবিদের সাথে তার তুলনা-ই বা কিভাবে দেয়া যায়। মুশরিকদের পক্ষে থেকে ইসলাম, কুরআন ও নাবী (সাঃ)-এর উপর আরোপিত প্রত্যেক সন্দেহের ক্ষেত্রে এভাবে সন্তোষজনক উত্তর দান করা হয়।
মুশরিকরা সবচেয়ে বেশি সন্দেহে ছিল প্রথমত তাওহীদ বিষয়ে, দ্বিতীয়ত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নবুওয়াত-রেসালাতে, তৃতীয়ত মৃতদের পুনরুজীবিত হওয়া ও কিয়ামত দিবসে হাশরের ময়দানে একত্রিত হওয়া নিয়ে। কুরআন তাওহীদ বিষয়ে তাদের সকল প্রকার সন্দেহের যথোপযুক্ত জবাব তো দিয়েছেই, বরং অনেক ক্ষেত্রে বেশি ও বিস্তারিত আকারে আলোচনা করেছে যাতে কোন সন্দেহের অবকাশ না থাকে। শুধু তা-ই নয় তাদের বাতিল মা’বুদের অসারতা সম্পর্কে এত বেশি সমালোচনা করেছে যে, এ বিষয়ে আর কোন আলোচনার অবকাশ নেই। সম্ভবত দীন ইসলাম বিষয়ে তাদের ক্রোধ-আক্রোষের পরিমাণ এত বেশি।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আল্লাহ ভীতি, তাঁর মহৎ উদ্দেশ্য, আমানতদারীতা এবং তাঁর নবুওয়াত সত্য বলে জানা সত্ত্বেও কাফিরদের সন্দেহের কারণ এই যে, তারা বিশ্বাস করতো নবুওয়াত-রিসালত এমনই বড় ও মর্যাদাপূর্ণ পদ যে তা কোন মানুষের হাতে অৰ্পন করার মতো নয়। সুতরাং তাদের আক্বীদা-বিশ্বাস মতে যেমন কোন মানুষ রাসূল হতে পারেন না, তেমনি কোন রাসূল কক্ষনো মানুষ হতে পারেন না। ফলে রাসূলল্লাহ (রঃ) যখন তাঁর নবুওয়াতের ঘোষণা দিলেন আর মানুষদেরকে আহবান জানালেন সব উপাস্যকে পরিত্যাগ করে এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন করতে তাদের বিবেক পেরেশান ও হতবাক হলো এবং তারা বলে উঠলো :
مَالِ هَٰذَا الرَّسُولِ يَأْكُلُ الطَّعَامَ وَيَمْشِي فِي الْأَسْوَاقِ ۙ لَوْلَا أُنزِلَ إِلَيْهِ مَلَكٌ فَيَكُونَ مَعَهُ نَذِيرًا
‘ এ কেমন রসূল যে খাবার খায়, আবার হাট-বাজারে চলাফেরা করে ? তার কাছে ফেরেশতা অবতীর্ণ হয় না কেন যে তার সঙ্গে থাকত সতর্ককারী হয়ে?’ (আল-ফুরক্বান ২৫ : ৭)
তার বলে মুহাম্মাদ (সাঃ) তো মানুষ- مَا أَنزَلَ اللَّهُ عَلَىٰ بَشَرٍ مِّن شَيْءٍ
“আল্লাহ কোন মানুষের কাছে কোন কিছুই অবতীর্ণ করেননি।” (আল-আন’আম ৬ ৯১)
তাদের এ দাবী খণ্ডন করে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন,
قُلْ مَنْ أَنزَلَ الْكِتَابَ الَّذِي جَاءَ بِهِ مُوسَىٰ نُورًا وَهُدًى لِّلنَّاسِ
“বল, তাহলে ঐ কিতাব কে অবতীর্ণ করেছিলেন যা নিয়ে এসেছিলেন মূসা, যা ছিল মানুষের জন্য আলোকবর্তিকা ও সঠিক পথের দিকদিশারী।” (আল-আন’আম ৬ :৯১)
অথচ তারা জানে যে আল্লাহর নাবী মূসা (আঃ)ও মানুষ ছিলেন। তাছাড়া পূর্ববতী নাবী-রাসূলকেই তার জাতি অস্বীকার করে বলতো-
إِنْ أَنتُمْ إِلَّا بَشَرٌ مِّثْلُنَا [ابراهيم ١٠] قَالَتْ لَهُمْ رُسُلُهُمْ إِن نَّحْنُ إِلَّا بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ وَلَٰكِنَّ اللَّهَ يَمُنُّ عَلَىٰ مَن يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ [ابراهيم ١١]
“তুমি আমাদেরই মত মানুষ বৈ তো নও,” “তাদের রসূলগণ তাদেরকে বলেছিল, যদিও আমরা তোমাদের মতই মানুষ ব্যতীত নই, কিন্তু আল্লাহ তার বান্দাহদের মধ্যে যার উপর ইচ্ছে অনুগ্রহ করেন।” (ইবরাহীম ১৪ : ১০-১১)
সুতরাং নাবী-রাসূল তো মানুষই হয়ে থাকে; আর রেসালাত ও মানবত্ব- এ উভয়ের কোন তফাৎ নেই।
অধিকন্তু তাদের জানা রয়েছে যে, ইবরাহীম, ইসমাঈল, মূসা (আলাইহিমুস সালাম)- তারা সকলেই মানুষ ও নাবী ছিলেন যে ব্যাপারে তাদের সন্দেহের কোন সুযোগ নেই। কাজে কাজেই তারা বলে, আল্লাহ এই দরিদ্র-ইয়াতিম ব্যতীত আর রিসালাতের দায়িত্ব দেয়ার মতো আর কাউকে পেলেন না যে তাকেই রাসূল করে পাঠাতে হবে? আল্লাহ তা’আলা মক্কার বড় বড় জাদরেল নেতাদের না বানিয়ে এই ইয়াতিমকেই রাসূল মনোনীত করলেন?
وَقَالُوا لَوْلَا نُزِّلَ هَٰذَا الْقُرْآنُ عَلَىٰ رَجُلٍ مِّنَ الْقَرْيَتَيْنِ عَظِيمٍ
“আর তারা বলে, এই কুরআন কেন অবতীর্ণ করা হলো না দু জনপদের কোন প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তির উপর?” (আয-যুখরুফ ৪৩ : ৩১)
আল্লাহ তা’আলা তাদের যুক্তি খণ্ডন করে বলেন, (أَهُمْ يَقْسِمُونَ رَحْمَتَ رَبِّكَ)
“তারা কি তোমার প্রতিপালকের রহমত বণ্টন করে?” (আয-যুখরুফ ৪৩ : ৩২)
অর্থাৎ নিশ্চয়ই ওহী আল্লাহ তা’আলার এক বিশেষ রহমত।
اللَّهُ أَعْلَمُ حَيْثُ يَجْعَلُ رِسَالَتَهُ
“নবুওয়াতের দায়িত্ব কার উপর অর্পণ করবেন তা আল্লাহ ভালভাবেই অবগত।” (আল-আন’আম ৬ : ১২৪)
আল্লাহ তা’আলার পক্ষ হতে তাদের অমূলক সন্দেহের দাঁতভাঙ্গা পেয়ে উপায়ান্তর না দেখে তারা আরেকটি বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করলো তা হলো। তারা বলল, রাসূলগণ হবেন দুনিয়ার রাজা-বাদশা তারা থাকবেন শত শত গোলাম ও পরিচারকবৃন্দ দ্বারা পরিবেষ্টিত, তাদের জীবন হবে অত্যন্ত জাকজমকপূর্ণ ও শান-শওকতপূর্ণ; তাদেরকে দেয়া হবে জীবন-জীবিকার প্রাচুর্যতা। আর মুহাম্মাদ (সঃ)-এর কী রয়েছে? সে জীবন ধানণের সামান্য বস্তুর জন্যও বাজারে যায় আবার সে দাবি করে যে, সে কিনা আল্লাহ তা’আলার প্রেরিত রাসূল?
وَقَالُوا مَالِ هَٰذَا الرَّسُولِ يَأْكُلُ الطَّعَامَ وَيَمْشِي فِي الْأَسْوَاقِ لَوْلَا أُنزِلَ إِلَيْهِ مَلَكٌ فَيَكُونَ مَعَهُ نَذِيرًا أَوْ يُلْقَىٰ إِلَيْهِ كَنزٌ أَوْ تَكُونُ لَهُ جَنَّةٌ يَأْكُلُ مِنْهَا وَقَالَ الظَّالِمُونَ إِن تَتَّبِعُونَ إِلَّا رَجُلًا مَّسْحُورًا
“তারা বলে- “এ কেমন রসূল যে খাবার খায়, আর হাট-বাজারে চলাফেরা করে? তার কাছে ফেরেশতা অবতীর্ণ হয় না কেন যে তার সঙ্গে থাকত সতর্ককারী হয়ে? কিংবা তাকে ধন-ভাণ্ডার দেয়া হয় না কেন, অথবা তার জন্য একটা বাগান হয় না কেন যা থেকে সে আহার করত? যালিমরা বলে- “তোমরা তো এক যাদুগ্ৰস্ত লোকেরই অনুসরণ করছ।” (আল-ফুরকান ২৫ : ৭-৮)
তাদের এ ভিত্তিহীন ও অমূলক সন্দেহের উপযুক্ত জবাব দেয়া হয়েছে- অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ নবী-রাসূল প্রেরণের মহা উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সুমহান বাণীকে ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র, সবল-দুর্বল, ইতর-ভদ্র, স্বাধীন বা দাস নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষের নিকট পৌঁছে দেয়া। আর যদি ঐসব নাবী রাসূল খুব শান-শওকতপূর্ণ জীবন-যাপন করেন, পরিবেষ্টিত থাকেন অসংখ্য খাদেম ও পরিচারক দ্বারা যে রমক রাজা বাদশাদের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে তবে তো দুর্বল ও দরিদ্রশ্রেণীর জনগণ তার ধারে-কাছে পৌছতেও পারবে না এবং তার নবুওয়াত-রিসালত থেকে কোন উপকারও লাভ করতে পারবে না। অথচ এরাই হচ্ছে পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী। ফলে রিসালতের মহৎ উদ্দেশ্য ব্যহত তো হবেই, উপরন্তু উপযুক্ত উদ্দেশ্য পূরণ হবে না।
আর তারা যে মৃত্যুর পর পুনথানের বিষয় অস্বীকার করে তা তাদের এ বিষয়ে আশ্চর্যতাবোধ, বেমানান মনে হওয়া ও জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই তারা বলে,
(أَإِذَا مِتْنَا وَكُنَّا تُرَابًا وَعِظَامًا أَإِنَّا لَمَبْعُوثُونَ أَوَآبَاؤُنَا الْأَوَّلُونَ)
(ذَٰلِكَ رَجْعٌ بَعِيدٌ) وكانوا يقولون
আর আমাদের পূর্বপুরুষদেরকেও (উঠানো হবে)? আমরা যখন মরব এবং মাটি ও হাড়ে পরিণত হব, তখনো কি আমাদেরকে আবার জীবিত করে উঠানো হবে?” ( আস-স-ফফাত ৩৭ : ১৬-১৭) তারা এও বলে যে, “এ ফিরে যাওয়াটা তো বহু দূরের ব্যাপার।” (ক্ব-ফ ৫০ : ৩)
তারা নিতান্ত একটা অদ্ভুত বিষয় সাব্যস্ত করে বলে,
هَلْ نَدُلُّكُمْ عَلَىٰ رَجُلٍ يُنَبِّئُكُمْ إِذَا مُزِّقْتُمْ كُلَّ مُمَزَّقٍ إِنَّكُمْ لَفِي خَلْقٍ جَدِيدٍ أَفْتَرَىٰ عَلَى اللَّهِ كَذِبًا أَم بِهِ جِنَّةٌ
“কাফিরগণ বলে- তোমাদেরকে কি আমরা এমন একজন লোকের সন্ধান দেব যে তোমাদেরকে খবর দেয় যে, তোমরা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেলেও তোমাদেরকে নতুনভাবে সৃষ্টি করা হবে? সে আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যে বলে, না হয় সে পাগল। বস্তুতঃ যারা আখিরাতে বিশ্বাস করে না তারাই শাস্তি এবং সুদূর গুমরাহীতে পড়ে আছে।” (সাবা ৩৪ : ৭-৮) তাদের কেউ এ কবিতা চরণ আবৃত্তি করে-
أمؤيك ثم بغك ثم حَشرُ ** حديث لخرافة يا أم عمرو
“মৃত্যু বরণ, অতঃপর পুনঃজীবন লাভ, আবার একত্রিতকরণ! হে উম্মু আমরা এটা তো কল্পকাহিনী ব্যতিত আর কিছুই নয়”।
তাদের এ দাবীকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে খণ্ডন করা হয়েছে। বাস্তব অবস্থা এমন দেখা যায় যে, যালিম তার যুলুমের প্রতিফল না ভোগ করেই মারা যায়, অত্যাচারিত ব্যক্তি তার অত্যাচারের বদলা না পেয়েই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে, সৎকর্মশীল ব্যক্তি তার সৎকর্মের প্রতিদানপ্রাপ্ত হওয়ার পূর্বেই দুনিয়া ছেড়ে পরপারে চলে যায়, নিকৃষ্ট পাপী তার পাপের প্রতিফল আস্বাদন করার পূর্বেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়। এমতাবস্থায় যদি পুনরায় জীবন লাভ এবং মৃত্যুর পর উভয় দলের মধ্যে কোন সমতা বিধান করা না হয় বরং সৎকর্মশীল ব্যক্তির চেয়ে নিকৃষ্ট পাপী, অত্যাচারী বিনা শাস্তিতে মৃত্যুবরণ করার সৌভাগ্যলাভে ধন্য হয় তবে তো এমন দাঁড়ায় যে, তা সুস্থ বিবেক তা কক্ষনোই সমর্থন করে না করতে পারে না। আর আল্লাহ তা’আলাও তার এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডতে শুধু ফিতনা ফাসাদের আখড়ায় পরিণত করার নিমিত্তে পরিচালিত করছেন না। তাই আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন,
أَفَنَجْعَلُ الْمُسْلِمِينَ كَالْمُجْرِمِينَ مَا لَكُمْ كَيْفَ تَحْكُمُونَ
“আমি কি আত্মসমর্পণকারীদেরকে অপরাধীদের মত গণ্য করব? তোমাদের কী হয়েছে, তোমরা কেমনভাবে বিচার করে সিদ্ধান্ত দিচ্ছ?” (আল-কালাম ৬৮ : ৩৫,৩৬)
أَمْ نَجْعَلُ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ كَالْمُفْسِدِينَ فِي الْأَرْضِ أَمْ نَجْعَلُ الْمُتَّقِينَ كَالْفُجَّارِ
“যারা ঈমান আনে আর সৎ কাজ করে তাদেরকে কি আমি ওদের মত করব যারা দুনিয়াতে ফাসাদ সৃষ্টি করে? মুত্তাকীদের কি আমি অপরাধীদের মত গণ্য করব?” (স্ব-দ ৩৮: ২৮)
أَمْ حَسِبَ الَّذِينَ اجْتَرَحُوا السَّيِّئَاتِ أَن نَّجْعَلَهُمْ كَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ سَوَاءً مَّحْيَاهُمْ وَمَمَاتُهُمْ سَاءَ مَا يَحْكُمُونَ
“যার অন্যায় কাজ করে তারা কি এ কথা ভেবে নিয়েছে যে, আমি তাদেরকে আর ঈমান গ্রহণকারী সৎকর্মশীলদেরকে সমান গণ্য করব যার ফলে তাদের উভয় দলের জীবন ও মৃত্যু সমান হয়ে যাবে? কতই না মন্দ তাদের ফায়সালা!” (আল-জাসিয়াহ ৪৫ : ২১)
তাদের মস্তিষ্ক-বিবেক মৃত্যুর পুনরায় জীবন লাভ করারে অসম্ভব মনে করে এর প্রতিবাদে আল্লাহ বলেন,
أَأَنتُمْ أَشَدُّ خَلْقًا أَمِ السَّمَاءُ بَنَاهَا
“তোমাদের সৃষ্টি বেশি কঠিন না আকাশের? তিনি তো সেটা সৃষ্টি করেছেন।” (আন-নাযিআত ৭৯ – ২৭)
أَوَلَمْ يَرَوْا أَنَّ اللَّهَ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَلَمْ يَعْيَ بِخَلْقِهِنَّ بِقَادِرٍ عَلَىٰ أَن يُحْيِيَ الْمَوْتَىٰ بَلَىٰ إِنَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
“তারা কি দেখে না যে আল্লাহ, যিনি আকাশ ও যমীন সৃষ্টি করেছেন আর ওগুলোর সৃষ্টিতে তিনি ক্লান্ত হননি, তিনি মৃতদেরকে জীবন দিতে সক্ষম? নিঃসন্দেহে তিনি সকল বিষয়ের উপর ক্ষমতাবান।” (আল-আহকাফ ৪৬ : ৩৩)
وَلَقَدْ عَلِمْتُمُ النَّشْأَةَ الْأُولَىٰ فَلَوْلَا تَذَكَّرُونَ
“তোমরা তোমাদের প্রথম সৃষ্টি সম্বন্ধে অবশ্যই জান তাহলে (আল্লাহ যে তোমাদেরকে পুনরায় সৃষ্টি করতে সক্ষম এ কথা) তোমরা অনুধাবন কর না কেন?” (আল-ওয়াকিয়াহ ৫৬ : ৬২)
বিবেক-বিবেচনা ও প্রচলিত কথা হলো, মৃত্যুর পর পুনঃজীবন দান, (أَهْوَنُ عَلَيْهِ) “এটা তার জন্য অতি সহজ।” (আর-রূম ৩০ : ২৭)
তিনি আরো বলেন, كَمَا بَدَأْنَا أَوَّلَ خَلْقٍ نُّعِيدُهُ “যেভাবে আমি সৃষ্টির সূচনা করেছিলাম, সেভাবে পুনরায় সৃষ্টি করবো।” (আল-আম্বিয়া ২১ : ১০৪)
আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন, (أَفَعَيِينَا بِالْخَلْقِ الْأَوَّلِ) “আমি কি প্রথমবার সৃষ্টি করেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।” (ক্ব-ফ ৫০ : ১৫)
এভাবে একের পর এক তাদের সন্দেহের জবাব দেয়া হয়েছে এমন প্রজ্ঞাপূর্ণভাবে ও গভীর দৃষ্টিকোণ থেকে যা প্রত্যেক চিন্তাশীল ও প্রশস্ত জ্ঞানের অধিকারীদের তৃপ্তিদান করেছে। কিন্তু মুশরিকদের উদ্দেশ্য তো কেবল অহংকার-বড়ত্ব প্রকাশ করা এবং আল্লাহর জমীনে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করে তাদের মতামতকে বিশ্ববাসীর উপর চাপিয়ে দেয়া। ফলে তারা তাদের অবাধ্যতার উপরই অটল থাকলো।
ফুটনোটঃ
তৃতীয় পন্থা : অতীতকালের ঘটনাবলী এবং উপাখ্যান সমূহ এবং কুরআন কারীমে বর্ণিত বিষয়াদির মধ্যে অর্থহীন বাগড়া বা প্রতিদ্বন্দ্বীতার ধূম্রজাল সৃষ্টি করে জনমনে ধাঁধার সৃষ্টি করা এবং মুক্ত চিন্তা-ভাবনার সুযোগ না দেয়া (الْحِيْلُوْلَةُ بَيْنَ النَّاسِ وَبَيْنَ سِمَاعِهِمْ الْقُرْآن, وَمُعَارَضَتُهُ بِأَسَاطِيْرِ الْأَوَّلِيْنَ):
উপযুক্ত সন্দেহের বশবর্তী হয়ে মুশরিকগণ মানুষদেরকে তাদের সাধ্যমত কুরআন ও ইসলামের দাওয়াতের কথা শ্রবণ করতে বাধা প্রদান করতো। তারা যখন দেখতে যে, নাবী (সাঃ) লোকেদেরকে দীনের পথে আহবান করছে বা সালাত আদায় করছে, কুরআন তেলাওয়াত করছে তখন তারা মানুষদেরকে সেখান হতে তাড়িয়ে দিত, হৈচৈ-হৈ-হুল্লোড়, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, হট্টগোল পাকিয়ে দিত, গান গাইতো এবং নানা খেল-তামাশায় মেতে উঠত। এ বিষয়ে কুরআনের বাণী,
وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لَا تَسْمَعُوا لِهَٰذَا الْقُرْآنِ وَالْغَوْا فِيهِ لَعَلَّكُمْ تَغْلِبُونَ
“কাফিররা বলে- এ কুরআন শুনো না, আর তা পড়ার কালে শোরগোল কর যাতে তোমরা বিজয়ী হতে পার।” (হা-মীম সাজদাহ ৪১ : ২৬)
অবস্থা এমন করে ফেলতো যে, নবী (সাঃ) সেখানে আর লোকেদের কুরআন তেলাওয়াত শোনাতে পারতেন না। এ অবস্থা পঞ্চম নবুওয়াতী বর্ষের শেষ অবধি চলে। অনেক সময় রাস্তাঘাটে তাঁর তেলাওয়াত করার উদ্দেশ্য না থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ করে মুশরিকরা এরকম হট্টগোল বাধাত।
প্রসঙ্গক্রমে এখানে নাযর বিন হারিসের ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। সে ছিল কুরাইশদের মধ্যে অন্যতম শয়তান। নযর বিন হারিস একদা হীরাহ চলে গেলেন। সেখানে রাজা-বাদশাহদের ঘটনাবলী, ইরানের বিখ্যাত বীর রুস্তম ও প্রাচীন গ্ৰীক সম্রাট আলেকজান্ডারের কাহিনী শিখলেন। এ সব শেখার পর তিনি মক্কায় প্রত্যাবর্তন করলেন। ঘটনাক্রমে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন কোন জায়গায় আল্লাহর নির্দেশাবলী নিয়ে আলোচনা করতেন এবং আল্লাহর আদেশ অমান্য করলে জাহান্নামের ভয়াবহ আযাব সম্পর্কে ভয় প্রদর্শন করতেন তখন সেই ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত হয়ে বলতেন, ‘আল্লাহর শপথ হে কুরাইশগণ! আমার কথা মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর কথার চেয়ে উত্তম। এরপর তিনি পারস্য সম্রাটদের, রুস্তম এবং সেকান্দার বাদশাহর (আলেকজান্ডার) কাহিনী শোনাতে আরম্ভ করতেন এবং বলতেন, বল, কোনদিক দিয়ে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর কথা আমার কথার চেয়ে উত্তম।[1]
ইবনে আব্বাসের বর্ণনা সূত্রে এটাও জানা যায় যে, ইসলাম বৈরিতার চরম পর্যায়ের ব্যবস্থা হিসেবে নাযর একাধিক ক্রীতদাসী রেখেছিলেন। যখন তিনি জানতে পারতেন যে, কোন লোক ইসলাম গ্রহণের ইচ্ছে করছে তখন সেই লোকের প্রতি এক ক্রীতদাসীকে নিয়োজিত করে দিতেন। ক্রীতদাসীকে বলতো তুমি তাকে খাওয়া দাওয়া করাও এবং তার মনোরঞ্জনের জন্য গীত গাও, বাদ্য বাজাও। মুহাম্মাদ যে বিষয়ের প্রতি আহবান করছে এটা তার চেয়ে উত্তম।[2] এ প্রসঙ্গে কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হয়েছে :
وَمِنَ النَّاسِ مَن يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَن سَبِيلِ اللَّهِ
‘কিছু মানুষ আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করার উদ্দেশে অজ্ঞতাবশত অবান্তর কথাবার্তা ক্রয় করে আর আল্লাহর পথকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে।’ (লুক্বমান ৩১ :৬)
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ২৯৯-৩০০ পৃঃ, ৩৫৮ পূঃ । শাইখ আবদুল্লাহ মুখতাসারুস সীরাহ পৃঃ ১১৭-১১৮।
[2] ফাতহুল কাদীর, ইমাম শাওকানী, ৪র্থ খণ্ড ২৩৬ পৃঃ ও অন্যান্য তাফসীর গ্রন্থসমূহ।
অন্যায় অত্যাচার (الْاِضْطِهَادَاتُ) :
নবুওয়তের চতুর্থ বছরে যখন প্রথমবার সর্ব সাধারণের নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করা হল, তখন মুশরিকগণ তা প্রতিহত করার কৌশল হিসেবে ঐ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন যা ইতোপূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে। এ কৌশল কার্যকর করার ব্যাপারে তাঁরা ধীরে চলার নীতি অবলম্বন করে অল্প অল্প করে অগ্রসর হতে থাকেন এবং এভাবে এক মাসের বেশী সময় অতিবাহিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাঁরা কোন প্রকার অন্যায় অত্যাচার আরম্ভ করেন নি। কিন্তু তাঁরা যখন এটা বুঝতে পারলেন যে, তাঁদের ঐ কৌশল ও ব্যবস্থাপনা ইসলামী আন্দোলনের ব্যাপ্তিলাভের পথে তেমন কার্যকর হচ্ছে না, তখন তাঁরা সকলে পুনরায় এক আলোচনা চক্রে মিলিত হন এবং মুসলমানদের শাস্তি প্রদান ও তাদেরকে ইসলাম থেকে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রত্যেক গোত্রপতি তার গোত্রের ইসলাম গ্রহণকারীদের শাস্তি প্রদান করা শুরু করে দিল। অধিকন্তু ঈমান আনয়নকারী দাস-দাসীদের উপর তারা অতিরিক্ত কাজের বোঝা চাপিয়ে দিল।
স্বাভাবিকভাবেই আরবের নেতা ও গোত্রপতিদের অধীনে অনেক ইতর ও নিম্নশ্রেণীর লোকজন থাকতো। এসব লোকেদের তারা তাদের ইচ্ছেমত পরিচালনা করতো। এদের মধ্যে যারা মুসলামান হতো তাদের উপর তারা চড়াও হতো। বিশেষ করে তাদের মধ্যে যারা দরিদ্র তাদের উপর অত্যাচারের স্টীমরোলার চালাতো। তারা তাদের শরীর থেকে চামড়া ছিলে ফেলাসহ এমন সব পাশবিক আচরণ করতে যা পাষাণ হৃদয় ব্যক্তিটিও প্রত্যক্ষ করে অস্থির কিংবা বিচলিত না হয়ে পারতেন না।
আবূ জাহল যখন কোন সম্ভ্রান্ত বা শক্তিধর ব্যক্তির মুসলিম হওয়ার কথা শুনত তখন সে তাকে ন্যায়-অন্যায় বলে গালি গালাজ করত, অপমান-অপদস্থ করত এবং ধন-সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি করবে বলে ভয় দেখাত। জ্ঞাতি গোষ্ঠীর যদি কোন দুর্বল ব্যক্তি মুসলিম হতো তাহলে তাকে সে অত্যন্ত নির্দয়ভাবে মারধোর করত এবং মারধোর করার জন্য অন্যদের প্ররোচিত করত।[1]
‘উসমান বিন আফফানের চাচা তাকে খেজুর পাতার চাটাইয়ের মধ্যে জড়িয়ে রেখে নীচ থেকে আগুন লাগিয়ে ধোঁয়া দিত’।[2]
মুসআব বিন উমায়ের (রা.)-এর মা যখন তার ইসলাম গ্রহণের খবর পেল তখন সে তার খানা পানি (আহারাদি) বন্ধ করে দিল এবং তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিল। প্রথম জীবনে তিনি আরাম আয়েশ ও সুখস্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে লালিত-পালিত হয়েছিলেন। কিন্তু ইসলাম গ্রহণের পর তিনি এতই কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন যে সর্পের গাত্র থেকে খুলে পড়া খোলসের মতো তার শরীরের চামড়া খুলে খুলে পড়ত।[3]
বিলাল, উমাইয়া বিন খালাফ জুমাহীর ক্রীতদাস ছিলেন। তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করায় উমাইয়া তার গলায় দড়ি বেঁধে ছোকরাদের হাতে ধরিয়ে দিত। তারা সেই দড়ি ধরে তাঁকে পথে প্রান্তরে টেনে হিচড়ে নিয়ে বেড়াত। এমনকি টানাটানির ফলে তার গলায় দড়ির দাগ বসে যেত। উমাইয়া স্বয়ং হাত পা বেঁধে তাকে প্রহার করত এবং প্রখর রোদে বসিয়ে রাখত। তাকে খানা পানি না দিয়ে ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত রাখত। এ সবের চেয়েও অনেক বেশী কঠিন ও কষ্টকর হতো তখন যখন দুপুর বেলা প্রখর রৌদ্রের সময় কংকর ও বালি আগুনের মতো উত্তপ্ত হয়ে উঠত এবং তাকে উত্তপ্ত বালির উপর শুইয়ে দিয়ে তার বুকের উপর পাথর চাপা দেয়া হতো। তারপর বলত আল্লাহর শপথ তুই এভাবেই শুয়ে থাকবি। তারপর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বি। অথবা মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর সঙ্গে কুফরী করবি। বিলাল(রাঃ) ঐ অবস্থাতেই বলতেন, ‘আহাদ, আহাদ”। (অর্থ আল্লাহ এক, আল্লাহ এক)। একদিন বিলাল (রা.) এমনভাবে এক দুঃসহ অবস্থার মধ্যে নিপতিত ছিলেন তখন আবূ বাকর সিদিক (রা.) সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি বিলাল (রা.)-কে এক কালোদাসের বিনিময়ে এবং বলা হয়েছে যে, দু’শত দেহরাম (৭৩৫ গ্রাম রুপা) অথবা দু’শ আশি দিরহামের (১ কেজিরও বেশী রুপা) বিনিময়ে ক্রয় করে মুক্ত করে দেন।[4]
আম্মার বিন ইয়াসির বনু মাখযুমের ক্রীতদাস ছিলেন। তাঁর পিতার নাম ইয়াসির এবং মাতার নাম সুমাইয়া। তিনি এবং তাঁর পিতামাতা সকলে একই সঙ্গে ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের কারণে তাদের উপর কেয়ামতের আযাব ভেঙ্গে পড়ে। দুপুর বেলা প্রখর রোদ্র তাপে মরুভূমির বালুকণারাশি এবং কংকর রাশি যখন আগুণের মতো উত্তপ্ত থাকত তখন আবূ জাহলের নেতৃত্বে মুশরিকগণ তাদেরকে নিয়ে গিয়ে সেই উত্তপ্ত বালি এবং কংকরের উপর শুইয়ে দিয়ে শাস্তি দিত। এক দিবস তাদেরকে যখন সেভাবে শাস্তি দেয়া হচ্ছিল এমন সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাদেরকে লক্ষ্য করে তিনি বললেন, “হে ইয়াসিরের বংশধর ধৈর্য্য ধারণ করো, তোমাদের স্থান জান্নাতে’। অতঃপর শাস্তি চলা অবস্থায় ইয়াসির মৃত্যুবরণ করেন।
পাষণ্ড আবূ জাহল আম্মারের মা সুমাইয়ার নারী অঙ্গে বর্শ বিদ্ধ করে। অতঃপর তিনি মারা যান। মুসলিম মহিলাদের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রথম শহীদ। সুমাইয়া বিনতে খাইয়াত ছিলেন আবূ হুজাইফাহ বিন আব্দুল্লাহ বিন উমার বিন মাখযুমের ক্রীতদাসী। সুমাইয়া ছিলেন অতি বৃদ্ধা এবং দুর্বল।
‘আম্মারের উপর নির্যাতন চলতে থাকে। কখনো তাকে প্রখর রোদে শুইয়ে দিয়ে তার বুকে লাল পাথর চাপা দেয়া হতো, কখনো বা পানিতে ডুবিয়ে শাস্তি দেয়া হতো। মুশরিকগণ তাকে বলত, যতক্ষণ না তুমি মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে গালমন্দ দেবে এবং আমাদের উপাস্য লাত এবং উযযা সম্পর্কে উত্তম কথা না বলবে ততক্ষণ তোমাকে অব্যাহতি দেয়া হবে না। নেহাৎ নিরূপায় হয়ে ‘আম্মার (রা.) তাদের কথা মেনে নিলেন।[5] তারপর নাবী করীমের দরবারে উপস্থিত হয়ে কান্না বিজড়িত কণ্ঠে সবিস্তারে ঘটনা বর্ণনা করে আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। এ প্রেক্ষিতে এ আয়াত কারমা অবতীর্ণ হল :
مَن كَفَرَ بِاللَّهِ مِن بَعْدِ إِيمَانِهِ إِلَّا مَنْ أُكْرِهَ وَقَلْبُهُ مُطْمَئِنٌّ بِالْإِيمَانِ
‘কোন ব্যক্তি তার ঈমান গ্রহণের পর আল্লাহকে অবিশ্বাস করলে এবং কুফরীর জন্য তার হৃদয় খুলে দিলে তার উপর আল্লাহর গযব পতিত হবে আর তার জন্য আছে মহা শাস্তি, তবে তার জন্য নয় যাকে (কুফরীর জন্য) বাধ্য করা হয় অথচ তার দিল ঈমানের উপর অবিচল থাকে। (আন-নাহল ১৬ : ১০৬)
আবূ ফুকাইহাহ (রা.) বনু আব্বাস গোত্রের দাস ছিলেন। সে ছিল আযদীদের অন্তর্ভুক্ত। তাঁর অপর নাম ছিল আফলাহ। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার কারণে তাঁর মালিক পায়ে লোহার শিকল বেঁধে, শরীর হতে কাপড় খুলে নিয়ে তাকে কংকরময় পথ ও প্রান্তরে টেনে নিয়ে বেড়াতেন।[6] অতঃপর তার পিঠের উপর ভারী পাথর চাপা দিত ফলে তিনি নড়াচড়া করতে পারতেন না। এভাবে শাস্তি দেয়ার এক পর্যায়ে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এমন শাস্তি চলছিল নিয়মিতভাবে। অতঃপর তিনি হাবশায় হিজরতকারী দ্বিতীয় কাফেলার সাথে তিনি হিজরত করেন। একদা তারা তার পায়ে রশি দিয়ে বেঁধে টেনে নিয়ে উত্তপ্ত ময়দানে নিয়ে তার গলায় ফাঁস লাগালো। এতে কাফিররা ধারণা করলো যে, আবূ ফুকাইহাহ মারা গেছে। ইত্যবসরে আবূ বকর (রা.) সে পথ দিয়ে যাওয়ার সময় তাকে ক্রয় করে আল্লাহর ওয়াস্তে আযাদ করে দিলেন।
খাব্বাব বিন আরাত খুযা’আহ গোত্রের উম্মু আনমার সিবা’ নাম্নী এক মহিলার দাস ছিলেন। খাব্বাব বিন আরাত ছিলেন কর্মকার। ইসলাম গ্রহণের পর উম্মু আনমার তাকে আগুন দিয়ে শাস্তি দিত। উত্তপ্ত লোহা দিয়ে তার পিঠ ও মাথায় সেঁক দিত যাতে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর দীনকে অস্বীকার করে। কিন্তু এতে তার ঈমান ও ইসলামে টিকে থাকার সংকল্প আরো বৃদ্ধি পায়। আর মুশরিকগণ তার উপর নানাধরণের নির্যাতন চালাতেন। কখনো বা খুব শক্ত হাতে চুল টানাটানি করে নিষ্পেষণ চালাতেন। কখনো বা আবার খুব শক্ত হাতে তার গ্রীবা ধরে মুচড়ে দিতেন। এক সময় তাকে কাঠের জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর শুইয়ে দিয়ে তার বুকের উপর পাথর চাপা দেয়া হয়েছিল যাতে তিনি উঠতে না পারেন। এতে তার পৃষ্ঠদেশ পুড়ে গিয়ে ধবল কুষ্ঠের মতো সাদা হয়ে গিয়েছিল।[7]
রুমী কৃতদাসী যিন্নীরাহ[8] ইসলাম গ্রহণ করলে এবং আল্লাহর উপর আনার কারণে তাকে শাস্তি দেয়া হয়। তাকে চোখে আঘাত করা হয় ফলে তিনি অন্ধ হয়ে যান। অন্ধ হওয়ার পরে তাকে বলা হলো তোমাকে লেগেছে। উত্তরে যিন্নীরাহ বললেন, আল্লাহর কসম! আমাকে লাত ও উযযার আসর লাগে নি। বরং এটা আল্লাহর একটা অনুগ্রহ এবং আল্লাহ তা’আলার ইচ্ছায় তা ভাল হয়ে যাবে। অতঃপর একদিন সকালে দেখা গেল যে, আল্লাহ তা’আলা তার চক্ষু ভাল করে দিয়েছেন। তার এ অবস্থা দর্শন করে কুরাইশরা বলল, এটা মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর একটা যাদু।
বনু যুহরার কৃতদাসী উম্মু ‘উবায়েস ইসলাম গ্রহণ করার কারণে মুশরিকগণ তাকে শাস্তি দিত; বিশেষ করে তার মনীব আসওয়াদ বিন ‘আবদে ইয়াগুস খুব শাস্তি দিত। সে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ঘোরতর শক্র এবং ঠাট্টা বিদ্রুপকারীদের অন্যতম ছিল।
বনু আদী গোত্রের এক পরিবার বনু মুয়াম্মিলের এক দাসীর মুসলিম হওয়ার সংবাদে ‘উমার বিন খাত্তাব তাকে এতই প্রহার করেছিলেন যে, তিনি নিজেই ক্লান্ত হয়ে গিয়ে এ বলে ক্ষান্ত হয়েছিলেন, ‘মানবত্বের কোন কারণে নয় বরং খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি বলে শাস্তি দেয়া থেকে আপাততঃ তোমাকে রেহাই দিলাম। অতঃপর বলতেন, তোমার সাথে তোমার মনিব এমন আচরণই করবে।[9] ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিল উমার (রা.) ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার পূর্বে।
নাহদিয়া এবং তার কন্যা উম্মু উবায়েস সকলেই দাসী ছিলেন। এঁরা উভয়েই বনু আব্দুদ্দার গোত্রের। ইসলাম গ্রহণের পর এরা সকলেই মুশরিকদের হাতে নানাভাবে নির্যাতিত ও নিগৃহীত হওয়ার ফলে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট ও জ্বালা-যন্ত্রণার সম্মুখীন হন।
ইসলাম গ্রহণ করার কারণে যে সব দাসকে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের সম্মখীন হতে হয় তাদের মধ্যে আমির বিন ফুরায়রাও একজন। তাকে এতই শাস্তি দেয়া হয় যে, তার অনুভূতি শক্তি লোপ পায় এবং তিনি কি বলতেন নিজেই তা বুঝতে পারতেন না।
অবশেষে আবূ বাকর (রা.) দাস-দাসীগুলোকেও ক্রয় করে নেয়ার পর মুক্ত করে দেন।[10] এতে তাঁর পিতা আবূ কুহাফাহ তাঁকে ভর্ত্সনা করে বললেন, আমি দেখছি যে, তুমি দুর্বল দাস-দাসীদের মুক্ত করে দিচ্ছ। এর পর যদি তুমি কোন প্রহৃত ব্যক্তিকে মুক্ত কর তবে আমি তোমাকে বাধা প্রদান করবো। পিতার এ কথা শ্রবণ করত আবূ বাকর (রা.) বললেন, আমি তো কেবল তাদেরকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্যই মুক্ত করি। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে আল্লাহ তা’আলা আবূ বাকর (রা.)-এর প্রশংসা এবং তাঁর শক্রদের নিন্দা জ্ঞাপন করে আয়াত নাযিল করেন। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, فَأَنذَرْتُكُمْ نَارًا تَلَظَّىٰ لَا يَصْلَاهَا إِلَّا الْأَشْقَى الَّذِي كَذَّبَ وَتَوَلَّىٰ
“কাজেই আমি তোমাদেরকে দাউ দাউ ক’রে জ্বলা আগুন সম্পর্কে সতর্ক করে দিচ্ছি। – চরম হতভাগা ছাড়া কেউ তাতে প্রবেশ করবে না। – যে অস্বীকার করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়”। (সূরাহ আল-লাইল ৯২ : ১৪-১৬)
উপর্যুক্ত আয়াতে ধমকী উমাইয়া বিন খালাফ ও তার মতো আচরণকারীদের উদ্দেশ্য করে দেয়া হয়েছে।
وَسَيُجَنَّبُهَا الْأَتْقَى الَّذِي يُؤْتِي مَالَهُ يَتَزَكَّىٰ وَمَا لِأَحَدٍ عِندَهُ مِن نِّعْمَةٍ تُجْزَىٰ إِلَّا ابْتِغَاءَ وَجْهِ رَبِّهِ الْأَعْلَىٰ وَلَسَوْفَ يَرْضَىٰ
“তাথেকে দূরে রাখা হবে এমন ব্যক্তিকে যে আল্লাহকে খুব বেশি ভয় করে, – যে পবিত্রতা অর্জনের উদ্দেশ্যে নিজের ধন-সম্পদ দান করে, – (সে দান করে) তার প্রতি কারো অনুগ্রহের প্রতিদান হিসেবে নয়, – একমাত্র তার মহান প্রতিপালকের চেহারা (সন্তোষ) লাভের আশায়। – সে অবশ্যই অতি শীঘ্র (আল্লাহর নিমাত পেয়ে) সন্তুষ্ট হয়ে যাবে।” (সূরাহ আল-লাইল ৯২ : ১৭-২১)
উপর্যুক্ত আয়াতের উদ্দিষ্ট ব্যক্তি হলেন, আবূ বাকর সিদীক (রা.)।
ইসলাম গ্রহণ করার কারণে আবূ বকর (রা.)-কেও শাস্তি পেতে হয়েছে। তাঁকে এবং তাঁর সাথে ত্বালহাহ বিন উবাইদুল্লাহকে সালাত থেকে বিরত রাখতে এবং দীন থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য নওফেল বিন খুওয়াইলিদ একই রশিতে শক্ত করে বোঁধে রাখতো। কিন্তু তাঁরা কেউই তাঁর কথায় কর্ণপাত করেন নি। তাঁরা উভয়ে সর্বদা এক সাথে সালাত আদায় করতেন। এজন্য তাঁদেরকে ‘কারীনাইন’ (দু’ সঙ্গী) বলা হয়। আবার এও বলা হয় যে, তাদের সাথে এরকম করার কারণ, ‘উসমান বিন উবাইদুল্লাহ- ত্বালহা বিন উবাইদুল্লাহর ভাই।
প্রকৃত অবস্থা ছিল মুশরিকগণ যখন কারো মুসলিম হওয়ার সংবাদ পেতেন তখন তাদের কষ্ট দেয়ার ব্যাপারে তারা উদ্বাহু এবং বদ্ধ পরিকর হয়ে যেতেন। ইসলাম গ্রহণ করার কারণে দরিদ্র মুসলমানদেরকে শাস্তি দেয়া ছিল তাদের নিকট একটি মামুলি ব্যাপার। বিশেষ করে দাস-দাসীদের শাস্তি দিতে কোন পরওয়াই করতো না। কেননা তাদের শাস্তি দেয়া কারণে কেউ ক্রুদ্ধও হতো না আর তাদের শাস্তি লাঘবের জন্য কেউ এগিয়েও আসতো না। বরং তাদের মনিবেরাই স্বয়ং শাস্তি প্রদান করতো। তবে কোন বড় ও সম্ভান্ত ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করলে তাদের শাস্তি দেয়া ছিল কঠিন ব্যাপার। বিশেষ করে তারা যখন তাদের গোত্রের সম্মানী ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি হতেন। এসব সম্ভ্রান্ত লোকের উপর মুশরিকরা সামান্যই চড়াও হতো যদিও এদেরকেই তারা দীনের ক্ষেত্রে বেশি ভয় করতো।
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ৩২০ পৃঃ।
[2] রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খণ্ড ৭৫ পৃঃ।
[3] রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খণ্ড ৫৮ পূঃ ও তালকীহু ফুহুমি আহলিল আসার।
[4] রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খণ্ড ৫৭ পৃঃ এবং তালকীহুল ফোহুম ৬১ পৃঃ ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ৩১৭-৩১৮ পৃ:।
[5] ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ৩১৯-৩২০ পূঃ এবং মুহাম্মাদ গাজ্জালী রচিত ফিকহুস সীরাহ ৮২ পৃঃ আওফী ইবনে আব্বাস হতে কিছু কিছু অংশ বর্ণনা করেছেন। ইবনে কাসীর, উপরোক্ত আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য।
[6] রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খণ্ড ৫৭ পৃঃ, এ জাযুত তানখীল ৫৩ পৃঃ হতে।
[7] রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খণ্ড ৫৭ পৃঃ, তালকীহুল ফোহুম ৬০ পৃঃ।
[8] যিন্নীরাহ মিসকীনার ওযনে অর্থাৎ ‘যে’ কে যের এবং নুনকে যের এবং তাশদীদ।
[9] রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খণ্ড ৫৭ পৃঃ, ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ৩১৯ পৃঃ।
[10] ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ৩১৮-৩১৯ পৃঃ।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ব্যাপারে মুশরিকদের অবস্থান (موقف المشتكين من رسول الله):
তাদের প্রকৃত সমস্যা ছিল রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে নিয়ে। কেননা ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন। বংশ মর্যাদার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন বৈশিষ্ট্যময় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। শত্রু-মিত্র পক্ষের কেউ তার নিকট আগমন করলে তাকে মান-মর্যাদা বা ইজ্জতের ভূষণে ভূষিত হয়েই সেখানে আগমন করতে হতো। কোন দুষ্টদুরাচার কিংবা অনাচারীর পক্ষে তার সম্মুখে কোন অশ্লীল বা জঘন্য কাজ করার মতো ধৃষ্টতা প্রদর্শন কখনই সম্ভব হতো না ।
নাবী কারীম (সাঃ)-এর উপর্যুক্ত গুণাবলী এবং ব্যক্তি বৈশিষ্ট্য প্রসূত প্রভাব প্রতিপত্তির সঙ্গে সংযুক্ত হল চাচা আবূ ত্বালিবের সাহায্য সহযোগিতা ও সমর্থন। ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত উভয় ক্ষেত্রেই আবূ ত্বালিব এত মর্যাদাসম্পন্ন এবং প্রভাব প্রতিপত্তিশালী ছিলেন যে, তার কথা অমান্য করা কিংবা তার গৃহীত সিদ্ধান্তের উপর হস্তক্ষেপ করার মতো দুঃসাহসিকতা কারোরই ছিল না। এমন এক অবস্থার প্রেক্ষাপটে অন্যান্য কুরাইশগণকে কঠিন দুশ্চিন্তা, এবং টানা পোড়নের মধ্যে নিপতিত হতে হল। সাত-পাঁচ এ জাতীয় নানা কথা নানা প্রশ্ন এবং নানা যুক্তিতর্কের পসরা নিয়ে তারা আবূ ত্বালিবের নিকট যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। তবে তা খুব হিকমত ও নম্রতার সাথে এবং মনে মনে চ্যালেঞ্জ ও ভীতিপ্রদর্শনের আকাঙ্ক্ষা গোপন করে যাতে করে তাদের বক্তব্য আবূ ত্বালিব খুব সহজেই মেনে নেয়।
আবূ ত্বালিব সমীপে কুরাইশ প্রতিনিধি দল (وفد قريش الى ابى طالب):
ইবনে ইসহাক্ব বলেন যে, কুরাইশ গোত্রের কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি একত্র হয়ে আবূ ত্বালিবের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘হে আবূ ত্বালিব, আপনার ভ্রাতুষ্পুত্র আমাদের দেব-দেবীগণকে গালিগালাজ করছেন, আমাদের ধর্মের নিন্দা করছেন, আমাদেরকে জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিচার-বিবেকহীন, মূৰ্খ বলছেন এবং আমাদের পূর্বপুরুষগণকে ধর্মভ্ৰষ্ট বলছেন। অতএব, হয় আপনি তাকে এ জাতীয় কাজ কর্ম থেকে বিরত রাখুন নতুবা আমাদের এবং তার মধ্য থেকে আপনি দূরে সরে যান। কারণ, আপনিও আমাদের মতই তার বক্তব্য মতে ভিন্নধর্মের অনুসারী। তার ব্যাপারে আমরাই আপনার জন্য যথেষ্ট হব।
এর জবাবে আবূ ত্বালিব অত্যন্ত ঠাণ্ডা মেজাঙ্গে পাঁচরকম কথা-বার্তা বলে তাদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বিদায় করলেন। এ প্রেক্ষিতে তারা ফিরে চলে গেলেন। এ দিকে রাসূলুল্লাহ পূর্ণোদ্যমে তার প্রচার কাজ চালিয়ে যেতে থাকলেন। দীনের দায়োত প্রচার করতে থাকলেন এবং সেদিকে লোকেদেরকে আহ্বান জানাতে থাকলেন।[1]
এদিকে কুরাইশগণও বেশি দেরি করলেন না যখন দেখলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কাজ ও আল্লাহর পথে দাওয়াত পূর্ণামাত্রায় চালিয়ে যাচ্ছেনই, বরং তিনি তাঁর দাওয়াতী তৎপরতা আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন। নিরুপায় তারা পূর্বের চেয়ে আরো ক্রোধ ও গরম মেজাজ নিয়ে আবূ ত্বালিবের নিকট পুনরায় আগমন করলেন।
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ২৬৫ পৃ:।
আবূ ত্বালিবের প্রতি কুরাইশগণের ধমক ( قريش يهددون الى ابا طالب):
আবূ ত্বালিবের সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর কুরাইশ প্রধানগণ আবূ ত্বালিবের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, হে আবূ ত্বালিব! আপনি আমাদের মাঝে মান-মর্যাদার অধিকারী একজন বয়স্ক ব্যক্তি। আমরা ইতোপূর্বে আপনার নিকট আবেদন করেছিলাম যে আপনার ভ্রাতুষ্পুত্রকে আমাদের ধর্ম সম্পর্কে নিন্দাবাদ করা থেকে বিরত রাখুন। কিন্তু আপনি তা করেন নাই। আপনি মনে রাখবেন, আমরা এটা কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারছিনা যে আমাদের পিতা পিতামহ এবং পূর্ব পুরুষদের গালি-গালাজ করা হোক, আমাদের বিবেককে নির্বুদ্ধিতা বলে আখ্যায়িত করা হোক এবং আমাদের দেবদেবীর নিন্দা করা হোক। আমরা আবারও আপনাকে অনুরোধ করছি হয় আপনি তাকে সে সব থেকে নিবৃত্ত রাখুন, নচেৎ তামাদের দু’দলের মধ্যে এক দল ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ বিগ্রহ চলতেই থাকবে’।
কুরাইশ প্রধানগণের এমন কঠোর বাক্য বিনিময় এবং আস্ফালনে আবূ ত্বালিব অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়লেন। তিনি সেই মুহুর্তে তার কর্তব্য স্থির করতে না পেরে নাবী কারীম (সাঃ)-কে ডেকে পাঠালেন। চাচার আহবানে নাবী কারীম (সাঃ) সেখানে উপস্থিত হলে আবূ ত্বালিব তাঁর নিকট কুরাইশ প্রধানগণের আলোচনা এবং আচরণ সম্পর্কে সবিস্তার বর্ণনা করার পর তাকে লক্ষ্য করে বললেন, বাবা! একটু বিচার বিবেচনা করে কাজ করো। যে ভার বহন করার শক্তি আমার নেই সে ভার আমার উপর চাপিয়ে দিও না।’
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ধারণা করলেন, মানবকুলের মধ্যে তার একমাত্র আশ্রয়দাতা ও সহায় চাচাও বোধ হয় আজ থেকে তাঁর সঙ্গ পরিত্যাগ করলেন এবং তাকে সাহায্য দানের ব্যাপারে তিনিও বোধ হয় দুর্বল হয়ে পড়লেন। তিনি এটাও সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করলেন যে, আজ থেকে তিনি এক নিদারুণ সংকটে নিপতিত হতে চললেন। তবুও আল্লাহ তা’আলার উপর অবিচল আস্থা রেখে তিনি বললেন,
يا عم والله لو وضعوا الشمس في يميني والقمر في يساري على أن أترك هذا الأمر حتى يظهره الله أو أهلك فيه ما تركته
‘চাচাজান, আল্লাহর শপথ। যদি এরা আমার ডান হাতে সূর্য এবং বাম হাতে চাঁদ এনে দেয় তবুও শাশ্বত এ মহা সত্য প্রচার সংক্রান্ত আমার কর্তব্য থেকে এক মুহুর্তের জন্যও আমি বিচ্যুত হব না। এ মহামহিম কার্যে হয় আল্লাহ আমাকে জয়যুক্ত করবেন না হয় আমি ধ্বংস হয়ে যাব। কিন্তু চাচাজান! আপনি অবশ্যই জানবেন যে, মুহাম্মাদ (সাঃ) কখনই এ কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হবে না।
স্বজাতীয় এবং স্বগোত্রীয় লোকজনদের নির্বুদ্ধিতা, হঠকারিতা এবং পাপাচারে ব্যথিত-হৃদয় নাবী (সাঃ)-এর নয়নযুগলকে বাষ্পাচ্ছন্ন করে তুলল। তিনি সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করলেন যে ভবিষ্যতের দিনগুলো তার জন্য আরও কঠিন হবে এবং আরও ভয়াবহতা এবং কঠোরতার সঙ্গে তাকে মোকাবালা করে চলতে হবে। তার নয়ন যুগলে অশ্রু কিন্তু অন্তরে অদম্য সাহস। এমন এক মানসিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে তিনি চাচা আবূ ত্বালিবের সম্মুখ থেকে বেরিয়ে এলেন।
তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রের এ অসহায়ত্ব ও মানসিক অশান্তিতে আবূ ত্বালিবের প্রাণ কেঁদে উঠল। পরক্ষণেই তিনি তাকে পুনরায় ডেকে পাঠালেন। যখন নাবী কারীম (সাঃ) তার সম্মুখে উপস্থিত হলেন তখন তিনি তাকে সম্বোধন করে বললেন : ‘প্রিয়তম ভ্রাতুষ্পুত্র! নিৰ্দ্ধিধায় নিজ কর্তব্য পালন করে যাও। আল্লাহর কসম করে বলছি আমি কোন অবস্থাতেই তোমাকে পরিত্যাগ করব না।[1] তারপর তিনি নিম্নোক্ত কবিতার চরণগুগুলো আবৃত্তি করলেন :
والله لن يصلوا إليك تجنعيهم ** حتى أرَسُدّ في العراب دفيئا
فاصدع بأمرك ما عليك غضاضة ** وانهز وقرّ بذاك منك عيوكا
অর্থ : ‘আল্লাহ চান তো তারা স্বীয় দলবল নিয়ে কখনই তোমার নিকট পৌছতে পারবে না যতক্ষণ না আমি সমাহিত হয়ে যাব। তুমি তোমার দ্বীনী প্রচার-প্রচারণা কর্মকাণ্ড যথাসাধ্য চালিয়ে যাও তাতে কোন প্রকার বাধা বিপত্তি আসবে না। তুমি খুশি থাক এবং তোমাব চক্ষু পরিতৃপ্ত হোক।[2]
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ২৬৫-২৬৬পৃঃ।
[2] মুখতাসারুস সীরাহ পৃঃ ৬৮।
পুনরায় আবূ ত্বালিব সমীপে কুরাইশগণ (قريش بين يدى أبي طالب مرة أخرى):
বিগত দিবসের চড়া-কড়া কথা সত্ত্বেও কুরাইশগণ যখন দেখল যে মুহাম্মাদ (সাঃ) বিরত থাকা তো দূরের কথা, আরও জোরে শোরে প্রচার-প্রচারণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তখন এটা তাদের কাছে পরিস্কার হয়ে গেল যে, আবূ ত্বালিব মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে পরিত্যাগ করবেন না। এ ব্যাপারে তিনি কুরাইশগণ হতে পৃথক হয়ে যেতে এমনকি তাদের শত্রুতা ক্রয় করতেও প্রস্তুত রয়েছেন। কিন্তু তবুও ভ্রাতুষ্পুত্রকে ছাড়তে প্রস্তুত নয়। চড়া কড়া কথা বার্তা এবং যুদ্ধের হুমকি দিয়েও যখন তেমন কিছুই হল না তখন একদিন যুক্তি পরামর্শ করে অলীদ বিন মুগীরাহর সন্তান ওমারাহকে সঙ্গে নিয়ে আবূ ত্বালিবের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘হে আবূ ত্বালিব! এ হচ্ছে কুরাইশগণের মধ্যে সব চেয়ে সুন্দর এবং ধাৰ্মিক যুবক। আপনি একে পুত্ররূপে গ্রহণ করুন। এর শোনিতপাতের খেসারত এবং সাহয্যের আপনি অধিকারী হবেন। আপনি একে পুত্র হিসেবে গ্রহণ করে নিন। এ যুবক আজ হতে আপনার সন্তান বলে গণ্য হবে। এর পরিবর্তে আপনার ভ্রাতুষ্পুত্রকে আমাদের হাতে সমর্পণ করে দিন। সে আপনার ও আমাদের পিতা, পিতামহদের বিরোধিতা করছে, আমাদের জাতীয়তা, একতা এবং শৃঙ্খলা বিনষ্ট করছে এবং সকলের জ্ঞানবুদ্ধিকে নির্বুদ্ধিতার আবরণে আচ্ছাদিত করছে। তাঁকে হত্যা করা ছাড়া আমাদের গত্যন্ত র নেই। এক ব্যক্তির বিনিময়ে এক ব্যক্তিই যথেষ্ট’।
প্রত্যুত্তরে আবূ ত্বালিব বললেন, ‘তোমরা যে কথা বললে এর চেয়ে জঘন্য এবং অর্থহীন কথা আর কিছু হতে পারে কি? তোমরা তোমাদের সন্তান আমাকে এ উদ্দেশ্যে দিচ্ছ যে আমি তাকে খাইয়ে পরিয়ে লালন-পালন করব আর আমার সন্তানকে তোমাদের হাতে তুলে দিব এ উদ্দেশ্যে যে, তোমরা তাকে হত্যা করবে। আল্লাহর শপথ! কক্ষনোই এমনটি হতে পারবে না’।
এ প্রেক্ষিতে নওফাল বিন আবদে মানাফের পুত্র মুতয়িম বিন আদী বলল : ‘আল্লাহর কসম হে আবূ ত্বালিব! তোমার জ্ঞাতি গোষ্ঠির লোকজন তোমার সঙ্গে বিচার বিবেচনা সুলভ কথাবার্তা বলছে, কাজকর্মের যে ধারা পদ্ধতি তোমার জন্য বিপজ্জনক তা থেকে তোমাকে রক্ষার প্রচেষ্টাই করা হয়েছে। কিন্তু আমি যা দেখছি তাতে আমার মনে হচ্ছে যে, তুমি তাদের কোন কথাকেই তেমন আমল দিতে চাচ্ছনা’।
এর জবাবে আবূ ত্বালিব বললেন, ‘আল্লাহর কসম! তোমরা আমার সঙ্গে বিচার বিবেচনা প্রসূত কোন কথাবার্তাই বলো নি। বরং তোমরা আমার সঙ্গ পরিত্যাগ করে আমার বিরোধিতায় লিপ্ত হয়েছ এবং বিরুদ্ধবাদীদের সাহায্যার্থে কোমর বেঁধে লেগেছ। তবে ঠিক আছে তোমাদের যেটা করণীয় মনে করবে তাইতো করবে।[1]
কুরাইশগণ যখন এবারের আলোচনাতেও হতাশ হলেন এবং আবূ ত্বালিব রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে নিষেধ করতে ও আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়া বাধা প্রদান করারা ব্যাপারে একমত হলেন না। তখন কুরাইশগণ অগত্যা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে সরাসরি শত্রুতা পোষণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো।
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ২৬৬-২৬৭ পৃঃ।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে বিভিন্নমুখী শক্ৰতা (اعتداءات على رسول الله):
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দাওয়াতের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ার পর থেকে তার সম্মান-মর্যাদা প্রশ্নবিদ্ধ করতে থাকলো এবং তাদের কাছে বিষয়টা খুব কঠিন হয়ে গেল যে তাদের ধৈৰ্য্যের ভেঙ্গে গেল। তারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে শত্রুতার হাতকে প্রশস্ত করে দিল। ফলে তারা ঠাট্টা-বিদ্রুপ, উপহাস, সংশয়-সন্দেহ, বিশৃংখলা সৃষ্টি ইত্যাদি যাবতীয় প্রকার দুর্ব্যবহার শুরু করে দিল। প্রকৃতপক্ষে প্রথম থেকেই রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রতি আবূ লাহাবের দৃষ্টিভঙ্গ ছিল অত্যন্ত কঠোর ও কঠিন। সে ছিল বনু হাশিমের অন্যতম নেতা। সে অন্যান্যদের চেয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)এর ব্যাপারে বেশি ভীত ছিল। সে ও তার স্ত্রী ছিল ইসলামের গোড়ার শত্রু। এমনকি অন্যান্য কুরাইশগণ যখন ঘুণাক্ষরেও নাবী কারীম (সাঃ)-কে নির্যাতন করার চিন্তা-ভাবনা করেন নি তখনে আবূ লাহাবের আচরণ ছিল অত্যন্ত মারমুখী। বনু হাশিমের বৈঠকে এবং সাফা পর্বতের নিকট তিনি যা কিছু করেছিলেন তা ইতোপূর্বে উল্লেখিত হয়েছে। কোন কোন বর্ণনায় এটা উল্লেখিত হয়েছে যে, সাফা পর্বতের উপর নাবী কারীম (সাঃ)-কে আঘাত করার জন্য তিনি একখণ্ড পাথর হাতে উঠিয়েছিলেন।[1]
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপর আবূ লাহাব যে কত পৈশাচিকতা ও নিষ্ঠুরতা অবলম্বন করেছিলেন তার আরও বিভিন্ন প্রমাণ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তার ছেলে ও রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মেয়ের মধ্যকার বিবাহ সম্পর্কোচ্ছেদ। নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দু’মেয়ের সঙ্গে আবূ লাহাব তার দু’ছেলের বিবাহ দিয়েছিলেন। কিন্তু নবুওয়াত প্রাপ্তির পর অত্যন্ত নিষ্ঠুরতা ও নির্যাতনের মাধ্যমে তিনি তার দু’ছেলেরই বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দেন।[2]
তাঁর পাশবিকতার আরও একটি ঘটনা হচ্ছে নাবী কারীম (সাঃ)-এর পুত্র আব্দুল্লাহ যখন মারা যান তখন তিনি (আবূ লাহাব) উল্লাসে ফেটে পড়েন, টগবগিয়ে দৌড়াতে তার বন্ধু-বান্ধবগণের নিকট এ দুঃসংবাদকে শুভ সংবাদরূপে পরিবেশন করেন যে, মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর লেজকাটা (পুত্রহীন) হয়েছে।[3]
অধিকন্তু, ইতোপূর্বে আলোচনা প্রসঙ্গে উল্লেখিত হয়েছে যে, হজ্বের মৌসুমে আবূ লাহাব নাবী কারীম (সাঃ)-কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে বাজার ও গণজমায়েতে তার পিছনে লেগে থাকতেন এবং জনতার মাঝে অপপ্রচার চালাতেন।
তারিক্ব বিন আব্দুল্লাহ মুহারিবীর বর্ণনায় জানা যায় যে, এ ব্যক্তি নাবী কারীম (সাঃ)-কে শুধু মাত্র মিথ্যা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা চালিয়েই ক্ষান্ত হন নি, বরং কোন কোন সময় তিনি নাবী (সাঃ)-কে লক্ষ্য করে প্রস্তর নিক্ষেপ করতেন, যার ফলে তার পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত রক্তাক্ত হয়ে যেত।[4]
আবূ লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামীল (যার নাম আরওয়া) ছিলেন হারব বিন উমাইয়ার কন্যা আবূ সুফইয়ানের বোন। নাবী (সাঃ)-এর প্রতি অত্যাচার ও জুলম ও নির্যাতনে তিনি ছিলেন স্বামীর যোগ্য অংশিদারিণী। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিদ্বেষপরায়ণা ও প্রতিহিংসাপরায়ণা মহিলা। এ সকল দুষ্কর্মে তিনি স্বামী থেকে পশ্চাদপদ ছিলেন না। তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর চলার পথে এবং দরজায় কাঁটা ছড়িয়ে কিংবা পুঁতে রাখতেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ দেয়া, কটুক্তি করা, মিথ্যা অপবাদ দেয়া ইত্যাদি নানাবিধ জঘন্য কাজকর্মে তিনি লিপ্ত থাকতেন। তাছাড়া মুসলিমদের বিরুদ্ধে নানাবিধ ফেৎনা ফাসাদের আগুন জ্বলিয়ে দেয়া এবং উস্কানী দিয়ে ভয়াবহ যুদ্ধের বিভীষিকা সৃষ্টিকরা তাঁর অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এজন্যই আল কুরআনে তাঁকে الحطب (খড়ির বোঝা বহনকারিণী) বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
যখন তিনি অবগত হলেন তাঁর এবং তাঁর স্বামীর ব্যাপারে নিন্দাসূচক আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে তখন তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর খোঁজ করতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তখন মসজিদুল হারামে কাবাহ গৃহের পাশে অবস্থান করছিলেন। আবূ বকর সিদীকও (রা.) তখন তাঁর সঙ্গে ছিলেন। আবূ লাহাব পত্নী যখন এক মুষ্ঠি পাথর নিয়ে বায়তুল হারামে (পবিত্র গৃহে) রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সম্মুখভাগে এসে দণ্ডায়মান হলেন তখন আল্লাহ তা’আলা মহিলার দৃষ্টিশক্তি বন্ধ করে দেয়ার কারণে তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে দেখতে পেলেন না।
অথচ আবূ বাকর (রাঃ)-কে তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন। তাঁর সামনে গিয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন, আবূ বাকর তোমার সাথী কোথায়? আমি জানতে পারলাম যে, সে নাকি আমাদের কুৎসা রটনা করে বেড়াচ্ছে? আল্লাহ করে আমি যদি এখন তাকে পেতাম তার মুখের উপর এ পাথর ছুঁড়ে মারতাম। দেখ আল্লাহর শপথ আমি একজন মহিলা কবি। তারপর সে এ কবিতা আবৃত্তি করে শোনাল।[5]
مذمما عصينا ٭ وامره ابينا ٭ ودينه قلينا
অর্থ : আমরা মন্দের অবজ্ঞা করেছি। তার নির্দেশ অমান্য করেছি এবং তাঁর দ্বীনকে (ধর্ম) ঘৃণা এবং নীচু মনে করে ছেড়ে দিয়েছি।
এর পর তিনি সেখান হতে চলে গেলেন। আবূ বাকর (রা.) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল। তিনি কি আপনাকে দেখেন নাই?’ আল্লাহর নাবী বললেন, (ما رأتنى لقد أخذ الله ببصرها عنى)
“না, তিনি আমাকে দেখতে পান নি। আল্লাহ তার দর্শন শক্তিকে আমার থেকে রহিত করে দিয়েছিলেন।[6]
আবূ বাকর বাযযারও এ ঘটনা বর্ণনা করেছেন এবং এর সঙ্গে আরও কিছু কথা সংযোজন করেছেন। তিনি বলেছেন যে, আবূ লাহাব পত্নী আবূ বাকর (রা.)-এর সামনে উপস্থিত হয়ে বললেন, আবূ বাকর! তোমার সঙ্গী আমার বদনাম করেছে। আবূ বাকর (রা.) বলেলেন, ‘না, এ ঘরের প্রভুর শপথ! তিনি কোন কবিতা রচনা কিংবা আবৃত্তি করেন না। আর না, সে সব তিনি মুখেই আনেন। তিনি বললেন, ‘তুমি সত্যই বলছ’।
এ সব সত্ত্বেও আবূ লাহাব সেই সব লোহমর্ষক ঘটনাবলী ঘটিয়ে চলেছিলেন যদিও তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর চাচা ও প্রতিবেশী। উভয়ের ঘর ছিল পাশাপাশি এবং লাগালাগি। এভাবেই তাঁর অন্যান্য প্রতিবেশীগণও তার উপর নির্যাতন চালাতেন।
ইবনে ইসহাক্বের বর্ণনায় রয়েছে যে, যে সকল লোকজনেরা নাবী কারীম (সাঃ)-কে তার বাড়িতে জ্বালা-যন্ত্রণা দিতেন তাদের নেতৃত্ব দিতেন আবূ লাহাব, হাকাম বিন আবিল আস বিন উমাইয়া, উক্ববা বিন আবী মু’আইত্ব , আদী বিন হামরা সাক্বাফী, ইবনুল আসদা হুযালী; এঁরা সকলেই ছিলেন তার প্রতিবেশী। এঁদের মধ্যে হাকাম বিন আবিল আস[7] ব্যতীত কেউই ইসলাম গ্রহণ করেন নাই। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপর তাদের জুলম নির্যাতনের ধারা ছিল এরূপ, তিনি যখন সালাতে রত হতেন তখন ছাগলের নাড়ি ভূড়ি ও মলমূত্র এমনভাবে লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করা হতো যে, তা গিয়ে পড়ত তার উপর। উনুনের উপর হাড়ি পাতিল চাপিয়ে রান্নাবান্না করার সময় এমনভাবে আবর্জনাদি নিক্ষেপ করা হতো যে, তা গিয়ে পড়ত হাড়ি পাতিলের উপর। তাদের থেকে নিস্কৃতি লাভের মাধ্যমে তিনি নিবিষ্ট চিত্তে সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে তিনি একটি পৃথক মাটির ঘর তৈরি করে নিয়েছিলেন।
যখন তাঁর উপর এ সকল আবর্জনা নিক্ষেপ করা হতো তখন সেগুলো নিয়ে বেরিয়ে দরজায় খাড়া হতেন এবং তাঁদের ডাক দিয়ে বলতেন, يا بنى عبد مناف أي جوار هذا
“ওহে আবদে মানাফ প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশীর এ কেমন আচরণ।”
তারপর আবর্জনা স্তুপে নিক্ষেপ করে আসতেন।[8]
উক্ববা বিন আবী মু’আইত্ব আরও দুষ্ট প্রকৃতির এবং প্রতি হিংসাপরায়ণ ছিলেন। সহীহুল বুখারীতে আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত আছে যে, ‘একদা নাবী কারীম (আঃ) বায়তুল্লাহর পাশে সালাত আদায় করছিলেন, এমতাবস্থায় আবূ জাহল এবং তার বন্ধুবৰ্গ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এদের মধ্যে কোন এক ব্যক্তি অন্যদের লক্ষ্য করে বললেন, ‘কে এমন আছে যে, অমুকের বাড়ি থেকে উটের ভূড়ি আনবে এবং মুহাম্মাদ যখন সালাত রত অবস্থায় সিজদায় যাবে তখন তার পিঠের উপর ভূড়িটি চাপিয়ে দিবে। ঐ সময় আরববাসীগণের মধ্যে নিকৃষ্টতম ব্যক্তি উক্ববা বিন আবী মু’আইত্ব [9] উঠল এবং কথিত ভূড়িটি নিয়ে এসে অপেক্ষা করতে থাকল। যখন নাবী কারীম (সাঃ) সিজদায় গেলেন তখন সেই দুরাচার নরাধম ভুঁড়িটি নিয়ে গিয়ে তার পিঠের উপর চাপিয়ে দিল। আমি সব কিছুই দেখছিলাম, কিন্তু কোন কিছু করার ক্ষমতা আমার ছিল না। হায় যদি আমার মধ্যে তাকে বাচানোর কোন ক্ষমতা থাকত।
আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ আরও বলেন, ‘এর পর তারা দানবীয় আনন্দ ও উত্তেজনায় পরস্পর পরস্পরের গায়ে ঢলাঢলি, পাড়াপাড়ি করে মাতামাতি শুরু করে দিল। মনে হল ওদের জন্য এর চেয়ে বড় আনন্দের ব্যাপার আর কিছু হতে পারে না। হায় আফসোস! যদি তারা একটু বুঝত যে, কী সর্বনাশের পথ তারা বেছে নিয়েছে’।
একদিকে অর্বাচীনের দল যখন দানবীয় আনন্দ ও নারকীয় কার্যকলাপে লিপ্ত ছিল তখন দুনিয়ার সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব মহানাবী মুহাম্মাদ (সাঃ) সিজদারত অবস্থায় বেহেশতী আবেহায়াত পানে বিভোর ছিলেন। কী অদ্ভুত বৈপরীত্য।
নাবী তনয়া ফাত্বিমাহ (রা.) এ দুঃসংবাদপ্রাপ্ত হয়ে দ্রুত সেখানে আগমন করেন এবং ভূঁড়ি সরিয়ে পিতাকে তার নীচ থেকে উদ্ধার করেন। তারপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) শির উত্তোলন করে তিনবার বললেন :
[اللهم عليك بقريش]
হে আল্লাহ! এ কুরাইশদিগকে পাকড়াও কর।”
যখন তিনি আল্লাহর নিকট এ আরয পেশ করলেন তখন তাদের মধ্যে কিছুটা অসুবিধা বোধের সৃষ্টি হল এবং তারা বিচলিত হয়ে পড়ল। কারণ তাদের এ বিশ্বাসও ছিল যে, এ শহরের মধ্যে প্রার্থনা কবুল হয়ে থাকে। তারপর তিনি নাম ধরে কয়েক জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও আরজি পেশ করলেনঃ
اللهم عليك بأبى جهل وعليك بعتبة بن ربيعة وشيبة بن ربيعة ووالد بن عتبة وامية بن خلف وعقبة بن ابى معيظ
‘হে আল্লাহ আবূ জাহেলকে, উতবাহহ বিন রাবী’আহকে, শায়বাহ বিন রাবী’আহকে অলীদ বিন উতবাহহকে, উমাইয়া বিন খালাফ এবং উক্ববা বিন মু’আইত্ব কে পাকড়াও কর।’
রাসূলুল্লাহ সপ্তম জনের নাম বলেছিলেন কিন্তু বর্ণনাকারীর তা স্মরণ নেই। ইবনে মাসউদ (রা.) বলেছেন, ‘সেই সত্ত্বার শপথ যার হাতে রয়েছে আমার জীবন! এ অবস্থার প্রেক্ষাপটে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যাদের নামে আরজি পেশ করেছিলেন বদর যুদ্ধে নিহত হয়ে কৃয়োর মধ্যে পতিত অবস্থায় আমি তাদের সকলকেই দেখেছি।[10]
উমাইয়া বিন খালাফের এ রকম এক স্বভাব হয়ে গিয়েছিল যে, যখনই সে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে দেখত তখনই তাঁকে ভর্ৎসনা করত এবং অভিশাপ দিত। এ প্রেক্ষিতে এ আয়াত কারীমা অবতীর্ণ হয় :
وَيْلٌ لِّكُلِّ هُمَزَةٍ لُّمَزَةٍ
‘প্রত্যেক অভিশাপকারী, ভর্ৎসনাকারী এবং অন্যায়কারীর জন্যই রয়েছে ধ্বংস (আল-হুমাযাহ ১০৪ : ১)
ইবনে হিশাম বলেন যে, ‘হুমাযাহা’ ঐ ব্যক্তি যে প্রকাশ্যে অশ্লীল বা অশালীন কথাবার্তা বলে ও চক্ষু বাঁকা টেড়া করে ইশারা ইঙ্গিত করে এবং ‘লুমাযাহ’ ঐ ব্যক্তি যে অগোচরে লোকের নিন্দা বা বদনাম করে ও তাদের কষ্ট দেয়।[11]
উমাইয়ার ভাই উবাই ইবনে খালফ ‘উক্ববা বিন আবী মু’আইতের অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল। এক দফা উক্ববা নাবী কারীম (সাঃ)-এর নিকট বসে কিছু শুনল। উবাই এ কথা জানতে পেরে তাকে খুব ধমক দিল, তার নিন্দা করল। তার নিকট অত্যন্ত কঠোরতার সঙ্গে কৈফিয়ত তলব করল এবং বলল যে, তুমি গিয়ে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর মুখে থুথু নিক্ষেপ করে এস। শেষ পর্যন্ত উক্ববা তাই করল। উবাই বিন খালফ নিজেই একবার মরা পচা হাড় নিয়ে তা চূৰ্ণ করে এবং জোরে ফূঁ দিয়ে তার রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দিকে উড়িয়ে দেয়।[12]
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে নির্যাতনকারী দলের মধ্যে যারা ছিল তাদের অন্যতম হচ্ছে আখনাস বিন শারীক সাক্বাফী। আল কুরআনে তার ৯টি বৈশিষ্ট্যের কথা বর্ণিত হয়েছে। এর মাধ্যমে তার মন মানসিকতা ও কাজকর্ম সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। ইরশাদ হয়েছে :
وَلَا تُطِعْ كُلَّ حَلَّافٍ مَّهِينٍ هَمَّازٍ مَّشَّاءٍ بِنَمِيمٍ مَّنَّاعٍ لِّلْخَيْرِ مُعْتَدٍ أَثِيمٍ عُتُلٍّ بَعْدَ ذَٰلِكَ زَنِيمٍ
“তুমি তার অনুসরণ কর না, যে বেশি বেশি কসম খায় আর যে (বার বার মিথ্যা কসম খাওয়ার কারণে মানুষের কাছে) লাঞ্ছিত। – যে পশ্চাতে নিন্দা করে একের কথা অপরের কাছে লাগিয়ে ফিরে, – যে ভাল কাজে বাধা দেয়, সীমালঙ্ঘনকারী, পাপিষ্ঠ, – কঠোর স্বভাব, তার উপরে আবার কুখ্যাত।” (আল-ক্বালাম ৬৮ : ১০-১৩)
আবূ জাহল কখনো কখনো রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট এসে কুরআন শ্রবণ করত। কিন্তু তার সে শ্রবণ ছিল নেহাৎই একটি মামুলী ব্যাপার। তার এ শ্রবণের মূলে আন্তরিক বিশ্বাস, আদব কিংবা আনুগত্যের কোন প্রশ্নই ছিল না। সেটাকে কিছুটা যেন তার উদ্ভট খেয়াল বলা যেতে পারে। সে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে অশ্লীল কিংবা কর্কশ কথাবার্তার মাধ্যমে কষ্ট দিত এবং আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টি করত। অধিকন্তু, অন্যায় অত্যাচারের ক্ষেত্রে সফলতা হওয়াটাকে গর্বের ব্যাপার মনে করে গর্ব করতে করতে পথ চলত। মনে হতো সে যেন মহা গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজ সম্পাদন করেছে। কুরআন মাজীদের এ আয়াত তার স্পর্কেই অবতীর্ণ হয়েছিল।[13]
فَلَا صَدَّقَ وَلَا صَلَّىٰ
“কিন্তু না, সে বিশ্বাসও করেনি, সলাতও আদায় করেনি।” (আল-ক্বিয়ামাহ ৭৫ : ৩১)
সেই ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে প্রথমদিকে যখন থেকে সালাত পড়তে দেখল তখন থেকে সালাত হতে নিবৃত্ত করার চেষ্টা চালাতে থাকে। এক দফা নাবী কারীম (সাঃ) মাকামে ইবরাহীমের নিকট সালাত পড়ছিলেন এমন সময় সে সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। তাকে দেখেই সে বলল, মুহাম্মাদ! আমি কি তোমাকে সালাত পড়া থেকে বিরত থাকতে বলিনি? সঙ্গে সঙ্গে সে নাবী কারীম রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে ধমকও দিল। নাবী কারীম (সাঃ)-ও ধমকের সুরে তাঁর এ কথার কঠোর প্রতিবাদ করলেন। প্রত্যুত্তরে সে বলল, “হে মুহাম্মাদ। আমাকে কেন ধমকাচ্ছ? আল্লাহর শপথ দেখ এ উপত্যকায় (মক্কায়) আমার বৈঠক সব চেয়ে বড়’। তার উক্তির প্রেক্ষিতে আল্লাহ তা’আলা এ আয়াত অবতীর্ণ করেন।[14]
فَلْيَدْعُ نَادِيَهُ
“কাজেই সে তার সভাষদদের ডাকুক।” (আল-আলাক্ব ৯৬ : ১৭)
এক বর্ণনায় রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার জামার বুকের অংশ ধরে জোরে হেঁচকা একটান দিলেন এবং এ আয়াতে কারীমা পাঠ করলেন :
أَوْلَىٰ لَكَ فَأَوْلَىٰ ثُمَّ أَوْلَىٰ لَكَ فَأَوْلَىٰ
“দুর্ভোগ তোমার জন্য, দুর্ভোগ, -তারপর তোমার জন্য দুর্ভোগের উপর দুর্ভোগ।” (আল-ক্বিয়ামাহ ৭৫ : ৩৪-৩৫)
এ পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহর সেই শত্রু বলতে লাগল, হে মুহাম্মাদ! তুমি আমাকে ধমক দিচ্ছ। আল্লাহর শপথ, তুমি ও তোমার প্রতিপালক আমার কিছুই করতে পারবে না। আমি মক্কার পর্বতের মধ্যে বিচরণকারীদের মধ্যে সব চেয়ে মর্যাদা-সম্পন্ন ব্যক্তি।[15]
তার এ অসার এবং উৎকট অহমিকা প্রকাশের পরও আবূ জাহাল সেসব থেকে নিবৃত্ত হল না। বরং তার অনাচার ও অন্যায় আচরণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েই চলল। যেমনটি সহীহুল মুসলিমে আবূ হুরাইরাহহ (রা.) কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন যে, এক দফা আবূ জাহল কুরাইশ প্রধানদের লক্ষ্য করে বললেন, ‘আপনাদের সম্মুখে মুহাম্মাদ (সাঃ) কি স্বীয় মুখমণ্ডলকে ধূলায় লাগিয়ে রাখে? প্রত্যুত্তরে বলা হল, হ্যাঁ”।
এরপর সে আস্ফালন করে বলল, ‘লাত ও উযযার কসম, যদি আমি তাকে পুনরায় সেই অবস্থায় (সালাতরত) দেখি তাহলে গ্ৰীবা পদতলে পিষ্ঠ করে ফেলব এবং মুখমণ্ডল মাটির সঙ্গে আচ্ছা করে ঘর্ষণ দিয়ে মজা দেখিয়ে দিব’।
কিছু দিন পর ঘটনাক্রমে একদিন সে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে সালাত পড়তে দেখে ফেলে এবং কুরাইশ প্রধানদের নিকট স্বঘোষিত সংকল্প কার্যকর করার উদ্দেশ্যে অগ্রসর হতে থাকে। কিন্তু আকস্মিকভাবে পরিলক্ষিত হল যে, অগ্রসর হওয়ার পরিবর্তে সে পশ্চাদপসরণ শুরু করেছে এবং আত্মরক্ষার জন্য অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে দু’হাত নড়াচড়া করে কী যেন এড়ানোর প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
উপস্থিত লোকজন জিজ্ঞাসা করল, ‘ওহে আবূল হাকাম! তোমার কী এমন হল যে, তুমি অমন ধারা ব্যস্ততায় লিপ্ত হয়ে পড়লে? সে উত্তর করল, ‘আমার এবং তার মধ্যে আগুনের এক গর্ত রয়েছে, ভয়াবহ বিভীষিকাময় ও ভীতপ্রদ শিকল রয়েছে’।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, ‘সে যদি আমার নিকট যেত তবে ফেরেশতাগণ তার এক একটা অঙ্গ উঠিয়ে নিয়ে যেতেন।[16]
উপর্যুক্ত বর্ণনা হচ্ছে, মুশরিকগণ (যারা ধারণা করতো তারা আল্লাহর বান্দা এবং তার হারামের অধিবাসী) মুসলমান এবং নাবী কারীম (সাঃ)-এর উপর যেভাবে অবর্ণনীয় অন্যায়, অত্যাচার ও উৎপীড়ন চালিয়ে আসছিল তার সংক্ষিপ্ত চিত্র।
এ রকম ভয়াবহ সংকটময় অবস্থায় এমন যথোচিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী ছিল যার মাধ্যমে মুসলমানগণ মুশরিকদের এমন বর্বোরোচিত অত্যাচার হতে রেহাই পেতে পারে। অতএব তিনি (সাঃ) দুটি হিকমতপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন যাতে করে সহজ পন্থায় দাওয়াতী কাজ চালানো যায় এবং অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌছা যায়। সিদ্ধান্ত দুটি হলো :
১. রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আরক্বাম বিন আবিল আরক্বাম মুখযুমীর বাড়িকে দাওয়াতী কর্মকাণ্ড পরিচালনা এবং শিক্ষা-প্রশিক্ষণের কেন্দ্র হিসেবে মনোনিত করলেন।
২. নবদীক্ষিত মুসলমানদেরকে হাবশায় হিযরত করার আদেশ করলেন।
ফুটনোটঃ[1] তিরমিযী শরীফ।
[2] ফী যিলালিল কুরআন ৩০ খণ্ড ২৮২ পৃঃ, তাফহীমূল কুরআন ৬ষ্ঠ খণ্ড ৫২২ পৃঃ।
[3] তাফহীমূল কুরআন ৬ষ্ঠ খণ্ড ৪৯০ পৃঃ।
[4] জামে তিরমিযী।
[5] মুশরিকগণ ক্রোধাম্বিত হয়ে নবী (সা.)-কে মুহাম্মাদ নামের পরিবর্তে মুযাম্মাম বলতেন যার অর্থ মুহাম্মাদ নামের বিপরীত। মুহাম্মাদ ঐ ব্যক্তি যাঁর প্রশংসা করা হয় এবং মুযামমাম ঐ ব্যক্তি যাকে তিরস্কার করা হয়।
[6] ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ৩৩৫-৩৩৬ পৃঃ।
[7] ইনি উমাইয়া খলীফা মারওয়ান বিন হাকামের পিতা ছিলেন।
[8] ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ৪১৬ পৃঃ।
[9] সহীহুল বুখারী এবং অন্য বর্ণনায় এর স্পষ্ট বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়েছে। দ্রষ্টব্য ১ম ৫৪৩ পৃঃ।
[10] সহীহুল বুখারী, অযু পর্বের ‘যখন কোন নামায়ীর উপর আবর্জনা নিক্ষিপ্ত” অধ্যায় ১ম খণ্ড ৩৭ পৃঃ।
[11] ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ৩৬১-৩৬২ পৃঃ।
[12] ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ৩৫৬ ও ৩৫৭ পৃঃ।
[13] ফী যিলালিল কুরআন ২৯/২১২।
[14] প্রাগুক্ত ৩০ পারা ২০৮।
[15] ফী যিলালিল কুরআন ২৯ পারা ৩১২।
[16] সহীহুল মুসলিম শরীফ।
আরকামের বাড়িতে (دَارُ الْأَرْقَمِ):
আরক্বাম বিন আবিল আরক্বাম মাখযূমীর বাড়িটি ছিল সাফা পর্বতের উপর অত্যাচারীদের দৃষ্টির আড়ালে এবং তাদের সম্মেলন স্থান হতে অন্য জায়গায় অবস্থিত। সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এ বাড়িকেই মুসলমানদের সাথে গোপনে মিলিত হওয়ার উপযুক্ত স্থান হিসেবে গ্রহণ করলেন। যাতে তিনি (সাঃ) সাহাবীদেরকে কুরআনের বাণী শোনানো, তাদের অন্তরকে কলূষমুক্তকরণ এবং তাদেরকে কিতাব এবং হিকমত শিক্ষা দিতে পারেন। আর মুসলমানগণ যেন নিরাপদে তাদের ইবাদাত বন্দেগী চালিয়ে যেতে পারেন; রাসূল (সাঃ) এর উপর যা অবতীর্ণ হয় তা তারা নিরাপদে গ্রহণ করতে পারেন এবং অত্যাচারী মুশরিকদের অজান্তে যারা ইসলাম গ্রহণ করতে চায় তারা যাতে ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হতে পারেন।
এ বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ ছিল না যে, তিনি যদি তাঁদের সঙ্গে একত্রিত হন তাহলে মুশরিকগণ তার আত্মশুদ্ধি এবং কিতাব ও হিকমত শেখার কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবেন এবং এর ফলে মুসলিম ও মুশরিক উভয় দলের মধ্যে সংঘর্ষের সম্ভাবনা থাকবে। ইবনু ইসহাক্ব বর্ণনা করেন, সাহাবীগণ (রা.) তাঁদের নির্দিষ্ট ঘাঁটিগুলোতে একত্রিত হয়ে সালাত আদায় করতেন। ঘটনাক্রমে এক দিবস কিছু সংখ্যক কাফের কুরাইশ তাদের এভাবে সালাত পড়তে দেখে ফেলার পর অশ্লীল ভাষায় তাদের গালিগালাজ করতে থাকেন এবং আক্রমণ করে বসেন। মুসলিমগণও সে আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য এগিয়ে আসেন। প্রতিহত করতে গিয়ে সা’দ বিন ওয়াক্কাস এক ব্যক্তিকে এমনভাবে প্রহার করেছিলেন যে তার শরীরের আঘাতপ্রাপ্ত স্থান থেকে রক্তধারা প্রবাহিত হতে থাকে। ইসলামে এটাই ছিল সর্বপ্রথম রক্তপাত।[1]
এটা সর্বজনবিদিত বিষয় যে, এভাবে যদি বারংবার মুসলিম ও মুশরিকদের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হতে থাকত তাহলে স্বল্প সংখ্যক মুসলিম স্বল্প সময়ের মধ্যেই নিঃশেষ হয়ে যেতেন। অতএব, ইসলামের সর্বপ্রকার কাজকর্ম অত্যন্ত সঙ্গোপনে সম্পন্ন করার দাবী ছিল খুবই যুক্তিসঙ্গত ও বিজ্ঞোচিত। এ প্রেক্ষিতে সাধারণ সাহাবীগণ (রা.)
তা’লীম, তাবলীগ, ইবাদত বন্দেগী সম্মেলন ও পারস্পরিক মত বিনিময় ইত্যাদি যাবতীয় কাজকর্ম সঙ্গোপনেই করতে থাকেন। তবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর এবাদত-বন্দেগী এবং প্রচারমূলক কাজকর্ম মুশরিকগণের সামনাসামনি প্রকাশ্যেই করতে থাকেন। তাকে কোন কিছুতেই তারা বাধা দেয়ার সাহস পেত না। তবুও মুসলিমগণের কল্যাণের কথা চিন্তা-ভাবনা করে সঙ্গোপণেই তিনি তাদের সঙ্গে একত্রিত হতেন।
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ২৬৩ পৃঃ। এবং মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব, মুখতাসারুস সীরাহ ৬০ পৃঃ।
আবিসিনিয়ার প্রথম হিজরত (الهِجْرَةُ الْأُوْلٰى إِلَى الْحَبْشَةِ):
অন্যায় অত্যাচারের উল্লেখিত বিভীষিকাময় ধারা-প্রক্রিয়া ও কার্যক্রম সূচিত হয় নবুওয়ত চতুর্থ বর্ষের মধ্যভাগে কিংবা শেষের দিক থেকে। জুলুম নির্যাতনের শুরুতে এর মাত্রা ছিল সামান্য। কিন্তু দিনের পর দিন মাসের পর মাস সময় যতই অতিবাহিত হতে থাকল জুলুম-নির্যাতনের মাত্রা ততই বৃদ্ধি পেতে পেতে পঞ্চম বর্ষের মধ্যভাগে তা চরমে পৌঁছল এবং শেষ পর্যন্ত এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হল যে, মক্কায় মুসলিমদের টিকে থাকা এক রকম অসম্ভব হয়ে উঠল। তাই এ বিভীষিকার কবল থেকে পরিত্রাণ লাভের উদ্দেশ্যে তাঁরা বাধ্য হলেন পথের সন্ধানে প্রবৃত্ত হতে। অনিশ্চয়তা এবং দুঃখ-দুর্দশার এ ঘোর অন্ধকারাচ্ছন্ন অবস্থার মধ্যে অবতীর্ণ হল সূরাহ যুমার।
এতে হিজরতের জন্য ইঙ্গিত প্রদান করে বলা হয় যে, ‘আল্লাহর জমিন অপ্রশস্ত নয়।’
{لِلَّذِيْنَ أَحْسَنُوْا فِيْ هَذِهِ الدُّنْيَا حَسَنَةٌ وَأَرْضُ اللهِ وَاسِعَةٌ إِنَّمَا يُوَفَّى الصَّابِرُوْنَ أَجْرَهُم بِغَيْرِ حِسَابٍ} [الزمر:10]
‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর। এ দুনিয়ায় যারা ভাল কাজ করবে, তাদের জন্য আছে কল্যাণ। আল্লাহর যমীন প্রশস্ত (এক এলাকায় ‘ইবাদাত-বন্দেগী করা কঠিন হলে অন্যত্র চলে যাও)। আমি ধৈর্যশীলদেরকে তাদের পুরস্কার অপরিমিতভাবে দিয়ে থাকি।’ (আয-যুমার ৩৯ : ১০)
অত্যাচারের মাত্রা যখন ধৈর্য ও সহ্যের সীমা অতিক্রম করে গেল, বিশেষ করে কুরআন মাজীদ পড়তে এবং নামায আদায় করতে না দেয়ার মানসিক যন্ত্রণা যখন চরমে পৌঁছল তখন তারা দেশান্তরের কথা চিন্তাভাবনা করতে শুরু করলেন। তিনি বহু পূর্ব থেকেই আবিসিনিয়ার সম্রাট আসহামা নাজ্জাশীর উদারতা এবং ন্যায় পরায়ণতা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। অধিকন্তু, সেখানে কারো প্রতি যে কোন অন্যায়-অত্যাচার করা হয় না সে কথাও তিনি জানতেন। মুসলিম সেখানে গমন করলে নিরাপদে থাকার এবং নির্বিঘ্নে ধর্ম কর্ম করার সুযোগ লাভ করবে। এ সব কিছু বিচার-বিবেচনা করে তাঁদের জীবন এবং ঈমানের নিরাপত্তা বিধান এবং নির্বিঘ্নে ধর্মকর্ম করার সুযোগ লাভের উদ্দেশ্যে হিজরত করে আবিসিনিয়ায় গমনের জন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবীগণ (রাঃ)-কে নির্দেশ প্রদান করেন।[1]
এ দিকে মুহাজিরগণ সম্পূর্ণ নিরাপদে আবিসিনিয়ায় বসবাস করতে থাকলেন।[2] পূর্বাহ্নেই বলা হয়েছে যে, এ দলটি রজব মাসে মক্কা থেকে হিজরত করেন। কিন্তু সেই বছরটির রমাযান মাসে কাবা শরীফে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়ে যায়।
ফুটনোটঃ[1] শাইখ আব্দুল্লাহ মুখতাসারুস সীরাহ পৃঃ ৯২-৯৩, যাদুল মা’আদ ১ম খন্ড ২৪ পৃঃ ও রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ৫১ পৃঃ।
[2] রহামাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড যাদুল মাযাদ ১ম খন্ড ২৪ পৃঃ।
মুসলিমদের সঙ্গে কাফিরদের সিজদাহ ও মুহাজিরদের প্রত্যাবর্তন (سُجُوْدُ الْمُشْرِكِيْنَ مَعَ الْمُسْلِمِيْنَ وَعَوْدَةُ الْمُهَاجِرِيْنَ):
একই বছর রমাযান মাসে নাবী কারীম (সাঃ) হারাম শরীফের উদ্দেশ্যে বের হন। কুরাইশগণের এক বিরাট জনতা সেই সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন। নাবী কারীম (সাঃ) সেখানে উপস্থিত হয়েই আকস্মিকভাবে সুরায়ে ‘নাজাম’ পাঠ করতে আরম্ভ করেন। ঐ সকল লোকেরা ইতোপূর্বে কুরআন শ্রবণ করত না এবং কোথাও কুরআন পাঠ করা হলে তারা শোরগোল করে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি করত যাতে তা শ্রুতিগোচর না হয়। কারণ, তাদের একটি বদ্ধমূল ধারণা ছিল কুরআন শ্রবণ করলে তারা প্রভাবিত হয়ে পড়বে। কুরআনের ভাষায় ব্যাপারটি ছিল এরূপঃ
{لاَ تَسْمَعُوْا لِهٰذَا الْقُرْآنِ وَالْغَوْا فِيْهِ لَعَلَّكُمْ تَغْلِبُوْنَ} [فصلت:26]
‘‘এ কুরআন শুনো না, আর তা পড়ার কালে শোরগোল কর যাতে তোমরা বিজয়ী হতে পার।’ (ফুসসিলাত ৪১ : ২৬)
কিন্তু নাবী কারীম (সাঃ) যখন এ সূরাহটি পাঠ আরম্ভ করলেন তখন এর অশ্রুত পূর্ব সুললিত বানী, অবর্ণনীয় কমনীয়তা ও অপরূপ মিষ্টতা যখন তাদের কর্ণকূহরে প্রবিষ্ট হল তখন তারা মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় সম্পূর্ণ ভাবাবিষ্ট এবং হতচকিত হয়ে পড়লেন। ইতোপূর্বে কুরআন পাঠের সময় তারা যেভাবে গন্ডগোল করত সে রকম গন্ডগোল করা তো দূরের কথা বরং আরও গভীর মনোযোগের সঙ্গে কান পেতে তারা তা শুনতে থাকল। তাদের অন্তরে ভিন্নমুখী কোন ভাবেরই উদ্রেক হল না। তারপর নাবী কারীম (সাঃ) যখন এ সূরাহর শেষের আয়াতসমূহ পাঠ করতে থাকলেন তখন তাদের অন্তরে কম্পন সৃষ্টি হতে থাকল। যখন তিনি আল্লাহর নির্দেশ-সম্বলিত শেষের আয়াতটি পাঠ করলেন :
{فَاسْجُدُوْا لِلهِ وَاعْبُدُوْا}
[1]
‘‘তাই, আল্লাহর উদ্দেশে সিজদাহয় পতিত হও আর তাঁর বন্দেগী কর। [সাজদাহ] (আন-নাজম ৫৩ : ৬২)
অতঃপর রাসূল (সাঃ) সিজদা করলেন এবং সাথে উপস্থিত মুশরিকরাও সকলে সিজদা করল।
কিন্ত পরক্ষণেই যখন ভাবাবিষ্ট অবস্থা থেকে তাঁরা স্বাভাবিকতায় প্রত্যাবর্তন করলেন তখন উপলব্ধি করতে সক্ষম হলেন যে, আল্লাহর কুরআনের অলৌকিকত্ব তাদের স্বকীয়তা বিনষ্ট করে দিয়েছে যার ফলে তাঁরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে সিজদাহ করতেও বাধ্য হয়েছেন। অথচ যাঁরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে সিজদাহহ করেন তাদের সমূলে ধ্বংস করার জন্য তাঁরা বদ্ধপরিকর। এমন এক অবস্থার প্রেক্ষাপটে তাঁরা আত্মগ্লানির অনলে দগ্ধীভূত হতে থাকেন। তাঁদের এ শোচনীয় মানসিক অবস্থার আরও অবনতি ঘটতে থাকে যখন অনুপস্থিত অন্যান্য মুশরিকগণ এ আচরণের জন্য তাঁদের লজ্জা দিতে ও নিন্দা জ্ঞাপন করতে থাকেন।
এ ত্রিশংকু অবস্থা থেকে আত্মরক্ষা এবং তাঁদের সমালোচনা মুখর মুশরিকগণের দৃষ্টির মোড় পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে তাঁরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নামে অপবাদ দিয়ে একটি অপপ্রচার শুরু করলেন। তাঁরা একটি নির্জলা মিথ্যাকে নানা রূপ ও রং দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নামে প্রচার শুরু করলেন যে, তিনি তাঁদের প্রতিমাসমূহের ইজ্জত ও সম্মানের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেছেনঃ
(تِلْكَ الْغَرَانِيْـقُ الْعُلٰى، وَإِنَّ شَفَاعَتَهُمْ لَتُرْتَجٰى)
(এরা সব উচ্চ পর্যায়ের দেবদেবী, তাদের শাফা‘আতের আশা করা যায়।)
অথচ তা ছিল মিথ্যা। নাবী কারীম (সাঃ)-এর সঙ্গে সিজদাহ করে তাদের ধারণায় তারা যে ভুলটি করেছিলেন তার গ্লানি থেকে মুক্তিলাভের উদ্দেশ্যেই তাঁদের এ অপপ্রচার। নাবী (সাঃ) সম্পর্কে সর্বদাই যাঁরা মিথ্যা কুৎসা রটনা এবং নানা অপপ্রচারে লিপ্ত থাকতেন এ ক্ষেত্রেও যে তাঁরা তা করবেন তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই। বরং এটাই স্বাভাবিক যে, যে কোন সূত্রে যে কোন মুহূর্তে নাবী (সাঃ)-এর নির্মল চরিত্রে কলংক লেপন করতে তারা কখনই কুণ্ঠা বোধ করবেন না।[2]
যা হোক, কুরাইশ মুশরিকগণের সিজদাহ করার খবর আবিসিনিয়ায় হিজরতকারী মুসলিমগণের নিকটও গিয়ে পৌঁছল। কিন্তু সেই সংবাদের রকম-সকম ছিল ভিন্ন। মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত কথার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই যেমন নানা রং-চংয়ের সংযোজন ও সংমিশ্রণ ঘটে যায় এ ক্ষেত্রেও হল ঠিক তাই। আবিসিনিয়ায় অবস্থানকারী মুহাজিরগণ খবর পেলেন যে, মক্কার কুরাইশগণ মুসলিম হয়ে গিয়েছেন। এ কথা শোনা মাত্রই স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য অনেকেরই মনে ব্যগ্রতা পরিলক্ষিত হল এবং পরবর্তী শওয়াল মাসেই তাঁদের একটি দল মক্কা অভিমুখে যাত্রা করলেন। কিন্তু মক্কা থেকে তাঁরা এক দিনের পথের দূরত্বে অবস্থান করছিলেন তখন প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে অবগত হয়ে তাঁরা বুঝতে পারেন যে, ব্যাপারটি যেভাবে তাঁদের নিকট চিত্রিত করা হয়েছে প্রকৃত ঘটনাটি তা নয়। তাই দলের কিছু সংখ্যক লোক আবিসিনিয়া অভিমুখে পুনরায় যাত্রা করলেন এবং কিছু সংখ্যক সঙ্গোপনে কিংবা কুরাইশগণের আশ্রয়ে মক্কায় প্রবেশ করলেন।[3]
এর পর মক্কা প্রত্যাগত মুহাজিরগণের উপর বিশেষভাবে এবং অন্যান্য মুসলিমগণের উপর সাধারণভাবে কুরাইশগণের অন্যায়, অত্যাচার ও উৎপীড়ন বহুলাংশে বৃদ্ধি পেল। শুধু মুহাজিরগণই নন, এমন কি তাঁদের পরিবার পরিজনও এ নির্যাতনের হাত থেকে নিস্তার পেল না। এর কারণ হচ্ছে ইতোপূর্বে কুরাইশগণ যখন অবগত হয়েছিলেন যে, আবিসিনিয়ায় মুহাজিরগণের সাথে নাজ্জাশী অত্যন্ত সহৃদয়তার সঙ্গে আচরণ করছেন এবং নানাভাবে তাঁদের প্রতি মদদ জুগিয়ে চলেছেন। মুসলিমদের উপর প্রতিহিংসাপরায়ণ কুরাইশদের জুলুম-নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার প্রেক্ষাপটে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পরামর্শ দিলেন পুনরায় আবিসিনিয়ায় হিজরত করতে।
ফুটনোটঃ[1] সহীহুল বুখারীতে এ সিজদার ঘটনাটি ইবনে মাসউদ ও ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে বর্ণিত হয়েছে। বাবু সাজাদাতিন্নাজমি এবং বাবু সুজুদিল মুশরিকীন ১ম খন্ড ১৪৬ পৃঃ ও বাবু মালাকিয়্যান নাবিয়্যু ফী আসহাবিহি ১ম খন্ড ৫৪৩ পৃঃ। দ্রষ্টব্য।
[2] বিশেষজ্ঞগণ এ বর্ণনা সূত্রের সমস্ত পথগুলো যাচাই করার পরে এ ফলাফলের গ্রহণ করেছেন।
[3] যাদুল মা’আদ ১ম খন্ড ২৪ পৃঃ এবং ২য় খন্ড ৪৪পৃঃ, ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৩৬৪ পৃঃ।
আবিসিনিয়ায় দ্বিতীয় হিজরত (الْهِجْرَةُ الثَّانِيَةُ إِلَى الْحَبْشَةِ):
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নির্দেশ পেয়ে মুসলমানগণ ব্যাপকভাবে হিজরতের প্রস্তুতি নিতে থাকলেন। কিন্তু এ দ্বিতীয় হিজরত ছিল খুবই কঠিন। কেননা প্রথম হিজরতের সময় কুরাইশগণ সচেতন ছিলেন না। কিন্তু অতন্দ্র প্রহরীর মতো এখন তাঁরা সচেতন এবং যে কোন মূল্যে এ ধরণের প্রচেষ্টা প্রতিহত করার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর ছিলেন।
কিন্তু আকাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্য সাধনে সাফল্য লাভের ব্যাপারে কুরাইশগণের তুলনায় মুসলমানদের সচেতনতা ও ঐকান্তিকতার মাত্রা ছিল অনেক গুণে বেশী। উপরন্তু নিরীহ, নির্দোষ এবং ন্যায়নিষ্ঠ মুসলিমদের প্রতি ছিল আল্লাহ তা‘আলার বিশেষ অনুগ্রহ। যার ফলে কুরাইশগণের তরফ থেকে কোন অনিষ্ট কিংবা প্রতিবন্ধকতা আসার পূর্বেই তাঁরা সহীহুল সালামতে গিয়ে পৌঁছলেন হাবশের সম্রাটের দরবারে।
দ্বিতীয় দফায় সর্বমোট ৮২ জন কিংবা ৮৩ জন পুরুষ হিজরত করেছিলেন (এর মধ্যে আম্মার (রাঃ)-এর হিজরত সম্পর্কে মত পার্থক্য রয়েছে) এবং ১৮ কিংবা ১৯ জন মহিলা ঐ দলে ছিলেন।[1] আল্লামা সুলাইমান মুনসুরপুরী দৃঢ়ভাবে মহিলা মুহাজিরগণের সংখ্যা ১৮ বলেছেন।[2]
ফুটনোটঃ[1] যাদুল মা’আদ ১ম খন্ড পৃঃ ২৪, রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ৬১ পৃঃ।
[2] রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ৬১পৃঃ।
আবিসিনিয়ায় হিজরতকারী মুহাজিরগণের বিরুদ্ধে কুরাইশ ষড়যন্ত্র (مَكِيْدَةُ قُرَيْشٍ بِمُهَاجِرِي الْحَبْشَةِ):
জান-মাল ও ঈমান রক্ষার্থে মুসলিমগণ দেশত্যাগ করে আবিসিনিয়ায় গিয়ে সেখানে শান্তি স্বস্তি লাভ করায় কুরাইশগণের দারুণ গাত্রদাহ সৃষ্টি হয়ে যায়। এ প্রেক্ষিতে ‘আমর বিন আস এবং গভীর জ্ঞানগরিমার অধিকারী আব্দুল্লাহ বিন রাবী’আহকে (যিনি তখনো ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন নি) নাজ্জাশীর নিকট প্রেরণ করার জন্য দূত মনোনীত করা হয়। তারপর সম্রাট নাজ্জাশী এবং বেতরীকগণের (খ্রীষ্টান ও অগ্নিপূজকদের পুরোহিত) জন্য বহু মূল্যবান উপঢৌকনসহ দূত দ্বয়কে দৌত্যকর্ম সম্পাদনের উদ্দেশ্যে আবিসিনিয়ায় প্রেরণ করা হয়।
আবিসিনিয়ায় পৌঁছে তারা সর্বপ্রথম বেতরীক পুরোহিতগণের দরবারে উপস্থিত হয়ে উপঢৌকন প্রদান করেন। তারপর তাঁদের নিকট সেই সকল বিবরণ ও প্রমাণাদি উপস্থাপন করেন যার ভিত্তিতে তারা মুসলিমগণকে হাবশ হতে বাহির করার উদ্যোগ নিয়েছিল। যদি সেই সকল বিবরণ ও প্রমাণাদির তেমন কোন ভিত্তিই ছিল না, তবুও উপঢৌকনের সুবাদে বেতরীকগণ (পাদ্রীগণ) এ ব্যাপারে একমত হলেন যে, মুসলিমগণকে হাবশ হতে বহিস্কার করার ব্যাপারে সম্রাট নাজ্জাশীকে তাঁরা পরামর্শ দিবেন। বেতরীকগণের নিকট থেকে সহযোগিতা লাভের আশ্বাস পেয়ে কুরাইশ দূতেরা সম্রাট নাজ্জাশীর দরবারে উপস্থিত হয়ে উপঢৌকন প্রদান করে আরজি পেশ করেন। তাঁদের আরজির বিবরণ হচ্ছে এরূপঃ
‘‘হে মহামান্য সম্রাট! আমাদের দেশের কিছু সংখ্যক অবোধ ও অর্বাচীন যুবক আমাদের দেশ থেকে পলায়ণ করে আপনার দেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। তাঁরা তাঁদের পূর্ব পুরুষগণের নিকট থেকে বংশপরম্পরা সূত্রে চলে আসা ধর্মমত পরিত্যাগ করেছে। আপনার দেশে আশ্রয় গ্রহণ করে আপনার ধর্মমতও গ্রহণ করেন নি। এ হচ্ছে তাঁদের চরম ধৃষ্টতার পরিচায়ক। শুধু তাই নয়, এরা নাকি একটা নতুন ধর্মমতও আবিস্কার করেছেন। এর চাইতে আজগুবি ব্যাপার আর কী হতে পারে বলুন। আমাদের গোত্রীয় প্রধান এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ, এ সকল অর্বাচিনের পিতামাতা, মুরুববী ও আত্মীয়-স্বজনগণ তাঁদেরকে স্বদেশে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে আমাদের দু’জনকে দূত হিসেবে দরবারে প্রেরণ করেছেন। আপনি অনুগ্রহ করে আমাদের সঙ্গে ওঁদের ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করুন। আমাদের প্রধানগণ এদের ভালমন্দ সম্পর্কে ভালভাবে বোঝেন এবং তাদের অসন্তোষের কারণ সম্পর্কে ওয়াকেবহাল রয়েছেন।’
কুরাইশ দূতেরা সম্রাটের নিকট যখন এ আরজি পেশ করলেন তখন পুরোহিতগণ বললেন, ‘মহামান্য সম্রাট! এরা উভয়েই খুব যুক্তিসংগত এবং সঠিক কথা বলেছেন। আপনি এদের হাতে ঐ দেশত্যাগী যুবকদের সমর্পণ করে দিন। আমাদের মনে হয় এটাই ভাল যে, তাঁরা তাঁদের স্বদেশে ফেরৎ নিয়ে যান।
কুরাইশ দূতগণের কথাবার্তা শ্রবণের পর সম্রাট নাজ্জাশী গভীরভাবে কিছুক্ষণ চিন্তা করে নিয়ে বললেন, ‘আলোচ্য বিষয়টির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভের পূর্বে কোন কিছু মন্তব্য প্রকাশ করা কিংবা সিদ্ধান্ত নেয়া সমীচীন হবে না। সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্বে বিষয়টির খুঁটি নাটি সম্পর্কে ওয়াকেবহাল হওয়া তাঁর বিশেষ প্রয়োজন। এ প্রেক্ষিতে তাঁর দরবারে উপস্থিত হওয়ার জন্য তিনি মুসলিমদের আহবান জানালেন। মুসলিমগণও আল্লাহ তা‘আলার কথা স্মরণ করে বিষয়ের খুঁটি-নাটিসহ সকল কথা সম্রাট সমীপে পেশ করার জন্য উত্তম মানসিক প্রস্ত্তটি সহকারে সম্রাটের দরবারে গিয়ে উপস্থিত হলেন।
সম্রাট নাজ্জাশী তাঁর দরবারে উপস্থিত মুসলিমদের লক্ষ্য করে বললেন, ‘যে ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার কারণে যুগ যুগ ধরে পূর্ব পুরুষগণের বংশপরম্পরা সূত্রে চলে আসা ধর্ম তোমরা পরিত্যাগ করেছ এবং এমন কি আমাদের দেশে আশ্রিত হয়েও তোমরা আমাদের ধর্মের প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন রয়েছে সে ধর্মটি কোন্ ধর্ম?’
