মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনী
- মুহাম্মাদ (সাঃ) এর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
নাম : হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
অন্যান্য সর্বাধিক প্রচলিত প্রিয় নাম সমূহ: মুহাম্মদ (সাঃ), মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ (সাঃ), আহমাদ (সাঃ), আবুল কাসিম (সাঃ), রাসূল (সাঃ), নবী (সাঃ), মহানবী (সাঃ)
পিতা : হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিব (রাঃ)
মাতা : হযরত আমিনা (রাঃ)
জন্ম : ২৯ আগস্ট ৫৭০ সাল/খ্রিস্টাব্দ
জন্মস্থান : বাক্কা, আরব (অধুনা মক্কা, মক্কা প্রদেশ, সৌদি আরব)
নবুয়াত লাভ : ৪০ বছর বয়সে (৬১০ সাল/খ্রিস্টাব্দ)
জীবনকাল : ৬৩ বছর
ওফাত (পরলোকগমণ) : ৮ জুন ৬৩২ সাল/খ্রিস্টাব্দ
ওফাত (পরলোকগমণ) এর স্থান : ইয়াসরিব (মদিনা), আরব (অধুনা মদিনা, হেজাজ, সৌদি আরব)
সমাধি স্থান : মদিনা (মসজিদে নববীর সবুজ গম্বুজের নিচের সমাধিক্ষেত্র), সৌদি আরব
স্থানাঙ্ক : ২৪°২৮′০৩.২২″ উত্তর ০৩৯°৩৬′৪১.১৮″ পূর্ব
মুহাম্মাদ (সাঃ) এর স্ত্রীগণ/বিবিগণ/দাম্পত্য সঙ্গী :
(প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ (রাঃ) বেঁচে থাকাকালীন কোন বিবাহ করেন নি, একসঙ্গে চার এর অধিক স্ত্রী ছিল না, ইসলাম প্রচারের সুবিধার্থে/স্বার্থে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করে ছিলেন, সবাই কে প্রতি সমান ইনছাফপূর্ণ হক/অধিকার আদায় করে ছিলেন যার জন্য কোন দিন কোন স্ত্রী তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তো দুরের কথা মনঃক্ষুর্ণও হননি)
খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ (রাঃ) (৫৯৫-৬১৯)
সাওদা বিনতে জামআ (রাঃ) (৬১৯-৬৩২)
আয়িশা (রাঃ) (৬১৯-৬৩২)
হাফসা বিনতে উমর (রাঃ) (৬২৪-৬৩২)
জয়নব বিনতে খুযায়মা (রাঃ) (৬২৫-৬২৭)
উম্মে সালামা হিন্দ বিনতু আবি উমাইয়া (রাঃ) (৬২৯-৬৩২)
জয়নব বিনতে জাহশ (রাঃ) (৬২৭-৬৩২)
জুওয়াইরিয়া বিনতে আল-হারিস (রাঃ) (৬২৮-৬৩২)
রামালাহ বিনতে আবি সুফিয়ান (রাঃ) (৬২৮-৬৩২)
রায়হানা বিনতে জায়েদ (রাঃ) (৬২৯-৬৩১)
সাফিয়া বিনতে হুওয়াই (রাঃ) (৬২৯-৬৩২)
মায়মুনা বিনতে আল-হারিস (৬৩০-৬৩২)
মারিয়া আল-কিবতিয়া (৬৩০-৬৩২)
সন্তান-সন্তানাদিগণ :
পুত্রগণ : কাসিম (রাঃ), আবদুল্লাহ (রাঃ), ইবরাহিম (রাঃ)
কন্যাগণ : জয়নব (রাঃ), রুকাইয়াহ (রাঃ), উম্মে কুলসুম (রাঃ), ফাতিমা (রাঃ)।
আত্মীয় : আলী (রাঃ), উমর (রাঃ), আবু বকর (রাঃ), আবু সুফিয়ান (রাঃ)।
সূচি / অধ্যায় সমূহ :
১। মুহাম্মাদ সাঃ এর জন্ম, পূর্ণনাম ও পরিচিতি
১.১। প্রাক-ইসলামী আরব
২। মুহাম্মাদ সাঃ এর জীবনের উপর তথ্যসূত্র
২.১। হাদিস
৩। মুহাম্মাদ সাঃ এর ইসলামী চরিতাভিধান অনুসারে জীবনী
৩.১। জন্ম
৩.২। শৈশব ও কৈশোর কাল
৩.৩। নবুয়ত-পূর্ব জীবন
৩.৪। নবুওয়ত প্রাপ্তি
৪। মক্কী জীবন
৪.১। গোপন প্রচার
৪.২। প্রকাশ্য দাওয়াত
৪.৩। মক্কায় বিরোধিতার সম্মুখীন
৪.৪। ইথিওপিয়ায় হিজরত
৪.৫। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ইসলাম গ্রহণ
৪.৬। একঘরে অবস্থা
৪.৭। দুঃখের বছর ও তায়েফ গমন
৪.৮। মি’রাজ বা উর্দ্ধারোহণ
৫। মদিনায় হিজরত
৬। মাদানী জীবন
৬.১। স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও সংবিধান প্রণয়ন
৬.২। মক্কার সাথে বিরোধ ও যুদ্ধ
৬.৩। মদিনার ইহুদিদের সাথে সম্পর্ক
৬.৪। হুদাইবিয়ার সন্ধি
৬.৫। বিভিন্ন রাষ্ট্রনায়কদের কাছে পত্র প্রেরণ
৬.৫.১। প্রেরিত দূতগণের তালিকা
৬.৬। মক্কা বিজয়
৬.৭। মক্কা বিজয়ের পর
৬.৮। মৃত্যু
৭। মুহাম্মাদ সাঃ এর ওফাত পর
৮। সংস্কারক হিসেবে মুহাম্মাদ সাঃ
৯। ইসলামী বর্ণনামতে মুহাম্মাদ সাঃ এর অলৌকিকত্ব
১০। অমুসলিমদের দৃষ্টিভঙ্গি
১১। আরও দেখুন
১২। পাদটীকা
১৩। তথ্যসূত্র
১৪। গ্রন্থপঞ্জী
১৫। বহিঃসংযোগ
১৫.১। সাধারণ
১৫.২। মুসলিম রচিত
১৫.৩। আহ্মদীয়া রচিত
১৫.৪। অমুসলিম রচিত
১ । মুহাম্মাদ সাঃ এর জন্ম, পূর্ণনাম ও পরিচিতি :
মুহাম্মাদ সাঃ বর্তমান সৌদি আরবে অবস্থিত মক্কা নগরীর কুরাইশ বংশের বনু হাশিম গোত্রে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ আগস্ট বা আরবি রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ জন্ম গ্রহণ করেন। محمد (সাহায্য) মোহাম্মদ এবং মুহম্মদ নামেও পরিচিত; তুর্কি : মুহাম্মেদ), পূর্ণ নাম : মুহাম্মাদ ইবনে ʿআবদুল্লাহ ইবনে ʿআবদুল মুত্তালিব ইবনে হাশিম (ابو القاسم محمد ابن عبد الله ابن عبد المطلب ابن هاشم) হলেন ইসলামের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব এবং ইসলামী বিশ্বাস মতে আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত সর্বশেষ নবী সাঃ, (আরবি: النبي আন-নাবিয়্যু), তথা “বার্তাবাহক” (আরবি : الرسول আর-রাসুল), যার উপর ইসলামী প্রধান ধর্মগ্রন্থ আল-কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। অধিকাংশ ইতিহাসবেত্তা ও বিশেষজ্ঞদের মতে, মুহাম্মাদ সাঃ ছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় নেতা। তার এই বিশেষত্বের অন্যতম কারণ হচ্ছে আধ্যাত্মিক ও জাগতিক উভয় জগতেই চূড়ান্ত সফলতা অর্জন। তিনি ধর্মীয় জীবনে যেমন সফল তেমনই রাজনৈতিক জীবনেও। সমগ্র আরব বিশ্বের জাগরণের পথিকৃৎ হিসেবে তিনি অগ্রগণ্য; বিবাদমান আরব জনতাকে একীভূতকরণ তার জীবনের অন্যতম সফলতা। ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে (হস্তিবর্ষ) মক্কা নগরীতে জন্ম নেওয়া মুহাম্মাদ সাঃ মাতৃগর্ভে (৬মাস) থাকাকালীন পিতা হারা হন ৬বছরের শিশু বয়সে মাতাকে হারিয়ে এতিম হন এবং প্রথমে তার পিতামহ আবদুল মুত্তালিব ও পরে পিতৃব্য আবু তালিবের নিকট লালিত পালিত হন। হেরা পর্বতের গুহায় ৪০ বছর বয়সে তিনি নবুওয়াত লাভ করেন। জিবরাঈল ফেরেশতা এই পর্বতের গুহায় আল্লাহর তরফ থেকে তার নিকট ওহী নিয়ে আসেন। তিন বছর পর ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে মুহাম্মাদ প্রকাশ্যে ওহী প্রচার করেন, এবং ঘোষণা দেন “আল্লাহ্ এক” ও তার নিকট নিজেকে সঁপে দেওয়ার মধ্যেই জাগতিক কল্যাণ নিহিত, এবং ইসলামের অন্যান্য নবীদের মত তিনিও আল্লাহর প্রেরিত দূত।
তৎকালীন আরবের ভৌগলিক, সামাজিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা
আরবের ভৌগোলিক অবস্থান এবং গোত্রসমূহ (مَوْقَعُ الْعَرَبِ وَأَقْوَامُهَا)
নাবী (সাঃ)-এর জীবন চরিত বলতে বুঝায় প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ প্রদত্ত সেই বার্তা বিচ্ছুরিত আলোক রশ্মির বাস্তবায়ন বা রূপায়ণ যা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মানব জাতির সম্মুখে উপস্থাপন করেছেন এবং যার মাধ্যমে মানুষকে ভ্রষ্টতার গাঢ় অন্ধকার থেকে উদ্ধার করে শাশ্বত আলোকোজ্জ্বল পথের উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং মানুষের দাসত্ব ও শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে আল্লাহর দাসত্বে প্রবিষ্ট করেছেন। এমনকি ইতিহাসের চিত্রকেই পাল্টিয়ে দিয়েছেন এবং মানবজগতের জীবনধারায় আমূল পরিবর্তন আনয়ন করেছেন।
সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব ও নাবী (সাঃ)-এর পবিত্র জীবন ধারার পূর্ণাঙ্গ প্রতিচ্ছবি অঙ্কন ততক্ষণ পর্যন্ত সম্ভব নয় যতক্ষণ না আল্লাহর বাণী অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বের ও পরের অবস্থার তুলনামূলক বিচার বিশ্লেষণ না করা হয়। এ প্রেক্ষাপটে প্রকৃত আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে আলোচ্য অধ্যায়ে প্রাক ইসলামিক আরবের ভৌগোলিক সীমারেখা, আরব ভূমিতে বসবাসরত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অবস্থা ও অবস্থান এবং তাদের ক্রমোন্নতির ধারা এবং সে যুগের রাষ্ট্র পরিচালনা, নেতৃত্ব প্রদান ও গোত্রসমূহের শ্রেণীবিন্যাশকে বিভিন্ন দীন-ধর্ম, সম্প্রদায়, আচার-আচরণ, অন্ধবিশ্বাস এবং রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক চিত্রসহ পাঠক-পাঠিকার সামনে তুলে ধরা প্রয়োজন।
একারণেই আমি এ বিষয়সমূহকে বিশেষভাবে বিভিন্ন স্তরবিন্যাশে উপস্থাপন করেছি।
ফুটনোটঃ
আরবের অবস্থান
‘আরব’ শব্দটি ‘বালুকাময় প্রান্তর’ উষর ধূসর মরুভূমি বা লতাগুল্ম তৃণশষ্যবিহীন অঞ্চল অর্থে ব্যবহৃত হয়। স্মরণাতীত কাল থেকেই বিশেষ এক বৈশিষ্ট্যগত অর্থে আরব উপদ্বীপ এবং সেখানে বসাবাসকারী সম্প্রদায়ের জন্য এ পরিভাষাটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
আরবের পশ্চিমে লোহিত সাগর ও সিনাই উপদ্বীপ, পূর্বে আরব উপসাগর ও দক্ষিণ ইরাকের এক বড় অংশ এবং দক্ষিণে আরব সাগর যা ভারত মহা সাগরের বিস্তৃত অংশ, উত্তরে শামরাজ্য এবং উত্তর ইরাকের কিছু অংশ। উল্লেখিত সীমান্ত সমূহের কোন কোন ক্ষেত্রে কিছুটা মতবিরোধ রয়েছে। সমগ্র ভূভাগের আয়তন ১০ লক্ষ থেকে ১৩ লক্ষ বর্গ মাইল পর্যন্ত ধরা হয়েছে।
আভ্যন্তরীণ ভৌগোলিক এবং ভূপ্রাকৃতিক উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই আরব উপদ্বীপ অত্যন্ত গুরুত্ব এবং তাৎপর্য বহন করে। এ উপদ্বীপের চতুর্দিক মরুভূমি বা দিগন্ত বিস্তৃত বালুকাময় প্রান্তর দ্বারা পরিবেষ্টিত। যে কারণে এ উপদ্বীপ এমন এক সুরক্ষিত দূর্গে পরিণত হয়েছে যে, যে কোন বিদেশী শক্তি বা বহিঃশত্রুর পক্ষে এর উপর আক্রমণ পরিচালনা, অধিকার প্রতিষ্ঠা কিংবা প্রভাব বিস্তার করা অত্যন্ত কঠিন। এ নৈসর্গিক কারণেই আরব উপদ্বীপের মধ্যভাগের অধিবাসীগণ সেই সুপ্রাচীন এবং স্মরণাতীত কাল থেকেই সম্পূর্ণ স্বাধীন থেকে নিজস্ব স্বাতন্ত্রগত বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে চলতে সক্ষম হয়েছে। অথচ অবস্থানের দিকে দিয়ে এ উপদ্বীপটি এমন দু’পরাশক্তির প্রতিবেশী যে, ভূপ্রকৃতিগত প্রতিবন্ধকতা না থাকলে এ পরাশক্তিদ্বয়ের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকা আরববাসীগণের পক্ষে কখনই সম্ভবপর হতো না।
বহির্বিশ্বের দিক থেকে আরব উপদ্বীপের অবস্থানের প্রতি লক্ষ করলেও প্রতীয়মান হবে যে, দেশটি পুরাতন যুগের মহাদেশ সমূহের একেবারে মধ্যস্থল বা কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত এবং জল ও স্থল উভয় পথেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও মহাদেশের সঙ্গে সংযুক্ত। এর উত্তর পশ্চিম সীমান্ত হচ্ছে আফ্রিকা মহাদেশ গমনের প্রবেশ পথ, উত্তর পূর্ব সীমান্ত হচ্ছে ইউরোপ মহাদেশে প্রবেশের প্রবেশদ্বার এবং পূর্ব সীমান্ত হচেছ ইরান ও মধ্য এশিয়া হয়ে চীন ভারতসহ দূর প্রতীচ্যে গমনামনের দরজা। এভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও মহাদেশ থেকে সাগর ও মহাসাগর হয়ে আগত জল পথ আরব উপদ্বীপের সঙ্গে চমৎকার যোগসূত্র রচনা করেছে। বিভিন্ন দেশের জাহাজগুলো সরাসরি আরবের বন্দরে গিয়ে ভিড়ে। এরূপ ভৌগোলিক অবস্থান ও সীমারেখার প্রেক্ষিতে আরব উপদ্বীপের উত্তর ও দক্ষিণ সীমান্ত ছিল বিভিন্ন সম্প্রাদয়ের ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি ও মত বিনিময়ের লক্ষ্যস্থল বা কেন্দ্রবিন্দু।
ফুটনোটঃ
আরব সম্প্রদায়সমূহ
জন্মসূত্রের ভিত্তিতে ইতিহাসবিদগণ আরব সম্প্রদায় সমূহকে তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। যথা:
আরবের বায়িদাহ : এঁরা হল ঐ সমস্ত ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাচীন গোত্র এবং সম্প্রদায় যা ধরাপৃষ্ঠ থেকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এবং এদের খোঁজ খবর সম্পর্কিত নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রমাণাদির সন্ধান লাভ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এ সম্প্রদায়গুলো হচ্ছে যথাক্রমে আদ, সামূদ, ত্বাসম, জাদীস, ইমলাক্ব, উমাইম, জুরহুম, হাযূর, ওয়াবার, ‘আবীল, জাসিম, হাযারামাওত ইত্যাদি।[1]
আরবে ‘আরিবা : এরা হচ্ছে ঐ সমস্ত গোত্র যারা ইয়াশজুব বিন ইয়া‘রুব বিন ক্বাহত্বানের বংশোদ্ভূত। এদেরকে ক্বাহত্বানী আরব বলা হয়।
আরবে মুস্তা’রিবা : এরা হচ্ছেন ঐ আরব সম্প্রদায় যারা ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশধারা থেকে আগত। এদেরকে আদনানী আরব বলা হয়।
আরবে ‘আরিবা অর্থাৎ ক্বাহত্বানী আরবদের প্রকৃত আবাসস্থল ছিল ইয়ামান রাজ্য। এখানেই তাদের বংশধারা এবং গোত্রসমূহ সাবা বিন ইয়াশযুব বিন ইয়া‘রুব বিন ক্বাহত্বান এর বংশধর থেকে বহু শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। এর মধ্যে পরবর্তীকালে দু’গোত্রই অধিক প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। সেগুলো হল : হিমইয়ার বিন সাবা ও কাহলান বিন সাবা। বনী সাবা’র আরো এগারটি বা চৌদ্দটি গোত্র ছিল যাদেরকে সাবিউন বলা হতো। সাবা ব্যতীত তাদের আর কোনো গোত্রের অস্তিত্ব নেই।
(ক) হিমইয়ার : এর প্রসিদ্ধ শাখাগুলো হচ্ছে-
(১) কুযা’আহ : এর প্রশাখাসমূহ হল বাহরা, বালী, আলক্বায়ন, কালব, উযরাহ ও ওয়াবারাহ।
(২) সাকাসিক : তারা হলেন যায়দ বিন ওয়ায়িলাহ বিন হিমইয়ার এর বংশধর। যায়দ এর উপাধি হল সাকাসিক। তারা বনী কাহলানের ‘সাকাসিক কিন্দাহ’র অন্তর্ভুক্ত নয় যাদের আলোচনা সামনে আসছে।
(৩) যায়দুল জামহুর : এর প্রশাখা হল হিমইয়ারুল আসগার, সাবা আল-আসগার, হাযূর ও যূ আসবাহ।
(খ) কাহলান : এর প্রসিদ্ধ শাখা-প্রশাখাগুলো হচ্ছে হামদান, আলহান, আশ’য়ার, ত্বাই, মাযহিজ (মাযহিজ থেকে আনস ও আন্ নাখ‘, লাখম (লাখম হতে কিন্দাহ, কিন্দাহ হতে বনু মুআ‘বিয়াহ, সাকূন ও সাকাসিক), জুযাম, আ‘মিলাহ, খাওলান, মাআ‘ফির, আনমার (আনমার থেকে খাসয়াম ও বাখীলাহ, বাখীলাহ থেকে আহমাস) আযদ (আযদ থেকে আউস, খাজরায, খুযা’আহ এবং জাফরান বংশধরগণ। এঁরা পরে শাম রাজ্যের আশেপাশে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং আলে গাসসান নামে প্রসিদ্ধ লাভ করেন।
অধিকাংশ কাহলানী গোত্র পরে ইয়ামান রাজ্য পরিত্যাগ করে আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণভাবে তাদের দেশত্যাগের ঘটনা ঘটে ‘সাইলে আরিমের’ কিছু পূর্বে। ঐ সময়ের ঘটনা, যখন রোমীয়গণ মিশর ও শামে অনুপ্রবেশ করে ইয়েমেরনর অধিবাসীদের ব্যবসা-বাণিজ্যের জলপথের উপর একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করে এবং স্থলপথের যাবতীয় সুযোগ সুবিধারও চিরতরে অবসান ঘটে। এর ফলে কাহলানীদের ব্যবসা-বাণিজ্য একদম উজাড় হয়ে যায়। যার সাক্ষ্য পবিত্র কুরআনে এসেছে, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
{لَقَدْ كَانَ لِسَبَإٍ فِيْ مَسْكَنِهِمْ آيَةٌ جَنَّتَانِ عَنْ يَمِيْنٍ وَّشِمَالٍ كُلُوْا مِن رِّزْقِ رَبِّكُمْ وَاشْكُرُوْا لَهُ بَلْدَةٌ طَيِّبَةٌ وَّرَبٌّ غَفُوْرٌ فَأَعْرَضُوْا فَأَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ سَيْلَ الْعَرِمِ وَبَدَّلْنَاهُمْ بِجَنَّتَيْهِمْ جَنَّتَيْنِ ذَوَاتَى أُكُلٍ خَمْطٍ وَأَثْلٍ وَشَيْءٍ مِّنْ سِدْرٍ قَلِيْلٍ ذٰلِكَ جَزَيْنَاهُمْ بِمَا كَفَرُوْا وَهَلْ نُجَازِيْ إِلَّا الْكَفُوْرَ وَجَعَلْنَا بَيْنَهُمْ وَبَيْنَ الْقُرٰى الَّتِيْ بَارَكْنَا فِيْهَا قُرًى ظَاهِرَةً وَّقَدَّرْنَا فِيْهَا السَّيْرَ سِيْرُوْا فِيْهَا لَيَالِيَ وَأَيَّامًا آمِنِيْنَ فَقَالُوْا رَبَّنَا بَاعِدْ بَيْنَ أَسْفَارِنَا وَظَلَمُوْا أَنفُسَهُمْ فَجَعَلْنَاهُمْ أَحَادِيْثَ وَمَزَّقْنَاهُمْ كُلَّ مُمَزَّقٍ إِنَّ فِيْ ذٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّكُلِِّ صَبَّارٍ شَكُوْرٍ} [سورة سبأ:15: 19]
‘‘সাবার অধিবাসীদের জন্য তাদের বাসভূমিতে একটা নিদর্শন ছিল- দু’টো বাগান; একটা ডানে, একটা বামে। (তাদেরকে বলেছিলাম) তোমাদের প্রতিপালক প্রদত্ত রিযক ভোগ কর আর তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। সুখ-শান্তির শহর আর ক্ষমাশীল পালনকর্তা। কিন্তু তারা (আল্লাহ হতে) মুখ ফিরিয়ে নিল। কাজেই আমি তাদের বিরুদ্ধে পাঠালাম বাঁধ-ভাঙ্গা বন্যা, আর আমি তাদের বাগান দু’টিকে পরিবর্তিত করে দিলাম এমন দু’টি বাগানে যাতে জন্মিত বিস্বাদ ফল, ঝাউগাছ আর কিছু কুল গাছ। অকৃতজ্ঞতাভরে তাদের সত্য প্রত্যাখ্যান করার জন্য আমি তাদেরকে এ শাস্তি দিয়েছিলাম। আমি অকৃতজ্ঞদের ছাড়া এমন শাস্তি কাউকে দেই না। তাদের এবং যে সব জনপদের প্রতি আমি অনুগ্রহ বর্ষণ করেছিলাম সেগুলোর মাঝে অনেক দৃশ্যমান জনপদ স্থাপন করে দিয়েছিলাম এবং ওগুলোর মাঝে সমান সমান দূরত্বে সফর মনযিল করে দিয়েছিলাম। (আর তাদেরকে বলেছিলাম) তোমরা এ সব জনপদে রাতে আর দিনে নিরাপদে ভ্রমণ কর। কিন্তু তারা বলল- হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের সফর-মঞ্জিলগুলোর মাঝে ব্যবধান বাড়িয়ে দাও। তারা নিজেদের প্রতি যুলম করেছিল। কাজেই আমি তাদেরকে কাহিনী বানিয়ে ছাড়লাম (যে কাহিনী শোনানো হয়) আর তাদেরকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিলাম। এতে প্রত্যেক ধৈর্যশীল কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য নিদর্শন রয়েছে। (সূরাহ সাবা : ১৫-১৯)
হিমইয়ারী ও কাহলানী গোত্রদ্বয়ের বংশদ্বয়ের মধ্যে বিরাজমান আত্মকলহ ও দ্বন্দ্ব ছিল তাদের অন্যতম প্রধান কারণ। যার ইঙ্গিত বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া যায়। এ সকল সূত্র থেকে যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় যে, আত্মকলহের কারণে জীবন যাত্রার বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানাবিধ জটিল সমস্যার উদ্ভব হওয়ায় কাহলানী গোত্রসমূহ স্বদেশভূমির মায়া-মমতা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়, কিন্তু হিমইয়ারী গোত্রসমূহ স্বস্থানে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকে।
যে সকল কাহলানী গোত্র স্বদেশের মায়া-মমতা কাটিয়ে অন্যত্র গমন করে তাদের চারটি শাখায় বিভক্ত হওয়ার কথা নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায় :
১। আযদ : এঁরা নিজ নেতা ইমরান বিন ‘আমর মুযাইক্বিয়ার পরামর্শানুক্রমে দেশত্যাগ করেন। প্রথম দিকে এঁরা ইয়ামানের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করতে থাকেন। তাঁদের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাত্রার প্রাক্কালে নিরাপত্তার ব্যাপারে সুনিশ্চিত হওয়ার জন্য অগ্রভাগে অনুসন্ধানী প্রহরীদল প্রেরণ করতেন। এভাবে পথ পরিক্রমা করতে করতে তাঁরা অবশেষে উত্তর ও পূর্বমুখে অগ্রসর হওয়ার এক পর্যায়ে বহু শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে পড়েন এবং এখানে-সেখানে পরিভ্রমণ করতে করতে বিভিন্ন স্থানে স্থায়ীভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করে নেন। তাঁদের এ দেশান্তর এবং বসতি স্থাপন সংক্রান্ত বিবরণ নিম্নরূপ :
ইমরান বিন ‘আমর : তিনি উমানে গমন করেন এবং তার গোত্র সেখানেই বসবাস করেন। এঁরা হলেন আযদে উমান।
নাসর বিন আযদ : বনু নাসর বিন আযদ তুহামায় বসতি স্থাপন করেন। এঁরা হলেন আযদে শানুয়াহ।
সা‘লাবাহ বিন ‘‘আমর : তিনি প্রথমত হিজায অভিমুখে অগ্রসর হয়ে সা‘লাবিয়া ও যূ ক্বার নামক স্থানের মধ্যস্থানে বাসস্থান নির্মাণ করে বসবাস করতে থাকেন। যখন তাঁর সন্তান সন্ততি বয়োঃপ্রাপ্ত হন এবং বংশধরগণ শক্তিশালী হয়ে উঠেন তখন মদীনা অভিমুখে অগ্রসর হয়ে মদীনাকেই বসবাসের জন্য উপযুক্ত স্থান মনে করে সেখানে বসতি স্থাপন করেন। ঐ সা‘লাবাহর বংশধারা থেকেই উদ্ভব হয়েছিল আউস এবং খাযরাজ গোত্রের তথা মদীনার আনসারদের।
হারিসাহ বিন ‘‘আমর : অর্থাৎ খুযা’আহ এবং তাঁর সন্তানাদি। এঁরা হিজায ভূমিতে চক্রাকারে ইতস্তত পরিভ্রমণ করতে করতে মার্রুয যাহরান নামক স্থানে শিবির স্থাপন করে বসবাস করতে থাকেন। তারপর হারাম শরীফের উপর প্রবল আক্রমণ পরিচালনা করে বানু জুরহুমকে সেখান থেকে বহিস্কার করেন এবং নিজেরা মক্কাধামে স্থায়ী বসতি স্থাপন করে বসবাস করতে থাকেন।
‘ইমরান বিন ‘‘আমর : তিনি এবং তাঁর সন্তানাদি ‘আম্মানে’ বসতি স্থাপন করেছিলেন। তাই তাঁদেরকে ‘আযাদে আম্মান’ বলা হতো।
নাসর বিন ‘আমর : এঁর সঙ্গে সম্পর্কিত গোত্রগুলো তুহামায় বসতি স্থাপন করেছিলেন। এঁদেরকে ‘আযাদে শানুআহ’ বলা হতো।
জাফনা বিন ‘‘আমর : তিনি শাম রাজ্যে গমন করে সেখানে বসতি স্থাপন করেন এবং সন্তানাদিসহ বসবাস করতে থাকেন। তিনি হচ্ছেন গাসসানী শাসকগণের প্রখ্যাত পূর্ব পুরুষ। শাম রাজ্যে গমনের পূর্বে হিজাযে গাসসান নামক ঝর্ণার ধারে তাঁরা কিছুদিন বসবাস করেছিলেন, তাই তাঁদের বংশধারাকে গাসসানী বংশ বলা হতো। কিছু ছোট ছোট গোত্র হিজাজ ও শামে হিজরত করে ঐ সকল গোত্রের সাথে মিলিত হয়। যেমন কা‘ব বিন ‘আমর, হারিস বিন ‘আমর ও আউফ বিন ‘আমর।
২। লাখম ও জুযাম গোত্র : তারা পূর্ব ও উত্তর দিকে গমন করে। এ লাখমীদের মধ্যে নাসর বিন রাবী’আহ নামক এক ব্যক্তি ছিলেন যিনি হীরাহর মুনাযিরাহ বংশের শাসকগণের অত্যন্ত প্রভাবশালী পূর্বপুরুষ ছিলেন।
৩। বানু ত্বাই গোত্র : এ গোত্র বানু আযদ গোত্রের দেশ ত্যাগের পর উত্তর অভিমুখে অগ্রসর হয়ে আযা’ এবং সালামাহ দু’পাহাড়ের পাদদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। এ গোত্রের নামানুসারে পাহাড় দুটি ‘বানু ত্বাই’ গোত্রের নামে পরিচিতি লাভ করে।
৪। কিন্দাহ গোত্র : এ গোত্র সর্বপ্রথম বাহরাইনে বর্তমান আল আহসায় শিবির স্থাপন করেন। কিন্তু সেখানে আশানুরূপ পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে ‘হাযরামাওত’ অভিমুখে যাত্রা করেন। কিন্তু সেখানেও তেমন কোন সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করতে না পারায় অবশেষে নাযদ অঞ্চলে গিয়ে বসতি গড়ে তোলেন। সেখানে তাঁরা একটি অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ বিশাল রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন। কিন্তু সে রাষ্ট্র বেশী দিন স্থায়ী হয় নি, অল্প কালের মধ্যেই তার অস্তিত্ব চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
কাহলান ব্যতিত হিময়ারেরও অনুরূপ একটি কুযা’আহ গোত্র রয়েছে। অবশ্য যাঁরা ইয়ামান হতে বাস্তুভিটা ত্যাগ করে ইরাক সীমান্তে বসতি স্থাপন করেন তাঁদের হিময়ারী হওয়ার ব্যাপারেও কিছুটা মতভেদ রয়েছে। এদের কিছু গোত্র সিরিয়ার উচ্চভূমি ও উত্তর হিজাজে বসতি স্থাপন করল।[2]
আরবে মুস্তা’রিবা : এঁদের প্রধান পূর্বপুরুষ ইবরাহীম (আঃ) মূলত ইরাকের উর শহরের বাসিন্দা ছিলেন। এ শহরটি ফোরাত বা ইউফ্রেটিস নদীর তীরে কুফার সন্নিকটে অবস্থিত। প্রত্নতাত্ত্বিকগণ কর্তৃক ঐ শহরটির ভূগর্ভ খননের সময় যে সকল শিলালিপি পুঁথি-পুস্তক ও দলিলাদী উদ্ধার করা হয়েছে তার মাধ্যমে এ শহর সম্পর্কে নানা মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি প্রকাশিত হয়েছে। অধিকন্তু, এ সবের মাধ্যমে ইবরাহীম (আঃ), তাঁর উর্ধ্বতন বংশধরগণ এবং তথাকার বাসিন্দাগণের ধর্মীয়, সামাজিক আচার অনুষ্ঠান এবং অবস্থা সম্পর্কে বহু নতুন নতুন তথ্য উদঘাটিত এবং নব দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আমরা আরও বিলক্ষণ অবগত রয়েছি যে, ইবরাহীম (আঃ) এ স্থান থেকে হিজরত করে হার্রান শহরে আগমন করেছিলেন তারপর সেখানে থেকে তিনি আবার ফিলিস্ত্বীনে গিয়ে উপনীত হন এবং সে দেশকেই তাঁর নবুওয়াতী বা আল্লাহর আহবানজনিত কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেন। আল্লাহ সুবহানাহূ তা‘আলা তাঁকে পরম সম্মানিত ‘খলিলুল্লাহ’ উপাধিতে ভূষিত করে তাঁর উপর রিসালাতের যে সুমহান দায়িত্ব ও কর্তব্য অর্পণ করেছিলেন সেখান থেকেই দেশের অভ্যন্তরভাগে এবং বহির্বিশে ব্যাপক সম্প্রচার এবং প্রসারের জন্য তিনি সর্বতোভাবে আত্মনিয়োগ করেছিলেন।
ইবরাহীম (আঃ) একদা মিশর ভূমিতে গিয়ে উপনীত হন। তাঁর সাথে তাঁর স্ত্রী সারাহও ছিলেন। মিশরের তৎকালীন বাদশাহ ফেরাউন তাঁর মন্ত্রীর মুখে সারাহর অপরিসীম রূপগুণের কথা শুনে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হন এবং অসদুদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে স্বীয় যৌন লিপ্সা চরিতার্থ মানসে তাঁর দিকে অগ্রসর হন। এদিকে একরাশ ঘৃণার ক্ষোভানলে বিদগ্ধপ্রাণা সারাহ আবেগকুলচিত্তে আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা জানালে তৎক্ষণাৎ তিনি তা কবূল করেন এবং এর অবশ্যম্ভাবী ফলশ্রুতি হিসেবে ফেরাউন বিকারগ্রস্ত হয়ে হাত-পা ছোড়াছুঁড়ি করতে থাকেন। অদৃশ্য শক্তিতে শেষ পর্যন্ত তিনি একদম নাজেহাল এবং জর্জরিত হতে থাকেন।
তাঁর এ ঘৃণ্য ও জঘণ্য অসদুদ্দেশ্যের ভয়াবহ পরিণতিতে তিনি একেবারে হতচকিত এবং বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়েন। এভাবে অত্যন্ত মর্মান্তিক অবস্থার মধ্য দিয়ে তিনি অনুধাবন করেন যে ‘সারাহ’ কোন সাধারণ নারী নন, বরং তিনি হচ্ছেন আল্লাহ তা‘আলার উত্তম শ্রেণীভুক্ত এক মহিয়সী মহিলা।
‘সারাহর’ এ ব্যক্তি-বিশিষ্টতায় তিনি এতই মুগ্ধ এবং অভিভূত হয়ে পড়েন যে তাঁর কন্যা হাজেরাকে[3] সারার খেদমতে সর্বতোভাবে নিয়োজিত করে দেন। হাজেরার সেবা যত্ন ও গুণ-গরিমায় মুগ্ধ হয়ে তারপর তিনি তাঁর স্বামী ইবরাহীম খলিলুল্লাহ (আঃ)-এর সঙ্গে হাজেরার বিবাহ দেন।[4]
ইবরাহীম (আঃ) ‘সারাহ’ এবং হাজেরাকে সঙ্গে নিয়ে নিজ বাসস্থান ফিলিস্ত্বীন ভূমে প্রত্যাবর্তন করেন। তারপর আল্লাহ তা‘আলা হাজেরার গর্ভে ইবরাহীম (আঃ)-কে পরম ভাগ্যমন্ত এক সন্তান দান করেন। হাজেরার গর্ভে ইবরাহীম (আঃ)-এর ঔরসজাত সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ায় তিনি কিছুটা লজ্জিত এবং বিব্রতবোধ করতে থাকলেন এবং নবজাতকসহ হাজেরাকে নির্বাসনে পাঠানোর জন্য উপর্যুপরি চাপ সৃষ্টি করে চললেন। ফলে তিনি হাজেরা ও নবজাত পুত্র ইসমাঈলকে সঙ্গে নিয়ে হিজায ভূমিতে এসে উপনীত হলেন। তারপর রায়তুল্লাহ শরীফের সন্নিকটে অনাবাদী ও শষ্যহীন উপত্যকায় পরিত্যক্ত অবস্থায় তাঁদের রেখে দিলেন। ঐ সময় বর্তমান আকারে বায়তুল্লাহ শরীফের কোন অস্তিত্বই ছিল না। বর্তমানে যে স্থানে বায়তুল্লাহ শরীফ অবস্থিত সেই সময় সে স্থানটির আকার ছিল ঠিক একটি উঁচু টিলার মতো। কোন সময় প্লাবনের সৃষ্টি হলে ডান কিংবা বাম দিক দিয়ে সেই প্লাবনের ধারা বয়ে চলে যেত। সেই সময় যমযম কূপের পাশে মসজিদুল হারামের উপরিভাগে বিরাট আকারের একটি বৃক্ষ ছিল। ইবরাহীম (আঃ) স্ত্রী হাজেরা এবং শিশু পুত্র ইসমাঈল (আঃ)-কে সেই বৃক্ষের নীচে রেখে গেলেন।
সেই সময় এ স্থানে না ছিল কোন জলাশয় বা পানির কোন উৎস, ছিল না কোন লোকালয় বা জনমানব বসতি। একটি পাত্রে কিছু খেজুর এবং একটি ছোট্ট মশকে কিছুটা পানি রেখে ইবরাহীম (আঃ) আবার পাড়ি জমালেন সেই ফিলিস্তিন ভূমে। কিন্তু দিন কয়েকের মধ্যেই ফুরিয়ে গেল খেজুর, ফুরিয়ে গেল পানিও। কঠিন সংকটে নিপতিত হলেন হাজেরা এবং শিশু পুত্র ইসমাঈল। কিন্তু এ ভয়াবহ সংকটেরও সমাধান হয়ে গেল আল্লাহ তা‘আলার অসীম মেহেরবানীতে অলৌকিক পন্থায়। সৃষ্টি হল আবে হায়াত যমযম ধারা। ঐ একই ধারায় সংগৃহীত হল দীর্ঘ সময়ের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পণ্য সামগ্রী।[5]
কিছুকাল পর ইয়ামান থেকে এক গোত্রের লোকজনেরা সেখানে আগমন করেন। ইসলামের ইতিহাসে এ গোত্রকে ‘জুরহুম সানী’’ বা ‘দ্বিতীয় জুরহুম বলা হয়ে থাকে। এ গোত্র ইসামাঈল (আঃ)-এর মাতার নিকট অনুমতি নিয়ে মক্কাভূমিতে অবস্থান করতে থাকেন। এ কথাও বলা হয়ে থাকে যে প্রথমাবস্থায় এ গোত্র মক্কার আশপাশের পর্বতময় উন্মুক্ত প্রান্তরে বসতি স্থাপন করেছিলেন। সহীহুল বুখারী শরীফে সুস্পষ্টভাবে এতটুকু উল্লেখ আছে যে, মক্কা শরীফে বসবাসের উদ্দেশ্যে তাঁরা আগমন করেছিলেন ইসমাঈল (আঃ)-এর আগমনের পর কিন্তু তাঁর যৌবনে পদার্পণের পূর্বে। অবশ্য তার বহু পূর্ব থেকেই তাঁরা সেই পর্বত পরিবেষ্টিত প্রান্তর দিয়ে যাতায়াত করতেন।[6]
পরিত্যক্ত স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে ইবরাহীম (আঃ) সময় সময় মক্কাভূমিতে আগমন করতেন। কিন্তু তিনি কতবার মক্কার পুণ্য ভূমিতে আগমন করেছিলেন তার সঠিক কোন বিবরণ বা হদিস খুঁজে পাওয়া যায় নি। তবে ইতিহাসবিদগণের অভিমত হচ্ছে যে, তিনি চার বার মক্কায় আগমন করেছিলেন, তাঁর এ চার দফা আগমনের বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত হল:
১. কুরআনুল মাজীদে বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা স্বপ্নযোগে ইবরাহীম খলিলুল্লাহ (আঃ)-কে দেখালেন যে তিনি আপন পুত্র ইসমাঈল (আঃ) কে কুরবাণী করেছেন। প্রকারান্তরে এ স্বপ্ন ছিল আল্লাহ তা‘আলার একটি নির্দেশ এবং পিতাপুত্র উভয়েই একাগ্রচিত্তে সেই নির্দেশ পালনের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন মনে প্রাণে।
{فَلَمَّا أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِيْنِ وَنَادَيْنَاهُ أَنْ يَا إِبْرَاهِيْمُ قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا إِنَّا كَذٰلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِيْنَ إِنَّ هٰذَا لَهُوَ الْبَلَاء الْمُبِيْنُ وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيْمٍ} (سورة صافات ٣٧ : ١٠٣-١٠٧)
‘পিতা যখন পুত্রকে কুরবাণী করার উদ্দেশ্যে কপাল-দেশ মাটিতে মিশিয়ে উপুড় করে শুইয়ে দিলেন তখন আল্লাহ তা‘আলার বাণী ঘোষিত হল, ‘হে ইবরাহীম! তোমার স্বপ্নকে তুমি সর্বতোভাবে সত্যে পরিণত করেছ। অবশ্যই আমি সৎকর্মশীলগণকে এভাবেই পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চিতরূপে এ ঘটনা ছিল আল্লাহর তরফ থেকে এক মহা অগ্নি পরীক্ষা এবং আল্লাহ তা‘আলা বিনিময়ে তাঁদেরকে স্বীয় মনোনীত একটি বড় রকমের প্রাণী দান করেছিলেন।’’[7]
‘মাজমুআহ’ বাইবেলের জন্ম পর্বে উল্লেখ আছে যে, ইসমাঈল (আঃ) ইসহাক্ব (আঃ)-এর চাইতে ১৩ বছরের বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন এবং কুরআন শরীফের হিসাব অনুযায়ী ঐ ঘটনা ইসহাক্ব (আঃ)-এর পূর্বে সংঘটিত হয়েছিল। কারণ, ইসমাঈল (আঃ)-এর বিস্তারিত বর্ণনার পর ইসহাক্ব (আঃ)-এর জন্ম প্রসঙ্গে সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। এ ঘটনা থেকেই একথা প্রতিপন্ন এবং সাব্যস্ত হয় যে ইসমাঈল (আঃ)-এর যৌবনে উপনীত হওয়ার আগে কমপক্ষে একবার ইবরাহীম (আঃ) মক্কা আগমন করেছিলেন। অবশিষ্ট তিন সফরের বিবরণ সহীহুল বুখারী শরীফের এক দীর্ঘ বর্ণনার মধ্যে পাওয়া যায় যা ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে সরাসরি বর্ণিত হয়েছে।[8] তার সংক্ষিপ্তসার হচ্ছে নিম্নরূপ :
২. ইসমাঈল (আঃ) যখন যৌবনে পদার্পণ করলেন তখন জুরহুম গোত্রের লোকজনদের নিকট থেকে আরবী ভাষা উত্তমরূপে আয়ত্ত করেন এবং সবদিক দিয়েই সংশ্লিষ্ট সকলের শুভ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। এরপর কিছু সময়ের মধ্যেই এ গোত্রের এক মহিলার সঙ্গে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যান। এমন এক অবস্থার মধ্য দিয়ে যখন সময় অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছিল তখন তাঁর নয়নমনি ইসমাঈল (আঃ) কে শোক সাগরে ভাসিয়ে হাজেরা জান্নাতবাসিনী হয়ে যান। (ইন্না লিল্লাহ…..রাজিউন)
এ দিকে পরিত্যক্ত পরিবারের কথা স্মৃতিপটে উদিত হলে ইবরাহীম (আঃ) পুনরায় মক্কা অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। সহধর্মিণী হাজেরা তখন জান্নাতবাসিনী। তিনি প্রথমে গিয়ে উপস্থিত হলেন ইসমাঈল (আঃ)-এর গৃহে। কিন্তু তাঁর অনুপস্থিতির কারণে পিতা-পুত্রের মধ্যে সাক্ষাৎকার আর সম্ভব হল না। দেখা-সাক্ষাৎ এবং কথাবার্তা হল পুত্র বধূর সঙ্গে। আলাপ আলোচনার এক পর্যায়ে পুত্রবধূ সাংসারিক অসচ্ছলতার অভিযোগ অনুযোগ পেশ করলে তিনি এ কথা বলে উপদেশ প্রদান করেন যে, ‘ইসমাঈল (আঃ)-এর আগমনের পর পরই যেন এ দরজার চৌকাঠ পরিবর্তন করে নেয়া হয়’। পিতার উপদেশের তাৎপর্য উপলব্ধি করে ইসমাঈল (আঃ) তাঁর স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দ্বিতীয় এক মহিলার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এ মহিলা ছিলেন জুরহুম গোত্রের মুযায বিন ‘আমর এর কন্যা।[9]
৩. ইসমাঈল (আঃ)-এর দ্বিতীয় বিয়ের পর ইবরাহীম (আঃ) পুনরায় মক্কা গমন করেন, কিন্তু এবারও পুত্রের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ সম্ভব হয়নি। পুত্রবধূর নিকট কুশলাদি অবগত হতে চাইলে তিনি আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করেন। এতে সন্তুষ্ট হয়ে ইবরাহীম (আঃ) দরজার চৌকাঠ স্থায়ী রাখার পরামর্শ দেন এবং পুনর্বার ফিলিস্ত্বীন অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন।
৪. এরপর ইবরাহীম (আঃ) আবার মক্কা আগমন করেন তখন ইসমাঈল (আঃ) যমযম কূপের নিকট বৃক্ষের নীচে তীর তৈরি করছিলেন। এমতাবস্থায় হঠাৎ পিতাকে দেখতে পেয়ে তিনি যুগপৎ আবেগ ও আনন্দের আতিশয্যে একেবারে লাফ দিয়ে উঠলেন এবং পিতা ও পুত্র উভয়ে উভয়কে কোলাকুলি ও আলিঙ্গনাবস্থায় বেশ কিছু সময় অতিবাহিত করলেন। এ সাক্ষাৎকার এত দীর্ঘসময় পর সংঘটিত হয়েছিল যে সন্তান-বৎসল, কোমল হৃদয় ও কল্যাণময়ী পিতা এবং পিতৃবৎসল ও অনুগত পুত্রের নিকট তা ছিল অত্যন্ত আবেগময় ও মর্মস্পর্শী। ঐ সময় পিতা পুত্র উভয়ে মিলিতভাবে ক্বাবা’হ গৃহ নির্মাণ করেছিলেন। এ ক্বাবা’হ গৃহের নির্মাণ কাজ পরিসমাপ্তির পর সেখানে পবিত্র হজ্জ্বব্রত পালনের জন্য ইবরাহীম (আঃ) বিশ্ব-মুসলিম গোষ্ঠিকে উদাত্ত আহবান জানালেন।
আল্লাহ তা‘আলা মুযায-এর কন্যার গর্ভে ইসমাঈল (আঃ)-এর ১২টি অথবা ৯টি সুসন্তান দান করেন। তাঁদের নাম হচ্ছে যথাক্রমে- নাবিত্ব বা নাবায়ূত, ক্বায়দার, আদবাঈল, মিবশাম, মিশমা‘, দুমা, মীশা, হাদদ, তাইমা ইয়াতুর, নাফিস, ক্বাইদুমান।
ইসমাঈল (আঃ)-এর ১২টি সন্তান থেকে ১২টি গোত্রের সূত্রপাত হয় এবং সকলেই মক্কা নগরীতে বসতি স্থাপন করেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁদের জীবনযাত্রা ছিল ইয়ামান, মিশর, সিরিয়া প্রভৃতি দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর নির্ভরশীল। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে এ গোত্রগুলো ক্রমান্বয়ে আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং এমন কি আরবের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। আল্লাহ তা‘আলার অত্যন্ত প্রিয় এবং মনোনীত এক মহাপুরুষের রক্তধারা থেকে এ সকল গোত্রের সৃষ্টি হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁরা কিন্তু কালচক্রের আবর্তনে সৃষ্ট যবনিকার অন্তরালেই অজ্ঞাত অখ্যাত অবস্থায় থেকে যান। শুধুমাত্র নাবিত্ব এবং ক্বায়দারের বংশধরগণই কালচক্রের আবর্তনে সৃষ্ট গাঢ় তিমির জাল থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে সক্ষম হন। কালক্রমে উত্তর হিজাযে নাবিত্বীদের সাহিত্য ও শিল্প সংস্কৃতির যথেষ্ট উৎকর্ষ সাধিত হয়। শুধু তাই নয়, তাঁরা একক শক্তিশালী জাতি এবং বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন, এবং আশপাশের জনগোষ্ঠীগুলোকে তাঁদের অধিনস্থ করে নিয়ে তাঁদের কাছ থেকে নিয়মিত ট্যাক্স বা করও আদায় করতে থাকেন। এঁদের রাজধানী ছিল বাতরা। এঁদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো সৎ সাহস কিংবা শক্তি আশপাশের কারো ছিল না।
তারপর কালচক্রের আবর্তনে রুমীদের অভ্যূদয় ঘটে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁরা এতই উন্নতি সাধন এবং এত বেশী শক্তি সঞ্চয় করে যে তখন নাবিত্বীদের শক্তি-সামর্থ্য এবং শৌর্যবীর্য্যের কথা রূপকথার মতো কল্প কাহিনীতে পর্যবসিত হয়ে যায়। মাওলানা সৈয়দ সুলাইমান নদভী স্বীয় গবেষণা, আলোচনা ও গভীর অনুসন্ধানের পর একথা প্রমাণ করেছেন যে গাসসান বংশধর এবং মদীনার আনসার তথা আওস ও খাজরায গোত্রের কেউই ক্বাহত্বানী আরবের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না, বরং ঐ অঞ্চলের মধ্যে নাবিত্ব বিন ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশধরগণের যাঁরা অবশিষ্ট ছিলেন কেবল তাঁদেরই অবস্থান আরব ভূমিতে ছিল।[10]
ইমাম বুখারী এ মতরে দিকেই আকৃষ্ট হয়ে তার সহীহুল বুখারীতে নিম্নোক্তভাবে অধ্যায় রচনা করেছেন,
نسبه اليمن إلي اسماعيل عليه السلام
‘ইয়ামানীদের সাথে ইসমাঈল (আঃ)-এর সম্পর্ক’। এর সম্পর্কে ইমাম বেশ কিছু হাদীস দ্বারা প্রমাণ দিয়েছেন। হাফেয ইবনু হাজার আসকালানী ক্বাহত্বানীদেরকে নাবিত্ব বিন ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশধর হওয়ার মতটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
মক্কা নগরীর পুণ্য ভূমিতেই ক্বায়দার বিন ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশবৃদ্ধি হয় এবং কালক্রমে তাঁরা সেখানে প্রগতির স্বর্ণ-শিখরে আরোহণ করেন। তারপর কালচক্রের আবর্তনে এক সময় তাঁরা অজ্ঞাত অখ্যাত হয়ে পড়েন। তারপর সে স্থানে আদনান এবং তাঁর সন্তানাদির অভ্যূদয় ঘটে। আরবের আদনানীগণের বংশ পরম্পরা সূত্র বিশুদ্ধভাবে এ পর্যন্তই সংরক্ষিত রয়েছে।
আদনান হচ্ছে নাবী কারীম (সাঃ)-এর বংশ তালিকায় ২১ তম উর্ধ্বতন পুরুষ। কোন কোন বর্ণনায় বিবৃত হয়েছে যে নাবী কারীম (সাঃ) যখন নিজ বংশ তালিকা বর্ণনা করতেন তখন আদনান পর্যন্ত গিয়ে হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যেতেন, আর একটুও অগ্রসর হতেন না। তিনি বলতেন যে, ‘বংশাবলী সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা ভুল বলেছেন।[11] কিন্তু আলেমগণের মধ্যে এক দলের অভিমত হচ্ছে, আদনান হতে আরও উপরে বংশপরম্পরা সূত্র বর্ণনা করা যেতে পারে। নাবী কারীম (সাঃ) এ বর্ণনাকে ‘দুর্বল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর অনুসন্ধান অনুযায়ী আদনান এবং ইবরাহীম (আঃ)-এর মধ্যবর্তী স্থানে দীর্ঘ ৪০টি পিঁড়ির ব্যবধান বিদ্যমান রয়েছে।
যাহোক, মা’আদ্দ এর সন্তান নাযার সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তিনি ছাড়া মা’আদ্দের অন্য কোন সন্তান ছিল না। কিন্তু এ নাযার থেকেই আবার কয়েকটি পরিবার অস্তিত্ব লাভ করেছে। প্রকৃতপক্ষে নাযারের ছিল চারটি সন্তান এবং প্রত্যেক সন্তান থেকেই এক একটি গোত্রের গোড়াপত্তন হয়েছিল। নাযারের এ চার সন্তানের নাম ছিল যথাক্রমে ইয়াদ, আনমার, রাবী’আহ এবং মুযার। এদের মধ্যে রাবী’আহ এবং মুযার গোত্রের শাখা-প্রশাখা ব্যাপকভাবে বিস্তৃত লাভ করে। অতএব, রাবী’আহ হতে আসাদ ও যুবাই’আহ; আসাদ হতে ‘আনযাহ ও জালীদাহ; জালীদাহ হতে অনেক প্রসিদ্ধ গোত্র যেমন- আব্দুল ক্বায়স, নামির, বনু ওয়ায়িল গোত্রের উৎপত্তি; বাকর, তাগলিব বনু ওয়ায়িলের অন্তর্ভুক্ত; বনু বাকর হতে বনু ক্বায়সম বনু শায়বাহন, বুন হানীফাহসহ অন্যান্য গোত্র অস্তিত্ব লাভ করে। আর বনু’ আনযাহ হতে বর্তমান সৌদি আরবের বাদশাহী পরিবার আলে সউদ-এর উদ্ভব।
মুযারের সন্তানগণ দুইটি বড় বড় গোত্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সে গোত্র দু’টো হচ্ছে:
(১) ক্বায়স আ‘ইলান বিন মুযার, (২) ইলিয়াস বিন মুযার।
ক্বায়স আ‘ইলান হতে বনু সুলাইম, বনু হাওয়াযিন, বনু সাক্বীফ, বনু সা’সা’আহ ও বুন গাত্বাফান। গাত্বাফান হতে আ‘বস, যুবইয়ান, আশজা‘ এবং গানি বিন আ‘সার গোত্র সমূহের সুত্রপাত হয়।
ইলিয়াস বিন মুযার হতে তামীম বিন মুররাহ, হুযাইল বিন মুদরিকাহ, বনু আসাদ বিন খুযাইমাহ এবং কিনানাহ বিন খুযাইমাহ গোত্রসমূহের উদ্ভব হয়। তারপর কিনানাহ হতে কুরাইশ গোত্রের উদ্ভব হয়। এ গোত্রটি ফেহর বিন মালিক বিন নাযার বিন কিনানাহ এর সন্তানাদি।
তারপর কুরাইশ গোত্র বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হয়েছে। এর মধ্যে মশহুর শাখাগুলোর নাম হচ্ছে- জুমাহ, সাহম ‘আদী, মাখযুম, তাইম, যুহরাহ এবং কুসাই বিন কিলাব এর বংশধরগণ। অর্থাৎ আব্দুদ্দার বিন কুসাই, আসাদ বিন আব্দুল ওযযা এবং আবদে মানাফ এ তিন গোত্রই ছিল কুসাইয়ের সন্তান।
এঁদের মধ্যে আব্দে মানাফের ছিল চার পুত্র এবং চার পুত্র থেকে সৃষ্টি হয় চারটি গোত্রের, অর্থাৎ আব্দে শামস, নওফাল, মোত্তালেব এবং হাশিম। এ হাশিম গোত্র থেকেই আল্লাহ তা‘আলা আমাদের প্রিয় নাবী মুহাম্মাদ (সাঃ) কে নাবী ও রাসূলরূপে মনোনীত করেন।[12]
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন যে, আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম (আঃ)’র সন্তানাদির মধ্য থেকে ইসমাঈল (আঃ) কে, ইসমাঈল (আঃ)-এর সন্তানাদির মধ্যে থেকে কিনানাহকে মনোনীত করেন। কিনানাহর বংশধারার মধ্য থেকে কুরাইশকে, কুরাইশ থেকে বনু হাশিমকে এবং বনু হাশিম থেকে আমাকে মনোনীত করেন।[13]
ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সৃষ্টি করেন এবং আমাকে সর্বোত্তম দলভুক্ত করেন। তারপর গোত্রসমূহ নির্বাচন করা হয় এবং এক্ষেত্রেও আমাকে সর্বোত্তম গোত্রের মধ্যে শামিল করা হয়। তারপর পারিবারিক মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য করা হয় এবং এক্ষেত্রেও আমাকে অত্যন্ত মর্যাদাশীল পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অতএব, আমি আমার ব্যক্তিসত্তায় যেমন উত্তম, বংশ মর্যাদার ব্যাপারেও তেমনি সব চাইতে উত্তম।[14]
যাহোক, আদনানের বংশধরগণ যখন অধিক সংখ্যায় বৃদ্ধি পেতে লাগলেন তখন জীবিকার অন্বেষণে আরব ভূখন্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েন। এ প্রেক্ষিতে আব্দুল ক্বায়স গোত্র, বাকর বিন ওয়ায়েলের কয়েকটি শাখা এবং বনু তামীমের বংশধরগণ বাহরায়েন অভিমুখে যাত্রা করেন এবং সেখানে বসতি স্থাপন করে বসবাস করতে থাকেন।
বনু হানীফা বিন সা‘ব বিন আলী বিন বাকর গোত্র ইয়ামামা অভিমুখে গমন করেন এবং তার কেন্দ্রস্থল হুজর নামক স্থানে বসতি স্থাপন করেন। বাকর বিন ওয়ায়েল গোত্রের অবশিষ্ট শাখাসমূহ ইয়ামামা থেকে বাহরায়েন, সাইফে কাযেমা, বাহর, সওয়াদে ইরাক, উবুল্লাহ এবং হিত প্রভৃতি অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন।
বনু তাগলব গোত্র ফোরাত উপদ্বীপ অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে বসবাস করতে থাকেন। অবশ্য তাঁদের কোন শাখা বনু বকরের সঙ্গেও বসবাস করতে থাকেন। এ দিকে বনু তামীম গোত্র বসরার প্রত্যন্ত অঞ্চলকে বসবাসের জন্য উপযুক্ত ভূমি হিসেবে মনোনীত করেন।
বনু সুলাইম গোত্র মদীনার নিকটবর্তী স্থানে বসতি স্থাপন করেন। তাঁদের আবাসস্থল ছিল ওয়াদিউল কুরা হতে আরম্ভ করে খায়বার এবং মদীনার পূর্বদিক দিয়ে অগ্রসর হয়ে হাররায়ে বনু সুলাইমের সাথে মিলিত দু্ই পাহাড় পর্যন্ত বিস্তৃত।
বনু আসাদ তাঁর বসতি স্থাপন করেন তাইমার পূর্বে ও কুফার পশ্চিমে। ওঁদের ও তাইমার মধ্যভাগে বনু ত্বাই গোত্রের এক বোহতার পরিবারের আবাদ ছিল। বনু আসাদের কর্ষিত ভূমি এবং কুফার মধ্যকার পথের দূরত্ব ছিল পাঁচদিনের ব্যবধান।
বনু যুবইয়ার গোত্র বসতি স্থাপন ও আবাদ করতেন তাইমার নিকটে হাওয়ানের আশপাশে।
বনু কিনানাহ গোত্রের লোকজন থেকে যান তেহামায়। এদের মধ্য থেকে কুরাইশগণ বসতি স্থাপন করেন মক্কা এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল সমূহে। এ সব লোক ছিলেন বিচ্ছিন্ন ধ্যান-ধারণার অধিকারী। তাঁদের মধ্যে কোন নিয়ম শৃঙ্খলা ছিল না। এভাবেই তাদের জীবনধারা চলে আসছিল। তারপর কুসাই বিন কিলাব নামক এক ব্যক্তি তাঁদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং সঠিক পরিচালনাদানের মাধ্যমে তাঁদেরকে প্রচলিত অর্থে মর্যাদা ও সম্মানের আসনে উন্নীত করেন এবং ঐশ্বর্যশালী ও বিজয়ী করেন।[15]
ফুটনোটঃ[1] ১৯৯৪ সালে লেখক কর্তৃক সম্পাদিত কপিতে জুরহুম, হাযূর, ওয়াবার, ‘আবীল, জাসিম, হাযারামাওত নামগুলো বৃদ্ধি করেছেন। যা পুরাতন কপিতে নেই।
[2] গোত্র সমূহের বিস্তারিত বিবরণাদির জন্য দ্রষ্টব্য আল্লামা খুযরীরঃ ‘মোহাযারাতে তাবীখিল উমামিল ইসলামিয়াহ’ ১ম খন্ড ১১-১৩ পৃঃ এবং ‘কালার জাযীরাতুল আরব’ ২৩১-২৩৫ পৃঃ। দেশত্যাগের ঘটনাবলীর সময় এবং কারণ বির্ধারণের ব্যাপারে ঐতিহাসিক উৎসবের মধ্যে যথেষ্ট মত পার্থক্য রয়েছে। বিভিন্ন দিক আলোচনা পর্যালোচনা করে যা সঠিক বিবেচনা করা হয়েছে তাই এখানে লিপিবদ্ধ হলো।
[3] কথিত আছে যে হাজেরা দাসী ছিলেন কিন্তু আল্লামা সুলাইমান মানসুরপুরী ব্যাপক গবেষণা ও অনুসন্ধান কাজ চালিয়ে সাব্যস্ত করেছেন যে তিনি দাসী ছিলেন না। তিনি ছিলেন ফেরাউনের মেয়ে মুক্ত এবং স্বাধীন। দ্রষ্টব্য রহামাতুল্লিল আলামীন, ২য় খন্ড ৩৬-৩৭ পৃঃ
[4] উলেখিত গ্রন্থের ৩৪ পৃষ্ঠার বিস্তারিত ঘটনা দ্রষ্টব্য সহীহা বুখারী ১ম খন্ড ৪৮৪ পৃ দ্রঃ।
[5] ‘সহীহুল বুখারী শরীফ ১ম খন্ড আম্বিয়া পর্ব, পৃঃ ৪৭৪-৪৭৫।
[6] ‘সহীহুল বুখারী শরীফ ১ম খন্ড আম্বিয়া পর্ব, পৃঃ ৪৭৫।
[7] সূরাহ সাফফাতঃ [(২৩) ১০৩-১০৭]
[8] সহীহুল বূখারী শরীফঃ ১ম খন্ড ৪৭৫-৪৭৬ পৃঃ।
[9] ‘‘কালব জাযীরাতুল আরব’’ ২৩০ পৃঃ।
[10] সৈয়দ সোলাইমান নদভীঃ তারিখে আরযুল কুরআন ২য় খন্ড ৭৮-৮৬ পৃঃ এবং ডঃ এম মজীবুর রহমানঃ মদীনার আনসারঃ পৃঃ ১৩-২৩।
[11] ইবন্ জাবীর তারাবীঃ তারীখূল উমাম ওয়ালি মূলক ১ম খন্ড ১৯১-১৯৪ পৃঃ। ‘আল ই’লাম’’ ৫ম খন্ড ৬ পৃঃ।
[12] আল্লামা খুযরীঃ মুহাযারাত ১ম খন্ডঃ ১৪-১৫পৃঃ।
[13] সহীহুল মুসলিম শরীফঃ ২য় খন্ডঃ ২৪৫ পৃঃ জামে তিরমিযী ২য় খন্ডঃ ২০১ পৃঃ।
[14] তিরমিযী শরীফ ২য় খন্ডঃ ২০১ পৃঃ।
[15] আল্লামা খুযরী মুহাযারাত ১ম খন্ড ১৫-১৬ পৃঃ।
সমসাময়িক আরবের বিভিন্ন রাজ্য ও নেতৃত্ব প্রসঙ্গ (الحُكْـمُ وَالْإِمَـارَةُ فِي الْعَـرَبِ )
আরব উপদ্বীপে নাবী সাঃ-এর দাওয়াত প্রকাশের প্রাক্কালে দু’প্রকারের রাজ্য শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল।
১. মুকুট পরিহিত সম্রাট। তবে তারা প্রকৃত পক্ষে সম্পূর্ণ স্বাধীন বা মুক্ত ছিলেন না।
২. গোত্রীয় দলনেতাগণ। মুকুট পরিহিত সম্রাটগণের যে মর্যাদা ছিল অন্যান্য খ্যাতিসম্পন্ন গোত্রীয় দলনেতাগণেরও সেই মর্যাদা ছিল। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁদের যে বিশেষ বৈশিষ্ট্যটি ছিল তা হচ্ছে, তাঁরা ছিলেন সম্পূর্ণ স্বাধীন। যে সকল সাম্রাজ্যে মুকুটধারী সম্রাটগণের প্রশাসন কায়েম ছিল সেগুলো হচ্ছে শাহানে ইয়ামান, শাহানে আলে গাসসান (শামরাজ্য) এবং শাহানে হীরাহ (ইরাক)। অবশিষ্ট অন্যান্য সকল ক্ষেত্রেই ছিল গোত্রীয় দলনেতার প্রশাসন।
ইয়ামান সাম্রাজ্য (المُلْكُ بِالْيَمَنِ) :
আরবে ‘আরিবার অন্তর্ভুক্ত যে সকল সম্প্রদায় প্রাচীনতম ইয়ামান সম্প্রদায় হিসেবে চিহ্নিত ছিল তারাই ছিল সাবা সম্প্রদায় ভুক্ত। প্রাচীন ‘উর’ (ইরাক) ভূখন্ডের বহু পুরাতন ধ্বংসপ্রাপ্ত শহরের ধ্বংসস্তুপ থেকে যে সকল তথ্য প্রমাণাদি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে তাতে খ্রীষ্টপূর্ব আড়াই হাজার বছর পূর্বের সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখিত হয়েছে। কিন্তু খ্রীষ্টপূর্ব একাদশ শতকে তাঁদের অভ্যূদয় সূচিত হয়েছিল বলে তথ্য প্রমাণাদিসূত্রে অনুমিত হয়েছে। গবেষণালব্ধ তথ্যাদির ভিত্তিতে তাঁদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে যে ধারণা করা হয়ে থাকে তা হচ্ছে নিম্নরূপ:
১. খ্রীষ্টপূর্ব ৬২০ হতে ১৩০০ অব্দ পর্যন্ত।
এসময়ে কিছু নির্দিষ্ট দেশসমূহে তাদের রাজত্ব ছিল বলে জানা যায়। যাওফ’এ অর্থাৎ নাযরান ও হাজরামাওত এর মধ্যবর্তী স্থানে তাদের আধিপত্য প্রকাশ পায়। অতঃপর তানমূ অধিকৃত হয় এবং পরবর্তীতে তাদের সাম্রাজ্য ব্যাপকভাবে প্রশস্ত হয় ও বিস্তার লাভ করে এমন কি তাদের রাজনৈতিক প্রভাব উত্তর হিযাজের ‘মা‘আন ও উ‘লা’ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
কথিত আছে যে, তাদের কলোনী বা উপনিবেশ আরববিশ্বের বাইরেও বিস্তার লাভ করে। ব্যবসায় ছিল তাদের প্রধান জীবিকা। অতঃপর মায়ারিবের সেই বিখ্যাত বাঁধ নির্মাণ করা হয় যা ইয়ামানের ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় ছিল। তাদেরকে পৃথিবীর প্রভূত কল্যাণ দেয়া হয়েছিল। কুরআনে এসেছে, {حَتّٰى نَسُوْا الذِّكْرَ وَكَانُوْا قَوْمًا بُوْرًا} ‘পরিণামে তারা ভুলে গিয়েছিল (তোমার প্রেরিত) বাণী, যার ফলে তারা পরিণত হল এক ধ্বংশপ্রাপ্ত জাতিতে।’
সেই সময়কালে শাহানে সাবার মর্যাদাসূচক উপাধি ছিল ‘মোকাররবে সাবা’। তাঁর রাজধানী ছিল সিরওয়াহ- যার ধ্বংসপ্রাপ্ত অট্টালিকা চিহ্ন আজও মায়ারেব শহর থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে ৫০ কিলোমিটার পথের দূরত্বে ও ‘সনয়া’ থেকে ১৪২ কিলোমিটার পূর্বে দেখতে পাওয়া যায় এবং তা খারিবা নামে প্রসিদ্ধ রয়েছে। এ রাজ্য বংশানুক্রমে ২২ থেকে ২৩ জন বাদশা দেশ শাসন করেন।
২. খ্রীষ্টপূর্ব ৬২০ অব্দ থেকে ১১৫ অব্দ পর্যন্ত।
এসময় কালে তাদের রাজত্বকে ‘সাবা সাম্রাজ্য’ বলা হতো। ‘সাবা’ সম্রাটগণ মোকাররব উপাধি পরিত্যাগ করে ‘রাজা’ (বাদশা) সম্মানসূচক উপাধি গ্রহণ করেন এবং ‘সারওয়াহ’ এর পরিবর্তে মায়ারেবকে সাম্রাজ্যের রাজধানী ঘোষণা দেন। সেই শহরের ধ্বংসস্তুপ আজও ‘সনয়া’ নামক স্থানের ১৯২ কিলোমিটার পূর্বে পরিদৃষ্ট হয়।
৩. খ্রীষ্টপূর্ব ৩০০ থেকে ১১৫ অব্দ পর্যন্ত।
এ সময়ে তাদের রাজত্বকে ‘প্রথম হিমইয়ারী’ বলা হয়। কেননা সাবা রাষ্ট্রের উপর ‘হিময়ার’ গোত্র প্রাধান্য লাভ করে ও সাবা রাজ্য সংকুচিত হয়ে পড়ে। তাদের রাজ্যকে ‘সাবা ও যূ রায়দান’ বলা হয়। আর তারা মায়ারেবের পরিবর্তে ‘রায়দানকে’ রাজধানী করেন। পরে রাজধানীর নাম ‘রায়দান’ পরিবর্তন করে ‘জিফার’ রাখা হয়। এ শহরের ধ্বংসাবশেষ আজও ‘ইয়ারিম’ শহরের নিকটে এক গোলাকার পর্বতে পরিদৃষ্ট হয়।
এ সময় থেকেই সাবা সম্প্রদায় এর পতন শুরু হয়ে যায়। নাবেতীয়গণ প্রথমে হিজাযের উত্তর প্রদেশে নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করে নিয়ে সাবা সম্প্রদায়ের বসতি স্থাপনকারীদের সেখান থেকে বহিস্কার করেন। অধিকন্তু রুমীগণ মিশর, শাম এবং হেজাজের উত্তরাঞ্চল দখল করে নেয়ার ফলে সমুদ্রপথে তাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এভাবে ক্রমান্বয়ে তাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্য সংকুচিত হতে হতে শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে ক্বাহত্বানী গোত্র সমূহও নিজেদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং কলহে লিপ্ত হয়ে পড়ার ফলে নিজ নিজ আবাস স্থল পরিত্যাগ করে তাঁরা নানা দিকে ছড়িয়ে পড়েন।
(৪) ৩০০ খ্রীষ্ট্রাব্দের পর থেকে ইসলামের আবির্ভাব পর্যন্ত।
এ সময়ে তাদের রাজত্বকে ‘দ্বিতীয় হিমইয়ারী’ বলা হয় এবং তাদের রাজ্য ‘সাবা, যূ রায়দান, হাজরামাওত ও ইয়ামনত’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ইয়ামানের মধ্যে অব্যাহতভাবে অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা ঘটতে থাকে। একের পর এক বহু বিপ্লব ও গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হতে থাকে এবং এর ফলে বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপের অবাঞ্ছিত সুযোগ সৃষ্টি হয়ে যায়। এমন কি এ পর্যায়ে এমন এক অবস্থার উদ্ভব হয় যার ফলশ্রুতিতে ইয়ামানের স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়ে যায়। পক্ষান্তরে সেই যুগের রুমীগণ এডেন দ্বীপে সৈন্য সমাবেশ করে তার উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করেন। তারপর হিময়ার ও হামদানের পারস্পরিক আত্মকলহের সুযোগ নিয়ে হাবশীগণ রুমী গোত্রের সহায়তায় তাঁদের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেন ৩৪০ খ্রীষ্টাব্দে। হাবশীগণের এ দখলদারিত্ব স্থায়ী থাকে ৩৭৮ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত। এর পর ইয়ামানের স্বাধীনতা এক প্রকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়ে গেল। কিন্তু মায়ারিবের মশহুর বাঁধে শুরু হল ফাটল। সেই ফাটল ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে পেতে অবশেষে ৪৫০ অথবা ৪৫১ খ্রীষ্টাব্দে বাঁধটি ভেঙ্গে যায়। এ বাঁধের ভাঙ্গনের ফলে ভয়াবহ প্লাবনের সৃষ্টি হয়ে যায়, যার উল্লেখ কুরআন শরীফের (সুরা সাবা) সায়লে আরেম নামে উল্লেখিত হয়েছে। এ ভয়াবহ প্লাবনের ফলে গ্রামের পর গ্রাম উজার হয়ে যায় এবং বহু গোত্র নানা দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে।
পরবর্তীকালে ৫২৩ খ্রীষ্টাব্দে পুনরায় ভিন্ন ধাঁচের এক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়। ইয়ামানের ইহুদী সম্রাট ‘যূনওয়াস’ নাজরানের খ্রীষ্টানদের উপর এক ন্যাক্কারজনক আক্রমণ পরিচালন করে খ্রীষ্ট ধর্ম পরিত্যাগ করে ইহুদী ধর্ম গ্রহণ করার জন্য তাঁদের উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন। কিন্তু খ্রীষ্টানগণ কোনক্রমেই এতে সম্মত না হওয়ায় ‘যূনওয়াস’ কতগুলো গর্ত খনন করে তাতে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করেন এবং সেই সকল অগ্নিকুন্ডে খ্রীষ্টানদের নিক্ষেপ করেন। কুরআন শরীফের সূরাহ বূরুজের {قُتِلَ أَصْحَابُ الْأُخْدُوْدِ} শেষ অবধি আয়াত দ্বারা এ লোমহর্ষক ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
এ ঘটনার ফল এ দাঁড়ায় যে রুমীয় সম্রাটগণের নেতৃত্বে খ্রীষ্টানগণ আরব উপদ্বীপের শহর ও নগরের উপর বার বার আক্রমণ চালিয়ে বিজয়ী হতে থাকেন। এতে উৎসাহিত হয়ে ইহুদীদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য তাঁরা সংকল্পবদ্ধ হয়ে যান এবং এ প্রতি আক্রমণে অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা দানের জন্য হাবশীগণকে সরবরাহ করা হয়। রুমীগণের সহযোগিতা লাভের ফলে হাবশীগণ বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেন এবং ৫২৫ খ্রীষ্টাব্দে ইরয়াতের নেতৃত্বে ৭০ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হন এবং পুনরায় ইয়ামানের উপর রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন। হাবশা সম্রাটের গর্ভনর হিসেবে ইরয়াত ইয়ামানের শাসন কাজ পরিচালনা করতে থাকেন। কিন্তু আবরাহা বিন সাবাহ আল আশরাম নামে তাঁর অধীনস্থ এক সৈনিক ৫৪৯ খ্রীষ্টাব্দে তাঁকে হত্যা করে নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন এবং অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে হাবশ সম্রাটের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলতে সক্ষম হন এবং খুশী করেন। ইনি ছিলেন সেই আবরাহা যিনি ক্বাবা’হ গৃহ ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে বিশাল হস্তী বাহিনী সহ ক্বাবা’হ অভিমুখে অভিযান পরিচালনা করেন এবং শেষ পর্যন্ত আল্লাহর পক্ষী বাহিনী কর্তৃক সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস প্রাপ্ত হন। আসমানী গ্রন্থ আল কুরআনে এ ঘটনা ‘আসহাবে ফীল’ (হস্তীবাহিনী) নামে প্রসিদ্ধ রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা ফীলের ঘটনার পর সনয়া ফিরে আসার পর তাকে ধ্বংশ করেন। তারপর তার পুত্র ইয়াকসূম সিংহাসনে আরোহন করেন। এরপর রাজত্ব করেন দ্বিতীয় পুত্র মাসরূক। তাদের উভয়ের সম্পর্কে বলা হয়েছে, তারা ছিল তাদের পিতার থেকেও খারাপ এবং ইয়ামানবাসীকে নিপীড়ন-নির্যাতন ও যুলূম-অত্যাচারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত নিকৃষ্ট স্বভাবের।
আসহাবে ফীলের ঘটনার পর ইয়ামানবাসীগণ পারস্যরাজ্যের সাহায্যপুষ্ট হয়। এবং হাবশীগণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ইয়ামানবাসীগণ সাইফ বিন যূ ইয়াযান হিময়ারীর সন্তান মা’দীকারবের নেতৃত্বে হাবশীগণকে সে দেশ থেকে বহিস্কার করে মুক্ত স্বাধীন সম্প্রদায় হিসেবে মাদী করেককে সম্রাট মনোনীত করেন। এ ছিল ৫৭৫ খ্রীষ্টাব্দের ঘটনা।
স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতালাভের পর মা’দীকারাব কিছু সংখ্যক হাবশীকে নিজের খেদমত এবং রাজদরবারের জাঁকজমক বৃদ্ধির কার্যে নিয়োজিত করেছিলেন। কিন্তু তাঁর এ অবিমৃষ্যকারিতা প্রসূত ভ্রান্ত নীতির কারণে ‘দুগ্ধ কলা সহকারে সর্প পালন’ প্রবাদ বাক্যটি এক মর্মান্তিক সত্যে পরিণত হয়ে যায়। প্রতারণা করে ঐ হাবশীগণ একদিন মা’দীকারাবকে হত্যা করার মাধ্যমে যূ ইয়াযান পরিবারের শাসন ক্ষমতাকে চিরদিনের জন্য স্তব্ধ করে দেয়। আর দেশটি পারস্য সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে পরিণত হয়। এরপর থেকে পারস্য বংশোদ্ভূত কয়েকজন গভর্ণর একাদিক্রমে ইয়ামান প্রদেশের শাসন সংক্রান্ত কর্মকান্ড পরিচালনা করতে থাকেন। অবশেষে সর্বশেষ পার্সী গভর্ণর বাযান ৬২৮ খ্রীষ্টাব্দে ইসলাম গ্রহণ করলে ইয়ামান পারস্য শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে ইসলামী জীবনধারা ও শাসন সৌকর্যের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় লাভ করে।[1]
ফুটনোটঃ[1] সৈয়দ সোলাইমান নদভী (রহঃ) ‘তারিখে আবযুল কুরআন’’ ১ম খন্ড ১৩৩ পৃঃ থেকে শেষ পযন্ত বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রমাণাদির আলোকে সম্প্রদায়ের বিভিন্ন বিবরণসহ আলোচনা করেছেনত, মওদূদী (রহ.)ও তাফহীমুল কুরআনের চতুর্থ খন্ডে ১৯৫-১৯৮ পৃষ্ঠায় বিবরণাদি একত্রিত করেছেন। কিন্তু ইতিহাসের উৎস হিসেবে এ সব ক্ষেত্রে বেশ মত বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি কোন কোন গবেষক বিবরণাদি পূর্ববর্তীগণের কাহিনী বলে বর্ণনা করেছেন। {إِنْ هٰذَا إِلَّا أَسَاطِيرُ الْأَوَّلِينَ} (٨٣) سورة المؤمنون
হীরাহর সাম্রাজ্য (الْمُلْكُ بِالْحِيْرَةِ )
ইরাক এবং উহার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে কুরুশকাবির (৫৫৭-৫২৯ খ্রীষ্টাব্দপূর্বাব্দ) এর সময় হতেই পারস্যবাসীগণের শাসন ব্যবস্থা চলে আসছিল। এ সময়ের মধ্যে তাঁদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো শক্তি কিংবা সাহস কারোরই ছিল না। তারপর খ্রীষ্টাব্দপূর্ব ৩২৬ অব্দে ইসকান্দার মাক্বদূনী পারস্য রাজ প্রথম দারাকে পরাজিত করে পারস্য শক্তিকে সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত করে ফেলে। এর ফলে সাম্রাজ্য ভেঙ্গে টুকরো টুকরো এবং সর্বত্র বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়ে যায়। এ বিশৃঙ্খল অবস্থা চলতে থাকে ২৩০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত। ঐ সময় ক্বাহত্বানী গোত্রসমূহ দেশত্যাগ করে ইরাকের এক শস্য-শ্যামল সীমান্ত অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। এ দিকে আবার দেশত্যাগী আদনানীগণ বিদ্রোহ ঘোষণা করে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে যায়। তারপর যুদ্ধে জয়লাভ করে তাঁরা ফোরাত নদীর উপকূলভাগের এক অংশে বসতি স্থাপন করেন।
এসব হিজরতকারীদের মধ্যে প্রথম সম্রাট ছিলেন ক্বাহত্বান বংশের মালিক বিন ফাহম তানূখী। তিনি আনবারের অধিবাসী ছিলেন বা আনবারের নিকটবর্তী স্থানে। এক বর্ণনা মতে তারপর তার ভাই ‘আমর বিন ফাহম রাজত্ব করেন। অন্য বর্ণনা মতে জাযীমাহ বিন মালিক বিন ফাহম। তার উপাধি ছিল ‘আবরাশ ও ওয়াযযাহ’।