প্রত্যুত্তরে মুসলিমদের মনোনীত মুখপাত্র হিসেবে জা’ফার বিন আবূ ত্বালিব অকপটে বলে চললেন, ‘হে সম্রাট! আমরা ছিলাম অজ্ঞতা, অশ্লীলতা ও অনাচারের অন্ধকারে নিমজ্জিত দুষ্কর্মশীল এক জাতি। আমরা প্রতিমা পূজা করতাম, মৃত জীব-জানোয়ারের মাংস ভক্ষণ করতাম, নির্বিচারে ব্যভিচার ও অশ্লীলতায় লিপ্ত থাকতাম, আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতাম, পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে অন্যায় আচরণ করতাম, আমানতের খেয়ানত ও মানুষের হক পয়মাল করতাম এবং দুর্বলদের সহায়-সম্পদ গ্রাস করতাম, এমন এক অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজ জীবনে আমরা যখন মানবেতর জীবন যাপন করে আসছিলাম তখন আল্লাহ রাববুল আলামীন অনুগ্রহ করে আমাদের মাঝে এক রাসূল প্রেরণ করলেন। তাঁর বংশ মর্যাদা, সততা, সহনশীলতা, সংযমশীলতা, ন্যায়-নিষ্ঠা, পরোপকারিতা ইত্যাদি গুণাবলী এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে পূর্ব থেকেই আমরা অবহিত ছিলাম। তিনি আমাদেরকে আহবান জানিয়ে বললেন যে, ‘সমগ্র বিশ্ব জাহানের স্রষ্টা প্রতিপালক এক আল্লাহ ছাড়া আমরা আর কারো উপাসনা করব না। বংশ পরম্পরা সূত্রে এ যাবৎ আমরা যে সকল প্রস্তর মূর্তি বা প্রতিমা পূজা করে এসেছি সে সব বর্জন করব। অধিকন্তু মিথ্যা বর্জন করা, পাড়া-প্রতিবেশীগণের সাথে সদ্ব্যবহার করা, অশ্লীল অবৈধ কাজকর্ম থেকে বিরত থাকা এবং রক্তপাত পরিহার করে চলার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। তাছাড়া মহিলাদের উপর নির্যাতন চালানো কিংবা মহিলাদের অহেতুক অপবাদ দেয়া থেকেও বিরত থাকার জন্য তিনি পরামর্শ দেন। আল্লাহর সঙ্গে শরীক করা থেকে বিরত থাকার জন্যও তিনি পরামর্শ দেন। অধিকন্তু, নামায, রোযা এবং যাকাতের জন্যও তিনি আমাদের নির্দেশ প্রদান করেন।’
এইভাবে জা’ফার অত্যন্ত চিত্তোদ্দীপক এবং মর্মস্পর্শী ভাষায় ইসলামের মূলনীতি এবং বিধি-বিধানগুলো বর্ণনা করলেন। তারপর আবারও বললেন, ‘এই পয়গম্বরকে বিশ্বজাহানের স্রষ্টা প্রতিপালক আল্লাহর (মহিমান্বিত প্রভূর) পয়গম্বর বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেছি এবং তাঁর আনীত দ্বীনে এলাহীর অনুসরণে দৃঢ় প্রত্যয় ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আল্লাহ এবং তদীয় রাসূলের পয়রবী করে চলছি। সুতরাং আমরা এক এবং অদ্বিতীয় প্রভূ আল্লাহর ইবাদত ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করি না এবং বিশ্ব জাহানে কোথাও তাঁর কোন শরীক আছে বলে আমরা বিশ্বাস করি না। পয়গম্বর যে সব কথা, কাজ ও খাদ্য আমাদের জন্য হারাম বলেছেন আমরা সেগুলোকে বিষবৎ পরিত্যাগ করেছি এবং যেগুলোকে হালাল বলেছেন আমরা সেগুলোকে বৈধ জেনে তার সদ্ব্যবহার করছি। এ কারণে আরব সমাজের বিভিন্নগোত্র ও সম্প্রদায় আমাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছে। তাঁরা চান এ সত্য, সুন্দর, শাশ্বত ও সুনির্মল দ্বীপে থেকে আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে অশ্লীলতা এবং অনাচারের গভীর পঙ্কে পুনরায় নিমজ্জিত করতে। কিন্তু আমরা তা অস্বীকার করায় তারা আমাদের উপর নারকীয় নির্যাতন চালিয়েছেন। এক আল্লাহর ইবাদত থেকে ফিরিয়ে নিয়ে প্রতিমা পূজায় লিপ্ত করানোর জন্য আমাদের উপর আঘাতের উপর আঘাত হেনেছে, নিদাঘের উত্তপ্ত কংকর ও বালুকারাশির উপর শুইয়ে বুকের উপর পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে, জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর শুইয়ে দিয়ে বুকে পাথর চাপা দিয়েছে, পায়ে দড়ি বেঁধে পথে প্রান্তরে টেনে নিয়ে বেড়িয়েছে। এমনকি এইভাবে যখন তাঁরা আমাদের উপর অবিরামভাবে অন্যায় অত্যাচার চালাতে থাকলেন আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে আল্লাহর জমিনকে আমাদের জন্য সংকীর্ণ করে ফেললেন এবং এমন কি আমাদের ও আমাদের দ্বীনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে ও প্রাণনাশের হুমকি দিতে থাকলেন তখন আপনার মহানুভবতা, উদারতা ও ন্যায়-নিষ্ঠার কথা অবগত হয়ে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আমাদের নির্দেশ প্রদান করলেন দেশত্যাগ করে আপনার দেশে আশ্রয় গ্রহণ করতে। হে সম্রাট! আমরা আপনার সহৃদয়, উদারতা ও মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়েছি। আমরা চাই আপনার আশ্রয়ের সুশীতল ছায়াতলে অবস্থান করতে। অনুগ্রহ করে এ সব পাষন্ড যালেমদের (অত্যাচারীদের) হাতে আমাদের সমর্পণ করবেন না।’
সম্রাট নাজ্জাশী বললেন সেই পয়গম্বর যা এনেছেন তার কিছু অংশ তোমাদের কাছে আছে কি? হযরত জা‘ফর বললেন, ‘জী হ্যাঁ’’।
নাজ্জাশী বললেন, ‘তা হলে আমার সামনে পড়ে শোনাও।
জা‘ফর (রাঃ) আল্লাহর সমীপে নিবেদিত এবং আত্মা-সমাহিত অবস্থায় ভাবগদগদ চিত্তে সুরায়ে মরিয়মের প্রথম কয়েকটি আয়াত পাঠ করে শোনালেন: {كهيعص}
নাজ্জাশী এতই মুগ্ধ হলেন যে, তাঁর চক্ষুদ্বয় হতে অশ্রুধারা প্রবাহিত হয়ে দাঁড়ি ভিজে গেল। জাফরের তিলাওয়াত শ্রবণ করে নাজ্জাশীর ধর্মীয় মন্ত্রণাদাতাগণও এতই ক্রন্দন করেছিলেন যে, ‘এ কালাম (বাণী) এবং সেই কালাম যা ঈসা (আঃ)-এর নিকট অবতীর্ণ হয়েছিল, উভয় কালামই এক উৎস হতে অবতীর্ণ হয়েছে।’
এরপর নাজ্জাশী ‘আমর বিন আস এবং আব্দুল্লাহ বিন রাবী’আহকে সম্বোধন করে বললেন, ‘তোমরা যে দূরভিসন্ধি নিয়ে আমার দরবারে আগমন করেছ তা সঙ্গে নিয়েই দেশে ফিরে যাও। তোমাদের হাতে এদের সমর্পণ করার কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। অধিকন্তু, এ ব্যাপারে এখানে কোন কূট কৌশলেরও অবকাশ থাকবে না।’
সম্রাট নাজ্জাশীর নিকট থেকে এ নির্দেশ লাভের পর তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থমনোরথ হয়ে তাঁর দরবার কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন। আদম সন্তানদের গোমরাহ করার ব্যাপারে আযাযীল শয়তান যেমন একের পর এক কৌশল প্রয়োগ করতে থাকে এরাও তেমনি একটি কৌশল ব্যর্থ হওয়ায় অন্য কৌশল প্রয়োগের ফন্দি ফিকির সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা শুরু করেন। এক পর্যায়ে ‘আমর বিন আস আব্দুল্লাহ বিন রাবী’আহকে বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আগামীকাল এদের সম্পর্কে এমন প্রসঙ্গ নিয়ে আসব যা এদের জীবিত থাকার মূল কর্তন করে ফেলবে। আর না হয়, এদের ব্যাপারে এমন মন্ত্রের অবতারণা করব যাতে এদের মূল কর্তিত হয়ে এবং সজীবতা ও সতেজতা বিনষ্ট হয়ে যায়। প্রত্যুত্তরে আব্দুল্লাহ বিন রাবী’আহ বললেন, ‘না-না, এমনটি করা সমীচীন হবে না। কারণ, এরা যদিও আমাদের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন তবুও এটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, তাঁরা আমাদের স্বজাতি এবং স্বগোত্রীয় লোক এবং আত্মীয়-স্বজনও বটে।
কিন্তু ‘আমর বিন আস একথার তেমন গুরুত্ব না দিয়ে স্বীয় মতের উপর অটল রইলেন।
পরের দিন পুনরায় নাজ্জাশীর দরবারে উপস্থিত হয়ে, ‘আমর বিন আস বললেন, ‘হে সম্রাট! এরা ঈসা বিন মরিয়ম সম্পর্কে এমন একটি কথা বলেন যা কেউই কোন দিন বলেনি। আপনি ওদের কাছ থেকে এটা জেনে নিয়ে এর প্রতিকার করুন।’
একথা শোনার পর সম্রাট নাজ্জাশী পুনরায় মুসলিমদের ডেকে পাঠালেন। তাঁরা দরবারে এসে উপস্থিত হলে ঈসা (অীঃ) সম্পর্কে মুসলিমগণ কী ধারণা পোষণ করেন তা তিনি জানতে চাইলেন। সম্রাটের মুখ থেকে এ কথা শুনে মুসলিমগণ দ্বিধা দ্বন্দ্ব এবং সংশয়ের মধ্যে নিপতিত হলেন। কারণ ঈসা (আঃ) সম্পর্কে খ্রীষ্টান এবং মুসলিমদের মধ্যে তত্ত্বগত মত পার্থক্য রয়েছে। খ্রীষ্টানগণ বলেন মসীহ (জেসাস) আল্লাহর পুত্র। কিন্তু পার্থক্য হেতু মুসলিমগণ বলেন ঈসা (আঃ) হচ্ছেন আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। তত্ত্বগত এ পার্থক্য হেতু মুসলিমদের সংশয় এ কারণে যে, এ কথা বললে সম্রাট নাজ্জাশী যদি বা বিরূপ ভাব পোষণ করেন, তাহলে মুসলিমদের জন্য তা খুবই উদ্বেগের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু সেটা ছিল নেহাৎই একটা ক্ষণিকের ব্যাপার। আল্লাহর অনুগ্রহের উপর আস্থাশীল দৃঢ়চিত্ত মুসলিমগণ পরক্ষণেই মনস্থির করে ফেললেন যে, আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলের পক্ষ থেকে যে শিক্ষা তাঁরা পেয়েছেন সেটাই হবে তাঁদের মূলমন্ত্র এবং সেটাই হবে তাঁদের বক্তব্য তাতে ভাগ্যে যা ঘটবে ঘটুক।
নাজ্জাশীর প্রশ্নের উত্তরে জা‘ফর বললেন আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল (সাঃ)-এর পক্ষ থেকে আমরা যে শিক্ষা লাভ করেছি তাতে আমরা জেনেছি যে ঈসা (আঃ) হচ্ছেন আল্লাহর বান্দা এবং রাসূল। তাঁর মা মরিয়ম ছিলেন সতী-সাধ্বী এবং আল্লাহর দৃষ্টিতে উচ্চ মর্যাদার মহিলা। আল্লাহর হুকুম এবং বিশেষ ব্যবস্থাধীনে কুমারী মরিয়মের গর্ভে ঈসা (আ)-এর জন্ম হয়।’
এ কথা শ্রবণের পর নাজ্জাশী এক টুকরো খড় উঁচু করে ধরে বললেন, ‘আল্লাহর শপথ, যা তোমরা বলেছ, ঈসা (আঃ)-এর চাইতে এ খড় পরিমাণও বেশী কিছু ছিলেন না।’ এ প্রেক্ষিতে পুরোহিতগণও ‘হুঁ’ ‘হুঁ’ বলে সমর্থন জ্ঞাপন করলেন।
নাজ্জাশী বললেন, ‘হ্যাঁ’, এখন তো তোমরা হাঁ হুঁ বলে সমর্থন জ্ঞাপন করবেই।’
তারপর নাজ্জাশী মুসলিমদের লক্ষ্য করে বললেন, ‘তোমরা নির্ভয়ে, শান্তি ও নিরাপত্তার সঙ্গে আমার রাজ্যে বসবাস কর। যে কেউ তোমাদের উপর অন্যায় করবে তার জন্য জরিমানা ও শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা করা হবে। তোমাদের প্রতি অন্যায় অত্যাচারের বিনিময়ে আমার হাতে কেউ সোনার পাহাড় এনে দিলেও আমি তা সহ্য করব না।’
এর পর তিনি তাঁর পার্শ্বচরদের লক্ষ্য করে বললেন, ‘এই কুরাইশ দূতদের আনীত উপঢৌকন তাদের ফিরিয়ে দাও। উপঢৌকনে আমার কোনই প্রয়োজন নেই। আল্লাহর শপথ! আল্লাহ তা‘আলা যখন আমাকে সাম্রাজ্য ফিরিয়ে দেন তখন আমার নিকট থেকে উপঢৌকন কিংবা উৎকোচ গ্রহণ করেন নি। সে ক্ষেত্রে তাঁর সন্তুষ্টি বিধানের উদ্দেশ্যে কাজ করতে গিয়ে কিভাবে আমি উৎকোচ গ্রহণ করতে পারি। যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা আমার ব্যাপারে অন্য লোকদের কথা গ্রহণ করেন নি, আমি কোন লোকের কোন কথা গ্রহণ করতে পারি না।’
এ ঘটনার বর্ণনাকারিণী উম্মু সালামাহ বলেছেন, এরপর প্রত্যাখ্যাত উপঢৌকন সহ কুরাইশ দূতগণ চরম বেইজ্জতির সঙ্গে নাজ্জাশীর দরবার থেকে বেরিয়ে এলেন এবং আমরা তাঁর ছত্রছায়ায় সম্মানের সঙ্গে তার রাজ্যে অবস্থান করতে থাকলাম।[1]
ইবনে ইসহাক্বের বর্ণনায় এ ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। কোন কোন চরিতকারের বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, নাজ্জাশীর দরবারে ‘আমর বিন আসের উপস্থিতির ঘটনাটি সংঘটিত হয় বদর যুদ্ধের পর। সামঞ্জস্য বিধানের জন্য বলঅ হয়েছে ‘আমর বিন আস দু’দফা নাজ্জাশীর দরবারে গিয়ে ছিলেন। কিন্তু বদর যুদ্ধের পর নাজ্জাশীর দরবারে ‘আমর বিন আসের উপস্থিতি সূত্রে সম্রাট নাজ্জাশী এবং জাফরের মধ্যে যে কথোপকথনের উল্লেখ করা হয়েছে তার সঙ্গে আবিসিনিয়ায় হিজরতের পর নাজ্জাশী এবং জাফরের মধ্যে যে কথোপকথন হয়েছিল তার হুবহু মিল রয়েছে। অধিকন্তু ইবনে ইসহাক্বের বর্ণনায় আবিসিনিয়ায় হিজরতের পর নাজ্জাশীর দরবারে ‘আমর বিন আসের উপস্থিতির কথা বলা হয়েছে এবং ঐ একই প্রশ্নোত্তরের কথা উল্লেখিত হয়েছে। কাজেই, উপর্যুক্ত বিভিন্ন তথ্য প্রমাণের প্রেক্ষাপটে এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, মুসলিমদের ফেরত আনার জন্য ‘আমর বিন আস মাত্র একবার নাজ্জাশীর দরবারে গিয়েছিলেন এবং ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল আবাসিনিয়ায় হিজরতের পর পরই।
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড পৃঃ ৩৩৪-৩৩৮ হতে সংক্ষিপ্ত।
অত্যাচারে কঠোরতা অবলম্বন ও নাবী কারীম (সাঃ)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র (الشدة فى التعذيب ومحاولة القضاء على رسول الله):
যা হোক মুশরিকগণের চাতুর্য শেষ পর্যন্ত পর্যবসিত হল অকৃতকার্যতায় এবং তাঁরা এটাও উপলব্ধি করলেন যে, মুসলিমদের বিরুদ্ধে তাদের শত্রুতা কিংবা তাদের শায়েস্তা করার ব্যাপারে স্বদেশভূমির বাইরে সাফল্য লাভের কোনই সম্ভবানা নেই। কাজেই তাদের প্রচার-সংক্রান্ত কাজকর্ম বন্ধ করতে হলে কিংবা শায়েস্তা করতে হলে স্বদেশের সীমানার মধ্যেই তা করতে হবে। তাছাড়া ষ্ট্রাটেজী বা কর্মকৌশল হিসেবে তাঁরা এটাও স্থির করলেন যে, এদের বিরুদ্ধে সাফল্য লাভ করতে হলে হয় বল প্রয়োগ করে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর প্রচারাভিযান সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিতে হবে আর না হয় তাঁর অস্তিত্বকে ধরাপৃষ্ঠ থেকে একদম নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে হবে।
এমন পরিস্থিতিতে খুব অল্পসংখ্যক মুসলিম মক্কায় অবস্থান করছিলেন যারা ছিলেন অত্যন্ত সম্রান্ত ও মযাদার পাত্র অথবা কারো আশ্রিত। এসত্ত্বেও তারা উদ্যত মুশরিকদের থেকে গোপনে ইবাদত বন্দেগী করতেন। তবুও তারা মুশরিকদের অত্যাচার নির্যাতন থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ ছিলেন না।
অন্যদিকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রকাশ্যভাবে মুশরিকদের সম্মুখে সালাত ও অন্যান্য ইবাদত করতেন এবং সংগোপনে আল্লাহর নিকট দু’আ করতেন এতে কোন শক্তিই তাঁকে বাধা দিতে পারতো না। অতঃপর নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হওয়ার পর তিনি (সাঃ) এমনভাবে প্রচার কাজ আরম্ভ করলেন যে তাঁকে আর কোন শক্তিই আটকিয়ে রাখতে সক্ষম হলো না। দাওয়াতে রেসালাতের কাজ যখন এরকম এক পরিস্থিতির সম্মুখীন তখন আল্লাহ তা’আলা তাঁর পিয়ারা হাবীবকে নির্দেশ দেন-
فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِينَ
‘কাজেই তোমাকে যে বিষয়ের হুকুম দেয়া হয়েছে তা জোরে শোরে প্রকাশ্যে প্রচার কর, আর মুশরিকদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও। (আল-হিজর ১৫ : ৯৪)
উপর্যুক্ত আয়াত অবতীর্ণের পর মুশরিকদের কাজ কেবল এটুকুই ছিল যে, তারা মুহাম্মাদ (সাঃ) থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। মুহাম্মাদ (সাঃ) এর মর্যাদা ও প্রভাবের কারণে এ ব্যতিত আর কিছুই করার ছিল না। অধিকন্তু মুহাম্মাদ (আঃ)-এর অভিভাবক ছিলেন আবূ ত্বালিব যিনি তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র এবং মুশরিকগণের মধ্যে বিরাজমান ছিলেন। তার কারণে মুহাম্মাদের উপর যে কোন কিছু করতে ভীত ছিল। তাছাড়া বনু হাশিমের পক্ষ থেকেও তাদের আশংকা ছিল। তাদের উদ্দেশ্য সাধনের ক্ষেত্রে কোন সিদ্ধান্তের উপর আস্থা রাখতে পারছিল না। যখনই মুশরিকরা কোন পদক্ষেপ গ্রহণের মনস্থ করতো তারা দেখতো যে, তাদের এ কর্মপন্থা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর দাওয়াতের কাছে খড়কুটোর মতোই তুচ্ছ ও অকার্যকর।
অত্যাচারে অত্যাচারে কিভাবে তারা মুসলিমদের জর্জরিত এবং অতিষ্ট করে তুলেছিল তার অসংখ্য প্রমাণ এ সম্পর্কিত হাদীসসমূহের পৃষ্ঠায় রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ এখানে দুয়েকটা ঘটনার কথা উল্লেখিত হল :
একদা আবূ লাহাবের পুত্ৰ উতায়বা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বলল ; আমি (وَالنَّجْمِ إِذَا هَوَىٰ) ও (ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّىٰ) এ আয়াত দুটোকে অস্বীকার করছি। এর পরই সে নাবী কারীম (সাঃ)-কে কষ্ট দেয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগে গেল। সে জামা ছিঁড়ে নষ্ট করে ফেলল এবং তাঁর পাক মুখে থুথু নিক্ষেপ করল। আল্লাহর রহমতে থুথু সে পর্যন্ত গিয়ে পৌছে নাই। সেই অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আল্লাহর সমীপে দু’আ করলেন, اللهم سلط عليه كلبا من كلابك
“হে আল্লাহ! তোমার কুকুরগুলোর মধ্য থেকে এর জন্য একটি কুকুর নিযুক্ত করে দাও।”
নাবী কারীম (সাঃ)-এর দু’আ আল্লাহর সমীপে গৃহীত হল এবং এভাবে তা প্রমাণিত হয়ে গেল।
কিছু সংখ্যক কুরাইশ লোকজনের সঙ্গে একদফা উতায়বা বিদেশ গেল। যখন তারা শাম রাজ্যের জারকা নামক স্থানে শিবিরস্থাপন করল তখন রাতের বেলায় একটি বাঘ এসে তাদের চারপাশে ঘোরাফিরা করতে থাকল। ওকে দেখেই ওতায়বা ভীতি বিহ্বল কণ্ঠে বলে উঠল, ‘হায়! হায়!, আমার ধ্বংস। আল্লাহর শপথ, সে আমাকে খেয়ে ফেলবে। এ মর্মেই মুহাম্মাদ (সাঃ) আমার ধ্বংসের জন্য আল্লাহর নিকট দু’আ করেছিলেন। দেখ আমি শাম রাজ্যে অবস্থান করছি অথচ তিনি মক্কা থেকেই আমাকে হত্যা করছেন’।
উতায়বার এ কথা শ্রবণের পর তার সঙ্গী সাখীরা সাবধানতা অবলম্বনের জন্য তাকে তাদের মধ্যস্থানে শুইয়ে দিল যাতে বাঘ এসে সহজে তার নাগাল না পায়। কিন্তু গভীর রাতে সেখানে বাঘ এসে সকলকে পাশ কাটিয়ে সোজা উতয়বার নিকটে যায় এবং তার মাথাটি শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে যায়।[1]
এক দফা উক্ববা বিন আবী মু’আইত্ব রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন সিজদারত ছিলেন তখন তার ঘাড় এত জোরে পদতলে পিষ্ঠ করল যে মনে হল তার অক্ষিগোলক দুটো তখনই অক্ষিপট থেকে বেরিয়ে আসবে।[2]
ইবনে ইসহাক্বের এক দীর্ঘ বর্ণনায় চরমপন্থী কুরাইশগণের এরূপ দুরভিসন্ধির আভাষ পাওয়া যায় যে, তারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে হত্যা করে দুনিয়া থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল।
অন্যান্য কুরাইশ দুর্বৃত্তদের সম্পর্কেও সত্যিকারভাবে বলা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে হত্যার মাধ্যমে ধরাপৃষ্ঠ থেকে ইসলামের নাম নিশানা মুছে ফেলার এক গভীর চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র তাদের অন্তরে ক্রমেই দানা বেঁধে উঠতে থাকে। যেমনটি আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর বিন ‘আস হতে ইবনে ইসহাক্ব তাঁর বর্ণনা উদ্ধৃত করে বলেছেন যে, এক দফা কুরাইশ মুশরিকগণ কাবাহ’র হাতীমে সম্মিলিতভাবে অবস্থান করছিল। সেখানে আমিও উপস্থিত ছিলাম। মুশরিকগণ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সম্পর্কে নানা প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ আলোচনা করছিল। আলোচনার এক পর্যায়ে তারা বলল, এ ব্যক্তির ব্যাপারে আমরা যে ধৈর্য ধারণ করেছি তার কোন তুলনা নাই। প্রকৃতই এর ব্যাপারে আমরা বড়ই ধৈর্য ধারণ করেছি।
এ ধারায় যখন তাদের কথোপকথন চলছিল তখন কিছুটা যেন অপ্রত্যাশিতভাবেই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলেন। সেখানে আগমনের পর সর্ব প্রথম তিনি হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করলেন এবং কা’বাহ ঘর প্রদক্ষিণ করলেন। এ সব করতে গিয়ে তাকে মুশরিকগণের নিকট দিয়ে যাতায়াত করতে হল। এ অবস্থায় কিছু বিদ্রুপাত্মক কথাবার্তা বলে তারা তার প্রতি কটাক্ষ করায় নাবী (সাঃ)-এর মনে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হল তার বহিঃপ্রকাশ তার চেহারা মুবারকে আমি সুস্পষ্টভাবে লক্ষ্য করলাম। এর পর দ্বিতীয় দফায় তিনি যখন সেখানে গেলেন তখনো মুশরিকগণ অনুরূপভাবে তাকে বিদ্রপাত্মক কথাবার্তা বলে ভর্ৎসনা করল। আমি এবারও তার মুখমণ্ডলে এর প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলাম। তারপর তৃতীয় দফায় তিনি সেখানে গেলে এবারও তারা পূর্বের মতো বিদ্রুপাত্মক কথাবার্তা বলল। এবার নাবী কারীম (সাঃ) সেখানে থেমে গেলেন এবং বললেন,
أتسمعون يا معشر قريش اما والذى نفس محمد بيده لقد جئتكم بالذبح
‘হে কুরাইশগণ! শুনছ? সেই সত্ত্বার শপথ যার হাতে আমার জীবন, আমি তোমাদের নিকট কুরবাণীর পশু নিয়ে এসেছি।’
তাদের প্রতি নাবী (সাঃ)-এর এ সম্বোধন এবং কথাবার্তা তাদেরকে এতই প্রভাবিত করে ফেলল (তাদের উপর মূৰ্ছা পাওয়ার মতো অবস্থা এসে পড়ল) এবং এমন এক অনুভূতির সৃষ্টি হয়ে গেল যে তাদের মনে হতে লাগল যেন প্রত্যেকের মাথার উপর চড়ুই বসে রয়েছে। এমনকি ঐ দলের মধ্যে যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপর সব চেয়ে প্রতিহিংসাপরায়ণ ছিল সেও যেন খুব ভাল হয়ে গেল এবং পঞ্চমুখে তাঁর প্রশংসা শুরু করল। অত্যন্ত বিনীতভাবে সে বলতে থাকল, ‘আবূল কাশেম! প্রত্যাবর্তন করুন। আল্লাহর কসম! আপনি কখনই জ্ঞানহীন ছিলেন না।’
দ্বিতীয় দিনেও তারা সেখানে একত্রিত হয়ে তার সম্পর্কে আলাপ আলোচনায় রত ছিল এমন সময় তিনি সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তাঁকে এভাবে দেখে তারা সকলে সম্মিলিতভাবে তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার উদ্দেশ্যে তাকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ধরল। আমি লক্ষ্য করলাম তাদের মধ্য থেকে একজন তার গলার চাদর ধরে নিল এবং বল প্রয়োগ শুরু করে দিল। আবূ বকর (রা.) তাকে বাচানোর জন্য চেষ্টা করতে লাগলেন। তিনি
ক্ৰন্দনরত অবস্থায় বলছিলেন, اتقتلون رجلا ان يقول ربي الله
অর্থ : ‘তোমরা লোকটিকে কি এ জন্য হত্যা করছে যে, তিনি বলেছেন যে, আল্লাহ আমার প্রভু?’
এর পর তারা নাবী (সাঃ)-কে ছেড়ে দিয়ে স্বস্থানে প্রত্যাবর্তন করল। আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস বলেছেন যে, এটাই ছিল সব চেয়ে কঠিন অত্যাচার ও উৎপীড়ন যা আমি কুরাইশগণকে করতে দেখেছি।[3] (সার সংক্ষেপ শেষ হল)।
সহীহুল বুখারীতে উরওয়া বিন জুবাইর (রা.) হতে বর্ণিত এক বিবরণ থেকে জানা যায়, তিনি বলেছেন যে, আমি আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর বিন আসকে মুশরিকগণ নাবী (সাঃ)-এর উপর সব চেয়ে কঠিন যে নিপীড়ন চালিয়েছিল, তা আমার সামনে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করার জন্য প্রশ্ন করলাম। তিনি বললেন যে, একদা নাবী (সাঃ) কাবাহ গৃহের হাতীমে সালাত পড়ছিলেন এমন সময় উক্ববা বিন আবী মু’আইত্ব সেখানে আগমন করলেন। তিনি সেখানে উপস্থিত হয়েই নিজ কাপড় দ্বারা তাঁর গ্রীবা ধারণ করে অত্যন্ত জোরে চপেটাঘাত করলেন এবং গলা টিপে ধরলেন। এমন সময় আবূ বকর সেখানে উপস্থিত হলেন এবং উক্ববার দু’কাঁধ ধরে জোরে ধাক্কা দিয়ে তাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বললেন, اتقتلون رجلا ان يقول ربي الله
অর্থ : তোমরা লোকটিকে এ জন্যই হত্যা করছ যে, তিনি বলেছেন যে, আমার প্রভু আল্লাহ।[4] আসমার বর্ণনায় অধিক বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, আবূ বকরের নিকট যখন এ আওয়াজ পৌছল যে, ‘আপন বন্ধুকে বাঁচাও’ তিনি তখন অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে আমাদের মধ্য থেকে বের হলেন। তার মাথার উপর চারটি ঝুঁটি ছিল। যাবার সময় আবূ বকর বলতে বলতে গেলেন, اتقتلون رجلا ان يقول ربي الله
অর্থ : তোমরা লোকটিকে শুধু এ কারণে হত্যা করছ যে, তিনি বলেন যে, আমার প্রভু আল্লাহ।
এরপর মুশরিকগণ নাবী কারীম (সাঃ)-কে ছেড়ে দিয়ে আবূ বকরের উপর ঝাপিয়ে পড়েন। তিনি যখন ফেরৎ আসলেন তখন তার অবস্থা ছিল এরূপ যে, আমরা তাঁর চুলের মধ্য থেকে যে ঝুঁটিটাই ধরছিলাম সেটাই আমাদের টানের সঙ্গে সঙ্গে উঠে আসছিল।[5]
ফুটনোটঃ[1] শায়খ আবদুল্লাহ, মুখতাসারুস সীরাহ পৃঃ ১৩৫, ইস্তিয়ার, এসবাহ, দালায়েন নবুয়্যত, রওযুল আনাফ।
[2] প্রাগুক্ত/মুখতাসারুস সীরাহ ১১৩ পৃঃ।
[3] ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ২৮৯-২৯০ পৃঃ।
[4] সহীহুল বুখারী মক্কার মুশরিকগণের নবী (সা.)-এর প্রতি উৎপীড়ন অধ্যায় ১ম খণ্ড পৃঃ ৫৪৪।
[5] শাইখ আবদুল্লাহ মোখতাসারুস সীরাহ পৃঃ ১১৩।
বড় বড় সাহাবাদের ইসলাম গ্রহণ
হামযাহ (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণ (إِسْلَامُ حَمْزَةَ رَضِيْ اللهُ عَنْهُ):
মক্কার বিস্তৃত অঞ্চল অন্যায় ও অত্যাচারের ঘনকৃষ্ণ মেঘমালা দ্বারা আচ্ছাদিত ছিল। সেই মেঘ মালার মধ্য থেকে হঠাৎ এক ঝলক বিদ্যুত চমকিত হওয়ায় মজলুমদের পথ আলোকিত হল, হামযাহ মুসলিম হয়ে গেলেন। তাঁর ইসলাম গ্রহণের ঘটনা সংঘটিত হয় নবুওয়ত প্রাপ্তি ৬ষ্ঠ বর্ষের শেষভাগ। সম্ভবতঃ তিনি যুল হিজ্জাহ মাসে মুসলিম হয়েছিলেন।
আল্লাহ তা‘আলা যাঁর উপর রহম করেন তাঁর পক্ষেই ইসলামের অমিয় ধারা থেকে এক অাঁজলা পান করা সম্ভব হয়। যদিও হামযাহর ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারটিও আল্লাহর তা‘আলার খাস রহমতেরই ফলশ্রুতি তবুও তাঁর ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে একটি বিশেষ ঘটনার কথা উল্লেখ না করে পারা যায় না। ঘটনাটি হচ্ছে এরূপ, এক দিবসে আবূ জাহল সাফা পর্বতের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। নাবী কারীম (সাঃ) সেখানে উপস্থিত ছিলেন। নাবী (সাঃ)-কে দেখে অনেক কটু কাটব্য করল এবং অপমানসূচক কথাবার্তা বললে নাবী কারীম (সাঃ) তার কথাবার্তার কোন উত্তর দিলেন না। আবূ জাহল একটি পাথর তুলে নিয়ে নাবীজী (সাঃ)-এর মাথায় আঘাত করল। এর ফলে আঘাতপ্রাপ্ত স্থান হতে রক্তধারা প্রবাহিত হতে থাকল। তারপর সে ক্বাবা’হ গৃহের নিকটে কুরাইশগণের বৈঠকে গিয়ে যোগদান করল।
আব্দুল্লাহ বিন জুদয়ানের এক দাসী নিজগৃহ থেকে সাফা পর্বতের উপর সংঘটিত ঘটনাটি আদ্যোপান্ত প্রত্যক্ষ করছিল। হামযাহ (রাঃ) মৃগয়া থেকে প্রত্যাবর্তন করা মাত্রই (তখনো তাঁর হাতে তীর ধনুক ছিল এমতাবস্থায়ঃ) সে তাঁকে আবূ জাহলের অন্যায় অত্যাচার এবং নাবী (সাঃ)-এর ধৈর্য ধারণের ব্যাপারটি বর্ণনা করে শোনাল। ঘটনা শ্রবণ করা মাত্র তিনি ক্রোধে ফেটে পড়লেন। কুরাইশগণের মধ্যে তিনি ছিলেন মহাবীর এবং মহাবলশালী এক যুবক। এ মুহূর্তে বিলম্ব না করে তিনি এ সংকল্পবদ্ধ হয়ে ছুটে চললেন যে, যেখানেই আবূ জাহলের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ লাভ হবে সেখানেই তিনি তার ভূত ছাড়াবেন। তিনি তার খোঁজ করতে করতে গিয়ে তাকে পেলেন মসজিদুল হারামে। সেখানে তিনি তার মুখোমুখী দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললেন, ‘ও হে গুহ্যদ্বার দিয়ে বায়ূ নিঃসরণকারী! আমার ভ্রাতুষ্পুত্র মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে তুমি গালি দিয়েছ এবং পাথর দিয়ে আঘাত করেছ। অথচ আমি তার দ্বীনেই আছি।
এরপর তিনি কামানের দ্বারা তার মাথার উপর এমনভাবে আঘাত করলেন যাতে সে আহত হয়ে গেল। এর ফলে আবূ জাহলের বনু মখযুম ও হামযাহ (রাঃ)-এর বনু হাশিম গোত্রদ্বয় একে অপরের প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। কিন্তু আবূ জাহল এভাবে সকলকে নিরস্ত করল যে, আবূ উমারাকে যেতে দাও। আমি প্রকৃতই তার ভ্রাতুষ্পুত্রকে গালমন্দ এবং আঘাত দিয়েছি।[1]
প্রাথমিক পর্যায়ে হামযাহর ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারটি ছিল কিছুটা যেন ভ্রাতুষ্পুত্রের প্রতি আবেগের উৎস থেকে উৎসারিত। মুশরিকগণ ভ্রাতুষ্পুত্রকে কষ্ট দিত। এটা বরদাস্ত করা তাঁর পক্ষে খুবই কঠিন ছিল। কাজেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করলে হয়তো তার দুঃখ কষ্টের কিছু লাঘব হতে পারে এ ধারণার বশবর্তী হয়েই তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন।[2] পরে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর অন্তরে ইসলাম প্রীতি জোরদার করে দেয়ায় তিনি দ্বীনের রশি মজবুত করে ধরলেন। তাঁর ইসলাম গ্রহণের ফলে মুসলামানদের শক্তি এবং সম্মান দুই-ই বৃদ্ধি পেল।
ফুটনোটঃ[1] শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাবঃ মোখতারুস সীরাহ পৃঃ ৬৬, আল্লামা মানসুরপুরীঃ রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ৬৮ পৃঃ। ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ২৯১-২৯২ পৃঃ।
[2] শাইখ আবদুল্লাহ মুখতাসারুস সীরাহ পৃঃ ১০১।
উমার (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণ (إِسْلاَمُ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ):
অন্যায় অত্যাচারের বিস্তৃতি পরিমন্ডলে ঘনকৃষ্ণ মেঘমালার বুক চিরে আরও একটি জ্যোতিষ্মান বিদ্যুতের চমকে আরব গগণ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। আরব জাহানের অন্যতম তেজস্বী পুরুষ উমার বিন খাত্তাব ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন। তাঁর ইসলাম গ্রহণের ঘটনা সংঘটিত হয় নবুওয়ত ৬ষ্ঠ বর্ষে[1] হামযাহ (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণের মাত্র ৩ দিন পর। নাবী কারীম (সাঃ) উমার (সাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণের জন্য আল্লাহর সমীপে প্রার্থনা করেছিলেন।
ইমাম তিরমিযী আব্দুল্লাহ বিন উমার হতে এ বিষয়টি বর্ণনা করেছেন এবং একে বিশুদ্ধ হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। অনুরূপভাবে তাবারাণী ইবনে মাসউদ (রাঃ) এবং আনাসের মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন যে, নাবী (সাঃ) বলতেন :
اللَّهُمَّ أَعِزَّ الْإِسْلَامَ بِأَحَبِّ هَذَيْنِ الرَّجُلَيْنِ إِلَيْكَ بِعُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ أَوْ بِأَبِيْ جَهْلٍ بن هشام
‘হে আল্লাহ! উমার বিন খাত্তাব অথবা আবূ জাহল বিন হিশাম এর মধ্য হতে যে তোমার নিকট অধিক প্রিয় তার দ্বারা ইসলামকে শক্তিশালী করে দাও।’
(আল্লাহ এ প্রার্থনা গ্রহণ করলেন এবং উমার মুসলিম হয়ে গেলেন)। এ দু’জনের মধ্যে আল্লাহর নিকট উমার (রাঃ) অধিক প্রিয় ছিলেন।[2]
উমার (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কিত সমস্ত বর্ণনা একত্রিত করে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তাঁর অন্তরে ইসলাম ধীরে ধীরে স্থান লাভ করতে থাকে। ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কিত বিষয়াদির সার সংক্ষেপ তুলে ধরার পূর্বে তাঁর মেজাজ এবং আবেগ ও অনুভূতি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করা সঙ্গত বলে মনে করি।
উমার (রাঃ) তাঁর উগ্র মেজায, রূঢ় প্রকৃতি এবং বীরত্বের জন্য আরব সমাজে বিশেষভাবে বিখ্যাত ছিলেন। মুসলিমগণকে বেশ কিছুকাল যাবৎ তাঁর হাতে উৎপীড়িত ও নিগৃহীত হতে হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও একটি লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্যের আভাষ যেন প্রথম থেকেই তাঁর মধ্যে পরিলক্ষিত হতো। তাঁর হাবভাব দেখে মনে হতো যে, ভাবাবেগের দু’বিপরীতমুখী শক্তি যেন তাঁর অন্তর রাজ্যে পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত রয়েছে। একদিকে তিনি তাঁর পূর্ব পুরুষগণের অনুসৃত রীতিনীতি ও আচার অনুষ্ঠানের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং মদ্যপান ও আমোদ প্রমোদের প্রতি তাঁর যথেষ্ট আসক্তি ছিল। অন্যদিকে মুসলিমদের ঈমান ও আকীদা এবং বিপদ আপদে তাঁদের ধৈর্য ধারণের অসাধারণ ক্ষমতা দেখে তিনি হতবাক হয়ে যেতেন এবং সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাঁদের দিকে চেয়ে থাকতেন। অধিকন্তু কোন কোন সময় জ্ঞানী ব্যক্তিগণের মতো তাঁর মনে তত্ত্ব-চিন্তার উদ্রেকও হতো। তিনি আপন খেয়ালে চিন্তা করতে থাকতেন নানা বিষয়, নানা কথা। কোন কোন সময় এটাও তাঁর মনে হতো যে, ইসলাম যে পথের সন্ধান দিচ্ছে, যে পথের চলার জন্য উদাত্ত আহবান জানাচ্ছে সম্ভবতঃ সেটাই উত্তম ও পবিত্রতম পথ। এ জন্য প্রায়শঃই তিনি দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগতেন, কোন কোন সময় বিচলিত বোধ করতেন, কখনো বা নিরুৎসাহিত বোধ করতেন।[3]
উমার (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কিত বিবরণাদির সমন্বিত সার সংক্ষেপ হচ্ছে এক রাত্রি তাঁকে বাড়ির বাইরে অবস্থানের মধ্য দিয়ে রাত্রি যাপন করতে হয়। তিনি হারামে আগমন করেন এবং ক্বাবা’হ গৃহেরপর্দার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। নাবী কারীম (সাঃ) সেই সময় নামাযে লিপ্ত ছিলেন। নামাযে তিনি সূরাহ ‘আলহাক্কা’’ তিলাওয়াত করছিলেন। উমার (রাঃ) নীরবে গভীর মনোযোগের সঙ্গে তিলাওয়াত শ্রবণ করলেন এবং এর ঝংকার, বাক্য বিন্যাস ও সুর-মাধূর্যে মুগ্ধ, চমৎকৃত ও হতবাক হয়ে গেলেন।
উমারের বর্ণনা সূত্রে এটা বলা হয়েছে যে, তিনি বলেছেনঃ আমি মনে মনে করলাম, আল্লাহর কসম, কুরাইশরা যেমনটি বলে থাকেন তিনি হচ্ছেন একজন কবি। কিন্তু এ সময় নাবী (সাঃ) এ আয়াত পাঠ করেনঃ
{إِنَّهُ لَقَوْلُ رَسُوْلٍ كَرِيْمٍ وَمَا هُوَ بِقَوْلِ شَاعِرٍ قَلِيْلاً مَا تُؤْمِنُوْنَ} [الحاقة:40، 41]
‘‘যে, অবশ্যই এ কুরআন এক মহা সম্মানিত রসূল [জিবরীল (‘আ.)]-এর (বহন করে আনা) বাণী। ৪১. তা কোন কবির কথা নয়, (কবির কথা তো) তোমরা বিশ্বাস করো না।’ (আল-হাক্কাহ ৬৯ : ৪০-৪১)
উমার (রাঃ) বললেন, ‘আমি মনে মনে বললাম, আর এ তো হচ্ছে আমারই মনের কথা, সে কী করে তা জানল। নিশ্চয়ই মুহাম্মাদ (সাঃ) হচ্ছেন একজন মন্ত্রতন্ত্রধারী গনৎকার। আমার মনে এ ভাবের উদয় হওয়ার পর-পরই মুহাম্মাদ (সাঃ) তিলাওয়াত করলেনঃ
{وَلَا بِقَوْلِ كَاهِنٍ قَلِيْلًا مَا تَذَكَّرُوْنَ تَنزِيْلٌ مِّن رَّبِّ الْعَالَمِيْنَ} إلى آخر السورة [الحاقة:42، 43]
‘‘ এটা কোন গণকের কথাও নয়, (গণকের কথায় তো) তোমরা নাসীহাত লাভ করো না। ৪৩. এটা বিশ্ব জগতের প্রতিপালকের নিকট থেকে অবতীর্ণ।’ (আল-হাক্কাহ ৬৯ : ৪২-৪৩)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সালাতে সূরাহর শেষ পর্যন্ত তিলাওয়াত করলেন এবং উমার (রাঃ) তা শ্রবণ করলেন। এ প্রসঙ্গে উমার (রাঃ) বলেছেন যে, ‘সেই সময় ইসলাম আমার অন্তর রাজ্যে স্থান অধিকার করে বসল।[4]
প্রকৃতপক্ষে, উমার (রাঃ)-এর অন্তর রাজ্যে এটাই ছিল ইসলামের বীজ বপনের প্রথম সময়। কিন্তু তখনো তাঁর চেতানায় অজ্ঞতাপ্রসূত আবেগ, আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রতি প্রবল আকর্ষণ এবং পূর্ব-পুরুষগণের ধর্মীয় অনুভূতি ও বিশ্বাসের ঐতিহ্যগত প্রভাব জগদ্দল প্রস্তরের মতো তাঁর মন-মস্তিষ্ককে এতই প্রভাবিত করে রেখেছিল যে ইসলামের প্রাথমিক অনুভূতির কার্যকারিতা তেমন একটা ছিল না বললেই চলে। কাজেই, বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা সংস্কারকে জিইয়ে রাখার ব্যাপারেই তাঁর আগ্রহ ছিল ঐকান্তিক।
তিনি ছিলেন অত্যন্ত কঠোর প্রকৃতির লোক। তাঁর স্বভাবগত কঠোরতার কারণেই তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এবং মুসলিমদের অন্যতম বিপজ্জনক শত্রু। তিনি এতই বিপজ্জনক ছিলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে হত্যা করার উদ্দেশ্যে এক দিবসে তিনি উলঙ্গ তরবারি হাতে বহির্গত হন। রুদ্র মেজাজে তাঁর পথচলার এক পর্যায়ে আকস্মিকভাবে নঈম বিন আব্দুল্লাহ নাহহাম আদভী[5] কিংবা বনু যুহরা[6] কিংবা বনু মাখযুমের[7] কোন এক ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। তাঁর ভ্রূ-যুগল কুঞ্চিত অবস্থায় দেখে সেই ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, ‘হে উমার! কী উদ্দেশ্যে কোথায় চলেছ? তিনি বললেন, ‘মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে হত্যা করার উদ্দেশ্যে চলেছি।’
লোকটি বলল, ‘মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে হত্যা করে বনু হাশিম ও বনু যুহরা থেকে কিভাবে রক্ষা পাবে? উমার বলেলেন, ‘মনে হচ্ছে তোমরাও পূর্ব পুরুষগণের ধর্ম পরিত্যাগ করে বেদ্বীন হয়ে গিয়েছ।
লোকটি বলল, ‘উমার! একটি আজব কথা তোমাকে শোনাব না কি? তোমার বোন ও ভগ্নিপতিও তোমাদের ধর্ম পরিত্যাগ করে বেদ্বীন হয়ে গিয়েছে।’
এ কথা শুনে উমার প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুন্ডে ঘৃতাহুতি দেয়ার মতো ক্রোধাগ্নিতে দপ করে জ্বলে উঠলেন এবং সোজা ভগ্নীপতির গৃহাভিমুখে যাত্রা করলেন। সেখানে খাব্বাব বিন আরাত্ত একটি সহীফার সাহায্যে সূরাহ ত্ব-হা’র অংশ বিশেষ স্বামী-স্ত্রীকে তালীম দিচ্ছিলেন। খাব্বাব তাঁদের তালীম দেয়ার জন্য নিয়মিত সেখানে যাতায়াত করতেন। খাব্বাব (রাঃ) যখন উমার (রাঃ)-এর সেখানে গমনের শব্দ শ্রবণ করলেন তখন তিনি ঘরের মধ্যে গিয়ে আত্মগোপন করলেন এবং উমারের বোন ফাত্বিমাহ সহীফা খানা লুকিয়ে রাখলেন। কিন্তু উমার বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে খাববাবের কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিলেন। তাই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কার কণ্ঠে মৃদু মৃদু আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম যেন।’
তাঁর বোন উত্তর করলেন, ‘না তেমন কিছুই না। আমরাই পরস্পর কথাবার্তা বলছিলাম।
উমার (রাঃ) বললেন, ‘সম্ভবতঃ তোমরা উভয়েই বেদ্বীন হয়ে গিয়েছ?
ভগ্নিপতি সাঈদ বললেন, আচ্ছা উমার! বলত, তোমাদের ধর্ম ছাড়া অন্য কোন ধর্মে যদি সত্য থাকে তবে করণীয় কী হবে?
এ কথা শোনা মাত্র উমার তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে ভগ্নীপতিকে নির্মমভাবে প্রহার করতে শুরু করলেন। নিরুপায় ভগ্নী জোর করে ভ্রাতাকে স্বামী থেকে পৃথক করে দিলেন। এতে আরও ক্রুব্ধ হয়ে উমার (রাঃ) তাঁর বোনের গন্ডদেশে এমন এক চপেটাঘাত করলেন যে, সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মুখমন্ডল রক্তাক্ত হয়ে গেল। ইবনে ইসহাক্বের বর্ণনায় আছে যে, তিনি মাথায় আঘাত প্রাপ্ত হয়েছিলেন। ভগ্নী ক্রোধ ও আবেগ জড়িত কণ্ঠে বললেন,
يَا عُمَرُ، إِنْ كَانَ الْحَقُّ فِيْ غَيْرِ دِيْنِكَ، أَشْهَدُ أَنْ لاَّ إِلٰهَ إِلاَّ اللهُ ، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا رَّسُوْلُ اللهِ
‘‘উমার! তোমার ধর্ম ছাড়া অন্য ধর্ম যদি সত্য হয়, এ কথা বলে তিনি কালেমা শাহাদত পাঠ করলেন, ‘আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্যিকারের কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁর বান্দা ও রাসূল।’
শাহাদতের এ বাণী শ্রবণ করা মাত্র উমার (রাঃ)-এর ভাবান্তর শুরু হয়ে গেল। তিনি তাঁর বোনের রক্তাক্ত মুখমন্ডল দেখে লজ্জিত হলেন। তারপর তিনি বোনকে সম্বোধন করে দয়ার্দ্র কণ্ঠে বললেন, ‘তোমাদের নিকট যে বইখানা আছে তা আমাকে একবার পড়তে দাওনা দেখি।
বোন বললেন, ‘তুমি অপবিত্র রয়েছ। অপবিত্র লোকের এটা স্পর্শ করা চলে না। শুধু মাত্র পবিত্র লোকেরাই এ বই স্পর্শ করতে পারবে। তুমি গোসল করে এসো তবেই বই স্পর্শ করতে পারবে। উমার গোসল করে পাক-সাফ হলেন তার পর সহীফা খানা হাতে নিলেন এবং বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম পড়লেন। বলতে লাগলেন এ তো বড়ই পবিত্র নাম! তারপর সূরাহ ত্ব-হা হতে পাঠ করলেন :
طه (1) مَا أَنْزَلْنَا عَلَيْكَ الْقُرْآنَ لِتَشْقٰى (2) إِلاَّ تَذْكِرَةً لِمَنْ يَخْشٰى (3) تَنْزِيْلاً مِمَّنْ خَلَقَ الْأَرْضَ وَالسَّمَاوَاتِ الْعُلٰى (4) الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوٰى (5) لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا وَمَا تَحْتَ الثَّرٰى (6) وَإِنْ تَجْهَرْ بِالْقَوْلِ فَإِنَّهُ يَعْلَمُ السِّرَّ وَأَخْفٰى (7) اللَّهُ لا إِلَهَ إِلَّا هُوَ لَهُ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنٰى (8) وَهَلْ أَتَاكَ حَدِيْثُ مُوْسٰى (9) إِذْ رَأى نَاراً فَقَالَ لِأَهْلِهِ امْكُثُوْا إِنِّي آنَسْتُ نَاراً لَعَلِّي آتِيْكُمْ مِنْهَا بِقَبَسٍ أَوْ أَجِدُ عَلَى النَّارِ هُدىً (10) فَلَمَّا أَتَاهَا نُوْدِيَ يَا مُوْسٰى (11) إِنِّي أَنَا رَبُّكَ فَاخْلَعْ نَعْلَيْكَ إِنَّكَ بِالْوَادِ الْمُقَدَّسِ طُوىً (12) وَأَنَا اخْتَرْتُكَ فَاسْتَمِعْ لِمَا يُوْحٰى(13) إِنَّنِيْ أَنَا اللهُ لا إِلٰهَ إِلاَّ أَنَا فَاعْبُدْنِيْ وَأَقِمِ الصَّلاةَ لِذِكْرِيْ (14) (سورة طه 1-144)
‘‘১. ত্ব-হা-। ২. তোমাকে ক্লেশ দেয়ার জন্য আমি তোমার প্রতি কুরআন নাযিল করিনি। ৩. বরং তা (নাযিল করেছি) কেবল সতর্কবাণী হিসেবে যে ভয় করে (আল্লাহকে)। ৪. যিনি পৃথিবী ও সুউচ্চ আকাশ সৃষ্টি করেছেন তাঁর নিকট হতে তা নাযিল হয়েছে। ৫. ‘আরশে দয়াময় সুপ্রতিষ্ঠিত আছেন। ৬. যা আকাশে আছে, যা যমীনে আছে, যা এ দু’য়ের মাঝে আছে আর যা ভূগর্ভে আছে সব তাঁরই। ৭. যদি তুমি উচ্চকণ্ঠে কথা বল (তাহলে জেনে রেখ) তিনি গুপ্ত ও তদপেক্ষাও গুপ্ত বিষয় জানেন। ৮. আল্লাহ, তিনি ব্যতীত সত্যিকারের কোন ইলাহ নেই, সুন্দর নামসমূহ তাঁরই। ৯. মূসার কাহিনী তোমার কাছে পৌঁছেছে কি? ১০. যখন সে আগুন দেখল (মাদ্ইয়ান থেকে মিসর যাওয়ার পথে), তখন সে তার পরিবারবর্গকে বলল, ‘তোমরা এখানে অবস্থান কর, আমি আগুন দেখেছি, সম্ভবতঃ আমি তাত্থেকে তোমাদের জন্য কিছু জ্বলন্ত আগুন আনতে পারব কিংবা আগুনের নিকট পথের সন্ধান পাব। ১১. তারপর যখন যে আগুনের কাছে আসল, তাকে ডাক দেয়া হল, ‘হে মূসা! ১২. বাস্তবিকই আমি তোমার প্রতিপালক, কাজেই তোমার জুতা খুলে ফেল, তুমি পবিত্র তুওয়া উপত্যকায় আছ। ১৩. আমি তোমাকে বেছে নিয়েছি, কাজেই তুমি মনোযোগ দিয়ে শুন যা তোমার প্রতি ওয়াহী করা হচ্ছে। ১৪. প্রকৃতই আমি আল্লাহ, আমি ছাড়া সত্যিকারের কোন ইলাহ নেই, কাজেই আমার ‘ইবাদাত কর, আর আমাকে স্মরণ করার উদ্দেশে সলাত কায়িম কর’।’ (ত্ব-হা ২০ : ১-১৪)
বললেন, ‘এটা তো বড়ই উত্তম এবং বড়ই সম্মানিত কথা। আমাকে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর সন্ধান বল।’
উমারের এ কথা শুনে খাব্বাব (রাঃ) তাঁর গোপনীয় অবস্থান থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, ‘উমার! সন্তুষ্ট হয়ে যাও। আমার আশা যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বিগত বৃহস্পতিবার রাত্রে তোমার সম্পর্কে যে প্রার্থনা করেছিলেন (হে আল্লাহ! উমার বিন খাত্তাব অথবা আবূ জাহল বিন হিশাম এর দ্বারা ইসলামকে শক্তিশালী করে দিন) তা কবুল হয়েছে। এ সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সাফা পর্বতের নিকটস্থ গৃহে অবস্থান করছিলেন।’
খাব্বাব (রাঃ)-এর মুখ থেকে এ কথা শ্রবণের পর উমার (রাঃ) তাঁর তরবারিখানা কোষে প্রবেশ করিয়ে নিয়ে সেই বাড়ির বহিরাঙ্গনে উপস্থিত হয়ে দরজায় করাঘাত করলেন। দরজার ফাঁক দিয়ে এক ব্যক্তি উঁকি দিয়ে দেখতে পেলেন যে, কোষবদ্ধ তলোয়ারসহ উমার দন্ডায়মান রয়েছেন। ঝটপট রাসূলুল্লাহ (রাঃ)-কে তা অবগত করানো হল। উপস্থিত লোকজন যাঁরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন সকলেই সঙ্গে সঙ্গে কাছাকাছি অবস্থায় সংঘবদ্ধ হয়ে গেলেন। সকলের মধ্যে এ সন্ত্রস্ত ভাব লক্ষ করে হামযাহ (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ব্যাপার, কী এমন হয়েছে?’
লোকজনেরা উত্তর দিলেন, ‘উমার বহিরাঙ্গনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।’
হামযাহ বললেন, ‘ঠিক আছে। উমার এসেছে, দরজা খুলে দাও। যদি সে সদিচ্ছা নিয়ে আগমন করে থাকে তাহলে আমাদের তরফ থেকেও ইন-শা-আল্লাহ সদিচ্ছার কোনই অভাব হবে না। আর যদি সে কোন খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে আগমন করে থাকে তাহলে আমরা তাকে তার তলোয়ার দ্বারাই খতম করব। এ দিকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করছিলেন এবং তাঁর উপর ওহী নাযিল হচ্ছিল। ওহী নাযিল সমাপ্ত হলে তিনি উমারের নিকট আগমন করলেন বৈঠক ঘরে। তিনি তাঁর কাপড় এবং তরবারির কোষ ধরে শক্তভাবে টান দিয়ে বললেন,
(أَمَا أَنْتَ مُنْتَهِيًا يَا عُمَرُ حَتّٰى يَنْزِلَ اللهُ بِكَ مِنْ الْخَزِى وَالنِّكَالِ مَا نَزَلَ بِالْوَلِيْدِ بْنِ الْمُغِيْرَةِ؟)
‘‘উমার! যেমনটি ওয়ালীদ বিন মুগীরার উপর অবতীর্ণ হয়েছিল সেইরূপ আল্লাহর তরফ থেকে যতক্ষণ না তোমার উপর লাঞ্ছনা, অবমাননা এবং শিক্ষামূলক শাস্তি অবতীর্ণ না হচ্ছে ততক্ষণ কি তুমি পাপাচার থেকে বিরত হবে না?’
তারপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আল্লাহর সমীপে দু‘আ করলেন,
اللهم هٰذَا عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ، اللهم أَعِزِّ الْإِسْلاَمَ بِعُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ
‘‘হে সর্বশক্তিমান প্রভূ! তোমার ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছাই হচ্ছে চূড়ান্ত। এ উমার বিন খাত্তাবের দ্বারা ইসলামের শক্তি এবং সম্মান বৃদ্ধি করুন।’ নাবী (সাঃ)-এর প্রার্থনা শ্রবণের পর উমার (রাঃ)-এর অন্তরে এমন এক স্পন্দনের সৃষ্টি হতে থাকল যে, তিনি অস্থির হয়ে পড়লেন এবং পাঠ করলেন,
أَشْهَدُ أَن لاَّ إِلٰهَ إِلاَّ اللهُ ، وَأَنَّكَ رَسُوْلُ اللهِ
অর্থঃ ‘আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই এবং সত্যই আপনি আল্লাহর রাসূল।’
উমার (রাঃ)-এর মুখ থেকে তাওহীদের এ বাণী শ্রবণ মাত্র গৃহাভ্যন্তরস্থিত লোকজনেরা এত জোরে ‘আল্লাহ আকবর’ ধ্বনি উচ্চারণ করলেন যে, মসজিদুলু হারামে অবস্থানকারী লোকেরাও তা স্পষ্টভাবে শুনতে পেলেন।[8] আরব মুলুকে এটা সর্বজন বিদিত বিষয় ছিল যে, উমার বিন খাত্তাব ছিলেন অত্যন্ত প্রতাপশালী এবং প্রভাবশালী। তিনি এতই প্রতাপশালী ছিলেন যে, তাঁর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো সাহস সেই সমাজে কারোই ছিল না। এ কারণে তাঁর মুসলিম হয়ে যাওয়ার কথা প্রচার হওয়া মাত্র মুশরিক মহলে ক্রন্দন এবং বিলাপ সৃষ্টি হয়ে গেল এবং তারা বড়ই লাঞ্ছিত ও অপমানিত বোধ করতে থাকল। পক্ষান্তরে তাঁর ইসলাম গ্রহণ করার ফলে মুসলিমদের শক্তি সাহস ও মান মর্যাদা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়ে গেল এবং তাঁদের মধ্যে আনন্দের জোয়ার প্রবাহিত হতে থাকল। ইবনে ইসহাক্ব নিজ সূত্রের বরাতে উমারের বর্ণনায় উদ্ধৃত করেছেন যে, ‘যখন আমি মুসলিম হয়ে গেলাম তখন চিন্তা-ভাবনা করতে থাকলাম যে, মক্কায়, কোন কোন ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সব চাইতে প্রভাবশালী শত্রু হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। তারপর মনে মনে বললাম এ আবূ জাহলই হচ্ছে তাঁর সব চাইতে বড় শত্রু। ততক্ষণাৎ তার গৃহে গমন করে দরজায় করাঘাত করলাম। সে বাহির হয়ে এসে (খুশি আমদেদ, খুশ আমদেদ) বলে আমাকে অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে স্বাগত জানাল এবং বলল, ‘কিভাবে এ অভাগার কথাটা আজ মনে পড়ে গেল?’ প্রত্যুত্তরে কোন ভূমিকা না করেই আমি সরাসরি বললাম, ‘তোমাকে আমি এ কথা বলতে এলাম যে, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর দ্বীনে আমি বিশ্বাস স্থাপন করেছি এবং যা কিছু আল্লাহর তরফ থেকে তাঁর উপর অবতীর্ণ হয়েছে তার উপরও বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমার কথা শ্রবণ করা মাত্র সে সশব্দে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলল, ‘আল্লাহ তোমার মন্দ করুন এবং যা কিছু আমার নিকট নিয়ে এসেছ সে সবেরও মন্দ করুন।[9]
ইমাম ইবনে জাওযী উমার (রাঃ)-এর বর্ণনা উদ্ধৃত করে বলেছেন যে, যখনই কোন ব্যক্তি মুসলিম হয়ে যেত তখনই লোক তার পিছু ধাওয়া করত এবং তাকে মারধর করত। সেও তাদের পাল্টা মারধর করত। এ জন্য যখন আমি মুসলিম হয়ে গেলাম তখন আমার মামা আসী বিন হাশিমের নিকটে গেলাম এবং তাঁকে আমার মুসলিম হয়ে যাওয়ার খবর জানালাম। আমার কথা শোনামাত্রই সে গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করল। তারপর কুরাইশের একজন বড় প্রধানের বাড়িতে গেলাম (সম্ভবতঃ আবূ জাহলের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে) এবং তাকেও বিষয়টি সম্পর্কে অবগত করলাম কিন্তু সেও গিয়ে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করল।[10]
ইবনে ইসহাক্ব বর্ণনা করেছেন যে, ইবনে উমার বলেন, যখন ‘উমার (রাঃ) মুসলমান হলেন তখন তিনি বললেন কে এমন আছে যে কোন কথাকে খুব প্রচার কিংবা ঢোল শোহরত করতে পারে? লোকেরা বলল, জামীল বিন মা’মার জুমাহী। একথা শোনার পর তিনিস জামীল বিন মা’মার জুমাহীর নিকট গেলেন, আমি তার সাথেই ছিলাম। ‘উমার তাকে বললেন যে, তিনি মুসলিম হয়ে গিয়েছেন। আল্লাহর শপথ এ কথা শোনামাত্র অত্যন্ত উচ্চ কণ্ঠে সে ঘোষণা করতে থাকল যে, খাত্তাবের পুত্র উমার বেদ্বীন হয়ে গিয়েছে। উমার তাঁর পিছনেই ছিলেন, তৎক্ষণাৎ তিনি এ বলে উত্তর দিলেন যে, ‘এ মিথ্যা বলছে। আমি বেদ্বীন হই নি বরং মুসলিম হয়েছি।’
যাহোক, লোকজনেরা তাঁর উপর চড়াও হল এবং মারপিট শুরু হয়ে গেল। এক পক্ষে জনতা এবং অন্য পক্ষে উমার; মারপিট চলতে থাকল। এত সময় ধরে মারপিট চলতে থাকল যে, সেই অবস্থায় সূর্য প্রায় মাথার উপর এসে পড়ল। উমার ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লেন। লোকজন তাঁকে ঘিরেই দাঁড়িয়ে ছিল। উমার বললেন, ‘যা খুশী করো। আল্লাহর শপথ! আমরা যদি সংখ্যায় তিন শত হতাম তাহলে মক্কায় তোমরা অবস্থান করতে, না আমরা করতাম তা দেখাদেখি হয়ে যেত।[11]
এ ঘটনার পর মুশরিকগণ আরও ক্রোধান্বিত এবং সংঘবদ্ধ হয়ে উঠল এবং উমার (রাঃ)-এর বাড়ি আক্রমণ করে তাঁকে হত্যা করার এক গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হল। যেমনটি সহীহুল বুখারীর মধ্যে ইবনে উমার হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন যে, উমার ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় ঘরের মধ্যেই অবস্থান করছিলেন এমন সময় আবূ ‘আমর আস বিন ওয়ায়েল সাহমী সেখানে আগমন করল। সে ইয়ামান দেশের তৈরী নকশাদার জোড়া চাদর এবং রেশম দ্বারা সুসজ্জিত চমকদার জামা পরিহিত অবস্থায় ছিল। তার সম্পর্ক ছিল সাহম গোত্রের সাথে এবং জাহেলিয়াত যুগে এ গোত্র বিপদ-আপদে আমাদের সাহায্য করবে বরে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল।
সে জিজ্ঞেস করল, ‘কী ব্যাপার’?
উমার (রাঃ) বললেন, ‘আমি মুসলিম হয়ে গিয়েছি এবং এ জন্যই আপনার জাতি আমাকে হত্যা করতে ইচ্ছুক।
আস বলল, ‘তা সম্ভব নয়।’
আসের এ কথা শুনে আমি মনে কিছুটা শান্তি পেলাম, কিছুটা তৃপ্তি অনুভব করলাম।
তারপর আস সেখান থেকে ফিরে গিয়ে লোকজনদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করার উদ্যোগ গ্রহণ করল। তখন জনতার ভিড়ে সমগ্র উপত্যকা গিজ গিজ করছিল।
আমজনতার অগ্রভাগে অবস্থিত লোকজনকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমরা কোথায় চলেছ?’
উত্তরে তারা বলল, ‘আমরা চলেছি খাত্তাবের ছেলের একটা কিছু হেস্তনেস্ত করতে। কারণ, সে বেদ্বীন (বিধর্মী) হয়ে গিয়েছে।’
আস বলল, ‘না সে দিকে যাবার কোন পথ নেই।’
এ কথা শুনা মাত্রই জনতা আর অগ্রসর না হয়ে তাদের পূর্বের স্থান অভিমুখে ফিরে গেল।[12]
উমারের ইসলাম গ্রহণের কারণে মুশরিকগণের এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল যা ইতোপূর্বে আলোচিত হল। অপর পক্ষে মুসলিমদের অবস্থা সম্পর্কে অাঁচ-অনুমান কিংবা কিছুটা ধারণা লাভ করা সম্ভব হবে এর পাশাপাশি আলোচিত পরের ঘটনাটি থেকে। মুজাহিদ ইবনে আব্বাস হতে বর্ণনা করেছেন, আমি উমার বিন খাত্তাব (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম যে, কী কারণে লকব বা উপাধি ‘ফারূক’ হয়েছে। তখন তিনি আমাকে বললেন, ‘আমার তিনদিন পূর্বে হামযাহ (রাঃ) মুসলিম হয়েছিলেন, তারপর তিনি তাঁর ইসলাম গ্রহণের ঘটনা বর্ণনা করে শেষে বললেন যে, ‘আমি যখন মুসলিম হলাম তখন আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আমরা কি সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত নই, যদি জীবিত থাকি কিংবা মরে যাই?
নাবী (সাঃ) ইরশাদ করলেন, ‘অবশ্যই! সেই সত্ত্বার শপথ যাঁর হাতে আমার জীবন, তোমরা যদি জীবিত থাক কিংবা মৃত্যুমুখে পতিত হও হক বা সত্যের উপরেই তোমরা রয়েছ।’
উমারের বর্ণনা : ‘তখন আমি সকলকে লক্ষ্য করে বললাম যে, গোপনীয়তার আর কী প্রয়োজন? সেই সত্তার শপথ যিনি আপনাকে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন, আমরা অবশ্যই গোপনীয়তা পরিহার করে বাইরে যাব।
তারপর আমরা দু’টি সারি বেঁধে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে দু্’সারির মধ্যে নিয়ে বাইরে এলাম। এক সারির শিরোভাগে ছিলেন হামযাহ (রাঃ) আর অন্য সারির শিরোভাগে ছিলাম আমি। আমাদের চলার কারণে রাস্তায় যাঁতার আটার মতো হালকা ধূলি কণা উড়ে যাচ্ছিল। এভাবে যেতে যেতে আমরা মসজিদুল হারামে গিয়ে প্রবেশ করলাম। উমার (রাঃ) বলেছেন, ‘কুরাইশগণ যখন আমাকে এবং হামযাহকে মুসলিমদের সঙ্গে দেখল তখন মনে মনে তারা এত আঘাতপ্রাপ্ত হল যে, এমন আঘাত ইতোপূর্বে আর কখনো পায়নি। সেই দিনই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমার উপাধি দিয়েছিলেন ‘ফারূক’’[13]
ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেছেন যে, যতদিন পর্যন্ত উমার (রাঃ) ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেননি ততদিন পর্যন্ত আমরা ক্বাবা’হগৃহের নিকট নামায আদায় করতে সাহস করিনি।[14]
সুহাইব বিন সিনান রুমী বর্ণনা করেছেন যে, উমার (রাঃ) যে দিন ইসলাম গ্রহণ করলেন সে দিন থেকে ইসলাম তার গোপন প্রকোষ্ঠ থেকে বেরিয়ে এল বাইরের জগতে। সে দিন থেকে প্রকাশ্যে প্রচার এবং মানুষকে প্রকাশ্যে দ্বীনের আহবান জানানো সম্ভব হল।
পূর্বের সূত্র ধরেই বলা হয়েছে, ‘আমরা গোলাকার হয়ে আল্লাহর ঘরের পাশে বৈঠক করলাম এবং আল্লাহর ঘর প্রদক্ষিণ করলাম। যারা আমাদের উপর অন্যায় অত্যাচার করত আমরা তার প্রতিশোধ গ্রহণ করলাম এবং তাদের কোন কোন অন্যায়ের প্রতিবাদও করলাম।[15]
ইবনে মাসউদের বর্ণনাঃ ‘যখন হতে উমার (রাঃ) মুসলিম হয়েছিলেন তখন থেকে আমরা সমানভাবে শক্তিশালী হয়েছিলাম এবং মান-সম্মানের সঙ্গে বসবাস করতে পেরেছিলাম।’[16]
ফুটনোটঃ[1] ইবনুল জাওযী লিখিত তারীখে উমার বিন খাত্তাব পৃঃ ১১।
[2] তিরমিযী আরওয়াবুল মানাকের আবীহাফস উমার বিন খাত্তাব ২য় খন্ড ২০৯ পৃঃ।
[3] শাইখ মুহাম্মাদ গাযালীঃ ফিক্বহুস সীরাহ ৯২-৯৩ পৃঃ। তিনি উমার (রাঃ)-এর মানসিকতার দু’বিপরীতমুখী ধারা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
[4] ইবনে জাওযী তারীখে উমার বিন খাত্তাব ৬ পৃঃ। ইবনে ইসহাক্ব আতা এবং মোজাহেদ হতে একই রূপ বর্ণনা করেছেন। তবে তার শেষাংশ এটা হতে কিছুটা ভিন্ন। দ্রষ্টব্য সীরাতে ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৩৪৬ ও ৩৪৮ পৃঃ এবং ইবনে জাওযী নিজেও যাবের (রাঃ) হতে তাঁর মতই বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এর শেষাংশেও এ বর্ণনার বিপরীত আছে, দ্রঃ তারীখে উমার বিন খাত্তাব ৯-১০ পৃঃ।
[5] এ বর্ণনা হচ্ছে ইবনে ইসহাক্বের দ্রঃ ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৩৪৪ পৃঃ।
[6] এ বর্ণনা আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত দ্রঃ ইবনে জাওযী তারীখে উমার বিন খাত্তাব পৃঃ ১০ এবং মুখতাসারুস সীরাহ আবদুল্লাহ রচিত ১০৩ পৃঃ।
[7] এ বিষয়টি ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে, দ্রঃ মুখতাসারুস সীরাহ ১০২ পৃঃ।
[8] তারীখে ইবনে উমার পৃঃ ৭, ১০, ১১। শাইখ আবদুল্লাহ মুখতাসারুস সীরাহ পৃঃ ১০২-১০৩। সীরাতে ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৩৪৩-৩৪৬।
[9] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড পৃঃ ৩৪৯-৩৫০।
[10] তারীখ উমার বিন খাত্তাব পৃঃ ৮।
[11] তারীখ উমার বিন খাত্তাব পৃঃ ৮ ও ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৩৪৮-৩৪৯ পৃঃ।
[12] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৩৪৯ পৃঃ।
[13] ইবনে জাওযী- তারীখে উমার বিন খাত্তাব (রাঃ) ৬-৭ পৃঃ।
[14] শাইখ আব্দুল্লাহ – মুখতাসারুস সীরাহ পৃঃ ১০৩।
[15] ইবনে জাওযী, তারীখে উমার বিন খাত্তাব পৃঃ ১৩।
[16] সহীহুল বুখারীর উমার বিন খাত্তাবের ইসলাম গ্রহণ অধ্যায় ১ম খন্ড ৫৪৫ পৃঃ।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সমীপে কুরাইশ প্রতিনিধি (مُمَثِّلُ قُرَيْشٍ بَيْنَ يَدَي الرَّسُوْلِ ):
দু’জন সম্মানিত এবং প্রতাপশালী বীর অর্থাৎ হামযাহ বিন আব্দুল মুত্তালিব এবং উমার বিন খাত্তাব (রাঃ)-এর মুসলিম হওয়ার পর থেকে মুশরিকগণের অন্যায় অত্যাচার ও উৎপীড়নের মাত্রা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকে এবং মুসলিমদের সঙ্গে আচরণের ব্যাপারে পাশবিকতা ও মাতলামির স্থলে বিচার বুদ্ধির প্রয়োগ দৃষ্টিগোচর হতে থাকে। এ প্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে তাঁর প্রচার এবং তাবলীগের কর্ম থেকে নিবৃত্ত করার জন্য কঠোরতা এবং নিষ্ঠুরতা অবলম্বনের পরিবর্তে তাঁর সঙ্গে সদাচার করা এবং অর্থ, ক্ষমতা, নেতৃত্ব, নারী ইত্যাদি যোগান দেয়ার প্রস্তাবের মাধ্যমে তাঁকে প্রচার কাজ থেকে নিবৃত্ত করার এক নয়া কৌশল প্রয়োগের মনস্থ করে। কিন্তু সেই হতভাগ্যদের জানা ছিল না যে, সমগ্র পৃথিবী যার উপর সূর্য উদিত হয় দাওয়াত ও তাবলীগের তুলনায় খড় কুটারও মর্যাদা বহন করে না। এ কারণে এ পরিকল্পনায়ও তাদের অকৃতকার্য ও বিফল হতে হয়।
ইবনে ইসহাক্ব ইয়াযিদ বিন যিয়াদের মাধ্যমে মুহাম্মাদ বিন ক্বা‘ব কুরাযীর এ বর্ণনা উদ্ধৃত করেন যে, আমাকে বলা হয় যে, উতবাহ বিন রাবী’আহ যিনি গোত্রীয় প্রধান ছিলেন, একদিন কুরাইশগণের বৈঠকে বললেন- ‘ঐ সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মাসজিদুল হারামের এক জায়গায় একাকী অবস্থান করছিলেন, ‘হে কুরাইশগণ! আমি মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নিকট গিয়ে কেনই বা কথোপকথন করব না এবং তাঁর সামনে কিছু উপস্থাপন করব না। হতে পারে যে, তিনি আমাদের কোন কিছু গ্রহণ করে নিবেন। তবে যা কিছু তিনি গ্রহণ করবেন তাঁকে তা প্রদান করে আমরা তাঁকে তাঁর প্রচারাভিযান থেকে নিবৃত্ত করে দেব।’ এটা হচ্ছে সে সময়ের কথা যখন হামযাহ মুসলিম হয়ে গিয়েছিলেন এবং মুশরিকগণ দেখছিল যে, মুসলিমদের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মুশরিকগণ বলল, ‘আবুল ওয়ালীদ! আপনি যান এবং তাঁর সাথে কথাবার্তা বলুন। এরপর উতবাহ সেখান থেকে উঠে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট বসল এবং বলল, ‘ভ্রাতুষ্পুত্র! আমাদের গোত্রে তোমার মর্যাদা ও স্থান যা আছে এবং বংশীয় যে সম্মান আছে তা তোমার জানা আছে। এখন তুমি নিজ গোত্রের নিকট এক বড় ধরণের ব্যাপার নিয়ে এসেছ যার ফলে গোত্রভুক্ত বিভিন্ন লোকজনদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়ে গেছে। ওদের বিবেক-বুদ্ধিকে নির্বুদ্ধিতার সম্মুখীন করে ফেলেছ। তাদের উপাস্য প্রতিমাদের এবং তাদের ধর্মের দোষত্রুটি প্রকাশ করে মৃত পূর্ব পুরুষদের ‘কাফের’ সাব্যস্ত করছ। এ সব নানা সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে আমি তোমার নিকট কয়েকটি কথা পেশ করছি। তার প্রতি মনোযোগী হও। এমনটি হয়তো বা হতেও পারে যে, কোন কথা তোমার ভাল লাগবে এবং তুমি তা গ্রহণ করবে।’
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘আবুল ওয়ালীদ বল আমি তোমার কথায় মনোযোগী হব।’
আবুল ওয়ালীদ বলল, ‘ভ্রাতুষ্পুত্র! এ ব্যাপারে তুমি যা নিয়ে আগমন করেছ এবং মানুষকে যে সব কথা বলে বেড়াচ্ছ তার উদ্দেশ্য যদি এটা হয় যে, এর মাধ্যমে তুমি কিছু ধন-সম্পদ অর্জন করতে চাও তাহলে আমরা তোমাকে এত বেশী ধন-সম্পদ একত্রিত করে দেব যে, তুমি আমাদের সব চাইতে অধিক ধন-সম্পদের মালিক হয়ে যাবে, কিংবা যদি তুমি এটা চাও যে, মান-মর্যাদা, প্রভাব-প্রতিপত্তি তোমার কাম্য তাহলে আমাদের নেতৃত্ব তোমার হাতে সমর্পন করে দিব এবং তোমাকে ছাড়া কোন সমস্যার সমাধান কিংবা মীমাংসা আমরা করব না, কিংবা যদি এমনও হয় যে, তুমি রাজা-বাদশাহ হতে চাও তাহলে আমরা তোমাকে আমাদের সম্রাটের পদে অধিষ্ঠিত করে দিচ্ছি। তাছাড়া তোমার নিকট যে আগমন করে সে যদি জিন কিংবা ভূত-প্রেত হয় যাকে তুমি দেখছ অথচ নিজে নিজে তার কুপ্রভাব প্রতিহত করতে পারছ না, তাহলে আমার তোমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি এবং তোমার পূর্ণ সুস্থতা লাভ না হওয়া পর্যন্ত যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা প্রয়োজন আমরাই তা করতে প্রস্তুত আছি, কেননা কখনো কখনো এমনও হয় যে, জিন-ভূতেরা মানুষের উপর প্রাধান্য বিস্তার করে ফেলে এবং এ জন্য চিকিৎসার প্রয়োজনও হয়ে দাঁড়ায়।
উতবাহ এক নাগাড়ে এ সব কথা বলতে থাকল এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) গভীর মনোযোগের সঙ্গে তা শুনতে থাকলেন। যখন সে তার কথা বলা শেষ করল তখন নাবী কারীম (সাঃ) বললেন, ‘আবুল ওয়ালীদ! তোমার বলা কি শেষ হয়েছে? সে বলল, ‘হ্যাঁ’
নাবী (সাঃ) বললেন, ‘বেশ ভাল, এখন আমার কথা শোন।’
সে বলল, ‘ঠিক আছে শুনব।’
নাবী (সাঃ) বললেন,
{بسم الله الرحمن الرحيم حٰم تَنزِيْلٌ مِّنَ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ كِتَابٌ فُصِّلَتْ آيَاتُهُ قُرْآنًا عَرَبِيًّا لِّقَوْمٍ يَعْلَمُوْنَ بَشِيْرًا وَنَذِيْرًا فَأَعْرَضَ أَكْثَرُهُمْ فَهُمْ لَا يَسْمَعُوْنَ وَقَالُوْا قُلُوْبُنَا فِيْ أَكِنَّةٍ مِّمَّا تَدْعُوْنَا إِلَيْهِ}[فصلت:1: 5].
অর্থঃ হা’মীম, এ বাণী করুণাময় দয়ালু (আল্লাহ) এর তরফ থেকে নাজিলকৃ, এটা এমন একটি কিতাব, যার আয়াতগুলো বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, অর্থাৎ কুরআন যা আরবী ভাষায় (অবতারিত), জ্ঞানী লোকদের জন্য (উপকারী)। (এটা) সুসংবাদ দাতা ও ভয় প্রদর্শক কিন্তু অধিকাংশ লোকই মুখ ফিরিয়ে নিল। সুতরাং তারা শুনেই না। এবং তারা বলে, যে কথার প্রতি আপনি আমাদের ডাকেন সে ব্যাপারে আমাদের অন্তর পর্দাবৃত। (ফুসসিলাত ৪১ : ১-৫)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পাঠ করতে থাকেন এবং উতবাহ নিজ দু’হাত পশ্চাতে মাটির উপর রাখা অবস্থায় তাতে ভর দিয়ে শ্রবণ করতে থাকে। যখন নাবী (সাঃ) সিজদার আয়াতের নিকট পৌঁছে গেলেন। তখন সিজদা করলেন এবং বললেন, আবুল ওয়ালীদ তোমাকে যা শ্রবণ করানোর প্রয়োজন ছিল তা শ্রবণ করেছ, এখন তুমি জান এবং তোমার কর্ম জানে।
উতবাহ সেখান থেকে উঠে সোজা তার বন্ধুদের নিকট চলে গেল। তাকে আসতে দেখে মুশরিকগণ পরস্পর বলাবলি করতে থাকল, আল্লাহর শপথ! আবুল ওয়ালীদ তোমাদের নিকট সেই মুখ দিয়ে আসছে না যে মুখ নিয়ে সে গিয়েছিল, তারপর আবুল ওয়ালিদ যখন তাদের নিকট এসে বসল তখন তারা জিজ্ঞেস করল, ‘আবুল ওয়ালীদ! পিছনের খবর কি?’
সে বলল, ‘পিছনের খবর হচ্ছে আমি এমন এক কথা শুনেছি যা কোনদিনই শুনি নি। আল্লাহর শপথ! সে কথা কবিতা নয়, যাদুও নয়। হে কুরাইশগণ! আমরা কথা মেনে নিয়ে ব্যাপারটি আমার উপর ছেড়ে দাও। (আমার মত হচ্ছে) ঐ ব্যক্তিকে তার অবস্থায় ছেড়ে দাও। সে পৃথক হয়ে থেকে যাক। আল্লাহর কসম! আমি তার মুখ থেকে যে বাণী শ্রবণ করলাম তা দ্বারা অতিশয় কোন গুরুতর ব্যাপার সংঘটিত হয়ে যাবে। আর যদি তাকে কোন আরবী হত্যা করে ফেলে তবে তো তোমাদের কর্মটা অন্যের দ্বারাই সম্পন্ন হয়ে যাবে। কিন্তু এ ব্যক্তি যদি আরবীদের উপর বিজয়ী হয়ে প্রাধান্য বিস্তারে সক্ষম হয় তাহলে এর রাজত্ব পরিচালনা প্রকৃতপক্ষে তোমাদেরই রাজত্ব হিসেবে গণ্য হবে! এর অস্তিত্ব বা টিকে থাকা সব চাইতে বেশী তোমাদের জন্যই মঙ্গলজনক হবে।
লোকেরা বলল, ‘আবুল ওয়ালীদ! আল্লাহর কসম, তোমার উপরও তার যাদুর প্রভাব কাজ করেছে।’
উতবাহ বলল, ‘তোমরা যাই মনে করনা কেন, তাঁর সম্পর্কে আমার যা অভিমত আমি তোমাদের জানিয়ে দিলাম। এখন তোমরা যা ভাল মনে করবে, তাই করবে।[1]
অন্য এক বর্ণনায় এটা উল্লেখিত হয়েছে যে, নাবী কারীম (সাঃ) যখন তিলাওয়াত আরম্ভ করেছিলেন তখন উতবাহ নীরবে শুনতে থাকে। তারপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন এ আয়াতে কারীমা পাঠ করেন,
{فَإِنْ أَعْرَضُوْا فَقُلْ أَنذَرْتُكُمْ صَاعِقَةً مِّثْلَ صَاعِقَةِ عَادٍ وَثَمُوْدَ} [فصلت:13]
‘‘এরপরও তারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে বল- আমি তোমাদেরকে অকস্মাৎ শাস্তির ভয় দেখাচ্ছি- ‘আদ ও সামূদের (উপর নেমে আসা) অকস্মাৎ-শাস্তির মত।’ (ফুসসিলাত ৪১ : ১৩)
এ কথা শোন মাত্রই উতবাহ ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল এবং এটা বলে তার হাত রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মুখের উপর রাখল যে, আমি আল্লাহর মাধ্যম দিয়ে এবং আত্মীয়তার প্রসঙ্গটি স্মরণ করিয়ে কথা বলছি যে, এমনটি যেন না করা হয়। সে এ ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছিল যে প্রদর্শিত ভয় যদি এসেই যায়। এরপর সে সমবেত মুশরিকগণের নিকট চলে যায় এবং তাদের সঙ্গে উল্লেখিত আলাপ আলোচনা করে।[2]
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ২৯৩-২৯৪।
[2] তাফসীর ইবনে কাসীর ৬/১৫৯-১৬১।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সাথে কুরাইশ নেতৃবৃন্দের কথোপকথন (رؤساء قريش يفاوضون رسول الله):
কুরাইশগণ উক্তরূপ উত্তকে একেবারে নিরাশ হয়ে যায় নি কেননা তিনি (সাঃ) তাদেরকে স্পষ্ট করে কিছু বলেন নি, বরং উতবাহকে কয়েকটি আয়াত তেলাওয়াত করে শুনিয়েছেন মাত্র। অতঃপর ‘উতবাহ সেখান হতে ফিরে এসেছে। ফলে কুরাইশ নেতৃবৃন্দ পরস্পরে যাবতীয় বিষয়াদী সম্পর্কে পরামর্শ ও চিন্তা-ভাবনা করল।
অতঃপর একদিবসে তারা মাগরিবের পর কা’বাহর সম্মুখে একত্রিত হয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে ডেকে পাঠালে তিনি (সাঃ) দ্রুত সেখানে হাজির হলেন এমন মনে করে যে, তাতে হয়তো কোন কল্যাণ রয়েছে। যখন তিনি (সাঃ) তাদের মাঝে আসন গ্রহণ করলেন, তারা উতবাহর অনুরূপ প্রস্তাব পেশ করল। তাদের ধারণা ছিল যে, সেদিন ‘উতবাহ একা একা প্রস্তাব করাতে মুহাম্মাদ সম্মত হয়নি; তবে সবাই সম্মিলিতভাবে প্রস্তাব করলে তা মেনে নিবেন অবশ্যই। কিন্তু তাদের প্রস্তাব শোনার পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, তোমরা আমার ব্যাপারে এসব কি বলছ, আমি তোমাদের নিকটে কোন ধন-সম্পদ ও মর্যাদা চাই না। তোমাদের নিটক কোন রাজত্ব চাই না। তবে আল্লাহ তা’আলা আমাকে তোমাদের প্রতি রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছেন, তাঁর পক্ষ হতে আমার উপর কিতাব অবতীর্ণ করেছেন। আর আমাকে এ মর্মে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যেন আমি তোমাদেরকে ভাল কর্মের উত্তম ফলাফলের শুভসংবাদ দেই এবং অন্যায় ও পাপকর্মের শাস্তি সম্পর্কে ভীতি প্রদর্শন করি। সুতরাং আমি তোমাদের নিকট আমি রিসালাতের বাণী পৌছিয়ে দিচ্ছি এবং সৎ উপদেশ প্রদান করছি। আমি যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছি তা যদি তোমরা মেনে নাও তাহলো দুনিয়া ও আখিরাতে এর ভাল পরিণাম ভোগ করবে। আর যদি আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করো তবে আমার ও তোমাদের মধ্যে আল্লাহর ফায়সালা না আসা পর্যন্ত ধৈৰ্য্য ধারণ করে যাবো।
তারা ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে গিয়ে আরেক পদক্ষেপ গ্রহণ করলো। তা হলো তারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাজে দাবি জানালো যে, নাবী (সাঃ) যেন তাদের জমিন থেকে পাহাড়সমূহ দূরীভূত করে দেন, তাদের জমিন প্রশস্থ করে দেন। অতঃপর সেই জমিনে ঝর্ণা ও নদ-নদী প্রবাহিত করে দেন। আর তিনি (সাঃ) যেন তাদের মৃতদেরকে জীবিত করে দেন; বিশেষ করে কুসাই বিন কিলাবকে। তিনি (সাঃ) এসব কর্ম সম্পাদন করলেই কেবল তারা ঈমান আনবে। তাদের এ কথার জবাবে রাসূল (সাঃ) পূর্বের ন্যায় জবাব দিলেন।
এরপর তারা আবার অন্য একটি বিষয় উত্থাপন করলো- তারা বললো নাবী (সাঃ) যেন তার প্রভুর নিকট একজন ফেরেশতাকেও নাবী করে পাঠান যিনি মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর দাবীকে সত্যায়ন করবে। আর আল্লাহ তা’আলা যেন তাঁকে বাগ-বাগিচা, ধন-সম্পদ ও স্বর্ণের অট্টালিকা প্রদান করেন। এবারও রাসূল (সাঃ) একই জবাব দিলেন।
অতঃপর তারা চতুর্থ একটি বিষয় উপস্থাপন করলো- মুহাম্মাদ যেহেতু তাদের শাস্তির ভয় দেখায় সুতরাং কুরাইশরা নাবী (সাঃ) এর কাছে আযাব আনয়ন করার দাবি জানালো এবং এও বললো তাদের উপর যেন আকাশ হয়ে পড়ে। (আল্লাহ তা’আলা যথাসময়ে এটা সম্পাদন করবেন।)
শেষ পর্যায়ে তারা ভীষণ হুমকি দিল এমনকি তারা বললো, আমরা তোমাকে সহজে ছেড়ে দেবনা, এতে হয় আমরা তোমাকে শেষ করবো অথবা আমরা নিঃশেষ হবো। তাদের এ ধরনের ধমকি শোনার পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অত্যন্ত চিন্তান্বিত হয়ে স্বীয় পরিবারবর্গের নিকটে ফিরে গেলেন।
ফুটনোটঃ
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে হত্যার ব্যাপারে আবূ জাহলের অস্বীকার (عزم ابي جهل على قتل رسول الله):
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন কুরাইশ নেতৃবৃন্দের নিকট হতে ফিরে আসলেন তখন আবূ জাহল কুরাইশ নেতৃবৃন্দের মধ্যে ঘোষণা দিয়ে বললো, ‘কুরাইশ ভ্রাতৃবৃন্দ। আপনার সম্যকরূপে অবগত আছেন যে, মুহাম্মাদ (সাঃ) আমাদের ধর্মে কলঙ্ক রটাচ্ছে, আমাদের পূর্বপুরুষের নিন্দা করছে, আমাদের জ্ঞান বুদ্ধিকে খাটো বলে রটনা করছে এবং দেবদেবীগণের অবমাননা করছে। এ সব কারণে আল্লাহ তা’আলার শপথ করে বলছি যে, আমি এক খণ্ড ভারী এবং সহজে উঠানো সম্ভব এমন পাথর নিয়ে বসব এবং মুহাম্মাদ (সাঃ) যখন সিজদায় যাবে তখন সেই পাথর মেরে তার মাথা চূর্ণ করে ফেলব। এখন এ অবস্থায় তোমরা আমাকে এক অসহায় ছেড়ে দাও, আর না হয় সাহায্য কর। বনু আবদে মানাফ এর পর যা চাই তা করুক’। উপস্থিত লোকেরা বলল, ‘আল্লাহর শপথ! আমরা তোমাকে অসহায় ছেড়ে দিতে পারি না। তুমি যা করার ইচ্ছে করেছ তার করে ফেল।
সকাল হলে আবূ জাহল তার ঘোষণার অনুরূপ একখণ্ড পাথর নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর অপেক্ষায় বসে থাকল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যথা নিয়মে আগমন করলেন এবং সালাতে রত হলেন। কুরাইশগণও সেখানে উপস্থিত হয়ে আবূ জাহলের কথিত কাণ্ড দেখার জন্য অপেক্ষামান রইল। যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সিজদায় গমন করলেন তখন আবূ জাহল পাথর উঠিয়ে তাঁর দিকে অগ্রসর হল, কিন্তু নিকটে পৌঁছে পরাস্ত সৈনিকের মতো স্ববেগে পশ্চাদপসরণ করল। এ সময় তাকে অত্যন্ত বিবর্ণ এবং ভীত সন্ত্রস্ত দেখাচ্ছিল। তার দু’হাত পাথরের সঙ্গে শক্তভাবে চিমটে লেগে গিয়েছিল। পাথরের গা থেকে হাত ছাড়াতে তাকে যথেষ্ট কষ্ট করতে এবং বেগ পেতে হয়েছিল।
এ দিকে কুরাইশগণের মধ্য থেকে কিছু সংখ্যক লোক দ্রুত তার নিকট এগিয়ে আসে এবং বলতে থাকে, আবূল হাকাম! ব্যাপারটি হল কী? কিছুই যেন বুঝে উঠছি না।
সে বলল, ‘আমি রাত্রিবেলা যা বলেছিলাম তা করার জন্যই এগিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু যখন তাঁর নিকটে গিয়ে পৌঁছলাম তখন একটি উট আমার সামনে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াল। হায় আল্লাহ! কক্ষনো আমি এমন মস্তক, এমন ঘাড় এবং এমন দাঁতবিশিষ্ট উট দেখি নি। মনে হল সে যেন আমাকে খেয়ে ফেলতে চাচ্ছে।
ইবনে ইসহাক্ব বলেন, আমাকে বলা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, ‘উষ্ট্রের রূপ ধারণ করে সেখানে ছিলেন জিবরাঈল (আঃ)। আবূ জাহল যদি আমার নিকট যেত তাহলে তার উপর বিপদ অবতীর্ণ হয়ে যেত।[1]
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিলমা ১ম খণ্ড ২৯৮-২৯৯ পৃঃ।
সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা ও কিছু ছাড় দেয়া (مساومات وتنازلات):
কুরাইশগণ বিভিন্নভাবে চেষ্টা-প্রচেষ্টা, ভীতি প্রদর্শন, হুমকি-ধমকি দিয়েও ব্যর্থ হলো এবং আবূ জাহল যে ন্যাক্কারজনক সংকল্প গ্রহণ করেছিল তা বিফল হলো তখন তারা সমস্যা থেকে উত্তোরণের নতুন কৌশল অবলম্বনের চিন্তা-ভাবনা করলো। তাদের মনে এ ধারণা ছিল না যে, মুহাম্মাদ (সাঃ) সত্য নাবী নয় বরং তাদের অবস্থান সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, لَفِي شَكٍّ مِنْهُ مُرِيبٍ -তারা বিভ্রান্তিকর সন্দেহে রয়েছে। (সূরাহ শূরা : ১৪ আয়াত)
কাজেই তারা সিদ্ধান্ত নিল যে, দীনের বিষয়ে মুহাম্মাদের সাথে কিছু সমতা আনয়ন এবং মধ্যপন্থা অবলম্বনের। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে কিছু বিষয় পরিত্যাগ করতে বলার চিন্তাভাবনা করলেন। এতে তারা ধারণা করলো যে, তারা এবার একটা প্রকৃত সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছে যদিও রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সত্য বিষয়ের প্রতি আহবান করে থাকেন।
ইবনে ইসহাক্ব বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কাবাহ গৃহ ত্বাওয়াফ করছিলেন এমতাবস্থায় আসওয়াদ বিন মুত্তালিব বিন আসাদ বিন আব্দুল উযযা, ওয়ালীদ বিন মুগীরাহ, উমাইয়া বিন খালাফ এবং আস বিন ওয়ায়িল সাহমী তার সামনে উপস্থিত হলেন। এঁরা সকলেই ছিলেন নিজ নিজ গোত্রের প্রধান। তাঁরা বললেন, ‘হে মুহাম্মাদ (সাঃ) এসো। তুমি যে মা’বুদের উপাসনা কর আমরাও সে মা’বুদের উপাসনা করি এবং আমরা যে মা’বুদের উপাসনা করি তোমরাও সে মা’বুদের উপাসনা কর। এরপর দেখা যাবে, যদি তোমাদের মা’বূদ কোন অংশে আমাদের মা’বূদ চেয়ে উন্নত হয় তাহলে আমরা সেই অংশ গ্রহণ করব, আর যদি আমাদের মা’বূদ কোন অংশে তোমার মা’বূদ চেয়ে উন্নত হয় তাহলে সেই অংশ গ্রহণ করবে। এ প্রেক্ষিতেই আল্লাহ তা’আলা সূরাহ কূল ইয়া আইয়্যুহাল কাফিরুন সম্পূর্ণ অবতীর্ণ করেন। যার মধ্যে জলদগম্ভীর সূরে ঘোষণা করা হয়েছে যে,
قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ لَا أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُونَ
‘বল, ‘হে কাফিররা! ২. তোমরা যার ইবাদাত কর, আমি তার ইবাদাত করি না।’ (আল-কাফিরূন ১০৯ : ১-২)[1]
আবদ বিন হুমায়েদ ও অন্যান্য হতে একটি বর্ণনা এভাবে রয়েছে যে, মুশরিকগণ প্রস্তাব করল যে, যদি আপনি আমাদের মাবূদকে গ্রহণ করেন তবে আমরাও আপনার আল্লাহর ইবাদত কর।[2]
ইবনে জারীর এবং তাবারানীর এক বর্ণনায় রয়েছে যে, মুশরিকগণ নাবী কারীম (সাঃ)-এর নিকট প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন যে, যদি তিনি এক বছর যাবৎ তাদের মা’বূদের (প্রভুর) পূজা অৰ্চনা করেন তাহলে তারা নাবী (সাঃ)-এর প্রভু প্রতিপালকের ইবাদত (উপাসনা) করবে।
قُلْ أَفَغَيْرَ اللَّهِ تَأْمُرُونِّي أَعْبُدُ أَيُّهَا الْجَاهِلُونَ
“বল, ওহে অজ্ঞরা! তোমরা কি আমাকে আল্লাহ ছাড়া অন্যের ইবাদত করার আদেশ করছ?” (যুমার : ৬৪ আয়াত) আল্লাহ তা’আলা তাদের এহেন হাস্যকর কথার এমন স্পষ্ট ও দৃঢ় জবাব দেওয়ার পরও মুশরিকরা বিরত হলো না বরং আরো অধিক হারে এ ব্যাপারে প্রচেষ্টা করতে থাকল। এমনকি তারা এ দাবি করলো যে, মুহাম্মাদ যা নিয়ে এসেছে তার কিছু অংশ যেন পরিবর্তন করে। তারা বললো, ائْتِ بِقُرْآنٍ غَيْرِ هَٰذَا أَوْ بَدِّلْهُ
তারা বলে, ‘এটা বাদে অন্য আরেকটা কুরআন আন কিংবা ওটাকে বদলাও’। (সূরাহ ইউনুস : ১৫ আয়াত)
আল্লাহ তা’আলা নিম্নোক্ত আয়াত অবতীর্ণ করে তাদের দাবিকে প্রত্যাখ্যান করেন,
قُلْ مَا يَكُونُ لِي أَنْ أُبَدِّلَهُ مِنْ تِلْقَاءِ نَفْسِي إِنْ أَتَّبِعُ إِلَّا مَا يُوحَىٰ إِلَيَّ إِنِّي أَخَافُ إِنْ عَصَيْتُ رَبِّي عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيمٍ
আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন, বল, “আমার নিজের ইচ্ছেমত ওটা বদলানো আমার কাজ নয়, আমার কাছে যা ওয়াহী করা হয় আমি কেবল সেটারই অনুসরণ করে থাকি। আমি আমার প্রতিপালকের অবাধ্যতা করলে এক অতি বড় বিভীষিকার দিনে আমি শাস্তির ভয় করি”। (সূরাহ ইউনুস : ১৫ আয়াত)
আর এরকম কাজের মহাদুর্ভোগ সম্পর্কে সতর্ক করে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন,
وَإِنْ كَادُوا لَيَفْتِنُونَكَ عَنِ الَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ لِتَفْتَرِيَ عَلَيْنَا غَيْرَهُ وَإِذًا لَاتَّخَذُوكَ خَلِيلًا وَلَوْلَا أَنْ ثَبَّتْنَاكَ لَقَدْ كِدْتَ تَرْكَنُ إِلَيْهِمْ شَيْئًا قَلِيلًا إِذًا لَأَذَقْنَاكَ ضِعْفَ الْحَيَاةِ وَضِعْفَ الْمَمَاتِ ثُمَّ لَا تَجِدُ لَكَ عَلَيْنَا نَصِيرًا
“আমি তোমার প্রতি যে ওয়াহী করেছি তাথেকে তোমাকে পদস্থলিত করার জন্য তারা চেষ্টার কোন ত্রুটি করেনি যাতে তুমি আমার সম্বন্ধে তার (অর্থাৎ নাযিলকৃত ওয়াহীর) বিপরীতে মিথ্যা রচনা কর, তাহলে তারা তোমাকে অবশ্যই বন্ধু বানিয়ে নিত। – আমি তোমাকে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত না রাখলে তুমি তাদের দিকে কিছু না কিছু ঝুঁকেই পড়তে। – তুমি তা করলে আমি তোমাকে এ দুনিয়ায় দ্বিগুণ আর পরকালেও দ্বিগুণ আযাবের স্বাদ আস্বাদন করাতাম। সে অবস্থায় তুমি তোমার জন্য আমার বিরুদ্ধে কোন সাহায্যকারী পেতে না।” (সূরাহ বানী ইসরাঈল : ৭৩-৭৪ আয়াত)
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৩৬২পৃঃ
[2] ফাতহুল ক্বাদীর, ইমাম শাওকানী, ৫ম খণ্ড ৫০৮ পৃঃ।
কুরাইশদের হতভম্বতা, প্রানান্তকর প্রচেষ্টা এবং ইহুদীদের সাথে মিলে যাওয়া (حيرة قريش وتفكيرهم الجاد واتصالهم باليهود):
কুরাইশদের সর্বপ্রকার উদ্যোগ যখন ব্যর্থ হলো তখন কুরাইশদের কাছে অন্ধকার নেমে আসলো। হতভম্ভ হয়ে গেল তারা। এমন অবস্থায় তাদের মধ্যেকার অন্যতম শয়তান নাযর বিন হারিস একদিন কুরাইশগণকে আহবান জানিয়ে বললেন, ‘ওহে কুরাইশ ভাইগণ। আল্লাহর শপথ তোমাদের সম্মুখে এক মহা দুর্যোগপূর্ণ সময় উপস্থিত হয়েছে, অথচ তোমরা আজ পর্যন্ত এর কোন প্রতিকার কিংবা প্রতিবাদ কোনটাই করতে পার নি। মুহাম্মাদ (সাঃ) যখন তোমাদের মধ্যে যুবক ছিল, তখন সকলের প্রিয় পাত্র ছিল। সবার চেয়ে সত্যবাদী ও বিশ্বাসী ছিল। এখন যখন তার কান ও মাথার মধ্যেকার চুল সাদা হতে চলল (অর্থাৎ বয়সবৃদ্ধি পেয়ে মধ্য বয়সে পৌঁছল) এবং তোমাদের নিকট কিছু বাণী ও বক্তব্য উপস্থাপন করল তখন তোমরা বলছ যে, সে একজন যাদুকর। না, আল্লাহর শপথ যে যাদুকর নয়। আমরা যাদুকর দেখেছি তাদের ঝাড় ফুঁক ও গিরাবন্দিও দেখেছি, কিন্তু এর মধ্যে সে রকম কোন কিছুই দেখছিনা’।
তোমরা বলছ যে, সে একজন কাহিন।
কিন্তু তাকে তো কাহিন বলেও মনে হয় না। আমরা কাহিন দেখেছি, দেখেছি তাদের অসার বাগাড়ম্বর, উল্টোপাল্টা কাজ কর্ম এবং বাক চাতুর্য। কিন্তু এঁর মধ্যে তেমন কিছুই দেখিনা।
তোমরা বলছ, সে কবি, কিন্তু তাঁকে কবি বলেও তো মনে হয় না। আমরা কবি দেখেছি এবং কাব্যধারা হাজয, রাজ্য ইত্যাদিও শুনেছি। কিন্তু মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর কাছে যা শুনেছি, কোনদিন কারো কাছেই তা শুনিনি। তার কাছে যা শুনেছি তা তো অদ্ভুত জিনিস।
তোমরা তাকে বলছ পাগল! কিন্তু তাকে পাগল বলার কোন হেতুই তো আমি খুঁজে পাচ্ছি না। আমরা তো অনেক পাগলের পাগলামি দেখেছি, দেখেছি তাদের উল্টোপাল্টা কাজকর্ম, শুনেছি তাদের অসংলগ্ন ও অশ্লীল। কথাবার্তা এবং আরও কত কিছু। কিন্তু এর মধ্যে তেমন কোন ঘটনাই কোন দিন দেখিনি। ওহে কুরাইশগণ! আল্লাহর শপথ, তোমরা খুব কঠিন অবস্থার মধ্যে নিপতিত হয়েছ। খুব ভালভাবে চিন্তা-ভাবনা করে পরিত্রাণের পথ খোঁজ করো।
কুরাইশগণ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সত্যবাদিতা, ক্ষমাশীলতা, উন্নত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি যাবতীয় কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে টিকে থাকা, সকল প্রকার প্রলোভনকে প্রত্যাখ্যান, প্রত্যেক বালা-মসিবতে ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা ও অনমণীয়তা প্রত্যক্ষ করলো তখন মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর সত্যিকার নাবী হওয়ার সপক্ষে তাদের সন্দেহ আরো ঘনিভূত হলো। ফলে তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো যে, তারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সম্পর্কে ভালভাবে যাচাই-বাছাই করার নিমিত্তে ইহুদীদের সাথে মিলিত হল। নাযর বিন হারিসের পূর্বোক্ত নসিহত শ্রবণ করে তারা তাকে ইহুদীদের শহরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলো। সুতরাং সে ইহুদী পণ্ডিতদের নিকটে আসলে তারা তাকে পরামর্শ প্রদান করলো যে, তোমরা তাকে তিনটি প্রশ্ন করবে। প্রশ্নগুলোর ঠিকঠক উত্তর দিতে পারলে বুঝা যাবে সে সত্যিকার নাবী। আর উত্তর দিতে না পারলে বুঝা যাবে, এটা তার নিজস্ব দাবি। যে তিনটি বিষয়ের প্রশ্ন করার জন্য পরামর্শ প্রদান করা হলো তা হচ্ছে-
১. তোমরা তার কাছে প্রথম যুগের সেই যুবকদের সম্পর্কে জানতে চাবে যে, তাদের অবস্থা আপনি বর্ণনা করুন। কেননা তাদের বিষয়টা নিতান্তই আশ্চর্যজনক ও রহস্যেঘেরা।
২. তোমরা তাকে সেই ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে, যে পৃথিবীর পূর্ব হতে পশ্চিম দিগন্ত পর্যন্ত ভ্রমণ করেছিল। তার খবর কী?
৩. তোমরা তাকে রূহ বিষয়ে জিজ্ঞেস করবে যে, রূহটা মূলত কী জিনিস?
অতঃপর নাযর বিন হারিস মক্কায় ফিরে এসে বললো, “আমি তোমাদের নিকট এমন বিষয় নিয়ে এসেছি যা আমাদের এবং মুহাম্মাদের মধ্যে ফায়সালা করে দেবে।” এরপর সে ইহুদী পণ্ডিতগণ যা বলেছে তা তাদের জানিয়ে দিল। কথামতো কুরাইশগণ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে উক্ত তিনটি বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার কয়েকদিন পর সূরাহ কাহফ অবতীর্ণ হয় যে সূরাহতে সেইসব যুবকদের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে- তারা হলো আসহাবে কাহফ, সারা পৃথিবী সফরকারী ব্যক্তি হলো- জুল কারনাইন। আর রূহ সম্পর্কে নাযিল হয় সূরাহ বানী ইসরাঈল। ফলে কুরাইশদের কাছে এ বিষয় সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, মুহাম্মাদ (সাঃ) সত্য ও হকের উপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু তা সত্ত্বেও সীমালংঘনকারীরা তা প্রত্যাখ্যান করে বসে।
এ হচ্ছে কুরাইশগণ কর্তৃক রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর দাওয়াত মুকাবেলা করার সামান্য চিত্র। বাস্তব কথা হলো তারা রাসূলুল্লাহ-এর দাওয়াতকে স্তব্ধ করে দেওয়ার লক্ষ্যে সর্ব প্রকারের চেষ্টা চালিয়েছে। তারা একস্তর থেকে অন্যস্তর, এক প্রকার থেকে অন্য প্রকার, কঠিন হতে নম্র, নম্র হতে কঠিন, তর্ক-বিতর্ক হতে আপোশরফা, মিমাংসা হতে আবার তর্ক-বিতর্ক, ধমকী প্রদান হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়া, তারা প্রলোভন দেখাতো, তাতে কাজ না তারা কখনো কোন প্রতিশ্রুতি দিত অতঃপর মুখ ফিরিয়ে নিত। তাদের অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছিল যেন তারা একবার সামনে অগ্রসর হচ্ছে আবার পিছনে হটছে। তাদের কোন স্থীরতা নেই আর নেই কোন প্রত্যাবর্তন স্থল। তাদের এরকম বিভিন্নমুখী কর্মতৎপরতার দাবি ছিল যে, এর মাধ্যমে ইসলামী দাওয়াত স্তব্ধ ও বন্ধ হয়ে যাবে এবং কুফরী প্রাধন্য পাবে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা হলো- তাদের যাবতীয় চেষ্টা-প্রচেষ্টা, কর্মতৎপরতা, উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো। শেষ পর্যন্ত তাদের হাতে একটি হাতিয়ার বাকী থাকল তা হলো অস্ত্ৰধারণ। তবে অস্ত্ৰধারণ কেবল মুসিবতই বৃদ্ধি করে না বরং ভিত্তিমূলকে নড়বড়ে করে দেয়। ফলে তারা এখন কী করবে ভেবে না পেয়ে পেরেশান হয়ে গেল।
ফুটনোটঃ
আবূ ত্বালিব ও তার আত্মীয় স্বজনের অবস্থান (موقف أبي طالب وعشيرته):
আবূ ত্বালিব যখন দেখলেন যে, কুরাইশগণ সার্বিকভাবে সকল ক্ষেত্রে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রের বিরোধিতায় লিপ্ত হয়ে পড়েছে তখন তিনি স্বীয় প্রপিতামহ আবদে মানাফের দু’পুত্র হাশিম ও মুত্তালেব বংশধারার পরিবার বর্গকে একত্রিত করেন। তারপর এ কথা বলে তাদের আহবান জানান যে, এতদিন পর্যন্ত তিনি এককভাবেই তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রের দেখাশোনা এবং সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন কিন্তু পরিবর্তিত অবস্থার প্রেক্ষাপটে যেহেতু তাঁর পক্ষে এককভাবে আর সেই দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়, সেহেতু সম্মিলিতভাবে সেই দায়িত্ব পালনের জন্য তিনি সকলের প্রতি অনুরোধ জানালেন। আবূ ত্বালীবের এই অনুরোধ আরবী সম্প্রদায়িকতার আকর্ষণের প্রেক্ষিতে সেই দু’পরিবারের সকলেই তা মেনে নিলেন। কিন্তু আবূ ত্বালীবের ভাই আবূ লাহাব তা গ্রহণ না করে কুরাইশ মুশরিকগণের সঙ্গে একত্রিত হয়ে কাজকর্ম করার এবং তাদের সাহায্য করার কথা ঘোষণা করলেন।[1]
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ২৬৯পৃঃ, শাইখ আব্দুল্লাহ মুখতাসারুস সীরাহ ১০৬ পৃঃ।
একঘরে করা
অত্যাচার উৎপীড়নের অঙ্গীকার (مِيْثَاقُ الظُّلْمِ وَالْعُدْوَانِ):
মুশরিকদের সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টা যখন ব্যর্থ হলো এবং তারা দেখতে পেল যে, বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিবের মুসলিম ও কাফির সকলের সম্মিলিতভাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে সাহায্যদানের অঙ্গীকার করেছে। এ সব কারণে মুশরিকদের হতবুদ্ধিতা আরো বেড়ে গেল।
পূর্বোলিখিত সিদ্ধান্ত মোতাবেক মুশরিকগণ ‘মুহাসসাব’ নামক উপত্যকায় খাইফে বনী কিনানাহর ভিতরে একত্রিত হয়ে সর্বসম্মতভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ হল যে, বনু হাশিম এবং বনু মুত্তালিবের সাথে ক্রয় বিক্রয়, সামাজিক কার্যকলাপ, অর্থনৈতিক আদান-প্রদান, কুশল বিনিময় ইত্যাদি সবকিছুই বন্ধ রাখা হবে। কেউ তাদের কন্যা গ্রহণ করতে কিংবা তাদের কন্যা দান করতে পারবে না। তাদের সঙ্গে উঠাবসা, কথোপকথন মেলামেশা, বাড়িতে যাতায়াত ইত্যাদি কোনকিছুই করা চলবে না। হত্যার জন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে যতদিন তাদের হাতে সমর্পণ না করা হবে ততদিন পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে।
মুশরিকগণ এ বর্জন বা বয়কটের দলিলস্বরূপ একটি অঙ্গীকারনামা সম্পাদন করে যাতে অঙ্গীকার করা হয়েছিল যে, তারা কখনো বনু হাশিমের পক্ষ হতে কোন সন্ধিচুক্তির প্রস্তাব গ্রহণ করবে না এবং তাদের প্রতি কোন প্রকার ভদ্রতা বা শিষ্টাচার প্রদর্শন করবে না, যে পর্যন্ত তারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে হত্যার জন্য মুশরিকগণের হাতে সমর্পন না করবে সে পর্যন্ত এ অঙ্গীকার নামা বলবৎ থাকবে।
ইবনে কাইয়ূমের বর্ণনা সূত্রে বলা হয়েছে যে, এ অঙ্গীকারপত্রখানা লিখেছিলেন মানসুর বিন ইকরামা বিন ‘আমির বিন হাশিম। কেউ কেউ উল্লেখ করেছেনে যে, এ অঙ্গীকার নামা লিখেছিলেন নাযর বিন হারিস। কিন্তু সঠিক কথা হচ্ছে এ অঙ্গীকার নামার সঠিক লেখক ছিলেন বোগায়েয বিন ‘আমির বিন হাশিম। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার প্রতি বদ দোওয়া করেছিলেন যার ফলে তার হাত পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে গিয়েছিল।[1]
যাহোক এ অঙ্গীকার স্থিরীকৃত হল এবং অঙ্গীকারনামাটি ক্বাবা’হর দেয়ালে ঝুলিয়ে দেয়া হল। যার ফলে আবূ লাহাব ব্যতীত বনু হাশিম এবং বনু মুত্তালিবের কী কাফের, কী মুসলিম সকলেই আতঙ্কিত হয়ে ‘শেয়াবে আবূ ত্বালিব’ গিরি সংকটে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল নবুওয়ত সপ্তম বর্ষের মুহারম মাসের প্রারম্ভে চাঁদ রাত্রিতে। তবে এ ঘটনা সংঘটনের সময়ের ব্যাপারে আরো মতামত রয়েছে।
ফুটনোটঃ[1] যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৪৬ পৃঃ।
তিন বৎসর, ‘শিয়াবে আবূ ত্বালিব’ গিরিসংকটে অন্তরীণাবস্থা (ثَلَاثَةَ أَعْوَامٍ فِيْ شَعْبِ أَبِيْ طَالِبٍ):
এ বয়কটের ফলে বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিবের লোকজনদের অবস্থা অত্যন্ত কঠিন ও সঙ্গীন হয়ে পড়ল। খাদ্য-শস্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব-সামগ্রী আমদানী ও পানীয় সরবরাহ বন্ধ হয়েছিল। কারণ, খাদ্য-শস্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রী যা মক্কায় আসত মুশরিকগণ তা তাড়াহুড়া করে ক্রয় করে নিত। এ কারণে গিরি সংকটে অবরুদ্ধদের অবস্থা অত্যন্ত করুণ হয়ে পড়ল। খাদ্যাভাবে তারা গাছের পাতা, চামড়া ইত্যাদি খেতে বাধ্য হল। কোন কোন সময় তাঁদের উপবাসেও থাকতে হতো। উপবাসের অবস্থা এরূপ হয়ে যখন মর্মবিদারক কণ্ঠে ক্রন্দন করতে থাকত তখন গিরি সংকটে তাঁদের নিকট জিনিসপত্র পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব পড়েছিল, যা পৌঁছত তাও অতি সঙ্গোপনে। হারাম মাসগুলো ছাড়া অন্য কোন সময়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁরা বাহিরে যেতে পারতেন না। অবশ্য যে সকল কাফেলা মক্কার বাহির থেকে আগমন করত তাদের নিকট থেকে তাঁরা জিনিসপত্র ক্রয় করতে পারতেন। কিন্তু মক্কার ব্যবসায়ীগণ এবং লোকজনেরা সে সব জিনিসের দাম এতই বৃদ্ধি করে দিত যে, গিরিসংকটবাসীগণের ধরা ছোঁয়ার বাইরেই তা থেকে যেত।
খাদীজাহ (রাঃ)-এর ভ্রাতুষ্পুত্র হাকীম বিন হিযাম কখনো কখনো তাঁর ফুফুর জন্য গম পাঠিয়ে দিতেন। এক দিবস আবূ জাহলের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে গেলে সে খাদ্যশস্য নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে বাধা দিতে উদ্যত হল, কিন্তু আবুল বোখতারী এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করল এবং তার ফুফুর নিকট খাদ্য প্রেরণে সাহায্য করল।
এ দিকে আবূ ত্বালিব রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সম্পর্কিত সর্বক্ষণ চিন্তিত থাকতেন। তাঁর নিরাপত্তা বিধানের কারণে লোকেরা যখন নিজ নিজ শয্যায় শয়ন করত তখন তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে নিজ শয্যায় শয়ন করার জন্য পরামর্শ দিতেন। উদ্দেশ্য এই ছিল যে, কেউ যদি তাঁকে হত্যা করতে ইচ্ছুক থাকে তাহলে সে দেখে নিক যে, তিনি কোথায় শয়ন করেন। তারপর যখন লোকজনেরা ঘুমিয়ে পড়ত তিনি তাঁর শয্যাস্থল পরিবর্তন করে দিতেন। নিজ পুত্র, ভাই কিংবা ভ্রাতুষ্পুত্রদের মধ্যথেকে এক জনকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর শয্যায় শয়ন করার জন্য পরামর্শ দিতেন এবং তার পরিত্যাজ্য শয্যায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর শয়নের ব্যবস্থা করতেন।
এ অবরুদ্ধ অবস্থা সত্ত্বেও হজ্বের সময় নাবী কারীম (সাঃ) এবং অন্যান্য মুসলিমগণ গিরি সংকট থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতেন এবং হজ্বব্রত পালনে আগত ব্যক্তিগণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁদের নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করতেন। সে সময় আবূ লাহাবের কার্যকলাপ যা ছিল সে সম্পর্কে ইতোপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।
ফুটনোটঃ
অঙ্গীকারনামা বিনষ্ট (نَقْضُ صَحِيْفَةِ الْمِيْثَاقِ):
এরূপ অবর্ণনীয় সংকটময় অবস্থায় দীর্ঘ দু’ বা তিন বছর অতিক্রান্ত হল। এরপর নবুওয়াত ১০ম বর্ষের মুহাররম মাসে[1] লিখিত অঙ্গীকারনামাটি ছিন্ন করে ফেলা হয় এবং অত্যাচার উৎপীড়নের পরিসমাপ্তিত ঘটানোর প্রচেষ্টা চালানো হয়। কারণ, প্রথম থেকেই কিছু সংখ্যক ছিল এর বিপক্ষে। যারা এর বিপক্ষে ছিল তারা সব সময় সুযোগের সন্ধানে থাকত একে বাতিল কিংবা বিনষ্ট করার জন্য। অনেক ত্যাগ ও তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে বছর দুয়েক অতিক্রান্ত হওয়ার পর আল্লাহর রহমতে সেই একরারনামা বিনষ্ট করার মোক্ষম এক সুযোগ এসে যায় অবলীলাক্রমে।
এর প্রকৃত উদ্যোক্তা ছিলেন বনু ‘আমির বিন লুঈ গোত্রের হিশাম বিন ‘আমর নামক এক ব্যক্তি। রাতের অন্ধকারে এ ব্যক্তি গোপনে গোপনে ‘শেয়াবে আবূ ত্বালিব’ গিরি সংকটের ভিতরে খাদ্য শস্যাদি প্রেরণ করে বনু হাশিমের লোকজনদের সাহায্য সহানুভূতি করতেন। এ ব্যক্তি এক দিন যুহাইর বিন আবূ উমাইয়া মাখযুমীর নিকট গিয়ে পৌঁছলেন। যুহায়েরের মাতা আতেকা হলেন আব্দুল মুত্তালিবের কন্যা এবং আবূ ত্বালীবের ভগ্নী। তিনি যুহাইরকে সম্বোধণ করে বললেন, যুহাইর! ‘তুমি এটা কিভাবে বরদাস্ত করছ যে, আমরা উদর পূর্ণ করে তৃপ্তি সহকারে আহার করছি, উত্তম বস্ত্রাদি পরিধান করছি আর বনু হাশিম খাদ্যাভাবে, বস্ত্রাভাবে, অর্থাভাবে জীবন্মৃত অবস্থায় দিন যাপন করছে। বর্তমানে তোমার মামা বংশের যে অবস্থা চলছে তা তুমি ভালভাবেই জানো।’ বনু হালীমাহর কথা শুনে ব্যথা-বিজড়িত কণ্ঠে যুহাইর বললেন, ‘সব কথাই তো ঠিক, কিন্তু এ ব্যাপারে একা আমি কী করতে পারি? তবে হ্যাঁ, আমার সঙ্গে যদি কেউ থাকত তাহলে অবশ্যই আমি এ একরারনামা ছিঁড়ে ফেলার ব্যাপারে যথাসাধ্য চেষ্টা করতাম’’। হিশাম বলল, ‘বেশতো, এ ব্যাপারে আমি আছি তোমার সঙ্গে।’ যুহাইর বলল, বেশ, তাহলে এখন তৃতীয় ব্যক্তির অনুসন্ধান করো।’
এ প্রেক্ষিতে হিশাম, মুত্ব’ঈম বিন আদীর নিকটে গেলেন। মুত্ব’ঈম বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিবের সম্পর্ক সূত্রে আবদে মানাফের সন্তানদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। হিশাম তাঁদের বংশীয় সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে তাঁকে ভৎর্সনা করার পর ‘বনু হাশিম এবং বনু মুত্তালিবের দারুণ দুঃখ-দুর্দশার কথা উল্লেখ করে বললেন, ‘বংশীয় ব্যক্তিদের এত দুঃখ, কষ্টের কথা অবগত হওয়া সত্ত্বও তুমি কিভাবে কুরাইশদের সমর্থন করতে পার?’ মুত্ব’ঈম বললেন, ‘সবই তো ঠিক আছে, কিন্তু আমি একা কী করতে পারি? ‘হিশাম বললেন, ‘আরও একজন রয়েছে।’ মুত্ব’ঈম জিজ্ঞাসা করলেন সে কে? হিশাম বললেন, ‘আমি’’। মুত্ব’ঈম বললেন, ‘আচ্ছা তবে তৃতীয় ব্যক্তির অনুসন্ধান করো’। হিশাম বললেন, ‘এটাও করেছি।’ বললেন, সে কে? উত্তরে বললেন, ‘যুহাইর বিন আবি উমাইয়া।’
মুত্ব’ঈম বললেন, ‘আচ্ছা তবে এখন চতুর্থ ব্যক্তির অনুসন্ধান করো’’। এ প্রেক্ষিতে হিশাম বিন ‘আমর আবুল বুখতারী বিন হিশামের নিকট গেলেন এবং মুতয়েমের সঙ্গে যেভাবে কথাবার্তা হয়েছিল তার সঙ্গেও ঠিক একইভাবে কথাবার্তা হল।
তিনি বললেন, ‘আচ্ছা এর সমর্থক কেউ আছে কি?’ হিশাম বললেন হ্যাঁ। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন কে? হিশাম বললেন, ‘যুহাইর বিন আবি উমাইয়া, মুত্ব’ঈম বিন আদী এবং আমি।’
তিনি বললেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। তবে এখন ৫ম ব্যক্তির খোঁজ করো। এবাবে হিশাম যামআ বিন আসওয়াদ বিন মুত্তালিব বিন আসাদের নিকট গেলেন এবং তার সঙ্গে কথাবার্তা বলেন বনু হাশিমের আত্মীয়তা এবং তাদের প্রাপ্যসমূহের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন।
তিনি বললেন, ‘আচ্ছা যে কাজের জন্য আমাকে ডাক দিচ্ছ, সে ব্যাপারে আরও কি কারো সমর্থন আছে?
হিশাম ‘হ্যাঁ’ সূচক উত্তর করে সকলের নাম বললেন। তারপর তাঁরা সকলে হাজূনের নিকট একত্রিত হয়ে এ মর্মে অঙ্গীকারাবদ্ধ হলেন যে, কুরাইশগণের অঙ্গীকারপত্রখানা অবশ্যই ছিঁড়ে ফেলতে হবে। যুহাইর বললেন, ‘এ ব্যাপারে আমিই সর্ব প্রথম মুখ খুলব।’
পূর্বের কথা মতো পর দিন প্রাতে সকলে মজলিসে উপস্থিত হলেন। যুহাইর শরীরে একজোড়া কাপড় ভালভাবে লাগিয়ে উপস্থিত হলেন। প্রথমে তিনি সাতবার বায়তুল্লাহ প্রদক্ষিণ করে নিলেন। তারপর সমবেত জনগণকে সম্বোধন করে বললেন, ওহে মক্কাবাসীগণ! আমরা তৃপ্তি সহকারে উদর পূর্ণ করে খাওয়া-দাওয়া করব, উত্তম পোষাক পরিচ্ছদ পরিধান করব। আর বনু হাশিম ধ্বংস হয়ে যাবে। তাদের সঙ্গে ক্রয়-বিক্রয় এবং আদান-প্রদান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আল্লাহর শপথ! আমি ততক্ষণ পর্যন্ত বসে থাকতে পারি না, যতক্ষণ ঐ অন্যায় ও উৎপীড়নমূলক অঙ্গীকারপত্রখানা ছিঁড়ে ফেলা না হচ্ছে।
আবূ জাহল মাসজিদুল হারামের নিকটেই ছিল- সে বললো, তুমি ভুল বলছ। আল্লাহর শপথ! তা ছিঁড়ে ফেলা হবে না।
প্রত্যুত্তরে যাময়া বিন আসওয়াদ বলে উঠল, ‘আল্লাহর কসম! তুমি অধিক ভুল বলছ। কিসের অঙ্গীকারপত্র! ওটা লিখার ব্যাপারে আমাদের কোন সম্মতি ছিল না। আমরা ওতে সন্তুষ্টও ছিলাম না।’’
অন্য দিক থেকে আবুল বুখতারী সহযোগী হয়ে বলে উঠল,
‘‘যাময়া ঠিকই বলেছো। ঐ অঙ্গীকারপত্রে যা লেখা হয়েছিল তাতে আমাদের সম্মতি ছিল না এবং এখনো তা মান্য করতে আমরা বাধ্য নই।’
এর পর মুত্ব’ঈম বিন আদী বললেন, ‘তোমরা উভয়েই ন্যায্য কথা বলেছো। এর বিপরীত কথাবার্তা যারা বলেছো তারাই ভুল বলেছো। আমরা এ প্রতিজ্ঞাপত্র এবং ওতে যা কিছু লেখা রয়েছে তা হতে আল্লাহর সমীপে অসন্তোষ প্রকাশ করছি।
ওদের সমর্থনে হিশাম বিন ‘আমরও অনুরূপ কথাবার্তা বললেন।
এদের আলাপ ও কথাবার্তা শুনে আবূ জাহল বলল, ‘বুঝেছি, বুঝেছি, এ সব কথা আলাপ-আলোচনা করে বিগত রাত্রিতে স্থির করা হয়েছে এবং এ সংক্রান্ত পরামর্শ এ স্থান বাদ দিয়ে অন্যত্র কোথাও করা হয়েছে।’
ঐ সময় আবূ ত্বালিবও পবিত্র হারামের এক প্রান্তে উপস্থিত ছিলেন। তাঁর আগমনের কারণ হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে এ অঙ্গীকারপত্র সম্পর্কে এ সংবাদ দিয়েছিলেন যে, তার জন্য আল্লাহ তা‘আলা এক প্রকার কীট প্রেরণ করেছেন যা অন্যায় ও উৎপীড়নমূলক এবং আত্মীয়তা বিনষ্টকারী অঙ্গীকার পত্রটির সমস্ত কথা বিনষ্ট করে দিয়েছে। শুধুমাত্র আল্লাহর নাম অবশিষ্ট রয়েছে। নাবী কারীম (সাঃ) তাঁর চাচা আবূ ত্বালিবকে এ কথা বলেছিলেন এবং তিনিও কুরাইশগণকে এ কথা বলার জন্য মসজিদুল হারামে আগমন করেছিলেন।
আবূ ত্বালিব কুরাইশগণকে লক্ষ্য করে বললেন, আল্লাহর তরফ থেকে আমার ভ্রাতুষ্পুত্রের নিকট সংবাদ এসেছে যে, আপনাদের অঙ্গীকারপত্রটির সমস্ত লেখা আল্লাহ প্রেরিত কীটেরা নষ্ট করে ফেলেছে। শুধু আল্লাহর নামটি বর্তমান আছে। এ সংবাদটি আপনাদের নিকট পৌঁছানোর জন্য আমার ভ্রাতুষ্পুত্র আমাকে প্রেরণ করেছেন। যদি তাঁর কথা মিথ্যা প্রমাণিত হয় তাহলে তাঁর ও আপনাদের মধ্য থেকে আমি সরে দাঁড়াব। তখন আপনাদের যা ইচ্ছে হয় করবেন। কিন্তু তাঁর কথা যদি সত্য প্রমাণিত হয় তাহলে বয়কটদের মাধ্যমে আপনারা আমাদের প্রতি যে অন্যায় অত্যাচার করে আসছেন তা থেকে বিরত হতে হবে। এ কথায় কুরাইশগণ বললেন, ‘আপনি ইনসাফের কথাই বলছেন।’
এ দিকে আবূ জাহল এবং লোকজনদের মধ্যে বাকযুদ্ধ ও বচসা শেষ হলে মুত্ব’ঈম বিন আদী অঙ্গীকার পত্রখানা ছিঁড়ে ফেলার জন্য উঠে দাঁড়াল। তারপর সেটা হাতে নিয়ে সত্যি সত্যিই দেখা গেল যে, এক প্রকার কীট লেখাগুলোকে সম্পূর্ণরূপে নষ্ট করে দিয়েছে। শুধু মাত্র ‘বিসমিকা আল্লাহুম্মা’ কথাটি অবশিষ্ট রয়েছে এবং যেখানে যেখানে আল্লাহর নাম লেখা ছিল শুধু সেই লেখা গুলোই অবশিষ্ট রয়েছে। কীটে সেগুলো খায়নি।
তারপর অঙ্গীকার পত্রখানা ছিঁড়ে ফেলা হল এবং এর ফলে বয়কটেরও অবসান ঘটল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এবং অন্যান্য সকলে শেয়াবে আবূ ত্বালিব থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন। মুশরিকগণ নাবী (সাঃ)-এর নবুওয়তের এক বিশেষ নিদর্শন প্রত্যক্ষ করে চমৎকৃত হল, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের আচরণের ক্ষেত্রে কোনই পরিবর্তন সূচিত হল না। যার উল্লেখ এ আয়াতে কারীমায় রয়েছে,
{وَإِن يَرَوْا آيَةً يُعْرِضُوْا وَيَقُوْلُوْا سِحْرٌ مُّسْتَمِرٌّ} [القمر:2]
‘‘কিন্তু তারা যখন কোন নিদর্শন দেখে তখন মুখ ফিরিয়ে নেয় আর বলে- ‘এটা তো সেই আগের থেকে চলে আসা যাদু’।’ (আল-ক্বামার ৫৪ : ২)
তাই মুশরিকগণ বিমুখ হলে গেল এবং স্বীয় কুফরে তারা আরও কয়েক ধাপ অগ্রসর হয়ে গেল।[2]
ফুটনোটঃ[1] এর প্রমাণ হচ্ছে যে অঙ্গকার নামা ছিঁড়ে ফেলার ছয় মাস পর আবূ তালিবের মৃত্যু হয় এবং সঠিক কথা এটাই যে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল রজম মাসে। যাঁরা একথা বলেন যে, তাঁর মৃত্যু হয়েছিল রমাযান মাসে তাঁরা একথাও বলেন যে, তাঁর মৃত্যু হয়েছিল অঙ্গীকার নাম ছিন্ন করা ছয় মাস পরে নয় বরং আট মাস অথবা আরও কয়েক দিন পরে। উভয় প্রকার হিসেবেই অঙ্গীকারানাম ছিন্ন করার মাস হচ্ছে মুহারম।
[2] বয়কটের এ বিস্তৃত বিবরণাদি নিম্নে বর্ণিত উৎস হতে চয়ন ও প্রণয়ন করা হয়েছে। সহীহুল বুখারী মক্কায় নাবাবী অবতরণ অধ্যায় ১ম খন্ড ২৬১ পৃঃ। বাবু তাকাসোমিল মুশরিকীন আলান্নাবীয়ে (সাঃ) ১ম খন্ড ৫৪৮ পৃঃ যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৪৬ পৃঃ। ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৩৫০-৩৫১ পৃঃ ও ৩৭৪-৩৭৭ পৃঃ। রাহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ৬৯-৭০ পৃঃ শাইখ আবদুল্লাহ রচিত ‘মুখতাসারুস সীরাহ ১০৬-১১০ পৃঃ। এবং শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব রচিত ‘মুখতাসারুস সীরাহ ৬৮-৭৩ পৃঃ। এ উৎসসমূহে কিছু কিছু মতবিরোধ রয়েছে। প্রমাণাদির প্রেক্ষিতে আমি অগ্রাধিকার যোগ্য দিকটিই উল্লেখ করেছি।
আবু ত্বালিবের কাছে শেষ কুরাইশ প্রতিনিধি দল
গিরি সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পর পূর্বের মতো আবারও রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দাওয়াত এবং তাবলীগের কাজ আরম্ভ করে দিলেন। অপরপক্ষে মুশরিকগণ যদিও বয়কট পরিহার করে নিয়েছিল, কিন্তু তবুও পূর্বের মতই মুসলিমদের উপর চাপসৃষ্টি এবং আল্লাহর পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি অব্যাহতভাবে চালিয়ে যেতে থাকল। আবূ ত্বালিবও পূর্বের মতই জীবন বাজি রেখে ভ্রাতুষ্পুত্রকে সাহায্য করতে থাকলেন এবং তাঁর নিরাপত্তা বিধানের ব্যাপারে যথাসাধ্য সতর্কতা অবলম্বন করে চলতে থাকলেন। কিন্তু এখন তিনি অশীতিপর বৃদ্ধ এবং বিশেষ করে গিরি সংকটে তিন বছর যাবৎ অবর্ণনীয় অভাব-অনটনের মধ্যে আবদ্ধ জীবন-যাপন করার ফলে তাঁর শক্তি সামর্থ্য প্রায় নিঃশেষিত হয়ে পড়েছিল এবং কোমর বক্রাকার ধারণ করেছিল। গিরি সংকটের আবদ্ধ জীবন থেকে বেরিয়ে আসার পর এ সব কারণে তিনি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন। ঐ সময় মুশরিকগণ চিন্তা-ভাবনা করল যে, যদি আবূ ত্বালীবের মৃত্যু হয় এবং তারা তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রের উপর অন্যায়-অত্যাচার করে তবে এতে তাদের খুব বড় রকমের বদনাম হয়ে যাবে। এ কারণে আবূ ত্বালীবের সামনেই মুহাম্মাদ (সাঃ) সম্পর্কে কোন একটা সিদ্ধান্ত হয়ে যাওয়া উচিত। এ ব্যাপারে তিনি কিছুটা সুযোগ-সুবিধাও দিতে পারেন আগে কোন দিনই যা দিতে তিনি রাজি ছিলেন না। এ চিন্তা ভাবনার প্রেক্ষাপটে একটি কুরাইশ প্রতিনিধিদল আবূ ত্বালীবের নিকট গিয়ে উপস্থিত হল এবং এটিই ছিল তাঁর নিকট অনুরূপ শেষ প্রতিনিধি দল।
ইবনে ইসহাক্ব এবং অন্যান্যদের বর্ণনা সূত্রে জানা যায় যে, যখন অসুস্থ আবূ ত্বালিব শয্যাগত হয়ে পড়লেন এবং দিনে দিনে তাঁর অবস্থা ক্রমেই অবনতির দিকে যেতে থাকল তখন কুরাইশগণ এ মর্মে পরস্পর বলাবলি করতে থাকল যে, ‘হামযাহ ও উমার মুসলিম হয়ে গিয়েছে এবং মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর ধর্ম বিভিন্ন কুরাইশ গোত্রে বিস্তার লাভ করেছে। কাজেই, চল আমরা আবূ ত্বালীবের নিকট গিয়ে তাঁকে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রের ধর্ম প্রচার থেকে বিরত রাখার ব্যাপারে একটি অঙ্গীকার আদায়ের কথা বলি এবং আমাদের পক্ষ থেকেও কোন প্রকার অনিষ্ট না করার ব্যাপারে তাঁর অনুকূলে একটি অঙ্গীকারনামা সম্পাদন করে নেই। কারণ, এ ব্যাপারে আমরা অত্যন্ত ভীত এবং আতংকিত যে, এই ধারায় মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁর প্রচার অব্যাহত রাখলে লোকজনেরা তাঁর ধর্মমত গ্রহণ করে আমাদের আয়ত্বের বাইরে চলে যাবে।
অন্য এক বর্ণনায় কুরাইশগণের বক্তব্য এ মর্মে প্রমাণ করা হয়েছে ‘আমাদের ভয় হচ্ছে যে, বৃদ্ধ আবূ ত্বালিব মৃত্যু বরণ করলে এবং তারপর মুহাম্মাদ(সাঃ)-এর সঙ্গে কোন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়ে গেলে আরবের লোকেরা আমাদের নিন্দা করবে এবং বলবে যে, তারা মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে ছেড়ে রেখেছিল। (অর্থাৎ তাঁর বিরুদ্ধে কোন কিছুই করতে পারে নি) কিন্তু যখন তাঁর চাচা মৃত্যু মুখে পতিত হলেন তখন তারা তাঁর উপর আক্রমণ করে বসল।
যাহোক, এ কুরাইশ প্রতিনিধি দল আবূ ত্বালীবের নিকট গিয়ে পৌঁছল এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ আলোচনা ও মত বিনিময় করল। কুরাইশগণের মধ্য থেকে বিশিষ্ট এবং সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের নিয়ে এই প্রতিনিধিদ দল গঠিত হয়েছিল। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিগণের মধ্যে ছিলেন উতবাহ বিন রাবী’আহহ্, শায়বাহ বিন রাবী’আহ, আবূ জাহল বিন হিশাম, উমাইয়া বিন খালফ, এবং আবূ সুফইয়ান বিন হারব। এ প্রতিনিধিদলে ছিল মোট পাঁচ জন সদস্য।
বৃদ্ধ আবূ ত্বালিবকে সম্বোধন করে তারা বলল, ‘হে আবূ ত্বালিব! আমাদের মধ্যে মান-মর্যাদার যে আসনে আপনি সমাসীন রয়েছেন তা সম্যক অবহিত রয়েছেন এবং বর্তমানে যে অবস্থার মধ্য দিয়ে কালাতিপাত করছেন তাও আপনার নিকট সুস্পষ্ট। আমাদের ভয় হচ্ছে যে, আপনি আপনার জীবনের অন্তিম পর্যায় অতিবাহিত করছেন। এ দিকে আপনার ভ্রাতুষ্পুত্র এবং আমাদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও মতদ্বৈধতা চলে আসছে সেও আপনার অজানা নেই। আমরা চাচ্ছি যে, আপনি তাঁকে ডাকিয়ে নেবেন এবং তাঁর সম্পর্কে আমাদের নিকট থেকে এবং আমাদের সম্পর্কে তাঁর নিকট থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করবেন। এ অঙ্গীকারের উদ্দেশ্য হবে আমরা তাঁর থেকে এবং সে আমাদের থেকে পৃথক থাকবে। অর্থাৎ আমাদের ধর্মমতের উপর সে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করবে না এবং আমরাও তার ধর্মমতের উপর কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করব না।
কুরাইশ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনার প্রেক্ষিতে আবূ ত্বালিব তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রকে ডাকিয়ে নিলেন এবং বললেন ভ্রাতুষ্পুত্র! তুমি অবশ্যই অবগত আছ যে, এরা হচ্ছেন তোমার স্বজাতীয় সম্মানিত ব্যক্তি। তোমার জন্যই এরা এখানে সমবেত হয়েছেন। এরা চাচ্ছেন যে, তোমাকে কিছু ওয়াদা বা অঙ্গীকার প্রদান করবেন এবং তোমাকেও তাঁদের কিছু ওয়াদা বা অঙ্গীকার প্রদান করতে হবে। অর্থাৎ ধর্মমতের ব্যাপারে তাঁরা তোমার প্রতি কোন কটাক্ষ করবেন না এবং তুমিও তাঁদের প্রতি কোন প্রকার কটাক্ষ করবে না।
প্রত্যুত্তরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রতিনিধিদলকে সম্বোধন করে বললেন, (أَرَأَيْتُمْ إِنْ أُعْطِيْتُكُمْ كَلِمَةً تَكَلَّمْتُمْ بِهَا، مَلَّكْتُمْ بِهَا الْعَرَبَ، وَدَانَتْ لَكُمْ بِهَا الْعَجَمُ) ‘আমি যদি এমন একটি প্রস্তাব পেশ করি যা মেনে নিলে গোটা আরবের সম্রাট হওয়া যাবে এবং আজম অধীনস্থ হয়ে যাবে তাহলে এ ব্যাপারে আপনাদের মতামত কী হতে পারে তা বলুন। কোন কোন বর্ণনায় এমনটিও বলা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর চাচা আবূ ত্বালিবকে সম্বোধন করে বলেছেন, চাচা জান! আমি তাঁদের নিকট থেকে এমন এক প্রস্তাবের প্রতি স্বীকৃতি ও সমর্থন চাই যা মেনে নিলে সমগ্র আরব জাহান তাঁদের অধীনস্থ হয়ে যাবে এবং আজম তাঁদের নিকট কর দিয়ে বসবাস করতে বাধ্য হবে।
অন্য এক বর্ণনায় কথাও উল্লেখ রয়েছে যে, নাবী (সাঃ) বললেন, ‘চাচাজান! আপনি তাদেরকে এমন কথার প্রতি আহবান জানান না কেন যা প্রকৃতই তাদের মঙ্গল জনক।’
তিনি বললেন, তুমি কোন্ কথার প্রতি তাদের আহবান জানাতে বলছ?
নাবী (সাঃ) বললেন, আমি এমন এক কথার প্রতি আহবান জানাচ্ছি যে, কথা মেনে নিলে সমগ্র আরব তাদের অধীনস্থ হয়ে যাবে এবং অনারবদের উপর তাদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। ইবনে ইসহাক্বের এক বর্ণনা সূত্রে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের বললেন,
كلمة واحدة تعطونها تملكون بها العرب وتدين لكم بها العجم
‘‘আপনারা শুধুমাত্র একটি কথা মেনে নিন যার বদৌলতে আপনারা হয়ে যাবেন আরবের সম্রাট এবং আজম হয়ে যাবে আপনাদের অধীনস্থ।’’
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মুখ থেকে যখন তার একথা শুনল তখন তারা সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ ও নির্বাক হয়ে গেল এবং মনে হল যেন তাদের হতবুদ্ধিতায় পেয়ে বসেছে। মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর শুধু একটি কথা মেনে নিলে তারা এত বেশী লাভবান হতে পারবে এ চিন্তা তাদের মন মগজকে একদম আচ্ছন্ন করে ফেলল। তারা মনে মনে বলতে থাকল যে, একটি মাত্র কথাতে যদি এত বড় উপকার হয় তাহলে তা ছেড়ে দেয়া যায় কী করে? আবূ জাহল বলল, ‘আচ্ছা তুমি বলত ঠিক সে কথাটি কী? তোমার পিতার কসম, কথাটা যদি সত্য হয় তাহলে একটি কেন দশটি বললেও আমরা মান্য করতে প্রস্তুত আছি।’ নাবী (সাঃ) বললেন,
(لَا إِلٰهَ إِلاَّ اللهُ ، وَتَخْلَعُوْنَ مَا تَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِهِ)
‘‘আপনারা বলুন, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এবং আল্লাহ ছাড়া যার উপাসনা করেন তা পরিহার করুন।’’
নাবী কারীম (সাঃ)-এর এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে তারা হাতে হাত মারতে মারতে এবং তালি দিতে দিতে বলল, ‘মুহাম্মাদ (সাঃ) তুমি এটাই চাচ্ছ যে, সকল আল্লাহর জায়গায় মাত্র এক আল্লাহকে আমরা মেনে নেই। বাস্তবিক তোমার ব্যাপার বড়ই আশ্চর্য্যজনক!’
তারপর তারা নিজেদের মধ্যে একে অন্যকে বলল, ‘আল্লাহর শপথ! এ ব্যক্তি তোমাদের একটি কথাও মান্য করার জন্য প্রস্তুত নয়। অতএব, চলো এবং পূর্ব পুরুষগণের নিকট থেকে বংশ পরম্পরা সূত্রে প্রাপ্ত দ্বীনের উপরেই অটল থাক যাবৎ আল্লাহ আমাদের এবং তার মধ্যে একটা মীমাংসা করে না দেন। এর পর তারা নিজ নিজ রাস্তায় চলে গেল।
এ ঘটনার পর সেই সব লোকজনকে কেন্দ্র করে কুরআন মাজীদে এ আয়াতসমূহ অবতীর্ণ হল[1] :
{ص وَالْقُرْآنِ ذِي الذِّكْرِ بَلِ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا فِيْ عِزَّةٍ وَشِقَاقٍ كَمْ أَهْلَكْنَا مِن قَبْلِهِم مِّن قَرْنٍ فَنَادَوْا وَلَاتَ حِيْنَ مَنَاصٍ وَعَجِبُوْا أَن جَاءهُم مُّنذِرٌ مِّنْهُمْ وَقَالَ الْكَافِرُوْنَ هٰذَا سَاحِرٌ كَذَّابٌ أَجَعَلَ الآلِهَةَ إِلَهًا وَاحِدًا إِنَّ هٰذَا لَشَيْءٌ عُجَابٌ وَانطَلَقَ الْمَلأُ× مِنْهُمْ أَنِ امْشُوْا وَاصْبِرُوْا عَلٰى آلِهَتِكُمْ إِنَّ هٰذَا لَشَيْءٌ يُرَادُ مَا سَمِعْنَا بِهٰذَا فِي الْمِلَّةِ الآخِرَةِ إِنْ هٰذَا إِلَّا اخْتِلَاقٌ} [ص:1: 7]
‘‘১. সা‘দ, নাসীহাতে পূর্ণ কুরআনের শপথ- (এটা সত্য)। ২. কিন্তু কাফিররা আত্মম্ভরিতা আর বিরোধিতায় নিমজ্জিত। ৩. তাদের পূর্বে আমি কত মানবগোষ্ঠীকে ধ্বংস করে দিয়েছি, অবশেষে তারা (ক্ষমা লাভের জন্য) আর্তচিৎকার করেছিল, কিন্তু তখন পরিত্রাণ লাভের আর কোন অবকাশই ছিল না। ৪. আর তারা (এ ব্যাপারে) বিস্ময়বোধ করল যে, তাদের কাছে তাদেরই মধ্য হতে একজন সতর্ককারী এসেছে। কাফিরগণ বলল- ’এটা একটা যাদুকর, মিথ্যুক। ৫. সে কি সব ইলাহকে এক ইলাহ বানিয়ে ফেলেছে? এটা বড়ই আশ্চর্য ব্যাপার তো!’ ৬. তাদের প্রধানরা প্রস্থান করল এই ব’লে যে, ‘তোমরা চলে যাও আর অবিচলিত চিত্তে তোমাদের ইলাহ্দের পূজায় লেগে থাক। অবশ্যই এ ব্যাপারটির পিছনে অন্য উদ্দেশ্য আছে। ৭. এমন কথা তো আমাদের নিকট অতীতের মিল্লাতগুলো থেকে শুনিনি। এটা শ্রেফ একটা মন-গড়া কথা।’ (স-দ ৩৮ : ১-৭)
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪১৭-৪১৯ পৃঃ। শাইখ আবদুল্লাহ মুখতাসারুস সীরাহ ৯১ পৃঃ।
শোকের বছর
আবূ ত্বালীবের মৃত্যু (وَفَاةُ أَبِيْ طَالِبٍ):
বার্ধক্য, দুশ্চিন্তা, অনিয়ম ইত্যাদি নানাবিধ কারণে আবূ ত্বালীবের অসুস্থতা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন। তাঁর মৃত্যু গিরি সংকটে অন্তরীণাবস্থা শেষ হওয়ার ৬ মাস পর নবুওয়ত ১০ম বর্ষের রজব মাসে।[1]
এ ব্যাপারে অন্য একটি মত হচ্ছে তিনি খাদীজাহ (রাঃ)-এর মৃত্যুর মাত্র তিন দিন পূর্বে রমাযান মাসে মৃত্যু বরণ করেন।
সহীর বুখারীতে মুসাইইব (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, আবূ ত্বালীবের মৃত্যুর সময় উপস্থিত হলে নাবী কারীম (সাঃ) তাঁর নিকটে আগমন করেন। সেখানে আবূ জাহলও উপস্থিত ছিল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন,
(أَيْ عَمِّ، قُلْ: لَا إِلٰهَ إِلاَّ اللهُ ، كَلِمَةً أُحَاجُ لَكَ بِهَا عِنْدَ اللهِ)
‘চাচাজান! আপনি শুধু একবার লা ইলাহা ইলালাহ কালেমাটি পাঠ করুন, যাতে আমি বিচার দিবসে প্রমাণ হিসেবে তা আল্লাহর সমীপে পেশ করতে পারি।’’
আবূ জাহল এবং আব্দুল্লাহ বিন উমাইয়া বলল, আবূ ত্বালিব আব্দুল মুত্তালিবের ধর্ম হতে কি তাহলে শেষ পর্যন্ত বিমুখ হয়েই যাবেন? তারপর এরা উভয়েই অবিরাম তাঁর সঙ্গে কথা বলতে থাকে। সব শেষে আবূ ত্বালিব যে কথাটি বলেছিলেন তা হচ্ছে, ‘আব্দুল মুত্তালিবের ধর্মের উপর।’ নাবী কারীম (সাঃ) বললেন,
(لَأَسْتَغْفِرَنَّ لَكَ مَا لَمْ أُنْهَ عَنْـهُ)
‘‘আমি যতক্ষণ বাধা প্রাপ্ত না হব ততক্ষণ আপনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকব।’ এ প্রেক্ষিতে এ আয়াতে কারীমা অবতীর্ণ হয়,
{مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِيْنَ آمَنُوْا أَن يَسْتَغْفِرُوْا لِلْمُشْرِكِيْنَ وَلَوْ كَانُوْا أُوْلِي قُرْبٰى مِن بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَابُ الْجَحِيْمِ} [التوبة:113]
‘‘নাবী ও মু’মিনদের জন্য শোভনীয় নয় মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা, তারা আত্মীয়-স্বজন হলেও, যখন এটা তাদের কাছে সুস্পষ্ট যে, তারা জাহান্নামের অধিবাসী।’ (আত্-তাওবাহ ৯ : ১১৩)
আরো অবতীর্ণ হয়:
{إِنَّكَ لاَ تَهْدِيْ مَنْ أَحْبَبْتَ} [القصص: 56]
‘‘তুমি যাকে ভালবাস তাকে সৎপথ দেখাতে পারবে না।’ (আল-ক্বাসাস ২৮ : ৫৬)
এখানে এ কথা বলা নিষ্প্রয়োজন যে, আবূ ত্বালিব রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে কী পরিমাণ সাহায্য সহযোগিতা ও রক্ষণাবেক্ষণ করেছিলেন। মক্কার অনাচারী মুশরিকগণের আক্রমণ থেকে ইসলামী আন্দোলনের প্রতিরক্ষার ব্যাপারে প্রকৃতই তিনি ছিলেন দৃর্গ স্বরূপ। কিন্তু আল্লাহর নাবী (সাঃ) এবং ইসলামের জন্য এত করেও যেহেতু তিনি বংশপম্পরা সূত্রে প্রাপ্ত বহুত্ববাদের প্রভাব কাটিয়ে আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস স্থাপন করতে পারলেন না, সেহেতু দোরগোড়ায় আগত কামিয়াবি থেকে বঞ্চিতই রয়ে গেলেন। যেমন সহীহুল বুখারী শরীফে আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি তোমার চাচার কি উপকারে আসবে? ‘কারণ নাবী কারীম (সাঃ)-এর রক্ষণাবেক্ষণ এবং নিরাপত্তা বিধানের ব্যাপারে তাঁর শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করতেও তিনি প্রস্তুত ছিলেন।
রাসূলুল্লাহ বললেন,
(هُوَ فِيْ ضَحْضَاحٍ مِن نَّارٍ، وَلَوْلَا أَنَا لَكَانَ فِيْ الدَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنْ النَّارِ)
‘‘তিনি এখন জাহান্নামের অগভীর স্থানে অবস্থান করেছেন। যদি আমি তাঁর সঙ্গে সম্পর্কিত না হতাম তা হলে তিনি জাহান্নামের অতল ডুবে যেতেন।[2]
আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, এক দফা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট তাঁর চাচা আবূ ত্বালীবের আলোচনা উপস্থিত হয়। আলোচনা সূত্রে তিনি বলেন, ‘সম্ভবত কেয়ামতের দিন আমার সুপারিশ তাঁর উপকারে আসবে এবং তাঁকে জাহান্নামের এক অগভীর স্থানে রাখা হবে যা শুধু তাঁর দু’পায়ের গিঁট পৌঁছবে।[3]
ফুটনোটঃ[1] জীবন চরিত বর্ণনাকারীদের মধ্যে কোন মাসে আবূ তালিবেরর মৃত্যু মৃত্যু হয়েছে তা নিয়ে চরম মতভেদ আছে। আমি রজব মাসকে এ জন্য অগ্রাধিকার দিলাম যে, অধিকাংশ ঐতিহাসিক একমত যে, তাঁর মৃত্যু আবূ তালিব গিরি গুহা হতে মুক্তি লাভের ছয় মাস পরে হয়েছে। অবরোধ আরম্ভ হয়েছিল ৭ম নাবাবী সনের মুহরম মাসের প্রথম তারীখে এ হিসেবে মৃত্যু ১০ম হিজরীর রজবে হয়।
[2] সহীহুল বুখারী আবূ তালিবের ঘটনা অধ্যায় ১ম খন্ড ৫৪৮ পৃঃ।
[3] সহীহুল বুখারী আবূ তালিবের ঘটনা অধ্যায় ১ম খন্ড ৫৪৮।
আল্লাহর অনন্ত রহমতের পথে খাদীজাহ (রাঃ) (خَدِيْجَةُ إِلٰى رَحْمَةِ اللهِ):
আবূ ত্বালীবের মৃত্যুর দু’মাস পর (মতান্তরে মাত্র তিনদিন পর) উম্মুল মো’মেনীন খাদিজাতুল কুবরা (রাঃ) মৃত্যুমুখে পতিত হন। তাঁর মৃত্যু নবুওয়ত দশমবর্ষের রমাযান মাসে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। রাসূলুল্লাহ তখন অতিবাহিত করেছিলেন তাঁর জীবনের ৫০তম বছর।[1]
রসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর জীবনে খাদীজাহ (রাঃ) ছিলেন আল্লাহ তা‘আলার এক বিশেষ নেয়ামত স্বরূপ। দীর্ঘ পঁচিশ বছর যাবৎ আল্লাহর নাবী (সাঃ)-কে সাহচর্য দিয়ে, সেবা-যত্ন দিয়ে, বিপদাপদে সাহস ও শক্তি দিয়ে, অভাব অনটনে অর্থ সম্পদ দিয়ে, ধ্যান ও জ্ঞানের প্রয়োজনে প্রেরণা ও পরামর্শ দিয়ে ইসলাম বীজের অংকুরোদগম এবং শিশু ইসলামের লালন-পালনের ক্ষেত্রে তিনি যে অসামান্য অবদান রেখেছেন ইসলামের ইতিহাসে তার কোন তুলনা মিলেনা। খাদীজাহ (রাঃ) সম্পর্কে বলতে গিয়ে নাবী কারীম (সাঃ) বলেছেন,
(آمَنَتْ بِىْ حِيْنَ كَفَرَ بِىْ النَّاسُ، وَصَدَقَتْنِىْ حِيْنَ كَذَبَنِيْ النَّاسُ، وَأَشْرَكَتْنِىْ فِيْ مَالِهَا حِيْنَ حَرَّمَنِىْ النَّاسُ، وَرَزَقَنِىْ اللهُ وَلَدَهَا وَحَرَّمَ وَلَدَ غَيْرِهَا)
যে সময় লোকেরা আমার সঙ্গে কুফরী করল সেই সময়ে তিনি আমার প্রতি নিটোল বিশ্বাস স্থাপন করলেন, যে সময় লোকেরা আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল সে সময় তিনি আমাকে দান করলেন, আর লোকেরা যখন আমাকে বঞ্চিত করল, তখন তিনি আমাকে তাঁর সম্পদে অংশীদার করলেন। আল্লাহ আমাকে তাঁর গর্ভে সন্তানাদি প্রদান করলেন, অন্য কোন স্ত্রীর গর্ভে সন্তান দেন নাই।[2]
সহীহুল বুখারীতে আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, জিবরাঈল (আঃ) নাবী কারীম (সাঃ)-এর নিকট আগমন করে বললেন যে, ‘হে আল্লাহর রাসূল! ইনি খাদীজাহ (রাঃ) আগমন করছেন। তাঁর নিকট একটি পাত্র আছে। যার মধ্যে তরকারী, খাদ্যবস্তু অথবা পানীয় বস্তু আছে। যখন সে আপনার নিকট এসে পৌঁছবে তখন আপনি তাঁকে তাঁর প্রতিপালকের পক্ষ থেকে সালাম বলবেন এবং জান্নাতে মতির তৈরি একটি মহলের সুসংবাদ প্রদান করবেন। যার মধ্যে কোন হট্টগোল বা হৈচৈ হবে না, কোন প্রকার ক্লান্তি ও শ্রান্তি আসবে না।[3]
ফুটনোটঃ[1] রমাযান মাসে মুত্যু হওয়ার স্পষ্ট ব্যাখ্যা ইবনে জাওযী তালকীহুল ফহুমে ৭ পৃষ্ঠায় এবং আল্লামা মানসুরপুরী রহমাতুল্লিল আলামীন ২য় খন্ড ১৬৪ পৃঃ।
[2] মুসনাদে আহমাদ ৬ষ্ঠ ১১৮ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
[3] সহীহুল বুখারী খাদীজার সাথে নাবী (সাঃ)-এর বিবাহ ও তাঁর ফযীলত অধ্যায় ১ম খন্ড ৫৩৯ পৃঃ।
দুঃখের উপর দুঃখ (تَرَاكُمُ الْأَحْزَانِ):
প্রাণপ্রিয় চাচা আবূ ত্বালীবের মৃত্যু এবং প্রাণাধিকা প্রিয়া ও সহধর্মিনী উম্মুল মো’মিনীন খাদীজাহ (রাঃ)-এর মুত্যু এ দুটি মর্মান্তিক ও বেদনাদায়ক ঘটনা সংঘটিত হয়ে গেল অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে। এ দুটি মৃত্যুর সুদূর প্রসারী ফল প্রতিফলিত হতে থাকল নাবী (সাঃ)-এর জীবনে। একদিকে যেমন তাঁর জীবনে বিস্তার লাভ করল নিদারুণ শোকের ছায়া, অন্যদিকে তিনি বঞ্চিত হলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী অভিভাবকের অভিভাবকত্ব এবং সহধর্মিনীর অনাবিল প্রেম ভালবাসা ও সাহচর্য থেকে। পিতৃব্যের মৃত্যুর ফলে মুশরিকগণের সাহস বৃদ্ধি পেয়ে গেল বহুগুণে। নাবী (সাঃ) ও মুসলিমগণের উপর নতুন উদ্যমে তারা শুরু করল নানামুখী নির্যাতন। একেত প্রিয় পরিজনদের বিয়োগ ব্যথা, অন্যদিকে দুঃখ, যন্ত্রণা নির্যাতন পর্বতসম ধৈর্য্যের অধিকারী হয়েও নাবী (সাঃ)-এর জীবন হয়ে উঠে বিষাদময় ও বিপর্যস্ত, হয়ে উঠে নৈরাশ্যে ভরপুর। নৈরাশ্যের মাঝে কিছুটা আশায় বুক বেঁধে অগ্রসর হন তিনি ত্বায়িফের পথে যদি সেখানকার লোকজন দাওয়াত গ্রহণ করেন, কিংবা দাওয়াত ও তাবলীগের ব্যাপারে তাঁকে কিছুটা সাহায্য করেন, কিংবা তাঁকে একটু আশ্রয় প্রদান করে তাঁর জাতির বিরুদ্ধে সাহায্য করেন। কিন্তু সেখানে দাওয়াত কবুল, আশ্রয় কিংবা, সাহায্য প্রদান কোন কিছু তো নয়ই, বরং তাঁর সঙ্গে এতই নির্মম আচরণ করা হল এবং এতই দৈহিক নির্যাতন চালানো হল যে, তা অতীত নির্যাতনের সকল রেকর্ড অতিক্রম করে গেল (এ সংক্রান্ত বিস্তারিত আলোচনা করা হবে আরও পরে)।
এ দিকে মক্কার মুশরিকগণ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এবং তাঁর অনুগামী ও অনুসারীদের উপর ইতোপূর্বে যেভাবে জুলুম-নির্যাতন ও অত্যাচার উৎপীড়ন চালিয়ে আসছিল এখনো অব্যাহতভাবে তা চালিয়ে যেতে থাকল। শুধু তাই নয়, বরং নির্যাতনের মাত্রা এত বেশী বৃদ্ধি পেতে থাকল যে, আবূ বাকর (রাঃ) -এর মতো অত্যন্ত ধৈর্যশীল এবং কষ্ট সহিষ্ণু ব্যক্তিও অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে উঠলেন এবং উপায়ান্তর না দেখে মক্কা ছেড়ে হাবশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। কিন্তু পথিমধ্যে ‘বারকে গিমাদ’ নামক স্থানে পৌঁছলে ইবনে দাগানার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে। সে তাঁকে নিরাপত্তা বিধানের আশ্বাস দিয়ে নিজ আশ্রয়ে মক্কায় ফিরে নিয়ে আসে।[1]
ইবনে ইসহাক্ব বর্ণনা করেছেন যে, যখন আবূ ত্বালিব মৃত্যুমুখে পতিত হন তখন কুরাইশগণ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে এত কষ্ট দেন যা আবূ ত্বালীবের জীবদ্দশায় কেউ কল্পনাই করতে পারেনি। এখানে একটি ঘটনার উল্লেখ করা হল। একদিন এক নির্বোধ ও গোঁয়ার প্রকৃতির কুরাইশ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সামনে এগিয়ে এসে মাথার উপর মাটি নিক্ষেপ করে দেয়। সেই অবস্থাতেই তিনি প্রত্যাবর্তন করেন। গৃহে প্রত্যাবর্তনের পর তাঁর এক কন্যা সেই মাটি ধুইয়ে পরিস্কার করে দেন। ধোয়ানোর সময় তিনি ক্রন্দন করছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে সান্ত্বনা দানের জন্য বললেন,
(لَا تَبْكِىْ يَابُنَيَّةُ، فَإِنَّ اللهَ مَانِعٌ أَبَاكَ)
‘‘পুত্রী ক্রন্দন কোরো না। আল্লাহই তোমার পিতার হিফাজতকারী।’’
ঐ সময় তিনি এ কথাও বলেন যে,
(مَا نَالَتْ مِنِّىْ قُرَيْشٌ شَيْئًا أَكْرَهُهُ حَتّٰى مَاتَ أَبُوْ طَالِبٍ)
‘‘যতদিন আমার চাচা আবূ ত্বালিব জীবিত ছিলেন কুরাইশগণ আমার সঙ্গে এত খারাপ ব্যবহার করে নি যা আমার সহ্যের বাহিরে ছিল।’’[2]
এমনিভাবে অবিরাম একের পর এক বিপদাপদের সম্মুখীন হওয়ার কারণে নাবী কারীম (সাঃ) সেই বছরটির নাম রাখেন ‘আমুল হুযন’ অর্থাৎ দুঃখ কষ্টের বছর। ইতিহাসে সে বছরটি এ নামেই প্রসিদ্ধ।
ফুটনোটঃ[1] আকবর শাহ নাজীরাবাদী স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, এ ঘটনা সেই বছরই ঘটেছিল। দ্রঃ তারীখে ইসলাম ১ম খন্ড ১২০ পৃঃ। মূল ঘটনাসহ বিস্তারিত আলোচনা ইবনে হিশাম ১ম খন্ড পৃঃ ৩৭২ ও ৩৭৪ ও সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড পৃঃ ৫৫২ ও ৫৫৩ তে উলেখ আছে।
[2] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪১৬ পৃঃ।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে সাওদাহ (রাঃ)-এর বিবাহ (الزِّوَاجُ بِسَوْدَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا):
নবুওয়ত ১০ম বর্ষের শাওয়াল মাসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সাওদা বিনতে যাম’আহ (রাঃ)-কে বিবাহ করেন। এ মহিলা নবুওয়তের প্রথম অবস্থাতেই মুসলিম হয়েছিলেন। হাবশের (আবিসিনিয়ায়) দ্বিতীয় হিজরতের সময় হিজরতও করেছিলেন। তাঁর পূর্ব স্বামীর নাম ছিল সাকরান বিন ‘আমর। তিনিও প্রথম পর্যায়ের মুসলিম ছিলেন এবং সাওদাহ তাঁর সঙ্গে হাবশা হিজরত করেছিলেন। সাওদাহর স্বামী হাবশে মৃত্যুবরণ করেন। এ কথাও বলা হয়ে থাকে যে, মক্কায় ফিরে আসার পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বৈধব্যের পর ইদ্দত পালন শেষ হলে নাবী কারীম (সাঃ) তাঁকে বিবাহের প্রস্তাব পাঠান। তারপর তাঁরা উভয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। খাদীজাহ (রাঃ)-এর পর এ মহিলা ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রথম স্ত্রী (বিবাহ পরম্পরায়) দ্বিতীয় স্ত্রী) কয়েক বছর পর ইনি নিজের পালা আয়িশাহ (রাঃ)-কে দান করে দিয়েছিলেন।[1]
ফুটনোটঃ[1] রাহমাতুল্লিল আলামীন ২য় খন্ড ১৬৫ পৃঃ। তালকীহুল ফহুম ৬ পৃঃ।
প্রথম পর্যায়ের মুসলিমগণের ধৈর্য এবং এর অন্তর্নিহিত কারণসমূহ
১. আল্লাহর প্রতি ঈমান (الْإِيْمــَانُ بِاللهِ):
উপর্যুক্ত প্রশ্নের প্রেক্ষাপটে সম্ভাব্য উত্তরমালার মধ্যে সর্বপ্রথম এবং সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সমগ্র বিশ্ব জাহানের অনাদি অনন্ত অদ্বিতীয়, সর্বশক্তিমান স্রষ্টা প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলার প্রতি প্রগাঢ় বিশ্বাস এবং তাঁর অস্তিত্ব, হিকমত এবং কুদরত সম্পর্কে সঠিক এবং সুস্পষ্ট ধারণা বা জ্ঞান। কারণ, তাওহীদের সুস্পষ্ট ধারণা এবং তাওহিদী নূরে যখন মু’মিনের অন্তর আলোকিত, উদ্বেলিত ও পুলকিত হয়ে ওঠে, পর্বত-প্রমাণ প্রতিবন্ধকতাও তখন তাঁর সামনে শুষ্ক তৃণখন্ডের মতো তুচ্ছ মনে হয়। যে মু’মিন পরিপক্ক ও সুদৃঢ় ঈমান এবং মজবুত ইয়াকীনের অধিকারী হওয়ার দুর্লভ সৌভাগ্য লাভ করেন, তাঁর সম্মুখে পৃথিবীর যত প্রকট সমস্যাই আসুক না কেন, তা যতই ভয়ংকর এবং ভীতিপ্রদই হোক না কেন, তাঁর অটল বিশ্বাসে বলীয়ান চেতনা এবং তাওহীদের অলৌকিক আস্বাদে পরিতৃপ্ত মন এ সব কিছুকে স্যাঁতসেঁতে এদো পরিবেশে ভগ্ন ইষ্টকখন্ডের উপর জমে উঠা শেওলার চাইতে অধিক কিছুই মনে করেন না। এ কারণেই ঈমানী সুরার অলৌকিক আস্বাদে পরিতৃপ্ত কোন ঈমানদারের প্রাণের সজীবতা এবং উদার উন্মুক্ত চিত্তের আনন্দানুভূতি মূর্খ ও নিকৃষ্ট শ্রেণীর মানব সৃষ্ট দুঃখ-কষ্ট, যন্ত্রণাকে কখনো পরোয়া করে না। কুরআন মাজীদে যেমনটি ইরশাদ হয়েছে,
{فَأَمَّا الزَّبَدُ فَيَذْهَبُ جُفَاء وَأَمَّا مَا يَنفَعُ النَّاسَ فَيَمْكُثُ فِي الأَرْضِ} [الرعد:17]
‘‘ফেনা খড়কুটোর মত উড়ে যায়, আর যা মানুষের জন্য উপকারী তা যমীনে স্থিতিশীল হয়।’ (আর-রা‘আদ : ১৩ : ১৭)
তারপর এ কারণের সূত্র ধরেই অস্তিত্ব লাভ করে অজস্র কারণ যা সেই ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও দৃঢ়তাকে আরও মজবুত করে তোলে।
২. মহিমান্বিত ও প্রাজ্ঞ পরিচালনা (قِيَادَةُ تَهْوِىْ إِلَيْهَا الْأَفْئِدَةُ):
এটা সর্বজনতবিদিত এবং সর্ববাদী সম্মত সত্য যে, নাবী কারীম (সাঃ) ছিলেন বিশেষ করে মুসলিম উম্মাহ এবং সাধারণভাবে বিশ্বমানবের জন্য মহিমান্বিত পরিচালক ও প্রাজ্ঞ পথপ্রদর্শক। দেহে, মন-মানসিকতায়, নেতৃত্বে, সৌজন্যে, সদাচারে তিনি ছিলেন সর্ব প্রজন্মের সকলের জন্য আদর্শ, অপরূপ দৈহিক সুষমা, আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতা, মহোত্তম চরিত্র, বিনম্র স্বভাব, উদার-উন্মুক্ত আচরণ, ন্যায়নিষ্ঠ কার্যকলাপ, অসাধারণ পান্ডিত্য বুদ্ধিমত্তা ও বাগ্মিতা সব কিছুর সমন্বয়ে তিনি ছিলেন এমন এক ব্যক্তিত্ব যাঁর সান্নিধ্য কিংবা সাহচর্যে মানুষ একবার এলে বার বার ফিরে ফিরে আসার জন্য আপনা থেকেই প্রলুব্ধ হতো এবং তাঁর (সাঃ) খেদমতে নিজেকে উৎসর্গ করে দেয়ার জন্য ব্যকুল হয়ে উঠল। তাঁর বিনয় নম্র আচরণ, সত্যবাদিতা, সহনশীলতা, সহমর্মিতা, আমানতদারী, পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি সদগুণাবলীর জন্য বন্ধু-বান্ধব দূরের কথা, শত্রুরাও তাঁকে শ্রদ্ধা না করে পারতেন না। তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল প্রশ্নাতীত। তাঁর শত্রুরাও তাঁর কোন উক্তি কিংবা অঙ্গীকারকে যে অবিশ্বাস্য বলে মনে করতে পারতেন না তার বহু প্রমাণ রয়েছে। এখানে কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করা হলঃ
এক দফা কুরাইশগণের এমন তিন ব্যক্তি একত্রিত হয় যারা পৃথক পৃথকভাবে একজন অন্যজনের অগোচরে কুরআন পাঠ শ্রবণ করেছিল। কিন্তু পরে তাদের প্রত্যেকের এ গোপন তথ্য প্রকাশ হয়ে পড়ে। সেই তিন জনের মধ্যে একজন ছিল আবূ জাহল। তিন জন যখন একত্রিত হল তখন একজন আবূ জাহলকে বলল, ‘তুমি মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নিকট যা শ্রবণ করেছ সে সম্পর্কে তোমার মতামত কী তা বল।’
আবূ জাহল বলল, ‘আমি কি আর এমন শুনেছি। প্রকৃত কথা হচ্ছে আমরা এবং বনু আবদে মানাফ মান-মর্যাদার ব্যাপারে একে অন্যের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আসছি। তারা যেমন গরীব-মিসকীনদের খানা খাওয়ায়, আমরাও তেমনি তাদের খানা খাওয়াই। তারা দান-খয়রাত করে, আমারও তা করি। তারা জনগণকে বাহন প্রদান করে আমরাও তা করি। এখন আমরা এবং তারা উভয় পক্ষই সর্বক্ষেত্রে একে অন্যের সমকক্ষ হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতারত দুটো ঘোড়ার ন্যায় উর্ধ্বশ্বাসে অবিরাম ছুটে চলেছি। এখন তারা নতুনভাবে বলতে শুরু করেছে যে, তাদের মাঝে একজন নাবী আছেন যাঁর নিকট আকাশ থেকে আল্লাহর বাণী অবতীর্ণ হয়। আচ্ছা, বলত আমরা তাহলে কিভাবে তাদের নাগাল পেতে পারি? আল্লাহর কসম! আমরা ঐ ব্যক্তির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করব না এবং তাঁকে কখনই সত্যবাদী বলনা না[1] যেমনটি আবূ জাহল বলত, হে মুহাম্মাদ (সাঃ)! আমরা তোমাকে ‘মিথ্যুক’ বলছিনা কিন্তু তুমি যা নিয়ে এসেছ তা মিথ্যা মনে করছি এবং এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত অবতীর্ণ করেন,
{فَإِنَّهُمْ لاَ يُكَذِّبُوْنَكَ وَلَكِنَّ الظَّالِمِيْنَ بِآيَاتِ اللهِ يَجْحَدُوْنَ} [الأنعام:33].
‘কেননা তারা তো তোমাকে মিথ্যে মনে করে না, প্রকৃতপক্ষে যালিমরা আল্লাহর আয়াতকেই প্রত্যাখ্যান করে।’ (আল-আন‘আম ৬ : ৩৩)
এ ঘটনা পূর্বে সবিস্তারে উল্লেখ করা হয়েছে যে, একদিন কাফেরগণ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে তিনবার অভিশাপ দেন। তৃতীয় দফায় নাবী কারীম (সাঃ) ইরশাদ করলেন,
(يَا مَعْشَرُ قُرَيْشٍ، جِئْتُكُمْ بِالذَّبْحِ)
‘‘হে কুরাইশগণ! আমি কুরবাণীর পশু নিয়ে তোমাদের নিকট আগমন করছি।’’
এ কথা তখন তাদের উপর এমনভাবে প্রভাব সৃষ্টি করল যে, যে ব্যক্তি শত্রুতায় সকলের চাইতে অগ্রগামী ছিল সে-ই সর্বোৎকৃষ্ট কথাবার্তা দ্বারা নাবী (সাঃ)-কে সন্তুষ্ট করতে সচেষ্ট হল।
অনুরূপভাবে একটি ঘটনারও বিস্তারিত বিবরণ ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। ঘটনাটি ছিল সিজদারত অবস্থায় যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপর নাড়িভূঁড়ি নিক্ষেপ করা হয় এবং তারপর মাথা উত্তোলন করেন তখন তিনি নিক্ষেপকারীর বিরুদ্ধে বদদোয়া করতে থাকেন তখন তারা একদম অস্থির হয়ে পড়েন। তাদের মধ্যে ভয়-ভীতি ও দুশ্চিন্তার ঢেউ প্রবাহিত হতে থাকে। তারা আর বাঁচতে পারবে না বলে তাদের মনে স্থির বিশ্বাসের সৃষ্টি হয়।
অন্য একটি ঘটনায় এটা উল্লেখিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন আবূ লাহাবের পুত্র উতায়বার বিরুদ্ধে বদ দু‘আ করলেন, তখন তার স্থির বিশ্বাস হয়ে গেল যে, সে নাবী কারীম (সাঃ)-এর বদ দু‘আ থেকে কিছুতেই মুক্তি পাবে না। যেমনটি শাম রাজ্য সফর অবস্থায় ব্যাঘ্র দেখেই বলেছিল, ‘আল্লাহর কসম! মুহাম্মাদ (সাঃ) মক্কা থেকেই আমাকে হত্যা করল।’
অন্য একটি ঘটনায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, উবাই বিন খালফ নাবী কারীম (সাঃ)-কে হত্যা করার জন্য বারবার হুমকি দিতেছিল। এক দফা নাবী কারীম (সাঃ) উত্তরে বললেন যে, ‘(তোমরা নয়) বরং আল্লাহ চানতো আমিই তোমাদের হত্যা করব, ইনশা-আল্লাহ।’ এর পর উহুদের যুদ্ধে নাবী কারীম (সাঃ) যখন উবাইয়ের গলদেশ বর্শার দ্বারা আঘাত করলেন, তখন যদিও সে আঘাত খুবই সামান্য ছিল তবুও উবাই বারবার এ কথাই বলছিল যে, ‘মুহাম্মাদ আমাকে মক্কায় বলেছিলেন যে, আমি তোমাকে হত্যা করব। কাজেই, সে যদি আমার গায়ে থুথুও দিত তাতেও আমার মৃত্যু হয়ে যেত।[2]
এমনভাবে এক দফা সা’দ বিন মা’আয মক্কায় উমাইয়া বিন খালফকে বলেছিল, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, মুসলিমগণ তোমাদের হত্যা করবে তখন থেকে উমাইয়া ভীষণভাবে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং ভয়-ভীতি তার অন্তরে সর্বক্ষণ বিরাজমান থাকে। তাই সে মনে মনে স্থির করেছিল যে, সে কখনই মক্কার বাইরে যাবে না। কিন্তু বদর যুদ্ধের সময় আবূ জাহলের পীড়াপীড়ি এবং চাপের মুখে বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য মক্কার বাইরে যেতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু প্রয়োজনবোধে যাতে দ্রুত পশ্চাদপসরণ সম্ভব হয় সে উদ্দেশ্যে সে মক্কার সব চাইতে দ্রুতগামী উটটি ক্রয় করে নিয়ে তার উপর সওয়ার হয়ে যুদ্ধে যায়।
এ দিকে যুদ্ধে যাবার প্রস্তুতি প্রত্যক্ষ করে তার স্ত্রীও তাকে এ ব’লে বাধা দেয় যে, ‘আবূ সাফওয়ান! আপনার ইয়াসরিবী ভাই যা বলেছিলেন আপনি কি তা ভুলে গেছেন?’ সে উত্তর দিল ‘না ভুলি নি, তবে আল্লাহর শপথ, তাদের সঙ্গে আমি অল্প দূরই যাব।[3]
এইত ছিল নাবী (সাঃ) শত্রুদের অবস্থা, অন্যদিকে তাঁর সাহাবীগণ (রাঃ), সঙ্গী-সাথী ও বন্ধু-বান্ধবগণের সকলের কাছে তিনি ছিলেন প্রাণের চাইতেও প্রিয়। তিনি ছিলেন সকলের চিন্তা-চেতনা ও অন্তরের চিকিৎসক। তাঁদের অন্তর থেকে উৎসারিত ভক্তি ও ভালবাসার ধারা ঠিক সেভাবে নাবী (সাঃ)-এর দিকে প্রবাহিত হতো যেমনটি জলের ধারা উচ্চ থেকে নিম্নভূমির দিকে প্রবলবেগে প্রবাহিত হতে থাকে এবং তাঁদের সকলের প্রাণ ঠিক সেইভাবে নাবী (সাঃ)-এর প্রাণের দিকে আকর্ষিত হতে থাকত, যেমনটি সাধারণ লৌহখন্ড আকর্ষিত হতে থাকে চুম্বুক লৌহের আকর্ষণে।
فصورته هيولى كل جسم ** ومغناطيس أفئـدة الرجــال
অর্থঃ ‘মুহাম্মাদের ছবি প্রতিটি মানবদেহের জন্য মূল অস্তিত্ব স্বরূপ ছিল এবং তাঁর বাস্তব অস্তিত্ব প্রতিটি অন্তরের জন্য চুম্বকের মতো ছিল।’
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)’র জন্য সাহাবীগণ (রাঃ)-এর অন্তরে প্রেম, প্রীতি, শ্রদ্ধা, ভক্তি ও ভালবাসার যে বেহেশতী ধারা সর্বক্ষণ প্রবাহিত হতো, অখন্ড মানব জাতির ইতিহাসে কোথাও তার কোন তুলনা মেলে না। সাহাবীগণ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্য কখনো কোন ত্যাগ স্বীকারকেই বড় বলে মনে করতেন না। এমন কি এ কথাও পছন্দ করতেন না যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নখে সামান্যতম আঘাত লাগুক অথবা তাঁর পায়ে কাঁটার আঁচড় লাগুক। তাঁর জন্য তাঁদের নিজেদের জীবন পর্যন্ত ত্যাগ করতে তাঁরা সর্বক্ষণ প্রস্তুত থাকতেন।
একদিন আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ) অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে প্রহৃত হলেন। উতবাহ বিন রাবীআহ তাঁর নিকটে এসে তালিযুক্ত জুতো দ্বারা প্রহার করতে লাগল। বিশেষ করে চেহারা লক্ষ করে মারতে মারতে তাঁর পিঠের উপর চড়ে বসল। এ অবস্থায় তাঁর গোত্র বনু তাইমের লোকজন তাঁকে কাপড়ে জড়িয়ে বাড়ি আনে। তাদের বিশ্বাস ছিল যে, তিনি আর বাঁচবেন না। কিন্তু দিনের শেষ ভাগে তাঁর কথা বের হল। আর সব কিছুর আগে প্রশ্ন করলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর অবস্থা কী? এর জন্য বনু তাইমের লোকেরা তাঁকে বকাঝকা করল। তাঁর মা উম্মুল খায়েরকে এ কথা বলে তারা ফিরে গেল যে, তাঁকে কিছু পানাহার করাবে। একেবারে একাকী অবস্থায় তিনি আবূ বাকর (রাঃ)-কে কিছু পানাহারের জন্য অনুরোধ করলেন। কিন্তু তিনি এ কথাই বলতে থাকলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কী অবস্থায়?’ পরিশেষে উম্মুল খায়ের বললেন, ‘আমি তোমার সাথীর সংবাদ জানি না।’ আবূ বাকর (রাঃ) বললেন, ‘উম্মু জামীল বিনতে খাত্তাবের নিকট যাও এবং তাকে জিজ্ঞেস করো।’ তিনি উম্মু জামীলের নিকটে গিয়ে বললেন, ‘আবূ বাকর (রাঃ), তোমার নিকট মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ (সাঃ) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে। উম্মু জামিল বললেন, আমি না চিনি মুহাম্মাদ সাঃ-কে আর না চিনি আবূ বাকর (রাঃ)-কে। তবে তুমি যদি চাও তাহলে তোমার সাথে তোমার পুত্রের নিকট যেতে পারি।’
উম্মুল খায়ের বললেন, ‘খু-উ-ব ভালো’’।
এরপর উম্মু জামীল তার সঙ্গে এসে দেখলেন আবূ বাকর (রাঃ) চরম শ্রান্ত, ক্লান্ত এবং বিপর্যস্ত অবস্থান পড়ে রয়েছেন। তারপর তাঁর নিকটবর্তী হয়ে চিৎকার করে বললেন, ‘যারা আপনাকে এই দুরবস্থার মধ্যে নিপতিত করেছে তারা অবশ্যই জঘন্য প্রকৃতির লোক এবং অমানুষ কাফের। আমি আশা করি যে, আল্লাহ আপনার এ অন্যায়ের প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন।
আবূ বাকর (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কী হয়েছে?
তিনি বললেন, ‘আপনার মা তো শুনছেন’’।
বললেন, ‘কোন অসুবিধা নেই’
তিনি বললেন, ‘সহীহুল সালামতে আছেন।’
‘‘কোথায় আছেন তিনি?’
‘‘ইবনে আরকামের বাড়িতে।’
আবূ বাকর (রাঃ) বললেন, ‘যতক্ষণ আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দরবারে উপস্থিত না হব ততক্ষণ আমি খাদ্য কিংবা পানীয় কোন কিছুই গ্রহণ করব না। এটাই হচ্ছে আল্লাহর জন্য আমার অঙ্গীকার।’
তারপর উম্মুল খায়ের এবং উম্মু জামীল সেখানেই অবস্থান করলেন। লোকদের আগমন এবং প্রত্যাগমন বন্ধ হয়ে যাবার পর যখন নিস্তব্ধতা বিরাজ করতে থাকল তখন মহিলাদ্বয় আবূ বাকর (রাঃ)-কে সঙ্গে নিয়ে বাহির হলেন। তিনি তাদের উপর ভর দিয়ে চলতে থাকলেন এবং এভাবে তাঁরা তাঁকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর খেদমতে পৌঁছে দিলেন।[4]
নাবী (সাঃ)-এর জন্য শ্রদ্ধা, মহববত, উৎসর্গীকরণ ও ত্যাগ তিতিক্ষার বিরল ঘটনাবলী এ গ্রন্থের বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্ন প্রসঙ্গে বর্ণিত হবে। বিশেষ করে উহুদ যুদ্ধের ঘটনাবলী এবং খুবায়েবের প্রসঙ্গে সেগুলো বিশেষভাবে উল্লেখ করা হবে।
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৩১৬ পৃঃ।
[2] ইবনে হিশাম ২য় খন্ড ৮৪ পৃঃ।
[3] সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৫৬৩ পৃঃ।
[4] আলবেদায়া ওয়ান্নেহাযা ৩য় খন্ড ৩০ পৃঃ।
৩. দায়িত্ববোধের অনুভূতি (الشُّعُوْرُ بِالْمَسْئُوْلَيَّةِ):
সাহাবীগণ (রাঃ) এটা সুস্পষ্টভাবে অবগত ছিলেন যে, এ একমুষ্টি মাটি যাকে ‘মানুষ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে আল্লাহর তরফ থেকে তার উপর যে বিশাল এবং দুর্বহ দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে কোন অবস্থাতেই তা থেকে বিমুখ হওয়া কিংবা তাকে এড়িয়ে চলা সম্ভব নয়। কারণ, দায়িত্ববিমুখ হলে কিংবা দায়-দায়িত্ব এড়িয়ে গেলে তার ফল যা হবে তা কাফির মুশরিকগণের অন্যায়, অত্যাচার এবং নির্যাতন নিপীড়নের তুলনায় সাত সহস্র গুণ বেশী ভয়াবহ এবং বিধ্বংসকারী হবে। অধিকাংশ কর্তব্যবিমুখ হলে কিংবা কর্তব্য এড়িয়ে গেলে নিজের এবং সমগ্র মানবতার যে ক্ষতি হবে এবং এমন সব সমস্যার উদ্ভব হবে যার তুলনায় এ সব দুঃখ কষ্ট এবং ক্ষয়ক্ষতি তেমন কিছুই নয়।
ফুটনোটঃ
৪. পরকালীন জীবনে বিশ্বাস (الإِيْمَـانُ بِالْآخـِرَةِ):
আল্লাহর জমীনে দ্বীন কায়েম করার ব্যাপারে আল্লাহর তরফ থেকে মানুষের উপর যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তৎসম্পর্কিত বোধকে শক্তিশালী এবং কর্মমুখী করার অন্যতম শক্তিশালী মাধ্যম হচ্ছে পরকালীন জীবনে বিশ্বাস। সাহাব কিরাম (রাঃ) এ কথার উপর অটল বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন যে, পরকালীন জীবনে বিচার দিবসে তাদিগকে অবশ্যই রাববুল আলামীনের নিকট নিজেদের কার্যকলাপের সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ হিসাব দিতে হবে। পুণ্যবানগণ অনন্ত সুখশান্তির চিরস্থায়ী আবাস জান্নাতে চিরকাল মহাসুখে বসবাস করতে থাকবেন। পক্ষান্তরে, পাপীতাপীগণ দুঃখ কষ্ট ও যন্ত্রণার আবাসস্থল জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হয়ে অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা ভোগ করতে থাকবে। তাই তারা সর্বক্ষণ কল্যাণমুখী কাজকর্মে লিপ্ত থাকার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি তথা জান্নাত লাভের আশায় উন্মুখ হয়ে থাকতেন। অন্যদিকে তেমনি মহান আল্লাহর অসন্তুষ্টি জাহান্নামের আযাবের ভয়ে অস্থির হয়ে থাকতেন। যেমনটি নিম্নোক্ত আয়াতে কারীমায় বর্ণিত হয়েছে।
{يُؤْتُوْنَ مَا آتَوْا وَّقُلُوْبُهُمْ وَجِلَةٌ أَنَّهُمْ إِلٰى رَبِّهِمْ رَاجِعُوْنَ} [المؤمنون:60]
‘‘যারা তাদের দানের বস্তু দান করে আর তাদের অন্তর ভীত শংকিত থাকে এ জন্যে যে, তাদেরকে তাদের প্রতিপালকের কাছে ফিরে যেতে হবে।’ (আল-মু’মিনূন ২৩ : ৬০)
এ বিষয়েও তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ, বিত্তবৈভব ও ভোগবিলাস, পরলৌকিক জীবনের সে সবের তুলনায় মশার একটি পাখার সমতুল্যও নয়। তাঁদের এ বিশ্বাস এতই দৃঢ়মূল ছিল যে, এর সামনে পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যা দুঃখ কষ্ট জুলম নির্যাতন সব ছিল অত্যন্ত তুচ্ছ ব্যাপার। কাজেই জুলম নির্যাতনের মাত্রা যতই বৃদ্ধি পেয়েছে তাঁদের ইয়াকীন (বিশ্বাস) এবং সহনশীলতাও ততোধিক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে যা কাফির মুশরিক বিরোধীপক্ষকে হতভম্ব ও হতবাক করে দিয়েছে।
ফুটনোটঃ
৫. (আল-কুরআন (القـــرآن):
কাফির মুশরিকসৃষ্ট ভয়ঙ্কর বিপদ আপদ ও ঘোর সামাজিক অনাচার এবং অবক্ষয় জনিত অন্ধকারাচ্ছন্ন অবস্থায় এমন সব সূরাহ ও আয়াতসমূহ অবতীর্ণ হয়েছিল যার মধ্যে নিবিড় অথচ আকর্ষণীয় পদ্ধতিতে ইসলামের মৌলিক নিয়মকানুনের উপর প্রমাণাদি ও দালায়েল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। সেই সময় উল্লেখিত নিয়ম কানুনের পাশাপাশি দাওয়াত এবং তাবলীগের কাজও পূর্ণোদ্যমে চলছিল। এ আয়াত সমূহে ইসলামের অনুসারীগণকে এমন সব মৌলিক কাজ কর্ম করতে বলা হচ্ছিল যার উপর ভিত্তি করে আল্লাহ তা‘আলা মানবগোষ্ঠির সবচাইতে উন্নত সমাজ অর্থাৎ ইসলামী সমাজের নির্মাণ ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সংক্রান্ত প্রশিক্ষণের ইঙ্গিত দিয়েছেন। উল্লেখিত আয়াতসমূহের মাধ্যমে মুসলিমগণের আবেগ ও অনুভূতিকে স্থায়িত্ব ও দৃঢ়তা দান কল্পে করা হচ্ছিল। আয়াতে কারীমাঃ
{أَمْ حَسِبْتُمْ أَن تَدْخُلُوْا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَأْتِكُم مَّثَلُ الَّذِيْنَ خَلَوْاْ مِن قَبْلِكُم مَّسَّتْهُمُ الْبَأْسَاء وَالضَّرَّاء وَزُلْزِلُوْا حَتّٰى يَقُوْلَ الرَّسُوْلُ وَالَّذِيْنَ آمَنُوْا مَعَهُ مَتَى نَصْرُ اللهِ أَلا إِنَّ نَصْرَ اللهِ قَرِيْبٌ} [البقرة:214]
‘‘তোমরা কি এমন ধারণা পোষণ কর যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ লাভ করবে, অথচ এখনও পর্যন্ত তোমাদের আগের লোকেদের মত অবস্থা তোমাদের সামনে আসেনি? তাদেরকে অভাবের তীব্র তাড়না এবং মসীবত স্পর্শ করেছিল এবং তারা এতদূর বিকম্পিত হয়েছিল যে, নাবী ও তার সঙ্গের মু’মিনগণ চিৎকার করে বলেছিল- আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে? জেনে রেখ, নিশ্চয়ই আল্লাহর সাহায্য নিকটবর্তী।’ (আল-বাক্বারাহ ২ : ২১৪)
{الم أَحَسِبَ النَّاسُ أَن يُتْرَكُوْا أَن يَقُوْلُوْا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُوْنَ وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِيْنَ مِن قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللهُ الَّذِيْنَ صَدَقُوْا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِيْنَ} [العنكبوت:1- 3]
‘আলিফ-লাম-মীম। লোকেরা কি মনে করে যে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’ বললেই তাদেরকে অব্যাহতি দিয়ে দেয়া হবে, আর তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না? তাদের পূর্বে যারা ছিল আমি তাদেরকে পরীক্ষা করেছিলাম; তারপর আল্লাহ অবশ্য অবশ্যই জেনে নেবেন কারা সত্যবাদী আর কারা মিথ্যেবাদী।’ [আল-‘আনকাবূত (২৯) : ১-৩]
আর তাদেরই পাশে পাশে এমনও আয়াতসমূহ অবতীর্ণ হচ্ছিল যার মধ্যে কাফির ও বিরুদ্ধাচরণকারীদের প্রশ্নের দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়া হয়েছে। তাদের জন্য কোন প্রকার সুযোগ সুবিধার অবকাশই দেয়া হয় নি। অধিকন্তু, তাদেরকে অত্যন্ত সহজ এবং সুস্পষ্টভাবে এটা বলে দেয়া হয়েছে যে, যদি কেউ আপন ভ্রষ্টতা ও অবাধ্যতায় একগুঁয়েমী ভাব পোষণ করে থাকে তাহলে এর পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। এর প্রমাণ স্বরূপ বিগত জাতিগুলোর এমন সব ঘটনা এবং ঐতিহাসিক সাক্ষ্য প্রমাণাদি উপস্থাপন করা হয়েছে যদ্দ্বারা এটা সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, নিজের বন্ধু এবং শত্রুদের ক্ষেত্রে আল্লাহর রীতিনীতি এবং ব্যবস্থাদি কি রয়েছে? তারপর ভয় প্রদর্শনের পাশাপাশি করুণা এবং অনুগ্রহের কথাও বলা হয়েছে। তাছাড়া উপদেশ প্রদান ও গ্রহণ এবং আদেশ ও পথ প্রদর্শনের দায়িত্বও আদায় করা হয়েছে যেন প্রকাশ্য ভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত ব্যক্তিগণ বিরত হতে চাইলে বিরত হতে পারে।
প্রকৃতই কুরআন মাজীদ মুসলিমগণকে অন্য এক জগতে পরিভ্রমণে রত রেখেছিল এবং তাদিগকে সৃষ্টির বিভিন্ন দৃশ্যপট, প্রভূত্বের পরিপাট্য, লিল্লাহিয়াতের চরমোৎকর্ষ এবং অনুকম্পা অনুগ্রহ, দয়াদাক্ষিণ্য, সন্তুষ্টি ইত্যাদি সম্পর্কিত এমন সব দ্বীপ্তিময় দৃশ্য প্রদর্শন করা হচ্ছিল যে, সেগুলোর আকর্ষণ ও মোহের সামনে কোন প্রতিবন্ধকতাই টিকে থাকতে পারে নি।
উপরন্তু, সে সকল আয়াতে মুসলিমগণকে যে সব সম্বোধন করা হচ্ছিল তা হলো-
يُبَشِّرُهُمْ رَبُّهُمْ بِرَحْمَةٍ مِنْهُ وَرِضْوَانٍ وَجَنَّاتٍ لَهُمْ فِيهَا نَعِيمٌ مُقِيمٌ
“তাদের প্রতিপালক তাদেরকে সুসংবাদ দিচ্ছেন তাঁর দয়া ও সন্তুষ্টির, আর জান্নাতের যেখানে তাদের জন্য আছে স্থায়ী সুখ-সামগ্রী”। (তাওবাহ : ২১ আয়াত)
তার মধ্যে এমনও আয়াত রয়েছে যাতে সীমালংঘনকারী কাফিরদের বিরোধীতার পরিণতির চিত্র অংকন করা হয়েছে-আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَوْمَ يُسْحَبُونَ فِي النَّارِ عَلَىٰ وُجُوهِهِمْ ذُوقُوا مَسَّ سَقَرَ
“যেদিন তাদেরকে মুখের ভরে আগুনের মধ্যে হিঁচড়ে টেনে আনা হবে (তখন বলা হবে) ‘জাহান্নামের স্পর্শ আস্বাদন কর”। (ক্বামার : ৪৮ আয়াত)
ফুটনোটঃ
৬. সফলতার শুভসংবাদ (البشارات بالنجاح):
উপর্যুক্ত বিষয়গুলো ছাড়াও মুসলিমগণ নিপীড়িত নির্যাতিত হওয়ার পূর্ব থেকে বরং বলা যায় যে, বহু পূর্ব থেকেই অবহিত ছিলেন যে, ইসলাম গ্রহণ করার অর্থ স্থায়ী বিবাদে জড়িয়ে পড়া কিংবা বিবাদ-বিসম্বাদের কারণে ক্ষয়-ক্ষতির শিকারে পরিণত হওয়া নয়, বরং এর প্রকৃত অর্থ ও উদ্দেশ্য হচ্ছে ইসলামী দাওয়াত পেশ করার প্রথম দিন থেকেই অজ্ঞদের অজ্ঞতা এবং তাদের অনুসৃত যাবতীয় ভ্রান্ত পথ ও পদ্ধতির অবসান কল্পে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের নির্দেশিত পথে অচল অটল থাকা। এ দাওয়াতের আরও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হচ্ছে পৃথিবীর রাজনৈতিক অঙ্গণে ইসলামী ভাবধারা ও ইসলামী বিধি-বিধানের বিস্তরণে বিশ্ব রাজনীতিকে এমনভাবে প্রভাবিত করা যাতে বিশ্বের জাতিসমূহকে আল্লাহর রেযামন্দি বা সন্তুষ্টির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে বান্দার দাসত্ব থেকে মুক্ত করে আল্লাহর দাসত্বে প্রতিষ্ঠিত করা।
কুরআন মাজীদে এ শুভ সংবাদ কখনো আকার ইঙ্গিতে কখনো বা সুস্পষ্ট ভাষায় নাজিল করা হয়েছে। অথচ গোটা পৃথিবীর উপর মুসলিমগণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আভাষ ইঙ্গিত সত্ত্বেও মনে হচ্ছিল তারা যেন নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। মুসলিমগণ যখন এমন এক অবস্থায় নৈরাশ্যের অন্ধকারে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন তখন অন্য দিকে আবার এমন সব আয়াত অবতীর্ণ হচ্ছিল যার মধ্যে বিগত নাবীগণের ঘটনাবলী এবং তাঁদের মিথ্যাপ্রতিপন্ন কারীগণের বিস্তারিত বিবরণের উল্লেখ ছিল। সে সব আয়াতে যে চিত্র অংকণ করা হচ্ছিল তার সঙ্গে মক্কার মুসলিম ও কাফিরগণের অবস্থার হুবহু সাদৃশ্য ছিল। এ সকল ঘটনা বর্ণনার মাধ্যমে এ ইঙ্গিতও প্রদান করা হচ্ছিল যে, সেই সকল অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অন্যায়-অত্যাচারীগণ কিভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল এবং আল্লাহর সৎ বান্দাগণ কিভাবে পৃথিবীর উত্তরাধিকার প্রাপ্ত হয়েছিলেন।
বিভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষাপটে অবতীর্ণ আয়াতসমূহের মধ্যে এমন আয়াতও অবতীর্ণ হয়েছিল যার মধ্যে মুসলিমগণের বিজয়ী হওয়ার শুভ সংবাদ বিদ্যমান ছিল। যেমনটি কুরআন কারীমে ইরশাদ হয়েছে,
{وَلَقَدْ سَبَقَتْ كَلِمَتُنَا لِعِبَادِنَا الْمُرْسَلِيْنَ إِنَّهُمْ لَهُمُ الْمَنصُوْرُوْنَ وَإِنَّ جُندَنَا لَهُمُ الْغَالِبُوْنَ فَتَوَلَّ عَنْهُمْ حَتّٰى حِيْنٍ وَأَبْصِرْهُمْ فَسَوْفَ يُبْصِرُوْنَ أَفَبِعَذَابِنَا يَسْتَعْجِلُوْنَ فَإِذَا نَزَلَ بِسَاحَتِهِمْ فَسَاء صَبَاحُالْمُنذَرِيْنَ} [الصافات:171: 177]
‘আমার প্রেরিত বান্দাহদের সম্পর্কে আমার এ কথা আগেই বলা আছে যে, তাদেরকে অবশ্যই সাহায্য করা হবে। আর আমার সৈন্যরাই বিজয়ী হবে। কাজেই কিছু সময়ের জন্য তুমি তাদেরকে উপেক্ষা কর। আর তাদেরকে দেখতে থাক, তারা শীঘ্রই দেখতে পাবে (ঈমান ও কুফুরীর পরিণাম)। তারা কি আমার শাস্তি তরান্বিত করতে চায়? শাস্তি যখন তাদের উঠানে নেমে আসবে, তখন কতই না মন্দ হবে ঐ লোকেদের সকালটি যাদেরকে সতর্ক করা হয়েছিল!।’ [আস-স-ফফাত (৩৭) : ১৭১-১৭৭]
{سَيُهْزَمُ الْجَمْعُ وَيُوَلُّوْنَ الدُّبُرَ} [القمر:45]
‘এ সংঘবদ্ধ দল শীঘ্রই পরাজিত হবে আর পিছন ফিরে পালাবে।’ (আল-ক্বামার ৫৪ : ৪৫)
{جُندٌ مَّا هُنَالِكَ مَهْزُوْمٌ مِّنَ الأَحْزَابِ} [ص:11]
‘(আরবের কাফিরদের) সম্মিলিত বাহিনীর এই দলটি এখানেই (অর্থাৎ এই মাক্কাহ নগরীতেই একদিন) পরাজিত হবে।’ [স-দ (৩৮): ১১]
যারা হাবাশায় হিজরত করেছিলেন তাদের সম্পর্কে অবতীর্ণ হলো :
{وَالَّذِيْنَ هَاجَرُوْا فِي اللهِ مِن بَعْدِ مَا ظُلِمُوْا لَنُبَوِّئَنَّهُمْ فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَلَأَجْرُ الآخِرَةِ أَكْبَرُ لَوْ كَانُوْا يَعْلَمُوْنَ} [النحل:41]
‘যারা অত্যাচারিত হওয়ার পরও আল্লাহর পথে হিজরাত করেছে, আমি তাদেরকে অবশ্য অবশ্যই এ দুনিয়াতে উত্তম আবাস দান করব, আর আখিরাতের পুরস্কার তো অবশ্যই সবচেয়ে বড়। হায়, তারা যদি জানত!’ [আন-নাহল (১৬): ৪১]
এভাবে কাফিরগণ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট ইউসুফ (আঃ)-এর ঘটনা জিজ্ঞেস করল, তার উত্তরে আনুষঙ্গিক আয়াতে কারীমা অবতীর্ণ হলঃ
{لَّقَدْ كَانَ فِيْ يُوْسُفَ وَإِخْوَتِهِ آيَاتٌ لِّلسَّائِلِيْنَ} [يوسف:7]
‘‘ ইউসুফ আর তার ভাইদের ঘটনায় সত্য সন্ধানীদের জন্য অবশ্যই নিদর্শন আছে।’ (ইউসুফ ১২ : ৭)
অর্থাৎ মক্কাবাসী মুশরিকগণ আজ ইউসুফ (আঃ)-এর যে ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছে এরা নিজেরাও অনুরূপভাবে অকৃতকার্য হবে যেমন ইউসুফ (আঃ)-এর ভাইগণ অকৃতকার্য হয়েছিল এবং তাদেরও রক্ষণাবেক্ষণের অবস্থা তাই হবে যা তাদের ভাইগণের হয়েছিল। তাদের ইউসুফ (আঃ) এবং তাঁর ভাইদের ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা একান্ত উচিত যে, অত্যাচারীদের হার কিভাবে হয়।
পয়গম্বরের কথা উল্লেখ করে কুরআন কারীমে ইরশাদ হয়েছে,
{وَقَالَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا لِرُسُلِهِمْ لَنُخْرِجَنَّـكُم مِّنْ أَرْضِنَآ أَوْ لَتَعُوْدُنَّ فِيْ مِلَّتِنَا فَأَوْحٰى إِلَيْهِمْ رَبُّهُمْ لَنُهْلِكَنَّ الظَّالِمِيْنَ وَلَنُسْكِنَنَّـكُمُ الأَرْضَ مِن بَعْدِهِمْ ذٰلِكَ لِمَنْ خَافَ مَقَامِيْ وَخَافَ وَعِيْدِ} [إبراهيم:13، 14].
‘কাফিরগণ তাদের রসূলদের বলেছিল, ‘আমরা তোমাদেরকে আমাদের দেশ থেকে অবশ্য অবশ্যই বের করে দেব, অন্যথায় তোমাদেরকে অবশ্য অবশ্যই আমাদের ধর্মমতে ফিরে আসতে হবে। এ অবস্থায় রসূলদের প্রতি তাদের প্রতিপালক এ মর্মে ওয়াহী করলেন যে, ‘আমি যালিমদেরকে অবশ্য অবশ্যই ধ্বংস করব। আর তাদের পরে তোমাদেরকে অবশ্য অবশ্যই যমীনে পুনর্বাসিত করব। এ (শুভ) সংবাদ তাদের জন্য যারা আমার সামনে এসে দাঁড়ানোর ব্যাপারে ভয় রাখে আর আমার শাস্তির ভয় দেখানোতে শংকিত হয়।’ [ইবরাহীম (১৪) : ১৩-১৪]
অনুরূপভাবে যে সময় পারস্য এবং রোমে যুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠল তখন মক্কার কাফেরগণ চাইল যে পারসিকরা জয়ী হোক, কেননা তারাও ছিল কাফের। আর মুসলিমগণ চাইল যে রোমীয়গণ জয়ী হোক, কারণ আর যা হোক না কেন, রোমীয়গণ আল্লাহর উপর, পয়গম্বর, ওহী, আসমানী কিতাবসমূহ এবং বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাস করার দাবীদার ছিলেন। কিন্তু পারস্যবাসীগণ যখণ জয়লাভের পথে অনেকটা অগ্রসর হল তখন আল্লাহ তা‘আলা এ শুভ সংবাদকে যথেষ্ট মনে না করে তার পাশাপাশি এ শুভ সংবাদটিও প্রদান করেন যে, রোমীয়গণের বিজয়ী হওয়ার প্রাক্কালে আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমগণকে বিশেষ সাহায্য প্রদান করবেন যাতে তারা সন্তোষ লাভ করবে। যেমনটি ইরশাদ হয়েছে,
{وَيَوْمَئِذٍ يَفْرَحُ الْمُؤْمِنُوْنَ بِنَصْرِ الله } [الروم: 4، 5]
‘সেদিন মু’মিনরা আনন্দ করবে। (সে বিজয় অর্জিত হবে) আল্লাহর সাহায্যে।’ [আর-রূম (৩০) : ৪-৫]
পরবর্তী পর্যায়ে আল্লাহ তা‘আলার এ সাহায্যই বদর যুদ্ধে অর্জিত মহা সাফল্য এবং বিজয়ের মধ্য দিয়ে রূপ লাভ করে। অধিকন্তু রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজেও অনুরূপ শুভ সংবাদ পরিবেশন করে মুসলিমগণকে উৎসাহিত করতেন। যেমন হজ্জের জনগণের মধ্যে প্রচারের জন্য গমন করতেন তখন শুধুমাত্র জান্নাতেরই শুভসংবাদ দিতেন না বরং পরিস্কার ভাষায় ঘোষণাও করতেন,
(يَأَيُّهَا النَّاسُ، قُوْلُوْا: لاَ إِلٰهَ إِلاَّ اللهُ تُفْلِحُوْا، وَتَمْلِكُوْا بِهَا الْعَرَبَ، وَتَدِيْنُ لَكُمْ بِهَا الْعَجَمُ، فَإِذَا مِتُّمْ كُنْتُمْ مُلُوْكًا فِيْ الْجَنَّةِ)
অর্থঃ ‘ওগো জনগণ! কালিমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পাঠ করো তাহলে সফলকাম হবে এবং এর ফলে আরবের সম্রাট হতে পারবে ও আজম তোমাদের অধীনস্থ হয়ে যাবে। আবার তোমরা যখন মৃত্যুর পরে জান্নাতে প্রবেশ করবে তখনো তোমরা সেখানে উচ্চ মর্যাদা ও প্রাধান্য লাভ করবে।[1]
এ ঘটনা ইতোপূর্বে বর্ণিত হয়েছে। ব্যাপারটি হচ্ছে যখন উতবাহ বিন রাবী’আহ নাবী (সাঃ)-এর নিকট পার্থিব জগতের পণ্য দ্রব্যের প্রস্তাব দিয়ে বিনিময় বা লেনদেন করতে চাইল এবং তদুত্তরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হামীম সিজদার আয়াতসমূহ পাঠ করে শোনালেন তখন উতবাহর এ বিশ্বাস হয়ে গেল যে, শেষ পর্যন্ত মুহাম্মাদ (সাঃ)-ই জয়ী হবেন।
অনুরূপভাবে আবূ ত্বালিবের নিকট আগমনকারী কুরাইশগণের শেষ প্রতিনিধিদের সাথে নাবী (সাঃ)-এর যে কথোপকথন হয়েছিল তারও বিস্তারিত বিবরণ ইতোপূর্বে দেয়া হয়েছে। সে সময়ও নাবী কারীম (সাঃ) মুশরিকগণকে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন যে, তারা যদি তাঁর শুধু একটি কথা মেনে নেয় তাহলে গোটা আরবজাহানে তাদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। এবং আজম তাদের অধীনস্থ হয়ে যাবে।
খাব্বাব বিন আরাত বলেছেন যে, ‘এক দফা আমি নাবী কারীম (সাঃ)-এর খেদমতে হাযির ছিলাম। তিনি ক্বাবা’হ ঘরের ছায়ায় একটি চাদরকে বালিশ করে শুয়েছিলেন। সে সময় আমরা মুশরিকগণণের হাতে দারুণভাবে নির্যাতিত হচ্ছিলাম। আমি বললাম, আল্লাহর সমীপে প্রার্থনা করছেন না কেন? এ কথা শ্রবণ করে নাবী কারীম (সাঃ)-এর মুখমন্ডল রক্তবর্ণ ধারণ করল। তিনি উষ্মার সঙ্গে বললেন,
(لَقَدْ كَانَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَيَمْشُطُ بِمُشَاطِ الْحَدِيْدِ مَا دُوْنَ عِظَامِهِ مِنْ لَحْمٍ وَعَصَبَ مَا يَصْرِفُهُ ذٰلِكَ عَنْ دِيْنِهِ،
‘‘যাঁরা তোমাদের পূর্বে গত হয়ে গেছেন তাঁদের শরীরের হাড়ে মাংস পর্যন্ত ছিল না। যাঁদের শরীরে মাংস ছিল তাঁদের মাংসপেশীতে লোহার চিরুনী দ্বারা আঁচড়ানো হতো। কিন্তু নির্যাতিত এবং নিপীড়িত হয়েও তাঁরা কোনদিন ধৈর্যচ্যুত হন নাই।
তারপর তিনি বললেন,
وَلَيَتَمَنَّ اللهُ هٰذَا الْأَمْرَ حَتّٰى يَسِيْرُ الرَّاكِبُ مِنْ صَنْعَاءَ إِلٰى حَضْرَمَوْتَ مَا يَخَافُ إِلَّا اللهُ ـ زاد بيان الراوى ـ وَالذِّئْبُ عَلٰى غَنَمِهِ)
‘আল্লাহ এ বিষয়কে অর্থাৎ দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দেবেন ইনশা-আল্লাহ। এমনকি সানআ হতে হাজারা মাওত পর্যন্ত একজন আরোহীর যাতায়াত কালে আল্লাহ ছাড়া কারোই ভয় থাকবে না। তবে ছাগলের জন্য বাঘের ভয় থাকবে।[2] অন্য এক বর্ণনায় এটাও আছে যে, (وَلٰكِنَّكُمْ تَسْتَعْجِلُوْنَ) কিন্তু তোমরা তাড়াহুড়ো করছ।[3]
এটা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য যে, এ শুভ সংবাদের কোন কিছুই গোপন ছিল না। মুসলিমগণের মতো কাফিরগণও এ সব ব্যাপারে সুবিদিত ছিল। তাদের এ সব কিছু অবগতির কারণে যখন আসওয়াদ বিন মুত্তালিব এবং তার বন্ধুগণ সাহাবীগণ (রাঃ)-কে দেখতে পেত তখন বিদ্রূপ করে একজন অপরজনকে বলত, ‘দেখ দেখ ঐ যে, পৃথিবীর সম্রাট এসে গেছে, এরা শীঘ্রই কায়সার ও কিসরা বাদশাহকে পরাজিত করবে। এ সব কথা বলে তারা করতালি দিত এবং মুখে বিদ্রূপাত্মক শিস্ দিত।[4]
সে সময় সাহাবীগণের (রাঃ) বিরুদ্ধে অন্যায় অত্যাচার, উৎপীড়ন নিপীড়ন, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা সবকিছুর ব্যাপ্তি এবং মাত্রা উভয় দিক দিয়েই চরমে পৌঁছেছিল কিন্তু তা সত্ত্বেও জান্নাত লাভের নিশ্চিত আশা, ভরসা এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের শুভসংবাদ ঝড়ো হাওয়ার ঝাপটায় নিক্ষিপ্ত ও বিতাড়িত মেঘমালার মতো মুসলিমগণের মানস আকাশ থেকে যাবতীয় দুঃখ বিপদকে বিদূরিত করে দিত।
এ ছাড়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মুসলিমগণের ঈমানী তালীমের মাধ্যমে অবিরামভাবে আধ্যাত্মিক খোরাক যোগাতেন, কিতাব ও হিকমতের শিক্ষা দিয়ে আত্মার পরিশুদ্ধির ব্যবস্থা করতেন এবং অত্যন্ত সূক্ষ্ণ ও সময়োচিত উপদেশ ও নির্দ্দেশনা প্রদান করতেন। তাছাড়া আত্মসম্মানবোধ, দৈহিক ও মানসিক পরিচ্ছন্নতা, চরিত্র মাধুর্য ও চারিত্রিক পবিত্রতা, সহিষ্ণুতা, সংযম, সত্য ও ন্যায়ের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা, অসত্য, অন্যায় ও অবিচারের প্রতি ঘৃণা ও আপোষহীন সংগ্রাম ইত্যাদি গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে সাহাবীগণ (রাঃ)-কে এমনভাবে তৈরি করে নিয়েছিলেন যেন, তাঁরা প্রয়োজনের মুহূর্তে এক একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠতে পারেন।
সর্বোপরি অজ্ঞানের অন্ধকার থেকে বাহির করে হেদায়েতের আলোকজ্জ্বল প্রান্তরে এনে যখন তিনি সাঃ তাঁদেরকে দাঁড় করিয়ে দিলেন তখন তাঁদের পূর্বের জীবন ও নতুন জীবনের মধ্যে রাতের অন্ধকার ও দিনের আলোর মতই পার্থক্য সূচিত হয়ে গেল। তাঁদের অন্তর্দৃষ্টির সামনে প্রতিভাত হয়ে উঠল স্রষ্টার অনন্ত মহিমা ও সৃষ্টি দর্শন, সীমাহীন বিশ্বের অন্তহীন বিস্তার ও বৈচিত্র, মানবজীবনের অনন্ত সম্ভাবনা পথ ও পাথেয় এবং পরলৌকিক জীবনের সফলতা-সাফল্য সম্পর্কিত মহাসত্যের উপলব্ধি।
উপর্যুক্ত বিষয়াদির আলোকে প্রত্যেক সাহাবীর মধ্যে এমন একটি সমন্বিত চেতনার সৃষ্টি হল যার মাধ্যমে বিপদ-আপদে ধৈর্য ধারণের অলৌকিক ক্ষমতা অর্জন, আবেগ নিয়ন্ত্রণ, প্রবনতার মোড় পরিবর্তন, আত্মশক্তির উৎকর্ষ সাধন, নিবেদিত নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভকে জীবনের একমাত্র ব্রত হিসেবে গ্রহণ করে তাঁরা এমন এক জীবন গঠনে ব্রতী হয়ে গেলেন কোথাও তার কোন তুলনা মিলে না।
ফুটনোটঃ[1] তিরমিযী শরীফ।
[2] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৫৪৩ পৃঃ।
[3] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৫১০ পৃঃ।
[4] ফিক্বহুস সীরাহ ৮৪ পৃঃ।
মক্কার বাইরে ইসলামের দাওয়াত
ত্বায়িফে রাসূল (সাঃ) (الرَّسُوْلُ ﷺ فِيْ الطَّائِفِ):
নবুওয়তের দশম বছর শাওয়াল মাসে[1] (৬১৯ খ্রীষ্টাব্দে মে মাসের শেষের দিকে কিংবা জুন মাসের প্রথম দিকে) নাবী কারীম (সাঃ) ত্বায়িফ গমন করেছিলেন। ত্বায়িফ মক্কা থেকে আনুমানিক ষাট মাইল দূরত্বে অবস্থিত। যাতায়াতের এ দূরত্ব তিনি অতিক্রম করেছিলেন পদব্রজে। সঙ্গে ছিলেন তাঁর মুক্ত করা ক্রীতদাস যায়দ বিন হারিসাহ (রাঃ)। পথ চলাকালে পথিমধ্যে যে কাবিলাহ বা গোত্রের নিকট তিনি উপস্থিত হতেন তাদের নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করতেন। কিন্তু তাঁর এ আহবানে তাদের পক্ষ থেকে কেউ সাড়া দেয় নি।
ত্বায়িফ গমন করে সাক্বীফ গোত্রের তিন নেতার সঙ্গে, যারা সকলেই সহোদর ছিলেন, তিনি সাক্ষাৎ করেন। তাঁর নাম ছিল যথাক্রমে আবদে ইয়ালাইল, মাসউদ ও হাবীব। ভ্রাতৃত্রয়ের পিতার নাম ছিল ‘আমর বিন ওমাইর সাক্বাফী। তাঁদের সঙ্গে (সাক্ষাতের পর মহানাবী (সাঃ) আল্লাহ তা‘আলার অনুগত হয়ে চলা এবং ইসলামকে সাহায্য করার জন্য তাঁদের নিকট দাওয়াত পেশ করেন। তদুত্তরে একজন বলেন যে, সে কাবার পর্দা (আবরণ) ফেড়ে দেখাক যদি আল্লাহ তাকে রাসূল করেছেন।[2] দ্বিতীয়জন বললেন, ‘নাবী করার জন্য আল্লাহ কি তোমাকে ছাড়া আর কাউকেও পান নি? তৃতীয়জন বললেন, ‘তোমার সঙ্গে আমি কোন ক্রমেই কথা বলবনা। প্রকৃতই যদি তুমি নাবী হও তবে তোমার কথা প্রত্যাখ্যান করা আমার জন্য বিপজ্জনক। আর যদি তুমি আল্লাহর নামে মিথ্যা প্রচারে লিপ্ত হও তবে তোমার সঙ্গে আমার কথা বলা সমীচীন নয়।’ তাঁদের এহেন আচরণ ও কথাবার্তায় তিনি মনঃক্ষুণ্ণ হলেন এবং সেখান থেকে যাবার প্রাক্কালে শুধু বললেন, ‘তোমরা যা করলে এবং বললে তা গোপনেই রাখ।’
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ত্বায়িফে দশদিন অবস্থান করেন। এ সময়ের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তিনি ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন। কিন্তু সকলের উত্তর একই ‘তুমি আমাদের শহর থেকে বের হয়ে যাও।’ ফলে ভগ্ন হৃদয়ে তিনি সেখান থেকে প্রত্যাবর্তনের প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। প্রত্যাবর্তনের পথে যখন তিনি পা বাড়ালেন তখন তাঁকে উত্যক্ত অপমানিত ও কষ্ট প্রদানের জন্য শিশু কিশোর ও যুবকদেরকে তাঁর পিছনে লেলিয়ে দেয়া হল। ইত্যবসরে পথের দু’পাশ ভিড় জমে গেল। তারা হাত তালি, অশ্রাব্য অশ্লীল কথাবার্তা বলে তাঁকে গাল মন্দ দিতে ও পাথর ছুঁড়ে আঘাত করতে থাকল। আঘাতের ফলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পায়ের গোড়ালিতে ক্ষতের সৃষ্টি হয়ে পাদুকাদ্বয় রক্তাক্ত হয়ে গেল।
ত্বায়িফের হতভাগ্য কিশোর ও যুবকেরা যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপর প্রস্তর নিক্ষেপ করছিল তখন যায়দ বিন হারিসাহই তাঁকে (সাঃ) রক্ষার জন্য ঢালের মতো কাজ করছিলেন। ফলে তাঁর মাথার কয়েকটি স্থানে তিনি আঘাত প্রাপ্ত হন। এভাবে অমানবিক যুলম নির্যাতনের মধ্য দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পথ চলতে থাকেন এবং দুরাচার ত্বায়িফবাসীগণ তাদের এ অত্যাচার অব্যাহত রাখে। আঘাতে আঘাতে জর্জ্জরিত রুধিরাক্ত কলেবরে পথ চলতে গিয়ে নাবী কারীম (সাঃ) খুবই ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়েন এবং শেষ পর্যন্ত এক আঙ্গুর উদ্যানে আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য হন। বাগানটি ছিল রাবী’আহর পুত্র উতবাহ ও শায়বাহর। তিনি বাগানে প্রবেশ করলে দূরাচার ত্বায়িফবাসীগণ গৃহাভিমুখে ফিরে যায়।
এ বাগানটি ত্বায়িফ থেকে তিন মাইল দূরে অবস্থিত। বাগানের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে নাবী কারীম (সাঃ) আঙ্গুর গাছের ছায়ায় এক দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়লেন।
কিছুক্ষণ বিশ্রাম করার ফলে কিছুটা সুস্থতা লাভের পর নাবী কারীম (সাঃ) আল্লাহ তা‘আলার দরবারে হাত তুলে দু‘আ করলেন। তাঁর এ দু‘আ ‘দুর্বলদের দু‘আ’ নামে সুপ্রসিদ্ধ। তাঁর দু‘আর এক একটি কথা থেকে এটা সহজেই অনুমান করা যায় যে, ত্বায়িফবাসীগণের দুর্ব্যবহারে তিনি কতটা ক্ষুব্ধ এবং তারা ঈমান না আনার কারণে তিনি কতটা ব্যথিত হয়েছিলেন। তিনি দু‘আ করলেন,
(اللهم إِلَيْكَ أَشْكُوْ ضَعْفَ قُوَّتِىْ، وَقِلَّةَ حِيْلَتِىْ، وَهَوَانِيْ عَلَى النَّاسِ، يَا أَرْحَمُ الرَّاحِمِيْنَ، أَنْتَ رَبُّ الْمُسْتَضْعَفِيْنَ، وَأَنْتَ رَبِّيْ، إِلٰى مَنْ تَكِلُنِىْ؟ إِلٰى بَعِيْدٍ يَتَجَهَّمُنِى؟ أَمْ إِلٰى عَدُوٍّ مَلَّكْتَهُ أَمْرِيْ؟ إِنْلَمْ يَكُنْ بِكَ عَلَيَّ غَضَبٌ فَلَا أُبَالِيْ، وَلٰكِنْ عَافِيْتُكَ هِيْ أَوْسَعُ لِيْ، أَعُوْذُ بِنُوْرِ وَجْهِكَ الَّذِيْ أَشْرَقْتَ لَهُ الظُّلُمَات، وَصَلُحَ عَلَيْهِ أَمْرُ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ مِنْ أَنْ تُنَزِّلَ بِيْ غَضَبُكَ، أَوْ يَحِلُّ عَلَيَّ سَخَطُكَ، لَكَالْعُتْبٰى حَتّٰى تَرْضٰى، وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِكَ).
‘‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট আমার শক্তির দুর্বলতা, অসহায়ত্ব আর মানুষের নিকট স্বীয় মূল্যহীনতার অভিযোগ প্রকাশ করছি। ওহে দয়াময় দয়ালু,তুমি দুর্বলদের প্রতিপালক, তুমি আমারও প্রতিপালক, তুমি আমাকে কার নিকট অর্পণ করছো, যে আমার সঙ্গে রূঢ় আচরণ করবে, নাকি তুমি আমাকে এমন শত্রুর নিকট ন্যস্ত করছো যাকে তুমি আমার যাবতীয় বিষয়ের মালিক করেছ। যদি তুমি আমার প্রতি অসন্তুষ্ট না হও তবে আমার কোন আফসোস নেই, তবে তোমার ক্ষমা আমার জন্য সম্প্রসারিত করো। আমি তোমার সেই নূরের আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যদ্দ্বারা অন্ধকার দূরীভূত হয়ে চতুর্দিক আলোয় উদ্ভাষিত হয়। দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় বিষয়াদি তোমার উপর ন্যস্ত। তুমি আমাকে অভিসম্পাত করবে কিংবা ধমক দিবে, তার থেকে তোমার সন্তুষ্টি আমার কাম্য। তোমার শক্তি ব্যতিরেকে অন্য কোন শক্তি নেই”।
এ দিকে রাবী’আহর পুত্রগণ যখন মহানাবী (সাঃ)-কে এমন এক দুরবস্থার মধ্যে নিপতিত অবস্থায় দেখতে পেল তখন তাদের মধ্যে গোত্রীয় চেতনা জাগ্রত হয়ে উঠল। আদাস নামক তাদের এক খ্রীষ্টান ক্রীতদাসের হাতে এক গোছা আঙ্গুর তারা নাবী কারীম (সাঃ)-এর নিকট পাঠিয়ে দিল। সেই ক্রীতদাসটি যখন আঙ্গুলের গোছাটি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হাতে তুলে দিতে চাইল তিনি তখন ‘বিসমিল্লাহ’ বলে হাত বাড়িয়ে তা গ্রহণ করলেন এবং খেতে আরম্ভ করলেন।
আদাস বলল, ‘এমন কথা তো এ অঞ্চলের লোকদের মুখে কখনো শুনিনি? রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘তুমি কোথায় থাক? তোমার ধর্ম কী?
সে বলল, ‘আমি খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বী এবং নিনওয়ার বাসিন্দা।’
নাবী কারীম (সাঃ) বললেন, ‘ভাল, তাহলে সৎ ব্যক্তি ইউনুস বিন মাত্তার গ্রামে তুমি বাস কর, তাই না?
সে বলল, ‘আপনি ইউনুস বিন মাত্তাকে কিভাবে চিনলেন?’
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘তিনি আমার ভাই। তিনি নাবী ছিলেন এবং আমিও নাবী’’। এ কথা শুনে আদাস নাবী কারীম (সাঃ)-এর দিকে ঝুঁকে পড়ল এবং তাঁর মাথা ও হাত-পায়ে চুমু দিল।
এ ব্যাপারে দেখে রাবী’আহ পুত্রদ্বয় নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগল, ‘দেখ, দেখ, ঐ ব্যক্তি দেখছি শেষ পর্যন্ত আমাদের ক্রীতদাসকেও বিগড়িয়ে দিল।’
এর পর আদাস যখন তাদের নিকট ফিরে গেল তখন ভ্রাতৃদ্বয় তাকে বলল, ‘বলত দেখি ব্যাপারটি কী? ঐ ভদ্রলোক দেখছি তোমাকেও বিগড়িয়ে দিল।’
সে বলল, ‘হে আমার মনিব! এ ধরাধামে তাঁর চেয়ে উত্তম মানুষ আর কেউই নেই। তিনি আমাকে এমন এক কথা বলেছেন যা নাবী রাসূল ছাড়া অন্য কেউই জানে না।’
তারা দুজন বলল, ‘দেখ আদ্দাস, ঐ ব্যক্তি যেন তোমাকে তোমার ধর্ম থেকে ফিরিয়ে না দেয়। কারণ তোমার ধর্ম তার ধর্ম থেকে উত্তম।’
কিছুক্ষণ অবস্থানের পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বাগান থেকে বের হয়ে মক্কার পথে যাত্রা করেন। তার মিশনের বিফলতাজনিত চিন্তা ও দৈহিক যন্ত্রনার দাপটে হৃদয় মন ছিল অত্যন্ত ভারাক্রান্ত ও বিশ্রান্ত। এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে তিনি যখন ‘কারনে মানাযেল’ নামক স্থানে পৌঁছলেন, তখন আল্লাহ রাববুল আলামীনের আদেশে জিবরাঈল (আঃ) সেখানে আগমন করেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন পর্বত নিয়ন্ত্রণকারী ফেরেশতামন্ডলী। আল্লাহর তরফ থেকে তাঁরা এ অভিপ্রায় নিয়ে এসেছিলেন যে, নাবী (সাঃ) যদি ইচ্ছা করেন তা হলে তারা দু’পাহাড়কে একত্রিত করে দূরাচার মক্কাবাসীকে পিশে মারবেন।
এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ বুখারী শরীফে আয়িশাহ সিদ্দীকাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে তিনি একদিন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার জীবনে কি এমন কোনদিন এসেছে যা উহুদের দিন চাইতেও কঠিন ছিল?
তিনি উত্তরে বললেন, ‘হ্যাঁ’’, তোমার সম্প্রদায়ের নিকট থেকে আমাকে যে যে দুঃখ কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়েছে তার মধ্যে সব চাইতে কঠিন ছিল ঐ দিনটি যে দিন আমি ঘাঁটিতে বিচলিত ছিলাম, যখন আমি নিজেকে আবদে ইয়ালাইল বিন আবদে কুলালের পুত্রদের নিকট পেশ করেছিলাম। কিন্তু তারা আমার কথায় কর্ণপাত না করায় দুশ্চিন্তা ও ব্যথায় পরিশ্রান্ত হয়ে আমি নিজ পথে গমন করি। এভাবে চলতে চলতে ‘কারনে সায়ালেবে’ যখন এসে পৌঁছি তখন আমার চেতনা ফিরে আসে।
এ সময় আমার মনে কিছুটা স্বস্তিবোধের সৃষ্টি হয়। সেখানে আমি আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকাতেই দেখি যে, একখন্ড মেঘ আমাকে ছায়া দান করছে; ব্যাপারটি আরও ভালভাবে নিরীক্ষণ করলে বুঝতে পারি যে, এতে জিবরাঈল (আঃ) রয়েছেন। তিনি আমাকে আহবান জানিয়ে বলেন, ‘আপনার সম্প্রদায় আপনাকে যা বলেছে এবং আপনার প্রতি যে আচরণ করেছে আল্লাহ তা‘আলা সব কিছুই শুনেছেন এবং দেখেছেন। এখন তিনি পর্বত নিয়ন্ত্রণকারী ফিরিশতাগণকে আপনার খেদমতে প্রেরণ করেছেন। আপনি তাঁদের কে যা ইচ্ছা নির্দেশ প্রদান করুন। এরপর পর্বতের ফিরিশতা আমাকে সালাম জানিয়ে বললেন, ‘হে মুহাম্মাদ (সাঃ)! কথা এটাই, আপনি যদি চান যে এদেরকে আমি দু’পাহাড় একত্রিত করে পিষে মারি তাহলে তাই হবে।[3] নাবী কারীম (সাঃ) বললেন, ‘না, বরং আমার আশা, মহান আল্লাহ এদের পৃষ্ঠদেশ হতে এমন বংশধর সৃষ্টি করবেন যারা একমাত্র তাঁর ইবাদত করবে এবং অন্য কাউকেও তাঁর অংশীদার ভাববে না।[4]
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এ উত্তরে তাঁর অসাধারণ মানবত্ব প্রেমে সমুজ্জ্বল এক ব্যক্তিত্ব এবং ক্ষমাশীল অনুপম চরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায়। সাত আসমানের উপর হতে আগত এই গায়েবী মদদের প্রস্তাব ও প্রতিশ্রুতি নিয়ে ফিরিশতাগণ যখন তাঁর খেদমতে উপস্থিত হন তখন তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং চরিত্র যেন আরও মহিমান্বিত হয়ে ওঠে। নিজের দুঃখ কষ্ট ভুলে গিয়ে তিনি সুস্থির চিত্তে আল্লাহ তা‘আলার দরবারে শুকরিয়া আদায় করতে থাকেন। এভাবে তাঁর মানসাকাশ থেকে চিন্তা ভাবনার মেঘ দূরীভূত হয়ে যায়।
তারপর তিনি মক্কা অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার পথে ওয়াদীয়ে নাখলায় অবস্থান করেন। এখানে দুটো জায়গা বসবাসের উপযোগী ছিল। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে আসসাইলুল কবীর এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে যায়মা। কেননা, সেখানে পানি ছিল কিছুটা সহজলভ্য এবং জায়গা দুটো ছিল শস্য শ্যামল। কিন্তু তিনি (সাঃ) এ দুটো জায়গার মধ্যে কোথায় অবস্থান করেছিলেন কোন সূত্র থেকেই তার সন্ধান পাওয়া যায় নি।
ওয়াদী নাখলায় তিনি যখন কয়েক দিনের জন্য অবস্থান করেছিলেন সে সময় আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিকট জিনদের একটি দলকে প্রেরণ করেন যার উল্লেখ কুরআন মাজীদের দুটো জায়গায় এসেছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে সূরাহ আল-আহক্বাফে এবং অন্যটি সূরাহ জিনে। সূরাহ আহক্বাফের আয়াতগুলো হচ্ছে,
{وَإِذْ صَرَفْنَا إِلَيْكَ نَفَرًا مِّنَ الْجِنِّ يَسْتَمِعُوْنَ الْقُرْآنَ فَلَمَّا حَضَرُوْهُ قَالُوْا أَنصِتُوْا فَلَمَّا قُضِيَ وَلَّوْا إِلٰى قَوْمِهِم مُّنذِرِيْنَ قَالُوْا يَا قَوْمَنَا إِنَّا سَمِعْنَا كِتَابًا أُنزِلَ مِن بَعْدِ مُوْسٰى مُصَدِّقًا لِّمَا بَيْنَ يَدَيْهِ يَهْدِيْإِلَى الْحَقِّ وَإِلٰى طَرِيْقٍ مُّسْتَقِيْمٍ يَا قَوْمَنَا أَجِيْبُوْا دَاعِيَ اللهِ وَآمِنُوْا بِهِ يَغْفِرْ لَكُم مِّن ذُنُوْبِكُمْ وَيُجِرْكُم مِّنْ عَذَابٍ أَلِيْمٍ} [الأحقاف:29: 31]
‘‘স্মরণ কর, যখন জিন্নদের একটি দলকে তোমার প্রতি ফিরিয়ে দিয়েছিলাম যারা কুরআন শুনছিল। তারা যখন সে স্থানে উপস্থিত হল, তখন তারা পরস্পরে বলল- চুপ করে শুন। পড়া যখন শেষ হল তখন তারা তাদের সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে গেল সতর্ককারীরূপে। ৩০. (ফিরে গিয়ে) তারা বলল- হে আমাদের সম্প্রদায়! আমরা একটি কিতাব (এর পাঠ) শুনেছি যা মূসার পরে অবতীর্ণ হয়েছে, তা পূর্বেকার কিতাবগুলোর সত্যতা প্রতিপন্ন করে, সত্যের দিকে আর সঠিক পথের দিকে পরিচালিত করে। ৩১. হে আমাদের সম্প্রদায়! আল্লাহর দিকে আহবানকারীর প্রতি সাড়া দাও এবং তার প্রতি ঈমান আন, আল্লাহ তোমাদের গুনাহ মাফ করে দেবেন আর তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক ‘আযাব থেকে রক্ষা করবেন।’ (আল-আহক্বাফ ৪৬ : ২৯-৩১)
قُلْ أُوْحِيَ إِلَيَّ أَنَّهُ اسْتَمَعَ نَفَرٌ مِنَ الْجِنِّ فَقَالُوْا إِنَّا سَمِعْنَا قُرْآناً عَجَباً (1) يَهْدِيْ إِلَى الرُّشْدِ فَآمَنَّا بِهِ وَلَنْ نُشْرِكَ بِرَبِّنَا أَحَداً (2) وَأَنَّهُ تَعَالٰى جَدُّ رَبِّنَا مَا اتَّخَذَ صَاحِبَةً وَلا وَلَداً (3) وَأَنَّهُ كَانَيَقُوْلُ سَفِيْهُنَا عَلَى اللهِ شَطَطاً (4) وَأَنَّا ظَنَنَّا أَنْ لَنْ تَقُوْلَ الْأِنْسُ وَالْجِنُّ عَلَى اللهِ كَذِباً (5) وَأَنَّهُ كَانَ رِجَالٌ مِنَ الْأِنْسِ يَعُوْذُوْنَ بِرِجَالٍ مِنَ الْجِنِّ فَزَادُوْهُمْ رَهَقاً (6) وَأَنَّهُمْ ظَنُّوْا كَمَا ظَنَنْتُمْ أَنْلَنْ يَبْعَثَ اللَّهُ أَحَداً (7) وَأَنَّا لَمَسْنَا السَّمَاءَ فَوَجَدْنَاهَا مُلِئَتْ حَرَساً شَدِيْداً وَشُهُباً (8) وَأَنَّا كُنَّا نَقْعُدُ مِنْهَا مَقَاعِدَ لِلسَّمْعِ فَمَنْ يَسْتَمِعِ الْآنَ يَجِدْ لَهُ شِهَاباً رَصَداً (9) وَأَنَّا لا نَدْرِيْ أَشَرٌّ أُرِيْدَبِمَنْ فِي الْأَرْضِ أَمْ أَرَادَ بِهِمْ رَبُّهُمْ رَشَداً (10) وَأَنَّا مِنَّا الصَّالِحُوْنَ وَمِنَّا دُوْنَ ذٰلِكَ كُنَّا طَرَائِقَ قِدَداً (11) وَأَنَّا ظَنَنَّا أَنْ لَنْ نُعْجِزَ اللهَ فِي الْأَرْضِ وَلَنْ نُعْجِزَهُ هَرَباً (12) وَأَنَّا لَمَّا سَمِعْنَا الْهُدَىآمَنَّا بِهِ فَمَنْ يُؤْمِنْ بِرَبِّهِ فَلا يَخَافُ بَخْساً وَلا رَهَقاً (13) وَأَنَّا مِنَّا الْمُسْلِمُوْنَ وَمِنَّا الْقَاسِطُوْنَ فَمَنْ أَسْلَمَ فَأُوْلَئِكَ تَحَرَّوْا رَشَداً (14) وَأَمَّا الْقَاسِطُوْنَ فَكَانُوْا لِجَهَنَّمَ حَطَباً (15) [ الجن: 1: 15].
‘১. বল, ‘আমার কাছে ওয়াহী করা হয়েছে যে, জিন্নদের একটি দল মনোযোগ দিয়ে (কুরআন) শুনেছে তারপর তারা বলেছে ‘আমরা এক অতি আশ্চর্যজনক কুরআন শুনেছি ২. যা সত্য-সঠিক পথ প্রদর্শন করে, যার কারণে আমরা তাতে ঈমান এনেছি, আমরা কক্ষনো কাউকে আমাদের প্রতিপালকের অংশীদার গণ্য করব না। ৩. আর আমাদের প্রতিপালকের মর্যাদা অতি উচ্চ, তিনি গ্রহণ করেননি কোন স্ত্রী আর কোন সন্তান। ৪. আর আমাদের মধ্যেকার নির্বোধেরা তাঁর সম্পর্কে সীমাতিরিক্ত কথাবার্তা বলত। ৫. আর আমরা ধারণা করতাম যে, মানুষ ও জ্বিন আল্লাহ সম্পর্কে কক্ষনো মিথ্যে কথা বলবে না। ৬. কতিপয় মানুষ কিছু জ্বিনের আশ্রয় নিত, এর দ্বারা তারা জ্বিনদের গর্ব অহঙ্কার বাড়িয়ে দিয়েছে। ৭. (জ্বিনেরা বলেছিল) তোমরা (জ্বিনেরা) যেমন ধারণা করতে তেমনি মানুষেরা ধারণা করত যে, (মৃত্যুর পর) আল্লাহ কাউকে পুনরুত্থিত করবেন না। ৮. আর আমরা আকাশের খবর নিতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমরা সেটাকে পেলাম কঠোর প্রহরী বেষ্টিত ও জ্বলন্ত উল্কাপিন্ডে পরিপূর্ণ। ৯. আমরা (আগে) সংবাদ শুনার জন্য আকাশের বিভিন্ন ঘাঁটিতে বসতাম, কিন্তু এখন কেউ সংবাদ শুনতে চাইলে তার উপর নিক্ষেপের জন্য সে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডকে লুকিয়ে থাকতে দেখে। ১০. আমরা জানি না (এই পরিবর্তিত অবস্থার মাধ্যমে) পৃথিবীবাসীর অকল্যাণই চাওয়া হচ্ছে, না তাদের প্রতিপালক তাদেরকে সরল সঠিক পথ দেখাতে চান। ১১. আর আমাদের কিছু সংখ্যক সৎকর্মশীল, আর কতিপয় এমন নয়, আমরা ছিলাম বিভিন্ন মত ও পথে বিভক্ত। ১২. আমরা বুঝতে পেরেছি যে, আমরা পৃথিবীতে আল্লাহকে পরাস্ত করতে পারব না, আর পালিয়েও তাঁকে অপারগ করতে পারব না। ১৩. আমরা যখন হিদায়াতের বাণী শুনতে পেলাম, তখন তার উপর ঈমান আনলাম। যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের উপর ঈমান আনে তার কোন ক্ষতি বা যুল্মের ভয় থাকবে না। ১৪. আমাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক (আল্লাহর প্রতি) আত্মসমর্পণকারী আর কিছু সংখ্যক অন্যায়কারী। যারা আত্মসমর্পণ করে তারা সঠিক পথ বেছে নিয়েছে। ১৫. আর যারা অন্যায়কারী তারা জাহান্নামের ইন্ধন।’ (আল-জিন ৭২ : ১-১৫)
এ ঘটনা প্রসঙ্গে অবতীর্ণ এ আয়াতসমূহের প্রাসঙ্গিক আলোচনা থেকে বুঝা যায় যে, এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে মহানাবী (সাঃ) জিনদের আগমনের কথা জানতেন না। আল্লাহ রাববুল আলামীন এ আয়াতের মাধ্যমে তাঁকে জিনদের আগমনের কথা অবহিত করেন এবং তখন তিনি তা জানতে পারেন। এ থেকে এও বুঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট এটাই ছিল জিনদের প্রথম আগমন। বিভিন্ন হাদীস সূত্রে জানা যায় যে, এর পর থেকে নাবী কারীম (সাঃ)-এর দরবারে তাদের গমনাগমন চলতে থাকে।
জিনদের আগমন ও ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারটি ছিল প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা‘আলার তরফ থেকে দ্বিতীয় সাহায্যমূলক ঘটনা যে সাহায্য তিনি করেছিলেন তাঁর অদৃশ্য ভান্ডার থেকে অদৃশ্য বাহিনী দ্বারা। এ ঘটনা সম্পর্কে আল্লাহ ছাড়া আর কারোরই অবগতি ছিল না। এ ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত যে সকল আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে তাতে নাবী কারীম (সাঃ)-এর দাওয়াতের কামিয়াবির সুসংবাদ রয়েছে। অধিকন্তু, এটাও পরিস্কার হয়ে গিয়েছে যে, বিশ্বের কোন শক্তি তাঁর দাওয়াতের কার্যকারিতার পথে কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে না। অতএব ইরশাদ হয়েছে,
{وَمَن لَّا يُجِبْ دَاعِيَ اللهِ فَلَيْسَ بِمُعْجِزٍ فِي الأَرْضِ وَلَيْسَ لَهُ مِن دُوْنِهِ أَولِيَاء أُوْلَئِكَ فِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ} [الأحقاف:32]،
‘‘আর যে আল্লাহর দিকে আহবানকারীর প্রতি সাড়া দিবে না, দুনিয়াতে সে আল্লাহকে ব্যর্থ করতে পারবে না, আর আল্লাহকে বাদ দিয়ে নেই তার কোন সাহায্যকারী, পৃষ্ঠপোষক। তারা আছে সুস্পষ্ট গুমরাহীতে।’ (আল-আহক্বাফ ৪৬ : ৩২)
{وَأَنَّا ظَنَنَّا أَن لَّن نُّعجِزَ اللهَ فِي الأَرْضِ وَلَن نُّعْجِزَهُ هَرَبًا} [الجن:12].
‘‘আমরা বুঝতে পেরেছি যে, আমরা পৃথিবীতে আল্লাহকে পরাস্ত করতে পারব না, আর পালিয়েও তাঁকে অপারগ করতে পারব না।’ (আল-জিন ৭২: ১২)
এ সাহায্য ও সুসংবাদের মাধ্যমে তাঁকে তাঁর যত প্রকারের চিন্তা-ভাবনা, দুঃখ-কষ্ট এবং নৈরাশ্য, ত্বায়িফবাসীদের গালি-গালাজ, চাটিমারা ও প্রস্তর নিক্ষেপের কালো মেঘ সব কিছুই মন থেকে মুছে গেল। তিনি সংকল্পবদ্ধ হলেন তাঁকে মক্কায় ফিরে যেতেই হবে এবং নতুনভাবে ইসলামের দাওয়াত ও নবুওয়াতের তাবলীগ পূর্ণোদ্যমে আরম্ভ করতে হবে। এটা ছিল ঐ সময়ের কথা যখন যায়দ বিন হারিসাহ (রাঃ) তাঁকে বলেছিলেন, ‘মক্কাবাসীগণ অর্থাৎ কুরাইশগণ যে অবস্থায় আপনাকে মক্কা থেকে বিতাড়িত করেছে সে অবস্থায় কিভাবে আপনি মক্কা প্রত্যাবর্তন করবেন?’ উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘হে যায়দ! তুমি যে অবস্থা দেখছ এর একটা সুরাহা অবশ্যই হবে এবং আল্লাহ তা‘আলা অবশ্যই এ থেকে পরিত্রাণের একটি পথ বের করে দেবেন। তাঁর মনোনীত দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে তিনি অবশ্যই সাহায্য করবেন এবং নিজ নাবী (সাঃ)-কে জয়ী করবেন।
নাবী কারীম (সাঃ) শেষ পর্যন্ত সেখান থেকে যাত্রা করলেন এবং মক্কার নিকটবর্তী হেরা পর্বতের পাদদেশে অবস্থান করলেন। তারপর খুযা’আহ গোত্রের একজন লোক মারফত আখনাস বিন শারীক্বের নিকট সংবাদ পাঠালেন যে তিনি যেন নাবী কারীম (সাঃ)-কে আশ্রয় প্রদান করেন। কিন্তু আখনাস এই বলে আপত্তি করলেন যে, কুরাইশরা হচ্ছেন তাঁর মিত্র। কাজেই তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে আশ্রয় প্রদান তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।
এরপর তিনি সুহায়েল বিন ‘আমর এর নিকট ঐ একই অনুরোধ বার্তা প্রেরণ করলেন। কিন্তু তিনিও এ কথা বলে আপত্তি জানালেন যে, বণী আমেরের আশ্রয় দেয়া বনু কা’বের জন্য (সঙ্গত) হয় না। অতঃপর নাবী সাঃ মুত্ব’ঈম বিন আদির নিকট বার্তা প্রেরণ করলেন। মুত্ব’ঈম বললেন, হাঁ, অতঃপর অস্ত্র সজ্জিত হয়ে নিজ পুত্রগণ এবং সম্প্রদায়কে ডাকলেন এবং বললেন, তোমরা অস্ত্রসজ্জিত হয়ে ক্বাবা’হ ঘরের নিকটে একত্রিত হয়ে যাও, কেননা আমি মুহাম্মাদ সাঃ-কে আশ্রয় দিয়ে দিয়েছি। অতঃপর মুত্বঈম নাবী কারীম (সাঃ)-এর নিকট খবর পাঠালেন মক্কায় আগমনের জন্য। তিনি খবর পেয়ে যায়িদ বিন হারিসাহকে সঙ্গে নিয়ে মক্কায় আগমন করে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করেন। এরপর মুত্ব’ঈম বিন আদী আগমন করে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করেন। এরপর মুত্ব’ঈম বিন আদী আপন বাহনের উপর দৌড়িয়ে উচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা করলেন যে, ‘হে কুরাইশগণ, আমি মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে আশ্রয় প্রদান করেছি, কেউ যেন তাঁকে আর অনর্থক হয়রান না করে।’
এ দিকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সোজা হাজরে আসওয়াদের নিকট গিয়ে তা চুম্বন করেন। তারপর দু’রাকায়াত সালাত আদায় করেন এবং অস্ত্রসজ্জিত মুত্ব’ঈম বিন আদী ও তাঁর লোকজন পরিবেষ্টিত হয়ে গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। বলা হয়, এ সময় আবূ জাহল মুত্ব’ঈমকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘তুমি মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে আশ্রয় দিয়েছ না মুসলিমগণের অনুসারী হয়ে গিয়েছ?’ উত্তরে মুত্ব’ঈম বলেছিলেন, ‘আমি তাঁকে আশ্রয় দিয়েছি।’ এর উত্তরে আবূ জাহল বলেছিল, ‘তুমি যাঁকে আশ্রয় দিয়েছ, আমিও তাঁকে আশ্রয় দিলাম’’।[5]
মুত্ব’ঈম বিন আদির সৌজন্য ও সহৃদয়তার কথা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কখনও ভুলেন নি। যখন বদরের যুদ্ধে মক্কার কাফেরদের একটি দল বন্দী হয়ে আসে এবং কোন বন্দীর মুক্তির জন্য জুবায়ের বিন মুত্ব’ঈম নাবীজী (সাঃ)-এর দরবারে আগমন করেন তখন তিনি বললেন,
(لَوْ كَانَ الْمُطْعِمُ بْنُ عَدِىٍّ حَيًّا ثُمَّ كَلَّمَنِىْ فِيْ هٰؤُلَاءِ النَّتْنٰى لَتَرَكْتُهُمْ لَهُ)
অর্থঃ যদি মুত্ব’ঈম বিন আদী জীবিত থাকত এবং এই দুর্গন্ধময় মানুষগুলোর জন্য সুপারিশ করত তাহলে তাঁর খাতিরে ওদেরকে ছেড়ে দিতাম।[6]
ফুটনোটঃ[1] মাওলানা নাজীব আবাদী ‘তারীখে ইসলাম ১ম খন্ড ১২২ পৃষ্ঠায় এটি বিশ্লেষণ করেছেন এবং এটাই আমার নিকট অধিক গ্রহণযোগ্য।
[2] একটি পরিভাষার সঙ্গে এ উক্তির মিল রয়েছে ‘তুমি যদি নাবী হও তবে আল্লাহ আমাকে ধ্বংস করুন।’’ এ উক্তির তাৎপর্য হচ্ছে দৃঢ়তার সঙ্গে একথা প্রকাশ করা যে তোমার নাবী হওয়া কোন ক্রমেই সম্ভব নয়, যেমনটি সম্ভব নয় কাবার পর্দা ফাড়ার জন্য হাত বাড়ানো।
[3] এ স্থলে সহীহুল বুখারী আখশাবাইন শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যা হচ্ছে মক্কার দুটি প্রসিদ্ধ পাহাড় কুরাইশ এবং কাইকায়ান। এ পাহাড় দুটি যথাক্রমে কাবা শরীফের দক্ষিণ ও উত্তরে পাশে মুখোমুখী অবস্থিত। সে সময় সাধারণ আবাসিক এলাকা ঐ দু’পাহাড়ের মধ্যেই অবস্থিত ছিল।
[4] সহীহুল বুখারী কিতাবু বাদইল খালকে ১ম খন্ড ৪৫৮ পৃঃ, মুসলিম শরীফ, বাবু মালাকেয়ান নাবীউ (সাঃ) মিন আয়াত মুমরিকীনা আল মুনাফেকীন ২য় খন্ড ১০৯ পৃষ্ঠা।
[5] ত্বায়িফ গমনের বিস্তারিত বর্ণনা ইবেন হিশাম ১ম খন্ড ৪১৯ পৃঃ যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৪৬-৪৭ পৃঃ মুখতাসারুস সীরাহ, শাইখ আবদুল্লাহ ১৪১-১২৪ পৃঃ এবং অন্যান্য প্রসিদ্ধ তফসীর গ্রন্থসমূহে হতে নেয়া হয়েছে।
[6] বুখারী ২য় খন্ড ৫৭৩ পৃঃ।
ব্যক্তি এবং গোষ্ঠিকে ইসলামের দাওয়াত
ব্যক্তি এবং গোষ্ঠিকে ইসলামের দাওয়াত প্রদান (عَرَضُ الْإِسْلَامِ عَلَى الْقَبَائِلِ وَالْأَفْرَادِ)
নবুওয়াতের দশম বর্ষের যুল ক্বা’দাহ মাসে (৬১৯ খ্রীষ্টাব্দের জুনের শেষ কিংবা জুলাইয়ের প্রথম ভাগে) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ত্বায়িফ থেকে মক্কা প্রত্যাবর্তন করেন এবং পুনরায় নতুনভাবে বিভিন্ন গোষ্ঠি এবং ব্যক্তিদের দাওয়াত দেয়া আরম্ভ করেন। যেহেতু তখন সময়টা ছিল হজ্জ্ব মৌসুমের কাছাকাছি সেহেতু নিকটবর্তী এবং দূরবর্তী বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজনেরা পদব্রজে ও যানবাহনে হজ্জ্ব পালনের জন্য মক্কা শরীফে আসতে আরম্ভ করেছিলেন। নাবী কারীম (সাঃ) এই সময়টাকে দাওয়াত দানের জন্য বেশ উপযোগী মনে করে এক এক গোত্রের নিকট গিয়ে ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন যা তিনি নবুওয়াতের ৪র্থ বছর থেকে করে আসছিলেন। অধিকন্তু তিনি (সাঃ) এই দশম বছর থেকে লোকেদেরকে তাঁকে সাহায্য-সহযোগীতা করা, আশ্রয় কামনার সাথে সাথে আল্লাহ তা’আলা প্রদত্ত রিসালাতের বাণী প্রচার করতে থাকেন।
ইমাম যুহরী (রঃ) বলেছেন, নাবী কারীম (সাঃ) যে যে গোত্রের নিকট গিয়ে তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত প্রদান করেন তাদের মধ্যে নিম্নের গোত্রগুলোর কথা আমাকে বলা হয়েছে। গোত্রগুলো হচ্ছে যথাক্রমেঃ
বনু ‘আমির বিন সা’সাআহ, মহারেব বিন খাসফাহ, ফাযারাহ, গাসসান, মুররাহ, হানিফাহ, সালীম, আবস, বনু নাসর, বনু বকা, কালব, হারিস বিন কা‘ব, আযরাহ ও হাযারেমা। কিন্তু এদের কেউই ইসলাম গ্রহণ করেন নি।[1]
প্রকাশ থাকে যে, ইমাম যুহরী যে সকল গোত্রের কথা উল্লেখ করেছেন তাদের সকলের নিকট একই বছর অথবা একই হজ্জ্বের মৌসুমে ইসলামের দাওয়াত দেয়া হয়নি। বরং নবুওয়াতের ৪র্থ বছর থেকে আরম্ভ করে হিজরতের পূর্বের শেষ হজ্জ্ব মৌসুম পর্যন্ত দশ বৎসর সময়ের মধ্যে এ দাওয়াত পেশ করেছিলেন কোন নির্দিষ্ট গোত্রের দাওয়াত পৌছানোর ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোন সময় নির্ণয় করা সম্ভব নয়। তবে এর অধিকাংশ ছিল দশম সনে।[2]
ইবনে ইসহাক্ব কোন কোন গোত্রের নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করা এবং তাদের উত্তরের অবস্থা, রকম, ধরণ ইত্যাদি সম্পর্কে যে বর্ণনা প্রদান করেছেন নিম্নে তার সংক্ষিপ্ত সার প্রদান করা হলঃ
১. বনু কালবঃ নাবী কারীম (সাঃ) বনু কালব এর একটি শাখা বনু আব্দুল্লাহর নিকটে ইসলামের দাওয়াত গ্রহণের আহবান জানিয়ে নিজেকে তাদের সম্মুখে পেশ করেন। আলাপ আলোচনা সূত্রে তিনি তাদের বলেন, ‘হে বনু আব্দুল্লাহ, আল্লাহ তোমাদের পূর্ব পুরুষদের যথেষ্ট অনুগ্রহ করেছেন এবং মর্যাদা দিয়েছেন। তোমাদের উচিত আল্লাহর এ আহবানে সাড়া দেয়া। কিন্তু এ গোত্র তাঁর দাওয়াত গ্রহণ করেন নি।
২. বনু হানীফাঃ নাবী কারীম (সাঃ) তাদের তাঁবুতে গিয়ে তাদেরকে আল্লাহর আহবান জানিয়ে নিজেকে তাদের সামনে পেশ করেন। কিন্তু তারা এমন অশ্রাব্য উত্তর প্রদান করে যা আরবের অন্য কেউই প্রদান করেনি।
৩. আমির বিন সা’সা’আহঃ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এ গোত্রের লোকজনদেরও আল্লাহর পথে আহবান জানিয়ে নিজেকে তাদের সামনে পেশ করেন। উত্তরে এ গোত্রের বাইহারাহ বিন ফিরাস নামক একটি লোক বলে যে, ‘আল্লাহর কসম! যদি আমি কুরাইশদের এ যুবককে গ্রহণ করি তবে তাঁর দ্বারা সমগ্র আরবকে খেয়ে ফেলব।’ আবার সে জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা বলুন, যদি আমরা আপনার নিকট আপনার এ ধর্মের উপর অনুগত্য স্বীকার করি এবং আল্লাহ আপনাকে বিপক্ষবাদীদের উপর জয়ী করেন তবে আপনার পরে নেতৃত্বের দায়িত্ব কি আমাদের উপর অর্পিত হবে?’
উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘নেতৃত্বের চাবি কাঠিতো আল্লাহর হাতে। যেখানে ইচ্ছা সেখানে তিনি নেতৃত্বের স্তম্ভ স্থাপিত করবেন।’
লোকটি বলল, ‘ভাল, আপনার রক্ষণাবেক্ষণে আমাদের বক্ষ আপনার প্রতিপক্ষ আরবদের নিশানায় থাকবে, কিন্তু আল্লাহ যখন আপনাকে জয়ী করবেন তখন কর্তৃত্বের চাবিকাঠি অন্য কারও হাতে থাকবে এটা কখনই হতে পারে না। কাজেই আপনার ধর্মের আমাদের কোন প্রয়োজনই নেই।’ মোট কথা তারা তাঁকে অস্বীকার করল।
এর পর যখন বনু ‘আমির গোত্রের লোকজনেরা নিজ অঞ্চলে ফিরে গিয়ে এক বৃদ্ধকে যিনি বার্ধক্যের কারণে হজ্জ্ব গমনে সক্ষম হন নি সমস্ত ঘটনা শুনালো এবং বলল যে, ‘আমাদের নিকট কুরাইশ খানদানের বনু আব্দুল মুত্তালিবের এক যুবক এসেছিল। তার ধারণা যে, সে আল্লাহর নাবী। সে দাওয়াত দিল যে, আমরা ইসলাম গ্রহণ করে যেন তার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করি এবং আমাদের অঞ্চলে তাঁকে নিয়ে আসি।’
এ কথা শ্রবণে বৃদ্ধ লোকটি দু’হাত দিয়ে মাথা ধরে ফেলল এবং বলল, ‘হে বন্ধু ‘আমির! এখন কি এ ভুল সংশোধনের কোন পথ আছে? আর যা হস্তচ্যুত হয়েছে তার কি অনুসন্ধান করা যেতে পারে? সে সত্ত্বার শপথ! যাঁর হাতে উমুকের প্রাণ আছে ইসমাঈল (আঃ)-এর গোত্রের কারও পক্ষে এ (নবুওয়াতের) মিথ্যা দাবী করা সম্ভব নয়। তিনি অবশ্যই সত্য নাবী। তোমাদের বুদ্ধি-সুদ্ধি কি লোপ পেয়েছিল?[3]
ফুটনোটঃ[1] তিরমিযী মুখতাসারুস সিরাত, শাইখ আবদুল্লাহ পৃঃ ১৪৯।
[2] রহমাতুলিত আলামীন ১/৭৪ পৃঃ।
[3] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪২৪-৪২৫ পৃঃ।
ঈমানের শিখা মক্কার বাইরে (المُؤْمِنُوْنَ مِنْ غَيْرِ أَهْلِ مَكَّةَ ):
যেভাবে মহানাবী (সাঃ) গোত্র ও দলসমূহকে ইসলামের দাওয়াত প্রদান করেন তেমনভাবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিগণকেও ইসলামের দাওয়াত প্রদান করেন।
এর মধ্যে কোন কোন ব্যক্তির নিকট থেকে ভাল সাড়া পাওয়া যায়। অধিকন্তু হজ্জ্বে এ মৌসুমের কিছুদিন পর কয়েক ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেন। নিম্নে তাঁদের একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি লিপিবদ্ধ করা হল:
১. সুওয়াইদ বিন সামিতঃ তিনি কবি, গভীর জ্ঞানবুদ্ধির অধিকারী এবং মদীনার অধিবাসী ছিলেন। তাঁর জ্ঞান-বুদ্ধির পরিপক্কতা, অভিজ্ঞতা, কাব্যচর্চা, সামাজিক মর্যাদা এবং বংশমর্যাদার কারণে জাতি তাঁকে ‘কামিল’ উপাধিতে ভূষিত করেন। হজ্জ্ব এবং ওমরা করার উদ্দেশ্যে তিনি মক্কায় আগমন করলে নাবী কারীম (সাঃ) তাঁকে ইসলামের দাওয়াত দেন। এতে তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে লক্ষ্য করে বলেন, ‘আমার নিকট যে জিনিস রয়েছে সম্ভবতঃ আপনার নিকটও সে জিনিস রয়েছে। উত্তরে নাবী কারীম (সাঃ) বললেন ‘আপনার নিকট কী কী জিনিস রয়েছে।’ সুওয়াইদ বললেন, ‘হিকমতে লোকমান।’ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘তা নিয়ে এসো’ এবং তিনি তা নিয়ে এলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘অবশ্যই একথা ভাল। কিন্তু আমার কাছে যা আছে তা এ থেকেও উত্তম এবং তা হচ্ছে আসমানী গ্রন্থ আলকুরআন যা আল্লাহ আমার উপর অবতীর্ণ করেছেন। তা হেদায়েত ও জ্যোতি।’ এর পর নাবী কারীম (সাঃ) তাকে কুরআন পাঠ করে শোনালেন এবং ইসলামের দাওয়াত দিলেন। তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং বললেন, ‘এতো খুব ভালো কথা। তারপর তাঁর মদীনা প্রত্যাবর্তনের পর পরই বু’আসের যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যায় এবং সে যুদ্ধে তাঁকে হত্যা করা হয়।[1] নবুওয়াতের একাদশ বর্ষের প্রথম ভাগে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।[2] মু’আয
২. ইয়াস বিন মু’আয : তিনিও মদীনার অধিবাসী ছিলেন। তিনি ছিলেন নব্য যুবক। নবুওয়াতের একাদশ বর্ষে বুআ-সের যুদ্ধের কিছু পূর্বে আউস গোত্রের একটি দল খাযরাজ গোত্রের বিরুদ্ধে কুরাইশদের মিত্রতা ও সহায়তা লাভের সন্ধানে মক্কা আগমন করেন। ইয়াস বিন মু’আযও সে দলের সঙ্গে এসেছিলেন। সে সময় ইয়াসরাবে আউস ও খাযরাজ এ উভয় গোত্রের মধ্যে যুদ্ধের আগুন জ্বলে ওঠে। যুদ্ধে আউসদের তুলনায় খাযরাজদের সংখ্যাধিক্য ছিল। আউসদের মক্কা আগমনের কথা অবগত হয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁদের নিকট গেলেন এবং যুদ্ধের বিভীষিকা ও ক্ষয় ক্ষতির কথা ভেবে তাদের লক্ষ্য করে তিনি বললেন, ‘আপনারা যে উদ্দেশ্যে আগমন করেছেন তার চাইতেও কি উত্তম বস্তু গ্রহণ করতে পারেন?’’
তাঁরা বললেন, ‘তা কী জিনিস?’
উত্তরে তিনি বললেন, ‘আমি আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ রাববুল আলামীন আমাকে নিজ বান্দার নিকট এ উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছেন যে, আমি যেন তাঁদের এ কথার দাওয়াত দেই যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তাঁর সঙ্গে কাউকেও শরীক করবে না। আল্লাহ আমার উপর কিতাবও অবতীর্ণ করেছেন। ইসলাম সম্পর্কে তিনি আরও কিছু আলাপ আলোচনা করলেন এবং কুরআন মাজীদের কিয়দংশ পাঠ করে শোনালেন।
ইয়াস বললেন, ‘হে আমার গোত্রীয় ভাইয়েরা, আল্লাহর শপথ তোমরা যে জন্য আগমন করেছ, এ হচ্ছে তার তাইতে অনেক বেশী উত্তম।’ কিন্তু দলের একজন সদস্য আবুল হায়সার আনাস বিন রাফি’ এক মুষ্টি কঙ্কর উঠিয়ে ইয়াসের মুখে মারল এবং বলল, ‘এ কথা ছাড়। আমার বয়সের শপথ! আমরা এ স্থানে অন্য উদ্দেশ্যে আগমন করেছি।’ এ কথা শোনার পর ইয়াস নীরবতা অলম্বন করল। নাবী কারীম (সাঃ)-ও সেখান থেকে উঠে চলে গেলেন। দলটি কুরাইশদের সঙ্গে মিত্রতা ও সহায়তা চুক্তি সম্পাদনে সক্ষম হয় নি, তারপর এক রাশ নৈরাশ্য নিয়ে তারা মদীনায় প্রত্যাবর্তন করে।
মদিনায় প্রত্যাবর্তনের অল্প দিন পরেই ইয়াস মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময় তিনি তাহলীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাকবীর (আল্লাহ আকবর), হামদ ও তাসবীহ জপতে ছিলেন। এ কারণে অনেকের দৃঢ় বিশ্বাস যে, তাঁর মৃত্যু ইসলামের ঈমানের উপর হয়েছিল।[3]
৩. আবূ যার গিফারী : তিনি ইয়াসরিবে বসবাস করতেন। যখন সুওয়াইদ বিন সামিত ও ইয়াস বিন মু’আয মারফরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আবির্ভাবের কথা তিনি শ্রবণ করলেন তখন তাঁর কর্ণকুহরে তিনি প্রচন্ড একটি ধাক্কার মতো অবস্থা অনুভব করলেন এবং সেটাই তাঁর ইসলাম গ্রহণের কারণ হয়ে দাঁড়াল।[4]
তাঁর ইসলাম গ্রহণের ঘটনা বিস্তারিতভাবে বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে। ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর বর্ণনা মতে আবূ যার (রাঃ) বলেছেন, ‘আমি ছিলাম গেফার গোত্রের একজন লোক। আমি জানতে পারলাম যে, মক্কায় এমন একজন লোকের আবির্ভাব হয়েছে যিনি নিজেকে নাবী বলে দাবী করছেন। আমি আপন ভাইকে বললাম তুমি লোকটির নিকট গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বল এবং খবর নিয়ে এসো। সে সেখানে গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর ফিরে এলো। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কী খবর এনেছ? সে বলল, ‘আল্লাহর কসম! আমি এমন মানুষ দেখেছি যিনি ভালোর জন্য আদেশ এবং মন্দের জন্য নিষেধ করছেন। আমি বললাম, তুমি সন্তোষজনক উত্তর দিলে না। শেষ পর্যন্ত আমি নিজেই কাঁধে খাদ্যের ঝুলি এবং হাতে লাঠি নিয়ে মক্কার পথে যাত্রা করলাম। সেখানে পৌঁছে গেলাম, কিন্তু তাঁকে (সাঃ) চিনতাম না এবং তাঁর (সাঃ) সম্পর্কে কাউকেও জিজ্ঞেস করব তাও সাহস পাচ্ছিলাম না।
ফলে আমি যমযমের পানি পান করতাম এবং মসজিদুল হারামে পড়ে থাকতাম। শেষ পর্যন্ত আমার নিকট দিয়ে আলী (রাঃ) পথ অতিক্রম করছিলেন। তিনি বললেন, ‘লোকটিকে অপরিচিত মনে হচ্ছে।’ আমি বললাম, ‘জী হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, ‘ভালো কথা, আমার বাসায় চলুন।’ আমি তাঁর সঙ্গে চললাম। তাঁর সঙ্গে নেহাৎই মামুলি গোছের কিছু কথাবার্তা হল। তিনি আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করলেন না। যে উদ্দেশ্যে আমার আগমন সে সম্পর্কে আমিও তাঁকে তেমন কিছু বললাম না। এভাবে রাত্রি অতিবাহিত হল।
সকাল হতে না হতেই আমি এ উদ্দেশ্যে মসজিদুল হারামে গেলাম যে, সেখানে নাবী (সাঃ) সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করব। কিন্তু সেখানে এমন কেউ ছিল না যিনি তাঁর সম্পর্কে কিছু বলবেন। শেষ পর্যন্ত দেখলাম আবারও আলী (রাঃ) সেখান দিয়ে যাচ্ছেন। আমাকে দেখে তিনি কিছুটা যেন নিজে নিজেই বললেন, ‘এ লোক তো দেখছি এখনো তাঁর ঠিকানা জানতে পারেন নি।’
আমি বললাম, ‘জী না’’। তিনি বললেন, ‘ভালো, আপনি আমার সঙ্গে চলুন।’ এক পর্যায়ে তিনি আমাকে বললেন, ‘আচ্ছা বলুন তো আপনার ব্যাপারটি কী? কি উদ্দেশ্যে আপনি এ শহরে এসেছেন?’
আমি বললাম, ‘আমার আগমনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমি যা বলব আপনি যতি তা গোপন রাখেন তাহলে আমি বলব?’
তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে আমি তাই করব।’
এ প্রেক্ষিতে আমি বললাম, ‘আমি জানতে পেরেছি যে, এখানে এক ব্যক্তির আবির্ভাব হয়েছে যিনি নিজেকে আল্লাহর নাবী বলে দাবী করছেন। আমি আমার ভাইকে পাঠিয়েছিলাম এ ব্যাপারে খোঁজ খবর নিয়ে কথাবার্তা বলার জন্য, কিন্তু সে ফিরে গিয়ে সন্তোষজনক কোন কিছুই বলতে সক্ষম হয় নি। এ জন্য আমি ভাবলাম যে, নিজে গিয়েই সাক্ষাৎ করে কথাবার্তা বলে আসি।
আলী (রাঃ) বললেন, ‘ভাই তুমি সঠিক জায়গাতেই পৌঁছেছ। দেখ আমার যাত্রা তাঁর দিকেই। আমি যেখানে প্রবেশ করব তুমিও সেখানে প্রবেশ করবে। আর যদি এমন কোন লোক দেখি যে, তোমার জন্য বিপজ্জনক হতে পারে তাহলে আমি তখন কোন প্রাচীরের গায়ে এমনভাবে থাকব যাতে মনে হবে যেন আমি আমার জুতো ঠিক করছি। তুমি কিন্তু তখন পথ চলতেই থাকবে।’
এরপর আলী (রাঃ) যাত্রা শুরু করলেন। আমিও তাঁকে অনুসরণ করলাম। তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দরবারে উপস্থিত হলেন। আমিও তাঁর সঙ্গে সেখানে উপস্থিত হয়ে আরয করলাম ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার নিকট ইসলাম পেশ করুন।’ হৃদয়স্পর্শী ভাব ও ভাষার মাধ্যমে তিনি আমার নিকট ইসলামের মূল বক্তব্য পেশ করলেন। বিষয় ও বক্তব্যে অভিভূত হয়ে আমি তখনই ইসলাম গ্রহণ করলাম। তারপর তিনি আমাকে বললেন, ‘হে আবূ যার, এ ব্যাপারটি গোপন রাখো এবং নিজ এলাকায় চলে যাও। যখন আমার বিজয়ের সংবাদ অবগত হবে তখন চলে আসবে। আমি বললাম, ‘ঐ মহান সত্ত্বার শপথ! যিনি আপনাকে সত্যের বাণী বাহক হিসেবে প্রেরণ করেছেন, আমি তাদের মধ্যে উচ্চ কণ্ঠে এ সত্য প্রচার করব।’
এরপর আমি মসজিদুল হারামে এলাম। কুরাইশ গোত্রের কিছু সংখ্যক লোকজন সেখানে উপস্থিত ছিল। আমি তাদের লক্ষ্য করে বললাম,
أَشْهَدُ أَنْ لَّا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ وَأَشْهْدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ
অর্থঃ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই এবং আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (সাঃ) আল্লাহর বান্দাহ ও রাসূল।
আমার মুখ থেকে তাওহীদের বাণী শ্রবণ করা মাত্র কুরাইশগণ বললো, এ লোককে শায়েস্তা করো। ফলে তারা এমনভাবে আমাকে মারপিট শুরু করল যেন, আমি মরে যাই। এমন এক বিপর্যয়ের মধ্যে নিপতিত অবস্থা থেকে আমাকে উদ্ধার করলেন আব্বাস (রাঃ)। জনতার ভিড়ের মধ্যখানে উঁকি দিয়ে তিনি আমাকে দেখতে পেলেন এবং কুরাইশদের লক্ষ্য করে বললেন, ‘তোমরা ধ্বংস হও! তোমরা গেফার গোত্রের একজন লোককে মারপিট করছ অথচ তোমাদের সফর ও ব্যবসার জন্য যাতায়াতের পথই হচ্ছে গেফার গোত্রের মধ্য দিয়ে। এ কথা শ্রবণের পর তারা আমাকে ছেড়ে দিয়ে সেখান থেকে সরে পড়ল।
দ্বিতীয় দিন সকাল হলে আমি আবারও সেখানে গেলাম এবং গতকাল যা বলেছিলাম আজও তা বললাম। অর্থাৎ উচ্চ কণ্ঠে উচ্চারণ করলাম তাওহিদ বাণী ‘আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ও আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ও রাসূলুহু।’ আমার উচ্চারিত কালেমা শাহাদাত শ্রবণের পর গতকালের মতই তারা আমাকে মারপিট শুরু করল। আজও আব্বাস (রাঃ) ওদের হাত থেকে উদ্ধার করলেন। তিনি আমার প্রতি ঝুঁকে পড়ে কুরাইশদের লক্ষ্য করে আবারও সেই কথাগুলো বললেন যা বলেছিলেন গতকাল।[5]
৪. তুফাইল বিন ‘আমর দাওসীঃ তিনি দাওস গোত্রের নেতা ছিলেন। তিনি ছিলেন কবি এবং একজন শরীফ ও বুদ্ধিমান ব্যক্তিত্ব। তাঁর গোত্রের কোন কোন সদস্য ইয়ামেনের কোন কোন অঞ্চলে রাজত্ব করত। তিনি নবুওয়াতের একাদশ বর্ষে মক্কা গমন করেন। সেখানে উপনীত হলে পূর্বাহ্নে মক্কাবাসী কাফেরগণ তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায় এবং সম্মান প্রদর্শন করে। এরপর তাঁর নিকট এ বলে আরয করে যে, ‘হে সম্মানিত মেহমান তুফাইল! আমাদের শহরে আগমনে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছি। কিন্তু একটি লোকের কারণে আমাদের সব আনন্দ নিরানন্দে পর্যবসিত হচ্ছে। সে নানা ধরণের নতুন নতুন কথাবার্তা বলে আমাদের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে, আমাদের একতা বিনষ্ট করেছে এবং শৃঙ্খলা ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছে। তাঁর কথাবার্তা অনেকের উপর যাদুর মতো প্রভাব বিস্তার করছে, সে পিতা-পুত্র, ভাই-ভাই এবং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও ভাঙ্গন ধরিয়ে দিচ্ছে। আমাদের ভয় হচ্ছে, আমরা যে বিপদে পড়েছি আপনি এবং আপনার সম্প্রদায় যেন অনুরূপ বিপদে না পড়েন। অতএব আপনি অবশ্যই তাঁর সঙ্গে কোন কথাবার্তা বললেন না, কিংবা তাঁর কোন কথাও শুনবেন না।’
তুফাইল যেভাবে বিষয়টি বর্ণনা করেছেন তা হচ্ছে, ‘তাঁরা আমাকে বরাবর বুঝতে থাকল। এবং এ প্রেক্ষিতে আমি সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, আমি তাঁর কোন কথা শ্রবণ করব না, তাঁর সঙ্গে কোনরূপ কথাবার্তাও বলব না। এমন কি আমি যখন মসজিদুল হারামে গেলাম তখন কানের ভিতরে খানিকটা তুলো প্রবেশ করিয়ে নিলাম যাতে তাঁর কোন কথা আমাদের কর্ণগোচর না হয়। কিন্তু খুব সম্ভব আল্লাহর ইচ্ছা হয়তো তা ছিল না। হয়তো এটাই আল্লাহর ইচ্ছা ছিল যে, তাঁর কথা আমাকে শুনতে হবে। ফলে খুব ভালভাবেই আমি তাঁর কথাবার্তা শুনতে পেলাম। তারপর আমি মনে মনে বললাম হায়! আমার সর্বনাশ হোক! আমি তো খোদার কৃপায় একজন বুদ্ধিমান মানুষ এবং কবি। আমার নিকট ভালোমন্দ গোপন থাকবে না, তবে কেন আমি সে ব্যক্তির কথা শুনব না? যদি তাঁর কথাবার্তা ভালো হয় তা গ্রহণ করে নিব, যদি মন্দ হয় ছেড়ে দিব। এ সব কিছু চিন্তা ভাবনা করে আমি থেমে গেলাম এবং যখন তিনি বাসায় ফেরার জন্য পথ ধরলেন তখন আমিও তাঁর পিছনে চললাম।
পথ চলতে চলতে গিয়ে তিনি গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন। তাঁকে অনুসরণ করে আমিও প্রবেশ করলাম এবং আমার আগমনের উদ্দেশ্য, কুরাইশগণের আমাকে ভয় দেখানো, তাঁর কথাবার্তা না শোনার জন্য শ্রবণ পথে তুলা দিয়ে রাখা, তা সত্ত্বেও তাঁর কথাবার্তা শ্রবণ করা ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে তাঁর কাছে বর্ণনা করলাম। তারপর বললাম, ‘আপনার বক্তব্য এখন পেশ করুন।’
তিনি আমার নিকট ইসলামের কথা পেশ করলেন এবং কুরআন মাজীদ থেকে কিছু অংশ পাঠ করে শোনালেন। আল্লাহ তা‘আলা সাক্ষী আছেন। এর চাইতে উত্তম কথা এবং ইনসাফের বাণী ইতোপূর্বে আমি আর কখনো শ্রবণ করিনি। কুরআনুল মাজীদের বাণী এবং তাঁর বক্তব্যের স্নিগ্ধতায় মুগ্ধ হয়ে আমি তখনই ইসলাম গ্রহণ করলাম এবং কালেমা শাহাদাত উচ্চারণ করে সত্যের সাক্ষ্য প্রদান করলাম। তারপর এ কথা বলে তাঁর নিকট আরয করলাম যে, ‘আমার সম্প্রদায় আমার কথা মান্য করে। আমি তাদের নিকট ফিরে গিয়ে তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত প্রদান করব। অতএব, আপনি আল্লাহ তা‘আলার দরবারে দু‘আ করবেন যেন তিনি অনুগ্রহ করে আমাকে কোন নিদর্শন প্রদান করেন।’ এ কথা শ্রবণের পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আল্লাহর সমীপে দু‘আ করলেন।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দু‘আর বরকতে তুফাইলকে যে নিদর্শন দেয়া হয়েছিল তা ছিল, যখন তিনি তাঁর সম্প্রদায়ের নিকট উপস্থিত হলেন তখন তাঁর মুখমন্ডল ছিল প্রদীপের আলোর মতো আলোকোজ্জ্বল। কিন্তু তাঁর মানসিক কিংবা অন্য কোন অসুবিধার প্রেক্ষিতে তিনি আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করলেন, ‘হে আল্লাহ মুখমন্ডলের পরিবর্তে অন্য কোন স্থানে এ নিদর্শন প্রকাশিত হোক। আমার ভয় হয় মানুষ তাকে বিকৃত বলবে। ফলে এ জ্যোতি তাঁর লাঠিতে প্রত্যাবর্তিত হয়েছিল। এরপর তিনি তাঁর পিতা এবং স্ত্রীকে ইসলামের দাওয়াত প্রদান করেন এবং উভয়েই তা গ্রহণ করে মুসলিম হয়ে যান। কিন্তু তাঁর সম্প্রদায়ের অন্যান্য লোকেরা ইসলাম গ্রহণে যথেষ্ট বিলম্ব করেন। অবশ্য এ ব্যাপারে তিনি অবিরাম প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। এর ফলে দেখা যায় যখন তিনি খন্দকের যুদ্ধের পর[6] হিযরত করেন তখন তাঁর সঙ্গে তাঁর সম্প্রদায়ের ৭০টি থেকে ৮০টি গোত্রের লোক ছিল। তুফাইল (রাঃ) ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলী সাধন করে ইয়ামামার যদ্ধে শহীদ হন।[7]
৫. যিমাদ আযদীঃ তিনি ছিলেন ইয়ামানের অধিবাসী এবং আযদে শানুওয়াহ গোত্রের এক ব্যক্তি। তাঁর কাজ ছিল মানুষের অসুখ বিসুখের ক্ষেত্রে ঝাড় ফুঁক করা এবং প্রেতাত্মা দূরীভূত করা। মক্কায় আগমনের পর ইসলামের শত্রুদের পক্ষ থেকে পরস্পর অবগত হলেন যে, মুহাম্মাদ (সাঃ) একজন পাগল। তারা তাঁকে তাঁর নিকট যাওয়ার জন্য পরামর্শ দিলেন। কিন্তু তিনি এ ভেবে চিন্তে তাঁর নিকট যাওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নিলেন যে, আল্লাহ যদি চান তাহলে তিনি তাঁর হাতে সুস্থ হতেও পারেন। কাজেই তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করে বললেন, ‘আমি প্রেতাত্মা ভালো করার জন্য ঝাড়ফুঁক করে থাকি। আপনার কি সেরূপ কোন প্রয়োজন আছে।’ উত্তরে তিনি বললেন,
(إِنَّ الْحَمْدَ لله÷ِ نَحْمَدُه” وَنَسْتَعِيْنُه”، مَن يَّهْدِهِ اللهُ فَلاَ مُضِلَّ لَه”، وَمَنْ يُضْلِلْهُ فَلاَ هَادِيَ لَه”، وأَشْهَدُ أَن لاَّ إِلٰهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَه” لاَ شَرِيْكَ لَه”، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُه” وَرَسُوْلُه”. أَمَّا بَعْدُ)
অর্থঃ অবশ্যই সকল প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য। আমরা তাঁরই প্রশংসা করছি এবং তাঁরই নিকট সাহায্য প্রার্থনা করছি। যাকে আল্লাহ সৎপথ দেখান তিনি পথভ্রষ্ট হন না এবং যাকে তিনি বিপথে চালিত করেন তাকে কেউই সৎপথে চালিত করতে পারে না। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্যিকার কোনই ইলাহ নেই। তিনি একক, তাঁর কোনই অংশীদার নেই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (সাঃ) আল্লাহর রাসূল এবং বান্দা।
তারপর যেমাদ বললেন, আপনার কথাগুলো পুনরায় বলুন, আমি শুনি। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পুনরায় একাদিক্রমে তিন বার অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় তাঁর বক্তব্য পেশ করলেন। এ কথা শ্রবণে ভাবগদগদ কণ্ঠে যিমাদ বললেন, ‘আমি জ্যোতিষ, যাদুকর এবং কবিদের কথাবার্তা শুনেছি কিন্তু আপনার কথার মতো এত চিত্তোদ্দীপক ও হৃদয়স্পর্শী কথাবার্তা কখনই শুনিনি। গভীরতম সমুদ্রের তলদেশে আলোড়ন সৃষ্টিকারী মহা প্রবাহের মতো এ আমার অন্তরের গভীরতম প্রদেশকে ভাব ও আবেগ আন্দোলিত এবং উচ্ছ্বসিত করে তুলছে।’
তারপর তিনি নাবী কারীম (সাঃ)-এর দিকে অত্যন্ত ভক্তিভরে হাত বাড়িয়ে কম্পিত কণ্ঠে বললেন, ‘হে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)! আপনি এ হাত গ্রহণ করে ইসলামের প্রতি আমার আনুগত্যের অঙ্গীকার গ্রহণ করুন। যেয়াদ এভাবে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করলেন।[8]
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১/৪২৫-৪২৭ রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ৭৪ পৃঃ।
[2] তারীখে ইসলাম আকবরশাহ নাজীবাবাদী ১/১২৫।
[3] ইবনে হিশাম ১/৪১৭, ৪২৮ পৃঃ।
[4] এ কথা আকবর শাহ নাজীরাবাদী লিখেছেন তাঁর তারীখে ইসলামে ১ম খন্ড ১২৮ পৃঃ।
[5] সহীহুল বুখারী কিস্সাতে ১ম খন্ড ৪৯৯-৫০০, ‘বাবু ইসলামে আবী যার’’ ১/৫৪৪-৫৪৫।
[6] বরং হোদায়াবিয়ার সন্ধির পর। কারণ যখন তিনি মদীনায় আগমন করেন তখন নাবী (সাঃ) খায়বারে ছিলেন। ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৩৮৫ পৃঃ।
[7] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৮২-১৮৩ পৃঃ। রহামাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ৮১-৮২ পৃঃ, মুখতাসার সীরাত শাইখ আবদুল্লাহ রচিত ১৪৪ পৃঃ।
[8] সহীহুল মুসলিম, মিশকাতুল মাসাবীহ, বারো আলামাতিন নবুওয়াত, ২য় খন্ড পৃঃ।
ইয়াসরিবের (মদীনার) ছয়টি পূণ্যবান আত্মা (سِتُّ نَسَمَاتٍ طَيِّبَةٍ مِّنْ أَهْلِ يَثْرِبَ):
একাদশ নবুওয়াত বর্ষে (জুলাই ৬২৩ খৃষ্টাব্দে) হজ্জ্বের মৌসুম ফিরে এলো। ইসলামী দাওয়াতের কয়েকটি কার্যকরী বীজ হস্তগত হল যা দেখতে দেখতে বিরাট বৃক্ষে পরিণত হল। এর ঘন শাখা-প্রশাখা ও পত্র পল্লবের সুশীতল ছায়ায় বসে মুসলিমগণ বহু বছরের অন্যায় অত্যাচার ও উৎপীড়নের উত্তাপ থেকে কিছুটা আরামও শান্তি পেলেন।
মক্কাবাসী মুশরিকগণ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার এবং লোকজনকে আল্লাহর পথ থেকে সরিয়ে রাখার জন্য প্রতিবন্ধকতার যে দেয়াল সৃষ্টি করে রেখেছিল তা এড়িয়ে চলার জন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর স্ট্রাটেজী বা কর্ম কৌশল পরিবর্তন করে নিলেন। মুশরিকরা যাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে তদুদ্দেশ্যে দিবা ভাগের পরিবর্তে তিনি রাতের অন্ধকারে বিভিন্ন গোত্রের নিকট যাতায়াতের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে থাকেন।
এ কর্ম কৌশল বা পদ্ধতির অনুসরণে একরাত্রি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আবূ বাকর (রাঃ) ও আলী (রাঃ)-কে সঙ্গে নিয়ে বের হলেন। বানু যুহল ও বানী শায়বান বিন সা’লাবাহগণের বাসস্থানের নিকট দিয়ে যাবার সময় ইসলাম সম্পর্কে তাঁদের সঙ্গে কিছু কথাবার্তা বললেন। আলাপ আলোচনার সময় তাদের সাড়া খুব অনুকূল বলে মনে হলেও ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে সিদ্ধান্তমূলক কোন কিছুই তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া গেল না। এ সময় আবূ বাকর (রাঃ) ও বনু যুহলের এক ব্যক্তির সঙ্গে বংশ পরম্পরা সম্পর্কে খুব হৃদ্যতাপূর্ণ কথাবার্তা হল। উভয়েই বংশধারা সম্পর্কে অত্যন্ত অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন।[1]
এরপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সঙ্গীদের নিয়ে মিনার চৌক দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। এমন সময় অদূরে কিছু সংখ্যক লোকের কথোপকথন তাঁর শ্রুতিগোচর হল।[2] কাজেই, তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে তিনি সে দিকে অগ্রসর হতে থাকলেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁদের নিকট গিয়ে পৌঁছলেন। এ দলে ছিলেন ইয়াসরাবের খাযরাজ গোত্রের ছয় জন যুবক। তাঁদের নাম হল যথাক্রমে :
(১) আস’আদ বিন যুরারাহ, (বনু নাজ্জার গোত্রের)
(২) ‘আওফ বিন হারিস বিন রিফা’আহ (ইবনে আফরা-), (বনু নাজ্জার গোত্রের)
(৩) রাফি’ বিন মালিক বিন আজলান, (বনু যুরাইক্ব গোত্রের)
(৪) কুত্ববা বিন ‘আমির বিন হাদীদাহ, (বনু সালামাহ গোত্রের)
(৫) উক্ববাহ বিন ‘আমির বিন নাবী, (বনু হারাম বিন কা‘ব গোত্রের)
(৬) হারিস বিন আব্দুল্লাহ বিন রিআব। (বনু উবাইদ বিন গানম গোত্রের)
এটা ইয়াসরিববাসীগণের সৌভাগ্য যে, তাঁরা তাঁদের মিত্র ইহুদীদের নিকট থেকে অবগত হয়েছিলেন যে, এ যুগে একজন নাবী প্রেরিত হবেন এবং শ্রীঘ্রই তা প্রকাশ পেয়ে যাবে। ইহুদীরা বলতেন যে, ‘আমরা তাঁর অনুসারী হয়ে তাঁর সঙ্গে তোমাদেরকে ইরম ও ‘আদদের মতো হত্যা করব।[3]
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) চলতে চলতে গিয়ে তাঁদের নিকট উপস্থিত হলেন এবং তাঁদের পরিচয় জানতে চাইলেন। তাঁরা বললেন, ‘আমরা খাযরাজ গোত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত।’ তিনি বললেন, ‘অর্থাৎ ইহুদীদের মিত্র?’
তাঁরা বললেন, ‘জী হ্যাঁ’।
তিনি বললেন, ‘আপনারা বসুন না, কিছু কথাবার্তা হোক।’
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)’এর এ কথা শ্রবণের পর তাঁরা বসে পড়লেন। তিনি তাঁদের সম্মুখে ইসলামের হাকীকত বর্ণনা করার পর কুরআন মাজীদ থেকে তিলাওয়াত করে শোনালেন এবং ইসলাম গ্রহণের জন্য দাওয়াত পেশ করলেন।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর থেকে দাওয়াত লাভের পর তাঁরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলেন, ‘ইনিতো সেই নাবী বলে মনে হচ্ছে যাঁর উল্লেখ করে ইহুদীগণ তোমাদেরকে ধমকাচ্ছে। কাজেই ইহুদীগণ যেন তোমাদেরকে পিছনে ফেলতে না পারে।’ এ কথা বলে তাঁরা তৎক্ষণাৎ ইসলামের দাওয়াত কবুল করে মুসলিম হয়ে গেলেন।
এঁরা ইয়াসরিবের জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন। সাম্প্রতিককালে ইয়াসরিবে যে যুদ্ধ হয়ে গেল এবং যার ধোঁয়া এখনো ইয়াসরিবের আকাশকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রেখেছে যে, যুদ্ধে তাঁদেরকে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলেছে। এ জন্য তাঁরা আশা করেছিলেন যে, ইসলামের এ দাওয়াতই এ যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটানোর একটা সূত্র হতে পারে। এ জন্য তাঁরা বললেন, আমরা আমাদের সম্প্রদায়কে এমন এক অবস্থায় রেখে এসেছি যে, তাদের পরস্পরের মধ্যে এমন শত্রুতা ও দুশমনীর সৃষ্টি হয়েছে, যার কোন নজির নেই। আশা করি আপনার দাওয়াতই তাদেরকে একত্রিত করে দিবে। আমরা সেখানে ফিরে গিয়ে লোকদের আপনার কাজের প্রতি আহবান জানাব এবং আপনার দাওয়াতের কারণে আল্লাহ যদি তাঁদের একত্রিত করে দেন তবে আপনার চাইতে অধিক আর কেউই সম্মানিত হবে না।
এরপর তাঁরা যখন মদীনা প্রত্যাবর্তন করলেন তখন সেই সঙ্গে ইসলামের সংবাদ ও পয়গাম সঙ্গে নিয়ে গেলেন। যার ফলে সেখানে ঘরে ঘরে রাসূল (সাঃ)-এর দাওয়াত প্রসার লাভ করল।[4]
ফুটনোটঃ[1] শাইখ আবদুল্লাহ মুখতাসারুস সীরাহ ১৫০-১৫২ পৃঃ।
[2] রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ৮৪ পৃঃ।
[3] যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৫০ পৃঃ, ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪২৯ ও ৫৪১ পৃঃ।
[4] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪২৮ ও ৪৩০ পৃঃ।
‘আয়িশাহ (রাঃ)-এর সঙ্গে বিবাহ (اِسْتِطْرَادُ ـ زِوَاجُ رَسُوْلِ اللهِ mvt بِعَائِشَةَ):
এ বছরই অর্থাৎ একাদশ নবুওয়াত বর্ষের শাওয়াল মাসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ‘আয়িশাহ (রাঃ)-এর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ঐ সময় তাঁর বয়স ছিল ছয় বছর। হিজরতের প্রথম বছর শাওয়াল মাসে মনোনীত নয় বছর বয়সে উম্মুল মু’মিনীন ‘আয়িশাহ (রাঃ) স্বামীগৃহে পদার্পণ করেন।[1] (রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রিয়তম সাহাবী আবূ বাকর (রাঃ)-এর ঐকান্তিক ইচ্ছা ছিল আল্লাহর নাবী (সাঃ)-এর সঙ্গে রক্ত সম্পর্ক গড়ে তোলা। এ প্রেক্ষিতেই ব্যবস্থা করা হয়েছিল এ অসম বিবাহের।) [অনুবাদক]
ফুটনোটঃ[1] তালকিহুর পহুম ১০ পৃঃ, সহীহুল বুখারী শরীফ ১ম খন্ড ৫৫০ পৃঃ।
নৈশ ভ্রমণ ও মি’রাজ
নাবী কারীম (সাঃ)-এর তাবলীগ ও দাওয়াতের কৃতকার্যতা এবং অন্যায় ও উৎপীড়নের মধ্য পর্যায়ে অতিক্রম করে চলছে। সুদূর আকাশের প্রান্তে আশার ক্ষীণ আলো এবং ধূলিযুক্ত ঝলক দৃষ্টি গোচর হতে আরম্ভ করেছে। ঠিক এমন সময়ে নৈশ ভ্রমণ ও উর্ধ্বগমনের ঘটনাটি সংঘটিত হয়। (একে আরবী ভাষায় বলা হয় মি’রাজ এবং এ নামেই ঘটনাটির সমধিক প্রসিদ্ধ রয়েছে)।
মি’রাজের এ বিশ্ববিশ্রুত অলৌকিক ঘটনাটি কোন্ সময় সংঘটিত হয়েছিল সে ব্যাপারে জীবনচরিতকারগণের মধ্যে যে মতভেদ লক্ষ্য করা যায় তা নিম্নে লিপিবদ্ধ করা হল,
১. রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে যে নবুওয়াত প্রদান করা হয়েছিল সে বছর মি’রাজ সংঘটিত হয়েছিল (এটা তাবারীর কথা)।
২. নবুওয়াতের পাঁচ বছর পর মি’রাজ সংঘটিত হয়েছিল (ইমাম নাবাবী এবং ইমাম কুরতুবী এ মত অধিক গ্রহণযোগ্য বলে স্থির করেছেন)।
৩. দশম নবুওয়াত বর্ষের ২৭শে রজব তারীখে মি’রাজ সংঘটিত হয়েছিল। (আল্লামা মানসুরপুরী এ মত গ্রহণ করেছেন)।
৪. হিজরতের ষোল মাস পূর্বে, অর্থাৎ নবুওয়াত দ্বাদশ বর্ষের রমযান মাসে মি’রাজ অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
৫. হিজরতের এক বছর দু’মাস পূর্বে অর্থাৎ নবুওয়াত ত্রয়োদশ বর্ষের মুহারম মাসে মি’রাজ অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
৬. হিজরতের এক বছর পূর্বে অর্থাৎ নবুওয়াত ত্রয়োদশ বর্ষের রবিউল আওয়াল মাসে মি’রাজ অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
এর মধ্যে প্রথম তিনটি মত এ জন্য সহীহুল হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে না যে, উম্মুল মু’মিনীন খাদীজাহ (রাঃ)-এর মৃত্যু হয়েছিল পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ হওয়ার পূর্বে। অধিকন্তু, এ ব্যাপারে সকলেই এক মত যে, পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ হয়েছে মি’রাজের রাত্রিতে। কাজেই, এ থেকে এটা পরিস্কার বুঝা যায় যে, খাদীজাহ (রাঃ)-এর মৃত্যু হয়েছিল মি’রাজের পূর্বে। তাছাড়া, এটাও সর্বজনবিদিত ব্যাপার যে, তাঁর মৃত্যু হয়েছিল দশম নবুওয়াত বর্ষের রমাযান মাসে। এ প্রেক্ষিতে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, মি’রাজের ঘটনা অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাঁর মৃত্যুর পরে, পূর্বে নয়।
অবশিষ্ট থাকে শেষের তিনটি মত। এ তিনটির কোনটিকেই কোনটির উপর অগ্রাধিকার দানের প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে সূরাহ ‘ইসরার’ বর্ণনাভঙ্গি থেকে অনুমান করা যায় যে, এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মক্কা জীবনের শেষ সময়ে।[1]
হাদীস বিশারদগণ এ ঘটনার যে বিস্তারিত রিওয়ায়াত প্রদান করেছেন পরবর্তী পঙ্ক্তিগুলোতে তার সার সংক্ষেপ লিপিবদ্ধ করা হল :
ইবনুল কাইয়্যেম লিখেছেনঃ প্রাপ্ত তথ্যাদি মোতাবেক প্রকৃত ব্যাপারটি হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে সশরীরে বুরাকের উপর আরোহন করিয়ে জিবরাঈল (আঃ) মসজিদুল হারাম থেকে বায়তুল মুকাদ্দাসে অবতরণের পর সেখানে সমাগত নাবীগণ (আঃ)-এর জামাতে ইমামত সহকারে সালাত আদায় করেন। সালাত আদায়ের পর পুনরায় তাঁকে বুরাকে আরোহন করিয়ে পৃথিবীর নিকটতম আসমানে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রথম আসমানের দরজা খোলা হল সেখানে মানুষের আদি পিতা আদম (আঃ)-এর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। জিবরাঈল (আঃ) এর প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন যে, ‘ইনি হচ্ছেন আপনার আদি পিতা আদম (আঃ)। একে সালাম করুন। এ কথা শ্রবণের পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে শ্রদ্ধাভারে সালাম জানান। আদম (আঃ) আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে সালামের জবাব দিয়ে বললেন, ‘খোশ আমদেদ!’ হে বংশের মধ্যমণি! খোশ আমদেদ! হে আমার বংশের গৌরব!’ তারপর তিনি তাঁর নবুওয়াতের স্বীকারোক্তি করলেন এবং ডান দিকে আল্লাহর নেককার বান্দাগণের এবং বাম দিকে বদকার বান্দাগণের আত্মাসমূহ তাঁকে প্রদর্শন করালেন।
এরপর তাঁকে দ্বিতীয় আসমানে নিয়ে যাওয়া হল। দরজা খোলা হলে সেখানে ইয়াহইয়া বিন যাকারিয়া এবং ঈসা বিন মরিয়ম (আঃ)-এর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। পরিচয় পর্বের পর তিনি তাঁকে শ্রদ্ধাভরে সালাম জানান। উভয়েই সালামের জবাব দিয়ে তাঁকে মুবারাকবাদ ও উষ্ণ অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করে তাঁর নবুওয়াতের স্বীকারোক্তি করেন।
তৃতীয় পর্যায়ে তাঁকে তৃতীয় আসমানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ইউসুফ (আঃ)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে তিনি তাঁকে শ্রদ্ধাভরে সালাম জানান। তিনিও সালামের জবাব দিয়ে তাঁকে মুবারকবাদ জানান এবং তাঁর নবুওয়াতের স্বীকারোক্তি করেন।
তারপর তাঁকে চতুর্থ আসমানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনি ইদরীস (আঃ)-কে দেখেন এবং শ্রদ্ধাভরে সালাম জানান। তিনি সালামের জবাব দিয়ে তাঁকে মুবারকবাদ জানান এবং তাঁর নবুওয়াতের স্বীকারোক্তি করেন।
পঞ্চম আসমানে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে তিনি হারুন বিন ইমরান (আঃ)-কে দেখতে পান এবং তাঁকে শ্রদ্ধাভরে সালাম জানান। তিনি যথারীতি সালামের জবাব দিয়ে তাঁকে মুবারকবাদ জানান এবং তাঁর নবুওয়াতের স্বীকারোক্তি জ্ঞাপন করেন।
তারপর রাসূলে কারীম (সাঃ)-কে ৬ষ্ঠ আসমানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মুসা বিন ইমরান (আঃ)-এর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। তিনি তাঁকে শ্রদ্ধাভরে সালাম জানিয়ে কুশলাদি বিনিময় করেন। মুসা (আঃ) সম্ভ্রমের সঙ্গে সালামের জবাব দিয়ে তাঁকে মুবারকবাদ জানান এবং তাঁর নবুওয়াতের স্বীকারোক্তি জ্ঞাপন করেন।
এরপর রাসূলুল্লাহ যখন সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন তখন তিনি ক্রন্দন করতে থাকেন। তাঁকে ক্রন্দনের কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন যে, ‘আমার পূর্বে এমন এক যুবককে নাবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে যাঁর উম্মতগণ আমার উম্মতদের তুলনায় অধিক সংখ্যায় জান্নাতে প্রবেশ লাভ করবেন।’’
অগ্রযাত্রার পরবর্তী পর্যায়ে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় সপ্তম আসমানে। সপ্তম আসমানে তাঁর সাক্ষাৎলাভ হয় ইবরাহীম খলীলুল্লাহ (আঃ)-এর সঙ্গে, তিনি (রাসূলুল্লাহ (সাঃ)) তাঁকে শ্রদ্ধাভরে সালাম ও মুবারকবাদ জ্ঞাপন করেন। তিনিও সসম্ভ্রমে সালামের জবাব দিয়ে তাঁকে মুবারকবাদ জানান এবং তাঁর নবুওয়াতের স্বীকারোক্তি জ্ঞাপন করেন।
অতঃপর তাঁকে সিদরাতুল মুনতাহায় উঠিয়ে নেয়া হয়। তথাকার কূল বৃক্ষের এক একটা ফল ‘হাজার’ অঞ্চলের কুল্লাহ’র ন্যায়। আর তার পত্র-পল্লবগুলো হাতির কানের মতো। অতঃপর সেই বৃক্ষকে স্বর্ণের প্রজাপতি, জ্যোতি ও বিভিন্ন বিচিত্র রং আচ্ছন্ন করে ফেলল। ফলে তা এমন রুপে পরিবর্তিত হলো যে, কোন সৃষ্টির পক্ষেই তার সৌন্দর্য বর্ণনা করা সম্ভব নয়।
চলার শেষ পর্যায়ে তাঁকে বায়তুল মা’মুরে নিয়ে যাওয়া হয়। এ বায়তুল মা’মূর এমন এক ঘর যাতে প্রত্যেক দিন সত্তর হাজার ফিরিশতা প্রবেশ করে। অতঃপর তারা আর সেখানে দ্বিতীয়বার প্রবেশ করার সুযোগ লাভ করে না। এরপর তিনি (সাঃ) জান্নাতে প্রবেশ করেন। সেখানে রয়েছে মোতি নির্মিত রশি, জান্নাতের মাটি হলো মেশক নামক সুগন্ধির তৈরী। অতঃপর তাঁর নিকট এমন বিষয় পেশ করা হয় যে, শেষ পর্যন্ত তিনি কলমের খসখস শব্দ শুনতে পান।
তারপর এ বিশ্বের মহা গৌরব, চির আকাঙ্ক্ষিত মানব নাবী, দোজাহানের মহাসম্মানিত সম্রাট, তাজদারে মদীনা, নাবীকুল শিরোমণি, রহমাতুল্লিল আলামীন, খাতামুন্নাবিয়ীন নীত হলেন অনাদি অনন্ত, অবিনশ্বর, অসীম শক্তি-সামর্থ্য ও হিকমতের মালিক আল্লাহ তা‘আলার সান্নিধ্যে। পর্দার একপাশে চির বিশ্ব জাহানের চির আরাধ্য, চির উপাস্য, অদ্বিতীয় স্রষ্টা প্রতিপালক প্রভূ, অন্যপাশে তাঁর একান্ত অনুগ্রহভাজন সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ও প্রিয়তম নাবী মুহাম্মাদ (সাঃ), মধ্যখানে রয়েছে দু’ধনুকের জ্যার সমপরিমাণ ব্যবধান কিংবা তার চাইতেও কম। অনুষ্ঠিত হল স্রষ্টা ও সৃষ্টির অভূতপূর্ব সাক্ষাৎকার, অশ্রুত পূর্ব সম্মেলন। অত্যন্ত প্রতাপান্বিত স্রষ্টা প্রভূ এবং মনোনীত প্রিয়তম সৃষ্টির মধ্যে হল আল্লাহর বাণী বিনিময়। তোহফা স্বরূপ বরাদ্দ করা হল পঞ্চাশ ওয়াক্ত ফরজ সালাত।
এরপর শুরু হল নাবীজী (সাঃ)-এর মর্তলোকে প্রত্যাবর্তনের পালা। এক পর্যায়ে সাক্ষাৎ হল মুসা (আঃ)-এর সঙ্গে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন কী কী নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাঁকে। উত্তরে নাবী কারীম (সাঃ) বললেন পঞ্চাশ ওয়াক্ত ফরজ সালাতের কথা।
উত্তরে মুসা (আঃ) বললেন, ‘আপনার উম্মতের পক্ষে সম্ভব হবে না পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা। আপনি ফিরে গিয়ে আপনার উম্মতের উপর আরোপিত এ গুরু দায়িত্ব হালকা করে নেয়ার জন্য আল্লাহর সমীপে আবেদন পেশ করুন।
এ কথা শ্রবণের পর জিবরাঈল (আঃ)-এর পরামর্শ গ্রহণের জন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। জিবরাঈল (আঃ) ইঙ্গিতে বুঝালেন যে, তিনি ইচ্ছা করলে তা করতে পারেন। এরপর জিবরাঈল (আঃ) তাঁকে মহাপরাক্রশালী আল্লাহ তা‘আলার দরবারে নিয়ে গেলেন, তিনি নিজ স্থানেই ছিলেন। কোন কোন বর্ণনায় সহীহুল বুখারীতে এ কথা আছে যে, পরম করুণাময় আল্লাহ তা‘আলা দশ ওয়াক্ত সালাত কমিয়ে দিলেন এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে নীচে আনা হল।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন মুসা (আঃ)-এর নিকট আগমন করে দশওয়াক্ত কমানোর কথা বললেন, তখন তিনি পুনরায় পরামর্শ দিলেন আল্লাহর সমীপে ফিরে গিয়ে এ গুরুভার আরও লাঘব করার জন্য আরও আবেদন পেশ করতে। শেষমেষ পাঁচওয়াক্ত সালাত নির্ধারিত না হওয়া পর্যন্ত মুসা (আঃ) এবং আল্লাহ তা‘আলার দরবারে এ দু’মঞ্জিলের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর যাতায়াত অব্যাহত থাকল। শেষ দফায় যখন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করে দেয়া হল তখনো মুসা (আঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে পরামর্শ দিলেন পুনরায় আল্লাহ তা‘আলার দরবারে ফিরে গিয়ে আরও কিছুটা হালকা করে নেয়ার জন্য। প্রত্যুত্তরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘এ ব্যাপারটি নিয়ে আল্লাহ তা‘আলার দরবারে পুনরায় যেতে আমি খুবই লজ্জাবোধ করছি। অত্যন্ত সন্তুষ্টির সঙ্গে আমি দিন ও রাতের মধ্যে পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ সালাতের সিদ্ধান্ত আমি মেনে নিলাম।’ এ বলে তিনি সম্মুখের দিকে এগিয়ে চললেন। যখন তিনি বেশ কিছুটা দূরত্ব অতিক্রম করলেন তখন নিম্নোক্ত কথাগুলো তাঁর শ্রুতিগোচর হল।
‘‘আমি আমার বান্দাদের জন্য আপন ফরজ জারী করে দিলাম এবং বান্দাদের দায়িত্বভার কিছুটা হালকা করে দিলাম।[2]
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আপন প্রভূকে বাহ্যিক দৃষ্টিতে দেখেছেন কিনা সে ব্যাপারে ইবতুল কাইয়্যেম মতভেদ বর্ণনা করেছেন। এরপর ইবনে তাইমিয়ার এক সূক্ষ্ণ বর্ণনার আলোচনা করেছেন, যার মূল বক্তব্য হচ্ছে ‘আল্লাহকে চাক্ষুস দেখার কোন প্রমাণ নেই।’ কোন সাহাবীও এরকম কোন কথা বলেন নি। আর ইবনে আব্বাস থেকে বাহ্যিক দৃষ্টিতে দেখার এবং অন্তর্দৃষ্টিতে দেখার যে দুটি মত বর্ণিত হয়েছে এর মধ্যে প্রথতুটি দ্বিতীয়টির বিপরীত নয়।
এরপর ইবনুল কাইয়্যেম লিখেছেন, সূরাহ নাজমে আল্লাহ তা‘আলার যে ইরশাদ,
{ثُمَّ دَنَا فَتَدَلّٰى} [النجم : 8]
‘‘তারপর সে (নাবীর) নিকটবর্তী হল, তারপর আসল আরো নিকটে,’ (আন-নাজ্ম ৫৩ : ৮)
‘তৎপর সে নিকটে আসল এবং আরও নিকটে আসল।’ এটা ঐ নৈকট্য থেকে ভিন্ন যেটা মি’রাজের ঘটনায় ঘটেছিল। কেননা, সূরাহ নাজমে যে নৈকট্যের উল্লেখ রয়েছে তাতে জিবরাঈল (আঃ)-এর নৈকট্যের কথা বলা হয়েছে। যেমনটি ‘আয়িশাহ সিদ্দীকা (রাঃ) এবং ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেছেন এবং বর্ণনা ভঙ্গিতেও এটাই নির্দেশিত হচ্ছে। এর বিপরীত মি’রাজের হাদীসে যে নৈকট্য লাভের কথা বলা হয়েছে তাতে সর্বশক্তিমান প্রভূ আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য লাভের কথা পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে। সূরাহ নাজমে একথার কোন উল্লেখ নেই। বরং তাতে বলা হয়েছে যে, রাসূল (সাঃ) তাঁকে দ্বিতীয়বার দেখেছিলেন সিদরাতুল মুনতাহার নিকট এবং তিনি ছিলেন জিবরাঈল (আঃ)। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দুবার তাঁকে তাঁর আসলরূপে দেখেছিলেন। একবার পৃথিবীতে এবং অন্যবার সিদরাতুল মুনতাহার নিকট।[3] এ সম্পর্কে সঠিক কী, সেটা আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।
এ সময় পুনরায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বক্ষ বিদারণের ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল এবং এ সফরকালে তাঁকে কয়েকটি জিনিসও দেখানো হয়েছিল। তাঁর সম্মুখে দুধ ও মদ পেশ করা হয়েছিল। তিনি দুধ পছন্দ করেছিলেন। এতে তাঁকে বলা হয়েছিল ‘আপনাকে ফিতরাতের (ইসলামের) পথ দেখানো হয়েছে আপনার উম্মত পথ ভ্রষ্ট হয়ে যেতেন। তিনি জান্নাতে চারটি নদী দেখেছিলেন। এর মধ্যে দুটি প্রকাশ্যে এবং দুটি গোপন। প্রকাশ্য দুটি হচ্ছে নীল ও ফোরাত। সম্ভবতঃ এর তাৎপর্য এই ছিল যে, তাঁর রেসালাত নীল ও ফোরাত নদের শস্য শ্যামল এলাকায় ইসলামের বিস্তৃতি ঘটাবে এবং এখানকার মানুষ বংশপরম্পরা সূত্রে মুসলিম হবে। ব্যাপারটি এ নয় যে, এ দু’পানির উৎস জান্নাত থেকে উৎসারিত হচ্ছে। অবশ্য আল্লাহই সব কিছু ভাল জানেন। তিনি জাহান্নামের মালিক এবং দারোগাকেও দেখেছেন। তাঁরা হাসছিলেন না এবং তাঁদের মুখমন্ডলে আনন্দ এবং প্রফুল্লতাও ছিল না। তিনি জান্নাত ও জাহান্নাম দেখেছিলেন।
তিনি তাদেরকেও দেখেছিলেন যারা অন্যায়ভাবে ইয়াতীমের মাল আত্মসাৎ করে চলেছে। তাদের ঠোঁটের আকার আকৃতি উটের ঠোঁটের মতো। তারা পাথরের টুকরোর মতো আগুনের ফুলকি মুখের মধ্যে পুরছিল এবং সেগুলো গুহ্যদ্বার দিয়ে নির্গত হয়ে আসছিল।
তিনি সুদখোরদের অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাদের পেটগুলো এতই প্রকান্ড আকারের ছিল যে, পেটের ভার বহন করা ছিল তাদের জন্য খুবই কষ্টকর ব্যাপার এবং পেটের ভারে এদিক ওদিক নড়াচড়া তাদের পক্ষে ক্রমেই সম্ভব হচ্ছিল না। অধিকন্তু, ফেরাউনের বংশধরগণকে যখন অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপের জন্য পেশ করা হচ্ছিল তখন তারা এদেরকে পদদলিত করে অতিক্রম করছিল।
এক পর্যায়ে তিনি ব্যভিচারীদের অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাদের সম্মুখে টাটকা ও মোটা গোস্ত ছিল এবং তার পাশে দুঃসহ দুর্গন্ধযুক্ত পচা মাংস ছিল। এরা টাটকা ও মোটা গোস্ত বাদ দিয়ে পচা গোস্ত খাচ্ছিল।
তিনি সেই সকল স্ত্রীলোকদেরকেও দেখেছিলেন যারা স্বামীদেরকে অন্যের ঔরষ জাত সন্তান প্রদান করত। (অর্থাৎ তারা ছিল ব্যভিচারিণী, ব্যভিচারের কারণে তারা পর পুরুষের বীর্যে গর্ভ ধারণ করত কিন্তু স্বামীর অজানতে সে সন্তান স্বামীর ঘাড়ে চাপিয়ে দিত)। তিনি দেখলেন তাদের বক্ষস্থল বড় বড় বড়শী দ্বারা বিদ্ধ করে আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যস্থানে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
যাতায়াতের সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আরববাসীদের এক বণিক দলকেও দেখেছিলেন এবং তাদের এক পলাতক উট দেখিয়ে দিয়েছিলেন এবং তাদের পানিও পান করেছিলেন। ঐ পানি একটি পাত্রে ঢাকা ছিল। এ সময়ে বণিকেরা ঘুমন্ত অবস্থায় ছিল। পানি পান করার পর পুনরায় তিনি পাত্রটিকে ঢেকে রেখেছিলেন। মি’রাজের রাত্রিশেষে সকাল বেলা এ ঘটনাটি তাঁর (সাঃ) দাবীর সত্যতা প্রমাণার্থে দলিল হিসেবে প্রতিপন্ন হয়।[4]
ইবনুল কাইয়্যেম বলেছেন, ‘যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সকালবেলায় স্বগোত্রীয় লোকজনদের নিকট আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে প্রদর্শিত নিদর্শনসমূহের কথা বর্ণনা করলেন, তখন তারা এ সব কিছুকে মিথ্যা এবং বাজে গল্প বলে উড়িয়ে দিল এবং তাঁর প্রতি যুলম নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিল। শুধু তাই নয়, তারা তাঁকে নানাভাবে পরীক্ষা করতে থাকে এবং প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। তারা বায়তুল মুক্বাদ্দাস সম্পর্কে তাঁকে নানা প্রশ্ন করতে থাকে এবং উত্তরের জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করে। এমন অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা তাঁর দৃষ্টি সম্মুখে বায়তুল মুকাদ্দাসের চিত্র তুলে ধরেন। তিনি সেই চিত্র প্রত্যক্ষ করে তাদের প্রশেণর জবাব দিতে থাকেন। এর ফলে নির্দ্বিধায় তাদের সকল প্রশ্নের জবাব দেয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়। তারা তাঁর কোন কথার প্রতিবাদ করতে সক্ষম হয়নি।
অধিকন্তু যাতায়াতের সময় তাদের যে কাফেলা তিনি দেখেছিলেন তার আগমনের সময় এবং বিবরণ ও তিনি বর্ণনা করে শোনালেন। এমন কি কাফেলার অগ্রগামী উটের চিহ্নও তিনি বলে দিলেন। তাছাড়া কাফেলার যে যা কিছু বলেছিল সবকিছুই সত্য বলে প্রমাণিত হয়ে গেল। কিন্তু তা সত্ত্বেও কুরাইশ মুশরিকগণ এ সব কিছুকেই সত্য বলে মেনে নিতে চাইল না।[5]
পক্ষান্তরে আবূ বাকর (রাঃ) এ সব কথা শোনামাত্র একে সত্য বলে মেনে নেন এবং এর সত্যতার ঘোষণা দিতে থাকেন। এ সময়ে আবূ বাকর (রাঃ) কে সিদ্দীক উপাধিতে ভূষিত করা হয়। কারণ, সকলে যখন এ ঘটনাকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিতে চাচ্ছিল তখন তিনি একে সর্বান্তঃকরণে সত্য বলে মেনে নিয়েছিলেন।[6]
মি’রাজের প্রসঙ্গ এবং উপকারিতা বর্ণনা করতে গিয়ে সব চাইতে সংক্ষিপ্ত এবং গুরুত্বপূর্ণ কথা যেটা বলা হয়েছে সেটা হচ্ছে,
{لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا} [الإسراء: 1]
‘‘এ জন্য যে, আমি (আল্লাহ তা‘আলা) তাঁকে আমার কিছু নিদর্শন দেখাব।’ (আল-ইসরা ১৭ : ১)
নাবী (আঃ)-দের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার এটাই নীতি। সূরাহ আনআমে বলেছেন,
{وَكَذٰلِكَ نُرِيْ إِبْرَاهِيْمَ مَلَكُوْتَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَلِيَكُوْنَ مِنَ الْمُوْقِنِيْنَ} [الأنعام:75]
‘‘ এভাবে আমি ইবরাহীমকে আকাশ ও পৃথিবী রাজ্যের ব্যবস্থাপনা দেখিয়েছি যাতে সে নিশ্চিত বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।’ (আল-আন‘আম ৬ : ৭৫)
তারপর আল্লাহ মূসাকে বললেন,
{لِنُرِيَكَ مِنْ آيَاتِنَا الْكُبْرَى} [طه:23]
‘যাতে আমি তোমাকে আমার বড় বড় নিদর্শনগুলোর কিছু দেখাতে পারি।’ (ত্ব-হা ২০ : ২৩)
ফলে যখন আম্বিয়ায়ে কিরামের জ্ঞান এভাবে প্রত্যক্ষদর্শিতার সনদ প্রাপ্ত হয়ে যায় তখন তাঁদের আয়নুল ইয়াকীনের (স্বচক্ষে দর্শনের) ঐ পর্যায় হাসেল হয়ে যায়। যার সম্পর্কে অনুমান করা সম্ভব নয়। যেমন শোনা কি দেখার মতো হয়। আর এই কারণেই নাবীগণ (আঃ) আল্লাহর পথে এমন সব দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে পারেন অন্য কেউ তা পারেন না। একারণে ঐ শক্তির পক্ষ থেকে আসা কোন প্রকার কঠোরতা কিংবা দুঃখ কষ্টকে তাঁরা দুঃখ কষ্ট বলে মনেই করতেন না।
এ মি’রাজের ঘটনার অন্তরালে যে সকল বিজ্ঞানময় এবং রহস্যজনক ব্যাপার রয়েছে তার আলোচনার স্থান হচ্ছে শরীয়ত দর্শনের পুস্তকাবলী। কিন্তু এমন কিছু তত্ত্ব রয়েছে যার দ্বারা এ বরকতময় সফরের স্রোতস্বিনী থেকে প্রবাহিত হয়ে নাবী (সাঃ)-এর জীবন উদ্যান অভিমুখে প্রবাহিত হয়েছে। এ কারণে সে সব সম্পর্কে নিম্নে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল,
পাঠকেরা দেখতে পায় যে, আল্লাহ তা‘আলা সূরাহ বণী ইসরাঈলে রাত্রি ভ্রমণের ঘটনা কেবলমাত্র একটি আয়াতে বর্ণনা করে কথার মোড় ইহুদীদের অন্যায় ও পাপকার্যের বর্ণনার দিকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। এরপর তাদেরকে অবহিত করা হয়েছে যে, এ কুরআন ঐ পথের সন্ধান দেয় যে পথ হচ্ছে সব চাইতে সোজা-সরল ও শুদ্ধ। কুরআন পাঠকেরা হয়তো সন্দেহ করতে পারে যে, কথা দুটির মধ্যে কোন মিল নেই। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা নয়, বরং আল্লাহ তা‘আলা এ বর্ণনাভঙ্গি দ্বারা ঐ দিকে ইঙ্গিত করেছেন যে, ইহুদীগণকে মানুষের নেতৃত্ব দেয়া থেকে বরখাস্ত করা হবে। কারণ তারা এমন সব অন্যায় করেছে যে, ঐ সকল কর্ম করার পর তাদেরকে ঐ পদে আর অধিষ্ঠিত রাখা সঙ্গত নয়। কাজেই এ পদ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে প্রদান করা হবে এবং ইবরাহীমী দাওয়াতের দুটি কেন্দ্রকেই তাঁর নেতৃত্বাধীনে স্থাপন করা হবে। অন্য কথায় বলা যায় যে, এখন এমন এক অবস্থার সূত্রপাত হয়েছে যার ফলে আত্মিক নেতৃত্বের প্রসঙ্গটি এক সম্প্রদায়ের নিকট হতে অন্য সম্প্রদায়ের নিকট হস্তান্তর করা দরকার। অর্থাৎ এমন এক সম্প্রদায় যাদের ইতিহাস বিশ্বাস ঘাতকতা, খেয়ানত, আসাধূতা, অন্যায়, অত্যাচার ও অপকর্মে ভরপুর তাদের হাত থেকে নেতৃত্ব কেড়ে নিয়ে অন্য এক উম্মত বা সম্প্রদায়কে দায়িত্বভার দেয়া দরকার যাঁরা প্রবাহিত হবেন কল্যাণ ও পুণ্যের প্রস্রবন হয়ে এবং যাঁদের নাবী (সাঃ) সর্বাধিক হেদায়েত প্রাপ্ত, সঠিক পথ প্রদর্শক ও আল্লাহর বাণী কুরআনের দ্বারা লাভবান হবেন।
কিন্তু যখন এ উম্মতের রাসূল (সাঃ) মক্কার পর্বত শ্রেণীতে মানুষের মাঝে ঠক্কর খেয়ে বেড়াচ্ছেন তখন এ প্রত্যাবর্তন কিভাবে সম্ভব হতে পারে? এটা একটা সে সময়ের প্রশ্নমাত্র, যে সময় এক অন্য রহস্যের আবরণ উন্মোচিত হচ্ছিল। আর সেই রহস্যটি ছিল, ইসলামী দাওয়াতের একটি পর্যায় শেষ যার ধারা থেকে কিছুটা ভিন্ন। এ জন্য আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, কোন আয়াতে অংশীবাদীদেরকে খোলাখুলি সতর্ক করে ধমক দেয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে,
{وَإِذَا أَرَدْنَا أَن نُّهْلِكَ قَرْيَةً أَمَرْنَا مُتْرَفِيْهَا فَفَسَقُوْا فِيْهَا فَحَقَّ عَلَيْهَا الْقَوْلُ فَدَمَّرْنَاهَا تَدْمِيْرًا وَكَمْ أَهْلَكْنَا مِنَ الْقُرُوْنِ مِن بَعْدِ نُوْحٍ وَكَفَى بِرَبِّكَ بِذُنُوْبِ عِبَادِهِ خَبِيْرًَا بَصِيْرًا} [الإسراء:16، 17]
‘‘আমি যখন কোন জনবসতিকে ধ্বংস করতে চাই তখন তাদের সচ্ছল ব্যক্তিদেরকে আদেশ করি (আমার আদেশ মেনে চলার জন্য)। কিন্তু তারা অবাধ্যতা করতে থাকে। তখন সে জনবসতির প্রতি আমার ‘আযাবের ফায়সালা সাব্যস্ত হয়ে যায়। তখন আমি তা সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করে দেই। ১৭. নূহের পর বহু বংশধারাকে আমি ধ্বংস করে দিয়েছি, বান্দাহ্দের পাপকাজের খবর রাখা আর লক্ষ্য রাখার জন্য তোমার প্রতিপালকই যথেষ্ট। ’ [আল-ইসরা (১৭) : ১৬-১৭]
পক্ষান্তরে এ সকল আয়াতের পাশে পাশে এমন সব আয়াতও রয়েছে যার মাধ্যমে মুসলিমগণকে তাহযীব, তমদ্দুনের এমন সব নিয়ম-কানুন এবং প্রতিরক্ষার সাধারণ নিয়মাবলী শিক্ষা দেয়া হয়েছে যার উপর ভিত্তি করে নবাগত ইসলামী জিন্দেগীর ভিত্তি নির্মিত, নিয়ন্ত্রিত ও সুদৃঢ় হতে পারে। মনে হয় মুসলিমগণ এখন এমন এক সরজমিনের উপর নিজ ঠিকানা বানিয়েছেন সেখানে সকল দিক দিয়ে নিজেদের সমস্যাবলী আপন হাতের মুঠোর মধ্যে রয়েছে এবং সমাজ জীবন যাত্রার ক্ষেত্রে তাঁরা এমন এক ঐকমত্য গঠনে সক্ষম হয়েছেন যার উপর ভিত্তি করে সমাজের যাঁতা ঘুরছে। অধিকন্তু, এ আয়াতে আরও ইঙ্গিত রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অচিরেই এমন এক স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করবেন, যা সম্পূর্ণ নিরাপদ হবে এবং তাঁর প্রচারিত ধর্ম সুপ্রতিষ্ঠিত হবে।
এই নৈশ ভ্রমণ ও মি’রাজ বরকতময় ঘটনার তলদেশে হিকমত ও রহস্যসমূহের মধ্যে এমন একটি হিকমত যা আমাদের বিষয়বস্তুর সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। এ জন্য বর্ণনা উপযোগী মনে করে আমি এখানে তা লিপিবদ্ধ করলাম। এরকম দুটি বিরাট হিকমতের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপের পর আমি এ ব্যাপারে মতস্থির করেছি যে, এ নৈশ ভ্রমণের ঘটনা ‘আক্বাবাহর প্রথম বাইআতের ঘটনার কিছু পূর্বের অথবা দু’বাইআতের মধ্যবর্তী সময়ের ঘটনা হতে পারে। আল্লাহ তা‘আলা সব চাইতে ভাল জানেন।
ফুটনোটঃ[1] বিস্তারিত তথ্য জানতে হলে দেখুন যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৪৯ পৃঃ মুকতাসারুস সীরাহ শাইখ আবদুল্লাহ পৃঃ ১৪৮-১৪৯। রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ৭৬ পৃঃ।
[2] যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৪৭-৪৮ পৃঃ।
[3] যা’দুল মায়দ ২য় খন্ড ৪৭-৪৮ পৃঃ, সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৫০, ৪৫৫, ৪৫৬, ৪৭০, ৪৮১, ৫৪৮, ৫৫০, ২য় খন্ড ৬৮৪ মসলিম ১ম খন্ড ৯১, ৯২, ৯৩, ৯৪, ৯৬।
[4] পূর্ববর্তী উদ্ধৃতি, এ ছাড়া ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৩৯৭, ৪০২ ও ৪০৬ পৃঃ। তফসীরের কিতাব সমূহের সূরাহ ইসরার তফসীর দ্রষ্টব্য।
[5] যা’দুল মাদ ১/৪৮ পৃঃ, এটা ছাড়া সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৬৮৪, সহীহুল মুসলিম ১ম খন্ড ৯৬ পৃঃ, ইবনে হিশাম ১/৪০২-৪০৩ পৃঃ।
[6] ইবনে হিশাম ১/৩৯৯ পৃঃ।
বায়আত (আনুগত্যের শপথ)
আক্বাবাহর* প্রথম বায়আত (আনুগত্যের শপথ) (بَيْعَةُ الْعَقَبَةِ الْأُوْلٰى )
পূর্বে আমি বলেছি যে, একাদশ নবুওয়াত বর্ষে হজ্বের মৌসুমে ইয়াসরিবের ছয়জন লোক ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট অঙ্গীকার করেছিলেন যে, ‘আমরা নিজ জাতির নিকট গিয়ে আপনার নবুওয়াতের কথা প্রচার করব।’
এর ফল হল যে, পরবর্তী বছর যখন হজ্বের মৌসুম এল (অর্থাৎ দ্বাদশ নবুওয়াত বর্ষের জিলহজ্ব মোতাবেক ৬২১ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই) তখন বারোজন লোক রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর খিদমতে এসে উপস্থিত হলেন। এদের মধ্যে জাবির বিন আব্দুল্লাহ বিন রেআব ছাড়া অবশিষ্ট পাঁচজন তাঁরাই ছিলেন যাঁরা পূর্বের বছর এসেছিলেন। এছাড়া অন্য সাত জন ছিলেন নতুন। নাম হল যথাক্রমেঃ
১. মা’আয বিন হারিস ইবনে আফরা-
কবীলাহ বনী নাজ্জার
(খাযরাজ)
২. যাকওয়ান বিন আব্দুল ক্বায়স
,, বনী যুরাইক্ব
(খাযরাজ)
৩. উবাদা বিন সামিত
,, বনী গানাম
(খাযরাজ)
৪. ইয়াযীদ বিন সা’লাবাহ
,, বনী গানামের মিত্র
(খাযরাজ)
৫. আব্বাস বিন উবাদাহ বিন নাযলাহ
,, বনী সালিম
(খাযরাজ)
৬. আবুল হায়সাম বিন তায়্যাহান
,, বনী আব্দুল আশহাল
(আউস)
৭. উয়াইম বিন সায়িদাহ
,, বনী ‘আমর বিন আওফ
(আউস)
এর মধ্যে কেবল শেষের দুজন আউস গোত্রের। তাছাড়া বাকী সকলেই ছিলেন খাযরাজ গোত্রের।[1] এ লোকগুলো মিনার ‘আক্বাবাহর নিকটে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁর প্রচারিত দ্বীনের ব্যাপারে কিছু কথার উপর অঙ্গীকার গ্রহণ করেন। ঐ কথাগুলো সবই পরবর্তীকালে সম্পাদিত হুদায়বিয়াহর সন্ধিপত্র এবং মক্কা বিজয়ের সময় মহিলাদের নিকট থেকে গৃহীত অঙ্গীকারনামার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ‘আক্বাবাহর এ অঙ্গীকার নামার ঘটনা সহীহুল বুখারী শরীফে উবাদাহ বিন সামিত (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘এসো, আমার নিকট এ কথার উপর অঙ্গীকার গ্রহণ কর যে, আল্লাহর সঙ্গে কোন কিছুকেই অংশীদার করবে না, চুরি করবে না, যেনা করবে না, নিজ সন্তানকে হত্যা করবেনা, হাত পায়ের মাঝে মন গড়া কোন অপবাদ আনবে না এবং কোন ভাল কথায় আমাকে অমান্য করবে না। যারা এ সকল কথা মান্য এবং পূর্ণ করবে আল্লাহ তা‘আলার নিকট তাদের পুরষ্কার রয়েছে। কিন্তু যারা এগুলোর মধ্যে কোনটি করে বসে এবং তার শাস্তি এখানেই প্রদান করা হয় তবে সেটা তার মুক্তিলাভের কারণ হয়ে যাবে। আর যদি কেউ সবের মধ্যে কোন কিছু করে বসে এবং আল্লাহ তা গোপন রেখে দেন তবে তার ব্যাপারটি আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেয়া হবে, চাইলে তিনি শাস্তি দিবেন, নচেৎ ক্ষমা করে দিবেন। উবাদাহ (রাঃ) বলেছেন এ সব কথার উপরে আমরা নাবী (সাঃ)-এর নিকট অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম।[2]
ফুটনোটঃ* عَقَبَة (অক্ষর তিনটাতে যবর) এর অর্থ হচ্ছে পাহাড়ের সুড়ঙ্গ বা সংকীর্ণ পাহাড়ী পথ। মক্কা থেকে মিনায় যাতায়াতের জন্য মিনার পশ্চিম দিকে একটি সংকীর্ণ পাহাড়ী পথ দিয়ে যাতায়াত করতে হত। এ সুড়ঙ্গ পথের স্থানটিই ‘আক্বাবাহ নামে প্রসিদ্ধ। দশই জিলহজ্জ্ব তারীখে যে জামরাকে (পাথরের মূর্তি) কংকর নিক্ষেপ করা হয় সেটা এ সুড়ঙ্গ পথের মাথায় অবস্থিত বলে একে জামরায়ে ‘আক্বাবাহ বলা হয়। এ জামরার দ্বিতীয় নাম জামরায়ে কুবরা। বাকী জামরা দুটি পূর্ব দিকে অল্প দূরে অবস্থিত। মিনার যে ময়দানে হাজীগণ অবস্থান করেন সেই প্রান্তরটি তিনটি জামরার পূর্বে রয়েছে কাজেই সমস্ত লোকের ঘুরাফিরা ঐ দিকেই হত এবং কংকর নিক্ষেপের পর এদিকে মানুষের যাতায়াত বন্ধ হয়ে যেত। একারণে নাবী (সাঃ) শপথ গ্রহণের এ সুড়ঙ্গটিকেই নির্বাচন করেছিলেন। এ কারণেই একে বায়আতে ‘আক্বাবাহ বা ‘আক্বাবাহর অঙ্গীকার বলা হয়। পাহাড় কেটে এখন প্রশস্ত রাস্তা তৈরি করা হয়েছে।
[1] রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ৮৫ পৃঃ। ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৩১-৪৩৩ পৃঃ।
[2] সহীহুল বুখারী বাবু বা’দা হালাওয়াতিল ঈমান ১/৭ পৃঃ। বাবু অফদিল আনসার ১/৫৫০-৫৫১ শব্দ এ বাবেরই , বাবু কাওলেহী তা‘আলা, ২য় খন্ড ৭২৭ পৃৃৃঃ। বাবুল হদুদে কাফ্ফারাতুন ২/১০০৩ পৃঃ।
মদীনায় ইসলাম প্রচারকের দল (سَفِيْرُ الْإِسْلَامِ فِيْ الْمَدِيْنَةِ):
অঙ্গীকার সম্পাদিত এবং হজ্বব্রত সম্পন্ন হয়ে গেলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এ লোকদের সঙ্গে ইয়াসরিবে প্রথম ধর্ম প্রচারক দল প্রেরণ করলেন। দ্বিবিধ উদ্দেশ্যে এ প্রচারক দল প্রেরণ করা হয়। প্রথম উদ্দেশ্য ছিল নব দীক্ষিত মুসলিমগণকে ইসলামের আহকাম এবং ধর্মের নিয়ম কানুন শিক্ষা দেয়া। দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটি ছিল যারা এখনও শিরকের উপরেই রয়ে গেছে তাদের নিকট ইসলাম প্রচার করা। নাবী কারীম (সাঃ) এ প্রবাসের জন্য প্রথম অগ্রগামীদের মধ্যে স্বনামধন্য এক যুবককে নির্বাচন করেন যার নাম হল মুসআব বিন উমায়ের আবদারী (রাঃ)।
ফুটনোটঃ
গৌরবময় সফলতা (النَّجَاحُ الْمُغْتَبَطُ):
মুসআব বিন উমায়ের (রাঃ) মদীনায় গিয়ে আস’আদ বিন যুবারাহ (রাঃ)-এর বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং উভয়ে মিলে ইয়াসরিববাসীদের নিকট প্রবল উদ্যম ও উদ্দীপনা নিয়ে ইসলামের প্রচার-প্রচারণার কাজ আরম্ভ করলেন। তাঁর উত্তম প্রচার কার্য্যের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি ‘মুক্বরিউন’ উপাধিতে ভূষিত হন।
মুক্বরিউন অর্থ পাঠদানকারী। সে সময় শিক্ষক বা উস্তাদকে মুক্বরিউন বলা হতো।
প্রচার কার্যের মধ্যে সবচাইতে সফল গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটির কথা এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে। একদিন আস’আদ বিন যুরারাহ তাঁকে সঙ্গে নিয়ে বণী আব্দুল আশহাল ও বণী যাফরের মহল্লায় গমন করলেন এবং সেখানে বণী যাফরের একটি বাগানের মধ্যে ‘মরক’ নামক এক কূয়ার উপরে বসে পড়লেন। সে সময় তাঁদের নিকট কিছু সংখ্যক মুসলিম এসে একত্রিত হলেন। তখন পর্যন্ত বণী আব্দুল আশহালের দু’জন নেতা সা’দ বিন মু’আয ও উসাইদ বিন হুযায়ের শিরকের উপরেই ছিলেন অর্থাৎ মুসলিম হন নি।
তাঁরা যখন তাঁদের আগমনের খবর জানতে পারলেন তখন সা’দ উসাইদকে বললেন, ‘একটু যান এবং তাঁদের উভয়কে বলে দিন যাঁরা আমাদের দুর্বল চিত্তের মানুষগুলোকে বোকা বানাতে এসেছেন তাঁদেরকে সাবধান করে বলে দিন যে, তাঁরা যেন আমাদের মহল্লায় না আসেন। আস’আদ বিন যুরারাহ আমার খালাতো ভাই, কাজেই আপনাকে পাঠাচ্ছি। অন্যথায় এ কাজ আমি নিজেই সম্পন্ন করতাম।’’
উসাইদ (রাঃ) নিজ বর্শা উত্তোলন করে তাঁদের দুজনের নিকট পৌঁছলেন। আস’আদ (রাঃ) তাঁদের আসতে দেখে মুসআবকে বললেন, ‘ইনি নিজ জাতির সরদার, আপনার কাছে আসছেন। এর জন্য আল্লাহর নিকট দু‘আ করুন।’ মুসআব বললেন, ‘যদি তিনি বসেন তাহলে কথা বলব।’ উসাইদ তাঁদের নিকট পৌঁছার পর দাঁড়িয়ে কঠোর ভাষায় কথা বলতে লাগলেন।
বললেন, ‘তোমরা দুজন আমাদের এখানে কেন এসেছে? আমাদের দুর্বল চিত্তের মানুষকে বোকা বানাচ্ছ? যদি তোমাদের প্রাণ বাঁচানোর ইচ্ছা থাকে তাহলে আমাদের নিকট হতে দূরে যাও।’ মুসআব বললেন ‘আপনি কিছুক্ষণের জন্য বসুন এবং কিছু কথাবার্তা শুনন। যদি কোন কথা পছন্দ হয় তা হলে তা গ্রহণ করুন। পছন্দ না হলে বর্জন করুন।’
উসাইদ বললেন, ‘কথা তো ন্যায়সঙ্গতই বলছেন।’ তারপর তিনি নিজ বর্শা মাটিতে পুঁতে দিয়ে বসে পড়লেন। এ সময় মুসআব ইসলামের কথা বলতে লাগলেন এবং কুরআন তিলাওয়াত করলেন। তাঁর বর্ণনায় এ কথা রয়েছে যে, ‘উসাইদকে আল্লাহ তা‘আলার কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে আমরা লক্ষ্য করলাম যে, তাঁর মুখ মন্ডলে একটা চমকের ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এতে আমাদের ধারণা হল যে, তিনি ইসলাম গ্রহণ করবেন।
এরপর তিনি মুখ খুললেন এবং বললেন, আপনারা যেসব কথা বলছেন তার চাইতে উত্তম কথা তো আর কিছুই হতে পারে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আপনারা যখন কাউকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করতে চান তখন কী করেন?
উত্তরে তাঁরা বললেন, ‘আপনি গোসল করুন, পাক-সাফ পরিচ্ছদ পরিধান করুন এবং সত্যের সাক্ষ্য প্রদান করে দু’ রাকায়াত সালাত পড়ুন।’ তিনি গোসল করে নিয়ে পাক সাফ পরিচ্ছদ পরিধান করলেন, কালেমা শাহাদত পাঠ করে সত্যের সাক্ষ্য প্রদান করে দু’ রাকায়াত সালাত আদায় করলেন। তারপর বললেন, ‘আমার পিছনে আরও একজন আছেন।’ যদি তিনি অনুসারী হয়ে যান তা হলে তাঁর সম্প্রদায়ে কেউ পিছনে পড়ে থাকবে না। আমি এখনই তাঁকে আপনাদের খেদমতে প্রেরণ করছি।’ (তাঁর ইঙ্গিত সা’দ বিন মুয়াযের প্রতি ছিল)।
এরপর উসাইদ (রাঃ) নিজ বর্শা উত্তোলন করে সায়াদের নিকট প্রত্যাবর্তন করলেন। তিনি তখন তাঁর স্বজাতীয় লোকজনদের সঙ্গে আলাপ আলোচনায় রত ছিলেন। উসাইদকে আসতে দেখে তিনি বললেন, ‘আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি এ ব্যক্তি তোমাদের নিকট যে চেহারা নিয়ে আসছেন এটা ঐ চেহারা নয় যা নিয়ে তিনি এখান থেকে প্রস্থান করেছিলেন।’ তারপর উসাইদ যখন সভাস্থানে এসে দাঁড়ালেন তখন সা’দ তাঁকে এ বলে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কী করে এলেন?’
তিনি বললেন, ‘আমি তাঁদের দুজনের সঙ্গে কথা বলেছি কিন্তু আল্লাহর কসম কোন প্রকার অন্যায় কিংবা অসুবিধা তো আমার নযরে পড়ল না। তবে তাদের নিষেধ করে দেয়া হয়েছে। তাঁরাও বলেছেন, ‘ঠিক আছে, আপনারা যা চান তা করা হবে।
অধিকন্তু, আমি জানতে পারলাম যে, বণী হারেসের লোকজন আস’আদ বিন যুরারাকে (রাঃ) হত্যা করতে গিয়েছে আর এর কারণ হলো তারা জানে যে, আস’আদ আপনার খালাতো ভাই। কাজেই, তারা চাচ্ছে যে, আপনার সঙ্গে যে চুক্তি রয়েছে তা ভঙ্গ করে দেবে। এ কথা শুনে সা’দ (রাঃ) রাগান্বিত ও উত্তেজিত হয়ে উঠলেন এবং নিজ বর্শা উত্তোলন করে সোজা ঐ দুজনের নিকট গিয়ে পৌঁছলেন। সেখানে গিয়ে দেখলেন যে, তাঁরা নিশ্চিন্তে বসে রয়েছেন। এতে তিনি এ কথা বুঝে গেলেন যে, উসাইদের ইচ্ছা ছিল যে, তিনি যেন তাদের কথা শোনেন। কিন্তু তাঁদের নিকট গিয়ে দাঁড়িয়ে তিনি কঠোর ভাষায় আস’আদ বিন যুরারাকে বলতে লাগলেন, ‘খোদার শপথ! হে আবূ উমামা, আমার ও আপনার মধ্যে যদি আত্মীয়তার বন্ধন না থাকত তবে আপনার কোন দিনই সাহস হতো না যে, আপনি এলাকায় এসে আমার অপছন্দীয় কথাবার্তা বলবেন।’
এ দিকে আস’আদ (রাঃ) পূর্বেই মুসয়াব (রাঃ)-কে এ কথা বলেছিলেন যে, আল্লাহর ওয়াস্তে আপনার নিকট এমন এক নেতা আসছেন যার পিছনে তাঁর সমস্ত জাতি রয়েছে। যদি তিনি আপনাদের কথা মেনে নেন তাহলে কেউই তারা পিছে থাকবে না। এ জন্য মুসয়াব (রাঃ) সা’দ (রাঃ)-কে বললেন, আপনি কেন আগমন করবেন না? আর কেনইবা আমাদের কথা শুনবেন না? যদি কোন কথা পছন্দ হয় তবে গ্রহণ করবেন। আর যদি অপছন্দ হয় তাহলে আমরা আপনার অপছন্দীয় কথা থেকে আপনাকে দূরেই রাখব। সা’দ (রাঃ) বললেন ‘ন্যায়সঙ্গত কথাই তো বলছেন।’ এর পর তিনি আপন বর্শা পুঁতে দিয়ে বসে পড়লেন। মুসয়াব তার নিকট ইসলাম পেশ করলেন এবং কুরআন পাঠ করলেন। তাঁর বর্ণনায় রয়েছে যে, সায়াদের বলার পূর্বেই তাঁর মুখমন্ডলের জৌলুস দেখে তাঁর ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারটি আঁচ করতে পেরেছিলাম। এর পর তিনি মুখ খুললেন এবং বললেন, ‘আপনারা কিভাবে ইসলামে দীক্ষিত করেন।’
তারা বললেন, ‘আপনি গোসল করুন, পাক-সাফ পরিচ্ছদ পরিধান করুন এবং সত্যের সাক্ষ্য প্রদান করে দু’রাকয়াত সালাত আদায় করুন। সা’দ তাই করলেন। এর পর তিনি নিজ বর্শা উত্তোলন করে আপন সম্প্রদায়ের লোকজনদের সভায় গমন করলেন।
তাকে দেখা মাত্রই লোকেরা বললেন, আল্লাহর শপথ! সা’দ যে মুখমন্ডল নিয়ে গিয়েছিলেন তার স্থানে অন্য একটি মুখমন্ডল নিয়ে ফিরে এসেছেন। সা’দ (রাঃ) যখন সভায় উপস্থিত লোকজনদের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘হে বণী আব্দুল আশহাল! তোমরা আমাকে তোমাদের মধ্যে কেমন মনে কর?’ তাঁরা বললেন, ‘আপনি আমাদের নেতা, অগাধ জ্ঞান গরিমার অধিকারী এবং বরকতময় কান্ডারী।’
তিনি বললেন, ‘বেশ ভালো, তবে এখন একটা কথা শোন। কথাটা হচ্ছে এখন থেকে তোমাদের নারী-পুরুষ সকলের সঙ্গে আমার কথা বলা হারাম, যে পর্যন্ত তোমরা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সাঃ)-এর উপর ঈমান না আনছ।’
তাঁর এ কথার এমন একটি প্রতিক্রিয়া হল যে, সন্ধ্যা হতে না হতেই ঐ গোত্রের এমন একটি পুরুষ কিংবা মাহিলা রইল না যারা ইসলাম গ্রহণ করে নি। কেবলমাত্র একজন লোক সে সময়ই ইসলাম গ্রহণ করে নি যাঁর নাম ছিল ইসাইরিম, তাঁর ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারটি উহুদের যুদ্ধকাল পর্যন্ত বিলম্বিত হয়েছিল। উহুদ যুদ্ধের দিন ইসলাম গ্রহণ করে তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং যুদ্ধরত অবস্থায় শাহাদত বরণ করেছিলেন। কালেমায়ে শাহাদত পাঠ করে তিনি ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার অল্প সময় পরেই শহীদ হন। আল্লাহ তা‘আলার উদ্দেশ্যে সিজদাহহ করার সুযোগ তাঁর হয়নি। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, ‘তিনি অল্প পরিশ্রম করে অধিক পুরষ্কার লাভ করলেন।’
মুসয়াব (রাঃ) আস’আদ বিন যুরারাহর বাড়িতে থেকেই ইসলামের প্রচার কাজ চালিয়ে যেতে থাকলেন। কেবলমাত্র বণী উমাইয়া বিন যায়দ, খাতমা ও ওয়ায়েলের বাড়ি ব্যতীত আনসারদের এমন কোন বাড়ি ছিল না যার পুরুষ ও মহিলাদের কিছু সংখ্যক মুসলিম হন নি। বিখ্যাত কবি ক্বায়স বিন আসলাত তাঁদেরই লোক ছিলেন। এরা তাঁরই কথা মান্য করতেন। এ কবিই তাঁদেরকে খন্দকের যুদ্ধ (৫ম হিজরী) পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখেন। যাহোক, পরবর্তী হজ্ব মৌসুম পর্যন্ত, অর্থাৎ ত্রয়োদশ নবুওয়াত বর্ষের হজ্ব মৌসুম আগমনের পূর্বেই মুসয়াব বিন উমায়ের (রাঃ) তাঁর সাফল্যের সংবাদ মক্কায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দরবারে নিয়ে আসেন এবং তাঁকে ইয়াসরিবের গোত্রগুলোর অবস্থা, তাদের রণকৌশল ও প্রতিরক্ষামূলক দক্ষতার উৎকর্ষতা সম্পর্কে অবগত করেন।[1]
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৩৫-৪৩৮ পৃ, ২য় খন্ড ৯০ পৃঃ যাদুল মা’আদ, ২ঢ খন্ড ৫১ পৃঃ।
‘আক্বাবাহর দ্বিতীয় শপথ (بَيْعَةُ الْعَقَبَةِ الثَّانِيَةِ):
নবুওয়াতের ত্রয়োদশ বর্ষে হজ্বের মৌসুমে (জুন, ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে) ইয়াসরিবের সত্তর জনেরও অধিক মুসলিম ফরজ হজ্ব পালনের উদ্দেশ্যে মক্কায় আগমন করেন। তাঁরা নিজ সম্প্রদায়ের মুশরিক হজ্বযাত্রীগণের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ইয়াসরিবের মধ্যে কিংবা মক্কার পথে ছিলেন এমন এক পর্যায়ে, তারা পরস্পর পরস্পরের মধ্যে বলাবলি করতে থাকলেন, ‘আমরা কতদিন আর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে এভাবে মক্কার পাহাড় সমূহের মধ্যে চক্কর ও ঠোক্কর খেতে ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় ফেলে রাখব?’
এ মুসলিমগণ যখন মক্কায় পৌঁছলেন তখন গোপনে নাবী কারীম (সাঃ)-এর সঙ্গে যোগাযোগ আরম্ভ করলেন এবং শেষ পর্যন্ত সর্ব সম্মতিক্রমে এ কথার উপর সিদ্ধান্ত গৃহীত হল যে, আইয়ামে তাশরীকের[1] মধ্য দিবসে (১২ই জিলহজ্জ তারীখে) উভয় দল মিনায় জামরাই উলা, অর্থাৎ জামরাই ‘আক্বাবাহর নিকটে যে সুড়ঙ্গ রয়েছে সেখানে একত্রিত হবেন এবং সে সমাবেশ গোপনে রাতের অন্ধকারে অনুষ্ঠিত হবে। এ ঐতিহাসিক সমাবেশ কিভাবে ইসলাম ও মূর্তিপূজার মধ্যে চলমান সংঘর্ষের মোড় পালটিয়ে দেয় তা একজন আনসার সাহাবীর নিকট থেকে প্রাপ্ত বিবরণ সূত্রে জানা যায়।
কা‘ব বিন মালিক (রাঃ) বলেছেন, ‘আমরা হজ্জের জন্য বের হলাম। আইয়াম তাশরীকের মধ্যবর্তী দিবাগত রাত্রে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সঙ্গে সাক্ষাতের সিদ্ধান্ত গৃহীত হল এবং শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত সময় উপস্থিত হল। আমাদের সঙ্গে আমাদের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা আব্দুল্লাহ বিন হারামও উপস্থিত ছিলেন (যিনি ইসলাম গ্রহণ করেন নি)। মুশরিকগণের মধ্যে একমাত্র তাঁকেই আমরা সঙ্গে নিয়েছিলাম। আমাদের সঙ্গে আগত অন্যান্য মুশরিকদের থেকে আমাদের কাজকর্ম ও কথাবার্তা গোপন রাখছিলাম। কিন্তু আব্দুল্লাহ বিন হারামের সঙ্গে আমাদের কথোপকথন ঠিকভাবেই চলছিল। আমরা তাকে বললাম, ‘হে আবূ জাবির! আপনি আমাদের একজন প্রভাবশালী এবং উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন নেতা। আপনার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সূত্রে আমরা আপনাকে বর্তমান অবস্থা থেকে বের করে আনতে চাচ্ছি যাতে করে আপনি জাহান্নামের ভয়াবহ অগ্নিকুন্ডের ইন্ধন হয়ে না যান। এর পর তাঁকে আমরা ইসলামের দাওয়াত দিলাম এবং বললাম যে, ‘আজ ‘আক্বাবাহয় রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সঙ্গে আমাদের সাক্ষাতের কথাবার্তা আছে’’, তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং আমাদের সাথে ‘আক্বাবাহয় গমন করলেন। তারপর তিনি আমাদের নেতা নির্বাচিত হলেন।
কা‘ব (রাঃ) ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমরা এ রাতেও যথারীতি নিজ নিজ সম্প্রদায়ের সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লাম। কিন্তু যখন রাত্রের তৃতীয় অংশ অতিবাহিত হল তখন আমরা নিজ নিজ তাঁবু থেকে বের হয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য নির্ধারিত স্থানে গেলাম যেমনটি পাখি নিজ বাসা থেকে নিজেকে জড়োসড়ো করে বের হয়। শেষ পর্যন্ত আমরা সকলে গিয়ে ‘আক্বাবাহয় একত্রিত হলাম। আমরা সংখ্যায় ছিলাম মোট পঁচাত্তর জন। তেহাত্তর জন্য পুরুষ এবং দু’জন মহিলা। মহিলা দু’জনের একজন ছিলেন উম্মু আম্মারা নাসীবা বিনতে কা‘ব। তিনি কাবিলা বনু মাযেন বিন নাজ্জারের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন। দ্বিতীয় জন ছিলেন উম্মু মানী আসমা বিনতে ‘আমর। তিনি বনু সালামাহ গোত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন।
আমরা সকলে সুড়ঙ্গে একত্রিত হয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। শেষ পর্যন্ত সে আকাঙ্ক্ষিত মুহূর্তে এসে পড়ল এবং তিনি তশরীফ আনয়ন করলেন। সঙ্গে ছিলেন তার চাচা আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব। যদিও তিনি তখনো নিজ সম্প্রদায়ের ধর্মের উপরই প্রতিষ্ঠিত ছিলেন তবুও তিনি এটা চাচ্ছিলেন যে, আপন ভ্রাতুষ্পুত্রের সমস্যায় উপস্থিত থাকেন যাতে তাঁর পূর্ণ ইত্বমিনান হাসিল হয়ে যায়। তিনিই সর্বপ্রথম কথা বলা আরম্ভ করেন।[2]
ফুটনোটঃ[1] যুল হিজ্জাহ মাসের ১১, ১২, ও ১৩ তারীখের আ্ইয়ামে তাশরীক বলা হয়।
[2] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৪০ ও ৪৪১ পৃঃ।
কথাবার্তার পর্যায় এবং আব্বাস (রাঃ)-এর পক্ষ থেকে সমস্যার নাজুকতার ব্যাখ্যা (بِدَايَةُ الْمُحَادَثَةِ وَتَشْرِيْحُ الْعَبَّاس لِخُطُوْرَةِ الْمَسْئُوْلِيَةِ):
সভার প্রাথমিক কাজকর্ম সম্পন্ন হলে ধর্মীয় ও সামরিক সাহায্যকল্পে সন্ধি ও চুক্তির পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা তৈরির জন্য কথোপকথন আরম্ভ হল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর চাচা আব্বাস (রাঃ) সর্বপ্রথম মুখ খুললেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল তাদের সম্পাদিত চুক্তির ফলে তাদের উপর যে দায়িত্ব কর্তব্য আরোপিত হয়েছে এবং পরিণামে যে নাজুক অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে তা ব্যাখ্যা করা।
কাজেই তিনি বললেন, ‘হে খাযরাজের লোকজন! (আরববাসীগণের নিকট আনসারদের মধ্যে দু’গোত্রের অর্থাৎ খাযরাজ এবং আউস, খাযরাজ নামেই পরিচিত ছিল) আমাদের মধ্যে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর মর্যাদা ও অবস্থান সম্পর্কে তোমরা সকলেই ওয়াকেফহাল রয়েছ। ধর্মের ব্যাপারে আমরা যে মনোভাব পোষণ করি আমাদের সম্প্রদায়ের লোকজনও একই মনোভাব পোষণ করে। আমরা তাঁকে তাঁর বিরুদ্ধবাদীদের অনিষ্ট থেকে হেফাজত করে রেখেছি। তিনি এখন আপন আবাসস্থানে নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে মানসম্মান, শক্তি সামর্থ্য এবং হেফাজতের সঙ্গেই রয়েছেন। কিন্তু এখন তিনি তোমাদের সেখানে গিয়ে তোমাদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য সংকল্পবদ্ধ। এ অবস্থায় যদি এমনটি হয় যে, তোমরা তাঁর কাজকর্মে সাহায্য সহযোগিতা প্রদান করবে এবং তাঁর বিরুদ্ধবাদীদের অনিষ্ট থেকে তাঁকে রক্ষা করার জন্য সচেষ্ট থাকবে তাহলে সব ঠিক আছে, আপত্তির কোন কিছু নেই। তোমরা জিম্মাদারীর যে গুরুভার গ্রহণ করতে যাচ্ছ আশা করি তার গুরুত্ব সম্পর্কে তোমাদের সুস্পষ্ট ধারণা রয়েছে। কিন্তু এমনটি যদি হয় যে, তোমরা তাঁকে নিয়ে গিয়ে আলাদা হয়ে যাবে কিংবা প্রয়োজনে তোমরা তাঁর কোন উপকারে আসবে না তাহলে তাঁকে এখনি ছেড়ে দাও। কেননা, তিনি নিজ আবাসিক নগরীতে আপন সম্প্রদায়ের মধ্যে মান-সম্মান ও হেফাজতের সঙ্গেই রয়েছেন।
কা‘ব (রাঃ) বলেছেন যে, ‘আব্বাস (রাঃ)-কে বললাম, ‘আমরা আপনার কথা শুনেছি।’ তারপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে লক্ষ্য করে বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আপনি কথাবার্তা বলুন এবং নিজের জন্য ও নিজ প্রভূর জন্য যে সন্ধি ও চুক্তি করতে পছন্দ করেন তা করুন’’।[1]
কা‘ব (রাঃ)-এর উত্তর থেকে এটা সহজেই অনুধাবন করা যায় যে, এ বিরাট জিম্মাদারী বহন করা এবং এর অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপজ্জনক পরিণতির ব্যাপারে আনসারগণের দৃঢ় সংকল্প, বাহাদুরী, ঈমান, উদ্যম ও খুলুসিয়াত কোন পর্যায়ের ছিল।
এর পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কথাবার্তা বললেন। তিনি (সাঃ) প্রথমে কুরআন শরীফ থেকে কিছু অংশ তিলাওয়াত করলেন, আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত পেশ করলেন এবং ইসলামের প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি করলেন। এরপর আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করলেন।
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১/ ৪৪২ পৃঃ।
বাইয়াতের দফা সমূহ (بُنُوْدُ الْبَيْعَةِ ):
ইমাম আহমাদ জাবির (রাঃ) হতে বাইয়াতের ঘটনা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। জাবির বলেছেন, ‘আমরা আরয করলাম, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আমরা আপনার নিকট কোন শপথ গ্রহণ করব?’
তিনি বললেন, ‘তোমরা যে কথার উপর শপথ গ্রহণ করবে তা হচ্ছে,
১. সুখে দুঃখে সর্ব অবস্থায় কথা শুনবে ও মেনে চলবে।
২. অভাবে ও স্বচ্ছলতায় একই ধারায় খরচ করবে।
৩. ভাল কাজের জন্য আদেশ করবে এবং মন্দকাজ থেকে বিরত থাকতে বলবে।
৪. আল্লাহর পথে দন্ডায়মান থাকবে এবং আল্লাহর ব্যাপারে কোন ভৎর্সনাকারীর ভৎর্সনার পরওয়া করবে না।
৫. যখন আমি তোমাদের নিকট হিজরত করে যাব তখন আমাকে সাহায্য করবে এবং যেমনভাবে আপন জান মাল ও সন্তানদের হেফাজত করছ সেভাবেই আমার হেফাজত করবে। এ সব করলে তোমাদের জন্য জান্নাত রয়েছে।[1]
কা‘ব (রাঃ)-এর বর্ণনা সূত্রে ইবনে ইসহাক্ব যে আলোচনা করেছেন তাতে শেষ ধারার (৫) কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কুরআন তিলাওয়াত করলেন, আল্লাহর দ্বীনের প্রতি দাওয়াত এবং ইসলাম গ্রহণের প্রতি অনুপ্রেরণা দানের পর বললেন, ‘আমি তোমাদের নিকট এ কথার শপথ গ্রহন করছি যে, তোমরা আমাকে ঐ সকল জিনিস থেকে হেফাযত করবে যে সকল জিনিস থেকে তোমরা আপন ছেলেমেয়ে এবং আত্মীয়-স্বজনদের হেফাজত করে থাক।’ এ কথা বলার পরেই বারা (রাঃ) বিন মা’রুর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হাত ধরে বললেন, ‘ঐ সত্ত্বার শপথ! যিনি আপনাকে সত্য নাবীরূপে প্রেরণ করেছেন, সুনিশ্চিত আমরা আপনাকে ঐ সকল অনিষ্ট থেকে হেফাজত করব, যে সকল অনিষ্ট থেকে আমাদের ছেলেমেয়ে ও আত্মীয়-স্বজনদের হেফাজত করি। অতএব, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আপনি আমাদের আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করুন। আল্লাহর শপথ! আমরা যুদ্ধের সন্তান এবং অস্ত্র আমাদের খেলনা। আমাদের এ পদ্ধতি বাপদাদার কাল থেকে চলে আসছে।
কা‘ব (রাঃ) বলেন যে, বারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলেন এমন সময় আবুল হায়সাম বিন তায়হান কথার ছেদ কেটে বললেন ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের ও কিছু মানুষের অর্থাৎ ইহুদীদের মধ্যে চুক্তি ও সন্ধির বন্ধন রয়েছে, আর আমরা এখন সে বন্ধন ছিন্ন করছি। তা হলে এ রকম তো হবে না যে, আমরা এরূপ করে ফেলি তারপরে আল্লাহ যখন আপনাকে জয়যুক্ত করবেন, তখন আপনি আমাদেরকে ছেড়ে দিয়ে নিজ জাতির দিকে ফিরে যাবেন।’
এ কথা শ্রবণের পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মৃদু হেসে বললেন, ‘না, বরং তোমাদের রক্ত আমার রক্ত এবং তোমাদের ধ্বংস আমার ধ্বংস, আমি তোমাদেরই এবং তোমরাও আমারই। তোমরা যাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবে আমিও তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করব। তোমরা যাদের সঙ্গে সন্ধি করবে আমিও তাদের সঙ্গে সন্ধি করব।[2]
ফুটনোটঃ[1] ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল এটাকে হাসান সনদ বলে উল্লেখ করেছেন এবং ইমাম হাকিম ও ইবনে হেববান সহীহুল বলেছেন, শাইখ আবদুল্লাহ নাজদী মুখতাসারুস সীরাত ১৫৫ পৃঃ। দ্রষ্টব্য ইবনে ইসাহাক উবাদাহ বিন সামিত (রাঃ) থেকে প্রায় অনুরূপ বর্ণনা করেছেন অবশ্য তাতে একটি অধিক ধারা রয়েছে, যা হচ্ছে, রাষ্ট্র কর্ণধারদের সঙ্গে রাষ্ট্রের জন্য বিবাদ করবে না। ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৫৪ পৃঃ।
[2] ইবনে হিশাম ১/৪৪২ পৃঃ।
বাইআতের বিপজ্জনক দিকগুলোর পুনঃ স্মরণ (التَّأْكِيْدُ مِنْ خُطُوْرِةِ الْبَيْعَةِ):
অঙ্গীকারের শর্তাদি সংক্রান্ত আলাপ আলোচনা প্রায় সমাপ্তির পথে এবং লোকজনেরা যখন অঙ্গীকার গ্রহণ আরম্ভ করতে যাচ্ছেন এমন সময় প্রথম সারির দুজন মুসলিম যারা একাদশ বা দ্বাদশ নবুওয়াত বর্ষে হজ্জ্বের মৌসুমে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তাঁরা উঠে পড়েন, যাতে মানুষের সামনে তাদের দায়িত্বের নাজুকতা ও ভয়াবহতা অর্থাৎ সম্ভাব্য বিপদাপদের ব্যাপারটি ভালভাবে ব্যাখ্যা করার প্রেক্ষাপটে সমস্যার সকল দিক ভালভাবে অবহিত হওয়ার পর তারা শপথ গ্রহণ করে। এর পিছনে আরও একটি উদ্দেশ্য ছিল তা হচ্ছে এ সকল লোকজন কতটুকু আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত রয়েছে তা অনুধাবন করা।
ইবনে ইসহাক্ব বলেছেন যে, যখন লোকজন অঙ্গীকার গ্রহণের জন্য একত্রিত হলেন তখন আব্বাস বিন উবাদাহ বিন নাযলাহ বললেন, ‘তোমরা কি জানো যে, তাঁর সাথে (রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রতি ইঙ্গিত ছিল) কোন কথার উপর অঙ্গীকার গ্রহণ করতে যাচ্ছ?’ তাঁরা সমবেত কণ্ঠে উত্তর দিলেন, ‘জী হ্যাঁ’’।
আব্বাস (রাঃ) বললেন, ‘লাল ও কালো মানুষের বিরুদ্ধে জান্নাতের বিনিময়ে যুদ্ধ করার ব্যাপারে তোমরা তাঁর কাছে অঙ্গীকার গ্রহণ করতে যাচ্ছ। যদি তোমাদের এ রকম ধারণা যে, যখন তোমাদের সকল সম্পদ নিঃশেষ হয়ে যাবে এবং তোমাদের দলের সম্ভ্রান্ত লোকজনকে হত্যা করা হবে তখন তোমরা তাঁর সঙ্গ ছেড়ে যাবে তাহলে এখনই ছেড়ে যাও। কেননা , তাঁকে নিয়ে যাওয়ার পর যদি তোমরা তাঁকে ছেড়ে দাও তাহলে ইহ ও পরকালের জন্য তা হবে চরম বেইজ্জতির ব্যাপার। আর যদি তোমাদের ইচ্ছা থাকে যে, তোমাদের ধনমাল ধ্বংসের এবং মর্যাদাসম্পন্ন লোকদের হত্যা সত্ত্বেও এ চুক্তি সম্পন্ন করবে যার প্রতি তোমরা তাকে আহবান করছ তবে অবশ্যই তা গ্রহণ করবে। কেননা, আল্লাহর শপথ! এতেই ইহলৌকিক এবং পরলৌকিক জীবনের জন্য মঙ্গল রয়েছে।
এ কথা শ্রবণের পর সকলেই সমবেত কণ্ঠে বললেন, ‘ধন-সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির এবং সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের হত্যার মতো অত্যন্ত বিপদ সংকুল পরিস্থিতির বিনিময়ে এটা আমরা গ্রহণ করছি। তবে হাঁ একটি প্রাসঙ্গিক কথা, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আমরা যদি যথাযথভাবে এ অঙ্গীকার পূরণ করি তবে প্রতিদানে আমাদের জন্য কি পুরষ্কারের ব্যবস্থা রয়েছে?
তিনি বললেন, ‘জান্নাত’’।
লোকেরা বললেন, ‘আপনার হাত মুবারক প্রশস্ত করুন।’
তিনি হাত প্রসারিত করলে লোকেরা তাঁর হাত ধারণ করে অঙ্গীকার গ্রহণ করলেন।[1]
জাবির (রাঃ)-এর বর্ণনা হচ্ছে অঙ্গীকার গ্রহণের জন্য যে সময় আমরা দাঁড়ালাম সে সময় সত্তর জনের মধ্যে সর্ব কনিষ্ঠ সদস্য আস’আদ বিন যুরারাহ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হাত ধারণ করে বললেন, ‘ইয়াসরিববাসীরা! একটু থেমে যাও। আমরা উটের কলিজা নষ্ট করে (অর্থাৎ দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে) এ বিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে তাঁর খিদমতে উপস্থিত হয়েছি যে, তিনি আল্লাহর রাসূল (সাঃ)। আজ তাঁকে নিয়ে যাওয়ার অর্থ সমস্ত আরববাসীর সঙ্গে শত্রুতা, তলোয়ারের আঘাতে তোমাদের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের হত্যা এবং ধন-সম্পদের অসামান্য ক্ষয়-ক্ষতি। অতএব, যদি এ সব সহ্য করতে পার তবে তাকে নিয়ে চল। এ সবের বিনিময়ে আল্লাহর সমীপে তোমাদের জন্য যে মহা পুরষ্কারের ব্যবস্থা রয়েছে তা হচ্ছে ‘জান্নাত’’। আর যদি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর চাইতে এ সব কিছুই তোমাদের নিকট অধিক প্রিয় হয় তবে এখনই তাঁকে ছেড়ে দাও। এটাই হবে আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য ওজর বা আপত্তি।[2]
ফুটনোটঃ[1]ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৪৬ পৃঃ।
[2] মুসনদে আমেদ।
বাইআতের পূর্ণতা লাভ (عَقْدُ الْبَيْعَةِ):
বাইআতের শর্ত বা দফাসমূহ পূর্বেই নির্ধারণ করা হয়েছিল। এর ভয়াবহ দিক গুলো সম্পর্কে একবার ব্যাখ্যাও প্রদান করা হয়েছিল। যখন এ অতিরিক্ত সতর্কতার কথা বলা হল তখন লোকেরা সমস্বর বলে উঠলেন, ‘আস’আদ বিন যুরারাহ! নিজ হাত হটাও। আল্লাহর কসম! আমরা এ অঙ্গীকার ছাড়তে কিংবা ভঙ্গ করতে পারি না।[1] উপস্থিত জনতার এ উত্তরে আস’আদ বিন যুরারাহ ভালভাবে ওয়াকিফহাল হওয়ার সুযোগ লাভ করলেন যে, লোকেরা আল্লাহর রাসূল (সাঃ)-এর জন্য কতটুকু ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত রয়েছেন। প্রকৃত পক্ষে আস’আদ বিন যুরারাহ মুসআব বিন উমায়েরের সাথে একযোগে মদীনায় ইসলাম প্রচার কার্যে লিপ্ত ছিলেন এবং সব চেয়ে বড় মুবাল্লেগ হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। এ কারণে স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয়া যায় যে, তিনি অঙ্গীকার গ্রহণকারীদের ধর্মীয় নেতাও ছিলেন। ফলে তিনিই সর্বপ্রথম অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন। এ জন্য ইবনে ইসহাক্বের বর্ণনায় রয়েছে যে, বনু নাজ্জার বলেছেন আবূ উমামা আস’আদ বিন যুরারাহ সর্ব প্রথম মানুষ যিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সঙ্গে হাত মিলিয়ে ছিলেন।[2] এরপর সাধারণ অঙ্গীকার অুনষ্ঠিত হয়। জাবির (রাঃ)-এর বর্ণনায় রয়েছে যে, আমরা একে একে দাঁড়ালাম আর নাবী কারীম (সাঃ) আমাদের থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করলেন। আর এর বিনিময়ে জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান করলেন।[3]
অবশিষ্ট রইলেন দুজন মহিলা যাঁরা সেখানেই উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের শপথ হল মৌখিক। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কখনও কোন পরস্ত্রীর সঙ্গে করমর্দন করেন নাই।[4]
ফুটনোটঃ[1] প্রাগুক্ত।
[2] ইবনে ইসহাক্বের বর্ণনায় রয়েছে যে, বুন আব্দুল্ আশহাল বলেছেন সর্ব প্রথম অঙ্গীকার গ্রহণ করেন আবুল হাইশাম বিন তায়্যেহান। কা‘ব বিন মালিক বলেছেন যে, বারা বিন মা’রুর প্রথম অঙ্গীকার গ্রহণ করেন। ইবনে হিশাম ১/৪৪৭ পৃঃ। আমার ধারনায় সম্ভবতঃ আবুল হাইশাম ও বারার সাথে বাইআতের পূর্বে যে কথাবার্তা হয়েছিল তাকেই মানুষ অঙ্গীকার বলে ধরে নিয়েছে। অন্যথায় এ সময় সর্বপ্রথম আগে যাওয়ার অধিকতর অধিকার আস’আদ বিন যুরারারই বয়েছে। আল্লাহই ভাল জানেন।
[3] মুসনাদে আহমাদ।
[4] সহীহুল মুসলিম বাবু কাইফিয়াতে বাইআতিন নিসা ২/ ১৩১ পৃঃ।
বারো জন নকীব (اِثْنَا عَشَرَ نَقِيْبًا):
অঙ্গীকার পর্ব সম্পন্ন হলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অঙ্গীকারাবদ্ধ লোকদের মধ্যে থেকে বারোজন নেতা নির্বাচন করলেন। নির্বাচিত ব্যক্তিগণ নিজ নিজ সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব গ্রহণ করবেন এবং আপন আপন সম্প্রদায়ের মধ্যে অঙ্গীকারের ধারাসমূহ বাস্তবায়ণের ব্যাপারে জিম্মাদারী ও দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর এরূপ ইঙ্গিত ছিল যে, নিজেদের মধ্যে থেকে তাঁরা এমন সব নেতা নির্বাচন করবেন যাঁরা নিজ নিজ সম্প্রদায়ের সমস্যাবলী সমাধানের ব্যাপারে যথোপযোগী ভূমিকা পালন করবেন। তাঁর ইঙ্গিতে তড়িঘড়ি নেতা নির্বাচন পর্ব সমাপ্ত হল। নয়জন খাযরাজ এবং তিন জন আউস গোত্র থেকে মোট বারজন নেতা নির্বাচন করা হল। খাযরাজ গোত্রের নেতাগণের নাম হচ্ছে যথাক্রমেঃ
(১) আস’আদ বিন যুরারাহ বিন আদাস (২) সা’দ বিন রাবী’আহ বিন ‘আমর (৩) আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহাহ বিন সা’লাবাহ (৪) রাফি বিন মালিক বিন আজলান (৫) বারা বিন মা’রুর বিন সাখর (৬) আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর বিন হারাম (৭) উবাদা বিন সামিত বিন ক্বায়স (৮) সা‘দ বিন উবাদাহ বিন অইম (৯) মুনযির বিন ‘আমর বিন খুনাইস।
আউস গোত্রের নেতাগণ হচ্ছেন, (১) উসাইদ বিন হুযাইর বিন সামাক (২) সা’দ বিন খায়সামা বিন হারিস এবং (৩) রিফাআ’হহা বিন আব্দুল মুনযির বিন যুবাইর।[1]
যখন এ সকল নেতার নির্বাচন পর্ব সমাপ্ত হল তখন নাবী কারীম (সাঃ) তাঁদের নিকট থেকে পুনরায় অঙ্গীকার গ্রহণ করলেন। তিনি বললেন, ঈসা (আঃ)-এর পক্ষ যেভাবে হাওয়ারীগণের উপর দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল সেভাবে আজ থেকে আপনাদের উপর আপন আপন সম্প্রদায়ের যিম্মাদারী বা দায়িত্ব অর্পিত হল। আর আমার উপর যিম্মাদারী বা দায়িত্ব ভার রইল সমগ্র মুসলিম জাতির। তাঁরা সকলে এক বাক্যে বলে উঠলেন ‘জী হ্যাঁ’’।[2]
ফুটনোটঃ[1] কেউ কেউ যুবাইর এর পরিবর্তে যুনাইর বলেছেন।
[2] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৪৩-৪৪৬ পৃঃ।
শয়তান চুক্তির কথা ফাঁস করে দিল (شَيْطَانٌ يَكْتَشِفُ الْمُعَاهَدَةَ):
অঙ্গীকার সংক্রান্ত কাজকর্ম সম্পূর্ণ হয়ে গেছে এবং লোকজনেরা এখন নিজ নিজ গন্তব্য স্থান অভিমুখে রওয়ানা হয়ে যাবেন এমন সময় এক শয়তান ব্যাপারটি জেনে ফেলে। যেহেতু ব্যাপার সে জানতে পারে একেবারে শেষ মুহূর্তে এবং তার হাতে এতটুকু সময় ছিল না যে, সে কুরাইশ মুশরিকদের নিকট এ খবর পাঠিয়ে দেয় এবং তারা আকস্মিকভাবে আক্রমণ চালিয়ে এ সুড়ঙ্গের মধ্যেই এদের সকলকে নিঃশেষ করে ফেলে, সেহেতু সে (শয়তান) তাড়াতাড়ি পাহাড়ে একটি উঁচু স্থানে দাঁড়িয়ে এমন উচ্চ কণ্ঠে (যা কদাচিৎ কেউ শুনে থাকবে) ডাক দিল, ‘হে তাঁবু ওয়ালা! মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে দেখ বেদীনেরা এখন তার সঙ্গে রয়েছে। তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য তারা এখানে একত্রিত হয়েছে।’
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘এ হচ্ছে এ সুড়ঙ্গের শয়তান। হে আল্লাহর দুশমন! আমি তোর জন্য অতিসত্ত্বর বেরিয়ে পড়ছি। এরপর তিনি সকলকে বললেন, ‘তোমরা সকলে নিজ নিজ আস্তানায় চলে যাও।[1]
ফুটনোটঃ[1] যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৫১ পৃঃ।
কুরাইশদের উপর আক্রমণের জন্য আনসারদের প্রস্তুতি (اِسْتِعْدَادُ الْأَنْصَارِ لِضَرْبِ قُرَيْشٍ ):
শয়তানের কণ্ঠ নিঃসৃত শব্দ শ্রবণ করে, আব্বাস বিন উবাদাহ বিন নাযলাহ বললেন, ‘ঐ সত্ত্বার শপথ যিনি ন্যায়ের সঙ্গে আপনাকে প্রেরণ করেছেন, আপনি যদি চান তাহলে আমরা কালই তরবারী নিয়ে মিনাবাসীর উপর আক্রমণ চালাই। তিনি (সাঃ) বললেন, ‘আমাকে এ নির্দেশ দেয়া হয়নি।’ অতএব আপনারা নিজ নিজ আস্তানায় চলে যান।’ কাজেই লোকেরা নিজ নিজ আস্তানায় ফিরে গিয়ে শুয়ে পড়লেন। এভাবেই সকাল হয়ে গেল।[1]
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৪৮ পৃঃ।
ইয়াসরিবী নেতৃবৃন্দের সামনে কুরাইশদের বিক্ষোভ (قريش تقدم الاحتجاج إلى رؤساء يثرب):
এ সংবাদ কুরাইশদের কর্ণকুহরে পৌঁছিবা মাত্র অসহনীয় দুঃখে বেদনা হেতু তাদের মাঝে কলরব শুরু হয়ে গেল। কেননা, মুসলিমগণের এ ধরণের অঙ্গীকার ও চুক্তির সুদূর প্রসারী বিরূপ প্রতিক্রিয়া যে তাদের জীবন ও সম্পদের উপরে হবে সেটা ভালভাবেই জানা ছিল। সুতরাং, সকাল হওয়া মাত্র তাদের নেতা ও মাস্তানদের ভারী দল ঐ চুক্তির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখানোর উদ্দেশ্যে মদীনাবাসীদের তাঁবু অভিমুখে যাত্রা করল এবং এইভাবে আবেদন জানাল,
হে খাযরাজের লোকেরা! আমরা অবগত হলাম যে, আপনারা আমাদের এ মানুষটিকে আমাদের নিকট হতে নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছেন ও আমাদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য তার সঙ্গে অঙ্গীকারাবদ্ধ হচ্ছেন। অথচ আরব গোত্র সমূহের মধ্যে শুধুমাত্র আপনাদের সাথে যুদ্ধ করা আমাদের অপছন্দ কাজ।[1]
কিন্তু যেহেতু এ বাইআত অত্যন্ত সঙ্গোপনে রাতের অন্ধকারে অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেহেতু খাযরাজ মুশরিকগণ এ সম্পর্কে মোটেই টের পায় নি। সেজন্য তারা বার বার আল্লহর কসম খেয়ে বলল সে রকম কিছু অনুষ্ঠিত হয় নি। আমরা এ বিষয়ে বিন্দু মাত্র অবগত নই। পরিশেষে বিক্ষোভে শামিল এ দল আব্দুল্লাহ বিন উবাই ইবনু সুলুলের নিকট পৌঁছিল। এ বিষয়ে তাঁর নিকট জানতে চাইলে প্রত্যুত্তরে সে বলল ‘নিশ্চয় এটা বাজে কথা। এমনটি কিছুতেই হতে পারে না যে, আমার সম্প্রদায় আমাকে এড়িয়ে আমার অগোচরে এ রকম কোন কাজ করতে পারে। আমি ইয়াসরাবে থাকতাম, তাহলেও আমার পরামর্শ ছাড়া আমার সম্প্রদায় এরূপ করতনা।
অবশিষ্ট রইলেন মুসলিমগণ, তাঁরা আড় চোখে পরস্পর পরস্পরকে দেখলেন এবং চুপচাপ রইলেন। এমন কি হ্যাঁ কিংবা না বলেও কেউ মুখ খুললেন না। শেষ পর্যন্ত কুরাইশ নেতাদের ধারণা হলো মুশরিকদের কথা সত্য এবং এ কারণে তারা নিরাশ হয়ে ফিরে গেল।
ফুটনোটঃ[1] প্রাগুক্ত।
সংবাদের সত্যতা ও শপথকারীদের পশ্চাদ্ধাধাবন (تَأَكَّدَ الْخَبَرُ لَدَى قُرَيْشٍ وَمُطَارَدَةُ الْمُبَايِعِيْنَ):
মক্কার কুরাইশ নেতাগণ সম্ভবতঃ দৃঢ়তার সঙ্গে এটা ধরেই নিয়েছিল যে, এ সংবাদ মিথ্যা। কিন্তু এর অনুসন্ধানে সর্বদা লেগেই থাকল এবং শেষ পর্যন্ত নিঃসন্দেহে আবগত হল যে, অঙ্গীকার গ্রহণের ঘটনা সত্য। এ ঘটনাটি অবগত হওয়ার পর তারা অঙ্গীকার গ্রহণকারীদের প্রতি মারমুখী হয়ে উঠে। কিন্তু যখন তারা এ সংবাদটি অবগত হল তখন অঙ্গীকারাবদ্ধ হাজীগণ নিজ নিজ গৃহাভিমুখে অনেকটা পথ অগ্রসর হয়ে গিয়েছেন। মক্কাবাসীগণ দ্রুতপদে অগ্রসর হয়েও তাঁদের নাগাল পেলনা। অবশ্য সা’দ বিন উবাদাহ এবং মুনযির বিন ‘আমরকে দেখে ফেলে এবং তাদেরকে তাড়া করতে থাকে। কিন্তু মুনযির অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে তাঁদের নাগালের বাইরে চলে যেতে সক্ষম হন। অবশ্য সা’দ বিন উবাদাহ তাদের হাতে ধরা পড়ে যান। তারা তাঁর হাত দুটো তাঁরই পালানের দড়ি দ্বারা গর্দানের পিছনে বেঁধে দেয়। কষ্ট দিতে দিতে মক্কা পর্যন্ত নিয়ে যায়। কিন্তু সেখানে মুত্ব’ঈম বিন আদী এবং হারিস বিন হারব বিন উমাইয়া এসে তাঁকে ছাড়িয়ে দেন। কারণ, তাদের দুজনের যে বাণিজ্য কাফেলা মদীনার পথ দিয়ে যাতায়াত করত তা সায়াদের আশ্রয়েই চলাচল করত। তাঁকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়ায় আনসারগণ খুবই বিব্রতবোধ করতে থাকেন এবং তাঁকে মুক্ত করার ব্যাপারে উপযুক্ত ব্যবস্থাবলম্বনের জন্য সলা পরামর্শ করতে থাকেন। ইতি মধ্যে দেখা গেল যে, বন্দী দশা থেকে মুক্ত হয়ে তিনি সঙ্গী সাথীদের নিকট প্রত্যাবর্তন করেছেন। এরপর সকলেই নিরাপদে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করলেন।[1]
এটাই হচ্ছে ‘আক্বাবাহর দ্বিতীয় অঙ্গীকার যাকে ‘আক্বাবাহর বড় শপথ বলে অভিহিত করা হয়। এ অঙ্গীকার এমন এক খোলা জায়গায় সম্পাদিত হয়েছিল যা ভালবাসা ও ওয়াদাপালন, সততা, বিচ্ছিন্ন ঈমানদারদের মধ্যে সাহায্য, সহযোগিতা, পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, আস্থা ও বিশ্বাস, আত্মত্যাগ ও বীরত্বের উদ্দীপনায় ভরপুর ছিল। ফলে ইমানদার ইয়াসরিববাসীদের অন্তর মক্কার দুর্বল ভাইদের প্রতি দয়ামায়ায় ভরপুর ছিল। মক্কার অধিবাসী ভাইদের সাহায্য করার জন্য তাঁদের অন্তরে উৎসাহ উদ্দীপনার কমতি ছিল না। অধিকন্তু, তাঁদের প্রতি অত্যাচার কারীদের বিরুদ্ধে দারুণ দুশ্চিন্তা ও ক্রোধছিল। তাঁদের অন্তর এ ভাইদের ভালবাসায় ভরপুর ছিল যাদের না দেখে আল্লাহর ওয়াস্তে ভাই নির্ধারণ করেছিল।
আর এ উৎসাহ উদ্দীপনা ও অনুধাবন শুধু একটি কল্পিত আকর্ষণের ফলই ছিল না, যা সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে শেষ হয়ে যেতে পারে বরং এর উৎস হচ্ছে আল্লাহর প্রতি ঈমান, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রতি ঈমান ও কিতাবের প্রতি ঈমান। অর্থাৎ যে ঈমান অন্যায় অত্যাচারের বড় থেকে বড় শক্তির কাছেও মাথানত করে না। যে ঈমানেরই বদৌলতে (কারণে) এমন সব যুগান্তকারী কর্ম ও কীর্তিমালা স্থাপিত হয়েছে এবং মানবজাতির ইতিহাসে এমন সব অধ্যায় রচিত হয়েছে যার তুলনায় অতীত কিংবা বর্তমান কোন কালেই মিলে না। সম্ভবতঃ ভবিষ্যতেও মিলবে না।
ফুটনোটঃ[1] যা’দুল মা’আদ ২য খন্ড ৫১ পৃঃ। ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৪৮-৪৫০ পৃঃ।
হিজরতের সর্বপ্রথম বাহিনী
‘আক্বাবাহর দ্বিতীয় অঙ্গীকার যখন সুসংবাদ ও সুসংগঠিত রূপ লাভ করল তখন নাস্তিকতা ও মূর্খতার তৃণ শস্য বিহীন মরুভূমিতে ইসলাম মহীরূহের ভিত্তিমূল বহুলাংশে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে উঠল। ইসলামী দাওয়াতের জন্মলগ্ন হতে অদ্যাবধি বিভিন্ন ক্ষেত্রে যতটা সফলতা অর্জন সম্ভব হয়েছিল তার মধ্যে এটাই ছিল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং উল্লেখযোগ্য সফলতা। এরপরই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মুসলিমগণকে এ নতুন দেশে হিজরত করার (দেশত্যাগ করার) অনুমতি প্রদান করেন।
হিজরতের অর্থ ছিল সকল প্রকার সুখ সুবিধা ও আরাম আয়েশ ত্যাগ করে এবং ধন দৌলত ও সহায় সম্পদ সবকিছু পরিত্যাগ করে কেবলমাত্র প্রাণ রক্ষা করা। আর এটা মনে রাখতে হবে যে, মুশরিকবেষ্টিত মুসলিমগণের জীবন যে কোন মুহূর্তে বিপদগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনাই ছিল অধিক। অধিকন্তু পথের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যেকোন স্থানে বিপদ ঘনিয়ে ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। আর ভ্রমণ ছিল এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পানে। জানা ছিল না আগামীতে কোন্ ধরণের বিপদাপদ ও দুঃখ কষ্টের সম্মুখীন তাঁদের হতে হবে।
মুসলিমগণ এ সব জেনে শুনে হিজরত আরম্ভ করে দিলেন। এদিকে মুশরিকরা তাঁদের যাত্রাপথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে শুরু করল। কারণ তারা বুঝতে পারছিল যে, এর মধ্যে বিপদ লুকায়িত রয়েছে। হিজরতের কয়েকটি নমুনা পাঠকগণের খিদমতে পেশ করা হল।
১. সর্ব প্রথম মুহাজির ছিলেন আবূ সালামাহ (রাঃ)। ইবনে ইসহাক্বের মতে তিনি ‘আক্বাবাহর বড় শপথের পূর্বেই হিজরত করেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েরা। যখন তিনি মক্কা শরীফ থেকে যাত্রা করতে চাইলেন তখন তাঁর শ্বশুর পক্ষ বলল, ‘আপনার নিজ প্রাণের ব্যাপারে আপনি আমাদের উপর জয়ী হলেন। কিন্তু আমাদের কন্যাকে আপনার সঙ্গে শহর থেকে শহরে ঘুরে বেড়াতে দিতে পারি না।’
এ কথা বলার পর তাঁরা তাঁর স্ত্রীকে তাঁর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেলেন। এতে আবূ সালামাহ (রাঃ)-এর আত্মীয়-স্বজন অত্যন্ত রাগান্বিত হলেন এবং বললেন, ‘তোমরা যখন এ মহিলাকে আমাদের নিকট থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছ তখন আমরাও আমাদের সন্তানটিকে কিছুতেই থাকতে দিতে পারি না।’
তারপর সন্তানটিকে নিয়ে উভয় পক্ষ টানাটানির ফলে শিশুটির একটি হাত উপড়ে গেল। এমন এক অবস্থার মধ্যে আবূ সালামাহর আত্মীয়-স্বজনেরা শিশুটিকে নিজেদের অধিকারে নিয়ে যান। এ কারণে আবূ সালামাহকে একাকী মদীনা গমন করতে হয়।
এরপর থেকে উম্মু সালামাহ (রাঃ)-এর অবস্থা এমনটি হল যে, প্রত্যহ সকালে তিনি আবতাহ (যেখানে এ ঘটনা ঘটেছিল) আসতেন এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত কান্নাকাটি করতে থাকতেন। এ অবস্থায় তাঁর অতিবাহিত হয়ে যায় প্রায় একটি বছর। তাঁর এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে কোন এক আত্মীয় গভীর মর্মবেদনা অনুভব করতে থাকেন। তিনি বলেন, কেন একে যেতে দিচ্ছ না। অনর্থক কেন তাকে তার স্বামী ও সন্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছ?