অন্য দিকে ২২৬ খ্রীষ্টাব্দে আরদশীর যখন সাসানী সাম্রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করেন তখন ধীরে ধীরে পারস্য সাম্রাজ্যের হৃত গৌরব ও ক্ষমতার পুনরুদ্ধার হতে থাকে। আরদশীর পারস্যবাসীকে একটি সুশৃঙ্খল জাতিতে পরিণত করেন এবং দেশের সীমান্ত অঞ্চলে বসবাসকারী আরবদের অধীনস্থ করেন। এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কুযা’আহ গোত্র শাম রাজ্যের দিকে গমন করেন। পক্ষান্তরে হীরা এবং আনবারের আরব বাসিন্দাগণ বশ্যতা স্বীকারের ব্যাপারে নমনীয় মনোভাব গ্রহণ করেন।
আরদশীর সময়কালে হীরাহ, বাদিয়াতুল ইরাক এবং উপদ্বীপবাসীগণের রাবীয়ী এবং মুযারী গোত্রসমূহের উপর জাযীমাতুল ওয়ায্যাহদের আধিপত্য ছিল। এ থেকে এটাই বুঝা যায় যে, আরববাসীদের উপর আরদশীর সরাসরি আধিপত্য বিস্তার করতে চাননি। তিনি এটা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, আরববাসীগণের উপর সরাসরি আধিপত্য বিস্তার করার কিংবা সীমান্ত এলাকা থেকে তাদের লুঠতরাজ বন্ধ করা খুব সহজে সম্ভব হবে না। এ প্রেক্ষিতে তিনি একটি বিকল্প ব্যবস্থার কথা চিন্তা করেছিলেন এবং তা ছিল, যদি গোত্র থেকে একজন শাসক নিযুক্ত করা হয় তাহলে তাঁর স্বগোত্রীয় লোকজন এবং আত্মীয়-স্বজনদের পক্ষ থেকে সমর্থন ও সাহায্য লাভ সম্ভব হতে পারে।
এর ফলে আরও যে একটি বিশেষ সুবিধা লাভের সম্ভাবনা ছিল তা হল, প্রয়োজনে রুমীয়গণের বিরুদ্ধে তাঁদের নিকট থেকে সাহায্য গ্রহণের সুযোগ থাকবে। অধিকন্তু, শাম রাজ্যের রোম অভিমুখী আরব অধিপতিদের বিরুদ্ধে ঐ সকল আরব অধিপতিদের দাঁড় করিয়ে পরিস্থিতিকে কিছুটা অনুকূল রাখা সম্ভব হতে পারে। এ প্রসঙ্গে একটি বিষয় বিশেষভাবে সময়ের জন্য মৌজুদ রাখা হতো যার দ্বারা মরুভূমিতে বসবাসকারী বিদ্রোহীদের দমন করা সহজসাধ্য হতো।
২৬৮ খ্রীষ্টাব্দের সময় সীমার মধ্যে জাযীমা মৃত্যুমুখে পতিত হন এবং ‘আমর বিন ‘আদী বিন নাসর লাখমী (২৬৮-২৮৮ খ্রীষ্টাব্দ) তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি ছিলেন লাখম গোত্রের প্রথম শাসনকর্তা ও তিনিই সর্বপ্রথম হীরাহকে স্বীয় বাসস্থান হিসেবে গ্রহণ করেন এবং শাবূর আরদশীর এর সম-সাময়িক। এরপর কুবায বিন ফাইরুযের (৪৪৮-৫৩১ খ্রীষ্টাব্দ) যুগ পর্যন্ত হীরাহর উপর লাখমীদেরই শাসন কায়েম ছিল। কুবাযের সময় মাজদাকের আবির্ভাব ঘটে। তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা নরপতি। কুবায এবং তাঁর বহু প্রজা মাজদাকের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। কুবায আবার হীরাহর সম্রাট মুনযির বিন মাউস সামায়ের (৫১২-৫৫৪ খ্রীষ্টাব্দ) নিকট এ মর্মে সংবাদ প্রেরণ করেন যে, তিনি যেন সেই ধর্মগ্রহণ করে নেন। কিন্তু মুনযির ছিলেন যথেষ্ট আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্ন প্রকৃতির ব্যক্তি। প্রেরিত পয়গামের কোন গুরুত্ব না দিয়ে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এর ফল এটা দাঁড়ায় যে, কুবায তাঁকে তাঁর পদ হতে অপসারণ করে তাঁর স্থানে মাযদাকের এক শিষ্য হারিস বিন ‘আমর বিন হাজর ফিন্দীর হাতে হীরাহর শাসনভার অর্পণ করেন।
কুবাযের পর পারস্যের রাজ্য শাসনভার এসে পড়ে কিসরা আনুশেরওয়ার (৫৩১-৫৭৮ হাতে। ঐ ধর্মের প্রতি তাঁর মনে ছিল প্রবল ঘৃণা। তিনি মাযদাক এবং তাঁর অনুসারীগণের এক বড় দলকে হত্যা করেছিলেন। তারপর পুনরায় মুনযিরের প্রতি হীরাহর শাসনভার অর্পিত হয় এবং হারিস বিন ‘আমরকে তাঁর দরবারে আগমণের জন্য আহবান জানানো হয়। কিন্তু তিনি বনু কালব গোত্রের দিকে পলায়ন করেন এবং সেখানেই বসবাস করতে থাকেন।
মুনযির বিন মাউস সামার পরে নু’মান বিন মুনযিরের (৫৮৩-৬০৫ খ্রীষ্টাব্দ) কাল পর্যন্ত হীরাহর রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব তাঁরই বংশধরের উপর ন্যস্ত করেন। আবার যায়দ বিন আদী ঊবাদী কিসরার নিকট নু’মান বিন মুনযির সম্পর্কে মিথ্যা অভিযোগ করলে কিসরা রাগান্বিত হয়ে নু’মানকে নিজ দরবারে তলব করেন। নু’মান গোপনে বনু শায়বাহন গোত্রের দলপতি হানী বিন মাসউদের নিকট গিয়ে নিজ পরিবারের সদস্যবৃন্দ এবং সহায় সম্পদ তাঁর হেফাজতে দিয়ে কিসরার নিকট যান। কিসরা তাঁকে জেলখানায় আটক করে রাখেন এবং সেখানেই তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন। এ দিকে কিসরা নু’মানকে কয়েদ খানায় আটকের পর তাঁর স্থানে ইয়াস বিন ক্বাবিসাহ তায়ীকে হীরাহর শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন এবং হানী বিন মাস’ঊদের নিকট থেকে নু’মানের রক্ষিত আমানত তলব করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। কিছুটা সূক্ষ্ণ মর্যাদাসম্পন্ন লোক হানী তলবী আমানত প্রদান করতে শুধু যে অস্বীকারই করলেন তাই নয় বরং যুদ্ধ ঘোষণা করে বসলেন। তারপর যা হবার তাই হল। ইয়াস নিজের সুসজ্জিত বাহিনী, কিসরার বাহিনী এবং মুরযবানের পুরো বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হলেন মোকাবিলা করার জন্য। ‘যূ ক্বার’’ নামক ময়দানে উভয় দলের মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে বনু শায়বাহন বিজয়ী হন এবং পারস্যবাসীগণ অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করেন। ইতিহাসে এ যুদ্ধ অতীব গুরত্বপূর্ণ এ কারণে যে, আজমীদের বিরুদ্ধে আরবীদের এটাই ছিল প্রথম বিজয়। এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল নাবী কারীম (সাঃ)-এর জন্মের পর।
ইতিহাসবিদগণ এ যুদ্ধের সময়কাল নিয়ে মতভেদ করেছেন। কেউ বলেছেন, রাসূলে কারীম (সাঃ)-এর জন্মের অল্প কিছুকাল পর। অথচ হীরাহর উপর ইয়াসের আধিপত্য লাভের অষ্টম মাসে নাবী কারীম (সাঃ) দুনিয়াতে তশরীফ আনয়ন করেন। আবার কেউ বলেছেন, নবুওয়াতের কিছুকাল পূর্বে। এটাই সঠিকতার নিকটবর্তী। কেউ বলেছেন, নবুওয়াতের কিছুকাল পর। কেউ বলেছেন, হিজরতের পর। কেউ বলেছেন, বদর যুদ্ধের পর ইত্যাদি।
ইয়াসের পর কিসরা এক পার্সীকে হীরাহর শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। তার নাম আযাদবাহ বিন মাহিব্ইয়ান বিন মিহরাবান্দাদ। তিনি ১৭ বছর (৬১৪-৬৩১ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত) শাসন করেন। কিন্তু ৬৩২ খ্রীষ্টাব্দে লাখমীদের অধিকার পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মুনযির বিন নু‘মান মা’রুব নামক এ গোত্রের এক ব্যক্তি শাসন কাজ পরিচালনে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। কিন্তু এ দায়িত্ব পালনের সময়ানুক্রমে যখন সবেমাত্র অষ্টম মাস অতিক্রান্ত হয়েছিল এমতাবস্থায় তখন ইসলামের বিশ্ববিশ্রুত বীর কেশরী সিপাহ সালার খালিদ বিন ওয়ালীদ ইসলামের উপচে পড়া প্রবহমান প্লাবনধারার অগ্রদূত হিসেবে হীরায় প্রবেশ করেন।
ফুটনোটঃ
শাম রাজ্যের শাসন (المُلْكُ بِالشَّامِ)
যে যুগ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে সেই যুগে এক স্থান থেকে স্থানান্তরের হিজরত করে যাওয়ার এক হিড়িক সৃষ্টি হয়েছিল আরব গোত্র সমূহের মধ্যে। কুযা’আহ গোত্রের কয়েকটি শাখা শাম রাজ্যের সীমানা অতিক্রম করে গিয়ে বসতি স্থাপন করেন সেখানে। বনু সুলাইম বিন হুলওয়ানদের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক ছিল। বনু যাজ’আম বিন সুলাইম নামক যে গোত্রটি যাজা’য়িমাহ নামে পরবর্তী কালে প্রসিদ্ধ লাভ করেছিল তা ছিল ওদের অন্তর্ভুক্ত। কুযা’আহর সেই শাখাকে রুমীগণ আরব মরুভূমিতে যাযাবরগণ কর্তৃক পরিচালিত লুটতরাজের কবল থেকে নিস্কৃতি লাভ ও লুটতরাজ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে এবং পার্সীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য নিজেদের পৃষ্ঠপোষক বানিয়েছিল। এ উদ্দেশ্যে তাঁদেরই এক ব্যক্তির মাথায় রাজ্য শাসনের মুকুট পরিধান করিয়েছিল।
এরপর থেকে বেশ কিছু কাল যাবৎ তাঁরই পরিচালনাধীন রাজ্যের শাসন সংক্রান্ত কর্মকান্ড পরিচালিত হতে থাকে। এদের মধ্যে সব চাইতে প্রসিদ্ধ শাসক ছিলেন সম্রাট যিয়াদ বিন হাবুলাহ। অনুমান করা হয় যে যাজায়েমাহ গোত্র কর্তৃক পরিচালিত রাজ্য শাসন ব্যবস্থা দ্বিতীয় খ্রীষ্টাব্দের পুরোটা জুড়েই চলছিল। তারপর সেই অঞ্চলে গাসসানী গোত্রের বংশধরগণের আগমনের কথাবার্তা চলতে থাকে। এ প্রসঙ্গে এটা বলাই বাহুল্য যে ইতোমধ্যেই গাসসানীগণ বনু যাজাআমাকে পরাজিত করে তাঁদের ক্ষমতা ও সহায় সম্পদ ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। এহেন পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে রুমীগণ গাসসানী বংশের শাসককে শাম অঞ্চলের জন্য আরবীয়দের সম্রাট হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন। গাসসানীদের রাজধানী ছিল ‘বসরা’। রুমীয় কর্মকান্ডের পরিচালক হিসেবে শাম অঞ্চলে পর্যায় ক্রমে সে পর্যন্ত তাঁদেরই রাজত্ব চলতে থাকে, যে পর্যন্ত ফারুকী প্রতিনিধিত্ব কালের মধ্যে ১৩ হিজরীতে ইয়ারমুক যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং গাসসানী বংশের শেষ শাসক জাবলা বিন আইহাম ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন[1]। (যদিও তার অহংবোধ ইসলামী সাম্যকে বেশী সময় পর্যন্ত সহ্য করতে না পেরে সে স্বধর্ম ত্যাগী হয়ে যায়।)
ফুটনোটঃ[1] মুহাযারাতে খুযরী, ১ম খন্ড ৩৪ পৃঃ তারীখে আরযুল কুরআন ২য় খন্ড ৮০-৮২ পৃঃ।
হিজাযের নেতৃত্ব (الإِمَارَةُ بِالْحِيْرَةِ)
এটা সর্বজনিতবিদিত বিষয় যে, মক্কায় জনবসতির সূত্রপাত হয় ইসমাঈল (আঃ)-এর মক্কাবাস থেকে, অতঃপর ১৩৭ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি জীবিত[1] থাকেন এবং আজীবন মক্কাবাসীগণের সর্দার ও বায়তুল্লাহ শরীফের অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন[2]। তাঁর ওফাত প্রাপ্তির পর তাঁর এক সন্তান মক্কার অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেন। কেউ বলেন, দু’সন্তানই- প্রথমে নাবিত্ব ও পরে ক্বায়দার মক্কার অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেন। আবার কেউ এর বিপরীতও বলেছেন। তারপর তাঁর নানা মুযায বিন ‘আমর জুরহুমী রাজ্যের শাসনভার নিজ হাতে গ্রহণ করেন। এভাবে মক্কার নেতৃত্ব বনু জুরহুম গোত্রের হাতে চলে যায় এবং এক যুগ পর্যন্ত তা তাঁদের হাতের মুঠোর মধ্যেই থাকে। যেহেতু ইসমাঈল (আঃ) পিতার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বায়তুল্লাহ শরীফের নির্মাণ কাজ করেছিলেন, সেইহেতু তাঁর সন্তানাদি বিশেষ এক মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত থাকেন। যদিও নেতৃত্ব কিংবা অধিকার লাভে তাঁদের কোন অংশীদারিত্ব ছিল না[3]।
তারপর দিনের পর দিন এবং বৎসরের পর বৎসর অতিবাহিত হতে থাকল। কিন্তু ইসমাঈল (আঃ) সন্তানগণ যেন মাতৃগর্ভেই রয়ে গেলেন। জনসমাজে তাঁরা অজ্ঞাত অখ্যাতই রয়ে গেলেন। পক্ষান্তরে বুখতুনসসরের খ্যাতি প্রকাশিত হওয়ার পূর্ব মূহুর্তে বনু জুরহুম গোত্রের শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং মক্কার আকাশে আদনানীদের রাজনৈতিক নক্ষত্রের দ্যুতি চমকাতে আরম্ভ করে। এর প্রমাণ হচ্ছে, বুখতুনসসর জাতে ‘ইরক্ব নামে স্থানে আরবদের সঙ্গে যে ভীষণ লড়াই করেছিলেন তাতে আরব সৈন্যদের সেনাপতি জুরহুমী ছিলেন না[4] বরং স্বয়ং আদনান ছিলেন সেনাপতি।
খ্রীষ্টপূর্ব ৫৮৭ অব্দে বুখতুনসসর আবার যখন মক্কা আক্রমণ করেন তখন আদনানীগণ পলায়ন করে ইয়ামান চলে যান। সেই সময় ইয়ারমিয়াহ অধিবাসী বারখিয়া যিনি বনি ইসরাঈলগণের নাবী ছিলেন তিনি আদনানের সন্তান মা’আদ্দকে তাঁর সঙ্গে নিয়ে শাম দেশের হার্রানে চলে যান এবং বুখতুনসসরের প্রভাব বিলুপ্ত হয়ে গেলে মা’আদ্দ পুনরায় মক্কায় ফিরে আসেন। মক্কায় প্রত্যাবর্তনের পর জুরহুম গোত্রের মাত্র এক জনের সঙ্গেই তাঁর সাক্ষাৎ হয়। তিনি ছিলেন জাওহাম বিন জালহামাহ। মা’আদ্দ তাঁর কন্যা মুয়া‘নাহকে বিবাহ করেন। তাঁর গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণ করেন নিযার[5]।
এরপর থেকে মক্কায় জুরহুম গোত্রের অবস্থা খুব খারাপ হতে থাকে। তাঁদেরকে প্রকট অসচ্ছলতার মধ্যে নিপতিত হতে হয়। ফলে তাঁরা বায়তুল্লাহর হজ্বতীর্থ যাত্রীদের উপর নানা প্রকার অন্যায় উৎপীড়ন শুরু করে দেয়। খানায়ে ক্বাবা’হহর অর্থ আত্মসাৎ করতেও তাঁরা কোন প্রকার দ্বিধাবোধ করেন না[6]।
এদিকে বনু আদনান গোত্র তাঁদের এ জাতীয় কর্মকান্ডের উপর গোপনে গোপনে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে থাকেন এবং তাঁদের উপর ভয়ানক ক্ষুব্ধ ও কুপিত হয়ে উঠেন। তাই, যখন বনু খুযা’আহ গোত্র মারুয যাহরানে শিবির স্থাপন করেন এবং লক্ষ্য করেন যে বনু আদনান গোত্র বনু জুরহুমকে ঘৃণার চোখে দেখছেন তখন এ সুযোগ গ্রহণ করে এক আদনানী গোত্রকে (বনু বাকর বিন আবদে মানাফ বিন কিনানাহ) সঙ্গে নিয়ে বুন জুরহুম গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আরম্ভ করে দেন এবং মক্কা থেকে তাঁদেরকে বিতাড়িত করে ক্ষমতা দখল করে নেন। এ ঘটনাটি ঘটে দ্বিতীয় খ্রীষ্ট শতাব্দীর মধ্য ভাগে।
বনু জুরহুম গোত্র মক্কা ছেড়ে যাবার সময় যমযম কূপের মধ্যে নানা প্রকার জিনিসপত্র নিক্ষেপ করে তা প্রায় ভরাট করে ফেলেন। যে সব জিনিসপত্র তাঁরা যমযম কূপের মধ্যে নিক্ষেপ করেন, তার মধ্যে ছিল কিছু সংখ্যক ঐতিহাসিক নিদর্শন। মুহাম্মাদ বিন ইসহাক্বের বিবরণ মতে ‘আমর বিন হারিস বিন মুযায জুরহুমী[7] খানায়ে ক্বাবা’হর দুটি হরিণ,[8] কর্ণারে গ্রোথিত পাথরটি (হাজারে আসওয়াদ বা কালোপাথর) বাহির করে নিয়ে তা কূপের মধ্যে নিক্ষেপ করেন। তারপর নিজ গোত্র বনু জুরহুমকে সঙ্গে নিয়ে ইয়ামানে চলে যান। মক্কা হতে বহিস্কার এবং সেখানকার রাজত্ব শেষ হওয়ার কারণে তাঁদের দুঃখের অন্ত ছিল না। এ প্রেক্ষিতেই ‘আমর নীচের কবিতাটি আবৃত্তি করেন,
كأن لم يكن بين الحَجُوْن إلى الصَّفَا
**
أنيـس ولـم يَسْمُـر بمكـــة سامـــر
بلــى نحــن كــنا أهـلــها فأبـادنـا
**
صُرُوْف الليالى والجُدُوْد العَوَاثِر [9]
‘হাজূন থেকে সাফা পর্যন্ত নিশিতে গল্প বলার কেউ ছিল না, কেন নেই? আমরাতো এরই অধিবাসী, সময়ের পরিবর্তনে আজ আমরা ভাগ্যাহত, হায়, আমাদের সর্বহারা বানিয়ে দিয়েছে’
ইসমাঈল (আঃ)-এর যুগ ছিল যীশু খ্রীষ্টের জন্মের আনুমানিক দু’হাজার বছর পূর্বে। সেই হিসেবে মক্কায় জুরহুম গোত্রের অস্তিত্ব ছিল প্রায় দু’হাজার একশত বছর পর্যন্ত এবং তাঁদের রাজত্ব কাল ছিল প্রায় দু’হাজার বছর পর্যন্ত।
মক্কার উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর বনু বাকরকে প্রশাসনিক দায়-দায়িবতে অন্তর্ভুক্ত না করেই বুন খুযা’আহ এককভাবে প্রশাসন পরিচালনা করেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এবং মর্যাদাসম্পন্ন তিনটি পদের অংশীদারিত্ব বনু মুযার গোত্র লাভ করেছিলেন। পদগুলো হচ্ছে যথাক্রমে নিম্নরূপ:
১. হাজীদের আরাফা থেকে মুজাদালেফায় নিয়ে যাওয়া এবং ইয়াওমুন নাফার অর্থাৎ ১৩ই (যিলহজ্জের শেষ দিন) মিনা থেকে রওয়ানা হওয়ার জন্য হাজীদের লিখিত আদেশ প্রদান। এ সম্মানের অধিকারী ছিলেন ইলিয়াস বিন মুযার বংশধরের মধ্যে বনি গাওস বিন মুররাহ যাদের বলা হতো ‘সূফাহ’। এ মর্যাদার ব্যাখ্যা হচ্ছে, ১৩ই জিলহজ্জ তারিখে যতক্ষণ না সুফাহর কোন একজন লোক সকলের আগে কংকর নিক্ষেপ কাজ সম্পন্ন করতেন ততক্ষণ হজ্জযাত্রীগণ কংকর নিক্ষেপ করতে পারতেন না। অধিকন্তু, হজ্জযাত্রীগণ যখন কংকর নিক্ষেপ কাজ সম্পন্ন করতেন এবং মিনা হতে রওয়ানা হওয়ার ইচ্ছা করতেন তখন সুফাহর লোকেরা মিনার একমাত্র পথ ‘আক্বাবাহর দু’পাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে যেতেন এবং যতক্ষণ না তাঁদের সকলের যাওয়া শেষ হতো ততক্ষণ সেই পথে অন্যদেরকে যেতে দেয়া হতো না। তাঁদের চলে যাওয়ার পর অন্যান্য লোকদের জন্য পথ ছেড়ে দেয়া হতো। যখন সুফাহ বিদায় নিল তখন এ সম্মান বনু তামীমের এক পরিবার বনু সা’দ বিন যায়দ মানাতের অনুকূলে গেল।
২. ১০ই জিলহজ্জ্ব তারিখ ‘ইফাজাহর জন্য’ সকালে মুজদালেফা থেকে মিনার দিকে যাত্রা করার ব্যাপারটি ছিল বনু আদওয়ানের এখতিয়ার্ভুক্ত এক মহা সম্মানের প্রতীক।
৩. হারাম মাসগুলোকে এগিয়ে নিয়ে আসা কিংবা পেছিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি ছিল উচ্চ সম্মানের প্রতীক। এ সম্মানের ব্যাপারটি ছিল বনু কিনানাহ গোত্রের অন্যতম শাখা বনু ফুক্বাইম বিন আদীর এখতিয়ার্ভুক্ত[10]।
মক্কার উপর বনু খুযা’আহ গোত্রের কর্তৃত্ব প্রায় তিনশত বছর যাবৎ প্রতিষ্ঠিত ছিল[11]। এ সময়ের মধ্যে আদনানী গোত্রসমূহ মক্কা এবং হিজায সীমান্ত অতিক্রম করে নাজদ, ইরক, বাহরাইন ইত্যাদি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েন। মক্কার আশপাশে কেবলমাত্র কুরাইশদের কয়েকটি শাখা অবশিষ্ট ছিল। তারা হলেন, ‘হুলূল’ ও ‘সিরম’। অবশ্য এদের ঘরবাড়ি বলতে তেমন কিছুই ছিল না। ছড়ানো ছিটানো এবং বিচ্ছিন্ন অবস্থায় এরা ভিন্ন ভিন্ন পাড়ায় বসবাস করতেন। বনু কিনানাহ গোত্রের মধ্যেও বিক্ষিপ্ত অবস্থায় তাদের কয়েকটি ঘড়বাড়ি ছিল। কিন্তু মক্কার প্রশাসন কিংবা বায়তুল্লাহর অভিভাবকত্বে তাঁদের কোন অংশ ছিল না। এমন এক সময়ে কুসাই বিন কিলাব গোত্র আত্মপ্রকাশ করে[12]।
কুসাই সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তিনি যখন মায়ের কোলে ছিলেন তখন তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। এরপর তাঁর মা বনু উযরা গোত্রের রাবী’আহ বিন হারাম নামক এক ব্যক্তির সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যান। এ গোত্র শাম রাজ্যের কোন এক অঞ্চলে বসবাস করত। কাজেই কুসাইয়ের মা কুসাইকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে চলে যান। বয়োঃপ্রাপ্তির পর কুসাই মক্কায় ফিরে আসেন। সেই সময় খুযা’য়ী গোত্রের হুলাইল বিন হাবশিয়া খুযা’য়ী ছিলেন মক্কার অভিভাবক। কুসাই হুলাইল কন্যা হুব্বাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিলে তিনি তা মঞ্জুর করেন এবং উভয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যান[13]। এর কিছু দিন পর হুলাইল মৃত্যু মুখে পতিত হলে মক্কা এবং বায়তুল্লাহর অভিভাবকত্ব নিয়ে খুযা’আহ এবং কুরাইশদের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধোত্তর মক্কায় কুসাইরা হয়ে উঠেন মধ্যমণি। মক্কা এবং বায়তুল্লাহর অভিভাকত্ব অর্পিত হয় তাঁরই হাতে।
খুযা’আহ এবং কুরাইশদের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধের কারণ সম্পর্কে তিন ধরণের বর্ণনা পাওয়া যায়। এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে, যখন কুসাইয়ের সন্তানাদি খুব উন্নতি লাভ করল, তাঁদের হাতে সম্পদের প্রাচুর্য পরিলক্ষিত হল এবং মান-সম্মানও বৃদ্ধি পেতে লাগল এবং এ দিকে হুলাইল যখন মৃত্যুবরণ করলেন তখন কুসাই এটা উপলব্ধি করলেন যে, মক্কার প্রশাসন এবং ক্বাবা’হর অভিভাবকত্বের ব্যাপারে বনু খুযা’আহ ও বকরের তুলনায় তার দাবীই অগ্রাধিকারযোগ্য। তিনি এ ধারণাও পোষণ করতে থাকলেন যে কুরাইশগণ হচ্ছেন ইসমাঈলীয় বংশোদ্ভুত খাঁটি আরব এবং ইসামাঈলীয় বংশের অন্যান্যদের সরদার।
এ প্রেক্ষিতে তিনি কুরাইশ এবং বনু কেননার কিছু সংখ্যক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির সঙ্গে এ মর্মে আলাপ-আলোচনা করেন যে, কেন বনু বাকর এবং বনু খুযা’আহকে মক্কা থেকে বহিস্কার করা হবে না? আলোচনায় অংশগ্রহণকারীগণ এ ব্যাপারে তাঁর মতের সঙ্গে অভিন্নমত পোষণ করেন[14]।
দ্বিতীয় বিবরণ হচ্ছে, বনু খুযা’আহর কথানুযায়ী হুলাইল নিজেই কুসাইকে অসীয়ত করেন যে, তিনিই মক্কার শাসনভার গ্রহণ করবেন এবং ক্বাবা’হর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু খুযা’আহ এ সম্মানজনক পদে কুসাইকে অধিষ্ঠিত করতে অস্বীকার করলে উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে[15]।
তৃতীয় বিবরণ হচ্ছে, হুলাইল তাঁর কন্যা হুব্বার হাতে বায়তুল্লাহর অভিভাবকত্ব ন্যস্ত করেন এবং আবূ গুবশান খুযা’য়ীকে তাঁর প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন। হুব্বার প্রতিনিধি হিসেবে আবূ গুবশান খুযা’য়ীই হয়ে যান ক্বাবা’হর দায়িত্বশীল ব্যক্তি। এ দিকে হুলাইল যখন মৃত্যুবরণ করেন তখন কুসাই এক মশক মদের বিনিময় আবূ গিবশানের নিকট থেকে ক্বাবা’হর অভিভাবকত্ব ক্রয় করে নেন। কিন্তু খুযা’আহ সম্প্রদায় এ জাতীয় ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যাপারটি অনুমোদন না করে বায়তুল্লার ব্যাপারে কুসাইকে বাধা প্রদান করতে থাকেন। কুসাইও কিন্তু ছাড়বার পাত্র নন। বনু খুযা’আহকে মক্কা থেকে বহিস্কার করার মানসে কুরাইশ এবং বনু কিনানাহকে একত্রিত করে তাঁদের সহায়তা লাভের জন্য আবেদন জানালেন। কুসাইয়ের আহবানে সাড়া দিয়ে তাঁরাও একাত্মতা ঘোষণা করলেন।[16]
কারণ যাই হোক না কেন, ঘটনার রূপটি ঠিক এ রকম ছিল যে, হুলাইল যখন মৃত্যুবরণ করলেন সুফা তখন তাই করতে চাইলেন যা তিনি সর্বদা করে আসছিলেন। কুসাই তখন কুরাইশ এবং কিনানাহর লোকজনদের সঙ্গে নিয়ে ‘আক্বাবাহর যে স্থানে তাঁরা সম্মিলিত হয়েছিলেন সেখানে উপস্থিত হয়ে বললেন যে, ‘খানায়ে ক্বাবা’হর অভিভাবকত্বের জন্য তোমাদের তুলনায় আমরা অধিকতর যোগ্য এবং আমাদের দাবী অগ্রগণ্য।’
কিন্তু কুসাইয়ের কথায় কর্ণপাত না করে তাঁরা যুদ্ধ ঘোষণা করে বসলেন। এ যুদ্ধে কুসাই তাঁদের পরাজিত করে তাঁর ইপ্সিত মান-মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেন। এ দিকে কুসাই এবং সুফার মধ্যকার বিরোধের সুযোগ নিয়ে বনু খুযা’আহ ও বনু বাকর অসহযোগিতার পথ অবলম্বন করলে কুসাই তাঁদের ভয় প্রদর্শন করে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেন। কিন্তু এ দু’গোত্রের লোকজন তাঁর কথার কোন গুরুত্ব না দিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করে বসেন। এভাবে উভয় পক্ষই এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পড়েন। এ যুদ্ধে উভয় পক্ষেরই বহু লোকজন হতাহত হয়।
জানমালের প্রভূত ক্ষয়-ক্ষতির পরিপ্রেক্ষিতে আপোষ-নিষ্পত্তির মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের জন্যে শেষ পর্যন্ত উভয় পক্ষের মধ্যেই আগ্রহ পরিলক্ষিত হয় এবং উভয় পক্ষই একটি চুক্তি সম্পাদনে সম্মত হন। এ লক্ষ্যে বনু বাকর গোত্রের ‘ইয়ামার বিন আওফ’’ নামক এক ব্যক্তিকে মধ্যস্থতাকারী মনোনীত করা হয়। সমস্যার সকল দিক পর্যালোচনা করে তিনি রায় দেন যে, মক্কার শাসন এবং খানায়ে ক্বাবা’হর অভিভাবকত্বের ব্যাপারে খুযা’আহর তুলনায় কুসাই অধিকতর যোগ্যতার অধিকারী। অধিকন্তু তিনি আরও ঘোষণা করেন যে, এ যুদ্ধে কুসাই যত রক্তপাত ঘটিয়েছেন তার সবই অর্থহীন এবং পদদলিত বলে ঘোষণা করছি। তাছাড়া এ সিদ্ধান্তও ঘোষিত হল যে, খুযা’আহ ও বন্ধু বাকর যে সকল লোকজনকে হত্যা করেছেন তাঁদের জন্য দিয়াত প্রদান এবং খানায়ে ক্বাবা’হর অভিভাবকত্ব অকুণ্ঠচিত্তে কুসাইয়ের হাতে সমর্পণ করতে হবে। সেই বিচারের রায়ের কারণে ইয়ামারের উপাধি হয়েছিল ‘শাদ্দাখ’[17]। শাদ্দাখ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ‘পদ দলিতকারী ব্যক্তি’’।
এ আপোষ-নিষ্পত্তি এবং চুক্তির ফলে মক্কার উপর কুসাই ও কুরাইশদের পূর্ণ কর্তৃত্ব লাভ সম্ভব হয় এবং বায়তল্লার ধর্মীয় নেতার মহা-সম্মানিত পদটিও কুসাই লাভ করেন। এর ফলে খানায়ে ক্বাবা’হ পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে আরবের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত লোকজনদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক স্থাপিত হতে থাকে। মক্কার উপর কুসাইয়ের আধিপত্যের ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল খ্রীষ্টিয় পঞ্চম শতকের মধ্যভাগে, অর্থাৎ ৪৪০ খ্রীষ্টাব্দের কোন এক সময়ে [18]।
মক্কার শাসন ক্ষমতা লাভের পর কুসাই শাসন ব্যবস্থার কিছুটা সংস্কারমুখী কাজকর্মের দিকে মনোনিবেশ করেন। মক্কার আশপাশে বসবাসরত কুরাইশগণকে মক্কায় নিয়ে এসে তিনি পুরো শহরটাকে তাঁদের মধ্যে বন্টন করে দেয়ার মাধ্যমে প্রত্যেক বংশের লোকজনদের বসবাসের জন্য স্থান নির্ধারণ করে দেন। তবে যাঁরা মাসকে আগে পিছে করতেন তাঁদের, এমন কি আলসফওয়ান, বনু আদওয়ান এবং বনু মুররা বিন আওফ প্রভৃতি গোত্র সমূহের লোকজনদের তাঁদের স্ব-স্ব পদে রাখেন। কারণ, কুসাই মনে করতেন যে, এ সকল কাজকর্মও ধর্মকর্মের অন্তর্ভুক্ত এবং এ সব ব্যাপারে রদ-বদল সঙ্গত নয়[19]।
কুসাইয়ের সংস্কারমুখী কর্মকান্ডের এটাও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল যে, তিনি ক্বাবা’হ হারামের উত্তরে দারুন নাদওয়া স্থাপন করেন (এর দরজা ছিল মসজিদের দিকে)। দারুন নাদওয়া ছিল প্রকৃতই কুরাইশদের সংসদ সেখানে গুরুত্বপূর্ণ এবং উল্লেখযোগ্য বিষয়াদির বিচার-বিশেষণ করা হতো। কুরাইশদের জন্য এটা ছিল একটি অত্যন্ত কল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠান।
করাণ, এ দারুন নাদওয়াই ছিল তাঁদের ঐক্যের প্রতীক এবং এখানেই তাঁদের বিক্ষিপ্ত ও বিতর্কিত সমস্যাবলী ন্যায়সঙ্গত উপায়ে মীমাংসিত হতো[20]।
কুসাইয়ের শ্রেষ্ঠত্ব ও দলনেতৃত্বের প্রেক্ষাপটে নিম্নলিখিত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বসমূহ পালনের অধিকার তিনি লাভ করেনঃ
১. দারুন নাদওয়ার অধিবেশনের সভাপতিত্ব : এ সকল অধিবেশনে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি সম্পর্কে পরামর্শ করার পর সিদ্ধান্ত নেয়া হতো। সেখানে সমাজের লোকজনদের কন্যাদের বিবাহ-শাদীর আয়োজনও করা হতো।
২. লিওয়া : অর্থাৎ যুদ্ধের পতাকা কুসাইয়ের হাতেই বেঁধে রাখা হতো।
৩. ক্বিয়াদাহ : এটা হল কাফেলার নেতৃত্ব দেয়া। মক্কার কোন কাফেলা ব্যবসা বা অন্য কোন উদ্দেশ্যেই হোক তার অথবা তার সন্তানদের নেতৃত্ব ছাড়া রওয়ানা হতো না।
৪. হিজাবাত : এর অর্থ হচ্ছে খানায়ে ক্বাবা’হর রক্ষণাবেক্ষণ। কুসাই নিজেই খানায়ে ক্বাবা’হর দরজা খুলতেন এবং আনুষঙ্গিক যাবতীয় দায়-দায়িত্ব তিনি নিজেই পালন করতেন।
৫. সিক্বায়াহ : এর অর্থ হচ্ছে পানি পান করানো। হজ্জযাত্রীদের পানি পান করানোর একটা সুন্দর রেওয়াজ প্রচলিত ছিল। এ উদ্দেশ্যে জলাধার বা চৌবাচ্চায় পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকত। সেই পানিতে পরিমাণ মতো খেজুর ও কিসমিস দিয়ে বেশ সুস্বাদু পানীয় বা শরবত তৈরি করা হতো। হজ্জযাত্রীগণ মক্কায় আগমন করলে তিনি তাঁদের সেই পানীয় পান করাতেন[21]।
৬. রিফাদাহ : অর্থাৎ হজ্জযাত্রীদের মেহমানদারিত্ব। হজ্জযাত্রীগণের আপ্যায়ন ও মেহমানদারীর জন্য খাদ্যদ্রব্য তৈরী করে খাওয়ানোর একটা রেওয়াজও প্রচলিত ছিল। এ উদ্দেশ্যে কুসাই কুরাইশগণের উপর একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের চাঁদা নির্ধারণ করে তা সংগ্রহ করতেন। সংগৃহীত অর্থের সাহায্যে খাদ্যদ্রব্য তৈরী করে আর্থিক দিক দিয়ে অসচ্ছল কিংবা যাঁদের নিকট খাদ্যবস্তু থাকত না এমন সব হজ্জযাত্রীদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হতো[22]।
উল্লেখিত কাজকর্মগুলো প্রত্যেকটি ছিল উচ্চমার্গের সম্মানের প্রতীক এবং কুসাই ছিলেন এ সবের প্রতিভূ। কুসাইয়ের প্রথম পুত্রের নাম ছিল আবদুদ্দার। কিন্তু তা সত্ত্বেও কুসাইয়ের জীবদ্দশাতেই দ্বিতীয় পুত্র আবদে মানাফ সম্মান ও নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হন।
এ কারণে কুসাই তাঁর পুত্র আব্দুদ্দারকে বললেন, যদিও কেউ কেউ সম্মান ও নেতৃত্বের ব্যাপারে তোমার চাইতেও অধিক মর্যাদাসম্পন্ন রয়েছে তবুও তোমাকে আমি কোনভাবেই খাটো করে রাখতে চাইনা। আমি চাই বিভিন্ন ক্ষেত্রে তুমি তাঁদের সমকক্ষ হয়ে থাকবে। এ আশ্বাসের প্রেক্ষিতে প্রথম পুত্র আব্দুদ্দারের অনুকূলে তাঁর নেতৃত্বেও সম্মানের বিষয়গুলো অসিয়ত করেছিলেন। অর্থাৎ দারুন নাদওয়ার অধিবেশনে সভাপতিত্ব করার অধিকার, খানায়ে ক্বাবা’হর রক্ষণাবেক্ষণের অধিকার, যুদ্ধের পতাকা বহনের অধিকার, হজ্জযাত্রীগণকে পানি পান করানো, হজ্জযাত্রীগণের মেহমানদারীর দায়িত্ব ইত্যাদি সব কিছুরই অধিকার আব্দুদ্দারকে অসিয়ত করলেন। কুসাই ছিলেন খুবই উন্নত মানের ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতা। কাজেই, কেউ কখনো তাঁর বিরোধিতা করত না এবং তাঁর কোন প্রস্তাব কিংবা সিদ্ধান্ত কেউ কখনো প্রত্যাখ্যানও করত না। তাঁর মৃত্যুর পরও ধর্মের অন্তর্ভুক্ত করণীয় কর্তব্য বলে মনে করা হতো। এজন্য পুত্রগণ তাঁর মৃত্যুর পরেও দ্বিধাহীন চিত্তে অসিয়তগুলো মেনে চলেছিলেন।
কিন্তু আবদেমানাফ যখন ইনতেকাল করলেন তখন তাঁর পুত্রগণ উল্লেখিত পদ সমূহের ব্যাপারে আব্দুদ্দারের সন্তানের সঙ্গে রেষারেষি আরম্ভ করলেন। যার ফলে কুরাইশগণ দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়লেন এবং দু’দলের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিল। কিন্তু ভয়াবহ পরিণতির কথা চিন্তা করে উভয় পক্ষই সংযম প্রদর্শন করে একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এ চুক্তির ফলে নেতৃত্ব ও মান মর্যাদার বিষয়গুলো উভয় পক্ষের মধ্যে বন্টিত হয়ে গেল। সিক্বায়াহ ও রিফাদাহ ও ক্বিয়াদাহ এ পদ তিনটি দেয়া হল বনু আবদে মানাফকে। দারুননাদওয়ার সভাপতিত্ব, লেওয়া ও হেজাবাতের দায়িত্ব বনু আব্দুদ্দারের হাতেই রয়ে গেল।
বলা হয়ে থাক, দারুন নাদওয়ার দায়িত্বে উভয় গোত্রই শরীক ছিল। বনু আবদে মানাফ আবার তাঁদের প্রাপ্ত পদগুলোর জন্য নিজেদের মধ্যে লটারী করলেন। ফলে সিক্বায়াহ ও রিফাদাহ আবদে শামস এর ভাগে পড়ে। তখন থেকে হাশিমই সিক্বায়াহ ও রিফাদাহ এ দুটি বিষয়ে নেতৃত্ব দান করতে থাকেন এবং তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। হাশিমের মৃত্যু হলে তাঁর সহোদর মুত্তালিব বিন আবদে মানাফ তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। কিন্তু মুত্তালিবের পর তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র আব্দুল মুত্তালিব (যিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দাদা) এ পদের অধিকর্তা হিসেবে কাজ করতে থাকেন। এমন কি যখন ইসলামের যুগ আরম্ভ হলো তখন আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব এ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।[23] বলা হয়, কুসাই পদসমূহ তার সন্তানদের মাঝে বন্টন করেন। অতঃপর তাদের সন্তানগণ উল্লেখ বর্ণনানুসারে পদসমূহের উত্তরাধীকারী হয়। আল্লাহ সর্বজ্ঞ।
এতদ্ব্যতীত আরও কিছু সংখ্যক পদ ছিল যা কুরাইশরা নিজেদের মধ্যে বিলিবন্টন করে নিয়েছিলেন। সেই সকল পদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকান্ড পরিচালনা এবং ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কুরাইশগণ একটি ছোট রাষ্ট্র, বরং বলা যায় যে একটি রাষ্ট্রমুখী সমাজ কাঠামো প্রবর্তন করে নিয়েছিলেন। বর্তমানে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় যে গণতান্ত্রিক ধারা অনুসৃত হয়ে থাকে কতটা যেন সেই ধাঁচ ও ছাঁচের প্রশাসনিক কাঠামো ও সমাজ ব্যবস্থা তৎকালীন মক্কায় গড়ে তোলা হয়েছিল। যে পদগুলোর কথা ইতোপূর্বে বলা হল সে পদগুলো হচ্ছে যথাক্রমে নিম্নরূপ :
১. ঈসার : এতে ভবিষ্যৎ কথনধারা নিরূপণ এবং ভাগ্য নির্ণয়ের জন্য মূর্তির পাশে রক্ষিত তীরের মালিকানার ব্যবস্থা ছিল। এ পদের অধিকর্তা ছিলেন বনু জুমাহ।
২. ধন-সম্পদের ব্যবস্থাপনা : মূর্তির নৈকট্য লাভের জন্য যে কুরবানী এবং মানত বা মানসী উৎসর্গ করা হতো এ হচ্ছে তারই ব্যবস্থাপনা। বিবাদ বিসম্বাদ এবং মামলা মোকদ্দমা মীমাংসার ব্যাপারটিও ছিল এর সঙ্গে সংশিষ্ট। এ সংক্রান্ত দায়িত্ব অর্পিত ছিল ‘বনু সাহম’ গোত্রের উপর।
৩. শূরা : এ সম্মানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গোত্র ছিলেন বনু আসাদ।
৪. আশনাক : এ অধিদপ্তরের কাজ ছিল শোনিতপাতের খেসারত এবং জরিমানার ব্যবস্থা। এর দায়িত্ব অর্পিত ছিল বনু তাইম গোত্রের উপর।
৫. উকার : এর কাজ ছিল জাতীয় পতাকা ধারণ। এ অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন বনু উমাইয়া গোত্র।
৬. কুব্বাহ : এ পদটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ অধিদপ্তরের দায়িত্ব-কর্তব্য ছিল সৈন্যদের শিবির স্থাপন এবং সৈন্য পরিচালনা। এ দায়িত্ব অর্পিত ছিল বনু মাখযুম গোত্রের উপর।
৭. সাফারাত : এ অধিদপ্তরের কর্তব্য ছিল পরিষ্কার-পরিচ্ছনতা সংক্রান্ত কর্মকান্ড সম্পাদন। এর দায়িত্বপ্রাপ্ত গোত্র ছিলেন বনু আদী।[24]
ফুটনোটঃ[1] পয়দায়েশ মোজমুআ বাইবেল ২৫-১৭।
[2] কালবে জাযীরাতুল আরব ২৩০-২৩৭ পৃঃ । ইবনে হিশাম ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশধর থেকে কেবলমাত্র নাবিত্বকে নেতৃত্বদানের কথা উল্লেখ করেছেন।
[3] ইবনে হিশাম ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশধর থেকে কেবলমাত্র নাবিত্বকে নেতৃত্বদানের কথা উল্লেখ করেছেন।
[4] কালবে জাযীরাতুল আরব ২৩০ পৃঃ।
[5] রহমাতুল্লিল আলামীন ২য় খন্ড ৪৮ পৃঃ।
[6] কালবে জাযীরাতুল আরব ২৩১ পৃঃ।
[7] ইনি ঐ মুযায জুরহুমী নান যাঁর উল্লেখ ইসমাঈল (আঃ)-এর ঘটনাতে আছে।
[8] মাসউদী লিখেছেন যে, অতীতে পারস্যবাসীগণ খানায়ে ক্বা‘বার জন্য প্রচুর সম্পদ ও মোতি পাঠাতেন। সাসান বিন বাবুক সোনার তৈরি দুটি হরিণ, মুক্তার তরবারী এবং অনেক সোনা প্রেরণ করে। আমর সেই সবকে যমযম কূপে নিক্ষেপ করে দিয়েছিলেন। মুরাওাযযাহাব ১ম খন্ড ২০৫ পৃঃ।
[9] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১১৪-১১৫ পৃঃ।
[10] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৪ ও ১১৯-১২০ পৃঃ।
[11] ইয়াকুতঃ মাদ্দাহ মক্কা।
[12] আল্লামা খুযরী মুহাযাবাত ১ম খন্ড ৩৫ পৃঃ। ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১১৭ পৃঃ।
[13] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১১৭-১১৮ পৃঃ।
[14] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১১৭-১১৮ পৃঃ।
[15] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১১৭-১১৮ পৃঃ।
[16] রহামাতুল্লিল আলামীন ২য় খন্ড ৫৫পৃঃ।
[17] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১২৩-১২৪ পৃঃ।
[18] কালবে জাযীরাতুল আরব ২৩২ পৃঃ।
[19] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১২৫ পৃঃ
[20] মহাযাবাত খুযরী ১ম খন্ড ৩৬ পৃঃ এবং আখবারুল কিরাম ১৫১পৃঃ।
[21] মুহাযারাতে খুযরী ১ম খন্ড ৩৬ পৃঃ।
[22] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৩০ পৃঃ।
[23] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১২৯-১৩২, ১৩৭, ১৪২, ১৭৮-১৭৯ পৃঃ।
[24] তারীখে আবযুল কুরআন ২য় খন্ড ১০৪-১০৬ পৃঃ।
সমসাময়িক আরবের বিভিন্ন রাজ্য ও নেতৃত্ব প্রসঙ্গ (الحُكْـمُ وَالْإِمَـارَةُ فِي الْعَـرَبِ )
ইতোপূর্বে ক্বাহত্বানী ও আদনানীদের নিজ নিজ বাস্তুভিটা পরিত্যাগ করে যাওয়া সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে এবং এ সকল গোত্রের মাঝে যে আরব ভূ-খন্ড বণ্টিত হয়েছিল সে প্রসঙ্গও আলোচনা করা হয়েছে যে সবগুলো আরব রাষ্ট্রই সংগঠিত হয়েছিল এ সকল গোত্রের সমন্বয়ে। অধিকন্তু, তাঁদের নেতৃত্ব এবং দলপতিত্বের স্বরূপ এরূপ ছিল যে, যে সকল গোত্র হীরাহর আশপাশে বসবাসরত ছিল তাদেরকে হীরাহ বা ইরাক রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত ধরা হয়েছে এবং যে সকল গোত্র বাদিয়াতুস শামে বসতি স্থাপন করেছিলেন তাঁদেরকে গাসসানী শাসকদের অন্তর্ভুক্ত ধরা হয়েছে। এ সম্পর্কে যেভাবে যতটুকুই বলা হোকনা কেন, তা হবে শুধু কথার কথা। এ সকল গোত্র, উপগোত্র, তাঁদের বসবাস, দেশত্যাগ এবং দেশে পুনরাগমন সম্পর্কে কোন ঐতিহাসিক সূত্র কিংবা আলোচনাকেই চূড়ান্ত বলে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।
উপর্যুক্ত গোত্রসমূহ ছাড়া আরও যে সকল গোত্র দেশের অভ্যন্তরে বসবাস করত তাঁদের সম্পর্কেও কিছুটা আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। সকল দিক দিয়েই এ সব গোত্র স্বাধীন ছিল। এদের মধ্যে দলপতি ব্যবস্থা চালু ছিল। গোত্রের জনসাধারণ নিজেরাই তাদের দলপতি নির্বাচিত করত। তাঁরা নিজ গোত্রকে একটি ছোট রাষ্ট্র এবং গোত্রপতিকে রাষ্ট্রপ্রধানের মর্যাদা প্রদান করত। গোত্রীয় রাষ্ট্রের অস্তিত্ব, স্থিতিশীলতা ও অখন্ডতা, সার্বভৌমত্ব, গোত্রটি জনগণের নিরাপত্তা, বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করা ইত্যাদি সব ব্যাপারেই গোত্রীয় সম্মিলিতভাবে কাজ করত।
যে কোন গোত্র সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে যুদ্ধ ঘোষণা, যুদ্ধ পরিচালনা কিংবা সন্ধি-চুক্তি সম্পাদন করতে পারত। যুদ্ধ কিংবা শান্তি যে কোন অবস্থাতেই গোত্রের লোকজনকে গোত্র পতির নির্দেশ মেনে চলতে হতো, কোন অবস্থাতেই তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করা চলত না। এমনকি কোন কোন দলপতির অবস্থা এমনটিও হতো যে, যদি তিনি রাগান্বিত হতেন তাহলে তৎক্ষণাৎ সহস্রাধিক তলোয়ার কোষমুক্ত হয়ে যেত। সে ক্ষেত্রে জিজ্ঞাসার কোন অবকাশই থাকত না যে গোত্রপতির রাগান্বিত হওয়ার কারণটি কী?
কোন কোন ক্ষেত্রে আবার নেতৃত্বের প্রশ্নে দলপতির চাচাত ভাইদের সঙ্গে রেষারেষি এবং দ্বন্ধও শুরু হয়ে যেত। এ কারণে দলপতিকে কতগুলো নিয়ম বিধি মেনে চলতে হতো। সেগুলো হচ্ছে যথাক্রমে:
১. স্বগোত্রীয় লোকজনদের সঙ্গে কথাবার্তা এবং আলাপ আলোচনার ক্ষেত্রে দলপতিকে সংযমের পরিচয় দিতে হবে এবং উদার মনোভাব অবলম্বন করতে হবে।
২. রাষ্ট্রীয়- অর্থ সম্পদ ব্যয় করার ব্যাপারে তাঁকে মিতব্যয়ী হতে হবে। কোনক্রমেই তিনি প্রয়োজনাতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করবেন না।
৩. মেহমানদারী করার ব্যাপারে তাঁকে অগ্রনী ভূমিকা পালন করতে হবে।
৪. কাজকর্মের ক্ষেত্রে তাঁকে অবশ্যই দয়া ও ধৈর্যশীলতার সঙ্গে কাজকর্ম করতে হবে।
৫. গোত্রীয় বীরত্বের প্রতিভূ হিসেবে তাঁকে বীরত্বের বাস্তব নমুনা প্রদর্শন করতে হবে।
৬. যে কাজ করলে লজ্জিত হতে হবে এমন সব কাজকর্ম করা থেকে তাঁকে বিরত থাকতে হবে।
৭. সাধারণ লোকজনদের দৃষ্টিতে একটি কল্যাণমুখী সমাজ এবং বিশেষভাবে কবিগণের দৃষ্টিতে একটি সুন্দর ও চরমোৎকর্ষের পথে অগ্রসরমান সমাজ জীবনের জন্য অব্যাহতভাবে কাজ করে যেতে হবে। কবিগণকেই সমাজের মুখ্য মুখপাত্র মনে করা হতো। এভাবে গোত্রপতিকে তাঁর প্রতিদ্বন্ধীগণের তুলনায় উচ্চাসন বা উচ্চ মর্যাদা লাভের জন্য বিধিবদ্ধ আচরণ ধারার অনুসরণের অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে ন্যায়ভিত্তিক জীবন যাপন করতে হতো।[1]
দলপতিগণের নিকট থেকে সমাজ যেমন অনেক কিছু আশা করত, অপরপক্ষে তেমনি আবার সমাজ দলপতিগণের জন্য কিছু কিছু সুযোগ সুবিধারও ব্যবস্থা করত। সে সম্পর্কে জনৈক কবি তাঁর ছন্দ-সৌকর্যের মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন:
لك المِرْبَاع فينـا والصَّفَايا ** وحُكْمُك والنَّشِيْطة والفُضُوْل
‘‘আমাদের নিকটে তোমার জন্য গণীমতের সম্পদের এক চতুর্থাংশ (‘১/৪) এবং যা তুমি পছন্দ করবে এবং সেই মাল যার তুমি মীমাংসা করবে এবং বিনা পরিশ্রমে অর্জিত সম্পদ এবং বিলিবন্টন থেকে যা অবশিষ্ট রয়ে যাবে।’’
মিরবা’ : মালে গণীমতের এক চতুর্থাংশ (১/৪)
সফী : ঐ সম্পদ যা বন্টনের পূর্বেই দলপতি নিজের জন্য নির্ধারিত করে রাখেন।
নাশীতাহ : এ সম্পদ যা মৌলিকস্তর অর্থাৎ সাধারণ লোকজনের নিকট পৌঁছার পূর্বেই পথিমধ্যে দলপতি গ্রহণ করেন।
ফুযূল : ঐ সম্পদ যা গাজীদের সংখ্যানুপাতে বন্টন করা সম্ভব না হওয়ার কারণে অবশিষ্ট থেকে যায়। বন্টনের পর অবশিষ্ট উট ঘোড়া ইত্যাদি সম্পদ দলপতিগণের প্রাপ্য হয়ে থাকে।
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১২৯, ১৩২, ১৩৭, ১৪২, ১৭৮ ও ১৭৯ পৃষ্ঠা।
রাজনৈতিক অবস্থা (الحَالَةُ السِّيَاسِيَةُ):
আরব উপদ্বীপের গোত্রসমূহ এবং গোত্রপতিগণ সম্পর্কে ইতোপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। এখন সমসাময়িক রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করা প্রয়োজন বলে আমাদের বিশ্বাস।
আরব উপদ্বীপের তিন দিকের সীমান্তবর্তী দেশসমূহের রাজনৈতিক অবস্থা দারুণ অস্থিতিশীল, বিশৃঙ্খল এবং পতনোন্মুখ ছিল। সমাজের মানবগোষ্ঠী হয় মনিব, নয়তো দাস, কিংবা হয় রাজা, নয়তো প্রজা, এ দু’শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। মনিব, রাজা, দলপতি, নরপতি যে উপাধিতেই ভূষিত থাকুন না কেন, সমাজ-জীবনের যাবতীয় কল্যাণ বা সুযোগ-সুবিধা নির্ধারিত থাকত তাদেরই জন্য বিশেষ করে বহিরাগত নেতাদের জন্য। অপরপক্ষে, দলপতি বা নরপতিগণের যাবতীয় আরাম-আয়েশ, সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধির আয়োজন ও উপকরণাদির জন্য প্রাণপাত প্ররিশ্রম করতে হতো জনসাধারণ এবং দাসদাসীগণকে। আরও সহজ এবং সুস্পষ্টভাবে বললে বলা যেতে পারে যে, প্রজারা ছিল যেন শস্যক্ষেত্র স্বরূপ যেখান থেকে সংস্থান হতো রাষ্ট্রের যাবতীয় আয়-উপার্জনের। রাষ্ট্র নায়কগণ এ সকল উপার্জন তাঁদের ভোগ-বিলাস, কাম-প্রবৃত্তি চরিতার্থ এবং অন্যান্য নানাবিধ দুষ্কর্মে ব্যবহার করতেন। সাধারণ মানুষের ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছার কোনই মূল্য থাকতনা। শত ধারায় বর্ষিত হতে থাকত তাঁদের উপর অত্যাচার-উৎপীড়নের অগ্নিধারা। এক কথায়, স্বৈরাচারী শাসন বলতে যা বোঝায় তা চরমে পৌঁছেছিল সেই সব অঞ্চলে। কাজেই, অসহায় মানুষের মুখ বুজে সে সব সয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না।
সেসব অঞ্চলের আশপাশে বসবাসকারী গোত্রগুলোকেও মাঝে মাঝে এসব অনাচার উৎপীড়নের শিকার হতে হতো। উল্লেখিত স্বৈরাচারী দলপতিগণের ভোগলিপ্সা, স্বার্থান্ধতা এবং অর্থহীন অহংবোধের বিষ-বাষ্পে বিপর্যন্ত হয়ে তাঁদেরকে ছুটে বেড়াতে হতো দিগ্বিদিকে। এ দলপতিগণ তাঁদের হীন স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে আরও একটু অগ্রসর হয়ে কখনো ইরাকীদের হাতকে শক্তিশালী করত, কখনো বা তাল মিলিয়ে চলত শামবাসীদের সঙ্গে।
যে সকল গোত্র আরব ভুখন্ডের অভ্যন্তরভাগে বসবাস করত তাদের জীবনযাত্রার ক্ষেত্রেও নানাবিধ সমস্যা এবং বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করত। গোত্রে গোত্রে বিবাদ-বিসম্বাদ, বংশপরম্পরাগত শত্রুতা, ধর্মীয় মতবিরোধ, গোষ্ঠিগত বিদ্বেষ ইত্যাদি নানাবিধ কারণে পরিবেশ থঅকত উত্তপ্ত। প্রত্যেক গোত্রের লোকজন সর্বাবস্থায় নিজ নিজ গোত্রের পক্ষে থাকত, তা সত্যের উপর বা বাতিলের উপর যা-ই হোক না কেন। প্রতিষ্ঠিত হোক তা যাচাই বাছাইর্য়ের কোন প্রশ্নই থাকত না। যেমনটি তাদের মুখপত্রে বলা হয়েছেঃ
وما أنا إلا من غَزَِّية إن غَوَتْ ** غويت، وإن ترشد غزية أرشد
‘আমিও তো গাযিয়া গোত্রের একজন। যদি সে ভ্রান্ত পথে চলে তবে আমিও ভ্রান্ত পথে চলব এবং যদি সে সঠিক পথে চলে তবে আমিও সঠিক পথে পরিচালিত হব।
আরবের অভ্যন্তরে এমন কোন পরিচালক ছিলেন না যিনি তাঁদের কণ্ঠকে শক্তিশালী করবেন এবং এমন কোন আশ্রয়স্থল ছিল না বিপদ-আপদ কিংবা সমস্যা -সংকুল সময়ে যেখানে তাঁরা আশ্রিত হতে পারবেন এবং প্রয়োজনে যার উপর তাঁরা নির্ভরশীল হতে পারবেন।
তবে হ্যাঁ, এটা নিঃসন্দেহ যে, উপদ্বীপ রাষ্ট্র হিজাযকে কোন মতে সম্মানের আসনে আসীন বলে মনে করা হতো এবং ধর্মকেন্দ্র ও ধর্মীয় আচার-আচরণের পরিচালক ও রক্ষক হিসেবে ধারণা করা হতো। প্রকৃতপক্ষে এ রাষ্ট্র ছিল পার্থিব পরিচালন ও ধর্মীয় পুরোহিত তত্ত্ববিদদের এক এক প্রকার মিশ্রিত রূপ। এর দ্বারা আরববাসীদের উপর ধর্মীয় পরিচালনার নামে তাঁদের মর্যাদার উচ্চাসন অর্জিত হতো এবং হারাম শরীফ ও হারাম শরীফের আশ-পাশের শাসন কাজ নিয়মিত পরিচালিত হতো। তাঁরাই বায়তুল্লাহর পরিদর্শকগণের জন্য প্রয়োজন পরিপূরণের ব্যবস্থাপনা এবং ইবরাহীম শরীয়তের হুকুম আহকাম চালু রাখার ব্যবস্থা করতেন। কিন্তু এ রাষ্ট্র এতই দুর্বল ছিল যে, আরবের যাবতীয় আভ্যন্তরীণ দায়-দায়িত্বের গুরুভার বহনের ক্ষমতা তার ছিল না। এ সত্যটি হাবশীদের আক্রমণের সময় সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়ে যায়।
ফুটনোটঃ
আরবে ধর্মকর্ম এবং ধর্মীয় মতবাদ প্রসঙ্গে (دِيَانَاتُ الْعَـرَبِ):
আরবে বসবাসকারী সাধারণ লোকজন ইসমাঈল (আঃ)-এর দাওয়াত ও প্রচারের ফলে ইবরাহীম (আঃ) প্রচারিত দ্বীনের অনুসারী ছিলেন। এ কারণেই তাঁরা ছিলেন আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী এবং একমাত্র আল্লাহরই উপাসনা করতেন। কিন্তু কাল প্রবাহে ক্রমান্বয়ে তাঁরা আল্লাহর একত্ববাদ এবং খালেস দ্বীনী শিক্ষার কোন কোন অংশ ভুলে যেতে থাকেন, কিংবা সে সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়েন। কিন্তু এত সব সত্ত্বেও আল্লাহর একত্ববাদ এবং দ্বীনে ইবরাহীম (আঃ)-এর কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য অবশিষ্ট থেকে যায় যে পর্যন্ত বনু খুযা’আহ গোত্রের সর্দার ‘আমর বিন লুহাই জন সমক্ষে এসে উপস্থিত না হন। ধর্মীয় মতাদর্শের লালন ও পরিপোষণ, দান খয়রাত এবং ধর্মীয় বিষয়াদির প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগের কারণে লোকজন তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধাপোষণ করতে থাকেন। অধিকন্তু, তাঁকে বড় বড় আলেম এবং সম্মানিত অলীদের দলভুক্ত ধরে নিয়ে তাঁর অনুসরণ করতে থাকেন।
এমন অবস্থার এক পর্যায়ে তিনি শাম দেশ ভ্রমণে যান এবং সেখানে গিয়ে মূর্তি পূজা-অর্চনার জাঁকালো চর্চা প্রত্যক্ষ করেন। শাম দেশ বহু পয়গম্বরের জন্মভূমি এবং আল্লাহর বাণী নাযিলের ক্ষেত্র হওয়ায় ঐ সকল মূর্তি পূজাকে তিনি অধিকতর ভাল এবং সত্য বলে ধারণা করেন। তাই দেশে প্রত্যাবর্তনের সময় তিনি ‘হুবল’ নামক মূর্তি সঙ্গে নিয়ে আসেন এবং খানায়ে ক্বাবা’হর মধ্যে তা রেখে দিয়ে পূজো অর্চনা শুরু করেন। সঙ্গে সঙ্গে মক্কাবাসীগণকেও পূজা করার জন্য আহবান জানান। মক্কাবাসীগণ তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে মূর্তি হোবলের পূজা করতে থাকেন। কাল-বিলম্ব না করে হিজাযবাসীগণও মক্কাবাসীগণের পদাংক অনুসরণ করতে থাকেন। কারণ, তাঁরাও এক কালে বায়তুল্লাহর অভিভাবক এবং হারামের বাসিন্দা ছিলেন।[1] এভাবে একত্ববাদী আরববাসী অবলীলাক্রমে মূর্তিপূজার মতো এক অতি জঘণ্য এবং ঘৃণিত পাপাচার ও দুষ্কর্মে লিপ্ত হয়ে পড়েন। এভাবে আরব ভূমিতে মূর্তিপূজার গোড়াপত্তন হয়ে যায়।
হুবাল ছিল মানুষের আকৃতিতে তৈরী লাল আকীক পাথর নির্মিত মূর্তি। তার ডান হাত ভাঙ্গা ছিল। কুরাইশগণ হুবালকে এ অবস্থাতেই প্রাপ্ত হয় এবং পরে তারা উক্ত হাতকে স্বর্ণ দিয়ে মেরামত করে। এটাই ছিল মুশরিকদের প্রথম এবং সবচেয়ে বড় ও সম্মানিত মূর্তি।
‘হুবাল’ ছাড়া আরবের প্রাচীনতম মূর্তিগুলোর মধ্যে ছিল ‘মানাত’ মূর্তি। এটি ছিল বনু হুযাইল ও বনু খুযা’আহর উপাস্য। লোহিত সাগরের তীরে কুদাইদ নামক ভূখন্ডের সন্নিকটস্থ মুসাল্লাল নামক স্থানে তা প্রতিষ্ঠিত ছিল।[2] মুশাল্লাল হল পাহাড় থেকে নেম আসা একটি সরু পথ যা কুদাইদের দিকে চলে গেছে। অতঃপর ‘লাত’ মূর্তিকে ত্বায়িফবাসী উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করে। এটি ছিল বনু সাক্বীফ গোত্রের উপাস্য এবং তা তাফিয়ের মসজিদের বামপাশে মিনারের নিকট স্থাপিত ছিল। এরপর ‘যাতে ইরক’ এর উচ্চভূমি শামের নাখলাহ নামক উপত্যকায় ‘উযযা’ নামক মূর্তির পূজা চলতে থাকে। এ মূর্তি ছিল কুরাইশ, বনু কিনানাহসহ অন্যান্য অনেক গোত্রের উপাস্য।
এ তিনটি ছিল আরবের সব চাইতে বড় এবং বিখ্যাত মূর্তি। এর পর হিজাযের বিভিন্ন অংশে শিরক ও মূর্তি পূজার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটতে থাকে।
কথিত আছে যে এক জিন ‘আমর বিন লুহাই এর অনুগত ছিল। সে বলল যে, নূহ সম্প্রদায়ের মূর্তি ওয়াদ্দ, সুওয়া, ইয়াগুস, ইয়াউক্ব এবং নাসর জিদ্দার ভূমিতে প্রোথিত রয়েছে। এ মূর্তির খোঁজ পেয়ে আমর বিন লুহাই জিদ্দায় যান এবং মাটি খনন করে মূর্তিগুলোকে বাহির করেন। তারপর সেগুলোকে তুহামায় নিয়ে যান এবং পরবর্তী হজ্জ মৌসুমে মূর্তিগুলো বিভিন্ন গোত্রের হাতে তুলে দেন। এভাবে একেকটি মূর্তি গোত্রগুলোর অধিকারে এসে যায়। পরবর্তী পর্যায়ে বিভিন্ন গোত্রের জন্য নির্ধারিত মূর্তিসমূহের বর্ণনা নিম্নরুপ :
ওয়াদ্দ : এ মূর্তি হলো ‘বনু কালব’ এর আরাধ্য মূর্তি। যারা ইরাকের নিকটবতী শামের অন্তর্গত দাওমাতুল জান্দালের জারাশ নামক স্থানের বাসিন্দা।
সুওয়া’ : এ মূর্তি হলো হিযাজের রুহাতৃ নামক স্থানের বনু হুযাইল বিন মুদরিকাহ’র। এ স্থান মক্কার নিকটবর্তী সাহিলের দিকে অবস্থিত।
ইয়াগুস : সাবার নিকটস্থ যুরফ নামক স্থানের বনু গুত্বাইফের মুরাদ গোত্রের উপাস্য।
ইয়াউক্ব : ইয়ামানের খাইওয়ান বস্তির বনু হামদানের মূর্তি। খাইওয়ান হলো হামদানের শাখাগোত্র।
নাসর : হিমইয়ার নামক স্থানের হিমইয়ারীদের অন্তর্গত আলে যুল কিলা’র উপাস্য।
তারা এসকল মূর্তির উপর ঘর নির্মাণ করে এগুলোকে কাবাহর মতো সম্মান করতো ও তাতে গিলাফ দিয়ে ঢেকে দিত। কাবাহতে হাদী বা কুরবানির পশু প্রেরণের মতো ঐসব তাগুতের সম্মানার্থে তারা সেখানেও হাদী প্রেরণ করতো এগুলোর উপর কা’বাহর শ্রেষ্ঠত্ব জানা সত্ত্বেও।
আর এ সকল পথে যেসব গোত্র যাতায়াত করতো তারাও এগুলোর ন্যায় মূর্তি বানিয়ে অনুরূপ গৃহ নিৰ্মাণ করে। এগুলোর মধ্যে যুল খালাসাহ হলো দাওস, খাস’আম ও বুজাইলাহ গোত্রের মূর্তি। তারা ছিল মক্কা ও ইয়ামান এর মধ্যবতী তাবালাহ স্থানের অধিবাসী। ফিলস হলো বনু তাই এবং তাই এর দু’টি পাহাড়- সালামাহ ও আযা’র নিকটে বসবাসকারী লোকেদের মূর্তি। এরকমই একটি হলো রিয়াম। যা ইয়ামান ও হিমইয়ার বাসীর জন্য সন’আয় নির্মিত একটি উপাসনা ঘর। রাযা- বনু রাবী’আহ বিন কা’ব বিন সা’দ বিন যায়দ ও মানাত বিন তামীম এর উপাসনা ঘর। কায়াবাত ওয়ায়িলের দু’পুত্র বাকর ও সানদাদের তাগলিব গোত্রের।
দাওসের যুল কাফফাইন নামক আরেকটি মূর্তি ছিল। বনু বাকর, বনু মালিক, বনু মালকান- যারা কেনানাহর বংশধর তাদের সা’দ নামক আরেকটি মূর্তি ছিল। উযরাহ গোত্রের একটি মূর্তি ছিল যাকে বলা হতো শামস এবং বনু খাওলানের গুমইয়ানিস নামক একটি মূর্তি ছিল।
এভাবে মূর্তি ছড়িয়ে পড়তে পড়তে একসময় সমগ্র আরব উপদ্বীপ মূর্তিতে ছেয়ে যায়। এমনকি শেষ পর্যন্ত প্রত্যেক গোত্র ও ঘরে ঘরে তা স্থান করে নেয়। তারপর মক্কার মুশরিকগণ একের পর এক মূর্তি দিয়ে মসজিদুল হারামকেও পরিপূর্ণ করে তোলেন। কথিত আছে যে, মক্কা বিজয়ের পূর্বে মসজিদুল হারামে ৩৬০টি মূর্তি ছিল। মক্কা বিজয়ের পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার লাঠি দিয়ে মূর্তিগুলোকে ধ্বংস করেছিলেন। একের পর এক তিনি যখন মূর্তিগুলোকে লাঠি দিয়ে আঘাত করছিলেন তখন সেগুলো পড়ে যাচ্ছিল। তারপর তিনি সেগুলোকে মসজিদুল হারামের বাইরে নিয়ে গিয়ে জ্বালিয়ে দেয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন এবং তা জ্বালিয়ে দেয়া হয়[3]। অধিকন্তু কা’বাহর অভ্যন্তরভাগে কিছু মূর্তি ও ছবি ছিল। তার মধ্যে একটি হলো ইবরাহীম (আঃ) ও অপরটি হলো ইসমাঈল (আঃ) আকৃতিতে তৈরি। এ উভয় মূর্তির হাতে ভাগ্য নির্ণায়ক তীর ছিল। মক্কা বিজয়ের দিন এসব মূর্তিকে নিশ্চিন্ন করে দেয়া হয় এবং ছবিগুলোকে মুছে দেয়া হয়।
এসব মূর্তির ব্যাপাবে মানুষ গভীর তমসাচ্ছন্ন ও বিভ্রান্তিতে ছিল। এমনকি আবূ রাযা উতারিদী (রা.) বলেন, ‘আমরা পাথরের পূজা করতাম। অতঃপর যখন এর চেয়ে ভাল মানের পাথরের সন্ধান পেতাম তখন আগেরটির পূজা পরিত্যাগ করে এবং নতুন পাথরটির পূজা আরম্ভ করে দিতাম। আবার পূজা করার মতো কোন পাথর না পেলে কিছু মাটি স্তুপাকারে একত্রিত করতাম। তারপর দুদ্ধবতী ছাগল নিয়ে ঐ স্তুপের উপর দোহন করে তা ত্বাওয়াফ করতাম।
মোট কথা মূর্তিপূজা ও অংশীবাদিতা দ্বীনের ক্ষেত্রে সব চেয়ে নিকৃষ্ট অনাচার এবং পাপাচার হওয়া সত্ত্বেও তৎকালীন আরববাসীগণের অসার অহংকার ও ভ্রান্ত ধারণা ছিল যে, তারা দ্বীনে ইবরাহীম (আঃ)-এর উপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।
এ জঘণ্য শিরক ও মূর্তিপূজা চালু হওয়া এবং লোকেদের মাঝে বিস্তার লাভের কিছু প্রেক্ষাপট রয়েছে তা হলো : যখন তারা ফেরেশতা, নাবী-রাসূল ও ওলী-আওলীয়া, পরহেযগার-দ্বীরদার এবং ভালকাজে প্রতিষ্ঠিত সৎকর্মশীল লোকদেকে প্রত্যক্ষ করল এবং এও প্রত্যক্ষ করল যে, তারা হলেন আল্লাহর প্রিয় সৃষ্টি, সম্মান-মর্যাদায় আল্লাহর প্রিয়পাত্র এতদসত্ত্বেও যখন তাদের হাতে বিশেষ কোন কারামাত প্রকাশ পেল এবং এমন অসম্ভব কাজ সম্পন্ন হলো যা সাধারণত মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় তখন তারা মনে করল যে, আল্লাহ তাআলা ঐ সকল লোকের হাতে তার কিছু ক্ষমতা, কুদরত ও নিজেদের ইচ্ছেমত কিছু করার শক্তি দান করার মাধ্যমে তাদেরকে বিশেষত্ব দান করেছেন। আর তাদের এ ক্ষমতা ও মর্যাদার কারণে তারা আল্লাহ তাআলা ও সাধারণ মানুষের মাঝে মধ্যস্ত তা ও করার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। সুতরাং এ সকল ব্যক্তি বা বস্তুর মাধ্যম ব্যতীত কারও পক্ষে আল্লাহর দরবারে সরাসরি নিজেদের প্রয়োজন বা আবেদন-নিবেদন পেশ করা সম্ভব নয় এবং তাদের মর্যাদার কারণে আল্লাহ তাআলা তাদের সুপারিশকে ফিরত দেন না। ঠিক অনুরূপভাবে ঐ সব ব্যক্তি বা বস্তুর মাধ্যম ব্যতিত আল্লাহর কোন ইবাদতও প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয়। কেননা তারা বিশেষ মর্যাদার বলে তাকে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করিয়ে দেবে।
তাদের মাঝে এ ধারণা যখন বদ্ধমূল হলো ও তাদের মনে তা স্থায়ী আসন লাভ করল তখন ঐ সব ব্যক্তি বা বস্তুকে তাদের অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করে আল্লাহ ও নিজেদের মাঝে মধ্যস্ততাকারী সাব্যস্ত করল এবং প্রভুর নিকট নৈকট্যলাভের যাবতীয় বিষয়কে তাদের দায়িত্বে ছেড়ে দিল। অতঃপর তাদের সম্মানার্থে তাদের ছবি, ভাষ্কর্য ও প্রতিমা তৈরি করল। এসকল ছবি ও প্রতিমা কখনোও তাদের উদ্দিষ্ট ব্যক্তির হুবহু আকৃতিতে তৈরি করতো। আবার কখনো তাদের খেয়াল-খুশিমতো আকৃতি দিয়ে তৈরি করতো। অতঃপর এসব ছবি ও প্রতিমাকেই তারা উপসনার যোগ্য মূর্তি বলে নামকরণ করতো।
কখনো তারা এসবের ছবি বা প্রতিমা তৈরি করতো না বটে তবে তাদের কবর বা সমাধিস্থল, বাসস্থান, অবতরণস্থল বা বিশ্রামস্থলকে পবিত্রতম স্থান হিসেবে দিয়ে সেগুলোর উদ্দেশ্যে মানত ও নযর নিয়ায ইত্যাদি উৎসর্গ করতো। আর সেখানে তারা খুব বিনয় ও আনুগত্য প্রকাশ করতো এবং তাদের ঐসব স্থানকে তারা মূর্তির নামে নামকরণ করতো। এ দিকে আবার জাহেলিয়া যুগের লোকজনদের মূর্তি পূজার বিশেষ বিশেষ রীতি পদ্ধতিও প্রচলিত ছিল। এসবের অধিকাংশই ‘আমর বিন লোহায়েরই মন গড় তৈরি। ইবনে লুহাই প্রবর্তিত মূর্তিপূজকের দল মনে করত যে, দ্বীনের ক্ষেত্রে তিনি যে রীতিপদ্ধতির কথা বলেছেন তা ইবরাহীম (আঃ) প্রবর্তিত দ্বীন এর পরিবর্তন কিংবা বিলোপসাধন নয়। বরং সেটা হচ্ছে ভালোর জন্য কিছু কিছু নবতর সংযোজনের মাধ্যমে সর্বযুগের সকল মানুষের উপযোগী একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান প্রবর্তন। জাহেলিয়াত যুগের লোকেরা তাদের মন গড়া দ্বীনের ক্ষেত্রে যে রীতি পদ্ধতির প্রচলন করে নিয়েছিলেন তা হচ্ছে যথাক্রমে নিম্নরূপ :
১. মূর্তিপূজকগণ দরগার খাদেমের মতো মূর্তির পাশে বসে তাদের নিকট আশ্রয় অনুসন্ধান করতেন, উচ্চকণ্ঠে তাদের আহবান জানাতেন, অভাব মোচন ও বিপদাপদ হতে উদ্ধারের জন্য অনুনয় বিনয় সহকারে তাদের নিকট প্রার্থনা জানাতেন। প্রার্থনাকারীগণ মনে করতেন যে, মূর্তিরূপী এ সকল দেবদেবী তাঁদের প্রার্থনা করার জন্য আল্লাহর নিকটে সুপারিশ পেশ করবে যা তাদের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে।
২. তাঁরা মূর্তির উদ্দেশ্যে হজ্জ সম্পন্ন করতেন, মূর্তিকে তাওয়াফ এবং সিজদাহহ করতেন এবং তাদের সামনে অত্যন্ত ভক্তি ও বিনয়াবনত আচরণ করতেন।
৩. মূর্তিদের জন্য বিভিন্ন প্রকারের মানত এবং কুরবাণী উৎসর্গ করা হতো। উৎসর্গীকৃত জীবজানোয়ারগুলোকে মূর্তির বেদীমূলে তার নাম নিয়ে জবেহ করা হতো। ঘটনাক্রমে অন্য কোথাও জবেহ করা হলেও মূর্তির নাম নিয়েই তা করা হতো। তাঁদের এ উসর্গীকৃত পশু জবেহ করা প্রসঙ্গে দুটি রীতির কথা আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদের মধ্যে উল্লেখ করেছেন:
{وَمَا ذُبِحَ عَلَى النُّصُبِ} [المائدة: 3]
‘‘ আর যা কোন আস্তানায় (বা বেদীতে) যবহ করা হয়েছে।’’ (মায়িদা ৫ : ৩)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে:
:{وَلاَ تَأْكُلُوْا مِمَّا لَمْ يُذْكَرِ اسْمُ اللهِ عَلَيْهِ} [الأنعام:121]
‘‘যাতে (যবহ করার সময়) আল্লাহর নাম নেয়া হয়নি তা তোমরা মোটেই খাবে না।’’ (আল আন‘আম ৬ : ১২১)
৪. মূর্তি পূজকগণ পূজার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে খাদ্য ও পানীয় দ্রব্যের কিছু অংশ, উৎপাদিত শস্যাদি এবং পালিত পশুদলের কিছু অংশ মূর্তির জন্য নির্দিষ্ট করে রাখত। এ ক্ষেত্রে আরও একটি আকর্ষণীয় ও প্রনিধানযোগ্য ব্যাপার ছিল, উৎপাদিত শস্যাদি এবং পালিত পশুদলের কিছু অংশ আল্লাহর নামেও নির্দিষ্ট করে রাখা হতো। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এমনটি হতে দেখা যেত যে আল্লাহর নির্দিষ্ট করে রাখা দ্রব্যাদি মূর্তির জন্য রেখে দেয়া দ্রব্যাদির সঙ্গে মিশিয়ে তা মূর্তির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে দেয়া হতো, কিন্তু মূর্তির জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা দ্রব্যাদির সঙ্গে মিশিয়ে কখনই তা আল্লাহর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হতো না। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন:
{وَجَعَلُوْا لِلهِ مِمِّا ذَرَأَ مِنَ الْحَرْثِ وَالأَنْعَامِ نَصِيْبًا فَقَالُوْا هٰذَا لِلهِ بِزَعْمِهِمْ وَهَـذَا لِشُرَكَآئِنَا فَمَا كَانَ لِشُرَكَآئِهِمْ فَلاَ يَصِلُ إِلَى اللهِ وَمَا كَانَ لِلهِ فَهُوَ يَصِلُ إِلٰى شُرَكَآئِهِمْ سَاء مَا يَحْكُمُوْنَ}[الأنعام:136]
‘‘ আল্লাহ যে শস্য ও গবাদি পশু সৃষ্টি করেছেন তাত্থেকে তারা আল্লাহর জন্য একটা অংশ নির্দিষ্ট করে আর তারা তাদের ধারণামত বলে এ অংশ আল্লাহর জন্য, আর এ অংশ আমাদের দেবদেবীদের জন্য। যে অংশ তাদের দেবদেবীদের জন্য তা আল্লাহর নিকট পৌঁছে না, কিন্তু যে অংশ আল্লাহর তা তাদের দেবদেবীদের নিকট পৌঁছে। কতই না নিকৃষ্ট এ লোকদের ফায়সালা!’’ (আল আন‘আম ৬ : ১৩৬)
৫. মূর্তির নৈকট্য লাভের আরও একটি রীতি ছিল যে, মুশরিকগণ শস্যাদি এবং চতুষ্পদ জন্তুর মধ্যে বিভিন্ন প্রকৃতির মানত মানতো আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেনঃ
{وَقَالُوْا هٰـذِهِ أَنْعَامٌ وَحَرْثٌ حِجْرٌ لاَّ يَطْعَمُهَا إِلاَّ مَنْ نَّشَاءُ بِزَعْمِهِمْ وَأَنْعَامٌ حُرِّمَتْ ظُهُوْرُهَا وَأَنْعَامٌ لاَّ يَذْكُرُوْنَ اسْمَ اللهِ عَلَيْهَا افْتِرَاءً عَلَيْهِ} [ الأنعام:138].
‘তারা তাদের ধারণা অনুসারে বলে, এ গবাদি পশু ও ফসল সুরক্ষিত। আমরা যার জন্য ইচ্ছে করব সে ছাড়া কেউ এগুলো খেতে পারবে না। এ সব তাদের কল্পিত। কিছু গবাদি পশুর পিঠে চড়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে, কিছু গবাদি পশু যবহ করার সময় তারা আল্লাহর নাম নেয় না।’ [আল আন‘আম (৬) : ১৩৮]
৬. সে সব চতুষ্পদ জন্তুগুলোর মধ্যে ‘বাহীরা, সায়িবাহ, ওয়াসীলা এবং হামী’ নামে পশু ছিল।
সাঈদ বিন মুসায়্যিব বলেন, ‘বাহীরাহ’ হল এমন উল্লী যার স্তনকে মূর্তির নামে উৎসর্গ করা হয়েছে। সুতরাং কোন মানুষ তার থেকে দুধ দোহন করতো না। ‘সায়িবাহ’ এমন উষ্ট্রী যা দেবদেবীর নামে ছেড়ে দিত। ফলে কেউ তাতে আরোহন করতো না। ‘ওয়াসিলাহ’ বলা হয় এমন উষ্ট্রীকে যার প্রথম গর্ভ থেকে স্ত্রী উট জন্ম নেয়। অতঃপর দ্বিতীয়বারও স্ত্রী উট জন্ম নেয়। মাঝখানে পুরুষ উট না জন্মে এরকম পরপর স্ত্রী উট জন্ম নিলে তারা সে উটকে মূর্তির নামে ছেড়ে দিত। ‘হামী’ বলা হয় এমন পুরুষ উটকে যার বীজ দ্বারা দশটি উষ্ট্রীর গর্ভধারণ হয়েছে। সংখ্যা পুর্ণ হলে ঐ উটকে দেবদেবীর নামে ছেড়ে দিত। ঐ উটের উপর কেউ আরোহন করতো না।
ইবনে ইসহাক্ব বলেন যে, ‘বাহীরা’ সায়্যিবাহরই’ মেয়ে সন্তানকে বলা হয় এবং সেই উটকে ‘সায়িবাহ’ বলা হয় যার গর্ভ থেকে দশ বার কন্যা সন্তান ভূমিষ্ট হয়েছে, এর মধ্যে কোন পুত্র সন্তান ভূমিষ্ট হয় নি। এমন অবস্থা বা প্রকৃতির উটকে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেয়া হতো। এর পৃষ্ঠদেশে কেউ আরোহণ করত না, এর লোম কর্তন করত না এবং মেহমান ব্যতীত অন্য কেউই তার দুগ্ধ পান করত না।
এরপর সেই উট যখন মেয়ে সন্তান প্রসব করত তখন তাঁর কান চিরে দেয়া হতো এবং তাকেও তার মায়ের সঙ্গে মুক্তভাবে চলা ফেরার জন্য ছেড়ে দেয়া হতো। এর পৃষ্ঠদেশে কেউ সওয়ার হতো না, তার লোম কাটা হতো না এবং মেহমান ব্যতীত অন্য কেউই তা দুগ্ধও পান করত না। একে বলা হতো ‘বাহীরা’ এবং তার মাকে বলা হতো ‘সায়িবাহ’।
‘ওয়াসীলাহ’ বলা হতো সেই ছাগীকে যে ছাগী একাদিক্রমে দুটি দুটি করে পাঁচ দফায় দশটি কন্যা সন্তান প্রসব করে এবং এর মধ্যে কোন পুত্র সন্তান প্রসব করে না। সেই ছাগীকে এ কারণে ওয়াসীলা বলা হয় যে, সে তার সবগুলো মেয়ে সন্তানকে একে অন্যের সঙ্গে জড়িয়ে দিয়েছে। এর পর সেই ছাগী যে বাচ্চা প্রসব করবে তাকে শুধু পুরুষ লোকেরাই খেতে পারবে, মহিলারা খেতে পারবে না। তবে যদি তা কোন মৃত বাচ্চা প্রসব করে তবে পুরুষ এবং মহিলা সকলেই তা খেতে পারবে।
সেই উটকে ‘হামী’ বলা হয় যার প্রজননের মাধ্যমে পর পর একাদিক্রমে দশটি কন্যা সন্তান জন্মলাভ করেছে এবং এ সবের মধ্যে কোন পুত্র সন্তান জন্মলাভ করে নি। এ জাতীয় উষ্ট্রের পৃষ্ঠদেশ সংরক্ষিত থাকত, অর্থাৎ এর প্রষ্ঠদেশে আরোহণ নিষিদ্ধ ছিল। এর লোমও কর্তন করা হতো না। শুধুমাত্র প্রজননের উদ্দেশ্যে উটের পালের মধ্যে ওকে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেয়া হতো, অন্য কোন কাজে ওকে ব্যবহার করা হতো না। জাহেলিয়াত আমলের মূর্তি পূজার সেই সকল রীতি পদ্ধতির প্রতিবাদ করে আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেনঃ
{مَا جَعَلَ اللهُ مِنْ بَحِيْرَةٍ وَلاَ سَآئِبَةٍ وَلاَ وَصِيْلَةٍ وَلاَ حَامٍ وَلٰـكِنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا يَفْتَرُوْنَ عَلَى اللهِ الْكَذِبَ وَأَكْثَرُهُمْ لاَ يَعْقِلُوْنَ} [المائدة:103]
‘আল্লাহ না নির্দিষ্ট করেছেন বাহীরাহ্, না সাইবাহ্, না ওয়াসীলাহ্, না হাম বরং যারা কুফুরী করেছে তারাই আল্লাহর নামে মিথ্যা আরোপ করে তা আবিষ্কার করেছে, তাঁদের অধিকাংশই নির্বোধ। ’’ (আল-মায়িদাহ ৫ : ১০৩)
{وَقَالُوْا مَا فِيْ بُطُوْنِ هٰـذِهِ الأَنْعَامِ خَالِصَةٌ لِّذُكُوْرِنَا وَمُحَرَّمٌ عَلٰى أَزْوَاجِنَا وَإِن يَكُن مَّيْتَةً فَهُمْ فِيْهِ شُرَكَاء} [ الأنعام:139]
‘তারা আরো বলে, এ সব গবাদি পশুর গর্ভে যা আছে তা খাস করে আমাদের পুরুষদের জন্য নির্দিষ্ট, আর আমাদের স্ত্রীলোকদের জন্য নিষিদ্ধ, কিন্তু তা (অর্থাৎ গর্ভস্থিত বাচ্চা) যদি মৃত হয় তবে সকলের তাতে অংশ আছে। তাদের এ মিথ্যে রচনার প্রতিফল অচিরেই তিনি তাদেরকে দেবেন, তিনি বড়ই হিকমাতওয়ালা, সর্বজ্ঞ।’’ (আল-আন‘আম ৬ : ১৩৯)
যেভাবে উল্লেখিত পশুগুলোর বর্ণনা দেয়া হয়েছে, যেমন- বাহীরা, সায়িবাহ ইত্যাদি এবং এ ছাড়া আরও বর্ণনা করা হয়েছে[4] তা ইবনে ইসহাক্বের উল্লেখিত ব্যাখ্যার কিছু বিপরীত এবং কিছুটা অন্য ধরণের বলে মনে হয়। সাঈদ বিন মুসাইব (আঃ) কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যে, এ পশুগুলো মুশরিকদের তাগুত মূর্তি সমূহের জন্য ছিল।[5]
বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন :
(رَأَيْتُ عُمَرَو بْنَ عَامِرِ بْنِ لُحَى الْخُزَاعِى يَجُرُّ قَصَبَهُ [أَيْ أَمْعَاءَهُ ] فِي النَّارِ)
‘‘আমি আমর বিন লুহাইকে জাহান্নামের মধ্যে তার নাড়ি-ভুড়ি টানতে দেখেছি।’’ কেননা ‘আমর বিন লুহাই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি ইবরাহীম (আঃ)-র দ্বীনে পরিবর্তন আনয়ন এবং মূর্তির নামে চতুষ্পদ জন্তু উৎসর্গ করার ব্যবস্থা করেছিলেন।[6]
আরববাসীগণ মূর্তিকে কেন্দ্র করে এতসব কিছু করত এ বিশ্বাসে যে, আল্লাহর নৈকট্য লাভে এরা তাদেরকে সাহায্য করবে। যেমনটি কুরআন কারীমে বলা হয়েছে যে,
{مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُوْنَا إِلَى اللهِ زُلْفٰى} [الزمر: 3]
(মুশরিকগণ বলত) ‘আমরা তাদের ‘ইবাদাত একমাত্র এ উদ্দেশেই করি যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর নৈকট্যে পৌঁছে দেবে।’’ (আয-যুমার ৩৯ : ৩)
আরও ইরশাদ হয়েছেঃ
{وَيَعْبُدُوْنَ مِن دُوْنِ اللهِ مَا لاَ يَضُرُّهُمْ وَلاَ يَنفَعُهُمْ وَيَقُوْلُوْنَ هَـؤُلاء شُفَعَاؤُنَا عِندَ اللهِ} [يونس:18]
‘‘আর তারা আল্লাহকে ছেড়ে ‘ইবাদাত করে এমন কিছুর যা না পারে তাদের কোন ক্ষতি করতে, আর না পারে কোন উপকার করতে। আর তারা বলে, ‘ওগুলো আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশকারী।’’ (ইউনুস ১০ : ১৮)
আরবের মুশরিকগণ ‘আযলাম’ অর্থাৎ কথন সম্পর্কে ফলাফল নির্ণয়ের জন্য তীরও ব্যবহার করত (আযলাম হচ্ছে যালামুন এর বহু বচন এবং যালাম ঐ তীরকে বলা হয় যার উপর পালক লাগানো হতো না)। ভবিষ্যৎ কথন সম্পর্কিত ফলাফল নির্ণয়ের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত তীরগুলো ছিল তিন প্রকারের:
প্রথম : এ শ্রেণীভুক্ত তীরগুলোর গায়ে (نعم) ‘হ্যাঁ’’ কিংবা (لا) না অথবা (غفل) ‘ব্যর্থ’ লেখা থাকত। এ শ্রেণীভুক্ত তীরগুলো সাধারণত ভ্রমণ, বিয়ে-শাদী এবং অনুরূপ অন্য কোন কার্যোপলক্ষ্যে ব্যবহৃত হতো। বিশেষ একটি পদ্ধতিতে তীর বাছাই পর্ব সম্পাদিত হতো। কর্মপন্থা নির্ণয়ের উদ্দেশ্যে বাছাইকৃত তীর গোত্রে ‘হ্যাঁ’’ লেখা থাকলে পরিকল্পিত কাজ আরম্ভ করা হতো। কিন্তু বাছাই করতে গিয়ে ‘না’’ লিখিত তীর বাহির হলে পরিকল্পিত কাজটি এক বছরের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হতো এবং আগামীতে আবার এ কাজের জণ্য গুণাগুণ বা লক্ষণ নির্ধারক বাহির করা হতো। আর যদি ‘ব্যর্থ’ লিখিত তীর বের হতো তবে আবার একইভাবে বাছাই করা হতো যতক্ষণ পর্যন্ত ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ লিখিত তীর বের হতো।
দ্বিতীয় : এ শ্রেণীভুক্ত তীরগুলোর কোনটির গায়ে লেখা থাকত ‘পানি’’ কোনটির গায়ে লেখা থাকত ‘দিয়াত’’ এবং অন্যান্যগুলোর গায়ে লেখা থাকত অন্য কোন কিছু।
তৃতীয় : এ শ্রেণীভুক্ত তীরগুলোর মধ্যে কোনটির গায়ে লেখা থাকত ‘তোমাদের অন্তর্ভুক্ত’’, কোনটির গায়ে লেখা থাকত ‘তোমাদের ছাড়া’’, হয়তো বা কোনটির গায়ে লেখা থাকত ‘মুলসাক’ (যার অর্থ হচ্ছে মিলিত)। উল্লেখিত তীরগুলোর ব্যবহার ছিল এরূপ- কারো বংশ পরিচয়ের ব্যাপারে যখন সন্দেহের সৃষ্টি হতো তখন তাকে একশত উটসহ হুবাল নামক মূর্তির নিকট নিয়ে যাওয়া হতো। উটগুলো তীরধারী সেবায়েতের (ঋষি) নিকট সমর্পণ করা হতো। তিনি সবগুলো তীর একত্রিত করে ঝাঁকুনি দিয়ে দিয়ে ঘুরাতে থাকতেন। তারপর তার মধ্য থেকে একটি তীর বাহির করে আনা হতো। তীর গাত্রে ‘তোমাদের অন্তর্ভুক্ত’ লিখিত তীরটি যদি বাহির হতো তবে তাঁকে তাঁদের গোত্রের একজন সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে স্থান দেয়া হতো। অপরপক্ষে যদি ‘তোমাদের বাহিরের’ লিখিত তীরটি বাহির হতো তখন তাঁকে ‘হালীফ’ হিসেবে স্থান দেয়া হতো। কিন্তু যদি ‘মুলসাক’ লিখিত তীরটি বাহির হতো তাহলে তাঁকে তাঁর নিজস্ব স্থানেই রাখা হতো। সেই গোত্রীয় ব্যক্তি কিংবা ‘হালীফ’ হিসেবে স্থান দেয়া হতো না।[7]
তারা এ তীর দ্বারা ভাগ্যের ভাল মন্দ যাচাই করতো। মূলত এটা এক প্রকার জুয়া খেলা। এর ধরণ হলো, তারা এ মাধ্যমে উটের গোশতের কার ভাগে পড়বে তা নির্ধারণের জন্য তীর ঘুরাতো। এ উদ্দেশ্যে তারা বাকীতে উট ক্রয় করে তা জবাই করে ২৮ অথবা দশ ভাগে ভাগ করতো। অতঃপর এ ব্যাপারে তীর ঘুরাতো। যার মধ্যে (الرابح) ‘রাবিহ’ ও (الغفل) ‘গুফল’ নামের তীর থাকতো। যার ক্ষেত্রে (الرابح) তীর বের হতো সে উটের গোশতের অংশ পেত। আর যার ক্ষেত্রে (الغفل) তীর বের হতো সে ব্যর্থ ও হতাশ হতো এবং ঐ উটের মূল পরিমাণ জরিমানা পরিশোধ করতে হতো।
আরবের মুশরিকগণ তথাকথিত ভবিষ্যদ্বক্তা যাদুকর এবং জ্যোতিষ শাস্ত্রবিদগণের ভবিষ্যদ্বাণী, কলাকৌশল এবং কথাবার্তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করতেন। যিনি আগামীতে অনুষ্ঠিতব্য ঘটনাবলীর ভবিষ্যদ্বাণী করতেন এবং গোপন তত্ত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়াদি অবগত আছেন বলে দাবী করতেন তাঁকে বলা হতো ‘কাহিন’। কোন কোন কাহিন এরূপ দাবীও করতেন যে, একটি জিন তাঁর অনুগত রয়েছে এবং সে তাঁকে সংবাদটি সংগ্রহ ও পরিবেশন করে থাকে। কোন কোন কাহিন আবার এরূপ দাবীও করতেন যে, অদৃশ্যের খবরাখবর নেয়ার মতো যথেষ্ট বিদ্যাবুদ্ধি তাঁর রয়েছে এবং তিনি তা নিয়েও থাকেন।
তৎকালীন সমাজে আরও এক ধরণের লোক ছিলেন যাঁরা মানুষের কথা ও কর্মের উপর অনুসন্ধান চালিয়ে তাঁদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতেন। এরা ‘আররাফ’ নামে অভিহিত ছিলেন। তাঁদের দাবী ছিল, কোন লোক যখন কোন কিছু ব্যাপারে অবগত হওয়ার জন্য তাঁর নিকট আগমন করেন তখন তাঁর অবস্থা, কিছু কিছু পূর্ব লক্ষণ এবং আনুষঙ্গিক কথাবার্তার মাধ্যমে ঘটনার স্থান বা ঠিকানা এবং ঘটনার সঙ্গে সংশিষ্ট ব্যক্তি কিংবা ব্যক্তিগোষ্ঠির খোঁজখবর তিনি দিতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- অপহৃত সম্পদ, অপহরণের স্থান ও সময়, হারানো পশু কিংবা অন্য কোন কিছু সম্পর্কিত খোঁজ খবর।
জ্যোতিষ শাস্ত্রবিদ : আকাশ মন্ডলে তারকা রাজির গতিবিধি, উদয়াস্ত, আগমন-প্রত্যাগমন ইত্যাদি লক্ষ্য করে ভবিষ্যতের আবহাওয়া কিংবা ঘটতে পারে এমন ঘটনা, কিংবা দুর্ঘটনা সম্পর্কে আভাস ইঙ্গিত প্রদান হচ্ছে জ্যোতিষীগণের কাজ।[8] জ্যোতিষীগণের চিন্তা-চেতনা এবং গণনার প্রভাব আজও যেমন জন-সমাজে লক্ষ্য করা যায় সেকালেও তেমনটি ছিল। কিন্তু বিশেষ তফাৎ ছিল, তারকারাজির অবস্থা ও অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে বৃষ্টি বাদলের পূর্বাভাষ দেয়া হলে তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, এ তারকাই তাঁদের বৃষ্টি বর্ষণ করেছে। তাঁদের মঙ্গলামঙ্গলের মূলে রয়েছে এ তারকারা। এভাবে তাঁরা জঘণ্য শির্ক করে বসতেন।[9]
ত্বিয়ারাহ : আরবের মুশরিকগণ কোন কাজকর্ম আরম্ভ করা পূর্বে কাজের ফল ‘ভালো’ কিংবা ‘মন্দ’ হতে পারে তা যাঁচাই করে নেয়ার জন্য কতিপয় মনগড়া রেওয়াজের প্রচলন করে নিয়েছিল। এরূপ যাচাইয়ের এ প্রথাকে বলা হতো ত্বিয়ারাহ। এতে তাঁদের স্বকীয় ধারণা-প্রসূত যে সকল কাজকর্ম করা হতো তা হচ্ছে-
যখন তাঁরা কোন কাজ করার ইচ্ছা করতেন তখন তা আরম্ভ করার পূর্বে কোন পাখিকে উড়িয়ে দেয়া হতো কিংবা হরিণকে তাড়া করা হতো। পাখি কিংবা হরিণ যদি তাঁদের ডান দিক দিয়ে পলায়ন করত তাহলে এটাকে শুভ লক্ষণ মনে করে তাঁরা তাড়াতাড়ি কাজ আরম্ভ করে দিতেন। কিন্তু বাম দিক দিয়ে পলায়ন করলে সেটাকে অশুভ লক্ষণ মনে করে কাজ করা থেকে বিরত থাকত। অনুরূপভাবে কোন পশু কিংবা পাখিকে যদি রাস্তায় আঁচোড় কাটতে দেখা যেত তাহলে সেটাকে অমঙ্গলের পূর্ব লক্ষণ বলে মনে করা হতো।
অশুভ কোন কিছুর প্রভাব কাটানোর জন্য খরগোশের পায়ের গোড়ালির উপরের হাড় ঝুলিয়ে রাখা হতো। সপ্তাহের কোন কোন দিন অশুভ, কোন কোন মাস অশুভ, কোন কোন চতুষ্পদ জন্তু অশুভ, কোন কোন মহিলার দর্শন অশুভ, দিন-রাত্রির কোন কোন সময় অশুভ, কোন কোন বাড়িঘর অশুভ ইত্যাদি নানা কুসংস্কার তাঁদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। কলেরা, বসন্ত ইত্যাদি মহামারীকে কোন অশুভ শক্তির পাঁয়তারা বলে মনে করা হতো। অধিকন্তু, মানাবাত্মা পেঁচায় পাওয়ার ব্যাপারটিও তাঁরা বিশ্বাস করতেন। তাঁদের এ বিশ্বাস ছিল যে কোন লোককে কেউ হত্যা করলে যতক্ষণ তাঁর প্রতিশোধ গ্রহণ না করা হয় ততক্ষণ সে আত্মার শান্তি লাভ হয় না। সেই আত্মা পেঁচায় পরিণত হয়ে জনশূন্য প্রান্তরে ঘোরাফিরা করতে থাকে[10] এবং ‘পিপাসা পিপাসা’ অথবা ‘আমাকে পান করাও’ ‘আমাকে পান করাও’ বলে আওয়াজ করতে থাকে। যখন সেই হত্যা প্রতিশোধ গ্রহণ করা হয় তখন সে শান্ত হয়।
ফুটনোটঃ[1] শাইখ মুহাঃ আব্দুল নাজদী (রহঃ) মুখতাসার সীরাতুর রাসূল (সাঃ) ১২ পৃঃ।
[2] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ২২২ পৃঃ।
[3] শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব নাজদী মুখতাসার সীরাতুর রাসূল (সা.) ১৩, ৫০-৫৪ পৃঃ।
[4] সীরাতে ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৮৯-৯০ পৃঃ।
[5] সহীহুল বুখারী শরীফ ১ম খন্ড ৪৯৯ পৃঃ।
[6] প্রাগুক্ত
[7] মুহাযারাতে খুযরী ১ম খন্ড ৫৬পৃঃ। ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১০২-১০৩ পৃঃ।
[8] মিরআতুল মাফাতীহ শারাহ মিশকাতুল মাসাবীহ (লক্ষ্ণৌমুদ্রণ ২য় খন্ড ২-৩ পৃঃ।
সহীহুল মুসলিম শরীফ নাবাবী শারাহ সহ ঈমান পর্ব বাবু বয়ানে কুফরি মান কালা মোতেবনা বিন নাওই ১ম খন্ড ৯৫ পৃঃ।
[9] সহীহুল মুসলিম শরীফ নাবাবী শারাহ সহ ঈমান পর্ব বাবু বয়ানে কুফরি মান কালা মোতেবনা বিন নাওই ১ম খন্ড ৯৫ পৃঃ।
[10] সহীহুল বুখারী শরীফ ২য় খন্ড ৮৫১, ৮৫৭ পৃঃ (ব্যাখ্যা সহ)।
দ্বীনে ইবরাহীমীতে কুরাইশগণের বিদ‘আত সংযোজন:
দ্বীনে ইবরাহীমীতে কুরাইশদের সংযোজিত ও অনুসৃত বিদ‘আত সমূহই ছিল জাহেলিয়াত আমলের আরববাসীগণের ধর্ম বিশ্বাস ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মূলরূপ। ইবরাহীম (আঃ) প্রবর্তিত সত্য ধর্মের কোন কোন আচার অনুষ্ঠানের কিছু কিছু অংশ তখনো অবশিষ্ট ছিল। অর্থাৎ ইবরাহীম (আঃ) প্রবর্তিত দ্বীনকে তাঁরা সম্পূর্ণ রূপে ছেড়ে দেননি, ফলে বায়তুল্লাহর প্রতি তাঁরা যথারীতি সম্মান প্রদর্শন এবং ত্বাওয়াফ করতেন, ওমরা এবং হজ্জ পালন করতেন, আরাফা এবং মুযদালিফায় অবস্থান করতেন এবং হাদয়ীর পশু কুরবাণী করতেন।
সনাতন ইসলামের কিছু কিছু রীতিনীতি এবং আচার অনুষ্ঠানাদি পালন করলেও প্রকৃতপক্ষে ধর্ম বিশ্বাসের ক্ষেত্রে তাঁরা এত বেশী শির্ক-বিদ’আতের সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন যে, সত্য ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানগুলো সম্পূর্ণ অর্থহীন হয়ে পড়েছিল। আরববাসীগণ আরও যে সব বিদ‘আতের প্রচলন করে নিয়েছিল তা হচ্ছে যথাক্রমে নিম্নরূপ :
১. কুরাইশরা দাবী করতেন যে, তাঁরা হচ্ছেন ইবরাহীম (আঃ)-এর বংশধর এবং তাঁরাই হচ্ছেন হারাম শরীফের সংরক্ষক ও অভিভাবক এবং মক্কার প্রকৃত অধিবাসী। কোন ব্যক্তিই তাঁদের সমকক্ষ নয় এবং কারো প্রাপ্য তাঁদের প্রাপ্যের সমান নয়। এ সব কারণে তাঁরা নিজেরাই নিজেদেরকে ‘হুমস’ (বীর এবং শক্তিশালী) আখ্যায় আখ্যায়িত করতেন। কাজেই, তাঁরা এটা মনে করতেন যে, হারাম সীমানার বাইরে অগ্রসর হওয়া তাঁদের উচিত না। তাই হজ্জ মৌসুমে তাঁরা আরাফাতে যেতেন না এবং সেখান থেকে তাঁরা তাওয়াফে ইফাযাও করতেন না। তাঁরা মুযদালিফায় অবস্থান করতেন এবং সেখান থেকেই তাওয়াফে ইফাযা করে নিতেন। তাঁদের সেই বিদ‘আত সংশোধনের জন্য আল্লাহ ইরশাদ করেছেন :
{ثُمَّ أَفِيْضُوْا مِنْ حَيْثُ أَفَاضَ النَّاسُ} [البقرة:199]
‘তারপর তোমরা ফিরে আসবে যেখান থেকে লোকেরা ফিরে আসে।’ (আল-বাক্বারাহ ২ : ১৯৯) [1]
২. এদের আরও একটি বিদ‘আতের ব্যাপার ছিল, তাঁরা বলতেন যে, হুমসদের (কুরাইশ) জন্য ইহরামের অবস্থায় পণীর এবং ঘী তৈরি করা ঠিক নয় এবং এটাও ঠিক নয় যে, লোম নির্মিত গৃহে (অর্থাৎ কম্বলের শিবিরে) প্রবেশ করবে। এটাও ঠিক নয় যে, ছায়ায় অবস্থানের প্রয়োজন হলে চামড়ার তৈরি শিবির ব্যতীত কোথাও অন্য কোন কিছুর ছায়ায় আশ্রয় নেবে।[2]
৩. তাঁদের আরও একটি বিদ‘আতের ব্যাপার ছিল যে, তাঁরা বলতেন যে, হারামের বাহির থেকে আগত হজ্জ উমরাহকারীগন হারামের বাহির হতে খাদ্যদ্রব্য কিংবা অনুরূপ কোন কিছু নিয়ে আসলে তা তাঁদের জন্য খাওয়া ঠিক নয়।[3]
৪. আরও একটি বিদ‘আতের কথা জানা যায় এবং তা হচ্ছে, তাঁরা হারামের বাহিরের বাসিন্দাদের প্রতি নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন যে, হারামের মধ্যে প্রবেশ করার পর হুমস হতে সংগৃহীত বস্ত্র পরিধান করে তাঁদের প্রথম ত্বাওয়াফ করতে হবে। এ প্রেক্ষিতে হুমসের বস্ত্র সংগৃহীত করা সম্ভব না হলে পুরুষেরা উলঙ্গ অবস্থাতেই ত্বাওয়াফ করত এবং মহিলারা পরিধানের কাপড় চোপড় খুলে ফেলে দিয়ে একটি ছোট রকমের খোলা জামা পরিধান করতেন এবং ঐ অবস্থাতেই ত্বাওয়াফ করতেন। ত্বাওয়াফ কালে তাঁরা কবিতার এ চরণ আবৃত্তি করতেন :
اليـوم يبـدو بعضـه أو كله ** ومـا بدا منـه فـلا أحلـه
‘অদ্য কিছু অথবা সম্পূর্ণ লজ্জাস্থান উলঙ্গ হয়ে যাবে, কিন্তু যা খুলে যায় আমি তা দেখা বৈধ বলে সাব্যস্ত করি না।’
এ সমস্ত অশ্লীলতা থেকে পরহেজ করে চলার জন্য আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন:
{يَا بَنِيْ آدَمَ خُذُوْا زِيْنَتَكُمْ عِندَ كُلِّ مَسْجِدٍ} [الأعراف:31]
‘হে আদাম সন্তান! প্রত্যেক সলাতের সময় তোমরা সাজসজ্জা গ্রহণ কর। (আল-আ‘রাফ ৭ : ৩১)
অপরদিকে, যদি কোন মহিলা কিংবা পুরুষ নিজেকে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন মনে করে হারামের বাহির থেকে আনা পোষাকে ত্বাওয়াফ করে নিত তাহলে ত্বাওয়াফের পর এ পোষাক তাঁকে ফেলে দিতে হতো। এর ফলে তাঁরা না নিজে উপকৃত হতেন না অন্য কেউ।[4]
৫. বিদ‘আতের আরও একটি ব্যাপার ছিল, ইহরাম অবস্থায় তাঁরা দরজা দিয়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করতেন না। ঘরে প্রবেশ করার জন্য তাঁরা ঘরের পিছন দিকে একটা বড় ছিদ্র করে নিয়ে সেই ছিদ্র পথে আসা-যাওয়া করতেন। অবোধ এবং আহাম্মকের মতই এ কাজকে তাঁরা পুণ্যময় কাজ বলে মনে করতেন। এ ধরণের কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য আল্লাহ তা‘আলা কুরআন কারীমে ইরশাদ করেছেন :
{وَلَيْسَ الْبِرُّ بِأَنْ تَأْتُوْا الْبُيُوْتَ مِن ظُهُوْرِهَا وَلٰـكِنَّ الْبِرَّ مَنِ اتَّقَى وَأْتُوْا الْبُيُوْتَ مِنْ أَبْوَابِهَا وَاتَّقُوْا اللهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ} [البقرة:189]
‘তোমরা যে গৃহের পেছন দিক দিয়ে প্রবেশ কর, তাতে কোন পুণ্য নেই, বরং পুণ্য আছে কেউ তাকওয়া অবলম্বন করলে, কাজেই তোমরা (সদর) দরজাগুলো দিয়ে গৃহে প্রবেশ কর এবং আল্লাহকে ভয় করতে থাক, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।’ (আল-বাক্বারাহ ২ : ১৮৯)
উপরোল্লেখিত আলোচনা সূত্রে আমাদের মানসিক দৃষ্টিপটে দ্বীনের যে চিত্রটি চিত্রিত হল সেটাই ছিল সাধারণ আরববাসীগণের দ্বীনের স্বরূপ। মূর্তিপূজা, শির্ক, বিদ‘আত, কল্পনা, কুসংস্কার, অশ্লীলতা, ইত্যাদির আবরণে চাপা পড়ে গিয়েছিল ইবরাহীম (আঃ) প্রবর্তিত সত্য ও সনাতন ইসলাম।
এ ছাড়া আরবীয় উপদ্বীপের বিভিন্ন অঞ্চলে ইহুদীবাদ, খ্রীষ্টবাদ, প্রাচীনতম পারসীক যাজকতাবাদ এবং সাবাঈধর্ম স্থান দখলের সুযোগ সক্রিয় ছিল। তাই সে সবেরও সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এবং ঐতিহাসিক পটভূমি সম্পর্কে আলোচনা করা হল:
ইহুদী মতবাদ : আরব উপদ্বীপে ইহুদীদের কমপক্ষে দু’টি যুগ অতিবাহিত হয়েছিল। প্রথম যুগটি সেই সময়ের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল যখন ফিলিস্ত্বীনে বাবেল এবং আশুরের রাষ্ট্র বিজয়ের কারণে ইহুদীগণকে দেশত্যাগ করতে হয়েছিল। বাহিনী কর্তৃক ব্যাপকভাবে ইহুদীদের ধরপাকড়, বুখতুনসসরের হাতে ইহুদীবসতি ধ্বংস ও উজাড়, তাঁদের উপাসনাগারের ক্ষতিসাধন এবং বাবেল থেকে ব্যাপকভাবে দেশান্তরের ফলে একদল ইহুদী ফিলিস্ত্বীন ছেড়ে গিয়ে হিজাযের উত্তরাঞ্চলে বসতি স্থাপন করে।[5]
দ্বিতীয় পর্যায় আরম্ভ হয় যখন টাইটাস রুমীর নেতৃত্বে রুমীগণ ৭০ খ্রীষ্টাব্দে জোর করে ফিলিস্ত্বীন দখল করে নেয়। সেই সময় রুমীগণের বহু ইহুদী বসতি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং তাঁদের উপাসনাগারের ক্ষতি সাধিত হয়। এর ফলে বহু ইহুদী গোত্র হিজাযে পালিয়ে আসে এবং ইয়াসরিব, খায়বার এবং তাইমায় গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। সেই সকল স্থানে তাঁরা স্থায়ী বসতি স্থাপন করেন এবং কেল্লা ও গড় নির্মাণ করেন।
উল্লেখিত দেশত্যাগী ইহুদীদের মাধ্যমে আরববাসীগণের মধ্যে এক প্রকার ইহুদী প্রথা চালু হয়ে যায়। এ আরব ইহুদী সংমিশ্রণের সূত্রপাত হয় ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে, ইসলামের প্রাথমিক যুগে দ্রুত পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক অবস্থা ও ঘটনা প্রবাহের প্রেক্ষাপটে তা বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে। ইসলামের আবির্ভাবকালে উল্লেখযোগ্য ইহুদী গোত্রগুলো ছিল যথাক্রমে খায়বার, নাযীর, মুস্তালাক্ব, কুরাইযাহ এবং ক্বায়নুক্বা। বিখ্যাত সামহুদী ‘ওয়াফাউল ওয়াফা’ গ্রন্থে ১১৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন যে তৎকালে ইহুদী গোত্রগুলোর সংখ্যা বিশেরও (২০) কিছু বেশী ছিল।[6]
ইয়ামানে ইহুদী মতবাদ বেশ বিস্তার লাভ করে। এখানে এর বিস্তার লাভের মূল হোতা ছিলেন তুব্বান আস’আদ আবূ কারাব। এ ব্যক্তি যুদ্ধ করতে করতে ইয়াসরিবে গিয়ে উপস্থিত হন। সেখানে তিনি ইহুদী মতবাদ গ্রহণ করেন এবং বনু কুরাইযাহর দু’জন ইহুদী বিদ্বানকে সঙ্গে নিয়ে ইয়ামান যান। এভাবে ইয়ামানে ইহুদী মতবাদ বিস্তার লাভ করেন।
আবূ কারাবের পর তাঁর পুত্র ইউসুফ যূ নাওয়াস ইয়ামানের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। শাসনভার গ্রহণ করার পর তিনি নাজরানবাসী খ্রীষ্টানগণের উপর হামলা চালান এবং ইহুদী মতবাদ চাপিয়ে দেয়ার জন্য প্রবল চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন। কিন্তু প্রবল চাপ সত্ত্বেও খ্রীষ্টানগণ ইহুদী মতবাদ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন যার ফলশ্রুতিতে যুনাওয়াস গর্ত খনন করে সেই গর্তে অগ্নিকুন্ড তৈরি করেন এবং যুবা, বৃদ্ধ, পুরুষ-মহিলা, নির্বিশেষে অনেককে সেই অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করে হত্যা করেন। বলা হয়ে থাকে যে, বিশ থেকে চল্লিশ হাজার লোক এ নারকীয় ঘটনার শিকার হয়েছিলেন। এ নারকীয় ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল ৫২৩ খ্রীষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে। কুরআন মাজীদের সূরাহ বূরুজে এ ঘটনার উল্লেখ রয়েছে।[7]
{قُتِلَ أَصْحَابُ الْأُخْدُوْدِ النَّارِ ذَاتِ الْوَقُوْدِ إِذْ هُمْ عَلَيْهَا قُعُوْدٌ وَهُمْ عَلٰى مَا يَفْعَلُوْنَ بِالْمُؤْمِنِيْنَ شُهُوْدٌ} [البروج: 4- 7]
‘‘ধ্বংস হয়েছে গর্ত ওয়ালারা ৫. (যে গর্তে) দাউ দাউ করে জ্বলা ইন্ধনের আগুন ছিল, ৬. যখন তারা গর্তের কিনারায় বসেছিল ৭. আর তারা মু’মিনদের সাথে যা করছিল তা দেখছিল।’ (আল-বুরূজ ৮৫ : ৪-৭)
খ্রীষ্টীয় মতবাদ : খ্রীষ্টীয় মতবাদ সম্পর্কে যতটুকু জানা যায় তা হল, আরবের শহরগুলোতে ওদের আগমনের ব্যাপারটি ঘটেছিল হাবশী এবং রুমীগণের জবর দখলের পর বিজয়ীদের মাধ্যমে। ইতোপূর্বে বলা হয়েছে যে, ইয়ামানের উপর হাবশীগণের প্রথম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় ৩৪০ খ্রীষ্টাব্দে কিন্তু তাদের এ রাজত্ব বেশিদিন টিকেনি। তাদের হাত হতে তা ৩৭০ থেকে ৩৭৮ খ্রিস্টাব্দ সময়ে হাতছাড়া হয়ে যায়। এ মধ্যবর্তী সময়ে খ্রীষ্টান মিশনারীগণ ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার কাজ চালাতে থাকেন। প্রায় সেই সময়েই এমন এক বুজর্গ ব্যক্তি নাজরানে আগমন করেন যাঁর প্রার্থনা আল্লাহর নিকটে কবুল হতো বলে কথিত আছে। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সম্মানিত ও কেরামতওয়ালা পুরুষ। তাঁর নাম ছিল ফাইমিউন। অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি নাজরানে খ্রীষ্টীয় মতবাদের প্রচার কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। নাজরানবাসীগণের উপর তাঁর প্রচার কাজের প্রভাব অত্যন্ত কার্যকরভাবে প্রতিফলিত হতে থাকে। তাঁরা তাঁর কাছে এমন কিছু কেরামত দেখতে পান যা তাদের বিশ্বাসের ভিত্তিমূলকে অধিকতর দৃঢ় করে তোলে। এরপর তাঁরা সকলেই খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেন।[8]
অতঃপর দ্বিতীয়বার হাবশগণ ৫২৫ খ্রিস্টাব্দে নূ নাওয়াস কর্তৃক খ্রীস্টানদের গর্তের মধ্যে পুড়িয়ে মারার মতো পৈশাচিক কর্মকান্ডের প্রতিশোধস্বরূপ আবরাহাহ আল-আশরাম রাষ্ট্রের শাসনভার গ্রহণ করেন। রাষ্ট্র নায়কের আসনে সমাসীন হওয়ার পর নতুন উদ্যমে খ্রীষ্টীয় মতবাদের প্রচার ও প্রসার কাজে তিনি আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর এ প্রচেষ্টার ফলশ্রুতিই হচ্ছে ইয়ামানে অন্য একটি কা’বাহ গৃহনির্মাণ এবং তাঁর নির্মিত কাবা’হ গৃহে হজ্জ পালনের জন্য আরববাসীগণকে আহবান জানানো। শাসক আবরাহা শুধু অন্য একটি ক্বাবা’হ গৃহ নির্মাণ এবং হজ্জ পালনের আহবান জানিয়েই ক্ষান্ত হননি। তিনি খানায়ে ক্বাবা’হকে সমূলে ধ্বংস করাতো দূরের কথা, আল্লাহ তা‘আলার গজবে পড়ে বিশাল এক হস্তী বাহিনীসহ তিনি নিজেই সমূলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। যেমনটি কুরআন কারীমের সূরাহ ‘ফীলে’ বলা হয়েছে। সূরাহ ফীলের এ ঘটনা সর্ব যুগের সকল মানুষের শিক্ষা লাভের জন্য একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে।
অপরদিকে রুমীয় অঞ্চল সমূহের সন্নিকটস্থ হওয়ার কারণে আলে গাসসান, বনু তাগলিব, বনু তাই এবং অন্যান্য আরব গোত্রসমূহে খ্রীষ্টীয় মতবাদ বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। হীরাহর আরব সম্রাটগণও খ্রীষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন বলে জানা যায়।
মাজুসী মতবাদ : মাজুসী মতবাদ সম্পর্কে যতটুকু জানা যায় তা হচ্ছে, পারস্যের সন্নিকটস্থ আরব ভূমিতে এ মতবাদ বেশ প্রাধান্য এবং প্রতিষ্ঠা লাভ করে, যেমন- আরবের ইরাকে, বাহরাইনে (আল আহসা), হাজার এবং আরব উপসাগরীয় সীমান্ত অঞ্চলে। তাছাড়া ইয়ামানে পারস্য শাসনামলেও বিচ্ছিন্নভাবে দু-একজন মাজুসী মতবাদ গ্রহণ করেছিলেন।
সাবী মতবাদ : এরপর অবশিষ্ট থাকে সাবী মতবাদের কথা। এটা এমন একটি মতবাদ যার অনুসারীরা নক্ষত্র ও তার বিভিন্ন কক্ষপথ এবং তারকারাজির প্রভাবকে এমনভাবে স্বীকৃতি দিত যে এগুলোকেই বিশ্ব পরিচালনা করে বলে বিশ্বাস করতো। ইরাক এবং অন্যান্য দেশের প্রাচীন শহর-নগরের ধ্বংসস্তুপ খননের সময় যে সকল দলিল-দস্তাবেজ হস্তগত হয়েছে তা থেকে এটা বুঝা যায় যে, তা ইবরাহীম (আঃ)-এর কালদানী সম্প্রদায়ের মতবাদ। প্রাচীন শাম এবং ইয়ামানের বহু অধিবাসী এ মতবাদের অনুসারী ছিলেন। কিন্তু পরবর্তী কালে যখন ইহুদী মতবাদ এবং তারও পরে খ্রীষ্টীয় মতবাদ বিস্তার লাভ করে তখন এ সাবী মতবাদের ভিত্তিমূল শিথিল হয়ে পড়ে এবং প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ ক্রমান্বয়ে নির্বাপিত হওয়ার সম্মুখীন হয়ে পড়ে। কিন্তু তবুও ইরাকে এবং আরব উপসাগরীয় সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এ মতবাদের কিছু সংখ্যক অনুসারী থেকে যায়।[9]
আবার আরবের কতক স্থানে কিছু সংখ্যক নাস্তিক্য মতবাদের অনুসারীদের দেখা যেত। তারা হীরাহর পথে এখানে আসে। যেমন কুরাইশদের কতক লোককে পারস্যে পাওয়া যায় যারা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে তথায় গিয়েছিল।
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৯৯ পৃঃ, সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ২২৬ পৃঃ।
[2] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ২০২ পৃঃ।
[3] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ২০২ পৃঃ।
[4] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ২০৩ পৃঃ এবং সহীহুল বুখারী শরীফ ১ম খন্ড ২২৬ পৃঃ।
[5] কালবে জাজীরাতুল আরব ২৫১ পৃঃ।
[6] কালবে জাজীরাতুল আরব ২৪১ পৃঃ।
[7] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ২০-২২ পৃঃ ২৭, ৩১, ৩৫-৩৬ পৃঃ। অধিকন্তু তাফসীর গ্রন্থে সূরাহ বুরুজের তাফসীর দ্রষ্ঠব্য।
[8] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৩১-৩৪ পৃঃ।
[9] তারিখে আরযুল কুরআন ২য় খন্ড ১৯৩-২০৮ পৃঃ।
ধর্মীয় অবস্থা (الحالة الدينية):
পৌত্তলিকতা, অশ্লীলতা, শিরক, বিদ’আত ও বহুত্ববাদের জমাট অন্ধকার ভেদ করে চির ভাস্বর ও চির জ্যোতির্ময় ইসলাম নামক সূর্য যখন নবায়িত আলোর বন্যায় উদ্ভাসিত হয়ে আত্মপ্রকাশ করল তখন প্রচলিত সকল বিশ্বাস এবং মতবাদের অনুসারীগণ একদম হতচকিত হয়ে পড়ল। সর্বশেষ আসমানী কিতাব মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের সুললিত শাশ্বত বাণী এবং মহানাবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর উদাত্ত কণ্ঠের তৌহীদী ঘোষণা সকল ভ্রান্ত বিশ্বাসের ভিত্তিমূলকে করে তুলল প্রকম্পিত। যে সকল মুশরিক ও পুতুল পুজক শির্ক ও পৌত্তলিকতার পাপপংকে নিমজ্জিত থেকেও দাবী করত যে, তাঁরা দ্বীন-ই ইবরাহীম (আঃ)-এর উপর প্রতিষ্ঠিত তাঁদের বিশ্বাসের ভিত্তিমূলে চরম আঘাত হানল।
ইবরাহীম (আঃ) প্রবর্তিত সত্য ধর্মের অনুসারী বলে দাবী করলেও প্রকৃতপক্ষে দ্বীন-ই-ইবরাহীমী (আঃ)-এর কোন বৈশিষ্ট্যই তাঁদের চিন্তা চেতনা ও ধ্যান-ধারণায় ছিল না। তারা নানা প্রকার অশ্লীলতা ও পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়ে। অবতীর্ণ আল্লাহর বাণীর আলোকে নাবী কারীম (সাঃ) যখন আল্লাহর একমাত্র মনোনীত ধর্ম ইসলামের শাশ্বতরূপ এবং ইবরাহীম (আঃ) প্রবর্তিত দ্বীনের সঙ্গে এর বিভিন্ন সম্পর্কের প্রসঙ্গটি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন তখন তাঁদের দ্বীন সম্পর্কিত দাবীর অসারতা দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট হয়ে উঠল।
ইহুদীবাদের অবস্থাও ছিল ঠিক একইরূপ। অসার বাহ্যাড়ম্বর সর্বস্ব স্বেচ্ছাচার ছাড়া তেমন আর কিছুই ছিল না ইহুদীদের মধ্যে। ইহুদী পুরোহিতগণ আল্লাহকে ভুলে গিয়ে নিজেরাই চেয়েছিলেন প্রভুর আসনে সমাসীন হতে। ধর্মের আবরণে তাঁরা চেয়েছিলেন পার্থিব প্রতিষ্ঠা। ধর্মের দোহাই দিয়ে তাঁরা চাইতেন সাধারণ মানুষের উপর তাঁদের স্বকীয় মতামত সম্পর্কিত প্রভাব বিস্তার করতে। তাঁদের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল সম্পদ সংগ্রহ করে সম্পদের পাহাড় রচনা করা। সম্পদ সংগ্রহ করতে গিয়ে তার ধর্ম-কর্ম যদি চুলায় যায় তা যাক, অবিশ্বাস কিংবা অধর্ম যদি বিস্তার লাভ করে তা করুক, তাতে কিছুই আসে যায় না। এ-ই ছিল ইহুদীবাদের সত্যিকার রূপ।
খ্রীষ্টান ধর্মও সত্য বিবর্জিত শির্ক এবং পৌত্তলিকতায় ভরপুর হয়ে পড়েছিল। আল্লাহর একত্ববাদের পরিবর্তে তৃত্ববাদের ধারণা তাঁদের মনে বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল এবং এ ভ্রান্ত ধারণাই আল্লাহ এবং মানবকে এক আজব সংমিশ্রণের বন্ধনে আবদ্ধ করেছিল। অধিকন্তু, যে আরববাসীগণ এ ধর্ম গ্রহণ করেছিল প্রকৃতপক্ষে তাদের উপর এ ধর্মের কোন প্রভাব প্রতিফলিত হয় নি। কারণ, এর আদর্শের সঙ্গে তাঁদের প্রচলিত জীবন যাত্রা-প্রণালীর কোন মিল ছিলনা আর তারা তাদের প্রচলিত জীবন-পদ্ধতি পরিত্যাগ করতে পারছিলেন না।
অবশিষ্ট আরবদের অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের অবস্থা মুশরিকগণের মতই ছিল। কারণ, তাঁদের অন্তঃকরণ একই ছিল, বিশ্বাসসমূহে পরস্পর সাদৃশ্য ছিল এবং রীতিনীতিতে সঙ্গতি ছিল।
আরবের তৎকালীন অবস্থা
সামাজিক অবস্থা :
তৎকালীন আরব সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর লোকজন ববসাব করত। অবস্থা এবং অবস্থানের কথা বিবেচনা করলে লক্ষ্য করা যায় যে, জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে যথেষ্ট ভিন্নতা রয়েছে। অভিজাত শ্রেণীর পরিবারে পুরুষ এবং মহিলাগণের পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল মর্যাদা এবং ন্যায়-ভিত্তিক ব্যবস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত। বহু ব্যাপারে মহিলাদের স্বাধীনতা দেয়া হতো, তাঁদের যুক্তি-সঙ্গত কথাবার্তার যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হতো এবং তাঁদের ব্যক্তি বৈশিষ্ট্যকে মর্যাদা দেয়া হতো। অভিজাত পরিবারের মহিলাদের রক্ষণাবেক্ষণ এবং মান সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখার ব্যাপারে সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখা হতো। মহিলাদের মান মর্যাদার ব্যাপারে হানিকর বা অবমাননাকর পরিস্থিতিতে সঙ্গে সঙ্গে তলোয়ার কোষমুক্ত হয়ে খুন-খারাবি শুরু হয়ে যেত।
তৎকালীন আরবে প্রচলিত রেওয়াজ মাফিক কোন ব্যক্তি নিজের উদারতা কিংবা বীরত্বের প্রশংসাসূচক কোন কিছু বলতে চাইলে মহিলাদের সম্বোধন করেই তা বলা হতো। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মহিলারা ইচ্ছা করতে পারত। পক্ষান্তরে পুরুষদের উত্তেজিত ও উদ্বোধিত করে সহজেই যুদ্ধাগ্নিও প্রজ্জ্বলিত করে দিতে পারত।
কিন্তু এতসব সত্ত্বেও প্রকৃতপক্ষে পুরুষ প্রধান সমাজ কাঠামোই আরবে প্রচলিত ছিল। পরিবার প্রধান বা পরিবারের পরিচালক হিসেবে পুরুষদেরই প্রাধান্য ছিল এবং তাঁদের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হিসেবে স্বীকৃত এবং গৃহীত হতো। পারিবারিক জীবন যাত্রার ক্ষেত্রে পুরুষ স্ত্রী এবং সম্পর্ক বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হতো। বর-কনে উভয় পক্ষের অভিভাবকগণের সম্মতিক্রমে কনের অভিভাবকগণের তত্ত্বাবধানে বিবাহ পর্ব অনুষ্ঠিত হতো। অভিভাবকগণের অগোচরে ইচ্ছামাফিক বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার অধিকার মহিলাদের ছিল না।
এক দিকে যখন সম্ভ্রান্ত এবং অভিজাত পরিবারসমূহের জন্য প্রচলিত ছিল এ ব্যবস্থা, অপরপক্ষে তখন সাধারণ মানুষের মধ্যে নারী পুরুষের সম্পর্ক এবং মেলামেশার ক্ষেত্রে এমন সব ঘৃণ্য ব্যবস্থা এবং জঘন্য প্রথা প্রচলিত ছিল যাকে অশ্লীলতা, পাশবিকতা এবং ব্যভিচার ছাড়া অন্য কিছুই বলা যেতে পারে না। উম্মুল মুমিনীন আয়িশাহ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত তথ্যাদি সূত্রে জানা যায় যে, অন্ধকারে যুগে আরব সমাজে বিবাহের চারটি প্রথা প্রচলিত ছিল। এর মধ্যে একটি হচ্ছে তো সেই প্রথা যা বর্তমান যুগেও জনসমাজে প্রচলিত রয়েছে। এ প্রথানুসারে বিভিন্ন দিক বিবেচনার পর একজন তাঁর অধীনস্থ মহিলার জন্য অন্য এক জনের নিকট বিয়ের প্রস্তাব বা পয়গাম পাঠাতেন। তারপর উভয় পক্ষের মধ্যে বোঝাপড়ার মাধ্যমে স্বীকৃতি লাভের পর বর কনেকে ধার্য মোহর দিয়ে বিয়ে করত।
নারী-পুরুষের মিলনের দ্বিতীয় প্রথাকে বলা হতো ‘নিকাহে ইসতিবযা’। নারী-পুরুষের মিলনের উদ্দেশ্য থাকত জ্ঞানী, গুণী ও শক্তিধর কোন সুপুরুষের সঙ্গে সঙ্গম ক্রিয়ায় লিপ্ত হওয়ার মাধ্যমে উৎকৃষ্ট শ্রেণীর সন্তান লাভ। এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে যখন কোন মহিলা ঋতু জনিত অপবিত্রতা থেকে পবিত্র হতেন তখন তাঁর স্বামী তাঁকে তাঁর পছন্দ মতো কোন সুপুরুষের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য প্রস্তাব পাঠাতে বলতেন। এ অবস্থায় স্বামী তাঁর নিকট থেকে পৃথক হয়ে থাকতেন, কোন ক্রমেই তাঁর সঙ্গে সঙ্গম ক্রিয়ায় লিপ্ত হতেন না। এদিকে স্ত্রী প্রেরিত প্রস্তাব স্বীকৃতি লাভ করলে গর্ভ ধারণের সুস্পষ্ট আলামত প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত তার সঙ্গে সঙ্গম ক্রিয়ায় লিপ্ত হতে থাকতেন। তারপর গর্ভ ধারণের আলামত সুস্পষ্ট হলে তিনি তাঁর স্বামীর সঙ্গে মিলিত হতেন। হিন্দুস্থানী পরিভাষায় এ বিবাহকে ‘নিয়োগ’ বলা হয়।
তথাকথিত ‘বিবাহ’ নামক নারী-পুরুষের মিলনের তৃতীয় প্রথা ভিন্নতর রূপের একটি জঘণ্য ব্যাপার। এতে দশ থেকে কম সংখ্যক ব্যক্তির সমন্বয়ে একটি দল একত্রিত হতো এবং সকলে পর্যায়ক্রমে একই মহিলার সঙ্গে সঙ্গম ক্রিয়ায় লিপ্ত হতো। এর ফলে এ মহিলা গর্ভ ধারণের পর যথা সময়ে সন্তান প্রসব করত। সন্তান প্রসবের কয়েক দিন পর সেই মহিলা তাঁর সঙ্গে যাঁরা সঙ্গম ক্রিয়ায় লিপ্ত হয়েছিলেন তাঁদের সকলকে ডেকে নিয়ে একত্রিত করতেন। প্রচলিত প্রথায় বাধ্য হয়েই সংশিষ্ট সকলকে সেখানে উপস্থিত হতে হতো। সেখানে উপস্থিত হওয়ার ব্যাপারে অমত করার কোন উপায় থাকতনা। মহিলার আহবানে যখন সকলে উপস্থিত হতেন তখন সকলকে লক্ষ্য করে মহিলা বলতেন যে, ‘আপনাদের সঙ্গে সঙ্গম ক্রিয়ার ফলেই যে আমার এ সন্তান ভূমিষ্ট হয়েছে এ ব্যাপারটি আপনারা সকলেই অবগত আছেন।’
তারপর সমবেত লোকজনদের মথ্য থেকে এক জনকে লক্ষ্য করে বলতেন ‘হে অমুক, আমার গর্ভজাত এ সন্তান হচ্ছে আপনারই সন্তান।’ মহিলার ঘোষণাক্রমে সন্তানটি হতো তাঁরই সন্তান এবং সংশিষ্ট সকলেই এর স্বীকৃতি প্রদান করতে বাধ্য থাকতেন।
নারী-পুরুষের ‘বিবাহ ও মিলন’ নাম দিয়ে আরও একটি জঘন্য রকমের অশ্লীল রেওয়াজ জাহেলিয়াত যুগের আরব সমাজে প্রচলিত ছিল। এতে কোন মহিলাকে কেন্দ্র করে বহু লোক একত্রিত হতেন এবং পর্যায়ক্রমে তাঁর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতেন। এরা হচ্ছেন পতিতা প্রবৃত্তির পেশাবলম্বিনী মহিলা। কাজেই, যৌন সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে কোন লোক তাঁদের নিকট আগমন করলে তাঁরা আপত্তি করতেন না। এদের বাড়ির প্রবেশ দ্বারে পেশার প্রতীক হিসেবে নিশান দিয়ে রাখা হতো যাতে ইচ্ছুক ব্যক্তিরা নির্দ্বিধায় গমনাগমন করতে পারেন। যৌনক্রিয়ার ফলে গর্ভ ধারণের পর যখন কোন মহিলা সন্তান প্রসব করতেন তখন তাঁর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনকারী সকল পুরুষকে একত্রিত করা হতো। তারপর যে ব্যক্তি মানুষের অবয়ব প্রত্যক্ষ করে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম এমন ব্যক্তিকে সেখানে আহবান জানানো হতো। সেই ব্যক্তি উপস্থিত সকলের অবয়ব নিরীক্ষণান্তে তাঁর বিবেচনা মতো এক জনের সঙ্গে সন্তানপির যোগসূত্র বা সম্পর্ক স্থাপন করে দিতেন। তিনি বলতেন, ‘এ সন্তান আপনার’’। যাঁকে লক্ষ্য করে এ রায় দেয়া হতো তিনি তা মানতে বাধ্য থাকতেন। এভাবে নব জাতকটির একজন পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত হয়ে যেত। তিনিও শিশুটিকে তাঁর ঔরসজাত সন্তান বলেই মনে করতেন।
যখন আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে রাসূল রূপে প্রেরণ করলেন তখন জাহেলিয়াত যুগের সর্ব প্রকার অশ্লীল বৈবাহিক ব্যবস্থার অবসান ঘটল। বর্তমানে ইসলামী সমাজে যে বিবাহ প্রথা প্রচলিত রয়েছে আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশে রাসূলে কারীম (সাঃ) আরব সমাজে সেই ব্যবস্থাই প্রতিষ্ঠিত করেন।[1]
আরও কোন কোন ক্ষেত্রে আরবের নারী-পুরুষদের অন্য রকম সম্পর্কের কথা জানা যায়। তৎকালে, অর্থাৎ জাহেলিয়াত আমলে নারী-পুরুষ সম্পর্ক বন্ধনের ব্যাপারটি এমন প্রথার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল যা তলোয়ারের ধার এবং বল্লমের ফলার সাহায্যে প্রতিষ্ঠালাভ করত। এতে গোত্রীয় যুদ্ধ বিগ্রহের ক্ষেত্রে বিজয়ী গোত্র বিজিত গোত্রের নারীদের আটক রেখে যৌন সম্ভোগে তাদের ব্যবহার করত। এ সকল মহিলার গর্ভে যে সকল সন্তান জন্মলাভ করত তাদের কোন সামাজিক মর্যাদা দেয়া হতো না। সামাজিক দৃষ্টিকোন থেকে সারা জীবন তাদেরকে খাটো হয়েই থাকতে হতো।
জাহেলিয়াত আমলে একই সঙ্গে একাধিক অনির্দিষ্ট সংখ্যক স্ত্রী গ্রহণের রেওয়াজ প্রচলিত ছিল। একই সঙ্গে দু’সহোদরাকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করে সংসার করাটা কোন দোষের ব্যাপার ছিল না। পিতার মৃত্যুর পর এবং পিতা কর্তৃক তালাক প্রাপ্তা বিমাতাকে বিবাহ প্রথাও তৎকালে চালু ছিল।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
{وَلاَ تَنكِحُوْا مَا نَكَحَ آبَاؤُكُم مِّنَ النِّسَاء إِلاَّ مَا قَدْ سَلَفَ إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَمَقْتًا وَسَاء سَبِيْلاً حُرِّمَتْ عَلَيْكُمْ أُمَّهَاتُكُمْ وَبَنَاتُكُمْ وَأَخَوَاتُكُمْ وَعَمَّاتُكُمْ وَخَالاَتُكُمْ وَبَنَاتُ الأَخِ وَبَنَاتُ الأُخْتِ وَأُمَّهَاتُكُمُاللاَّتِيْ أَرْضَعْنَكُمْ وَأَخَوَاتُكُم مِّنَ الرَّضَاعَةِ وَأُمَّهَاتُ نِسَآئِكُمْ وَرَبَائِبُكُمُ اللاَّتِيْ فِيْ حُجُوْرِكُم مِّن نِّسَآئِكُمُ اللاَّتِيْ دَخَلْتُم بِهِنَّ فَإِن لَّمْ تَكُوْنُوْا دَخَلْتُم بِهِنَّ فَلاَ جُنَاحَ عَلَيْكُمْ وَحَلاَئِلُ أَبْنَائِكُمُ الَّذِيْنَ مِنْأَصْلاَبِكُمْ وَأَن تَجْمَعُوْا بَيْنَ الأُخْتَيْنِ إَلاَّ مَا قَدْ سَلَفَ إِنَّ اللهَ كَانَ غَفُوْرًا رَّحِيْمًا} [سورة النساء: 22، 233]
‘যাদেরকে তোমাদের পিতৃপুরুষ বিয়ে করেছে, সেসব নারীকে বিয়ে করো না, পূর্বে যা হয়ে গেছে হয়ে গেছে, নিশ্চয়ই তা অশ্লীল, অতি ঘৃণ্য ও নিকৃষ্ট পন্থা। – তোমাদের প্রতি হারাম করা হয়েছে তোমাদের মা এবং মেয়ে, বোন, ফুফু, খালা, ভাইঝি, ভাগিনী, দুধ মা, দুধ বোন, শ্বাশুড়ী, তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যার সাথে সঙ্গত হয়েছ তার পূর্ব স্বামীর ঔরসজাত মেয়ে যারা তোমাদের তত্ত্বাবধানে আছে, কিন্তু যদি তাদের সাথে তোমরা সহবাস না করে থাক, তবে (তাদের বদলে তাদের মেয়েদেরকে বিয়ে করলে) তোমাদের প্রতি গুনাহ নেই এবং (তোমাদের প্রতি হারাম করা হয়েছে) তোমাদের ঔরসজাত পুত্রের স্ত্রী এবং এক সঙ্গে দু’ বোনকে (বিবাহ বন্ধনে) রাখা, পূর্বে যা হয়ে গেছে হয়ে গেছে, নিশ্চয়ই আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল, দয়ালু।’ (আন-নিসা ৪ : ২২-২৩)
স্ত্রীকে পুরুষদের তালাক প্রদানের অধিকার ছিল কিন্তু এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোন সময় সীমা ছিল না অতঃপর ইসলাম তা নির্দিষ্ট করে দেয়।[2]
সেই আমলে ব্যভিচারের মতো একটি অতি ঘৃণ্য ও জঘন্য পাপাচারে লিপ্ত হতে প্রায় সকল শ্রেণীর মানুষকেই দেখা যেত। কোন গোষ্ঠী কিংবা গোত্রের খুব নগণ্য সংখ্যক লোকই এ নারকীয় দুষ্কর্ম থেকে মুক্ত থাকত। অবশ্য এমন কিছু সংখ্যক নারী-পুরুষও চোখে পড়ত যাঁদের আভিজাত্যানুভূতি ও সম্ভ্রম বোধ পাপাচারের এ পঙ্কিলতা থেকে তাঁদেরকে বিরত রাখত। অত্যন্ত দুঃসহ অবস্থার মধ্য দিয়ে নারীদের জীবন যাপন করতে হতো। অবশ্য দাসীদের তুলনায় স্বাধীনাদের অবস্থা কিছুটা ভালো ছিল।
সমাজে দাসীগণকে অত্যন্ত দুঃসহ অবস্থার মধ্য দিয়ে কালাতিপাত করতে হতো। তৎকালীন সমাজে এমন মনিবের সংখ্যা খুব কমই ছিল যিনি দাসীদের নিয়ে নানা অনাচার, যথেচ্ছাচার ও পাপাচারে লিপ্ত না হতেন। এ সব অনাচার ও পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারে কোন লজ্জাবোধ কিংবা সংশয়ের সৃষ্টি হতো না। যেমন ‘সুনানে আবূ দাউদ’ গ্রন্থে বর্ণিত আছে এক দফা এক ব্যক্তি খাড়া হয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে লক্ষ্য করে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ), অমুক ব্যক্তি আমার পুত্র। অজ্ঞতার যুগে আমি তার মার সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়েছিলাম।
প্রত্যুত্তরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘ইসলামে এমন দাবীর কোন সুযোগ কিংবা মূল্য নেই। অন্ধকার যুগের যাবতীয় প্রথা পদদলিত ও বিলুপ্ত হয়েছে। এখন পুত্র তাঁরই গণ্য হবে যার স্ত্রী আছে অথবা দাসী আছে। আর ব্যভিচারীর জন্য রয়েছে পাথর।
সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) এবং আবদ ইবনে যাম’আহর মধ্যে যাম’আহর দাসী পুত্র আব্দুর রহমান বিন যাম’আহর ব্যাপারে যে বিবাদ সংঘটিত হয় তা হচ্ছে একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা এবং এ ব্যাপারটি অবশ্যই অনেকের জানা কথা।[3]
অন্ধকার যুগে পিতা পুত্রের সম্পর্কও বিভিন্ন প্রকারের ছিল। সে সম্পর্কে ইতোপূর্বে কিছু কিছু আলোচিত হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এমনটি হয়তো বা বলা সঙ্গত হবে না যে সন্তান বাৎসল্যের ব্যাপারে তাদের কিছুটা ঘাটতি ছিল। নীচের কবিতার চরণটি প্রণিধানযোগ্যঃ
إنمـــا أولادنـــا بيننــا ** أكبادنا تمشـى على الأرض
‘‘আমাদের সন্তান আমাদের কলিজার টুকরো, যারা জমিনের উপর চলাফেরা করছে।’
পক্ষান্তরে, কন্যা সন্তানদের ব্যাপারে নারকীয় দুষ্কর্ম করতে তাঁরা একটুও দ্বিধাবোধ করতেন না। সমাজের লোক লজ্জা ও নিন্দা এবং তাঁদের জন্য ব্যয় নির্বাহের ভয়ে অনটন ও অনাহার এবং দুর্ভিক্ষের কারণে পুত্র সন্তানদেরও হত্যা করতেও তাঁরা কুণ্ঠা বোধ করতেন না।
আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে :
{قُلْ تَعَالَوْاْ أَتْلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمْ عَلَيْكُمْ أَلاَّ تُشْرِكُوْا بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَلاَ تَقْتُلُوْا أَوْلاَدَكُم مِّنْ إمْلاَقٍ نَّحْنُ نَرْزُقُكُمْ وَإِيَّاهُمْ وَلاَ تَقْرَبُوْا الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَلاَ تَقْتُلُوْا النَّفْسَ الَّتِيْحَرَّمَ اللهُ إِلاَّ بِالْحَقِّ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُوْنَ} [الأنعام: 151]
‘‘বল, ‘এসো, তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্য যা নিষিদ্ধ করেছেন তা পড়ে শোনাই, তা হচ্ছে, তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করো না, পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার কর, দরিদ্রতার ভয়ে তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না, আমিই তোমাদেরকে আর তাদেরকে জীবিকা দিয়ে থাকি, প্রকাশ্য বা গোপন কোন অশ্লীলতার কাছেও যেয়ো না, ন্যায়সঙ্গত কারণ ছাড়া কাউকে হত্যা করো না। এ সম্পর্কে তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যাতে তোমরা চিন্তা-ভাবনা করে কাজ কর।’ (আল-আন‘আম ৬ : ১৫১)[4]
কিন্তু পুত্র সন্তান হত্যার ব্যাপারে যে জনশ্রুতি রয়েছে তার যথার্থতা নির্ণয় করা বা প্রত্যয়ণ করা একটি অত্যন্ত মুস্কিল ব্যাপার। কারণ, গোত্রীয় বিরোধ এবং যুদ্ধবিগ্রহের সময় স্বপক্ষকে শক্তিশালী করা এবং যুদ্ধে জয়লাভ করার ব্যাপারে অন্যদের তুলনায় আপন আপন সন্তানেরাই অধিকতর নির্ভরযোগ্য বলে প্রামাণিত হতো। এ প্রেক্ষিতে পুত্র সন্তানগণের সংখ্যাধিক্যই আরববাসীগণের কাম্য হওয়া স্বাভাবিক।
অবশ্য এ জনশ্রুতিটি যে কোন ঐতিহাসিক সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত নয় এমনটি বলাও বোধ হয় সমীচীন হবে না। কারণ, ক্ষমতালিপ্সা, গোত্রপতিগণের জন্য পুত্র সন্তানগণের সংখ্যাধিক্য কাম্য হতে পারে। কিন্তু অনাহারী, অর্ধাহারী, নিরীহ গোবেচারা গরীব দুঃখীদের জন্য পুত্র সন্তানের আধিক্য কোন ক্রমেই কাম্য হতে পারে না। এরূপ ক্ষেত্রে দুর্ভিক্ষ কিংবা দুঃসময়ে পুত্র সন্তান হত্যার ব্যাপারটিকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না।
যতদূর জানা যায় তৎকালীন আরব সমাজে সহোদর ভাই, চাচাতো ভাই এবং গোষ্ঠী ও গোত্রের লোকজনদের পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপারটি ছিল অত্যন্ত শক্ত ও মজবুত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। এর কারণ হচ্ছে, বহু গোত্রে বিভক্ত এবং গোত্রে গোত্রে রেষারেষিক্লীষ্ট আরব সমাজে গোত্রীয় ঐক্যের সুদৃঢ় বন্ধনের উপর নির্ভর করেই টিকে থাকতে হতো আরববাসীগণকে। গোত্রের মান-মর্যাদা ও নিরাপত্তা রক্ষার ব্যাপারে জীবন উৎসর্গ করতেও তাঁরা কুণ্ঠিত হতেন না। গোত্র সমূহের অভ্যন্তরে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সামাজিকতার মূলতত্ত্ব গোত্রীয় চেতনা এবং আবেগ ও অনুভূতিকে সজীব ও সক্রিয় রাখার ব্যাপারে সহায়ক হতো। সাম্প্রদায়িকতা এবং আত্মীয়তাই ছিল গোত্রীয় নিয়ম-শৃঙ্খলার উৎস। তাঁরা সেই উদাহরণকে শাব্দিক অর্থে বাস্তবে রূপদান করতেন, যেমনঃ
(اُنْصُرْ أَخَاكَ ظَالِمًا أَوْ مَظْلُوْمًا)
(নিজ ভাইকে সাহায্য কর সে অত্যাচারী হোক কিংবা অত্যাচারিত হোক)।
ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বিভিন্ন গোত্রের লোকজনের মধ্যে উৎকট এ গোত্রীয় চিন্তাধারা প্রচলিত ছিল। ইসলাম সেই সকল ধারণার মূলোৎপাটন করেছে। অত্যাচারী এবং অত্যাচারিত উভয়কেই সাহায্য করার বিধান ইসলামে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে অত্যাচারীকে সাহায্য করার অর্থ হল তাঁকে অন্যায় ও অনাচার থেকে বিরত রাখা। অবশ্য, মর্যাদা এবং নেতৃত্ব কর্তৃত্বের ব্যাপারে একে অন্যের আগে অগ্রসর হওয়ার যে আকুতি ও আকঙ্খা একই ব্যক্তি কর্তৃক বহুবার তা বাস্তবে পরিণত করতে চাওয়ার কারণেই গোত্র সমূহের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহের দামামা বেজে উঠত। আওস ও খাযরাজ, আবস ও যুবইয়ান, বাকর ও তগলিব এবং অন্যান্য গোত্রের সংঘটিত ঘটনাবলীর ক্ষেত্রে যেমনটি লক্ষ্য করা যায়।
পক্ষান্তরে যতদূর জানা যায়, বিভিন্ন গোত্র বা গোষ্ঠির পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপারটি ছিল অপেক্ষাকৃত শিথিল বন্ধনের উপর প্রতিষ্ঠিত। প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন গোত্রের সকল ক্ষমতাই ব্যয়িত হতো পরস্পর পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহে। তবে দ্বীনী ব্যবস্থা এবং অশ্লীল কথনের সংমিশ্রণে গঠিত কতিপয় রীতিনীতি ও অভ্যাসের মাধ্যমে কোন কোন ক্ষেত্রে পারস্পরিক লেনদেন, সহযোগিতামূলক কাজকর্ম সংক্রান্ত চুক্তি, প্রতিজ্ঞাপত্র এবং আনুগত্যের বিধি বিধান সমন্বিত ব্যবস্থাধীনে গোত্রগুলো পরস্পর একত্রিত হতেন। সর্বোপরি, হারাম মাসগুলো তাঁদের জীবিকার্জন ও জীবন নির্বাহের ব্যাপারে বিশেষভাবে সহায়ক ছিল। এ মাসগুলোতে তারা পরিপূর্ণ নিরাপত্তা দিত কেননা এ মাসগুলোকে তারা অত্যন্ত মর্যাদা প্রদান করতো। যেমন আবূ রযা ‘উতারিদী বলেন, যখন রজব মাস সমাগত হতো তখন আমরা বলতাম, منصل الأسنة তখন এমন কোন তীর বা বর্শা থাকতো না যা অকার্যকর করার জন্য তা থেকে আমরা লোহার ফলক খুলে ফেলতাম না এবং রজব মাসে আমরা এগুলো দূরে নিক্ষেপ করতাম। অন্যান্য হারাম মাসগুলোতেও একই অবস্থা বিরাজ করতো।
জাহেলিয়াত যুগের আরব সমাজের সামাজিক অবস্থার সারকথা বলতে গেলে শুধু এটুকুই বলতে হয় যে স্থিরতা এবং কুপমন্ডুকতাই সমাজ জীবনের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। অজ্ঞতা, অশ্লীলতা, স্বেচ্ছাচারিতা ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ছিল সমগ্র সমাজ। অসত্য ও অন্যায়ের নিকট সত্য ও ন্যায় হয়ে পড়েছিল সম্পূর্ণরূপে পর্যুদস্ত। সাধারণ মানুষকে জীবন যাপন করতে হতো পশুর মত। বাজারের পণ্যের মতো ক্রয়-বিক্রয় করা হতো মহিলাদের এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তাঁদের সঙ্গে ব্যবহার করা হতো মাটি ও পাথরের মতো। গোত্র কিংবা রাষ্ট্র যাই বলা হোক না কেন, প্রশাসনের মূল ভিত্তি ছিল শক্তিমত্ততা। প্রশাসন পরিচালিত হতো শক্তিধরগণের স্বার্থে। দুর্বলতর শ্রেণীর সাধারণ লোকজনের কল্যাণের কথা কস্মিনকালেও চিন্তা করা হতো না। প্রজাদের নিকট থেকে গৃহীত অর্থসম্পদে কোষাগার ভরে তোলা হতো এবং প্রতিদ্বন্দ্বীগণের বিরুদ্ধে সৈন্যদলের মহড়া এবং যুদ্ধবিগ্রহের উদ্দেশ্যেই তা সংরক্ষিত হতো।
ফুটনোটঃ[1] সহীহুল বুখারী, ‘অভিভাবক ছাড়া বিবাহ হবে না’’ অধ্যায় ২য় খন্ড ৭৬৯ পৃঃ এবং আবূ দাউদ, নেকাহর পদ্ধতিসমূহ অধ্যায়।
[2] আবূ দাউদ মুরাযায়াত বাদা ত্বাতালিকাতিস সালাম ৬৫ পৃঃ ‘আত্তালাকু মার্রতানে’’ সংশিষ্ট তাফসীর গ্রন্থ দ্রষ্টব্য।
[3] সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৯৯৯, ১০৬৫ পৃঃ, আবূ দাউদ ‘আল আওলাদুলিল ফিরাশ’’ অধ্যায় দ্রষ্টব্য।
[4] কুরআন মাজীদ : ১৬/৫৮, ৫৯, ১৭/৩১, ৮১।
অর্থনৈতিক অবস্থাঃ
জাহেলিয়াত যুগের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো এবং অর্থনৈতিক অবস্থা ও ব্যবস্থাকে কোনক্রমেই সামাজিক অবস্থার চাইতে উন্নত বলা যেতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে তেজারত ব্যবসা-বাণিজ্যই ছিল আরব অধিবাসীগণের জীবন ও জীবিকার প্রধান অবলম্বন। কিন্তু দেশ থেকে দেশান্তরে গমনাগমন, মালপত্র পরিবহন, বাণিজ্যে উদ্দেশে ভ্রমণ পর্যটনের জন্য নিরাপত্তা ও শান্তি-শৃঙ্খলা ইত্যাদি ব্যাপারগুলো এতই সমস্যা সংকুল ছিল যে, নির্বিঘ্নে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করা ছিল এক দুষ্কর ব্যাপার। তৎকালে মরুপথে গমনাগমন এবং মালপত্র পরিবহনের একমাত্র মাধ্যম ছিল উট। উটের পিঠে চড়ে যাতায়াত এবং মালপত্র পরিবহনের ব্যবস্থাটি ছিল অত্যান্ত সময়-সাপেক্ষ ব্যাপার। তাছাড়া, পথও ছিল অত্যন্ত বিপদসংকুল। সব দিক দিয়ে সুসজ্জিত বড় বড় কাফেলা ছাড়া পথ চলার কথা চিন্তাই করা যেত না। কিন্তু তা সত্ত্বেও যে কোন সময় দস্যুদল কর্তৃক আক্রান্ত এবং যথা-সর্বস্ব লুণ্ঠিত হওয়ার ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে থাকতে হতো কাফেলার সকলকে। অবশ্য, হারাম মাসগুলোতে তাঁরা কিছুটা নির্ভয়ে ও নির্বিঘ্নে ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজকর্ম চালিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু তা ছিল সময়ের একটি সীমিত পরিসরে সীমাবদ্ধ। কাজেই, বাণিজ্য-নির্ভর হলেও নানাবিধ কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য তাঁরা তেমন সুবিধা করতে পারতেন না। তবে হারাম মাসগুলোতে ‘উকায, যুল মাজায, মাজান্নাহ এবং আরও কিছু প্রসিদ্ধ মেলায় বেচা-কেনা করে তাঁরা কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারতেন।’