এ কথাবার্তার পরিপ্রেক্ষিতে তার আত্মীয়রা তাকে বলল, তুমি যদি ইচ্ছা কর তাহলে স্বামীর নিকট যেতে পার। তখন তিনি সন্তানটিকে তার দাদার বাড়ী হতে ফেরত নিয়ে মদীনার উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেলেন। এ সফর হলো দীর্ঘ পাঁচশত কিলোমিটারের। আর তাঁকে পথ চলতে হবে দুর্গম পাহাড় ও ভয়ংকর সব উপত্যকা হয়ে অথচ তার সাথে কোন সঙ্গী-সাথী নেই। আল্লাহ আকবার! সন্তান সহ যখন তিনি তানঈম গিয়ে পৌঁছলেন তখন উসমান বিন আবূ ত্বালহাহর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হল। অবস্থা অবগত হয়ে সহযাত্রীরূপে মদীনা পৌঁছানোর জন্য নিয়ে গেলেন। যখন জনবসতি দৃষ্টি গোচর হল তখন তিনি বললেন, ‘এ গ্রামে তোমার স্বামী আছেন, এ গ্রামে চলে যাও। আল্লাহ বরকতময়, বরকত দিন’’। এরপর তিনি মক্কার অভিমুখে অগ্রসর হলেন।[1]
২. সুহাইব (রাঃ) যখন হিজরতের ইচ্ছা করলেন, তখন কুরাইশ গোত্রের কাফিরগণ বলল, ‘তুমি যখন আমাদের নিকট এসেছিলে তখন নিকৃষ্ট ভিক্ষুক ছিলে। কিন্তু এখানে আসার পর তোমার অনেক ধন সম্পদ হয়েছে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে। এখন তুমি চাচ্ছ যে, তোমার ধনসম্পদ নিয়ে এখান থেকে চলে যাবে। আল্লাহর কসম! এ কিছুতেই হতে পারে না।’
সুহাইব (রাঃ) বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি যদি আমার ধন-সম্পদ ছেড়ে যাই, তবে কি তোমরা আমার পথ ছেড়ে দিব?
তারা বলল, ‘হ্যাঁ’
সুহাইব বললেন, ‘বেশ ঠিক আছে। চলো আমার ধন-সম্পদ যা কিছু আছে তোমাদেরকে দিয়ে দিই।’ (তারপর তিনি আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূল (সাঃ)-এর মহববতে তার সমস্ত সম্পদ কাফিরদের হাতে তুলে দিলেন)।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন এ খবর জানতে পারলেন তখন আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘সুহাইব লাভবান হয়েছেন, সুহাইব লাভবান হয়েছেন।[2]
৩. উমার বিন খাত্তাব (রাঃ), আইয়াশ বিন আবী রাবী’আহ (রাঃ), হিশাম বিন আস বিন ওয়ায়িল (রাঃ) নিজেদের মধ্যে এটা স্থির করলেন যে, সারিফ-এর তানাযুব স্থানে খুব সকালে একত্রিত হয়ে সেখানে থেকে মদীনা হিজরত করা হবে। উমার (রাঃ) ও আইয়াশ (রাঃ) যথাসময়ে নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হলেন, কিন্তু হিশাম বন্দি হয়ে গেলেন।
এ দিকে উমার (রাঃ) ও আইয়াশ (রাঃ) যখন মদীনায় গিয়ে ‘কুবাতে’ অবতরণ করলেন তখন আবূ জাহল ও তার ভাই হারিস আইয়াশের নিকট উপস্থিত হল। তারা তিন জন ছিল একই মায়ের একই মায়ের সন্তান। তারা দুজন আইয়াশ (রাঃ) কে বলল, ‘তোমার এবং আমাদের মাতা নযর (মানত) মেনেছে যে, যতক্ষণ তোমাকে দেখতে না পাবে ততক্ষণ পর্যন্ত চুল আঁচড়াবে না এবং রোদ ছেড়ে ছায়াতে আশ্রয় নেবে না। এ কথা শ্রবণে আইয়াশ (রাঃ) আপন মায়ের ব্যাপারে অত্যন্ত দয়াদ্র হয়ে পড়লেন। এ অবস্থা দেখে উমার (রাঃ) আইয়াশ (রাঃ)-কে বললেন, ‘দেখ আইয়াশ! আল্লাহর কসম! এরা তোমাকে তোমার ধর্ম থেকে সরিয়ে বিপদে ফেলার জন্য এ কূট কৌশল অবলম্বন করেছে। কাজেই তাদের সম্পর্কে সতর্ক থেকো। আল্লাহর কসম! তোমার মাতাকে যদি উকুনে কষ্ট দেয় তবে সে অবশ্যই ছায়ায় গিয়ে আশ্রয় নেবে। কিন্তু আইয়াশ সে কথায় কর্ণপাত না করে মাতার কসম পূর্ণ করার জন্য ঐ দুজনের সঙ্গে বেরিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন।
উমার (রাঃ) তাঁকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘তোমার মাতার ইচ্ছা পূরণের ব্যাপারে তুমি যখন দৃঢ় সংকল্প তখন তোমার যাতায়াতের সুবিধার্থে আমার উটনীটি নিয়ে যাও। এ হচ্ছে খুবই দ্রুতগামী এবং শান্ত স্বভাবের একে যদি তুমি নিয়ে যাও তাহলে হাতের বাইরে ছেড়ে দেবে না। তাছাড়া মক্কার মুশরিকগণের নিকট হতে কোন প্রকার অনিষ্ট কিংবা অসদাচরণের আশঙ্কা থাকলে পালিয়ে আসবে।
আইয়াশ (রাঃ) উটনীর উপর আরোহণ করে তাদের সঙ্গে যাত্রা করলেন। কিছু পথ অতিক্রম করার পর এক জায়গায় আবূ জাহল বলল, ‘ভাই আমার এ উট নিয়ে তো খুব অসুবিধায় পড়তে হল। তুমি কি আমাকে তোমার পশ্চাতে ঐ উটনীর পিঠে বসিয়ে নেবে?’
আইয়াশ বললেন, ‘ঠিক আছে’ তারপর তিনি উটনীকে বসিয়ে দিলেন।
তারা দুজনে আপন আপন উটকে বসিয়ে দিল যাতে আবূ জাহাল তার উটের পিঠ থেকে নেমে গিয়ে আইয়াশ (রাঃ)-এর উটনীর পিঠে গিয়ে উঠতে পারে। কিন্তু তিনজনেই যখন মাটিতে নেমে পড়ল তখন হঠাৎ তারা দুজনে মিলিতভাবে আইয়াশ (রাঃ)-এর উপর আক্রমণ চালাল এবং দড়ি দিয়ে কষে বেঁধে ফেলল। তারপর তাঁকে এ বাঁধা অবস্থাতেই দিবাভাগে মক্কায় নিয়ে এসে মক্কাবাসীকে লক্ষ্য করে বলল, ‘হে মক্কাবাসী! আপনারা আপনাদের অবোধদের সঙ্গে এরূপ করবেন যেমন আমরা আমাদের অবোধের সঙ্গে করেছি।[3]
হিজরতের দৃঢ় ইচ্ছা পোষণকারীদের সম্পর্কে জানতে পেরে মক্কার মুশরিকগণ তাঁদের সঙ্গে কিরূপ আচরণ করত। তার তিনটি নমুনা এখানে পেশ করা হল। কিন্তু তা সত্ত্বেও হিজরতের ধারা অব্যাহত থাকল যার ফলে ‘আক্বাবাহর বড় অঙ্গীকারের পর মাত্র দু’মাসের বেশী সময় অতিক্রান্ত হতে না হতেই রাসূলুল্লাহ (সাঃ), আবূ বাকর ও আলী রাঃ ব্যতীত কোন মুসলমান মক্কায় অবশিষ্ট ছিলেন না। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)’র নির্দেশে এরা দুজন মক্কাতেই অবস্থান করছিলেন। অবশ্য আরও এমন কিছু সংখ্যক মুসলিম মক্কায় ছিলেন যাদেরকে মুশরিকগণ বল প্রয়োগের মাধ্যমে আটকে রেখেছিল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজ মাল-সামানা গোছগাছ করে রেখে যাত্রার জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি সহকারে আল্লাহ তা‘আলার আদেশের অপেক্ষা করছিলেন। আবূ বাকর (রাঃ)-এর প্রবাসের সামগ্রী বাঁধা ছিল। অর্থাৎ তিনি হিজরতের জন্য প্রস্তুত ছিলেন।[4]
সহীহুল বুখারীতে ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, নাবী কারীম (সাঃ) মুসলিমগণকে বললেন, ‘আমাকে তোমাদের হিজরতের স্থান দেখানো হয়েছে। এটা হচ্ছে লাওয়ার দু’পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত একটি খেজুর বাগানের এলাকা। এরপর মুসলিমগণ মদীনার দিকে হিজরত করলেন। হাবশের সাধারণ মোহাজেরগণও মদীনায় হিজরত করলেন। আবূ বাকর (রাঃ)-ও মদীনায় হিজরতের জন্য জিনিসপত্র গুছিয়ে ফেললেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে বললেন, ‘একটু থেমে যাও। কেননা আশা করছি আমাকেও অনুমতি দেয়া হবে। আবূ বাকর বললেন, ‘আপনার জন্য আমার মাতা-পিতা কুরবান হোক, আপনার জন্যও কি হিজরতের অনুমতি আশা করতে পারি।’
তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ’।
এরপর আবূ বাকর (রাঃ) থেমে গেলেন যেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সঙ্গে সফর করতে পারেন। তাঁর কাছে দুটো উটনী ছিল। তিনি তাদের চার মাস ধরে ভালভাবে বাবলা গাছের পাতা খাইয়ে হৃষ্টপুষ্ট করে তুললেন যাতে তারা অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে পথ চলতে পারে।[5]
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১/৪৬৮-৪৭০ পৃঃ।
[2] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৭৭ পৃঃ।
[3] হিশাম ও আইয়াশ (রাঃ) কাফিরদের বন্দী খানায় পড়ে থাকলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হিজরত করে যাওয়ার পর একদিন বললেন, ‘কে এমন আছে যিনি হিশাম ও আইয়াশকে আমার জন্য ছাড়িয়ে আনবে।’’ অলীদ বিন অলীদ বললেন, ‘আমি তাদেরকে আপনার জন্য ছাড়িয়ে আনার দায়িত্ব নিলাম।’’ তারপর অলীদ গোপনে মক্কা গমন করলেন। একজন স্ত্রীলোকের (যে তাদের দুজনের জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছিল) পিছনে পিছনে গিয়ে তাদের ঠিকানা বের করলেন। এরা দুজনে একটি ছাদ বিহীন গৃহে বন্দী ছিলেন। রাত্রি হলে অলীদ দেওয়াল ডিঙিয়ে তাঁদের নিকট হাজির হলেন এবং বন্দীদশা থেকে মুক্ত করে তাঁদেরকে নিয়ে মদীনায় পালিয়ে এলেন। ইবনে হিশাম ১/৪৭৪-৪৭৬ পৃঃ। উমার (রাঃ) বিশজন সাহাবা’র এক জামায়াতের সঙ্গে হিজরত করেছিলেন সহীহুল বুখারী ১/৬৬৮)।
[4] যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৫২ পৃঃ।
[5] সহীহুল বুখারী বাবু হিজবাতিন নাবী (সাঃ) অসহাবিহী ১ম খন্ড ৫৫৩ পৃঃ।
কুরাইশদের অধিবেশন
সাহাবীগণ (রাঃ) নিজ নিজ ধনসম্পদ ও স্ত্রী পুত্র কন্যাদেরকে সঙ্গে নিয়ে যখন আউস ও খাযরাজ গোত্রের আবাসিক এলাকায় গিয়ে উপস্থিত হলেন তখন মুশরিকদের মধ্যে একটা হৈচৈ পড়ে গেল। চরম দুঃশ্চিন্তা ও মানসিক যন্ত্রণায় তারা এতই অস্থির হয়ে পড়ল যে, ইতোপূর্বে কোন কারণেই তাদের মধ্যে এত অধিক অস্থিরতা পরিলক্ষিত হয় নি। হিজরতের এ ব্যাপারটি ছিল তাদের মূর্তি পূজা, সামাজিক ঐক্যবোধ এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ স্বরূপ।
মুশরিকরা এটা ভালভাবেই অবগত ছিল যে, মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর মধ্যে পূর্ণ নেতৃত্বদান ও পথ নির্দেশনার সঙ্গে সঙ্গে কিরূপ আকর্ষণীয় শক্তি মওজুদ রয়েছে, সাহাবীদের (রাঃ) মধ্যে কিরূপ দৃঢ়তা এবং আত্মত্যাগের উৎসাহ উদ্দীপনা রয়েছে। তাছাড়া আউস ও খাযরাজ গোত্রের মধ্যে কিরূপ শক্তি সামর্থ্য এবং যুদ্ধ করার যোগ্যতা রয়েছে এবং ঐ গোত্রদ্বয়ের জ্ঞানীদের মধ্যে সন্ধি ও পরিচ্ছন্নতার কিরূপ উৎসাহ উদ্দীপনা রয়েছে ও কয়েক বছর ধরে পরিচালিত গৃহযুদ্ধের তিক্ততা আস্বাদনের পর এখন কিভাবে নিজেদের মধ্যকার দুঃখকষ্ট ও শত্রুতা দূরীকরণের জন্য তারা আগ্রহী।
তারা এটাও অনুধাবন করে ছিল যে, ইয়ামান হতে সিরিয়া পর্যন্ত লোহিত সাগরের উপকূল দিয়ে তাদের যে, ব্যবসার জাতীয় সড়ক (রাজপথ) অতিক্রম করছে, এ জাতীয় সড়কে মদীনার সৈনিক অবস্থান কতবেশী গুরুত্বপূর্ণ এমন এক স্পর্শকাতর অবস্থার সম্মুখীন তারা হল। সে সময় সিরিয়ার সঙ্গে মক্কাবাসীদের ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল প্রায় আড়াই লক্ষ দীনার সোনার সমতুল্য। এছাড়া ছিল ত্বায়িফবাসীদের ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপার। আর এ সব ব্যবসা-বাণিজ্য নির্ভর করছিল পথচারী বাণিজ্য কাফেলার নিরাপত্তা বিধানের উপর।
এ বর্ণনা মতে এটা অনুমান করা মোটেই কঠিন ছিল না যে, হিজরতকারী মুসলিমগণের মদীনায় আগমনের ফলে ইসলামী দাওয়াতের ভিত্তি সুপ্রতিষ্ঠিত হলে এবং মদিনাবাসীগণকে মক্কাবাসীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করাতে সক্ষম হলে, তা হবে মক্কাবাসীদের জন্য একটি অত্যন্ত বিপজ্জনক ব্যাপার। মুশরিকেরা উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন ছিল, কাজেই তারা এ চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার জন্য তৎপর হয়ে উঠেল। এটা তাদের জানা কথা যে, এ বিপদের মূলসূত্র হচ্ছে ইসলামের দাওয়াত। যার পতাকাবাহী হচ্ছেন মুহাম্মাদ (সাঃ)।
উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে ‘আক্বাবাহর দ্বিতীয় অঙ্গীকারের আনুমানিক আড়াইমাস পর চতুর্দশ নবুওয়াত বর্ষের ২৬শে সফর মোতাবেক ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার[1] দিবসের প্রথম ভাগে[2] মক্কার সংসদ ভবন দারুন নদওয়াতে কুরাইশ মুশরিকগণ ইতিহাসের সব চাইতে ভয়াবহ অধিবেশন অনুষ্ঠিত করে। এতে সকল কুরাইশগোত্রের নেতৃবৃন্দ অংশ গ্রহণ করে।
আলোচ্য বিষয় ছিল এমন এক অকাট্য পরিকল্পনা তৈরি করা যাতে যত শীঘ্র সম্ভব ইসলামী দাওয়াতের পতাকাবাহীকে (নাবী (সাঃ)-কে) হত্যার মাধ্যমে ইসলামের অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলা সম্ভব হয়।
এ অবস্থায় মারমুখী অধিবেশনে যে সকল গোত্রীয় কুরাইশ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে যথাক্রমেঃ (১) আবূ জাহল বিন হিশাম- বনী মাখযুম গোত্র (২) যুবাইর বিন মুত্ব’ঈম, তু’আইমাহ বিন আদী এবং হারিস বিন ‘আমির- বনী নওফাল বিন আবদে মানাফ থেকে (৩) শাইবাহ বিন রাবী’আহ, উতবাহ বিন রাবী’আহ এবং আবূ সুফইয়ান বিন হারব- বনী আবদে শামস্ বিন আবদে মানাফ থেকে। (৪) নাযর বিন আসওয়াদ ও হাকীম বিন হিযাম- বনী আসাদ বিন আব্দুল উযযা থেকে। (৬) নুবাইহ বিন হাজ্জাজ ও মুনাব্বিহ বিন হাজ্জাজ- বনী সাহম থেকে (৭) উমাইয়া বিন খালফ- বনী জুমাহ থেকে।
নির্ধারিত সময়ে যখন এ সব নেতৃবৃন্দ দারুন নদওয়ায (সংসদভবনে) পৌঁছলেন তখন ইবলীসও সম্ভ্রান্ত পন্ডিতের রূপ ধরে অত্যন্ত অভিজাত মানের পোশাক পরিহিত অবস্থায় রাস্তা ঘিরে দরজার উপর দন্ডায়মান হল। তাকে দেখে লোক সকলে আপোষে বলাবলি করতে লাগল। ‘ইনি কোথাকার শাইখ (পন্ডিত)’’?
ইবলীস বলল, ‘ইনি হচ্ছেন নাজদের শাইখ।’ আপনাদের প্রোগ্রাম শুনে উপস্থিত হয়েছেন, ‘কথাবার্তা শুনতে চান এবং সম্ভব হলে প্রয়োজন মাফিক পরামর্শ দান করতে চান।’
লোকেরা বলল, ‘বেশ ভাল, আপনি ভিতরে আসুন’’।
এ সুযোগে ইবলীস তাদের সঙ্গে ভিতরে গেল।
ফুটনোটঃ[1] এ দিনক্ষণ বা তারীখ আল্লামা সুলায়মান মানসুরপুরীর (সাঃ) গবেষণার আলোকে নির্দিষ্ট করা হল। রহমাতুল্লিল আলামীন ১/৯৫, ৯৭, ১০২, ২য় খন্ড ৪৭১ পৃঃ।
[2] ইবনে ইসহাক্বের বর্ণনা মতে বলা হয়েছে যে, জিবরাঈল (আঃ) নাবী (সাঃ)-এর নিকট এ সভার সংবাদ এনেছিলেন এবং তাঁকে হিজরতের অনুমতি সংবাদ দিলেন। ‘আয়িশাহ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীস থেকে জানা যায় যে, নাবী (সাঃ) ঠিক দুপুরে আবূ বকরের গৃহে এসে বললেন, হিজরতের অনুমতি দেয়া হয়েছে। পূর্ণ বিবরণ পরে আছে।
নাবী (সাঃ)-কে অন্যায়ভাবে হত্যার সিদ্ধান্ত
গণ্যমান্য ব্যক্তিগণের আগমনে সভাকক্ষ পরিপূর্ণ হওয়ার পর বিতর্ক পর্বের সূচনা হল। তারপর প্রস্তাব ও সিদ্ধান্ত আকারে বিতর্ক চলতে থাকল। প্রথমে আবুল আসওয়াদ এ প্রস্তাব পেশ করল যে, ‘আমরা ঐ লোকটিকে আমাদের ভিতর থেকে বের করে দিই এবং এ শহর থেকে বিতাড়িত করি। সে কোথায় যাবে কিংবা কোথায় থাকবে সে ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে আমাদের আর কোনই সম্পর্ক থাকবে না। এ কারণে আমাদের আর কোন সমস্যা থাকবে না এবং পূর্বের অবস্থা আবার ফিরে আসবে।
কিন্তু শাইখ নাজদী বলল, ‘আল্লাহর কসম! এটা সঠিক প্রস্তাব হল না। তোমরা কি দেখতে পাওনা যে, ঐ ব্যক্তির কথা কত চমৎকার এবং কথা বলার ধারা কতটা মধুর। তোমরা দেখনা কিভাবে সে মানুষের মন জয় করে চলেছে। আল্লাহর শপথ! তোমরা যদি এটা কর তবে সে কোন আরব গোত্রে গিয়ে আশ্রয় নেবে এবং তাদেরকে নিজ অনুসারী করে নেবে। তারপর তাদের সঙ্গে সখ্যতা করে তোমাদের শহরে আক্রমণ চালিয়ে তোমাদের কোনঠোসা করে ফেলবে এবং যাচ্ছেতাই ব্যবাহার করবে। তোমরা যে সমাধানের কথা বলছ তা বাদ দিয়ে অন্য সমাধানের কথা চিন্তা করো।’
আবুল বুখতারী বলল, ‘তাকে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে রাখ। বন্দী অবস্থায় তাঁকে ঘরে আবদ্ধ রেখে বাহির থেকে দরজা বন্ধ করে দাও এবং এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতির জন্য (মৃত্যু) অপেক্ষা করতে থাক। যেমনটি ইতোপূর্বে কবিদের বেলায় (যুহাইর, নাবেগা ও অন্যান্য) হয়েছিল।’
শাইখ নাজদী বলল, ‘না, আল্লাহর কসম! এ প্রস্তাব তেমন সঙ্গত বলে মনে হচ্ছে না। আল্লাহর শপথ! যদি তোমরা তাকে বন্দী করো যেমনটি তোমরা বলছ তাহলে তাঁর খবর বন্ধ দরজা দিয়েই বের হয়ে তাঁর সঙ্গীদের নিকট পৌঁছে যাবে। আর তখন তাদের পক্ষে হয়তো এটা অসম্ভব হবে না যে, তারা তোমাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে তাকে মুক্ত করে নিয়ে যাবে। এরপর তারা সম্মিলিতভাবে আক্রমণ চালিয়ে একদম পর্যুদস্ত করে ফেলবে। অতএব, এ প্রস্তাব ও সমর্থন যোগ্য নয়। অন্য কোন সমাধানের কথা চিন্তা করা প্রয়োজন।
এরপর দুটি প্রস্তাবই যখন সংসদ কর্তৃক নাকচ হয়ে গেল তখন পেশ করা হল অন্য একটি প্রস্তাব। এ প্রস্তাবটি পেশ করল মক্কার সব চাইতে কুখ্যাত ব্যক্তি আবূ জাহল। সে বলল, ‘ঐ ব্যক্তি (মুহাম্মাদ সাঃ) সম্পর্কে আমার একটি অভিমত রয়েছে। আমি দেখছি এ যাবৎ তোমরা কেউই সে পর্যন্ত পৌঁছতে পারনি। লোকেরা বলল, ‘আবুল হাকাম! সেটা কী?’
আবূ জাহল বলল, ‘আমাদের প্রস্তাব হল প্রত্যেক গোত্র থেকে একজন করে সুঠাম দেহী ও শক্তিশালী যুবক নির্বাচন করা হোক এবং প্রত্যেককে একটি করে ধারালো তরবারী দেয়া হোক। তারপর সকলেই তার দিকে অগ্রসর হোক এবং সকলেই এক সঙ্গে তলোয়ার মেরে তাকে হত্যা করুক। তাহলেই আমরা তার হাত থেকে নিস্তার পেয়ে যাব। আর এভাবে হত্যা করার ফল হবে রক্তপাতের দায়িত্বটা সকল গোত্রের উপর সমানভাবে ছড়িয়ে পড়বে। এর একটি বিশেষ সুবিধা হবে বনু আবদে মানাফ সকলের সঙ্গে যুদ্ধ করতে সক্ষম হবে না। ফলে (একটি খুনের বদলে একশত উট প্রদান) দিয়াত গ্রহণে রাজী হয়ে যাবে এবং আমরা তা আদায় করে দেব।[1]
শাইখ নাজদী বলল, ‘এ যুবক যে কথা বলল সেটাই কার্যকর থাকল। যদি কোন প্রস্তাব ও সমর্থনের প্রশ্ন আসে তবে এটাই থাকবে, অন্যগুলোর তেমন কোন গুরুত্বই থাকবে না।’
মক্কার সংসদ এমনভাবে এক কাপুরুষোচিত ঘৃণ্য ও জঘন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্য দিয়ে সে দিনের মতো মুলতবী হয়ে গেল। আর সদস্যগণ এ সিদ্ধান্ত ত্বরিৎ বাস্তবায়ণে সংকল্পবদ্ধ হয়ে আপন গৃহে প্রত্যাবর্তন করল।
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৮০-৪৮২ পৃঃ।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হিজরত
আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তা’আলার ইচ্ছে ও কুরাইশদের প্রচেষ্টা (بين تدبير قريش وتدبير الله سبحانه وتعالى):
তারা তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য এমন জঘন্য পরামর্শ সভা অত্যন্ত গোপনে করে যাতে কার্যসিদ্ধির আগ পর্যন্ত কেউ জানতে না পারে। তারা তাদের এতদিন যাবৎ প্রতিরোধের ধরণে পরিবর্তন নিয়ে আসে যা পূর্বের সব সিদ্ধান্তের চেয়ে নিতান্ত ভয়াবহ ও লোমহর্ষক। এটা ছিল কুরাইশদের চক্রান্ত। অন্যদিকে আল্লাহ তা’আলাও কৌশল অবলম্বন করলেন। তাদেরকে এমনভাবে ব্যর্থ করে দেয়া হলো যে তারা বুঝতেও পারল না। তখন জিবরাঈল (আঃ) মহান ও বরকতময় প্রভুর তরফ থেকে আল্লাহর বাণী নিয়ে তার সম্মুখে উপস্থিত হলেন এবং তাকে কুরাইশ মুশরিকদের ষড়যন্ত্রের কথা জনালেন। তিনি বললেন যে, ‘আপনার প্রভু পরওয়ারদেগার মক্কা থেকে হিজরত করার অনুমতি প্রদান করেছেন জিবরাঈল (আঃ) তাঁকে হিজরতের সময় নির্ধারণ করে দিলেন এবং কুরাইশদের কিভাবে প্রতিহত করতে হবে তা বলে দিলেন। অতঃপর বললেন, আপনি এ যাবৎ যে শয্যায় শয়ন করে এসেছেন আজ রাত্রে সে শয্যায় শয়ন করবেন না।[1]
হিজরত সংক্রান্ত আল্লাহর বাণী প্রাপ্ত হওয়ার পর নাবী কারীম (সাঃ) ঠিক দুপুরে আবূ বাকর (রাঃ)-এর গৃহে তশরীফ আনয়ন করলেন। উদ্দেশ্য ছিল, হিজরতের সময় এবং পন্থা প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। ‘আয়িশাহ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, ‘আমরা আব্বাস (আবূ বাকর (রাঃ)-এর) বাড়ীতে ঠিক দুপুরে বসেছিলাম তখন এক ব্যক্তি এসে খবর দিল যে, নাবী কারীম (সাঃ) মাথা ঢেকে আগমন করছেন। এটা দিবা ভাগের এমন সময় ছিল যে সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সাধারণতঃ কোথাও যেতেন না। আবূ বাকর (রাঃ) বললেন ‘আমার মাতা-পিতা আপনার জন্য কোরবান হোক, আপনি এ সময় কোন্ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনার জন্য আগমন করেছেন?’
‘আয়িশাহ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ভিতরে আসার অনুমতি চাইলেন, তাঁকে ভিতরে আসার অনুমতি দেয়া হলে তিনি ভিতরে প্রবেশ করলেন। তারপর আবূ বাকর (রাঃ)-কে বললেন, ‘আপনার কাছে যে সকল লোক রয়েছে তাদের সরিয়ে দিন।’
আবূ বাকর বললেন, ‘যথেষ্ট, আপনার গৃহিনী ছাড়া এখানে আর কেউই নেই। আপনার প্রতি আমার মাতা-পিতা কুরবান হোক, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)।
তিনি বললেন, ‘ভাল, হিজরত করার জন্য আল্লাহ রাববুল আলামীনের তরফ থেকে আমাকে অনুমতি প্রদান করা হয়েছে।
আবূ বাকর বললেন, ‘সাথে… হে আল্লাহর (সাঃ)! আপনার প্রতি আমার পিতামাতা উৎসর্গ হোক।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘হ্যাঁ’’।
তারপর হিজরতের সময় সূচী নির্ধারণ করে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আপন গৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন এবং রাতের আগমনের জন্য প্রতীক্ষারত রইলেন। তিনি (সাঃ) এ দিন এমনভাবে প্রস্তুতি নিলেন যে, হিজরতের উদ্দেশ্যে তাঁর প্রস্তুতির কথা কেউ জানতে পারল না। নচেৎ জানতে পারলে অন্য যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে কুরাইশরা দ্বিধাবোধ করতো না।
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ৪৮২ পৃঃ। যাদুল মাদ ২য় খণ্ড ৫২ পৃঃ।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বাড়ি ঘেরাও (تَطْوِيْقُ مَنْزِلِ الرَّسُوْلِ ﷺ):
এক দিকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন হিজরতের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকলেন, অন্য দিকে মক্কার পাপিষ্ঠরা দারুন নাদওয়ার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকল। উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নিম্ন তালিকাভুক্ত এগার জন পাপীষ্ঠকে নির্বাচন করা হল। তাদের নাম হচ্ছে যথাক্রমেঃ
(১) আবূ জাহল বিন হিশাম, (২) হাকাম বিন আবীল ‘আস, (৩) উক্ববা বিন আবূ মু’আইত্ব, (৪) নাযর বিন হারিস (৫) উমাইয়া বিন খাআফ, (৬) যাম’আহ বিন আসওয়াদ, (৭) তু’আইইমা বিন আদী, (৮) আবূ লাহাব, (৯) উবাই বিন খালাফ, (১০) নুবাইহ বিন হাজ্জাজ এবং তার ভাই (১১) মুনাব্বিহ বিন হাজ্জাজ।[1]
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর স্বভাবগত অভ্যাস ছিল তিনি এশার সালাত পর রাত্রের প্রথম প্রহরে ঘুমিয়ে যেতেন এবং অর্ধ রাত্রিতে জেগে মাসজিদুল হারামে চলে যেতেন। তিনি (সাঃ) সেখানে তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করতেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ‘আলী (রাঃ)-কে বললেন, ‘তুমি আমার এ সবুজ হাযরামী[2] চাদর গায়ে দিয়ে আমার বিছানায় ঘুমিয়ে থাক। তারা তোমার ক্ষতি করতে পারবে না।
অতঃপর রাতের এক তৃতীয়াংশ গত হলো, ধরনীতে নিস্তব্ধতা নেমে এল এবং অধিকাংশ মানুষ ঘুমিয়ে পড়ল- এমন সময় উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গ অতি গোপনে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বাড়িতে হাজির হলো। তাঁকে বাধা দেওয়ার জন্য তারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ঘরের দরজায় অবস্থান করলো। তাদের ধারণা ছিল, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ঘুমিয়ে আছেন, তিনি যখনই বেন হবেন তারা তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের চক্রান্ত বাস্তবায়ন করবে।
তাদের এ ঘৃণ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়ণ ও কার্যকর করার ব্যাপারে তাদের অবস্থা এতই দৃঢ় ছিল যে, কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা কেলাহ ফতেহ করে দেবে। আবূ জাহল চরম অহংকার, উপহাস ও তাচ্ছিল্যের সঙ্গে নাবী (সাঃ)-এর গৃহ ঘেরাওকারী আপন সঙ্গীদের বলল, ‘মুহাম্মাদ (সাঃ) বলছে যে, যদি তোমরা তার ধর্মে প্রবেশ কর, তার অনুসরণ কর তাহলে অনারবদের উপর আরবদের শাসন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। মৃত্যুর পরে আবার যখন তোমাদের উঠানো হবে তখন উরদুনের বাগান সমূহের মতো বাগান দেয়া হবে। আর যদি তোমরা তা না কর তাহলে তার পক্ষ থেকে তোমাদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালানো হবে। আর এ অবস্থায় মৃত্যুর পর আবার যখন তোমাদের উঠানো হবে তখন ঠিকানা হবে জাহান্নাম। সেখানে না কি অনন্ত কাল জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে হবে।[3]
যাহোক, জঘন্যতম এ পাপাচার অনুষ্ঠানের জন্য নির্ধারিত সময় ছিল রাত দুপুরের পরক্ষণ। এ জন্য তারা রাত জেগে সময় কাটাচ্ছিল এবং নির্ধারিত সময়ের জন্য প্রতীক্ষারত ছিল। কিন্তু আল্লাহর ব্যবস্থাই হচ্ছে চূড়ান্ত এবং তাঁর বিজয়ই হচ্ছে প্রকৃত বিজয়। তাঁরই একক এখতিয়ারে রয়েছে আসমান ও জমিনের একচ্ছত্র আধিপত্য। তিনি যা চান তাই করেন। তিনি যাঁকে বাঁচাতে চান কেউই তাঁর কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারে না। আবার তিনি যাকে পাকড়াও করতে চান পৃথিবীর কোন শক্তিই তাকে রক্ষা করতে পারে না। এ প্রসঙ্গে নিম্নের আয়াতে কারীমায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে সম্বোধন করে বলা হয়েছে,
{وَإِذْ يَمْكُرُ بِكَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا لِيُثْبِتُوْكَ أَوْ يَقْتُلُوْكَ أَوْ يُخْرِجُوْكَ وَيَمْكُرُوْنَ وَيَمْكُرُ اللهُ وَاللهُ خَيْرُ الْمَاكِرِيْنَ} [الأنفال:30].
‘‘স্মরণ কর, সেই সময়ের কথা যখন কাফিরগণ তোমাকে বন্দী করার কিংবা হত্যা করার কিংবা দেশ থেকে বের করে দেয়ার জন্য ষড়যন্ত্র করে। তারা চক্রান্ত করে আর আল্লাহ্ও কৌশল করেন। আল্লাহ্ই সর্বশ্রেষ্ঠ কৌশলী।’ (আল-আনফাল ৮ : ৩০)
ফুটনোটঃ[1] যা’দুল মাহদ ২য় খন্ড ৫২ পৃঃ।
[2] হাযমারাউতের (দক্ষিণ ইয়েমেনের) তৈরি চাদরকে হাযরামী চাদর বলা হয়।
[3] প্রাগুক্ত ১ম খন্ড ৪৮৩ পৃঃ।
হিজরতের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর গৃহত্যাগ (الرَّسُوْلُ ﷺ يُغَادِرُ بَيْتَهُ):
কুরাইশ মুশরিকগণ তাদের দুরভিসন্ধি বাস্তবায়নের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েও চরমভাবে ব্যর্থ হয়ে গেল। উন্মত্ত জিঘাংসু শত্রু পরিবেষ্টিত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আলী (রাঃ)-কে বললেন, ‘তুমি আমার এ সবুজ হাযরামী[1] চাদর গায়ে দিয়ে আমার বিছানায় ঘুমিয়ে থাক। তারা তোমার ক্ষতি করতে পারবে না। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এ চাদর গায়ে দিয়েই শুয়ে থাকতেন।[2]
তারপর নাবী কারীম (সাঃ) গৃহের বাহিরে গমন করলেন এবং মুশরিকদের কাতার ফেড়ে এক মুষ্টি কংকরযুক্ত মাটি নিয়ে তাদের মাথার উপর ছড়িয়ে দিলেন। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাদের দৃষ্টি দরে রাখলেন যার ফলে তারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে আর দেখতে পেল না। এ সময় তিনি এ আয়াত কারীমাটি পাঠ করছিলেন,
{وَجَعَلْنَا مِن بَيْنِ أَيْدِيْهِمْ سَدًّا وَمِنْ خَلْفِهِمْ سَدًّا فَأَغْشَيْنَاهُمْ فَهُمْ لاَ يُبْصِرُوْنَ} [يس:9]
‘‘তাদের সামনে আমি একটা (বাধার) প্রাচীর দাঁড় করিয়ে দিয়েছি, আর পেছনে একটা প্রাচীর, উপরন্তু তাদেরকে ঢেকে দিয়েছি; কাজেই তারা দেখতে পায় না।’ (ইয়া সীন ৩৬ : ৯)
এ সময় এমন কোন মুশরিক বাকি ছিল না যার মাথায় তিনি মাটি নিক্ষেপ করেন নি। এরপর তিনি আবূ বাকর (রাঃ)-এর গৃহে গমন করলেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে সঙ্গে নিয়ে ইয়ামান অভিমুখে যাত্রা করলেন। তারপর রাতের অন্ধকার থাকতেই তাঁরা মক্কা থেকে কয়েক মাইল দূরত্বে ‘সাওর’ নামক পর্বত গুহায় গিয়ে পৌঁছলেন।[3]
এদিকে অবরোধকারীরা রাত ১২ টার অপেক্ষা করছিল। কিন্তু তার আগেই তাদের নিকট তাদের ব্যর্থতা ও অক্ষমতার সংবাদ পৌঁছে গেল। অবস্থা হল এই যে, তাদের নিকট এক আগন্তুক এসে তাদেরকে সাঃ-এর দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল ‘আপনারা কিসের জন্য অপেক্ষা করছেন? তারা বলল, ‘আমরা মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে খতম করার অপেক্ষায় রয়েছি।
সে বলল, ‘উদ্দেশ্য সাধনে তোমরা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছ। আল্লাহর কসম! কিছুক্ষণ পূর্বে মুহাম্মাদ (সাঃ) তোমাদের সম্মুখ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছেন। যাওয়ার পূর্বে তিনি তোমাদের মাথার উপর এক মুষ্টি মৃত্তিকা ছড়িয়ে দিয়ে গিয়েছেন।’
তারা বলল, ‘আল্লাহর কসম! আমরা তো তাকে দেখিনি। এ বলে তারা মাথা ঝাড়তে ঝাড়তে দাঁড়িয়ে পড়ল। এরপর দারুণ হতাশা ও ক্রোধের সঙ্গে তারা দরজার ফাঁক-ফোকর দিয়ে গৃহের মধ্যে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে থাকল। চাদর জড়ানো অবস্থায় শায়িত আলী (রাঃ) দৃষ্টি গোচর হলে তারা বলতে লাগল, ‘আল্লাহর কসম! এই তো মুহাম্মাদ (সাঃ) শুয়ে আছে।’ তিনি শুয়ে আছেন এ ভ্রান্ত বিশ্বাস নিয়েই তারা সেখানে সকালের জন্য অপেক্ষা করতে থাকল। এ দিকে যখন সকাল হল এবং আলী (রাঃ) বিছানা ছেড়ে উঠলেন তখন তারা বুঝতে পারল যে, সত্যি সত্যিই মুহাম্মাদ (সাঃ)-নেই। তারা অত্যন্ত ক্রদ্ধ এবং বিক্ষুব্ধ কণ্ঠে আলী (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করল, ‘মুহাম্মাদ (সাঃ) কোথায়’’? হযরত আলী (রাঃ) বললেন, ‘‘আমি জানিনা।’’
ফুটনোটঃ[1] হাযমারাউতের (দক্ষিণ ইয়েমেনের) তৈরি চাদরকে হাযরামী চাদর বলা হয়।
[2] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৮২-৪৮৩ পৃঃ।
[3] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৮৩ পৃঃ। যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৫২ পৃঃ।
গৃহ থেকে গুহা পর্যন্ত (مِنْ الدَّارِ إِلَى الْغَارِ):
রাসূলুল্লাহ ২৭শে সফর চতুর্দশ নবুওয়াত সাল মোতাবেক ১২/১৩ই সেপ্টেম্বর, ৬২২[1] খ্রিষ্টাব্দ মধ্যরাতের সামান্য কিছু সময় পর নিজ গৃহ থেকে বাহির হয়ে জান-মালের ব্যাপারে সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য সঙ্গী আবূ বাকর (রাঃ)-এর গৃহে গমন করেছিলেন এবং সেখান থেকে পিছনের একটি জানালা দিয়ে বাহির হয়ে দুজনই পথ বেয়ে অগ্রসর হতে থাকেন যাতে রাতের অন্ধকার থাকতেই তারা মক্কা নগরীর বাহিরে চলে যেতে সক্ষম হন। কারণ, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জানতেন যে, কুরাইশগণ তাঁকে দেখতে না পেলে সর্বশক্তি দিয়ে তার সন্ধানে লেগে পড়বে এবং সর্বপ্রথম যে রাস্তায় দৃষ্টি দেবে তা হচ্ছে মদীনার কর্মব্যস্ত রাস্তা যা উত্তর দিকে গেছে। এ জন্য তাঁরা সেই পথে যেতে থাকলেন যে পথটি ছিল সেই পথের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। অর্থাৎ ইয়ামান যাওয়ার পথ যা মক্কার দক্ষিণে দিকে অবস্থিত ছিল। এ পথ ধরে পাঁচ মাইল দূরত্ব অতিক্রম করে সুপ্রসিদ্ধ সওর পর্বতের পাদদেশে গিয়ে পৌঁছলেন। এ পর্বতটি ছিল খুব উঁচু, পর্বত শীর্ষে আরোহণের পথ ছিল অাঁকা-বাঁকা ও পাক জড়ানো। আরোহণের ব্যাপারটিও ছিল অত্যন্ত আয়াস-সাধ্য। এ পর্বত গাত্রের এখানে-সেখানে ছিল প্রচুর ধারালো পাথর যা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পদযুগলকে ক্ষত-কিক্ষত করে ফেলেছিল। বলা হয়েছে যে, তিনি পদচিহ্ন গোপন করার জন্য আঙ্গুলের উপর ভর দিয়ে চলছিলেন। এ জন্য তাঁর পা জখম হয়েছিল। যাহোক, আবূ বাকর (রাঃ)-এর সহায়তায় তিনি পর্বতের শৃঙ্গদেশে অবস্থিত গুহার পাশে গিয়ে পৌঁছলেন। এ গুহাটিই ইতিহাসে ‘গারে সওর বা সওর গুহা’ নামে পরিচিত।[2]
ফুটনোটঃ[1] রাহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ৯৫ পৃঃ। সফরের এ মাস চতুর্দশ নবুওয়াত বর্ষের ঐ সময় হবে যখন বৎসর আরম্ভ হবে মুহারম মাসে। আর যদি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যে মাসে নবুওয়াত প্রাপ্ত হয়েছিলেন সে মাস থেকে বৎসর গণনা করা হয়ে থাকে তাহলে তা ছিল নবুওয়াত ত্রয়োদশ বর্ষের সফর মাসে। সাধারণ ইতিহাসবিদগণ প্রথম হিসাবটি গ্রহণ করেছেন। আর যাঁরা দ্বিতীয়টি গ্রহণ করেছেন, তাঁরা ঘটনার ক্রমধারায় ভুল করেছেন। আমি মুহাররম থেকে বছরের শুরু ধরেছি।
[2] রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ৯৫ পৃঃ। শাইখ আবদুল্লাহ মুখাতসারুস ১৬৭ পৃঃ।
গুহায় প্রবেশ (إِذْ هُمَا فِي الْغَارِ):
গুহার নিকট উপস্থিত হয়ে আবূ বাকর (রাঃ) বললেন, ‘আল্লাহর ওয়াস্তে আপনি এখন গুহায় প্রবেশ করবেন না। প্রথমে আমি প্রবেশ করে দেখি এখানে অসুবিধাজনক কোন কিছু আছে কিনা। যদি তেমন কিছু থাকে তাহলে প্রথমে তা আমার সম্মুখীন হবে এবং এর ফলে আপনাকে প্রাথমিক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে না। এ কথা বলার পর আবূ বাকর (রাঃ) গর্তের ভিতরে প্রবেশ করলেন এবং প্রথমে গর্তটি পরিষ্কার করে নিলেন। গর্তের এক পাশে কিছু ছিদ্র ছিল। নিজের কাপড় টুকরো টুকরো করে তিনি ছিদ্রপথের মুখগুলো বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু কাপড়ের টুকরোর ঘাটতির কারণে দুটো ছিদ্র মুখ বন্ধ করা সম্ভব হল না। আবূ বাকর (রাঃ) ছিদ্র দুটোর মুখে নিজ পদদ্বয় স্থাপন করার পর ভিতরে আগমনের জন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট আরয করলেন। তিনি ভিতরে প্রবেশ করে আবূ বাকর (রাঃ)-এর উরুতে মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লেন।
এদিকে আবূ বাকর (রাঃ)-এর পায়ে ছিদ্র মধ্যস্থিত স্বর্প কিংবা বিচ্ছু কোন কিছুতে দংশন করল। তিনি বিষে কাতর হয়ে উঠলেন অথচ নড়াচড়া করলেন না এ ভয়ে যে, এর ফলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ঘুম ভেঙ্গে যেতে পারে। এদিকে বিষের তীব্রতায় তাঁর চক্ষু যুগল থেকে অশ্রু ঝরতে থাকল এবং সেই আশ্রু বিন্দু ঝরে পড়ল রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মুখমন্ডলের উপর। এর ফলে তাঁর ঘুম ভেঙ্গে গেলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আবূ বাকর (রাঃ)! তোমার কী হয়েছে?’’
তিনি আরয করলেন, ‘আমার মাতা-পিতা আপনার জন্য কুরবান হউক, গর্তের ছিদ্র পথে কোন কিছু আমার পায়ে কামড় দিয়েছে। এ কথা শ্রবণের পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজের মুখ থেকে কিছুটা লালা নিয়ে সেই ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিলেন। ফলে আবূ বাকর (রাঃ)-এর দংশন জনিত বিষব্যথা দূরীভূত হল।[1] এ পর্বত গুহায় তাঁরা উভয়ে একাদিক্রমে তিন রাত্রি (শুক্র, শনি ও রবিবার রাত্রি) অবস্থান করলেন।[2] আবূ বাকর (রাঃ)-এর পুত্র আব্দুল্লাহও ঐ সময় একই সঙ্গে সেখানে রাত্রি যাপন করতেন। ‘আয়িশাহ (রাঃ)-এর বর্ণনাতে তিনি ছিলেন একজন কর্মঠ, বুদ্ধিমান ও ধীশক্তিসম্পন্ন যুবক। সকলের অগোচরে রাত গভীর হলে তিনি সেখানে যেতেন এবং সাহরী সময়ের পূর্বেই মক্কায় ফিরে এসে মক্কাবাসীগণের সঙ্গে মিলিত হতেন। এতে মনে হতো যেন তিনি মক্কাতেই রাত্রি যাপন করেছেন। গুহায় আত্মগোপনকারীগণের বিরুদ্ধে মুশরিকগণ যে সকল ষড়যন্ত্র করত তা অত্যন্ত সঙ্গোপনে তিনি তাঁদের নিকট পৌঁছিয়ে দিতেন।
এদিকে আবূ বাকর (রাঃ)-এর গোলাম ‘আমির বিন ফুহাইরা পর্বতের ময়দানে ছাগল চরাত এবং যখন রাত্রির এক অংশ অতিবাহিত হয়ে যেত তখন সে ছাগল নিয়ে গারে সওরের নিকটে যেত এবং আত্মগোপনকারী নাবী (সাঃ) এবং তাঁর সাহাবীকে (রাঃ) দুগ্ধ পান করাত। আবার প্রভাত হওয়ার প্রাক্কালে সে ছাগলের পাল নিয়ে দূরে চলে যেত। পরপর তিন রাত্রেই সে এরূপ করল।[3] অধিকন্তু, আব্দুল্লাহ বিন আবূ বকরের গমনাগমন পথে তাঁর পদ চিহ্নগুলো যাতে মিশে যায় তার জন্য ‘আমির বিন ফুহাইরা সেই পথে ছাগল খেদিয়ে নিয়ে যেত।[4]
ফুটনোটঃ[1] উমার বিন খাত্তাব থেকে ইমাম রাযীন একথা বর্ণনা করেছেন। এ রেওয়ায়েতে এটা আছে যে, মৃত্যুর প্রান্তকালে এ বিষ তাঁর দেহে প্রতিক্রিয়া করল এবং এটাই ছিল তাঁর মৃত্যুর প্রত্যক্ষ কারণ, মিশকাত ২য় খন্ড ৫৫৬ পৃঃ। বাবু মানাকেবে আবূ বকর দ্রঃ।
[2] ফাতহুল বারী ৭ম খন্ড ৩৩৬ পৃঃ।
[3] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৫৫৩-৫৫৪ পৃঃ।
[4] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৮৬ পৃঃ।
কুরাইশদের প্রচেষ্টা:
এদিকে কুরাইশদের অবস্থা এই ছিল যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে হত্যার উন্মাদনায় উন্মত্ত অবস্থায় রাত্রি অতিবাহিত করার পর প্রভাতে যখন তারা নিশ্চিতভাবে জানতে পারল যে, তিনি তাদের আয়ত্বের বাইরে চলে যেতে সক্ষম হয়েছেন, তখন তারা একদম দিশেহারা হয়ে পড়ল এবং ক্রোধের আতিশয্যে ফেটে পড়তে চাইল। তাদের ক্রোধের প্রথম শিকার হলেন আলী (রাঃ)। তাঁকে টেনে হিঁচড়ে ক্বাবা’হ গৃহ পর্যন্ত নিয়ে গেল এবং প্রায় এক ঘন্টা কাল যাবৎ তাঁর উপর নানাভাবে নির্যাতন চালাল যাতে তার নিকট থেকে তাঁদের দুজনের সম্পর্কে খোঁজ খবর কিছুটা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়।[1] কিন্তু তাঁর কাছ থেকে কোন সংবাদ গ্রহণ করা সম্ভব না হওয়ায় আবূ বাকর (রাঃ)-এর গৃহের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল এবং সেখানে গিয়ে দরজায় করাঘাত করল। দরজার করাঘাত শুনে আসমা বিনতে আবূ বাকর (রাঃ) বের হলেন। তারা তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার পিতা কোথায় আছেন?’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহই ভাল জানেন, আমি জানি না আববা কোথায় আছেন?’ এতে কমবখত খবীস আবূ জাহল তাঁর গন্ডদেশে এমন জোরে চপেটাঘাত করল যে, সে ব্যথার চোটে চিৎকার করে উঠল এবং তার কানের বালী খুলে পড়ে গেল।[2]
এরপর কুরাইশগণ একটি তড়িঘড়ি সভা করে সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল যে, তাঁদের ধরার জন্য অনতিবিলম্বে সম্ভাব্য সর্বপ্রকার ব্যবস্থা অবলম্বন করা হোক। ফলে মক্কা থেকে বেরিয়ে যে দিকে যত পথ গেছে সকল পথেই অত্যন্ত কড়া সশস্ত্র পাহারা বসিয়ে দেয়া হল। অধিকন্তু, সর্বত্র এ ঘোষণাও প্রচার করে দেয়া হল যে, যদি কেউ মুহাম্মাদ (সাঃ) এবং আবূ বাকর (সাঃ)-কে অথবা দুজনের যে কোন একজনকে জীবন্ত কিংবা মৃত অবস্থায় হাজির করতে পারবে তাকে একশত উষ্ট্রের সমন্বয়ে একটি অত্যন্ত মূল্যবান পুরষ্কার প্রদান করা হবে।[3]
এই প্রচারনার ফলে বিভিন্ন বাহনারোহী, পদাতিক ও পদচিহ্নবিশারদগণ অত্যন্ত জোরে শোরে অনুসন্ধান কাজ শুরু করে দিল। প্রান্তর, পর্বতমালা, শস্যভূমি, বিরান অঞ্চল সর্বত্রই তারা অনুসন্ধান কাজ চালিয়ে যেতে থাকল, কিন্তু ফল হল না কিছুই।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও আবূ বাকর (রাঃ) যে পর্বত গুহায় আত্মগোপন করে ছিলেন অনুসন্ধানকারীগণ সে গুহার প্রবেশ পথের পার্শ্বদেশে পৌঁছে গেল, কিন্তু আল্লাহ আপন কাজে জয়ী হলেন। সহীহুল বুখারী শরীফে আনাস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যে, ‘আবূ বাকর (রাঃ) বলেছেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সঙ্গে গুহায় থাকা অবস্থায় মাথা তুলে মানুষের পা দেখতে পেলাম।’ আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর নাবী (সাঃ) তাদের মধ্যে কেউ যদি শুধু নিজ দৃষ্টি নীচের দিকে নামায় তাহলেই আমাদেরকে দেখে ফেলবে।’
তিনি বললেন, [اُسْكُتْ يَا أَبَا بَكْرٍ، اِثْنَانِ، اللهُ ثَالِثُهُمَا] ‘আবূ বাকর (রাঃ) চুপচাপ থাক। আমরা দুজন, আর তৃতীয় জন আছেন আল্লাহ তা‘আলা।’ অন্য একটি বর্ণনায় ভাষা এরূপ আছে, [مَا ظَنُّكَ يَا أَبَا بَكْرٍ بِاِثْنَيْنِ اَللهُ ثَالِثُهُمَا] ‘হে আবূ বাকর (রাঃ) এরূপদুজন লোক সম্পর্কে তোমার কী ধারণা যাদের তৃতীয়জন হলেন আল্লাহ।[4]
প্রকৃত কথা হচ্ছে এটা ছিল একটি মো’জেযা (অলৌকিক ঘটনা) যা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নাবী (সাঃ)-কে প্রদান করেছিলেন। কাজেই অনুসন্ধানকারীগণ সে সময় ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হল যেখানে তিনি (সাঃ) ও তাদের মধ্যে ব্যবধান ছিল কয়েক ফুটেরও কম।
ফুটনোটঃ[1] রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ৯৬ পৃঃ।
[2] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৮৭ পৃঃ।
[3] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৫৫৪ পৃঃ।
[4] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৫১৬, ৫৫৮ পৃঃ। এক্ষেত্রে অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে যে, আবূ বকর (রাঃ)-এর অস্থিরতার কারণ নিজ প্রাণের ভয় নয় বরং এর একমাত্র কারণ ছিল যা এ রিওয়ায়েতে বর্ণনা করা হয়েছে যে, যখন আবূ বকর (রাঃ) পদরেখা বিশারদগণকে দেখেছিলেন তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সম্পর্কে তাঁর চিন্তা হল। তিনি বললেন, ‘আমি যদি মারা যাই তবে কেবলমাত্র আমি একজন লোকই মরব। কিন্তু যদি আপনাকে হত্যা করা হয়, তাহলে পুলো উম্মতটাই ধ্বংস হয়ে যাবে। এ সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছিলেন ‘চিন্তা করবেন না। অবশ্যই আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন। দ্রঃ শেখ আব্দুল্লাহ কৃত মুখতাসারুস সীরাহ ১৬৮ পৃঃ।
মদীনার পথে (فِي الطَّرِيْقِ إِلَى الْمَدِيْنَةِ):
তিনদিন যাবৎ নিস্ফল দৌড়ঝাঁপ এবং খোঁজাখুঁজির পর যখন কুরাইশদের আকস্মিক প্রজ্জ্বলিত ক্রোধাগ্নি কিছুটা প্রশমিত হওয়ায় অনুসন্ধান কাজের মাত্রা মন্দীভূত হয়ে এল এবং তাদের উৎসাহ উদ্দীপনা কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ল তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এবং আবূ বাকর (রাঃ) মদীনার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করার জন্য সংকল্পবদ্ধ হলেন। আব্দুল্লাহ বিন আরীকাত লাইসী যিনি সাহারা জনমানবশুন্য পথ সম্পর্কে অভিজ্ঞ ছিলেন, মদীনায় পৌঁছিয়ে দেয়ার জন্য পূর্বে তাঁর সঙ্গে চুক্তি ও মজুরী নির্ধারিত হয়েছিল এবং তার নিকট দুটি বাহনও রাখা হয়েছিল। ঐ ব্যক্তি তখনো কুরাইশ মূর্তিপূজকদের দলভুক্ত থাকলেও পথ প্রদর্শক হিসেবে তাঁর উপর নির্ভর করার ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ ছিল না। তাঁর সঙ্গে এ মর্মে কথাবার্তা ছিল যে, তিন রাত্রি অতিবাহিত হওয়ার পর চতুর্থ রাত্রিতে বাহন দুটি নিয়ে তাকে গারে সওর পৌঁছতে হবে। সেই কথা মোতাবেক সোমবারের দিবাগত রাত্রিতে বাহন দুটি নিয়ে উপস্থিত হয়ে (সেটি ছিল ১ম হিজরী সনের রবিউল আওয়াল মাসের চাঁদনী রাত মোতাবেক ১৬ই সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিষ্টাব্দ) বললেন ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ)! আমার বাহন দুটির মধ্যে একটি আপনি গ্রহণ করুন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, মূল্যের বিনিময়ে।
এদিকে আসমা বিনতে আবূ বাকর (রাঃ) সফরের সামগ্রী নিয়ে এলেন কিন্তু তাতে ঝুলানোর জন্য বন্ধনের রশি লাগাতে ভুলে গিয়েছিলেন। যখন যাত্রার সময় হয়ে এল এবং আসমা (রাঃ) সামগ্রী ঝুলাতে গিয়ে দেখলেন তাতে বন্ধন রশি নেই, তখন তিনি তাঁর কোমরবন্ধ খুললেন এবং তা দু ভাগে ভাগ করে ছিঁড়ে ফেললেন। তারপর এক অংশের সাহায্যে সামগ্রী ঝুলিয়ে দিলেন এবং দ্বিতীয় অংশের সাহায্যে কোমর বাঁধলেন। এ কারণেই তার উপাধি হয়েছিল যাতুন নিত্বাক্বাইন।[1]
এরপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও আবূ বাকর (রাঃ) উটের পিঠে আরোহণ করলেন। ‘আমর বিন ফুহায়রাও সঙ্গে ছিলেন। পথ প্রদর্শক আব্দুল্লাহ বিন আরীকাত মদীনা যাত্রার সাধারণ পথে না গিয়ে লোহিত সাগরের উপকূলের পথ ধরলেন। সর্বপ্রথম সওর গুহা হতে যাত্রা আরম্ভ করে তিনি (পথ প্রদর্শক) ইয়ামেনের পথে যাত্রা করলেন এবং দক্ষিণ দিকে অনেক দূর পর্যন্ত নিয়ে গেলেন। তার পরে পশ্চিমদিকে ঘুরে সমুদ্রোপকূলের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন। তারপরে এমন এক পথে নিয়ে গেলেন যে পথের সন্ধান সাধারণ লোকেরা জানত না। এরপর উত্তর দিকে মোড় নিলেন যে পথ লোহিত সাগরের খুব কাছাকাছি ছিল। এপথে খুব অল্প মানুষ চলাচল করত।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এ পথে যে সকল স্থান দিয়ে অতিক্রম করেছিলেন ইবনে ইসহাক্ব তার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন পথপ্রদর্শক যখন তাদের দুজনকে নিয়ে বের হলেন তখন মক্কার নিম্নভূমি অঞ্চল দিয়ে নিয়ে গেলেন এরপর উপকূল দিয়ে চলতে চলতে ‘উসফানের নিম্ন দিয়ে পথ কাটলেন। এরপর আমাজের নিম্নদিয়ে এগিয়ে চললেন এবং কুদাইদ পার হয়ে রাস্তা কাটলেন। তারপর সান্নায়াতুল মাররাহ দিয়ে তারপরে লিক্বফ দিয়ে তার পরে লিক্বফের বিস্তৃতি ভূমি অতিক্রম করেন। তারপর হাজ্জাজের বিস্তৃীর্ণ ভূমিতে পৌঁছলেন এবং সেখান থেকে মিযাযের মোড় দিয়ে অতিক্রম করেন। তারপর যুল গুযওয়াইনের মোড়ের শস্য শ্যামল ভূমিতে যান। তারপরে যূ কাশর মাঠে প্রবেশ করে জুদাজাদের দিকে যান এবং সেখান থেকে আজরাদে পৌঁছেন। এরপর মাদজালাহ তি’হিনের বিস্তৃীর্ণ অঞ্চলের পাশ দিয়ে যু সালাম অতিক্রম করেন। সেখান থেকে আবাবীদ তাপরে ফাজহ অভিমুখে যাত্রা করেন। তারপরে ‘আরজে অবতরণ করলেন। তারপরে রকূবার ডান পার্শ্ব দিয়ে সান্নায়াতুল ‘আয়িরে গেলেন এবং রি’ম উপত্যকায় অবতরণ করেন। এরপরই কুবায় গিয়ে পৌঁছলেন।[2]
ফুটনোটঃ[1] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৫৫৩-৫৫৫ পৃঃ। ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৮৬ পৃঃ।
[2] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৯১-৪৯২ পৃঃ।
পথে ঘটিত কতিপয় বিচ্ছিন্ন ঘটনা (وَهَاكَ بَعْضُ مَا وَقَعَ فِي الطَّرِيْقِ):
১. সহীহুল বুখারী শরীফে আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, ‘আমরা (গারে সওর থেকে বেরিয়ে) একটানা সারা রাত এবং পরের দিন দুপুর পর্যন্ত চলতে থাকলাম। রোদের প্রখরতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ক্রমান্বয়ে পথচারীর সংখ্যা কমতে থাকল এবং ঠিক দুপুরে পথ জনশূন্য হয়ে গেল। আমরা তখন দীর্ঘ বড় পাথর দেখতে পেলাম যার ছায়ায় তখনো রোদ আসেনি। আমরা সেখানে নেমে পড়লাম। আমি নিজ হাতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর শয়নের জন্য একটি জায়গা সমতল করে দিলাম এবং সেখানে একখানা চাদর পেতে দিয়ে বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আপনি এখানে শয়ন করুন আর আমি আপনার আশ-পাশের সব কিছু দেখাশুনা করছি। তিনি শয়ন করলেন এবং আমি সামনে ও পেছনের খোঁজ খবর নেওয়া এবং দেখাশোনার জন্য বেরিয়ে পড়লাম। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম একজন রাখাল তার ছাগলের পাল নিয়ে পাথরের দিকে চলে আসছে। সেই পাথর থেকে সেও ঐ জিনিসই চাচ্ছে যা আমরা চেয়েছিলাম। আমি তাকে বললাম, ‘হে যুবক তুমি কার লোক?’
সে মক্কা অথবা মদীনার কোন লোকের কথা বলল। আমি তাকে বললাম, ‘তোমার ছাগীর ওলানে কি কিছু দুধ আছে?’ সে বলল, ‘হ্যাঁ’’। আমি পুনরায় বললাম, ‘সেটি কি দোহন করতে পারি?’ সে বলল, ‘হ্যাঁ’’। তারপর সে একটি ছাগী ধরে নিয়ে এল। আমি বললাম, ‘মাটি, খড়কুটো এবং লোম থেকে ওলানটা পরিষ্কার করে নাও। পরিষ্কার করে নেয়ার পর একটি পেয়ালায় অল্প কিছুটা দুধ দোহন করল। তারপর দুধটুকু আমি একটি চামড়ার পাত্রে ঢেলে নিলাম। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পানি এবং ওযুর জন্য ঐ পাত্রটি আমি সঙ্গে নিয়েছিলাম।
আমি দুগ্ধ পাত্র হাতে রাসূলুল্লাহর নিকট এসে দেখি তখনো তিনি ঘুমন্ত অবস্থায় রয়েছেন। কাজেই, তাকে ঘুম থেকে জগানোর সাহস হল না। তারপর যখন তিনি জাগ্রত হলেন তখন আমি দুধের মধ্যে কিছুটা পানি ঢেলে দিলাম যাতে দুধের তলদেশ ঠান্ডা হয়ে যায় এবং বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এ দুগ্ধটুকু পান করুন’’, তিনি পান করলেন। তাকে পান করানোর সুযোগ প্রদানের জন্য আনন্দ উদ্বেল চিত্তে আল্লাহর সমীপে শুকরিয়া আদায় করলাম।
দুগ্ধ পানের পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘এখনো কি যাত্রার সময় হয়নি?’
আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল কেন হবে না, যাত্রার উপযুক্ত সময় হয়েছে,’ তারপর আমরা পুনরায় যাত্রা শুরু করলাম।[1]
২. এই প্রবাস যাত্রাকালে আবূ বাকর (রাঃ) সাধারণতঃ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর রাদীফ থাকতেন। অর্থাৎ তিনি বাহনে নাবী (সাঃ)-এর পিছনে বসতেন। তিনি পিছনে বসতেন এ কারণে যে, তার মধ্যে বার্ধক্যের চিহ্ন প্রকাশ পেয়েছিল এবং মানুষের দৃষ্টি প্রথমেই তার উপরেই পড়তো। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মধ্যে তখনো যৌবনের চিহ্ন পরিষ্ফুট ছিল এজন্য তার প্রতি মানুষের দৃষ্টি অপেক্ষাকৃত কম যেতো। এর ফল ছিল কোন লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে সে আবূ বাকর (রাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করত আপনার সম্মুখের লোকটি কে? আবূ বাকর (রাঃ)-এর এক অত্যন্ত সূক্ষ্ণ উত্তর প্রদান করতেন। বলতেন, ‘এই লোকটি আমাকে পথ বলে দিচ্ছেন। এতে লোকেরা সহজভাবে পথের কথাই বুঝতেন। কিন্তু এ কথার মাধ্যমে তিনি কল্যাণের পথকেই বোঝাতে চেয়েছেন।[2]
৩. এই প্রবাস যাত্রাকালে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) খুযা’আহ গোত্রের উম্মু মা’বাদের তাঁবুদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করেন। ইনি একজন নামকরা স্বাস্থ্যবান মহিলা ছিলেন। হাতে হাঁটু ধারণ করে তাঁবুর অঙ্গনে বসে থাকতেন এবং গমনাগমনকারীদেরকে পানাহার করাতেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন আপনার নিকট কিছু আছে? তিনি বললেন, ‘আমার নিকট যদি কিছু থাকত তাহলে আল্লাহর ওয়াস্তে আপনাদের মেহমানদারীতে কোন প্রকার ত্রুটি হতো না। ঘরে তেমন কিছুই নেই, বকরীগুলোও রয়েছে দূরদূরান্তে। সময়টা ছিল দূর্ভিক্ষ কবলিত।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দেখলেন তাঁবুর এক কোনে একটি বকরী রয়েছে।
তিনি বললেন, ‘হে উম্মু মা’বাদ, এটা কেমন বকরী? মহিলা বললেন, ওর দুর্বলতার কারণে ওকে দলের বাহিরে রাখা হয়েছে। নাবী (সাঃ) বললেন ওর ওলানে কি কিছু দুধ আছে? তিনি বললেন, ‘দুধ দানের মতো তার কোন শক্তিই নেই।’ নাবী (সাঃ) বললেন, ‘অনুমতি দিলে আমি তাকে দোহন করি’’।
মহিলা বললেন, ‘হ্যাঁ’’, আমার মাতা-পিতা আপনার জন্য কুরবান হোক। যদি আপনি ওলানে দুধ দেখতে পান তবে অবশ্যই দোহন করবেন।’
এ কথাবার্তার পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বকরীটির ওলানের উপর হাত ফিরালেন, আল্লাহর নাম নিলেন এবং দু’আ করলেন। তারপর বকরীটা তার পেছনের পা দুটি বিস্তার করল এবং তার ওলান দুধে ভরপুর হয়ে উঠল।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) উম্মু মা’বাদের বেশ বড় আকারের একটি পাত্র নিলেন এবং এত পরিমাণ দুধ দোহন করলেন যে, দুধের ফেনা পাত্রের উপরে উঠে গেল। দুধ দোহনের পর উম্মু মা’বাদকে পান করালেন। তিনি দুগ্ধপানে পূর্ণরূপে পরিতৃপ্ত হলেন। তারপর সঙ্গী সাথীদের পান করালেন। পূর্ণ পরিতৃপ্তির সঙ্গে সকলকে পান করানোর পর তিনি নিজে পান করলেন। দ্বিতীয় বারেও তিনি এত পরিমাণ দুধ দোহন করলেন যে, পাত্র ভরে গেল। এ দুগ্ধ উম্মু মা’বাদের নিকট রেখে দিয়ে তিনি সঙ্গীদের সহ মদীনার পথে অগ্রসর হলেন।
অল্পক্ষণ পরেই তাঁর স্বামী আবূ মা’বাদ আপন দুর্বল বকরী যা দুর্বলতা হেতু ধীরে ধীরে পায়ে হাঁটছিল হাঁকাতে হাঁকাতে এসে পৌঁছল। পাত্রভর্তি দুধ দেখে তিনি বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়লেন। তাঁর সহধর্মিনীকে জিজ্ঞেস করলেন, এ দুধ তুমি কোথায় পেলে? সে ক্ষেত্রে দুগ্ধবতী বকরীগুলো দূর চারণ ভূমিতে ছিল এবং বাড়িতে কোন দুগ্ধবতী বকরীই ছিলনা, সেক্ষেত্রে পাত্রে এত দুধ এল কোথায় থেকে?
স্ত্রী উম্মু মা’বাদ তাঁর স্বামীকে সেই বরকতময় মেহমানের কথা জানালেন যিনি পথ চলার সময় তাঁর গৃহে আগমন করেন এবং যেভাবে যা ঘটেছিল তা সবিস্তারে বর্ণনা করলেন। এ সব কথা শ্রবণের পর স্বামী আবূ মা’বাদ বললেন, ‘একে তো ঠিক সেই লোক বলে মনে হচ্ছে যাঁকে কুরাইশগণ খুঁজে বেড়াচ্ছেন।’ আবূ মা’বাদ পুনরায় তাঁর স্ত্রীকে বললেন, ‘আচ্ছা তাঁর আকৃতি প্রকৃতি বর্ণনা কর দেখি।’
স্বামীর এ কথা শ্রবণের পর উম্মু মা’বাদ অত্যন্ত জীবন্ত ও আকর্ষণীয়ভাবে তাঁর গুণাবলী ও যোগ্যতার এমন একটি নকশা অংকণ করলেন তাতে মনে হল শ্রবণকারীগণ যেন তাঁকে চোখের সম্মুখেই দেখছে (কিতাবের শেষ ভাগে সেই গুণগুলোর কথা উল্লেখিত হবে)। মেহমানের এ সকল গুণের কথা অবগত হয়ে আবূ মা’বাদ বললেন, ‘আল্লাহর শপথ! ইনি তো কুরাইশদের সেই সাথী লোকেরা যাঁর সম্পর্কে বিভিন্ন প্রকার কথা বলছেন। আমার ইচ্ছা তাঁর বন্ধুত্ব গ্রহণ করি এবং যদি কোন পথ পাই তাহলে অবশ্যই তা করব। এদিকে মক্কায় একটি ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়ছে যা মানুষ শুনতে পাচ্ছে কিন্তু বক্তাকে দেখতে পাচ্ছে না। কথাগুলো ছিল এরূপ :
جزى الله رب العرش خير جزائـه ** رفيقين حَلاَّ خيمــتى أم مَعْبَـدِ
هـمـا نزلا بالبِــرِّ وارتحلا بـه ** وأفلح من أمسى رفيق محمــد
فيا لقُصَىّ مــا زَوَى الله عنكـم ** به من فعال لا يُحَاذى وسُــؤْدُد
لِيَهْنِ بني كعـب مكــان فَتاتِهـم ** ومقعدُهـا للمؤمنـين بَمْرصَـد
سَلُوْا أختكم عن شاتهـا وإنائهـا ** فإنكم إن تسألوا الشاة تَشْـهَـد
অর্থঃ আরশের প্রভূ আল্লাহ ঐ দু’বন্ধুকে উত্তম পুরষ্কার দেন যারা উম্মু মা’বাদের তাঁবুতে অবতরণ করেছিলেন। তারা দুজনে কল্যাণের সঙ্গে অবতরণ করেছেন এবং কল্যাণের সঙ্গে গমন করেছেন। যিনি মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর বন্ধু হয়েছেন, তিনি সফলকাম হয়েছেন। হায় কুসাই! আল্লাহ তোমাদের থেকে কত নজিরবিহীন কার্যকলাপ ও নেতৃত্ব গুটিয়ে নিয়ে তাদেরকে দিয়েছেন, অর্থাৎ বনু কা‘বদেরকে, ওদের মহিলাবর্গের অবস্থান স্থল এবং মুমিনদের সেনাচৌকী বরকতময় হোক। তোমরা নিজ ভগ্নিদেরকে তাদের পাত্র এবং বকরী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো। তুমি যদি স্বয়ং বকরীদেরকেও জিজ্ঞেস কর তবে তারাও সাক্ষ্য দেবে।
আসমা (রাঃ) বলছেন, ‘আমরা জানতাম না যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কোন্ দিকে গমন করেছেন। ইতোমধ্যে একজন মক্কার নিম্নভূমি থেকে এ কবিতা পাঠ করতে করতে এল। মানুষ তার পিছনে পিছনে চলছিল, তার কথা শুনছিল, কিন্তু তাকে কেউই দেখতে পাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত সে মক্কার উচ্চভূমি থেকে বের হয়ে গেল।’
তিনি বলেন, ‘আমরা যখন তাঁর কথা শুনলাম তখন বুঝতে পারলাম রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কোন দিকে গমন করেছেন। অর্থাৎ তিনি গমন করেছেন মদীনার দিকে।[3]
৪. সুরাক্বাহ বিন মালিক পথের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পিছু ধাওয়া করে। এ ঘটনা সুরাক্বাহ নিজেই বর্ণনা করেছে। সে বলেছে, ‘আমি নিজ সম্প্রদায় বনী মুদলিজের এক সভায় বসেছিলাম। ইতোমধ্যে একজন লোক আমার পাশে এসে দাঁড়াল। সে বলল, ‘হে সুরাক্বাহ! আমি কিছুক্ষণ পূর্বে উপকূলে কতিপয় লোককে দেখলাম। আমার ধারণা এরা হবেন মুহাম্মাদ (সাঃ) এবং তাঁর সঙ্গীগণ।’
সুরাক্বাহ বলেন, ‘আমি বুঝে গেলাম যে, এরা তাঁরাই।’ কিন্তু ঐ লোকটির ধারণা পালটিয়ে দেয়ার জন্য তাকে বললাম, ‘এরা তারা নয়। বরং তুমি অমুক অমুককে দেখেছ যারা আমার চোখের সম্মুখ দিয়ে অতিক্রম করল।’
‘এরপর সভাস্থানে সামান্য সময় অপেক্ষা করে অন্দর মহলে চলে গেলাম এবং নিজ দাসীকে নির্দেশ দিলাম আস্তাবল থেকে আমার ঘোড়াটি বের করে নিয়ে গিয়ে ঢিবির পিছনে আমার জন্য অপেক্ষা করতে। এদিকে আমি নিজ তীর গ্রহণ করলাম এবং বাড়ির পিছন দরজা দিয়ে বের হলাম। এ সময় আমার হাতের লাঠিটির এক মাথা মাটির সঙ্গে ঘর্ষণ খাচ্ছিল এবং অন্য মাথা নীচু করে রাখা ছিল। এ অবস্থায় আমি নিজ ঘোড়ার নিকট গিয়ে তার উপর আরোহণ করলাম। তারপর লোকটির কথিত দিক লক্ষ্য করে ঘোড়া ছুটিয়ে চললাম।’
‘‘আমি দেখলাম সে আমাকে নিয়ে স্বাভাবিকভাবে ছুটছে। এক পর্যায়ে আমি তাদের নিকটবর্তী হয়ে গেলাম, কিন্তু আকস্মিকভাবে আমাকে সমেত ঘোড়ার পা পিছলিয়ে যাওয়ায় আমি ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেলাম। আমি উঠে দাঁড়িয়ে তুনের দিকে হাত বাড়ালাম এবং পাশার তীর বের করে জানতে চাইলাম যে, তাঁকে বিপদে ফেলতে পারব কিনা। কিন্তু যে তীরটি বেরিয়ে আসল সেটা আমার অপছন্দনীয়। কিন্তু আমি তীরের সাংকেতিক অভিব্যক্তি এড়িয়ে অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করলাম। সে আমাকে নিয়ে ছুটতে লাগল এবং এক পর্যায়ে নাবী (সাঃ)-এর কণ্ঠ নিঃসৃত কুরআনের পাঠ আমার কর্ণকূহরে প্রবিষ্ট হল। তিনি কোন সময়ের জন্যও পিছনে ফিরে তাকান নি। কিন্তু আবূ বাকর (রাঃ) বার বার পিছনে ফিরে তাকাচ্ছিলেন।
আর সামান্য পথ অতিক্রম হলে তাঁদের পথ রোধ করতে পারি এমন এক অবস্থায় আকস্মিকভাবে আমার ঘোড়ার পা হাঁটু পর্যন্ত মাটিতে ঢুকে গেল। এতে আমি তার পিঠ থেকে ছিটকে পড়ে গেলাম। আমি অবস্থাটা সামলিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াবার জন্য ঘোড়াটিকে ধমকা-ধমকি শুরু করলাম। আমার ধমক খেয়ে সে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল কিন্তু সহজে তা পারল না। অবশেষে অনেক কষ্ট করে সে পা টেনে বের করল। কিন্তু সে যখন বহু কষ্টের পর উঠে দাঁড়াল তখন তার পদচিহ্ন থেকে আসমানের দিকে ধোঁয়ার মতো ধূলি প্রবাহের সৃষ্টি হয়েছিল।
আমি আবার পাশার তীর থেকে আমার ভাগ্যান্বেষণের ইঙ্গিত সম্পর্কে জানতে চাইলাম। কিন্তু আবার ঐ তীরটিই বাহির হল, যা আমার অপছন্দনীয় ছিল। এরপর আমি তাঁদের নিরাপত্তা চেয়ে আহবান জানালে তাঁরা থেমে গেলেন। আমি ঘোড়া খেদিয়ে তাঁদের নিকট পৌঁছলাম। যখন আমি তাঁদেরকে থামিয়ে ছিলাম তখনই আমার মনে এ কথাটা গেঁথে গিয়েছিল যে, মুহাম্মাদ (সাঃ)-ই শেষ পর্যন্ত জয়ী হবেন। এজন্য আমি তাকে বললাম যে, ‘আপনার সম্প্রদায় আপনার প্রাণের বিনিময়ে পুরষ্কার ঘোষণা করেছে’ এবং ঐ কথার সূত্রেই আমি তাঁকে মানুষের মনোভাব সম্পর্কে সতর্ক করে দিলাম। অধিকন্তু, কিছু খাদ্য-সামগ্রী এবং আসবাবপত্রেরও ব্যবস্থা করে দিতে চাইলাম। কিন্তু আমার কাছ থেকে কোন কিছুই গ্রহণ করলেন না এবং আমাকে কোন প্রশ্নও জিজ্ঞেস করলেন না। শুধু এ টুকুই বললেন যে, ‘আমাদের ব্যাপারে গোপনীয়তা রক্ষা করবেন।’ আমি আরয করলাম ‘আমাকে নিরাপত্তা পরওয়ানা লিখে দিন।’ তিনি ‘আমির বিন ফুহাইরাকে তা লিখে দেয়ার নির্দেশ প্রদান করায়। তিনি এক টুকরো চামড়ার উপর তা লিখে আমার হাতে দিলেন। তারপর নাবী (সাঃ)-এর দল সম্মুখে পানে অগ্রসর হলেন।[4]
এ ঘটনা সম্পর্কে খোদ আবূ বাকর (রাঃ)-এর এক রেওয়ায়েতে এর বর্ণনা রয়েছে যে, ‘আমাদের যাত্রা করার পর আমাদের স্বগোত্রীয় লোকজন অনুসন্ধান কাজে তৎপর হয়ে ওঠে, কিন্তু সুরাক্বাহ বিন মালিক বিন জু’শুম ছাড়া যারা নিজ ঘোড়ায় উঠেছিল তার কেউই আমাদের নাগাল পায়নি। আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আমাদের পিছনে আগমনকারীরা আমাদেরকে পেয়ে যাবে।’
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন,
{لاَ تَحْزَنْ إِنَّ اللهَ مَعَنَا} [التوبة:40]
‘‘চিন্তার কোন কারণ নেই, আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সঙ্গেই আছেন।(আত্-তাওবাহ ৯ : ৪০)[5]
যাহোক, সুরাক্বাহ প্রত্যাবর্তন করে দেখে যে, লোকজন সব হন্যে হয়ে অনুসন্ধান কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সে তাদের বলল, ‘এ দিকের খোঁজ খবর আমি নিয়েছি। এদিকে তোমাদের যা কাজ ছিল তা যথারীতি করা হয়েছে। এভাবে সে লোকদের ফিরিয়ে নিয়ে গেল। দিনের প্রথম ভাগে যে ছিল আক্রমণকারী শত্রু, দিনের শেষ ভাগে সেই হল জীবন রক্ষাকারী বন্ধু।[6]
৫. পথে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ছোট্ট কাফেলার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় বুরাইদাহ বিন হুসাইব আসলামীর। সে ছিল নিজ সম্প্রদায়ের নেতা এবং শক্তিমান পুরুষ। তার সাথে প্রায় আশি জন লোক ছিল। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তার সঙ্গী সাথীগণও ইসলাম গ্রহণ করেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এশার সালাত আদায় করেন এবং এসব লোকেরাও তাঁর পেছনে সালাত আদায় করেন। বুরাইদাহ তার স্বীয় গোত্রের সঙ্গেই বসবাস করেন এবং উহুদ যুদ্ধের পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন।
আব্দুল্লাহ বিন বুরাইদাহ বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ফাল বিশ্বাস করতেন কিন্তু ত্বিয়ারাহ (এর প্রকার ভাগ্য নির্ণয়) বিশ্বাস করতেন না। বুরাইদাহ (রাঃ) সত্তর জন লোকের এক কাফেলাসহ মদীনায় আগমন করেন। অতঃপর তারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করলে তাদের জিজ্ঞাসা করেন, তোমরা কোন কওমের লোক। তারা বললো আমরা আসলাম গোত্রের। এরপর আবূ বাকরকে বললেন, আমি নিরাপদ হলাম। অতঃপর তিনি (সাঃ) কোন গোত্রের? তারা বললো বনু সাহম গোত্রের। তিনি বললেন তোমার অংশ বের হয়ে গেছে।
৬. রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আবূ আওস তামীম বিন হাযার আসলামী অথবা আবূ তামীম আওস বিন হাযার আসলামীর নিকট দিয়ে আরয-এর হারশা ও জুহফাহর মধ্যবর্তী কাহদাওয়াত অতিক্রম করছিলেন। তাঁর পিঠের ব্যথার কারণে ধীরে পথ চলছিলেন। সে সময় তিনি (সাঃ) এবং আবূ বাকর (রাঃ) একই উটের সওয়ারী ছিলেন। আওস লোকজন তাঁকে সওয়ার জন্য একটা উট প্রদান করলেন এবং তাদের সাথে মাস’উদ নামক এক ক্রীতদাসকে সঙ্গে দিয়ে দিলেন। ক্রীতদাসকে বলে দিলেন যে, তাঁদের সাথে সাথে পথ চলবে। কক্ষনোই তাঁদের থেকে পৃথক হবে না। ফলে সে তাঁদের সাথে চলতে থাকলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁরা মদীনায় পৌছে গেলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মাসউদকে তার মনিবের নিকটে ফিরত পাঠালেন। আর তাকে এ নির্দেশ দিলেন যে, সে যেন আওস গোত্রের লোকেদের বলে যে, তারা যেন তাদের এ উটের গর্দানে গাধার ন্যায় দুটো আংটা পরিয়ে দেয় এবং উভয়ের মাঝে দুরত্ব রাখে। এটাই তাদের চিহ্ন। মুশরিকরা উহুদ প্রান্তরে উপস্থিত হলে আওস তার ক্রীতদাস মাসউদ বিন হুনাইদাহকে ‘আরয হতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দরবারে গিয়ে মুশরিকদের বিষয়ে খবর দেয়ার জন্য প্রেরণ করলেন। এ ঘটনাকে ইবনু মা’কূল ত্বাবারী থেকে বর্ণনা করেছেন।
তিনি রাসূলুলাহ (সাঃ)-এর মদীনায় আগমনের পর ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তিনি আরযে বসবাস করতেন।
৭. পথ চলার পরবর্তী পর্যায়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সঙ্গে যুবাইর বিন আওয়ামের সাক্ষাৎ হয়। মুসলিমগণের একটি বাণিজ্য কাফেলার সঙ্গে তিনি সিরিয়া থেকে প্রত্যাবর্তন করছিলেন। যুবাইর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও আবূ বাকর (রাঃ) কে সাদা কাপড় প্রদান করেন।[7]
ফুটনোটঃ[1] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৫১০ পৃঃ।
[2] সহীহুল বুখারী আনাসহেত ১ম খন্ড ৫৫৬ পৃঃ।
[3] যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৫৩-৫৪ পৃঃ। বনু খোযয়ার আবাদী অবস্থানের প্রতিদৃষ্টি রেখে এ কথাই অধিক গ্রহণযোগ্য যে, এ গটনাটি গার থেকে যাত্রা পরে ২য় দিনে সংঘটিত হয়েছিল।
[4] সহীহুল বুখারী শরীফ ১ম খন্ড ৫৫৪ পৃঃ। বনী মুদলেজদের বাড়ি রাবেগের নিকটবর্তী ছিল। সুরাক্বাহ সেই সময় নাবী (সাঃ)-এর অনুসন্ধানে রত হয়েছিলেন যখন তিনি কুদাইদ থেকে উপরে যাচ্ছিলেন। যাদুল মা’আদ ২য় খন্ড ৫৩ পৃঃ। এটা অধিক গ্রহণযোগ্য এ কারণে যে, গুহা থেকে যাত্রার তৃতীয় দিবসে পিছু ধাওয়ার এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল।
[5] সহীহুল বুখারী শরীফ, ১ম খন্ড ৫১৬ পৃঃ।
[6] যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৫৩ পৃঃ।
[7] সহীহুল বুখারী উরওয়াপুত্র যুবাইর থেকে ১ম খন্ড ৫৫৪ পৃঃ।
কুবাতে আগমন (النُّزُوْلُ بِقُبَاءٍ):
৮ই রবিউল আওয়াল, ১৪ই নাবাবী সনে, অর্থাৎ ১ম হিজরী সন মোতাবেক ২৩ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কুবাতে আগমন করেন।[1]
‘উরওয়া বিন যুবাইরের বর্ণনায় রয়েছে যে, মদীনাবাসী মুসলিমগণ মক্কা থেকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর রওয়ানা হওয়ার সংবাদ শুনেছিলেন এজন্য তাঁরা প্রত্যেক দিন সকালে বের হয়ে হাররার দিকে গমন করতেন এবং তার পথ চেয়ে থাকতেন। দুপুরে রোদ যখন অত্যন্ত প্রখর হয়ে উঠত তখন তাঁরা গৃহে ফিরতেন। এক দিবসে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর মুসলিমগণ যখন গৃহে ফিরে এলেন তখন একজন ইহুদী তাঁর নিজের কোন কাজে একটা টিবির উপর উঠলে সে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এবং তার সঙ্গীদের দেখতে পায়। সাদা কাপড়ে আবৃত অবস্থায় তাঁরা যখন আসছিলেন তখন তাঁদের পোষাক হতে যেন চাঁদের কিরণ বিচ্ছুরিত হচ্ছিল। এ অবস্থা দেখে সে আত্মহারা হয়ে উচ্চ কণ্ঠে বলল, ‘ওগো আরবের লোকেরা! তোমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়েছে, তোমাদের বহু আকাঙ্ক্ষিত অতিথি ঐ যে এসে গেছেন।’ এ কথা শোনামাত্রই মুসলিমগণ অস্ত্রাগারে দৌড় দিলেন[2] এবং অস্ত্র শয্যায় সজ্জিত হয়ে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)-কে স্বাগত জানানোর জন্য সমবেত হলেন।
ইবনুল কাইয়্যেম বলেছেন : এর মধ্যেই বণী ‘আমর বিন আউফ গোত্রের (কুবার বাসিন্দা) লোকজনদের শোরগোল উঁচু হয়ে উঠল এবং তাকবীর ধ্বনি শোনা গেল। মুসলিমগণ নাবী কারীম (সাঃ)-এর আগমনে তাঁকে খুশআমদেদ জানানোর উদ্দেশ্যে হর্ষোৎফুল্ল কণ্ঠে তাকবীর ধ্বনি দিতে দিতে সমবেত হতে থাকল। তিনি তাঁদের মাঝে এসে উপস্থিত হলে সকলে সম্মিলিতভাবে তাঁকে মুবারকবাদ জ্ঞাপন করলেন এবং চতুর্দিক থেকে পরিবেষ্টন করে দাঁড়ালেন। এ সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) শান্তির আবরণে আচ্ছাদিত ছিলেন এবং আল্লাহর বাণী অবতীর্ণ হচ্ছিল,
{فَإِنَّ اللهَ هُوَ مَوْلَاهُ وَجِبْرِيْلُ وَصَالِحُ الْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمَلَائِكَةُ بَعْدَ ذٰلِكَ ظَهِيْرٌ} [التحريم:4]
‘‘তবে (জেনে রেখ) আল্লাহ তার মালিক-মনিব-রক্ষক। আর এ ছাড়াও জিবরীল, নেক্কার মু’মিনগণ আর ফেরেশতাগণও তার সাহায্যকারী।’ (আত্-তাহরীম ৬৬ : ৪)
‘উরওয়া বিন যুবাইর (রাঃ)-এর বর্ণনা রয়েছে যে, লোকজনের সঙ্গে মিলিত হবার পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের সঙ্গে নিয়ে ডানদিকে ফিরলেন এবং ’’আমর বিন আওফ গোত্রে গমন করলেন। সে সময়টা ছিল রবিউল আওয়াল মাসের সোমবার। অতঃপর আবূ বকর (রাঃ) লোকেদের সাথে কথাবার্তা বলার জন্য দাঁড়ালেন আর রাসূল (সাঃ) চুপ করে বসে থাকলেন। সে সকল আনসার রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এখন পর্যন্ত দেখেন নি তারা একের পর এক আসতে থাকলেন তাঁকে স্বাগতম জানাতে।
অন্য বর্ণনায় রয়েছে, আবূ বকর (রাঃ) আগমন করলেন। এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ এর উপর সূর্যের তাপ লাগতে লাগল তখন আবূ বাকর (রাঃ) স্বীয় চাদর দিয়ে তাঁকে ছায়া দিলেন। ফলে লোকেরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে চিনে ফেললেন।
পুরো মদীনা যেন স্বাগতম জানানোর জন্য কুচকাওয়াজ করছিল। সে দিন এমনই একটা দিন ছিল মদীনার ইতিহাসে এমন দিন আর আসেনি।
রাসূলুল্লাহ কুলসুম বিন হাদাম এবং বলা যায় যে, সা’দ বিন খায়সামার বাড়ীতে অবস্থান করেছিলেন। এর মধ্যে প্রথম মতটি অধিক শক্তিশালী।
এদিকে আলী (রাঃ) মক্কায় তিন দিন অবস্থানের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট লোকদের গচ্ছিত আমানত আদায় করার পর পদদলে মদীনা অভিমুখে যাত্রা করলেন। তারপর মদীনায় পৌঁছে তিনি কুবায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন এবং কুলসুম বিন হাদামের বাড়িতেই অবস্থান করলেন।[3]
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কুবাতে চারদিন[4] (সোমবার, মঙ্গলবার, বুধ ও বৃহস্পতিবার) অথবা দশ দিন থেকে বেশী অথবা পৌঁছা ও যাত্রার দিন ছাড়া চবিবশ দিন অবস্থান করেন। আর এ সময়ের মধ্যেই মসজিদে কুবার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন এবং তাতে সালাতও আদায় করেন। তাঁর নবুওয়াত প্রাপ্তির পর এটা হচ্ছে সর্ব প্রথম মসজিদ যার বুনিয়াদ তাকওয়া (আল্লাহ ভীতির) উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পঞ্চম দিনে (অথবা দ্বাদশ দিনে অথবা চবিবশতম দিনে) শুক্রবারে তিনি আল্লাহর নির্দেশে আরোহণ করলেন। আবূ বাকর (রাঃ) তাঁর রাদীফ (পিছনে আরোহণকারী) ছিলেন। তিনি বনু নাজ্জারদেরকে (যাঁরা তাঁর মামাগোষ্ঠির ছিলেন) সংবাদ প্রেরণ করেছিলেন। ফলে তাঁরা তরবারী ধারণ করে উপস্থিত হলেন। তিনি তাঁদেরসহ মদীনার দিকে যাত্রা করলেন। তারপর বনু সালিম বিন আউফের আবাসস্থানে পৌঁছিলে জুমার সালাতের সময় হয়ে যায়। তিনি এ স্থানে বাতনে অদীতে জুমা পড়লেন। সেখানে এখনো মসজিদ রয়েছে। সেখানে মোট একশত লোক ছিলেন।[5]
ফুটনোটঃ[1] রহামাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ১০২ পৃঃ। এ সময় নাবী (সাঃ)-এর বয়স একেবারে কাঁটায় কাঁটায় ৫০ বছর হয়েছিল। আর যাঁরা তাঁর নবুওয়াত কাল ৯ই রবিউল আওয়াল ৪১ ফীল বর্ষ মানছেন তাঁদের কথা মোতাবেক নবুওয়াতের ঠিক ১৩ বছর পূর্ণ হয়েছিল। অবশ্য যাঁরা তাঁর নবুওয়াতের সময় কাল রমাযান ১৪ ফীল বর্ষ মানেন তাঁদের কথা মোতাবেক ১২ বছর ৫মাস কিংবা ২২ দিন হয়েছিল।
[2] সহীহুল বুখারী শরীফ ১ম খন্ড ৫৫৫ পৃঃ।
[3] যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৫৪ পৃঃ ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৯৩ পৃঃ। রহমতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ১০২ পৃঃ।
[4] এটা ইবনে ইসহাক্বের রেওয়াতে। ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৯৪ পৃঃ। আল্লামা মানসুরপুরী এটাই গ্রহণ করেছেন। রাহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ১০২ পৃঃ দ্রঃ। কিন্তু সহীহুল বুখারীর একটি বর্ণনা রয়েছেন যে, নাবী কারীম (সাঃ) কুবাতে ২৪ দিন অবস্থান করেছিলেন। কিন্তু অন্য একটি বর্ণনায় আছে দশরাত হতে কয়েকদিন হতে বেশী ১/৫৫৫ অন্য এক (তৃতীয়) বর্ণনায় চৌদ্দ রাত ১/৫৬০ পৃঃ। ইবনুল কাইয়্যেম শেষ বর্ণনাটিকে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তিন নিজে ব্যাখ্যা করেছেন যে, নাবী (সাঃ) কুবাতে সোমবার পৌঁছেন এবং সেখান থেকে শুক্রবার যাত্রা করেন্ (যা’দুল মা’আদ) ২/৫৪ ও ৫৫ পৃঃ।) আর এটা জানা যায় যে, সোমবার আর জুমা (শুক্রবার) পৃথক পৃথক দু’সপ্তাহের ধরা হলে পৌঁছা ও যাত্রার দিন দুটি বাদ দিলে সর্ব মোট হচ্ছে ১০ দিন আর পদার্পণ ও যাত্রার দিন সহ হচ্ছে ১২ দিন। সর্বমোট চৌদ্দ দিন কিভাবে হবে?
[5] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৪৫৫-৫৬০ পৃঃ। যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৫৫ পৃঃ। ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৯৪ পৃঃ। রমহাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ১০২ পৃঃ।
মদীনায় প্রবেশ (الدُّخُوْلُ فِي الْمَدِيْنَةِ):
জুমআর সালাত শেষে নাবী (সাঃ) মদীনায় প্রবেশ করলেন। ঐ দিন থেকেই এ শহরের নাম ইয়াসরিরের পরিবর্তে মদীনাতুররাসূল বা রাসূলের শহর হয়ে যায় সংক্ষেপে একে মদীনা বলা হয়ে থাকে। এটা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক ঐতিহাসিক দিবস। মদীনার অলিতে গলিতে সর্বত্র সেদিন তাকদীস ও তাহমীদের (পবিত্রতা ও প্রশংসার) গুঞ্জণ ধবনি শ্রুত হচ্ছিল। আনসারদের ছেলেমেয়েরা আনন্দ উদ্বেল কণ্ঠে নিন্মের কবিতার চরণগুলো সুর ও ঝংকার সহকারে গেয়ে বেড়াচ্ছিল।
طـلـع الـبــدر علـينا
**
مـن ثـنيــات الـوداع
وجـب الشـكـر علـين
**
مـــا دعــا لـلـه داع
أيـهـا المبـعـوث فـينا
**
جـئـت بـالأمـر المطاع
‘‘দক্ষিণ পাশের পাহাড় হতে পূর্ণিমার চন্দ্র আমাদের উপর উদিত হয়েছে।’
‘‘কি উত্তম ধর্ম ও শিক্ষা! আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা আমাদের প্রতি ওয়াজেব।’
তোমার নির্দেশ অনুসরণ করা ফরয। তোমার প্রেরণকারী হচ্ছেন কিবরিয়া (মহাপ্রভূ)[1]
আনসারগণ যদিও ধনী ছিলেন না, তবুও সকলের আশা ছিল যে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তার বাসাতেই অবস্থান করুন। ফলে তার উটনী আনসারদের যে বাড়ি কিংবা মহল্লার পাশ দিয়ে অতিক্রম করত সেখানকার লোকজন উটনীর লাগাম ধরে নিতেন এবং অনুরোধ করতেন যে, আসবাবপত্র, অস্ত্রশস্ত্র ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা প্রস্তুত রয়েছে, আগমন করুন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলতেন ‘উটনীর পথ ছেড়ে দাও। সে আল্লাহর পক্ষ থেকে নিদের্শিত রয়েছে। ফলে উটনী একটানা চলতে থাকল এবং ঐ স্থানে এসে বসে পড়ল যেখানে মসজিদে নাবাবী রয়েছে।
কিন্তু তিনি নীচে অবতরণ করলেন না। তারপর উটনী পুনরায় উঠে দাঁড়াল এবং কিছু দূরে গিয়ে ঘুরে ফিরে দেখার পর পূর্বের জাগাতেই এসে বসে পড়ল। এরপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নীচে অবতরণ করলেন। এটা ছিল তাঁর নানীর, অর্থাৎ বনু নাজ্জার গোত্রের মহল্লা। আর উটনীর জন্য ছিল এটা আল্লাহর তরফ থেকে নির্দেশনা। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) চেয়েছিলেন তাঁর নানার গোত্রে অবস্থান করে তাঁদের মর্যাদা বৃদ্ধি করতে, সেই জন্যই এ ব্যবস্থা।
এখন বনু নাজ্জার গোত্রের লোকজনেরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে নিজ নিজ গৃহে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁর নিকট আবেদন নিবেদন শুরু করে দিলেন। কিন্তু আবূ আইউব আনসারী (রাঃ) উষ্ট্রের পালান উঠিয়ে নিলেন এবং বাড়িতে নিয়ে গেলেন। এতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলতে লাগলেন মানুষ তার পালানের সাথে রয়েছে। এদিকে আস’আদ বিন যুরারাহ (রাঃ) এসে উটনীর লাগাম ধরে নিলেন, ফলে উটনী তার নিকটেই রয়ে গেল।[2]
সহীহুল বুখারী শরীফে আদাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘কোন্ লোকের বাড়ি আমার থেকে নিকটে’’?
আইউব আনসারী (রাঃ) বলেন, ‘আমার বাড়ি, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এটা আমার বাড়ি আর এটা আমার দরজা।’
তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে বললেন, ‘যাও এবং আমার বিশ্রামের জায়গা ঠিক কর। তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এবং আবূ বাকর (রাঃ) দুজনকেই সেখানে যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানালেন।[3]
কিছুদিন পর নাবী পত্নী উম্মুল মু’মিনীন সওদা (রাঃ) এবং নাবী তনয়া ফাত্বিমাহ (রাঃ) ও উম্মুল কুলসুম (রাঃ) এবং উসামা বিন যায়দ (রাঃ) ও উম্মু আয়মান (রাঃ) মদীনায় গিয়ে পৌঁছলেন। এদের সকলকে আব্দুল্লাহ বিন আবূ বাকর (রাঃ)- আবূ বকরের আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে যাদের মধ্যে ‘আয়িশাহও ছিলেন- নিয়ে এসেছিলেন। অবশ্য নাবী তনয়া যায়নাব (রাঃ), আবুল আসের নিকট থেকে গিয়েছিলেন। তিনি তাকে আসতে দেননি। তিনি বদরের যুদ্ধের পরে এসেছিলেন।[4]
‘আয়িশাহ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মদীনায় পৌঁছার পর আবূ বাকর (রাঃ) ও বিলাল (রাঃ) জ্বরে আক্রান্ত হন। আমি তাদের খেদমতে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম আববাজান! আপনি কেমন আছেন? তারপরে বিলালকে লক্ষ্য করে বললাম আপনি কেমন আছেন? তিনি অর্থাৎ ‘আয়িশাহ (রাঃ) বলেছেন যখন আবূ বাকর (রাঃ)-এর জ্বর আসত তখন তিনি এ কবিতা পাঠ করতেন,
كل امرئ مُصَبَّحٌ في أهله ** والموت أدنى من شِرَاك نَعْلِه
অর্থঃ প্রতিটি মানুষকে তার আত্মীয়ের মাঝে সুপ্রভাত বলা হয়ে থাকে অথচ মৃত্যু তার জুতার ফিতার চাইতেও নিকটবর্তী।
বিলালের অবস্থা যখন একটু সুস্থ থাকত তখন তিনি নিজের দুঃখপূর্ণ স্বর উঁচু করে বলতেনঃ
ألا ليت شِعْرِى هل أبيتَنَّ ليلة ** بوَادٍ وحولى إذْخِرٌ وجَلِيْـلُ
وهل أردْن يومـًا ميـاه مِجَنَّة ** وهل يَبْدُوَنْ لى شامة وطَفِيْلُ
‘হায় যদি আমি জানতাম যে, আমার কোন একরাত্রি যাপন হবে এক প্রান্তরে (মক্কায়) এবং আমার পাশে ইযখির ও জালীল (ঘাস) থাকবে এবং কোন দিন কি মাজিন্না ঝর্ণাতে অবতরণ করতে পারব এবং আমি সামা ও তুফাইল পাহাড় দেখতে পাব?’
‘আয়িশাহ (রাঃ) বলেছেন যে, আমি রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে তাদের এ প্রলাপের সংবাদ দিলাম। তখন তিনি বললেন,
[اللهم حبب إلينا المدينة كحبنا مكة أو أشد، وصححها، وبارك في صاعها ومدها، وانقل حماها فاجعلها بالجُحْفَة].
‘‘হে আল্লাহ, আমাদের নিকট মদীনাকে এমন প্রিয় করে দাও যেমন মক্কা প্রিয় ছিল বরং তার চেয়ে অনেক বেশী। মদীনার মাঠ, ঘাট ও আবহাওয়া স্বাস্থ্যের উপযোগী করে দাও এবং উহার ‘সা‘’ ও ‘মুদ্দে’ (শস্য মাপার পাত্র বিশেষ) বরকত দাও, তার অসুখ প্রত্যাবর্তন করে জুহফাহ’য় পৌঁছিয়ে দাও।[5] আল্লাহ তাঁর দু‘আ শুনলেন ও অবস্থার পরিবর্তন ঘটল।
এখান পর্যন্ত পবিত্র জীবনের এক প্রকার ও ইসলামী দাওয়াতের এক যুগ অর্থাৎ মক্কী জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটল। আমরা এখন তাঁর মাদানী জীবন সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করবো। আল্লাহ তা’আলা তাওফীক দাতা।
ফুটনোটঃ[1] কবিতার এ অনুবাদটি আল্লামা মানসুরপুরী করেছেন। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম লিখেছেন যে, এ কবিতাটি তাবুকের যুদ্ধ হতে নাবী (সাঃ)-এর ফেরত আসার সময় পাঠ করা হয়েছিল এবং যাঁরা বলেছেন এটা নাবী (সাঃ)-এর মদীনায় প্রবেশের সময় পাঠ করা হয়েছিল তাঁদের ভুল হয়েছে। (যা’দুল মা’আদ ৩/১০২ পৃঃ।) কিন্তু আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম ভুল হওয়ার কোন সুস্পষ্ট প্রমাণ প্রদান করেন নি। এর বিপরীতে আল্লামা মানসুরপুরী এ কবিতাটি নাবী (সাঃ)-এর মদীনায় প্রবেশের সময় পাঠ করা হয়েছিল বলে অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এ ব্যাপারে তাঁর নিকট দলীলও রয়েছে। রহমাতুল্লিল আলামীন ১/১০৬ পৃঃ।
[2] যা’দুল মা’আদ ২য়/৫৫ পৃঃ। রাহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ১০৬ পৃঃ।
[3] সহীহুল বুখারী শরীফ ১ম খন্ড ৫৫৬ পৃঃ।
[4] যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৫৫ পৃঃ।
[5] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৫৮৮-৫৮৯ পৃঃ।
মদীনার জীবনে দাওয়াত
মদীনার জীবনে দাওয়াত ও জিহাদের স্তরসমূহ (مراحل الدعوة والجهاد فى العهد المدني):
মদীনার জীবনকে তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করা যেতে পারে।
১. প্রথম পর্যায়ঃ ইসলামী সমাজ নির্মাণের ও ইসলামের দাওয়াত প্রতিষ্ঠালাভের যুগ। এ পর্যায়ে ফিতনা ও অশান্তি সৃষ্টি করা হয়েছে। শহরের মধ্য হতে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে এবং বাহির থেকে শত্রুরা আক্রমণ চালিয়েছে যাতে মদীনায় ইসলামের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায়। এ পর্যায়ের সমাপ্তি ঘটেছে ৬ হিজরী সনে যুল ক্বা’দাহ মাসে হুদায়বিয়াহর সন্ধিতে।
২. দ্বিতীয় পর্যায়ঃ এ পর্যায়ে মূর্তি পূজারী নেতাদের সঙ্গে সন্ধি স্থাপিত হয়, এটার সমাপ্তি ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের দ্বারা ঘটে। এ পর্যায়কে বিশ্বের রাজন্যবর্গের নিকট ইসলামের দাওয়াত প্রেরণের পর্যায়ও বলা যেতে পারে।
৩. তৃতীয় পর্যায়ঃ এ পর্যায়ের বিস্তৃতি ঘটেছিল একাদশ হিজরীর রবিউল আওয়াল রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পবিত্র জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। এ সময়ে বিভিন্ন দেশ ও গোত্রের মানুষ দলেদলে ইসলাম গ্রহণ করে। এ পর্যায় বিভিন্ন জাতি ও গোত্রসমূহের মুখপাত্রগণের মদীনায় আগমনের পর্যায়।
মদীনার অধিবাসীগণ এবং হিজরতের সময় তাদের অবস্থা (سكان المدينة واحوالهم عند الهجرة):
অশান্তি এবং উপহাসের লক্ষ্য বস্তু হওয়া থেকে নিস্কৃতিলাভই শুধু হিজরতের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল না। বরং এ উদ্দেশ্যও নিহিত ছিল যে, এক শান্তিপূর্ণ এলাকায় ইসলামী আন্দোলনের জন্য স্বস্তি ও শান্তির বাতাবরণ সৃষ্টি করা। এ কারণে সকল সমর্থ মুসলিমগণের জন্য এটা ফরজ করে দেয়া হয়েছিল যে, এই নতুন দেশ ও নতুন রাষ্ট্রের নির্মাণ কাজে তারা সাধ্যমত অংশ গ্রহণ করবেন এবং একে রক্ষণাবেক্ষণ ও মর্যাদার উচ্চশিখরে সমাসীন করার ব্যাপারে আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন। আর এ কথা তো সন্দেহাতীতভাবে সকলেই অবগত আছেন যে, এ মহতি জীবনধারার রূপকার এবং এ মহান জাতির ইমাম নেতা ও পথ প্রদর্শক ছিলেন স্বয়ং বিশ্বের সেরা মানব মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)।
মদীনাতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে এমন তিনটি গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কে গড়ে তুলতে হয়েছিল যাদের একগোষ্ঠি থেকে অন্যগোষ্ঠির অবস্থা ছিল ভিন্ন এবং পরস্পর পরস্পরের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এমন সব বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল যার ভিন্নতার প্রাধান্যই ছিল বেশী। গোষ্ঠী তিনটির পরিচিতি হচ্ছে যথাক্রমে নিম্নরূপঃ
১. আল্লাহর মনোনীত রাসূল (সাঃ)-এর নিকট হতে উত্তম প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ও আল্লাহর পথে ধন প্রাণ উৎসর্গ করতে সদাপ্রস্তুত সাহাবী (রাঃ)-এর জামাত বা গোষ্ঠী।
২. মদীনার আদি ও মূল বাসিন্দাদের মুশরিক (পৌত্তলিক) গোষ্ঠী যারা তখনো ঈমান আনে নি।
৩. ইহুদীগণ
(ক) সাহাবীগণ (রাঃ) সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে যে সব সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো তা হচ্ছে- তাদের জন্য মদীনার অবস্থা অবশ্যই মক্কার অবস্থার বিপরীত ছিল। যদিও তাঁদের দ্বীন সম্পর্কিত ধ্যান ধারণা দ্বীনী কাজ কর্মের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অভিন্ন ছিল, কিন্তু মক্কা জীবনে তারা বসবাস করতেন বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত অবস্থায়। আর তাঁরা ছিলেন নিরুপায়, পর্যু্যদস্ত, অপমানিত ও দুর্বলতর। তারা আত্মিক ও নৈতিকবলে চরম বলীয়ান হলেও লৌকিক শক্তি সামর্থ্য কিংবা ব্যক্তি স্বাধীনতা বলতে তেমন কিছুই ছিল না। সকল প্রকার শক্তি ও সম্পদ পুঞ্জীভূত ছিল ধর্মের চির দুশমনদের হাতে। এমনকি মানবিক জীবন যাপনের জন্য সে সকল আসবাবপত্র এবং উপকরণাদির ন্যূনতম প্রয়োজন সে সব কিছুই ছিল না মুসলিমগণের হাতে যাকে সম্বল করে তারা নতুনভাবে ইসলামী সমাজ গঠন করতে সক্ষম হবেন। কাজেই আমরা দেখতে পাই মক্কী সূরাহগুলোতে কেবলমাত্র ইসলামের প্রারম্ভিক বিষয়গুলোরই বর্ণনা রয়েছে এবং ঐ সকল বিষয়ের উপর নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে যা ব্যক্তিগতভাবে করা সম্ভব। অধিকন্তু এ পর্যায়ে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই পূত পবিত্র জীবন যাপনের মাধ্যমে আত্মিক উন্নতি ও উত্তম চরিত্র গঠনের উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে এবং অনৈতিক ও অসামাজিক ক্রিয়াকর্ম থেকে পরহেজ করে চলার জোর তাকীদ প্রদান করা হয়েছে। পক্ষান্তরে মদীনা জীবনের প্রথম থেকেই নেতৃত্ব-কর্তৃত্বের বাগডোর ছিল মুসলিমগণেরই হাতে। মুসলিম ছাড়া মদীনা কিংবা তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় যে সকল সম্প্রদায় ছিল, ইসলাম সূর্যের নিকট তাদের নেতৃত্ব ছিল নিষ্প্রভ। কাজেই তখন এমন এক সময় ও সুযোগ এসেছিল যাতে মুসলিমগণ তাহযীব, তামাদ্দুন ও স্থাপত্য জীবনধারা, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্ম, রাষ্ট্র পরিচালনা, যুদ্ধ-সন্ধি ইত্যাদি সকল ব্যাপারেই ইসলামের বিধি বিধান ও অনুশীলন অনুযায়ী পরিচালিত হবে। এর ফলে হালাল, হারাম, ইবাদত, আখলাক ইত্যাদি জীবনের সব ব্যাপারে পুরাপুরি মীমাংসা করা সম্ভব হয়।
সময় ও সুযোগ এসেছিল মুসলিমগণের জন্য এমন এক জীবন-ধারা প্রবর্তনের যা ছিল জাহেলিয়াত যুগের জীবন-ধারা থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। এমনকি পৃথিবীর কোথাও এমন কোন জীবন ধারা ছিল না যার সঙ্গে এর কোন তুলনা করা যেতে পারে। বিগত দশ বছর যাবৎ মুসলিমগণ অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের জীবন-যাপনের মধ্য দিয়ে এমন এক জীবন ধারা গড়ে তুলেছিলেন কোন কালে কোথাও যার তুলনা মিলবে না।
এ প্রসঙ্গে যে ব্যাপারটি বিশেষভাবে উল্লেখ্য তা হচ্ছে এ জাতীয় কোন জীবন ধারার রূপ এক দিনের, এক মাসের কিংবা এক বছরের কাজ হতে পারে না। এর জন্য প্রয়োজন একটি দীর্ঘ সময়ের যাতে করে ধীরে ধীরে পর্যায়ক্রমে এর বিধি-বিধান ও নির্দেশাবলী প্রয়োগ করা এবং নীতি-নির্ধারণী কাজের অভ্যাস ও চর্চা এবং তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে পূর্ণতা দান করা সম্ভব হতে পারে। ইসলাম যে পর্যন্ত বিধি-বিধান প্রদান সংগ্রহ সংরক্ষণের পর্যায়ে ছিল তার জিম্মাদার ছিলেন স্বয়ং আল্লাহ। পক্ষান্তরে, এ সবের বাস্তবায়ন মুসলিমগণের চর্চা ও অভ্যন্তকরণ এবং পথ প্রদর্শনের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)। ফলে ইরশাদ হয়েছে ,
{هُوَ الَّذِيْ بَعَثَ فِيْ الْأُمِّيِّيْنَ رَسُولًا مِّنْهُمْ يَتْلُوْ عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيْهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ} [الجمعة: 2].
‘তিনিই নিরক্ষরদের মাঝে পাঠিয়েছেন তাঁর রসূলকে তাদেরই মধ্য হতে, যে তাদের কাছে আল্লাহর আয়াত পাঠ করে, তাদেরকে পবিত্র করে, আর তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেয় অথচ ইতোপূর্বে তারা ছিল স্পষ্ট গুমরাহীতে নিমজ্জিত।’ (আল-জুমু‘আহ ৬২ : ২)
এদিকে সাহাবায়ে কেরামের (রাঃ) এই অবস্থা ছিল যে, তাঁরা সর্বক্ষণ নাবী কারীম (সাঃ)-এর প্রতি সজাগ দৃষ্টি রেখে চলতেন। যে কোন আহকাম নির্ধারিত হওয়া মাত্র তা কায় মনোবাক্যে গ্রহণ করে নিতেন এবং তা পালন করে আনন্দ লাভ করতেন। ইরশাদ হয়েছে,
{وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيْمَانًا} [الأنفال: 2].
‘‘আর তাদের কাছে যখন তাঁর আয়াত পঠিত হয়, তখন তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে…।’ (আল-আনফাল ৮ : ২)
এ সকল বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনা করা আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়, কাজেই এ বিষয়ের প্রয়োজনীয় অংশটুকু আলোচনা করব।
যাহোক, এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল মুসলিমগণের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, এবং দাওয়াতে ইসলামীয়ার ও রিসালাতে মুহাম্মাদীয়ার এটাই ছিল বড় রকমের উদ্দেশ্য, কিন্তু সত্যিকার অর্থে এটা কোন ক্ষণস্থায়ী বিষয় ছিল না। বরং স্বয়ং সম্পূর্ণ ও স্থায়ী ব্যাপার ছিল। অবশ্য এ ছাড়া এমন কিছু অন্যান্য বিষয়ও ছিল যা সমাধানের ব্যাপারে তাৎক্ষণিক মনোযোগের প্রয়োজন ছিল। যার সংক্ষিপ্ত অবস্থা নিম্নরূপ :
মুসলিমগণের মধ্যে দু’শ্রেণীর লোক ছিলেন, প্রথম শ্রেণীভুক্ত হচ্ছেন যাঁরা নিজস্ব জমিজমা, ঘরবাড়ি এবং ধনসম্পত্তির মধ্যে বববাস করতেন। এ সম্পর্কে তাদের অন্য কোন অতিরিক্ত চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন ছিল না, যা একজন লোককে তাঁর আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে শান্তিতে থেকে করতে হয়। এরা হচ্ছেন আনসার গোত্রীয় লোক। এদের মধ্যে বংশানুক্রমে একে অন্যের সঙ্গে প্রবল শত্রুতা ও মত বিরোধ চলে আসছিল। তাঁদের পাশাপাশি অন্য যে দলটি ছিলেন তাঁরা হচ্ছেন মোহাজের গোত্র। ঐ সকল সুবিধা হতে সম্পূর্ণরূপে এরা বঞ্চিত ছিলেন। লুণ্ঠিত হয়েও মার খেয়ে নিঃস্ব এবং রিক্ত অবস্থায় ভাগ্যের প্রতি ভরসা করে কোনরূপে মদীনায় পৌঁছে ছিলেন।
মদীনায় বসবাসের জন্য মুহাজিরদের জন্য কোন বাসস্থান বা আহার ও পোষাকের জন্য কোন কর্ম সংস্থান ছিল না। অথবা কোন প্রকার ধন ও সম্পদ ছিল না, যার দ্বারা তাঁরা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন। অথচ এ আশ্রয় প্রার্থী মোহাজিরদের সংখ্যা কম ছিল না। তদুপরি দিনের পর দিন তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েই চলেছিল। কারণ, সুস্পষ্ট ঘোষণা করা হয়েছিল যে, যারা আল্লাহ ও রাসূল (সাঃ)-এর প্রতি ঈমান আনয়ন করেছেন তারা যেন হিজরত করে মদীনায় চলে আসেন। অথচ এটা জানা কথা যে, মদীনাতে সম্পদ বলতে উল্লেখযোগ্য কোন কিছুই ছিল না। এমনকি ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ-সুবিধাও ছিল অত্যন্ত সীমিত। এর ফলে মদীনার অর্থনৈতিক ভারসাম্য মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়ে পড়ল। ইসলাম বিরোধী চক্র এ বিপর্যয়ের সুযোগ নিয়ে অর্থনৈতিক বয়কট আরম্ভ করে দেয়। কাজেই আমদানী সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায় এবং অবস্থা অত্যন্ত সঙ্গীন হয়ে পড়ে। কিন্তু মুসলিমগণের বিরুদ্ধে অন্তরে কোন বিদ্বেষ বিরোধিতা কিংবা শত্রুতার মনোভাব ছিল না।
(খ) দ্বিতীয় সম্প্রদায়ঃ মদীনার মূল পৌত্তলিক (মুশরিক) অধিবাসী এ সম্প্রদায়ভুক্ত। মুসলিমগণের উপর এদের কোন নেতৃত্ব বা কর্তৃত্ব ছিল না। কিছু সংখ্যক মুশরিক সন্দেহ ও দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে পড়েছিল এবং পৈতৃক ধর্ম পরিত্যাগের ব্যাপারে সন্দিহান ও অনিচ্ছুক ছিল, কিন্তু মুসলিমগণের বিরুদ্ধে তাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ বিরোধিতা কিংবা শত্রুতার মনোভাব ছিল না। এ শ্রেণীর মানুষ স্বল্প কালের মধ্যেই ইসলাম গ্রহণ করে এবং নিষ্ঠাবান মুসলিমগণের দলভুক্ত হয়ে যায়।
পক্ষান্তরে এমন কিছু সংখ্যক মুশরিক ছিল যারা অন্তরে অন্তরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও মুসলিমগণের প্রতি বিদ্বেষ, হিংসা ও শত্রুতা পোষণ করত, কিন্তু তাঁদের সঙ্গে মোকাবেলা করার ক্ষমতা তাদের ছিল না। অন্তরে তাদের যেভাবেই থাক না কেন, প্রকাশ্যে তার মৈত্রী ও বন্ধুত্বের ভাব প্রকাশে বাধ্য হতো। এদের মধ্যে প্রথম সারিতে ছিল আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সলুল। আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ছিল সেই ব্যক্তি যাকে বুআসের যুদ্ধের পর আউস ও খাযরাজ গোত্র থেকে নেতা নির্বাচনের সিদ্ধান্তে একমত হয়ে ছিল। অথচ এর পূর্বে এ দু’গোত্র মিলিতভাবে কোন লোককে নেতা নির্বাচনের ব্যাপারে এক মত হতে পারে নি। নেতা নির্বাচনের পর তার জন্য মনিমুক্তা খচিত মুকুট তৈরি করা হচ্ছিল। এ মুকুট পরিয়ে দেয়ার পর তাকে মদীনার রাজা হিসেবে অভিষেক অনুষ্ঠানের কথা ছিল। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে মদীনায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আগমনের ফলে পট পরিবর্তিত হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হয়ে উঠেন মদীনা সমাজের মধ্যমণি। এর ফলে আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের ধারণা বদ্ধমূল হয়ে যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কারণেই মদীনার রাজ সিংহাসন থেকে তাকে বঞ্চিত হতে হয়েছে। ফলে অত্যন্ত পাকাপাকিভাবে সে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)’র বিরুদ্ধাচরণে লিপ্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে নানাভাবে নানা চক্রান্তে করেও সে তেমন কোন সুবিধা করতে পারল না। বদরের যুদ্ধের পর যখন সে দেখল যে, অবস্থা মোটেই তার অনুকূল নয় এবং শিরকের উপর অটল থাকার কারণে তাকে পার্থিব ফায়দা থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে, তখন সে বাহ্যিকভাবে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দিয়ে বসল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে কাফেরই ছিল।
এ কারণে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও মুসলিমগণের বিরুদ্ধে শত্রুতার সামান্যতম সুযোগ পেলেও তার সদ্ব্যবহার করতে সে পিছপা হতো না। তার সঙ্গে সাধারণতঃ ঐ সকল নেতার সম্পর্ক ছিল যারা তার রাজত্বে বড় বড় পদ পাওয়ার আশায় আশান্বিত ছিল। কিন্তু মুসলিমগণের প্রাধান্যের ফলে এদেরকে তাদের আকাঙ্খিত পদ ও প্রতিপত্তি থেকে বঞ্চিত হতে হল। এ জন্য তাদের আক্ষেপও কম ছিল না। এ হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার মানসে তারা কোন কোন সময় সরল প্রাণ মুসলিম যুবকদেরকে অস্ত্র হিসেবে চাইত।
(গ) তৃতীয় সম্প্রদায়ঃ মদীনার ইহুদীগণ হচ্ছে এ শ্রেণীভুক্ত। এরা এ্যাসিরীয় ও রোমীয়গণের অন্যায় অত্যাচার জর্জরিত হয়ে হিজাযে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এরা ছিল প্রকৃতপক্ষে ইবরানী (হিব্রু) ভাষাভাষী। কিন্তু হিজাযে বসবাসের পর তাদের চাল-চলন, ভাষা এবং তাহযীব-তামুদ্দুন ইত্যাদি সম্পূর্ণরূপে আরবী রঙে রঞ্জিত হয়ে গিয়েছিল। এমনকি তাদের গোত্রীয় এবং ব্যক্তিমন্ডলও আরবী সংস্কৃতির প্রভাব দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। শুধু তাই নয়, ইহুদী এবং আরবদের মধ্যে বিবাহ শাদির সম্পর্কও স্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের বংশধারা এবং বংশপরিচয় ঠিকই ছিল। আরবদের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে মিশে যায় নি। বরং নিজেদেরকে ইহুদী বা ইসরাঈলী জাতীয়তাবাদের অনুসারী বলে গর্ববোধ করত এবং আরবদের অত্যন্ত নিকৃষ্ট শ্রেণীর বলে মনে করত। কোন কোন ক্ষেত্রে তাদেরকে অশিক্ষিত, বর্বর, হিংস্র, নীচ, অচ্ছুৎ ইত্যাদি বিশেষণে বিশেষিত করতেও ছাড়ত না। তাদের ধারণা ছিল যে, অরবদের সম্পদ তাদের জন্য বৈধ বা হালাল। আরবদের সম্পদ এভাবে যথেচ্ছ ব্যবহার করার ফলে ইরশাদ হয়েছে,
{وَمِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ مَنْ إِن تَأْمَنْهُ بِقِنطَارٍ يُؤَدِّهِ إِلَيْكَ وَمِنْهُم مَّنْ إِن تَأْمَنْهُ بِدِيْنَارٍ لاَّ يُؤَدِّهِ إِلَيْكَ إِلاَّ مَا دُمْتَ عَلَيْهِ قَآئِمًا ذٰلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوْا لَيْسَ عَلَيْنَا فِي الأُمِّيِّيْنَ سَبِيْلٌ} [آل عمران: 75].