আরব ভূখন্ডে শিল্পের প্রচলন তেমন এতটা ছিল না। শিল্প কারখানার ব্যাপারে পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় আরব দেশ আজও পিছনে পড়ে রয়েছে তুলনামূলকভাবে, সেকালে আরও অনেক বেশী পিছনে পড়ে ছিল। শিল্পের মধ্যে বস্ত্র, চর্ম শিল্প, ধাতব শিল্প, ইত্যাদি শিল্পের প্রচলন চোখে পড়ত। অবশ্য, এ শিল্পগুলো ইয়ামান, হীরা এবং শামরাজ্যের সন্নিকটস্থ অঞ্চলগুলোতেই প্রসার লাভ করেছিল অপেক্ষাকৃত বেশী। কিন্তু সুতোকাটার কাজে সকল অঞ্চলের মহিলাদেরই ব্যাপৃত থাকতে দেখা যেত। আরব ভূখন্ডে অভ্যন্তর ভাগের লোকেরা প্রায় সকলেই পশু পালন কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করত। মরু প্রান্তরের আনাচে-কানাচে যে সকল স্থানে কৃষির উপযোগী ভূমি পাওয়া যেত সে সকল স্থানে কৃষির ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে সমস্যাটি সব চাইতে জটিল ছিল তা হচ্ছে, মানুষের দারিদ্র দূরীকরণ এর মাধ্যম জীবনমান উন্নয়ন, মহামারী ও বোগব্যাধি দূরীকরণ কিংবা অন্য কোন কল্যাণমূলক কাজে অর্থ-সম্পদের খুব সামান্য অংশই ব্যয়িত হতো। সম্পদের সিংহ ভাগই ব্যয়িত হতো যুদ্ধবিগ্রহের কাজে। কাজেই, জনজীবনে সুখ, শান্তি বা স্বাচ্ছন্দ্য বলতে তেমন কিছুই ছিল না। সমাজে এমন এক শ্রেণীর লোক ছিল যাদের দুবেলা দু মুঠো অন্ন এবং দেহাবরণের জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় বস্ত্রখন্ডের সংস্থানও সম্ভব হতো না।
নীতি-নৈতিকতা :
মরুচারী আরববাসীগণের নীতি-নৈতিকতা ও চরিত্রের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী দুইটি ধারার বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। এক দিকে লক্ষ্য করা যায় জুয়া, মদ্যপান, ব্যভিচার, হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি, হত্যা, প্রতিহিংসা পরায়ণতা ইত্যাদি জঘন্য মানবেতর ক্রিয়াকলাপ, অন্যদিকে লক্ষ্য করা যায় দয়া-দাক্ষিণ্য, উদারতা, অতিথিপরায়ণতা প্রতিজ্ঞাপরায়ণতা এবং আরও অনেক উন্নত মানসিক গুণাবলীর সমাবেশ। তাঁদের মানবেতর ক্রিয়াকলাপ এবং আচরণ সম্পর্কে ইতোপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। এ পর্যায়ে তাঁদের চরিত্রের বিভিন্ন মানবিক দিক এবং সমস্ত গুণাবলী সম্পর্কে আলোচনা করা হলঃ
১. দয়া-দাক্ষিণ্য ও উদারতাঃ অন্ধকার যুগের আরববাসীগণের দয়া-দাক্ষিণ্য সম্পর্কিত জনশ্রুতি ছিল সর্ব যুগের মানুষের গর্ব করার মতো একটি বিষয়। নীতি- নৈতিকতার ক্ষেত্রে ভ্রষ্টতার নিম্নতম পর্যায়ে পৌঁছলেও দয়া-দাক্ষিণ্য কিংবা বদান্যতার ব্যাপারে বিশ্ব মানব গোষ্ঠীর মধ্যে তাঁরা ছিলেন সকলের শীর্ষস্থানে। শুধু তাই নয় এ নিয়ে তাঁদের রীতিমত প্রতিযোগিতা চলতো এবং এ ব্যাপারে তাঁরা এ বলে গর্ব করতেন যে, ‘আরবের অর্ধভাগ তার জন্য উপহার হয়ে গিয়েছে।’ এ গুণকে কেন্দ্র করে কেউ কেউ নিজের প্রশংসা নিজেই করেছে আবার কেউ করেছে অন্যের প্রশংসা।
তাঁদের বদান্যতা বাস্তবিক পক্ষে এতই উঁচু মানের ছিল যে তা মানুষকে বিস্ময়ে অভিভূত করে ফেলে। কোন কোন ক্ষেত্রে এমনটিও দেখা গিয়েছে যে, কঠিন শীত কিংবা ক্ষুধার সময়ও কারো বাড়িতে যদি মেহমান আসতেন এবং তাঁর জীবন ও জীবিকার জন্য অপরিহার্যরূপে প্রয়োজনীয় একটি উট ছাড়া আর কোন সম্বলই নেই, তবুও এমন এক সংকটময় মুহূর্তেও তাঁর উদারতা এবং অতিথিপরায়ণতা তাঁকে এতটা প্রভাবিত করে ফেলত যে, অগ্র-পশ্চাৎ চিন্তা না করে তৎক্ষনাৎ সেই উটটি জবেহ করে মেহমানের মেহামান দারিত্বে তিনি লিপ্ত হয়ে পড়তেন। অধিকন্তু, তাঁদের দয়া-দাক্ষিণ্য এবং উদারতার অন্যন্য চেতনায় তারা বড় বড় শোনিত পাতের মূলসূত্র কিংবা তদ্সংক্রান্ত আর্থিক দায়-দায়িত্ব অবলীলাক্রমে আপন স্কন্ধে তুলে নিয়ে এমনভাবে মানুষকে ধ্বংস ও রক্তপাতের বিভীষিকা থেকে রক্ষা করত যে অন্যান্য নেতা কিংবা দলপতিগণের তুলনায় তা অনেক বেশী গর্বের ব্যাপারে হয়ে দাঁড়াত।
এ প্রসঙ্গে একটি মজার ব্যাপার ছিল, দয়া-দাক্ষিণ্যের অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করে তাঁরা যেমন গর্ববোধ করতেন তেমনি মদ্যপান করেও গর্ববোধ করতেন। মদ্যপান একটি গর্বের বিষয় সেই অর্থে মদ্যপান করে তাঁরা গর্ববোধ করতেন না, বরং এ জন্য গর্ববোধ করতেন যে, উদারতার উদবোধক হিসেবে তাদের উপর বিশেষভাবে প্রাধান্য বিস্তার করত যার ফলশ্রুতিতে কোন ত্যাগ স্বীকারকেই তাঁরা বড় মনে করতেন না। এর প্রকৃত কারণ হচ্ছে, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় মানুষ অসাধ্য সাধন করতে পিছপা হয় না। এজন্য এরা আঙ্গুর ফলের বৃক্ষকে ‘কারম’ এবং আঙ্গুর রসে তৈরি মদ্যকে ‘বিনতুল কারম’ (কারমের কন্যা) বলতেন। জাহেলিয়াত যুগের কবিগণের কাব্যে এ জাতীয় প্রশংসা এবং গৌরবসূচক রচনা একটি উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে রয়েছে। আনতার বিন সাদ্দাদ আবসী তাঁর নিজ মুয়াল্লাকায় বলেছেনঃ
অর্থঃ ‘নিদাঘের উত্তাপ স্তিমিত হওয়ার পর বাম দিকে রক্ষিত হলুদ বর্ণের এক নকশাদার কাঁচ পাত্র হতে যা ফুটন্ত এবং মোহরকৃত মদপূর্ণ ছিল, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন মদ্য আমি পান করলাম এবং যখন আমি তা পান করি তখন নিজের মাল লুটিয়ে দিই, কিন্তু আমার মান-ইজ্জতপূর্ণ মাত্রায় থাকে। এর উপর কোন চোট কিংবা আঘাত আসে না। তারপর যখন আমি সজ্ঞানে থাকি, কিংবা যখন আমার জ্ঞান ফিরে আসে তখনো আমি দান করতে কুণ্ঠিত হই না, এবং আমার দয়া-দাক্ষিণ্য যা কিছু সে সব সম্পর্কে তোমরা অবহিত রয়েছ।’’
তাঁরা জুয়া খেলতেন এবং মনে করতেন যে, ‘এটাও হচ্ছে তাঁদের দয়া-দাক্ষিণ্যের একটি পথ। কারণ, এর মাধ্যমে তাঁরা যে পরিমাণ উপকৃত হতেন তার অংশ বিশেষ, কিংবা উপকৃত ব্যক্তিদের অংশ থেকে যা অবশিষ্ট থেকে যেত তা অসহায় এবং মিসকীনদের মধ্যে পান করে দিতেন। এ জন্যই কুরআন কারীমে মদ এবং জুয়ার উপকারকে অস্বীকার করা হয়নি। বরং এ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে,
{وَإِثْمُهُمَآ أَكْبَرُ مِن نَّفْعِهِمَا} [البقرة:219]
‘‘কিন্তু এ দু’টোর পাপ এ দু’টোর উপকার অপেক্ষা অধিক’।’ (আল-বাক্বারাহ ২ : ২১৯)
২. প্রতিজ্ঞাপরায়ণতাঃ অন্ধকার যুগের আরববাসীগণের অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল প্রতিজ্ঞা পরায়ণতা। ওয়াদা পালন বা অঙ্গীকার রক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, কিংবা অন্য কোনভাবে তাঁরা যাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত থাকতেন তাঁদের জন্য সন্তানগণের রক্ত প্রবাহিত করা, কিংবা নিজ বাস্তভিটা বিলুপ্ত করার মতো অতীব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারকেও তাঁরা সামান্য কিছু মনে করতেন। এর যথার্থতা উপলব্ধির জন্য হানি বিন মাস’উদ শাইবানী, সামাওয়াল বিন আদিয়া এবং হাজেব বিন যুরারাহ তামীমী এর ঘটনাবলীই যথেষ্ট।
৩. ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদাবোধঃ জাহেলিয়াত যুগের আরববাসীগণের অন্যতম ব্যক্তি বৈশিষ্ট্য ছিল পার্থিব সব কিছুর উপর নিজের মান ইজ্জতকে প্রাধান্য দেয়া এবং কোন প্রকার অন্যায় অত্যাচার সহ্য না করা। এর ফলে এরূপ দাঁড়িয়েছিল যে, তাঁদের উৎকট অহংবোধ এবং মর্যাদাবোধ সীমা অতিক্রম করে গিয়েছিল। বিশেষ কোন কারণে তাঁদের এ অহং ও মর্যাদাবোধ এর উপর সামান্যতম আঘাত কিংবা অপমান এলেও তাঁরা উত্তেজিত হয়ে পড়তেন এবং তরাবারি, বর্শা, ফলা ইত্যাদি নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পড়তেন। এ সংঘর্ষে লিপ্ত হতে গিয়ে তাঁদের প্রাণহানির ব্যাপারে কোনই উৎকণ্ঠা থাকত না। প্রাণের তুলনায় মান-মর্যাদাকেই তাঁরা অধিকতর মূল্যবান মনে করতেন।
৪. সংকল্প বাস্তবায়নঃ প্রাক ইসলামি আরববাসীগণের আরও একটি বৈশিষ্ট্য ছিল এ রকম যে, কোন কাজ-কর্মকে মান-সম্মান ও পুরুষের প্রতীক মনে করে যখন তাঁরা সেই কর্ম সম্পাদনের লক্ষ্যে সংকল্পবদ্ধ হতেন তখন তাঁরা প্রাণ বাজী রেখে সেই কর্ম সম্পাদনের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তেন। পার্থিব কোন শক্তিই তাঁদেরকে এ সংকল্প থেকে বিরত রাখতে পারত না।
৫. ভদ্রতা, ধৈর্য্য ও গাম্ভীর্যঃ ভদ্রতা-শিষ্টতা ও ধৈর্য্য-গাম্ভীর্য আরববাসীগণের নিকট খুবই প্রিয় ও প্রশংসনীয় ছিল। এ সকল মানসিক গুণাবলীকে কোন সময়েই তাঁরা খাটো করে দেখতেন না, কিন্তু তাঁদের উগ্র স্বভাব, উৎকট অহংবোধ ও প্রতিহিংসা পরায়ণতার কারণে খুব কম ক্ষেত্রেই এর যথার্থতা রক্ষা করতে তাঁরা সক্ষম হতেন।
৬. সরলতা ও অনাড়ম্বরতাঃ ইসলাম পূর্ব আরববাসীগণের সংস্কৃতি ধারা থেকে অবগত হওয়া যায় যে, তাঁদের জীবন যাত্রা ছিল অত্যন্ত সহজ সরল এবং অনাড়ম্বর। তাঁদের চিন্তা ও চেতনার মধ্যে ঘোর-প্যাঁচ কিংবা জটিলতার লেশমাত্র থাকত না। উদার, উন্মুক্ত অগ্নিখরা মরু প্রকৃতির মতই তাঁদের মন ছিল উন্মুক্ত, কিন্তু মেজাজ ছিল তীক্ষ্ণ। এ কারণে প্রকৃতিগতভাবেই তাঁরা ছিলেন সৎ এবং সততা প্রিয়। ধোঁকাবাজী এবং বিশ্বাস ভঙ্গের মতো কোন ব্যাপার ছিল তাঁদের সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। গচ্ছিত ধন বা আমানত রক্ষার ব্যাপারটিকে তাঁদের পবিত্রতম দায়িত্ব হিসেবেই তাঁরা গণ্য করতেন।
আমরা সর্বান্তঃকরণে বিশ্বাস করি যে, এ পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলে আরব ভূমির অবস্থান, আরব ভূমির ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগত বিশেষ বিশেষ সুযোগ-সুবিধা, আরববাসীগণের উদার-উন্মুক্ত মানবিক চেতনা, অতিথি পরায়ণতা, সহজ, সরল ও অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা এবং আমানত গচ্ছিত রাখার অনপনেয় উপযুক্ততার প্রেক্ষাপটে আরব ভূমিকে ইসলাম প্রচারের কেন্দ্রবিন্দু, আরব জাতিকে আল্লাহর পবিত্রতম আমানত ইসলামকে হেফাজত করার উপযুক্ত মানবগোষ্ঠি, আরবী ভাষাকে আল্লাহর বাণী ধারণ ও বহনের উপযুক্ত ভাষা এবং আরব সম্প্রদায়ের মধ্যে সকল দৃষ্টিকোণ থেকে সর্বোত্তম ব্যক্তিটিকে নবুওয়াত ও রিসালাতের উপযুক্ত বিবেচনা সাপেক্ষে ইসলামের আয়োজন ও বাস্তবায়ন ধারা সূচিত হয়েছিল।
আর সম্ভবত আরবদের এসব চারিত্রিক বৈশিষ্টে বিশেষ করে প্রতিশ্রুত পূর্ণ করা ছাড়াও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও উপকারী বৈশিষ্ট্য তা হলো আত্মমর্যাদাবোধ ও সংকল্পে অটল থাকা। আর এ সব মহৎ গুণাবলী ও স্বচ্ছ পরিষ্কার দৃঢ় সংকল্প ব্যতীত অন্যায় অত্যাচার, ফিতনা ফাসাদ দূরীভূত করা এবং একটি ইনসাফপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। উল্লেখিত এসব চারিত্রিক গুণ ছাড়াও তাদের অনেক উত্তম রয়েছে গুণ যারা অনুসন্ধান করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়।
রাসুল (স) এর বংশ পরম্পরা
পয়গম্বরী বংশাবলী (نَسَبُ النَّبِيِّ ﷺ ):
পরম্পরাগত সূত্রে নাবী কারীম (সাঃ)-এর বংশাবলীকে তিন পর্যায়ে ভাগ করে নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। এর প্রথম পর্যায় হচ্ছে আদনান পর্যন্ত যার বিশুদ্ধতা সম্পর্কে চরিতবেত্তা এবং বংশাবলী বিশেষজ্ঞা বিভিন্ন মত পোষণ করে থাকেন। এর দ্বিতীয় পর্যায় হচ্ছে আদনান হতে উপরে ইবরাহীম (আঃ) পর্যন্ত। দ্বিতীয় পর্যায়ের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে চরিতবেত্তা এবং বংশাবলী বিশেষজ্ঞগণের মধ্যে দ্বিমত বা মতান্তর রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারটিকে কেউ কেউ মুলতুবী রেখেছেন, কেউ কেউ বা আবার কথাবার্তাও বলেছেন। তৃতীয় পর্যায়ের সময়কাল হচ্ছে ইবরাহীম (আঃ) থেকে আদম (আঃ) পর্যন্ত। বিশেষজ্ঞগণের অভিমত হচ্ছে, তৃতীয় পর্যায়ের আলোচনা এবং সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে কিছুটা ভুলভ্রান্তি রয়েছে। উপরে উল্লেখিত পর্যায় তিনটি সম্পর্কে কিছুটা বিস্তৃত আকারে নিম্নে আলোচনা করা হল।
প্রথম পর্যায়ঃ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল মুত্তালিব (শায়বাহ) বিন হাশিম (‘আমর) বিন আবদে মানাফ (মুগীরাহ) বিন কুসাই (যায়দ) বিন কিলাব বিন মুররাহ বিন কা‘ব লুওয়াই বিন গালিব বিন ফিহর (তাঁর উপাধি ছিল কুরাইশ এবং এ সূত্রেই কুরাইশ বংশের উদ্ভব) বিন মালিক বিন নাযর (ক্বায়স) বিন কিনানাহ বিন খুযায়মাহ বিন মুদরিকাহ (আমির) বিন ইলিয়াস বিন মুযার বিন নিযার বিন মা’আদ্দ বিন আদনান।[1]
দ্বিতীয় পর্যায়ঃ আদনান থেকে উপরের দিক অর্থাৎ আদনান বিন উদাদ বিন হামায়সা’ বিন সালামান বিন ‘আওস বিন বুয বিন ক্বামওয়াল বিন উবাই বিন ‘আউওয়াম বিন নাশিদ বিন হিযা বিন বালদাস বিন ইয়াদলাফ বিন ত্বাবিখ বিন যাহিম বিন নাহিশ বিন মাখী বিন ‘আইয বিন আ’বক্বার বিন উবাইদ বিন আদ-দু’আ বিন হামদান বিন সুনবর বিন ইয়াসরিবী বিন ইয়াহযুন বিন ইয়ালহান বিন আর’আওয়া বিন ‘আইয বিন দীশান বিন ‘আইসার বিন আফনাদ বিন আইহাম বিন মুক্বসির বিন নাহিস বিন যারিহ বিন সুমাই বিন মুযী বিন ‘আওযাহ বিন ‘ইরাম বিন ক্বাইদার বিন ইসামাঈল বিন ইবরাহীম (আঃ)।[2]
তৃতীয় পর্যায়ঃ ইবরাহীম (আঃ) হতে উপরে ইবরাহীম বিন তারিহ (আযর) নাহুর বিন সারু’ অথবা সারুগ বিন রাউ’ বিন ফালাখ বিন ‘আবির বিন শালাখ বিন আরফাখশাদ বিন শাম বিন নূহ (আঃ) বিন লামিক বিন মাতাওশালখ বিন আখনুন (কথিত আছে এ নাম ছিল ইদরিস (আঃ)-এর নাম) বিন ইয়াদ বিন মাহলায়ীল বিন ক্বায়নান বিন আনূশ বিন শীস বিন আদম (আঃ)।[3]
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১ ও ২ তালকীহ ফুহুমি আহলিল আসার ৫ ও ৬ পৃষ্ঠা, রাহমাতুল্লিল আলামীন ২য় খন্ড ১১-১৪ ও ৫২ পৃষ্ঠা।
[2] খুব সূক্ষ্ণ অনুসন্ধানের পর আল্লামা মানসুরপুরী বংশাবলীর অংশ কালবী এবং ইবনে সা’দের বর্ণনা দ্বারা একত্রিত করেছেন, দ্রষ্টব্য রহমাতুল্লিল আলামীন ২য় খন্ড ১৪-১৭ পৃঃ। এ অংশের ঐতিহাসিক সূত্রে মত বিরোধ।
[3] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ২-৪ পৃঃ তালকীহুল ফহুম ৬ পৃঃ খোলাসাতুস সিয়র ৬ পৃঃ রহমাতুল্লিল আলামীন ২য় খন্ড ১৮ পৃঃ কোন কোন না নিয়ে ঐ সুত্রগুলোতে মতভেদ আছে এবং কোন কোন সূত্রে কোন কোন নাম ছুটে গেছে।
নাবী পরিবার পরম্পরা (الأُسْرَةُ النَّبَوِيَّةُ):
নাবী কারীম (সাঃ)-এর পরিবার উপরের দিকে তাঁর প্রপিতামহ হাশিম বিন আবদে মানাফ থেকে পারিবারিক পরিচয় প্রদানের মূলসূত্র ধরার কারণে তা হাশেমী পরিবার নামে প্রসিদ্ধ ছিল। নাবী কারীম (সাঃ) সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভের জন্য তাঁর পিতামহ, প্রপিতামহ, অর্থাৎ পূর্বতন কয়েক প্রজন্মের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণের জীবনী সম্পর্কে আলোচনার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। এ প্রেক্ষিতেই পরবর্তী আলোচনাঃ
হাশেমঃ আমরা ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি যে, যখন বনু আবদে মানাফ এবং বনু আবদুদ্দারের মধ্যে হারামের সঙ্গে সংশিষ্ট পদ সমূহ বন্টনের ব্যাপারে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল তখন আবদে মানাফের সন্তানদের মধ্যে হাশিমকেই ‘সিক্বায়াহ’ এবং রিফাদাহ অর্থাৎ হজ্জযাত্রীগণকে পানি পান করানো এবং তাঁদের মেহমানদারী করার মর্যাদা প্রদান করা হয়। হাশিম ছিলেন অত্যন্ত সম্মানিত ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিত্ব। তিনিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি ‘শোরবা’ বা ঝোলের সঙ্গে রুটি মিশ্রিত করে মক্কায় হজ্জযাত্রীগণকে খাওয়ানোর বন্দোবস্ত করেন। তাঁর আসল নাম ছিল ‘‘আমর’। কিন্তু শোরবা বা ঝোলের সঙ্গে রুটি ভেঙ্গে মিশ্রিত করার কারণে ‘হাশিম’ নামে তাকে ডাকা হতে থাকে। কারণ, হাশিম অর্থ হচ্ছে যিনি কোন কিছু ভেঙ্গে ফেলেন। আবার এ হাশিমই হচ্ছেন প্রথম ব্যক্তি যিনি কুরাইশদের জন্য গ্রীষ্ম ও শীত কালে ব্যবসা-সংক্রান্ত দুইটি ভ্রমণ-পর্যটনের গোড়াপত্তন করেন। তাঁর সম্পর্কে জনৈক কবি বলেছেনঃ
عمرو الذي هَشَمَ الثريدَ لقومه
**
قَومٍ بمكة مُسِْنتِين عِجَافِ
سُنَّتْ إليه الرحلتان كلاهما
**
سَفَرُ الشتاء ورحلة الأصياف
অর্থঃ ‘এ ‘আমরই এমন ব্যক্তিসত্তা যিনি দুর্ভিক্ষ পীড়িত দুর্বল স্বজাতির জন্য মক্কায় ‘শোরবা বা ঝোলের মধ্যে রুটির টুকরো ভিজিয়ে ভিজিয়ে খাইয়েছিলেন এবং শীত ও গ্রীষ্মের দিনে ভ্রমণের ব্যবস্থা করেছিলেন।’
তাঁর ব্যক্তি জীবন এবং পরবর্তী ইতিহাসের সঙ্গে সংশিষ্ট একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল এটা যে, ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে শাম রাজ্যে যাওয়ার পথে যখন তিনি মদীনায় পৌঁছলেন তখন সেখানে বনু নাজ্জার গোত্রের সালামাহ বিনতে ‘আমর নাম্নী এক মহিলাকে বিবাহ করেন এবং কিছুকাল সেখানে অবস্থান করেন। তারপর স্বীয় স্ত্রীকে গর্ভবতী অবস্থায় তাঁর পিত্রালয়ে রেখে দিয়ে তিনি শাম রাজ্যে চলে যান এবং সেখানে গিয়ে ফিলিস্ত্বীনের গায্যাহ শহরে পরলোক গমন করেন।
এদিকে সালামাহর গর্ভজাত সন্তান যথা সময়ে ভূমিষ্ট হন। বর্ষপঞ্জীর হিসেবে সে বছরটি ছিল ৪৯৭ খ্রীষ্টাব্দ। নবজাত শিশুর মাথার চুল ছিল সাদা তাই সালামাহ তাঁর নাম রাখেন শায়বাহ।[1] সালামাহ নিজ পিত্রালয়ে সযত্নে তাঁর লালন পালন করতে থাকেন। সেদিনের এ শিশুটিই ছিলেন পরবর্তী কালে আখেরী নাবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর পিতামহ এবং অভিভাবক আব্দুল মুত্তালিব। শিশু আব্দুল মুত্তালিব দিনে দিনে শশীকলার মত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে উঠলেও দীর্ঘদিন যাবৎ হাশিম পরিবারের কেউই তাঁর জন্মের কথা জানতে পারেন নি। হাশিম ছিলেন ৯ জন সন্তান-সন্ততির জনক। ৯ জনের মধ্যে ৪ জন ছেলে ও ৫ জন মেয়ে। তাঁদের নাম হচ্ছে যথাক্রমে আসাদ, আবূ সাইফী, নাযলাহ, আব্দুল মুত্তালিব এবং শিফা, খালিদাহ, যা’ঈফাহ, রুক্বাইয়া ও জান্নাহ।[2]
আব্দুল মুত্তালিবঃ পূর্বোক্ত আলোচনা থেকে আমরা বিলক্ষণ অবগত হয়েছি যে, ‘সিক্বায়াহ’ এবং ‘রিফাদাহ’ সম্পর্কিত পদের দায়িত্ব অর্পিত ছিল হাশিমের উপর। হাশিমের মৃত্যুর পর সেই দায়িত্ব অর্পিত হয় তাঁর ভাই মুত্তালিবের উপর। তিনিও দলের মধ্যে বিভিন্ন সদগুণাবলী এবং মান-মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। তাঁর কথা অমান্য করা কিংবা নড়চড় করার ক্ষমতা দলের অন্য কারো ছিল না। বদান্যতার জন্যও তিনি প্রসিদ্ধ ছিলেন। বদান্যতার কারণেই কুরাইশগণ তাঁর নাম রাখেন ‘ফাইয়ায’। যখন শায়বাহ অর্থাৎ আব্দুল মুত্তালিব দশ বছর বয়সে উপনীত হন তখন মুত্তালিব তাঁর সম্পর্কে অবগত হয়ে নিয়ে আসার জন্য ইয়াসরিব গমন করেন। সেখানে পৌঁছার পর যখন তিনি শায়বাহকে দেখতে পান তখন তাঁর চক্ষুদ্বয় থেকে অশ্রুধারা প্রবাহিত হতে থাকে। তারপর তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে উষ্ট্র পৃষ্ঠে আরোহণ করে নেন এবং মক্কা অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন।
কিন্তু শায়বাহ তাঁর মাতার অনুমতি ব্যতিরেকে মক্কা যেতে অস্বীকার করায় তাঁকে নিয়ে যাওয়ার জন্য মুত্তালিব তাঁর মাতার নিকট অনুমতি প্রার্থী হন। কিন্তু শায়বাহর মাতা তাঁকে অনুমতি দিতে অস্বীকার করলে মুত্তালিব তাঁকে এ কথা বুঝিয়ে বলেন যে, ‘এ ছেলে তাঁর পিতার রাজত্বে এবং আল্লাহর হারাম শরীফের দিকে যাচ্ছেন। নিশ্চিতরূপে এ হচ্ছে তাঁর চরম সৌভাগ্যের ব্যাপার।’’
এ কথা শ্রবণের পর শায়বাহকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁর আম্মা অনুমতি প্রদান করেন। অনুমতি লাভের পর মুত্তালিব তাঁকে তাঁর উটের পিঠে বসিয়ে মক্কা অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকেন। মক্কায় পৌঁছলে শায়বাহকে মুত্তালিবের পাশে দেখে মক্কাবাসীগণ বলেন যে, এ বালক হচ্ছে ‘আব্দুল মুত্তালিব’ অর্থাৎ মুত্তালিবের দাস। তদুত্তরে মুত্তালিব বলেন, ‘না না, এ হচ্ছে আমার ভ্রাতুষ্পুত্র, আমার ভাই হাশিমের ছেলে।’ এর পর থেকে মুত্তালিবের নিকট লালিত হতে থাকেন।
শায়বাহ যখন যৌবনে পদার্পণ করেন তখন কোন এক সময় রোমান সাম্রাজ্যের ইয়ামানে মুত্তালিব পরলোক গমন করেন। তাঁর মৃত্যুর পর আব্দুল মুত্তালিব পরিত্যক্ত পদ সমূহের অধিকার লাভ করেন। কালক্রমে আব্দুল মুত্তালিব নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে এমন মান-মর্যাদা লাভ করেন যে, তাঁর পিতা কিংবা পিতামহ কেউই এত মান-সম্মানের অধিকারী হতে সক্ষম হন নি। একজন গুণী ব্যক্তি হিসেবে কাওমের লোকেরা সকলেই তাঁকে একান্ত আন্তরিকতার সঙ্গে ভালবাসতেন এবং সমীহ করে চলতেন।[3]
মুত্তালিব যখন পরলোক গমন করেন তখন নাওফাল বল প্রয়োগ করে আব্দুল মুত্তালিব চত্ত্বর দখল করে নেন। আব্দুল মুত্তালিবের একার পক্ষে তাঁর চাচার সঙ্গে মুকাবিলা করা সম্ভব না হওয়ার কারণে কুরাইশ গোত্রের কোন কোন লোকের নিকট তিনি সাহায্য প্রার্থী হন। কিন্তু তাঁরা এ কথা বলে আপত্তি করেন যে, তাঁর এবং তাঁর চাচার বিরোধের ব্যাপারে কোন কিছু করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। নিরুপায় হয়ে আব্দুল মুত্তালিব বনু নাজ্জার গোত্রের তাঁর মামা গোষ্ঠির নিকট কিছু কবিতা লিখে পাঠান যার মধ্যে নিহিত ছিল সাহায্যের করুণ আবেদন। এ আহবানে সাড়া দিয়ে তাঁর মামা আবূ সা‘দ বিন আদী আশি জন অশ্বারোহী নিয়ে মক্কা অভিমুখে অগ্রসর হন এবং আবতাহ নামক স্থানে অবতরণ করেন। আব্দুল মুত্তালিব সেখানে গিয়ে তাঁর মামার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁকে গৃহে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানান। কিন্তু নাওফালের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া না হওয়া পর্যন্ত আবূ সা‘দ তাঁর গৃহে যেতে অস্বীকৃতি জানান। তারপর তিনি অগ্রসর হয়ে নাওফালের নানার নিকট গিয়ে দাঁড়ান।
নাওফাল তখন হাতীম নামক স্থানে কয়েকজন কুরাইশদের সাথে উপবিষ্ট ছিলেন। আবূ সা‘দ তলোয়ার কোষমুক্ত করে বললেন, ‘এ পবিত্র ঘরের প্রভুর শপথ, তোমরা যদি ভাগ্নেকে তাঁর অধিকার ফিরিয়ে না দাও তাহলে এ তলোয়ার তোমার বক্ষদেশ বিদীর্ণ করবে।’ কোন ইতস্তত না করে নাওফাল বললেন, ‘ঠিক আছে আমি তাঁর অধিকার ফেরত দিলাম।’ এ কথা শ্রবণের পর আবূ সা‘দ কুরাইশদের কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে এ ব্যাপারে সাক্ষী থাকা এবং প্রয়োজনবোধে সাক্ষ্য প্রদানের জন্য অনুরোধ জানান। তারপর তিনি আব্দুল মুত্তালিবের গৃহে গমন করেন এবং সেখানে তিন দিন অবস্থান ও উমরাহ পালনের পর মদীনা প্রতাবর্তন করেন।
এ ঘটনার পর নাওফাল বনু হাশিমের বিরুদ্ধে বনু আবদে শামস এর সাথে পরস্পর সাহায্য ও সহযোগিতামূলক এক চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এ দিকে বনু খুযা’আহ গোত্র যখন লক্ষ্য করলেন যে, বনু নাজ্জার গোত্র আব্দুল মুত্তালিবকে সাহায্য করেছে তখন তাঁরা বললেন যে, ‘আব্দুল মুত্তালিব যেমন তোমাদের সন্তান, তেমনি আমাদেরও সন্তান। অতএব, তাঁকে সাহায্য করা অধিকভাবে আমাদেরই কর্তব্য।’ কারণ আবদে মানাফের মায়ের সম্পর্ক ছিল খুযা’আহ গোত্রের সঙ্গে। এ প্রেক্ষিতে বনু খুযা’আহ গোত্র দারুণ নাদওয়ায় গিয়ে বনু আবদে শামস এবং বনু নাওফালের বিরুদ্ধে বনু হাশিমের সঙ্গে সাহায্য ও সহযোগিতার এক চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এ চুক্তিতে এমন সব অঙ্গীকার করা হয়েছিল যা পরবর্তী পর্যায়ের ইসলামী যুগে মক্কা বিজয়ের জন্য খুবই সহায়ক হয়েছিল। বিস্তারিত বিবরণ যথাস্থানে উল্লেখিত হবে।[4]
বায়তুল্লাহর সঙ্গে সংশিষ্ট হওয়ায় আব্দুল মুত্তালিবের সঙ্গে দুইটি বিশেষ ঘটনার সম্পর্ক রয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ‘যমযম’ কূপের খনন কাজ সম্পর্কিত ঘটনা এবং অন্যটি হচ্ছে ‘হস্তী বাহিনী’ সম্পর্কিত ঘটনা। ঘটনা দুটি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলঃ
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৩৭ পৃঃ রাহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ২৬ পৃঃ/ ২য় খন্ড ২৪ পৃঃ।
[2] রাহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ১০৭ পৃঃ।
[3] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৩৭-১৩৮ পৃঃ।
[4] শায়খুল ইসলাম মুহাম্মাদ আবুল ওয়াহহাব নাজদী (রহঃ) মুখাতাসার সীরাতে রাসূল ৪১-৪২ পৃঃ।
যমযম কূপ খননঃ
এ ঘটনার সার সংক্ষেপ হচ্ছে আব্দুল মুত্তালিব স্বপ্নযোগে অবগত হন যে, তাঁকে যমযম কূপ খননের নির্দেশ দেয়া হচ্ছে এবং স্বপ্নযোগে তার স্থানও নির্দিষ্ট করে দেয়া হচ্ছে। তারপর ঘুম থেকে জেগে উঠে তিনি খনন কাজ আরম্ভ করে দেন। খনন কাজ চলাকালে কূপ থেকে ঐ সমস্ত জিনিস উত্তোলন করা হয় বনু জুরহুম গোত্র মক্কা ছেড়ে যাওয়ার প্রাক্কালে কূপের মধ্যে যা নিক্ষেপ করেছিলেন। নিক্ষিপ্ত দ্রব্যের মধ্যে ছিল কিছু সংখ্যক তলোয়ার ও লৌহবর্ম এবং দুইটি সোনার হরিণ। আব্দুল মুত্তালিব তলোয়ারগুলো দ্বারা ক্বাবা’হ গৃহের দরজা ঢালাই করেন, সোনার হরিণ দুটি দরজার সঙ্গে সন্নিবেশিত করে রাখেন এবং হজ্জযাত্রীগণকে পানি পান করানোর ব্যবস্থা করেন।
যমযম কূপ খনন কালে আরও যে ঘটনাটির উদ্ভব হয়েছিল তা হচ্ছে যখন কূপটি প্রকাশিত হয় তখন কুরাইশগণ আব্দুল মুত্তালিবের সঙ্গে বিবাদ আরম্ভ করেন এবং দাবী করেন যে, খনন কাজে তাঁদেরকেও অংশ গ্রহণ করতে দিতে হবে।
আব্দুল মুত্তালিব বললেন, ‘যেহেতু এ কূপ খননের জন্য তিনি স্বপ্নযোগে আদিষ্ট হয়েছেন সেহেতু এ খনন কাজে তাঁদের অংশ গ্রহণ করতে দেয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু অন্যান্য কুরাইশগণও ছাড়বার পাত্র নন। এ ব্যাপারে মতামত গ্রহণের জন্য তাঁরা বনু সা‘দ গোত্রের এক মহিলা ভবিষ্যদ্বক্তার নিকট যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং এ উদ্দেশ্যে মক্কা থেকে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু পথের মধ্যে তাঁরা এমন কতিপয় নিদর্শন প্রত্যক্ষ করেন যাতে তাঁদের নিকট এটা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, সর্ব শক্তিমান আল্লাহ তা‘আলা যমযম কূপের খনন কাজ আব্দুল মুত্তালিবের জন্যই নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। তাই তাঁরা আর অগ্রসর না হয়ে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করেন। এ প্রেক্ষিতেই আব্দুল মুত্তালিব মানত করেছিলেন যে আল্লাহ তা‘আলা যদি অনুগ্রহ করে তাঁকে দশটি পুত্র সন্তান দান করেন এবং সকলেই বয়োপ্রাপ্ত হয়ে জীবনের এ স্তরে গিয়ে পৌঁছে যে তাঁরা আত্মরক্ষা করতে সক্ষম তাহলে তিনি তাঁর একটি সন্তানকে বায়তুল্লাহর জন্য উৎসর্গ করবেন।[1]
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৪২-১৪৭ পৃঃ।
হস্তী বাহিনীর ঘটনাঃ
দ্বিতীয় ঘটনার সংক্ষিপ্ত সার হচ্ছে, আবরাহা সাবাহ হাবশী (তিনি নাজ্জাশী সম্রাট হাবশের পক্ষ হতে ইয়ামানের গভর্ণর ছিলেন) যখন দেখলেন যে, আরববাসীগণ ক্বাবা’হ গৃহে হজ্জব্রত পালন করছেন এবং একই উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশ থেকে লোকজন সেখানে আগমন করছেন তখন সানআয় তিনি একটি বিরাট গীর্জা নির্মাণ করলেন এবং আরববাসীগণের হজ্জব্রতকে সেদিকে ফিরিয়ে আনার জন্য আহবান জানালেন। কিন্তু বনু কিনানাহ গোত্রের লোকজন যখন এ সংবাদ অবগত হলেন তখন তাঁরা এক রাত্রে গোপনে গীর্জায় প্রবেশ করে তার সামনের দিকে মলের প্রলেপন দিয়ে একদম নোংরা করে ফেললেন। এ ঘটনায় আবরাহা ভয়ানক ক্রোধান্বিত হন এবং প্রতিশোধ গ্রহণ কল্পে ক্বাবা’হ গৃহ ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে ষাট হাজার অস্ত্র সজ্জিত সৈন্যের এক বিশাল বাহিনীসহ মক্কা অভিমুখে অগ্রসর হন। তিনি নিজে একটি শক্তিশালী হস্তীপৃষ্ঠে আরোহণ করেন। সৈন্যদের নিকট মোট নয়টি অথবা তেরটি হস্তী ছিল।
আবরাহা ইয়ামান হতে অগ্রসর হয়ে মুগাম্মাস নামক স্থানে পৌঁছলেন এবং সেখানে তাঁর সৈন্যবাহিনীকে প্রস্তুত করে নিয়ে মক্কায় প্রবেশের জন্য অগ্রসর হলেন। তারপর যখন মুজদালেফা এবং মিনার মধ্যবর্তী স্থান ওয়াদিয়ে মুহাস্সারে পৌঁছলেন তখন তার হাতী মাটিতে বসে পড়ল। ক্বাবা’হ অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার জন্য কোন ক্রমেই তাকে উঠানো সম্ভব হল না। অথচ উত্তর, দক্ষিণ কিংবা পূর্ব মুখে যাওয়ার জন্য উঠানোর চেষ্টা করলে তা তৎক্ষণাৎ উঠে দৌঁড়াতে শুরু করত। এমন সময়ে আল্লাহ তা‘আলা এক ঝাঁক ছোট ছোট পাখী প্রেরণ করলেন। সেই পাখীগুলো ঝাঁকে ঝাঁকে পাথরের ছোট ছোট টুকরো সৈন্যদের উপর নিক্ষেপ করতে লাগল। প্রত্যেকটি পাখি তিনটি করে পাথরের টুকরো বা কংকর নিয়ে আসত একটি ঠোঁটে এবং দুইটি দু’পায়ে। কংকরগুলোর আকার আয়তন ছিল ছোলার মতো। কিন্তু কংকরগুলো যার যে অঙ্গে লাগত সেই অঙ্গ ফেটে গিয়ে সেখান দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হতে হতে সে মরে যেত।
এ কাঁকর দ্বারা সকলেই যে আঘাত প্রাপ্ত হয়েছিল তা নয়। কিন্তু এ অলৌকিক ঘটনায় সকলেই ভীষণভাবে আতংকিত হয়ে পড়ল এবং প্রাণভয়ে পলায়নের উদ্দেশ্যে যখন বেপরোয়াভাবে ছুটাছুটি শুরু করল তখন পদতলে পিষ্ট হয়ে অনেকেই প্রাণত্যাগ করল। কংকরাঘাতে ছিন্নভিন্ন এবং পদতলে পিষ্ট হয়ে পলকে বীরপুরুষগণ মৃত্যুর কবলে ঢলে পড়তে লাগল। এদিকে আবরাহার উপর আল্লাহ তা‘আলা এমন এক মুসিবত প্রেরণ করলেন যে তাঁর আঙ্গুল সমূহের জোড় খুলে গেল এবং সানা নামক স্থানে যেতে না যেতেই তিনি পাখির বাচ্চার মতো হয়ে পড়লেন। তারপর তাঁর বক্ষ-বিদীর্ণ হয়ে হৃদপিন্ড বেরিয়ে এল এবং তিনি মৃত্যু মুখে পতিত হলেন।
মক্কা অভিমুখে আবরাহার অগ্রাভিযানের সংবাদ অবগত হয়ে মক্কাবাসীগণ প্রাণভয়ে নানা দিকে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পলায়ন করে পাহাড়ের আড়ালে কিংবা পর্বত চূড়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। তারপর যখন তাঁরা অবগত হলেন যে, আবরাহা এবং তাঁর বাহিনী সমূলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে তখন তাঁরা স্বস্তির নিংশ্বাস ত্যাগ করে আপন আপন গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন।[1]
অধিক সংখ্যক চরিতবেত্তাগণের অভিমত হচ্ছে এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্মলাভের মাত্র ৫০ কিংবা ৫৫ দিন পূর্বে মুহাররম মাস। অত্র প্রেক্ষিতে এটা ধরে নেয়া যায় যে ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিল ৫৭১ খ্রীষ্টাব্দে ফ্রেব্রুয়ারী মাসের শেষ ভাগে কিংবা মার্চ মাসের প্রথম ভাগে। হস্তী বাহিনীর এ ঘটনা ছিল আগামী দিনের নাবী (সাঃ) এবং ক্বাবা’হ শরীফের জন্য আল্লাহর সিদ্ধান্ত ও সাহায্যের এক সুস্পষ্ট নিদর্শন। এর পিছনে আরও যে একটি কারণ ছিল তা হচ্ছে নাবী কারীম (সাঃ) তাঁর আমলেই দেখলেন যে বায়তুল মুক্বাদ্দাস ছিল মুসলিমদের ক্বিবলাহহ এবং সেখানকার অধিবাসীগণও ছিল মুসলিম। কিন্তু তা সত্ত্বেও এর উপর আল্লাহর শত্রুদের অর্থাৎ মুশরিকগণের শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। এর সুস্পষ্ট প্রমাণ হচ্ছে বুখতুনাসসরের আক্রমণ (৫৮৭ খ্রীষ্ট পূর্ব অব্দে) এবং রোমানগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা (৭০ খ্রীষ্টাব্দে)। পক্ষান্তরে ক্বাবা’হর উপর খ্রীষ্টনদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় নি। যদিও তাঁরা তৎকালে মুসলিম ছিলেন এবং ক্বাবা’হর অধিবাসীগণ ছিলেন মুশরিক।
অধিকন্তু, এ ঘটনা এমন এক সময়ে সংঘটিত হয়েছিল যে, এ সংক্রান্ত সংবাদটি তৎকালীন সভ্য জগতের অধিকাংশ অঞ্চলে (রোমান সাম্রাজ্য, পারস্য সাম্রাজ্য ইত্যাদি) খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কারণ, হাবশী এবং রোমীয়গণের মধ্যে গভীর সম্প্রীতির সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। অপর দিকে পারস্যবাসীগণের দৃষ্টি রোমীয়গণের উপর সমভাবে নিপতিত ছিল এবং শেষ পর্যন্ত অবস্থা এ দাঁড়ায় যে, পারস্যবাসীগণ অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ইয়ামান দখল করে বসে।
যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে তখন রোমান এবং পারস্য এ দুইটি রাষ্ট্রই তৎকালীন পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য অংশের প্রতিনিধিত্ব করত এবং যেহেতু হস্তীবাহিনীর ঘটনাটি এ দু’রাষ্ট্রের সকলের নিকটেই সুবিদিত ছিল সেহেতু বলা যায় যে সমগ্র পৃথিবীর দৃষ্টি ক্বাবা’হ গৃহের অলৌকিকত্বের প্রতি নিবদ্ধ হয়ে গেল। বায়তুল্লাহর উচ্চ সম্মান ও সুমহান মর্যাদা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত সুস্পষ্ট নিদর্শন স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করার পর একথা তাঁদের মনে দৃঢ়ভাবে স্থান লাভ করল যে, এ গৃহকে সংরক্ষণ ও পবিত্রকরণ এবং এর সুমহান মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার ব্যাপারেই আল্লাহ তা‘আলা এ অলৌকিক ব্যবস্থা অবলম্বন করেছিলেন। অতএব ভবিষ্যতে এখানকার অধিবাসীগণের মধ্য থেকে কেউ যদি নবুয়ত দাবী করেন তবে সেই ঘটনার প্রেক্ষাপটে তা হবে আইন-সঙ্গত এবং বাঞ্ছনীয় ব্যাপার এবং তা হবে পার্থিব ব্যবস্থাপনার উর্ধ্বে খোদায়ী রাজত্বের ভিত্তি যা ঈমানদারদের সাহায্যার্থে অবতীর্ণ হয়েছিল গায়েবী সূত্র থেকে।
আব্দুল মুত্তালিবের ছিল সর্বমোট দশটি সন্তান। তাঁদের নাম ছিল যথাক্রমেঃ হারিস, জুবাইর, আবূ তালেব, আব্দুল্লাহ, হামজাহ, আবূ লাহাব, গায়দাক্ব, মুক্বাবভিম, যেরার, এবং ‘আব্বাস। কেউ কেউ বলেছেন যে তাঁর ছিল ১১টি সন্তান, একজনের নাম ছিল কুসাম। অন্য কেউ বলেছেন যে, ১৩টি সন্তান ছিল। অন্য দু’জনের নাম হল, ‘আব্দুল ক্বাবা’হ এবং ‘হাযল’। কিন্তু দশ জনের কথা যাঁরা বলেছেন তাঁরা বলেন যে, ‘মুক্বাবভিমেরই’ অপর নাম ছিল ‘আব্দুল ক্বাবা’হ এবং ‘গায়দাক্বেরর’ অপর নাম ছিল ‘হাযল’। তাঁদের মতে কুসাম নামে আব্দুল মুত্তালিবের কোন পুত্র সন্তান ছিল না। আব্দুল মুত্তালিবের কন্যা ছিল ৬ জন। তাঁদের নামগুলো হচ্ছে যথাক্রমেঃ উম্মুল হাকীম (তাঁর অপর নাম বায়যা), বাররাহ, আতিকাহ, সাফিয়্যাহ, আরওয়া এবং উমাইয়া।[2]
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৫৬ পৃঃ।
[2] তালকীহুল ফহুম ৮-৯ পৃঃ এবং রহমাতুল্লিল আলামীন ২য় খন্ড ৫৬-৬৬ পৃঃ।
আব্দুল্লাহ (রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতা):
তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সম্মানিত পিতা। তার (আব্দুল্লাহর) মাতার নাম ছিল ফাত্বিমাহ। তিনি ছিলেন ‘আমর বিন আয়েয বিন ইমরান মাখযুম বিন ইয়াকযাহ বিন মুররাহর কন্যা। আব্দুল মুত্তালিবের সন্তানগণের মধ্যে আব্দুল্লাহ ছিলেন সব চাইতে সুন্দর এবং সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী। তিনি ছিলেন পিতার অত্যন্ত প্রিয়পাত্র। তাঁর লকব বা উপাধি ছিল যবীহ। যে কারণে তাঁকে যবীহ বলা হতো তা হচ্ছে আব্দুল মুত্তালিবের প্রার্থিত পুত্র সংখ্যা যখন ১০ জন হল এবং তাঁরা সকলেই আত্মরক্ষা করার যোগ্যতা অর্জন করলেন তখন আব্দুল মুত্তালিব তাঁদের নিজ মানত সম্পর্কে অবহিত করেন (তাঁদের পক্ষ থেকে এক জনকে আল্লাহর নামে উৎসর্গ করার ব্যাপারে) তাঁরা সকলেই এ প্রস্তাবে স্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন।
কথিত আছে, আব্দুল মুত্তালিব ছেলেদের মধ্যে কাকে কুরবানী করা যায় এ ব্যাপারে লটারি করলেন। লটারিতে আব্দুল্লাহর নাম উঠল অথচ তিনি ছিলেন তার সবচেয়ে প্রিয়পাত্র। এমতাবস্থায় আব্দুল্লাহ মুত্তালিব বললেন, হে আল্লাহ! সে-ই নাকি একশত উট? অতঃপর আবার আবদুল্লাহ ও একশতক উটের মধ্যে লটারী করলে একশত উটের নাম উঠে। আবার এও কথিত আছে যে, আব্দুল মুত্তালিব ভাগ্য-নির্ণায়ক তীরের উপর তাঁদের সকলের নাম লিখেন এবং হুবাল মূর্তির সেবায়েত বা তদারককারীগণের পন্থায় চক্রাকারে ঘোরানো ফেরানোর পর নির্বাচনগুটিকা বা লটারীর গুটি বের করেন। লটারীতে আব্দুল্লাহর নাম উঠে যায়। আব্দুল মুত্তালিব আব্দুল্লাহর হাত ধরে তাঁকে নিয়ে যান ক্বাবা’হ গৃহের নিকট। তাঁর হাতে ছিল যবেহ কাজে ব্যবহারোপযোগী একটি ধারালো অস্ত্র। কিন্তু কুরাইশগণের মধ্যে বনু মাখযুম অর্থাৎ আব্দুল্লাহর নানা গোষ্ঠীর লোকজন এবং আব্দুল্লাহর ভাই আবূ ত্বালিব এ ব্যাপারে তাঁকে বাধা প্রদান করেন। তাঁর মানত পূরণে বাধাপ্রাপ্ত আব্দুল মুত্তালিব বললেন তাহলে মানতের ব্যাপারে তাঁর করণীয় কাজ কী হতে পারে? এতদ্বিষয়ে বিশেষ জ্ঞানের অধিকারিনী বা তত্ত্ব বিশারদ কোন মহিলার নিকট থেকে এ ব্যাপারে পরামর্শ গ্রহণের জন্য তাঁরা তাঁকে উপদেশ প্রদান করেন। আব্দুল মুত্তালিব জনৈক তত্ত্ববিশারদের নিকট গিয়ে এ ব্যাপারে তাঁর পরামর্শ চাইলে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য আব্দুল্লাহ এবং ১০ টি উটের মধ্যে লটারী বা নির্বাচনগুটিকা ব্যবহারের পরামর্শ দেন। নির্বাচনী গুটিকায় যদি আব্দুল্লাহর নাম উঠে যায় তাহলে ১০টি উটের সঙ্গে আরও ১০টি উট যোগ করে নির্বাচনী গুটিকা ব্যবহার করতে হবে যে পর্যন্ত না আব্দুল্লাহর নামের স্থানে ‘উট’ কথাটি প্রকাশিত হয় সে পর্যন্ত একই ধারায় নির্বাচনী গুটিকা ব্যবহার করে যেতে হবে যতক্ষণ না আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়ে যান। তারপর উটের যে সংখ্যা নির্ধারক নির্বাচনী গুটিকা ব্যবহার করা হবে সেই সংখ্যক উট আল্লাহর নামে উৎসর্গ করতে হবে।
সেখান থেকে প্রত্যাবর্তনের পর আব্দুল মুত্তালিব, আব্দুল্লাহ ও ১০টি উটের মধ্যে নির্বাচনী গুটিকা ব্যবহার করেন। কিন্তু এতে আব্দুল্লাহর নামই প্রকাশিত হয়। তত্ত্ববিশারদের নির্দেশ মুতাবেক দ্বিতীয় দফায় উটের সংখ্যা আরও বেশী বৃদ্ধি করে তিনি নির্বাচনী গুটিকা ব্যবহার করেন। কিন্তু এতেও আব্দুল্লাহর নামই উঠে যায়। কাজেই পরবর্তী প্রত্যেক দফায় ১০টি উটের সং্যখা বৃদ্ধি করে তিনি নির্বাচনী গুটিকা ব্যবহার করে যেতে থাকেন। এ ধারায় চলতে চলতে যখন একশত উট এবং আব্দুল্লাহর নাম নির্বাচনী গুটিকায় ব্যবহার করা হয় তখন উট কথাটি প্রকাশিত হয়। এ প্রেক্ষিতে আব্দুল মুত্তালিব আব্দুল্লাহর পরিবর্তে ১০০ টি উট আল্লাহর নামে উৎসর্গ করেন। উৎসর্গীকৃত পশুর গোশত্ কোন মানুষ কিংবা জীবজন্তুর খাওয়ার ব্যাপারে কোন বাধা-নিষেধ ছিল না। উল্লেখিত ঘটনার পূর্বে আরব এবং কুরাইশগণের মধ্যে শোনিতপাতের খেসারত বা মূল্য ছিল ১০টি উট। কিন্তু এ ঘটনার পর এর বর্ধিত সংখ্যা নির্ধারিত হয় ১০০টি উট। ইসলামও এ সংখ্যাকে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। প্রিয় নাবী (সাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন যে, ‘আমি দু’ যবীহর সন্তান’, ‘একজন ইসমাঈল (আঃ) এবং অন্য জন হচ্ছেন আমার পিতা আব্দুল্লাহ।[1]
আব্দুল মুত্তালিব স্বীয় সন্তান আব্দুল্লাহর বিবাহের জন্য আমিনাহহকে মনোনীত করেন। তিনি ছিলেন ওয়াহাব বিন আবদে মানাফ বিন যুহরা বিন কিলাবের কন্যা। বংশ পরম্পরা এবং মর্যাদার দিক দিয়ে তাঁকে কুরাইশ গোত্রের মধ্যে উন্নত মানের মহিলা ধরা হতো। তাঁর পিতা ছিলেন বিখ্যাত বনু যুহরা গোত্রের দলপতি। বিবাহের পর আমিনাহ মক্কায় স্বামী গৃহে আগমন করেন এবং স্বামীর সঙ্গে বসবাস করতে থাকেন কিন্তু অল্প দিন পরেই আব্দুল মুত্তালিব ব্যবসা উপলক্ষ্যে খেজুর আনয়নের উদ্দেশ্যে আব্দুল্লাহকে মদীনা প্রেরণ করেন। তিনি সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।
কোন কোন চরিতবিদ বলেন যে, ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে আব্দুল্লাহ শামদেশে গমন করেছিলেন। এক কুরাইশ কাফেলার সঙ্গে মক্কা প্রত্যাবর্তনের পথে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন ও মদীনায় অবতরণ করেন। সেই অসুস্থতার মধ্যেই সেখানে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। নাবেগা জা’দীর বাড়িতে তাঁর কাফন দাফনের ব্যবস্থা করা হয়। সেই সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ২৫ বছর। অধিক সংখ্যক ইতিহাসবিদদের অভিমত হচ্ছে তিনি পিতার মৃত্যুসময় জন্ম গ্রহণ করেন নি। আর অল্প সংখ্যক ঐতিহাসিকের অভিমত হচ্ছে, পিতার মৃত্যুর দু’মাস পূর্বেই নাবী কারীম (সাঃ) জন্ম গ্রহণ করেছিলেন।[2] যখন তাঁর মৃত্যু সংবাদ মক্কায় পৌঁছল তখন আমিনাহ অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় একটি শোকগাথা আবৃত্তি করেছিলেন। শোক গাথাটি হচ্ছে-
عَفَـا جانبُ البطحـاءِ من ابن هـاشـم
**
وجاور لَحْدًا خارجـًــا في الغَــمَاغِم
دَعَتْـــه المنــايا دعــوة فأجـابـهــا
**
وما تركتْ في الناس مثل ابن هاشم
عشيـة راحـوا يحمــــلــون سريـره
**
تَعَاوَرَهُ أصــحــابــه في التزاحـــم
فإن تـك غـالتـه الــمنـايا ورَيْبَهـا
**
فقـد كـان مِعْطـاءً كـثير التراحم
অর্থঃ ‘বাতহার জমিন হাশিমের পুত্রকে হারালো, সে চিৎকার ও গোলমালের মাঝে সমাধিতে সুখস্বপ্নবৎ পরিতৃপ্ত হয়ে গেল। মৃত্যু মানুষের মধ্যে ইবনে হাশিমের মত কোন ব্যক্তিকে ছাড়ে নাই। (কতই দুঃখ জনক ছিল) যখন সেই সন্ধায় লোকেরা তাঁকে মৃতের খাটে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। যদিও মৃত্যু এবং মৃত্যুর ঘটনাবলী তাঁর অস্তিত্বকে শেষ করেছে। তবুও তাঁর উন্নততর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসমূহকে মুছে ফেলতে পারবে না। তিনি ছিলেন বড়ই দয়াবান এবং কোমল অন্তঃকরণের অধিকারী।[3]
মৃত্যুকালে তিনি যে সব সহায়-সম্পদ রেখে গিয়েছিলেন তা ছিল যথাক্রমে ৫টি উট, এক পাল ছাগল এবং একটি হাবশী দাসী যার নাম ছিল বরকত ও উপনাম উম্মে আয়মান। এ উম্মে আয়মানই নাবী কারীমকে দুগ্ধ খাইয়েছিলেন।[4]
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৫১-১৫৫ পৃঃ রহমাতুল্লিল আলামীন ২য় খন্ড ৮৯-৯০ পৃঃ। মোখতাসারে সীরাতে রাসূল শাইখ আব্দুল্লাহ নাজদী ১২, ২২, ২৩।
[2] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৫৬-১৫৮ পৃঃ ফিকহুস সীরাত মুহাম্মাদ গাযালী ৪৫ পৃঃ রহমাতুল্লিল আলামীন ২য় খন্ড ৯১ পৃঃ।
[3] তাবাকাতে ইবনে সা‘দ ১ম খন্ড ৬২ পৃঃ।
[4] শাইখ আব্দুল্লাহ মুখতাসারুস সীরাত ১২ পৃঃ তালকীহুল ফোহম ১৪ পৃঃ সহীহুল মুসলিম ২য় খন্ড ৯৬ পৃঃ।
সৌভাগ্যময় জন্ম এবং নবুয়ত পূর্ব পবিত্র জীবন
সৌভাগ্যময় জন্ম (المولـــد):
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মক্কায় বিখ্যাত বনু হাশিম বংশে ৯ই রবিউল আওয়াল (ফীলের বছর) সোমবার দিবস রজনীর মহাসন্ধিক্ষণে সুবহে সাদেকের সময় জন্মলাভ করেন। ইংরেজী পঞ্জিকা মতে তারিখটি ছিল ৫৭১ খ্রীষ্টাব্দে ২০শে অথবা ২২শে এপ্রিল। এ বছরটি ছিল বাদশাহ নওশেরওয়ার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার চল্লিশতম বছর। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মুহাম্মাদ সুলায়মান মুনসুরপুরী সাহেব (রহঃ) এর অনুসন্ধানলব্ধ সঠিক অভিমত হচ্ছে এটাই।[1]
ইবনে সা‘দ হতে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মা বলেছেন যখন তাঁর জন্ম হয়েছিল তখন আমার শরীর হতে এক জ্যোতি বের হয়েছিল যাতে শামদেশের অট্টালিকাসমূহ আলোকিত হয়েছিল। ইমাম আহমাদ (রঃ) ইরবায বিন সারিয়া কর্তৃক অনরূপ একটি বর্ণনা উল্লেখ করেছেন।[2] নাবী (সাঃ)-এর জন্মের সময় কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা নবুওয়াতের পূর্বাভাস স্বরূপ প্রকাশিত হয়। কিসরাপ্রাসাদের চৌদ্দটি সৌধচূড়া ভেঙ্গে পড়ে, প্রাচীন পারসীক যাজকমন্ডলীর উপাসনাগারগুলোতে যুগ যুগ ধরে প্রজ্জ্বলিত হয়ে আসা অগ্নিকুন্ডগুলো নির্বাপিত হয়ে যায়, বাহীরা পাদ্রীগণের সরগম গীর্জাগুলো নিস্তেজ ও নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। এ বর্ণনা হচ্ছে ইমাম বায়হাক্বী, তাবারী এবং অন্যান্যদের।[3] তবে এগুলোর কোন সঠিক ভিত্তি নেই এবং তৎকালীন কোন ইতিহাসও এর সাক্ষ্য দেয় না।[4]
সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর পরই আমিনাহহ আব্দুল মুত্তালিবের নিকট তার পুত্রের জন্ম গ্রহণের শুভ সংবাদটি প্রেরণ করেন। এ শুভ সংবাদ শ্রবণ মাত্রই তিনি আনন্দ উদ্বেল চিত্তে সূতিকাগারে প্রবেশ করে নব জাতককে কোলে তুলে নিয়ে কা‘বাগৃহে গিয়ে উপস্থিত হন। তারপর অপূর্ব সুষমামন্ডিত এ শিশুর মুখমন্ডলে আনন্দাশ্রু সজল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করতে থাকেন এবং তার সার্বিক কল্যাণের জন্য প্রার্থনা করতে থাকেন। একান্ত আনন্দ মধুর এ মুহূর্তেই তিনি এটাও স্থির করে ফেলেন যে এ নব জাতকের নাম রাখা হবে মুহাম্মাদ। আরববাসীগণের নামের তালিকায় এটা ছিল অভিনব একটি নাম। তারপর আরবের প্রচলিত প্রথানুযায়ী সপ্তম দিনে তাঁর খাতনা করা হয়।[5]
তাঁর মাতার পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে সর্বপ্রথম দুগ্ধ পান করিয়েছিলেন আবূ লাহাবের দাসী সুওয়ায়বা। ঐ সময় তার কোলে যে সন্তান ছিল তাঁর নাম ছিল মাসরুহ। নাবী কারীম (সাঃ)-এর পূর্বে সুওয়ায়বা হামযাহ বিন আব্দল মুত্তালিবকে এবং পরে আবূ সালামাহ বিন আব্দুল আসাদ মাখযুমীকেও দুগ্ধ পান করিয়েছিলেন।[6]
ফুটনোটঃ[1] মাহমুদ পাশা- তারীখে খুযরী ১ম খন্ড ৬২ পৃঃ। মুহাম্মাদ সুলায়মান মানসুরপুরী, রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ৩৮-৩৯ পৃঃ। এপ্রিলের তারিখ সম্পর্কে মতভেদ হচ্ছে খ্রীষ্টীয় পঞ্জিকার গোলমালের ফল।
[2] শাইখ আব্দুল্লাহ মুখতাসারুস সীরাহ ১২ পৃঃ ও ইবনে সা‘দ ১ম খন্ড ৬৩ পৃঃ।
[3] মুখতাসারুস সীরাহ ১২ পৃঃ।
[4] মুহাম্মাদ গাযালী সীরাত ৪৬ পৃঃ (ইমাম বায়হাকীর মত। কিন্তু মুহাম্মাদ গাযালী এটার শুদ্ধতা সম্পর্কে দ্বিমত পোষণ করেন।)
[5] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৫৯-১৬০ পৃঃ তারীখে খুযরী ১ম খন্ড ভিন্ন একটি বর্ণনা মতে তিনি খাতনাকৃত অবস্থায়ই জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। তালকীহুল ফোহুম ৪ পৃঃ কিন্তু ইবনে কাইয়েম বলেন যে, এ ব্যাপারে কোন প্রামাণ্য হাদীস নেই। যাদুল মা’আদ ১ম খন্ড ১৮ পৃঃ।
[6] তালকীহুল ফোহুম ৪ পৃঃ শাইখ আব্দুল্লাহ মুখতাসারুস সীরাহ ১৩ পৃঃ।
বনু সা‘দ গোত্রে লালন পালন (فِيْ بَنِيْ سَعْدٍ ):
দুগ্ধপোষ্য শিশুদের লালন পালনের ব্যাপারে তৎকালীন নগরবাসী আরবগণের মধ্যে একটি বিশেষ প্রথা প্রচলিত ছিল। সেই প্রথাটি ছিল শহর-নগরের জনাকীর্ণ পরিবেশ জনিত আধি-ব্যাধির কুপ্রভাব থেকে দূরে উন্মুক্ত গ্রামীন পরিবেশে শিশুদের লালন-পালন করার মাধ্যমে তারা যাতে বলিষ্ঠদেহ এবং মজবুত মাংসপেশীর অধিকারী হয় এবং বিশুদ্ধ আরবী ভাষা শিখতে সক্ষম হয় তদুদ্দেশ্যে দুগ্ধ পানের জন্য বেদুঈন পরিবারের ধাত্রীগণের হাতে শিশুদের সমর্পণ করা। এ প্রথানুযায়ী অব্দুল মুত্তালিব শিশু মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে দুগ্ধ পান করানোর উদ্দেশ্যে ধাত্রী অনুসন্ধান করেন এবং শেষ পর্যন্ত হালীমাহ বিনতে আবূ যুয়ায়বের নিকট তাকে সমর্পণ করেন। এ মহিলা বনু সা‘দ বিন বাকর গোত্রের একজন খাতুন ছিলেন। তার স্বামীর নাম ছিল হারিস বিন আব্দুল উযযা এবং উপনাম ছিল আবূ কাবশাহ। তিনিও বনু সা‘দ গোত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন।
হালীমাহ ও হারিস দম্পতির কয়েকটি সন্তান ছিল। তারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দুগ্ধ সম্পর্কিত ভ্রাতা ও ভগিনীর সম্মান লাভ করে। তাদের নাম হচ্ছে যথাক্রমেঃ আব্দুল্লাহ, আনীসাহ, হুযাফা অথবা জুযামাহ। হুযাফা শায়মা নামে অধিকতর পরিচিত ও প্রসিদ্ধ ছিলেন। এ শায়মাই রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর লালন-পালনের ব্যাপারে মাতা হালীমাহ সাহায্য করতেন বলে কথিত আছে। অধিকন্তু, তাঁর চাচাতো ভাই আবূ সাফিয়্যাহহন বিন হারিস বিন আব্দুল মুত্তালিবও হালীমাহর সূত্র ধরে দুগ্ধ সম্পর্কিত ভাই ছিলেন। নাবী কারীম (সাঃ)’র চাচা হামযাহ বিন আব্দুল মুত্তালিবকেও বনু সা’দ গোত্রের এক মহিলা দুগ্ধ পান করিয়েছিলেন। হালীমাহ গৃহে থাকা অবস্থায় এ মহিলাও একদিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে দুগ্ধ পান করিয়েছিলেন। এ প্রেক্ষিতে নাবী কারীম (সাঃ) এবং হামযাহ (রাঃ) দুধভাই সম্পর্কে সম্পর্কিত হয়ে যান। প্রথম সূত্রে সুওয়াইবার সম্পর্কের মাধ্যমে এবং দ্বিতীয় সূত্রে বনু সা’দ গোত্রে সেই মহিলার মাধ্যমে।[1]
দুগ্ধ পান কালে হালীমাহ নাবী কারীম (সাঃ)-এর অলৌকিক ও বরকতময় অনেক দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে আশ্চর্যান্বিত ও হতবাক হয়ে যান। হালীমাহর বর্ণনা সূত্রে ইতিহাসবিদ ইবনে ইসহাক্ব বলেন যে, হালীমাহ এবং তার স্বামী তাদের একটি দুগ্ধপোষ্য সন্তানসহ বনু সা’দ গোত্রের এক দল মহিলার সঙ্গে অর্থের বিনিময়ে দুগ্ধপান করবে এমন শিশুর সন্ধানে মক্কা যান। সেই সময় আরব ভূমিতে দুর্ভিক্ষজনিত দারুন খাদ্য ও অর্থ সংকট বিরাজমান ছিল।
হালীমাহ বলেন, ‘আমি আমার একটি সাদা মাদী গাধার পিঠে সওয়ার হয়ে চলছিলাম। আমার সঙ্গে উটও ছিল। কিন্তু কি আল্লাহর মহিমা যে, উটের ওলান থেকে এক বিন্দুও দুধ বাহির হচ্ছিলনা। আমার বুকেও শিশুটির জন্য এক বিন্দু দুধ ছিলনা। এ দিকে ক্ষুধার তাড়নায় শিশুটি এতই ছটফট করছিল যে, সারাটি রাত আমরা ঘুমাতে পারি নি। এমতাবস্থায় আমরা বৃষ্টি ও সচ্ছলতার আশা-ভরসা নিয়ে প্রহর গুণছিলাম। কিন্তু অবস্থার তেমন কোন উন্নতি না হওয়ায় অবশেষে উপায়ান্তর না দেখে পুনরায় আমরা পথ চলা শুরু করলাম।’
‘আমি আমার মাদী গাধাটির উপর সওয়ার হয়ে পথ চলতে থাকলাম। গাধাটি ছিল খুবই দুর্বল, তার দুর্বলতা এবং শক্তি হীনতার কারণে সে এতই ধীরে ধীরে চলতে থাকল যে, এতে কাফেলার অন্যেরা অত্যন্ত বিরক্ত এবং বিব্রত বোধ করতে থাকল। যা হোক, এমনভাবে এক অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যদিয়ে আমরা মক্কায় গিয়ে উপস্থিত হলাম। তারপর আমাদের দলে এমন কোন মহিলা ছিল না যার নিকট শিশু নাবী (সাঃ)- কে দুগ্ধ পান করানোর প্রস্তাব দেয়া হয় নি। কিন্তু যখনই তারা জানতে পারল যে, শিশুটি পিতৃহীন ইয়াতীম তখনই তারা তাকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করল। কারণ, দুগ্ধদানের জন্য দুগ্ধপোষ্যের পিতার নিকট থেকে উত্তম বিনিময় লাভের প্রত্যাশা সকলেরই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তেমন কোন সম্ভাবনাই নেই। মা বিধবা, দাদা বৃদ্ধ, এ শিশুকে লালন-পালন করে তার বিনিময়ে কীইবা এমন পাওয়ার আশা করা যেতে পারে? ইতস্তত করে এ সব কিছু ভেবে চিন্তে দলের কেউই তা নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করল না।’
‘এদিকে দলের অন্যান্য মহিলা যারা আমার সঙ্গে এসেছিল তারা সকলেই একটি করে শিশু সংগ্রহ করে নিল। অবশিষ্ট রইলাম শুধু আমি। আমার পক্ষে কোন শিশু সংগ্রহ করা সম্ভব হল না। ফিরে যাওয়ার সময় যতই ঘনিয়ে আসতে লাগল আমার মনটা ক্রমান্বয়ে ততই যেন কষ্টকর ও ভারাক্রান্ত হয়ে উঠতে থাকল। অবশেষে আমি আমার স্বামীকে বললাম, ‘আমার সঙ্গিনীরা সকলেই দুধপানের জন্য সন্তান নিয়ে ফিরছে আর আমাকে শূন্য হাতে ফিরে যেতে হচ্ছে এ যেন আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। তার চাইতে বরং আমি সেই ইয়াতিম ছেলেটিকেই নিয়ে যাই (যা করেন আল্লাহ)।’
স্বামী বললেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, কোন অসুবিধা নেই, তুমি গিয়ে তাকেই নিয়ে এসো। এমনটিও হতে পারে যে, আল্লাহ এর মধ্যেই আমাদের জন্য কোন বরকত নিহিত রেখেছেন। এমন এক অবস্থা এবং মন-মানসিকতার প্রেক্ষাপটে শিশু মুহাম্মাদ (সাঃ)- কে দুধ পান করানোর জন্য আমি গ্রহণ করলাম।’
তারপর হালীমাহ বললেন, ‘যখন আমি শিশু মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে নিয়ে নিজ আস্তানায় ফিরে এলাম এবং তাঁকে আমার কোলে রাখলাম তখন তিনি তাঁর দু’সীনা আমার বক্ষের সঙ্গে মিলিত করে পূর্ণ পরিতৃপ্তির সঙ্গে দুগ্ধ পান করলেন। তাঁর দুধভাই অর্থাৎ আমার গর্ভজাত সন্তানটিও পূর্ণ পরিতৃপ্তির সঙ্গে দুগ্ধ পান করল। এরপর উভয়েই ঘুমিয়ে পড়ল। এর পূর্বে তার এভাবে ঘুম আমরা কক্ষনোই দেখিনি।
অন্য দিকে আমার স্বামী উট দোহন করতে গিয়ে দেখেন যে, তার ওলান দুধে পরিপূর্ণ রয়েছে। তিনি এত বেশী পরিমাণে দুধ দোহন করলেন যে, আমরা উভয়েই তৃপ্তির সঙ্গে পেট পুরে তা পান করলাম এবং বড় আরামের সঙ্গে রাত্রি যাপন করলাম। পূর্ণ পরিতৃপ্তির সঙ্গে রাত্রি যাপন শেষে যখন সকাল হল তখন আমার স্বামী বললেন, ‘হালীমাহ! আল্লাহর শপথ, তুমি একজন মহা ভাগ্যবান সন্তান লাভ করেছ।’ উত্তরে বললাম, ‘অবস্থা দেখে আমারও যেন তাই মনে হচ্ছে।’
হালীমাহ আরও বলেন যে, ‘এরপর আমাদের দল মক্কা থেকে নিজ নিজ গৃহে ফেরার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। শিশু মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে বুকে নিয়ে আমার সেই দুর্বল এবং নিস্তেজ মাদী গাধার উপর সওয়ার হয়ে আমিও তাদের সঙ্গে যাত্রা শুরু করলাম। কিন্তু আল্লাহর শপথ আমার সেই দুর্বল গাধাই সকলকে পিছনে ফেলে দ্রুত বেগে সকলের অগ্রভাগে এগিয়ে যেতে থাকল। অন্য কোন গাধাই তার সাথে চলতে পারল না। এমনকি অন্যান্য সঙ্গিনীরা বলতে থাকল, ‘ওগো আবূ যুওয়াইবের কন্যা! ব্যাপারটি হল কী বল দেখি। আমাদের প্রতি একটু অনুগ্রহ করো! এটা কি সেই গাধাটি নয় যার উপর সওয়ার হয়ে তুমি এসেছিলে?’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, আল্লাহর শপথ, এটা সেই গাধাই যার উপর সওয়ার হয়ে আমি এসেছিলাম।’
তারা বলল, ‘নিশ্চয়ই, এর সঙ্গে বিশেষ রহস্যজনক কোন ব্যাপার ঘটেছে।’
এমন এক রহস্যময় অবস্থার মধ্য দিয়ে অবশেষে আমরা বনু সা’দ গোত্র নিজ বাড়িতে এসে উপস্থিত হলাম। ইতোপূর্বে আমার জানা ছিল না যে, আমাদের অঞ্চলের মানুষের চাইতে অন্য কোন অঞ্চলের মানুষ অধিকতর অভাবগ্রস্ত ছিল কিনা, কিন্তু মক্কা থেকে আমাদের ফিরে আসার পরবর্তী সময়ে আমাদের বকরীগুলো চারণভূমি থেকে খেয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে দুগ্ধ পরিপূর্ণ ওলান সহকারে বাড়িতে ফিরে আসত। দুগ্ধবতী বকরীগুলো দোহন করে আমরা তৃপ্তিসহকারে দুধ পান করতাম। অথচ অন্য লোকেরা দুধ পেত না এক ফোঁটাও। তাদের পশুগুলোর ওলানে কোন দুধই থাকত না। এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পশুপালের মালিকেরা তাদের রাখালদের বলতেন, ‘হতভাগারা যেখানে বনু যুওয়াইবের কন্যার রাখাল পশুপাল নিয়ে যায় তোমরা কি তোমাদের পশুপাল নিয়ে সেই চারণভূমিতে যেতে পার না?’