‘আহলে কিতাবের মধ্যে কেউ কেউ এমন আছে যে, যদি তাদের নিকট স্বর্ণের স্তুপ গচ্ছিত রাখ, তবে তোমাকে তা ফেরত দেবে, পক্ষান্তরে তাদের কেউ কেউ এমন যে, একটি দিনারও যদি তাদের নিকট গচ্ছিত রাখ, তার পেছনে লেগে না থাকলে সে তোমাকে তা ফেরত দেবে না, এটা এজন্য যে, তারা বলে, ‘নিরক্ষরদের প্রতি আমাদের কোন দায়-দায়িত্ব নেই’।’ (আল-‘ইমরান ৩ : ৭৫)
ধর্ম প্রচারের ব্যাপারে ইহুদীদের মধ্যে কোন প্রকার সংগ্রামী চেতনা কিংবা উৎসাহ উদ্দীপনা চোখে পড়ত না। ধর্মের মূল প্রতিপাদ্য তাদের মধ্যে যা লক্ষ্য করা যেত তা হল ভালো মন্দ লক্ষণ নির্ধারণ করা, যাদু ও টোনার ঝাঁড়ফুঁক এবং আরও নানা প্রকার তুকতাক করা। এসকল কাজের জন্যই তারা নিজেদেরকে জ্ঞানী গুণী এবং আধ্যাত্মিক ইমাম ও নেতা মনে করত।
অর্থোপার্জনের নানা পন্থা প্রক্রিয়া ও কৌশলাদির ব্যাপারে ইহুদীরা ছিল অত্যন্ত সিদ্ধহস্ত। বিখ্যাত শস্যাদি, খেজুর, মদ এবং বস্ত্র ব্যবসায়ে তারা ছিল সে জমানায় শীর্ষ স্থানীয় । তারা খাদ্যশস্য, বস্ত্র, মদ ইত্যাদি আমদানী করত এবং খেজুর রপ্তানী করত। এছাড়া অন্যান্য বিভিন্ন কাজেও তারা নিয়োজিত থাকত। ব্যবসা-বাণিজ্য করতে গিয়ে তারা আরবদের নিকট থেকে অত্যন্ত উচ্চ হারে মুনাফা আদায় করত। শুধু তাই নয়, তারা চড়া সুদে সুদী কারবারও করত। এ সকল সুদখোর ইহুদীরা আরবের বড় বড় ব্যবসায়ী নেতাদের সুদী ঋণ প্রদান করত। এ সকল ঘাতক ব্যবসায়ী ও নেতাগণ ঋণদাতা ইহুদীগণের প্রশংসা কীর্তনের জন্য এবং প্রশংসাসূচক কাব্য রচনার জন্য কবিদের অর্থ যোগান দিত। ঋণদানের সময় ইহুদীগণ ঋণ পরিশোধের পরবর্তী কালে চড়া সুদের ফলে সুদ আসলে ঋণলব্ধ অংকের অর্থ যখন অতিমাত্রায় ফুলে ফেঁপে উঠত তখন ঋণ গ্রহীতাদের পক্ষে সেই ঋণ পরিশোধ করা সম্ভবপর হয়ে উঠত না। ফলে তাদের দায়বদ্ধ সম্পত্তি ইহুদীদের অধিকারে চলে যেত।
এরা কুচক্র, ষড়যন্ত্র, যুদ্ধ ও শত্রুতার অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করতে সিদ্ধহস্ত ছিল। তারা এত সূক্ষ্ণ ও কূটকৌশলের সঙ্গে প্রতিবেশী গোত্রসমূহের মধ্যে শত্রুতার বীজ বপন করত যে, তারা এ ব্যাপারে কোন অাঁচই পেতনা। তাদের কুচক্রিপণার ফলশ্রুতিতে গোত্রে গোত্রে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলতে থাকত। ঘটনাচক্রে যুদ্ধের তীব্রতা কিছুটা মন্দীভূত হলে তারা পুনরায় কুট-কৌশল প্রয়োগ করে তার তীব্রতা বাড়িয়ে দিত। এক্ষেত্রে সব চাইতে মজার ব্যাপার ছিল গোত্রে গোত্রে যখন ধবংসযজ্ঞ চলত তখন আরবদের এ ধ্বংসলীলা যাতে বন্ধ হয়ে না যায়, তদুদ্দেশ্যে যুদ্ধমান পক্ষদ্বয়কে বিশাল বিশাল অংকের ঋণ স্বল্প সুদে প্রদান করত এবং বিনিময়ে তাদের সহায়-সম্পত্তি দায়বদ্ধ করে রাখত। এভাবে ক্বায়দা-কৌশল করে দোধারী অস্ত্রের মতো তারা দ্বিমুখী মুনাফা লুটত। অধিকন্তু এক দিকে তারা ইহুদী ঐক্য সংরক্ষিত করার ব্যাপারে যেমন সর্বক্ষণ স্বচেষ্ট থাকত অন্যদিকে তেমনি সুদের বাজার গরম রাখার জন্য সর্বক্ষণ সক্রিয় থাকত।
ইয়াসরিবের ইহুদী গোত্রগুলোর তিনটি গোত্র ছিল সমাধিক প্রসিদ্ধ। এ গোত্রদ্বয় হচ্ছেঃ
১. বনু ক্বাইনুক্বা : এরা ছিল খাযরাজদের মিত্র এবং এদের আবাসস্থল মদীনার মধ্যেই ছিল।
২. বনু নাযীর : এরা ছিল খাযরাযের মিত্র এবং এদের আবাসস্থল মদীনার উপকণ্ঠে।
৩. বনু কুরাইযাহ : এ গোত্র দুটি ছিল আউসদের মিত্র। এদের বাসস্থান ছিল মদীনার উপকণ্ঠে।
প্রায় এক যুগ যাবৎ এ গোত্রদ্বয় আউস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয়ের মধ্যে যুদ্ধাগ্নি প্রজ্জ্বলিত করে রেখেছিল এবং বুআসের যুদ্ধে আপন আপন মিত্র গোত্রের পক্ষে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিল।
ইসলাম ও মুসলিমগণের সঙ্গে ইহুদীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে সংক্ষেপে এ টুকুই বলা যায় যে, তারা কখনই মুসলিমগণকে সুনজরে দেখত না। তারা সর্বদাই মুসলিমগণের ব্যাপারে প্রতিহিংসাপরায়ণ ও শত্রুভাবাপন্ন থাকত। কারণ, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সঙ্গে তাদের গোত্রীয় কিংবা বংশজাত কোন সম্পর্কই ছিল না। প্রসঙ্গক্রমে এটা বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, তাদের বংশীয় টান তাদের আত্মা ও মন মেজাজের অংশ হিসেবে স্থান লাভ করত এবং এতে তারা প্রচুর আনন্দও পেত।
ইসলাম সম্পর্কে তাদের বিরূপ ভাবাপন্ন হওয়ার অন্য একটি কারণ ছিল এর দাওয়াত ছিল একটি অত্যন্ত উকৃষ্ট মানের দাওয়াত যা ভাঙ্গা অন্তরকে জোড়া দিয়ে চলছিল, হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতার অগ্নিকে নির্বাপিত করছিল, সকল লেনদের ক্ষেত্রে বিশ্বস্ততা ও পবিত্রতার পথ অবলম্বন এবং হালাল উপার্জন ও হালাল ভক্ষণের জন্য মানুষকে অনুপ্রাণিত ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছিল। এর ফলে ইয়াসরিবের গোত্রসমূহের মধ্যকার শিথিল সম্পর্ক ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী ও মজবুত হয়ে উঠতে থাকল যা হহুদীদের মনে দারুণ প্রতিক্রিয়া ও আতঙ্কের সৃষ্টি করল। এ ব্যাপারে তাদের আশঙ্কা ছিল ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে তাদের রমরমাপূর্ণ সূদী কারবার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যাবে। তাছাড়া, সূদী কারবার সূত্রে কূট-কৌশলের মাধ্যমে মদীনাবাসীগণের যে সকল সম্পদ তারা কুক্ষিগত করে রেখেছিল সে সব কিছুই তাদেরকে ফেরৎ দিতে বাধ্য হতে হবে।
যখন ইহুদীগণ বুঝতে পারল যে, ইসলামী দাওয়াত ইয়াসরিবের মাটিতে নিজের জন্য স্থান করে নিয়ে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তখন থেকেই তারা এটাকে তাদের জন্য একটি প্রকৃত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে নিল। একারণেই রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ইয়াসরিবে আগমনের সঙ্গে সঙ্গে ইসলাম ও মুসলিমগণের সঙ্গে তারা শত্রুতা আরম্ভ করে দিল। অবশ্য একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাদের এ শত্রুতা গোপনে গোপনেই চলেছিল। তার পর প্রকাশ্যে শত্রুতা করার সৎসাহস তারা অর্জন করে। ইবনে ইসহাক্ব বর্ণিত একটি ঘটনা সূত্রে এ ব্যাপার সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা লাভ করা যায় :
তাঁর বর্ণনায় রয়েছে যে, ‘আমি উম্মুল মু’মিনীন সাফিয়্যাহ বিনতে হুয়াই বিন আখতাব (রাঃ) থেকে এ বর্ণনা প্রাপ্ত হয়েছি যে, তিনি বলেন, ‘আমি আমার আববা ও চাচাজান আবূ ইয়াসেরের নিকট তাদের সন্তানদের মধ্যে সব চাইতে অধিক প্রিয় ছিলাম। তাঁদের অন্যান্য সন্তানদের সঙ্গে থেকে আমি যখনই তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতাম তাঁরা সকলের চাইতে আমাকেই অধিক ভালবাসতেন এবং সকলের আগে আমাকেই কোলে তুলে নিতেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন মদীনায় আগমন করলেন তখন আমার পিতা হুয়াই ইবনে আখতাব ও আমার চাচা আবূ ইয়াসার অতি প্রত্যুষে তাঁর দরবারে উপস্থিত হলেন। ক্লান্ত ও অবসন্ন অবস্থায় সূর্যাস্তের সময় টাল খেতে খেতে তারা ফিরছিলেন, আমি উঁকি মেরে তাদের দেখার পর পূর্বের নিয়ম মাফিক দৌড় দিয়ে তাঁদের নিকট গেলাম, কিন্তু আল্লাহর শপথ তাঁরা এত বেশী চিন্তিত ছিলেন যে, আমার প্রতি তারা ফিরেও তাকালেন না। আমি আমার চাচাকে বলতে শুনলাম, তিনি আববাকে বলছিলেন, ‘ইনিই কি তিনি’’? আববা বললেন, ‘হ্যাঁ, আল্লাহর শপথ!’ চাচা পুনরায় বললেন, ‘আপনি তাকে ঠিক ঠিক চিনতে পারছেন তো’’?
পিতা বললেন, ‘হ্যাঁ’’।
তারপর চাচা বললেন, ‘তার ব্যাপারে আপনি এখন মনে মনে কী ধারণা পোষণ করছেন?
পিতা বললেন, ‘শত্রুতা, আল্লাহর শপথ! যতদিন জীবিত থাকব’’।[1]
এর সাক্ষ্য সহীহুল বুখারী শরীফের একটি বর্ণনায় পাওয়া যায়, যাতে আব্দুল্লাহ বিন সালামের ইসলাম গ্রহণের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। তিনি ইহুদী সম্প্রদায়ের একজন উঁচুদূরের আলেম ছিলেন। তিনি যখন অবগত হলেন যে, নাবী (সাঃ) বণী নাজ্জার গোত্রে আগমন করেছেন তখন তিনি খুব তাড়াতাড়ি তাঁর দরবারে গিয়ে উপস্থিত হলেন এবং তাকে কয়েকটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন, যার উত্তর একমাত্র নাবীগণ ছাড়া অন্য কেউই দিতে পারেন না। তিনি যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট থেকে প্রশ্ন সমূহের উত্তর পেয়ে গেলেন, তখন তিনি সেখানেই মুসলিম হয়ে গেলেন এবং তাঁকে বললেন যে, ইহুদীরা হচ্ছে মিথ্যা অপবাদকারী এক ঘৃণিত সম্প্রদায়। আমার ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারটি জানার পর যদি তাদেরকে আমার সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তবে তাঁরা আমার সম্পর্কে মিথ্যা অপবাদ দিতে থাকবে।
এ কথা শোনার পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইহুদীদেরকে ডেকে পাঠালেন। তারা এ আহবানে তাঁর দরবারে এসে উপস্থিত হল, এদিকে আব্দুল্লাহ বিন সালাম গৃহকোণে আত্মগোপন করে রইলেন। এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আব্দুল্লাহ বিন সালাম কেমন লোক তা জানতে চাইলেন। প্রত্যুত্তরে তারা বলল, ‘তিনি হচ্ছেন আমাদের মধ্যে সব চাইতে বড় আলেম এবং সব চাইতে বড় আলেমের পুত্র, তিনি হচ্ছেন আমাদের মধ্যে সব চাইতে ভাল মানুষ এবং সব চাইতে ভাল মানুষের পুত্র।’
অন্য এক বর্ণনা সূত্রে জানা যায় যে, তারা বলল, ‘তিনি আমাদের সর্দার এবং সর্দারের ছেলে। আরও এক বর্ণনাতে রয়েছে যে, তারা বলল, ‘তিনি হচ্ছেন আমাদের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট ব্যক্তি এবং সর্বোৎকৃষ্ট ব্যক্তির সন্তান।’
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘আচ্ছা বলত আব্দুল্লাহ যদি মুসলিম হয়ে যায় তবে?’
ইহুদীগণ দু’ কিংবা তিনবার বলল, ‘আল্লাহ যেন তাঁকে এ থেকে রক্ষা করেন।’ এ কথা শ্রবণান্তে আব্দুল্লাহ বিন সালাম ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন,
أَشْهَدُ أَن لاَّ إِلٰهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَه” لاَ شَرِيْكَ لَه”، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا رَسُوْلُ اللهِ
অর্থঃ ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্যিকারের কোন উপাস্য নেই এবং আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল।’
এ কথা শোনা মাত্রই ইহুদীগণ বলে বসল, (এ হচ্ছে আমাদের মধ্যে সব চাইতে খারাপ লোক এবং সব চাইতে খারাপ লোকের সন্তান)। এর পর তারা তার কুৎসা বর্ণনা করতে শুরু করে দিল। একটি বর্ণনায় আছে, আব্দুল্লাহ বিন সালাম (রাঃ) এ সময় বললেন, ‘হে ইহুদীদের দল! আল্লাহকে ভয় কর। সেই আল্লাহর শপথ! যিনি ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই। তোমরা আরও জান যে, তিনি (মুহাম্মাদ (সাঃ)) আল্লাহর রাসূল এবং তিনি সত্যসহ আগমন করেছেন।’
কিন্তু ইহুদীরা বলল, ‘তুমি মিথ্যা বলছ’’।[2]
এটা ছিল ইহুদী সম্প্রদায় সম্পর্কিত রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রথম অভিজ্ঞতা। আর তা মদীনায় প্রবেশের প্রথম দিনেই অর্জন হয়েছিল।
এ পর্যন্ত যে সকল বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হল, তা ছিল রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মদীনায় প্রবেশ কালীন অবস্থা ও ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত। মদীনার বাইরে মুসলিমগণের সব চাইতে শক্তিশালী শত্রু ছিল কুরাইশ মুশরিকগণ। মুসলিমগণকে দশ বছর যাবৎ তাদের প্রবল চাপ, ভীতি প্রদর্শন, অত্যাচার, উৎপীড়ন এবং জুলুম নির্যাতনের মধ্যে বসবাস করতে হয়। পক্ষান্তরে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাঃ)-এর উপর দৃঢ় বিশ্বাস, ঈমান-আমান সংক্রান্ত সুষ্ঠু প্রশিক্ষণ, ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং সহিষ্ণুতা ইত্যাদির মাধ্যমে মুসলিমগণের আত্মিক উৎকর্ষতা চরমে পৌঁছেছিল। যার ফলে অনেক অসুবিধার মধ্যে থেকে তাঁদের মনোবল উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েই চলেছিল।
মুসলিমগণ যখন মদীনায় হিজরত করলেন, কুরাইশ মুশরিকগণ তখন তাঁদের বাড়িঘর এবং ধন-সম্পত্তি নিজেদের অধিকারভুক্ত করে নিয়েছিল। শুধু সে সব নিয়েই তারা ক্ষান্ত হল না, মুসলিমগণের সঙ্গে তাঁদের আত্মীয়-স্বজনদের যোগাযোগ রক্ষা করে চলার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলল, অধিকন্তু, তারা যাকে পেল তাকেই বন্দী করে রাখল এবং তাদের উপর অমানুষিক জুলুম-নির্যাতন চালাতে থাকল। কিন্তু এত করেও তারা ক্ষান্ত হল না, আরও চরম ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে তারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে হত্যা এবং তাঁর দাওয়াতকে সমূলে ধ্বংস করার জন্য চেষ্টা চালাতে থাকল। তা সত্ত্বেও মুসলিমগণ যখন কোনভাবে জীবন রক্ষা করে পাঁচশ’ কিলোমিটার দূরত্বে মদীনায় গিয়ে উপস্থিত হলেন তখন কুরাইশগণ সুযোগের সদব্যবহার করে এক রাজনৈতিক কূটকৌশলের প্রয়োগ শুরু করল। যেহেতু তারা ছিল বায়তুল্লাহ শরীফের প্রতিবেশী, সে কারণে আরব বাসীদের মধ্যে তাদের ধর্মীয় নেতৃত্ব, পার্থিব ঐশ্বর্য ও পদসমূহ তাদের অধিনস্থ ছিল। এ কারণে তারা আরব উপদ্বীপের মুশরিক অধিবাসীদেরকে মদীনার বিরুদ্ধে উস্কানি প্রদান করে সম্পূর্ণভাবে বয়কট করে ফেলল। যার ফলে মদীনায় জিনিসপত্র আমদানী ক্রমেই হ্রাস পেতে থাকল। অথচ মুহাজিরদের সংখ্যা দিনে দিনে বৃদ্ধি পেতেই থাকল। প্রকৃতপক্ষে মক্কার বিরুদ্ধবাদীদের সঙ্গে মদীনার মুসলিমগণের নতুন অবস্থার প্রেক্ষাপটে যুদ্ধাবস্থার সৃষ্টি হয়ে গেল। যারা সমস্যার অভ্যন্তরে প্রবেশ না করে এ যুদ্ধের দোষ এবং দায়-দায়িত্ব মুসলিমগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দিল তাদের সম্পর্কে বুঝতে হবে যে, হয় তারা বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে একথা বলছে, নতুবা এ ব্যাপারে তাদের কোন ধারণাই নেই।
মুসলিমগণের জন্য এ পর্যায়ে নায্য প্রাপ্য এটাই ছিল যে, যেভাবে তাদের সম্পদ হরণ করা হয়েছে তেমনিভাবে তাঁরাও দুস্কৃতিকারীদের সম্পদ হরণ করবেন, যেভাবে তাঁদের প্রতি অত্যাচার উৎপীড়ন চালানো হয়েছে সেভাবে তাঁরাও অত্যাচারীদের উপর অত্যাচারের প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন, যেভাবে মুসলিমগণের জীবনধারণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে, তেমনিভাবে তাঁরাও তাদের জীবন ধারণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবেন। মোট কথা, দুষ্কৃতিকারীদের সঙ্গে ‘যেমন কর্ম তেমনি ফল’ নীতি অবলম্বন করে চলবেন যাতে মুসলিমগণের প্রতি তাদের প্রতিহিংসাপরায়ণতা এবং ইসলামের মূলোৎপাটনের ধারণা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।
বর্ণিত ঘটনা প্রবাহ ও সমস্যাসমূহ যেগুলো রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নাবী, রাসূল, হাদী ও নেতা হিসেবে মদীনা আগমনের পর প্রত্যক্ষ করেন, তিনি সে সকল সমস্যার সমাধান করেছিলেন নাবী এবং নেতা সুলভ ভূমিকার মাধ্যমে। যে সম্প্রদায় দয়া পাবার যোগ্য তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন এবং যারা কঠোরতা পাবার যোগ্য তাদের প্রতি কঠোরতা প্রদর্শনের মাধ্যমে তিনি এ সকল সমস্যার সমাধান করেছিলেন। তবে এতে কোন সন্দেহ নেই যে, কঠোরতার চাইতে দয়াই তাঁর অধিক কাম্য এবং প্রিয় ছিল। যার ফলে স্বল্প কালের মধ্যেই ইসলামের চাবিকাঠি মুসলিমগণের নিয়ন্ত্রণে এসে যায়। পরবর্তী পৃষ্ঠাসমূহে এ সবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করা হবে।
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৫১৮-৫১৯ পৃঃ।
[2] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৪৫৯, ৫৫৬ ও ৫৬১ পৃঃ।
প্রথম পর্যায়
নতুন সমাজ ব্যবস্থার রূপায়ণ (بِنَاءُ مُجْتَمِعٍ جَدِيْدٍ ):
ইতোপূর্বে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মদীনায় আগমন করে প্রথম হিজরী রবিউল আওয়াল মাসের ১২ই তারীখে জুমআর দিন মোতাবেক ২৭শে সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে বনী নাজ্জার গোত্রের আবূ আইউব আনসারীর বাড়ির সম্মুখে অবরতণ করেছিলেন এবং বলেছিলেন ‘ইন-শা-আল্লাহ এটাই হবে আমার অবস্থান।’ তারপর তিনি আবূ আইউব আনসারীর বাড়িতে স্থানান্তর হয়ে যান।
ফুটনোটঃ
মসজিদে নাবাবীর নির্মাণ (بِنَاءُ الْمَسْجِدِ النَّبَوِيْ ):
এরপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রথম কাজ হল মসজিদে নাবাবীর নির্মাণ। আর এজন্য ঐ স্থানটিই নির্ধারিত হল যেখানে সর্ব প্রথম তাঁর উটটি বসে পড়েছিল। এ স্থানটির মালিক ছিল দু’জন অনাথ বালক। তিনি ঐ স্থানটি ন্যায্য মূল্যে ক্রয় করলেন এবং স্বশরীরে মসজিদের নির্মাণ কাজে অংশগ্রহণ করলেন। তিনি ইট ও পাথর বহন করছিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বলছিলেন,
[اَللَّهُمَّ لاَ عَيْشَ إِلاَّ عَيْشُ الآخرة ** فاغْفِرْ للأنصار والمُهَاجِرَة]
অর্থঃ ‘হে আল্লাহ! জীবন তো কেবল পরকালেরই জীবন। অতএব আনসার ও মহাজিরদেরকে ক্ষমা করুন।’
অধিকন্তু এ কথাও বলছিলেন,
[هذا الحِمَالُ لا حِمَال خَيْبَر ** هــذا أبـَــرُّ رَبَّنَا وأطْـهَر]
অর্থঃ ‘এটা খায়বারের বোঝা নয়, এ আমার প্রভূর পক্ষ হতে অধিক পুণ্যময় ও পবিত্র।’
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কর্মধারা সাহাবীগণ (রাঃ)-কে উৎসাহিত, উদ্দীপিত ও উজ্জীবিত করছিল। কাজে তারাও বলছিলেন,
لئن قَعَــدْنا والنبي يَعْمَل ** لـذاك مِــنَّا العَمَــلُ المُضَلَّل
অর্থঃ ‘যদি আমরা বসে থাকি এবং নাবী (সাঃ) কাজ করেন, তাবে আমাদের এ কাজ হবে পথভ্রষ্টতার’’।
এ জমিতে মুশরিকদের কিছু সংখ্যক কবর ছিল। কিছু অংশ পতিত ছিল। তাছাড়া খেজুর ও গারকাদের কয়েকটি গাছ ছিল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মুশরিকদের কবরগুলো পরিষ্কার করিয়ে নিলেন, অসমতল জায়গাটা সমতল করলেন এবং খেজুর ও অন্য গাছগুলো কাটিয়ে ক্বিবলাহর দিকে খাড়া করে দিলেন। সে সময় ক্বিবলাহ বায়তুল মুক্বাদ্দাস। দরজার দু’বাহুর স্তম্ভগুলো পাথর দ্বারা এবং দেওয়াল নির্মিত হল কাঁচা ইট দিয়ে। ছাদের উপর খেজুরের ডালপালা চাপিয়ে আবরণ তৈরি করা হল আর খেজুর গাছের গুড়ি দিয়ে থাম তৈরি করা হল। মেঝেতে বিছানো হল বালি ও ছোট ছোট কাঁকর। ঘরের তিন দরজা লাগানো হয়েছিল। ক্বিবলাহর দেওয়াল হতে পিছনের দেওয়াল পর্যন্ত দৈর্ঘ ছিল ১০০ (একশত) হাত আর প্রস্থও ছিল ঐ পরিমাণ অথবা কিছু কম। ভিতরে গভীরতা ছিল তিন হাত।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মসজিদের পাশে কয়েকটি ঘর তৈরি করিয়ে নিলেন যার দেয়াল ছিল কাঁচা ইটের এবং ছাদ ছিল খেজুরের গুঁড়ির বর্গা দিয়ে। ছাউনি দেয়া হয়েছিল খেজুরের শাখা ও পাতা দিয়ে তৈরি। এগুলো ছিল উম্মাহাতুল মু’মিনীন নাবী পত্নীগণের (রাঃ) আবাস কক্ষ। এ কক্ষগুলোর কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আবূ আইউব আনসারী (রাঃ)-এর বাসা থেকে এ আবাসস্থানে স্থানান্তর হয়ে গিয়েছিলেন।[1]
মসজিদে নাবাবী শুধুমাত্র সালাত আদায়ের কেন্দ্রবিন্দুই ছিল না, বরং তা ছিল তৎকালীন মুসলিম রাষ্ট্রের বিভিন্নমুখী কর্মকান্ডের উৎসস্থল। এ মসজিদেই ছিল মুসলিম সামাজের আদিশিক্ষা কেন্দ্র যেখানে বসে মুসলিমগণ ইসলামের যাবতীয় শিক্ষাদিক্ষা এবং হেদায়াতের পাঠ গ্রহণ করতেন, এ মসজিদেই ছিল এমন একটি মিলনকেন্দ্র যেখানে জাহেলিয়াত জীবনের দীর্ঘ কালের বিবাদ বিসম্বাদ ও যুদ্ধ-বিগ্রহের অবসান ঘটিয়ে আরব গোত্রগুলোর মধ্যে সৌহার্দ ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন গড়ে তোলা হয়েছিল, এ মসজিদেই বসত রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম পরিচালনার পরামর্শ সভা। রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণ, সৈন্য পরিচালনা, সন্ধি স্থাপন, চুক্তি সম্পাদন ইত্যাদি যাবতীয় কাজকর্মের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এ মসজিদে নাবাবী। অধিকন্তু, এ মসজিদেই ছিল অনেক নিবেদিত সাহাবী (রাঃ)-এর আবাসস্থল, যাঁদের বাড়িঘর, ধন-সম্পদ এবং আত্মীয়-স্বজন বলতে কিছুই ছিল না।
হিজরতের প্রথম দিকেই আযান প্রথা প্রচলিত হয়। এটা এমন এক সুরেলা স্বর্গীয় সঙ্গীত এবং সালাত কায়েমের উদ্দেশ্যে মসজিদে আগমনের জন্য এমন মনোজ্ঞ আহবান যা প্রত্যহ পাঁচবার প্রচারিত হয় মসজিদের মিনার থেকে। মসজিদে নাবাবীতে যখন আযান দেয়া হতো এবং আযানের গুরু গম্ভীর আওয়াজ যখন আকাশের দিকে দিকে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকত, তখন একদিকে আল্লাহ প্রেমিক মুসলিমদের অন্তর ভালবাসায়, ভক্তিতে, আবেগে উদ্বেলিত হয়ে উঠত, অন্যদিকে কাফির মুশরিকদের অন্তর ভয়-ভীতিতে প্রকম্পিত হয়ে উঠত। এ সম্পর্কে আব্দুল্লাহ বিন যায়দ বিন আবদে রাব্বিহীর (রাঃ) স্বপ্নের ঘটনাটি সুপ্রসিদ্ধ রয়েছে (বিস্তারিত অবগতির জন্য জামে তিরমিযী, সুনানে আবূ দাউদ, মুসনাদে আহমাদ ও সহীহুল ইবনে খুযায়মাহ’য় দৃষ্টি দেয়া যেতে পারে।)
ফুটনোটঃ[1] সহীহুল বুখারী শরীফ ১ম খন্ড ৭১, ৫৫৫ ও ৫৬০ পৃঃ। যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৫৬ পৃঃ।
মুসলিমগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন স্থাপন (المُؤَاخَاةُ بَيْنَ الْمُسْلِمِيْنَ):
মসজিদে নাবাবীর নির্মাণ কাজে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এবং মুসলিমগণ যেভাবে পারস্পরিক বোঝাপড়া, সাহায্য সহযোগিতা এবং উৎসাহ-উদ্দীপনার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তেমনভাবে মুসলিমগণের মধ্যে এমন অপূর্ব এক ভ্রাতৃত্ব বন্ধন প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছিলেন যার তুলনা মানব জাতির ইতিহাসে কোথাও মিলে না। মুসলিমগণের এ ভ্রাতৃত্ব বন্ধনকে ‘মুহাজির ও আনসারগণের ভ্রাতৃত্ব বন্ধন’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। ইবনুল কাইয়্যেম লিখেছেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আনাস বিন মালেকের গৃহে মুহাজির ও আনসারগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন স্থাপন করিয়েছিলেন। এ সভায় সর্বশেষ নব্বই জন মুসলিম উপস্থিত ছিলেন, অর্ধেক সংখ্যক ছিলেন মুহাজির এবং অর্ধেক সংখ্যক আনাসার। ‘মুহাজির আনসার ভ্রাতৃত্বের’ মূলনীতি গুলো ছিল, ‘একে অন্যের দুঃখে দুঃখিত হবেন এবং মৃত্যুর পর নিজ আত্মীয়ের মতো একে অন্যের ওয়ারেস বা উত্তরাধিকারী হবেন। ওয়ারাসাত বা উত্তরাধিকারের এ ব্যবস্থা বদর যুদ্ধ পর্যন্ত চালু ছিল। তারপর যখন এ আয়াতে শরীফা,
{وَأُوْلُوْا الأَرْحَامِ بَعْضُهُمْ أَوْلَى بِبَعْضٍ} [الأنفال: 75]
‘‘কিন্তু আল্লাহর বিধানে রক্ত সম্পর্কীয়গণ পরস্পর পরস্পরের নিকট অগ্রগণ্য।’ (আল-আনফাল ৮ : ৭৫)
বলা হয়ে থাকে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কেবলমাত্র মুহাজিরীনদের মধ্যে আরও এক ভ্রাতৃত্ব বন্ধন গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু প্রথম মতটিই অধিক প্রামণ্য ও গ্রহণযোগ্য। কেননা, মুহাজিরীনগণ এমনিতেই পরস্পর ইসলামী ভ্রাতৃত্বে, দেশীয় ও গোত্রীয় ভ্রাতৃত্বে এবং আত্মীয়তার বন্ধনের কারণেই তাঁদের মধ্যে নতুন করে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু আনসারদের ব্যাপারটি ছিল ভিন্ন।[1]
এ ভ্রাতৃত্বের উদ্দেশ্য সম্পর্কে মুহাম্মাদ গাযালী লিখেছেন যে, ‘এ ছিল মূর্খতার যুগের বংশীয় সম্পর্ক ছিন্নকারী। আত্মীয়তা বা অনাত্মীয়তার সম্পর্ক যা কিছু হবে তা হবে ইসলামের জন্য। এরপর থেকে মানুষে মানুষে বংশ, বর্ণ ও দেশের সম্পর্ক মুছে যাবে। উঁচু, নীচু ও মানবত্বের মাপকাঠি হবে কেবলমাত্র তাকওয়ার ভিত্তিতে, অন্য কোন কিছুর ভিত্তিতে নয়।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এ ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে শুধুমাত্র ফাঁকা বুলির পোষাক পরে ক্ষান্ত হন নি, বরং এ ছিল এমন এক কার্যকর অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি যা রক্ত ও ধন-সম্পদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। এটা শুধু ফাঁকা বুলি এবং গতানুগতিক সালাম ও মুবারকবাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এ ভ্রাতৃত্বের মধ্যে ছিল সমবেদনা, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার এক অপূর্ব সংমিশ্রণ। আর এ কারণেই তাঁর পরিকল্পিত ও প্রতিষ্ঠিত এ নবতর জীবনধারা মানব জাতির ইতিহাসে এমন এক অধ্যায় রচনা করেছিল কোন কালেই যার কোন তুলনা মিলে না।[2]
সহীহুল বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে যে, মুহাজিরগণ যখন মদীনায় আগমন করলেন তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আব্দুর রহমান বিন আউফ (রাঃ) এবং সা’দ বিন রাবীর মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন স্থাপনে করিয়ে দিয়েছিলেন। এর পর সা’দ (রাঃ) আব্দুর রহমানকে (রাঃ) বললেন, ‘আনসারদের আমি সর্বাপেক্ষা ধনী ব্যক্তি। আপনি আমার সম্পদ দু’ভাগে ভাগ করে অর্ধেক গ্রহণ করুন। তাছাড়া, আমার দুজন স্ত্রী রয়েছে। দুজনের মধ্যে যাকে আপনার পছন্দ হয় আমাকে বলুন, আমি তাকে তালাক দিব। ইদ্দত পালনের পর তাকে বিবাহ করবেন।’
আব্দুর রহমান (রাঃ) বললেন, ‘আল্লাহ আপনার ধনজন ও মালমাত্তায় বরকত দিন। আপনাদের বাজার কোথায়?’ তাঁকে বনু ক্বাইনুক্কা’র বাজার দেখিয়ে দেয়া হল। তিনি যখন বাজার থেকে ফিরে এলেন তখন তাঁর নিকট অতিরিক্ত কিছু পনির ও ঘি ছিল। এরপর তিনি প্রত্যহ বাজারে যেতে থাকলেন। তারপর একদিন যখন তিনি বাজার থেকে ফিরে এলেন তখন তাঁর শরীরে হলুদ রঙের চিহ্ন ছিল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা কী?’ তিনি বললেন, ‘আমি বিবাহ করেছি।’ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘স্ত্রীকে মোহর দিয়েছ তো?’ তিনি বললেন, ‘একটি খেজুরের বিচী পরিমাণ স্বর্ণ (অর্থাৎ সোয়া ভরি) দিয়েছি।[3]
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে এরূপ একটি বর্ণনা এসেছে যে, আনাসারগণ রাসূলুল্লাহ (রাঃ)-এর নিকট এ বলে আবেদন পেশ করলেন যে, ‘আপনি আমাদের এবং মুহাজিরীন ভাইদের মধ্যে আমাদের খেজুর বাগানগুলো ভাগ বন্টন করে দিন’’। তিনি বললেন, ‘না’’।
আনসারগণ বললেন, ‘তবে আপনারা অর্থাৎ মুহাজিরগণ আমাদের কাজ করে দেবেন এবং তাদেরকে আমরা ফলের অংশ দিব।
তারা বললেন, ‘ঠিক আছে, আমরা কথা শ্রবণ করলাম ও মান্য করলাম।[4]
এ থেকে সহজে অনুমান করা যায় যে, আনাসারগণ কিভাবে আন্তরিকতা ও আগ্রহের সঙ্গে আগু বেড়ে মুহাজির ভাইদের জন্য সহমর্মিতা প্রকাশ ও সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করেছিলেন এবং কতটুকু মহববত, খলুসিয়াত ও আত্মত্যাগের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। অধিকন্তু, মুহাজিরগণও তাঁদের আনসার ভাইদের প্রতি কতটুকু শ্রদ্ধাশীল, সহমর্মী ও আত্মসচেতন ছিলেন তা এ ঘটনা থেকেই প্রমাণিত হয়ে যায়। আনসারগণের আত্মত্যাগের সুযোগ তাঁরা গ্রহণ করেছিলেন কিন্তু সুযোগের অপব্যবহার কখনই করেন নি। তাঁদের ভেঙ্গে যাওয়া জীবনধারাকে ন্যূনতম প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে সচল করে তোলার জন্য যতটুকু গ্রহণ করার প্রয়োজন ছিল তাঁরা ঠিক ততটুকুই গ্রহণ করেছিলেন।
এ প্রসঙ্গটি সম্পর্কে সত্য কথা এবং এর গৃঢ় রহস্য সম্পর্কে বলতে গেলে কথা অবশ্যই বলতে হয় যে, এ ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের ভিত্তি ছিল অভাবিত ও অপূর্ব। আল্লাহ দর্শন এবং বিজ্ঞানের উর্বর পলল ভূমিতে উপ্ত হয়েছিল ইসলামী রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় নীতিমালার বীজ যার ফলে মুসলিমগণের সম্মুখে সৃষ্ট সকল সমস্যার সমাধান হয়েছিল সর্বোত্তম পন্থায়।
ফুটনোটঃ[1] যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৫৬ পৃঃ।
[2] ফিকহুস সীরাহ ১৪০ ও ১৪১ পৃঃ।
[3] সহীহুল বুখারী বাবু এখাউন নাবী (সাঃ) বায়নাল মুহাজিরীনা অল আনসার, ১ম খন্ড ৩৫৫ পৃঃ।
[4] প্রাগুক্ত বাবু ইয়াকলা আকফেনী মোউনাতান নাখলে ১ম খন্ড ৩১২ পৃঃ।
পরস্পরে ইসলামী সাহায্যের অঙ্গীকার (مِيْثَاقُ التَّحَالُفِ الْإِسْلَامِيْ):
উপরি উল্লেখিত ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের মতই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মুসলিমগণের মধ্যে আরও একটি অঙ্গীকারপত্র সম্পাদন করেছিলেন যদ্দ্বারা জাহেলিয়াত যুগের সকল গোত্রীয় গন্ডগোলের মূলোৎপাটন এবং যাবতীয় কুসংস্কার ও রসম-রেওয়াজের বিলোপ সাধন ঘটে। এ অঙ্গীকারনামার দফাগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে লিপিবদ্ধ করা হল যার রূপ ছিল এ ধরণেরঃ
এটা লিখিত হচ্ছে নাবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর পক্ষ থেকে কুরাইশ, ইয়াসরেবী এবং তাঁদের অনুসারী ও তাঁদের সঙ্গে মিলিত হয়ে জিহাদে অংশগ্রহণকারী মুসলিমগণের জন্যঃ
১. এরা নিজেদের ছাড়া অন্য সকল মানব থেকে ভিন্ন একটি গোষ্ঠি।
২. কুরাইশ মুহাজিরগণ নিজেদের পূর্বেকার অবস্থা মোতাবেক নিজেদের মধ্যে দিয়াত (হত্যার বিনিময়) দেবেন এবং মু’মিনদের মধ্যে ইনসাফের সঙ্গে বন্দীদের মুক্তিপণ প্রদান করবেন। আনসারদের সকল গোত্র নিজেদের পূর্বেকার অবস্থা মোতাবেক নিজেদের মধ্যে দিয়াত প্রদান করবেন এবং তাঁদের সকল দল ঈমানদারদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গত পন্থায় আপন বন্দীদের জন্য মুক্তিপণ প্রদান করবেন।
৩. ঈমানদারগণ কোন সহায় সম্পদহীন (অনাথ) কে মুক্তিপণ ও দিয়াত প্রদানের ব্যাপারে উত্তম পন্থা মোতাবেক প্রদান এবং সম্মান করা থেকে বিমুখ করবেন না।
৪. সকল ধর্মপ্রাণ মু’মিন ঐ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধাচরণ করবেন যারা তাঁদের প্রতি অন্যায় আচরণ করবে অথবা ঈমানদারদের বিরুদ্ধে অন্যায়, অত্যাচার, পাপ ও গন্ডগোলের পথ বেছে নেবে।
৫. মু’মিনগণ তাদের বিরুদ্ধে কাজ করবেন যদিও তাদের মধ্যে কেউ আপন পুত্রও হয়।
৬. কোন কাফিরের বদলে কোন মু’মিন কোন মু’মিনকে হত্যা করবেন না।
৭. কোন মু’মিন কোন মু’মিনের বিরুদ্ধে কোন কাফিরকে সাহায্য করবেন না।
৮. আল্লাহর যিম্মা (অঙ্গীকার) একই হবে। একজন সাধারণ মানুষের প্রদানকৃত যিম্মা সকল মুসলমানের জন্য সমানভাবে পালনযোগ্য হবে।
৯. যে সকল ইহুদী মুসলিমগণের অনুগামী হবে তাদের প্রয়োজনে সাহায্য করতে হবে এবং তারা অন্য মুসলিমগণের মতো হয়ে যাবে। তাদের প্রতি কোন অন্যায় করা যাবে না। কিংবা তাদের বিরুদ্ধে অন্যকে সাহায্যও করা যাবে না।
১০. মুসলিমগণের সম্পাদিত সন্ধি হবে একই। কোন মুসলিম কোন মুসলিমকে বাদ দিয়ে আল্লাহর পথে যুদ্ধের ব্যাপারে কোন সন্ধি করবেন না, বরং সকলে সমতা ও ন্যায়ের ভিত্তিতেই তা করবেন।
১১. মুসলিমগণ ঐ রক্তপাতের ব্যাপারে সমান অধিকার রক্ষা করবেন যা আল্লাহর পথে প্রবাহিত হবে।
১২. কোন কুরাইশ মুশরিককে আশ্রয় দেবে না, তাদের ধন-সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে সাহায্য করবে না, আর কোন মু’মিনের হেফাজতের ব্যাপারে মুশরিকদেরকে প্রতিবন্ধক হিসেবে দাঁড় করাবে না।
১৩. যে ব্যক্তি কোন মুসলমানকে হত্যা করবে এবং তা যদি প্রমাণিত হয় তাহলে তার নিকট থেকে হত্যার বদলা গ্রহণ করা হবে যদি নিহতের অভিভাবক রাজী থাকেন।
১৪. যে সকল মু’মিন এর বিরুদ্ধাচরণ করবে তাদের জন্য এছাড়া আর কিছু হালাল হবে না যে, তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করবেন, তাঁরা বিরুদ্ধাচারীর বিরুদ্ধাচরণ করবেন।
১৫. কোন মু’মিনের জন্য এটা সঙ্গত হবে না যে, যারা গুন্ডগোল সৃষ্টি করে (বিদ’আতী) তাদের কার্যকলাপে সাহায্য করে অথবা তাকে আশ্রয় দেয়, কিংবা যে তাকে সাহায্য করে তাকে আশ্রয় দেয়। যে এরূপ করবে কিয়ামতের দিন সে অভিশাপ এবং গযবে নিপতিত হবে এবং তার ফরজ ও নফল কোন ইবাদতই কবুল হবে না।
১৬. তোমাদের মধ্যে যখনই যে কোন মতভেদ পরিলক্ষিত হবে তখনই তা আল্লাহ এবং তার রাসূল (সাঃ)-এর বিধি-বিধান মতো ফয়সালার ব্যবস্থা করবে।[1]
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৫০২-৫০৩ পৃঃ।
জীবনধারায় বৈপ্লবিক ধ্যান-ধারণার প্রবর্তন (أَثَرُ الْمَعْنَوِيَاتِ فِي الْمُجْتَمِعِ):
ইসলামী রাষ্ট্র ও মহা বিজ্ঞানময় মুসলিম সমাজের এ ক্রান্তি লগ্নে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এক নতুন জীবনধারার ভিত্তি স্থাপন করেন। এ জীবনধারার বাহ্যিকতা প্রকৃতপক্ষে ঐ আভ্যন্তরীণ পরিপূর্ণতারই প্রতিবিম্ব (রশ্মি) ছিল যাকে নাবী (সাঃ)-এর সঙ্গ ও সাহচর্যের বদৌলতে অভাবনীয় এক সম্মানের আসনে সমাসীন করা সম্ভব হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর শিষ্যদের দীক্ষা, আত্মশুদ্ধি ও উত্তম চরিত্র গঠনে উৎসাহিত করতেন এবং অবিরামভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতেন।
তিনি তাঁর শিষ্যগণকে সদা-সর্বদা ভ্রাতৃত্ব ও ভালবাসা, সম্মান, সম্ভ্রম এবং উপাসনা, আনুগত্য ও আদবক্বায়দার তালীম দিতেন এবং নিষ্ঠার সঙ্গে তা মেনে চলার জন্য প্রেরণা ও পরামর্শ দান করতেন।
একজন সাহাবী রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন,
أَيُّ الْإِسْلَامِ خَيْرٌ
‘কোন্ ইসলাম উত্তম? অর্থাৎ ইসলামের কোন্ আচার-আচরণটি উৎকৃষ্ট?’ তিনি বললেন,
[تُطْعِمُ الطَّعَامَ، وَتُقْرِئُ السَّلَامَ عَلٰى مَنْ عَرَفْتَ وَمَنْ لَمْ تَعْرِفْ]
‘তুমি খাদ্য খাওয়াও এবং চেনা-অচেনা (লোককে) সালাম দাও’’।[1]
আব্দুল্লাহ বিন সালাম (রাঃ)-এর বর্ণনা রয়েছে যে, ‘রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন মদীনায় আগমন করলেন, তখন আমি তাঁর দরবারে হাজির হয়ে তাঁর পবিত্র মুখমন্ডল প্রত্যক্ষ করেই স্পষ্টতঃ উপলব্ধি করলাম যে, এ কমনীয়, রমণীয়, সুষমাস্নিগ্ধ ও উজ্জ্বলতামন্ডিত মুখমন্ডলটি কোন মিথ্যুক মানুষের হতেই পারে না (এবং তার মুখ নিঃসৃত যে প্রথম বাণীটি শ্রবণ করেছিলাম তা ছিল,
[يَا أَيُّهَا النَّاسُ، أَفْشُوْا السَّلَامَ، وَأَطْعِمُوْا الطَّعَامَ، وَصِلُوْا الْأَرْحَامَ، وَصَلُّوْا بِاللَّيْلِ وَالنَّاسُ نِيَامٌ، تَدْخُلُوْا الْجَنَّةَ بِسَلَامٍ]
‘হে লোক সকল! তোমরা পরস্পর পরস্পরকে সালাম দেয়ার রেওয়াজ প্রবর্তন কর, খাদ্য খাওয়াও, আত্মীয়তার বন্ধন সুদৃঢ় কর এবং রাত্রি বেলা মানুষ যখন নিদ্রাসুখে মগ্ন থাকবে তখন আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাক। (তবে) নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করবে।[2]
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলতেন,
[لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ لَا يَأْمَنْ جَارُهُ بَوَائِقَهُ]
‘‘ঐ ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, যার প্রতিবেশী তার অন্যায়-অত্যাচার থেকে নিরাপদে না থাকে।[3] তিনি আরও বলেছেন,
[الْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُوْنَ مِنْ لِّسَانِهِ وَيَدِهِ]
‘‘(প্রকৃত) মুসলিম ঐ ব্যক্তি যার হাত ও জিহবা থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদে থাকে।[4]
তিনি আরও বলেছেন,
[لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتّٰى يُحِبُّ لِأَخِيْهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ]
‘তোমাদের মধ্যে কেউই (প্রকৃত) মুসলিম হতে পারবে না যতক্ষণ না সে অপর ভাইয়ের জন্য ঐ সকল জিনিস পছন্দ করবে যা নিজের জন্য পছন্দ করে।’[5]
তিনি আরও বলেছেন,
[المُؤْمِنُوْنَ كَرَجُلٍ وَّاحِدٍ، إِنْ اشْتَكٰى عَيْنُهُ اِشْتَكٰى كَلُّهُ، وَإِنْ اشْتَكٰى رَأْسُهُ اِشْتَكٰى كُلُّهُ]
‘‘সকল মু’মিন একটি মানব দেহের মত, যদি তার চোখে ব্যথা হয় তাহলে সমগ্র দেহেই ব্যথা অনুভূত হবে, আর যদি মাথায় ব্যথা হয় তাহলে তার সমগ্র শরীরেই ব্যথা অনুভূত হবে।[6]
তিনি আরও বলেছেন,
[المُؤْمِنُ لِلْمُؤْمِنِ كَالْبُنْيَانِ يَشُدُّ بَعْضُهُ بَعْضاً]
‘‘মু’মিন মু’মিনের জন্য একটি দালান ঘরের মতো, একাংশ অপর অংশকে শক্তি দান করে। [7]
তিনি আরও বলেছেন,
[لَا تَبَاغَضُوْا، وَلَا تَحَاسَدُوْا، وَلَا تَدَابَرُوْا، وَكُوْنُوْا عِبَادَ اللهِ إِخْوَاناً، وَلَا يَحِلُّ لِمُسْلِمٍ أَنْ يَهْجُرَ أَخَاهُ فَوْقَ ثَلَاثَةَ أَيَّامٍ]
‘‘নিজেদের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ রাখবে না, রাগ করবে না, একে অপর থেকে মুখ ফিরাবে না, আল্লাহর বান্দা ও আপোষের মধ্যে ভাই ভাই হয়ে থাকবে। কোন মুসলমানের জন্য হালাল নয় যে, সে তিন দিনের বেশী তার ভাইয়ের সাথে ক্রোধবশত কথা বার্তা বলবে না।[8]
তিনি আরও বলেছেন,
[الْمُسْلِمُ أَخُوْ الْمُسْلِمِ لَا يَظْلِمُهُ وَلَا يَسْلِمُهُ، وَمَنْ كاَنَ فِيْ حَاجَةِ أَخِيْهِ كَانَ اللهُ فِيْ حَاجَتِهِ، وَمَنْ فَرَّجَ عَنْ مُسْلِمٍ كُرْبَةً فَرَّجَ اللهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرَبَاتِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِماً سَتَرَهُ اللهُيَوْمَ الْقِيَامَةِ]
‘মুসলিম মুসলমানের ভাই, না তার প্রতি অন্যায় করবে আর তাকে শত্রুর হাতে অর্পণ করবে। আর যে ব্যক্তি আপন (মুসলিম) ভাইয়ের প্রয়োজন মেটাতে সচেষ্ট হবে আল্লাহ তার প্রয়োজন মিটাতে থাকবেন। কোন মুসলিম যদি তার মুসলিম ভাইয়ের দুঃখ-কষ্ট দূরীভূত করে তবে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দুঃখ-কষ্ট দূর করবেন। আর কেননা মুসলিম যদি তার মুসলিম ভাইয়ের দোষত্রুটি গোপন করে তবে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দোষত্রুটি গোপন রাখবেন।’[9]
আরও বলেছেন,
[اِرْحَمُوْا مَنْ فِي الْأَرْضِ يَرْحَمُكُمْ مَنْ فِي السَّمَاءَ]
‘তোমরা পৃথিবীবাসীদের প্রতি সদয় হও, আকাশবাসী (আল্লাহ) তোমাদের প্রতি সদয় হবেন।’[10]
তিনি আরও বলেছেন,
[لَيْسَ الْمُؤْمِنُ بِالَّذِيْ يَشْبَعُ وَجَارُهُ جَائِعٌ إِلٰى جَانِبِهِ]
‘ঐ ব্যক্তি মুসলিম নহে, যে পেট পুরে খায় অথচ তার পাশেই প্রতিবেশী অনাহারে কালাতিপাত করে।’[11]
আরও বলেছেন,
[سِبَابُ الْمُؤْمِنِ فُسُوْقٌ، وَقِتَالُهُ كُفْرٌ]
‘মুসলিমগণকে গালি দেয়া ফিসক (পাপ) তাদের হত্যা করা কুফুরী কাজ (অবিশ্বাসের কর্ম)।’[12]
এভাবে তিনি রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু দূরীভূত করাকে সদকা বলে গণ্য করতেন এবং এটাকে ঈমানের শাখাসমূহের মধ্যে একটি শাখা বলে গণ্য করতেন।[13]
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দান-খয়রাতের ব্যাপারে উৎসাহিত করতেন এবং এ সবের এমন এমন ফযীলত বর্ণনা করতেন যেদিকে মন এমনিতেই আকৃষ্ট হতো। তিনি বলতেন যে, সদকা এবং দান-খয়রাত পাপকে এমনভাবে মুছে ফেলে যে, যেমন পানি আগুনকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে ফেলে।[14]
তিনি আরো বলেছেন,
[أَيُّمَا مُسْلِمٍ كَسَا مُسْلِماً ثَوْباً عَلٰى عُرى كَسَاهُ اللهُ مِنْ خُضَرِ الْجَنَّةِ، وَأَيُّمَا مُسْلِمٍ أَطْعَمَ مُسْلِماً عَلٰى جُوْعٍ أَطْعَمَهُ اللهُ مِنْ ثِمَارِ الْجَنَّةِ، وَأَيُّمَا مُسْلِمٍ سَقٰى مُسْلِماً عَلٰى ظَمَأٍ سَقَاهُ اللهُ مِنْ الرَّحِيْقِالْمَخْتُوْمِ]
‘‘কোন মুসলিম যদি কোন নগ্ন মুসলিমকে কাপড় পরিয়ে দেয় তা হলে আল্লাহ তাকে জান্নাতের সবুজ পোষাক পরিয়ে দিবেন এবং কোন মুসলিম যদি ক্ষুধার্ত মুসলিমকে খাদ্য খাওয়ায় তাহলে আল্লাহ তাকে জান্নাতে ফল খাওয়াবেন এবং কোন মুসলিম যদি কোন তৃষ্ণার্ত মুসলিমকে পানি পান করায় তাহলে আল্লাহ তাকে জান্নাতে মোহরকৃত পবিত্র শরাব পান করাবেন।[15] তিনি বলেছেন,
[اِتَّقُوْا النَّارَ وَلَوْ بِشَقِّ تَمَرَةٍ، فَإِنْ لَمْ تَجِدْ فَبِكَلِمَةٍ طَيِّبَةٍ]
‘‘আগুন থেকে বাঁচার চেষ্টা করো যদিও খেজুরের অর্ধাংশ দিয়েও হয়, তাও যদি না পাও তা হলে কমপক্ষে ভাল কথার দ্বারা ভিখারীকে তুষ্ট করো।[16]
অথচ ভিক্ষা বৃত্তি হতে বিরত থাকার জন্য চরমভাবে নিষেধ করেছেন, ধৈর্যধারণ এবং অল্পতে সন্তুষ্ট হওয়ার ফযীলত শুনাতেন, ভিক্ষুকগণের ভিক্ষাবৃত্তিকে তাদের মুখমন্ডলে অাঁচড়, পাচড়ও ক্ষত আখ্যায়িত করেছেন।[17] অবশ্য সীমাতিরিক্ত নিরুপায় হয়ে যারা ভিক্ষা করে তাদেরকে এর বাইরে রেখেছেন।
কোন ইবাদতের কী ফযীলত এবং আল্লাহর নিকট তার কী সওয়াব ও পুরষ্কার রয়েছে সে সবও তিনি আলোচনা করতেন। উপরন্তু, তাঁর নিকট যে সকল আয়াত অবতীর্ণ হতো মুসলিমগণকে তার সঙ্গে শক্তভাবে জড়িয়ে রাখতেন। সেই সকল আয়াত তিনি মুসলিমগণকে পড়ে শোনাতেন এবং পরবর্তী পর্যায়ে তাঁদের তা পড়ে শোনাতে বলতেন। উদ্দেশ্য ছিল এ কাজের মাধ্যমে তাঁদের মধ্যে বুঝ-সমঝ ও চিন্তাভাবনার উদ্রেক এবং দাওয়াতের যোগ্যতা, পয়গম্বরত্বের অনুভূতি ও সচেতনতার সৃষ্টি করা।
এভাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মুসলিমগণের সুপ্ত সম্ভাবনা সমূহের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের মাধ্যমে মানবত্বের সর্বোচ্চ স্তরে তাঁদের উন্নীত করেন এবং জাগতিক ও পারত্রিক ভাবধারার সুষ্ঠু সমন্বয় ঘটিয়ে আল্লাহর চেতনা ও ন্যায়-নীতির প্রতি নিবেদিত ও সমর্পিত এমন এক মানবগোষ্ঠির গোড়াপত্তন করেছিলেন ইতিহাসে যার কোন নজির নেই। এ মানবগোষ্ঠির মধ্যে তার সাক্ষাৎ শিষ্যদের বলা হতো সাহাবী (রাঃ)। মান-মর্যাদা এবং মানবত্বের উৎকর্ষতার ক্ষেত্রে সাহাবীগণের স্থান ছিল নাবী রাসূলগণের পরেই। আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) বলেন, ‘যার অনুসরণের প্রয়োজন রয়েছে সে অতীত মানবগোষ্ঠির অনুসরণ করুক কেন না, জীবিতদের ব্যাপারে ফিৎনার ভয় রয়েছে।’
‘অতীত মানবগোষ্ঠি’ বলতে তিনি সাহাবীগণের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘তাঁরা নাবী (সাঃ)-এর সঙ্গী ছিলেন। নাবী (সাঃ)-এর এই উম্মত-গোষ্ঠি ছিলেন সর্বোৎকৃষ্ট মানব, সব চাইতে পুণ্যবান, সর্বাধিক জ্ঞানী এবং সব চাইতে নিবেদিত। আল্লাহ তা‘আলা তাঁদেরকে নিজ নাবী (সাঃ)-এর বন্ধুত্ব এবং আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার মহান-ব্রতে শরীক হওয়ার দুর্লভ সুযোগ দানে ধন্য ও সম্মানিত করেছেন। তাঁদের পদাংক অনুসরণ করে তাঁদের চরিত্রে চরিত্রবান হওয়া প্রত্যেক মুসলমানের একান্ত কর্তব্য। কারণ, তাঁরা ছিলেন হিদায়াত প্রাপ্তির উজ্জ্বলতার দৃষ্টান্ত।[18]
অন্যদিকে আবার, আমাদের পয়গম্বর রহাবারে আযম (সাঃ) সেরা পথপ্রদর্শক নিজেও এরূপ মানবিক ও আধ্যাত্মিক গুণাবলি, আল্লাহ প্রদত্ত পয়গম্বরত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ, মান-মর্যাদা মহানচরিত্র এবং সুন্দর সুন্দর কাজ-কর্মের অধিকারী ছিলেন যে, তার সংস্পর্শে এলে মন এমনিতেই তাঁর প্রতি ঝুঁকে পড়ত। ফলে তাঁর মুখ থেকে যখনই কোন কথা বের হতো তখনই সাহাবীগণ (রাঃ) তা বাস্তবায়নের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তেন। হিদায়াতের যে সকল কথা তিনি বলতেন জীবন-মরণ পণ করে সাহাবীগণ (রাঃ) তা সর্বাগ্রে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে যেতেন।
আধ্যাত্মিকতার অলৌকিক চেতনায় উজ্জীবিত প্রেরণাবোধ এবং ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে নাবী কারীম (সাঃ) মদীনার সমাজ জীবনে এমন এক জীবনধারা প্রবর্তন করতে সক্ষম হয়েছিলেন অখন্ড মানব জাতির ইতিহাসে যা ছিল সর্বোচ্চ মানের এবং সর্বাধিক পূর্ণত্বপ্রাপ্ত। এ জীবনধারায় তিনি এমন সব নিয়মনীতি এবং আচার-আচরণ প্রবর্তন করলেন যা যুগ-যুগান্তর ধরে অব্যাহত থাকা শোষণ, শাসন ও নিষ্পেষণের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত মানব জীবনকে শান্তি, স্বস্তি ও মুক্তির আস্বাদে ভরপুর করে তুলে এ জীবনধারার উপাদানগুলোকে এমন উঁচু মানের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পূর্ণতা দান করা হয়েছিল যে, যুদ্ধ এবং শান্তি সকল অবস্থার সঙ্গেই সর্বাধিক যোগ্যতার সঙ্গে মোকাবেলা করে যে কোন পরিস্থিতির মোড় নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আসার মতো যোগ্যতা মুসলিমগণ অর্জন করেছিলেন। মুসলিমগণের এহেন পরিবর্তিত জীবনধারা কিছুটা যেন আকস্মিকভাবেই ইতিহাসের মোড় পরিবর্তন করে দেয়।
ফুটনোটঃ[1] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৬ ও ৯ পৃঃ।
[2] তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, দারেমি, মিশকাত ১ম খন্ড ১৬৮ পৃঃ।
[3] সহীহুল মুসলিম, মিশকাত ২য় খন্ড ৪২২ পৃঃ।
[4] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৬ পৃঃ।
[5] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৬ পৃঃ।
[6] সহীহুল মুসলিম, মিশকাত ২য় খন্ড ৪২২ পৃঃ।
[7] মুত্তাফাকুন আলাইহি মিশকাত ২য় খন্ড ৪২২ পৃঃ, সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৮৯০ পৃঃ।
[8] সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৮৯৬ পৃঃ।
[9] মুত্তাফাকুন আলাইহি, মিশকাত ২য় খন্ড ৪২২ পৃঃ।
[10] সুনানে আবূ দাউদ ২য় খন্ড ৩৩৫ পৃঃ, জামে তিরমিযী ২য় খন্ড ১৪ পৃঃ।
[11] বাইহাকী, শোআবুল ঈমান, মিশকাত ২য় খন্ড ৪২৪ পৃঃ।
[12] সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৮৯৩ পৃঃ।
[13] মুত্তাফাকুন আলাইহি, মিশকাত ১ম খন্ড ১২ ও ১৬৭ পৃঃ।
[14] আহমাদ তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, মিশকাত ১ম খন্ড ১৪ পৃঃ।
[15] সুনানে আবূ দাউদ, জামে তিরমিযী, মিশকাত ১ম খন্ড ১৬৯ পৃঃ।
[16] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ১৯০ পৃঃ ২য় খন্ড ৮৯০ পৃঃ।
[17] দ্রষ্টব্য, আবূ দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, দারেমী, মিশকাত ১ম খন্ড ১৬৩ পৃঃ।
[18] রাযীন, মিশকাত ১ম খন্ড ৩২ পৃঃ।
ইহুদীদের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন
চুক্তির ধারাসমূহ (بُنُوْدُ الْمُعَاهَدَةِ) :
হিজরতের পর মুহাজির ও আনসারদের সমন্বয়ে গঠিত মদীনার মুসলিম সমাজকে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস, সুদৃঢ় ভ্রাতৃত্ব বন্ধন এবং পরিচ্ছন্ন নিয়ম-শৃঙ্খলার উপর প্রতিষ্ঠিত করতে নাবী কারীম (সাঃ) যখন সক্ষম হলেন তখন মদীনার অমুসলিম জনগোষ্ঠির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ও সমঝোতা গড়ে তোলার কাজে মনোনিবেশ করেন। তাঁর এ কার্যক্রমের উদ্দেশ্য ছিল জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের সুখী, সমৃদ্ধ ও বরকতময় জীবনের পথ প্রশস্তকরণ, মদীনবাসী ও পার্শ্ববর্তী জনগোষ্ঠির মধ্যে ঐক্যবোধ সৃষ্টি ও একতার বন্ধন সুদৃঢ় করণ। এ লক্ষ্যে উদার উন্মুক্ত মনমানসিকতা নিয়ে এমন সব নিয়ম নীতি ও কার্যক্রম তিনি অবলম্বন করলেন যে, ধর্মান্ধতা ও স্বার্থান্ধতা-ক্লিষ্ট সম সাময়িক সমাজে যা ছিল একটি কল্পনাতীত ব্যাপার।
মদীনার মুসলিমগণের নিকটতম প্রতিবেশী ছিল ইহুদীগণ। মদীনায় মহানাবী (সাঃ)-এর হিজরতের সঙ্গে সঙ্গে মুসলিমগণের সুশৃঙ্খল সমাজ সংগঠন, ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন এবং ক্রমবর্ধমান শক্তি সামর্থ্যের ব্যাপারে তারা সতর্কতার সঙ্গে সবকিছু লক্ষ্য করে যাচ্ছিল। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সব ক্ষেত্রেই মুসলিমগণের সাথে শত্রুতা পোষণ করলেও প্রকাশ্য কলহ কিংবা ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হওয়ার হাবভাবও প্রকাশ করে নি। কাজেই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের সঙ্গে একটি চুক্তি সম্পাদনের প্রয়োজন অনুভব করে চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এ চুক্তিতে তাদেরকে জানমালের সাধারণ নিরাপত্তা এবং ধর্মকর্মের স্বাধীনতার স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। তাতে দেশত্যাগ, মালক্রোক এবং ঝগড়া ফাসাদের ব্যাপারে কোন নীতি নির্ধারণ করা হয়নি।
এ চুক্তি ঐ চুক্তির সঙ্গেই হয়েছিল যা মুসলিমদের পরস্পরের সঙ্গে সম্পাদিত হয়েছিল যার উল্লেখ কিছু পূর্বে করা হয়েছে। নিম্নে তার উল্লেখযোগ্য ধারাসমূহ আলোচনা করা হলঃ
১. বনু আওফের ইহুদীগণ মুসলিমদের সঙ্গে মিলেমিশে একই উম্মতের মতো থাকবে, কিন্তু উভয় সম্প্রদায়ের লোকেরাই নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। এটা তাদের নিজেদের অধিকার হিসেবে যেমন গণ্য হবে, ঠিক তেমনিভাবে তাদের সঙ্গে যারা সম্পর্কিত তাদের এবং তাদের দাসদাসীদের বেলায়ও গণ্য হবে। বনু আউফ ছাড়া অন্যান্য ইহুদীদের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য হবে।
২. মুসলিম এবং ইহুদী উভয় সম্প্রদায়ের লোকই নিজ নিজ আয়-উপার্জনের যিম্মাদার থাকবে।
৩. এ চুক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোন পক্ষের সঙ্গে অন্য কোন শক্তি যুদ্ধে লিপ্ত হলে চুক্তিভুক্ত পক্ষগুলো সম্মিলিতভাবে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে।
৪. এ চুক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পক্ষদ্বয়ের লোকেরা নিজেদের মধ্যে সহানুভূতি, সদিচ্ছা ও পারস্পরিক উপকারের ভিত্তিতে কাজ করে যাবে, কোন অন্যায়-অনাচার কিংবা পাপাচারের ভিত্তিতে নয়।
৫. মিত্র পক্ষের অন্যায়-অনাচারের জন্য সংশ্লিষ্ট অন্য পক্ষকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না।
৬. কেউ কারো উপর জুলুম করলে মজলুমকে সাহায্য করা হবে।
৭. চুক্তিবদ্ধ কোন পক্ষ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে যত দিন চলতে থাকবে ততদিন ইহুদীদেরকেও মুসলিমদের সঙ্গে যুদ্ধের খরচ বহন করতে হবে।
৮. এ চুক্তিভুক্ত সকলের জন্যই মদীনায় কোন প্রকার হাঙ্গামা সৃষ্টি করা কিংবা রক্তপাত ঘটানো হারাম হবে।
৯. চুক্তিভুক্ত পক্ষগুলো কোন নতুন সমস্যা কিংবা ঝগড়া ফ্যাসাদে জড়িয়ে পড়ার উপক্রম হলে এর মীমাংসা করবেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাঃ)।
১০. কুরাইশ ও তাদের সহায়তাকারীদের আশ্রয় দেয়া চলবে না।
১১. ইয়াসরিবের উপর কেউ হামলা চালালে সম্মিলিতভাবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এবং নিজ নিজ অঞ্চলে থেকে তা প্রতিহত করতে হবে।
১২. কোন অন্যায়কারী কিংবা পাপীর জন্য এ চুক্তি সহায়ক হবে না।[1]
এ চুক্তি সম্পাদনের ফলে মদীনা এবং সংলগ্ন পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহ এক শান্তি-স্বস্তিময় সাম্রাজ্যের রূপ পরিগ্রহ করে যার রাজধানী ছিল মদীনা এবং সর্বময় নেতৃত্বে ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)। এ সাম্রাজ্য পরিচালনের ভিত্তি ছিল ইসলামী বিধি-বিধান এবং পরিচালন ভাগের অধিকাংশ কর্মকর্তা ছিলেন মুসলিম। প্রকৃতপক্ষে এভাবে মদীনা ইসলামী হকুমতের রাজধানীতে পরিণত হয়ে যায়।
সুশৃঙ্খল এবং শান্তি-স্বস্তিময় অঞ্চলের সীমারেখা সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে নাবী কারীম (সাঃ) পরবর্তী পর্যায়ে অন্যান্য গোত্রের সঙ্গে অবস্থার প্রেক্ষাপটে অনুরূপ চুক্তি সম্পাদন করেন।
ফুটনোটঃ[1] দ্রষ্টব্য- ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৫০৩-৫০৪ পৃঃ।
অস্ত্রের ঝনাঝনানি
কুরাইশদের সংঘাতময় কর্মসূচী এবং আব্দুল্লাহ ইবনু উবাইয়ের সঙ্গে পত্রালাপ (استفزازات قريش واتصالهم بعبد الله بن ابي):
মক্কার কুরাইশ মুশরিকগণ মুসলিমদের উপর কিরূপ অন্যায় অত্যাচার ও নিপীড়ন নির্যাতনের পাহাড় ভেঙ্গে ছিল এবং যখন তারা মদীনায় হিজরত শুরু করেন তখন তারা তাদের বিরুদ্ধে কী ধরণের বিদ্বেষমূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করেছিল তা ইতোপূর্বে বর্ণিত হয়েছে। যার ফলে তাদের ধনমাল ছিনিয়ে নেয়ার এবং সাধারণভাবে তারা হত্যার নির্দেশ প্রদানেরযোগ্য হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এরপরও তাদের অন্যায় আচরণ ও হঠকারিতামূলক কার্য-কলাপ বন্ধ হল না এবং তারা সে সব থেকে বিরতও থাকল না। পক্ষান্তরে, মুসলিমগণ তাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গিয়ে মদীনায় একটা নিরাপদ আশ্রয় লাভ করেছে এবং ধীরে ধীরে সুসংগঠিত ও শক্তি সঞ্চয় করে চলেছে। এটা প্রত্যক্ষ করে তাদের ক্রোধাগ্নি অতি মাত্রায় প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠল। তাই তারা আনসারদের নেতা আব্দুল্লাহ ইবনু উবাইকে প্রকাশ্য হুমকি সহকারে একটি পত্র লিখল যিনি তখন পর্যন্ত খোলাখুলি মুশরিক ছিলেন। তখন মদীনাবাসীগণের মধ্যে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল যে, মদীনায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আগমন সংঘটিত না হলে তারা তাকেই মুকুট পরিয়ে তাদের বাদশাহ নির্বাচিত করত। মুশরিকদের এ পত্রের সার সংক্ষেপ ছিল নিম্নরূপ :
‘তোমরা আমাদের কিছু সংখ্যক বিপথগামী লোককে আশ্রয় দিয়েছ, এজন্য আমরা আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি যে, হয় তোমরা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে তোমাদের দেশ থেকে তাদেরকে বহিষ্কার করে দেবে, অন্যথায় সদল বলে তোমাদের উপর ভীষণভাবে আক্রমণ পরিচালিত করে তোমাদের যোদ্ধাদের হত্যা এবং মহিলাদের মান হানি করব।’[1]
এ পত্র পাওয়া মাত্রই আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই তার ঐ মক্কাবাসী মুশরিক ভাইদের দির্দেশ পালনার্থে উঠে পড়ে লেগে গেল। যেহেতু তার অন্তরে এ বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়েছিল যে, মদীনায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আগমনের কারণেই তাকে মদীনার বাদশাহী থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছে সেহেতু পূর্ব থেকেই সে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রতি হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরছিল। এ কারণে কাল বিলম্ব না করে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে সে তার মুশরিক ভাইদের একত্রিত করে ফেলল।
এ সংবাদ অবগত হয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের নিকট আগমন করলেন এবং তাদের সম্বোধন করে বললেন, ‘আমি দেখছি যে, কুরাইশদের হুমকি তোমাদের অন্তরে গভীরভাবে রেখাপাত করেছে। কিন্তু এটা তোমাদের অনুধাবন করা উচিত যে, তোমরা নিজেরাই নিজেদেরকে যে পরিমাণ ক্ষতির মুখে ঠেলে দিতে যাচ্ছ কুরাইশরা কোনক্রমেই তোমাদের সেই পরিমাণ ক্ষতি করতে সক্ষম হবে না। তোমরা কি তোমাদের পুত্র ও ভ্রাতাদের সঙ্গে নিজেরাই যুদ্ধ করতে চাও?’
নাবী কারীম (সাঃ)-এর এ কথা শ্রবণ করে তারা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে।[2] কাজেই, আব্দুল্লাহ ইবনু উবাইকে তার প্রতিহিংসাজনিত যুদ্ধের সংকল্প থেকে তখনকার মতো বিরত থাকতে হয়। কারণ, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কথায় তার সঙ্গী সাথীদের যুদ্ধ স্পৃহা স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও কুরাইশদের সঙ্গে তার গোপন যোগাযোগ চলতে থাকে। কারণ, মুসলিম ও কাফিরদের মধ্যে বিবাদ বিসম্বাদ বাধিয়ে দেয়ার কোন সুযোগ হাতছাড়া করার ইচ্ছা তার আদৌ ছিল না। তাছাড়া ইহুদীদের সঙ্গেও সে যোগাযোগ রাখতে থাকে যাতে প্রয়োজন হলে তাদের কাছ থেকেও সাহায্য লাভ সম্ভব হয়। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সময়োচিত ও বিজ্ঞোচিত ব্যবস্থাপনার ফলে ঝগড়া বিবাদের প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখা ক্রমান্বয়ে প্রশমিত হতে থাকে।[3]
ফুটনোটঃ[1] সুনানে আবূ দাউদ, বাবু খাবারিন নাযীর।
[2] সুনানে আবূ দাউদ, বাবু খাবারিন নাযীর।
[3] এ সম্পর্কে সহীহুল বুখারীর ২য় খন্ড ৬৫৫, ৬৫৬, ৯১৬ ও ৯২৪ পৃঃ।
মুসমানদের জন্য মসজিদুল হারামের দরজা বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা (إِعْلَانُ عَزِيْمَةِ الصَّدِّ عَنْ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ):
এরপর সা‘দ ইবনু মু’আয (রাঃ) উমরাহ করার উদ্দেশ্যে মক্কায় আগমন করেন এবং উমাইয়া ইবনু খালফের অতিথি হন। তিনি উমাইয়াকে সম্বোধন করে বলেন, ‘আমার জন্য এমন এক সময়ের ব্যবস্থা করে দাও যখন আমি নির্জনে বায়তুল্লাহর ত্বাওয়াফ করতে পারি। সেই মোতাবেক উমাইয়া খরতপ্ত দুপুরে তাকে নিয়ে পথে বের হলে পথে আবূ জাহলের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে যায়। সে উমাইয়াকে সম্বোধন করে বলে, ‘হে আবূ সাফওয়ান, তোমার সঙ্গে ঐ লোকটি কে?’
উত্তরে উমাইয়া বলল, ‘এ হচ্ছে সা‘দ (রাঃ)।’
আবূ জাহল তখন সা‘দ (সাঃ)-কে লক্ষ্য করে বলল, ‘আমি দেখছি যে, তুমি বড় নিরাপদে ত্বাওয়াফ করতে রয়েছ, অথচ তোমরা বেদ্বীনদেরকে আশ্রয় দিয়েছ এবং তাদেরকে সাহায্য করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছ। আল্লাহর কসম! যদি তুমি আবূ সাফওয়ানের সঙ্গে না থাকতে তবে নিরাপদে ফিরে যেতে পারতে না।
তার একথা শুনে সা‘দ (রাঃ) উচ্চ কণ্ঠে বললেন, ‘দেখো আল্লাহর কসম! যদি তুমি আমার একাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি কর তবে তোমার এমন কাজে আমি প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াব যা তোমাদের জন্য হবে অত্যন্ত ভয়াবহ এবং তা হবে মদীনার পাশ দিয়ে চলে যাওয়া বাণিজ্য পথটি।[1]
ফুটনোটঃ[1] সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড, কিতাবুল মাগাযী ৫৬৩ পৃঃ।
মুহাজিরদেরকে কুরাইশদের ধমক প্রদান (قُرَيْشٌ تَهَدَّدَ الْمُهَاجِرِيْنَ):
কুরাইশ মুশরিকগণ মদীনার মুহাজিরদেরকে ধমকের সূরে বলে পাঠাল, ‘মক্কা হতে তোমরা নিরাপদে ইয়াসরিবে পালিয়ে যেতে পেরেছ বলে অহংকারে ফেটে পড় না যেন। এটুকু জেনে রেখ যে, ইয়াসরিবে চড়াও হয়েই তোমাদের ধ্বংস করে ফেলার ক্ষমতা আমাদের রয়েছে।[1]
তাদের এ ধমক শুধু যে কথাবার্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়, বরং এ ব্যাপারে তারা গোপনে গোপনে তৎপরও ছিল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের এ ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের কথা এমন এক গুরুত্বপূর্ণ সূত্র থেকে অবগত হয়েছিলেন যে, তিনি সতর্কতা অবলম্বন না করে পারেন নি। নিরাপত্তার খাতিরে হয় জাগ্রত অবস্থায় তিনি রাত্রি যাপন করতেন, নতুবা সাহাবীদের প্রহরাধীনে ঘুমোতেন। যেমনটি সহীহুল বুখারী এবং সহীহুল মুসলিম শরীফে ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, ‘মদীনায় আগমনের পর একদা রাত্রি বেলায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জাগ্রত অবস্থায় ছিলেন এবং আকাঙ্ক্ষা পোষণ করছিলেন যে, আজ রাত্রে যদি তাঁর সাহাবীদের মধ্যে থেকে কোন ব্যক্তি এখানে এসে পাহারা দিতেন (তাহলে কতই না ভাল হতো)।
আমরা ঐ অবস্থাতেই ছিলাম এমন সময় অকস্মাৎ অস্ত্রের ঝনাঝনানি আমাদের কর্ণগোচর হল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রশ্ন করলেন, ‘কে’? উত্তরে শ্রুত হল ‘আমি সা‘দ ইবনু আবী অক্কাস’ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ গভীর রাত্রে তোমার এখানে আগমনের কারণ কী’? জবাবে তিনি বললেন, ‘আপনার সম্পর্কে আমার মনে বিপদের আশঙ্কা উদ্রেক হওয়ায় আপনাকে পাহারা দেয়ার উদ্দেশ্যে এসেছি।’ তার একথা শুনে তিনি তার জন্য দু‘আ করলেন এবং ঘুমিয়ে পড়লেন।[2]
এটা স্মরণ রাখার বিষয় যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে পাহারা দেয়ার ব্যাপারটি শুধু কয়েকটি রাত্রির জন্য নির্দিষ্ট ছিল না, বরং এটা ছিল পর্যায়ক্রমিক এবং স্থায়ী ব্যবস্থা। ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে যেমনটি বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন যে, রাত্রিকালে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে পাহারা দেয়া হতো। তারপর নিম্নের আয়াতটি অবতীর্ণ হয়ঃ
{وَاللهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ} [المائدة: 67]،
‘‘(হে রসূল!) মানুষ হতে আল্লাহ্ই তোমাকে রক্ষা করবেন।’ (আল-মায়িদাহ ৫ : ৬৭)
তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কুববা (ঘর বিশেষ) থেকে মাথা বের করে বললেন,
(يَا أَيُّهَا النَّاسُ، اِنْصَرِفُوْا عَنِّيْ فَقَدْ عَصَمَنِيْ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ)
‘‘হে জনমন্ডলী! তোমরা ফিরে যাও। মহামহিমান্বিত প্রভূ পরওয়ার দেগার আল্লাহ আমাকে নিরাপত্তা দান করেছেন।’’[3]
আরব মুশরিকদের শত্রুতাজনিত এ বিপদ শুধুমাত্র রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তা মুসলিম সমাজের সকল সদস্য পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। যেমনটি উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন যে, যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও তাঁর সাহাবীগণ (রাঃ) মদীনা আগমন করেন এবং আনসারগণ তাদের আশ্রয় দান করেন, তখন আরব মুশরিকগণ তাঁদেরকে একই কামান দ্বারা আক্রমণ করে। তাই না তাঁরা অস্ত্র ছাড়া রাত্রি যাপন করতেন, না অস্ত্র ছাড়া সকাল বেলা নিদ্রা থেকে জাগ্রত হতেন।
ফুটনোটঃ[1] রহমাতুল্লিল আলামীন প্রথম খন্ড ১১৬ পৃঃ।
[2] সহীহুল মুসলিম শরীফ ২য় খন্ড, বাবু ফাযালি সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রাঃ) ২৮০ পৃঃ এবং সহীহুল বুখারী বাবুল হারাসাতে ফিল গাযভে ফী সাবীলিল্লাহ ১ম খন্ড ৪০৪ পৃঃ।
[3] জামীউত তিরমিযী, আবওয়াবুত তাফসীর ২য় খন্ড ১৩ পৃঃ।
যুদ্ধের অনুমতি (الإِذَانُ بِالْقِتَالِ):
এ ভয়ভীতি ও বিপজ্জনক অবস্থা মদীনায় মুসলিমদের অস্তিত্বের জন্য একটি মারাত্মক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং যদ্দ্বারা এটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে, কুরাইশরা কোনক্রমেই তাদের বিদ্বেষপরায়ণতা ও এক গুঁয়েমি পরিহার করতে প্রস্তুত নয়। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমগণকে যুদ্ধের অনুমতি প্রদান করেন, কিন্তু তখন পর্যন্ত মুসলিমদের উপর যুদ্ধ ফরজ হয় নি। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা যে আয়াত নাযিল করলেন তা হচ্ছে নিম্নরূপঃ
{أُذِنَ لِلَّذِيْنَ يُقَاتَلُوْنَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوْا وَإِنَّ اللهَ عَلٰى نَصْرِهِمْ لَقَدِيْرٌ} [الحج: 39].
‘‘ যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হয় তাদেরকে যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হল, কেননা তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করতে অবশ্যই সক্ষম।’ (আল-হাজ্জ ২২ : ৩৯)
তারপর এ ধরণের আরো বহু আয়াত অবতীর্ণ হয় সেগুলোতে বলে দেয়া হয় যে, যুদ্ধের এ অনুমতি যুদ্ধ হিসেবে নয় বরং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে বাতিলের বিলোপ সাধন এবং আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত করণ। যেমনটি ইরশাদ হয়েছেঃ
{الَّذِيْنَ إِن مَّكَّنَّاهُمْ فِي الأَرْضِ أَقَامُوْا الصَّلاَةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوْا بِالْمَعْرُوْفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنكَرِ وَلِلهِ عَاقِبَةُ الأُمُوْرِ } [الحج: 41]
‘‘(এরা হল) যাদেরকে আমি যমীনে প্রতিষ্ঠিত করলে তারা সলাত প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত প্রদান করে, সৎ কাজের আদেশ দেয় ও মন্দ কাজে নিষেধ করে, সকল কাজের শেষ পরিণাম (ও সিদ্ধান্ত) আল্লাহর হাতে নিবদ্ধ।’ (আল-হাজ্জ ২২ : ৪১)
যুদ্ধের অনুমতি তো নাযিল হলও তা শুধু কুরাইশদের সাথেই সীমাবদ্ধ ছিল। তারপর বিভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধের অনুমতির বিস্তৃতি ঘটে। এমনকি তা ওয়াজিবের স্তর বা পর্যায়ে উপনীত হয়। তখন এ নির্দেশ কুরাইশ ব্যতিত অন্যাদের বেলায় প্রযোজ্য হয়। এ সব ঘটনার বিস্তারিত আলোচনা করার পূর্বে সংক্ষেপে এসব স্তর বা পর্যায় সম্পর্কে আলোকপাত করার প্রয়োজন মনে করছি :
১. মক্কার কুরাইশ মুশরিকদেরকে যুদ্ধরত গণ্য করা। কেননা তারাই প্রথম শত্রুতা আরম্ভ করে। ফলে তাদের সাথে যুদ্ধ করা মুসলমানদের পক্ষে আবশ্যক হয়ে পড়ে। আর সাথে সাথে মক্কার অন্যান্য মুশরিক ব্যতিত কেবল তাদের ধন-সম্পদকে বাজেয়াপ্ত করাও জরুরি হয়ে পড়ে।
২. ওদের সাথে যুদ্ধ করা যারা আরবের সকল মুশরিক কুরাইশদের সাথে মিলিত ও একত্রিত হয়। অনুরূপ কুরাইশ ব্যতীত অন্যান্য গোষ্ঠী যারা পৃথক পৃথকভাবে মুসলমানদের সাথে শত্রুতা পোষণ করে।
৩. সে সব ইহুদীদের সাথে যুদ্ধ করা যারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে সন্ধি ও প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও খিয়ানত করেছে এবং মুশরিকদের সাথে জোটবদ্ধ হয়েছে ও অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে।
৪. আহলে কিতাবদের মধ্যে যারা মুসলমানদের সাথে শত্রুতা পোষণ করে তাদের সাথে যুদ্ধ করা (যেমন খ্ৰীষ্টান সম্প্রদায়) যতক্ষণ তারা বিনীত হয়ে যিজিয়া কর না দেয়।
৫. মুশরিক, ইহুদী, খ্ৰীষ্টান নির্বিশেষে যারাই ইসলাম গ্রহণ করবে তাদের সাথে যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকা । ইসলামের হদ ব্যতীত তাকে কিছু করা যাবেনা। তার বাকী হিসাব আল্লাহর হাতে।
যুদ্ধের অনুমতি তো নাযিল হল, কিন্তু যে অবস্থার প্রেক্ষাপটে নাযিল হল ওটা যেহেতু শুধু কুরাইশদেরই শক্তিমত্ততা ও একগুঁয়েমির ফল ছিল সেহেতু এটাই ছিল সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ ও বিজ্ঞোচিত কাজ যে মুসলিমগণ নিজেদের দখল সীমা কুরাইশদের ঐ বাণিজ্য পথ পর্যন্ত বিস্তৃত করে নেবে যা মক্কা হতে সিরিয়া পর্যন্ত চালু ছিল। এ কারণেই দখল সীমা বিস্তৃতির উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দুটি পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন। পরিকল্পনা দুটি হচ্ছে যথাক্রমে :
১. যে সকল গোত্র এ রাজপথের আশপাশে কিংবা এ রাজপথ হতে মদীনা পর্যন্ত বিস্তৃত জায়গার মধ্যবর্তী এলাকায় বসবাসরত ছিল তাদের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন এবং যুদ্ধ না করার চুক্তি সম্পাদন।
২. এ রাজপথের উপর টহলদারী দল প্রেরণ।
প্রথম পরিকল্পনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার ছিল ঐ ঘটনাটি যা পূর্বে ইহুদীদের সঙ্গে সংঘটিত হয়েছিল এবং যে চুক্তিটির বিস্তারিত বিবরণ ইতোপূর্বে প্রদত্ত হয়েছে। সামরিক তৎপরতা শুরু করার পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এভাবে জুহাইনা গোত্রের সঙ্গেও বন্ধুত্ব, মিত্রতা ও পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত না হওয়ার একটি চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। মদীনা থেকে তিন মনজিলের অধিক অর্থাৎ ৪০ থেকে ৫০ মাইলের ব্যবধানে তাদের আবাসস্থল অবস্থিত ছিল। টহলদারী সৈন্যদের পরিভ্রমণ কালে লোকজনদের সঙ্গে কয়েকটি চুক্তিও সম্পাদন করেছিলেন যার আলোচনা পরে আসছে। দ্বিতীয় পরিকল্পনাটি ছিল যুদ্ধ বিগ্রহের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
ফুটনোটঃ
বদর যুদ্ধের পূর্বেকার সারিয়্যাহ ও গাযওয়াহসমূহ (الغَزَوْاتُ وَالسَّيرَايَا قَبْلَ بَدْرٍ):
যুদ্ধের অনুমতি সংক্রান্ত আয়াত নাযিল হওয়ায় এ দুটি পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে মুসলিমদের সামরিক তৎপরতার কাজ শুরু হয়ে যায়। পরিভ্রমণকারী প্রহরীরূপে মুসলিম সেনাবাহিনী মদীনা এবং তৎসংলগ্ন এলাকাগুলোতে টহল দিতে শুরু করেন, যেমনটি ইতোপূর্বে আভাষ প্রদান করা হয়েছে। তাঁদের এ টহলদারীর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল মদীনার আশ-পাশের পথসমূহের উপর সাধারণভাবে এবং মক্কা থেকে আগত পথগুলোর উপর বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা। এভাবে বিভিন্ন পথের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার মাধ্যমে নিরাপত্তার ব্যাপারটি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে লক্ষ্য করে যাওয়া এবং একই সঙ্গে এ সকল পথের আশে পাশে বসবাসকারী গোত্রগুলোর সঙ্গে মিত্রতা ও বন্ধুত্বের চুক্তি সম্পাদন করা। অধিকন্তু, এ সুসংগঠিত টহলদারীর অন্য যে একটি উদ্দেশ্য ছিল তা হচ্ছে ইয়াসরিবের ইহুদী, মুশরিক এবং বেদুঈনদের অন্তরে এ ধারণাটি বদ্ধমূল করা যে, মুসলিমগণ এখন যথেষ্ট শক্তিশালী এবং পূর্বের নাজুক অবস্থাকে পেছনে ফেলে তারা অনেকদূর অগ্রসর হয়েছেন। তাছাড়া কুরাইশ মুশরিকগণকে তাদের অর্থহীন ক্রোধ ও ইন্দ্রিয়াবেগের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়া যাতে এখনো তারা তাদের নির্বুদ্ধিতার অন্ধকূপে যে পতিত অবস্থায় রয়েছে তা থেকে বেরিয়ে এসে জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিচার বিবেচনার আলোকোজ্জ্বল পথে পদচারণা শুরুর মাধ্যমে নিজেদের আয় উপার্জন ও জীবন-জীবিকার পথে বিপদের সমূহ সম্ভাবনা এড়ানোর উদ্দেশ্যে সন্ধির কথাটা সক্রিয়ভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে থাকে এবং মুসলিমদের আবাসস্থানের উপর চড়াও হয়ে তাদের ধ্বংস করে ফেলার যে চরম হঠকারী সিদ্ধান্ত তারা গ্রহণ করেছে, আল্লাহর দ্বীনের পথে যে সব প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলেছে ও মক্কার মুসলিমদের উপর যে অমানবিক নিপীড়ন নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে সে সব থেকে বিরত থাকে। সর্বোপরি, মুসলিমগণ যাতে আরব উপদ্বীপে আল্লাহর পয়গাম পৌঁছানোর ব্যাপারে নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে কর্মপ্রবাহ অব্যাহত রাখতে সক্ষম হন সেটাও ছিল অন্যতম উদ্দেশ্য।
ফুটনোটঃ[ঐতিহাসিক পরিভাষায় যে যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্বয়ং অংশ গ্রহণ করেছেন তাকে বলা হয় গাযওয়াহ এবং যাতে তিনি স্বয়ং অংশ গ্রহণ করেন নি তাকে বলা হয় সারিয়্যাহ।]
সারিয়্যাহ ও গায্ওয়াহসমূহের সংক্ষিপ্ত বিবরণঃ
মদীনায় হিজরতের পর মুসলিমদের যে সকল সারিয়্যাহ ও গায্ওয়ায় অংশ গ্রহণ করতে হয়েছিল তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে লিপিবদ্ধ করা হল।
১। সারিয়্যাতু সীফিল বাহর বা সমুদ্রোপকূলের প্রেরিত বাহিনী[1]
হিজরী ১ম বর্ষ রমাযান মাস মুতাবিক মার্চ ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হামযাহ বিন আবুল মুত্তালিবকে এ অভিযানে সেনাপতি নিযুক্ত করেন এবং তাঁর অধীনে ৩০ জন মুহাজির সৈন্য দিয়ে তাদেরকে সিরিয়া থেকে প্রত্যাবর্তনকারী কুরাইশ কাফেলার গতিবিধি লক্ষ্য করার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। তিন শত সদস্য বিশিষ্ট এ কুরাইশ কাফেলার অন্যতম সদস্য ছিল আবূ জাহল। মুসলিম বাহিনী ‘ঈস’[2] নামক জায়গার পার্শ্ববর্তী সমুদ্রোপকূলের নিকট পৌঁছলে ঐ কাফেলার সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাৎ ঘটে। উভয় দলই পরস্পরের মুখোমুখী হলে এক পর্যায়ে উভয় দলই যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু জুহাইনা গোত্রের নেতা মাজদী ইবনু ‘আমর- যিনি উভয় দলেরই মিত্র ছিলেন- অনেক চেষ্টা চরিত্র করে উভয় দলকে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া থেকে নিরস্ত করেন।
হামযাহ (রাঃ)-এর এটা ছিল প্রথম পতাকা যা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্বীয় মুবারক হাত দ্বারা বেঁধে দিয়েছিলেন। এর বহনকারী ছিলেন আবূ মার্সাদ কিনায ইবনু হাসীন গানাভী (রাঃ)।
২. সারিয়্যাতু রাবিগ বা রাবিগ অভিযানঃ এ অভিযান পরিচালিত হয় হিজরী ১ম বর্ষের শাওয়াল মাস মুতাবিক এপ্রিল, ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) উবাইদাহ ইবনু হারিস ইবনু মুত্তালিবকে ৬০ জন মুহাজিরের সমন্বয়ে গঠিত এক বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে প্রেরণ করেন। এ অভিযানে তাঁরা রাবেগ উপত্যকায় আবূ সুফইয়ানের সম্মুখীন পরস্পর পরস্পরের উপর কিছু সংখ্যক তীর নিক্ষেপ করা ছাড়া আর তেমন কিছুই করেনি, যার ফলে বড় আকারের কোন ঘটনা সংঘটিত হয় নি।
এ অভিযান কালে মক্কা বাহিনী থেকে দু’জন মুসলিম এসে যোগদান করেন মুসলিম বাহিনীতে। এদের একজন হচ্ছেন মিক্বদাদ বিন আমরুল বাহরানী এবং অন্যজন হচ্ছেন উতবাহ বিন গাযওয়ান মাযেনী (রাঃ), উভয়েই মুসলিম ছিলেন। তাঁরা কাফিরদের সঙ্গে এ উদ্দেশ্যে বাহির হয়েছিলেন যে, সামনে গিয়ে মুসলিমদের সঙ্গে মিশে যাবেন। আবূ ওবায়দার (রাঃ) পতাকা ছিল সাদা এবং তার বহনকারী ছিলেন মিসতাহ বিন আসাসাহ বিন মুত্তালিব বিন আবদে মানাফ।
সারীয়্যায়ে খার্রার[3] এ অভিযান হিজরী ১ম বর্ষের যিলকদ মাস মুতাবিক মে ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত হয়।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রাঃ)-কে এ সারিয়্যাহর সেনাপতি নিযুক্ত করেন এবং বিশ জন যোদ্ধার সমন্বয়ে এক বাহিনী গঠন করে একটি কুরাইশ কাফেলার গতিবিধি লক্ষ্য করার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। তাদেরকে তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন যে, তারা যেন খার্রার হতে সামনের দিকে আর অগ্রসর না হন। এ বাহিনী পদব্রজে পথ চলতেন। তারা দিবাভাগে নিজেদের গোপন করে রাখতেন এবং রাতের বেলা পথ চলতেন। পঞ্চম দিবস সকালে তারা খার্রারে গিয়ে পৌঁছেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে জানতে পারেন যে, একদিন পুর্বেই সেই কাফেলা সে স্থান অতিক্রম করে গিয়েছে। এ সারিয়্যাহর পতাকা ছিল সাদা রঙের এবং পতাকাবাহী ছিলেন মিক্বদাদ ইবনু ‘আমর (রাঃ)।
৪. গাযওয়ায়ে আবওয়া অথবা অদ্দান[4] : এ গাযওয়ার সময় ছিল হিজরী ২য় বর্ষের সফর মাস মুতাবিক আগষ্ট, ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দ। ৭০ জন মুহাজির যোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্বয়ং এ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। এ গাযওয়ায় যাত্রার প্রাক্কালে সা‘দ ইবনু উবাদাহ (রাঃ)-কে মদীনায় তার স্থলাভিষিক্ত রূপে নিযুক্ত করা হয়। তাঁদের এ যাত্রার উদ্দেশ্য ছিল একটি কুরাইশ কাফেলার পথরোধ করা। তাদের অগ্রযাত্রার এক পর্যায়ে তিনি অদ্দানে গিয়ে পৌঁছেন।
কিন্তু সংঘাতমূলক কোন ঘটনা সংঘটিত হয় নি। এ গাযওয়া অভিযান কালেই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বনু যমরাহ গোত্রের তৎকালীন সরদার ‘আমর ইবনু মুখশী যমরীর সঙ্গে মিত্রতামূলক চুক্তি সম্পাদন করেন। চুক্তির কথাগুলো নিম্নরূপঃ
‘‘এটা হচ্ছে বনু যমরাহর জন্য মহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দলীল। এ গোত্রের লোকজনেরা লাভ করবে তাদের জান ও মালের নিরাপত্তা। তারা আক্রান্ত হলে আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে তাদের সাহায্য করা হবে, যদি তারা আল্লাহর দ্বীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত না হয়। পক্ষান্তরে, যখনই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর সাহায্যের প্রয়োজনে তাদেরকে আহবান জানাবেন তখনই তাঁর সাহায্যার্থে তাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে।[5]
‘‘এটা ছিল প্রথম সৈন্য পরিচালনা যাতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। এ অভিযানে ১৫ দিন যাবৎ মদীনার বাইরে থাকার পর তিনি মদীনা ফিরে আসেন। এ অভিযানের পতাকার রঙ ছিল সাদা এবং পতাকাবাহী ছিলেন হামযাহ (রাঃ)।
৫. গাযওয়ায়ে বুওয়াত বা বুওয়াতের অভিযানঃ এ অভিযান সংঘটিত হয় হিজরী দ্বিতীয় বর্ষের রবিউল আওয়াল মুতাবিক সেপ্টেম্বর, ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে। দু’শ জন সাহাবী সমভিব্যাহার রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এ অভিযানে বহির্গত হন। এক কুরাইশ কাফেলার পথরোধ করাই ছিল এ অভিযানের উদ্দেশ্য। উমাইয়া ইবনু খালফসহ একশ জন কুরাইশ এবং আড়াই হাজার উট ছিল এ কাফেলায়। মুসলিম বাহিনী রাযওয়ার পার্শ্ববর্তী বুওয়াত[6] নামক স্থান পর্যন্ত পৌঁছেন। কিন্তু কোন সংঘর্ষ বাধেনি। এ গাযওয়ায় গমনকালে সা‘দ ইবনু মু’আয (রাঃ)-কে মদীনার আমীর নিযুক্ত করা হয়। এ গাযওয়ার পতাকা ছিল সাদা এবং পতাকাবাহী ছিলেন সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রাঃ)।
৬. গাযওয়ায়ে সাফওয়ানঃ এ গাযওয়া সংঘটিত হয় হিজরী দ্বিতীয় বর্ষের রবীউল আওয়াল মাস মুতাবিক সেপ্টেম্বর ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে। এ গাযওয়ার কারণ ছিল কুরয ইবনু জারির ফাহরী মুশরিকদের একটি ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়ে মদীনার চারণভূমির উপর আক্রমণ চালায় এবং কিছু গবাদি পশু লুট করে নিয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সত্তর জন সাহাবীকে সঙ্গে নিয়ে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করেন এবং বদর প্রান্তরের পার্শ্ববর্তী সাফওয়ান উপত্যকায় গিয়ে পৌঁছেন। কিন্তু কুরয এবং তার সঙ্গীরা অত্যন্ত দ্রুতবেগে তাদের নাগালের বাইরে চলে যেতে সক্ষম হয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর বাহিনীসহ মদীনা প্রত্যাবর্তন করেন। এ গাযওয়ায় শত্রু পক্ষের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হওয়ার কোন সুযোগই সৃষ্টি হয় নি। কেউ কেউ এ গাযওয়াকে গাযওয়ায়ে বদরে উলা বা বদরের প্রথম যুদ্ধ বলে অভিহিত করেন।
এ গাযওয়ায় যাওয়ার সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যায়দ ইবনু হারিসাহকে মদীনায় আমীর নিযুক্ত করেন। এ গাযওয়ায় পতাকার রঙ ছিল সাদা এবং পতাকাবাহী ছিলেন আলী (রাঃ)।
৭. গাযওয়ায়ে যিল উশাইরাহঃ এ গাযওয়া সংঘটিত হয় হিজরী দ্বিতীয় বর্ষের জামাদিউল ঊলা ও জামাদিউল উখরা মুতাবিক নভেম্বর ও ডিসেম্বর ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে। এ অভিযানে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সঙ্গে অংশ গ্রহণ করেন দেড়শ কিংবা দু’শ মুহাজির সাহাবী। অবশ্য এ অভিযানে অংশ গ্রহণ করতে কাউকেই তিনি বাধ্য করেন নি। সওয়ারীর জন্য উট ছিল মাত্র ত্রিশটি এ কারণে তারা পালাক্রমে সওয়ার হতেন। এ অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল সিরিয়া অভিমুখে এক কুরাইশ কাফেলার পথরোধ করা। জানা গিয়েছিল যে, এ কাফেলা মক্কা থেকে যাত্রা শুরু করেছে। এ কাফেলার সঙ্গে কুরাইশদের বহু সুন্দর সুন্দর মূল্যবান মালপত্র ছিল। এ কাফেলার সন্ধানে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর বাহিনীসহ যুল উশাইরাহ[7] পর্যন্ত অগ্রসর হন। কিন্তু তারা সেখানে পৌঁছার কয়েক দিন পূর্বেই কুরাইশ কাফেলা সে স্থান পরিত্যাগ করে গিয়েছিল। এটা ছিল ঐ যাত্রীদল সিরিয়া থেকে প্রত্যাবর্তনের পথে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যাদেরকে গ্রেফতার করতে চেয়েছিলেন। ঐ যাত্রীদল তার হাত থেকে রক্ষা পেয়ে ফিরে গিয়েছিলেন বটে, কিন্তু এর ফলে ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল বদর যুদ্ধের। ইবনু ইসহাক্বের বর্ণনা মতে এ অভিযানে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বের হয়েছিলেন জামাদিউল উলার শেষ ভাগে এবং মদীনায় ফিরে এসেছিলেন জামাদিউল উখরায়। সম্ভবতঃ এ কারণেই এ গাযওয়ায় মাস নির্ধারণে নাবী (সাঃ)-এর জীবনী লেখকদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে। এ গাযওয়া কালে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বনু মুদলিজ এবং তাদের মিত্র বনু যমরাহর সঙ্গে যুদ্ধ না করার চুক্তি সম্পাদন করেন।
এ অভিযানের দিনগুলোতে আবূ সালামাহ ইবনু আব্দুল আসাদ মাখযুমী (রাঃ) মদীনার শাসন পরিচালনের দায়িত্ব পালন করেন। এবারের পতাকাও ছিল সাদা রঙের এবং পতাকাবাহী ছিলেন হামযাহ (রাঃ)।
৮. নাখলাহ অভিযান : এ অভিযানের সময় ছিল হিজরী দ্বিতীয় বর্ষের রজব মাস মুতাবিক জানুয়ারী ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে। এ অভিযানে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আব্দুল্লাহ ইবনু জাহশ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে বারো জন মুহাজির সাহাবীর একটি বাহিনী প্রেরণ করেন। এ বাহিনীর বাহন ছিল প্রতি দুজনের জন্য একটি উট। একই উটের উপর তার পালাযথাক্রমে আরোহণ করতেন। বাহিনী প্রধানের হাতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একটি পত্র দিয়ে নির্দেশ প্রদান করেন যে, দু’দিনের পথ অতিক্রম করার পর যেন এ পত্র পাঠ করা হয়। সুতরাং দুদিন পথ চলার পর আব্দুল্লাহ (রাঃ) পত্রটি পাঠ করেন। পত্রে লিখিত ছিল ‘আমার এ পত্র পাঠ করার পর তোমরা সামনের দিকে এগিয়ে চলবে এবং মক্কা ও ত্বায়িফের মধ্যস্থানে অবস্থিত নাখলায় অবরতণ করবে। এক কুরাইশ কাফেলার আগমনের প্রতীক্ষায় তোমরা সেখানে ওঁৎ পেতে থাকবে এবং তাদের অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে আমাদের অবহিত করবে।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর এ নির্দেশ পালনের জন্য আব্দুল্লাহ দ্বিধাহীন চিত্তে মানসিক প্রস্তুতি নেয়ার পর তাঁর সঙ্গীদের নিকটে পত্রের বিষয়টি প্রকাশ করে বললেন, ‘আমি কারো উপর জোর জবরদস্তি করতে চাই না। তোমাদের মধ্যে যার শাহাদাত পছন্দনীয় নয় সে প্রত্যাবর্তন করবে। শাহাদাতই আমার কাম্য।’
তাঁর এ কথা শ্রবণের পর সঙ্গীরা সকলেই সম্মুখ পানে অগ্রসর হতে থাকলেন। কিছু পথ অতিক্রম করার পর সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রাঃ) এবং ‘উতবাহ ইবনু গাযওয়ানের উটটি হারিয়ে যায়। এ উটটিই ছিল তাঁদের উভয়ের বাহন। উট হারিয়ে যাওয়ার কারণে তাঁরা পিছনে থেকে যেতে বাধ্য হন।
আব্দুল্লাহ ইবনু জাহশ (রাঃ) এবং তার সঙ্গীগণ দীর্ঘপথ অতিক্রম করার পর নাখলায় অবতরণ করেন। সেই সময় একটি কুরাইশ বাণিজ্য কাফেলা সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিল। তাদের বাণিজ্য সামগ্রী ছিল কিশমিশ, চামড়া এবং আরও অনেক সামগ্রী। ঐ কাফেলায় ছিল আব্দুল্লাহ ইবনু মুগীরার দু’পুত্র উসমান ও নওফাল এবং মুগীরার মুক্ত দাস ‘আমর ইবনু হাযরামী ও হাকীম ইবনু কায়সান। শত্রুপক্ষ নাগালের মধ্যে, অথচ দিনটি ছিল হারাম মাস রজবের শেষ দিন। এ দিনে মুসলিম বাহিনীর মনে কিছুটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা পরস্পর পরামর্শ করতে থাকলেন। যদি তারা এ দিনে যুদ্ধে লিপ্ত হন তাহলে হারাম মাসের অসম্মান করা হবে। পক্ষান্তরে রাত্রি পর্যন্ত যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকলে ঐ কাফেলা আরও অগ্রসর হয়ে হারাম সীমার মধ্যে প্রবেশ করবে। উভয় সংকট জনিত দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে মুসলিম বাহিনী অবশেষে এ কুরাইশ কাফেলাকে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন।
আক্রমণের সূচনাতে মুসলিম বাহিনী ‘আমর ইবনু হাযরামীকে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করলেন। তীরবিদ্ধ হাযরামী ঢলে পড়ল মৃত্যুর কোলে। তারপর তারা উসমান এবং হাকীমকে বন্দী করে ফেললেন। কিন্তু পলায়নপর নওফাল নাগালের বাইরে গিয়ে আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হল। বন্দী দুজন এবং মালপত্রসহ মুসলিম বাহিনী নিরাপদে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করলেন। তারা গণীমতের মাল হতে এক পঞ্চামাংশ বের করেও নিয়েছিলেন।[8]
হারাম মাসে মুসলিম বাহিনীর যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমি তো তোমাদেরকে হারাম মাসে যুদ্ধ করার হুকুম দেই নি।’ এ অভিযানের গণীমত এবং যুদ্ধবন্দীদের ব্যাপারে তিনি কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করেন নি।
সারিয়্যাতু নাখলার ঘটনার ফলে মুশরিকেরা এ রটনা রটানোর সুযোগ পায় যে, মুসলিমগণ আল্লাহ তা‘আলার হারামকৃত মাসে যুদ্ধ এবং নরহত্যা করে ‘হারাম’ বিধান লঙ্ঘন করেছে এবং তার অমর্যাদা করেছে। এর ফলে দারুণ অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলা ওহী নাযিল করে এ সমস্যার সমাধান করে দেন। ওহীর মাধ্যমে তিনি ঘোষণা করেন যে, মুশরিকেরা যে সকল কাজকর্ম করেছে তা মুসলিমদের এ কাজের তুলনায় বহুগুণে অপরাধজনক। কালাম পাকে – হয়েছেঃ
{يَسْأَلُوْنَكَ عَنِ الشَّهْرِ الْحَرَامِ قِتَالٍ فِيْهِ قُلْ قِتَالٌ فِيْهِ كَبِيْرٌ وَصَدٌّ عَن سَبِيْلِ اللهِ وَكُفْرٌ بِهِ وَالْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَإِخْرَاجُ أَهْلِهِ مِنْهُ أَكْبَرُ عِندَ اللهِ وَالْفِتْنَةُ أَكْبَرُ مِنَ الْقَتْلِ} [البقرة: 217].