এ প্রেক্ষিতে আমাদের রাখাল যে চারণভূমিতে পশুপাল নিয়ে যেত অন্যান্য লোকের রাখালরাও সেই ভূমিতে পশুপাল নিয়ে যেত। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের পশুগুলো ক্ষুধার্ত ও অভুক্ত অবস্থায় ফিরে আসত। সে সকল পশুর ওলানে দুধও থাকত না। অথচ আমাদের বকরীগুলো পরিতৃপ্তি এবং ওলানে পূর্ণমাত্রায় দুধসহকারে বাড়িতে ফিরত। প্রত্যেকটি কাজে কর্মে আল্লাহ তা‘আলার তরফ থেকে সব কিছুর মধ্যেই আমরা বরকত লাভ করতে থাকলাম।
এভাবে সেই ছেলের পুরো দুটি বছর অতিবাহিত হয়ে গেল এবং আমি তাঁকে স্তন্য পান করানো বন্ধ করে দিলাম। অন্যান্য শিশুদের তুলনায় এ শিশুটি এত সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে থাকলেন যে, দু’বছর পুরো হতে না হতেই তাঁর দেহ বেশ শক্ত ও সুঠাম হয়ে গড়ে উঠল। লালন-পালনের মেয়াদ দু’বছর পূর্ণ হওয়ায় আমরা তাঁকে তাঁর মাতার নিকট নিয়ে গেলাম। কিন্তু তাঁকে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে আমাদের সংসার জীবনে সচ্ছলতা ও বরকতের যে সুফল আমরা ভোগ করে আসছিলাম তাতে আমরা মনের কোণে একটি গোপন ইচ্ছা পোষণ করে আসছিলাম যে, তিনি যেন আরও কিছুকাল আমাদের নিকট থাকেন। তাঁর মাতার নিকট আমাদের গোপন ইচ্ছা ব্যক্ত করে বললাম যে, তাঁকে আরও কিছু সময় আমদের সঙ্গে থাকতে দিন যাতে তিনি সুস্বাস্থ্য ও সুঠাম দেহের অধিকারী হয়ে ওঠেন। অধিকন্তু, মক্কায় মহামারীর প্রাদুর্ভাব সম্পর্কেও আমরা কিছুটা ভয় করছি। আমাদের বারংবার অনুরোধ ও আন্তরিকতায় আশ্বস্ত হয়ে তিনি মুহাম্মাদ (সাঃ)- কে পুনরায় নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সম্মতি দান করলেন।[2]
ফুটনোটঃ[1] যাদুল মা’আদ ১ম খন্ড ১৯ পৃঃ।
[2] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৬২-১৬৪ পৃঃ।
বক্ষ বিদারণ (شَقُّ الصَّدْرِ):
এভাবে দুগ্ধ পানের সময়সীমা অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরও বালক নাবী (সাঃ) বনু সা‘আদ গোত্রে অবস্থান করতে থাকলেন। দ্বিতীয় দফায় বনু সা‘আদ গোত্রে অবস্থান কালে জন্মের ৪র্থ কিংবা ৫ম[1] বছরে তাঁর বক্ষ বিদারণের ঘটনাটি ঘটে। আনাস (রাঃ) হতে সহীহুল মুসলিমে ঘটনাটির বিস্তারিত বিবরণ বর্ণিত হয়েছে। ব্যাপারটি হচ্ছে একদিন বালক নাবী (সাঃ) যখন সঙ্গী-সাথীদের সঙ্গে খেলাধূলা করছিলেন এমন সময় জিবরাঈল (আঃ) সেখানে এসে উপস্থিত হন। তারপর তাঁকে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে চিৎ করে শুইয়ে দিলেন এবং তাঁর বক্ষ বিদীর্ণ করে হৃৎপিন্ডটি বের করে আনলেন। তারপর তার মধ্য থেকে কিছুটা জমাট রক্ত বের করে নিয়ে বললেন, ‘এটা হচ্ছে শয়তানের অংশ যা তোমার মধ্যে ছিল।’ তারপর হৃৎপিন্ডটিকে একটি সোনার তস্ত্তরীতে রেখে যমযমের পানি দ্বারা তা ধুয়ে তা যথাস্থানে প্রতিস্থাপন করে কাটা অংশ জোড়া লাগিয়ে দিলেন। এ সময় তাঁর খেলার সঙ্গী-সাথীগণ দৌড়ে গিয়ে দুধমা হালীমাহকে বলল যে, মুহাম্মাদ (সাঃ) নিহত হয়েছেন। হালীমাহ এবং তাঁর স্বামী এ কথা শুনে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ও অস্থির হয়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে নাবী (সাঃ)-এর মুখমন্ডলে মালিন্য এবং পেরেশানির ভাব লক্ষ্য করলেন। এ অবস্থার মধ্যে তাঁরা তাঁকে বাড়িতে নিয়ে এসে তাঁরা সেবাযত্নে লিপ্ত হলেন।[2] আনাস (রাঃ) বলেন, আমি তাঁর বক্ষে ঐ সেলাইয়ের চিহ্ন দেখেছি।
ফুটনোটঃ[1] এটাই হল সাধারণ চরিতকারকগণের মত। কিন্তু ইবনে ইসহাক্বের বর্ণনানুযায়ী জানা যায় যে, ঘটনাটি হয়েছিল তৃতীয় বছরে। ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড ১৬৪-১৬৫ পৃ.।
[2] সহীহুল মুসলিম, বাবুল ইসরা, ১ম খন্ড ৯২ পৃ.।
স্নেহময়ী মাতৃক্রোড়ে (إِلٰى أُمِّهِ الْحُنُوْنِ):
বালক নাবী (সাঃ)-এর বক্ষ বিদারণের ঘটনায় দুধমা হালীমাহ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তাঁকে তাঁর মার নিকট ফেরত দেন। এভাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ছয় বছর বয়স পর্যন্ত মা হালীমাহর ঘরে বড় হন।[1] দুধমা’র ঘর থেকে প্রাণের টুকরো নয়নমণি সন্তানকে ফেরত পাওয়ার পর আমিনাহ ইয়াসরিব গিয়ে তাঁর স্বামীর কবর যিয়ারত করার মনস্থ করেন। তারপর শশুর আব্দুল মুত্তালিবের ব্যবস্থাপনায় শিশুপুত্র মুহাম্মাদ (সাঃ) এবং পরিচারিকা উম্মু আয়মানকে সঙ্গে নিয়ে মক্কা-মদীনার মধ্যবর্তী পাঁচশ’ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে মদীনায় পৌঁছেন। সেখানে এক মাস অবস্থানের পর মক্কায় ফেরার উদ্দেশ্যে তিনি মদীনা থেকে যাত্রা করেন। সামনে মক্কা অনেক দূরের পথ, পেছনে মদীনা তুলনামূলক কম দূরত্বে অবস্থিত। পথ চলার এমন এক পর্যায়ে আমিনাহ হয়ে পড়লেন অসুস্থ। ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকল তাঁর অসুখ। তারপর তিনি ইয়াতিম শিশু নাবী (সাঃ) এবং আত্মীয়-স্বজনকে শোক সাগরে ভাসিয়ে আবওয়া নামক স্থানে মৃত্যুবরণ করেন।[2]
ফুটনোটঃ[1] তালকীহুল ফোহুম, ৭ পৃ. ও ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড ১৬৮ পৃ.।
[2] ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড ১৬৮ আলকীহুল ফোহুম, ৭ পৃ.। তারীখে খুযরী, ১ম খন্ড ৬৩ পৃ. ফিকহুস সীরাত, গাযালী ৫০ পৃ.।
পিতামহের স্নেহ-ছায়ার আশ্রয়ে (إِلٰى جَدِّهِ العَطُوْفِ):
পিতার মৃত্যুর পর রইলেন স্নেহময়ী মা, মাতার মৃত্যুর পর বেঁচে রইল বৃদ্ধ দাদা। মায়ের মৃত্যুর পর শোকাভিভূত দাদা নিয়ে এলেন পিতা-মাতাহীন পুত্রকে নবুয়ত ও রিসালাতের নিকেতন মক্কায়। প্রাণের চেয়ে বেশী প্রিয় পুত্র আব্দুল্লাহ’র মৃত্যুতে আব্দুল মুত্তালিব যতটা ব্যথা অনুভব করেছিলেন, তার চাইতে অনেক বেশী ব্যথা অনুভব করলেন পুত্রবধূ আমিনাহর মৃত্যুতে। কারণ, আব্দুল্লাহ’র মৃত্যুর পর শিশু মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর অবলম্বন ছিলেন তাঁর মা আমিনাহ। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পর তাঁর যে আর কোন অবলম্বনই রইল না। এ দুঃখ তাঁর শতগুণে বেড়ে গেল। অন্য দিকে তেমনি আবার ইয়াতিম শিশুটির জন্য তাঁর স্নেহসুধাও শত ধারায় বর্ষিত হতে থাকল। মনে হতো যেন ঔরসজাত সন্তানের চাইতেও বেশী মাত্রায় তিনি তাঁকে স্নেহ করতে লাগলেন।
ইবনে হিশামের বর্ণনায় আছে যে, কা’বাহ ঘরের ছায়ায় আব্দুল মুত্তালিবের জন্য বিশেষ একটি আসন বিছানো থাকত। আব্দুল মুত্তালিব এ আসনে বসতেন এবং সন্তানগণ বসতেন সেই আসনের পার্শ্ববর্তী স্থানে। পিতার সম্মানার্থে তাঁর কোন সন্তান এ আসনে বসতেন না। কিন্তু শিশু নাবী (সাঃ) সেখানে আগমন করে সেই আসনেই বসতেন। এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে তাঁর চাচাগণ তাঁর হাত ধরে তাঁকে সেই আসন থেকে নামিয়ে দিতেন। কিন্তু আব্দুল মুত্তালিবের উপস্থিতিতে শিশু নাবী (সাঃ)-কে সেই আসন থেকে নামানোর চেষ্টা করা হলে তিনি বলতেন, ‘ওকে তোমরা এ আসন থেকে নামানোর চেষ্টা করো না, ওকে ছেড়ে দাও। কারণ, আল্লাহর শপথ! এ শিশুকে সাধারণ শিশু বলে মনে হয় না। ও হচ্ছে ভিন্ন রকমের এক শিশু, অনন্য এক ব্যক্তিত্ব’। তারপর তাঁকে নিজের কাছেই বসিয়ে নিতেন সে আসনে, তাঁর গায়ে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে সোহাগ করতেন এবং তাঁর চাল-চলন ও কাজকর্ম দেখে আনন্দ প্রকাশ করতেন।[1]
নাবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর বয়স যখন আট বছর দু’মাস দশ দিন তখন তাঁর দাদা আব্দুল মুত্তালিব মৃত্যুবরণ করলেন। নাবী (সাঃ) এ দুঃখ-শোকের মুহূর্তে দুঃখ-বেদনার বোঝা লাঘব করতে এগিয়ে এলেন চাচা আবূ ত্বালিব। হৃষ্টচিত্তে তিনি আপন কাঁধে তুলে নিলেন বালক মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর লালন-পালনের সকল দায়িত্ব। বৃদ্ধ আব্দুল মুত্তালিব মৃত্যুর আগে আবূ তালেবকে সেই অসিয়তই করে গিয়েছিলেন।[2]
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৬৬ পৃঃ।
[2] তাকীহুল ফোহুম ৭ পৃঃ এবং ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৪৯ পৃঃ।
স্নেহশীল পিতৃব্যের তত্ত্বাবধানে (إِلٰى عَمِّهِ الشَّفِيْقِ):
পিতার অন্তিম অসিয়তের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আবূ ত্বালিব অত্যন্ত যত্নসহকারে ভ্রাতুষ্পুত্র ও ভবিষ্যতের নাবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে লালন-পালন করতে থাকেন। আবূ ত্বালিব তাঁকে যে আপন সন্তানাদির অন্যতম হিসেবে লালন-পালন করতে থাকেন তা-ই নয়, বরং নিজ সন্তানের চেয়ে অধিক স্নেহ-মমতা দিয়েই তাঁকে প্রতিপালন করতে থাকেন। অধিকন্তু, পিতা আব্দুল মুত্তালিবের মতই তিনিও তাঁকে নানাভাবে সম্মান প্রদর্শন করতে থাকেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত এভাবে তিনি বিচক্ষণ চাচার অধীনে লালিত-পালিত হতে থাকেন। তাঁর চাচার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ঘটনাবলী প্রসঙ্গক্রমে পরবর্তী পর্যায়ে আলোচনা করা হবে।
ফুটনোটঃ
চেহারা মুবারক হতে রহমত বর্ষণের অন্বেষণ (يُسْتَسْقَى الْغَمَامُ بِوَجْهِهِ):
ইবনে আসাকের, জালহুমাহ বিন ‘উরফুতাহ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, ‘আমি একবার মক্কায় আগমন করলাম। দুর্ভিক্ষের কারণে মানুষ তখন অত্যন্ত নাজেহাল এবং সংকটাপন্ন অবস্থায় নিপতিত ছিলেন। কুরাইশগণ আবূ ত্বালিবকে বললেন, ‘হে আবূ ত্বালিব! আরববাসীগণ দুর্ভিক্ষজনিত চরম আকালের সম্মুখীন হয়েছেন। চলুন সকলে বৃষ্টির জন্য আল্লাহ তা‘আলার নিকটে দু‘আ করি’’। এ কথা শ্রবণের পর আবূ ত্বালিব এক বালককে (বালক নাবী (সাঃ))-কে সঙ্গে নিয়ে বাহির হলেন। ঐ বালককে আকাশে মেঘাচ্ছন্ন এমন এক সূর্য বলে মনে হচ্ছিল যা থেকে ঘন মেঘমালা যেন এখনই আলাদা হয়ে গেল। সেই বালকের আশপাশে আরও অন্যান্য বালকও ছিল, কিন্তু এ বালকটির মুখমন্ডল থেকে এ বৈশিষ্ট্য যেন ছড়িয়ে পড়ছিল।
আবূ ত্বালিব সে বালককে হাত ধরে কাবা গৃহের নিকট নিয়ে গেলেন এবং ক্বাবা’হর দেয়ালের সঙ্গে তাঁর পিঠ লাগিয়ে তাঁকে দাঁড়িয়ে থাকতে বললেন। বালক তাঁর চাচার হাতের আঙ্গুল ধরে দাঁড়িয়ে থাকলেন। সে সময় আকাশে এক টুকরো মেঘও ছিল না। অথচ কিছুক্ষণের মধ্যেই মেঘে মেঘে আকাশ ছেয়ে গিয়ে আঁধার ঘনিয়ে এল এবং মুষল ধারে বৃষ্টিপাত শুরু হল। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এত বেশী হল যে উপত্যকায় প্লাবনের সৃষ্টি হয়ে গেল এবং এর ফলে শহর ও মরু অঞ্চল পুনরায় সতেজ-সজীব হয়ে উঠল। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আবূ ত্বালিব মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর যে প্রশংসা গীতি গেয়েছিলেন তা হচ্ছে:
وأبيضَ يُستسقى الغَمَام بوجهه ** ثِمالُ اليتامى عِصْمَةٌ للأرامل
অর্থঃ ‘তিনি অত্যন্ত সৌন্দর্যমন্ডিত। তাঁর চেহারা মুবারক দ্বারা রহমতের বৃষ্টি অন্বেষণ করা হয়ে থাকে। তিনি ইয়াতিমদের আশ্রয়স্থল এবং স্বামী হারাদের রক্ষক।’[1]
ফুটনোটঃ[1] শাইখ আব্দুল্লাহ মুখতাসারুস সীরাহ ১৫ ও ৬ পৃষ্ঠা।
বাহীরা রাহেব (بَحِيرَى الرَّاهِب):
কথিত আছে যে, (এ বর্ণনা সূত্র কিছুটা সন্দেহযুক্ত) নাবী (সাঃ)-এর বয়স যখন বার বছর (ভিন্ন এক বর্ণনায় বার বছর দু’মাস দশদিন)[1] সেই সময়ে ব্যবসা উপলক্ষে চাচা আবূ ত্বালীবের সঙ্গে তিনি শাম দেশে (সিরিয়া) গমন করেন এবং সফরের এক পর্যায়ে বসরায় গিয়ে উপস্থিত হন। বসরা ছিল শাম রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত একটি স্থান এবং হুরানের কেন্দ্রীয় শহর। সে সময় তা আরব উপদ্বীপের রোমীয়গণের আয়ত্বাধীন রাষ্ট্রের রাজধানী ছিল। এ শহরে জারজিস নামক একজন খ্রীষ্টান ধর্মযাজক (রাহেব) বসবাস করতেন। তাঁর উপাধি ছিল বাহীরা এবং এ উপাধিতেই তিনি সকলের নিকট পরিচিত এবং প্রসিদ্ধ ছিলেন। মক্কার ব্যবসায়ী দল যখন বসরায় শিবির স্থাপন করেন তখন রাহেব গীর্জা থেকে বেরিয়ে তাঁদের নিকট আগমন করেন এবং আতিথেয়তায় আপ্যায়িত করেন। অথচ এর আগে কখনও তিনি এভাবে গীর্জা থেকে বেরিয়ে কোন বাণিজ্য কাফেলার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন নি। তিনি কিশোর নাবী (সাঃ)-এর অবয়ব, আচরণ এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য দেখে বুঝতে পারেন যে, ইনিই হচ্ছেন বিশ্বমানবের মুক্তির দিশারি আখেরী নাবী (সাঃ)। তারপর কিশোর নাবী (সাঃ)-এর হাত ধরে তিনি বলেন যে, ‘ইনি হচ্ছেন বিশ্ব জাহানের সরদার। আল্লাহ তাঁকে বিশ্ব জাহানের রহমত রূপী রাসূল মনোনীত করবেন।’
আবূ ত্বালিব এবং কুরাইশের লোকজন বললেন, ‘আপনি কিভাবে অবগত হলেন যে, তিনিই হবে আখেরী নাবী?’ বাহীরা বললেন, ‘গিরি পথের ঐ প্রান্ত থেকে তোমাদের আগমন যখন ধীরে ধীরে দৃষ্টিগোচর হয়ে আসছিল আমি প্রত্যক্ষ করলাম যে, সেখানে এমন কোন বৃক্ষ কিংবা প্রস্তরখন্ড ছিল না যা তাঁকে সিজদা করে নি। এ সকল জিনিস নাবী-রাসূল ছাড়া সৃষ্টিরাজির অন্য কাউকেও কখনো সিজদা করে না। অধিকন্তু, ‘মোহরে নবুওয়াত’ দেখেও আমি তাঁকে চিনতে পেরেছি। তাঁর কাঁধের নীচে কড়ি হাড্ডির পাশে সেব ফলের আকৃতি বিশিষ্ট একটি দাগ রয়েছে, সেটাই হচ্ছে ‘মোহরে নবুওয়াত’। আমাদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেল সূত্রে আমরা এ সব কিছু অবগত হতে পেরেছি।’ অতঃপর তিনি তাদেরকে আতিথেয়তায় আপ্যায়িত করেন।
এরপর বাহীরা আবূ ত্বালিবকে বললেন, ‘এঁকে সঙ্গে নিয়ে আর বিদেশ ভ্রমণ করবেন না। শীঘ্রই একে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যান। কারণ, এর পরিচয় অবগত হলে ইহুদী ও রুমীগণ এঁকে হত্যা করে ফেলতে পারে।
এ কথা জানার পর আবূ ত্বালিব তাঁকে কয়েকজন গোলামের সাথে মক্কা ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।[2]
ফুটনোটঃ[1] একথা ইবনে জাওযী তালকিহুল ফোহুম ৭ পৃঃ।
[2] মুখতাসারুস সীরাহ ১৬ পৃঃ, ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৮০-১৮৩ পৃঃ। তিরমিযী ও অন্যান্য বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে যে বিলাল (রাঃ)-এর সাথে তাঁকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তা ছিল ভুল। কেন না তখনো বিলালের জন্ম হয়নি। আর জন্ম হয়ে থাকলে আবূ তালিব আবূ বকর (রাঃ)-এর সঙ্গে ছিলেন না। যাদুল মা’আদ ১/১৭।
ফিজার যুদ্ধ (حرب الفجار او حرب الفجار):
নাবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর বয়স যখন বিশ বছর তখন ওকায বাজারে একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধের একপক্ষে ছিলেন কুরাইশগণ এবং তাঁদের মিত্র বনু কিনানাহ। বিপক্ষে ছিলেন ক্বায়স আয়লান। এ যুদ্ধ ‘ফিজার যুদ্ধ’ হিসেবে খ্যাত। কেননা বনু কিনানাহর বার্রায নামে এক ব্যক্তি ক্বায়স আয়লানের তিন লোককে হত্যা করে। এ খবর ওকাযে পৌছলে উভয় দলের মাঝে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে যুদ্ধ বেধে যায়। কুরাইশ-কিনানা মিত্রপক্ষের সেনাপতি ছিলেন হারব বিন উমাইয়া। কারণ, প্রতিভা এবং প্রভাব-প্রতিপত্তির ফলে তিনি কুরাইশ ও কিনানাহ গোত্রের মধ্যে নিজেকে মান-মর্যাদার উচ্চাসনে প্রতিষ্ঠিত করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রথম দিকে কিনানাহদের উপর ক্বায়সদের সমর্থন ছিল বেশী, কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে কিনানাহদেরই সমর্থন হয়ে যায় বেশী। অতঃপর কুরাইশের কতক ব্যক্তি উভয় পক্ষের নিহতদের বিষয়ে সমঝোতার লক্ষ্যে সন্ধির প্রস্তাব দেন এবং বলেন যে, কোন পক্ষে বেশি নিহত থাকলে অতিরিক্ত নিহতের দিয়াত গৃহীত হবে। এতে উভয়পক্ষ সম্মত হয়ে সন্ধি করে এবং যুদ্ধ পরিত্যাগ করে পরষ্পর শত্রুতা বিদ্বেষ ভুলে যায়। একে ফিজার যুদ্ধ এ জন্যই বলা হয় যে, এতে নিষিদ্ধ বস্তুসমূহ এবং পবিত্র মাসের পবিত্রতা উভয়ই বিনষ্ট করা হয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কিশোর বালক অবস্থায় এ যুদ্ধে গমন করেছিলেন। এ যুদ্ধে তিনি তীরের আঘাত থেকে তাঁর চাচাদের রক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিলেন।[1]।
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, কালবে জাযীরাতুল আরব ৩২০ পৃঃ এবং তারীখে খুযরী ১ম খন্ড ৬৩ পৃঃ।
হিলফুল ফুযূল বা ন্যায়নিষ্ঠার প্রতিজ্ঞা (حِلْفُ الْفُضُوْلِ):
ফিজার যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা ও ভয়াবহতা সুচিন্তাশীল ও সদিচ্ছাপরায়ণ আরববাসীগণকে দারুণভাবে বিচলিত করে তোলে। এ যুদ্ধে কত যে প্রাণহানি ঘটে, কত শিশু ইয়াতীম হয়, কত নারী বিধবা হয় এবং কত সম্পদ বিনষ্ট হয় তার ইয়ত্তা করা যায় না। ভবিষ্যতে আরববাসীগণকে যাতে এ রকম অর্থহীন যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে না হয় সে জন্য আরবের বিশিষ্ট গোত্রপতিগণ আব্দুল্লাহ বিন জুদয়ান তাইমীর গৃহে একত্রিত হয়ে আল্লাহর নামে একটি অঙ্গীকারনামা সম্পাদনা করেন। আব্দুল্লাহ বিন জুদ’আন ছিলেন তৎকালীন মক্কার একজন অত্যন্ত ধণাঢ্য ব্যক্তি। অধিকন্তু, সততা, দানশীলতা এবং অতিথি পরায়ণতার জন্য সমগ্র আরবভূমিতে তাঁর বিশেষ প্রসিদ্ধি থাকার কারণে আবরবাসীগণের উপর তাঁর যথেষ্ট প্রভাবও ছিল। এ প্রেক্ষিতেই তাঁর বাড়িতেই অঙ্গীকারনামা সম্পাদনের এ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়।
যে সকল গোত্র আলোচনা বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন তার মধ্যে প্রধান গোত্রগুলো হচ্ছে বনু হাশিম, বনু মুত্তালিব, বনু আসাদ বিন আব্দুল উযযা, বনু যুহরা বিন কিলাব এবং বনু তামীম বিন মুররাহ। বৈঠকে একত্রিত হয়ে সকলে যাবতীয় অন্যায়, অনাচার এবং অর্থহীন যুদ্ধ-বিগ্রহের প্রতিকার সম্পর্কে আলাপ আলোচনা করেন। তখনকার সময়ে নিয়ম ছিল গোত্রীয় কিংবা বংশীয় কোন ব্যক্তি, আত্মীয়-স্বজন অথবা সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ কোন ব্যক্তি শত অন্যায়-অনাচার করলেও সংশ্লিষ্ট সকলকে তাঁর সমর্থন করতেই হবে তা সে যত বড় বা বীভৎস অন্যায় হোক না কেন। এ পরামর্শ সভায় এটা স্থিরীকৃত হয় যে, এ জাতীয় নীতি হচ্ছে ভয়ংকর অন্যায়, অমানবিক ও অবমাননাকর। কাজেই, এ ধরণের জঘন্য নীতি আর কিছুতেই চলতে দেয়া যেতে পারে না। তাঁরা প্রতিজ্ঞা করলেন:
(ক) দেশের অশান্তি দূর করার জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব।
(খ) বিদেশী লোকজনের ধন-প্রাণ ও মান-সম্ভ্রম রক্ষা করার জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব।
(গ) দরিদ্র, দুর্বল ও অসহায় লোকদের সহায়তা দানে আমরা কখনই কুণ্ঠাবোধ করব না।
(ঘ) অত্যাচারী ও অনাচারীর অন্যায়-অত্যাচার থেকে দুর্বল দেশবাসীদের রক্ষা করতে প্রাণপণ চেষ্টা করব।
এটা ছিল অন্যায় ও অনাচারের বিরুদ্ধে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য অঙ্গীকার নামা। এ জন্য এ অঙ্গীকারনামা ভিত্তিক সেবা সংঘের নাম দেয়া হয়েছিল ‘হিলফুল ফুযূল’ বা ‘হলফ-উল ফুযূল’।
একদা এ প্রসঙ্গের উল্লেখ কালে তিনি দৃপ্তকণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আজও যদি কোন উৎপীড়িত ব্যক্তি বলে, ‘হে, ফুযুল অঙ্গীকারনামার ব্যক্তিবৃন্দ! আমি নিশ্চয়ই তার সে আহবানে সাড়া দিব।
অধিকন্তু, এ ব্যাপারে অন্য এক প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘আব্দুল্লাহ বিন জুদ’আনের বাসভবনে আমি এমন এক অঙ্গীকারনামায় শরীক ছিলাম যার বিনিময়ে আমি আসন্ন প্রসবা উটও পছন্দ করি না এবং যদি ইসলামের যুগে এরূপ অঙ্গীকারের জন্য আমাকে আহবান জানানো হয় তাহলেও ‘আমি উপস্থিত আছি কিংবা প্রস্তুত আছি’ বলতাম।[1]
‘হলফ-উল-ফুযুল’ প্রতিষ্ঠার অন্য একটি প্রাসঙ্গিক প্রত্যক্ষ পটভূমির কথাও জানা যায় এবং তা হচ্ছে, জুবাইদ নামক একজন লোক মক্কায় এসেছিলেন কিছু মালপত্র নিয়ে ব্যবসার উদ্দেশ্যে। আস বিন ওয়ায়িল সাহমী তাঁর নিকট থেকে মালপত্র ক্রয় করেন কিন্তু তাঁর প্রাপ্য তাঁকে না দিয়ে তা আটক রাখেন। এ ব্যাপারে তাঁকে সাহায্যের জন্য তিনি আব্দুদ্দার, মাখযুম, জুমাহ, সাহম এবং আদী এ সকল গোত্রের নিকট সাহায্যের আবেদন জানান। কিন্তু তাঁর আবেদনের প্রতি কেউই কর্ণপাত না করায় তিনি জাবালে আবূ কুবাইশ পর্বতের চূড়ায় উঠে উচ্চ কণ্ঠে কিছু কবিতা আবৃত্তি করেন যার মধ্যে তাঁর নিজের অত্যাচার-উৎপীড়নের মুখোমুখি হওয়ার বিষয়টিও বর্ণিত ছিল। আবৃত্তি শ্রবণ করে জুবাইর বিন আব্দুল মুত্তালিব দৌড়ে গিয়ে বলেন, ‘এ লোকটি অসহায় এবং সহায় সম্বলহীন কেন? তাঁরই অর্থাৎ জুবাইরের প্রচেষ্টায় উপরোক্ত গোত্রগুলো একত্রিত হয়ে একটি সন্ধিচুক্তি সম্পাদন করেন এবং পরে আস বিন ওয়ায়িলের নিকট থেকে জুবাইরের পাওনা আদায় করে দেয়া হয়।’[2]
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৩৩ ও ১৩৫ পৃঃ, মুখতাসারুস সীরাহ ৩০-৩১ পৃঃ।
[2] মুখতাসারুস সীরাহ ৩০-৩১ পৃঃ।
দুঃখময় জীবন যাপন (حَيَاةُ الْكَدْحِ):
নাবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর বাল্য, কৈশোর এবং প্রথম যৌবনে পেশাভিত্তিক সুনির্দিষ্ট কোন কাজ-কর্মের কথা পাওয়া যায় না। তবে নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে জানা যায় যে, বনু সা‘দ গোত্রে দুধমা’র গৃহে থাকাবস্থায় অন্যান্য বালকদের সঙ্গে ছাগল চরানোর উদ্দ্যেশে মাঠে গমন করতেন।[1] মক্কাতেও কয়েক কীরাত অর্থের বিনিময়ে তিনি ছাগল চরাতেন।[2]
অধিকন্তু, কৈশোরে চাচা আবূ ত্বালীবের সঙ্গে বাণিজ্য উপলক্ষে তিনি সিরিয়া গমন করেছিলেন। বর্ণিত আছে যে, তিনি (সাঃ) সায়িব বিন আবূ মাখযূমীর সাথে ব্যবসা করতেন এবং তিনি একজন ভাল অংশীদার ছিলেন। না তোষামোদী ছিলেন, না ঝগড়াটে ছিলেন। তিনি যখন মক্কা বিজয়ের সময় আগমন করেন তখন তাকে সাদর সম্ভাষন জানান এবং বললেন, হে আমার ভাই এবং ব্যবসায়ের অংশীদার।
তারপর যখন তিনি পঁচিশ বছর বয়সে পদার্পণ করেন তখন খাদীজাহ (রাঃ)-এর সম্পদ নিয়ে ব্যবসার উদ্দেশ্যে শাম দেশে গমন করেন। ইবনে ইসহাক্ব হতে বর্ণিত আছে যে, খাদীজাহ (রাঃ) বিনতে খুওয়াইলিদ এক সম্ভ্রান্ত সম্পদশালী ও ব্যবসায়ী মহিলা ছিলেন। ব্যবসায়ে অংশীদারিত্ব এবং প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী লভ্যাংশের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে তিনি ব্যবসায়ীগণের নিকট অর্থলগ্নী করতেন। পুরো কুরাইশ গোত্রই জীবন জীবিকার জন্য ব্যবসা-বাণিজ্যে লিপ্ত থাকতেন। যখন খাদীজাহ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সত্যবাদিতা, উত্তম চরিত্র, সদাচার এবং আমানত হেফাজতের নিশ্চয়তা সম্পর্কে অবগত হলেন তখন তিনি মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নিকট এক প্রস্তাব পেশ করলেন যে, তিনি তাঁর অর্থ নিয়ে ব্যবসার উদ্দেশ্যে তাঁর দাস মায়সারার সঙ্গে শাম দেশে গমন করতে পারেন। তিনি স্বীকৃতিও প্রদান করেন যে, অন্যান্য ব্যবসায়ীগণকে যে হারে লভ্যাংশ বা মুনাফা প্রদান করা হয় তাঁকে তার চাইতে অধিকমাত্রায় মুনাফা প্রদান করা হবে। মুহাম্মাদ (সাঃ) এ প্রস্তাব গ্রহণ করলেন এবং তার অর্থ সম্পদ নিয়ে দাস মায়সারার সঙ্গে শাম দেশে গমন করলেন।[3]
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৬৬ পৃঃ।
[2] সহীহুল বুখারী, আল এজারত্ব বাবু রাইল গানামে আলা কাবারিতা ১ম খন্ড ৩০১ পৃঃ।
[3] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৮৭-১৮৮ পৃঃ।
খাদীজাহ (রাঃ) এর সঙ্গে বিবাহ (زِوَاجُهُ بِخَدِيْجَةَ):
সিরিয়া থেকে যুবক নাবী (সাঃ)-এর প্রত্যাবর্তনের পর ব্যবসা বাণিজ্যের খতিয়ান করা হল। হিসাব নিকাশ করে আমানতসহ এত বেশী পরিমাণ অর্থ তিনি পেলেন ইতোপূর্বে কোন দিনই তা পাননি। এতে খাদীজাহ (সাঃ)-এর অন্তর তৃপ্তির আমেজে ভরে ওঠে। অধিকন্তু, তাঁর দাস মায়সারার কথাবার্তা থেকে মুহাম্মাদ (সাঃ) মিষ্টভাষিতা, সত্যবাদিতা, উন্নত চিন্তা-ভাবনা, আমানত হেফাজত করার ব্যাপারে একাগ্রতা ইত্যাদি বিষয় অবগত হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাবোধ ক্রমেই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে থাকে এবং তাঁকে পতি হিসেবে পাওয়ার একটা গোপন বাসনা ক্রমেই তাঁর মনে দানা বেঁধে উঠতে থাকে। এর পূর্বে বড় বড় সরদার, নেতা ও প্রধানগণ অনেকেই তাঁর নিকট বিয়ের প্রস্তাব পাঠান কিন্তু তিনি কোনটিই মঞ্জুর করেন নি। অথচ মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে স্বামী রূপে পাওয়ার জন্য তিনি যার পরনাই ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। তিনি নিজ অন্তরের গোপন বাসনা ও ব্যাকুলতার কথা তাঁর বান্ধবী নাফীসা বিনতে মুনাবিবহ এর নিকট ব্যক্ত করলেন এবং বিষয়টি নিয়ে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর সঙ্গে আলোচনা করার জন্য তাঁকে অনুরোধ জানালেন। নাফীসা খাদীজাহ (রাঃ)-এর প্রস্তাব সম্পর্কে নাবী কারীম (সাঃ)-এর সঙ্গে আলোচনা করলেন। নাবী কারীম (সাঃ) এ প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করে বিষয়টি চাচা আবূ ত্বালীবের সঙ্গে আলোচনা করলেন। আবূ ত্বালিব এ ব্যাপারে খাদীজাহ (রাঃ)-এর পিতৃব্যের সঙ্গে আলোচনার পর বিয়ের প্রস্তাব পেশ করেন এবং এক শুভক্ষণে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহপ্রাপ্ত দুইটি প্রাণ বিশ্বমানবের অনুকরণ ও অনুসরণযোগ্য পবিত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যান। বিবাহ অনুষ্ঠানে বনু হাশিম ও মুযারের প্রধানগণ উপস্থিত থেকে অনুষ্ঠানের সৌষ্ঠব বৃদ্ধি করেন।
নাবী কারীম (সাঃ) এবং খাদীজাহ (রাঃ)-এর মধ্যে শুভ বিবাহপর্ব অনুষ্ঠিত হয় শাম দেশ থেকে প্রত্যাবর্তনের দু’মাস পর। তিনি সহধর্মিনী খাদীজাহকে মোহরানা স্বরূপ ২০টি উট প্রদান করেন। ঐ সময় খাদীজাহ (রাঃ)-এর বয়স হয়েছিল ৪০ বছর। বংশ-মর্যাদা, সহায়-সম্পদ, বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সমাজের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়া। তিনি ছিলেন উত্তম চরিত্রের এক অনুপমা মহিলা এবং নাবী কারীম (সাঃ)-এর প্রথমা সহধর্মিনী। তাঁর জীবদ্দশায় তিনি আর অন্য কোন মহিলাকে বিবাহ করেন নাই।[1]
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সন্তানদের মধ্যে ইবরাহীম ব্যতীত অন্যান্য সকলেই ছিলেন খাদীজাহ (রাঃ)-এর গর্ভজাত সন্তান। নাবী দম্পতির প্রথম সন্তান ছিলেন কাসেম, তাই উপনাম হয় ‘আবুল কাসেম’। তারপর যথাক্রমে জন্মগ্রহণ করেন যায়নাব, রুকাইয়্যাহ, উম্মে কুলসুম, ফাত্বিমাহ ও আব্দুল্লাহ। আব্দুল্লাহর উপাধি ছিল ‘ত্বাইয়িব’ এবং ‘ত্বাহির’।
নাবী কারীম (সাঃ)-এর সকল পুত্র সন্তানই বাল্যাবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তবে কন্যাদের মধ্যে সকলেই ইসলামের যুগ পেয়েছেন, মুসলিম হয়েছেন এবং মুহাজিরের মর্যাদাও লাভ করেছেন। কিন্তু ফাত্বিমাহ (রাঃ) ব্যতীত কন্যাগণ সকলেই পিতার জীবদ্দশাতেই মৃত্যু বরণ করেন। ফাত্বিমাহ (রাঃ)-এর মৃত্যু হয়েছিল নাবী কারীম (সাঃ)-এর ছয় মাস পর।[2]
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৮৯-১৯০ পৃঃ। ফিক্বহুস সীরাহ ৫৯ পৃঃ ও তালকিহুল ফোহুম ৭ পৃঃ।
[2] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৯০-১৯১ পৃঃ, ফিক্বহুস সীরাহ ৬০ পৃঃ। ফাতহুল বারী ৭ম খন্ড ১৫০ পৃঃ। তারীখের বই সমূহে কিছু মতভেদের কথা উলেখিত হয়েছে। তবে আমার নিকট যা অধিক গ্রহণযোগ্য তা এখানে লিপিবদ্ধ করলাম।
ক্বাবা’হ গৃহ পুনঃ নির্মাণ এবং হজরে আসওয়াদ সম্পর্কিত বিবাদ মীমাংসা (بِنَاءُ الْكَعْبَةِ وَقَضِيَّةُ التَّحْكِيْمِ):
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন পঁয়ত্রিশ বছরে পদার্পণ করেন তখন কুরাইশগণ ক্বাবা’হ গৃহের পুনঃনির্মাণ কাজ আরম্ভ করেন। কারণ, ক্বাবা’হ গৃহের স্থানটি চতুর্দিকে দেয়াল দ্বারা পরিবেষ্টিত অবস্থায় ছিল মাত্র। দেয়ালের উপর কোন ছাদ ছিল না। এ অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করে কিছু সংখ্যক চোর এর মধ্যে প্রবেশ করে রক্ষিত বহু মূল্যবান সম্পদ এবং অলঙ্কারাদি চুরি করে নিয়ে যায়। ইসমাঈল (আঃ)-এর আমল হতেই এ ঘরের উচ্চতা ছিল ৯ হাত।
গৃহটি বহু পূর্বে নির্মিত হওয়ার কারণে দেয়ালগুলোতে ফাটল সৃষ্টি হয়ে যে কোন মুহূর্তে তা ভেঙ্গে পড়ার মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। তাছাড়া সেই বছরেই মক্কা প্লাবিত হয়ে যাওয়ার কারণে ক্বাবা’হমুখী জলধারা সৃষ্টি হয়েছিল। তাছাড়া প্রবাহিত হওয়ায় ক্বাবা’হগৃহের দেওয়ালের চরম অবনতি ঘটে এবং যে কোন মুহূর্তে তা ধ্বসে পড়ার আশঙ্কা ঘণীভূত হয়ে ওঠে। এমন এক নাজুক অবস্থার প্রেক্ষাপটে কুরাইশগণ সংকল্পবদ্ধ হলেন ক্বাবা’হ গৃহের স্থান ও মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার উদ্দেশ্যে তা পুনঃনির্মাণের জন্য।
ক্বাবা’হ গৃহ নির্মাণের উদ্দেশ্যে সকল গোত্রের কুরাইশগণ একত্রিত হয়ে সম্মিলিতভাবে কতিপয় নীতি নির্ধারণ করে নিলেন। সেগুলো হচ্ছে যথাক্রমেঃ ক্বাবা’হ গৃহ নির্মাণ করতে গিয়ে শুধুমাত্র বৈধ অর্থ-সম্পদ (হালাল) ব্যবহার করা হবে। এতে বেশ্যাবৃত্তির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ, সুদের অর্থ এবং হক নষ্ট করে সংগৃহীত হয়েছে এমন কোন অর্থ নির্মাণ কাজে ব্যবহার করা চলবে না। এ সকল নীতির প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন করে নির্মাণ কাজ আরম্ভ করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা হল।
নতুন ইমারত তৈরির জন্য পুরাতন ইমারত ভেঙ্গে ফেলা প্রয়োজন। কিন্তু আল্লাহর ঘর ভেঙ্গে ফেলার কাজে হাত দিতে কারো সাহস হচ্ছে না, অবশেষে ওয়ালীদ বিন মুগীরাহ মাখযুমী সর্বপ্রথম ভাঙ্গার কাজে হাত দিলেন এবং অন্যেরা ভীত-সম্ভ্রন্ত চিত্তে তা প্রত্যক্ষ করতে থাকলেন। কিন্তু কিছু অংশ ভেঙ্গে ফেলার পরও যখন তাঁরা দেখলেন যে তাঁর উপর কোন বিপদ আপদ আসছে না তখন সকলেই ভাঙ্গার কাজে অংশ গ্রহণ করলেন। যখন ইবরাহীম (আঃ)-এর ভিত্তি পর্যন্ত ভেঙ্গে ফেলা হল তখন নির্মাণ কাজ শুরু হল। প্রত্যেক গোত্র যাতে নির্মাণ কাজে অংশ গ্রহণের সুযোগ লাভ করে তজ্জন্য কোন্ গোত্র কোন্ অংশ নির্মাণ করবেন পূর্বাহ্নেই তা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এ প্রেক্ষিতে প্রত্যেক গোত্রই ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রস্তর সংগ্রহ করে রেখেছিলেন। বাকূম নামক একজন রুমীয় মিস্ত্রির তত্ত্বাবধানে নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলছিল। নির্মাণ কাজ যখন কৃষ্ণ প্রস্তরের স্থান পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছল তখন নতুনভাবে এক সমস্যার সৃষ্টি হল। সমস্যাটি হল ‘হাজারে আসওয়াদ’ তথা ‘কৃষ্ণ প্রস্তর’টি স্থাপন করার মহা গৌরব অর্জন করবেন তা নিয়ে। এ ব্যাপারে ঝগড়া ও কথা কাটাকাটি চার বা পাঁচ দিন চললো।
সকলেই নিজে বা তাঁর গোত্র কৃষ্ণ প্রস্তরটি যথাস্থানে স্থাপন করার দাবীতে অনড়। সকলেরই এক কথা, এ কাজটি তাঁরাই করবেন। কেউই সামান্য ছাড় দিতেও তৈরি নন। সকলেরই একই কথা, একই জেদ। জেদ ক্রমান্বয়ে রূপান্তরিত হল রেষারেষিতে। রেষারেষির পরবর্তী পর্যায় হচ্ছে রক্তারক্তি। এ ব্যাপারে রক্তারক্তি করতেও তাঁরা পিছপা হবেন না। সকল গোত্রের মধ্যেই চলছে সাজ সাজ রব। শুরু হয়েছে অস্ত্রের মহড়া। একটু নরমপন্থীগণ সকলেই আতঙ্কিত কখন যে যুদ্ধ বেধে যায় কে তা জানে।
এমন বিভীষিকাময় এক অবস্থার প্রেক্ষাপটে বর্ষীয়ান নেতা আবু্ উমাইয়া মাখযূমী এ সমস্যা সমাধানের একটি সূত্র খুঁজে পেলেন। তিনি সকলকে লক্ষ্য করে প্রস্তাব করলেন যে, আগামী কাল সকালে যে ব্যক্তি সর্ব প্রথম মসজিদুল হারামে প্রবেশ করবেন তাঁর উপরেই এ বিবাদ মীমাংসার দায়িত্ব অর্পণ করা হোক। সকলেই এ প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করলেন। আল্লাহর কী অপার মহিমা! দেখা গেল সকল আরববাসীর প্রিয়পাত্র ও শ্রদ্ধেয় আল-আমিনই সর্ব প্রথম মসজিদুল হারামে প্রবেশ করেছেন। নাবী কারীম (সাঃ)-এর এভাবে আসতে দেখে সকলেই চিৎকার করে বলে উঠল :
هٰذَا الْأَمِيْنُ، رَضَيْنَاهُ، هٰذَا مُحَمَّدٌ،
আমাদের বিশ্বাসী, আমরা সকলেই এর উপর সন্তুষ্ট, তিনিই মুহাম্মাদ (সাঃ)।
তারপর নাবী কারীম (সাঃ) যখন তাঁদের নিকটবর্তী হলেন তখন ব্যাপারটি সবিস্তারে তাঁর নিকট পেশ করা হল। তখন তিনি এক খানা চাদর চাইলেন। তাঁকে চাদর দেয়া হলে তিনি মেঝের উপর তা বিছিয়ে দিয়ে নিজের হাতে কৃষ্ণ প্রস্তরটি তার উপর স্থাপন করলেন এবং বিবাদমান গোত্রপতিগণকে আহবান জানিয়ে বললেন, ‘আপনারা সকলে চাদরের পার্শ্ব ধরে উত্তোলন করুন। তাঁরা তাই করলেন। চাদর যখন কৃষ্ণ প্রস্তর রাখার স্থানে পৌছল তখন তিনি স্বীয় মুবারক হস্তে কৃষ্ণ প্রস্তরটি উঠিয়ে যথাস্থানে রেখে দিলেন। এ মীমাংসা সকলেই হৃষ্টচিত্তে মেনে নিলেন। অত্যন্ত সহজ, সুশৃঙ্খল এবং সঙ্গত পন্থায় জ্বলন্ত একটি সমস্যার সমাধান হয়ে গেল।
এ দিকে কুরাইশগণের নিকট বৈধ অর্থের ঘাটতি দেখা দিল। এ জন্যই উত্তর দিক হতে ক্বাবা’হ গৃহের দৈর্ঘ আনুমানিক ছয় হাত পর্যন্ত কমিয়ে দেয়া হল। এ অংশটুকুই ‘হিজর’ ‘হাতীম’ নামে প্রসিদ্ধ। এবার কুরাইশগণ ক্বাবা’হর দরজা ভূমি হতে বিশেষভাবে উঁচু করে দিলেন যেন এর মধ্য দিয়ে সেই ব্যক্তি প্রবেশ করতে পারে যাকে তাঁরা অনুমতি দেবেন। যখন দেয়ালগুলো পনের হাত উঁচু হল তখন গৃহের অভ্যন্তর ভাগে ছয়টি পিলার বা স্তম্ভ নির্মাণ করা হল এবং তার উপর ছাদ দেয়া হল। ক্বাবা’হ গৃহের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলে একটি চতুর্ভূজের রূপ ধারণ করল। বর্তমানে ক্বাবা’হ গৃহের উচ্চতা হচ্ছে পনের মিটার। কৃষ্ণ প্রস্তর বিশিষ্ট দেয়াল এবং তার সামনের দেয়াল অর্থাৎঃ দক্ষিণ ও উত্তর দিকের দেয়াল হচ্ছে দশ দশ মিটার। কৃষ্ণ প্রস্তর মাতাফের জায়গা হতে দেড় মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। দরজা বিশিষ্ট দেয়াল এবং এর সাথে সামনের দেয়াল অর্থাৎ পূর্ব এবং পশ্চিম দিকের দেয়াল বার মিটার করে। দরজা রয়েছে মেঝে থেকে দু’মিটার উঁচুতে। দেয়ালের পাশেই চতুর্দিকে নীচু জায়গা এক বৃদ্ধিপ্রাপ্ত চেয়ার সমতুল্য অংশ দ্বারা পরিবেষ্টিত আছে যার উচ্চতা পঁচিশ সেন্টিমিটার এবং গড় প্রস্থ ত্রিশ সেন্টিমিটার। একে শাজে বওয়া (চলন্ত দুর্লভ) বলা হয়। এটাও হচ্ছে প্রকৃত পক্ষে বায়তুল্লাহর অংশ। কিন্তু কুরাইশগণ এটাও ছেড়ে দিয়েছিলেন।[1]
ফুটনোটঃ[1] বিস্তারিত জানার জন্য দ্রষ্ঠব্য ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৯২-১৯৭ পৃঃ ফিক্বহুস সীরাহ ৬২ পৃঃ সহীহুল বুখারী মক্কার ফযীলত অধ্যায় ১ম খন্ড ২১৫ পৃঃ, তারীখে খুযরী ১ম খন্ড ৬৪-৬৫ পৃঃ।
নবুওয়াত লাভের পূর্বকালীন সংক্ষিপ্ত চরিত্র (السِّيْرَةُ الْإِجْمَالِيَّةُ قَبْلَ النُّبُوَّةِ) :
বিভিন্ন মানুষের জীবনের বিভিন্ন স্তরে ভিন্ন ভিন্নভাবে যে সকল সদগুণাবলির বিকাশ পরিলক্ষিত হয়ে থাকে সে সবগুলোর চরম উৎকর্ষ সাধন হয়েছিল রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর অস্তিত্বের সবটুকু জুড়ে। তিনি ছিলেন চিন্তা-চেতনার যথার্থতা, পারদর্শিতা এবং ন্যায় পরায়ণতার এক জ্বলন্ত প্রতীক। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে প্রদান করা হয়েছিল সুষমামন্ডিত দেহ সৌষ্ঠব, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, যাবতীয় জ্ঞানের পরিপূর্ণতা এবং উদ্দেশ্য সাধনে সাফল্য লাভের নিশ্চয়তা। তিনি দীর্ঘ সময় যাবৎ নীরবতা অবলম্বনের মাধ্যমে নিরবছিন্ন ধ্যান ও অনুসন্ধান কাজে রত থাকতে এবং বিষয়ের খুঁটিনাটি সম্পর্কে সুদূর প্রসারী চিন্তা ভাবনার মাধ্যমে ন্যায় ও সত্যের উদঘাটন করতে সক্ষম হতেন। তিনি তাঁর সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধি বিবেচনা এবং নির্ভুল নিরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার দ্বারা মানব সমাজের প্রকৃত অবস্থা, দল বা গোত্র সমূহের গতিবিধি ও মন-মানসিকতা, মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়গুলো অনুধাবনের মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হতেন। যার ফলে শত অন্যায়, অশ্লীলতা এবং অনাচার পরিবেষ্টিত সমাজে বসবাস করেও তিনি ছিলেন সবকিছুর উর্ধ্বে, সবকিছু থেকে মুক্ত ও পবিত্র। শরাবপায়ীদের সাথে বসবাস করেও কোনদিন তিনি শরাব স্পর্শ করেন নি, দেবদেবীর আস্তানায় যবেহকৃত পশুর গোশত্ তিনি কখনো খাননি এবং মূর্তির নামে অনুষ্ঠি কোন প্রকার খেলাধূলায় তিনি কখনো অংশ গ্রহণ করেননি।
জীবনের প্রথমস্তর থেকেই তিনি তৎকালীন সমাজে প্রচলিত যাবতীয় মিথ্যা উপাস্যকে ঘৃণা করতেন এবং সে ঘৃণার মাত্রা এতই অধিক ছিল যে, তাঁর দৃষ্টিতে আর অন্য কোন জিনিস এত নিন্দনীয় ও অপছন্দনীয় ছিল না। এমনকি লাত ও উযযার নামে শপথ করার ব্যাপারটি তাঁর কানে গেলে তিনি তা সহ্য করতেই পারতেন না।[1]
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যে আল্লাহর খাস রহমত, হেফাজত, রক্ষণাবেক্ষণ এবং প্রত্যক্ষ পরিচালনাধীনে লালিত পালিত, পরিচালিত এবং নিয়ন্ত্রিত হয়েছেন সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। অতএব, যখনই পার্থিব কোন ফায়দা লাভের দিকে প্রবৃত্তি আকৃষ্ট বা আকর্ষিত হয়েছে অথবা অপছন্দনীয় কিংবা অনুসরণীয় রীতিনীতি অনুসরণের প্রতি আখলাক আকৃষ্ট হয়েছে তখন আল্লাহ তা‘আলার প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রন সেখানে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইবনে আসীরের একটি বর্ণনা সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘আইয়ামে জাহেলিয়াতের লোকেরা যে সকল কাজ করেছে দু’বার ছাড়া আর কখনো সে ব্যাপারে আমার খেয়াল জাগেনি। কিন্তু সে দু’বারের বেলায় আল্লাহ তা‘আলা আমার এবং সে কাজের মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। এর পর কখনো সে ব্যাপার সম্পর্কে আমার কোন খেয়াল জন্মে নি যে পর্যন্ত না আল্লাহ তা‘আলা আমাকে পয়গম্বরীর মর্যাদা প্রদান করেছেন।
এ ঘটনা ছিল, যে বালকের সঙ্গে আমি মক্কার উপরিভাগে ছাগল চরাতাম এক রাত্রে তাকে বললাম, ‘তুমি আমার ছাগলগুলো একটু দেখাশোনা করো, আমি মক্কায় যাই এবং সেখানে অন্যান্য যুবকগণের মতো যৌবন সংশিষ্ট আবৃত্তি অনুষ্ঠানে যোগদান করি।’
সে বলল, ‘ঠিক আছে। এর পর আমি বাহির হলাম এবং তখনো মক্কার প্রথম ঘরের নিকটেই ছিলাম এমন সময় কিছু বাদ্য যন্ত্রের শব্দ এসে কানে পৌঁছল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথা থেকে বাদ্যযন্ত্রের এ শব্দ ভেসে আসছে?’
লোকেরা বলল, ‘অমুকের বিবাহ হচ্ছে, তারই বাজনা বাজছে’’। আমি সেই যন্ত্র সঙ্গীত শ্রবণের জন্য সেখানে বসে পড়লাম। অমনি আল্লাহ তা‘আলার নিয়ন্ত্রণ আমার শ্রবণ শক্তির উপর আরোপিত হল। তিনি আমার কর্ণের কাজ বন্ধ করে দিলেন এবং আমি সেখানে শুয়ে পড়লাম। তারপর সূর্যের তাপে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। তার পর আমি আমার সে বন্ধুর নিকট চলে গেলাম এবং তার জিজ্ঞাসার জবাবে ঘটনাটি তার নিকট বিস্তারিত বর্ণনা করলাম। এর পর আবার এক রাত্রি আমার বন্ধুর নিকট বসেছিলাম এবং মক্কায় পৌঁছে তদ্রুপ ঘটনার সম্মুখীন হলাম। তদন্তর আর কখনো অনুরূপ ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করি নি।[2]
সহীহুল বুখারীতে জাবির বিন আব্দুল্লাহ কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যে, যখন ক্বাবা’হ গৃহের নিমার্ণ কাজ চলছিল তখন নাবী কারীম (সাঃ) এবং আব্বাস (রাঃ) প্রস্তর বহন করে আনছিলেন। আব্বাস (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বললেন, ‘স্বীয় লুঙ্গি আপন কাঁধে রাখ তাহলে প্রস্তর বহন জনিত যন্ত্রণা থেকে মুক্ত থাকবে। কিন্তু তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন। তাঁর দৃষ্টি আকাশের দিকে উঠে গেল এবং তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। জ্ঞান ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে তিনি চিৎকার করতে লাগলেন, ‘আমার লুঙ্গি, আমার লুঙ্গি’’। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর লুঙ্গি বেঁধে দেয়া হল। অন্য বর্ণনা সূত্রে জানা যায় যে, এরপর তাঁর লজ্জাস্থান আর কোন দিনই দেখা যায় নি।[3]
নাবী কারীম (সাঃ)-এর কাজকর্ম ছিল সব চাইতে আকর্ষণীয়, চরিত্র ছিল সর্বোত্তম এবং মহানুভবতা ছিল সর্বযুগের সকলের জন্য অনুসরণ ও অনুকরণযোগ্য। তিনি ছিলেন সর্বাধিক শিষ্টাচারী, নম্র-ভদ্র, সদালাপী ও সদাচারী। তিনি ছিলেন সব চাইতে দয়াদ্র চিত্ত, দূরদর্শী, সূক্ষ্ণদর্শী ও সত্যবাদী। মিথ্যা কখনো তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। তাঁর সত্যবাদিতার জন্য তিনি এতই প্রসিদ্ধ এবং প্রশংসনীয় ছিলেন যে আরববাসীগণ সকলেই তাঁকে ‘আল-আমীন’ বলে আহবান জানাতেন।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ছিলেন আরববাসীগণের মধ্যে সব চাইতে নির্ভরযোগ্য আমানতদার। খাদীজাহ (রাঃ) সাক্ষ্য দিতেন যে, ‘তিনি অভাবগ্রস্তদের বোঝা বহন করতেন, নিঃস্ব ও অসহায়দের জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করতেন। ন্যায্য দাবীদারদের তিনি সহায়তা করতেন এবং অতিথি পরায়ণতার জন্য মশহুর ছিলেন।[4]
ফুটনোটঃ[1] বোহাযযার ঘটনায় এবং মুদ্রণে বিদ্যমান আছে। দ্রষ্ঠব্য ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১২৮ পৃঃ।
[2] হাদীসটি হাকিম ও যাহাবী বিশুদ্ধ বলেছেন। কিন্তু ইবনে কাসীর আল বেদায়া ও নেহায়া গ্রন্থে ২য় খন্ড ২৮৭ পৃঃ একে দুর্বল বলেছেন।
[3] সহীহুল বুখারী ক্বা‘বা নির্মাণ অধ্যায় ১ম খন্ড ৫৪০ পৃঃ।
[4] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৩ পৃষ্ঠা।
নবুয়াত প্রাপ্তি
হেরা গুহার অভ্যন্তরে (فِيْ غَارِ حِرَاءٍ):
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন চল্লিশে পদার্পণ করলেন, ঐ সময় তাঁর এত দিনের বিচার বিবেচনা, বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তা-ভাবনা যা জনগণ এবং তাঁর মধ্যে ব্যবধানের এক প্রাচীর সৃষ্টি করে চলেছিল তা উন্মুক্ত হয়ে গেল এবং ক্রমান্বয়ে তিনি নির্জনতা প্রিয় হয়ে উঠতে থাকলেন। খাবার এবং পানি সঙ্গে নিয়ে মক্কা নগরী হতে দু’মাইল দূরত্বে অবস্থিত হেরা পর্বত গুহায় গিয়ে ধ্যানমগ্ন থাকতে লাগলেন। এটা হচ্ছে ক্ষুদ্র আকার-আয়তনের একটি গুহা। এর দৈর্ঘ্য হচ্ছে চার গজ এবং প্রস্থ পৌনে দু’গজ। এর নীচ দিকটা তেমন গভীর ছিল না। একটি ছোট্ট পথের প্রান্তভাগে অবস্থিত পর্বতের উপরি অংশের একত্রে মিলে মিশে ঠিক এমন একটি আকার আকৃতি ধারণ করেছিল যা শোভাযাত্রার পুরোভাগে অবস্থিত আরোহী শূন্য সুসজ্জিত অশ্বের মতো দেখায়।
পুরো রমাযান রাসূলুল্লাহ (ষাঃ) হেরা গুনায় অবস্থান করে আল্লাহ তা’আলার ইবাদাত বন্দেগীতে লিপ্ত থাকেন। বিশ্বের দৃশ্যমান বস্তুনিচয়ের অন্তরাল থেকে যে মহাশক্তি প্রতিটি মুহুর্তে সকল কিছুকে জীবন, জীবিকা ও শক্তি জাগিয়ে চলেছেন, সেই মহা মহীয়ান ও গরীয়ান সত্ত্বার ধ্যানে মশগুল থাকতেন। স্বগোত্রীয় লোকদের অর্থহীন বহুত্ববাদী বিশ্বাস ও পৌত্তলিক ধ্যান-ধারণা তাঁর অন্তরে দারুন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করত। কিন্তু তাঁর সামনে এমন কোন পথ খোলা ছিল না যে পথ ধরে তিনি শান্তি ও স্বস্তির সঙ্গে পদচারণা করতে সক্ষম হতেন।[1]
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নির্জন-প্রিয়তা ছিল প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা‘আলার ব্যবস্থাপনার একটি অংশ।
এভাবে আল্লাহ তা‘আলা ভবিষ্যতের এক মহতী কর্মসূচীর জন্য তাঁকে প্রস্তুত করে নিচ্ছিলেন। যে আত্মার নসীবে নবুয়তরূপী এক মহান আসমানী নেয়ামত নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে এবং যিনি পথভ্রষ্ট ও অধঃপতিত মানুষকে সঠিকপথ নির্দেশনা দিয়ে করবেন ধন্য তাঁর জন্য যথার্থই প্রয়োজন সমাজ জীবনের যাবতীয় ব্যস্ততা, জীবন যাত্রা নির্বাহের যাবতীয় ঝামেলা এবং সমস্যা থেকে মুক্ত থেকে নির্জনতা অবলম্বনের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য লাভ করা। আল্লাহ তা‘আলা যখন মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে বিশ্বব্যবস্থায় সব চাইতে মর্যাদাশীল ও দায়িত্বশীল-আমানতদার মনোনীত করে তাঁর কাঁধে দায়িত্বভার অর্পণের মাধ্যমে বিশ্বমানবের জীবন বিধানের রূপরেখা পরিবর্তন এবং অর্থহীন আদর্শের জঞ্জাল সরিয়ে শাশ্বত আদর্শের আঙ্গিকে ইতিহাসের পরিমার্জিত ধারা প্রবর্তন করতে চাইলেন, তখন নবুয়ত প্রদানের প্রাককালে তাঁর জন্য একমাসব্যাপী নির্জনতা অবলম্বন অপরিহার্য করে দিলেন যাতে তিনি গভীর ধ্যানের সূত্র ধরে দিব্যজ্ঞান লাভের পথে অগ্রসর হতে সক্ষম হন। নির্জন হেরা গুহার সেই ধ্যানমগ্ন অবস্থায় তিনি বিশ্বের আধ্যাত্মিক জগতে পরিভ্রমণ করতেন এবং সকল অস্তিত্বের অন্তরালে লুক্কায়িত অদৃশ্য রহস্য সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা ও গবেষণা করতেন যাতে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে নির্দেশ আসা মাত্রই তিনি বাস্তবায়নের ব্যাপারে ব্রতী হতে পারেন।[2]
ফুটনোটঃ[1] আল্লামা সুলায়মান মানসুরপুরী, রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ১ম খন্ড ৪৭ পৃষ্ঠা, ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, ২৩৫ ও ২৩৬ পৃষ্ঠা। ফী যিলালিল কুরআন: ২৯/১৬৬ পৃষ্ঠা।
[2] ফী যিলালিল কুরআন: পারা ২৯, পৃষ্ঠা ১৬৬-১৬৭।
জিবরাঈল (আঃ)-এর আগমন (جِبْرِيْلٌ يَنْزِلُ بِالْوَحْيِ):
নাবী কারীম (সাঃ)-এর বয়সের ৪০তম বছর যখন পূর্ণ হল- এটাই হচ্ছে মানুষের পূর্ণত্ব প্রাপ্তির বয়স এবং বলা হয়েছে যে, এ বয়স হচ্ছে পয়গম্বরগণের নবুয়ত প্রাপ্তির উপযুক্ত বয়স-তখন নবুওয়তের কিছু স্পষ্ট লক্ষণ প্রকাশ হতে লাগল। সে লক্ষণগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে স্বপ্নের মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছিল। তিনি যখনই কোন স্বপ্ন দেখতেন তা প্রতীয়মান হতো সুবহে সাদেকের মত। এ অবস্থার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হল ছয়টি মাস যা ছিল নবুওয়তের সময় সীমার ছয়চল্লিশতম অংশ এবং নবুওয়তের সময়সীমা ছিল তেইশ বছর। এরপর তিনি যখন হেরাগুহায় নিরবচ্ছিন্ন ধ্যানে নিমগ্ন থাকতেন এবং এভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এবং বছরের পর বছর অতিবাহিত হতে হতে তৃতীয় বর্ষ অতিবাহিত হতে থাকল তখন আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীর মানুষের উপর স্বীয় রহমত বর্ষণের ইচ্ছা করলেন। তারপর আল্লাহ রাববুল আলামীন জিবরাঈল (আঃ)-এর মাধ্যমে তাঁর কুরআনুল কারীমের কয়েকটি আয়াতে করীমা নাযিল করে মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে নবুওয়তের মহান মর্যাদা প্রদানে ভূষিত করেন।[1]
বিভিন্ন ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত প্রমাণাদি গভীরভাবে অনুধাবন করলেই জিবরাঈল (আঃ)’র আগমনের প্রকৃত দিন তারিখ ও সময় অবগত হওয়া সম্ভব হবে। আমাদের সন্ধানের ভিত্তিতে বলা যায় যে, এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল রমাযান মাসে ২১ তারিখ মঙ্গলবার দিবাগত রাত্রে। খ্রীষ্টিয় হিসাব অনুযায়ী দিনটি ছিল ৬১০ খ্রীষ্টাব্দের ১০ই আগষ্ট। চান্দ্রমাসের হিসাব অনুযায়ী নাবী কারীম (সাঃ)-এর বয়স ছিল চল্লিশ বছর ছয় মাস বার দিন এব সৌর হিসাব অনুযায়ী ছিল ৩৯ বছর ৩ মাস ২২ দিন।[2]
আসুন, এখন আমরা উম্মুল মুমিনীন আয়িশাহ (রাঃ)-এর বর্ণনা থেকে বিস্তারিত বিবরণ জেনে নেই। এটা নৈসর্গিক নূর বা আসমানী দীপ্তির মতো এমন এক আলোক রশ্নি ছিল যা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে অবিশ্বাস ও ভ্রষ্টতার অন্ধকার বিদূরিত হতে থাকে, জীবনের গতিধারা পরিবর্তিত হতে থাকে এবং ইতিহাসের পট পরিবর্তিত হয়ে নতুন নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি হতে থাকে। আয়িশাহ (রাঃ) বলেছেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট ওহী অবতীর্ণ হয়েছিল ঘুমের অবস্থায় স্বপ্নযোগে, তিনি যখন যে স্বপ্নই দেখতেন তা প্রভাত রশ্মির মতো প্রকাশিত হতো। তারপর ক্রমান্বয়ে তিনি নির্জনতা প্রিয় হতে থাকলেন। নিরবাচ্ছিন্ন নির্জনতায় ধ্যানমগ্ন থাকার সুবিধার্থে তিনি হিরা গুহায় অবস্থান করতেন। কোন কোন সময় গৃহে প্রত্যাবর্তণ না করে রাতের পর রাত তিনি এবাদত বন্দেগী এবং গভীর ধ্যানে নিমগ্ন থাকতেন। এ জন্য খাদ্য এবং পানীয় সঙ্গে নিয়ে যেতেন। সে সব ফুরিয়ে গেলে পুণরায় তিনি গৃহে প্রত্যাবর্তন করতেন।
পূর্বের মতো খাদ্য এবং পানীয় সঙ্গে নিয়ে পুনরায় তিনি হেরা গুহায় গিয়ে ধ্যান মগ্ন হতেন। ওহী নাযিলের মাধ্যমে তাঁর নিকট সত্য প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত এভাবেই তিনি হেরাগুহার নির্জনতায় অবস্থান করতে থাকেন।
এমনভাবে একদিন তিনি যখন ধ্যানমগ্ন অবস্থায় ছিলেন তখন আল্লাহর দূত জিবরাঈল (আঃ) তাঁর নিকট আগমন করে বললেন, ‘তুমি পড়’’। তিনি বললেন, ‘পড়ার অভ্যাস আমার নেই।’ তারপর তিনি তাঁকে অত্যন্ত শক্তভাবে ধরে আলিঙ্গন করলেন এবং ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘তুমি পড়’’। তিনি আবারও বললেন, ‘আমার পড়ার অভ্যাস নেই’’। তারপর তৃতীয় দফায় আমাকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করার পর ছেড়ে দিয়ে বললেন ‘পড়-
{اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ خَلَقَ الْإِنسَانَ مِنْ عَلَقٍ اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ} [العلق:1: 3])
অর্থঃ সেই প্রভুর নামে পড় যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে রক্ত পিন্ড থেকে। পড় সেই প্রভূর নামে যিনি তোমাদের জন্য অধিকতর দয়ালু।’’[3]
তারপর ওহীর আয়াতগুলো অন্তরে ধারণ করে নাবী কারীম (সাঃ) কিছুটা অস্থির ও স্পন্দিত চিত্তে খাদীজাহ বিনতে খোওয়ালেদের নিকট প্রত্যাবর্তন করলেন এবং বললেন, ‘আমাকে বস্ত্রাবৃত করো, আমাকে বস্ত্রাবৃত করো।’ খাদীজাহ (রাঃ) তাঁকে শায়িত অবস্থায় বস্ত্রাবৃত করলেন। এভাবে কিছুক্ষণ থাকার পর তাঁর অস্থিরতা ও চিত্ত স্পন্দন প্রশমিত হলে তিনি তাঁর সহধর্মিনীকে হেরা গুহার ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করলেন। তাঁর অস্থিরতা ও চিত্ত চাঞ্চল্যের ভাব লক্ষ্য করে খাদীজাহ (রাঃ) তাঁকে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘কোন ভয় করবেন না, আপনি ধৈর্য ধরুন। আল্লাহ কখনো আপনাকে অপমান করবেন না। আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে আপনি সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলেন। অভাবগ্রস্তদের অভাব মোচনের চেষ্টা করেন। অসহায়দের আশ্রয় প্রদান করেন। মেহমানদের আদর-যত্ন করেন, অতিথিদের আতিথেয়তা প্রদান করেন এবং ঋণগ্রস্তদের ঋণের দায় মোচনে সাহায্য করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ আপনাকে অপদস্থ করবেন না।’
এরপর খাদীজাহ (রাঃ) তাঁকে স্বীয় চাচাত ভাই ওয়ারাকা বিন নাওফাল বিন আসাদ বিন আব্দুল উযযার নিকট নিয়ে গেলেন। জাহেলিয়াত আমলে অরকা খ্রীষ্টান ধর্ম অবলম্বন করেছিলেন এবং ইবরাণী ভাষা পড়তে ও লিখতে শিখেছিলেন। এক সময় তিনি ইবরাণী ভাষায় কিতাব লেখতেন। কিন্তু যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে সে সময় তিনি অত্যন্ত বৃদ্ধ এবং অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। খাদীজাহ (রাঃ) তাঁকে বললেন, ‘ভাইজান, আপনি আপনার ভাতিজার কথা শুনুন। তিনি কী যেন সব কথাবার্তা বলছেন এবং অস্থির হয়ে পড়ছেন।’
অরাকা বললেন, ‘ভাতিজা, বলতো তুমি কী দেখেছ? কী হয়েছে তোমার?
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যা কিছু প্রত্যক্ষ করেছিলেন এবং হিরাগুহায় যেভাবে যা ঘটেছিল সব কিছু সবিস্তারে বর্ণনা করলেন অরাকার নিকট।
আনুপূর্বিক সব কিছু শ্রবণের পর বিস্ময়-বিহবল কণ্ঠে অরাকা বলে উঠলেন, ‘ইনিই তো সেই মানুষ যিনি মুসা (আঃ)-এর নিকটেও আগমন করেছিলেন।’[4]
তারপর বলতে থাকলেন, ‘হায়! হায়! যেদিন আপনার স্বজাতি এবং স্বগোত্রীয় লোকেরা আপনার উপর নানাভাবে জুলম অত্যাচার করবে এবং আপনাকে দেশ থেকে বহিস্কার করবে সেদিন যদি আমি শক্তিমান এবং জীবিত থাকতাম।’
অরাকার মুখ থেকে এ কথা শ্রবণের পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘একী! ওরা আমাকে দেশ থেকে বহিস্কার করবে?’
ওয়ারাকা বললেন, ‘হ্যাঁ, তারা অবশ্যই আপনাকে দেশ থেকে বহিস্কার করবে।’ তিনি আরও বললেন ‘শুধু আপনার কথাই নয়, অতীতে এ রকম বহু ঘটনা ঘটেছে। যখনই জনসমাজে সত্যের বার্তা বাহক কোন সাধক পুরুষের আবির্ভাব ঘটেছে তখনই তার স্বাগোত্রীয় লোকেরা নানাভাবে তার উপর জুলম, নির্যাতন চালিয়েছে এবং তাঁকে দেশ থেকে বহিস্কার করেছে।’ তিনি আরও বললেন, ‘মনে রাখুন আমি যদি সেই সময় পর্যন্ত জীবিত থাকি তাহলে সর্ব প্রকারে আপনাকে সাহায্য করব।’ কিন্তু এর অল্পকাল পরেই ওরাকা মৃত্যু মুখে পতিত হন। এ দিকে ওহী আসাও সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়।[5]
ফুটনোটঃ[1] হাফেয ইবনে হাজার বলেন যে, বায়হাকী এ ঘটনা উদ্ধৃত করেছেন যে, স্বপ্নের সময় ছয় মাস ছিল। অতএব স্বপ্নের মাধ্যমে নবুওয়তের শুরু চলিশ বছর পূর্ণ হবার পরে রবিউল আওয়াল মাসেই হয়েছিল। যা তাঁর জন্ম মাস ছিল। কিন্তু জাগ্রত অবস্থায় তাঁর নিকট রমাযান মাসে ওহী আসা আরম্ভ হয়েছিল। ফাতহুলবারী ১ম খন্ড ২৭ পৃষ্ঠা।
[2] ওহী নাজিল শুরুর মাস দিন এবং তারিখঃ নাবী কারীম (সাঃ)-এর ওহী প্রাপ্তি এবং নবুওয়ত লাভের মহান মর্যাদায় ভূষিত হওয়ার মাস ও দিন তারিখ সম্পর্কে ইতিহাসবিদগণের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। অধিক সংখ্যক চরিতকারগণ এ ব্যাপারে অভিন্ন মত পোষণ করে থাকেন যে মাসটি ছিল রবিউল আওয়াল। কিন্তু অন্য এক দল বলেন যে, মাসটি ছিল রমাযানুল মুবারক। কেউ কেউ আবার এ কথাও বলে থাকেন যে মাসটি ছিল রজব। (দ্রষ্টব্য- শাইখ আবদুল্লাহ রচিত মুখতাসারুস ‘সীরাহ’ পৃষ্ঠা ৭৫) দ্বিতীয় দলের মতটি অধিকতর গ্রহণযোগ্য বলে আমাদের মনে হয়, অর্থাৎ যাঁরা বলেন যে, এটা রমাযান মাসে অবতীর্ণ হয়েছিল তাঁদের মত কারণ, আল্লাহ পাক কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করেছেনঃ
{شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ} ( البقرة : ১৮৫) {إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ} (القدر : ১)
দ্বিতীয় মতটি গ্রহণযোগ্য হওয়ার আরও একটি কারণ হচ্ছে নাবী কারীম (সাঃ) রমাযান মাসেই হেরা গুহায় অবস্থান করতেন এবং এটাও জানা যায় যে, জিবরাঈল (আঃ) সেখানে আগমন করতেন, অধিকমুত যাঁরা রমাযান মাসে ওহী অবতীর্ণ হওয়ার কথা বলেছেন কোন তারীখে তা অবতীর্ণ হয়েছিল সে ব্যাপারেও বিভিন্ন মত ব্যক্ত করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন রমাযান মাসের ৭ তারীখে, কেউ বলেছেন ১৭ তারীখে, কেউ বা আবার বলেছেন ১৮ তারীখে তা অবতীর্ণ হয়েছিল (দ্রষ্টব্য- মুখতাসারুস সীরাহ ৭৫ পৃঃ, রাহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ৪৯ পৃঃ) আল্লামা খুযরী অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বলেছেন যে, তারীখটি ছিল ১৭ই রমাযান (দৃষ্টব্য- তারীখে খুযরী ১ম খন্ড ৬৯ পৃঃ এবং তারীকুত্তাশরীউল ইসলামী ৫-৭ পৃঃ)।
আমার মতে ২১শে রমাযান এ জন্য গ্রহণযোগ্য যে, যদিও এটার স্বপক্ষে কেউ নাই, তবুও অধিক সংখ্যক চরিতকার এ ব্যাপারে এক মত হয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নবুওয়ত প্রাপ্তির দিনটি ছিল সোমবার। এ সমর্থন পাওয়া যায় আবূ কাতাদাহর সেই বর্ণনা থেকে, যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট সোমবারের রোযা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হল, তিনি উত্তর দিয়েছিলেন যে, ‘এ হচ্ছে সেই দিন যেদিন আমি ভূমিষ্ট হয়েছিলাম এবং আমার নিকট ওহী নাযিল করে আমাকে নুবুওয়াত প্রদান করা হয়েছিল।’’(সহীহুল মুসলিম শরীফ ১ম খন্ড ৩৬৮ পৃঃ, মুসনদে আহমাদ ২৯৭ পৃঃ, বায়হাকী ৪র্থ খন্ড ২৮৬ ও ৩০০ পৃঃ, হাকিম ২য় খন্ড ২৬৬ পৃঃ)। সেই রমাযান মাসে সোমবার হয়েছিল ৭, ১৪, ২১ ও ২৮ তারীখগুলোতে। এ দিকে সহীহুল হাদীস সূত্রে এটা প্রমাণিত ও স্বীকৃত হয়েছে যে, পবিত্র কদর রাত্রি রমাযান মাসের শেষ দশ দিনের মধ্যে বিজোড় রাত্রিগুলোকেই ধরা হয়ে থাকে।
এখন আমরা এক দিকে কুরআন কারীম থেকে অবগত হচ্ছি যে, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, {إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ} (القدر : ১) তাছাড়া, আবূ কাতাদার বর্ণিত হাদীস সূত্রে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সোমবার দিবস নবুওয়ত প্রাপ্ত হয়েছিলেন। তৃতীয় সূত্রে পঞ্জিকার হিসেবে জানা যায়, ঐ বছর রমাযান মাসে কোন্ কোন্ তারীখ সোমবার ছিল। অতএব নির্দিষ্টভাবে জানা যায় যে, নাবী কারীম (সাঃ) নবুওয়তপ্রাপ্ত হয়েছিলেন ২১শে রমাযানের রাত্রিতে। সুতরাং এটা ছিল ওহী অবতীর্ণ হওয়ার প্রথম তারিখ।
[3] {عَلَّمَ الْإِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ} পর্যন্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়।
[4] তাবারী ২য় খন্ড ২০৭ পৃঃ। ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ২৩৭-২৩৮ পৃঃ। শেষে কিছুটা অংশ সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। এ বর্ণনার বৈধতা নিয়ে আমার মনে কিছুটা দ্বিধা আছে। সহীহুল বুখারীর বর্ণনাভঙ্গী এবং তার বিভিন্ন বর্ণনার সমন্বয় সাধনের পর আমি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মক্কাভিমুখে প্রত্যাবর্তন এবং অরাকার সাথে সাক্ষাৎ ওহী অবতীর্ণ হওয়ার পর সেদিনই ঘটে ছিল। অবশিষ্ট হেরাগুহার অবস্থান তিনি মক্কা হতে ফিরে গিয়ে পূর্ণ করেছিলেন।
[5] সহীহুল বুখারী- ওহী নাযিলের বিবরণ অধ্যায় ১ম খন্ড ২ ও ৪৩ পৃষ্ঠা। শব্দের কিছু কিছু পরিবর্তনের মাধ্যমে সহীহুল বুখারী কেতাবুত তাফসীর এবং তা‘বিরুর রুইয়া পর্বেও বর্ণিত হয়েছে।
ওহী বন্ধ (فَتْرَةُ الْوَحْىِ):
কত দিন যাবৎ ওহী বন্ধ ছিল সেই ব্যাপারে ইতিহাসবেত্তাগণ কয়েকটি মতামত পেশ করেছেন। সেগুলোর মধ্যে সঠিক কথা হলো ওহী বন্ধ ছিল মাত্র কয়েকদিন। কতদিন যাবৎ ওহী বন্ধ ছিল সে ব্যাপারে ইবনে সা‘দ ইবনে আব্বাস হতে একটি উদ্ধৃতি বর্ণনা করেছেন যা এ দাবীর পৃষ্ঠপোষকতা করে। কোন কোন সূত্রে এ কথাটি প্রচারিত হয়ে এসেছে যে, আড়াই কিংবা তিন বছর যাবৎ ওহী অবতীর্ণ বন্ধ ছিল; কিন্তু তা সঠিক নয়।
এ বিষয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা এবং এতদসম্পর্কিথ বর্ণনা ও বিজ্ঞজনের মতামতসমূহের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাতের ফলে আমার নিকট একটি কিছু অপ্রচলিত বিষয় প্রকাশিত হয়েছে এবং বিজ্ঞজনের মধ্যে এ বিষয়ে দ্বিমত প্রত্যক্ষ করা যায় না তা হলো :
নবুওয়াতের পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হেরা গুহায় কেবলমাত্র একমাস ধরে নির্জনে কাটাতেন; আর সেটি হলো প্রত্যেক বছরের রামাযান মাস। নবুওয়াতের বছর ছিল এ তিন বছরের শেষ বছর। এই রামাযানের পুরো মাস অবস্থানের শেষে আওয়াল মাসের প্রথম সকালে বিশ্বজাহানের নাবী শেষ নাবী ওহী লাভে ধন্য হয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন।
তাছাড়া বুখারী, মুসলিমের বর্ণনা হতে জানা যায় যে, ওহী বন্ধ হওয়ার পর দ্বিতীয় বার ওহী অবতীর্ণ হয় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন নির্জনে পুরো মাস অবস্থানের পর ফিরে আসছিলেন সে সময়।
আমি (সফিউর রহমান) বলছিঃ এ হাদীস সাক্ষ্য দেয় যে, ওহী বন্ধ হওয়ার পর দ্বিতীয়বার ওহী অবতীর্ণ হয় সেই দিন যেদিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যে রামাযান মাসে ওহীপ্রাপ্ত হন সেই মাসের শেষ হওয়ার পর শাওয়াল মাসের প্রথম দিন। কেননা এটাই ছিল হেরা গুহায় তার শেষ অবস্থান। আর যখন এটা প্রমাণিত হলো যে, তাঁর নিকট প্রথম ওহী অবতীর্ণ হয়েছিল ২১ রামাযানে তখন এটা নিশ্চিতরূপেই অবধারিত হয়ে গেল যে, ওহী বন্ধ থাকার সময়কাল ছিল মাত্র ১০ দিন। অতঃপর নবুওয়াতের প্রথম বছর শাওয়াল মাসের প্রথম দিবস শুক্রবার সকালে পুনরায় ওহী অবতীর্ণ হয়। হতে পারে এর রহস্য হচ্ছে রামাযানের শেস দশ দিন নির্জনে অবস্থান এবং ইতিকাফ পূর্ণকরণ এবং শাওয়ালের প্রথম দিবসকে উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য ঈদের দিন হিসেবে বিশেষত্ব দান। আল্লাহ অধীক জ্ঞাত।
ওহী বন্ধ থাকার সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অত্যন্ত চিন্তিত এবং বিচলিত বোধ করতেন। সহীহুল বুখারী শরীফের তাবীর (স্বপ্নের ব্যাখ্যা) পর্বে বর্ণিত হয়েছে যে, ওহী বন্ধ হয়ে গেলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এতই বিচলিত ও বিব্রতবোধ করতেন এবং তাঁর দুশ্চিন্তা ও অস্বস্তিবোধ এতই অধিক বৃদ্ধি পেত যে, পর্বত শিখর হতে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করার জন্য তিনি মনস্থির করে ফেলতেন। কিন্তু এ উদ্দেশ্যে যখনই তিনি পর্বত শীর্ষে আরোহণ করেছেন তখন জিবরাঈল (আঃ) তাঁর দৃষ্টিগোচর হয়েছেন। জিবরাঈল (আঃ) তাঁকে লক্ষ্য করে বলেছেন, ‘হে মুহাম্মাদ (সাঃ) আপনি আল্লাহর সত্যনাবী।’ এতদশ্রবণে তাঁর প্রাণের অস্বস্তি ভাব স্তিমিত হয়ে আসত, মনে লাভ করতেন অনাবিল শান্তি, তারপর ফিরে আসতেন গৃহে। আবারও কোন সময় কিছু বেশীদিনের জন্য ওহী বন্ধ থাকলে একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি হতো।[1]
ফুটনোটঃ[1] সহীহুল বুখারীতে তা‘বীর পর্বে প্রথম প্রথম স্বপ্নযোগে ওহী প্রকাশিত হয় অধ্যয়ে, দ্বিতীয় খন্ড ১০৩৪ পৃঃ দ্রষ্টব্য।
পুনরায় ওহীসহ জিবরাঈল (আঃ)-এর আগমন (جِبْرِيْلٌ يَنْزِلُ بِالْوَحْيِ مَرَّةً ثَانِيَةً):
হাফেয ইবনে হাজার বলেন যে, নাবী (সাঃ) -এর উপর প্রথম ওহী অবতীর্ণ হওয়ার সময় তিনি কিছুটা ভয়-ভীতির সঙ্গে বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়েন। তাঁর মানসিকতার ক্ষেত্রে কিছুটা বিহবলতার ভাবও পরিলক্ষিত হতে থাকে। এ প্রেক্ষিতেই আল্লাহ রাববুল আলামীন কিছুদিন ওহী নাযিল বন্ধ রাখেন, যাতে তিনি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ লাভ করেন।[1] ঠিক তাই হলো, নাবী কারীম (সাঃ) প্রথম ওহী নাযিলের অসুবিধা থেকে মুক্ত হয়ে যখন মন মানসিকতার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক হয়ে উঠলেন, তখন তাঁর এ ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেল যে, তিনি আল্লাহর বার্তা বাহক বা রাসূল মনোনীত হয়েছেন। এবং তাঁর নিকট যিনি ওহী নিয়ে আগমন করেছিলেন তিনি হচ্ছেন আসমানী দূত বা ওহীবাহক। এভাবে রহস্যাবৃত ব্যাপারটি যখন তাঁর নিকট পরিস্কার হয়ে গেল তখনই তিনি পরবর্তী ওহীর জন্য উন্মুখ হয়ে উঠলেন। ওহী গ্রহণের জন্য মানসিকভাবে যখন প্রস্তুত হয়ে গেলেন, তখন জিবরাঈল (আঃ) পুনরায় ওহী নিয়ে আগমন করলেন। সহীহুল বুখারীর মধ্যে জাবির বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট থেকে ওহী নিয়ে আগমন বন্ধের ঘটনা শ্রবণ করেন। ঘটনার বর্ণনা প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,
(جَاوَرْتُ بِحِرَاءٍ شَهْرًا فَلَمَّا قَضَيْتُ جَوَارِىْ هَبَطْتُّ [فَلَمَّا اِسْتَبْطَنْتُ الْوَادِيَ] فَنُوْدِيْتُ، فَنَظَرْتُ عَنْ يَّمِيْنِيْ فَلَمْ أَرَ شَيْئًا، وَنَظَرْتُ عَنْ شِمَالِيْ فَلَمْ أَرَ شَيْئًا، وَنَظَرْتُ أَمَامِيْ فَلَمْ أَرَ شَيْئًا، وَنَظَرْتُخَلْفِيْ فَلَمْ أَرَ شَيْئًا، فَرَفَعْتُ رَأْسِىْ فَرَأَيْتُ شَيْئًا، [فَإِذَا الْمَلَكُ الَّذِيْ جَاءَنِيْ بِحِرَاءٍ جَالِسٌ عَلٰى كُرْسِيٍّ بَيْنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ، فَجُئِثْتُ مِنْهُ رُعْبًا حَتّٰى هَوِيْتُ إِلَى الْأَرْضِ] فَأَتَيْتُ خَدِيْجَةَ فَقُلْتُ:[زَمِّلُوْنِيْ، زَمِّلُوْنِيْ]، دَثِّرُوْنِىْ، وَصُبُّوْا عَلَىَّ مَاءً بَارِدًا)، قَالَ : (فَدَثَّرُوْنِىْ وَصَبُّوْا عَلَىَّ مَاءً بَارِدًا، فَنَزَلَتْ : {يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ قُمْ فَأَنذِرْ وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ} [المدثر: 1: 5])
‘‘আমি পথ ধরে চলছিলাম এমন সময় হঠাৎ আকাশ থেকে একটি আওয়াজ আমার শ্রুতিগোচর হল। আকাশের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই আমি সেই ফিরিশতাকে দেখতে পেলাম যিনি আমার নিকট হেরা গুহায় আগমন করেছিলেন। তিনি আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যস্থানে কুরশীতে উপবিষ্ট ছিলেন। ভয়ে বিস্ময়ে আমার দৃষ্টি অবনত হয়ে এল। তারপর আমার সহধর্মিণীর নিকট এসে বললাম, ‘আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দাও।’ তিনি আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দিলেন। তারপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘ওহে বস্ত্র আবৃত (ব্যক্তি)! ২. ওঠ, সতর্ক কর। ৩. আর তোমার প্রতিপালকের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর। ৪. তোমার পোশাক পরিচ্ছদ পবিত্র রাখ। ৫. (যাবতীয়) অপবিত্রতা থেকে দূরে থাক। [মুদ্দাসসির (৭৪) : ১-৫] পর্যন্ত ওহী অবতীর্ণ করেন এরপর থেকে অবিরামভাবে ওহী অবতীর্ণ হতে থাকে।[2]
এ ক’টি আয়াত নবুওয়াতের প্রাথমিক অবস্থায় ওহী বন্ধ হওয়ার কয়েকদিন পর অবতীর্ণ হয়। তার উপর দায়িত্ব অর্পনের দুটি স্তর রয়েছে যা ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করা হলো-
প্রথমত : রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপর নবুওয়াতের প্রচার ও ভীতি প্রদর্শনের দায়িত্ব অর্পন।
এ মর্মে আল্লাহর বাণী : (قُمْ فَأَنذِرْ) অর্থাৎ মানবমণ্ডলী অজ্ঞতা, পাপাচার, পথভ্রষ্টতা, মহান আল্লাহর ব্যতীত বাতিল উপাস্যের ইবাদত করা, তাঁর সত্ত্বা, গুণাবলী, তাঁর হক ও কর্মসমূহের সাথে শিরক বা অংশীস্থাপন করা থেকে যদি বিরত না হয় তবে তাদেরকে আল্লাহর কঠিন আযাব সম্পর্কে ভীতি প্রদর্শন করো।
দ্বিতীয়ত ; রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপর আল্লাহর নির্দেশিত বিষয়সমূহের সাথে তার সত্ত্বার সমন্বয় সাধন করা এবং তার উপর স্বয়ং অটল থাকা। ঐসব বিষয়কে কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই সযত্নে সংরক্ষণ করা। আর যারা আল্লাহ তা’আলার উপর বিশ্বাস স্থাপর করবে তাদের জন্য একটি উত্তম আদর্শ বনে যাওয়া। যথা পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করছেন, (وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ) অর্থাৎ একনিষ্ঠভাবে তার বড়ত্ব ঘোষণা করে এবং তার সাথে আর কাউকে শরীক করো না। এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেন, (وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ) এর বাহ্যিক অর্থ : শরীর ও কাপড়-চোপড়ের পবিত্রতা অর্জন। কেননা যে ব্যক্তি আল্লাহর সামনে দণ্ডায়মান হবে তার জন্য এটা শোভনীয় নয় যে, সে অপবিত্র ও নোংরা অবস্থায় দণ্ডায়মান হবে। আর এখানে প্রকৃতপক্ষে যে পবিত্রতা উদ্দেশ্য তা হচ্ছে, যাবতীয় শিরক ও পাপকৰ্ম থেকে বিরত থাকা এবং উত্তম চরিত্রে ভূষিত হওয়া। (وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ) অর্থাৎ আল্লাহর অসন্তোষ ও শাস্তি অবধারিত হওয়ার কারণসমূহ থেকে নিজেকে বিরত রাখো। অধিকন্তু তার আনুগত্যকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে এবং পাপকৰ্ম পরিহার করো। আল্লাহ বলেন, (وَلَا تَمْنُنْ تَسْتَكْثِرُ) অর্থাৎ তুমি যেসব উত্তম আমল কর না কেন মানুষের নিকট তার প্রতিদান কামনা করো না অথবা এর বিনিময়ে দুনিয়াতে আল্লাহর কাছে এর চেয়ে কোন ভাল ফলাফল আশা করো না।
পরবর্তী আয়াতসমূহে মানুষদেরকে এক আল্লাহর দিকে আহ্বান করা, তাদেরকে তার শাস্তি ও পাকড়াও থেকে ভীতি প্রদর্শন এবং দীনের কারণে মানুষের পক্ষ থেকে যে বিরোধিতার সম্মুখীন হবেন, তাদের দ্বারা অত্যাচারিত-নির্যাতিত হবেন ঐ সব বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, (وَلِرَبِّكَ فَاصْبِرْ) অর্থাৎ আপনি আপনার পরওয়ার দিগরের সন্তষ্টি অর্জনার্থে ধৈর্য্যধারণ করুন।
উল্লেখিত আয়াতসমূহের প্রারম্ভিক সুরে মহান আল্লাহ তা’আলার এক উদাত্ত আহবান সুস্পষ্ট, যে আহবানে নাবী কারীম (সাঃ)-কে নবুওয়াতের মহা মর্যাদাপূর্ণ কাজের জন্য ঘুম থেকে জাগ্রত হতে এবং ঘুমের আচ্ছাদন ও বিছানার উষ্ণতা পরিত্যাগ করে আল্লাহর একত্ববাদের বাণী প্রচারে লিপ্ত হওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে :
يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ قُمْ فَأَنْذِرْ
ওহে বস্ত্র আবৃত (ব্যক্তি)। ২. ওঠ, সতর্ক কর। (আল-মুদাসসির ৭৪ – ১-২)
বলা হয়ে থাকে যে, যে নিজের জন্যই বাঁচতে চায় সে আরাম আয়েশে গা ভাসিয়ে চলতে পারে। কিন্তু আপনাকে এক বিরাট ও মহান দায়িত্বে আত্মনিয়োগ করতে হচ্ছে তখন ঘুমের সঙ্গে আপনার কী সম্পর্ক? আরাম আয়েশের সঙ্গে আপনার কি সম্পর্ক? আপনার গরম বিছানার কী প্রয়োজন? কী প্রয়োজন আপনার সুখময় জীবন যাপনের? আপনি উঠে পড়ুন এবং ঐ মহানকাজে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। আপনার ঘুম এবং আরাম আয়েশের সময় এখন অতিক্রান্ত। এখন আপনাকে অবিরাম পরিশ্রম করে যেতে হবে এবং দীর্ঘ ও কষ্টদায়ক সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করতে হবে।
আল্লাহর পথে আহবান এবং কালেমার দাওয়াত ও তাবলীগী নেসাবের কাজ হচ্ছে অতীব উঁচু দরের কাজ। কিন্তু এ পথে চলার ব্যাপারটি হচ্ছে অত্যন্ত ভয়ভীতিজনক এবং বিপদ-সংকুল। এ কাজ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে শান্তির নীড় ঘর-বাড়ি, সুখময় পারিবারিক পরিবেশ, আরাম-আয়েশ স্নিগ্ধ শয্যা থেকে টেনে বের করে এনে দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা এবং দুঃখ কষ্টের অথৈ সাগরে নিক্ষেপ করে দিল। এনে দাঁড় করিয়ে দিল মানুষের বাহ্যিক পোষাকী আচরণ এবং শঠতাপূর্ণ আভ্যন্তরীণ প্রকৃতিগত দ্বিধা-দ্বন্দ্বের দারুণ টানা-পোড়েনের মাধ্যমে।
তারপর, নাবী কারীম (সাঃ) তার অবস্থা এবং দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ হয়ে গেলেন এবং বিশ বছরেরও অধিককাল যাবৎ সেই জাগ্রত অবস্থার মধ্য দিয়েই অতিবাহিত করলেন। এ দীর্ঘ কাল যাবৎ সুখ-শান্তি, আরাম-আয়েশ বলতে তার আর কিছুই রইল না। সব কিছুকেই তিনি করলেন বিসর্জন। তার জীবন নিজের কিংবা পরিবার পরিজনদের জন্য আর রইল না। তার জীবন রইল আল্লাহর কাজের জন্য দায়বদ্ধ। তার কাজ ছিল আল্লহির প্রতি বিশ্ববাসীকে আহ্বান জানানো। বিশ্বের বুক থেকে সর্বপ্রকার অসত্য, অন্যায় ও মিথ্যার মূলোৎপাটন এবং ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষকে পথ-পদর্শন।
‘আল্লাহর পথে আহ্বান’, ‘সত্যের প্রতিষ্ঠা’ ইত্যাদি কথাগুলো আপাতঃ দৃষ্টিতে ততটা কঠিন কিংবা দুঃসাধ্য মনে নাও হতে পারে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর চেয়ে কঠিন এবং কষ্টসাধ্য কাজ পৃথিবীতে আর কিছুই হতে পারে না। রেসালাতের আমানত হচ্ছে বিশ্বের বুকে সব চেয়ে দায়িত্বপূর্ণ এবং দুর্বহ আমানত। এ আমানত হচ্ছে এক পক্ষে বিশ্বময় মানবের চরম উৎকর্ষ ও বিকাশের আমানত এবং অন্য পক্ষে যাবতীয় বাতিল এবং গায়রুল্লাহর প্রভাব প্রতিহত করে তাকে ধ্বংস করার আমানত। কাজেই তার কাধে যে বোঝা চাপান হয়েছিল তা ছিল সমগ্র মানবতার বোঝা । সমস্ত মতবাদের বোঝা এবং ময়দানে ময়দানে জেহাদ ও তা প্রতিহত করার বোঝা। বিশ বছরেরও অধিক কাল যাবৎ অবিরামভাবে তিনি ব্যাপক ও বহুমুখী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করেন। সেই দীর্ঘ কাল যাবৎ, অর্থাৎ যখন তিনি আসমানী আহবান শ্রবণের মাধ্যমে অত্যন্ত কঠিন ও কন্টকময় দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেন, তখন থেকেই তাকে কোন এক অবস্থা অন্য কোন অবস্থা সম্পর্কে বিন্দুমাত্রও গাফেল কিংবা উদাসীন রাখতে পারে নি। আল্লাহ তা’আলা তাকে আমাদের এবং সমগ্র মানবতার পক্ষ হতে উত্তম বিনিময় প্রদান করুন।[3]
ফুটনোটঃ[1] ফাতহুলবারী ১ম খন্ড ২৭ পৃঃ।
[2] সহীহুল বুখারী- ‘কেতাবূত তাফসীর, বাবু অর রুজযা ফাহজুর’’ (অশালীন কাজ পরিহার করন) অধ্যায় ২য় খন্ড ৭৩৩ পৃঃ। এ প্রসঙ্গে অন্যান্য কিছু অধিক বর্ণিত হয়েছে। নাবী (সাঃ) বলেন, ‘আমি হেরায় এতেক্বাফ করি। যখন আমার এতেক্বাফ সম্পূর্ণ হয় তখন আমি নীচে অবতরণ করি। সে সময় আমি বাতনে ওয়াদী অতিক্রম করি তখন আমাকে ডাক দেয়া হয়। আমি তাকাই ডানে, বামে, সামনে, পিছনে কিন্তু কিছুই দেখতে পাই না। এর পর যখন উপরে দৃষ্টিপাত করি তখন এ ফিরিশতাকে দেখতে পাই।’’
যেবছর রামাযান মাসে গারে হেরায় এতেক্বাফ করেছিলেন এবং যে রমাযান মাসে তাঁর উপর ওহী অবতীর্ণ হয় তা ছিল ৩য় রমাযান, অর্থাৎ শেষ রমাযান। তাঁর নিয়ম ছিল যখন তাঁর রমাযানের এতেক্বাফ পূর্ণ হত তখন তিনি প্রথম শাওয়ালে প্রত্যুষেই মক্কা প্রত্যাবর্তন করতেন। উপরি উল্লেখিত বর্ণনার সঙ্গে এ কথাটি জুড়ে দিলে এটা দাঁড়ায় যে, ইয়া আইউহাল মোদ্দাস্সির (হে বস্ত্রাবৃত ব্যক্তি) ওহীটি প্রথম ওহীর দশ দিন পরে প্রথম শাওয়ালে অবতীর্ণ হয়েছিল। অর্থাৎ ওহী বন্ধের পূর্ণ সময়কাল কাল ছিল ১০ দিন।
[3] ফী- যিলালিল কুরআন (সূরাহ মুযযাম্মিল ও মুদ্দাসসির, পারা ২৯, পৃষ্ঠা নং ১৬৮-১৭১।
ওহীর প্রকারভেদ (أَقْسَامُ الْوَحْىِ):
এখানে আমরা আলোচনার মূল বিষয়াদি থেকে একটু সরে গিয়ে, অর্থাৎ রিসালাত ও নবুওয়াতের বরকতময় বিষয়াদির বিস্তৃত বিবরণ লিপিবদ্ধ করার পূর্বে ওহীর প্রকৃতি ও প্রকারভেদ সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা করার প্রয়োজন বোধ করছি। কারণ, এটাই হচ্ছে রেসালাতের উৎস এবং প্রচারের উপায়। ওহীর প্রকৃতি এবং প্রকারভেদ সম্পর্কে আল্লামা ইবনে কাইয়্যেম যে আলোচনা করেছেন তা নিম্নে লিপিবদ্ধ করা হলঃ
১. সত্য স্বপ্নঃ স্বপ্নের মাধ্যমে নাবী কারীম (সাঃ)-এর উপর ওহী অবতীর্ণ হয়।
২. ফিরিশতা দেখা না দিয়ে অর্থাৎ অদৃশ্য অবস্থান থেকেই রাসূল (সাঃ)-এর অন্তরে ওহী প্রবেশ করিয়ে দেন। এ প্রসঙ্গে নাবী কারীম (সাঃ) যেমনটি ইরশাদ করেছেনঃ
(إن روح القدس نفث في روعى أنه لن تموت نفس حتى تستكمل رزقها، فاتقوا الله وأجملوا في الطلب، ولا يحملنكم استبطاء الرزق على أن تطلبوه بمعصية الله ، فإن ما عند الله لا ينال إلابطاعته)
অর্থঃ ‘জিবরাঈল (আঃ) ফিরিশতা আমার অন্তরে এ কথা নিক্ষেপ করলেন যে, কোন আত্মা সে পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করবে না যে পর্যন্ত তার ভাগ্যে যতটুকু খাদ্যের বরাদ্দ রয়েছে পুরোপুরিভাবে তা পেয়ে না যাবে। অতএব, তোমরা আল্লাহকে সমীহ কর এবং রুজি অন্বেষণের জন্য ভাল পথ অবলম্বন কর। রুজি প্রাপ্তিতে বিলম্ব হওয়ায় তোমরা আল্লাহর অসন্তোষের পথ অন্বেষণে যেন উদ্বুদ্ধ না হও। কারণ, আল্লাহর নিকট যা কিছু রয়েছে তা তাঁর আনুগত্য ছাড়া পাওয়া দুস্কর।
৩. ফেরেশতা মানুষের আকৃতি ধারণপূর্বক নাবী কারীম (সাঃ)-কে সম্বোধন করতেন। তারপর তিনি যা কিছু বলতেন নাবী কারীম (সাঃ) তা মুখস্থ করে নিতেন। এ অবস্থায় সাহাবীগণ (রাঃ)ও ফেরেশতাকে দেখতে পেতেন।
৪. ওহী অবতীর্ণ হওয়ার সময় নাবী কারীম (সাঃ)-এর নিকট ঘন্টার টুন টুন ধ্বনির মতো ধ্বনি শোনা যেত। ওহী নাযিলের এটাই ছিল সব চাইতে কঠিন অবস্থা। টুন টুন ধ্বনির সংকেত প্রকাশ করতে করতে ফিরিশতা ওহী নিয়ে আগমন করতেন এবং নাবী (সাঃ)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। ওহী নাযিলের সময় কঠিন শীতের দিনেও রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কপাল থেকে ঘাম ঝরতে থাকত। তিনি উষ্ট্রের উপর আরোহণরত অবস্থায় থাকলে উট বসে পড়ত। এক দফা এইভাবে ওহী নাযিল হওয়ার সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উরু যায়দ বিন সাবেত (সাঃ)-এর উরুর উপর ছিল। তখন তাঁর উরুতে এতই ভারবোধ হয়েছিল যে মনে হয়েছিল যেন উরু চূর্ণ হয়ে যাবে।
৫. নাবী কারীম (সাঃ) ফিরিশতাকে কোন কোন সময় নিজস্ব জন্মগত আকৃতিতে প্রত্যক্ষ করতেন এবং আল্লাহর ইচ্ছায় সেই অবস্থাতেই তিনি তাঁর নিকট ওহী নিয়ে আগমন করতেন। নাবী কারীম (সাঃ)-এর এ রকম অবস্থা দু’বার সংঘটিত হয়েছিল যা আল্লাহ তা‘আলা সূরাহ ‘নাজমে’ উল্লেখ করেছেন।
৬. পবিত্র মি’রাজ রজনীতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন আকাশের উপর অবস্থান করছিলেন সেই সময় আল্লাহ তা‘আলা নামায এবং অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে সরাসরি হুকুমের মাধ্যমে ওহীর ব্যবস্থা করেছিলেন।
৭. আল্লাহ তা‘আলার সঙ্গে নাবী কারীম (সাঃ)-এর সরাসরি কথোপকথন যেমনটি হয়েছিল, তেমনি মূসা (আঃ)-এর সঙ্গে হয়েছিল। মূসা (আঃ)-এর সঙ্গে যে আল্লাহ তা‘আলার কথোপকথন হয়েছিল কুরআন কারীমে তা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলার সঙ্গে নাবী কারীম (সাঃ)-এর কথোপকথনের ব্যাপারটি হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে (কুরআন দ্বারা নয়)।
কোন কোন লোক পর্দা বা আবরণ ব্যতিরেকে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সাঃ)-এর সামনা-সামনি কথোপকথনের মাধ্যমে ওহী নাযিলের অষ্টম রীতির কথা বলেছেন। কিন্তু ইসলামের পূর্বসূরীদের হতে শুরু করে পরবর্তীদের সময়কাল পর্যন্ত এ পদ্ধতিতে ওহী নাযিলের ব্যাপারে মতভেদ চলে আসছে।[1]
ফুটনোটঃ[1] যাদুল মা’আদ ১ম খন্ড ১৮ পৃঃ। প্রথম এবং অষ্টম রীতির বর্ণনাতে আসল ইবারতের মধ্যে কিছুটা সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে।
গোপনে ইসলাম প্রচার
তিন বছর গোপনে প্রচার (ثَلَاثُ سَنَوَاتٍ مِنْ الدَّعْوَةِ السِّرِّيَّةِ):
সূরাহ মুদ্দাসসিরের প্রথম আয়াত প্রথম থেকে ষষ্ঠ আয়াত পর্যন্ত
يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ (1) قُمْ فَأَنذِرْ (2) وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ (3) وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ (4) وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ (5) وَلَا تَمْنُن تَسْتَكْثِرُ (6) وَلِرَبِّكَ فَاصْبِرْ (7)
‘১. ওহে বস্ত্র আবৃত (ব্যক্তি)। ২. ওঠ, সতর্ক কর। ৩. আর তোমার প্রতিপালকের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর। ৪, তোমার পোশাক পরিচ্ছদ পবিত্র রাখ। ৫. (যাবতীয়) অপবিত্রতা থেকে দূরে থাক। ৬. (কারো প্রতি) অনুগ্রহ করো না অধিক পাওয়ার উদ্দেশে। ৭. তোমার প্রতিপালকের (সস্তুষ্টির) জন্য ধৈর্য ধর। (আল-মুদ্দাসসির ৭৪ : ১-৭)
সূরাহ মুদ্দাসসিরের উপযুক্ত আয়াতসমূহ নাযিল হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পথহারা মানুষদেরকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দেয়ার কাজ শুরু করলেন এমন অবস্থায় যে, তাঁর জাতি কুরাইশদের মূর্তি ও প্রতিমার পূজা-অৰ্চনা ব্যতীত কোন দীন ছিল না। তাদের সঠিক কোন হজ্জ ছিল না, তবে তারা হজ্জ করতো যেভাবে তাদের পিতৃপুরুষদেরকে দেখেছে। তাদের আত্মমর্যাদা ও বংশগৌরব ব্যতীত কোন সৎচরিত্র ছিল না। তাদের কোন সমস্যা তলোয়ার ব্যতীত সমাধান হতো না। তা সত্ত্বেও মক্কা ছিল আরববাসীগণের ধর্মীয় চেতনার কেন্দ্রস্থল। এ মক্কাবাসীই ছিলেন কা’বাহর তত্ত্বাবধায়ক ও খাদেমগণ। এ জন্যই দূরবর্তী স্থানের তুলনায় মক্কায় সংস্কারমুখী কর্মসূচী বাস্তবায়নের ব্যাপারটি ছিল অনেক বেশী কঠিন ও কষ্টকর। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেও প্রাথমিক পর্যায়ে মক্কায় প্রচার ও তাবলীগের কাজকর্ম সন্তর্পণে ও সঙ্গোপনে করার প্রয়োজন ছিল যাতে মক্কাবাসীগণের সামনে আকস্মিকভাবে বৈপ্লবিক কিংবা উত্তেজনামূলক কোন অবস্থার সৃষ্টি হয়ে না যায়।
ফুটনোটঃ
ইসলাম কবুলকারী প্রথম দল (الرَّعِيْلُ الْأَوَّلُ):
এটা খুবই স্বাভাবিক এবং সঙ্গত কথা যে যাঁরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সবচাইতে কাছের, সব চাইতে ঘনিষ্ঠ এবং সব চাইতে নির্ভরযোগ্য ছিলেন সর্ব প্রথম তিনি তাঁদেরই নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করেছিলেন। এ দলের মধ্যে ছিলেন পরিবারের লোকজন, ঘনিষ্ঠ আত্মীয় এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধব। অধিকন্তু, প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি ঐ সকল লোককে সত্যের প্রতি আহবান জানিয়েছিলেন যাঁদের মুখমন্ডলে কল্যাণ এবং সত্য-প্রীতির আভাষ ছিল সুস্পষ্ট। তাছাড়া যাঁরা নাবী (সাঃ)-এর সততা, সত্যবাদিতা এবং পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে সুবিদিত ছিলেন এবং এ কারণে তাঁর প্রতি এত বেশী অনুরক্ত এবং শ্রদ্ধাশীল ছিলেন যে, প্রথম আহবানেই সাড়া দিয়ে তাঁরা ইসলাম কবুল করেন এবং প্রথম মুসলিম হওয়ার এক দুর্লভ গৌরব অর্জন করেন। এদের তালিকার শীর্ষে ছিলেন উম্মুল মু’মিনীন নাবী- পত্নী খাদীজাহতুল কোবরা (রাঃ) বিনতে খুওয়াইলিদ, তাঁর স্বাধীনতা প্রাপ্ত ক্রীতদাস যায়দ বিন হারিসাহ বিন শোরাহবীল কালবী,[1] তাঁর চাচাত ভাই আলী বিন আবূ ত্বালিব যিনি তখনো তাঁর লালন-পালনাধীন শিশু ছিলেন এবং তাঁর সওর গুহার সঙ্গী আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ)। এরা সকলে প্রথম দিনেই মুসলিম হয়েছিলেন।[2]
তারপর আবূ বাকর (রাঃ) ইসলামের প্রচার কাজে বেশ তৎপর হয়ে ওঠেন। তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয়, কোমল-স্বভাব, পছন্দনীয় অভ্যাসের অধিকারী, সচ্চরিত্র এবং দরাজ দিল ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর দানশীলতা, দূরদর্শিতা, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সৎ সাহচর্যের কারণে তাঁর নিকট লোকজনের গমনাগমন প্রায় সব সময় লেগেই থাকত। পক্ষান্তরে তিনি তাঁর নিকট আগমন ও প্রত্যাগমনকারী এবং আশপাশে বসবাসকারীগণের মধ্যে যাঁকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করতেন তাঁর সামনেই ইসলামের দাওয়াত পেশ করতেন। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় উসমান (রাঃ), জোবায়ের (রাঃ), আব্দুর রহমান (রাঃ) বিন আওফ, সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) এবং ত্বালহাহ বিন ওবায়দুল্লাহ (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করেন। এ মহা সম্মানিত ব্যক্তিবর্গই হচ্ছেন প্রথম মুসলিম জনগোষ্ঠি।
প্রাথমিক অবস্থায় যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেন বিলাল হাবশী (রাঃ)-ও ছিলেন সেই দলের অন্তর্ভুক্ত। এর পর ইসলাম কবূল করেন বনু হারিস বিন ফিহর গোত্রের আবূ ‘উবায়দাহ ‘আমির বিন জাররাহ (রাঃ), আবু সালামাহ বিন আব্দুল আসাদ মাখযূমী (রাঃ), আরক্বাম বিন আবিল আরক্বাম (রাঃ), উসমান বিন মাযউন যুমাহী (রাঃ), এবং তাঁর দু’ভাই যথাক্রমেঃ কুদামা এবং আব্দুল্লাহ, উবায়দাহ বিন হারিস বিন মুত্তালিব বিন আবদে মানাফ, সাঈদ বিন যায়দ এবং তাঁর স্ত্রী, অর্থাৎ উমারের বোন ফাত্বিমাহ বিনতে খাত্তাব, খাব্বাব বিন আরাত তামীমী (রাঃ), জা’ফার বিন আবূ ত্বালিব ও তার স্ত্রী আসমা বিনতে ‘উমায়স, খালিদ বিন সাঈদ বিন ‘আস আল উমাবী ও তার স্ত্রী আমীনাহ বিনতে খালাফ, অতঃপর তার ভাই ‘আমর বিন সাঈদ বিন আস, হাতিব বিন হারিস জুমাহী ও তার স্ত্রী ফাতিমাহহ বিনতে মুখাল্লিল ও তার ভাই খাত্তাব বিন হারিস এবং তার স্ত্রী ফুকাইহাহ বিনতে ইয়াসার ও তার ভাই মা’মার বিন হারিস, মুত্তালিব বিন আযহার যুহরী ও তার স্ত্রী রামলাহ বিনতে আবূ ‘আওফ, নাঈম বিন আবদুল্লাহ বিন নুহাম আদবী (রাঃ), এদরে সকলেই কুরাইশ ও কুরাইশের বিভিন্ন শাখা গোত্রের।
কুরাইশ ব্যতীত অন্য গোত্র থেকে প্রাথমিক অবস্থায় ইসলাম গ্রহণকারীরা হলেন, আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ, মাসউদ বিন রাবী’আহ, আব্দুল্লাহ বিন জাহশ আসাদী ও তার ভাই আহমাদ বিন জাহশ, বিলাল বিন রিবাহ হাবশী, সুহাইব বিন সিনান রূমী, ‘আম্মার বিন ইয়াসার আনসী, তার পিতা ইয়াসার ও তার মাতা সুমাইয়া এবং আমির বিন ফুহাইরাহ।
উপরে উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও প্রাথমিক পর্যায়ের মুসলমান মহিলাদের মধ্যে রয়েছেন, উম্মু আইমান বারাকাত হাবশী, উম্মুল ফযল লুবাবাতুল কুবরা বিনতে হারিস হিলালিয়াহ (আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিবের স্ত্রী), আসমা বিনতে আবূ বকর সিদ্দীক (রা.)।
উপরে উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গ প্রথম পর্যায়ের ইসলাম গ্রহণকারী হিসেবে প্রসিদ্ধ। বিভিন্নভাবে অনুসন্ধান ও গবেষণার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে যে, প্রথম পর্যায়ের ইসলাম গ্রহণকারীর গুণে গুণম্বিতদের সংখ্যা পুরুষ-মহিলা মিলে ৩৩০ জন। তবে এটা অকাট্যভাবে জানা যায় নি যে, তারা সকলেই প্রকাশ্যে দাওয়াত চালু হওয়ার পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন নাকি ইসলামের দাওয়াত প্রকাশ্যভাবে চালু হওয়া পর্যন্ত তাদের কেই কেউ ইসলাম গ্রহণে বিলম্ব করেছিলেন।
ফুটনোটঃ[1] ইনি যুদ্ধে বন্দী হয়ে দাসে পরিণত হন। পরে খাদীজা (রাঃ) তাঁর মালিক হন তাঁকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট দেন। এর পর তাঁর পিতা এবং চাচা তাঁকে নিজ বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য আগমন করেন। কিন্তু তিনি বাড়ি না গিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সঙ্গে থাকাকেই বেশী পছন্দ করেন। প্রচলিত প্রথানুযায়ী তারপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে পোষ্য পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। এজন্য তাঁকে যায়েদ বিন মুহাম্মাদ (সাঃ) বলে ডাকা হত। পরে সে প্রথার ইসলাম সমাপ্তি ঘোষণা করে।
[2] রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ৫০ পৃষ্ঠা।
সালাত বা প্রার্থনা (الصَّلَاةُ):
প্রাথমিক পর্যায়ে যে সকল আয়াত অবতীর্ণ হয় তাতে নামাজের নির্দেশেনা বিদ্যমান ছিল । ইবনে হাজার বলেন যে, নাবী কারীম (সাঃ) এবং তাঁর সাহাবাগণ (রা.) মি’রাজের ঘটনার পূর্বে অবশ্যই সালাত পড়তেন। তবে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয হওয়ার পূর্বে সালাত ফরজ ছিল কি ছিল না সে ব্যাপারে মতবিরোধ রয়েছে। কেউ কেউ বলে থাকেন যে, সূর্যের উদয় এবং অস্ত যাওয়ার পূর্বে একটি করে সালাত ফরজ ছিল।
হারিস বিন উসামাহ ইবনে লাহী’আর মাধ্যমে বর্ণনাকারীদের মিলিত পরম্পরা সূত্রের বরাতে যায়দ বিন হারিসাহ বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট যখন প্রথম ওহী অবতীর্ণ হল তখন জিবরাঈল (আঃ) আগমন করলেন এবং তাকে অযুর পদ্ধতি শিক্ষা দিলেন। যখন অযু শেখা সমাপ্ত হল তখন এক চুল্লি পানি লজ্জা স্থানে ছিটিয়ে দিলেন। ইবনে মাজাহও এ মর্মে হাদীস বর্ণনা করেছেন। বারা বিন আযিব এবং ইবনে আব্বাস হতেও ঐ ধরণের হাদীস বর্ণিত হয়েছে। ইবনে আব্বাস হতে বর্ণিত হাদীসে এ কথারও উল্লেখ রয়েছে যে, সালাত প্রাথমিক ফরজকৃত কর্তব্যসমূহের অন্তর্ভুক্ত ছিল।[1]
ইবনে হিশামের বর্ণনায় এ কথা রয়েছে যে, নাবী কারীম (সাঃ) এবং সাহাবীগণ (রা.) সালাতের সময় ঘাঁটিতে চলে যেতেন এবং গোত্রীয় লোকজনদের দৃষ্টির আড়ালে গোপনে সালাত আদায় করতেন। আবূ ত্বালিব এক দফা নাবী কারীম (সাঃ) এবং আলীকে সালাত আদায় করতে দেখেন এবং জিজ্ঞাসা করে প্রকৃত বিষয়টি অবগত হলে এর উপর দৃঢ় থাকার পরামর্শ প্রদান করেন।[2]
প্রথম পর্যায়ের মুসলমানগণ এসব ইবাদত করতেন। সালাত সংশ্লিষ্ট ইবাদত ব্যতীত অন্য কোন ইবাদত বা আদেশ নিষেধের কথা জানা যায় না। সে সময়কার ওহীতে মূলত সে সব বিষয় বর্ণিত হয় যা বিভিন্নভাবে তাওহীদের বর্ণনা, তাদেরকে আত্মশুদ্ধির প্রতি উৎসাহিতকরণ, উন্নত চরিত্র গঠনে উদ্বুদ্ধকরণ, জান্নাত-জাহান্নামের বর্ণনা যেন তা চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে, অন্তরাত্মা পরিশুদ্ধকরণে প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ যা অন্তরের খোরাক হয়, ঈমানদারদের তৎকালীন মানব-সমাজ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক এবং ভিন্নতর এক পরিবেশে পরিভ্রমণ করাতে থাকে।
এভাবে তিন বছর অতিক্রান্ত হয় কিন্তু ইসলামের দাওয়াত গুটিকয়েক ব্যক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। রাসূল (সাঃ)-ও তা লোকসমাজে প্রকাশ করতেন না। তবে কুরাইশরা ইসলামের খবর জানতো ও মক্কাতে ইসলামের কথা ছড়িয়ে পড়ে এবং লোকসমাজে এর মৃদু গুঞ্জন চলতে থাকে। আবার কেউ একে ঘৃণাও করতো এবং মুমিনদের সাথে শত্রুতা ভাব দেখাতো। তবে সামনা সামনি কিছু বলতো না যতক্ষণ পর্যন্ত না রাসূলুল্লাহ তাদের দীন-ধর্মে হস্তক্ষেপ করতেন এবং তাদের ভিত্তিহীন ও মনগড়া ইলাহ মূর্তিসমূহের সমালোচনা না করতেন।
ফুটনোটঃ[1] শাইখ আব্দুল্লাহ মোখতাসার মীরাহ পৃঃ ৮৮৷
[2] ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ২৪৭ পৃঃ।
প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার
প্রকাশ্য দাওয়াতের প্রথম আদেশ (أَوَّلُ أَمْـرٍ بِإِظْهَارِ الدَّعْـوَةِ):
ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ ও পরস্পর সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমে মুমিনদের যখন একটি দল সৃষ্টি হলো এবং রিসালাতের বোঝা বহনের মতো যোগ্যতা অর্জিত হলো ও ইসলাম তার নিজ অবস্থানকে কিছুটা শক্তিশালী করতে সক্ষম হলো তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রকাশ্যভাবে ইসলামের দাওয়াত দেয়া ও বাতিল দীন, উপাস্যদেরকে উত্তম পন্থায় প্রতিহত করতে আদিষ্ট হলেন।
এ বিষয়ে সর্ব প্রথম আল্লাহ তা‘আলার এ বাণী অবতীর্ণ হয়:
{وَأَنذِرْ عَشِيْرَتَكَ الْأَقْرَبِيْنَ} [الشعراء:214]،
‘‘আর তুমি সতর্ক কর তোমার নিকটাত্মীয় স্বজনদের।’ (আশ-শু‘আরা ২৬ : ২১৪)
এটি হচ্ছে সূরাহ শু‘আরার আয়াত এবং এ সূরাহয় সর্ব প্রথমে মূসা (আঃ)-এর ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। এতে মূসা (আঃ)-এর নবুওয়তের প্রারম্ভিক কাল কিভাবে অতিবাহিত হয়েছিল, বনি ইসরাঈলসহ কিভাবে তিনি হিজরত করে ফেরাউনের কবল থেকে পরিত্রাণ লাভ করলেন এবং পরিশেষে কিভাবে স্বদলবলে ফেরাউনকে নিমজ্জিত করা হল সেব কথা বলা হয়েছে। অন্য কথায়, ফেরাউন এবং তাঁর কওমকে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত প্রদান করতে গিয়ে মূসা (আঃ)-কে যে সকল পর্যায় অতিক্রম করতে হয়েছিল এ ছিল সেই কর্মকান্ডের একটি সমন্বিত আলোচনা।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে যখন তাঁর আত্মীয়-পরিজন এবং স্বগোত্রীয় লোকজনদের নিকট দ্বীনের প্রকাশ্য দাওয়াত পেশ করার নির্দেশ দেয়া হল সেই প্রসঙ্গে মূসা (আঃ)-এর ঘটনাবলীর বিস্তারিত বিবরণাদি এ কারণেই তুলে ধরা হল, যাতে প্রকাশ্য দাওয়াতের পর কিভাবে মিথ্যা এবং বাতিলের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হয়ে যায় এবং হক পন্থীদের কিভাবে অন্যায়-অত্যাচারে সম্মুখীন হতে হয় তার একটি চিত্র নাবী কারীম (সাঃ) এবং সাহাবীগণের (রাঃ) সম্মুখে বিদ্যমান থাকে।
দ্বিতীয়তঃ এ সূরাহর মধ্যে নাবী-রাসূলদের মিথ্যা প্রতিপন্নকারী জাতিসমূহ, যথাঃ ফেরাউন ও তার দল ব্যতীত নূহ (আঃ)-এর সম্প্রদায়, আদ, সামুদ, ইবরাহীম (আঃ)-এর সম্প্রদায়, লুত (আঃ)-এর সম্প্রদায় এবং আসহাবুল আইকার পরিণতির কথাও উল্লেখিত হয়েছে। সম্ভবতঃ এর উদ্দেশ্য হচ্ছে যে সকল কওম নাবী-রাসূলদের মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে, তাঁদের উপর তাদের হঠকারিতার পরিণতি, কী কৌশলে আল্লাহ তাঁদের ধ্বংস করে দিতে পারেন, তাদের পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে এবং ঈমানদারগণ অজস্র বিপদাপদ পরিবেষ্টিত থেকেও আল্লাহর রহমতে কিভাবে পরিত্রাণ লাভ করে থাকেন তা তুলে ধরাই হচ্ছে এর নিগূঢ় উদ্দেশ্য।
ফুটনোটঃ
আত্মীয়-স্বজনদের নিকট প্রচারের নির্দেশ (الدَّعْـوَةُ فِي الْأَقْرَبِيْنَ):
প্রথম সম্মেলন : যাহোক, এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর নাবী কারীম (সাঃ) বনু হাশিম গোত্রকে একত্রিত করে এক সম্মেলনের আয়োজন করেণ। সেই সম্মেলনে বনু মুত্তালিব বিন আবদে মানাফেরও এক দল লোক উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনে উপস্থিত লোকদের সংখ্য ছিল পঁয়তালিশ জন। সম্মেলনের শুরুতেই আবূ লাহাব আকস্মিকভাবে বলে উঠলেন, ‘দেখ এঁরা সকলেই তোমার নিকট আত্মীয়- চাচা, চাচাত ভাই ইত্যাদি। বাচালতা বাদ দিয়ে এদের সঙ্গে ভালভাবে কথাবার্তা বলার চেষ্টা করবে। তোমার জানা উচিত যে তোমার জন্য সকল আরববাসীদের সঙ্গে শত্রুতা করার শক্তি আমাদের নেই। তোমার আত্মীয়-স্বজনদের পক্ষে তোমাকে ধরে কারারুদ্ধ করে রাখাই কর্তব্য। সুতরাং তোমার জন্য তোমার পিতৃ-পরিবারই যথেষ্ট। তুমি যদি তোমার ধ্যান-ধারণা এবং কথাবার্তায় অটল থাক তবে এটা অনেক সহজ এবং স্বাভাবিক যে সমগ্র কুরাইশ গোত্র তোমার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবে এবং অন্যান্য আরব গোত্র এ ব্যাপারে সহযোগিতা করবে। তারপর এটা আমার জানার বিষয় নয় যে, স্বীয় পিতৃপরিবারের আর অন্য কেউ তোমার চাইতে বড় সর্বনাশা হতে পারে। আবূ লাহাবের এ জাতীয় অর্থহীন আস্ফালনের প্রেক্ষাপটে নাবী কারীম (সাঃ) সম্পূর্ণ নীরবতা অবলম্বন করলেন এবং ঐ নীরবতার মধ্য দিয়েই সম্মেলন শেষ হয়ে গেল।
দ্বিতীয় সম্মেলনঃ
এরপর নাবী কারীম (সাঃ) স্বগোত্রীয় লোকজনদের একত্রিত করে দ্বিতীয় সম্মেলনের ব্যবস্থা করেন। সম্মেলনে উপস্থিত জনতাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন,
الحَمْدُ لِلهِ، أَحْمَدُهُ وَأَسْتَعِيْنُهُ، وَأُوْمِنُ بِهِ، وَأَتَوَكَّلُ عَلَيْهِ. وَأَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلٰهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ
‘‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য, আমি তাঁর প্রশস্তি বর্ণনা করছি এবং তাঁরই সাহায্য প্রার্থনা করছি। তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপন করছি, তাঁর উপরেই নির্ভর করছি এবং সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউই উপাসনার যোগ্য নয়। তিনি একক এবং অদ্বিতীয়, তাঁর কোন অংশীদার নেই।
তারপর তিনি বলেনঃ
(إِنَّ الرَّائِدَ لَا يَكْذِبُ أَهْلَهُ، وَاللهِ الَّذِيْ لاَ إِلٰهَ إِلاَّ هُوَ، إِنِّىْ رَسُوْلُ اللهِ إِلَيْكُمْ خَاصَّةً وَإِلَى النَّاسِ عَامَّةً، وَاللهِ لَتَمُوْتُنَّ كَمَا تَنَامُوْنَ، وَلَتَبْعَثُنَّ كَمَا تَسْتَيْقِظُوْنَ، وَلَتَحَاسَبْنَ بِمَا تَعْمَلُوْنَ، وَإِنَّهَا الْجَنَّةُأَبَدًا أَوِ النَّارِ أَبَدًا)
‘‘কল্যাণকামী পথ-প্রদর্শক স্বীয় আত্মীয়-পরিজনগণের নিকট কখনই মিথ্যা বলতে পারেন না, সেই আল্লাহর শপথ যিনি ব্যতীত অন্য কোনই উপাস্য নেই। বিশেষভাবে তোমাদের জন্য এবং সাধারণভাবে বিশ্বের সকল মানুষের জন্য আমি আল্লাহর রাসূল হিসেবে প্রেরিত হয়েছি। আল্লাহ জানেন, তোমরা সকলেই সেভাবেই মৃত্যুর সম্মুখীন হবে যেমনটি বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ো এবং সেভাবেই পুনরায় উত্থিত হবে যেমনটি তোমরা ঘুমন্ত অবস্থা থেকে জাগ্রত হও। পুনরুত্থান দিবসে তোমাদের সফলতা সম্পর্কে হিসাব গ্রহণ করা হবে এবং পুণ্যের ফলশ্রুতি হিসেবে চিরস্থায়ী সুখ-শান্তির আবাস স্থল জন্নাতে ও পাপাচারের ফলশ্রুতি হিসেবে কঠিন আযাব ও দুঃখ কষ্টের আবাসস্থল জাহান্নামে প্রবেশ করানো হবে।
এ কথা শুনে আবূ ত্বালিব বললেন, (জিজ্ঞেস করো না) আমরা কতটুকু তোমার সাহায্য করতে পারব, তোমার উপদেশ আমাদের জন্য কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে এবং তোমার কথাবার্তা কতটুকু সত্য বলে আমরা জানব। এখানে সমবেত লোকজন তোমার পিতৃ-পরিবারের সদস্য এবং আমিও অনুরূপ একজন সদস্য। পার্থক্য শুধু এ টুকুই যে, তোমার সহযোগিতার জন্য তাঁদের তুলনায় আমি অগ্রগামী আছি। অতএব, তোমার নিকট যে নির্দেশাবলী অবতীর্ণ হয়েছে তদনুযায়ী কাজ সম্পাদন করতে থাক। আল্লাহ ভরসা, আমি অবিরামভাবে তোমার কাজকর্ম দেখাশোনা ও তোমাকে সহানুভূতি করতে থাকব। তবে আব্দুল মুত্তালিবের দ্বীন ত্যাগ করতে আমি প্রস্তুত নই।
আবূ লাহাব বললেনঃ ‘আল্লাহর শপথ, এ হচ্ছে অন্যায় এবং দুষ্টামি-নষ্টামি। এর হাত অন্যদের আগে তোমরাই ধরে নাও।’
আবূ লাহাবের মুখ থেকে এ কথা শ্রবণের পর আবূ ত্বালিব বললেন, ‘আল্লাহর শপথ করে বলছি, যতক্ষণ আমার দেহে প্রাণ থাকবে আমি তাঁর হেফাযত বা রক্ষণাবেক্ষণ করতে থাকব।[1]
ফুটনোটঃ[1] ইবনুল আসিরঃ ফিকহুস সীরাহ পৃঃ ৭৭ ও ৮৮।
সাফা পর্বতের উপর (عَلٰى جَبَلِ الصَّفَا):
যখন নাবী কারীম (সাঃ) খুব ভালভাবে নিশ্চিত হলেন যে, আল্লাহর দ্বীন প্রচারের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে আবূ ত্বালিব তাঁকে সাহায্য করবেন তখন এক দিবস তিনি সাফা পর্বত শিখরে আরোহণ করে জন সাধারণকে আহবান করলেন, (يَا صَبَاحَاه) হায় প্রাতঃকাল[1] ব’লে তা শ্রবণ করে কুরাইশ গোত্রের লোকেরা সেখানে যখন সমবেত হলেন তখন তিনি সকলকে লক্ষ্য করে আল্লাহর একত্ববাদ, স্বীয় নবুওয়ত এবং পরকালীন জীবনের উপর বিশ্বাস স্থাপনের জন্য অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় সকলকে আহবান জানালেন। এ ঘটনার এক অংশ সহীহুল বুখারীতে ইবনে আব্বাস কর্তৃক এইভাবে বর্ণিত হয়েছেঃ
যখন {وَأَنْذِرْ عَشِيْرَتَكَ الْأَقْرَبِيْ} আয়াত অবতীর্ণ হল তখন নাবী কারীম (সাঃ) সাফা পর্বত শিখরে আরোহন করে কুরাইশ গোত্রের সকলকে লক্ষ্য করে বিশেষ কিছু শব্দ উচ্চারণ করে চিৎকার করতে থাকলেনঃ
يَا بَنِيْ فِهْرٍ، يَا بِنْيِ عَدِىٍّ، (يَا بَنِيْ فُلَانٍ، يَا بَنِيْ فُلَانٍ، يَا بَنِيْ عَبْدِ مَنَافٍ، يَا بَنِيْ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ)
‘‘ওহে বনু ফিহর! ওহে বনু আদী! (ওহে বনু অমুক, ওহে বনু ওমুক, ওহে বনু আবদে মানাফ, ওহে বনু আবদুল মুত্তালিব)
এ আহবান শ্রবণ করে সকলেই সেখানে সমবেত হয়ে গেলেন। এমনকি কোন ব্যক্তির পক্ষে তাঁর উপস্থিতি সম্ভব না হলে ব্যাপারটি সম্পর্কে অবগত হওয়ার জন্য তিনি প্রতিনিধি প্রেরণ করলেন। ফলকথা হচ্ছে কুরাইশ গোত্রের সকলকেই সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। আবূ লাহাবও উপস্থিত ছিলেন।
তারপর নাবী কারীম (সাঃ) বললেন,
(أَرَأَيْتُكُمْ لَوْ أَخْبَرْتُكُمْ أَنَّ خَيْلًا بِالْوَادِىِّ بِسَفْح هٰذَا الْجَبَلِ تُرِيْدُ أَنْ تَغَيَّرَ عَلَيْكُمْ أَكُنْتُمْ مُصَدِّقِىَّ؟)
‘‘হে কুরাইশ বংশীয়গণ! তোমরা বল, আজ (এ পর্বত শিখরে দাঁড়িয়ে) যদি আমি তোমাদিগকে বলি যে, পর্বতের অন্য দিকে এক প্রবল শত্রু সৈন্য বাহিনী তোমাদের যথা- সর্বস্ব লুণ্ঠনের জন্য অপেক্ষা করছে তাহলে তোমরা আমার এ কথার উপর বিশ্বাস স্থাপন করবে কি?
সকলে সমস্বরে উত্তর করল হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, বিশ্বাস না করার কোনই কারণ নেই। আমরা কখনো আপনাকে মিথ্যার সংস্পর্শে আসতে দেখি নি।
তখন গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলতে লাগলেন ,
(إِنِّىْ نَذِيْرٌ لَّكُمْ بَيْنَ يَدْى عَذَابٍ شَدِيْدٍ، إِنَّمَا مَثَلِىْ وَمَثَلُكُمْ كَمَثَلِ رَجُلٍ رَأَي الْعَدُوَّ فَانْطَلَقَ يَرْبَأ أَهْلَهُ) ( أَيْ يَتَطَلِّعُ وَيُنْظَرُ لَهُمْ مِنْ مَكَانٍ مُّرْتَفِعٍ لِئَلاَّ يُدْهِمُهُمْ الْعَدُوُّ) (خَشِىَ أَنْ يَسْبِقُوْهُ فَجَعَلَيُنَادِىْ: يَا صَبَاحَاه)
‘‘যদি তাহাই হয়, তবে শ্রবণ করুন। আমি আপনাদেরকে (পাপ ও আল্লাহ দ্রোহিতার ভীষণ পরিণাম ও তজ্জনিত) অবশ্যম্ভাবী কঠোর দন্ডের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য প্রেরিত হয়েছি ……………………।
অতঃপর সাধারণ ও বিশেষভাবে সকলকে সত্যের পথে আহ্বান জানালেন এবং তাদেরকে আল্লাহর কঠিন শাস্তির ভয় প্রদর্শন করে বললেন
“হে কুরাইশগণ, তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুণ থেকে রক্ষা কর এবং তোমাদের নিজেদেরকে আল্লাহর নিকট সঁপে দিয়ে তার সন্তুষ্টি অর্জন করো।”
“হে বনু কা’ব বিন লুহাই, তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুণ থেকে রক্ষা কর। কেননা আমি তোমাদের কোন উপকার বা ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখি না।”
“হে বনু কা’ব বিন মুররাহ, তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুণ থেকে রক্ষা কর।”
“হে বনু কুসাই সম্প্রদায়, তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুণ থেকে রক্ষা কর। কেননা আমি তোমাদের কোন উপকার বা ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখি না।”
“হে বনু আবদে মানাফ সম্প্রদায়, তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুণ থেকে রক্ষা কর। কারণ, আমি আল্লাহর নিকট তোমাদের উপকার বা অপকার কিছুরই মালিক নই। আমি আল্লাহর নিকট তোমাদের জন্য কোন উপকারে আসবো না ।”
“হে বনু আবদে শামস, তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুণ থেকে বাঁচাও।”
“হে বনু হাশিম, তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুণ থেকে বাঁচাও।”
“হে বনু আব্দুল মুত্তালিব সম্প্রদায়, তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুণ থেকে বাঁচাও। কারণ, আমি তোমাদের উপকার বা অপকার কিছুরই মালিক নই। আমি আল্লাহর নিকট তোমাদের জন্য কোন উপকারে আসবো না। আমার নিকট থেকে তোমরা ইচ্ছমতো কোন সম্পদ চেয়ে পার কিন্তু আমি আল্লাহর নিকট তোমাদের জন্য কোন উপকারে আসবো না।”
“হে বনু আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব, আমি আল্লাহর নিকট তোমাদের জন্য কোন উপকারে আসবো না।”
“হে সাফিয়্যাহ বিনতে আব্দুল মুত্তালিব (রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ফুফু), আমি আপনার জন্য আল্লাহর নিকট কোন উপকারে আসবো না।”
“হে বনু হে ফাত্বিমাহ বিনতে মুহাম্মাদ! তুমি নিজেকে দোযখ থেকে বাঁচাও। কারণ, আমি আল্লাহর নিকট তোমাদের (উপকার-অপকার) কিছুরই মালিক নই। আমি তোমার জন্য আল্লাহর নিকট কিছুই করতে পারবো না। তবে তোমাদের সাথে (আমার) যে আত্মীয়তা রয়েছে তা আমি (দুনিয়াতে) অবশ্যই আর্দ্র রাখব। অর্থাৎ যথাযথভাবে আতীয়তা বজায় রাখবো।”
যখন এ ভীতিপ্রদর্শনমূলক বক্তব্য শেষ হলো সম্মেলন ভেঙ্গে গেল ও লোকজন যার যার মতো চলে গেল, কেউ কোন প্রতিবাদ করল না। কিন্তু আবূ লাহাব মন্দ উদ্দেশ্য নিয়ে নাবী (র)-এর নিকটে এসে বলে উঠলেন, ‘তোর সর্বনাশ হোক! এ জন্য কি তুই এখানে আমাদেরকে সমবেত করেছিস? এর ফলশ্রুতিতে আয়াতে কারীমা অবতীর্ণ হলো :[2]
{تَبَّتْ يَدَا أَبِيْ لَهَبٍ وَتَبَّ} [سورة المسد:1]
‘‘আবূ লাহাবের হাত ধ্বংস হোক।’ (আল-মাসাদ ১১১ : ১)
এভাবে উচ্চকণ্ঠে আহানের উদ্দেশ্য ছিল দীনের দাওয়াতের বাণী পৌছে দেয়া। এর মাধ্যমে রাসূল (সাঃ) তার নিকটস্ত লোকেদের মাঝে এটা পরিস্কার করলেন যে, তাঁর রেসালাতকে সত্যায়ন করার অর্থই হলো, রাসূল (সাঃ) এবং তাদের মধ্যে একটা সৌহাদ্যপূর্ণ জীবনের সূত্রপাত করণ। আর আরবে যে আত্মীয় সম্বন্ধের যে মজবুত ভিত্তি রয়েছে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা সতর্কবাণীর তুলনায় নিতান্তই নগণ্য।
এর প্রতিধ্বনি মক্কার অলি-গলিতে পৌছেই নি এমন সময় নাযিল হলো
فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِينَ
“কাজেই তোমাকে যে বিষয়ের হুকুম দেয়া হয়েছে তা জোরে শোরে প্রকাশ্যে প্রচার কর, আর মুশরিকদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও।” (আল-হিজর : ৯৪)
এ আয়াত অবতীর্ণের পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মুশরিক সমাজে ও অলি-গলি ঘুরে ঘুরে প্রকাশ্যভাবে দাওয়াত দেয়া শুরু করলেন। তাদের নিকট আল্লাহর কিতাব পড়ে শুনাতে থাকলেন, অন্যান্য রাসূলগণ যা দাওয়াত দিতেন তাই প্রচার করতে থাকলেন অর্থ্যাৎ [يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَٰهٍ غَيْرُهُ] “হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তিনি ছাড়া তোমাদের কোন ইলাহ নেই।” এবং দৃষ্টির সামনেই আল্লাহর ইবাদত করতে লাগলেন। অতঃপর তিনি প্রকাশ্য দিবালোকে কুরাইশ নেতাদের সম্মুখে কাবাহ প্রাঙ্গণে সালাত আদায় করতেন। তাঁর দীনের দাওয়াত দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে লাগল এবং একের পর এক লোকজন শান্তির ধর্ম ইসলামে দীক্ষিত হতে থাকলেন। ফলশ্রুতিতে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছেন এবং যারা ইসলাম গ্রহণ করেন নি
এ উভয় দলের বাড়িতে বাড়িতে হিংসা-বিদ্বেষ, শত্রুতা-বিরোধীতা ক্রমে বেড়েই চললো এবং কুরাইশগণ সর্বদিক থেকে মুমিনদের ঘৃণা করতে থাকলেন এবং তাদের সাধ্যমত ইসলামের সাথে মন্দ আচরণ করতে লাগলো।
ফুটনোটঃ[1] তৎকালীন সময়ে আরবের নিয়ম ছিল ভয়ঙ্কর কোন বিপদের আশঙ্কা দেখা দিলে কিংবা কেউ দেশবাসীর নিকট কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিচার কিংবা প্রতিকার প্রার্থী হলে পর্বত শীর্ষে আরোহণ করে (ইয়াসাবাহাহ) হায় প্রাতঃকাল বলে চিৎকার করতে থাকত। এতে লোকজন সেখানে সমবেত হতো।
[2] সহীহুল বুখারী ২য় খণ্ড ৭০২ ও ৭৪৩ পৃঃ, সহীহুল মুসলিম ১ম খণ্ড ১১৪ পৃঃ।
হজ্জ যাত্রীগণকে বাধা দেয়ার বৈঠক (المَجْلِسُ الْاِسْتِشَارِيْ لِكَفِّ الْحِجَاجِ عَنْ اِسْتِمَاعِ الدَّعْوَةِ):
যে সময়ের কথা ইতোপূর্বে বলা হল সেই সময়ে কুরাইশগণের সামনে আরও একটি সমস্যা দেখা দিল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রকাশ্য প্রচার অভিযানের কয়েক মাস অতিবাহিত হতে না হতেই হজ্জের মৌসুম এসে উপস্থিত হল। যেহেতু এ মৌসুমে আরব ভূমির দূর দূরান্ত থেকে বিভিন্ন গোত্রের প্রতিনিধি দলের আগমন আরম্ভ হয়ে যাবে এবং সেহেতু মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁদের নিকটে প্রচারাভিযান শুরু করবেন সেহেতু তাঁর সম্পর্কে সমাগত সকলের নিকট এমন এক কথা বলার প্রয়োজনবোধ করলেন যার ফলে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর উপর ক্রিয়ার সৃষ্টি করবে না। এ প্রেক্ষিতে এ ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা ও সলাপরামর্শের জন্য তাঁরা অলীদ বিন মুগীরার গৃহে সমবেত হলেন। অলীদ বললেন ‘এ ব্যাপারে তোমাদের মতামত ঠিক, কারো যাতে এ নিয়ে তোমাদের পরস্পরের মধ্যে মতবিরোধ কিংবা মত পার্থক্যের সৃষ্টি না হয় এবং তোমাদের একজনের কথাকে অন্যজন যেন মিথ্যা প্রতিপন্ন না করে।’
অন্যেরা বললেন, ‘আপনি একটা মোক্ষম মন্তব্য ঠিক করে দিন তাহলেই তা আমাদের সকলের জন্য গ্রহণযোগ্য হবে।’
তিনি বললেন, ‘না তা হবে না বরং তোমরা বলবে এবং আমি তা শুনব।’
ওলীদের এ কথার পর কয়েকজন সমস্বরে উঠলেন ‘আমরা মন্তব্য করব যে, তিনি কাহিন।’
অলীদ বললেন, ‘না আল্লাহর শপথ তিনি কাহিন (গণক) নয়।
আমরা অনেক কাহিন দেখেছি। ইনি তো কাহিনদের মতো গুনগুন করে গান গান না। ছন্দাকারে কবিতা আবৃত্তি করেন না কিংবা কবিতা রচনাও করেন না।’
অন্যরা বললেন, ‘তাহলে আমরা তাঁকে একজন পাগল বলব।’
অলীদ বললেন, ‘না তিনি তো পাগল নন, আমরা পাগল দেখেছি এবং তাঁর রকম সকম সম্পর্কে জানি। এ লোকের মধ্যে পাগলাদের মতো দম বন্ধ করে থাকা, অস্বাভাবিক কোন কাজকর্ম করা অসংলগ্ন কথাবার্তা বলা কিংবা অনুরূপ কোন কিছুই তো দেখি না।’
অন্যেরা বললেন, ‘তাহলে আমরা বলব যে, তিনি একজন কবি।’
অলীদ বললেন, ‘তাঁর মধ্যে কবির কোন বৈশিষ্ট্য নেই যে, তাঁকে কবি বলা হবে। রযয, হাজয, কারীয, মাকবুয, মাবসুত ইত্যাদি সর্বপ্রকার কাব্যরীতি সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। যাহোক তাঁর কথাবার্তাকে কিছুতেই কাব্য বলা যেতে পারে না।’
অন্যেরা বললেন, ‘তাহলে আমরা তাঁকে যাদুকর বলব।’
অলীদ বললেন, ‘এ ব্যক্তিকে যাদুকরও বলা যেতে পারে না। আমরা যাদুকর এবং যাদু সংক্রান্ত নানা ফন্দি-ফিকির দেখেছি, তারা সত্যমিথ্যা কত কথা বলে, কত অঙ্গ-ভঙ্গি করে কত যে, ঝাড়-ফুঁক করে এবং গিরা দেয় তার ইয়ত্তা থাকেনা। কিন্তু এ ব্যক্তি তো যাদুকরদের মতো সত্য-মিথ্যা কথা বলা, ঝাড়-ফুঁক কিংবা গিরা দেয়া কোন কিছুই করে না।’
অন্যেরা তখন বললেন, ‘আমরা তাহলে আর কী বলব।’
অলীদ বললেন, ‘আল্লাহর শপথ, তাঁর কথাবার্তা বড়ই মিষ্টি মধুর, তাঁর ভিত শিকড় বড়ই শক্ত এবং শাখা-প্রশাখা বড়ই মনোমুগ্ধকর। তোমরা তাঁর সম্পর্কে যাই বল না কেন, যাঁরা তাঁর সংস্পর্শে কিছুক্ষণ থাকবেন তাঁরা তোমাদের কথাবার্তাকে অবশ্যই মিথ্যা মনে করবেন। তারপর কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে পুনরায় তিনি বললেন, ‘তাঁর সম্পর্কে যদি কিছু বলতেই হয় তাহলে খুব জোর যাদুকর বলতে পারো। তাঁর এটা কিছুটা উপযোগী বলে মনে হতে পারে। তিনি এমন সব কথা উত্থাপন করেছেন যা যাদু বলেই মনে হয়। তিনি পিতাপুত্রের মধ্যে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে, ভাই-ভাইয়ের মধ্যে গোত্রে গোত্রে, আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে দিয়েছেন।’
শেষ পর্যন্ত তাঁরা তাঁকে যাদুকর বলার সিদ্ধান্তে একমত হয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলেন।[1]
কোন কোন বর্ণানায় এ কথাও বলা হয়েছে যে, অলীদ যখন তাঁদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দিলেন তখন তাঁরা বললেন, ‘আপনি তাহলে আপনার গ্রহণযোগ্য অভিমত ব্যক্ত করুন।’ প্রত্যুত্তরে অলীদ বললেন, ‘আমাকে তবে কিছু চিন্তা-ভাবনা করার সুযোগ দাও।’ এরপর তিনি বহুক্ষণ ধরে চিন্তা-ভাবনা করতে থাকেন এবং উল্লেখিত অভিমত ব্যক্ত করেন।[2]
এ ব্যাপারে অলীদ সম্পর্কে সূরাহ মুদ্দাসসিরের ১৬ টি আয়াত (১১-২৬) অবতীর্ণ হয়েছে :
{ذَرْنِيْ وَمَنْ خَلَقْتُ وَحِيْدًا وَجَعَلْتُ لَهُ مَالًا مَّمْدُوْدًا وَبَنِيْنَ شُهُوْدًا وَمَهَّدتُّ لَهُ تَمْهِيْدًا ثُمَّ يَطْمَعُ أَنْ أَزِيْدَ كَلَّا إِنَّهُ كَانَ لِآيَاتِنَا عَنِيْدًا سَأُرْهِقُهُ صَعُوْدًا إِنَّهُ فَكَّرَ وَقَدَّرَ فَقُتِلَ كَيْفَ قَدَّرَ ثُمَّ قُتِلَ كَيْفَقَدَّرَ ثُمَّ نَظَرَ ثُمَّ عَبَسَ وَبَسَرَ ثُمَّ أَدْبَرَ وَاسْتَكْبَرَفَقَالَ إِنْ هٰذَا إِلَّا سِحْرٌ يُؤْثَرُ إِنْ هٰذَا إِلَّا قَوْلُ الْبَشَرِسَأُصْلِيْهِ سَقَرَ} [من 11 إلى 26]
‘১১. ছেড়ে দাও আমাকে (তার সঙ্গে বুঝাপড়া করার জন্য) যাকে আমি এককভাবে সৃষ্টি করেছি। ১২. আর তাকে (ওয়ালীদ বিন মুগীরাহ্কে) দিয়েছি অঢেল ধন-সম্পদ, ১৩. আর অনেক ছেলে যারা সব সময় তার কাছেই থাকে। ১৪. এবং তার জীবনকে করেছি সচ্ছল ও সুগম। ১৫. এর পরও সে লোভ করে যে, আমি তাকে আরো দেই। ১৬. কক্ষনো না, সে ছিল আমার নিদর্শনের বিরুদ্ধাচারী। ১৭. শীঘ্রই আমি তাকে উঠাব শাস্তির পাহাড়ে (অর্থাৎ তাকে দিব বিপদের উপর বিপদ)। ১৮. সে চিন্তা ভাবনা করল এবং সিদ্ধান্ত নিল, ১৯. ধ্বংস হোক সে, কিভাবে সে (কুরআনের অলৌকিকতা স্বীকার করার পরও কেবল অহমিকার বশবর্তী হয়ে নবুওয়াতকে অস্বীকার করার) সিদ্ধান্ত নিল! ২০. আবারো ধ্বংস হোক সে, সে সিদ্ধান্ত নিল কিভাবে! ২১. তারপর সে তাকালো। ২২. তারপর ভ্রু কুঁচকালো আর মুখ বাঁকালো। ২৩. তারপর সে পিছনে ফিরল আর অহংকার করল। ২৪. তারপর বলল- ‘এ তো যাদু ছাড়া আর কিছু নয়, এ তো পূর্বে থেকেই চলে আসছে। ২৫. এটা তো মানুষের কথা মাত্র।’ ২৬. শীঘ্রই আমি তাকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করব।’ (আল-মুদ্দাসসির ৭৪ : ১১-২৬)
যার মধ্যে কয়েকটি আয়াতে তাঁর চিন্তার ধরণ সম্পর্কিত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছেঃ
{إِنَّهُ فَكَّرَ وَقَدَّرَ فَقُتِلَ كَيْفَ قَدَّرَ ثُمَّ قُتِلَ كَيْفَ قَدَّرَ ثُمَّ نَظَرَ ثُمَّ عَبَسَ وَبَسَرَ ثُمَّ أَدْبَرَ وَاسْتَكْبَرَ فَقَالَ إِنْ هٰذَا إِلَّا سِحْرٌ يُؤْثَرُ إِنْ هٰذَا إِلَّا قَوْلُ الْبَشَرِ} [المدثر:18: 25]
‘‘১৮. সে চিন্তা ভাবনা করল এবং সিদ্ধান্ত নিল, ১৯. ধ্বংস হোক সে, কিভাবে সে (কুরআনের অলৌকিকতা স্বীকার করার পরও কেবল অহমিকার বশবর্তী হয়ে নবুওয়াতকে অস্বীকার করার) সিদ্ধান্ত নিল! ২০. আবারো ধ্বংস হোক সে, সে সিদ্ধান্ত নিল কিভাবে! ২১. তারপর সে তাকালো। ২২. তারপর ভ্রু কুঁচকালো আর মুখ বাঁকালো। ২৩. তারপর সে পিছনে ফিরল আর অহংকার করল। ২৪. তারপর বলল- ‘এ তো যাদু ছাড়া আর কিছু নয়, এ তো পূর্বে থেকেই চলে আসছে। ২৫. এটা তো মানুষের কথা মাত্র।’ (আল-মুদ্দাসসির ৭৪ : ১৮-২৬)
যা হোক, তাঁরা যে সিদ্ধান্ত করলেন তা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে এখন থেকে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকলেন। কিছু সংখ্যক কাফির মক্কায় আগমনকারী হজ্জযাত্রীগণের পথের পাশে কিংবা পথের মোড়ে মোড়ে জটলা করে নাবী কারীম (সাঃ)-এর প্রচার এবং তাবলীগের ব্যাপারে যা ইচ্ছে তাই বলে হজ্জযাত্রীগণকে বিভ্রান্ত করতে শুরু করলেন। নাবী কারীম (সাঃ) সম্পর্কে তাঁদের সতর্ক করে দিয়ে তাঁর সম্পর্কে বহু কিছু বলতে থাকলেন।[3] এ সব ব্যাপারে আবূ লাহাব অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
হজ্বের মৌসুমে হজ্ব যাত্রীগণের শিবিরে এবং উকায, মাজিন্নাহ ও যুলমাজায বাজারে নাবী কারীম (সাঃ) যখন আল্লাহর একত্ব এবং দ্বীনের তাবলীগ করতেন তখন আবূ লাহাব তাঁর পিছন পিছন গিয়ে বলতেন, ‘এর কথায় তোমরা কান দিয়ো না। সে মিথ্যুক এবং বেদ্বীন হয়ে গিয়েছে।[4]
এভাবে দৌড় ঝাপের ফল হল যে, হজ্ব পালনের পর হাজীগণ যখন নিজ নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন তখন তাঁরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সম্পর্কে ভালভাবে অবগত হয়ে গৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন। তাছাড়া তাঁরা এ কথাও অবগত হয়ে গেলেন যে মুহাম্মাদ (সাঃ) নবুওয়ত দাবী করেছেন। এভাবে হজ্ব যাত্রীগণের মাধ্যমেই নাবী কারীম (সাঃ)-এর নবুওয়ত এবং ইসলামের প্রাথমিক কথাবার্তা সমগ্র আরব জাহানে বিস্তার লাভ করল।
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ২৭১ পৃঃ।
[2] ফী যিলালিল কুরআন: পারা ২৯, পৃষ্ঠা ১৮৮।
[3] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ২৭১ পৃঃ।
[4] তিরমিযী মসনাদে আহমাদ ৩য় খন্ড ৪৯২ পৃঃ ও ৪র্থ ৩৪১ পৃঃ।
বিরুদ্ধাচরণের বিভিন্ন পন্থা (أَسَالِيْبٌ شَتّٰى لِمُجَابَهَةِ الدَّعْوَةِ):
কুরাইশগণ যখন দেখলেন যে, মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে তাঁর দ্বীনের দাওয়াত এবং তাবলীগ থেকে নিবৃত্ত করার কোন কৌশল কার্যকর হচ্ছে না তখন তাঁরা পুনরায় চিন্তাভাবনা করে তাঁর তাবলীগী কর্মকান্ডকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে ফেলার জন্য নানামুখী পন্থা-প্রক্রিয়া অবলম্বন শুরু করলেন। যে সকল পন্থা তাঁরা অবলম্বন করলেন তা হচ্ছে যথাক্রমেঃ
ফুটনোটঃ
প্রথম পন্থা : উপহাস, ঠাট্টা-তামাশা, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, মিথ্যাপ্রতিপন্ন, অকারণ হাসাহাসি (السُّخْرِيَّةُ وَالتَّحْقِيْرُ وَالْاِسْتِهْزَاءُ وَالتَّكْذِيْبُ وَالتَّضْحِيْكُ):
বিভিন্ন অবমাননাকর উক্তি ইত্যাদির মাধ্যমে নাবী কারীম (সাঃ)-কে তাঁরা জর্জরিত এবং অতীষ্ঠ করে তুলতে চাইলেন। এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল মুসলিমগণকে সন্দেহপরায়ণ, বিপন্ন ও ব্যতিব্যস্ত করে তাঁদের উদ্যম ও কাজের স্পৃহাকে নষ্ট করে দেয়া। এ উদ্দেশ্যে মুশরিকগণ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে অশালীন অপবাদ এবং গালিগালাজ করতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। তাঁরা কখনো তাঁকে পাগল বলেও সম্বোধন করতেন। যেমনটি ইরশাদ হয়েছেঃ
{وَقَالُوْا يَا أَيُّهَا الَّذِيْ نُزِّلَ عَلَيْهِ الذِّكْرُ إِنَّكَ لَمَجْنُوْنٌ} [الحجر:6]
‘‘তারা বলে, ‘ওহে ঐ ব্যক্তি যার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে! তুমি তো অবশ্যই পাগল।’ (আল-হিজর ১৫ : ৬)
কখনো কখনো নাবী (সাঃ)-কে যাদুকর বলত এবং মিথ্যার অপবাদও দিত। যেমনটি ইরশাদ হয়েছেঃ
{وَعَجِبُوْا أَن جَاءهُم مُّنذِرٌ مِّنْهُمْ وَقَالَ الْكَافِرُوْنَ هٰذَا سَاحِرٌ كَذَّابٌ} [ص:4]
‘‘আর তারা (এ ব্যাপারে) বিস্ময়বোধ করল যে, তাদের কাছে তাদেরই মধ্য হতে একজন সতর্ককারী এসেছে। কাফিরগণ বলল- ’এটা একটা যাদুকর, মিথ্যুক।’ (স্ব-দ ৩৮ : ৪)
এ কাফিরগণ নাবী (সাঃ)-এর অগ্রভাগে ও পিছনে ক্রোধান্বিত এবং প্রতি হিংসাপরায়ণ দৃষ্টিভঙ্গী ও মন-মানসিকতা নিয়ে ঘোরাফিরা করত। এ প্রসঙ্গে কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছেঃ
{وَإِن يَكَادُ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا لَيُزْلِقُوْنَكَ بِأَبْصَارِهِمْ لَمَّا سَمِعُوْا الذِّكْرَ وَيَقُوْلُوْنَ إِنَّهُ لَمَجْنُوْنٌ} [القلم:51]
‘‘কাফিররা যখন কুরআন শুনে তখন তারা যেন তাদের দৃষ্টি দিয়ে তোমাকে আছড়ে ফেলবে। আর তারা বলে, ‘সে তো অবশ্যই পাগল।’ (আল-ক্বালাম ৬৮ : ৫১)
অধিকন্তু, নাবী কারীম (সাঃ) যখন কোথাও গমন করতেন এবং তাঁর দুর্বল ও মজলুম সাহাবীগণ (রাঃ) তাঁর নিকট উপস্থিত থাকতেন তখন এদের লক্ষ্য করে মুশরিকগণ উপহাস করে বলতঃ
{مَنَّ اللهُ عَلَيْهِم مِّن بَيْنِنَا أَلَيْسَ اللهُ بِأَعْلَمَ بِالشَّاكِرِيْنَ} [الأنعام:53]
‘‘এরা কি সেই লোক আমাদের মধ্যে যাদেরকে আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন, আল্লাহ কি তাঁর কৃতজ্ঞ বান্দাহদের সম্পর্কে অধিক অবগত নন?’ (আল-আন‘আম ৬ : ৫৩)
সাধারণতঃ মুশরিকগণের অবস্থা তাই ছিল যার চিত্র নীচের আয়াত সমূহে তুলে ধরা হয়েছেঃ
{إِنَّ الَّذِيْنَ أَجْرَمُوْا كَانُوْا مِنَ الَّذِيْنَ آمَنُوْا يَضْحَكُوْنَ وَإِذَا مَرُّوْا بِهِمْ يَتَغَامَزُوْنَ وَإِذَا انقَلَبُوْا إِلىٰ أَهْلِهِمُ انقَلَبُوْا فَكِهِيْنَ وَإِذَا رَأَوْهُمْ قَالُوْا إِنَّ هَؤُلَاء لَضَالُّوْنَ وَمَا أُرْسِلُوْا عَلَيْهِمْ حَافِظِيْنَ} [المطففين:29: 333]
‘‘পাপাচারী লোকেরা (দুনিয়ায়) মু’মিনদেরকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করত। ৩০. আর তারা যখন তাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করত তখন পরস্পরে চোখ টিপে ইশারা করত। ৩১. আর তারা যখন তাদের আপন জনদের কাছে ফিরে আসত, তখন (মু’মিনদেরকে ঠাট্টা ক’রে আসার কারণে) ফিরত উৎফুল্ল হয়ে। ৩২. আর তারা যখন মু’মিনদেরকে দেখত তখন বলত, ‘এরা তো এক্কেবারে গুমরাহ্।’ ৩৩. তাদেরকে তো মু’মিনদের হিফাযাতকারী হিসেবে পাঠানো হয়নি।’ (আল-মুত্বাফফিফীন ৮৩ : ২৯-৩৩)
মুশরিকদের উপহাস, ঠাট্টা-বিদ্রুপ, হাসাহাসি ও বিভিন্নভাবে আঘাতের মাত্রা এর বাড়িয়ে দিল যে তা নাবী (সাঃ)-কে মর্মাহত করে তুলল। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন,
قَالَ فَمَا خَطْبُكُمْ أَيُّهَا الْمُرْسَلُونَ
“আমি জানি, তারা যে সব কথা-বার্তা বলে তাতে তোমার মন সংকুচিত হয়। (আল-হিজর ১৫ : ৯৭)
অতঃপর আল্লাহ তা’আলা তার অন্তরকে দৃঢ় করলেন এবং এমন বিষয়ের নির্দেশ প্রদান করলেন, যাতে করে তার অন্তর থেকে ব্যথা-বেদনা দূরীভূত হয়। এ মর্মে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন,
فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَكُنْ مِنَ السَّاجِدِينَ وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتَّىٰ يَأْتِيَكَ الْيَقِينُ
“কাজেই প্রশংসা সহকারে তুমি তোমার প্রতিপালকের পবিত্রতা ঘোষণা কর, আর সাজদাহকারীদের দলভুক্ত হও। আর তোমার রবের ইবাদত করতে থাক সুনিশ্চিত ক্ষণের (অর্থাৎ মৃত্যুর) আগমন পর্যন্ত। (আল-হিজর ১৫ : ৯৮-৯৯)
অধিকন্তু আল্লাহ তা’আলা ইতোপূর্বেই তাঁর প্রিয় হাবীবকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, এ সব ঠাট্টা-বিদ্রুপকারীদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। আল্লাহ বলেন,
إِنَّا كَفَيْنَاكَ الْمُسْتَهْزِئِينَ الَّذِينَ يَجْعَلُونَ مَعَ اللَّهِ إِلَٰهًا آخَرَ ۚ فَسَوْفَ يَعْلَمُونَ
“(সেই) ঠাট্টা-বিদ্রুপকারীদের বিরুদ্ধে তোমার জন্য আমিই যথেষ্ট। যারা আল্লাহর সাথে অন্যকেও ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে, (কাজেই শিরকের পরিণতি কী শীঘ্রই তার জানতে পারবে।” (আল-হিজর ১৫ : ৯৫-৯৬)
আল্লাহ তা’আলা আরো জানিয়ে দিলেন যে, এ অবস্থার শীঘ্রই উন্নতি হবে এবং এ ঠাট্টা-বিদ্রুপ তাদের ক্ষতির কারণ হবে।
وَلَقَدِ اسْتُهْزِئَ بِرُسُلٍ مِنْ قَبْلِكَ فَحَاقَ بِالَّذِينَ سَخِرُوا مِنْهُمْ مَا كَانُوا بِهِ يَسْتَهْزِئُونَ
“তোমার পূর্বেও রাসূলদেরকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা হয়েছে, অতঃপর যা নিয়ে তারা ঠাট্ট-বিদ্রুপ করত তাই তাদেরকে পরিবেষ্টন করে ফেলল।” (আল-আনআম ৬ : ১০)
ফুটনোটঃ
দ্বিতীয় পন্থা : সংশয় সন্দেহের উসকানি ও মিথ্যা দাওয়াতের মুখোশ উন্মোচন (إِثَارَةُ الشُّبُهَاتِ وَتَكْثِيْفِ الدِّعَايَاتِ الْكَاذِبَةِ):
নাবী (সাঃ)-এর শিক্ষা-দীক্ষার বিষয়াদির বিকৃত করে দেখানো, নবী (সাঃ)-এর শিক্ষা-দীক্ষা সম্পর্কে জনমনে সন্দেহ ও সংশয় সৃষ্টি করা এবং মিথ্যা ও অপপ্রচার করা, নাবী (সাঃ)-এর শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যক্তিত্ব ইত্যাদি সব কিছুকে অর্থহীন ও আজেবাজে প্রশ্নের সম্মুখীন করা, এ সবগুলো অনবরত এত অধিক পরিমানে করা যাতে জনসাধারণ তার দ্বীন প্রচারের দিকে ধীর স্থিরভাবে মনযোগ দেয়া কিংবা চিন্তা-ভাবনা করার সুযোগ না পায়। মুশরিকগণ যেমন কুরআন সম্পর্কে বলেছেন: (أَضْغَاثُ أَحْلَامٍ) ‘এসব অলীক স্বপ্ন’ রাত্রে তৈরি করে আর দিনে সে তিলাওয়াত করে (بَلِ افْتَرَاهُ) সে মিথ্যা উদ্ভাবন করেছে অর্থাৎ সে নিজের পক্ষ থেকে বানিয়েছে এবং তারা এও বলে যে, (إِنَّمَا يُعَلِّمُهُ بَشَرٌ) ‘এক মানুষ তাকে (মুহাম্মাদ (সা)-কে) শিখিয়ে দেয়’ (আন-নাহল : ১০৩) তারা বলে, إِنْ هَٰذَا إِلَّا إِفْكٌ افْتَرَاهُ وَأَعَانَهُ عَلَيْهِ قَوْمٌ آخَرُونَ
‘কাফিররা বলে- ‘এটা মিথ্যে ছাড়া আর কিছুই নয়, সে তা (অর্থ্যাৎ কুরআন) উদ্ভাবন করেছে এবং ভিন্ন জাতির লোক এ ব্যাপারে তাকে সাহায্য করেছে’। (আল-ফুরক্বান ২৫ : ৪)
وَقَالُوا أَسَاطِيرُ الْأَوَّلِينَ اكْتَتَبَهَا فَهِيَ تُمْلَىٰ عَلَيْهِ بُكْرَةً وَأَصِيلًا
“তারা বলে, এগুলো পূর্ব যুগের কাহিনী যা সে [অর্থাৎ মুহাম্মাদ (সাঃ)] লিখিয়ে নিয়েছে আর এগুলোই তার কাছে সকাল-সন্ধ্যা শোনানো হয়। (আল-ফুরকান ২৫ : ৫)
কখনো তারা বলত যে, কাহিনদের উপর যেমন জিন ও শয়তান নাযিল তেমনি তার উপরও একজন জিন ও শয়তান নাযিল হয়। একথার প্রতিবাদে আল্লাহ বলেন,
هَلْ أُنَبِّئُكُمْ عَلَىٰ مَن تَنَزَّلُ الشَّيَاطِينُ تَنَزَّلُ عَلَىٰ كُلِّ أَفَّاكٍ أَثِيمٍ
“তোমাদেরকে কি জানাবো কার নিকট শয়তানরা অবতীর্ণ হয়? তারা তো অবতীর্ণ হয় প্রত্যেকটি ঘোর মিথ্যাবাদী ও পাপীর নিকট”। (আশ্ শুআরা ২৬ : ২২১-২২২)
ওটা তো মিথ্যাবাদী পাপীষ্টের উপর নাযিল হয়। তোমরা আমার মধ্যে কোন মিথ্যাচার ও ফাসেকী পাও না। সুতরাং কুরআনকে কিভাবে তোমরা শয়তানের পক্ষ থেকে নাযিলকৃত বল?