‘‘ পবিত্র মাসে লড়াই করা সম্বন্ধে তোমাকে তারা জিজ্ঞেস করছে। বল, এতে যুদ্ধ করা ভয়ঙ্কর গুনাহ। পক্ষান্তরে আল্লাহর পথ হতে বাধা দান, আল্লাহর সঙ্গে কুফুরী, কা‘বা গৃহে যেতে বাধা দেয়া এবং তাত্থেকে তার বাসিন্দাদেরকে বের করে দেয়া আল্লাহর নিকট তার চেয়ে অধিক অন্যায়। ফিতনা হত্যা হতেও গুরুতর অন্যায়।’ (আল-বাক্বারাহ ২ : ২১৭)
এ ওহী নাযিল হওয়ার ফলে এটা সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে, মুসলিম মুজাহিদের সম্পর্কে মুশরিকেরা যে অপবাদ রটাচ্ছে তা হচ্ছে সম্পূর্ণ অমূলক ও ভিত্তিহীন। কেননা, কুরাইশ মুশরিকগণ ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে অন্যায় অনাচার ও জুলুম নির্যাতন করার ব্যাপারে বিন্দুমাত্রও ইতস্তত করে নি কিংবা নিয়ম নীতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে নি। যখন হিজরতকারী মুসলিমদের ধনমাল তারা ছিনিয়ে নেয়ার কাজে ব্যাপৃত থাকত এবং এমন কি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে হত্যার জন্য তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল তখন হারাম মাস কিংবা হারাম সীমার (মক্কা) প্রতি তারা কোন ভ্রুক্ষেপই করেনি। অথচ, কী কারণে হঠাৎ করে তারা এ পবিত্র মাসগুলোর পবিত্রতার ব্যাপারে এত সচেতন হয়ে উঠল এবং এগুলোর পবিত্রতা নষ্ট করা দূষণীয় বলে এত সোচ্চার হয়ে উঠল? অবশ্যই মুসলিমদের বিরুদ্ধে মুশরিকেরা যে গুজব রটিয়েছে এবং হৈ চৈ শুরু করেছে তা প্রকাশ্য বিদ্বেষ ও সুস্পষ্ট নির্লজ্জতার উপর প্রতিষ্ঠিত।
এরপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বন্দী দুজনকে মুক্ত করে দেন এবং নিহত ব্যক্তিটির অভিভাবককে রক্তপণ দেয়ার ব্যবস্থা করেন।[9]
এগুলো হচ্ছে বদর যুদ্ধের পূর্বেকার সারিয়্যাহ ও গাযওয়া। এগুলোর কোনটাতেই সুস্পষ্ট ও হত্যার তেমন কোন ঘটনা ঘটেনি, যে পর্যন্ত না কুরয ইবনু জাবির ফাহরীর নেতৃত্বে মুশরিকরা মদীনার সন্নিকটস্থ চারণ ভূমি থেকে কিছু গবাদি পশু লুট করে নিয়ে যায়। সুতরাং বুঝা গেল যে, এর সূচনাও মুশরিকদের পক্ষ থেকেই হয়েছিল। ইতোপূর্বে তারা যেমন বিভিন্ন প্রকার অত্যাচার ও উৎপীড়ন চালিয়ে এসেছিল, গবাদি পশু লুট কারার ঘটনাটিও ছিল অনুরূপ একটি ঘটনা।
আব্দুল্লাহ ইবনু জাহশের সারিয়্যার পর কুরাইশ মুশরিকদের মধ্যে কিছুটা ভয়-ভীতির ভাব পরিলক্ষিত হল এবং তারা সুস্পষ্টভাবে এটা উপলব্ধি করল যে, তাদের সামনে এক ভয়াবহ বিপদের সম্ভাবনা ক্রমেই দানা বেঁধে উঠছে। যে ফাঁদে পড়ার আশঙ্কা তারা এতদিন করে আসছিল শেষ পর্যন্ত সেই ফাঁদেই তাদের পতিত হতে হল। এ বিষয়টিও তাদের নিকট পরিষ্কার হয়ে গেল যে, মদীনার মুসলিম বাহিনী অত্যন্ত সজাগ ও তৎপর রয়েছে এবং কুরাইশদের প্রত্যেকটি বাণিজ্য কাফেলার গতিবিধির উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে চলছে। তারা এটাও বুঝল যে, মুসলিমগণ এখন ইচ্ছা করলে তিনশ মাইল পথ অতিক্রম করে আক্রমণ চালাতে, লোকজনদের বন্দী করে নিয়ে নিরাপদে প্রত্যাবর্তন করতে সম্পূর্ণ সক্ষম। এটাও তাদের নিকট সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে, সিরিয়ামুখী ব্যবসা-বাণিজ্য এখন কঠিন বিপদের সম্মুখীন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা নিজেদের মূর্খতা এবং উদ্ধত আচরণ থেকে বিরত রইল না। তারা জুহাইনা এবং বনু যমরাহ গোত্রদ্বয়ের মতো সন্ধির পথ অবলম্বনের পরিবর্তে ক্রোধ, হিংসা ও শত্রুতার মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিল। তাদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরাও সিদ্ধান্ত নিয়ে গেল যে, মুসলিমদের আবাসস্থানে আক্রমণ চালিয়ে তারা তাদের একদম নিশ্চিহ্ন করে ফেলবে। এ লক্ষ্যে এক সুসজ্জিত যোদ্ধা বাহিনীসহ তারা বদর প্রান্তর অভিমুখে অগ্রসর হল।
এখন মুসলিমদের সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয় যে, আব্দুল্লাহ ইবনু জাহশের সারিয়্যার পর দ্বিতীয় হিজরী সনে শা‘বান মাসে আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর যুদ্ধ ফরজ করে দেন এবং এ সম্পর্কীয় কয়েকটি সুস্পষ্ট আয়াত অবতীর্ণ করেন। ইরশাদ হলোঃ
{وَقَاتِلُوْا فِيْ سَبِيْلِ اللهِ الَّذِيْنَ يُقَاتِلُوْنَكُمْ وَلاَ تَعْتَدُوْا إِنَّ اللهَ لاَ يُحِبِّ الْمُعْتَدِيْنَ وَاقْتُلُوْهُمْ حَيْثُ ثَقِفْتُمُوْهُمْ وَأَخْرِجُوْهُم مِّنْ حَيْثُ أَخْرَجُوْكُمْ وَالْفِتْنَةُ أَشَدُّ مِنَ الْقَتْلِ وَلاَ تُقَاتِلُوْهُمْ عِندَ الْمَسْجِدِالْحَرَامِ حَتّٰى يُقَاتِلُوْكُمْ فِيْهِ فَإِن قَاتَلُوْكُمْ فَاقْتُلُوْهُمْ كَذٰلِكَ جَزَاء الْكَافِرِيْنَ فَإِنِ انتَهَوْاْ فَإِنَّ اللهَ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ وَقَاتِلُوْهُمْ حَتّٰى لاَ تَكُوْنَ فِتْنَةٌ وَيَكُوْنَ الدِّيْنُ لِلهِ فَإِنِ انتَهَواْ فَلاَ عُدْوَانَ إِلاَّ عَلَى الظَّالِمِيْنَ}[البقرة:190- 193]
‘‘তোমরা আল্লাহর পথে সেই লোকেদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, কিন্তু সীমা অতিক্রম করো না। আল্লাহ নিশ্চয়ই সীমা অতিক্রমকারীকে ভালবাসেন না। ১৯১. তাদেরকে যেখানেই পাও হত্যা কর এবং তাদেরকে বের করে দাও যেখান থেকে তারা তোমাদেরকে বের করে দিয়েছে। বস্তুতঃ ফিতনা হত্যার চেয়েও গুরুতর। তোমরা মাসজিদে হারামের নিকট তাদের সাথে যুদ্ধ করো না, যে পর্যন্ত তারা তোমাদের সাথে সেখানে যুদ্ধ না করে, কিন্তু যদি তারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে, তবে তোমরাও তাদের হত্যা কর, এটাই কাফিরদের প্রতিদান। ১৯২. তারপর যদি তারা বিরত হয়, তবে আল্লাহ ক্ষমাশীল, বড়ই দয়ালু। ১৯৩. ফিত্না দূরীভূত না হওয়া পর্যন্ত এবং দীন আল্লাহর জন্য নির্ধারিত না হওয়া পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, তারপর যদি তারা বিরত হয় তবে যালিমদের উপরে ছাড়া কোনও প্রকারের কঠোরতা অবলম্বন জায়িয হবে না।’ (আল-বাক্বারাহ ২ : ১৯০-১৯৩)
এরপর অতি সত্বরই অন্য প্রকারের আয়াত অবতীর্ণ হলো যাতে যুদ্ধের নিয়ম কানুন বর্ণিত হলো। ইরশাদ হলোঃ
{فَإِذا لَقِيْتُمُ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا فَضَرْبَ الرِّقَابِ حَتّٰى إِذَا أَثْخَنتُمُوْهُمْ فَشُدُّوْا الْوَثَاقَ فَإِمَّا مَنًّا بَعْدُ وَإِمَّا فِدَاء حَتّٰى تَضَعَ الْحَرْبُ أَوْزَارَهَا ذٰلِكَ وَلَوْ يَشَاء اللهُ لَانتَصَرَ مِنْهُمْ وَلَكِن لِّيَبْلُوَ بَعْضَكُم بِبَعْضٍوَالَّذِيْنَ قُتِلُوْا فِيْ سَبِيْلِ اللهِ فَلَن يُضِلَّ أَعْمَالَهُمْ سَيَهْدِيْهِمْ وَيُصْلِحُ بَالَهُمْ وَيُدْخِلُهُمُ الْجَنَّةَ عَرَّفَهَا لَهُمْ يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا إِن تَنصُرُوْا اللهَ يَنصُرْكُمْ وَيُثَبِّتْ أَقْدَامَكُمْ } [محمد: 4- 7]
‘‘তারপর যখন তোমরা কাফিরদের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হও, তখন তাদের ঘাড়ে আঘাত হানো, অবশেষে যখন তাদেরকে পূর্ণরূপে পরাস্ত কর, তখন তাদেরকে শক্তভাবে বেঁধে ফেল। তারপর হয় তাদের প্রতি অনুগ্রহ কর, না হয় তাদের থেকে মুক্তিপণ গ্রহণ কর। তোমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে, যে পর্যন্ত না শত্রুপক্ষ অস্ত্র সমর্পণ করে। এ নির্দেশই তোমাদেরকে দেয়া হল। আল্লাহ ইচ্ছে করলে (নিজেই) তাদের উপর প্রতিশোধ নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তোমাদের একজনকে অন্যের দ্বারা পরীক্ষা করতে চান (এজন্য তোমাদেরকে যুদ্ধ করার সুযোগ দেন)। যারা আল্লাহর পথে শহীদ হয় তিনি তাদের কর্মফল কক্ষনো বিনষ্ট করবেন না। ৫. তিনি তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন আর তাদের অবস্থা ভাল করে দেন। ৬. তারপর তিনি তাদেরকে জান্নাতে দাখিল করবেন যা তাদেরকে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন। ৭. হে ঈমানদারগণ! তোমরা যদি আল্লাহকে সাহায্য কর, তিনি তোমাদেরকে সাহায্য করবেন আর তোমাদের পদগুলোকে দৃঢ়প্রতিষ্ঠ করবেন।’ (মুহাম্মাদ ৪৭ : ৪-৭)
এরপর আল্লাহ তা‘আলা ঐ সকল লোকদের নিন্দা করেছেন যুদ্ধের হুকুম শুনে যাদের হৃৎকম্পন শুরু হয়েছিল। ইরশাদ হলোঃ
{فَإِذَا أُنزِلَتْ سُوْرَةٌ مُّحْكَمَةٌ وَذُكِرَ فِيْهَا الْقِتَالُ رَأَيْتَ الَّذِيْنَ فِيْ قُلُوْبِهِم مَّرَضٌ يَنظُرُوْنَ إِلَيْكَ نَظَرَ الْمَغْشِيِّ عَلَيْهِ مِنَ الْمَوْتِ} [محمد: 20]
‘‘তারপর যখন কোন সুস্পষ্ট অর্থবোধক সূরাহ্ অবতীর্ণ হয় আর তাতে যুদ্ধের কথা উল্লেখ থাকে, তখন যাদের অন্তরে রোগ আছে তুমি তাদেরকে দেখবে মৃত্যুর ভয়ে জ্ঞানহারা লোকের মত তোমার দিকে তাকাচ্ছে। কাজেই ধ্বংস তাদের জন্য।’ (মুহাম্মাদ ৪৭ : ৪-৭)
বস্তুতঃ যুদ্ধ ফরজ করা, তার প্রতি উৎসাহ দান করা এবং তার প্রস্তুতির নির্দেশ প্রদান ছিল পরিস্থিতির প্রয়োজন। এমন কি পরিস্থিতির প্রতি সতর্ক ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপনরত কোন সেনাধিনায়ক থাকলে তিনিও তাঁর সেনাবাহিনীকে সর্ব প্রকারের সংঘাতময় পরিস্থিতির তাৎক্ষণিক মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ প্রদান করতেন। তাহলে মহামহিমান্বিত আল্লাহ যিনি প্রকাশ্য ও গোপনীয় সকল বিষয় সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকেবহাল তিনি কেন এরূপ নির্দেশ প্রদান করবেন না? প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে প্রয়োজন ও পরিস্থিতির একান্ত আকাঙ্ক্ষিত ছিল ‘হক’ ও ‘বাতিলের’ মধ্যে একটি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের বিশেষ করে আব্দুল্লাহ ইবনু জাহশের অভিযান পরবর্তী পরিস্থিতির যা মুশরিকদের মর্যাদা ও আমিত্বের উপর ছিল কঠিন আঘাত স্বরূপ এবং যা তাদেরকে যন্ত্রণায় ফেলে রেখেছিল।
যুদ্ধের নির্দেশ সম্পর্কিত পূর্বাপর আয়াতগুলো দ্বারা অনুমিত হচ্ছিল যে, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সময় আসন্ন প্রায় এবং এতে মুসলিমদের বিজয়ও সুনিশ্চিত। এটা বিশেষ লক্ষণীয় বিষয় যে, কিভাবে আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমদের নির্দেশ দিচ্ছেন, ‘যেখান থেকে মুশরিকরা তোমাদের বের করে দিয়েছে তোমরাও তাদেরকে সেখান থেকে বের করে দাও।’ আর কিভাবে তিনি বন্দীদেরকে বেঁধে ফেলার এবং বিরোধীদেরকে পিষ্ট করে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটানোর হিদায়াত দিয়েছেন যা একটি বিজয় কাহিনীর সাথে সম্পর্কযুক্ত। এর মাধ্যমে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত হচ্ছিল যে, মুসলিমদের বিজয় সুনিশ্চিত।
কিন্তু এটা গোপনীয়তার সঙ্গে এবং আভাষ ইঙ্গিতেই বলা হয়েছে যাতে যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে যুদ্ধের জন্য যতটা আগ্রহী ও উন্মুখ থাকে কার্যতঃ তা প্রকাশ করতে সক্ষম হয়।
তারপর ঐ সময়েই অর্থাৎ দ্বিতীয় হিজরীর শা‘বান মাস মুতাবিক ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাসে আল্লাহ তা‘আলা বায়তুল মুকাদ্দাসের পরিবর্তে ক্বাবা’হ গৃহকে ক্বিবলাহ বলে ঘোষণা করলেন এবং নামাযে ঐ দিক মুখ ফিরানোর নির্দেশ প্রদান করলেন। এর ফলে যে ক্ষেত্রে মুসলিমগণ বিশেষভাবে উপকৃত হলেন তা হচ্ছে, যে সকল মুনাফিক্ব ইহুদী মুসলিমদের মধ্যে শুধু ফাটল ধরানো ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে মুসলিমদের সারিতে এসে দাঁড়াত তাদের মুখোশ খুলে গেল। তারা এখন মুসলিমদের মধ্যে থেকে পৃথক হয়ে গিয়ে নিজেদের আসল অবস্থানে ফিরে গেল। আর এভাবে মুসলিমদের সারিগুলো বিশ্বাসঘাতক ও কপটদের বিশ্বাসঘাতকতা ও কপটতার দূষণ থেকে পবিত্র হয়ে গেল।
এ সময় ক্বিবলাহ পরিবর্তনের মধ্যে যে একটি সূক্ষ্ণ ইঙ্গিত নিহিত ছিল তা হচ্ছে এখন থেকে এমন একটি নতুন যুগের সূচনা হতে যাচ্ছে যা এ ক্বিবলাহর উপর মুসলিমদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। কেননা, এটা বড়ই বিস্ময়কর এবং কথা হবে যে, কোন জাতির ক্বিবলাহ তাদের শত্রুদের কব্জায় থাকবে। আর যদি তা সেভাবে থাকে তাহলে এটা খুবই জরুরী যে, তাদের শত্রুদের অধিকার থেকে মুক্ত করে সেখানে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এ নির্দেশাবলী ও ইঙ্গিতসমূহ প্রকাশের পর মুসলিমদের আনন্দানুভূতি ও আবেগ আরও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হল এবং আল্লাহর পথে তাঁদের যুদ্ধ করার উন্মাদনা এবং শত্রুদের সঙ্গে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তমূলক সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা বহুগুণে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হল।
ফুটনোটঃ[1] সীনে জের দিয়ে পড়া হয়েছে যার অর্থ সমুদ্রোপকূল।
[2] আইন এ জের দিয়ে পড়তে হবে। এটা লোহিত সাগর এলাকার ইয়ামবু এবং মারওয়ার মধ্যস্থলে অবস্থিত একটি জায়গা।
[3] খার্রার যোহফার নিকটবর্তী একটি স্থানের নাম।
[4] অদ্দান হচ্ছে মক্কা ও মদীনার মধ্যস্থলে অবস্থিত একটি জায়গার নাম। এটা রাবেগ হতে মদীনা যাওয়ার পথে ২৯ মাইল দূরত্বে অবস্থিত। আবওয়া হচ্ছে অদ্দানেরই নিকটবর্তী একটি জায়গার নাম।
[5] আল মাওাহিবর লাদুন্নিয়্যাহ ১ম খন্ড ৭৫ পৃঃ যুরকানীর শারহসহ।
[6] বুওয়াত ও রাযওয়া জুহাইনার পাহাড়গুলোর মধ্যে দুটি পাহাড় যা প্রকৃতপক্ষে একটি পাহাড়েরই দুটি শাখা। এটা মক্কা হতে সিরিয়া যাওয়ার পথের সাথে মিলিত হয়েছে। এ পাহাড় দুটি মদীনা থেকে ৪৮ মাইল দূরত্বে অবস্থিত।
[7] উশাইরাহ ইয়ামবুর পার্শ্ববর্তী একটি স্থানের নাম। উশায়বাহকে উশায়রাহ অথবা উসাইরাহ বলা হয়।
[8] চরিতকারগণের বর্ণনা হচ্ছে এটাই, তবে যাতে জটিলতা রয়েছে এবং তা হচ্ছে এক পঞ্চমাংশ বের করে নেয়ার নির্দেশ সংক্রান্ত আয়াত বদর যুদ্ধের পরে অবতীর্ণ হয়েছিল। আর এর শানে নযুলের যে ব্যাখ্যা তাফসীর কিতাবসমূহে দেয়া হয়েছে তাতে জানা যায় যে, এর আগ পর্যন্ত মুসলিমগণ পঞ্চমাংশের হুকম সম্পর্কে অজ্ঞাত ছিলেন।
[9] ঐ সকল সারিয়্যাহ এবং গাযওয়ার বিস্তারিত নিম্নলিখিত পুস্তকাদি থেকে গৃহীত হয়েছে , যা’দুল মা’দ ২য় খন্ড ৮৩-৮৫ পৃঃ ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৫৯১-৬০৫ পৃঃ, রাহমাতুল্লিল আলামীন ১/১১৫-১১৬ পৃঃ, ২য় খন্ড ২১৫-২১৬ ও ৪৬৮ থেকে ৪৭০ পৃঃ। এ গাযওয়া এবং সারিয়্যাহ সম্পর্কে যেখান থেকে তথ্যাদি গৃহীত হয়েছে তার ধারাবাহিকতা এবং তাতে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। আমি আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম এবং আল্লামা মানসুরপুরীর গৃহীত তথ্যের উপর নির্ভর করেছি।
বদরের যুদ্ধ
যুদ্ধের কারণ (سَبَبُ الْغَزْوَةِ):
গাযওয়ায়ে উশায়রার আলোচনায় এটা উল্লেখিত হয়েছে যে, একটি কুরাইশ কাফেলা মক্কা হতে সিরিয়া যাওয়ার পথে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)’র পাকড়াও হতে বেঁচে গিয়েছিল। এ কাফেলাটি যখন সিরিয়া থেকে মক্কায় ফিরে যাচ্ছিল তখন নাবী কারীম (সাঃ) ত্বালহাহ ইবনু উবাইদিল্লাহ (রাঃ) এবং সাইদ ইবনু যায়দ (রাঃ)-কে তাদের অবস্থা ও অবস্থানের প্রতি লক্ষ্য রাখার জন্য উত্তর দিকে প্রেরণ করেন। এ সাহাবীদ্বয় (রাঃ) ‘হাওরা’ নামক স্থান পর্যন্ত গমন করেন এবং সেখানে অপেক্ষমান থাকেন। আবূ সুফইয়ান যখন কাফেলাটি নিয়ে ঐ স্থানটি অতিক্রম করছিলেন তখন সাহবীদ্বয় অত্যন্ত দ্রুত গতিতে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বিষয়টি অবহিত করেন।
এ কাফেলায় মক্কাবাসীদের প্রচুর ধন-সম্পদ ছিল। এক হাজার উট ছিল এবং এ উটগুলো কম পক্ষে পঞ্চাশ হাজার স্বর্ণ মুদ্রা মূল্যের মালপত্র বহন করছিল। শুধুমাত্র এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কাফেলার সঙ্গে চল্লিশ জন কর্মী ছিল।
মদীনাবাসীদের ধনদৌলত লাভের জন্য এটা ছিল অপূর্ব এক সুযোগ। পক্ষান্তরে এ বিশাল পরিমাণ ধনমাল থেকে বঞ্চিত হওয়ার ব্যাপারটি ছিল মক্কাবাসীদের জন্য সামরিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এক বিরাট ক্ষতি। এ জন্যই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মুসলিমদের মধ্যে ঘোষণা করে দিলেন যে, ‘সিরিয়া থেকে মক্কা প্রত্যাবর্তনকারী এক কুরাইশ কাফেলার সঙ্গে প্রচুর ধনমাল রয়েছে। সুতরাং তোমরা এর জন্য বেরিয়ে পড়। হয়ত আল্লাহ পাক গণীমত হিসেবে এ সকল মালপত্র তোমাদের হাতে দিয়ে দিবেন।
কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এ উদ্দেশ্যে গমন কারো উপর জরুরী বলে উল্লেখ করেননি। বরং এটাকে তিনি জনগণের ইচ্ছা এবং আগ্রহের উপর ছেড়ে দেন। কেননা এ ঘোষণার সময় এটা মোটেই ধারণা করা হয়নি যে, এ কাফেলার সঙ্গে যুঝাযুঝির পরিবর্তে শক্তিশালী কুরাইশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে বদর প্রান্তরে ভয়াবহ এক রক্ষক্ষয়ী সংঘর্ষের মোকাবেলা করতে হবে। আর এ কারণেই বহু সাহাবী মদীনাতেই রয়ে গিয়েছিলেন। তাদের অভিযানগুলোর মতই সাধারণ একটা কিছু হবে। আর এ কারণেই যারা এ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেননি তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগও উত্থাপিত হয় নি।
ফুটনোটঃ
মুসলিম সৈন্যসংখ্যা ও তাঁদের নেতৃত্বের বিন্যাস (مَبْلَغُ قُوَّةِ الْجَيْشِ الْإِسْلَامِيْ وَتَوْزِيْعُ الْقِيَادَاتِ ):
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বদর অভিযানে অগ্রসর হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন। তাঁর সঙ্গী হলেন তিন শতাধিক সাহাবী (রাঃ)। তিন শতাধিক বলতে সে সংখ্যাটি হতে পারে ৩১৩, ৩১৪ কিংবা ৩১৭ যাদের মধ্যে ৮২, ৮৩ কিংবা ৮৬ জন ছিলেন মহাজির এবং অন্যেরা ছিলেন আনসার। আনসারদের মধ্যে আবার ৬১ জন ছিলেন আউস গোত্রের এবং ১৭০ জন ছিলেন খাযরাজ গোত্রের লোক। যুদ্ধের জন্য সেনাবাহিনীর যে প্রস্তুতি গ্রহণের প্রয়োজন এ রকম কোন প্রস্তুতিই রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বাহিনীর ছিল না। এমন কি যুদ্ধ প্রস্তুতির কোন ব্যবস্থাও ছিল না। তিন শতাধিক লোক বিশিষ্ট এ বাহিনীর জন্য মাত্র দুটি ঘোড়া ছিল। যুবাইর ইবনু ‘আউওয়াম (রাঃ)-এর ছিল একটি এবং মিক্বদাদ ইবনু আসওয়াদ কিনদী (রাঃ)-এর ছিল অপরটি। উট ছিল সত্তরটি, এক এক উটের উপর পালাক্রমে আরোহণ করতেন দুই কিংবা তিন জন লোক। রাসূলুল্লাহ (সাঃ), আলী (রাঃ) এবং মারসাদ ইবনু আবী মারসাদ গানাভী (রাঃ)-এর জন্য বরাদ্দ ছিল একটি উট। তাঁরা তিন জন পালাক্রমে আরোহণ করতেন সেই উটটির উপর।
মদীনায় ব্যবস্থাপনা ও সালাতে ইমামত করার দায়িত্ব প্রথমে অর্পণ করা হয়েছিল ইবনু উম্মু মাকতুম (রাঃ)-এর উপর। কিন্তু ‘রাওহা’ নামক স্থানে পৌঁছার পর নাবী কারীম (রাঃ) আবূ লুবাবাহ ইবনু আবদিল মুনযির (রাঃ)-কে মদীনার ব্যবস্থাপক নিযুক্ত করে পাঠিয়ে দেন।
এরপর আসে যুদ্ধ পূর্ব অবস্থার কথা। সার্বিক নেতৃত্বের পতাকা প্রদান করা হয় মুস’আব ইবনু ‘উমায়ের (রাঃ)-কে। এ পতাকার রঙ ছিল সাদা। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মুসলিম বাহিনীকে দুটি দলে বিভক্ত করেন :
১। মুহাজিরদের সমন্বয়ে গঠিত যার পতাকা দেয়া হয় আলী ইবনু আবী (রাঃ) তালেবকে। যাকে ইক্বাব বলা হয়।
২। আনসারদের সমন্বয়ে গঠিত যার পতাকা দেয়া হয় সা‘দ ইবনু মু‘আয (রাঃ)-কে। এ দুটি পতাকা ছিল কালো বর্ণের।
সেনাবাহিনীর ডান দিকের দলপতি নিযুক্ত করা হয় যুবাইর ইবনু ‘আউওয়াম (রাঃ)-কে এবং বাম দিকের দলপতি নিযুক্ত করা হয় মিক্বদাদ ইবনু ‘আমর (রাঃ)-কে। কারণ, সমগ্র সেনাবাহিনীর মধ্যে মাত্র এ দুজনই ছিলেন অশ্বারোহী। সেনাবাহিনীর পশ্চাদ্ভাগের দলপতি নিযুক্ত হন ক্বায়স ইবনু আবী সা’সা’আহ (রাঃ) আর প্রধান সেনাপতি হিসেবে সমগ্র বাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সাঃ)।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) উত্তম প্রস্তুতিবিহীন সেনাবাহিনী নিয়েই অগ্রযাত্রা শুরু করেন। তাঁর বাহিনী মদীনার মুখ হতে বের হয়ে মক্কাগামী সাধারণ রাজপথ ধরে চলতে থাকেন এবং ‘বি’রে রাওহা’ গিয়ে পৌঁছেন। অতঃপর সেখান থেকে অগ্রসর হয়ে বাম দিকে মক্কাগমী রাজপথ ছেড়ে দেন এবং ডান দিকের পথ ধরে চলতে থাকেন। চলার এক পর্যায়ে ‘নাযিয়াহ’ নামক স্থানে গিয়ে পৌঁছেন (গন্তব্য স্থল ছিল বদর)। তারপর নাযিয়ার এক প্রান্ত দিয়ে অগ্রসর হয়ে ‘রাহকান’ উপত্যকা অতিক্রম করেন। এটা হচ্ছে ‘নাযিয়াহ’ ও ‘দাররার’ মাঝে একটি উপত্যকা দিয়ে গমণ করেন। তারপর ‘দাররাহ’ থেকে নেমে সাফরার নিকট গিয়ে পৌঁছেন। সেখান হতে ‘জুহাইনা’ গোত্রের দুজন লোককে যথা বাবীস ইবনু উমার ও আদী ইবনু আবী যাগবাকে কুরাইশ কাফেলার অবস্থা ও অবস্থান লক্ষ্য করার উদ্দেশ্যে বদর অভিমুখে প্রেরণ করা হয়।
ফুটনোটঃ
মক্কায় বিপদের ঘোষণা (النَّذِيْرُ فِيْ مَكَّةَ):
পক্ষান্তরে কুরাইশ কাফেলার অবস্থা এই ছিল যে, এর নেতা আবূ সুফইয়ান ছিলেন সুচতুর সতর্ক এবং অত্যন্ত সচেতন ব্যক্তি। এ প্রেক্ষিতে তিনি অব্যাহতভাবে পথের খবরাখবর নিতেই থাকতেন। পথে যে কাফেলার সঙ্গেই সাক্ষাৎ হতো তাদের সকলকেই তিনি পথের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতেন। সুতরাং বিভিন্ন সূত্রে তিনি অবগত হতে সক্ষম হন যে, মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁর সাহাবীদেরকে কাফেলার উপর আক্রমণের নির্দেশ দিয়েছেন। তাই তৎক্ষণাৎ তিনি যমযম ইবনু ‘আমর গিফারীকে কিছু পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মক্কা পাঠিয়ে দেন এবং তার মাধ্যমে এ মর্মে সংবাদ প্রেরণ করেন যে, ‘কাফেলা ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন, হিফাযতের জন্য সাহায্যের আশু প্রয়োজন।’ যমযম অত্যন্ত দ্রুত গতিতে মক্কায় আসে এবং আরব সমাজের প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী নিজের উটের নাক চাপড়ালো, হাওদা উলটালো, জামা ছিঁড়ে ফেলল, মক্কা উপত্যাকায় উটের উপর দাঁড়িয়ে উচ্চৈঃস্বরে বলতে থাকল, ‘হে কুরাইশগণ! কাফেলা (আক্রান্ত কাফেলা, আক্রান্ত আবূ সুফইয়ানের সঙ্গে তোমাদের ধনমাল রয়েছে, তার উপর আক্রমণ চালানোর জন্য মুহাম্মাদ (সাঃ) এবং তার সাহাবীরা উদ্যত হয়েছেন। সুতরাং আমি বিশ্বাস করতে পারছিনা যে, তোমরা তা পাবে। অতএব, সাহায্যের জন্য এগিয়ে চলো, এগিয়ে চলো।’)
ফুটনোটঃ
মক্কাবাসীগণের যুদ্ধ প্রস্তুতি (أَهْلُ مَكَّةَ يَتَجَهَّزُوْنَ لِلْغَزْوِ):
কাফেলা আক্রান্ত হওয়ার সংবাদ শ্রবণে সমগ্র মক্কা উপত্যকায় একদম হৈচৈ শুরু হয়ে গেল। চতুর্দিক থেকে সকলে দৌঁড়ে এসে বলতে থাকল, ‘মুহাম্মাদ (সাঃ) এবং তার সঙ্গী সাথীরা কি মনে করেছে যে, এ কাফেলাও ইবনু হাযরামীর কাফেলার মতই? না, না, কখনই না। আল্লাহর শপথ! এ কখনই সেরূপ নয়। শীঘ্রই তারা জানতে পারবে যে, আমাদের ব্যাপারটি অন্য রকম।’
সমগ্র মক্কা শহরে তখন দু’শ্রেণীর লোক চোখে পড়ছিল। এক শ্রেণীর লোক যুদ্ধ প্রস্তুতি সহকারে যুদ্ধ গমন করছিল এবং অন্যদল নিজের পরিবর্তে অন্যকে যুদ্ধে প্রেরণ করছিল। আর এভাবে প্রায় সবাই ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। বিশেষ করে মক্কার সম্মানিত ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ কেউই পিছনে ছিলেন না। শুধু আবূ লাহাব নিজে না এসে তার একজন ঋণী ব্যক্তিকে পাঠিয়েছিলেন। আশে-পাশে অন্যান্য আরব গোত্রগুলোকেও তারা দিজেদের দলভুক্ত করে নিল। কুরাইশ গোত্রসমূহের মধ্যে একমাত্র বনু আদী ছাড়া আর কোন গোত্রই পিছনে রইল না। বনু আদী গোত্রের কোন লোকই এ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করল না।
ফুটনোটঃ
মক্কা সেনাবাহিনীর সংখ্যা (قَوَامُ الْجَيْشِ الْمَكِّيْ):
প্রথমাবস্থায় মক্কা বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ছিল তের শত। তাদের কাছে ছিল একশ ঘোড়া এবং ছয়শ লৌহবর্ম। উটের সংখ্য এত বেশী ছিল যে, তার কোন হিসাব কিতাবই ছিল না। সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিল আবূ জাহল ইবনু হিশাম। এ বাহিনীর রসদ পত্রের দায়িত্বে ছিল নয় জন সম্ভ্রান্ত কুরাইশ। কোন দিন নয়টি এবং কোন দিন দশটি এভাবে প্রতিদিন উট জবেহ করা হতো।
ফুটনোটঃ
বনু বাকর গোত্রের সমস্যা (مُشْكِلَةُ قَبَائِلِ بَنِيْ بَكِر):
সর্বাত্মক প্রস্তুতি সহকারে মক্কা সেনাবাহিনী যখন অগ্রগমনে উদ্যত এমতাবস্থায় কুরাইশদের মনে পড়ে গেল বনু বাকর গোত্রের কথা। বনু বাকর গোত্রের সঙ্গে তখন তারা ছিল যুদ্ধরত। এ কারণে তাদের আশঙ্কা হল যে, হয়ত বনু বাকর পিছনে থেকে তাদের আক্রমণ করবে এবং ফলে দুই জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডের মধ্যে তাদের নিপতিত হতে হবে। এ ধারণা তাদেরকে যুদ্ধের সংকল্প থেকে বিরত রাখার মতো মানসিক পরিবেশ সৃষ্টি করল। কিন্তু এমন সময়ে অভিশপ্ত ইবলীস শয়তান বনু কিনানাহ গোত্রের নেতা সুরাক্বাহ ইবনু মালিক ইবনু জু’শুম মুদলিজীর রূপ ধরে প্রকাশিত হল এবং বলল, ‘আমিও তোমাদের বন্ধু এবং আমি তোমাদের নিকট এ বিষয়ের জামিন হচ্ছি যে, বনু কিনানাহ তোমাদের বিরুদ্ধাচরণ করবে না কিংবা কোন অশোভনীয় কাজও করবে না।’
ফুটনোটঃ
মক্কা সেনাবাহিনীর যুদ্ধযাত্রা (جيش مكة يتحرك):
সুরাক্বাহ ইবনু মালিকরূপী অভিশপ্ত ইবলীস শয়তান বনু কিনানাহর ব্যাপারে জামিন হওয়ার প্রতিশ্রুতি প্রদান করায় কুরাইশগণ আশঙ্কামুক্ত হয়ে মক্কা থেকে বেরিয়ে পড়ল। আল্লাহ তা‘আলা যেমনটি বলেন,
{بَطَرًا وَرِئَاء النَّاسِ وَيَصُدُّوْنَ عَن سَبِيْلِ اللهِ} [الأنفال:47]
‘‘তারা শক্তিমত্তায় গর্বিত হয়ে জনগণকে (নিজেদের শক্তিমত্তা) দেখাতে দেখাতে আল্লাহর পথে বিঘ্ন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে নিজেদের গৃহ হতে বহির্গত হলো।’ (আল-আনফাল ৮ : ৪৭)
আর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যেমনটি বলেছেন, ‘নিজেদের ক্ষুরধার অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে অপমানিত হয়ে প্রতিশোধ নেয়ার ও আত্ম-অহমিকার নেশায় উন্মত্ত হয়ে এ বলে যুদ্ধে বেরিয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও তাঁর সাথীগণ মক্কাবাসীগণের ব্যবসায়ী দলের উপর চক্ষুত্তোলনের হিম্মত পেল কোথায় থেকে?’
মক্কা বাহিনী খুব দ্রুত গতিতে উত্তর মুখে বদর প্রান্তরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। অগ্রযাত্রার এক পর্যায়ে তারা উসফান ও কুদায়েদ উপত্যকা অতিক্রম করে যখন জুহফা নামক স্থানে উপস্থিত হল তখন আবূ সুফইয়ানের লোক এসে সংবাদ দিল যে, ‘কাফেলা নিরাপদে চলে এসেছে সুতরাং সামনে আর অগ্রসর না হয়ে এখন ফিরে যাওয়ার পালা।’
ফুটনোটঃ
কাফেলার নিরাপদ অগ্রযাত্রা (العِيْرُ تَفَلَّت):
আবূ সুফইয়ানের কাফেলার নিরাপদে অগ্রযাত্রার বিস্তারিত বিবরণ হচ্ছে এ কাফেলা সিরিয়া হতে রাজপথ ধরে অগ্রসর হচ্ছিল বটে, কিন্তু আবূ সুফইয়ান অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করে চলছিলেন। পথ চলার বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি ক্রমাগত খবরাখবর নিতেই থাকছিলেন। বদর প্রান্তরের নিকটবর্তী হয়ে তিনি কাফেলাকে থামালেন এবং নিজেই সম্মুখে অগ্রসর হয়ে মাজদী ইবনু আমরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে মদীনার সেনাবাহিনী সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। মাজদী বলল, ‘এ রকম কোন সেনাবাহিনী তো আমি দেখিনি, তবে দু’জন উটারোহীকে দেখেছি যারা টিলার পাশে তাদের উটকে বসিয়ে নিজেদের মশকে পানি ভর্তি করে নিয়ে চলে গেছে।’
এ কথা শুনেই আবূ সুফইয়ান অত্যন্ত দ্রুতবেগে অগ্রসর হয়ে সেই স্থানে গিয়ে পৌঁছলেন এবং তাদের উটের গোবর ভেঙ্গে দেখলেন। তখন ঐ গোবরের মধ্যে থেকে খেজুরের আঁটি বেরিয়ে পড়ল। এ দেখে তিনি বলে উঠলেন আল্লাহর কসম! এটা হচ্ছে ইয়াসরিবেরই (মদীনার) খেজুরের আঁটি। তারপর তিনি দ্রুতগতিতে কাফেলার কাছে ফিরে গেলেন এবং তাদেরকে পশ্চিম দিকে ঘুরিয়ে দিলেন। বদর অভিমুখী পথ বাম দিকে ছেড়ে দিয়ে কাফেলাকে উপকূল অভিমুখে অগ্রসর হতে বললেন। এভাবে কাফেলাকে তিনি মদীনা বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করলেন। একই সঙ্গে মক্কা বাহিনীর নিকট কাফেলার নিরাপদ থাকার সংবাদ পাঠিয়ে বাহিনীকে মক্কায় ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। জুহফাহ’তে অবস্থানকালে মক্কা বাহিনী এ সংবাদ পেয়েছিল।
ফুটনোটঃ
মক্কায় প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে মক্কা বাহিনীর মধ্যে মতভেদ (هَمُّ الْجَيْشِ الْمَكِّيْ بِالرُّجُوْعِ، وَوُقُوْعُ الْاِنْشِقَاقِ فِيْهِ ):
আবূ সুফইয়ানের পয়গাম প্রাপ্ত হয়ে মক্কা বাহিনীর প্রায় সকল সদস্যই মক্কায় ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করল। কিন্তু কুরাইশ নেতা ও মক্কা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক আবূ জাহল অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে বলল, ‘আল্লাহর কসম! আমরা এখান থেকে ফিরে যাব না। বরং আমরা বদর যাব, সেখানে তিন দিন অবস্থান করব এবং এ তিন দিন যাবৎ উট জবেহ করব, পানভোজন ও আমোদ আহ্লাদ করব। এর ফলে সমগ্র আরব জাতি আমাদের শক্তি সামর্থ্যের কথা অবগত হবে, আর এভাবে চিরদিনের জন্য তাদের উপর আমাদের প্রভাব প্রতিফলিত হবে।
আবূ জাহলের এ কথার পরেও আখনাস ইবনু শুরায়েক ফিরে যাবারই পরামর্শ দিল। কিন্তু অধিক সংখ্যক লোকই তার কথায় কান দিল না। তাই, সে বনু যুহরার লোকজনদের সঙ্গে নিয়ে মক্কায় ফিরে গেল। কেননা, সে ছিল বনু যুহরা গোত্রের মিত্র এবং বাহিনীতে সে ছিল তাদের নেতা। তাদের কোন লোকই বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে নি। পরবর্তীতে বনু যুহরা গোত্রের লোকেরা আখনাস ইবনু শুরায়েকের এ সিদ্ধান্তের কারণে খুব আনন্দ প্রকাশ করেছিল এবং তাদের অন্তরে তার প্রতি শ্রদ্ধা চিরদিনের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাদের সংখ্যা ছিল তিন শত।
বনু যুহরার মতো বনু হাশিমও মক্কায় ফিরে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু আবূ জাহল অত্যন্ত কঠোরতা অবলম্বন করায় তাদের পক্ষে মক্কায় ফিরে যাওয়া সম্ভব হল না। সে কঠোর কণ্ঠে বলল, আমরা ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত এ দলটি আমাদের থেকে পৃথক হতে পারবে না। মোট কথা, ঐ বাহিনী তাদের সফরসূচী বহাল রাখল। বনু যুহরা গোত্রের লোকজনদের মক্কা প্রত্যাবর্তনের ফলে তাদের সৈন্য সংখ্যা দাঁড়ায় এক হাজারে এবং তারা ছিল বদর অভিমুখী। বদরের নিকটবর্তী হয়ে তারা একটি টিলার পিছনে শিবির স্থাপন করে। এ টিলাটি বদর উপত্যকার সীমান্তের উপর দক্ষিণমুখে অবস্থিত।
ফুটনোটঃ
মুসলিম বাহিনীর স্পর্শকাতর অবস্থা (مَوْقِفُ الْجَيْشِ الْإِسْلَامِيْ فِيْ ضَيْقٍ وَحُرْجٍ ):
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পথিমধ্যেই ছিলেন এমতাবস্থায় তিনি আবূ সুফইয়ানের বাণিজ্য কাফেলা এবং মক্কা সেনাবাহিনী সম্পর্কে অবহিত হন। উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে আসন্নপ্রায় সমস্যাটির খুটিনাটি সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনার পর তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস হয় যে, এখন একটি রক্ষক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। সুতরাং এখন এমনভাবে অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন যে দুর্দমনীয় সাহস, বীরত্ব এবং নির্ভীকতার উপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। কারণ, এটা নিশ্চিত সত্য যে, মক্কা বাহিনীকে যদি এ এলাকায় যথেচ্ছ চলতে ফিরতে দেয়া হয় তাহলে তাদের সামরিক মর্যাদা যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়ে যাবে এবং রাজনৈতিক প্রাধান্য বহু দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়বে। পক্ষান্তরে এর ফলে মুসলিমদের শক্তি হ্রাস পাবে এবং আঞ্চলিক সুযোগ সুবিধাও সীমিত হয়ে পড়বে। এর ফলশ্রুতিতে ইসলামী দাওয়াতকে একটি নিষ্প্রাণ আদর্শ মনে করে যাদের অন্তরে ইসলামের প্রতি হিংসা, বিদ্বেষ ও শত্রুতা রয়েছে এরূপ প্রত্যেক লোক ইসলামের ক্ষতি সাধনে উঠে পড়ে লেগে যাবে। এ ছাড়াও মক্কা বাহিনীর মদীনার দিকে অগ্রসর হয়ে এ যুদ্ধকে মদীনার চার প্রাচীর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে মুসলিমগণকে যে তাদের আবাসস্থানেই ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার সাহস ও চেষ্টা করবে না তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। ‘জী হ্যাঁ’ মুসলিম সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে যদি সামান্য পরিমাণও অবহেলা, আলস্য কিংবা কাপুরুষত্ব প্রদর্শিত হতো তাহলে এ সবের যথেষ্ট সম্ভাবনা ও আশঙ্কা ছিল। আর যদি এরূপ নাও হতো তাহলেও মুসলিমদের সামরিক প্রভাব প্রতিপত্তি এবং সুখ্যাতির উপর যে এ সবের একটি মন্দ ও প্রতিকূল প্রতিক্রিয়া প্রতিফলিত হতো তাতে কোনই সন্দেহ নেই।
পরামর্শ সভার বৈঠক (المَجْلِسُ الْاِسْتِشَارِيْ ):
অবস্থার এ আকস্মিক ভয়াবহ পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) উচ্চ পর্যায়ের এক সামরিক পরামর্শ সভার আয়োজন করলেন। এ সভায় তিনি বর্তমান সংকটজনক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে নেতৃস্থানীয় ও সাধারণ সৈনিকদের সঙ্গে মত বিনিময় করলেন। অবস্থার এ আকস্মিক মোড় পরিবর্তনের ফলে আসন্ন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের কথা অবগত হয়ে একটি দলের হৃৎকম্প উপস্থিত হল। এ দলটি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করলেন,
{كَمَا أَخْرَجَكَ رَبُّكَ مِن بَيْتِكَ بِالْحَقِّ وَإِنَّ فَرِيْقاً مِّنَ الْمُؤْمِنِيْنَ لَكَارِهُوْنَ يُجَادِلُوْنَكَ فِي الْحَقِّ بَعْدَمَا تَبَيَّنَ كَأَنَّمَا يُسَاقُوْنَ إِلَى الْمَوْتِ وَهُمْ يَنظُرُوْنَ} [الأنفال:5، 6]
‘(তারা যেমন প্রকৃত মু’মিন) ঠিক তেমনি প্রকৃতভাবেই তোমার প্রতিপালক তোমাকে তোমার ঘর হতে বের করে এনেছিলেন যদিও মু’মিনদের একদল তা পছন্দ করে নি। ৬. সত্য স্পষ্ট করে দেয়ার পরও তারা তোমার সঙ্গে বাদানুবাদে লিপ্ত হয়েছিল, (তাদের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল) তারা যেন চেয়ে চেয়ে দেখছিল যে, তাদেরকে মৃত্যুর দিকে তাড়িয়ে নেয়া হচ্ছে।’ (আল-আনফাল ৮ : ৫-৬)
কিন্তু সামরিক বাহিনীর নেতৃস্থানীয় লোকদের মধ্য থেকে আবূ বাকর (রাঃ) উঠে দাঁড়ালেন এবং অতি চমৎকার কথা বললেন। তারপর উমার (রাঃ) উঠে দাঁড়িয়ে আরয করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে যে পথ প্রদর্শন করেছেন সে পথে আপনি চলতে থাকুন। আমরা সর্বাবস্থায় আপনার সঙ্গে রয়েছি। আল্লাহর কসম! আমরা আপনাকে ঐ কথা বলব না, যে কথা ইসরাঈল মুসা (আঃ)-কে বলেছিল তা হলঃ
{فَاذْهَبْ أَنتَ وَرَبُّكَ فَقَاتِلا إِنَّا هَاهُنَا قَاعِدُوْنَ} [المائدة:24]
‘‘কাজেই তুমি আর তোমার প্রতিপালক যাও আর যুদ্ধ কর, আমরা এখানেই বসে রইলাম।’ (আল-মায়িদাহ ৫ : ২৪)
কিন্তু আমাদের ব্যাপার ভিন্ন। আমরা বরং বলব, ‘আপনি ও আপনার প্রভু যুদ্ধ করুন, আমরা সর্বাবস্থায় আপনাদের সঙ্গে থেকে যুদ্ধ করব। যিনি আপনাকে এক মহা সত্য প্রেরণ করেছেন তাঁর শপথ! যদি আপনি আমাদেরকে বারকে গিমাদ পর্যন্ত নিয়ে যান তবুও আমরা পথরোধকারীদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে আপনার সঙ্গে সেখানেও গমন করব।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁদের সম্পর্কে উত্তম কথা বললেন, এবং তাদের জন্য দুআ করলেন। এ তিনজন নেতাই ছিলেন মুহাজির। সেনাবাহিনীতে আনসারদের তুলনায় মুহাজির সৈন্যের সংখ্যা ছিল অনেক কম। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আনসারদেরও মতামত জানার প্রয়োজন বোধ করলেন। কেননা, সেনাবাহিনীতে সংখ্যায় তাঁরাই ছিলেন অধিক এবং যুদ্ধের ব্যয়ভার বহনের চাপও ছিল প্রকৃতপক্ষে তাঁদের উপরেই বেশী। অবশ্য, ‘আক্বাবাহ’র বাইআতের স্বীকৃতি মোতাবেক মদীনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করা তাদের জন্য অপরিহার্য ছিল না। এ প্রেক্ষিতে তিনি উপর্যুক্ত তিন মহান নেতার বক্তব্য শোনার পর পুনরায় বললেন, উপস্থিত ভ্রাতৃবৃন্দ! বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের করণীয় সম্পর্কে তোমরা আমাকে পরামর্শ দাও।’
আনসারদের উদ্দেশ্যেই তিনি এ কথাগুলো বলেছিলেন। আনসার অধিনায়ক ও পতাকাবাহক সা‘দ ইবনু মু’আয (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর এ কথার প্রকৃত তাৎপর্য অনুধাবন করে আরয করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! মনে হয় আপনি আমাদের মতামতই জানতে চাচ্ছেন।’
প্রত্যুত্তরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘হ্যাঁ’’।
তখন তিনি বললেন, ‘আমরা তো আপনার উপর ঈমান এনেছি, আপনার সত্যতা স্বীকার করেছি এবং এ সাক্ষ্য দিয়েছি যে, আপনি যা কিছু নিয়ে এসেছেন সবই সত্য এবং ওগুলো শোনা ও মান্য করার পর আমরা আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। সুতরাং হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আপনি যা ইচ্ছা করেছেন তা পূরণার্থে সম্মুখে অগ্রসর হয়ে যান। যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন তার শপথ! আপনি আদেশ করলে আমরা উত্তাল সাগরেও ঝাঁপ দিতে পারি। জগতের দুর্গমতম স্থানকেও পদদলিত করতে পারি, ইনশাআল্লাহ! আমাদের একজন লোকও পিছনে থাকবে না। যু্দ্ধ বিগ্রহে আপনি আমাদের প্রত্যক্ষ করবেন সাহসী ও নির্ভীক বীর পুরুষের ভূমিকায়। সম্ভবতঃ আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে আমাদের মাঝে এমন নৈপুণ্য প্রদর্শন করাবেন যা প্রত্যক্ষ করে আপনার চক্ষুদ্বয় শীতল হয়ে যাবে। সুতরাং যেখানে ইচ্ছা আপনি আমাদেরকে নিয়ে চলুন। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের কাজেকর্মে বরকত দান করুন।’
অন্য এক রেওয়ায়াতে আছে যে, সা‘দ ইবনু মু’আয (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট আরয করেন, ‘আপনি হয়ত আশঙ্কা করছেন যে, আনসারগণ তাঁদের শহরে থেকেই শুধু আপনাকে সাহায্য করা কর্তব্য মনে করছেন। এ কারণে আমি তাদের পক্ষ থেকে বলছি এবং তাঁদের পক্ষ থেকেই উত্তর দিচ্ছি যে, আপনার যেখানে ইচ্ছা হয় চলুন, যার সঙ্গে ইচ্ছে সম্পর্ক ঠিক রাখুন এবং যার সঙ্গে ইচ্ছা সম্পর্ক ছিন্ন করুন। আমাদের ধন-সম্পদ হতে যে পরিমাণ ইচ্ছা গ্রহণ করুন এবং যা ইচ্ছে ছেড়ে দিন। তবে যেটুকু আপনি গ্রহণ করবেন তা আমাদের নিকট যেটুকু ছেড়ে দেবেন তার চাইতে অধিক পছন্দনীয় হবে। আর এ ব্যাপারে আপনি যে ফায়সালাই করবেন, আমাদের ফায়সালা তারই অনুসারী হবে। আল্লাহর কসম! আপনি যদি অগ্রসর হয়ে বারকে গিমাদ পর্যন্ত চলে যান তাহলেও আমরা আপনার সঙ্গেই যাব। আর যদি আপনি আমাদের নিয়ে ঐ সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে চান তবে আমরাও এতে ঝাঁপিয়ে পড়ব।’
সা’দের এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর চেহারা মুবারক আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি বললেন,
(سِيْرُوْا وَأَبْشِرُوْا، فَإِنَّ اللهَ تَعَالٰى قَدْ وَعَدَنِىْ إِحْدٰى الطَّائِفَتَيْنِ، وَاللهِ لَكَأَنِّيْ الْآنَ أَنْظُرُ إِلٰى مَصَارِعِ الْقَوْمِ).
‘‘চলো এবং আনন্দিত চিত্তে চলো। আল্লাহ আমার সঙ্গে দুটি দলের মধ্য হতে একটির ওয়াদা করেছেন। আল্লাহর কসম! আমি যেন এসময় (কাফির) সম্প্রদায়ের বধ্যভূমি দেখতে পাচ্ছি।
ফুটনোটঃ
মুসলিম বাহিনীর পরবর্তী অগ্রযাত্রা (الْجَيْشُ الْإِسْلَامِيْ يُوَاصِلُ سِيرَهُ):
এরপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যাফরান হতে সামনে অগ্রসর হন এবং কয়েকটি পাহাড়ী মোড় অতিক্রম করেন যেগুলোকে আসাফির বলা হয়। সেখান থেকে আরও অগ্রসর হয়ে ‘দাব্বাহ’ নামক এক জনপদে অবতরণ করেন। তারপর ‘হিনান’ নামক পাহাড়কে ডান দিকে ছেড়ে দিয়ে অগ্রসর হতে থাকেন এবং পরবর্তী পর্যায়ে বদরের নিকটবর্তী স্থানে অবতরণ করেন।
ফুটনোটঃ
তথ্যানুসন্ধানের চেষ্টা (الرَّسُوْلُ ﷺ يَقُوْمُ بِعَمَلِيَةِ الْاِسْتِكْشَافِ):
এখানে পৌঁছেই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার ‘সওর’ গুহার সঙ্গী ও সব চাইতে ঘনিষ্ট বন্ধু আবূ বাকর (রাঃ)-কে সঙ্গে নিয়ে শত্রু বাহিনীর সন্ধান নেয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। দুর হতে তাঁরা মক্কা বাহিনীর শিবির এবং অবস্থান সম্পর্কে সমীক্ষারত ছিলেন। এমন সময় একজন বৃদ্ধ আরবকে তাঁরা পেয়ে গেলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ঐ বৃদ্ধকে কুরাইশ বাহিনী এবং মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর সাহাবীদের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। দু’বাহিনী সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদের উদ্দেশ্য ছিল যেন সে তাঁকে চিনতে না পারে। বৃদ্ধ বললেন, ‘আপনারা কোন কওমের সম্পর্কযুক্ত তা না জানালে আমি কিছুই বলব না।’
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন ঠিক আছে, ‘আপনি বলে দিলে আমরাও বলে দিব।’
সে বলল, ‘এটা ওটার বিনিমিয় তো?’
তিনি উত্তর দিলেন ‘হ্যাঁ’।
সে তখন বলল, ‘আমি জানতে পেরেছি যে, মুহাম্মাদ (সাঃ) এবং তাঁর সঙ্গীরা অমুক দিন মদীনা থেকে বের হয়েছেন। সংবাদ দাতা, আমাকে সঠিক বলে থাকলে আজ তারা অমুক জায়গায় রয়েছেন।
সে ঠিক ঐ জায়গাটিরই নাম ঠিকানা বলে দিল যেখানে ঐ সময় মুসলিম বাহিনী অবস্থান করছিলেন।
তারপর সে বলল, আমি এটাও অবগত হয়েছিল যে, কুরাইশ বাহিনী অমুক দিন মক্কা থেকে বের হয়েছে সংবাদ দাতা আমাকে সঠিক সংবাদ বলে থাকলে তারা আজ অমুক জায়গায় অবস্থান করছে।’
সে ঠিক ঐ জায়গারই নাম বলল, যেখানে ঐ সময় কুরাইশ বাহিনী অবস্থান করছিল।
বৃদ্ধ নিজের কথা শেষ করে বলল, ‘আচ্ছা তবে এখন বলুন, আপনারা কোন সম্প্রদায়ভুক্ত।’
উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘আমরা এক পানি হতেই (উদ্ভূত)।’
এ কথা বলেই তিনি ফিরে চললেন। আর বৃদ্ধ বক্ বক্ করতেই থাকল, কোন্ পানি হতে? ইরাকের পানি হতে কি?
ফুটনোটঃ
মক্কা বাহিনী সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যলাভ (الُحصُوْلُ عَلٰى أَهَمِّ الْمَعْلُوْمَاتِ عَنْ الْجَيْشِ الْمَكِّيْ):
ঐ দিনই সন্ধ্যায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) শত্রুদের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য নতুনভাবে এক গোয়েন্দা বাহিনী গঠন করেন। এ বাহিনীর ব্যবস্থাপনার জন্য আলী ইবনু আবূ ত্বালিব (রাঃ), যুবাইর ইবনু ‘আউওয়াম (রাঃ) এবং সা‘দ ইবনু ওয়াক্কাস (রাঃ)-কে প্রেরণ করেন। এ গোয়েন্দা বাহিনী সরাসরি বদরের প্রস্রবণে গিয়ে পৌঁছেন। সেখানে দুজন গোলাম মক্কা বাহিনীর জন্য পানির পাত্র পূর্ণ করছিল। মুসলিম গোয়েন্দা বাহিনী এ দুজন পানি বাহককে বন্দী করে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট হাযির করেন। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সালাতরত ছিলেন। উপস্থিত সাহাবীগণ ঐ গোলামদ্বয়কে বিভিন্ন ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকলেন। উত্তরে তারা বলল যে, ‘আমরা কুরাইশদের পানি বাহক। পাত্রে পানি ভর্তি করে আনার জন্য তারা আমাদের পাঠিয়েছিল।
তাদের এ জবাবে সাহাবীগণ সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। তাদের আশা ছিল যে, এরা দুজন হবে আবূ সুফইয়ানের লোক। কেননা, তাদের অন্তরে তখনো এ ক্ষীণ আশা বিরাজমান ছিল যে, তারা আবূ সুফইয়ানের বাণিজ্য কাফেলার উপর জয়যুক্ত হবেন। সুতরাং তারা ঐ গোলামদ্বয়কে কিছু মারপিটও করেন। তারা তখন বাধ্য হয়ে বলল যে, তারা আবূ সুফইয়ানের কাফেলার লোক। এ কথা বলার পর তাদের মারপিট বন্ধ করা হয়।
ততক্ষণে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সালাত আদায় শেষ করেছেন। সাহাবীগণের এহেন আচরণে বিরক্ত হয়ে তিনি বললেন, ‘গোলামদ্বয় যখন সত্য কথা বলল, তখন তোমরা তাদের মারপিট করলে, অথচ যখন মিথ্যা কথা বলল তখন তাদের ছেড়ে দিলে। আল্লাহর কসম! তারা দুজন সঠিক কথাই বলেছিল যে, তারা কুরাইশের লোক।’
এরপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ঐ গোলাম দ্বয়কে বললেন, আচ্ছা এখন আমাকে কুরাইশদের সম্পর্কে খবর দাও।’
তারা বলল, ‘ঐ যে টিলাটি, যা উপত্যকার শেষ প্রান্তে দেখা যাচ্ছে, কুরাইশরা তারই পিছনে অবস্থান করছে।’
তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘তারা কতজন আছে’’? উত্তরে তারা বলল, ‘অনেক’।
তিনি আবারও জিজ্ঞেস করলেন, তাদের সংখ্যা কত?’ তারা বলল ‘আমাদের তা জানা নেই।’
তিনি পুনরায় প্রশ্ন করলেন, ‘প্রত্যহ কটি উট জবেহ করা হয়?’
তারা জবাব দিল, ‘একদিন নয়টি এবং আরেক দিন দশটি’’। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মন্তব্য করলেন, ‘তাহলে তো তাদের সংখ্যা নয়শ ও এক হাজারের মাঝামাঝি হবে।’
তারপর তিনি তাদেরকে পুনরায় প্রশ্ন করলেন, ‘তাদের সঙ্গে সম্ভ্রান্ত কুরাইশদের কে কে আছে’’?
উত্তরে তারা বলল, ‘রাবী’আহর দু’পুত্র ‘উতবাহ ও শায়বাহ, আবুল বাখতারী ইবনু হিশাম, হাকীম ইবনু হিযাম, নাওফাল ইবনু খুওয়াইলিদ, হারিস ইবনু আমির, তোআইমাহ ইবনু আদী, নাযর ইবনু হারিস, যামআহ ইবনু আসওয়াদ, আবূ জাহল ইবনু হিশাম, উমাইয়া ইবনু খালফ এবং আরও অনেকে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘মক্কা তার কলিজার টুকরোগুলোকে তোমাদের পাশে এনে নিক্ষেপ করেছে।’
ফুটনোটঃ
রহমতের বৃষ্টি বর্ষণ (نُزُوْلُ الْمَطَرِ):
মহা মহিমান্বিত আল্লাহ রাববুল আলামীন এ রাত্রেই বৃষ্টি বর্ষণ করলেন। মক্কা বাহিনীর উপর বর্ষিত হল সেই বৃষ্টির ধারা মুষল ধারে। প্রবল বৃষ্টির কারণে মক্কা বাহিনীর অগ্রগমন কিছুটা বাধাপ্রাপ্ত হল। কিন্তু মুসলিম বাহিনীর উপর তা বর্ষিত হল আল্লাহ পাকের বিশেষ এক রহমত রূপে। আল্লাহর রহমতের এ বৃষ্টি শয়তানের সৃষ্ট অপবিত্রতা থেকে মুসলিমদের পবিত্র করে এবং ভূমিকে সমতল ও মসৃন করে। এর ফলে বেশ অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি করে। পদচারণার ক্ষেত্রে অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার কারণে তাদের অন্তরেও দৃঢ়তার ভাব সৃষ্টি হয়ে যায়।
ফুটনোটঃ
গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কেন্দ্রস্থলের দিকে মুসলিম বাহিনীর অগ্রগমন (الجَيْشُ الْإِسْلَامِيْ يَسْبِقُ إِلٰى أَهَمِّ الْمَرَاكِزِ الْعَسْكَرِيَّةِ):
এরপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্বীয় সেনাবাহিনীকে দ্রুত পথে চলার নির্দেশ দেন যাতে তাঁরা মুশরিক বাহিনীর পূর্বেই বদরের প্রস্রবণের নিকট পৌঁছে যান এবং প্রস্রবণের উপর নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। মুশরিক বাহিনী যাতে কোনভাবেই প্রস্রবণের উপর অধিকার লাভ করতে না পারে সেটাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। এ প্রেক্ষিতে তিনি এবং তাঁর বাহিনী এশার সময় বদরের নিকট অবতরণ করেন। এ সময় হাববাব ইবনু মুনযির (রাঃ) একজন অভিজ্ঞ সামরিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রশ্ন করলেন। ‘হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এ স্থানে আপনি আল্লাহর নির্দেশ ক্রমে অবতরণ করেছেন, না শুধু যুদ্ধের কৌশল হিসেবেই আপনি এ ব্যবস্থা অবলম্বন করেছেন। ‘কেননা এর অগ্র কিংবা পশ্চাদগমনের আমাদের কোন সুযোগ নেই’’?
প্রত্যুত্তরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘শুধু যুদ্ধের কৌশল হিসেবেই আমি এ ব্যবস্থা অবলম্বন করেছি।’
এ কথা শুনে হুবাব (রাঃ) বললেন, ‘এটা উপযুক্ত স্থান নয়। আরও সামনের দিকে এগিয়ে চলুন এবং কুরাইশ বাহিনীর সব চাইতে নিকটে যে প্রস্রবণ রয়েছে সেখানে শিবির স্থাপন করুন। তারপর অন্যান্য সব প্রস্রবণ বন্ধ করে দিয়ে নিজেদের প্রস্রবণের উপর চৌবাচ্চা তৈরি করে তাতে পানি ভর্তি করে নেব। এরপর কুরাইশ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হলে আমরা পানি পাব কিন্তু তারা তা পাবে না।
তাঁর এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘তুমি উত্তম পরামর্শ দিয়েছ।’ এরপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর বাহিনীকে অগ্রগমনের নির্দেশ প্রদান করলেন এবং অর্ধেক রাত যেতে না যেতেই কুরাইশ বাহিনীর সব চাইতে নিকটবর্তী প্রস্রবণের নিকট পৌঁছে গিয়ে শিবির স্থাপন করলেন। তারপর সেখানে একটি চৌবাচ্চা বা জলাধার তৈরি করে নিয়ে অবশিষ্ট সমস্ত প্রস্রবণ বন্ধ করে দিলেন।
ফুটনোটঃ
নেতৃত্বের কেন্দ্র (مُقِرُّ الْقِيَادَةِ):
প্রস্রবণের উপর মুসলিম বাহিনীর যখন শিবির স্থাপন কাজ সম্পন্ন হল তখন সা‘দ ইবনু মু’আয (রাঃ) প্রস্তাব করলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সৈন্য পরিচালনা বা নেতৃত্ব প্রদানের কেন্দ্রস্থল রূপে একটি ছাউনী নির্মাণ করে দেয়া হোক, যেখানে তিনি অবস্থান করবেন। আল্লাহ না করুন বিজয়ের পরিবর্তে আমাদেরকে যদি পরাজিত হতে হয় কিংবা অন্য কোন অসুবিধাজনক অবস্থার সম্মুখীন হতে হয় তাহলে পূর্ব থেকেই তাঁর নিরাপত্তার জন্য আমরা যেন প্রস্তুত থাকতে পারি। তাঁর এ প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে সমর্থিত হলো। তারপর তাঁরা আরয করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আমরা আপনার জন্য একটি বস্ত্রের ছাউনী নির্মাণ করার মনস্থ করেছি। আপনি ওর মধ্যে অবস্থান করবেন এবং আপনার সওয়ারীগুলো পাশে তৈরি অবস্থায় থাকবে। তারপর আমরা শত্রুদের সঙ্গে মোকাবেলা করব। যদি আল্লাহ পাক আমাদের মান মর্যাদা রক্ষা করে শত্রুদের উপর বিজয় দান করেন তবে সেটা তো হবে আমাদের একান্ত আকাঙ্ক্ষিত ও পছন্দনীয়। আর আল্লাহ না করুন যদি আমরা অন্য অবস্থার সম্মুখীন হই তবে আপনি সওয়ারীর উপর আরোহণ করে আমাদের কওমের ঐ সকল লোকের নিকট চলে যাবেন যারা পিছনে রয়ে গেছেন। হে আল্লাহর নাবী (সাঃ)! প্রকৃতপক্ষে আপনার পিছনে এরূপ লোকেরা রয়েছেন যাঁদের তুলনায় আপনার প্রতি আমাদের ভালবাসা বেশী নয়। যদি তারা অনুমান করতে পারতেন যে, আপনি যুদ্ধের সম্মুখীন হয়ে পড়বেন তবে কখনই তারা পিছনে থাকতেন না। আল্লাহ তা‘আলা তাঁদের মাধ্যমে আপনাকে হিফাযত করবেন। তাঁরা আপনার শুভাকফঙ্ক্ষী এবং তাঁরা আপনার সঙ্গে থেকে যুদ্ধ করবেন।’
তাঁদের এ কথায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) খুশী হলেন ও তাদের প্রশংসা করলেন এবং তাঁদের কল্যাণের জন্যে দুআ করলেন।
সাহাবীগণ যুদ্ধ ক্ষেত্রের উত্তর পূর্বে একটি উঁচু টিলার উপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্য আরীশ (তাঁবু) নির্মাণ করলেন যেখান থেকে পূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্রটি দৃষ্টি গোচর হতো। তারপর তাঁর ঐ আরীশের রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে সা‘দ ইবনু মু’আয (রাঃ)-এর নেতৃত্বে আনসারী যুবকদের একটি বাহিনী নির্বাচন করা হলো।
ফুটনোটঃ
সেনা বিন্যাস ও রাত্রি যাপন (تَعْبِئَةُ الْجَيْشِ وَقَضَاءُ اللَّيْلِ):
এরপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সৈন্যদেরকে বিন্যস্ত করেন[1] এবং যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হন। সেখানে তিনি স্বীয় পবিত্র হাত দ্বারা ইশারা করে করে যাচ্ছিলেন, ‘এটা হবে ভাবীকাল ইনশাআল্লাহ[2] অমুকের বধ্যভূমি এবং এটা আগামী কাল হলে ইনশাআল্লাহ অমুকের বধ্যভূমি।’ এরপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সেখানে একটি গাছের মূলের পাশে রাত্রি যাপন করেন এবং মুসলিমরাও পূর্ণ শান্তিতে রাত্রি অতিবাহিত করেন। তাঁদের অন্তর আল্লাহর উপর ভরসায় পরিপূর্ণ ছিল। তাঁদের এ আশা ছিল যে, প্রত্যুষেই তাঁরা স্বচক্ষে প্রতিপালকের শুভ সংবাদের বাণী দেখতে পাবেন। আল্লাহ পাক বলেন,
{إِذْ يُغَشِّيْكُمُ النُّعَاسَ أَمَنَةً مِّنْهُ وَيُنَزِّلُ عَلَيْكُم مِّن السَّمَاء مَاء لِّيُطَهِّرَكُم بِهِ وَيُذْهِبَ عَنكُمْ رِجْزَ الشَّيْطَانِ وَلِيَرْبِطَ عَلٰى قُلُوْبِكُمْ وَيُثَبِّتَ بِهِ الأَقْدَامَ} [الأنفال:11].
‘‘স্মরণ কর, যখন আল্লাহ তাঁর নিকট হতে প্রশান্তি ধারা হিসেবে তোমাদেরকে তন্দ্রায় আচ্ছন্ন করেছিলেন, আকাশ হতে তোমাদের উপর বৃষ্টিধারা বর্ষণ করেছিলেন তোমাদেরকে তা দিয়ে পবিত্র করার জন্য। তোমাদের থেকে শায়ত্বনী পংকিলতা দূর করার জন্য, তোমাদের দিলকে মজবুত করার জন্য আর তা দিয়ে তোমাদের পায়ের ভিত শক্ত করার জন্য।’ (আল-আনফাল ৮ : ১১)
এ রাতটি ছিল হিজরী ২য় সনের ১৭ই রমাযানের জুমুআহর রাত। ঐ মাসেরই ৮ই অথবা ১২ই তারীখে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মদীনা থেকে রওয়ানা হয়েছিলেন।
ফুটনোটঃ[1] জামে তিরমিযী ১ম খন্ড আবওয়াবুল জিহাদ, বাবু মা জাআ ফিস সাফফে ওয়াত তা’বিয়াতে ১ম খন্ড ২০১ পৃঃ।
[2] মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে আনাস (রাঃ) হতে, মিশকাত ২য় খন্ড ৫৪৩ পৃঃ।
যুদ্ধ ক্ষেত্রে মক্কা সৈন্যদের আগমন এবং তাদের পারস্পরিক মতানৈক্য (الْجَيْشُ الْمَكِّيْ فِيْ عَرْصَةِ الْقِتَالِ، وَوُقُوْعُ الْاِنْشِقَاقِ فِيْهِ):
অপরপক্ষে কুরাইশরা উপত্যকার বাইরে দিকে তাদের শিবিরে রাত্রি যাপন করে। আর প্রত্যুষে পুরো বাহিনী সহ টিলা হতে অবতরণ করে বদরের দিকে রওয়ানা হয়। একটি দল রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হাউযের দিকে অগ্রসর হয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘তাদেরকে ছেড়ে দাও।’ তাদের মধ্যে যেই পানি পান করেছিল সেই এ যুদ্ধে নিহত হয়েছিল। শুধু হাকীম ইবনু হিযামের প্রাণ বেঁচেছিল। সে পরে মুসলিম হয়েছিল এবং পাকা মুসলিমই হয়েছিল। তার নিয়ম ছিল যে, যখন সে দৃঢ় শপথ করত তখন বলত ঐ সত্ত্বার শপথ! যিনি আমাকে বদরের দিন হতে পরিত্রাণ দিয়েছেন।
ওদিকে কুরাইশ সৈন্যদলে মহা কোলাহল শুরু হয়েছে। কেউ অহংকার ভরে চিৎকার করছে এবং কেউ ক্রোধভরে মাটিতে পদাঘাত করছে। এ সময় কুরাইশ দলপতির আদেশক্রমে উমায়ের ইবনু অহাব নামক এক ব্যক্তি মুসলিমদের সংখ্যা নির্ণয় করার জন্য অশ্বরোহণে তাদের চারদিক প্রদক্ষিণ করে চলে যায়। স্বদলে ফিরে এসে উমায়ের বলতে শুরু করে মুসলিমদের সংখ্যা কমবেশি তিনশ হবে এবং তাদের পশ্চাতে সাহায্য করারও কেউ নেই। তরবারী ছাড়া আত্মরক্ষার জন্যে কোন উপকরণ তাদের সাথে নেই, এটাও আমি উত্তমরূপে বুঝতে পেরেছি। কিন্তু তারা এমন সুবিন্যস্তভাবে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হয়ে আছে যে, আমরা আমাদের একটি প্রাণের বিনিময় ছাড়া তাদের একটি প্রাণনাশ করতে পারবো না। কাজেই এ যুদ্ধে আমাদের পক্ষের অন্তত তিনশত প্রাণ উৎসর্গ না করে আমরা কোন ক্রমেই বিজয় লাভে সক্ষম হব না। যদি তারা আমাদের বিশেষ বিশেষ লোকদেরকে হত্যা করে ফেলে তবে এর পরে বেঁচে থাকার সাধ আর কী থাকতে পারে? অতএব, আমাদের কিছু চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে।’
উমায়েরের এ কথা শুনে যুদ্ধের ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্পকারী আবূ জাহেলের সামনে আরেক সমস্যা দেখা দিল। লোকারো তাকে যুদ্ধ করা ছাড়াই মক্কায় ফিরে যেতে বললো। হাকীম ইবনু হিযাম নামক কুরাইশ দলপতির চৈতন্যেদয় হল। তিনি দাঁড়িয়ে এক নীতি দীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন এবং সকলকে বুঝাবার চেষ্টা করলেন যে, এ অন্যায় সমরে প্রবৃত্ত হওয়ার কোনই কারণ নেই, তিনশত প্রাণ বলি দিয়ে এ যুদ্ধে বিজয় লাভের সার্থকতাও কিছুই নেই। হাকীম বক্তৃতা দিয়ে ক্ষান্ত হলেন না। তিনি ‘উতবাহ ইবনু রাবীআহ নামক কুরাইশ দলপতির নিকট উপস্থিত হয়ে নিজের মনোভবতার কাছে ব্যক্ত করলেন। ‘উতবাহ হাকীমের কথার যৌক্তিকতা অস্বীকার করতে পারল না। হাকীম তখন আশান্বিত হয়ে বললেন, ‘দেখুন, আপনি ধনে মানে কুরাইশের একজন বরেণ্য ব্যক্তি। সুতরাং আপনি একটু দৃঢ়তা অবলম্বন করে এ অন্যায় যুদ্ধ হতে স্বজাতিকে বিরত রাখুন, তাহলে আরবের ইতিহাসে আপনার নাম চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’ ‘উতবাহ উত্তরে বলল, ‘আমি তো প্রস্তুত আছি। এক ‘আমর বিন হাযরামীর (যে সারিয়্যায়ে নাখলাহতে মারা গিয়েছিল) রক্তপণ, সেটাও আমি নিজে পরিশোধ করে দিতে পারি। কিন্তু হানযালিয়ার পুত্রকে (আবূ জাহল) কোন যুক্তির দ্বারাই বিরত রাখা সম্ভব নয়। যাহোক, তুমি তার কাছে গিয়ে চেষ্টা করে দেখো, তোমার প্রস্তাবে আমার সম্মতি রয়েছে।’
তারপর ‘উতবাহ দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখতে লাগল। বলল, ‘হে কুরাইশগণ! তোমরা মুহাম্মাদ (সাঃ), তাঁর সঙ্গীদের সাথে যুদ্ধ করে কোন বাহাদুরী করবেনা। আল্লাহর শপথ! যদি তোমরা তাঁদেরকে হত্যা করে ফেল তাহলে এমন চেহেরাসমূহ দেখতে পাওয়া যাবে যেগুলোকে দেখা পছন্দনীয় হবে না। কেননা এ যুদ্ধে হয় চাচাতো ভাই নিহত হবে নতুবা খালাতো ভাই কিংবা নিজের গোত্রেরই লোক নিহত হবে। সুতরাং ফিরে চল এবং মুহাম্মাদ (সাঃ) ও গোটা আরব দুনিয়াকে ছেড়ে দাও। যদি আরবের অন্য লোকেরা মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে হত্যা করে ফেলে তাহলে তো সেটা তোমাদের কাঙ্খিত কাজই হবে। অন্যথা মুহাম্মাদ (সাঃ) তোমাদেরকে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখবেন যে, তোমরা তাঁর প্রতি তোমাদের করণীয় কাজটি করো নি।
এদিকে হাকীম আবূ জাহলের নিকট হাযির হয়ে নিজের ও ‘উতবাহর মতামত ব্যক্ত করলেন। হাকীমের কথা শুনে আবূ জাহলের আপাদমস্তক জ্বলে উঠল। সে ক্রোধান্বিত স্বরে বলতে লাগল, আল্লাহর শপথ, মুহাম্মাদ ও তার সাথীদের দেখার পর ‘মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর যাদু ‘উতবাহর উপর বিশেষ কার্যকরী হয়েছে। কক্ষনো না, আল্লাহর শপথ! আমাদের ও মুহাম্মাদের মধ্যে আল্লাহর ফায়সালা না হওয়া পর্যন্ত আমরা ফিরে যাব না। না, না এতক্ষণে বুঝতে পেরেছি, ‘উতবাহর পুত্র মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর দলভুক্ত (‘উতবাহর পুত্র আবূ হুযাইফা (রাঃ) প্রথম পর্যায়ের মুসলিম ছিলেন এবং হিজরত করে মদীনায় গিয়েছিলেন)। সে যুদ্ধ ক্ষেত্রে উপস্থিত। তার নিহত হওয়ার আশঙ্কায় নরাধম এমন বিচলিত হয়ে পড়েছে। ধিক্ শত ধিক তাকে।’
হাকীম তখন আবূ জাহলকে সেখানে রেখে ‘উতবাহর নিকট গমন করে সমস্ত বৃত্তান্ত প্রকাশ করলেন। ক্রোধ, অভিমান ও অহংকারে ‘উতবাহ একেবারে আতমবিস্মৃত হয়ে পড়লো। সে বলে উঠল, কী, আমি ভীরু? আমি কাপুরুষ? পুত্রের মায়ায় আমি বীরধর্মে জলাঞ্জলি দিচ্ছি। আচ্ছা, তাহলে আরববাসী দেখুক, জগদ্বাসী দেখুক যে, কে বীর পুরুষ, আমি ততক্ষণ ফিরব না যতক্ষণ না মুহাম্মাদের সঙ্গে একটা চূড়ান্ত বোঝাপড়া হয়। এ বলে সে সদল বলে সমরাঙ্গনে এগিয়ে চলল। আর ওদিকে আবূ জাহল ছুটে গিয়ে ‘আমির ইবনু হযরামীকে বলল, ‘দেখছ কি, তোমার ভ্রাতার প্রতিশোধ গ্রহণ আর সম্ভব হবে না। কাপুরুষ ‘উতবাহ সদল বলে যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করে যাচ্ছে। শীঘ্র উঠে আর্তনাদ করতে শুরু কর।’
আবূ জাহলের কথা শেষ হতে না হতেই ‘আমির তার সকল অঙ্গে ধূলো বালি মাখতে মাখতে এবং গায়ের কাপড় ছিঁড়তে ছিঁড়তে নিহত ভ্রাতার নাম নিয়ে আর্তনাদ করে বেড়াতে লাগল। আর যায় কোথায়, মুহূর্তের মধ্যে হাকীমের সমস্ত পরিশ্রম পশু হয়ে গেল। ক্ষণিকের মধ্যেই রণ পিপাসু মুশরিক বাহিনীর বীভৎস চিৎকার দিগ্বিদিক ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত করে তুলল এবং রণাঙ্গন প্রকম্পিত হয়ে উঠল।
ফুটনোটঃ
মুশরিক ও মুসলিম বাহিনী পরস্পর মুখোমুখী (الجَيْشَانِ يَتَرَاآنِ):
‘‘হে আল্লাহ, এ মুশরিক কুরাইশগণ ভীষণ গর্বভরে তোমার বিরুদ্ধাচরণ করতে করতে এবং তোমার রাসূল (সাঃ)-কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে করতে এগিয়ে আসছে। হে আল্লাহ, আমরা তোমার সাহায্যপ্রার্থী। হে আল্লাহ, তোমার এ দীন দাসদের প্রতি তোমার যে ওয়াদা রয়েছে তা আজ পূর্ণ করে দেখিয়ে দাও।’
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ‘উতবাহ ইবনু রাবী’আহকে তার একটি লাল উটের উপর দেখে বললেন,
(إِنْ يَّكُنْ فِيْ أَحَدٍ مِّنْ الْقَوْمِ خَيْرٌ فَعِنْدَ صَاحِبُ الْجَمَلِ الْأَحْمَرِ، إِنْ يُّطِيْعُوْهُ يَرْشُدُوْا)
কওমের মধ্যে কারো কাছে কল্যাণ থাকলে লাল উটের মালিকের কাছে রয়েছে। জনগণ তার কথা মেনে নিলে তারা সঠিক পথ প্রাপ্ত হবে।’
এ স্থানে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মুসলিমদের সারিগুলো ঠিক করলেন। সারি ঠিক করা অবস্থায় একটি বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে গেল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হাতে একটি তীর ছিল যা দ্বারা তিনি সারি ঠিক করছিলেন। ঐ সময় সাওয়াদ ইবনু গাযিয়্যাহ সারি হতে কিছু আগে বেড়েছিলেন। তার পেটের উপর তিনি তীরের ছোঁয়া দিয়ে বললেন, ‘হে সাওয়াদ সমান হয়ে যাও। তখন সাওয়াদ (রাঃ) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ), আমাকে আপনি কষ্ট দিয়েছেন, সুতরাং প্রতিশোধ প্রদান করুন।’ তার একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্বীয় পেট খুলে দিয়ে বললেন, ‘প্রতিশোধ নিয়ে নাও।’ সাওয়াদ (রাঃ) তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন এবং পেটে চুম্বন দিতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তখন তাকে বললেন, ‘হে সাওয়াদ (রাঃ) তোমার এরূপ করার কারণ কী?’ সাওয়াদ (রাঃ) উত্তরে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) যা কিছু সামনে আছে তা তো আপনি দেখতেই পাচ্ছেন। আমি চেয়েছি যে, এ স্থানে আপনার সাথে আমার শেষ আদান প্রদান যেন এটাই হয়, অর্থাৎ আমার দেহের চামড়া আপনার দেহের চামড়াকে স্পর্শ করে।’ তাঁর এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর জন্যে কল্যাণের দুআ করলেন। সারিসমূহ ঠিক ঠাক হয়ে গেল, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সৈন্যদেরকে উপদেশ দিতে গিয়ে বললেন যে, তিনি তাদেরকে শেষ নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত যেন তারা যুদ্ধ শুরু না করেন। তারপর তিনি যুদ্ধনীতির ব্যাপারে বিশেষ একটি উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন, ‘মুশরিকরা যখন সংখ্যা বহুলরূপে তোমাদের নিকট এসে পড়বে তখন তাদের প্রতি তীর চালাবে এবং নিজেদের তীর বাঁচাবার চেষ্টা করবে[1] (অর্থাৎ প্রথম থেকেই অযথা তীরন্দাজী করে তীর নষ্ট করবে না।) আর যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তোমাদের উপর ছেয়ে না যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা তরবারী উত্তোলন করবে না।[2]
এরপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এবং আবূ বাকর (রাঃ) ছাউনির দিকে ফিরে গেলেন এবং সা‘দ ইবনু মু’আয (রাঃ) তাঁর রক্ষকবাহিনীকে নিয়ে ছাউনির দরজার উপর নিযুক্ত হয়ে গেলেন।
অপর পক্ষে মুশরিকদের অবস্থা এই ছিল যে, আবূ জাহল আল্লাহ তা‘আলার নিকট ফায়সালার দুআ করল। সে বলল, ‘হে আল্লাহ আমাদের মধ্যে যে দলটি আত্মীয়তার বন্ধন বেশী ছিন্নকারী ও ভুল পন্থা অবলম্বনকারী ঐ দলকে তুমি আজ ছিন্ন ভিন্ন করে দাও। হে আল্লাহ! আমাদের মধ্যে যে দল তোমার নিকট বেশী প্রিয় ও পছন্দনীয় আজ তুমি ঐ দলকে সাহায্য কর।’ পরবর্তীতে এ কথারই দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা নিম্নের আয়াতটি অবতীর্ণ করেন।
{إِن تَسْتَفْتِحُوْا فَقَدْ جَاءكُمُ الْفَتْحُ وَإِن تَنتَهُوْا فَهُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ وَإِن تَعُوْدُوْا نَعُدْ وَلَن تُغْنِيَ عَنكُمْ فِئَتُكُمْ شَيْئًا وَلَوْ كَثُرَتْ وَأَنَّ اللهَ مَعَ الْمُؤْمِنِيْنَ} [الأنفال:19]
‘‘(ওহে কাফিরগণ!) তোমরা মীমাংসা চাচ্ছিলে, মীমাংসা তো তোমাদের কাছে এসে গেছে; আর যদি তোমরা (অন্যায় থেকে) বিরত হও, তবে তা তোমাদের জন্যই কল্যাণকর, তোমরা যদি আবার (অন্যায়) কর, আমিও আবার শাস্তি দিব, তোমাদের দল-বাহিনী সংখ্যায় অধিক হলেও তোমাদের কোন উপকারে আসবে না এবং আল্লাহ তো মু’মিনদের সঙ্গে আছেন।’ (আল-আনফাল ৮ : ১৯)
ফুটনোটঃ[1] সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৫৬৮ পৃঃ।
[2] সুনানে আবূ দাউদ, বাবু ফী সাল্লিম সূযুফে ইনদাল্লিকা ২/১৩ পৃঃ।
শেষ মুহূর্ত ও যুদ্ধের প্রথম ইন্ধন (سَاعَةُ الصِّفْرِ وَأَوَّلُ وُقُوْدُ الْمَعْرِكَةِ):
এ যুদ্ধের প্রথম ইন্ধন ছিল আসওয়াদ ইবনু আবুল আসাদ মাখযুমী। এ লোকটি ছিল বড়ই হঠকারী ও দুশ্চরিত্র। সে একথা বলতে বলতে যুদ্ধক্ষেত্রে বেরিয়ে আসলো ‘আমি এদের হাউযের পানি পান করব অথবা একে ভেঙে ফেলব নতুবা এজন্যে জীবন দিয়ে দিব।’ এ কথা বলে যখন সে ওদিক থেকে বেরিয়ে আসলো তখন এদিক থেকে হামযাহ ইবনু আব্দুল মুত্তালিব (রাঃ) এগিয়ে আসলেন। হাউযের পাড়েই দুজনের দেখাদেখি হলো। হামযাহ (রাঃ) তাকে এমনভাবে তরবারী দ্বারা আঘাত করলেন যে, তার পা অর্ধ পদনালী হতে কেটে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল এবং সে পৃষ্ঠভরে পড়ে গেল। তার পা হতে রক্তের ফোয়ারা ছুটছিল যার গতি তার সঙ্গীদের দিকে ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে হাঁটুর ভরে ছেঁচড়িয়ে চলে হাউযের দিকে অগ্রসর হলো এবং তাতে প্রবেশ করতেই চাচ্ছিল যাতে তার কসম পুরো হয়ে যায়। ইতোমধ্যে হামযাহ (রাঃ) দ্বিতীয়বার তার উপর তরবারী চালালেন এবং সে হাউযের মধ্যেই মৃত্যুমুখে পতিত হলো।
ফুটনোটঃ
যুদ্ধের সূত্রপাত (المُبَـــارَزَةُ):
এটা ছিল এ যুদ্ধের প্রথম হত্যা। এর ফলে যুদ্ধের অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠল। তখন নিয়ম ছিল যে, যুদ্ধের পূর্বে প্রত্যেক পক্ষের বিখ্যাত বীর পুরুষরা রণাঙ্গনে অবতীর্ণ হয়ে অন্যপক্ষকে সমরে আহবান করত। তখন ঐ পক্ষের নির্বাচিত কয়েকজন খ্যাতনামা বীর এ আহবানের উত্তর প্রদানের জন্যে বীরদর্পে অগ্রসর হতো। এ ক্ষেত্রেও তাই হলো। অভিযান ক্ষুব্ধ ‘উতবাহ ও তার সহোদর শায়বাহ ও পুত্র ওয়ালীদসহ চীৎকার করতে লাগল ‘কে আসবি আয়, আমাদের তরবারীর খেলা দেখে যা।’ তার এ আহবান শুনে তিনজন আনসার বীর উলঙ্গ তরবারী হাতে সেই দিকে ধাবিত হলেন। তারা হলেন আউয (রাঃ), মুআব্বিয (রাঃ), এরা দুজন হারিসের পুত্র ছিলেন এবং তাদের মাতার নাম ছিল আফরা-। তৃতীয় জন হলেন আব্দুল্লাহ ইবনু রাওয়াহা। কুরাইশরা তাদের জিজ্ঞেস করল, তোমরা কে? তাঁরা বললেন, ‘আমরা আনসার’। তখন তারা বলল, ‘আপনাদের আমরা চাচ্ছি না। আমরা আমাদের চাচাতো ভাইদের চাচ্ছি এবং একজন চিৎকার করে বলতে লাগল ‘হে মুহাম্মাদ (সাঃ), মদীনার এ চাষাগুলোর সাথে যুদ্ধ করা আমাদের পক্ষে অসম্মানজনক। আমাদের যোগ্য যোদ্ধা পাঠাও। তার একথা শুনে রাসূলুল্লাহ এ তিনজন আনসার বীরকে তাদের স্ব- স্ব স্থানে ফিরে যেতে বললেন। তারপর তিনি নিজের পরমাত্মীয়দের মধ্যে হতে হামযাহ (রাঃ), উবাইদাহ বিন হারিস (রাঃ) ও আলী (রাঃ)-কে সম্বোধন করে বললেন, ‘তোমরা তাদের মোকাবেলায় অগ্রসর হও। এরা অগ্রসর হলে কুরাইশগণ বলল, ‘তোমরা কে?’ তাঁরা তাদের পরিচয় দান করলেন। কাফিররা তাদেরকে আক্রমণ করল। ওয়ালীদের সাথে আলী (রাঃ)-কে, শায়বাহর সাথে হামযাহর (রাঃ) এবং ‘উতবাহর সাথে উবাইদাহ (রাঃ)-এর যুদ্ধ বেধে গেল। মুহূর্তের মধ্যে শায়বাহ ও ওয়ালীদের মস্তক ভূলণ্ঠিত হয়ে পড়লো। উবাইদাহ (রাঃ) ছিলেন তখন সবার চেয়ে বৃদ্ধ। তিনি ও ‘উতবাহ পরস্পরে তরবারীর আঘাতে গুরুতররূপে আহত হয়ে পড়ল। ইতোমধ্যে আলী ও হামযাহ (রাঃ) নিজ নিজ প্রতিদ্বন্দ্বীকে খতম করে এসে ‘উতবাহর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা কাজ শেষ করেন ও উবাইদাহকে তুলে আনলেন। তার মুখে আওয়াজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং ক্রমাগতভাবে বন্ধই থাকল। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের ৪র্থ বা ৫ম দিন যখন মুসলিমরা মদীনা প্রত্যাবর্তনের পথে সাফরা নাম উপত্যকা অতিক্রম করছিলেন ঐ সময় উবাইদাহ (রাঃ) মৃত্যুবরণ করেন।
আলী (রাঃ) আল্লাহর নামে শপথ করে বলতেন, ‘এ আয়াতটি আমাদেরই ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়,
{هٰذَانِ خَصْمَانِ اخْتَصَمُوْا فِيْ رَبِّهِمْ} الآية [الحج:19]
‘‘এরা বিবাদের দু’টি পক্ষ, (মু’মিনরা একটি পক্ষ, আর সমস্ত কাফিররা আরেকটি পক্ষ) এরা এদের প্রতিপালক সম্বন্ধে বাদানুবাদ করে।’ (আল-হাজ্জ ২২ : ১৯)
ফুটনোটঃ
সাধারণ আক্রমণ (الهُجُوْمُ الْعَامُ):
এ মল্ল যুদ্ধের পরিণাম মুশরিকদের জন্য খুবই মন্দ সূচনা ছিল। তারা একটি মাত্র লম্ফনে তাদের তিন জন বিখ্যাত অশ্বারোহী নেতাকে হারিয়ে বসেছিল। এ জন্যে তাঁরা ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে একত্রিতভাবে মুসলিমগণকে আক্রমণ করল।
অপর দিকে মুসলিমরা তাঁদের প্রতিপালকের নিকট অত্যন্ত আন্তরিকতা ও বিনয়ের সাথে সাহায্যের জন্য প্রার্থনা করার পর স্ব স্ব স্থানে অটল থাকলেন এবং প্রতিহত করার ব্যবস্থা অবলম্বন করলেন। তাঁরা মুশরিকদের একাদিক্রমিক আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকলেন এবং তাঁদের বিশেষ ক্ষতিসাধন করে চললেন। তাদের মুখে আহাদ আহাদ শব্দ উচ্চারিত হচ্ছিল।
ফুটনোটঃ
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আকুল প্রার্থনা (الرَّسُوْلُ ﷺ يُنَاشِدُ رَبَّهُ):
এদিকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সৈন্যদের শ্রেণী বিন্যাস কাজ শেষ করে ফিরে এসেই স্বীয় মহান প্রতিপালকের নিকট সাহায্যের ওয়াদা পূরণের প্রার্থনা করতে লাগলেন। তাঁর প্রার্থনা ছিল,
(اللهم أَنْجِزْ لِيْ مَا وَعَدْتَنِيْ، اللهم إِنِّيْ أَنْشُدُكَ عَهْدَكَ وَوَعْدَكَ)،
তারপর যখন উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল তখন তিনি এ প্রার্থনা করলেন।
(اللهم إِنْ تُهْلِكْ هٰذِهِ الْعِصَابَةَ الْيَوْمَ لَا تُعْبَدُ، اللهم إِنْ شِئْتَ لَمْ تُعْبَدْ بَعْدَ الْيَوْمِ أَبَدًا)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অত্যন্ত বিনয়ের সাথে প্রার্থনা করলেন এবং তিনি এমন আত্মভোলা হয়ে পড়লেন যে, তাঁর চাদরখানা তাঁর কাঁধ হতে পড়ে গেল। তখনও তিনি পূর্ববত তন্ময়ভাবে প্রার্থনায় নিমগ্ন থাকলেন। এ দৃশ্য দেখে ভক্ত প্রবর আবূ বাকর (রাঃ) দ্রুত ছুটে আসলেন এবং চাদরখানা দ্বারা তাঁর দেহ আচ্ছাদিত ক’রে তাকে আলিঙ্গন করে বলতে লগালেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ), যথেষ্ট হয়েছে। বড়ই কাতর কণ্ঠে আপনি প্রতিপালকের নিকট প্রার্থনা করেছেন। এ প্রার্থনা ব্যর্থ হবে না। শীঘ্রই তিনি নিজের ওয়াদা পূর্ণ করবেন।’ এদিকে আল্লাহ তা‘আলা ফিরিশতাদেরকে ওহী করলেন,
{أَنِّي مَعَكُمْ فَثَبِّتُوْا الَّذِيْنَ آمَنُوْا سَأُلْقِيْ فِيْ قُلُوْبِ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا الرَّعْبَ} [الأنفال: 12]
‘স্মরণ কর যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদের প্রতি ওয়াহী পাঠিয়েছিলেন, ‘আমি তোমাদের সঙ্গেই আছি; অতএব মু’মিনদেরকে তোমরা দৃঢ়পদ রেখ। অচিরেই আমি কাফিরদের দিলে ভীতি সঞ্চার করব।’ [আল-আনফাল (৮) : ১২]
আর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট আল্লাহ তা‘আলা ওহী পাঠালেন,
{أَنِّي مُمِدُّكُم بِأَلْفٍ مِّنَ الْمَلآئِكَةِ مُرْدِفِيْنَ} [الأنفال:9]
‘আমি তোমাদেরকে এক হাজার ফেরেশতা দিয়ে সাহায্য করব যারা পর পর আসবে।’ [আল-আনফাল (৮) : ৯]
ফুটনোটঃ
ফেরেশতাদের অবতরণ (نُزُوْلُ الْمَلَائِكَةِ):
এরপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে একটু তন্দ্রা আসলো। তারপর তিনি স্বীয় মস্তক মুবারক উঠিয়ে বললেন,
(أَبْشِرْ يَا أَبَا بَكْرٍ، هٰذَا جِبْرِيْلُ عَلٰى ثَنَايَاهُ النَّقْعُ)
‘আবূ বাকর (রাঃ) খুশী হও। ইনি জিবরাঈল, (আঃ) তার দেহ ধূলো বালিতে ভরপুর।’ ইবনু ইসহাক্বের বর্ণনায় রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,
(أَبْشِرْ يَا أَبَا بَكْرٍ، أَتَاكَ نَصْرُ اللهِ، هٰذَا جِبْرِيْلُ آخِذٌ بِعَنَانِ فَرْسِهِ يَقُوْدُهُ، وَعَلٰى ثَنَايَاهُ النَّقْعُ)
‘আবূ বাকর (রাঃ) আনন্দিত হও, তোমাদের কাছে আল্লাহর সাহায্য এসে গেছে। ইনি জিবরাঈল (আঃ), তিনি স্বীয় ঘোড়ার লাগাম ধরে ওর আগে আগে চলে আসছেন। তার দেহ ধূলোবালিতে পরিপূর্ণ রয়েছে।’
এরপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ছাউনির দরজা হতে বাইরে বেরিয়ে আসলেন। তিনি লৌহ বর্ম পরিহিত ছিলেন। পূর্ণ উত্তেজনার সাথে তিনি সামনে অগ্রসর হচ্ছিলেন এবং মুখে উচ্চারণ করছিলেন,
{سَيُهْزَمُ الْجَمْعُ وَيُوَلُّوْنَ الدُّبُرَ} [القمر:45]
‘‘এ সংঘবদ্ধ দল শীঘ্রই পরাজিত হবে আর পিছন ফিরে পালাবে।’ (আল-ক্বামার ৫৪ : ৪৫)
তারপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এক মুষ্টি পাথুরে মাটি নিলেন এবং কুরাইশদের দিকে মুখ করে বললেন, (شَاهَتِ الْوُجُوْهُ) ‘চেহারাগুলো বিকৃত হোক’’। আর একথা বলার সাথে সাথেই ঐ মাটি তাদের চেহারার দিকে নিক্ষেপ করলেন। তারপর মুশরিকদের মধ্যে এমন কেউই ছিল না যার চক্ষুদ্বয়ে, নাসারন্ধ্রে ও মুখে ঐ এক মুষ্টি মাটির কিছু না কিছু যায় নি। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
{وَمَا رَمَيْتَ إِذْ رَمَيْتَ وَلٰـكِنَّ اللهَ رَمَى} [الأنفال:17].
‘‘তুমি যখন নিক্ষেপ করছিলে তা তো তুমি নিক্ষেপ করনি, বরং আল্লাহই নিক্ষেপ করেছিলেন।’ (আল-আনফাল ৮ : ১৭)
ফুটনোটঃ
পাল্টা আক্রমণ (الهُجُوْمُ الْمَضَادِّ):
এরপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পাল্টা আক্রমণের নির্দেশ দেন এবং যুদ্ধের প্রতি উৎসাহ প্রদান করতে গিয়ে বলেন,
(وَالَّذِيْ نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ، لَا يُقَاتِلُهُمْ الْيَوْمَ رَجُلٌ فَيَقْتُلُ صَابِرًا مُحْتَسِبًا مُقْبِلًا غَيْرَ مُدْبِرٍ، إِلَّا أَدْخَلَهُ اللهُ الْجَنَّةَ)
‘‘তোমরা আক্রমণ চালাও। যাঁর হাতে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর প্রাণ রয়েছে সেই সত্ত্বার শপথ! এদের মধ্যে যে ব্যক্তি যুদ্ধে অটল থেকে যুদ্ধ করাকে সওয়াব বা পুণ্য মনে করে সম্মুখে অগ্রসর হয়ে পিছপা না হয়ে লড়াই করতে করতে মৃত্যুবরণ করবে আল্লাহ তাকে অবশ্য অবশ্যই জান্নাতে প্রবিষ্ট করাবেন।’
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যুদ্ধের জন্য উত্তেজিত ও উৎসাহিত করতে গিয়ে আরো বলেন,
(قُوْمُوْا إِلٰى جَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمٰوَاتُ وَالْأَرْضُ)،
‘‘তোমরা ঐ জান্নাতের দিকে উঠে যাও যার প্রস্থ আসমান ও যমীনের সমান।’
একথা শুনে উমায়ের ইবনু হাম্মাম (রাঃ) বললেন, ‘খুব ভাল! খুব ভাল! রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তখন তাঁকে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি এ কথা কেন বললে?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আমি আশা রাখি যে, আমিও ঐ জান্নাতীদের অন্তর্ভুক্ত হবো, এছাড়া অন্য কোন কথা নয়।’ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন ‘হ্যাঁ তুমিও ঐ জান্নাতবাসীদেরই অন্তর্ভুক্ত হবে।’ তারপর তিনি তার খাদ্য থলে হতে কিছু খেজুর বের করে খেতে লাগলেন। তারপর তিনি বললেন, ‘যদি আমি এ খেজুরগুলো খেয়ে শেষ করা পর্যন্ত জীবিত থাকি তবে এটাও তো দীর্ঘ জীবন হয়ে যাবে।’ সুতরাং তিনি তার কাছে যে খেজুরগুলো ছিল সেগুলো ফেলে দিলেন। তারপর মুশরিকদের সাথে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে গেলেন।
এভাবেই খ্যাতনামা মহিলা আফরার (রাঃ) পুত্র আউফ ইবনু হারিশ (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাদের কোন্ কাজে খুশী হয়ে হেসে থাকেন’’? উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘তিনি বান্দার ঐ কাজে খুশী হয়ে হেসে থাকেন যে, সে অনাবৃত দেহে (যুদ্ধে দেহ রক্ষক পোষাক পরিধান না করেই ) স্বীয় হাত শত্রুদের মধ্যে ডুবিয়ে দেয়’। একথা শুনে আউফ (রাঃ) দেহ হতে লৌহবর্ম খুলে নিয়ে নিক্ষেপ করলেন এবং তরবারী নিয়ে শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তারপর যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে গেলেন।[1]
যে সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পাল্টা আক্রমণের নির্দেশ দিয়েছিলেন তাতে শত্রুদের আক্রমণের প্রচন্ডতা হ্রাস পেয়েছিল এবং তাদের উত্তেজনা স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। এজন্য এ কৌশলপূর্ণ পরিকল্পনা মুসলিমদের অবস্থান দৃঢ় করতে খুবই ক্রিয়াশীল হয়েছিল, কেননা, সাহাবীগণ (রাঃ) যখন আক্রমণ করার দির্দেশ পেলেন তখন ছিল তাঁদের জিহাদের উত্তেজনার যৌবনকাল। তাই তাঁরা এক দুর্দমনীয় ও ফায়সালাকারী আক্রমণ পরিচালনা করলেন। তাঁরা শত্রুদের সারিগুলোকে তছনছ ও এলোমেলো করে দিয়ে তাদের গলা কেটে কেটে সামনে অগ্রসর হয়ে গেলেন। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বর্ম পরিহিত অবস্থায় লাফাতে লাফাতে আসতে দেখে এবং শ্রীঘ্রই তারা পরাজিত হবে ও পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পলায়ন করবে, একথা স্পষ্টভাবে বলতে শুনে তাঁদের উত্তেজনা আরো বৃদ্ধি পেলো। এ জন্যেই মুসলিমরা বীর বিক্রমে যু্দ্ধ করলেন এবং ফিরিশতারাও তাঁদেরকে সাহায্য করলেন। যেমন ইবনু সা’দের বর্ণনায় ইকরামা (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, ঐ দিন মানুষের মস্তক কেটে পড়ত, অথচ কে কেটেছে তা জানা যেত না এবং মানুষের হাত কর্তিত হয়ে পড়ে যেত, অথচ কে কর্তন করেছে তা জানা যেত না।
ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একজন মুসলিম একজন মুশরিককে তাড়া করছিলেন। হঠাৎ ঐ মুশরিকের উপর চাবুক মারার শব্দ শোনা গেল এবং একজন অশ্বারোহীর শব্দ শোনা গেল, যিনি বলছিলেন। ‘সম্মুখে অগ্রসর হও।’ মুসলিম মুশরিকটিকে তাঁর সামনে দেখলেন যে, সে চিৎ হয়ে পড়ে গেল, তিনি লাফ দিয়ে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখতে পেলেন যে, তার নাকের উপর আঘাতের চিহ্ন রয়েছে এবং অবয়র ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে যেন চাবুক দ্বারা আঘাত করা হয়েছে। ঐ আনসারী মুসলিম রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট এসে ঘটনাটি বর্ণনা করলেন। তখন তিনি বললেন, ‘তুমি সত্য কথা বলেছো। এটা ছিল তৃতীয় আসমানের সাহায্য।’’[2]
আবূ দাউদ মাযেনী বলেন, ‘আমি একজন মুশরিককে মারার জন্যে তাড়াতাড়ি করছিলাম। অকস্মাৎ তার মস্তকটি, আমার তরবারী ওর উপর পৌঁছার পূর্বে কেটে পড়ে যায়। আমি তখন বুঝতে পারলাম যে, তাকে আমি নই, বরং অন্য কেউ হত্যা করেছে।’
একজন আনসারী আব্বাস ইবনু আব্দুল মুত্তালিবকে বন্দী করে নিয়ে আসেন। তখন আব্বাস (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর শপথ! আমাকে এ ব্যক্তি বন্দী করেনি। একজন চুলবিহীন মাথাওয়ালা লোক যিনি দেখতে অত্যন্ত সুন্দর এবং একটি বিচিত্র বর্ণের ঘোড়ার উপর সওয়ার ছিলেন তিনি আমাকে বন্দী করেছিলেন। তাকে এখন আমি লোকজনদের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি না।’ আনসারী বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! তাকে আমি বন্দী করেছি।’
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, (اُسْكُتْ فَقَدْ أَيَّدَكَ اللهُ بِمَلَكٍ كَرِيْمٍ)
‘‘চুপ করো, আল্লাহ এক সম্মানিত ফিরিশতা দ্বারা তোমাকে সাহায্য করেছেন।’
‘আলী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে এবং আবূ বাকরকে বললেন, তোমাদের একজনের সাথে জিবরীল এবং আরেকজনের সাথে মিকাঈল ও ইসরাফীল (আঃ) যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। অথবা যুদ্ধক্ষেত্রে ছিলেন।
ফুটনোটঃ[1] মুসলিম শরীফ ২/১৩৯ পৃঃ, মিশকাত ২/৩৩১ পৃঃ।
[2] মুসলিম শরীফ ২/৯৩ পৃঃ।
ময়দান হতে ইবলীসের পলায়ন (إِبْلِيْسُ يَنْسَحِبُ عَنْ مَيْدَانِ الْقِتَالِ):
যেমনটি আমরা বলে এসেছি, অভিশপ্ত ইবলিস সুরাক্বাহ বিন মালিক বিন জুশুম মুদলিজীর সুরতে এসেছিল এবং এতক্ষণ পর্যন্তও সে মুশরিকগণ হতে পৃথক হয় নি। কিন্তু যখন সে মুশরিকদের বিরুদ্ধে ফিরিশতাগণের ভূমিকা প্রত্যক্ষ করল তখন সে পিছনে ফিরে পলায়ন করতে থাকল। কিন্তু হারিস বিন হিশাম তাকে আটকে রাখল। তার বিশ্বাস যে, সে প্রকৃতই সুরাক্বাহ। কিন্তু ইবলীস তার বুকে এত জোরে ঘুষি মারল যে, সে মাটিতে পড়ে গেল। ইত্যবসরে ইবলিস সেখান থেকে পলায়ন করল। মুশরিকগণ বলতে লাগল, ‘সুরাক্বাহ কোথায় যাচ্ছ? তুমি কি বল নি যে, তুমি আমাদের সাহায্য করবে এবং কখনই আমাদের থেকে পৃথক হবে না?’
একথা শোনার পর ইবলীস বলল, {إِنِّي أَرٰى مَا لاَ تَرَوْنَ إِنِّيَ أَخَافُ اللهَ وَاللهُ شَدِيْدُ الْعِقَابِ} [الأنفال:48]
‘‘আমি যা দেখছি, তোমরা তা দেখছনা। আল্লাহকে আমার ভীষণ ভয় হচ্ছে। তিনি কঠিন শাস্তির মালিক।’ (আল-আনফাল ৮ : ৪৮)
এরপর পলায়ন করে সে সমুদ্রের ভিতরে যেতে থাকল।
ফুটনোটঃ
সাংঘাতিক পরাজয় (الهَزِيْمَةُ السَّاحِقَةِ):
অল্পক্ষণের মধ্যেই মুশরিকগণের সৈন্য বাহিনীতে অকৃতকার্যতা ও দুর্ভাবনার বিভিন্ন লক্ষণ পরিষ্ফুট হয়ে উঠল। মুসলিমদের কঠিন এবং অবিরাম আক্রমণের নির্ধারণের নিকটবর্তী হয়ে আসতে থাকল। এমনকি তারা দৌঁড় দিয়ে পিছু হটতে লাগল। এ সুযোগে মুসলিম বাহিনী তাদের হত্যা, জখম ও বন্দী করতে করতে পিছু পিছু ধাওয়া করে চলল। এমনকি দেখতে দেখতে কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা সম্পূর্ণরূপে পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হল।
ফুটনোটঃ
আবূ জাহলের হঠকারিতা (صُمُوْدُ أَبِيْ جَهْلٍ):
কিন্তু বড় তাগুত আবূ জাহল যখন নিজ সারির সৈন্যদলের মধ্যে বিশৃঙ্খল অবস্থা প্রত্যক্ষ করল তখনও সে নিজ অবস্থানে সুদৃঢ় থাকার মনস্থ করল। কাজেই সে নিজ দলের সৈন্যগণকে উচ্চ কণ্ঠে এবং আত্মম্ভরিতার সঙ্গে বলতে থাকল যে, ‘যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সুরাক্বাহর সরে পড়ার কারণে তোমরা মনোবল হারিও না যেন, কারণ সে পূর্ব হতেই মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। ‘উতবাহ, শায়বাহ এবং ওয়ালীদের হত্যার কারণেও তোমাদের ভীত হওয়ার কোন কারণ নেই। তাড়াহুড়োর মধ্যে কাজ করতে গিয়েই তাদের এ অবস্থা হয়েছে। লাত ও উযযার শপথ! তাদেরকে রশি দ্বারা শক্ত করে বেঁধে না ফেলা পর্যন্ত আমরা প্রত্যাবর্তন করব না। দেখ, তোমাদের কোন ব্যক্তি তাদের কাউকেও যেন হত্যা না করে। আমরা যেন তাদেরকে অন্যায়ের শাস্তি দিতে পারি এ উদ্দেশ্যে তাদেরকে ধর এবং বন্দী কর।’
কিন্তু তার এ অসার অহমিকার প্রতিফল শীঘ্রই তাকে অনুধাবন করতে হল। কারণ মুহূর্তের মধ্যেই মুসলিমদের পক্ষ থেকে পাল্টা আক্রমণ শুরু হয়ে গেল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলল। কিন্তু আবূ জাহল তার চতুষ্পাশের একদল জনতাকে বেশ সংঘবদ্ধ অবস্থাতেই রেখেছিল। এ জনতা তার চতুর্দিকে তরবারীর প্লাবন ও বর্শার জঙ্গল সৃষ্টি করে রেখেছিল। কিন্তু ইসলামী জনতার প্রলয়ঙ্করী তুফান তার তরবারীর প্লাবন এবং বর্শার জঙ্গলকে একদম তছনছ করে ফেলল। তারপর এ বড় তান্ডত মর্দে মু’মিনদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে এসে গেল। মুসলিম সৈন্যরা দেখতে পেলেন যে, সে এক ঘোড়ার পিঠে চড়ে চক্কর দিয়ে বেড়াচ্ছে। এদিকে আনসারী যুবকের হাতে তার মৃত্যু রক্ত চুষে নেয়ার অপেক্ষায় ছিল।
ফুটনোটঃ
আবূ জাহলের হত্যা (مَصْرَعُ أَبِيْ جَهْلٍ):
আব্দুর রহমান বিন আওফ হতে বর্ণিত আছে যে, ‘বদরের যুদ্ধের দিন আমি সৈন্যদের সারিতে ছিলাম। এমতাবস্থায় হঠাৎ ডানে এবং বামে অল্প বয়স্ক দুজন যুবককে দেখতে পেলাম। তাদের উপস্থিতিতে আমি নিজেকে নিরাপদ মনে করতে পারলাম না। এমন অবস্থায় ওদের একজন তার সঙ্গীকে এড়িয়ে আমার কাছে এসে বলল। ‘চাচাজান আবূ জাহল কোনটি, আমাকে দেখিয়ে দিন।’
আমি বললাম, ‘ভাতিজা, তাকে তোমার কী প্রয়োজন।’ সে বলল, ‘আমাকে বলা হয়েছে যে, সে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে মন্দ বলেছে। সেই সত্ত্বার কসম! যার হাতে রয়েছে আমার জীবন, যদি আমি তাকে দেখতে পাই তাহলে যতক্ষণ আমাদের মধ্যে যার মৃত্যু পূর্বে অবধারিত হয়েছে সে মৃত্যুবরণ না করবে ততক্ষণ আমার অস্তিত্ব তার অস্তিত্ব থেকে পৃথক হবে না।’
তিনি বলেছেন যে, ‘আমি তার এ কথায় একদম অভিভূত হয়ে পড়লাম।’
তিনি আরও বলেছেন যে, ‘দ্বিতীয় জনও এসে ইঙ্গিতে আমাকে ঐ একই কথাই বলল। তারপর আমি প্রত্যক্ষ করলাম যে, আবূ জাহল লোকজনদের মাঝে চক্কর দিয়ে বেড়াচ্ছে। আমি তাদের উদ্দেশ্যে বললাম আরে দেখছ না, ঐ যে, তোমাদের শিকার যার সম্পর্কে তোমরা আমাকে জিজ্ঞাসা করছিলে।’
তিনি বর্ণনা করেছেন যে, ‘এ কথা শোনা মাত্র তারা উভয়ে তরবারী নিয়ে লাফ দিয়ে এগিয়ে চলল এবং সেই কুখ্যাত নরাধমকে হত্যা করে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট প্রত্যাবর্তন করল।’
নাবী কারীম (সাঃ) বললেন, ‘তোমাদের উভয়ের মধ্যে কে তাকে হত্যা করেছ?’
তারা উভয়েই বলল, ‘আমি হত্যা করেছি।’
নাবী কারীম (সাঃ) পুনরায় বললেন, ‘তোমরা কি নিজ নিজ তরবারী মুছে ফেলেছ?’