কখনো তারা নাবী (সাঃ) সম্পর্কে বলত, তাকে একপ্রকার পাগলামীতে পেয়েছে, সে কিছু খেয়াল করে সে অনুযায়ী প্রজ্ঞাপূর্ণ শব্দ তৈরি করে যেমন কবিরা করে থাকে। তাদের কথার উত্তরে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, وَالشُّعَرَاءُ يَتَّبِعُهُمُ الْغَاوُونَ أَلَمْ تَرَ أَنَّهُمْ فِي كُلِّ وَادٍ يَهِيمُونَ وَأَنَّهُمْ يَقُولُونَ مَا لَا يَفْعَلُونَ
“তুমি কি দেখো না তারা বিভ্রান্ত হয়ে (কল্পনার জগতে) প্রত্যেক উপত্যকায় ঘুরে বেড়ায়? আর তারা বলে যা তারা করে না।” (আশ শুআরা ২৬ : ২২৫-২২৬)
আয়াতে কথিত গুণ তিনটি কবিদের মধ্যে পাওয়া যায়, কিন্তু নাবী (সাঃ)-এর মধ্যে এগুলো অনুপস্থিত। অধিকন্তু তার অনুসারীগণ হলেন, হিদায়াতপ্রাপ্ত, আল্লাহ ভীরু, সৎকর্মশীল তাদের চরিত্রে, কাজে কর্মে সবক্ষেত্রে। তাদেরকে কোন প্রকার বিভ্রান্ত স্পর্শ করে নি। নাবী (সাঃ) কবিদের মতো উদ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ান না বরং তিনি এক-অদ্বিতীয় প্রতিপালক, এক দীন, এক পথের দিকে আহবান করেন। তিনি যা বলেন তা পালন করেন, যা বলেন না তা করেন না। তবে তিনি কিভাবে কবিদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন, আর কবিদের সাথে তার তুলনা-ই বা কিভাবে দেয়া যায়। মুশরিকদের পক্ষে থেকে ইসলাম, কুরআন ও নাবী (সাঃ)-এর উপর আরোপিত প্রত্যেক সন্দেহের ক্ষেত্রে এভাবে সন্তোষজনক উত্তর দান করা হয়।
মুশরিকরা সবচেয়ে বেশি সন্দেহে ছিল প্রথমত তাওহীদ বিষয়ে, দ্বিতীয়ত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নবুওয়াত-রেসালাতে, তৃতীয়ত মৃতদের পুনরুজীবিত হওয়া ও কিয়ামত দিবসে হাশরের ময়দানে একত্রিত হওয়া নিয়ে। কুরআন তাওহীদ বিষয়ে তাদের সকল প্রকার সন্দেহের যথোপযুক্ত জবাব তো দিয়েছেই, বরং অনেক ক্ষেত্রে বেশি ও বিস্তারিত আকারে আলোচনা করেছে যাতে কোন সন্দেহের অবকাশ না থাকে। শুধু তা-ই নয় তাদের বাতিল মা’বুদের অসারতা সম্পর্কে এত বেশি সমালোচনা করেছে যে, এ বিষয়ে আর কোন আলোচনার অবকাশ নেই। সম্ভবত দীন ইসলাম বিষয়ে তাদের ক্রোধ-আক্রোষের পরিমাণ এত বেশি।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আল্লাহ ভীতি, তাঁর মহৎ উদ্দেশ্য, আমানতদারীতা এবং তাঁর নবুওয়াত সত্য বলে জানা সত্ত্বেও কাফিরদের সন্দেহের কারণ এই যে, তারা বিশ্বাস করতো নবুওয়াত-রিসালত এমনই বড় ও মর্যাদাপূর্ণ পদ যে তা কোন মানুষের হাতে অৰ্পন করার মতো নয়। সুতরাং তাদের আক্বীদা-বিশ্বাস মতে যেমন কোন মানুষ রাসূল হতে পারেন না, তেমনি কোন রাসূল কক্ষনো মানুষ হতে পারেন না। ফলে রাসূলল্লাহ (রঃ) যখন তাঁর নবুওয়াতের ঘোষণা দিলেন আর মানুষদেরকে আহবান জানালেন সব উপাস্যকে পরিত্যাগ করে এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন করতে তাদের বিবেক পেরেশান ও হতবাক হলো এবং তারা বলে উঠলো :
مَالِ هَٰذَا الرَّسُولِ يَأْكُلُ الطَّعَامَ وَيَمْشِي فِي الْأَسْوَاقِ ۙ لَوْلَا أُنزِلَ إِلَيْهِ مَلَكٌ فَيَكُونَ مَعَهُ نَذِيرًا
‘ এ কেমন রসূল যে খাবার খায়, আবার হাট-বাজারে চলাফেরা করে ? তার কাছে ফেরেশতা অবতীর্ণ হয় না কেন যে তার সঙ্গে থাকত সতর্ককারী হয়ে?’ (আল-ফুরক্বান ২৫ : ৭)
তার বলে মুহাম্মাদ (সাঃ) তো মানুষ- مَا أَنزَلَ اللَّهُ عَلَىٰ بَشَرٍ مِّن شَيْءٍ
“আল্লাহ কোন মানুষের কাছে কোন কিছুই অবতীর্ণ করেননি।” (আল-আন’আম ৬ ৯১)
তাদের এ দাবী খণ্ডন করে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন,
قُلْ مَنْ أَنزَلَ الْكِتَابَ الَّذِي جَاءَ بِهِ مُوسَىٰ نُورًا وَهُدًى لِّلنَّاسِ
“বল, তাহলে ঐ কিতাব কে অবতীর্ণ করেছিলেন যা নিয়ে এসেছিলেন মূসা, যা ছিল মানুষের জন্য আলোকবর্তিকা ও সঠিক পথের দিকদিশারী।” (আল-আন’আম ৬ :৯১)
অথচ তারা জানে যে আল্লাহর নাবী মূসা (আঃ)ও মানুষ ছিলেন। তাছাড়া পূর্ববতী নাবী-রাসূলকেই তার জাতি অস্বীকার করে বলতো-
إِنْ أَنتُمْ إِلَّا بَشَرٌ مِّثْلُنَا [ابراهيم ١٠] قَالَتْ لَهُمْ رُسُلُهُمْ إِن نَّحْنُ إِلَّا بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ وَلَٰكِنَّ اللَّهَ يَمُنُّ عَلَىٰ مَن يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ [ابراهيم ١١]
“তুমি আমাদেরই মত মানুষ বৈ তো নও,” “তাদের রসূলগণ তাদেরকে বলেছিল, যদিও আমরা তোমাদের মতই মানুষ ব্যতীত নই, কিন্তু আল্লাহ তার বান্দাহদের মধ্যে যার উপর ইচ্ছে অনুগ্রহ করেন।” (ইবরাহীম ১৪ : ১০-১১)
সুতরাং নাবী-রাসূল তো মানুষই হয়ে থাকে; আর রেসালাত ও মানবত্ব- এ উভয়ের কোন তফাৎ নেই।
অধিকন্তু তাদের জানা রয়েছে যে, ইবরাহীম, ইসমাঈল, মূসা (আলাইহিমুস সালাম)- তারা সকলেই মানুষ ও নাবী ছিলেন যে ব্যাপারে তাদের সন্দেহের কোন সুযোগ নেই। কাজে কাজেই তারা বলে, আল্লাহ এই দরিদ্র-ইয়াতিম ব্যতীত আর রিসালাতের দায়িত্ব দেয়ার মতো আর কাউকে পেলেন না যে তাকেই রাসূল করে পাঠাতে হবে? আল্লাহ তা’আলা মক্কার বড় বড় জাদরেল নেতাদের না বানিয়ে এই ইয়াতিমকেই রাসূল মনোনীত করলেন?
وَقَالُوا لَوْلَا نُزِّلَ هَٰذَا الْقُرْآنُ عَلَىٰ رَجُلٍ مِّنَ الْقَرْيَتَيْنِ عَظِيمٍ
“আর তারা বলে, এই কুরআন কেন অবতীর্ণ করা হলো না দু জনপদের কোন প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তির উপর?” (আয-যুখরুফ ৪৩ : ৩১)
আল্লাহ তা’আলা তাদের যুক্তি খণ্ডন করে বলেন, (أَهُمْ يَقْسِمُونَ رَحْمَتَ رَبِّكَ)
“তারা কি তোমার প্রতিপালকের রহমত বণ্টন করে?” (আয-যুখরুফ ৪৩ : ৩২)
অর্থাৎ নিশ্চয়ই ওহী আল্লাহ তা’আলার এক বিশেষ রহমত।
اللَّهُ أَعْلَمُ حَيْثُ يَجْعَلُ رِسَالَتَهُ
“নবুওয়াতের দায়িত্ব কার উপর অর্পণ করবেন তা আল্লাহ ভালভাবেই অবগত।” (আল-আন’আম ৬ : ১২৪)
আল্লাহ তা’আলার পক্ষ হতে তাদের অমূলক সন্দেহের দাঁতভাঙ্গা পেয়ে উপায়ান্তর না দেখে তারা আরেকটি বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করলো তা হলো। তারা বলল, রাসূলগণ হবেন দুনিয়ার রাজা-বাদশা তারা থাকবেন শত শত গোলাম ও পরিচারকবৃন্দ দ্বারা পরিবেষ্টিত, তাদের জীবন হবে অত্যন্ত জাকজমকপূর্ণ ও শান-শওকতপূর্ণ; তাদেরকে দেয়া হবে জীবন-জীবিকার প্রাচুর্যতা। আর মুহাম্মাদ (সঃ)-এর কী রয়েছে? সে জীবন ধানণের সামান্য বস্তুর জন্যও বাজারে যায় আবার সে দাবি করে যে, সে কিনা আল্লাহ তা’আলার প্রেরিত রাসূল?
وَقَالُوا مَالِ هَٰذَا الرَّسُولِ يَأْكُلُ الطَّعَامَ وَيَمْشِي فِي الْأَسْوَاقِ لَوْلَا أُنزِلَ إِلَيْهِ مَلَكٌ فَيَكُونَ مَعَهُ نَذِيرًا أَوْ يُلْقَىٰ إِلَيْهِ كَنزٌ أَوْ تَكُونُ لَهُ جَنَّةٌ يَأْكُلُ مِنْهَا وَقَالَ الظَّالِمُونَ إِن تَتَّبِعُونَ إِلَّا رَجُلًا مَّسْحُورًا
“তারা বলে- “এ কেমন রসূল যে খাবার খায়, আর হাট-বাজারে চলাফেরা করে? তার কাছে ফেরেশতা অবতীর্ণ হয় না কেন যে তার সঙ্গে থাকত সতর্ককারী হয়ে? কিংবা তাকে ধন-ভাণ্ডার দেয়া হয় না কেন, অথবা তার জন্য একটা বাগান হয় না কেন যা থেকে সে আহার করত? যালিমরা বলে- “তোমরা তো এক যাদুগ্ৰস্ত লোকেরই অনুসরণ করছ।” (আল-ফুরকান ২৫ : ৭-৮)
তাদের এ ভিত্তিহীন ও অমূলক সন্দেহের উপযুক্ত জবাব দেয়া হয়েছে- অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ নবী-রাসূল প্রেরণের মহা উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সুমহান বাণীকে ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র, সবল-দুর্বল, ইতর-ভদ্র, স্বাধীন বা দাস নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষের নিকট পৌঁছে দেয়া। আর যদি ঐসব নাবী রাসূল খুব শান-শওকতপূর্ণ জীবন-যাপন করেন, পরিবেষ্টিত থাকেন অসংখ্য খাদেম ও পরিচারক দ্বারা যে রমক রাজা বাদশাদের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে তবে তো দুর্বল ও দরিদ্রশ্রেণীর জনগণ তার ধারে-কাছে পৌছতেও পারবে না এবং তার নবুওয়াত-রিসালত থেকে কোন উপকারও লাভ করতে পারবে না। অথচ এরাই হচ্ছে পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী। ফলে রিসালতের মহৎ উদ্দেশ্য ব্যহত তো হবেই, উপরন্তু উপযুক্ত উদ্দেশ্য পূরণ হবে না।
আর তারা যে মৃত্যুর পর পুনথানের বিষয় অস্বীকার করে তা তাদের এ বিষয়ে আশ্চর্যতাবোধ, বেমানান মনে হওয়া ও জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই তারা বলে,
(أَإِذَا مِتْنَا وَكُنَّا تُرَابًا وَعِظَامًا أَإِنَّا لَمَبْعُوثُونَ أَوَآبَاؤُنَا الْأَوَّلُونَ)
(ذَٰلِكَ رَجْعٌ بَعِيدٌ) وكانوا يقولون
আর আমাদের পূর্বপুরুষদেরকেও (উঠানো হবে)? আমরা যখন মরব এবং মাটি ও হাড়ে পরিণত হব, তখনো কি আমাদেরকে আবার জীবিত করে উঠানো হবে?” ( আস-স-ফফাত ৩৭ : ১৬-১৭) তারা এও বলে যে, “এ ফিরে যাওয়াটা তো বহু দূরের ব্যাপার।” (ক্ব-ফ ৫০ : ৩)
তারা নিতান্ত একটা অদ্ভুত বিষয় সাব্যস্ত করে বলে,
هَلْ نَدُلُّكُمْ عَلَىٰ رَجُلٍ يُنَبِّئُكُمْ إِذَا مُزِّقْتُمْ كُلَّ مُمَزَّقٍ إِنَّكُمْ لَفِي خَلْقٍ جَدِيدٍ أَفْتَرَىٰ عَلَى اللَّهِ كَذِبًا أَم بِهِ جِنَّةٌ
“কাফিরগণ বলে- তোমাদেরকে কি আমরা এমন একজন লোকের সন্ধান দেব যে তোমাদেরকে খবর দেয় যে, তোমরা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেলেও তোমাদেরকে নতুনভাবে সৃষ্টি করা হবে? সে আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যে বলে, না হয় সে পাগল। বস্তুতঃ যারা আখিরাতে বিশ্বাস করে না তারাই শাস্তি এবং সুদূর গুমরাহীতে পড়ে আছে।” (সাবা ৩৪ : ৭-৮) তাদের কেউ এ কবিতা চরণ আবৃত্তি করে-
أمؤيك ثم بغك ثم حَشرُ ** حديث لخرافة يا أم عمرو
“মৃত্যু বরণ, অতঃপর পুনঃজীবন লাভ, আবার একত্রিতকরণ! হে উম্মু আমরা এটা তো কল্পকাহিনী ব্যতিত আর কিছুই নয়”।
তাদের এ দাবীকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে খণ্ডন করা হয়েছে। বাস্তব অবস্থা এমন দেখা যায় যে, যালিম তার যুলুমের প্রতিফল না ভোগ করেই মারা যায়, অত্যাচারিত ব্যক্তি তার অত্যাচারের বদলা না পেয়েই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে, সৎকর্মশীল ব্যক্তি তার সৎকর্মের প্রতিদানপ্রাপ্ত হওয়ার পূর্বেই দুনিয়া ছেড়ে পরপারে চলে যায়, নিকৃষ্ট পাপী তার পাপের প্রতিফল আস্বাদন করার পূর্বেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়। এমতাবস্থায় যদি পুনরায় জীবন লাভ এবং মৃত্যুর পর উভয় দলের মধ্যে কোন সমতা বিধান করা না হয় বরং সৎকর্মশীল ব্যক্তির চেয়ে নিকৃষ্ট পাপী, অত্যাচারী বিনা শাস্তিতে মৃত্যুবরণ করার সৌভাগ্যলাভে ধন্য হয় তবে তো এমন দাঁড়ায় যে, তা সুস্থ বিবেক তা কক্ষনোই সমর্থন করে না করতে পারে না। আর আল্লাহ তা’আলাও তার এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডতে শুধু ফিতনা ফাসাদের আখড়ায় পরিণত করার নিমিত্তে পরিচালিত করছেন না। তাই আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন,
أَفَنَجْعَلُ الْمُسْلِمِينَ كَالْمُجْرِمِينَ مَا لَكُمْ كَيْفَ تَحْكُمُونَ
“আমি কি আত্মসমর্পণকারীদেরকে অপরাধীদের মত গণ্য করব? তোমাদের কী হয়েছে, তোমরা কেমনভাবে বিচার করে সিদ্ধান্ত দিচ্ছ?” (আল-কালাম ৬৮ : ৩৫,৩৬)
أَمْ نَجْعَلُ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ كَالْمُفْسِدِينَ فِي الْأَرْضِ أَمْ نَجْعَلُ الْمُتَّقِينَ كَالْفُجَّارِ
“যারা ঈমান আনে আর সৎ কাজ করে তাদেরকে কি আমি ওদের মত করব যারা দুনিয়াতে ফাসাদ সৃষ্টি করে? মুত্তাকীদের কি আমি অপরাধীদের মত গণ্য করব?” (স্ব-দ ৩৮: ২৮)
أَمْ حَسِبَ الَّذِينَ اجْتَرَحُوا السَّيِّئَاتِ أَن نَّجْعَلَهُمْ كَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ سَوَاءً مَّحْيَاهُمْ وَمَمَاتُهُمْ سَاءَ مَا يَحْكُمُونَ
“যার অন্যায় কাজ করে তারা কি এ কথা ভেবে নিয়েছে যে, আমি তাদেরকে আর ঈমান গ্রহণকারী সৎকর্মশীলদেরকে সমান গণ্য করব যার ফলে তাদের উভয় দলের জীবন ও মৃত্যু সমান হয়ে যাবে? কতই না মন্দ তাদের ফায়সালা!” (আল-জাসিয়াহ ৪৫ : ২১)
তাদের মস্তিষ্ক-বিবেক মৃত্যুর পুনরায় জীবন লাভ করারে অসম্ভব মনে করে এর প্রতিবাদে আল্লাহ বলেন,
أَأَنتُمْ أَشَدُّ خَلْقًا أَمِ السَّمَاءُ بَنَاهَا
“তোমাদের সৃষ্টি বেশি কঠিন না আকাশের? তিনি তো সেটা সৃষ্টি করেছেন।” (আন-নাযিআত ৭৯ – ২৭)
أَوَلَمْ يَرَوْا أَنَّ اللَّهَ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَلَمْ يَعْيَ بِخَلْقِهِنَّ بِقَادِرٍ عَلَىٰ أَن يُحْيِيَ الْمَوْتَىٰ بَلَىٰ إِنَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
“তারা কি দেখে না যে আল্লাহ, যিনি আকাশ ও যমীন সৃষ্টি করেছেন আর ওগুলোর সৃষ্টিতে তিনি ক্লান্ত হননি, তিনি মৃতদেরকে জীবন দিতে সক্ষম? নিঃসন্দেহে তিনি সকল বিষয়ের উপর ক্ষমতাবান।” (আল-আহকাফ ৪৬ : ৩৩)
وَلَقَدْ عَلِمْتُمُ النَّشْأَةَ الْأُولَىٰ فَلَوْلَا تَذَكَّرُونَ
“তোমরা তোমাদের প্রথম সৃষ্টি সম্বন্ধে অবশ্যই জান তাহলে (আল্লাহ যে তোমাদেরকে পুনরায় সৃষ্টি করতে সক্ষম এ কথা) তোমরা অনুধাবন কর না কেন?” (আল-ওয়াকিয়াহ ৫৬ : ৬২)
বিবেক-বিবেচনা ও প্রচলিত কথা হলো, মৃত্যুর পর পুনঃজীবন দান, (أَهْوَنُ عَلَيْهِ) “এটা তার জন্য অতি সহজ।” (আর-রূম ৩০ : ২৭)
তিনি আরো বলেন, كَمَا بَدَأْنَا أَوَّلَ خَلْقٍ نُّعِيدُهُ “যেভাবে আমি সৃষ্টির সূচনা করেছিলাম, সেভাবে পুনরায় সৃষ্টি করবো।” (আল-আম্বিয়া ২১ : ১০৪)
আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন, (أَفَعَيِينَا بِالْخَلْقِ الْأَوَّلِ) “আমি কি প্রথমবার সৃষ্টি করেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।” (ক্ব-ফ ৫০ : ১৫)
এভাবে একের পর এক তাদের সন্দেহের জবাব দেয়া হয়েছে এমন প্রজ্ঞাপূর্ণভাবে ও গভীর দৃষ্টিকোণ থেকে যা প্রত্যেক চিন্তাশীল ও প্রশস্ত জ্ঞানের অধিকারীদের তৃপ্তিদান করেছে। কিন্তু মুশরিকদের উদ্দেশ্য তো কেবল অহংকার-বড়ত্ব প্রকাশ করা এবং আল্লাহর জমীনে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করে তাদের মতামতকে বিশ্ববাসীর উপর চাপিয়ে দেয়া। ফলে তারা তাদের অবাধ্যতার উপরই অটল থাকলো।
ফুটনোটঃ
তৃতীয় পন্থা : অতীতকালের ঘটনাবলী এবং উপাখ্যান সমূহ এবং কুরআন কারীমে বর্ণিত বিষয়াদির মধ্যে অর্থহীন বাগড়া বা প্রতিদ্বন্দ্বীতার ধূম্রজাল সৃষ্টি করে জনমনে ধাঁধার সৃষ্টি করা এবং মুক্ত চিন্তা-ভাবনার সুযোগ না দেয়া (الْحِيْلُوْلَةُ بَيْنَ النَّاسِ وَبَيْنَ سِمَاعِهِمْ الْقُرْآن, وَمُعَارَضَتُهُ بِأَسَاطِيْرِ الْأَوَّلِيْنَ):
উপযুক্ত সন্দেহের বশবর্তী হয়ে মুশরিকগণ মানুষদেরকে তাদের সাধ্যমত কুরআন ও ইসলামের দাওয়াতের কথা শ্রবণ করতে বাধা প্রদান করতো। তারা যখন দেখতে যে, নাবী (সাঃ) লোকেদেরকে দীনের পথে আহবান করছে বা সালাত আদায় করছে, কুরআন তেলাওয়াত করছে তখন তারা মানুষদেরকে সেখান হতে তাড়িয়ে দিত, হৈচৈ-হৈ-হুল্লোড়, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, হট্টগোল পাকিয়ে দিত, গান গাইতো এবং নানা খেল-তামাশায় মেতে উঠত। এ বিষয়ে কুরআনের বাণী,
وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لَا تَسْمَعُوا لِهَٰذَا الْقُرْآنِ وَالْغَوْا فِيهِ لَعَلَّكُمْ تَغْلِبُونَ
“কাফিররা বলে- এ কুরআন শুনো না, আর তা পড়ার কালে শোরগোল কর যাতে তোমরা বিজয়ী হতে পার।” (হা-মীম সাজদাহ ৪১ : ২৬)
অবস্থা এমন করে ফেলতো যে, নবী (সাঃ) সেখানে আর লোকেদের কুরআন তেলাওয়াত শোনাতে পারতেন না। এ অবস্থা পঞ্চম নবুওয়াতী বর্ষের শেষ অবধি চলে। অনেক সময় রাস্তাঘাটে তাঁর তেলাওয়াত করার উদ্দেশ্য না থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ করে মুশরিকরা এরকম হট্টগোল বাধাত।
প্রসঙ্গক্রমে এখানে নাযর বিন হারিসের ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। সে ছিল কুরাইশদের মধ্যে অন্যতম শয়তান। নযর বিন হারিস একদা হীরাহ চলে গেলেন। সেখানে রাজা-বাদশাহদের ঘটনাবলী, ইরানের বিখ্যাত বীর রুস্তম ও প্রাচীন গ্ৰীক সম্রাট আলেকজান্ডারের কাহিনী শিখলেন। এ সব শেখার পর তিনি মক্কায় প্রত্যাবর্তন করলেন। ঘটনাক্রমে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন কোন জায়গায় আল্লাহর নির্দেশাবলী নিয়ে আলোচনা করতেন এবং আল্লাহর আদেশ অমান্য করলে জাহান্নামের ভয়াবহ আযাব সম্পর্কে ভয় প্রদর্শন করতেন তখন সেই ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত হয়ে বলতেন, ‘আল্লাহর শপথ হে কুরাইশগণ! আমার কথা মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর কথার চেয়ে উত্তম। এরপর তিনি পারস্য সম্রাটদের, রুস্তম এবং সেকান্দার বাদশাহর (আলেকজান্ডার) কাহিনী শোনাতে আরম্ভ করতেন এবং বলতেন, বল, কোনদিক দিয়ে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর কথা আমার কথার চেয়ে উত্তম।[1]
ইবনে আব্বাসের বর্ণনা সূত্রে এটাও জানা যায় যে, ইসলাম বৈরিতার চরম পর্যায়ের ব্যবস্থা হিসেবে নাযর একাধিক ক্রীতদাসী রেখেছিলেন। যখন তিনি জানতে পারতেন যে, কোন লোক ইসলাম গ্রহণের ইচ্ছে করছে তখন সেই লোকের প্রতি এক ক্রীতদাসীকে নিয়োজিত করে দিতেন। ক্রীতদাসীকে বলতো তুমি তাকে খাওয়া দাওয়া করাও এবং তার মনোরঞ্জনের জন্য গীত গাও, বাদ্য বাজাও। মুহাম্মাদ যে বিষয়ের প্রতি আহবান করছে এটা তার চেয়ে উত্তম।[2] এ প্রসঙ্গে কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হয়েছে :
وَمِنَ النَّاسِ مَن يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَن سَبِيلِ اللَّهِ
‘কিছু মানুষ আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করার উদ্দেশে অজ্ঞতাবশত অবান্তর কথাবার্তা ক্রয় করে আর আল্লাহর পথকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে।’ (লুক্বমান ৩১ :৬)
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ২৯৯-৩০০ পৃঃ, ৩৫৮ পূঃ । শাইখ আবদুল্লাহ মুখতাসারুস সীরাহ পৃঃ ১১৭-১১৮।
[2] ফাতহুল কাদীর, ইমাম শাওকানী, ৪র্থ খণ্ড ২৩৬ পৃঃ ও অন্যান্য তাফসীর গ্রন্থসমূহ।
অন্যায় অত্যাচার (الْاِضْطِهَادَاتُ) :
নবুওয়তের চতুর্থ বছরে যখন প্রথমবার সর্ব সাধারণের নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করা হল, তখন মুশরিকগণ তা প্রতিহত করার কৌশল হিসেবে ঐ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন যা ইতোপূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে। এ কৌশল কার্যকর করার ব্যাপারে তাঁরা ধীরে চলার নীতি অবলম্বন করে অল্প অল্প করে অগ্রসর হতে থাকেন এবং এভাবে এক মাসের বেশী সময় অতিবাহিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাঁরা কোন প্রকার অন্যায় অত্যাচার আরম্ভ করেন নি। কিন্তু তাঁরা যখন এটা বুঝতে পারলেন যে, তাঁদের ঐ কৌশল ও ব্যবস্থাপনা ইসলামী আন্দোলনের ব্যাপ্তিলাভের পথে তেমন কার্যকর হচ্ছে না, তখন তাঁরা সকলে পুনরায় এক আলোচনা চক্রে মিলিত হন এবং মুসলমানদের শাস্তি প্রদান ও তাদেরকে ইসলাম থেকে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রত্যেক গোত্রপতি তার গোত্রের ইসলাম গ্রহণকারীদের শাস্তি প্রদান করা শুরু করে দিল। অধিকন্তু ঈমান আনয়নকারী দাস-দাসীদের উপর তারা অতিরিক্ত কাজের বোঝা চাপিয়ে দিল।
স্বাভাবিকভাবেই আরবের নেতা ও গোত্রপতিদের অধীনে অনেক ইতর ও নিম্নশ্রেণীর লোকজন থাকতো। এসব লোকেদের তারা তাদের ইচ্ছেমত পরিচালনা করতো। এদের মধ্যে যারা মুসলামান হতো তাদের উপর তারা চড়াও হতো। বিশেষ করে তাদের মধ্যে যারা দরিদ্র তাদের উপর অত্যাচারের স্টীমরোলার চালাতো। তারা তাদের শরীর থেকে চামড়া ছিলে ফেলাসহ এমন সব পাশবিক আচরণ করতে যা পাষাণ হৃদয় ব্যক্তিটিও প্রত্যক্ষ করে অস্থির কিংবা বিচলিত না হয়ে পারতেন না।
আবূ জাহল যখন কোন সম্ভ্রান্ত বা শক্তিধর ব্যক্তির মুসলিম হওয়ার কথা শুনত তখন সে তাকে ন্যায়-অন্যায় বলে গালি গালাজ করত, অপমান-অপদস্থ করত এবং ধন-সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি করবে বলে ভয় দেখাত। জ্ঞাতি গোষ্ঠীর যদি কোন দুর্বল ব্যক্তি মুসলিম হতো তাহলে তাকে সে অত্যন্ত নির্দয়ভাবে মারধোর করত এবং মারধোর করার জন্য অন্যদের প্ররোচিত করত।[1]
‘উসমান বিন আফফানের চাচা তাকে খেজুর পাতার চাটাইয়ের মধ্যে জড়িয়ে রেখে নীচ থেকে আগুন লাগিয়ে ধোঁয়া দিত’।[2]
মুসআব বিন উমায়ের (রা.)-এর মা যখন তার ইসলাম গ্রহণের খবর পেল তখন সে তার খানা পানি (আহারাদি) বন্ধ করে দিল এবং তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিল। প্রথম জীবনে তিনি আরাম আয়েশ ও সুখস্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে লালিত-পালিত হয়েছিলেন। কিন্তু ইসলাম গ্রহণের পর তিনি এতই কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন যে সর্পের গাত্র থেকে খুলে পড়া খোলসের মতো তার শরীরের চামড়া খুলে খুলে পড়ত।[3]
বিলাল, উমাইয়া বিন খালাফ জুমাহীর ক্রীতদাস ছিলেন। তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করায় উমাইয়া তার গলায় দড়ি বেঁধে ছোকরাদের হাতে ধরিয়ে দিত। তারা সেই দড়ি ধরে তাঁকে পথে প্রান্তরে টেনে হিচড়ে নিয়ে বেড়াত। এমনকি টানাটানির ফলে তার গলায় দড়ির দাগ বসে যেত। উমাইয়া স্বয়ং হাত পা বেঁধে তাকে প্রহার করত এবং প্রখর রোদে বসিয়ে রাখত। তাকে খানা পানি না দিয়ে ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত রাখত। এ সবের চেয়েও অনেক বেশী কঠিন ও কষ্টকর হতো তখন যখন দুপুর বেলা প্রখর রৌদ্রের সময় কংকর ও বালি আগুনের মতো উত্তপ্ত হয়ে উঠত এবং তাকে উত্তপ্ত বালির উপর শুইয়ে দিয়ে তার বুকের উপর পাথর চাপা দেয়া হতো। তারপর বলত আল্লাহর শপথ তুই এভাবেই শুয়ে থাকবি। তারপর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বি। অথবা মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর সঙ্গে কুফরী করবি। বিলাল(রাঃ) ঐ অবস্থাতেই বলতেন, ‘আহাদ, আহাদ”। (অর্থ আল্লাহ এক, আল্লাহ এক)। একদিন বিলাল (রা.) এমনভাবে এক দুঃসহ অবস্থার মধ্যে নিপতিত ছিলেন তখন আবূ বাকর সিদিক (রা.) সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি বিলাল (রা.)-কে এক কালোদাসের বিনিময়ে এবং বলা হয়েছে যে, দু’শত দেহরাম (৭৩৫ গ্রাম রুপা) অথবা দু’শ আশি দিরহামের (১ কেজিরও বেশী রুপা) বিনিময়ে ক্রয় করে মুক্ত করে দেন।[4]
আম্মার বিন ইয়াসির বনু মাখযুমের ক্রীতদাস ছিলেন। তাঁর পিতার নাম ইয়াসির এবং মাতার নাম সুমাইয়া। তিনি এবং তাঁর পিতামাতা সকলে একই সঙ্গে ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের কারণে তাদের উপর কেয়ামতের আযাব ভেঙ্গে পড়ে। দুপুর বেলা প্রখর রোদ্র তাপে মরুভূমির বালুকণারাশি এবং কংকর রাশি যখন আগুণের মতো উত্তপ্ত থাকত তখন আবূ জাহলের নেতৃত্বে মুশরিকগণ তাদেরকে নিয়ে গিয়ে সেই উত্তপ্ত বালি এবং কংকরের উপর শুইয়ে দিয়ে শাস্তি দিত। এক দিবস তাদেরকে যখন সেভাবে শাস্তি দেয়া হচ্ছিল এমন সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাদেরকে লক্ষ্য করে তিনি বললেন, “হে ইয়াসিরের বংশধর ধৈর্য্য ধারণ করো, তোমাদের স্থান জান্নাতে’। অতঃপর শাস্তি চলা অবস্থায় ইয়াসির মৃত্যুবরণ করেন।
পাষণ্ড আবূ জাহল আম্মারের মা সুমাইয়ার নারী অঙ্গে বর্শ বিদ্ধ করে। অতঃপর তিনি মারা যান। মুসলিম মহিলাদের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রথম শহীদ। সুমাইয়া বিনতে খাইয়াত ছিলেন আবূ হুজাইফাহ বিন আব্দুল্লাহ বিন উমার বিন মাখযুমের ক্রীতদাসী। সুমাইয়া ছিলেন অতি বৃদ্ধা এবং দুর্বল।
‘আম্মারের উপর নির্যাতন চলতে থাকে। কখনো তাকে প্রখর রোদে শুইয়ে দিয়ে তার বুকে লাল পাথর চাপা দেয়া হতো, কখনো বা পানিতে ডুবিয়ে শাস্তি দেয়া হতো। মুশরিকগণ তাকে বলত, যতক্ষণ না তুমি মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে গালমন্দ দেবে এবং আমাদের উপাস্য লাত এবং উযযা সম্পর্কে উত্তম কথা না বলবে ততক্ষণ তোমাকে অব্যাহতি দেয়া হবে না। নেহাৎ নিরূপায় হয়ে ‘আম্মার (রা.) তাদের কথা মেনে নিলেন।[5] তারপর নাবী করীমের দরবারে উপস্থিত হয়ে কান্না বিজড়িত কণ্ঠে সবিস্তারে ঘটনা বর্ণনা করে আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। এ প্রেক্ষিতে এ আয়াত কারমা অবতীর্ণ হল :
مَن كَفَرَ بِاللَّهِ مِن بَعْدِ إِيمَانِهِ إِلَّا مَنْ أُكْرِهَ وَقَلْبُهُ مُطْمَئِنٌّ بِالْإِيمَانِ
‘কোন ব্যক্তি তার ঈমান গ্রহণের পর আল্লাহকে অবিশ্বাস করলে এবং কুফরীর জন্য তার হৃদয় খুলে দিলে তার উপর আল্লাহর গযব পতিত হবে আর তার জন্য আছে মহা শাস্তি, তবে তার জন্য নয় যাকে (কুফরীর জন্য) বাধ্য করা হয় অথচ তার দিল ঈমানের উপর অবিচল থাকে। (আন-নাহল ১৬ : ১০৬)
আবূ ফুকাইহাহ (রা.) বনু আব্বাস গোত্রের দাস ছিলেন। সে ছিল আযদীদের অন্তর্ভুক্ত। তাঁর অপর নাম ছিল আফলাহ। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার কারণে তাঁর মালিক পায়ে লোহার শিকল বেঁধে, শরীর হতে কাপড় খুলে নিয়ে তাকে কংকরময় পথ ও প্রান্তরে টেনে নিয়ে বেড়াতেন।[6] অতঃপর তার পিঠের উপর ভারী পাথর চাপা দিত ফলে তিনি নড়াচড়া করতে পারতেন না। এভাবে শাস্তি দেয়ার এক পর্যায়ে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এমন শাস্তি চলছিল নিয়মিতভাবে। অতঃপর তিনি হাবশায় হিজরতকারী দ্বিতীয় কাফেলার সাথে তিনি হিজরত করেন। একদা তারা তার পায়ে রশি দিয়ে বেঁধে টেনে নিয়ে উত্তপ্ত ময়দানে নিয়ে তার গলায় ফাঁস লাগালো। এতে কাফিররা ধারণা করলো যে, আবূ ফুকাইহাহ মারা গেছে। ইত্যবসরে আবূ বকর (রা.) সে পথ দিয়ে যাওয়ার সময় তাকে ক্রয় করে আল্লাহর ওয়াস্তে আযাদ করে দিলেন।
খাব্বাব বিন আরাত খুযা’আহ গোত্রের উম্মু আনমার সিবা’ নাম্নী এক মহিলার দাস ছিলেন। খাব্বাব বিন আরাত ছিলেন কর্মকার। ইসলাম গ্রহণের পর উম্মু আনমার তাকে আগুন দিয়ে শাস্তি দিত। উত্তপ্ত লোহা দিয়ে তার পিঠ ও মাথায় সেঁক দিত যাতে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর দীনকে অস্বীকার করে। কিন্তু এতে তার ঈমান ও ইসলামে টিকে থাকার সংকল্প আরো বৃদ্ধি পায়। আর মুশরিকগণ তার উপর নানাধরণের নির্যাতন চালাতেন। কখনো বা খুব শক্ত হাতে চুল টানাটানি করে নিষ্পেষণ চালাতেন। কখনো বা আবার খুব শক্ত হাতে তার গ্রীবা ধরে মুচড়ে দিতেন। এক সময় তাকে কাঠের জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর শুইয়ে দিয়ে তার বুকের উপর পাথর চাপা দেয়া হয়েছিল যাতে তিনি উঠতে না পারেন। এতে তার পৃষ্ঠদেশ পুড়ে গিয়ে ধবল কুষ্ঠের মতো সাদা হয়ে গিয়েছিল।[7]
রুমী কৃতদাসী যিন্নীরাহ[8] ইসলাম গ্রহণ করলে এবং আল্লাহর উপর আনার কারণে তাকে শাস্তি দেয়া হয়। তাকে চোখে আঘাত করা হয় ফলে তিনি অন্ধ হয়ে যান। অন্ধ হওয়ার পরে তাকে বলা হলো তোমাকে লেগেছে। উত্তরে যিন্নীরাহ বললেন, আল্লাহর কসম! আমাকে লাত ও উযযার আসর লাগে নি। বরং এটা আল্লাহর একটা অনুগ্রহ এবং আল্লাহ তা’আলার ইচ্ছায় তা ভাল হয়ে যাবে। অতঃপর একদিন সকালে দেখা গেল যে, আল্লাহ তা’আলা তার চক্ষু ভাল করে দিয়েছেন। তার এ অবস্থা দর্শন করে কুরাইশরা বলল, এটা মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর একটা যাদু।
বনু যুহরার কৃতদাসী উম্মু ‘উবায়েস ইসলাম গ্রহণ করার কারণে মুশরিকগণ তাকে শাস্তি দিত; বিশেষ করে তার মনীব আসওয়াদ বিন ‘আবদে ইয়াগুস খুব শাস্তি দিত। সে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ঘোরতর শক্র এবং ঠাট্টা বিদ্রুপকারীদের অন্যতম ছিল।
বনু আদী গোত্রের এক পরিবার বনু মুয়াম্মিলের এক দাসীর মুসলিম হওয়ার সংবাদে ‘উমার বিন খাত্তাব তাকে এতই প্রহার করেছিলেন যে, তিনি নিজেই ক্লান্ত হয়ে গিয়ে এ বলে ক্ষান্ত হয়েছিলেন, ‘মানবত্বের কোন কারণে নয় বরং খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি বলে শাস্তি দেয়া থেকে আপাততঃ তোমাকে রেহাই দিলাম। অতঃপর বলতেন, তোমার সাথে তোমার মনিব এমন আচরণই করবে।[9] ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিল উমার (রা.) ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার পূর্বে।
নাহদিয়া এবং তার কন্যা উম্মু উবায়েস সকলেই দাসী ছিলেন। এঁরা উভয়েই বনু আব্দুদ্দার গোত্রের। ইসলাম গ্রহণের পর এরা সকলেই মুশরিকদের হাতে নানাভাবে নির্যাতিত ও নিগৃহীত হওয়ার ফলে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট ও জ্বালা-যন্ত্রণার সম্মুখীন হন।
ইসলাম গ্রহণ করার কারণে যে সব দাসকে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের সম্মখীন হতে হয় তাদের মধ্যে আমির বিন ফুরায়রাও একজন। তাকে এতই শাস্তি দেয়া হয় যে, তার অনুভূতি শক্তি লোপ পায় এবং তিনি কি বলতেন নিজেই তা বুঝতে পারতেন না।
অবশেষে আবূ বাকর (রা.) দাস-দাসীগুলোকেও ক্রয় করে নেয়ার পর মুক্ত করে দেন।[10] এতে তাঁর পিতা আবূ কুহাফাহ তাঁকে ভর্ত্সনা করে বললেন, আমি দেখছি যে, তুমি দুর্বল দাস-দাসীদের মুক্ত করে দিচ্ছ। এর পর যদি তুমি কোন প্রহৃত ব্যক্তিকে মুক্ত কর তবে আমি তোমাকে বাধা প্রদান করবো। পিতার এ কথা শ্রবণ করত আবূ বাকর (রা.) বললেন, আমি তো কেবল তাদেরকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্যই মুক্ত করি। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে আল্লাহ তা’আলা আবূ বাকর (রা.)-এর প্রশংসা এবং তাঁর শক্রদের নিন্দা জ্ঞাপন করে আয়াত নাযিল করেন। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, فَأَنذَرْتُكُمْ نَارًا تَلَظَّىٰ لَا يَصْلَاهَا إِلَّا الْأَشْقَى الَّذِي كَذَّبَ وَتَوَلَّىٰ
“কাজেই আমি তোমাদেরকে দাউ দাউ ক’রে জ্বলা আগুন সম্পর্কে সতর্ক করে দিচ্ছি। – চরম হতভাগা ছাড়া কেউ তাতে প্রবেশ করবে না। – যে অস্বীকার করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়”। (সূরাহ আল-লাইল ৯২ : ১৪-১৬)
উপর্যুক্ত আয়াতে ধমকী উমাইয়া বিন খালাফ ও তার মতো আচরণকারীদের উদ্দেশ্য করে দেয়া হয়েছে।
وَسَيُجَنَّبُهَا الْأَتْقَى الَّذِي يُؤْتِي مَالَهُ يَتَزَكَّىٰ وَمَا لِأَحَدٍ عِندَهُ مِن نِّعْمَةٍ تُجْزَىٰ إِلَّا ابْتِغَاءَ وَجْهِ رَبِّهِ الْأَعْلَىٰ وَلَسَوْفَ يَرْضَىٰ
“তাথেকে দূরে রাখা হবে এমন ব্যক্তিকে যে আল্লাহকে খুব বেশি ভয় করে, – যে পবিত্রতা অর্জনের উদ্দেশ্যে নিজের ধন-সম্পদ দান করে, – (সে দান করে) তার প্রতি কারো অনুগ্রহের প্রতিদান হিসেবে নয়, – একমাত্র তার মহান প্রতিপালকের চেহারা (সন্তোষ) লাভের আশায়। – সে অবশ্যই অতি শীঘ্র (আল্লাহর নিমাত পেয়ে) সন্তুষ্ট হয়ে যাবে।” (সূরাহ আল-লাইল ৯২ : ১৭-২১)
উপর্যুক্ত আয়াতের উদ্দিষ্ট ব্যক্তি হলেন, আবূ বাকর সিদীক (রা.)।
ইসলাম গ্রহণ করার কারণে আবূ বকর (রা.)-কেও শাস্তি পেতে হয়েছে। তাঁকে এবং তাঁর সাথে ত্বালহাহ বিন উবাইদুল্লাহকে সালাত থেকে বিরত রাখতে এবং দীন থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য নওফেল বিন খুওয়াইলিদ একই রশিতে শক্ত করে বোঁধে রাখতো। কিন্তু তাঁরা কেউই তাঁর কথায় কর্ণপাত করেন নি। তাঁরা উভয়ে সর্বদা এক সাথে সালাত আদায় করতেন। এজন্য তাঁদেরকে ‘কারীনাইন’ (দু’ সঙ্গী) বলা হয়। আবার এও বলা হয় যে, তাদের সাথে এরকম করার কারণ, ‘উসমান বিন উবাইদুল্লাহ- ত্বালহা বিন উবাইদুল্লাহর ভাই।
প্রকৃত অবস্থা ছিল মুশরিকগণ যখন কারো মুসলিম হওয়ার সংবাদ পেতেন তখন তাদের কষ্ট দেয়ার ব্যাপারে তারা উদ্বাহু এবং বদ্ধ পরিকর হয়ে যেতেন। ইসলাম গ্রহণ করার কারণে দরিদ্র মুসলমানদেরকে শাস্তি দেয়া ছিল তাদের নিকট একটি মামুলি ব্যাপার। বিশেষ করে দাস-দাসীদের শাস্তি দিতে কোন পরওয়াই করতো না। কেননা তাদের শাস্তি দেয়া কারণে কেউ ক্রুদ্ধও হতো না আর তাদের শাস্তি লাঘবের জন্য কেউ এগিয়েও আসতো না। বরং তাদের মনিবেরাই স্বয়ং শাস্তি প্রদান করতো। তবে কোন বড় ও সম্ভান্ত ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করলে তাদের শাস্তি দেয়া ছিল কঠিন ব্যাপার। বিশেষ করে তারা যখন তাদের গোত্রের সম্মানী ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি হতেন। এসব সম্ভ্রান্ত লোকের উপর মুশরিকরা সামান্যই চড়াও হতো যদিও এদেরকেই তারা দীনের ক্ষেত্রে বেশি ভয় করতো।
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ৩২০ পৃঃ।
[2] রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খণ্ড ৭৫ পৃঃ।
[3] রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খণ্ড ৫৮ পূঃ ও তালকীহু ফুহুমি আহলিল আসার।
[4] রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খণ্ড ৫৭ পৃঃ এবং তালকীহুল ফোহুম ৬১ পৃঃ ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ৩১৭-৩১৮ পৃ:।
[5] ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ৩১৯-৩২০ পূঃ এবং মুহাম্মাদ গাজ্জালী রচিত ফিকহুস সীরাহ ৮২ পৃঃ আওফী ইবনে আব্বাস হতে কিছু কিছু অংশ বর্ণনা করেছেন। ইবনে কাসীর, উপরোক্ত আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য।
[6] রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খণ্ড ৫৭ পৃঃ, এ জাযুত তানখীল ৫৩ পৃঃ হতে।
[7] রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খণ্ড ৫৭ পৃঃ, তালকীহুল ফোহুম ৬০ পৃঃ।
[8] যিন্নীরাহ মিসকীনার ওযনে অর্থাৎ ‘যে’ কে যের এবং নুনকে যের এবং তাশদীদ।
[9] রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খণ্ড ৫৭ পৃঃ, ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ৩১৯ পৃঃ।
[10] ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ৩১৮-৩১৯ পৃঃ।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ব্যাপারে মুশরিকদের অবস্থান (موقف المشتكين من رسول الله):
তাদের প্রকৃত সমস্যা ছিল রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে নিয়ে। কেননা ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন। বংশ মর্যাদার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন বৈশিষ্ট্যময় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। শত্রু-মিত্র পক্ষের কেউ তার নিকট আগমন করলে তাকে মান-মর্যাদা বা ইজ্জতের ভূষণে ভূষিত হয়েই সেখানে আগমন করতে হতো। কোন দুষ্টদুরাচার কিংবা অনাচারীর পক্ষে তার সম্মুখে কোন অশ্লীল বা জঘন্য কাজ করার মতো ধৃষ্টতা প্রদর্শন কখনই সম্ভব হতো না ।
নাবী কারীম (সাঃ)-এর উপর্যুক্ত গুণাবলী এবং ব্যক্তি বৈশিষ্ট্য প্রসূত প্রভাব প্রতিপত্তির সঙ্গে সংযুক্ত হল চাচা আবূ ত্বালিবের সাহায্য সহযোগিতা ও সমর্থন। ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত উভয় ক্ষেত্রেই আবূ ত্বালিব এত মর্যাদাসম্পন্ন এবং প্রভাব প্রতিপত্তিশালী ছিলেন যে, তার কথা অমান্য করা কিংবা তার গৃহীত সিদ্ধান্তের উপর হস্তক্ষেপ করার মতো দুঃসাহসিকতা কারোরই ছিল না। এমন এক অবস্থার প্রেক্ষাপটে অন্যান্য কুরাইশগণকে কঠিন দুশ্চিন্তা, এবং টানা পোড়নের মধ্যে নিপতিত হতে হল। সাত-পাঁচ এ জাতীয় নানা কথা নানা প্রশ্ন এবং নানা যুক্তিতর্কের পসরা নিয়ে তারা আবূ ত্বালিবের নিকট যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। তবে তা খুব হিকমত ও নম্রতার সাথে এবং মনে মনে চ্যালেঞ্জ ও ভীতিপ্রদর্শনের আকাঙ্ক্ষা গোপন করে যাতে করে তাদের বক্তব্য আবূ ত্বালিব খুব সহজেই মেনে নেয়।
আবূ ত্বালিব সমীপে কুরাইশ প্রতিনিধি দল (وفد قريش الى ابى طالب):
ইবনে ইসহাক্ব বলেন যে, কুরাইশ গোত্রের কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি একত্র হয়ে আবূ ত্বালিবের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘হে আবূ ত্বালিব, আপনার ভ্রাতুষ্পুত্র আমাদের দেব-দেবীগণকে গালিগালাজ করছেন, আমাদের ধর্মের নিন্দা করছেন, আমাদেরকে জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিচার-বিবেকহীন, মূৰ্খ বলছেন এবং আমাদের পূর্বপুরুষগণকে ধর্মভ্ৰষ্ট বলছেন। অতএব, হয় আপনি তাকে এ জাতীয় কাজ কর্ম থেকে বিরত রাখুন নতুবা আমাদের এবং তার মধ্য থেকে আপনি দূরে সরে যান। কারণ, আপনিও আমাদের মতই তার বক্তব্য মতে ভিন্নধর্মের অনুসারী। তার ব্যাপারে আমরাই আপনার জন্য যথেষ্ট হব।
এর জবাবে আবূ ত্বালিব অত্যন্ত ঠাণ্ডা মেজাঙ্গে পাঁচরকম কথা-বার্তা বলে তাদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বিদায় করলেন। এ প্রেক্ষিতে তারা ফিরে চলে গেলেন। এ দিকে রাসূলুল্লাহ পূর্ণোদ্যমে তার প্রচার কাজ চালিয়ে যেতে থাকলেন। দীনের দায়োত প্রচার করতে থাকলেন এবং সেদিকে লোকেদেরকে আহ্বান জানাতে থাকলেন।[1]
এদিকে কুরাইশগণও বেশি দেরি করলেন না যখন দেখলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কাজ ও আল্লাহর পথে দাওয়াত পূর্ণামাত্রায় চালিয়ে যাচ্ছেনই, বরং তিনি তাঁর দাওয়াতী তৎপরতা আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন। নিরুপায় তারা পূর্বের চেয়ে আরো ক্রোধ ও গরম মেজাজ নিয়ে আবূ ত্বালিবের নিকট পুনরায় আগমন করলেন।
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ২৬৫ পৃ:।
আবূ ত্বালিবের প্রতি কুরাইশগণের ধমক ( قريش يهددون الى ابا طالب):
আবূ ত্বালিবের সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর কুরাইশ প্রধানগণ আবূ ত্বালিবের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, হে আবূ ত্বালিব! আপনি আমাদের মাঝে মান-মর্যাদার অধিকারী একজন বয়স্ক ব্যক্তি। আমরা ইতোপূর্বে আপনার নিকট আবেদন করেছিলাম যে আপনার ভ্রাতুষ্পুত্রকে আমাদের ধর্ম সম্পর্কে নিন্দাবাদ করা থেকে বিরত রাখুন। কিন্তু আপনি তা করেন নাই। আপনি মনে রাখবেন, আমরা এটা কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারছিনা যে আমাদের পিতা পিতামহ এবং পূর্ব পুরুষদের গালি-গালাজ করা হোক, আমাদের বিবেককে নির্বুদ্ধিতা বলে আখ্যায়িত করা হোক এবং আমাদের দেবদেবীর নিন্দা করা হোক। আমরা আবারও আপনাকে অনুরোধ করছি হয় আপনি তাকে সে সব থেকে নিবৃত্ত রাখুন, নচেৎ তামাদের দু’দলের মধ্যে এক দল ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ বিগ্রহ চলতেই থাকবে’।
কুরাইশ প্রধানগণের এমন কঠোর বাক্য বিনিময় এবং আস্ফালনে আবূ ত্বালিব অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়লেন। তিনি সেই মুহুর্তে তার কর্তব্য স্থির করতে না পেরে নাবী কারীম (সাঃ)-কে ডেকে পাঠালেন। চাচার আহবানে নাবী কারীম (সাঃ) সেখানে উপস্থিত হলে আবূ ত্বালিব তাঁর নিকট কুরাইশ প্রধানগণের আলোচনা এবং আচরণ সম্পর্কে সবিস্তার বর্ণনা করার পর তাকে লক্ষ্য করে বললেন, বাবা! একটু বিচার বিবেচনা করে কাজ করো। যে ভার বহন করার শক্তি আমার নেই সে ভার আমার উপর চাপিয়ে দিও না।’
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ধারণা করলেন, মানবকুলের মধ্যে তার একমাত্র আশ্রয়দাতা ও সহায় চাচাও বোধ হয় আজ থেকে তাঁর সঙ্গ পরিত্যাগ করলেন এবং তাকে সাহায্য দানের ব্যাপারে তিনিও বোধ হয় দুর্বল হয়ে পড়লেন। তিনি এটাও সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করলেন যে, আজ থেকে তিনি এক নিদারুণ সংকটে নিপতিত হতে চললেন। তবুও আল্লাহ তা’আলার উপর অবিচল আস্থা রেখে তিনি বললেন,
يا عم والله لو وضعوا الشمس في يميني والقمر في يساري على أن أترك هذا الأمر حتى يظهره الله أو أهلك فيه ما تركته
‘চাচাজান, আল্লাহর শপথ। যদি এরা আমার ডান হাতে সূর্য এবং বাম হাতে চাঁদ এনে দেয় তবুও শাশ্বত এ মহা সত্য প্রচার সংক্রান্ত আমার কর্তব্য থেকে এক মুহুর্তের জন্যও আমি বিচ্যুত হব না। এ মহামহিম কার্যে হয় আল্লাহ আমাকে জয়যুক্ত করবেন না হয় আমি ধ্বংস হয়ে যাব। কিন্তু চাচাজান! আপনি অবশ্যই জানবেন যে, মুহাম্মাদ (সাঃ) কখনই এ কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হবে না।
স্বজাতীয় এবং স্বগোত্রীয় লোকজনদের নির্বুদ্ধিতা, হঠকারিতা এবং পাপাচারে ব্যথিত-হৃদয় নাবী (সাঃ)-এর নয়নযুগলকে বাষ্পাচ্ছন্ন করে তুলল। তিনি সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করলেন যে ভবিষ্যতের দিনগুলো তার জন্য আরও কঠিন হবে এবং আরও ভয়াবহতা এবং কঠোরতার সঙ্গে তাকে মোকাবালা করে চলতে হবে। তার নয়ন যুগলে অশ্রু কিন্তু অন্তরে অদম্য সাহস। এমন এক মানসিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে তিনি চাচা আবূ ত্বালিবের সম্মুখ থেকে বেরিয়ে এলেন।
তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রের এ অসহায়ত্ব ও মানসিক অশান্তিতে আবূ ত্বালিবের প্রাণ কেঁদে উঠল। পরক্ষণেই তিনি তাকে পুনরায় ডেকে পাঠালেন। যখন নাবী কারীম (সাঃ) তার সম্মুখে উপস্থিত হলেন তখন তিনি তাকে সম্বোধন করে বললেন : ‘প্রিয়তম ভ্রাতুষ্পুত্র! নিৰ্দ্ধিধায় নিজ কর্তব্য পালন করে যাও। আল্লাহর কসম করে বলছি আমি কোন অবস্থাতেই তোমাকে পরিত্যাগ করব না।[1] তারপর তিনি নিম্নোক্ত কবিতার চরণগুগুলো আবৃত্তি করলেন :
والله لن يصلوا إليك تجنعيهم ** حتى أرَسُدّ في العراب دفيئا
فاصدع بأمرك ما عليك غضاضة ** وانهز وقرّ بذاك منك عيوكا
অর্থ : ‘আল্লাহ চান তো তারা স্বীয় দলবল নিয়ে কখনই তোমার নিকট পৌছতে পারবে না যতক্ষণ না আমি সমাহিত হয়ে যাব। তুমি তোমার দ্বীনী প্রচার-প্রচারণা কর্মকাণ্ড যথাসাধ্য চালিয়ে যাও তাতে কোন প্রকার বাধা বিপত্তি আসবে না। তুমি খুশি থাক এবং তোমাব চক্ষু পরিতৃপ্ত হোক।[2]
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ২৬৫-২৬৬পৃঃ।
[2] মুখতাসারুস সীরাহ পৃঃ ৬৮।
পুনরায় আবূ ত্বালিব সমীপে কুরাইশগণ (قريش بين يدى أبي طالب مرة أخرى):
বিগত দিবসের চড়া-কড়া কথা সত্ত্বেও কুরাইশগণ যখন দেখল যে মুহাম্মাদ (সাঃ) বিরত থাকা তো দূরের কথা, আরও জোরে শোরে প্রচার-প্রচারণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তখন এটা তাদের কাছে পরিস্কার হয়ে গেল যে, আবূ ত্বালিব মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে পরিত্যাগ করবেন না। এ ব্যাপারে তিনি কুরাইশগণ হতে পৃথক হয়ে যেতে এমনকি তাদের শত্রুতা ক্রয় করতেও প্রস্তুত রয়েছেন। কিন্তু তবুও ভ্রাতুষ্পুত্রকে ছাড়তে প্রস্তুত নয়। চড়া কড়া কথা বার্তা এবং যুদ্ধের হুমকি দিয়েও যখন তেমন কিছুই হল না তখন একদিন যুক্তি পরামর্শ করে অলীদ বিন মুগীরাহর সন্তান ওমারাহকে সঙ্গে নিয়ে আবূ ত্বালিবের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘হে আবূ ত্বালিব! এ হচ্ছে কুরাইশগণের মধ্যে সব চেয়ে সুন্দর এবং ধাৰ্মিক যুবক। আপনি একে পুত্ররূপে গ্রহণ করুন। এর শোনিতপাতের খেসারত এবং সাহয্যের আপনি অধিকারী হবেন। আপনি একে পুত্র হিসেবে গ্রহণ করে নিন। এ যুবক আজ হতে আপনার সন্তান বলে গণ্য হবে। এর পরিবর্তে আপনার ভ্রাতুষ্পুত্রকে আমাদের হাতে সমর্পণ করে দিন। সে আপনার ও আমাদের পিতা, পিতামহদের বিরোধিতা করছে, আমাদের জাতীয়তা, একতা এবং শৃঙ্খলা বিনষ্ট করছে এবং সকলের জ্ঞানবুদ্ধিকে নির্বুদ্ধিতার আবরণে আচ্ছাদিত করছে। তাঁকে হত্যা করা ছাড়া আমাদের গত্যন্ত র নেই। এক ব্যক্তির বিনিময়ে এক ব্যক্তিই যথেষ্ট’।
প্রত্যুত্তরে আবূ ত্বালিব বললেন, ‘তোমরা যে কথা বললে এর চেয়ে জঘন্য এবং অর্থহীন কথা আর কিছু হতে পারে কি? তোমরা তোমাদের সন্তান আমাকে এ উদ্দেশ্যে দিচ্ছ যে আমি তাকে খাইয়ে পরিয়ে লালন-পালন করব আর আমার সন্তানকে তোমাদের হাতে তুলে দিব এ উদ্দেশ্যে যে, তোমরা তাকে হত্যা করবে। আল্লাহর শপথ! কক্ষনোই এমনটি হতে পারবে না’।
এ প্রেক্ষিতে নওফাল বিন আবদে মানাফের পুত্র মুতয়িম বিন আদী বলল : ‘আল্লাহর কসম হে আবূ ত্বালিব! তোমার জ্ঞাতি গোষ্ঠির লোকজন তোমার সঙ্গে বিচার বিবেচনা সুলভ কথাবার্তা বলছে, কাজকর্মের যে ধারা পদ্ধতি তোমার জন্য বিপজ্জনক তা থেকে তোমাকে রক্ষার প্রচেষ্টাই করা হয়েছে। কিন্তু আমি যা দেখছি তাতে আমার মনে হচ্ছে যে, তুমি তাদের কোন কথাকেই তেমন আমল দিতে চাচ্ছনা’।
এর জবাবে আবূ ত্বালিব বললেন, ‘আল্লাহর কসম! তোমরা আমার সঙ্গে বিচার বিবেচনা প্রসূত কোন কথাবার্তাই বলো নি। বরং তোমরা আমার সঙ্গ পরিত্যাগ করে আমার বিরোধিতায় লিপ্ত হয়েছ এবং বিরুদ্ধবাদীদের সাহায্যার্থে কোমর বেঁধে লেগেছ। তবে ঠিক আছে তোমাদের যেটা করণীয় মনে করবে তাইতো করবে।[1]
কুরাইশগণ যখন এবারের আলোচনাতেও হতাশ হলেন এবং আবূ ত্বালিব রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে নিষেধ করতে ও আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়া বাধা প্রদান করারা ব্যাপারে একমত হলেন না। তখন কুরাইশগণ অগত্যা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে সরাসরি শত্রুতা পোষণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো।
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ২৬৬-২৬৭ পৃঃ।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে বিভিন্নমুখী শক্ৰতা (اعتداءات على رسول الله):
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দাওয়াতের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ার পর থেকে তার সম্মান-মর্যাদা প্রশ্নবিদ্ধ করতে থাকলো এবং তাদের কাছে বিষয়টা খুব কঠিন হয়ে গেল যে তাদের ধৈৰ্য্যের ভেঙ্গে গেল। তারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে শত্রুতার হাতকে প্রশস্ত করে দিল। ফলে তারা ঠাট্টা-বিদ্রুপ, উপহাস, সংশয়-সন্দেহ, বিশৃংখলা সৃষ্টি ইত্যাদি যাবতীয় প্রকার দুর্ব্যবহার শুরু করে দিল। প্রকৃতপক্ষে প্রথম থেকেই রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রতি আবূ লাহাবের দৃষ্টিভঙ্গ ছিল অত্যন্ত কঠোর ও কঠিন। সে ছিল বনু হাশিমের অন্যতম নেতা। সে অন্যান্যদের চেয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)এর ব্যাপারে বেশি ভীত ছিল। সে ও তার স্ত্রী ছিল ইসলামের গোড়ার শত্রু। এমনকি অন্যান্য কুরাইশগণ যখন ঘুণাক্ষরেও নাবী কারীম (সাঃ)-কে নির্যাতন করার চিন্তা-ভাবনা করেন নি তখনে আবূ লাহাবের আচরণ ছিল অত্যন্ত মারমুখী। বনু হাশিমের বৈঠকে এবং সাফা পর্বতের নিকট তিনি যা কিছু করেছিলেন তা ইতোপূর্বে উল্লেখিত হয়েছে। কোন কোন বর্ণনায় এটা উল্লেখিত হয়েছে যে, সাফা পর্বতের উপর নাবী কারীম (সাঃ)-কে আঘাত করার জন্য তিনি একখণ্ড পাথর হাতে উঠিয়েছিলেন।[1]
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপর আবূ লাহাব যে কত পৈশাচিকতা ও নিষ্ঠুরতা অবলম্বন করেছিলেন তার আরও বিভিন্ন প্রমাণ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তার ছেলে ও রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মেয়ের মধ্যকার বিবাহ সম্পর্কোচ্ছেদ। নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দু’মেয়ের সঙ্গে আবূ লাহাব তার দু’ছেলের বিবাহ দিয়েছিলেন। কিন্তু নবুওয়াত প্রাপ্তির পর অত্যন্ত নিষ্ঠুরতা ও নির্যাতনের মাধ্যমে তিনি তার দু’ছেলেরই বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দেন।[2]
তাঁর পাশবিকতার আরও একটি ঘটনা হচ্ছে নাবী কারীম (সাঃ)-এর পুত্র আব্দুল্লাহ যখন মারা যান তখন তিনি (আবূ লাহাব) উল্লাসে ফেটে পড়েন, টগবগিয়ে দৌড়াতে তার বন্ধু-বান্ধবগণের নিকট এ দুঃসংবাদকে শুভ সংবাদরূপে পরিবেশন করেন যে, মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর লেজকাটা (পুত্রহীন) হয়েছে।[3]
অধিকন্তু, ইতোপূর্বে আলোচনা প্রসঙ্গে উল্লেখিত হয়েছে যে, হজ্বের মৌসুমে আবূ লাহাব নাবী কারীম (সাঃ)-কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে বাজার ও গণজমায়েতে তার পিছনে লেগে থাকতেন এবং জনতার মাঝে অপপ্রচার চালাতেন।
তারিক্ব বিন আব্দুল্লাহ মুহারিবীর বর্ণনায় জানা যায় যে, এ ব্যক্তি নাবী কারীম (সাঃ)-কে শুধু মাত্র মিথ্যা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা চালিয়েই ক্ষান্ত হন নি, বরং কোন কোন সময় তিনি নাবী (সাঃ)-কে লক্ষ্য করে প্রস্তর নিক্ষেপ করতেন, যার ফলে তার পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত রক্তাক্ত হয়ে যেত।[4]
আবূ লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামীল (যার নাম আরওয়া) ছিলেন হারব বিন উমাইয়ার কন্যা আবূ সুফইয়ানের বোন। নাবী (সাঃ)-এর প্রতি অত্যাচার ও জুলম ও নির্যাতনে তিনি ছিলেন স্বামীর যোগ্য অংশিদারিণী। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিদ্বেষপরায়ণা ও প্রতিহিংসাপরায়ণা মহিলা। এ সকল দুষ্কর্মে তিনি স্বামী থেকে পশ্চাদপদ ছিলেন না। তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর চলার পথে এবং দরজায় কাঁটা ছড়িয়ে কিংবা পুঁতে রাখতেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ দেয়া, কটুক্তি করা, মিথ্যা অপবাদ দেয়া ইত্যাদি নানাবিধ জঘন্য কাজকর্মে তিনি লিপ্ত থাকতেন। তাছাড়া মুসলিমদের বিরুদ্ধে নানাবিধ ফেৎনা ফাসাদের আগুন জ্বলিয়ে দেয়া এবং উস্কানী দিয়ে ভয়াবহ যুদ্ধের বিভীষিকা সৃষ্টিকরা তাঁর অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এজন্যই আল কুরআনে তাঁকে الحطب (খড়ির বোঝা বহনকারিণী) বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
যখন তিনি অবগত হলেন তাঁর এবং তাঁর স্বামীর ব্যাপারে নিন্দাসূচক আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে তখন তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর খোঁজ করতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তখন মসজিদুল হারামে কাবাহ গৃহের পাশে অবস্থান করছিলেন। আবূ বকর সিদীকও (রা.) তখন তাঁর সঙ্গে ছিলেন। আবূ লাহাব পত্নী যখন এক মুষ্ঠি পাথর নিয়ে বায়তুল হারামে (পবিত্র গৃহে) রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সম্মুখভাগে এসে দণ্ডায়মান হলেন তখন আল্লাহ তা’আলা মহিলার দৃষ্টিশক্তি বন্ধ করে দেয়ার কারণে তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে দেখতে পেলেন না।
অথচ আবূ বাকর (রাঃ)-কে তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন। তাঁর সামনে গিয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন, আবূ বাকর তোমার সাথী কোথায়? আমি জানতে পারলাম যে, সে নাকি আমাদের কুৎসা রটনা করে বেড়াচ্ছে? আল্লাহ করে আমি যদি এখন তাকে পেতাম তার মুখের উপর এ পাথর ছুঁড়ে মারতাম। দেখ আল্লাহর শপথ আমি একজন মহিলা কবি। তারপর সে এ কবিতা আবৃত্তি করে শোনাল।[5]
مذمما عصينا ٭ وامره ابينا ٭ ودينه قلينا
অর্থ : আমরা মন্দের অবজ্ঞা করেছি। তার নির্দেশ অমান্য করেছি এবং তাঁর দ্বীনকে (ধর্ম) ঘৃণা এবং নীচু মনে করে ছেড়ে দিয়েছি।
এর পর তিনি সেখান হতে চলে গেলেন। আবূ বাকর (রা.) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল। তিনি কি আপনাকে দেখেন নাই?’ আল্লাহর নাবী বললেন, (ما رأتنى لقد أخذ الله ببصرها عنى)
“না, তিনি আমাকে দেখতে পান নি। আল্লাহ তার দর্শন শক্তিকে আমার থেকে রহিত করে দিয়েছিলেন।[6]
আবূ বাকর বাযযারও এ ঘটনা বর্ণনা করেছেন এবং এর সঙ্গে আরও কিছু কথা সংযোজন করেছেন। তিনি বলেছেন যে, আবূ লাহাব পত্নী আবূ বাকর (রা.)-এর সামনে উপস্থিত হয়ে বললেন, আবূ বাকর! তোমার সঙ্গী আমার বদনাম করেছে। আবূ বাকর (রা.) বলেলেন, ‘না, এ ঘরের প্রভুর শপথ! তিনি কোন কবিতা রচনা কিংবা আবৃত্তি করেন না। আর না, সে সব তিনি মুখেই আনেন। তিনি বললেন, ‘তুমি সত্যই বলছ’।