তারা বলল, ‘না’’।
তারপর নাবী কারীম (সাঃ) উভয়ের তরবারী দেখলেন এবং বললেন, ‘তোমরা উভয়েই তাকে হত্যা করেছ।’
অবশ্য আবূ জাহলের সামান অর্থাৎ জিনিসপত্রগুলো তিনি মু’আয বিন ‘আমর বিন জামুহকে প্রদান করেন। আবূ জাহলের এ দু’হত্যাকারীর নাম হল, (১) মু’আয বিন ‘আমর বিন জামুহ এবং (২) মু’আয বিন আফরা-।[1]
ইবনে ইসহাক্ব বর্ণনা করেছেন যে, মু’আয বিন ‘আমর বিন জামুহ বলেছেন, ‘আমি মুশরিকদিগকে আবূ জাহল সম্পর্কে বলতে শুনলাম যে, সে ঘন গাছগুলোর মতো বর্শা ও তরবারীর ভিড়ের মধ্যে ছিল। তারা একথাও বলছিল যে, আবুল হাকাম পর্যন্ত কেউ পৌঁছতে পারবে না।’
মু’আয বিন ‘আমর আরও বলেছেন যে, ‘যখন আমি একথা শুনলাম তখন তাকে আমার লক্ষ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে নিলাম এবং তার প্রতি মনোযোগ নিবদ্ধ করে রাখলাম। তারপর যখন সুযোগ পেয়ে গেলাম তখনই আক্রমণ করে বসলাম এবং এমনভাবে আঘাত করলাম যে, তার পা দ্বিখন্ডিত হয়ে খুলে পড়ে গেল। আল্লাহর কসম! যখন তার পায়ের অর্ধাংশ খুলে পড়ে গেল তখন আমি তার সাদৃশ্য শুধু ঐ ফলের বীচি দ্বারা বর্ণনা করতে পারি যা হাতুড়ির সাহায্যে আলগা করা হয় এবং এর এক অংশ থেকে অন্য অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
তিনি আরও বর্ণনা করেছেন যে, ‘এদিকে আমি যখন আবূ জাহলকে আঘাত করলাম অন্য দিকে তখন তার ছেলে ইকরামা আমার কাঁধে তরবারীর আঘাত করল এবং তাতে আমার হাত কেটে গিয়ে চামড়ার সঙ্গে ঝুলে গেল এবং যুদ্ধের জন্য প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াল। আমি সেটি পিছনে টেনে নিয়ে সাধারণভাবে যুদ্ধ করতে থাকলাম। কিন্তু সে যখন আমাকে খুবই কষ্ট দিতে লাগল তখন আমি তার উপর আমার পা রেখে জোরে টান দিয়ে তাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললাম।[2]
এরপর আবূ জাহলের নিকট পৌঁছে যান মু’আয বিন আফরা। তিনি তাকে এত জোরে আঘাত করেন যে, তার ফলে সে সেখানেই স্ত্তপে পরিণত হয়ে যায়। সে সময় শুধু তার শ্বাস-প্রশ্বাসটুকু অবশিষ্ট ছিল। এরপর মু’আয বিন আফরা যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে যান।
যখন যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘কে আছ এমন যে, দেখে আসবে আবূ জাহলের অবস্থা কি হল। এ কথা শুনে সাহাবীগণ (রাঃ) তার খোঁজে বিক্ষিপ্তভাবে নানাদিকে চলে গেলেন। আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) তাকে এমন অবস্থায় পেলেন যে, তখনো তার শ্বাস-প্রশ্বাস যাওয়া আসা করছিল। তিনি তার গ্রীবার উপর পা রেখে মাথা কেটে নেয়ার জন্য দাড়ি ধরলেন এবং বললেন, ‘ওহে আল্লাহর শত্রু! শেষে আল্লাহ তোমাকে এভাবে অপমানিত করলেন? সে বলল, ‘আমাকে কী প্রকারে লাঞ্ছিত করলেন?’ যে ব্যক্তিকে তোমরা হত্যা করছো তার চেয়ে উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন লোক কেউ আছে কি? অথবা যে লোকটিকে তোমরা হত্যা করছো তার চেয়ে উঁচু সম্মানের কোন লোক আছে কি?’ তারপর সে বলল, ‘যদি আমাকে কৃষকরা ছাড়া অন্য কেউ হত্যা করত তবে কতই না ভাল হতো!’ তারপর সে বলল, ‘আচ্ছা, আমাকে বলত আজ বিজয় লাভ কার হয়েছে?’ আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) উত্তরে বললেন, ‘আল্লাহ এবং তার রাসূল (সাঃ)-এর।’ তারপর সে আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ)-কে বলল- যিনি তার গ্রীবার উপর পা রেখেছিলেন- হে বকরীর রাখাল! তুমি বড় উঁচু ও কঠিন জায়গায় চড়ে গিয়েছো। প্রকাশ থাকে যে, আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) মক্কায় বকরী চরাতেন।
এ কথোপকথনের পর আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) তার মস্তক কেটে নিলেন এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর খিদমতে নিয়ে গিয়ে হাজির করে দিলেন এবং আরয করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এটা আল্লাহর শত্রু আবূ জাহলের মস্তক।’ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তিনবার বলেলেন,
(اللهُ الَّذِيْ لَا إِلٰهَ إِلَّا هُوَ؟)
‘‘সত্যিই, ঐ আল্লাহর শপথ যিনি ছাড়া অন্য কোন মা’বূদ নেই।’ তারপর বললেন,
(اللهُ أَكْبَرُ، الحَمْدُ لِلهِ الَّذِيْ صَدَقَ وَعْدَهُ، وَنَصَرَ عَبْدَهُ، وَهَزَمَ الْأَحْزَابَ وَحْدَهُ، اِنْطَلَقَ أُرْنِيَهُ)
অর্থঃ আল্লাহ সবচেয়ে মহান। ঐ আল্লাহর সমুদয় প্রশংসা যিনি তাঁর ওয়াদাকে সত্য প্রমাণিত করেছেন। স্বীয় বান্দাকে সাহায্য করেছেন এবং একাই সমস্ত দলকে পরাজিত করেছেন।’
এরপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘চলো আমাকে তার মৃত দেহ দেখাও।’ (আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, ‘আমি তাঁকে নিয়ে গিয়ে তার মৃতদেহ দেখালাম। তিনি বললেন, ‘ঐ ব্যক্তি এ উম্মতের ফিরাউন।’
ফুটনোটঃ[1] সহীহুল বুখারী ১/৪৪৪ পৃঃ, ২/৫৬৮ পৃঃ, মিশকাত ২/৩৫২ পৃঃ, অন্য বর্ণনায় দ্বিতীয় নাম মোআওয়ায বিন আফরা বলা হয়েছে। ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৬৩৫ পৃঃ, আবূ জাহলের জিনিসপত্র এক জনকে এ কারণে দেয়া হয়েছিল যে, পরে মু’আয (মুআওয়ায) সেই যুদ্ধেই শহীদ হয়েছিলেন। তবে আবূ জাহলের তরবারী আব্দুল্লাহ বিন মাসউদকে দেয়া হয়েছিল। কারণ, সেই তার মাথা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিলেন। দ্রঃ সুনানে আবূ দাউদ, বাবু মান আজাযা আলা জীবীহিন ২য় খন্ড ৩৭৩ পৃঃ।
[2] মু’আয বিন আমর বিন জামুহ উসমান (রাঃ)-এর খিলাফত পর্যন্ত জীবিত ছিলেন।
ঈমানের উজ্জ্বলতায় গৌরবোজ্জ্বল চিত্রাবলী (مِنْ رَوَائِعِ الْإِيْمَانِ فِيْ هٰذِهِ الْمَعْرِكَةِ):
উমায়ের ইবনু হাম্মাম (রাঃ) এবং আউফ ইবনু হারিস ইবনু আফরা’র (রাঃ) ঈমান দীপ্ত চরিত কথার বিষয়াবলী ইতোপূর্বে বর্ণিত হয়েছে। প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে এ যুদ্ধে পদে পদে এমন সব দৃশ্য দৃষ্টিগোচর হয়েছে যেগুলোতে ঈমানী শক্তি ও মৌলিক নীতিমালার পরিপক্কতা সুস্পষ্ট ও সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। এ যুদ্ধে পিতা ও পুত্র এবং ভাই ও ভাইয়ের মধ্যে দল বিভাগ বা শ্রেণীবিন্যাস হয়েছে, আর মূল নীতির ব্যাপারে মতানৈক্যের কারণে তরবারী কোষমুক্ত হয়েছে। এভাবে অত্যাচারিত ব্যক্তিও অত্যাচারীর উপর আঘাত হেনে ক্রোধাগ্নি প্রশমিত করেছে। পরবর্তী আলোচানা থেকে এর যথার্থতা প্রমাণিত হবে।
১. ইবনু ইসহাক্ব ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, নাবী কারীম (সাঃ) সাহাবীগণ (রাঃ)-কে বলেন,
(إِنِّيْ قَدْ عَرَفْتُ أَنَّ رَجُالًا مِنْ بَنِيْ هَاشِمٍ وَغَيْرِهِمْ قَدْ أَخْرَجُوْا كُرْهًا، لَا حَاجَةَ لَهُمْ بِقِتَالِنَا، فَمَنْ لَقِىْ أَحَدًا مِنْ بَنِيْ هَاشِمٍ فَلَا يَقْتُلْهُ، وَمَنْ لَقِىَ أَبَا الْبَخْتَرِيِّ بْنِ هِشَامٍ فَلَا يَقْتُلْهُ، وَمَنْ لَقِىْ الْعَبَّاسَبْنَ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ فَلَا يَقْتُلْهُ، فَإِنَّهُ إِنَّمَا أُخْرِجَ مُسْتَكْرَهًا)
‘আমি জানি যে, বনু হাশিম এবং আরও কোন কোন গোত্রের কতগুলো লোককে জোর করে যুদ্ধ ক্ষেত্রে আনয়ন করা হয়েছে। আমাদের যুদ্ধের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। সুতরাং বনু হাশিমের কোন লোক কারো তরবারীর সামনে পড়ে গেলে সে যেন তাকে হত্যা না করে। আবুল বাখতারী বিন হিশাম কারো সামনে এসে পড়লে তাকে যেন সে হত্যা না করে। আর আব্বাস ইবনু আব্দুল মুত্তালিব কারো সামনে পড়ে গেলে তাকেও যেন হত্যা করা না হয়। কেননা তাকে জোর করে এ যুদ্ধে নিয়ে আসা হয়েছে।’
এ কথা শুনে ‘উতবাহর পুত্র আবূ হুযাইফা (রাঃ) বললেন, ‘আমরা কি আমাদের পিতা, পুত্র, ভ্রাতা ও আত্মীয়স্বজনকে হত্যা করব, আর আব্বাস (রাঃ)-কে ছেড়ে দিব? আল্লাহর কসম! যদি তিনি আমার সামনে পড়ে যান তবে আমি তাকে তরবারীর লাগাম পরিয়ে দিব। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট এ খবর পৌঁছলে তিনি উমার ইবনু খাত্তাব (রাঃ)-কে বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর চাচার চেহারার উপর কি তরবারীর আঘাত করা হবে?’ উত্তরে উমার (রাঃ) বলেন, ‘আমাকে ছেড়ে দিন, আমি তরবারী দ্বারা এ ব্যক্তির গর্দান উড়িয়ে দেই। কেননা, এ ব্যক্তি মুনাফিক্ব হয়ে গেছে।’
পরবর্তীকালে আবূ হুযাইফা (রাঃ) বলতেন, ‘ঐ দিন আমি যে কথা বলে ফেলেছিলাম তার কারণে আমি কোন সময় মনে শান্তি পাই না। এ ব্যাপারে বরাবরই আমার মনে ভয় থেকে যায়। এটা হতে মুক্ত হওয়ার একটি মাত্র উপায় হলো আমার শাহাদতের মাধ্যমে এর কাফ্ফারা হয়ে যাওয়া।’ অবশেষে ইয়ামামার যুদ্ধে তিনি শহীদ হয়ে যান।
২. আবুল বাখতারীকে হত্যা করতে নিষেধ করার কারণ ছিল এ ব্যক্তি মক্কায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে কষ্ট দেয়া হতে সবচেয়ে বেশী বিরত থেকে ছিল। সে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে কোন প্রকারের কষ্ট দিত না এবং তার পক্ষ হতে তিনি কখনো কোন অপছন্দনীয় কথা শোনেননি। আর এ ব্যক্তি ঐ লোকদের একজন ছিল যারা বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিবের বয়কট পত্রটি ছিঁড়ে ফেলেছিল।
কিন্তু তা সত্ত্বেও আবুল বাখতারী শেষে নিহতই হয়েছিল। ঘটনাটি হল মুজাযযার ইবনু যিয়াদ বালাভী (রাঃ)-এর সাথে তার লড়াই হয়। তার সাথে তার অন্য এক সঙ্গীও ছিল। দুজন এক সাথে যুদ্ধ করছিল। মুজাযযার (রাঃ) তাকে বলেন, ‘হে আবুল বাখতারী! আপনাকে হত্যা করতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাদেরকে নিষেধ করেছেন।’ সে বলে ‘আমার সাথীকেও কি?’ মুজাযযার (রাঃ) উত্তরে বলেন, ‘না, আল্লাহর কসম! আপনার সাথীকে আমরা ছেড়ে দিতে পারি না।’ সে তখন বলল, ‘আল্লাহর কসম! তাহলে আমি এবং সে দুজনই মরবো।’ এরপর দুজনই যুদ্ধ শুরু করে দেয়। মুজাযযার (রাঃ) বাধ্য হয়ে তাকেও হত্যা করেন।
৩. মক্কায় জাহেলিয়াত যুগে আব্দুর রহমান ইবনু আউফ (রাঃ) ও উমাইয়া ইবনু খালফের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধুত্ব ছিল। বদর যুদ্ধের দিন উমাইয়া ইবনু খালফ তার ছেলে আলীর হাত ধরে দাঁড়িয়েছিল। এমন সময় আব্দুর রহমান ইবনু আউফ (রাঃ) সেখান দিয়ে গমন করেন। তিনি শত্রুর নিকট হতে কিছু লৌহ বর্ম ছিনিয়ে নিয়ে তা উটের পিঠে বোঝাই করে নিয়ে যাচ্ছিলেন। উমাইয়া তাঁকে দেখে বলে, ‘তুমি আমার কোন প্রয়োজন বোধ কর কি? আমি তোমার এ লৌহ বর্মগুলো হতে উত্তম। আজকের মতো দৃশ্য আমি কোন দিন দেখিনি। তোমার দুধের কি প্রয়োজন নেই।’ সে একথা দ্বারা বুঝাতে চেয়েছিল যে, আমাকে বন্দী করবে তাকে মুক্তি পণ হিসেবে বহু দুগ্ধবতী উট প্রদান করব।’
তার এ কথা শুনে আব্দুর রহমান ইবনু আউফ (রাঃ) লৌহবর্মগুলো ফেলে দিয়ে পিতা-পুত্র দুজনকে গ্রেফতার করে সামনে অগ্রসর হলেন।
আব্দুর রহমান (রাঃ) বলেন, ‘আমি উমাইয়া এবং তার পুত্রের মাঝে হয়ে চলছিলাম এমতাবস্থায় উমাইয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি কে ছিল যে তার বক্ষে উটপাখির পালক লাগিয়ে রেখে ছিল।’ আমি উত্তরে বললাম উনি ছিলেন হামযাহ ইবনু আব্দুল মুত্তালিব (রাঃ)। সে তখন বলল এ সেই ব্যক্তি যে আমাদের মধ্যে ধ্বংস রচনা করে রেখেছিল।’
আব্দুর রহমান (রাঃ) বলেন, আল্লাহর শপথ! আমি দুজনকে নিয়ে চলছিলাম অকস্মাৎ বিলাল (রাঃ) উমাইয়াকে আমার সাথে চলতে দেখে নেন। এটা স্মরণ রাখার বিষয় যে, এ উমাইয়া মক্কায় বিলাল (রাঃ)-এর উপর অমানুষিক উৎপীড়ন করেছিল। বিলাল (রাঃ) বললেন, ‘এ হচ্ছে কাফিরদের নেতা উমাইয়া ইবনু খালফ । হয় আমি বাঁচবো না হয় সে বাঁচবে। আমি বললাম, হে বিলাল (রাঃ) এটা হচ্ছে আমার বন্দী। তিনি আবার বললেন, এখন দুনিয়াতে হয় আমি থাকবো, না হয় সে থাকবে।’ তারপর তিনি অত্যন্ত উচ্চৈঃস্বরে ডাক দিয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহর আনসারগণ! এ হচ্ছে কুফর নেতা উমাইয়া ইবনু খালফ। এখন হয় আমি থাকবো, অথবা সে থাকবে। আব্দুর রহমান (রাঃ) বললেন, ‘ইতোমধ্যে জনগণ আমাদেরকে কংকণের মতো বেষ্টনীর মধ্যে নিয়ে নিল। আমি তাকে বাঁচাবার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু একটি লোক তার পুত্রের পায়ে তরবারীর আঘাত হেনে দিলো। আর সাথে সাথে সে পড়ে গেল। ও দিকে উমাইয়া এত জোরে চিৎকার করল যে, এরূপ চিৎকার আমি কখনই শুনিনি। আমি বললাম, ‘পালিয়ে যাও। কিন্তু আজ পালাবার কোন উপায় নেই। আল্লাহর কসম! আজ আমি তোমার কোন উপকার করতে পারবো না।’ আব্দুর রহমান (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, জনগণ তরবারী দ্বারা তাদের দুজনকে কেটে ফেলে তাদের জীবন লীলা শেষ করে দেয়। এরপর আব্দুর রহমান (রাঃ) বলতেন, ‘আল্লাহ বিলালের উপর রহম করুন। আমার লৌহবর্মও গেল এবং আমার বন্দীর ব্যাপারে আমাকে ব্যাকুলও হতে হলো।’
ইমাম বুখারী (রহ.) আব্দুর রহমান বিন ‘আওফ থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, উমাইয়াহ বিন খালফ এ মর্মে আমার সাথে একটি চুক্তিপত্র লিখেছিল যে, সে মক্কায় আমার পরিবার-পরিজনকে হেফাজত করবে আর আমি মদীনায় তার পরিবার-পরিজনকে হেফাজত করবো। অতঃপর বদর যুদ্ধের দিন মানুষেরা ঘুমিয়ে পড়ার পর পাহাড়ের দিকে গেলাম তাকে হেফাজ করার জন্য। কিন্তু পথিমধ্যে বিলাল দেখে ফেলে। অতঃপর আনসারদের দলে গিয়ে এ বলে ঘোষণা দেয় যে,হয় আমি মরব, অথবা উমাইয়া বিন খালাফ মরবে। এরপর বিলালের সাথে আনসারদের এক দল যোদ্ধা আমাদেরকে নিকেট আসতে থাকে। আমি যখন এ আশঙ্কা করলাম যে লোকেরা আমাদের ধরে ফেলবে তখন আমি উমাইয়ার ছেলেকে আমার পেছনে নিয়ে নিলাম যাতে তারা তাকে হত্যা করতে না পারে। কিন্তু লোকেরা তাকে হত্যা করে ফেলল। আর তার পিতার শরীর খুব ভারী ছিল। লোকেরা আমার কাছে পৌছলে আমি উমাইয়া ইবনু খালফকে বললাম, ‘তুমি হাঁটুর ভরে বসে পড়।’ সে বসে গেল এবং আমি তার উপর চড়ে বসলেন। কিন্তু লোকেরা নীচ দিয়ে তরবারী মেরে উমাইয়াকে হত্যা করল।
কোন একটি তরবারীর আঘাতে আব্দুর রহমান ইবনু আউফ (রাঃ)-এর পা আহত হয়েছিল।[1] আবদুর রহমান পরবর্তীতে তার পায়ের সেই আঘাতের চিহ্ন দেখিয়েছেন।
৪. উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) তার মামা আস ইবনু হিশাম ইবনু মুগীরাহকে হত্যা করেন। সেদিন আত্মীয় সম্পর্কের প্রতি ভ্রুক্ষেপই করেন নি। কিন্তু মদীনায় ফিরে আসার পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)’র চাচা ‘আব্বাসকে বললেন, (সে সময় ‘আব্বাস বন্দী ছিলেন) হে ‘আব্বাস! আপনি ইসলাম গ্রহণ করুন। আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমার পিতা খাত্তাব ইসলাম গ্রহণের চেয়ে আপনার ইসলাম গ্রহণটা অধিক প্রিয়। অধিকন্তু আপনার ইসলাম গ্রহণের ফলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যার পরই না খুশি হতেন।
৫. আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ) স্বীয় পুত্র আব্দুর রহমানকে ডাক দিয়ে বলেছিলেন যখন সে মুশরিকদের পক্ষে যুদ্ধ করেছিল ‘ওরে দুরাচার আমার মাল কোথায়’’? আব্দুর রহমান উত্তরে বলেছিল :
لَمْ يَبْقَ غَيْرُ شَكَّةٍ ويَعْبُوْب ** وصَارِمٍ يَقْتُلُ ضُلاَّل الشِّيَبْ
অর্থাৎ অস্ত্র, শস্ত্র, দ্রুতগামী অশ্ব এবং ঐ তরবারী ছাড়া কিছুই বাকী নেই যা বার্ধক্যের ভ্রষ্টতার সমাপ্তি ঘটিয়ে থাকে।
৬. যখন মুসলিমরা মুশরিকদেরকে গ্রেফতার করতে শুরু করেন তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ছাউনীর মধ্যে অবস্থান করছিলেন এবং সা‘দ ইবনু মু’আয (রাঃ) তরবারী হাতে দরজার উপর পাহারা দিচ্ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) লক্ষ্য করলেন যে, সা‘দ (রাঃ)-এর চেহারায় মুসলিমদের এ কার্যকলাপ অপছন্দনীয় হওয়ার লক্ষণ প্রকাশিত হচ্ছে। তাই, তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে সা‘দ (রাঃ), আল্লাহর কসম! বুঝা যাচেছ যে, মুসলিমদের এ কার্যকলাপ তোমার পছন্দ হচ্ছে না, তাই নয় কি? সা‘দ (রাঃ) উত্তরে বললেন, ‘জ্বী হ্যাঁ’’, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! তিনি বললেন, ‘আল্লাহর কসম! মুশরিকদের সাথে এটাই প্রথম যুদ্ধ, যার সুযোগ আল্লাহ তা‘আলা আমাদের দান করেছেন। সুতরাং মুশরিকদেরকে ছেড়ে দেয়ার পরিবর্তে অধিক সংখ্যায় হত্যা করে ফেলাই আমার নিকট বেশী পছন্দনীয়।’
৭. এ যুদ্ধে উকাশাহ ইবনু মুহসিন আসাদী (রাঃ)-এর তরবারী ভেঙ্গে যায়। তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর খিদমতে হাযির হলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে কাঠের একটা ভাঙ্গা থাম্বা প্রদান করেন এবং বলেন ‘উকাশাহ (রাঃ) তুমি এটা দ্বারাই যুদ্ধ কর’। উকাশাহ (রাঃ) ওটা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট হতে নিয়ে নড়ানো মাত্রই একটা লম্বা, শক্ত সাদা চকচকে তরবারীতে পরিবর্তিত হয়। তারপর তিনি ওটা দ্বারাই যুদ্ধ করেন এবং শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমগণকে বিজয় দান করেন। ঐ তরবারীখানা স্থায়ীভাবে উকাশাহ (রাঃ)-এর কাছেই থাকে এবং তিনি ওটাকে বিভিন্ন যুদ্ধে ব্যবহার করেন। অবশেষে আবূ বাকর (রাঃ)-এর খিলাফতকালে ধর্মত্যাগীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে তিনি শহীদ হন। ঐ সময়েও ঐ তরবারীটি তার কাছেই ছিল।
৮. যুদ্ধ শেষে মুসআ’ব ইবনু উমায়ের আবদারী (রাঃ) তার ভাই আবূ উযায়ের ইবনু উমায়ের আবদারীর পার্শ্ব দিয়ে গমন করেন। আবূ উযায়ের মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল এবং ঐ সময় একজন আনসারী সাহাবী তাঁর হাত বাঁধছিলেন। মুসআব (রাঃ) ঐ আনসারীকে বললেন ‘এ ব্যক্তির মাধ্যমে আপনি আপনার হাতকে দৃঢ় করুন। এর মা খুবই ধনবতী মহিলা। অবশ্যই সে আপনাকে উত্তম মুক্তিপণ দিবে।’ একথা শুনে আবূ উযায়ের তার ভাই মুসআ’ব (রাঃ)-কে বলল, ‘আমার ব্যাপারে তোমার উপদেশ এটাই?’ মুসআ’ব (রাঃ) উত্তরে বললেন, ‘হ্যাঁ, তোমার পরিবর্তে এ আনসারই আমার ভাই।’
৯. মুশরিকদের মৃতদেহগুলোকে যখন কূপে নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেয়া হলো এবং ‘উতবাহ ইবনু রাবীআহকে কূপের দিকে হেঁচড়িয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হলো তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার পুত্র আবূ হুযাইফা (রাঃ)-এর চেহারার প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন। তখন দেখলেন যে, তিনি দুঃখিত হয়েছেন এবং তার চেহারা পরিবর্তিত হয়েছে। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আবূ হুযাইফাহ, নিশ্চয়ই তোমার পিতার এ অবস্থা দেখে তোমার অন্তরে কিছু অনুভূতি জেগেছে, তাই না?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আল্লাহর শপথ! আমার পিতার ব্যাপারে এবং তার হত্যার ব্যাপারে আমার অন্তরে একটুও শিহরণ উঠেনি। তবে অবশ্যই আমার পিতা সম্পর্কে আমি জানতাম যে, তার মধ্যে বিবেক, বুদ্ধি, দূরদর্শিতা ও ভদ্রতা রয়েছে। এ জন্য আমি আশা করতাম যে, এ গুণাবলী তাকে ইসলাম পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিবে। কিন্তু এখন তার পরিণাম দেখে এবং আমার আশার বিপরীত কুফরের উপর তার জীবনের সমাপ্তি দেখে আমি দুঃখিত হয়েছি। তাঁর এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর মঙ্গলের জন্যে দুআ করলেন এবং তার সাথে উত্তমরূপে বাক্যালাপ করলেন।
ফুটনোটঃ[1] যা’দুল মায়া’দ ২য় খন্ড ৮৯ পৃঃ। সহীহুল বুখারীর ১ম খন্ড ১০৮ পৃঃ। কিতাবুল অকালাহ এর মধ্যে এ ঘটনাটি কিছু বেশী আংশিক ব্যাখ্যা সহ বর্ণিত হয়েছে।
উভয় দলের নিহত ব্যক্তিবর্গ (قَتْلَى الْفَرِيْقَيْنِ):
এ যুদ্ধ মুশরিকদের প্রকাশ্য পরাজয় এবং মুসলিমদের সুস্পষ্ট বিজয়ের উপর সমাপ্ত হয়। এতে চৌদ্দজন মুসলিম শহীদ হন, ছয় জন মুহাজির এবং আট জন আনসার। কিন্তু মুশরিকরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের সত্তর জন নিহত এবং সত্তর জন বন্দী হয়। এদের অধিকাংশই ছিল নেতৃস্থানীয় লোক।
যুদ্ধ শেষে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিহতদের পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘তোমরা তোমাদের নাবী (সাঃ)-এর কতই না নিকৃষ্ট গোষ্ঠী ও গোত্র ছিলে। তোমরা আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছ। তোমরা আমাকে বন্ধুহীন ও সহায়কহীনরূপে ছেড়ে দিয়েছো যখন অন্যরা আমার পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। তোমরা আমাকে বের করে দিয়েছ, যখন অন্যরা আমাকে আশ্রয় দিয়েছে।’ এরপর তাঁর নির্দেশক্রমে তাদের টেনে হেঁচড়ে বদরের একটি কূপে নিক্ষেপ করা হয়।
আবূ ত্বালহাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নাবী (সাঃ)-এর আদেশক্রমে বদরের দিন কুরাইশদের চবিবশ জন বড় বড় নেতার মৃত দেহ বদরের একটি নোংরা কূপে নিক্ষেপ করা হয়।
তাঁর নিয়ম ছিল যখন তিনি কোন কাওমের উপর বিজয় লাভ করতেন তখন তিন দিন পর্যন্ত যুদ্ধ ক্ষেত্রেই অবস্থান করতেন। সুতরাং যখন বদরে তৃতীয় দিবস সূচিত হল তখন তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী তাঁর সওয়ারীর উপর হাওদা উঠিয়ে দেয়া হলো। তারপর তিনি পদব্রজে চলতে থাকলেন এবং তাঁর পিছনে পিছনে তাঁর সাহাবীগণও চললেন। অবশেষে তিনি কূপের ধারে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং তাদেরকে তাদের নাম ধরে ও তাদের পিতাদের নাম ধরে ডাকতে শুরু করলেন। (তিনি বললেন) হে অমুকের পুত্র অমুক, হে অমুকের পুত্র অমুক! তোমরা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সাঃ)-এর আনুগত্য করতে এটা কি তোমাদের জন্য খুশীর বিষয় হতো না। কেননা, আমাদের প্রতিপালক আমাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আমরা তো তা সত্য পেয়েছি। আর তোমাদের প্রতিপালক তোমাদেরকে যা কিছু বলেছিলেন তা তোমরা সত্যরূপে পেয়েছ কি?’ উমার (রাঃ) তখন আরয করলেন ‘হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আপনি এমন দেহসমূহের সঙ্গে কথা বলছেন যে গুলোর আত্মা নেই, ব্যাপার কী?’ নাবী (সাঃ) উত্তরে বললেন, ‘যে সত্ত্বার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ! আমি যা কিছু বলছি তা এদের চেয়ে বেশী তোমরা শুনতে পাওনা।’ রেওয়াইয়াতে রয়েছে যে, নাবী (সাঃ) বলেন, ‘তোমরা এদের চেয়ে বেশী শুনতে পাওনা। কিন্তু এরা উত্তর দিতে পারে না।[1]
ফুটনোটঃ[1] সহীহুল বুখারী ও সহীহুল মুসলিম। মিশকাত, ২য় খন্ড ৩৪৫ পৃঃ।
মক্কায় পরাজয়ের খবর (مَكَّةُ تَتَلَقّٰى نَبَأَ الْهَزِيَمْةِ):
মুশরিকরা বদর প্রান্তর হতে বিশৃঙ্খল, ছত্রভঙ্গ ও ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় মক্কামুখী হয়। শরম ও সংকোচের কারণে তাদের ধারণায় আসছিল না যে, কিভাবে তারা মক্কায় প্রবেশ লাভ করবে।
ইবনু ইসহাক্ব বলেন যে, যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম কুরাইশদের পরাজয়ের সংবাদ বহন করে মক্কায় পৌঁছেছিল, সে হলো হাইসামান ইবনু আব্দুল্লাহ কুযায়ী। জনগণ তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘যুদ্ধের খবর কী?’ সে উত্তরে বলল, ‘‘উতবাহ ইবনু রাবীআহ, শায়বাহ ইবনু রাবীআহ, আবুল হাকাম ইবনু হিশাম, উমাইয়া ইবনু খালফসহ আরো কিছু সংখ্যক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে যারা সবাই নিহত হয়েছে। সে যখন নিহতদের তালিকায় সম্ভ্রান্ত কুরাইশদের নাম উল্লেখ করতে শুরু করল তখন হাতীমের উপর উপবিষ্ট সাফওয়ান ইবনু উমাইয়া বলল, ‘আল্লাহর কসম! যদি তার স্বাভাবিক জ্ঞান থেকে থাকে তবে তাকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস কর?’ জনগণ তখন তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা বলত সাফওয়ান ইবনু উমাইয়ার কী হয়েছে?’ সে উত্তরে বলল ‘ঐ দেখ, সে হাতীমে উপবিষ্ট রয়েছে। আল্লাহর কসম! তার পিতা ও ভ্রাতাকে নিহত হতে স্বয়ং আমিই দেখেছি।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)’র আযাদকৃত দাস আবূ রাফি (রাঃ) বর্ণনা করেনঃ ‘আমি ঐ সময় আব্বাস (রাঃ)-এর গোলাম ছিলাম। আমাদের বাড়িতে ইসলাম প্রবেশ করেছিল। আব্বাস (রাঃ) মুসলিম হয়েছিলেন, উম্মুল ফযল (রাঃ) মুসলিম হয়েছিলেন এবং আমিও মুসলিম হয়েছিলাম। তবে অবশ্যই আব্বাস (রাঃ) তার ইসলাম গোপন রেখেছিলেন। এদিকে আবূ লাহাব বদর যুদ্ধে হাযির হয়নি। যখন কুরাইশদের পরাজয়ের খবর তার কানে পৌঁছল তখন লজ্জায় ও অপমানে তার মুখ কালো হয়ে গেল। পক্ষান্তরে আমরা নিজেদের মধ্যে শক্তি ও সম্মান অনুভব করলাম। আমি দুর্বল মানুষ ছিলাম, তীর বানাতাম এবং যমযম কক্ষে বসে তীরের হাতল ছিলতাম। আল্লাহর কসম! ঐ সময় আমি কক্ষে বসে তীর ছিলছিলাম। উম্মুল ফযল (রাঃ) আমার পাশেই বসেছিলেন এবং যে খবর এসেছিল তাতে আমরা খুশী ও আনন্দিত ছিলাম। ইতোমধ্যে আবূ লাহাব জঘন্যভাবে তার পদদ্বয় টেনে টেনে আমাদের কাছে এসে কক্ষপ্রান্তে বসে পড়লো। তার পৃষ্ঠ আমার পৃষ্ঠের দিকে ছিল। হঠাৎ গোলমাল শোনা গেল, ‘আবূ সুফইয়ান ইবনু হারিস ইবনু আব্দুল মুত্তালিব এসে গেছে।’ আবূ লাহাব তাকে বলল, ‘হে আমার প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্র। আমার কাছে এসো। আমার জীবনের শপথ! তোমার নিকট হতে খবর পাওয়া যাবে।’ তিনি আবূ লাহাবের কাছে বসে পড়লেন। জনগণ দাঁড়িয়ে ছিল। আবূ লাহাব বলল, লোকদের কী অবস্থা? ‘বল ভাতিজা, যুদ্ধের খবর কী?’ তিনি উত্তরে বললেন, ‘কিছুই নয়, এটুকুই বলা যথেষ্ট যে, লোকদের মুসলিমদের সাথে মোকাবেলা হয়েছে এবং আমরা আমাদের কাঁধগুলো তাদেরকে সোপর্দ করেছি। তারা আমাদের ইচ্ছামত হত্যা করেছে এবং বন্দী করেছে। তা সত্ত্বেও আমি আমাদের লোকদেরকে তিরষ্কার করতে পারি না। প্রকৃতপক্ষে আমাদের মোকাবালা এমন কতিপয় লোকের সঙ্গে হয়েছিল যারা আসমান ও জমিনের মধ্যস্থানে সাদাকালো মিশ্রিত ঘোড়ার উপর সওয়ার ছিল। আল্লাহর শপথ! না তারা কোন কিছু ছেড়ে দিচ্ছিল, না কোন জিনিস তাদের মোকাবালায় টিকতে পারছিল।’
আবূ রাফি (রাঃ) বলেন, আমি স্বীয় হাত দ্বারা তাঁবুর প্রান্ত উঠালাম, তারপর বললাম, ‘আল্লাহর শপথ! তারা ছিলেন ফিরিশতা’। আমার এ কথা শুনে আবূ লাহাব তার হাত উঠিয়ে ভীষণ জোরে আমার গালে এক চড় লাগিয়ে দিল। আমি তখন তার সাথে লড়ে গেলাম। কিন্তু সে আমাকে উঠিয়ে মাটিতে ফেলে দিল। তারপর আমার উপর হাঁটুর ভরে বসে আমাকে প্রহার করতে লাগল। আমি দুর্বল প্রমাণিত হলাম। কিন্তু ইতোমধ্যে উম্মুল ফযল উঠে তাঁবুর একটি খুঁটি নিয়ে তাকে এমনভাবে মারলেন যে, তার মাথায় ভীষণভাবে আঘাত লাগল। আর সাথে সাথে উম্মুল ফযল (রাঃ) বলে উঠলেন, ‘তার মনিব নেই বলে তাকে দুর্বল মনে করছো। আবূ লাহাব তখন লজ্জিত হয়ে উঠে চলে গেল। এরপর আল্লাহর কসম! মাত্র সাত দিন অতিবাহিত হয়েছে এরই মধ্যে আল্লাহর হুকুমে সে আদাস নামক কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত হলো এবং এতেই তার জীবনলীলা শেষ হয়ে গেল। আদাসার ফোড়াকে আরবরা বড়ই কুলক্ষণ মনে করত। তাই, তার মৃত্যুর পর তার পুত্ররা তার গোর-কাফন না করে তিন দিন পর্যন্ত তাকে উপরেই রেখে দেয়। কেউই তার নিকটে গেল না এবং তার দাফন-কাফনের ব্যবস্থাও করলনা। অবশেষে যখন তার পুত্ররা আশঙ্কা করল যে, তাকে এভাবে রেখে দিলে জনগণ তাদেরকে তিরস্কার করবে তখন তারা একটি গর্ত খনন করে ঐ গর্তের মধ্যে তার মৃত দেহকে কাঠ দ্বারা ঢেকে ফেলে দিল এবং দূর থেকেই ঐ গর্তের মধ্যে পাথর নিক্ষেপ করে তাকে ঢেকে ফেললো।
মোট কথা, এভাবে মক্কাবাসীগণ তাদের লোকদের সুস্পষ্ট পরাজয়ের খবর পেলো এবং তাদের স্বভাবের উপর এর অত্যন্ত খারাপ প্রতিক্রিয়া হলো। এমনকি তারা নিহতদের উপর বিলাপ করতে নিষেধ করে দিল যাতে মুসলিমরা তাদের দুঃখে আনন্দিত হওয়ার সুযোগ না পায়।
এ ব্যাপারে একটি চিত্তাকর্ষক ঘটনা রয়েছে। তা হচ্ছে বদরের যুদ্ধে আসওয়াদ ইবনু আব্দুল মুত্তালিবের তিনটি পুত্র মারা যায়। তাদের জন্য সে কাঁদতে চাচ্ছিল। সে ছিল অন্ধ লোক। একদা রাত্রে সে এক বিলাপকারিণী মহিলার বিলাপের শব্দ শুনতে পেল। তৎক্ষণাৎ সে তার গোলামকে বলল ‘তুমি গিয়ে দেখ তো, বিলাপ করার কি অনুমতি পাওয়া গেছে? কুরাইশরা কি নিহতদের জন্য ক্রন্দন করছে? তাহলে আমিও আমার পুত্র আবূ হাকিমের জন্য ক্রন্দন করব। কেননা, আমার বুক জ্বলে যাচ্ছে।’ গোলাম ফিরে এসে খবর দিল ‘মহিলাটি তো তার এক হারানো উটের জন্য ক্রন্দন করছে।’ এ কথা শুনে আসওয়াদ নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। আবেগে সে নিম্নের বিলাপ পূর্ণ কবিতাটি বলে ফেললোঃ
أتبكي أن يضل لها بـعـير ** ويمنعها من النوم السهود
فلا تبكي على بكر ولكـن ** على بدر تقاصرت الجدود
على بدر سراة بني هصيص ** ومخزوم ورهط أبي الوليد
وبكى إن بكيت على عقيل ** وبكى حارثا أسد الأسود
وبكيهم ولا تسمى جميعـا ** وما لأبي حكيمة من نديد
ألا قد ساد بعدهـم رجال ** ولولا يوم بدر لم يسودوا
অর্থঃ ‘তার উট হারিয়ে গেছে এজন্যে কি সে কাঁদছে? আর ওর জন্যে অনিদ্রা কি তার নিদ্রাকে হারাম করে দিয়েছে। (হে মহিলা) তুমি উটের জন্যে ক্রন্দন করো না, বরং বদরের (নিহতদের) জন্যে ক্রন্দন করো, যেখানে ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে গেছে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, বদরের (বেদনাদায়ক ঘটনার) জন্যে ক্রন্দন করো যেখানে বনু হাসীস, বনু মাখযূম, আবুল ওয়ালীদ প্রভৃতি গোত্রের অসাধারণ ব্যক্তিবর্গ (সমাধিস্থ) রয়েছে। যদি ক্রন্দন করতেই হয় তবে আকীলের জন্যে ক্রন্দন করো এবং হারিসের জন্যে ক্রন্দন করো যারা ছিল সিংহদের সিংহ। তুমি ঐ লোকদের জন্যে ক্রন্দন করো এবং সবার নাম নিও না। আর আবূ হাকীমার তো কোন সমকক্ষই ছিল না। দেখ ওদের পরে এমন লোকেরা নেতা হয়ে গেছে যে, ওরা থাকলে এরা নেতা হতে পারত না।’
ফুটনোটঃ
মদীনায় বিজয়ের শুভ সংবাদ (المَدِيْنَةُ تَتَلَقّٰى أَنْبَاءَ النَّصْرِ):
এদিকে মুসলিমদের বিজয় পূর্ণতায় পৌঁছে গেলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মদীনাবাসীকে অতি শীঘ্র শুভ সংবাদ দেয়ার জন্যে দুজন দূতকে প্রেরণ করেন। একজন আব্দুল্লাহ ইবনু রাওয়াহা (রাঃ) যাকে মদীনার উচ্চ ভূমি অঞ্চলের অধিবাসীদের নিকট প্রেরণ করা হয় এবং অপর জন যায়দ ইবনু হারিসাহ (রাঃ) যাকে মদীনার নিম্নভূমি অঞ্চলের অধিবাসীদের নিকট পাঠানো হয়।
ঐ সময়ে ইয়াহুদী ও মুনফিকরা এ গুজব রটিয়ে দিয়েছিল। যে মুসলিমরা পরাজিত হয়েছে। এমন কি এ গুজবও তারা রটিয়েছিল যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে হত্যা করা হয়েছে। সুতরাং একজন মুনাফিক্ব যখন যায়দ ইবনু হারিস (রাঃ)-কে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উষ্ট্র কাসওয়ার উপর সাওয়ার হয়ে আসতে দেখলো তখন বলে উঠল ‘সত্যিই মুহাম্মাদ (সাঃ) নিহত হয়েছেন। দেখ, এটা তো তারই উট। আমরা এটাকে চিনি। আর এ ব্যক্তি যায়দ ইবনু হারিসাহ (রাঃ) পরাজিত হয়ে পালিয়ে এসেছে এবং সে এত ভীত সন্ত্রস্ত হয়েছে যে, কী বলবে তা বুঝতে পারছে না।’ মোট কথা, যখন দুজন দূত মদীনায় পৌঁছলেন তখন মুসলিমরা তাদেরকে ঘিরে নেন এবং তাদের মুখে বিস্তারিত খবর শুনতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত তাদের দৃঢ় বিশ্বাস হয় যে, মুসলিমরা বিজয় লাভ করেছেন। এরপর চতুর্দিকে আনন্দের ঢেউ উথলে ওঠে এবং মদীনার আকাশ-বাতাস তাকবীর ধ্বনিতে মুখরিত হতে থাকে। যে সব মর্যাদাসম্পন্ন নেতৃস্থানীয় সাহাবী মদীনাতেই রয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে এ প্রকাশ্য বিজয়ের মুবারকবাদ জানাবার জন্যে বদরের রাস্তার উপর বেরিয়ে পড়েন।
উসামাহ ইবনু যায়দ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, ‘আমাদের নিকট এ সুসংবাদ ঐ সময় পৌঁছে যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কন্যা ও উসমান (রাঃ)-এর সহধর্মিনী রুকাইয়া (রাঃ)-কে দাফন করে মাটি বরাবর করা হয়েছিল। তাঁর শুশ্রূষার জন্যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাকে উসমান (রাঃ)-এর সাথে মদীনায় রেখে গিয়েছিলেন।
ফুটনোটঃ
মুসলিম সেনাবাহিনী মদীনার পথে (الجَيْشُ النَّبَوِيْ يَتَحَرَّكُ نَحْوَ الْمَدِيْنَةِ):
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যুদ্ধ শেষে তিন দিন বদরে অবস্থান করেন এবং তখনও তিনি যুদ্ধক্ষেত্র হতে যাত্রা শুরু করেন নি এর মধ্যেই গণীমতের মাল নিয়ে সৈন্যদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হয় এবং এ মতভেদ চরম সীমায় পৌঁছে যায়। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নির্দেশ দেন যে, যার কাছে যা আছে তা যেন সে তাঁর কাছে জমা দেয়। সাহাবীগণ (রাঃ) তাঁর এ নির্দেশ পালন করেন এবং এরপর আল্লাহ তা‘আলা ওহীর মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করে দেন।
উবাদাহ ইবনু সামিত (রাঃ) বর্ণনা করেছেনঃ ‘আমরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে মদীনা হতে যাত্রা শুরু করে বদর প্রান্তরে উপনীত হলাম। লোকদের (মুশরিকদের) সাথে আমাদের যুদ্ধ হলো এবং আল্লাহ তা‘আলা শত্রুদেরকে পরাজিত করলেন। তারপর আমাদের মধ্যে একটি দল তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল এবং তাদেরকে ধরতে ও হত্যা করতে লাগল। আর একটি দল গণীমতের মাল লুট করতে ও জমা করতে থাকল। অন্য একটি দল রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে চতুর্দিকে থেকে পরিবেষ্টন করে থাকলেন যাতে শত্রুরা প্রতারণা করে তাকে কোন কষ্ট দিতে না পারে। যখন রাত্রি হলো এবং প্রতিটি দল একে অপরের সাথে মিলিত হলো তখন গণীমত একত্রিতকারীরা বলল, ‘আমরা এগুলো জমা করেছি। সতুরাং এতে অন্য কারো কোন অংশ নেই।’ শত্রুদের পশ্চাদ্ধাবনকারীরা বলল, ‘তোমরা আমাদের চেয়ে বেশী এর হকদার নও। কেননা, আমরা এ মাল হতে শত্রুদের তাড়ানো ও দূর করানোর কাজ করেছি।’ আর যারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হিফাযতের কাজ করেছিল তারা বলল ‘আমরা এ আশঙ্কা করেছিলাম যে, আমাদের অবহেলার কারণে শত্রুরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কোন ক্ষতি সাধন করতে পারে। এ জন্যে আমরা তার হিফাযতের কাজে নিয়োজিত থেকেছি। সুতরাং আমরা এর বেশী হকদার।’ তখন আল্লাহ তা‘আলা নিম্নের আয়াত অবতীর্ণ করলেন :
{يَسْأَلُوْنَكَ عَنِ الأَنفَالِ قُلِ الأَنفَالُ لِلهِ وَالرَّسُوْلِ فَاتَّقُوْا اللهَ وَأَصْلِحُوْا ذَاتَ بِيْنِكُمْ وَأَطِيْعُوْا اللهَ وَرَسُوْلَهُ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِيْنَ} [الأنفال:1]
‘‘তারা তোমাকে যুদ্ধে প্রাপ্ত সম্পদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে। বল, ‘যুদ্ধে প্রাপ্ত সম্পদ হচ্ছে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের; কাজেই তোমরা আল্লাহকে ভয় কর আর নিজেদের সম্পর্ককে সুষ্ঠু সুন্দর ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত কর। তোমরা যদি মু’মিন হয়ে থাক তবে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য কর।’ (আল-আনফাল ৮ : ১)
এরপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এ গনীমতের মাল মুসলিমদের মধ্যে বন্টন করে দেন।[1]
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তিন দিন বদরে অবস্থানের পর মদীনার পথে যাত্রা শুরু করেন। তাঁর সাথে মুশরিক বন্দীরাও ছিল এবং মুশরিকদের নিকট হতে প্রাপ্ত গণীমতের মালও ছিল। তিনি তাদের পাহারার দায়িত্ব আব্দুল্লাহ ইবনু কা‘ব (রাঃ)-এর উপর অর্পণ করেন। যখন তিনি সাফরা উপত্যকায় গিরিপথ হতে বের হয়ে একটি টিলার উপর বিশ্রাম গ্রহণ করেন তখন তিনি সেখানে গণীমাতের এক পঞ্চমাংশ বের করে নিয়ে বাকী মাল মুসলিমদের মধ্যে সমভাবে বন্টন করে দেন। আর সাফরা উপত্যকাতেই তিনি নাযর ইবনু হারিসের হত্যার নির্দেশ দেন। এ ব্যক্তি বদরের যুদ্ধে মুশরিকদের পতাকা ধরে রেখেছিল এবং সে কুরাইশদের বড় বড় অপরাধীদের একজন ছিল। ইসলামের শত্রুতায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে কষ্ট প্রদানে সে বড় ভূমিকা পালন করেছিল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নির্দেশক্রমে আলী (রাঃ) তাকে হত্যা করেন।
এরপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরকুয যুবয়্যাহ নামক স্থানে পৌঁছে উকবাহ ইবনু আবী মুআইত্বকে হত্যা করার আদেশ জারী করেন। এ লোকটি যেভাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে কষ্ট দিয়েছিল তার কিছু আলোচনা ইতোপূর্বে করা হয়েছে। এ সেই ব্যক্তি যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সালাতের অবস্থায় তাঁর পিঠের উপর উটের ভূঁড়ি চাপিয়ে দিয়েছিল এবং সে তার গলায় চাদর জড়িয়ে দিয়ে তাঁকে মেরে ফেলার ইচ্ছা করেছিল এবং আবূ বাকর (রাঃ) সেখানে সময়মত এসে না পড়লে সে তো তাকে গলা টিপে মেরেই ফেলত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন তাকে হত্যা করার নির্দেশ দেন তখন সে বলে ওঠে ‘হে মুহাম্মাদ (সাঃ) আমার সন্তানদের জন্য কে আছে?’ তিনি উত্তরে বললেন, ‘আগুন’’। তারপর আসিম ইবনু সাবিত (রাঃ) এবং মতান্তরে আলী (রাঃ) তার গর্দান উড়িয়ে দেন।[2]
সামরিক নীতি অনুযায়ী এ দুরাচার ব্যক্তিদ্বয়ের হত্যা অপরিহার্য ছিল। কেননা, তারা শুধু বন্দী ছিল না, বরং আধুনিক পরিভাষার দিক থেকে যুদ্ধ অপরাধীও ছিল।
ফুটনোটঃ[1] মুসনাদে আহমাদ ৫ম খন্ড ৩২৩ ও ৩২৪ পৃঃ এবং হাকিম ২য় খন্ড ৩২৮ পৃঃ।
[2] এ হাদীসটি সহীহুল গ্রন্থসমূহে বর্ণিত যথা সুনানে আবূ দাউদ , আওনুল মা’বুদে ৩য় খন্ড ১২ পৃঃ।
অভ্যর্থনাকারী প্রতিনিধিদল (وُفُوْدُ التَّهْنِئَةِ):
এরপর যখন মুসলিম সেনাবাহিনী রাওহা নামক স্থানে পৌঁছেন তখন ঐ মুসলিম প্রতিনিধি দলের সাথে তাদের সাক্ষাৎ হয় যারা দূতদ্বয় মারফত বিজয়ের শুভ সংবাদ শুনে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর অভ্যর্থনার জন্যে এবং তাকে বিজয়ের মুবারকবাদ জানাবার জন্যে মদীনা হতে বের হয়ে এসেছিলেন। যখন তারা মুবারকবাদ পেশ করলেন তখন সালামাহহ ইবনু সালামাহ্ (রাঃ) বললেন, ‘আপনারা আমাদেরকে মুবারকবাদ দিচ্ছেন কেন? আল্লাহর শপথ! আমাদের মোকাবেলা তো টেকো মাথাবিশিষ্ট বুড়োদের সাথে হয়েছিল, যারা ছিল উটের মত।’ তার এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মুচকি হেসে বললেন, ‘ভ্রাতুষ্পুত্র, এরাই ছিল কওমের নেতৃস্থানীয় লোক বা নেতা।’
তারপর উসায়েদ ইবনু হুযায়ের (রাঃ) আরয করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আল্লাহর জন্যেই সমস্ত প্রশংসা যে, তিনি আপনাকে সফলতা দান করেছেন এবং আপনার চক্ষুদ্বয় শীতল করেছেন। আল্লাহর কসম! আমি একথা মনে করে বদরে গমন হতে পিছনে থাকি নি যে, আপনার মোকাবেলা শত্রুদের সাথে হবে। আমি তো ধারণা করেছিলাম যে, এটা শুধু কাফেলার ব্যাপার। আমি যদি বুঝতাম যে, শত্রুদের মুখোমুখী হতে হবে তবে আমি কখনো পিছনে থাকতাম না।’ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তখন তাকে বললেন? তুমি সত্য কথাই বলেছ।
এরপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মদীনা মুনাওওরায় বিজয়ীর বেশে এমনভাবে প্রবেশ করলেন যে, মদীনা শহর এবং তাঁর আশপাশের শত্রুদের উপর তাঁর চরম প্রভাব প্রতিফলিত হল। এ বিজয়ের ফলে মদীনার বহু লোক দলে দলে এসে ইসলাম গ্রহণ করলেন। এ সময়েই আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই এবং তার সঙ্গীরা শুধু লোক দেখানো ইসলাম গ্রহণ করে।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মদীনায় আগমনের এক দিন পর বন্দীদের আগমন ঘটে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদেরকে সাহাবীগণের (রাঃ) মধ্যে বন্টন করে দেন এবং তাদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহারের পরামর্শ প্রদান করেন। এ পরামর্শের কারণে সাহাবীগণ (রাঃ) নিজেরা খেজুর খেতেন এবং বন্দীদেরকে রুটি খাওয়াতেন। কেননা মদীনায় খেজুর ছিল সাধারণ খাদ্য এবং রুটি ছিল বিশেষ মূল্যবান খাদ্য।
ফুটনোটঃ
বন্দীদের সম্বন্ধে পরামর্শ (قَضِيَّةُ الْأَسَارِى):
মদীনায় প্রত্যাবর্তন করে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবীদের সঙ্গে বন্দীদের ব্যাপারে পরামর্শ করেন। আবূ বাকর (রাঃ) নিবেদন করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! এরা সবাই আমাদের চাচাত ভাই, বংশীয় লোক এবং আত্মীয়। আমার মতে মুক্তিপণ হিসেবে কিছু কিছু অর্থ নিয়ে এদেরকে মুক্তি দেয়া উচিত। এতে আমাদের সাধারণ তহবিল যথেষ্ট অর্থ সঞ্চিত হবে। পক্ষান্তরে অল্প দিনের মধ্যে এদের সবার পক্ষে ইসলাম গ্রহণ করাও সম্ভব হবে। তখন তাদেরকে আমাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে আমরা ব্যবহার করতে পারব।
তারপর নাবী কারীম (সাঃ) খাত্তাবের পুত্রকে (উমার (রাঃ)) সম্বোধন করে বললেন, হে খাত্তাবের পুত্র, তোমার অভিমত কী? উত্তরে উমার (রাঃ) বললেন, আল্লাহর কসম! এ ব্যাপারে আমি আবূ বকরের সঙ্গে একমত হতে পারছিনা। আমার মত হচ্ছে যে, অমুককে (যিনি উমারের আত্মীয় ছিলেন) আমার হাওয়ালা করে দেন, আমি তাকে হত্যা করি। আকীল বিন আবি তালেবকে আলীর হাওয়ালা করে দিন। তিনি তাকে হত্যা করবেন এবং অমুককে (যিনি হামযাহর ভাই ছিলেন) হামযাহর হালওয়ালা করে দিন, তিনি তাকে হত্যা করবেন। যাতে করে আল্লাহ এটা বোঝেন যে, আমাদের অন্তরে মুশরিকদের সম্পর্কে কোন প্রকার দুর্বলতা নেই। আর এরা ছিল মুশরিকদের সার্বক্ষণিক অগ্রণী নেতা। এরা ইসলামের চির শত্রু এবং মুসলিমদের প্রাণের বৈরী। আমাদেরকে নির্যাতিত করতে, আল্লাহর রাসূল (সাঃ)-কে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করতে এবং আল্লাহর সত্য ধর্মকে জগতের পৃষ্ঠ হতে মুছে ফেলতে এরা সাধ্যপক্ষে চেষ্টার কোন ত্রুটি করেনি। এরা অন্যায়, অধর্ম ও অত্যাচারের সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তি। এদেরকে অবিলম্বে হত্যা করে ফেলা হোক। প্রত্যেক মুসলিম উলঙ্গ তরবারী হাতে দন্ডায়মান হোক এবং নিজ হাতে নিজের আত্মীয়বর্গের মুন্ডপাত করুক, আমার এটাই মত।’
উমার (রাঃ) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আবূ বাকর (রাঃ)-এর মতকেই পছন্দ করলেন, আমার মতকে পছন্দ করলেন না। সুতরাং বন্দীদের নিকট থেকে মুক্তিপণ নেয়ার সিন্ধান্ত গৃহীত হলো। পরের দিন আমি সকাল সকাল রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এবং আবূ বাকর (সাঃ)-এর খিদমতে হাযির হলাম। দেখি যে, তাঁরা দুজনই ক্রন্দন করছেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলুন, আপনারা কেন কাঁদছেন? যদি ক্রন্দনের কোন কারণ থাকে তাহলে আমিও ক্রন্দন করব। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) উত্তরে বললেন ‘মুক্তিপণ গ্রহণ করার কারণে তোমার সঙ্গীদের উপর যে জিনিস পেশ করা হয়েছে সে কারণেই কাঁদছি।’ আর তিনি নিকটবর্তী একটি গাছের প্রতি ইঙ্গিত করে বললেন, ‘আমার সামনে তাদের শাস্তিকে এ গাছের চেয়েও বেশী নিকটবর্তীরূপে পেশ করা হয়েছে।’ তারপর আল্লাহ তা‘আলা নিম্নলিখিত আয়াত নাযিল করেন,
{مَا كَانَ لِنَبِيٍّ أَن يَكُوْنَ لَهُ أَسْرَى حَتّٰى يُثْخِنَ فِي الأَرْضِ تُرِيْدُوْنَ عَرَضَ الدُّنْيَا وَاللهُ يُرِيْدُ الآخِرَةَ وَاللهُ عَزِيْزٌ حَكِيْمٌ لَّوْلاَ كِتَابٌ مِّنَ اللهِ سَبَقَ لَمَسَّكُمْ فِيْمَا أَخَذْتُمْ عَذَابٌ عَظِيْمٌ} [الأنفال:67،68]
‘‘কোন নাবীর জন্য এটা সঠিক কাজ নয় যে, দেশে (আল্লাহর দুশমনদেরকে) পুরোমাত্রায় পরাভূত না করা পর্যন্ত তার (হাতে) যুদ্ধ-বন্দী থাকবে। তোমরা দুনিয়ার স্বার্থ চাও আর আল্লাহ চান আখিরাত (এর সাফল্য), আল্লাহ প্রবল পরাক্রান্ত, মহাবিজ্ঞানী। – আল্লাহর লেখন যদি পূর্বেই লেখা না হত তাহলে তোমরা যা (মুক্তিপণ হিসেবে) গ্রহণ করেছ তজ্জন্য তোমাদের উপর মহাশাস্তি পতিত হত।’ (আল-আনফাল ৮ : ৬৭-৬৮)
আল্লাহর পক্ষ থেকে আগিই সে নির্দেশ এসেছিল তা হল: {فَإِمَّا مَنًّا بَعْدُ وَإِمَّا فِدَاء}
‘অতঃপর তখন হয় অনুকম্পা; নয় মুক্তিপণ’। (মুহাম্মাদ : ৪ আয়াত)
যেহেতু এ বিধানে বন্দীদের নিকট হতে মুক্তিপণ নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে সেহেতু মুক্তিপণ গ্রহণ করার কারণে সাহাবীগণ (রাঃ)-কে শাস্তি দেয়া হয় নি, বরং তাদেরকে শুধু তিরস্কার ও নিন্দা করা হয়েছে যে, ভালোভাবে কাফেরদেরকে উত্তম মাধ্যম দেয়ার আগেই বন্দী করে নিয়েছিলেন এবং এ জন্যও যে, তাঁরা এমন যুদ্ধ অপরাধীদের নিকট থেকে মুক্তিপণ গ্রহণ করেছিলেন যারা বড় অপরাধী ছিল, যাদের উপর আধুনিক আইনও মুকদ্দমা না চালিয়ে ছাড়ত না, এদের মুকদ্দমার ফায়সালাও সাধারণত মৃত্যুদন্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদন্ড হতো।
যা হোক, আবূ বাকর (রাঃ)-এর অভিমত অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল বলে মুশরিকদের নিকট হতে মুক্তিপণ গৃহীত হয়। মুক্তিপণের পরিমাণ চার হাজার দিরহাম পর্যন্ত ছিল। মক্কাবাসীগণ লেখা পড়াও জানত, পক্ষান্তরে মদীনাবাসীগণ লেখাপড়া জানত না বললেই চলে। এ জন্যে এ সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়েছিল যে, যে মুক্তিপণ দিতে অসমর্থ হবে সে মদীনার দশজন ছেলেকে লেখাপড়া শিখাবে। যখন এ ছেলেগুলো উত্তমরূপে লেখাপড়া শিখে নিবে তখন এটাই তার মুক্তিপণ হিসেবে বিবেচিত হবে।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কয়েকজন বন্দীর উপর অনুগ্রহও করেছেন এবং তাদেরকে মুক্তিপণ ছাড়াই মুক্ত করে দিয়েছেন। এ তালিকায় মুত্তালিব ইবনু হানতাব, সাইফী ইবনু আবী রিফাআহ এবং আবূ ইযযাহ জুমাহীর নাম পাওয়া যায়। শেষের দুজনকে উহুদের যুদ্ধে বন্দী ও হত্যা করা হয়। (বিস্তারিত বিবরণ সামনে আসছে)।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্বীয় জামাতা আবুল আসকেও বিনা মুক্তিপণে এ শর্তে ছেড়ে দেন যে, সে তার কন্যা যায়নাব (রাঃ)-এর পথ রোধ করবে না। এর কারণ এই ছিল যে, যায়নাব (রাঃ) আবুল আসের মুক্তিপণ হিসেবে কিছু মাল পাঠিয়েছিলেন যার মধ্যে একটি হারও ছিল। এ হারটি প্রকৃত পক্ষে খাদীজাহ (রাঃ)-এর ছিল। যায়নাব (রাঃ)-কে আবুল আসের নিকট বিদায় দেয়ার সময় তিনি তাকে এ হারটি প্রদান করেছিলেন। হারটি দেখে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মধ্যে ভাবাবেগ সৃষ্টি হয়। তাই, তিনি সাহাবীদের (রাঃ) নিকট অনুমতি চান যে, আবুল আসকে মুক্তিপণ ছাড়াই মুক্ত করে দেয়া হোক। সাহাবীগণ সন্তুষ্টচিত্তে এটা মেনে নেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আবুল আসকে এ শর্তে ছেড়ে দেন যে, সে যায়নাব (রাঃ)-এর পথরোধ করতে পারবে না। এ শর্তানুসারে আবুল আস তাঁর পথ ছেড়ে দেয় এবং যায়নাব (রাঃ) মদীনায় হিজরত করেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যায়দ ইবনু হারিসাহ (রাঃ) এবং একজন আনসারী সাহাবী (রাঃ)-কে এ উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন যে, তাঁরা বাতনে ইয়াজিজ নামক স্থানে অবস্থান করবেন, যায়নাব (রাঃ) তাদের পাশ দিয়ে গমনকালে তাঁরা তাঁর সাথী হয়ে যাবেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর এ নির্দেশ অনুযায়ী তাঁরা দুজন যায়নাব (রাঃ)-কে সাথে নিয়ে মদীনায় ফিরে আসেন। যায়নাব (রাঃ)-এর হিজরতের ঘটনাটি খুবই দীর্ঘ ও হৃদয়বিদারক।
বন্দীদের মধ্যে সুহায়েল ইবনু ‘আমরও ছিল। সে ছিল বড় বাকপটু ভাল বক্তা। উমার (রাঃ) আরয করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! সুহায়েল ইবনু আমরের সামনের দাঁত দুটি ভেঙ্গে দেয়া হোক, যাতে সে কোন জায়গায় বক্তা হয়ে আপনার বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিতে না পারে।’ কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর এ আবেদন প্রত্যাখ্যান করলেন। কেননা এটা মুসলাহ (নাক, কান কর্তিত) এর অন্তর্ভুক্ত। যার কারণে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে পাকড়াও এর আশঙ্কা থাকবে।
সা‘দ ইবনু নু’মান (রাঃ) উমরাহ করার জন্যে বের হলে আবূ সুফইয়ান তাকে বন্দী করে ফেলেন। আবূ সুফইয়ানের পুত্র ‘আমরও বদরযুদ্ধে বন্দীদের একজন ছিল। ‘আমরকে আবূ সুফইয়ানের নিকট পাঠিয়ে দিলে তিনি সা‘দ (রাঃ)-কে ছেড়ে দেন।
ফুটনোটঃ
এ যুদ্ধ সম্পর্কে কুরআনের পর্যালোচনা (القُرْآنُ يَتَحَدَّثُ حَوْلَ مَوْضُوْعِ الْمَعْرِكَةِ):
এ যুদ্ধ সম্পর্কে সূরাহ আনফাল অবতীর্ণ হয়। প্রকৃতপক্ষে এ সূরাহটি এ যুদ্ধের উপর আল্লাহ প্রদত্ত এক বিশদ বর্ণনা। আর আল্লাহ তা‘আলার এ বর্ণনা বাদশাহ ও কমান্ডারদের বিজয় বর্ণনা হতে সম্পূর্ণ পৃথক। এ বিশদ বর্ণনার কয়েকটি কথা হচ্ছে :
আল্লাহ তা‘আলা সর্বপ্রথম মুসলিমদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ঐ অসতর্কতা ও চারিত্রিক দুর্বলতার প্রতি যা মোটের উপর তাদের মধ্যে বাকী রয়ে গিয়েছিল। আর যেগুলোর মধ্যে কিছু কিছু এ যুদ্ধে প্রকাশও পেয়ে গিয়েছিল। তাদের এ মনোযোগ আকর্ষণের উদ্দেশ্য ছিল তারা নিজেদেরকে এ সব দুর্বলতা হতে পবিত্র করে পরিপূর্ণতা লাভ করবে।
এরপর মহান আল্লাহ এ বিজয়ে স্বীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও গায়েবী সাহায্যের অন্তভুক্তির বর্ণনা দিয়েছেন। এর উদ্দেশ্য ছিল মুসলিমরা নিজেদের সাহস ও বীরত্বের প্রতারণায় যেন না পড়ে। কেননা, এর ফলে স্বভাব ও প্রকৃতির মধ্যে গর্ব ও অহংকার সৃষ্টি হয়। বরং তারা যেন আল্লাহ তা‘আলার উপরই নির্ভরশীল হয় এবং তাঁর ও তাঁর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আনুগত্য স্বীকার করে।
তারপর ঐ সব মহৎ উদ্দেশ্যের আলোচনা করা হয়েছে যার জন্যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এ ভয়াবহ ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে পা রেখেছিলেন এবং এর মধ্যে ঐ চরিত্র ও গুণাবলী চিহ্ণিত করা হয়েছে যা যুদ্ধসমূহে বিজয়ের কারণ হয়ে থাকে।
তারপর মুশরিক মুনাফিক্ব, ইহুদী এবং যুদ্ধবন্দীদেরকে এমন মর্মস্পর্শী উপদেশ দেয়া হয় যাতে তারা সত্যের সামনে ঝুঁকে পড়ে এবং ওর অনুসারী হয়ে যায়।
এরপর মুসলিমগণকে যুদ্ধলব্ধ সম্পদের ব্যাপারে সম্বোধন করে এ বিজয়ের সমুদয় বুনিয়াদী নিয়ম-কানুন ও নীতিমালা বুঝানো হয় ও বলে দেয়া হয়।
তারপর এ স্থানে ইসলামী দাওয়াতের জন্যে যুদ্ধ ও সন্ধির যে নীতিমালার প্রয়োজন ছিল ও গুলোর বিশ্লেষণ ও বিবরণ দেয়া হয়েছে। যাতে মুসলিমদের যু্দ্ধ এবং জাহেলিয়াত যুগের যুদ্ধের মধ্যে স্বাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং চরিত্র ও কর্মের ক্ষেত্রে মুসলিমদের উৎকৃষ্টতা লাভ হয়, আর দুনিয়ার মানুষ উত্তমরূপে জেনে নেয় যে, ইসলাম শুধু মাত্র একটা মতবাদ নয়, বরং সে যে নীতিমালা ও রীতিনীতির প্রতি আহবানকারী, স্বীয় অনুসারীদেরকে ওগুলো অনুযায়ী আমল করার শিক্ষাও দিয়ে থাকে।
তারপর ইসলামী হুকুমতের কয়েকটি দফা বর্ণনা করা হয়েছে যেগুলো দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামী হুকমতের গন্ডীর মধ্যে বসবাসকারী মুসলিম ও এর বাইরে বসবাসকারী মুসলিমদের মধ্যে কতই না পার্থক্য রয়েছে।
ফুটনোটঃ
বিচ্ছিন্ন ঘটনাবলীঃ
হিজরী ২য় সনে রমাযানের রোযা এবং সাদকায়ে ফিতর ফরজ করা হয়, আর যাকাতের বিভিন্ন নিসাব ও ধনের পরিমাণ যা থাকলে যাকাত ফরজ হয়, নির্দিষ্ট করা হয়। সাদকায়ে ফিতর ফরজ ও যাকাতের নিসাব নির্দিষ্ট করণের ফলে ঐ বোঝা ও কষ্ট অনেকাংশ হালকা হয়ে গেল যা বহু সংখ্যক দরিদ্র মুহাজির বহণ করে আসছিলেন। কেননা, তাঁরা জীবিকার সন্ধানে ভূপৃষ্ঠে ঘুরেও জীবিকার ব্যবস্থা করতে অপারগ হচ্ছিলেন।
তারপর অত্যন্ত সুন্দর ও মোক্ষম ব্যবস্থা এই ছিল যে, মুসলিমরা তাদের জীবনে যে প্রথম ঈদ উদযাপন করেছিলেন তা ছিল ২য় হিজরীর শাওয়াল মাসের ঈদ, যা বদর যুদ্ধের প্রকাশ্য বিজয়ের পর হাযির হয়েছিল। কতই না সুন্দর ছিল এ সৌভাগ্যের ঈদ, যে সৌভাগ্য আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমদের মস্তিষ্কে বিজয় ও সম্মানের মুকুট পরানোর পর দান করেছিলেন। আর কতই না ঈমানের ছিল এ ঈদের সালাতের দৃশ্য যা মুসলিমরা নিজেদের ঘর হতে বের হয়ে তকবীর তাওহীদ ধ্বনিতে গগণ পবন মুখরিত মাঠে গিয়ে আদায় করে থাকেন। ঐ সময় অবস্থা ছিল মুসলিমদের অন্তরে ছিল আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামতরাশি ও তাঁর দেয়া সাহায্যের কারণে তাঁর করুণা ও সন্তুষ্টি লাভের আগ্রহে উচ্ছ্বসিত এবং বিজয়োন্মাদনার উল্লাসে পরিপূর্ণ। তাদের ললাটগুলো তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের জন্যে ঝুঁকে পড়েছিল। আল্লাহ তা‘আলা এ নিয়ামতের বর্ণনা নিম্নের আয়াতে দিয়েছেনঃ
{وَاذْكُرُوْا إِذْ أَنتُمْ قَلِيْلٌ مُّسْتَضْعَفُوْنَ فِي الأَرْضِ تَخَافُوْنَ أَن يَتَخَطَّفَكُمُ النَّاسُ فَآوَاكُمْ وَأَيَّدَكُم بِنَصْرِهِ وَرَزَقَكُم مِّنَ الطَّيِّبَاتِ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ} [الأنفال:26].
‘‘স্মরণ কর সে সময়ের কথা যখন তোমরা ছিলে সংখ্যায় অল্প, দুনিয়াতে তোমাদেরকে দুর্বল হিসেবে গণ্য করা হত। তোমরা আশঙ্কা করতে যে, মানুষেরা তোমাদের কখন না হঠাৎ ধরে নিয়ে যায়। এমন অবস্থায় তিনি তোমাদেরকে আশ্রয় দিলেন, তাঁর সাহায্য দিয়ে তোমাদেরকে শক্তিশালী করলেন, তোমাদের উত্তম জীবিকা দান করলেন যাতে তোমরা (তাঁর নির্দেশ পালনের মাধ্যমে) কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।’ (আল-আনফাল ৮ : ২৬)
ফুটনোটঃ
বদর পরবর্তী সময়ের তৎপরতা (النَّشَاطُ الْعَسْكَرِيْ بَيْنَ بَدْرٍ وَّأُحُدٍ)
বদরের যুদ্ধ ছিল মুসলিম এবং মুশরিকদের মধ্যে সর্ব প্রথম অস্ত্রের লড়াই এবং মীমাংসাসূচক সংঘর্ষ। এ সংঘর্ষে মুসলিমগণ প্রকাশ্য বিজয় লাভ করেন এবং সমগ্র আরব তা প্রত্যক্ষ করে। এ যুদ্ধের ফলে যারা সরাসরি চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তারাই মর্মাহত হয়েছিল সব চাইতে বেশী অর্থাৎ মক্কার মুশরিকেরা। তাছাড়া ঐ সকল লোকও যারা মুসলিমদের বিজয় ও সফলতাকে নিজেদের ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক অস্তিত্বের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক বলে মনে করেছিল, অর্থাৎ ইহুদীর। সুতরাং মুসলিমগণ যখন বদর যুদ্ধে কল্পনাতীতভাবে বিজয় লাভ করলেন তখন এ দুটি দল মুসলিমদের প্রতি ক্রোধ, ক্ষোভ ও মন পীড়ায় জ্বলে পুড়ে মরতে লাগল। কুরআনুল কারীমে যেমনটি ইরশাদ হয়েছেঃ
{لَتَجِدَنَّ أَشَدَّ النَّاسِ عَدَاوَةً لِّلَّذِيْنَ آمَنُوْا الْيَهُوْدَ وَالَّذِيْنَ أَشْرَكُوْا} [المائدة:82]
‘‘যারা ঈমান এনেছে তাদের প্রতি মানুষের মধ্যে ইয়াহূদ ও মুশরিকদেরকে তুমি অবশ্য সবচেয়ে বেশি শত্রুতাপরায়ণ দেখতে পাবে।’ (আল-মায়িদা ৫ : ৮২)
মদীনায় কিছু লোক এ দুটি দলের সঙ্গী ও অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল। তারা যখন দেখল যে, তাদের মান মর্যাদা সমুন্নত রাখার এখন আর কোন পথ রইল না তখন তারা বাহ্যিকভাবে ইসলামে প্রবেশ করল।
এটা ছিল আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই ও তার বন্ধু বান্ধবের দল। ইহুদী এবং মুশরিকদের তুলনায় মুসলিমদের প্রতি এরাও কম ক্ষোভ হিংসা ও বিদ্বেষ পোষণ করত না।
এদের ছাড়া চতুর্থ একটি দলও ছিল। অর্থাৎ ঐ সব বেদুঈন যারা মদীনার চতুষ্পার্শে বসবাস করত। কুফর কিংবা ঈমান কোন কিছুর প্রতিই তাদের কোন আকর্ষণ কিংবা আবেগের প্রশ্ন জড়িত ছিল না। তারা ছিল লুণ্ঠনকারী দস্যু। এ কারণে বদর যুদ্ধে মুসলিমদের সাফল্যে তারাও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। তাদের আশঙ্কা ছিল যে, মদীনায় একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে তাদের লুণ্ঠন ও দস্যুবৃত্তির পথ বন্ধ হয়ে যাবে। এ কারণে তাদের অন্তরেও মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসা দানা বেঁধে ওঠে। যার ফলে তারাও মুসলিমদের শত্রু দলভুক্ত হয়ে পড়ে।
মুসলিমগণ এভাবে চতুর্দিক থেকে বিপদের সম্মুখীন হন। কিন্তু মুসলিমদের ব্যাপারে প্রত্যেক দলের কর্ম পদ্ধতি ছিল অন্যান্য দলের কর্ম পদ্ধতি হতে পৃথক। প্রত্যেক দল নিজেদের অবস্থার প্রেক্ষাপটে এমন সব পন্থা অবলম্বন করেছিল যা তাদের ধারণায় তাদের উদ্দেশ্য সাধনে ছিল সহায়ক। সুতরাং মদীনাবাসী মুনাফিক্বগণ বাহ্যিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করে গোপনে গোপনে ষড়যন্ত্র করে পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে দেয়ার পথ অবলম্বন করল। ইহুদীদের একটি দল খোলাখুলিভাবে মুসলিমদের প্রতি ক্রোধ ও শত্রুতা শুরু করল এবং প্রতিশোধ গ্রহণের প্রকাশ্য ঘোষণা দিতে থাকল। তাদের সামরিক তৎপরতা এবং প্রস্তুতি ছিল খোলাখুলি, তারা যেন তাদের কার্যকলাপের মাধ্যমে মুসলিমগণকে নিম্নরূপ পয়গাম দিচ্ছিলঃ
ولا بد من يوم أغرّ مُحَجَّل ** يطول استماعي بعده للنوادب
অর্থাৎ এমন এক উজ্জ্বল ও আলোকময় দিনের প্রয়োজন, যার পরে দীর্ঘকাল ধরে বিলাপকারিণীদের বিলাপ শুনতে থাকবো।
আর বছর কাল পরে তারা কার্যতঃ যুদ্ধ করার জন্যে মদীনার উপর চড়াও হল, যা ইতিহাসে উহুদের যুদ্ধ নামে পরিচিত। মুসলিমদের খ্যাতি মর্যাদার উপর এর যথেষ্ট মন্দ প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছিল।
এ বিপদের মোকাবেলা করার জন্যে মুসলিমগণ গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এর দ্বারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর যোগ্য নেতৃত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রকাশ থাকে যে, মদীনার নেতা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) চার পাশের এ সব বিপদের ব্যাপারে সদা সচেতন ও সতর্ক ছিলেন এবং এগুলো মোকাবেলা করার জন্য যে, ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন এখানে তারই একটা সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরা হবে পরবর্তী অনুচ্ছেদে।
বদর যুদ্ধের পরবর্তী ঘটনাসমূহ
১. কুদর* নামক স্থানে গাযওয়ায়ে বনী সুলাইমের যুদ্ধ (غَزْوَةُ بَنِيْ سُلَيْمٍ بِالْكُدْرِ):
বদর যুদ্ধের পর সর্ব প্রথম মুসলিম গোয়েন্দা বাহিনী সরবরাহ করেন তা ছিল গাত্বাফান গোত্রের শাখা বনু সুলাইমের লোকেরা মদীনার উপর চড়াও হওয়ার জন্যে সৈন্য সমাবেশ করছে। এর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে নাবী কারীম (সাঃ) দু’শ জন উষ্ট্রারোহীকে সঙ্গে নিয়ে আকস্মিকভাবে তাদের নিজেদের এলাকায় ধাওয়া করেন এবং কুদর নামক স্থানে তাদর মনযিল পর্যন্ত পৌঁছেন। বনু সুলাইম গোত্র এ আকস্মিক আক্রমণে একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে এবং উপায়ন্তর না দেখে উপত্যকার মধ্যে পাঁচশটি উট ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যায়। এগুলোর উপর মদীনার মুসলিম সেনাবাহিনী দখলদার হয়ে যান। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এগুলোর এক পঞ্চমাংশ বের করে নিয়ে অবশিষ্ট মাল গণীমত হিসেবে মুজাহিদদের মধ্যে বন্টন করে দেন। প্রত্যেকের অংশে দুটি করে উট পড়ে। এ গাযওয়ায় ইয়াসার নামক একটি গোলাম হাতে আসে যাকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আযাদ করে দেন। এরপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বনু সুলাইমের বাসভূমিতে তিন দিন অবস্থান করার পর মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন।
এ গাযওয়া হিজরী ২য় সনের শাওয়াল মাসে বদর হতে প্রত্যাবর্তনের মাত্র সাত দিন পরে সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধকালীন সময়ে সিবা’ ইবনু ‘উরফুত্বাহ (রাঃ)-কে এবং মতান্তরে ইবনু উম্মু মাকতূম (রাঃ)-কে মদীনার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল।[1]
ফুটনোটঃ* কুদর প্রকৃত পক্ষে মেটোখাকীরং এর এক প্রকার পাখী। কিন্তু এখানে বানু সুলাইমের একটি প্রস্রবণ উদ্দেশ্য, এটা নজদের মধ্যে অবস্থিত। মক্কা হতে (নজদের পথে) সিরিয়াগামী রাজপথের উপর অবস্থিত।
[1] যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৯০ পৃঃ, ইবনে হিশাম ২য় খন্ড ৪৩-৪৪ পৃঃ, মুখতাসার সীরাহ শায়খ আব্দুল্লাহ প্রণীত ২৩৬।
২. নাবী কারীম (সাঃ)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র (مؤامرة لاغتيال النبي ﷺ):
বদর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মুশরিকরা ক্ষোভে ও ক্রোধে অগ্নি শর্মা হয়ে ওঠে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে হত্যা করে বদর যুদ্ধের গ্লানি ও অপমানের প্রহিশোধ গ্রহণের জন্য ভীষণ ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, দু’ যুবক নিজ বুদ্ধিবলে এ সকল মতভেদ ও এখতেলাফের বুনিয়াদ ও বদর যুদ্ধের অবমাননাকর পরিস্থিতির মূলোৎপাটন করবে অর্থাৎ নাবী (সাঃ)-কে হত্যা করবে।
ফলে বদর যুদ্ধের পরের ঘটনা হল ওহাব ইবনে উমায়ের জুমাহী, যে ছিল কুরাইশদের সব চাইতে বড় শয়তান এবং মক্কাতে নাবী কারীম (সাঃ) ও সাহাবীগণ (রাঃ)-কে যন্ত্রণা দেয়ার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করত তার পুত্র ওহাব ইবনে উমায়ের বদর যুদ্ধে মুসলিমদের হাতে বন্দী হয়েছিল। এ উমায়ের এক দিন হাতীমে বসে সাফওয়ান ইবনে উমাইয়ার সঙ্গে বদরের কূঁয়ায় নিক্ষিপ্ত ব্যক্তিবর্গ সম্পর্কে আলোচনা করছিল। এতে সাফওয়ান বলে উঠল, ‘আল্লাহর শপথ! এরপর আমাদের বেঁচে থাকার আর কোন আকর্ষণ থাকতে পারে না।’
উত্তরে উমায়ের বলল, ‘আল্লাহর কসম! তুমি সত্যই বলেছ। দেখ, আমার যদি ঋণ না থাকত যা পরিশোধ করার মতো অবস্থা বর্তমানে আমার নেই এবং আমার ছোট ছোট ছেলেমেয়ে যদি না থাকত যা আমার অভাবে বিনষ্ট হওয়ার সম্বাবনা রয়েছে, তবে এখনই আমি বাহনে আরোহণ করে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর কাছে যেতাম এবং তাকে হত্যা করে ফেলতাম। কেননা, তার কাছে যাওয়ার কারণ আমার মজুদ রয়েছে। আমার পুত্র তার নিকট বন্দী রয়েছে। সাফওয়ান তার এ কথার উত্তরে বলল, বেশ, তোমার সমস্ত ঋণের আমি যিম্মাদার হচ্ছি এবং তোমার পরিবার প্রতিপালনের দায়িত্ব আমি নিচ্ছি। তোমার সন্তানেরা হবে আমার সন্তান।
উমায়ের বলল, ‘সাবধান! ব্যাপারটা যেন গোপন থাকে।’ সিদ্ধান্ত হল, সে তার বন্দী সন্তানকে মুক্ত করার অজুহাত নিয়ে মদীনায় গমন করবে এবং সুযোগ মতো অতর্কিতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)’র উপর তরবারী চালাবে। অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে এ কাজ করতে গিয়ে একাধিক বারের বেশী আঘাত করা হয়ত বা সম্ভব নাও হতে পারে এবং এর ফলে নাবী (সাঃ) আহত হয়েও বেঁচে যেতে পারেন। এ সব ভেবে-চিন্তে উমায়েরের তরবারী খানা তীব্র গরলে সিক্ত করা হল যাতে মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে কোন রকমে আঘাত করতে পারলেই তার প্রাণ রক্ষার ব্যাপারটি সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব হয়ে পড়বে।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মসজিদে বসে রয়েছেন। উমার (রাঃ) এবং আরও কয়েকজন সাহাবী (রাঃ) বাইরে বসে বদর যুদ্ধ সম্বন্ধে কথোপকথন করছেন, এমন সময় গলায় তরবারী ঝুলিয়ে উমায়ের মসজিদের দ্বারদেশে উপস্থিত হলো। তখন উমার (রাঃ) তাকে কুরাইশদের অন্যতম শয়তান বলে উল্লেখ করলেন। তার কুটিল চাহনি ও সন্দেহজনক হাবভাব দেখে উমার (রাঃ)-এর মনে খটকা লাগল। তিনি সকলকে সতর্ক হতে ইঙ্গিত করলেন এবং কয়েকজন আনসারকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর চারদিকে উপবেশন করার আদেশ দিয়ে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর খিদমতে হাযির হয়ে অবস্থা নিবেদন করলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একটু মধুর হাস্য করে বললেন, ‘বেশ, তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো।’ উমার (রাঃ) তখন উমায়েরের কণ্ঠ বিলম্বিত তরবারী ধরে টানতে টানতে তাকে নিয়ে মসজিদের মধ্যে উপস্থিত হলেন। এ দেখে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে ছেড়ে দিতে আদেশ করলেন এবং উমায়েরকে তাঁর কাছে আসতে বললেন। সে নিকটে এসে বলল, ‘আপনাদের প্রাতঃকাল শুভ হোক।’ নাবী (সাঃ) বললেন, ‘আল্লাহ আমাদেরকে এর চাইতে অনেক ভাল অভিবাদন দান করেছেন অর্থাৎ সালাম, যা হচ্ছে জান্নাতীদের অভিবাদন।’
তারপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) উমায়েরকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘উমায়ের, কী মনে করে এসেছো?’ সে উত্তরে বলল, ‘হুযূর এ বন্দীদের জন্যে আপনি দয়া করুন।’ তিনি বললেন, ‘এ তো খুব ভাল কথা। কিন্তু এ তরবারী এনেছো কেন?’
উমায়ের উত্তরে দিলো ‘তরবারীর কপাল পুড়ুক, এটা আপনাদের কী ক্ষতি করতে পেরেছে?’
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে পুনঃ পুনঃ সত্য বলতে নির্দেশ দিলেন, কিন্তু সে নানা প্রকার টাল বাহানা করে এ কথাই বলতে থাকল। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, “তুমি ও সাফওয়ান হাতীমে বসে নিহত কুরাইশদের (বদরের) কুয়ায় নিক্ষেপ করার বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেছিলে। অতঃপর তুমি বলেছ, আমার উপর যদি কোন ঋণ না থাকতো, এবং আমার পরিবারবর্গের ব্যাপারে আশংকা না করতাম- মদীনায় গিয়ে মুহাম্মাদকে হত্যা করতাম। তারপর সাফওয়ান আমাকে হত্যা করার বিনিময়ে তোমার ঋণ এবং পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণ করে। অথচ আল্লাহ তা’আলা আমার ও তোমার মাঝে বাধাদানকারী”।
‘উমায়ের ভয়-ভক্তি বিজড়িত কণ্ঠে ধীরে ধীরে বলতে লাগল, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আপনি আল্লাহ রাসূল। আসমানী যে কল্যাণ আপনি নিয়ে এসেছেন ও আপনার উপর যে ওহী অবতীর্ণ হতো সেগুলোকে আমরা মিথ্যা সাব্যস্ত করেছি। অতচ আপনি এমন বিষয় স্পষ্টভাবে বলে দিলেন যা আমি ও সাফওয়ান ব্যতীত আর কেউ জানেনা। অতএব আল্লাহর শপথ! আমি এক্ষণে জানতে পারলাম যে, এটা একমাত্র আল্লাহ আপনাকে জানিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার জন্যেই সমস্ত প্রশংসা যে, তিনি আমাকে সত্যের জ্যোতি সুদর্শনের সৌভাগ্য প্রদান করেছেন এবং আমাকে এক পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন। অতঃপর ‘উমায়ের সত্যের সাক্ষ্য দিলেন।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবীদেরকে সম্বোধন করে বললেন, ‘তোমাদের এ ধর্ম ভ্রাতাকে উত্তমরূপে ধর্ম ও কুরআন শিক্ষা দাও এবং তার প্রার্থিত বন্দীদের মুক্তি দাও।’
কিছুকাল পরে উমায়ের (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর খিদমতে হাযির হয়ে নিবেদন করলেন, ‘মহাত্মন! আমি আল্লাহর জ্যোতিকে নির্বাপিত এবং সত্যের সেবকদেরকে নির্যাতিত করতে সাধ্যপক্ষে চেষ্টার ত্রুটি করিনি। এরূপে যে মহাপাপ আমি সঞ্চয় করেছি, এখন তার প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই। আপনি আমাকে অনুমতি দিন, আমি মক্কায় গিয়ে যথাসাধ্য ইসলাম প্রচার করতে থাকি।’ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) উমায়ের (রাঃ)-কে অনুমতি দিলেন এবং স্পর্শমণির সংশ্রবে নতুন জীবন লাভ করে তিনি মক্কায় প্রত্যাবর্তন করলেন।
এদিকে সাফওয়ান মক্কার লোকদেরকে ইঙ্গিতে বলে রেখেছিল, ‘দেখে নিয়ো, আমি শীঘ্রই এমন এক শুভ সংবাদ দিতে পারবো যার ফলে তোমরা বদর যুদ্ধের সমস্ত শোক ভুলে যাবে।’ কিন্তু উমায়েরকে দেখে সে অবাক হয়ে রইলো। একি! এহেন দুর্ধর্ষ উমায়ের; তার উপরও মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর যাদু খেটে গেল, যাহোক, উমায়ের আর কোন দিকে দৃকপাত না করে নিজের কর্তব্য পালন করে যেতে লাগলেন। তার আদর্শে ও প্রচার মাহাত্মে মক্কার বহু সংখ্যক নরনারী ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করে ধন্য হয়েছিলেন।[1]
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড ৬৬১-৬৬৩ পৃঃ।
৩. গাযওয়ায়ে বনী ক্বাইনুক্কা’ বা ক্বাইনুক্কা’ অভিযান (غَـزْوَةُ بَنِيْ قَيْنُقَـاع):
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মদীনায় আগমনের পর ইহুদীদের সঙ্গে তিনি যে চুক্তি করেছিলেন তার দফাগুলো ইতোপূর্বে আলোচিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পূর্ণ চেষ্টা ও ইচ্ছা ছিল যে, এ চুক্তি পত্রে যে সব শর্ত আরোপিত হয়েছে সেগুলো যেন পুরোপুরিভাবে পালিত হয়। সুতরাং মুসলিমরা এমন এক পদও অগ্রসর হননি যা এ চুক্তি নামার কোন একটি অক্ষরেরও বিপরীত হয়। কিন্তু ইহুদীদের ইতিহাস বিশ্বাসঘাতকতা, হঠকারিতা এবং প্রতিজ্ঞা ভঙ্গে পরিপূর্ণ। তারা অতি তাড়াতাড়ি তাদের পূর্ব স্বভাবের দিকে ফিরে গেল। তারা মুসলিমদের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-কলহ এবং গন্ডগোল বাধাবার চেষ্টায় লেগে পড়লো। এর একটি দৃষ্টান্ত পেশ করা হচ্ছে।
ফুটনোটঃ
ইয়াহুদীদের প্রতারণার একটি নমুনা (نَمُوْذَجٌ مِّنْ مَّكِيْدَةِ الْيَهُوْدِ):
ইবনু ইসহাক্ব বর্ণনা করেছেন যে, শাস ইবনু ক্বায়স নামক একজন বৃদ্ধ ইয়াহুদী ছিল। তার পা যেন কবরে লটকানো ছিল (অত্যন্ত বৃদ্ধ ছিল)। সে মুসলিমদের প্রতি চরম শত্রুতা ও হিংসা পোষণ করত। সে একদা সাহাবীগণের (রাঃ) একটি মজলিসের পাশ দিয়ে গমন করছিল যে মজলিসে আউস ও খাযরাজ উভয় গোত্রেরই লোকেরা পরস্পর কথোপকথন করছিলেন। এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে তার অন্তর হিংসায় জ্বলে উঠল এবং তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার পথ সে অন্বেষণ করতে লাগল। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে ঐ দু’সম্প্রদায়ের মধ্যে দীর্ঘকালব্যাপী বিরাজিত শত্রুতা ইসলাম পরবর্তীকালে প্রেম প্রীতিতে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল এবং এভাবে তাদের দীর্ঘ কালের দুঃখ-দুর্দশার অবসান হয়েছিল। সমবেত জনতাকে দেখে সে বলতে লাগল এখানে বনু কাইলার সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণ একত্রিত হয়েছে। আল্লাহর কসম! এ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গের নিকট দিয়ে আমার গমন সঙ্গত হবে না। তাই সে তার এক যুবক সঙ্গীকে নির্দেশ দিল যে, সে যেন তাদের মজলিসে যায় এবং তাদের সঙ্গে বসে গিয়ে বুআস যুদ্ধ এবং তার পূর্ববর্তী অবস্থা আলোচনা করে এবং ঐ সময়ে উভয় পক্ষ হতে যে সকল কবিতা পাঠ করা হয়েছিল ওগুলোর কিছু কিছু পাঠ করে শুনিয়ে দেয়। ঐ যুবক ইহুদীকে যা যা বলা হয়েছিল ঠিক সে ঐ রূপই করল।
ঐ কবিতাগুলো শোনা মাত্রই উভয় গোত্রের লোকদের মধ্যে পুরনো হিংসা বিদ্বেষের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল এবং উভয় পক্ষের মধ্যে অনেক বাক বিতন্ডা হয়ে গেল। যুদ্ধের উন্মাদনা নিয়ে উভয় পক্ষের যোদ্ধাগণ হার্রাহ নামক স্থানে সমবেত হলেন।
এ দুঃসংবাদ পাওয়া মাত্রই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মুহাজির সাহাবীগণ (রাঃ)-কে সঙ্গে নিয়ে তাঁদের মাঝে আগমন করে বললেন,
(يا معشر المسلمين، الله الله، أبدعوي الجاهلية وأنا بين أظهركم بعد أن هداكم الله للإسلام، وأكرمكم به، وقطع به عنكم أمر الجاهلية، واستنقذكم به من الكفر وألف بين قلوبكم)
‘হে মুসলিম সম্প্রদায়! আল্লাহ ক্ষমা করুন, এ কী হচ্ছে? আমার জীবদ্দশাতেই জাহেলিয়াতের চিৎকার? অথচ আল্লাহ তোমাদেরকে মুসলিম করেছেন, ইসলামের দ্বারা জাহেলিয়াতের মূলোৎপাটন করে তোমাদিগকে কুফর হতে মুক্ত করে তোমাদের পরস্পরের হৃদয়কে এক অপরের সাথে বেঁধে দিয়েছেন।’
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর এ কথা শুনে নিজেরা নিজেদেরকে সামলিয়ে নিলেন এবং অনুধাবন করলেন যে, এটা শয়তানের প্ররোচনা ছাড়া আর কিছুই নয়। তারপর তাঁরা পরস্পর গলায়-গলায় মিলে ক্রন্দন এবং তওবাহ করলেন। এভাবে শাস ইবনু কায়েসের প্রতি হিংসার আগুন নির্বাপিত হল।[1]
এটা হচ্ছে কুচক্রীপনা ও গন্ডগোলের একটা নমুনা যা ইহুদীরা মুসলিমদের মধ্যে সৃষ্টি করার চেষ্টা করতে থাকত। এ কাজের জন্যে তারা বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করত এবং মিথ্যা রটনা রটাতে থাকত। তারা সকালে মুসলিম হয়ে সন্ধ্যায় কাফির হয়ে যেত এবং এভাবে সরল প্রাণ মুসলিমদের অন্তরে সন্দেহের বীজ বপন করার চেষ্টায় লেগে থাকত। কোন মুসলমানের সাথে তাদের অর্থের সম্পর্ক থাকলে তারা তার জীবিকার পথ সংকীর্ণ করে দিত। আর তাদের উপর মুসলিমদের ঋণ থাকলে তারা তাদের ঋণ পরিশোধ করত না, বরং অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করত এবং বলত তোমাদের ঋণ তো আমাদের উপর ঐ সময় ছিল যখন তোমরা তোমাদের পূর্বপুরুষদের ধর্মের উপর ছিলে। কিন্তু এখন তোমরা ঐ ধর্ম যখন পরিবর্তন করেছো তখন আমাদের নিকট হতে ঋণ আদায়ের তোমাদের কোন পথ নেই।[2]
প্রকাশ থাকে যে, ইহুদীরা এ সব কার্যকলাপ বদর যুদ্ধের পূর্বেই শুরু করেছিল এবং তাদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি ভঙ্গ করার সূচনা করে ফেলেছিল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও সাহাবীদের অবস্থা এই ছিল যে, তারা ইহুদীদের হিদায়াত প্রাপ্তির আশা করে তাদের এ সব কার্যকলাপের উপর ধৈর্য ধারণ করে চলছিলেন। এছাড়া এটাও উদ্দেশ্য ছিল যে, যেন ঐ অঞ্চলের শান্তি ও নিরাপত্তার কোন ব্যাঘাত না ঘটে।
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৫৫৫-৫৫৬ পৃঃ।
[2] সূরাহ আল-ইমরান প্রভৃতির তাফসীর, মুফাসসিরগণ ইহুদীদের এ সব কার্যকলাপ বর্ণনা দিয়েছেন।
বনু ক্বাইনুক্কা’র অঙ্গীকার ভঙ্গ (بَنُوْ قَينُقَاع يَنْقُضُوْنَ الْعَهْدَ):
ইহুদীরা যখন দেখল যে, আল্লাহ তা‘আলা বদর প্রান্তরে মুসলিমগণকে চরমভাবে সাহায্য করে তাদেরকে মর্যাদা মন্ডিত করলেন এবং দূরবর্তী নিকটবর্তী প্রতিটি স্থানের বাসিন্দাদের অন্তরে তাদের প্রভাব প্রতিফলিত হল, তখন তাদের প্রতি শত্রুতা ও হিংসায় তারা ফেটে পড়ল। প্রকাশ্যভাবে তারা শত্রুতার ভাব প্রদর্শন করতে লাগল এবং খোলাখুলিভাবে তারা বিদ্রোহ ঘোষণা করল ও দুঃখ কষ্ট দিবার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল।
তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় হিংসুটে ও প্রতিহিংসাপরায়ন ছিল কাব বিন আশরাফ, যার আলোচনা সামনে আসছে। অনুরূপভাবে ইহুদীদের তিনটি গোত্রের মধ্যে সর্বাধিক হিংসুটে ছিল বনু ক্বাইনুক্কা’ গোত্রটি। এরা সকলেই মদীনার মধ্যে অবস্থান করত এবং তাদের মহল্লাটি তাদের নামেই কথিত ছিল। পেশার দিকে দিয়ে তারা ছিল স্বর্ণকার, কর্মকার ও পাত্র নির্মাতা। এ কারণে ওদের প্রত্যেকের নিকটে বহুল পরিমাণে সমরাস্ত্র মওজুদ ছিল। তাদের যোদ্ধার সংখ্যা সাতশত। তারা ছিল মদীনার সবচেয়ে বাহাদুর ইহুদী গোষ্ঠী। তাদের সর্বপ্রথম অঙ্গীকার ভঙ্গের বিস্তারিত বিবরণ হচ্ছে নিম্নরূপ :
আল্লাহ তা‘আলা যখন বদর প্রান্তরে মুসলিমগণকে বিজয় দান করলেন তখন তাদের বিরুদ্ধাচরণ চরমে উঠল। তারা তাদের প্রতিহিংসা, অন্যায়াচরণ এবং ঝগড়া বাধানোর কার্যকলাপের সীমা আরো বাড়িয়ে দিল। সুতরাং যে মুসলিমই তাদের বাজারে যেতেন তাঁরই তারা ঠাট্টা তামাশা এবং বিদ্রূপাত্মক আচরণ শুরু করে দিত এবং নানাভাবে কষ্ট দিত। এমন কি মুসলিম মহিলাদের নিয়েও তারা উপহাস ও ঠাট্টা বিদ্রূপ করতে কসুর করত না।
এভাবে পরিস্থিতির যখন চরমে পৌঁছল এবং তাদের ঔদ্ধত্যপনা বেড়েই চলল তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্বয়ং বনু ক্বাইনুক্কা’র বাজারে উপস্থিত হলেন এবং ইহুদীদেরকে ডেকে নানা প্রকার হিতোপদেশ প্রদান করলেন। ইমাম আবূ দাউদ এবং অন্যান্যরা ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বদর প্রান্তরে কুরাইশদেরকে পরাজিত করে যখন মদীনায় আগমন করলেন তখন বনু ক্বাইনুক্কা’র বাজারে ইহুদীদের একত্রিত করে বললেন, ‘হে ইহুদী সমাজ, তোমরা আনুগত্য স্বীকার কর, অন্যথায় কুরাইশদের মতো তোমাদেরকেও বিপন্ন হতে হবে।’
কিন্তু তারা তাঁর উপদেশ গ্রহণ করল না। চরম ধৃষ্টতা সহকারে তারা বলতে লাগল, ‘হে মুহাম্মাদ কতিপয় আনাড়ী কুরাইশকে হত্যা করেছ বলে গর্বিত হয়ো না। যুদ্ধ সম্বন্ধে তারা একেবারে অনভিজ্ঞ ছিল। কিন্তু আমাদের সঙ্গে যখন যুদ্ধ হবে তখন বুঝবে যে, ব্যাপারটি কত কঠিন।’ তাদের এ সবের জবাবে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
{قُل لِّلَّذِيْنَ كَفَرُوْا سَتُغْلَبُوْنَ وَتُحْشَرُوْنَ إِلٰى جَهَنَّمَ وَبِئْسَ الْمِهَادُ قَدْ كَانَ لَكُمْ آيَةٌ فِيْ فِئَتَيْنِ الْتَقَتَا فِئَةٌ تُقَاتِلُ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ وَأُخْرَى كَافِرَةٌ يَرَوْنَهُم مِّثْلَيْهِمْ رَأْيَ الْعَيْنِ وَاللهُ يُؤَيِّدُ بِنَصْرِهِ مَن يَشَاءإِنَّ فِيْ ذٰلِكَ لَعِبْرَةً لَّأُوْلِي الأَبْصَارِ} [آل عمران 12، 13]
‘‘যারা কুফরী করে তাদেরকে বলে দাও, ‘তোমরা অচিরেই পরাজিত হবে আর তোমাদেরকে জাহান্নামের দিকে হাঁকানো হবে, ওটা কতই না নিকৃষ্ট আবাসস্থান’! ১৩. তোমাদের জন্য অবশ্যই নিদর্শন আছে সেই দু’দল সৈন্যের মধ্যে যারা পরস্পর প্রতিদ্বনদ্বীরূপে দাঁড়িয়েছিল (বাদ্র প্রান্তরে)। একদল আল্লাহর পথে যুদ্ধ করেছিল এবং অপরদল ছিল কাফির, কাফিররা মুসলিমগণকে প্রকাশ্য চোখে দ্বিগুণ দেখছিল। আল্লাহ যাকে ইচ্ছে স্বীয় সাহায্যের দ্বারা শক্তিশালী করে থাকেন, নিশ্চয়ই এতে দৃষ্টিমানদের জন্য শিক্ষা রয়েছে।’ (আলু-‘ইমরান ৩ : ১২-১৩)
মোট কথা, বনু ক্বাইনুক্কা’ যে জবাব দিয়েছিল তাতে পরিস্কারভাবে যুদ্ধের ঘোষণাই ছিল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ক্রোধ সম্বরণ করে ধৈর্য্য ধারণ করেন। অন্যান্য মুসলিমগণও ধৈর্য্য ধারণ করে পরবর্তী অবস্থার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।
এদিকে ঐ হিতোপদেশের পর বনু ক্বাইনুক্কা’র ইহুদীগণের ঔদ্ধত্য আরও বেড়ে যায় এবং অল্প দিনের মধ্যেই তারা মদীনাতে হাঙ্গামা শুরু করে দেয়। এর ফলশ্রুতিতে তারা নিজের কবর নিজের হাতেই খনন করে এবং নিজেদের জীবন বিপন্ন করে তোলে।
আবূ আওন থেকে ইবনু হিশাম বর্ণনা করেছেন যে, এ সময়ে জনৈকা মুসলিম মহিলা বানুক্বাইনুক্কা’র বাজারে দুধ বিক্রী করে বিশেষ কোন প্রয়োজনে এক ইহুদী স্বর্ণকারের কাছে গিয়ে বসে পড়েন। কয়েকজন দুর্বৃত্ত ইহুদী তাঁর মুখের অবগুণ্ঠন খোলাবার অপচেষ্টা করে, তাতে মহিলাটি অস্বীকার করেন। এ স্বর্ণকার গোপনে মহিলাটির পরিহিত বস্ত্রের এক প্রান্ত তার পিঠের উপরে গিরা দিয়েছিল, তিনি তা বুঝতেই পারলেন না। তিনি উঠতে গিয়ে বিবস্ত্র হয়ে পড়লেন। এ ভদ্র মহিলাকে বিবস্ত্র অবস্থায় প্রত্যক্ষ করে নর পিশাচের দল হো হো করে হাত তালি দিতে থাকল। মহিলাটি ক্ষোভে ও লজ্জায় মৃত প্রায় হয়ে আর্তনাদ করতে লাগলেন। তা শুনে জনৈক মুসলিম ঐ স্বর্ণকারকে আক্রমণ করে হত্যা করেন। প্রত্যুত্তরে ইহুদীগণ মুসলিমটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হত্যা করে।
এরপর নিহত মুসলিমটির পরিবার বর্গ চিৎকার করে ইহুদীদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের নিকট ফরিয়াদ করলেন। এর ফলে মুসলিম ও বনু ক্বাইনুক্কা’র ইহুদীদের মধ্যে সংঘাত বেধে গেল।[1]
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ২য় খন্ড ৪৭ পৃঃ।
অবরোধ, আত্মসমর্পণ ও নির্বাসন (الحِصَارُ ثُمَّ التَّسْلِيْمُ ثُمَّ الجلَاءُ):
এ ঘটনার পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। তিনি মদীনার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব আবূ লুবাবাহ ইবনু আব্দুল মুনযির (রাঃ)-এর উপর অর্পণ করে স্বয়ং হামযাহ ইবনু আব্দুল মুত্তালিব (রাঃ)-এর হাতে মুসলিমদের পতাকা প্রদান করে আল্লাহর সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে বনু ক্বাইনুক্কা’র দিকে ধাবিত হলেন। ইহুদীরা তাদেরকে দেখামাত্র দূর্গের মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করে দূর্গের দ্বারগুলো উত্তমরূপে বন্ধ করে দিলো। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কঠিনভাবে তাদের দূর্গ অবরোধ করলেন। এ দিনটি ছিল শুক্রবার, হিজরী ২য় সনের শাওয়াল মাসের ১৫ তারীখ। ১৫ দিন পর্যন্ত অর্থাৎ যুলকাদার নতুন চাঁদ উদয় হওয়া অবধি অবরোধ জারী থাকল। তারপর আল্লাহ তা‘আলা ইহুদীদের অন্তরে ভীতি ও সন্ত্রস্তভাব সৃষ্টি করলেন এবং তাঁর নীতি এটাই যে, যখন তিনি কোন সম্প্রদায়কে পরাজিত ও লাঞ্ছিত করার ইচ্ছা করেন তখন তিনি তাদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার করে থাকেন। অবশেষে বনু ক্বাইনুক্কা’ আত্মসমর্পণ করল এবং বলল যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের জান মাল, সন্তান-সন্ততি এবং নারীদের ব্যাপারে যা ফায়সালা করবেন তারা তা মেনে নিবে। তারপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)’র নির্দেশক্রমে তাদের সকলকে বেঁধে নেয়া হয়।
কিন্তু এ স্থানে আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই তার কপট চাল চালবার সুযোগ গ্রহণ করল। সে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে অত্যন্ত অনুনয় বিনয় করে বলল, ‘হে মুহাম্মাদ (সাঃ) আপনি এদের প্রতি সদয় ব্যবহার করুন।’ প্রকাশ থাকে যে, বনু ক্বাইনুক্কা’ গোত্র খাযরাজ গোত্রের মিত্র ছিল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শনের ব্যাপারে বিলম্ব করলেন। সে পীড়াপীড়ি করতে থাকল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার হতে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। কিন্তু শেষে সে তাঁর (সাঃ) জামার বুকের অংশবিশেষ ধরে ফেলল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বিশেষ বিরক্তি ও ক্রোধ সহকারে পুনঃপুনঃ তাকে ছেড়ে দিতে বললেন, কিন্তু এতদ্সত্ত্বেও সে পুনঃ পুনঃ উত্তর করতে লাগল ‘আমি কোন মতেই ছাড়বো না যে পর্যন্ত না আপনি তাদের উপর দয়াপরবশ হন। চারশ জন খোলা দেহের যুবক এবং তিনশ জন বর্মপরিহিত যুবককে আপনি একই দিনের সকালে কেটে ফেলবেন, অথচ তারা আমাকে কঠিন বিপদ থেকে বাঁচিয়েছিল। আল্লাহর কসম! আমি কালচক্রের বিপদের আশঙ্কা করছি।
অবশেষে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের ধন মাল হস্তগত করলেন যেগুলোর মধ্যে তিনটি কামান, দুটি বর্ম, তিনটি তরবারী এবং তিনটি বর্শা নিজের জন্যে বেছে নেন এবং গনীমতের মালের এক পঞ্চমাংশ বের করেন। মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামা (রাঃ) গণীমত একত্রিত করার কাজ সম্পাদন করেন।[1]
ফুটনোটঃ[1] যা’দুল মাআদ ২য় খন্ড ৭১ ও ৯১ পৃঃ এবং ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৪৭-৪৯ পৃঃ।
৪. গাযওয়ায়ে সাভীক বা ছাতুর যু্দ্ধ (غَزْوَةُ السَّوِيْقِ):
এদিকে সাফওয়ান ইবনু উমাইয়া, ইহুদী এবং মুনাফিক্বরা নিজ নিজ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল, অপরদিকে আবূ সুফইয়ানও এমন ব্যবস্থাপনা কার্যকরী করার সুযোগে ছিলেন যাতে কষ্ট কম হয় আর ফল ভাল হয়। তিনি এ ব্যবস্থাপনা তাড়াতাড়ি কার্যকরী করে স্বীয় কওমের মর্যাদা রক্ষা এবং তাদের শক্তি প্রকাশ করার ইচ্ছা করছিলেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, অপবিত্রতার কারণে তাঁর মস্তক পানি স্পর্শ করবে না যে পর্যন্ত না তিনি মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর সঙ্গে যুদ্ধ করবেন। সুতরাং তিনি তাঁর এ প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করার জন্যে দুশ জন অশ্বারোহী নিয়ে যাত্রা শুরু করেন এবং কানাত উপত্যকার শেষে অবস্থিত নীব নামক এক পর্বত প্রান্তে তাঁবু স্থাপন করেন। মদীনা হতে এ জায়গাটির দূরত্ব প্রায় বারো মাইল। মদীনার উপর খোলাখুলিভাবে আক্রমণ করার সাহস তাঁর ছিল না বলে তিনি এমন এক ব্যবস্থা কার্যকরী করলেন যেটাকে ডাকাতি বলা যেতে পারে। এর বিস্তারিত বিবরণ হল, তিনি রাত্রির অন্ধকারে মদীনার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে প্রবেশ করেন এবং হোয়াই ইবনু আখতাবের নিকট গিয়ে তার দরজা খুলিয়ে নেন। কিন্তু হোয়াই পরিণাম চিন্তা করে তাঁকে তার বাড়ীতে প্রবেশ করার অনুমতি দিতে অস্বীকার করে। আবূ সুফইয়ান তখন সেখান হতে ফিরে গিয়ে বনু নাযীরের সালাম ইবনু মুশকিম নামক আর এক সর্দারের নিকট উপস্থিত হন। সে বনু নাযীর গোত্রের কোষাধ্যক্ষ ছিল। আবূ সুফইয়ান তার বাড়ির ভিতরে প্রবেশের অনুমতি চাইলে সে অনুমতি প্রদান করে। সে তার অতিথি সেবাও করে। খাদ্য ছাড়াও মদ্যও পান করায় এবং লোকদের গোপনীয় অবস্থা সম্পর্কেও অবহিত করে। রাত্রির শেষভাগে আবূ সুফইয়ান সেখান হতে বের হয়ে নিজের সঙ্গীদের সাথে মিলিত হন এবং একটি দল পাঠিয়ে মদীনার পার্শ্ববর্তী আরীয নামক একটি জায়গার উপর হামলা করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেন। ঐ দলটি তথাকার কিছু খেজুরের গাছ কর্তন করে এবং জ্বালিয়ে দেয়, আর একজন আনসারী ও তার মিত্রকে তাদের জমিতে পেয়ে হত্যা করে দেয় এবং দ্রুত বেগে পলায়ন করে মক্কার পথে ফিরে যায়।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এ সংবাদ পাওয়া মাত্রই দ্রুত গতিতে আবূ সুফইয়ান এবং তার সঙ্গীদের পশ্চাদ্ধাবন করেন, কিন্তু তারা আরো দ্রুত গতিতে পলায়ন করে। সুতরাং তাদেরকে ধরা সম্ভবপর হয়নি। কিন্তু তারা বোঝা হালকা করার জন্যে ছাতু, পাথেয় এবং বহু আসবাব পত্র ফেলে দেয় যা মুসলিমদের হস্তগত হয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কারকুরাতুল কুদর পর্যন্ত পশ্চাদ্ধাবন করে ফিরে আসেন। ফিরবার পথে তাঁরা ছাতু ইত্যাদি বোঝাই করে নিয়ে আসেন। এ অভিযানের নাম গাযওয়ায়ে সাভীক রাখা হয়। কারণ আরবী ভাষায় ছাতুকে সাভীক বলা হয়। এ যুদ্ধ বদর যুদ্ধের মাত্র দুমাস পর হিজরী ২য় সনের যুল হিজ্জাহ মাসে সংঘটিত হয়।[1]
এ যুদ্ধ কালীন সময়ে মদীনায় ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব আবূ লুবাবাহ ইবনু আব্দুল মুনযির (রাঃ)-এর উপর অর্পণ করা হয়।
ফুটনোটঃ[1] যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৯০-৯১ পৃঃ, ইবনে হিশাম ২য় খন্ড ৪৪-৪৫ পৃঃ।
৫. গাযওয়ায়ে যূ ‘আমর (غَزْوَةُ ذِيْ أَمْرٍ):
বদর ও উহুদ মধ্যবর্তী সময়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নেতৃত্বাধীনে এটাই সবচেয়ে বড় সামরিক অভিযান। এটা তৃতীয় হিজরীর মুহরম মাসে সংঘটিত হয়।
এ অভিযানের কারণ : মদীনার গোয়েন্দা বাহিনী রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে খবর দেন যে, বনু সা‘লাবাহ ও মুহারিব গোত্রের এক বিরাট বাহিনী মদীনার উপর আক্রমণ করার জন্য একত্রিত হচ্ছে। এ খবর শোনা মাত্রই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মুসলিমগণকে প্রস্তুতির নির্দেশ দেন এবং আরোহী ও পদাতিক মিলে মোট চারশ জন সৈন্যের বাহিনী নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। উসমান ইবনু আফফান (রাঃ)-কে মদীনায় নিজের স্থলাভিষিক্ত করেন।
পথে সাহাবীগণ বনু সা‘লাবাহ গোত্রের জাববার নামক এক ব্যক্তিকে পাকড়াও করে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর খিদমতে হাযির করেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে ইসলামের দাওয়াত দেন এবং সে ইসলাম গ্রহণ করে। এরপর তিনি তাকে বিলাল (রাঃ)-এর বন্ধুত্বে দিয়ে দেন এবং সে পথ প্রদর্শক রূপে মুসলিমগণকে শত্রুদের অবস্থানস্থল পর্যন্ত রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যায়।
এদিকে শত্রুরা মদীনার সৈন্য বাহিনীর আগমনের খবর পেয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে এবং আশে পাশের পাহাড় গুলোতে লুকিয়ে যায়। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখেন এবং সেনাবাহিনী সহ ঐ জায়গা পর্যন্ত গমন করেন যেটাকে শত্রুরা নিজেদের দলের একত্রিত হওয়ার স্থান নির্বাচিত করেছিল। এটা ছিল আসলে একটি প্রস্রবণ যা যূ ‘আমর নামে পরিচিত ছিল। বেদুইনদের উপর প্রভাব প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত এবং মুসলিমদের শক্তি সামর্থ্য সম্পর্কে তাদের ওয়াকিবহাল করানোর জন্য তৃতীয় হিজরীর পূর্ণ সফর মাসটি তিনি সেখানে অতিবাহিত করেন। তারপর মদীনায় ফিরে আসেন।[1]
ফুটনোটঃ[1] ইবুন হিশাম ২য় খন্ড ৪৬ পৃঃ, যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৯১ পৃঃ, কথিত আছে যে, দুা’সুর অথবা গাওরসি মুহারিবী এ যুদ্ধেই নাবী (সাঃ)-কে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সঠিক কথা হচ্ছে এটা অন্য এক যুদ্ধের ঘটনা। সহীহুল বুখারীর ২য় খন্ডের ৫৯৩ পৃঃ।
৬. কা‘ব ইবনু আশরাফের হত্যা (قَتْلُ كَعْبِ بْنِ الْأَشْرَفِ):
এ ছিল ইহুদীদের মধ্যে এমন এক ব্যক্তি, যে ইসলাম ও মুসলিমদের প্রতি অত্যন্ত শত্রুতা ও হিংসা পোষণ করত। সে নাবী (সাঃ)-কে কষ্ট দিত এবং তাঁর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যভাবে যুদ্ধের হুমকি দিয়ে বেড়াত। ‘তাই’ গোত্রের শাখা বনু নাবাহানের সাথে তার সম্পর্ক ছিল। আর তার মাতা বনু নাযীর গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সে ছিল বড় ধনী ও পুঁজিপতি। আরবে তার সৌন্দর্য্যের খ্যাতি ছিল। সে একজন খ্যাতনামা কবিও ছিল। তার দূর্গটি মদীনার দক্ষিণে বনু নাযীর গোত্রের আবাদী ভূমির পিছনে অবস্থিত ছিল।
বদর যুদ্ধে মুসলিমদের বিজয় লাভ এবং নেতৃস্থানীয় কুরাইশদের নিহত হওয়ার প্রথম খবর শুনে সে অকস্মাৎ বলে ওঠে ‘সত্যিই কি ঘটনা এটাই? এরা ছিল আরবের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি এবং জনগণের বাদশাহ। যদি মুহাম্মাদ (সাঃ) তাদেরকে হত্যা করে থাকে তবে পৃথিবীর অভ্যন্তর ভাগ ওর উপরিভাগ হতে উত্তম হবে অর্থাৎ আমাদের বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই উত্তম হবে।
তারপর যখন সে নিশ্চিতরূপে জানতে পারল যে, এটা সত্য খবর তখন আল্লাহর এ শত্রু রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এবং মুসলিমদের নিন্দা এবং ইসলামের শত্রুদের প্রশংসা করতে শুরু করল এবং তাদেরকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে লাগল। কিন্তু এতেও তার বিদ্বেষ বহ্ণি প্রশমিত না হওয়ায় সে অশ্বে আরোহণ করে কুরাইশদের নিকট গমন করল এবং মুত্তালিব ইবনু আবী অদাআ সাহমীর অতিথি হল। তারপর সে কুরাইশদের মর্যাদাবোধ উত্তেজিত করতে, তাদের প্রতিশোধাগ্নি প্রজ্জ্বলিত করতে এবং তাদেরকে নাবী (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্যে উৎসাহিত করতে কবিতা বলে বলে ঐ কুরাইশ নেতাদের জন্য বিলাপ করতে লাগল যাদের বদর প্রান্তরে হত্যা করার পর কূপে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। মক্কায় তার অবস্থান কালে আবূ সুফইয়ান ও মুশরিকরা তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার নিকট আমাদের দ্বীন বেশী পছন্দনীয়, না মুহাম্মাদ (সাঃ)- ও তাঁর সঙ্গীদের দ্বীন? আর উভয় দলের মধ্যে কোন্ দলটি বেশী হিদায়াত প্রাপ্ত?’ উত্তরে কা‘ব ইবনু আশরাফ বলল ‘তোমরাই তাদের চেয়ে বেশী হিদায়াত প্রাপ্ত এবং উত্তম। এ ব্যাপারেই আল্লাহ তা‘আলা নিম্নের আয়াত নাযিল করেন
{أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِيْنَ أُوْتُوْا نَصِيْبًا مِّنَ الْكِتَابِ يُؤْمِنُوْنَ بِالْجِبْتِ وَالطَّاغُوْتِ وَيَقُوْلُوْنَ لِلَّذِيْنَ كَفَرُوْا هَؤُلاء أَهْدَى مِنَ الَّذِيْنَ آمَنُوْا سَبِيْلاً} [ النساء: 51].
‘‘যাদেরকে কিতাবের জ্ঞানের একাংশ প্রদত্ত হয়েছে, সেই লোকেদের প্রতি তুমি কি লক্ষ্য করনি, তারা অমূলক যাদু, প্রতিমা ও তাগূতের প্রতি বিশ্বাস করে এবং কাফিরদের সম্বন্ধে বলে যে, তারা মু’মিনগণের তুলনায় অধিক সঠিক পথে রয়েছে।’ (আন-নিসা ৪ : ৫১)
কা‘ব ইবনু আশরাফ এ সব কিছু করে মদীনায় ফিরে এসে সাহাবায়ে কেরামের (রাঃ) স্ত্রীদের ব্যাপারে বাজে কবিতা বলতে শুরু করে এবং কট্যূক্তির মাধ্যমে তাঁদেরকে ভীষণ কষ্ট দিতে থাকে।
তা এ দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘কে এমন আছে যে, কা‘ব ইবনু আশরাফকে হত্যা করতে পারে? কেননা, সে আল্লাহ এবং তার রাসূল (সাঃ)-কে কষ্ট দিয়েছে এবং দিচ্ছে।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এ প্রশ্নের জবাবে মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামা (রাঃ), আব্বাদ ইবনু বিশর (রাঃ), আবূ নায়িলাহ (রাঃ) তার নাম সিলকান বিন সালামাহ যিনি ছিলেন কা’বের দুধ ভাই, হারিস ইবনু আউস (রাঃ) এবং আবূ আবস ইবনু জাবর (রাঃ) এ খিদমতের জন্যে এগিয়ে আসেন। এ সংক্ষিপ্ত বাহিনীর নেতা ছিলেন মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাঃ)।
কা‘ব ইবনু আশরাফের হত্যার ব্যাপারে যে সব বর্ণনা রয়েছে ওগুলোর সারমর্ম হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন বললেন, ‘কা‘ব ইবনু আশরাফকে কে হত্যা করতে পারে? সে আল্লাহ এবং তার রাসূল্লাহ (সাঃ)-কে কষ্ট দিয়েছে।’ তখন মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাঃ) উঠে আরয করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আমি প্রস্তুত আছি। আমি তাকে হত্যা করব এটা কি আপনি চান?’ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জবাবে বললেন, ‘হ্যাঁ’। তিনি বললেন, ‘তাহলে আপনি আমাকে অস্বাভাবিক কিছু বলার অনুমতি দিচ্ছেন কি?’
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) উত্তরে বলেন, ‘হ্যাঁ’ তুমি বলতে পার।’
এরপর মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামা (রাঃ) কা‘ব ইবনু আশরাফির নিকট গমন করলেন এবং তাকে বললেন, ‘এ ব্যক্তি মুহাম্মাদ (সাঃ) আমাদের কাছে সাদকাহ চাচ্ছে এবং প্রকৃত কথা হচ্ছে সে আমাদেরকে কষ্টের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
একথা শুনে কা‘ব বলল, ‘আল্লাহর কসম! তোমাদের আরো বহু দুর্ভোগ পোহাতে হবে।’
মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাঃ) বললেন, ‘আমরা যখন তার অনুসারী হয়েই গেছি তখন হঠাৎ করে এখনই তার সঙ্গ ত্যাগ করা উচিত মনে করছি না। পরিণামে কী হয় দেখাই যাক। আচ্ছা, আমি আপনার কাছে এক অসাক বা দু’ অসাক (এক অসাক =১৫০ কেজি) খাদ্য শস্যের আবেদন করছি?’
কা‘ব বলল ‘আমার কাছে কিছু বন্ধক রাখো।’
মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামা (রাঃ) বললেন, ‘আপনি কী জিনিস বন্ধক রাখা পছন্দ করেন?’
কা‘ব উত্তর দিলো, ‘তোমাদের নারীদেরকে আমার নিকট বন্ধক রাখো।’
মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাঃ) বললেন, ‘আপনি আরবের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সুদর্শন পুরুষ, সুতরাং আমরা আমাদের নারীদেরকে কিরূপে আপনার নিকট বন্ধক রাখতে পারি?’
সে বলল, ‘তাহলে তোমাদের পুত্রদেরকে বন্ধক রাখো।’
মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাঃ) বললেন, ‘আমরা আমাদের পুত্রদেরকে কী করে বন্ধক রাখতে পারি? এরূপ করলে তাদেরকে গালি দেয়া হবে যে, এক অসাক বা দু অসাক খাদ্যের বিনিময়ে তাদেরকে বন্ধক রাখা হয়েছিল। এটা আমাদের জন্যে খুবই লজ্জার কথা হবে। আমরা অবশ্য আপনার কাছে অস্ত্র বন্ধক রাখতে পারি।’
এরপর দুজনের মধ্যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো যে, মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাঃ) অস্ত্র নিয়ে তার কাছে আসবেন। এদিকে আবূ নায়িলাও (রাঃ) অগ্রসর হলেন অর্থাৎ কা‘ব ইবনু আশরাফের কাছে আসলেন। কিছুক্ষণ পর্যন্ত উভয়ের মধ্যে বিভিন্ন দিকের কবিতা শোনা ও শোনানোর কাজ চললো। তারপর আবূ নায়িলা (রাঃ) বললেন, ‘ভাই ইবনু আশরাফ! আমি এক প্রয়োজনে এসেছি। এটা আপনাকে আমি বলতি চাচ্ছি এই শর্তে যে, আপনি কারো কাছে এটা প্রকাশ করবেন না।’ কা‘ব বলল, ‘ঠিক আছে, আমি তাই করব।’
আবূ নায়িলাহ (রাঃ) বললেন, ‘এ ব্যক্তির (মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর) আগমন তো আমাদের জন্যে পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গোটা আরব আমাদের শত্রু হয়ে গেছে। আমাদের পথ ঘাট বন্ধ হয়ে গেছে, পরিবার পরিজন ধ্বংস হতে চলেছে। সন্তান-সন্ততির কষ্টে আমরা চৌচির হচ্ছি।’ এরপর তিনি ঐ ধরণেরই কিছু আলাপ আলোচনা করলেন, যেমন মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামা করেছিলেন। কথোপকথনের সময় আবূ নায়িলাহ (রাঃ) এ কথাও বলেছিলেন আমার কয়েকজন বন্ধু বান্ধব রয়েছে যাদের চিন্তাধারা ঠিক আমারই মত। আমি তাদেরকেও আপনার কাছে নিয়ে আসতে চাচ্ছি। আপনি তাদের হাতেও কিছু বিক্রি করুন এবং তাদের উপর অনুগ্রহ করুন।’
মুহাম্মাদ ইবনু মাসালামা (রাঃ) এবং আবূ নায়িলাহ (রাঃ) নিজ নিজ কথোপকথনের মাধ্যমে নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনে সফলকাম হন। কেননা, ঐ কথোপকথনের পরে অস্ত্রশস্ত্র বন্ধু বান্ধবসহ এ দুজনের আগমনের কারণে কা‘ব ইবনু আশরাফির সতর্ক হয়ে যাওয়ার কথা নয়। তারপর হিজরী ৩য় সনের রবিউল আওয়াল মাসের ১৪ তারীখে চাঁদনী রাতে এ ক্ষুদ্র বাহিনী রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট একত্রিত হন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বাকীয়ে গারকাদ পর্যন্ত তাঁদের অনুসরণ করেন। তারপর বলেন, ‘আল্লাহর নাম নিয়ে যাও। বিসমিল্লাহ। হে আল্লাহ! এদেরকে সাহায্য করুন।’ তারপর তিনি নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন। তারপর বাড়িতে তিনি সালাত ও মুনাজাতে লিপ্ত হয়ে পড়েন।
এদিকে এ বাহিনী কা‘ব ইবনু আশরাফির দুর্গের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাওয়ার পর আবূ নায়িলাহ (রাঃ) উচ্চৈঃস্বরে ডাক দেন। ডাক শুনে কা‘ব তাদের নিকট আসার জন্যে উঠলে তার স্ত্রী- যে ছিল নববধূ- তাকে বলল, ‘এ সময় কোথায় যাচ্ছেন? আমি এমন শব্দ শুনতে পাচ্ছি যে, যেন তা হতে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে।’
স্ত্রীর এ কথা শুনে কা‘ব বলল, ‘এটা তো আমার ভাই মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামা এবং দুধ ভাই আবূ নায়িলাহ। সম্ভ্রান্ত লোককে যদি তরবারী যুদ্ধের দিকে আহবান করা হয় তবে সে ডাকেও সে সাড়া দিবে।’ এরপর সে বাইরে আসল। তার দেহ থেকে সুগন্ধি ছুটছিল এবং তার মাথায় খোশবুর ঢেউ খেলছিল।
আবূ নায়িলাহ (রাঃ) তাঁর সঙ্গীদেরকে বলে রেখেছিলেন। ‘যখন সে আসবে তখন আমি তার চুল ধরে শুঁকবো। যখন তোমরা দেখবে যে, আমি তার মাথা ধরে তাকে ক্ষমতার মধ্যে পেয়ে গেছি তখন ঐ সুযোগে তোমরা তাকে হত্যা করবে।’
সুতরাং যখন কা‘ব আসলো তখন দীর্ঘক্ষণ ধরে আলাপ আলোচনা ও গল্পগুজব চললো। তারপর আবূ নায়িলাহ (রাঃ) বললেন, ‘ইবনু আশরাফ! আজুয ঘাঁটি পর্যন্ত চলুন। সেখানে আজ রাতে কথাবার্তা বলাবলি হবে। সে বলল, ‘তোমাদের ইচ্ছা হলে চলো।’ তারপর তাদের সাথে সে চলল।
পথের মধ্যে আবূ নায়িলাহ (রাঃ) তাকে বললেন, ‘আজকের মতো এমন উত্তম সুগন্ধির সাথে আপনার পরিচয় নেই।’ একথা শুনে কা’বের বক্ষ গর্বে ফুলে উঠল। সে বলল, ‘আমার পাশে আরবের সর্বাপেক্ষা অধিক সুগন্ধি ব্যবহারকারিণী মহিলা রয়েছে।’ আবূ নায়িলাহ (রাঃ) বললেন, ‘আপনার মাথাটি একটু শুঁকবো এ অনুমতি আছে কি?’ সে উত্তরে বলল ‘হ্যা, হ্যাঁ’। আবূ নায়িলাহ (রাঃ) তখন কা‘বের মাথায় হাত রাখলেন। তারপর তিনি নিজেও তার মাথা শুঁকলেন এবং সঙ্গীদেরকেও শুঁকালেন। কিছুদূর যাওয়ার পর আবূ নায়িলাহ (রাঃ) বললেন, ‘ভাই আর একবার শুঁকতে পারি কি?’ কা‘ব উত্তর দিল ‘হ্যাঁ হ্যাঁ। কোন আপত্তি নেই।’ আবূ নায়িলাহ (রাঃ) আবার শুঁকলেন। সুতরাং সে নিশ্চিত হয়ে গেল।
আরো কিছুদূর চলার পর আবূ নায়িলাহ (রাঃ) পুনরায় বললেন, ‘ভাই আর একবার শুঁকবো কি?’ এবারও কা‘ব উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ, শুঁকতে পারো।
এবার আবূ নায়িলাহ (রাঃ) তার মাথায় হাত রেখে ভালভাবে মাথা ধরে নিলেন এবং সঙ্গীদেরকে বললেন, ‘আললাহর এ দুশমনকে হত্যা করে ফেল।’ ইতোমধ্যেই তার উপর কয়েকটি তরবারী পতিত হলো, কিন্তু কাজ হলো না। এ দেখে মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামা (রাঃ) নিজের কোদাল ব্যবহার করে তার দুনিয়ার স্বাদ চিরতরে মিটিয়ে দিলেন। আক্রমণের সময় সে এত জোরে চিৎকার করেছিল যে, চতুর্দিকে তার চিৎকারের শব্দ পৌঁছে গিয়েছিল এবং এমন কোন দূর্গ বাকী ছিল না যেখানে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করা হয়নি। কিন্তু ওটা মুসলিমদের ক্ষতির কোন কারণ হয় নি।
কা‘বকে আক্রমণ করার সময় হারিস ইবনু আউস (রাঃ)-কে তাঁর কোন এক সাথীর তরবারীর কোণার আঘাত লেগেছিল। ফলে তিনি আহত হয়েছিলেন এবং তাঁর দেহ হতে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছিল। কা‘বকে হত্যা করে ফিরবার সময় যখন এ ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনী হররায়ে আরীয নামক স্থানে পেঁŠছেন তখন দেখেন যে, হারিস (রাঃ) অনুপস্থিত রয়েছেন। সুতরাং তারা সেখানে থেমে যান। অল্পক্ষণ পরে হারিসও (রাঃ) সঙ্গীদের পদচিহ্ণ ধরে সেখানে পৌঁছে যান। সেখান হতে তাঁরা তাঁকে উঠিয়ে নেন এবং বাকীয়ে গারকাদে পৌঁছে এমন জোরে তাকবীর ধ্বনি দেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-ও তা শুনতে পান। তিনি বুঝে নেন যে, কা‘ব নিহত হয়েছে। সুতরাং তিনিও আল্লাহ আকবার ধ্বনি উচ্চারণ করেন। তারপর যখন এ মুসলিম বাহিনী তাঁর খিদমতে উপস্থিত হন তখন তিনি বলেন, ‘আফলাহাতিল উজূহু’ অর্থাৎ এ চেহারাগুলো সফল থাকুক। তখন তারা বললেন, ‘অ অজুহুকা ইয়া রাসূলুল্লাহ’ অর্থাৎ হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আপনার চোহরাও সফলতা লাভ করুক। আর সাথে সাথেই তাঁরা তাগূতের (কা‘বের) কর্তিত মস্তক তাঁর সামনে রেখে দেন। তিনি তখন আল্লাহ পাকের প্রশংসা করেন এবং হারিস (রাঃ)-এর ক্ষত স্থানে স্বীয় পবিত্র মুখের লালা লাগিয়ে দেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি আরোগ্য লাভ করেন এবং পরে আর কখনো তিনি কষ্ট অনুভব করেন নি।[1]
এদিকে ইহুদীরা যখন কা‘ব ইবনু আশরাফির হত্যার খবর জানতে পারল তখন তাদের শঠতাপূর্ণ অন্তরে ভীতি ও সন্ত্রাসের ঢেউ খেলে গেল। তারা তখন বুঝতে পারল যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন অনুধাবন করবেন যে, শান্তি ভঙ্গকারী, গন্ডগোল ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী এবং প্রতিজ্ঞা ও অঙ্গীকার ভঙ্গকারীদেরকে উপদেশ দিয়ে কোন ফল হচ্ছেনা তখন তিনি তাদের উপর শক্তি প্রয়োগ করতেও দ্বিধাবোধ করবেন না। এ জন্যেই তারা এ তাগূতের হত্যার প্রতিবাদে কোন কিছু করার সাহস করলনা, বরং একেবারে সোজা হয়ে গেল। তারা অঙ্গীকার পূরণের স্বীকৃতি দান করল এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধাচরণের সাহস সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে ফেলল।
এভাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মদীনার বিরুদ্ধে বহিরাক্রমণের মোকাবেলা করার অপূর্ব সুযোগ লাভ করলেন এবং মুসলিমরা অভ্যন্তরীণ গোলযোগ হতে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হয়ে গেলেন যে গোলযোগের তাঁরা আশঙ্কা করছিলেন এবং যার গন্ধ তাঁরা মাঝে মাঝে পাচ্ছিলেন।
ফুটনোটঃ[1] এ ঘটনাটির বিস্তারিত বিবরণ ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৫১-৫৭ পৃঃ, সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৩৪১-৪২৫ পৃঃ, ২য় খন্ড ৫৭৭ পৃঃ, সুনানে আবূ দাউদ আউনুল মা’বূদ সহ দ্রষ্টব্য ২য় খন্ড ৪২-৪৩ পৃঃ এবং যা’দুল মাআ’দ ২য় খন্ড ৯১ পৃঃ, এ সব হাদীস গ্রন্থ হতে গৃহীত হয়েছে।
৭. গাযওয়ায়ে বাহরান (غَزْوَةُ بُحْرَان):
এটা ছিল বড় সামরিক অভিযান যার সৈন্য সংখ্যা ছিল তিনশ জন। এ সেনাদল নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তৃতীয় হিজরীর রবিউল আখের মাসে বাহরান নামক একটি অঞ্চলের দিকে গমন করেছিলেন। এটা হিজাযের মধ্যে ফারা সীমান্তে খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ একটি জায়গা। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সেনাবাহিনীর রাবিউল আখের ও জুমাদিউল উলা এ দু’মাস সেখানে অবস্থানের পর মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন। এ অভিযানে তাঁদেরকে কোন প্রকার যুদ্ধের সম্মুখীন হতে হয়নি।[1]
ফুটনোটঃ[1] ইবুন হিশাম ২য় খন্ড ৫০-৫১ পৃঃ, যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৯১ পৃঃ। এ গাযওয়ার কারণের ব্যাপারে মতানৈক্য রয়েছে। কথিত আছে, মদীনায় এ খবর পৌঁছে যে, বনু সুলায়েম গোত্র মদীনা ও ওর আশেপাশে আক্রমণ চালাবার জন্যে খুব বড় রকমের সামরিক প্রস্ত্ততি গ্রহণ করছে। এটাও কথিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কুরাইশদের কোন এক যাত্রীদলের সন্ধানে বের হয়েছিলেন। ইবনু হিশাম এ কারণেই বর্ণনা করেছেন। আর ইবনুল কাইয়্যেমও এটাই গ্রহণ করেছেন। তাই তিনি প্রথম কারণটি উল্লেখ করেন নি। এটাই সত্য বলেও মনে হচ্ছে। কেননা, বনু সুলায়েম গোত্র ফারা এলাকায় বসবাসই করেনি বরং তারা নাজদের বাসিন্দা ছিল, যা ফারা হতে বহু দূরে।
৮. সারিয়্যাতু যায়দ ইবনু হারিসাহ (سَرِيَّةُ زَيْدِ بْنِ حَارِثَةَ):
এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ৩য় হিজরী জুমাদিউল আখের মাসে। উহুদ যুদ্ধের পূর্বে মুসলিমদের জন্যে এটা ছিল সর্বশেষ এবং সাফল্যজনক অভিযান।
ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ হল কুরাইশরা বদর যুদ্ধের পর হতে দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগের মধ্যে নিমজ্জিত তো ছিলই, তদুপরি যখন গ্রীষ্মকাল আসলো এবং শাম দেশে বাণিজ্যের সফরের সময় এসে পড়লো তখন তারা আর এক দুশ্চিন্তায় নিপতিত হলো। এর ব্যাখ্যা হচ্ছে সাফওয়ান ইবনু উমাইয়া- যাকে ঐ বছর শামদেশে গমনকারী কাফেলার আমীর নিযুক্ত করা হয়েছিল- কুরাইশকে বলল ‘মুহাম্মাদ (সাঃ) এবং তার সঙ্গীরা আমাদের বাণিজ্য পথ কঠিন করে ফেলেছে। তার সঙ্গীদের সাথে আমরা কিভাবে মোকাবেলা করব তা আমি বুঝতে পারছি না। তারা সমুদ্র উপকূল ছাড়তেই চাচ্ছে না। আর উপকূলের বাসিন্দারা তাদের সাথে সন্ধি করে নিয়েছে। সাধারণ লোকেরাও তাদের সাথী হয়ে গেছে। তাই, তখন আমি কোন্ রাস্তা অবলম্বন করব তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। আর যদি আমরা বাড়িতেই বসে থাকি তবে মূলধনও খেয়ে ফেলবো, কিছুই বাকী থাকবে না। কেননা, গ্রীষ্মকালে সিরিয়ার সাথে এবং শীতকালে আবিসিনিয়ায় ব্যবসা করার উপরে আমাদের জীবিকা নির্ভর করছে।’
সাফওয়ানের এ উক্তির পর বিষয়টির উপর চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়ে গেল। অবশেষে আসওয়াদ ইবনু আব্দুল মুত্তালিব সাফওয়ানকে বলল, ‘তুমি উপকূলের রাস্তা ছেড়ে দিয়ে ইরাকের রাস্তায় সফর কর।’ প্রকাশ থাকে যে, এটা খুবই দীর্ঘ রাস্তা। এটা নাজদ হয়ে সিরিয়া চলে গেছে এবং মদীনার পূর্ব দিকে কিছু দূর দিয়ে গিয়েছে। কুরাইশদের নিকট এটা ছিল সম্পূর্ণ অজানা পথ।
এ জন্য আসওয়াদ ইবনু আব্দুল মুত্তালিব সাফওয়ানকে পরামর্শ দিল যে, সে যেন বাকর ইবনু ওয়াইলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ফুরাত ইবনু হাইয়ানকে পথ প্রদর্শক হিসেবে সঙ্গে নেয়।
এ ব্যবস্থাপনার পর কুরাইশের বাণিজ্য কাফেলা সাফওয়ান ইবনু উমাইয়ার নেতৃত্বে নতুন পথ ধরে যাত্রা শুরু করল। কিন্তু এ যাত্রীদলের এ পথ যাত্রার খবর ইতোমধ্যেই মদীনায় পৌঁছে গিয়েছিল। ঘটনা হল সালীত ইবনু নুমান যিনি মুসলিম হয়েছিলেন, নাঈম ইবনু মাসউদের সাথে এক মদ্যপানের মজলিসে উপস্থিত ছিলেন। নাঈম তখনো মুসলিম হয়নি। এটা মদ্যপান নিষিদ্ধ হওয়ার পূর্বের ঘটনা। যখন নাঈমের উপর নেশা চেপে বসল তখন সে কুরাইশ কাফেলার সফর এবং তাদের অভিপ্রায়ের কথা পূর্ণভাবে বর্ণনা করে দিল। সালীত (রাঃ) দ্রুতগতিতে নাবী কারীম (সাঃ)-এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করলেন।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তৎক্ষণাৎ আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন এবং একশ জন অশ্বারোহীর একটি বাহিনীকে যায়দ ইবনু হারিসার নেতৃত্বে প্রেরণ করলেন। যায়দ (রাঃ) অত্যন্ত দ্রুতগতিতে পথ অতিক্রম করলেন। কুরাইশদের কাফেলা সম্পূর্ণ অসতর্ক অবস্থায় কারদাহ নামক একটি প্রস্রবণের উপর শিবির স্থাপনের নিমিত্ত অবতরণ করছিল, ইত্যবসরে মুসলিম বাহিনী অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে পুরো কাফেলার উপর অধিকার লাভ করলেন। সাফওয়ান ইবনু উমাইয়া এবং কাফেলার অন্যান্য রক্ষকদের পলায়ন ছাড়া আর কোন উপায় থাকল না।
মুসলিমরা কাফেলার পথ প্রদর্শক ফুরাত ইবনু হাইয়ানকে এবং কথিত মতে আরো দুজনকে গ্রেফতার করে নেন। কাফেলার নিকট প্রচুর পরিমাণ রৌপ্য ছিল, যার মূল্য আনুমানিক এক লক্ষ দিরহাম হবে, সবগুলোই মুসলিমরা গনীমতরূপে লাভ করেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এক পঞ্চমাংশ বের করে নিয়ে বাকীগুলো মুসলিমদের মধ্যে বন্টন করে দেন। ফুরাত ইবনু হাইয়ান নাবী কারীম (সাঃ) -এর পবিত্র হাতে ইসলামের দীক্ষাগ্রহণ করেন।[1]
বদর যুদ্ধের পরে এটাই ছিল কুরাইশদের জন্য সর্বাপেক্ষা বেদনাদায়ক ঘটনা, যাত্ম ফলে তাদের উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা বহুগুণ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়। এখন তাদের সামনে দুটি মাত্র পথ ছিল, হয় তারা গর্ব ও অহংকার ত্যাগ করে মুসলমানদের সাথে সন্ধি করবে, না হয় ভীষণ যুদ্ধ করে নিজেদের অতীত গৌরব ও মর্যাদা ফিরিয়ে আনবে এবং মুসলিমদের শক্তি এমনভাবে চূর্ণ করে দিবে যাতে তারা পুনর্বার মাথা চাড়া দিতে না পারে। মক্কাবাসীগণ দ্বিতীয় পথটি বেছে নিল। সুতরাং এ ঘটনার পর কুরাইশদের প্রতিশোধ গ্রহণের উত্তেজনা আরো বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হল। তারা মুসলিমদের সাথে মোকাবেলা করার জন্য এবং তাদের ঘরে ঢুকে তাদের উপর আক্রমণ চালানোর জন্য পূর্ণ মাত্রায় প্রস্তুতি শুরু করে দিল। এভাবে পূর্ববর্তী ঘটনাবলী ছাড়া এ ঘটনাটিও উহুদ যুদ্ধের বড় একটা কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ২য় খন্ড ৫০-৫১ পৃঃ, রহমাতুল্লিল আলামীন ২য় খন্ড ২১৯ পৃঃ
46,910 total views, 1 views today