এ সব সত্ত্বেও আবূ লাহাব সেই সব লোহমর্ষক ঘটনাবলী ঘটিয়ে চলেছিলেন যদিও তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর চাচা ও প্রতিবেশী। উভয়ের ঘর ছিল পাশাপাশি এবং লাগালাগি। এভাবেই তাঁর অন্যান্য প্রতিবেশীগণও তার উপর নির্যাতন চালাতেন।
ইবনে ইসহাক্বের বর্ণনায় রয়েছে যে, যে সকল লোকজনেরা নাবী কারীম (সাঃ)-কে তার বাড়িতে জ্বালা-যন্ত্রণা দিতেন তাদের নেতৃত্ব দিতেন আবূ লাহাব, হাকাম বিন আবিল আস বিন উমাইয়া, উক্ববা বিন আবী মু’আইত্ব , আদী বিন হামরা সাক্বাফী, ইবনুল আসদা হুযালী; এঁরা সকলেই ছিলেন তার প্রতিবেশী। এঁদের মধ্যে হাকাম বিন আবিল আস[7] ব্যতীত কেউই ইসলাম গ্রহণ করেন নাই। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপর তাদের জুলম নির্যাতনের ধারা ছিল এরূপ, তিনি যখন সালাতে রত হতেন তখন ছাগলের নাড়ি ভূড়ি ও মলমূত্র এমনভাবে লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করা হতো যে, তা গিয়ে পড়ত তার উপর। উনুনের উপর হাড়ি পাতিল চাপিয়ে রান্নাবান্না করার সময় এমনভাবে আবর্জনাদি নিক্ষেপ করা হতো যে, তা গিয়ে পড়ত হাড়ি পাতিলের উপর। তাদের থেকে নিস্কৃতি লাভের মাধ্যমে তিনি নিবিষ্ট চিত্তে সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে তিনি একটি পৃথক মাটির ঘর তৈরি করে নিয়েছিলেন।
যখন তাঁর উপর এ সকল আবর্জনা নিক্ষেপ করা হতো তখন সেগুলো নিয়ে বেরিয়ে দরজায় খাড়া হতেন এবং তাঁদের ডাক দিয়ে বলতেন, يا بنى عبد مناف أي جوار هذا
“ওহে আবদে মানাফ প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশীর এ কেমন আচরণ।”
তারপর আবর্জনা স্তুপে নিক্ষেপ করে আসতেন।[8]
উক্ববা বিন আবী মু’আইত্ব আরও দুষ্ট প্রকৃতির এবং প্রতি হিংসাপরায়ণ ছিলেন। সহীহুল বুখারীতে আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত আছে যে, ‘একদা নাবী কারীম (আঃ) বায়তুল্লাহর পাশে সালাত আদায় করছিলেন, এমতাবস্থায় আবূ জাহল এবং তার বন্ধুবৰ্গ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এদের মধ্যে কোন এক ব্যক্তি অন্যদের লক্ষ্য করে বললেন, ‘কে এমন আছে যে, অমুকের বাড়ি থেকে উটের ভূড়ি আনবে এবং মুহাম্মাদ যখন সালাত রত অবস্থায় সিজদায় যাবে তখন তার পিঠের উপর ভূড়িটি চাপিয়ে দিবে। ঐ সময় আরববাসীগণের মধ্যে নিকৃষ্টতম ব্যক্তি উক্ববা বিন আবী মু’আইত্ব [9] উঠল এবং কথিত ভূড়িটি নিয়ে এসে অপেক্ষা করতে থাকল। যখন নাবী কারীম (সাঃ) সিজদায় গেলেন তখন সেই দুরাচার নরাধম ভুঁড়িটি নিয়ে গিয়ে তার পিঠের উপর চাপিয়ে দিল। আমি সব কিছুই দেখছিলাম, কিন্তু কোন কিছু করার ক্ষমতা আমার ছিল না। হায় যদি আমার মধ্যে তাকে বাচানোর কোন ক্ষমতা থাকত।
আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ আরও বলেন, ‘এর পর তারা দানবীয় আনন্দ ও উত্তেজনায় পরস্পর পরস্পরের গায়ে ঢলাঢলি, পাড়াপাড়ি করে মাতামাতি শুরু করে দিল। মনে হল ওদের জন্য এর চেয়ে বড় আনন্দের ব্যাপার আর কিছু হতে পারে না। হায় আফসোস! যদি তারা একটু বুঝত যে, কী সর্বনাশের পথ তারা বেছে নিয়েছে’।
একদিকে অর্বাচীনের দল যখন দানবীয় আনন্দ ও নারকীয় কার্যকলাপে লিপ্ত ছিল তখন দুনিয়ার সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব মহানাবী মুহাম্মাদ (সাঃ) সিজদারত অবস্থায় বেহেশতী আবেহায়াত পানে বিভোর ছিলেন। কী অদ্ভুত বৈপরীত্য।
নাবী তনয়া ফাত্বিমাহ (রা.) এ দুঃসংবাদপ্রাপ্ত হয়ে দ্রুত সেখানে আগমন করেন এবং ভূঁড়ি সরিয়ে পিতাকে তার নীচ থেকে উদ্ধার করেন। তারপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) শির উত্তোলন করে তিনবার বললেন :
[اللهم عليك بقريش]
হে আল্লাহ! এ কুরাইশদিগকে পাকড়াও কর।”
যখন তিনি আল্লাহর নিকট এ আরয পেশ করলেন তখন তাদের মধ্যে কিছুটা অসুবিধা বোধের সৃষ্টি হল এবং তারা বিচলিত হয়ে পড়ল। কারণ তাদের এ বিশ্বাসও ছিল যে, এ শহরের মধ্যে প্রার্থনা কবুল হয়ে থাকে। তারপর তিনি নাম ধরে কয়েক জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও আরজি পেশ করলেনঃ
اللهم عليك بأبى جهل وعليك بعتبة بن ربيعة وشيبة بن ربيعة ووالد بن عتبة وامية بن خلف وعقبة بن ابى معيظ
‘হে আল্লাহ আবূ জাহেলকে, উতবাহহ বিন রাবী’আহকে, শায়বাহ বিন রাবী’আহকে অলীদ বিন উতবাহহকে, উমাইয়া বিন খালাফ এবং উক্ববা বিন মু’আইত্ব কে পাকড়াও কর।’
রাসূলুল্লাহ সপ্তম জনের নাম বলেছিলেন কিন্তু বর্ণনাকারীর তা স্মরণ নেই। ইবনে মাসউদ (রা.) বলেছেন, ‘সেই সত্ত্বার শপথ যার হাতে রয়েছে আমার জীবন! এ অবস্থার প্রেক্ষাপটে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যাদের নামে আরজি পেশ করেছিলেন বদর যুদ্ধে নিহত হয়ে কৃয়োর মধ্যে পতিত অবস্থায় আমি তাদের সকলকেই দেখেছি।[10]
উমাইয়া বিন খালাফের এ রকম এক স্বভাব হয়ে গিয়েছিল যে, যখনই সে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে দেখত তখনই তাঁকে ভর্ৎসনা করত এবং অভিশাপ দিত। এ প্রেক্ষিতে এ আয়াত কারীমা অবতীর্ণ হয় :
وَيْلٌ لِّكُلِّ هُمَزَةٍ لُّمَزَةٍ
‘প্রত্যেক অভিশাপকারী, ভর্ৎসনাকারী এবং অন্যায়কারীর জন্যই রয়েছে ধ্বংস (আল-হুমাযাহ ১০৪ : ১)
ইবনে হিশাম বলেন যে, ‘হুমাযাহা’ ঐ ব্যক্তি যে প্রকাশ্যে অশ্লীল বা অশালীন কথাবার্তা বলে ও চক্ষু বাঁকা টেড়া করে ইশারা ইঙ্গিত করে এবং ‘লুমাযাহ’ ঐ ব্যক্তি যে অগোচরে লোকের নিন্দা বা বদনাম করে ও তাদের কষ্ট দেয়।[11]
উমাইয়ার ভাই উবাই ইবনে খালফ ‘উক্ববা বিন আবী মু’আইতের অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল। এক দফা উক্ববা নাবী কারীম (সাঃ)-এর নিকট বসে কিছু শুনল। উবাই এ কথা জানতে পেরে তাকে খুব ধমক দিল, তার নিন্দা করল। তার নিকট অত্যন্ত কঠোরতার সঙ্গে কৈফিয়ত তলব করল এবং বলল যে, তুমি গিয়ে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর মুখে থুথু নিক্ষেপ করে এস। শেষ পর্যন্ত উক্ববা তাই করল। উবাই বিন খালফ নিজেই একবার মরা পচা হাড় নিয়ে তা চূৰ্ণ করে এবং জোরে ফূঁ দিয়ে তার রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দিকে উড়িয়ে দেয়।[12]
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে নির্যাতনকারী দলের মধ্যে যারা ছিল তাদের অন্যতম হচ্ছে আখনাস বিন শারীক সাক্বাফী। আল কুরআনে তার ৯টি বৈশিষ্ট্যের কথা বর্ণিত হয়েছে। এর মাধ্যমে তার মন মানসিকতা ও কাজকর্ম সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। ইরশাদ হয়েছে :
وَلَا تُطِعْ كُلَّ حَلَّافٍ مَّهِينٍ هَمَّازٍ مَّشَّاءٍ بِنَمِيمٍ مَّنَّاعٍ لِّلْخَيْرِ مُعْتَدٍ أَثِيمٍ عُتُلٍّ بَعْدَ ذَٰلِكَ زَنِيمٍ
“তুমি তার অনুসরণ কর না, যে বেশি বেশি কসম খায় আর যে (বার বার মিথ্যা কসম খাওয়ার কারণে মানুষের কাছে) লাঞ্ছিত। – যে পশ্চাতে নিন্দা করে একের কথা অপরের কাছে লাগিয়ে ফিরে, – যে ভাল কাজে বাধা দেয়, সীমালঙ্ঘনকারী, পাপিষ্ঠ, – কঠোর স্বভাব, তার উপরে আবার কুখ্যাত।” (আল-ক্বালাম ৬৮ : ১০-১৩)
আবূ জাহল কখনো কখনো রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট এসে কুরআন শ্রবণ করত। কিন্তু তার সে শ্রবণ ছিল নেহাৎই একটি মামুলী ব্যাপার। তার এ শ্রবণের মূলে আন্তরিক বিশ্বাস, আদব কিংবা আনুগত্যের কোন প্রশ্নই ছিল না। সেটাকে কিছুটা যেন তার উদ্ভট খেয়াল বলা যেতে পারে। সে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে অশ্লীল কিংবা কর্কশ কথাবার্তার মাধ্যমে কষ্ট দিত এবং আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টি করত। অধিকন্তু, অন্যায় অত্যাচারের ক্ষেত্রে সফলতা হওয়াটাকে গর্বের ব্যাপার মনে করে গর্ব করতে করতে পথ চলত। মনে হতো সে যেন মহা গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজ সম্পাদন করেছে। কুরআন মাজীদের এ আয়াত তার স্পর্কেই অবতীর্ণ হয়েছিল।[13]
فَلَا صَدَّقَ وَلَا صَلَّىٰ
“কিন্তু না, সে বিশ্বাসও করেনি, সলাতও আদায় করেনি।” (আল-ক্বিয়ামাহ ৭৫ : ৩১)
সেই ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে প্রথমদিকে যখন থেকে সালাত পড়তে দেখল তখন থেকে সালাত হতে নিবৃত্ত করার চেষ্টা চালাতে থাকে। এক দফা নাবী কারীম (সাঃ) মাকামে ইবরাহীমের নিকট সালাত পড়ছিলেন এমন সময় সে সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। তাকে দেখেই সে বলল, মুহাম্মাদ! আমি কি তোমাকে সালাত পড়া থেকে বিরত থাকতে বলিনি? সঙ্গে সঙ্গে সে নাবী কারীম রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে ধমকও দিল। নাবী কারীম (সাঃ)-ও ধমকের সুরে তাঁর এ কথার কঠোর প্রতিবাদ করলেন। প্রত্যুত্তরে সে বলল, “হে মুহাম্মাদ। আমাকে কেন ধমকাচ্ছ? আল্লাহর শপথ দেখ এ উপত্যকায় (মক্কায়) আমার বৈঠক সব চেয়ে বড়’। তার উক্তির প্রেক্ষিতে আল্লাহ তা’আলা এ আয়াত অবতীর্ণ করেন।[14]
فَلْيَدْعُ نَادِيَهُ
“কাজেই সে তার সভাষদদের ডাকুক।” (আল-আলাক্ব ৯৬ : ১৭)
এক বর্ণনায় রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার জামার বুকের অংশ ধরে জোরে হেঁচকা একটান দিলেন এবং এ আয়াতে কারীমা পাঠ করলেন :
أَوْلَىٰ لَكَ فَأَوْلَىٰ ثُمَّ أَوْلَىٰ لَكَ فَأَوْلَىٰ
“দুর্ভোগ তোমার জন্য, দুর্ভোগ, -তারপর তোমার জন্য দুর্ভোগের উপর দুর্ভোগ।” (আল-ক্বিয়ামাহ ৭৫ : ৩৪-৩৫)
এ পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহর সেই শত্রু বলতে লাগল, হে মুহাম্মাদ! তুমি আমাকে ধমক দিচ্ছ। আল্লাহর শপথ, তুমি ও তোমার প্রতিপালক আমার কিছুই করতে পারবে না। আমি মক্কার পর্বতের মধ্যে বিচরণকারীদের মধ্যে সব চেয়ে মর্যাদা-সম্পন্ন ব্যক্তি।[15]
তার এ অসার এবং উৎকট অহমিকা প্রকাশের পরও আবূ জাহাল সেসব থেকে নিবৃত্ত হল না। বরং তার অনাচার ও অন্যায় আচরণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েই চলল। যেমনটি সহীহুল মুসলিমে আবূ হুরাইরাহহ (রা.) কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন যে, এক দফা আবূ জাহল কুরাইশ প্রধানদের লক্ষ্য করে বললেন, ‘আপনাদের সম্মুখে মুহাম্মাদ (সাঃ) কি স্বীয় মুখমণ্ডলকে ধূলায় লাগিয়ে রাখে? প্রত্যুত্তরে বলা হল, হ্যাঁ”।
এরপর সে আস্ফালন করে বলল, ‘লাত ও উযযার কসম, যদি আমি তাকে পুনরায় সেই অবস্থায় (সালাতরত) দেখি তাহলে গ্ৰীবা পদতলে পিষ্ঠ করে ফেলব এবং মুখমণ্ডল মাটির সঙ্গে আচ্ছা করে ঘর্ষণ দিয়ে মজা দেখিয়ে দিব’।
কিছু দিন পর ঘটনাক্রমে একদিন সে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে সালাত পড়তে দেখে ফেলে এবং কুরাইশ প্রধানদের নিকট স্বঘোষিত সংকল্প কার্যকর করার উদ্দেশ্যে অগ্রসর হতে থাকে। কিন্তু আকস্মিকভাবে পরিলক্ষিত হল যে, অগ্রসর হওয়ার পরিবর্তে সে পশ্চাদপসরণ শুরু করেছে এবং আত্মরক্ষার জন্য অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে দু’হাত নড়াচড়া করে কী যেন এড়ানোর প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
উপস্থিত লোকজন জিজ্ঞাসা করল, ‘ওহে আবূল হাকাম! তোমার কী এমন হল যে, তুমি অমন ধারা ব্যস্ততায় লিপ্ত হয়ে পড়লে? সে উত্তর করল, ‘আমার এবং তার মধ্যে আগুনের এক গর্ত রয়েছে, ভয়াবহ বিভীষিকাময় ও ভীতপ্রদ শিকল রয়েছে’।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, ‘সে যদি আমার নিকট যেত তবে ফেরেশতাগণ তার এক একটা অঙ্গ উঠিয়ে নিয়ে যেতেন।[16]
উপর্যুক্ত বর্ণনা হচ্ছে, মুশরিকগণ (যারা ধারণা করতো তারা আল্লাহর বান্দা এবং তার হারামের অধিবাসী) মুসলমান এবং নাবী কারীম (সাঃ)-এর উপর যেভাবে অবর্ণনীয় অন্যায়, অত্যাচার ও উৎপীড়ন চালিয়ে আসছিল তার সংক্ষিপ্ত চিত্র।
এ রকম ভয়াবহ সংকটময় অবস্থায় এমন যথোচিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী ছিল যার মাধ্যমে মুসলমানগণ মুশরিকদের এমন বর্বোরোচিত অত্যাচার হতে রেহাই পেতে পারে। অতএব তিনি (সাঃ) দুটি হিকমতপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন যাতে করে সহজ পন্থায় দাওয়াতী কাজ চালানো যায় এবং অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌছা যায়। সিদ্ধান্ত দুটি হলো :
১. রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আরক্বাম বিন আবিল আরক্বাম মুখযুমীর বাড়িকে দাওয়াতী কর্মকাণ্ড পরিচালনা এবং শিক্ষা-প্রশিক্ষণের কেন্দ্র হিসেবে মনোনিত করলেন।
২. নবদীক্ষিত মুসলমানদেরকে হাবশায় হিযরত করার আদেশ করলেন।
ফুটনোটঃ[1] তিরমিযী শরীফ।
[2] ফী যিলালিল কুরআন ৩০ খণ্ড ২৮২ পৃঃ, তাফহীমূল কুরআন ৬ষ্ঠ খণ্ড ৫২২ পৃঃ।
[3] তাফহীমূল কুরআন ৬ষ্ঠ খণ্ড ৪৯০ পৃঃ।
[4] জামে তিরমিযী।
[5] মুশরিকগণ ক্রোধাম্বিত হয়ে নবী (সা.)-কে মুহাম্মাদ নামের পরিবর্তে মুযাম্মাম বলতেন যার অর্থ মুহাম্মাদ নামের বিপরীত। মুহাম্মাদ ঐ ব্যক্তি যাঁর প্রশংসা করা হয় এবং মুযামমাম ঐ ব্যক্তি যাকে তিরস্কার করা হয়।
[6] ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ৩৩৫-৩৩৬ পৃঃ।
[7] ইনি উমাইয়া খলীফা মারওয়ান বিন হাকামের পিতা ছিলেন।
[8] ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ৪১৬ পৃঃ।
[9] সহীহুল বুখারী এবং অন্য বর্ণনায় এর স্পষ্ট বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়েছে। দ্রষ্টব্য ১ম ৫৪৩ পৃঃ।
[10] সহীহুল বুখারী, অযু পর্বের ‘যখন কোন নামায়ীর উপর আবর্জনা নিক্ষিপ্ত” অধ্যায় ১ম খণ্ড ৩৭ পৃঃ।
[11] ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ৩৬১-৩৬২ পৃঃ।
[12] ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ৩৫৬ ও ৩৫৭ পৃঃ।
[13] ফী যিলালিল কুরআন ২৯/২১২।
[14] প্রাগুক্ত ৩০ পারা ২০৮।
[15] ফী যিলালিল কুরআন ২৯ পারা ৩১২।
[16] সহীহুল মুসলিম শরীফ।
আরকামের বাড়িতে (دَارُ الْأَرْقَمِ):
আরক্বাম বিন আবিল আরক্বাম মাখযূমীর বাড়িটি ছিল সাফা পর্বতের উপর অত্যাচারীদের দৃষ্টির আড়ালে এবং তাদের সম্মেলন স্থান হতে অন্য জায়গায় অবস্থিত। সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এ বাড়িকেই মুসলমানদের সাথে গোপনে মিলিত হওয়ার উপযুক্ত স্থান হিসেবে গ্রহণ করলেন। যাতে তিনি (সাঃ) সাহাবীদেরকে কুরআনের বাণী শোনানো, তাদের অন্তরকে কলূষমুক্তকরণ এবং তাদেরকে কিতাব এবং হিকমত শিক্ষা দিতে পারেন। আর মুসলমানগণ যেন নিরাপদে তাদের ইবাদাত বন্দেগী চালিয়ে যেতে পারেন; রাসূল (সাঃ) এর উপর যা অবতীর্ণ হয় তা তারা নিরাপদে গ্রহণ করতে পারেন এবং অত্যাচারী মুশরিকদের অজান্তে যারা ইসলাম গ্রহণ করতে চায় তারা যাতে ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হতে পারেন।
এ বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ ছিল না যে, তিনি যদি তাঁদের সঙ্গে একত্রিত হন তাহলে মুশরিকগণ তার আত্মশুদ্ধি এবং কিতাব ও হিকমত শেখার কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবেন এবং এর ফলে মুসলিম ও মুশরিক উভয় দলের মধ্যে সংঘর্ষের সম্ভাবনা থাকবে। ইবনু ইসহাক্ব বর্ণনা করেন, সাহাবীগণ (রা.) তাঁদের নির্দিষ্ট ঘাঁটিগুলোতে একত্রিত হয়ে সালাত আদায় করতেন। ঘটনাক্রমে এক দিবস কিছু সংখ্যক কাফের কুরাইশ তাদের এভাবে সালাত পড়তে দেখে ফেলার পর অশ্লীল ভাষায় তাদের গালিগালাজ করতে থাকেন এবং আক্রমণ করে বসেন। মুসলিমগণও সে আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য এগিয়ে আসেন। প্রতিহত করতে গিয়ে সা’দ বিন ওয়াক্কাস এক ব্যক্তিকে এমনভাবে প্রহার করেছিলেন যে তার শরীরের আঘাতপ্রাপ্ত স্থান থেকে রক্তধারা প্রবাহিত হতে থাকে। ইসলামে এটাই ছিল সর্বপ্রথম রক্তপাত।[1]
এটা সর্বজনবিদিত বিষয় যে, এভাবে যদি বারংবার মুসলিম ও মুশরিকদের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হতে থাকত তাহলে স্বল্প সংখ্যক মুসলিম স্বল্প সময়ের মধ্যেই নিঃশেষ হয়ে যেতেন। অতএব, ইসলামের সর্বপ্রকার কাজকর্ম অত্যন্ত সঙ্গোপনে সম্পন্ন করার দাবী ছিল খুবই যুক্তিসঙ্গত ও বিজ্ঞোচিত। এ প্রেক্ষিতে সাধারণ সাহাবীগণ (রা.)
তা’লীম, তাবলীগ, ইবাদত বন্দেগী সম্মেলন ও পারস্পরিক মত বিনিময় ইত্যাদি যাবতীয় কাজকর্ম সঙ্গোপনেই করতে থাকেন। তবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর এবাদত-বন্দেগী এবং প্রচারমূলক কাজকর্ম মুশরিকগণের সামনাসামনি প্রকাশ্যেই করতে থাকেন। তাকে কোন কিছুতেই তারা বাধা দেয়ার সাহস পেত না। তবুও মুসলিমগণের কল্যাণের কথা চিন্তা-ভাবনা করে সঙ্গোপণেই তিনি তাদের সঙ্গে একত্রিত হতেন।
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ২৬৩ পৃঃ। এবং মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব, মুখতাসারুস সীরাহ ৬০ পৃঃ।
আবিসিনিয়ার প্রথম হিজরত (الهِجْرَةُ الْأُوْلٰى إِلَى الْحَبْشَةِ):
অন্যায় অত্যাচারের উল্লেখিত বিভীষিকাময় ধারা-প্রক্রিয়া ও কার্যক্রম সূচিত হয় নবুওয়ত চতুর্থ বর্ষের মধ্যভাগে কিংবা শেষের দিক থেকে। জুলুম নির্যাতনের শুরুতে এর মাত্রা ছিল সামান্য। কিন্তু দিনের পর দিন মাসের পর মাস সময় যতই অতিবাহিত হতে থাকল জুলুম-নির্যাতনের মাত্রা ততই বৃদ্ধি পেতে পেতে পঞ্চম বর্ষের মধ্যভাগে তা চরমে পৌঁছল এবং শেষ পর্যন্ত এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হল যে, মক্কায় মুসলিমদের টিকে থাকা এক রকম অসম্ভব হয়ে উঠল। তাই এ বিভীষিকার কবল থেকে পরিত্রাণ লাভের উদ্দেশ্যে তাঁরা বাধ্য হলেন পথের সন্ধানে প্রবৃত্ত হতে। অনিশ্চয়তা এবং দুঃখ-দুর্দশার এ ঘোর অন্ধকারাচ্ছন্ন অবস্থার মধ্যে অবতীর্ণ হল সূরাহ যুমার।
এতে হিজরতের জন্য ইঙ্গিত প্রদান করে বলা হয় যে, ‘আল্লাহর জমিন অপ্রশস্ত নয়।’
{لِلَّذِيْنَ أَحْسَنُوْا فِيْ هَذِهِ الدُّنْيَا حَسَنَةٌ وَأَرْضُ اللهِ وَاسِعَةٌ إِنَّمَا يُوَفَّى الصَّابِرُوْنَ أَجْرَهُم بِغَيْرِ حِسَابٍ} [الزمر:10]
‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর। এ দুনিয়ায় যারা ভাল কাজ করবে, তাদের জন্য আছে কল্যাণ। আল্লাহর যমীন প্রশস্ত (এক এলাকায় ‘ইবাদাত-বন্দেগী করা কঠিন হলে অন্যত্র চলে যাও)। আমি ধৈর্যশীলদেরকে তাদের পুরস্কার অপরিমিতভাবে দিয়ে থাকি।’ (আয-যুমার ৩৯ : ১০)
অত্যাচারের মাত্রা যখন ধৈর্য ও সহ্যের সীমা অতিক্রম করে গেল, বিশেষ করে কুরআন মাজীদ পড়তে এবং নামায আদায় করতে না দেয়ার মানসিক যন্ত্রণা যখন চরমে পৌঁছল তখন তারা দেশান্তরের কথা চিন্তাভাবনা করতে শুরু করলেন। তিনি বহু পূর্ব থেকেই আবিসিনিয়ার সম্রাট আসহামা নাজ্জাশীর উদারতা এবং ন্যায় পরায়ণতা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। অধিকন্তু, সেখানে কারো প্রতি যে কোন অন্যায়-অত্যাচার করা হয় না সে কথাও তিনি জানতেন। মুসলিম সেখানে গমন করলে নিরাপদে থাকার এবং নির্বিঘ্নে ধর্ম কর্ম করার সুযোগ লাভ করবে। এ সব কিছু বিচার-বিবেচনা করে তাঁদের জীবন এবং ঈমানের নিরাপত্তা বিধান এবং নির্বিঘ্নে ধর্মকর্ম করার সুযোগ লাভের উদ্দেশ্যে হিজরত করে আবিসিনিয়ায় গমনের জন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবীগণ (রাঃ)-কে নির্দেশ প্রদান করেন।[1]
এ দিকে মুহাজিরগণ সম্পূর্ণ নিরাপদে আবিসিনিয়ায় বসবাস করতে থাকলেন।[2] পূর্বাহ্নেই বলা হয়েছে যে, এ দলটি রজব মাসে মক্কা থেকে হিজরত করেন। কিন্তু সেই বছরটির রমাযান মাসে কাবা শরীফে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়ে যায়।
ফুটনোটঃ[1] শাইখ আব্দুল্লাহ মুখতাসারুস সীরাহ পৃঃ ৯২-৯৩, যাদুল মা’আদ ১ম খন্ড ২৪ পৃঃ ও রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ৫১ পৃঃ।
[2] রহামাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড যাদুল মাযাদ ১ম খন্ড ২৪ পৃঃ।
মুসলিমদের সঙ্গে কাফিরদের সিজদাহ ও মুহাজিরদের প্রত্যাবর্তন (سُجُوْدُ الْمُشْرِكِيْنَ مَعَ الْمُسْلِمِيْنَ وَعَوْدَةُ الْمُهَاجِرِيْنَ):
একই বছর রমাযান মাসে নাবী কারীম (সাঃ) হারাম শরীফের উদ্দেশ্যে বের হন। কুরাইশগণের এক বিরাট জনতা সেই সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন। নাবী কারীম (সাঃ) সেখানে উপস্থিত হয়েই আকস্মিকভাবে সুরায়ে ‘নাজাম’ পাঠ করতে আরম্ভ করেন। ঐ সকল লোকেরা ইতোপূর্বে কুরআন শ্রবণ করত না এবং কোথাও কুরআন পাঠ করা হলে তারা শোরগোল করে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি করত যাতে তা শ্রুতিগোচর না হয়। কারণ, তাদের একটি বদ্ধমূল ধারণা ছিল কুরআন শ্রবণ করলে তারা প্রভাবিত হয়ে পড়বে। কুরআনের ভাষায় ব্যাপারটি ছিল এরূপঃ
{لاَ تَسْمَعُوْا لِهٰذَا الْقُرْآنِ وَالْغَوْا فِيْهِ لَعَلَّكُمْ تَغْلِبُوْنَ} [فصلت:26]
‘‘এ কুরআন শুনো না, আর তা পড়ার কালে শোরগোল কর যাতে তোমরা বিজয়ী হতে পার।’ (ফুসসিলাত ৪১ : ২৬)
কিন্তু নাবী কারীম (সাঃ) যখন এ সূরাহটি পাঠ আরম্ভ করলেন তখন এর অশ্রুত পূর্ব সুললিত বানী, অবর্ণনীয় কমনীয়তা ও অপরূপ মিষ্টতা যখন তাদের কর্ণকূহরে প্রবিষ্ট হল তখন তারা মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় সম্পূর্ণ ভাবাবিষ্ট এবং হতচকিত হয়ে পড়লেন। ইতোপূর্বে কুরআন পাঠের সময় তারা যেভাবে গন্ডগোল করত সে রকম গন্ডগোল করা তো দূরের কথা বরং আরও গভীর মনোযোগের সঙ্গে কান পেতে তারা তা শুনতে থাকল। তাদের অন্তরে ভিন্নমুখী কোন ভাবেরই উদ্রেক হল না। তারপর নাবী কারীম (সাঃ) যখন এ সূরাহর শেষের আয়াতসমূহ পাঠ করতে থাকলেন তখন তাদের অন্তরে কম্পন সৃষ্টি হতে থাকল। যখন তিনি আল্লাহর নির্দেশ-সম্বলিত শেষের আয়াতটি পাঠ করলেন :
{فَاسْجُدُوْا لِلهِ وَاعْبُدُوْا}
[1]
‘‘তাই, আল্লাহর উদ্দেশে সিজদাহয় পতিত হও আর তাঁর বন্দেগী কর। [সাজদাহ] (আন-নাজম ৫৩ : ৬২)
অতঃপর রাসূল (সাঃ) সিজদা করলেন এবং সাথে উপস্থিত মুশরিকরাও সকলে সিজদা করল।
কিন্ত পরক্ষণেই যখন ভাবাবিষ্ট অবস্থা থেকে তাঁরা স্বাভাবিকতায় প্রত্যাবর্তন করলেন তখন উপলব্ধি করতে সক্ষম হলেন যে, আল্লাহর কুরআনের অলৌকিকত্ব তাদের স্বকীয়তা বিনষ্ট করে দিয়েছে যার ফলে তাঁরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে সিজদাহ করতেও বাধ্য হয়েছেন। অথচ যাঁরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে সিজদাহহ করেন তাদের সমূলে ধ্বংস করার জন্য তাঁরা বদ্ধপরিকর। এমন এক অবস্থার প্রেক্ষাপটে তাঁরা আত্মগ্লানির অনলে দগ্ধীভূত হতে থাকেন। তাঁদের এ শোচনীয় মানসিক অবস্থার আরও অবনতি ঘটতে থাকে যখন অনুপস্থিত অন্যান্য মুশরিকগণ এ আচরণের জন্য তাঁদের লজ্জা দিতে ও নিন্দা জ্ঞাপন করতে থাকেন।
এ ত্রিশংকু অবস্থা থেকে আত্মরক্ষা এবং তাঁদের সমালোচনা মুখর মুশরিকগণের দৃষ্টির মোড় পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে তাঁরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নামে অপবাদ দিয়ে একটি অপপ্রচার শুরু করলেন। তাঁরা একটি নির্জলা মিথ্যাকে নানা রূপ ও রং দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নামে প্রচার শুরু করলেন যে, তিনি তাঁদের প্রতিমাসমূহের ইজ্জত ও সম্মানের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেছেনঃ
(تِلْكَ الْغَرَانِيْـقُ الْعُلٰى، وَإِنَّ شَفَاعَتَهُمْ لَتُرْتَجٰى)
(এরা সব উচ্চ পর্যায়ের দেবদেবী, তাদের শাফা‘আতের আশা করা যায়।)
অথচ তা ছিল মিথ্যা। নাবী কারীম (সাঃ)-এর সঙ্গে সিজদাহ করে তাদের ধারণায় তারা যে ভুলটি করেছিলেন তার গ্লানি থেকে মুক্তিলাভের উদ্দেশ্যেই তাঁদের এ অপপ্রচার। নাবী (সাঃ) সম্পর্কে সর্বদাই যাঁরা মিথ্যা কুৎসা রটনা এবং নানা অপপ্রচারে লিপ্ত থাকতেন এ ক্ষেত্রেও যে তাঁরা তা করবেন তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই। বরং এটাই স্বাভাবিক যে, যে কোন সূত্রে যে কোন মুহূর্তে নাবী (সাঃ)-এর নির্মল চরিত্রে কলংক লেপন করতে তারা কখনই কুণ্ঠা বোধ করবেন না।[2]
যা হোক, কুরাইশ মুশরিকগণের সিজদাহ করার খবর আবিসিনিয়ায় হিজরতকারী মুসলিমগণের নিকটও গিয়ে পৌঁছল। কিন্তু সেই সংবাদের রকম-সকম ছিল ভিন্ন। মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত কথার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই যেমন নানা রং-চংয়ের সংযোজন ও সংমিশ্রণ ঘটে যায় এ ক্ষেত্রেও হল ঠিক তাই। আবিসিনিয়ায় অবস্থানকারী মুহাজিরগণ খবর পেলেন যে, মক্কার কুরাইশগণ মুসলিম হয়ে গিয়েছেন। এ কথা শোনা মাত্রই স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য অনেকেরই মনে ব্যগ্রতা পরিলক্ষিত হল এবং পরবর্তী শওয়াল মাসেই তাঁদের একটি দল মক্কা অভিমুখে যাত্রা করলেন। কিন্তু মক্কা থেকে তাঁরা এক দিনের পথের দূরত্বে অবস্থান করছিলেন তখন প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে অবগত হয়ে তাঁরা বুঝতে পারেন যে, ব্যাপারটি যেভাবে তাঁদের নিকট চিত্রিত করা হয়েছে প্রকৃত ঘটনাটি তা নয়। তাই দলের কিছু সংখ্যক লোক আবিসিনিয়া অভিমুখে পুনরায় যাত্রা করলেন এবং কিছু সংখ্যক সঙ্গোপনে কিংবা কুরাইশগণের আশ্রয়ে মক্কায় প্রবেশ করলেন।[3]
এর পর মক্কা প্রত্যাগত মুহাজিরগণের উপর বিশেষভাবে এবং অন্যান্য মুসলিমগণের উপর সাধারণভাবে কুরাইশগণের অন্যায়, অত্যাচার ও উৎপীড়ন বহুলাংশে বৃদ্ধি পেল। শুধু মুহাজিরগণই নন, এমন কি তাঁদের পরিবার পরিজনও এ নির্যাতনের হাত থেকে নিস্তার পেল না। এর কারণ হচ্ছে ইতোপূর্বে কুরাইশগণ যখন অবগত হয়েছিলেন যে, আবিসিনিয়ায় মুহাজিরগণের সাথে নাজ্জাশী অত্যন্ত সহৃদয়তার সঙ্গে আচরণ করছেন এবং নানাভাবে তাঁদের প্রতি মদদ জুগিয়ে চলেছেন। মুসলিমদের উপর প্রতিহিংসাপরায়ণ কুরাইশদের জুলুম-নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার প্রেক্ষাপটে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পরামর্শ দিলেন পুনরায় আবিসিনিয়ায় হিজরত করতে।
ফুটনোটঃ[1] সহীহুল বুখারীতে এ সিজদার ঘটনাটি ইবনে মাসউদ ও ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে বর্ণিত হয়েছে। বাবু সাজাদাতিন্নাজমি এবং বাবু সুজুদিল মুশরিকীন ১ম খন্ড ১৪৬ পৃঃ ও বাবু মালাকিয়্যান নাবিয়্যু ফী আসহাবিহি ১ম খন্ড ৫৪৩ পৃঃ। দ্রষ্টব্য।
[2] বিশেষজ্ঞগণ এ বর্ণনা সূত্রের সমস্ত পথগুলো যাচাই করার পরে এ ফলাফলের গ্রহণ করেছেন।
[3] যাদুল মা’আদ ১ম খন্ড ২৪ পৃঃ এবং ২য় খন্ড ৪৪পৃঃ, ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৩৬৪ পৃঃ।
আবিসিনিয়ায় দ্বিতীয় হিজরত (الْهِجْرَةُ الثَّانِيَةُ إِلَى الْحَبْشَةِ):
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নির্দেশ পেয়ে মুসলমানগণ ব্যাপকভাবে হিজরতের প্রস্তুতি নিতে থাকলেন। কিন্তু এ দ্বিতীয় হিজরত ছিল খুবই কঠিন। কেননা প্রথম হিজরতের সময় কুরাইশগণ সচেতন ছিলেন না। কিন্তু অতন্দ্র প্রহরীর মতো এখন তাঁরা সচেতন এবং যে কোন মূল্যে এ ধরণের প্রচেষ্টা প্রতিহত করার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর ছিলেন।
কিন্তু আকাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্য সাধনে সাফল্য লাভের ব্যাপারে কুরাইশগণের তুলনায় মুসলমানদের সচেতনতা ও ঐকান্তিকতার মাত্রা ছিল অনেক গুণে বেশী। উপরন্তু নিরীহ, নির্দোষ এবং ন্যায়নিষ্ঠ মুসলিমদের প্রতি ছিল আল্লাহ তা‘আলার বিশেষ অনুগ্রহ। যার ফলে কুরাইশগণের তরফ থেকে কোন অনিষ্ট কিংবা প্রতিবন্ধকতা আসার পূর্বেই তাঁরা সহীহুল সালামতে গিয়ে পৌঁছলেন হাবশের সম্রাটের দরবারে।
দ্বিতীয় দফায় সর্বমোট ৮২ জন কিংবা ৮৩ জন পুরুষ হিজরত করেছিলেন (এর মধ্যে আম্মার (রাঃ)-এর হিজরত সম্পর্কে মত পার্থক্য রয়েছে) এবং ১৮ কিংবা ১৯ জন মহিলা ঐ দলে ছিলেন।[1] আল্লামা সুলাইমান মুনসুরপুরী দৃঢ়ভাবে মহিলা মুহাজিরগণের সংখ্যা ১৮ বলেছেন।[2]
ফুটনোটঃ[1] যাদুল মা’আদ ১ম খন্ড পৃঃ ২৪, রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ৬১ পৃঃ।
[2] রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ৬১পৃঃ।
আবিসিনিয়ায় হিজরতকারী মুহাজিরগণের বিরুদ্ধে কুরাইশ ষড়যন্ত্র (مَكِيْدَةُ قُرَيْشٍ بِمُهَاجِرِي الْحَبْشَةِ):
জান-মাল ও ঈমান রক্ষার্থে মুসলিমগণ দেশত্যাগ করে আবিসিনিয়ায় গিয়ে সেখানে শান্তি স্বস্তি লাভ করায় কুরাইশগণের দারুণ গাত্রদাহ সৃষ্টি হয়ে যায়। এ প্রেক্ষিতে ‘আমর বিন আস এবং গভীর জ্ঞানগরিমার অধিকারী আব্দুল্লাহ বিন রাবী’আহকে (যিনি তখনো ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন নি) নাজ্জাশীর নিকট প্রেরণ করার জন্য দূত মনোনীত করা হয়। তারপর সম্রাট নাজ্জাশী এবং বেতরীকগণের (খ্রীষ্টান ও অগ্নিপূজকদের পুরোহিত) জন্য বহু মূল্যবান উপঢৌকনসহ দূত দ্বয়কে দৌত্যকর্ম সম্পাদনের উদ্দেশ্যে আবিসিনিয়ায় প্রেরণ করা হয়।
আবিসিনিয়ায় পৌঁছে তারা সর্বপ্রথম বেতরীক পুরোহিতগণের দরবারে উপস্থিত হয়ে উপঢৌকন প্রদান করেন। তারপর তাঁদের নিকট সেই সকল বিবরণ ও প্রমাণাদি উপস্থাপন করেন যার ভিত্তিতে তারা মুসলিমগণকে হাবশ হতে বাহির করার উদ্যোগ নিয়েছিল। যদি সেই সকল বিবরণ ও প্রমাণাদির তেমন কোন ভিত্তিই ছিল না, তবুও উপঢৌকনের সুবাদে বেতরীকগণ (পাদ্রীগণ) এ ব্যাপারে একমত হলেন যে, মুসলিমগণকে হাবশ হতে বহিস্কার করার ব্যাপারে সম্রাট নাজ্জাশীকে তাঁরা পরামর্শ দিবেন। বেতরীকগণের নিকট থেকে সহযোগিতা লাভের আশ্বাস পেয়ে কুরাইশ দূতেরা সম্রাট নাজ্জাশীর দরবারে উপস্থিত হয়ে উপঢৌকন প্রদান করে আরজি পেশ করেন। তাঁদের আরজির বিবরণ হচ্ছে এরূপঃ
‘‘হে মহামান্য সম্রাট! আমাদের দেশের কিছু সংখ্যক অবোধ ও অর্বাচীন যুবক আমাদের দেশ থেকে পলায়ণ করে আপনার দেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। তাঁরা তাঁদের পূর্ব পুরুষগণের নিকট থেকে বংশপরম্পরা সূত্রে চলে আসা ধর্মমত পরিত্যাগ করেছে। আপনার দেশে আশ্রয় গ্রহণ করে আপনার ধর্মমতও গ্রহণ করেন নি। এ হচ্ছে তাঁদের চরম ধৃষ্টতার পরিচায়ক। শুধু তাই নয়, এরা নাকি একটা নতুন ধর্মমতও আবিস্কার করেছেন। এর চাইতে আজগুবি ব্যাপার আর কী হতে পারে বলুন। আমাদের গোত্রীয় প্রধান এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ, এ সকল অর্বাচিনের পিতামাতা, মুরুববী ও আত্মীয়-স্বজনগণ তাঁদেরকে স্বদেশে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে আমাদের দু’জনকে দূত হিসেবে দরবারে প্রেরণ করেছেন। আপনি অনুগ্রহ করে আমাদের সঙ্গে ওঁদের ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করুন। আমাদের প্রধানগণ এদের ভালমন্দ সম্পর্কে ভালভাবে বোঝেন এবং তাদের অসন্তোষের কারণ সম্পর্কে ওয়াকেবহাল রয়েছেন।’
কুরাইশ দূতেরা সম্রাটের নিকট যখন এ আরজি পেশ করলেন তখন পুরোহিতগণ বললেন, ‘মহামান্য সম্রাট! এরা উভয়েই খুব যুক্তিসংগত এবং সঠিক কথা বলেছেন। আপনি এদের হাতে ঐ দেশত্যাগী যুবকদের সমর্পণ করে দিন। আমাদের মনে হয় এটাই ভাল যে, তাঁরা তাঁদের স্বদেশে ফেরৎ নিয়ে যান।
কুরাইশ দূতগণের কথাবার্তা শ্রবণের পর সম্রাট নাজ্জাশী গভীরভাবে কিছুক্ষণ চিন্তা করে নিয়ে বললেন, ‘আলোচ্য বিষয়টির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভের পূর্বে কোন কিছু মন্তব্য প্রকাশ করা কিংবা সিদ্ধান্ত নেয়া সমীচীন হবে না। সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্বে বিষয়টির খুঁটি নাটি সম্পর্কে ওয়াকেবহাল হওয়া তাঁর বিশেষ প্রয়োজন। এ প্রেক্ষিতে তাঁর দরবারে উপস্থিত হওয়ার জন্য তিনি মুসলিমদের আহবান জানালেন। মুসলিমগণও আল্লাহ তা‘আলার কথা স্মরণ করে বিষয়ের খুঁটি-নাটিসহ সকল কথা সম্রাট সমীপে পেশ করার জন্য উত্তম মানসিক প্রস্ত্তটি সহকারে সম্রাটের দরবারে গিয়ে উপস্থিত হলেন।
সম্রাট নাজ্জাশী তাঁর দরবারে উপস্থিত মুসলিমদের লক্ষ্য করে বললেন, ‘যে ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার কারণে যুগ যুগ ধরে পূর্ব পুরুষগণের বংশপরম্পরা সূত্রে চলে আসা ধর্ম তোমরা পরিত্যাগ করেছ এবং এমন কি আমাদের দেশে আশ্রিত হয়েও তোমরা আমাদের ধর্মের প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন রয়েছে সে ধর্মটি কোন্ ধর্ম?’
প্রত্যুত্তরে মুসলিমদের মনোনীত মুখপাত্র হিসেবে জা’ফার বিন আবূ ত্বালিব অকপটে বলে চললেন, ‘হে সম্রাট! আমরা ছিলাম অজ্ঞতা, অশ্লীলতা ও অনাচারের অন্ধকারে নিমজ্জিত দুষ্কর্মশীল এক জাতি। আমরা প্রতিমা পূজা করতাম, মৃত জীব-জানোয়ারের মাংস ভক্ষণ করতাম, নির্বিচারে ব্যভিচার ও অশ্লীলতায় লিপ্ত থাকতাম, আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতাম, পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে অন্যায় আচরণ করতাম, আমানতের খেয়ানত ও মানুষের হক পয়মাল করতাম এবং দুর্বলদের সহায়-সম্পদ গ্রাস করতাম, এমন এক অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজ জীবনে আমরা যখন মানবেতর জীবন যাপন করে আসছিলাম তখন আল্লাহ রাববুল আলামীন অনুগ্রহ করে আমাদের মাঝে এক রাসূল প্রেরণ করলেন। তাঁর বংশ মর্যাদা, সততা, সহনশীলতা, সংযমশীলতা, ন্যায়-নিষ্ঠা, পরোপকারিতা ইত্যাদি গুণাবলী এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে পূর্ব থেকেই আমরা অবহিত ছিলাম। তিনি আমাদেরকে আহবান জানিয়ে বললেন যে, ‘সমগ্র বিশ্ব জাহানের স্রষ্টা প্রতিপালক এক আল্লাহ ছাড়া আমরা আর কারো উপাসনা করব না। বংশ পরম্পরা সূত্রে এ যাবৎ আমরা যে সকল প্রস্তর মূর্তি বা প্রতিমা পূজা করে এসেছি সে সব বর্জন করব। অধিকন্তু মিথ্যা বর্জন করা, পাড়া-প্রতিবেশীগণের সাথে সদ্ব্যবহার করা, অশ্লীল অবৈধ কাজকর্ম থেকে বিরত থাকা এবং রক্তপাত পরিহার করে চলার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। তাছাড়া মহিলাদের উপর নির্যাতন চালানো কিংবা মহিলাদের অহেতুক অপবাদ দেয়া থেকেও বিরত থাকার জন্য তিনি পরামর্শ দেন। আল্লাহর সঙ্গে শরীক করা থেকে বিরত থাকার জন্যও তিনি পরামর্শ দেন। অধিকন্তু, নামায, রোযা এবং যাকাতের জন্যও তিনি আমাদের নির্দেশ প্রদান করেন।’
এইভাবে জা’ফার অত্যন্ত চিত্তোদ্দীপক এবং মর্মস্পর্শী ভাষায় ইসলামের মূলনীতি এবং বিধি-বিধানগুলো বর্ণনা করলেন। তারপর আবারও বললেন, ‘এই পয়গম্বরকে বিশ্বজাহানের স্রষ্টা প্রতিপালক আল্লাহর (মহিমান্বিত প্রভূর) পয়গম্বর বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেছি এবং তাঁর আনীত দ্বীনে এলাহীর অনুসরণে দৃঢ় প্রত্যয় ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আল্লাহ এবং তদীয় রাসূলের পয়রবী করে চলছি। সুতরাং আমরা এক এবং অদ্বিতীয় প্রভূ আল্লাহর ইবাদত ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করি না এবং বিশ্ব জাহানে কোথাও তাঁর কোন শরীক আছে বলে আমরা বিশ্বাস করি না। পয়গম্বর যে সব কথা, কাজ ও খাদ্য আমাদের জন্য হারাম বলেছেন আমরা সেগুলোকে বিষবৎ পরিত্যাগ করেছি এবং যেগুলোকে হালাল বলেছেন আমরা সেগুলোকে বৈধ জেনে তার সদ্ব্যবহার করছি। এ কারণে আরব সমাজের বিভিন্নগোত্র ও সম্প্রদায় আমাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছে। তাঁরা চান এ সত্য, সুন্দর, শাশ্বত ও সুনির্মল দ্বীপে থেকে আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে অশ্লীলতা এবং অনাচারের গভীর পঙ্কে পুনরায় নিমজ্জিত করতে। কিন্তু আমরা তা অস্বীকার করায় তারা আমাদের উপর নারকীয় নির্যাতন চালিয়েছেন। এক আল্লাহর ইবাদত থেকে ফিরিয়ে নিয়ে প্রতিমা পূজায় লিপ্ত করানোর জন্য আমাদের উপর আঘাতের উপর আঘাত হেনেছে, নিদাঘের উত্তপ্ত কংকর ও বালুকারাশির উপর শুইয়ে বুকের উপর পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে, জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর শুইয়ে দিয়ে বুকে পাথর চাপা দিয়েছে, পায়ে দড়ি বেঁধে পথে প্রান্তরে টেনে নিয়ে বেড়িয়েছে। এমনকি এইভাবে যখন তাঁরা আমাদের উপর অবিরামভাবে অন্যায় অত্যাচার চালাতে থাকলেন আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে আল্লাহর জমিনকে আমাদের জন্য সংকীর্ণ করে ফেললেন এবং এমন কি আমাদের ও আমাদের দ্বীনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে ও প্রাণনাশের হুমকি দিতে থাকলেন তখন আপনার মহানুভবতা, উদারতা ও ন্যায়-নিষ্ঠার কথা অবগত হয়ে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আমাদের নির্দেশ প্রদান করলেন দেশত্যাগ করে আপনার দেশে আশ্রয় গ্রহণ করতে। হে সম্রাট! আমরা আপনার সহৃদয়, উদারতা ও মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়েছি। আমরা চাই আপনার আশ্রয়ের সুশীতল ছায়াতলে অবস্থান করতে। অনুগ্রহ করে এ সব পাষন্ড যালেমদের (অত্যাচারীদের) হাতে আমাদের সমর্পণ করবেন না।’
সম্রাট নাজ্জাশী বললেন সেই পয়গম্বর যা এনেছেন তার কিছু অংশ তোমাদের কাছে আছে কি? হযরত জা‘ফর বললেন, ‘জী হ্যাঁ’’।
নাজ্জাশী বললেন, ‘তা হলে আমার সামনে পড়ে শোনাও।
জা‘ফর (রাঃ) আল্লাহর সমীপে নিবেদিত এবং আত্মা-সমাহিত অবস্থায় ভাবগদগদ চিত্তে সুরায়ে মরিয়মের প্রথম কয়েকটি আয়াত পাঠ করে শোনালেন: {كهيعص}
নাজ্জাশী এতই মুগ্ধ হলেন যে, তাঁর চক্ষুদ্বয় হতে অশ্রুধারা প্রবাহিত হয়ে দাঁড়ি ভিজে গেল। জাফরের তিলাওয়াত শ্রবণ করে নাজ্জাশীর ধর্মীয় মন্ত্রণাদাতাগণও এতই ক্রন্দন করেছিলেন যে, ‘এ কালাম (বাণী) এবং সেই কালাম যা ঈসা (আঃ)-এর নিকট অবতীর্ণ হয়েছিল, উভয় কালামই এক উৎস হতে অবতীর্ণ হয়েছে।’
এরপর নাজ্জাশী ‘আমর বিন আস এবং আব্দুল্লাহ বিন রাবী’আহকে সম্বোধন করে বললেন, ‘তোমরা যে দূরভিসন্ধি নিয়ে আমার দরবারে আগমন করেছ তা সঙ্গে নিয়েই দেশে ফিরে যাও। তোমাদের হাতে এদের সমর্পণ করার কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। অধিকন্তু, এ ব্যাপারে এখানে কোন কূট কৌশলেরও অবকাশ থাকবে না।’
সম্রাট নাজ্জাশীর নিকট থেকে এ নির্দেশ লাভের পর তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থমনোরথ হয়ে তাঁর দরবার কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন। আদম সন্তানদের গোমরাহ করার ব্যাপারে আযাযীল শয়তান যেমন একের পর এক কৌশল প্রয়োগ করতে থাকে এরাও তেমনি একটি কৌশল ব্যর্থ হওয়ায় অন্য কৌশল প্রয়োগের ফন্দি ফিকির সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা শুরু করেন। এক পর্যায়ে ‘আমর বিন আস আব্দুল্লাহ বিন রাবী’আহকে বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আগামীকাল এদের সম্পর্কে এমন প্রসঙ্গ নিয়ে আসব যা এদের জীবিত থাকার মূল কর্তন করে ফেলবে। আর না হয়, এদের ব্যাপারে এমন মন্ত্রের অবতারণা করব যাতে এদের মূল কর্তিত হয়ে এবং সজীবতা ও সতেজতা বিনষ্ট হয়ে যায়। প্রত্যুত্তরে আব্দুল্লাহ বিন রাবী’আহ বললেন, ‘না-না, এমনটি করা সমীচীন হবে না। কারণ, এরা যদিও আমাদের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন তবুও এটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, তাঁরা আমাদের স্বজাতি এবং স্বগোত্রীয় লোক এবং আত্মীয়-স্বজনও বটে।
কিন্তু ‘আমর বিন আস একথার তেমন গুরুত্ব না দিয়ে স্বীয় মতের উপর অটল রইলেন।
পরের দিন পুনরায় নাজ্জাশীর দরবারে উপস্থিত হয়ে, ‘আমর বিন আস বললেন, ‘হে সম্রাট! এরা ঈসা বিন মরিয়ম সম্পর্কে এমন একটি কথা বলেন যা কেউই কোন দিন বলেনি। আপনি ওদের কাছ থেকে এটা জেনে নিয়ে এর প্রতিকার করুন।’
একথা শোনার পর সম্রাট নাজ্জাশী পুনরায় মুসলিমদের ডেকে পাঠালেন। তাঁরা দরবারে এসে উপস্থিত হলে ঈসা (অীঃ) সম্পর্কে মুসলিমগণ কী ধারণা পোষণ করেন তা তিনি জানতে চাইলেন। সম্রাটের মুখ থেকে এ কথা শুনে মুসলিমগণ দ্বিধা দ্বন্দ্ব এবং সংশয়ের মধ্যে নিপতিত হলেন। কারণ ঈসা (আঃ) সম্পর্কে খ্রীষ্টান এবং মুসলিমদের মধ্যে তত্ত্বগত মত পার্থক্য রয়েছে। খ্রীষ্টানগণ বলেন মসীহ (জেসাস) আল্লাহর পুত্র। কিন্তু পার্থক্য হেতু মুসলিমগণ বলেন ঈসা (আঃ) হচ্ছেন আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। তত্ত্বগত এ পার্থক্য হেতু মুসলিমদের সংশয় এ কারণে যে, এ কথা বললে সম্রাট নাজ্জাশী যদি বা বিরূপ ভাব পোষণ করেন, তাহলে মুসলিমদের জন্য তা খুবই উদ্বেগের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু সেটা ছিল নেহাৎই একটা ক্ষণিকের ব্যাপার। আল্লাহর অনুগ্রহের উপর আস্থাশীল দৃঢ়চিত্ত মুসলিমগণ পরক্ষণেই মনস্থির করে ফেললেন যে, আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলের পক্ষ থেকে যে শিক্ষা তাঁরা পেয়েছেন সেটাই হবে তাঁদের মূলমন্ত্র এবং সেটাই হবে তাঁদের বক্তব্য তাতে ভাগ্যে যা ঘটবে ঘটুক।
নাজ্জাশীর প্রশ্নের উত্তরে জা‘ফর বললেন আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল (সাঃ)-এর পক্ষ থেকে আমরা যে শিক্ষা লাভ করেছি তাতে আমরা জেনেছি যে ঈসা (আঃ) হচ্ছেন আল্লাহর বান্দা এবং রাসূল। তাঁর মা মরিয়ম ছিলেন সতী-সাধ্বী এবং আল্লাহর দৃষ্টিতে উচ্চ মর্যাদার মহিলা। আল্লাহর হুকুম এবং বিশেষ ব্যবস্থাধীনে কুমারী মরিয়মের গর্ভে ঈসা (আ)-এর জন্ম হয়।’
এ কথা শ্রবণের পর নাজ্জাশী এক টুকরো খড় উঁচু করে ধরে বললেন, ‘আল্লাহর শপথ, যা তোমরা বলেছ, ঈসা (আঃ)-এর চাইতে এ খড় পরিমাণও বেশী কিছু ছিলেন না।’ এ প্রেক্ষিতে পুরোহিতগণও ‘হুঁ’ ‘হুঁ’ বলে সমর্থন জ্ঞাপন করলেন।
নাজ্জাশী বললেন, ‘হ্যাঁ’, এখন তো তোমরা হাঁ হুঁ বলে সমর্থন জ্ঞাপন করবেই।’
তারপর নাজ্জাশী মুসলিমদের লক্ষ্য করে বললেন, ‘তোমরা নির্ভয়ে, শান্তি ও নিরাপত্তার সঙ্গে আমার রাজ্যে বসবাস কর। যে কেউ তোমাদের উপর অন্যায় করবে তার জন্য জরিমানা ও শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা করা হবে। তোমাদের প্রতি অন্যায় অত্যাচারের বিনিময়ে আমার হাতে কেউ সোনার পাহাড় এনে দিলেও আমি তা সহ্য করব না।’
এর পর তিনি তাঁর পার্শ্বচরদের লক্ষ্য করে বললেন, ‘এই কুরাইশ দূতদের আনীত উপঢৌকন তাদের ফিরিয়ে দাও। উপঢৌকনে আমার কোনই প্রয়োজন নেই। আল্লাহর শপথ! আল্লাহ তা‘আলা যখন আমাকে সাম্রাজ্য ফিরিয়ে দেন তখন আমার নিকট থেকে উপঢৌকন কিংবা উৎকোচ গ্রহণ করেন নি। সে ক্ষেত্রে তাঁর সন্তুষ্টি বিধানের উদ্দেশ্যে কাজ করতে গিয়ে কিভাবে আমি উৎকোচ গ্রহণ করতে পারি। যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা আমার ব্যাপারে অন্য লোকদের কথা গ্রহণ করেন নি, আমি কোন লোকের কোন কথা গ্রহণ করতে পারি না।’
এ ঘটনার বর্ণনাকারিণী উম্মু সালামাহ বলেছেন, এরপর প্রত্যাখ্যাত উপঢৌকন সহ কুরাইশ দূতগণ চরম বেইজ্জতির সঙ্গে নাজ্জাশীর দরবার থেকে বেরিয়ে এলেন এবং আমরা তাঁর ছত্রছায়ায় সম্মানের সঙ্গে তার রাজ্যে অবস্থান করতে থাকলাম।[1]
ইবনে ইসহাক্বের বর্ণনায় এ ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। কোন কোন চরিতকারের বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, নাজ্জাশীর দরবারে ‘আমর বিন আসের উপস্থিতির ঘটনাটি সংঘটিত হয় বদর যুদ্ধের পর। সামঞ্জস্য বিধানের জন্য বলঅ হয়েছে ‘আমর বিন আস দু’দফা নাজ্জাশীর দরবারে গিয়ে ছিলেন। কিন্তু বদর যুদ্ধের পর নাজ্জাশীর দরবারে ‘আমর বিন আসের উপস্থিতি সূত্রে সম্রাট নাজ্জাশী এবং জাফরের মধ্যে যে কথোপকথনের উল্লেখ করা হয়েছে তার সঙ্গে আবিসিনিয়ায় হিজরতের পর নাজ্জাশী এবং জাফরের মধ্যে যে কথোপকথন হয়েছিল তার হুবহু মিল রয়েছে। অধিকন্তু ইবনে ইসহাক্বের বর্ণনায় আবিসিনিয়ায় হিজরতের পর নাজ্জাশীর দরবারে ‘আমর বিন আসের উপস্থিতির কথা বলা হয়েছে এবং ঐ একই প্রশ্নোত্তরের কথা উল্লেখিত হয়েছে। কাজেই, উপর্যুক্ত বিভিন্ন তথ্য প্রমাণের প্রেক্ষাপটে এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, মুসলিমদের ফেরত আনার জন্য ‘আমর বিন আস মাত্র একবার নাজ্জাশীর দরবারে গিয়েছিলেন এবং ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল আবাসিনিয়ায় হিজরতের পর পরই।
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড পৃঃ ৩৩৪-৩৩৮ হতে সংক্ষিপ্ত।
অত্যাচারে কঠোরতা অবলম্বন ও নাবী কারীম (সাঃ)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র (الشدة فى التعذيب ومحاولة القضاء على رسول الله):
যা হোক মুশরিকগণের চাতুর্য শেষ পর্যন্ত পর্যবসিত হল অকৃতকার্যতায় এবং তাঁরা এটাও উপলব্ধি করলেন যে, মুসলিমদের বিরুদ্ধে তাদের শত্রুতা কিংবা তাদের শায়েস্তা করার ব্যাপারে স্বদেশভূমির বাইরে সাফল্য লাভের কোনই সম্ভবানা নেই। কাজেই তাদের প্রচার-সংক্রান্ত কাজকর্ম বন্ধ করতে হলে কিংবা শায়েস্তা করতে হলে স্বদেশের সীমানার মধ্যেই তা করতে হবে। তাছাড়া ষ্ট্রাটেজী বা কর্মকৌশল হিসেবে তাঁরা এটাও স্থির করলেন যে, এদের বিরুদ্ধে সাফল্য লাভ করতে হলে হয় বল প্রয়োগ করে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর প্রচারাভিযান সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিতে হবে আর না হয় তাঁর অস্তিত্বকে ধরাপৃষ্ঠ থেকে একদম নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে হবে।
এমন পরিস্থিতিতে খুব অল্পসংখ্যক মুসলিম মক্কায় অবস্থান করছিলেন যারা ছিলেন অত্যন্ত সম্রান্ত ও মযাদার পাত্র অথবা কারো আশ্রিত। এসত্ত্বেও তারা উদ্যত মুশরিকদের থেকে গোপনে ইবাদত বন্দেগী করতেন। তবুও তারা মুশরিকদের অত্যাচার নির্যাতন থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ ছিলেন না।
অন্যদিকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রকাশ্যভাবে মুশরিকদের সম্মুখে সালাত ও অন্যান্য ইবাদত করতেন এবং সংগোপনে আল্লাহর নিকট দু’আ করতেন এতে কোন শক্তিই তাঁকে বাধা দিতে পারতো না। অতঃপর নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হওয়ার পর তিনি (সাঃ) এমনভাবে প্রচার কাজ আরম্ভ করলেন যে তাঁকে আর কোন শক্তিই আটকিয়ে রাখতে সক্ষম হলো না। দাওয়াতে রেসালাতের কাজ যখন এরকম এক পরিস্থিতির সম্মুখীন তখন আল্লাহ তা’আলা তাঁর পিয়ারা হাবীবকে নির্দেশ দেন-
فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِينَ
‘কাজেই তোমাকে যে বিষয়ের হুকুম দেয়া হয়েছে তা জোরে শোরে প্রকাশ্যে প্রচার কর, আর মুশরিকদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও। (আল-হিজর ১৫ : ৯৪)
উপর্যুক্ত আয়াত অবতীর্ণের পর মুশরিকদের কাজ কেবল এটুকুই ছিল যে, তারা মুহাম্মাদ (সাঃ) থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। মুহাম্মাদ (সাঃ) এর মর্যাদা ও প্রভাবের কারণে এ ব্যতিত আর কিছুই করার ছিল না। অধিকন্তু মুহাম্মাদ (আঃ)-এর অভিভাবক ছিলেন আবূ ত্বালিব যিনি তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র এবং মুশরিকগণের মধ্যে বিরাজমান ছিলেন। তার কারণে মুহাম্মাদের উপর যে কোন কিছু করতে ভীত ছিল। তাছাড়া বনু হাশিমের পক্ষ থেকেও তাদের আশংকা ছিল। তাদের উদ্দেশ্য সাধনের ক্ষেত্রে কোন সিদ্ধান্তের উপর আস্থা রাখতে পারছিল না। যখনই মুশরিকরা কোন পদক্ষেপ গ্রহণের মনস্থ করতো তারা দেখতো যে, তাদের এ কর্মপন্থা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর দাওয়াতের কাছে খড়কুটোর মতোই তুচ্ছ ও অকার্যকর।
অত্যাচারে অত্যাচারে কিভাবে তারা মুসলিমদের জর্জরিত এবং অতিষ্ট করে তুলেছিল তার অসংখ্য প্রমাণ এ সম্পর্কিত হাদীসসমূহের পৃষ্ঠায় রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ এখানে দুয়েকটা ঘটনার কথা উল্লেখিত হল :
একদা আবূ লাহাবের পুত্ৰ উতায়বা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বলল ; আমি (وَالنَّجْمِ إِذَا هَوَىٰ) ও (ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّىٰ) এ আয়াত দুটোকে অস্বীকার করছি। এর পরই সে নাবী কারীম (সাঃ)-কে কষ্ট দেয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগে গেল। সে জামা ছিঁড়ে নষ্ট করে ফেলল এবং তাঁর পাক মুখে থুথু নিক্ষেপ করল। আল্লাহর রহমতে থুথু সে পর্যন্ত গিয়ে পৌছে নাই। সেই অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আল্লাহর সমীপে দু’আ করলেন, اللهم سلط عليه كلبا من كلابك
“হে আল্লাহ! তোমার কুকুরগুলোর মধ্য থেকে এর জন্য একটি কুকুর নিযুক্ত করে দাও।”
নাবী কারীম (সাঃ)-এর দু’আ আল্লাহর সমীপে গৃহীত হল এবং এভাবে তা প্রমাণিত হয়ে গেল।
কিছু সংখ্যক কুরাইশ লোকজনের সঙ্গে একদফা উতায়বা বিদেশ গেল। যখন তারা শাম রাজ্যের জারকা নামক স্থানে শিবিরস্থাপন করল তখন রাতের বেলায় একটি বাঘ এসে তাদের চারপাশে ঘোরাফিরা করতে থাকল। ওকে দেখেই ওতায়বা ভীতি বিহ্বল কণ্ঠে বলে উঠল, ‘হায়! হায়!, আমার ধ্বংস। আল্লাহর শপথ, সে আমাকে খেয়ে ফেলবে। এ মর্মেই মুহাম্মাদ (সাঃ) আমার ধ্বংসের জন্য আল্লাহর নিকট দু’আ করেছিলেন। দেখ আমি শাম রাজ্যে অবস্থান করছি অথচ তিনি মক্কা থেকেই আমাকে হত্যা করছেন’।
উতায়বার এ কথা শ্রবণের পর তার সঙ্গী সাখীরা সাবধানতা অবলম্বনের জন্য তাকে তাদের মধ্যস্থানে শুইয়ে দিল যাতে বাঘ এসে সহজে তার নাগাল না পায়। কিন্তু গভীর রাতে সেখানে বাঘ এসে সকলকে পাশ কাটিয়ে সোজা উতয়বার নিকটে যায় এবং তার মাথাটি শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে যায়।[1]
এক দফা উক্ববা বিন আবী মু’আইত্ব রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন সিজদারত ছিলেন তখন তার ঘাড় এত জোরে পদতলে পিষ্ঠ করল যে মনে হল তার অক্ষিগোলক দুটো তখনই অক্ষিপট থেকে বেরিয়ে আসবে।[2]
ইবনে ইসহাক্বের এক দীর্ঘ বর্ণনায় চরমপন্থী কুরাইশগণের এরূপ দুরভিসন্ধির আভাষ পাওয়া যায় যে, তারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে হত্যা করে দুনিয়া থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল।
অন্যান্য কুরাইশ দুর্বৃত্তদের সম্পর্কেও সত্যিকারভাবে বলা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে হত্যার মাধ্যমে ধরাপৃষ্ঠ থেকে ইসলামের নাম নিশানা মুছে ফেলার এক গভীর চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র তাদের অন্তরে ক্রমেই দানা বেঁধে উঠতে থাকে। যেমনটি আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর বিন ‘আস হতে ইবনে ইসহাক্ব তাঁর বর্ণনা উদ্ধৃত করে বলেছেন যে, এক দফা কুরাইশ মুশরিকগণ কাবাহ’র হাতীমে সম্মিলিতভাবে অবস্থান করছিল। সেখানে আমিও উপস্থিত ছিলাম। মুশরিকগণ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সম্পর্কে নানা প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ আলোচনা করছিল। আলোচনার এক পর্যায়ে তারা বলল, এ ব্যক্তির ব্যাপারে আমরা যে ধৈর্য ধারণ করেছি তার কোন তুলনা নাই। প্রকৃতই এর ব্যাপারে আমরা বড়ই ধৈর্য ধারণ করেছি।
এ ধারায় যখন তাদের কথোপকথন চলছিল তখন কিছুটা যেন অপ্রত্যাশিতভাবেই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলেন। সেখানে আগমনের পর সর্ব প্রথম তিনি হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করলেন এবং কা’বাহ ঘর প্রদক্ষিণ করলেন। এ সব করতে গিয়ে তাকে মুশরিকগণের নিকট দিয়ে যাতায়াত করতে হল। এ অবস্থায় কিছু বিদ্রুপাত্মক কথাবার্তা বলে তারা তার প্রতি কটাক্ষ করায় নাবী (সাঃ)-এর মনে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হল তার বহিঃপ্রকাশ তার চেহারা মুবারকে আমি সুস্পষ্টভাবে লক্ষ্য করলাম। এর পর দ্বিতীয় দফায় তিনি যখন সেখানে গেলেন তখনো মুশরিকগণ অনুরূপভাবে তাকে বিদ্রপাত্মক কথাবার্তা বলে ভর্ৎসনা করল। আমি এবারও তার মুখমণ্ডলে এর প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলাম। তারপর তৃতীয় দফায় তিনি সেখানে গেলে এবারও তারা পূর্বের মতো বিদ্রুপাত্মক কথাবার্তা বলল। এবার নাবী কারীম (সাঃ) সেখানে থেমে গেলেন এবং বললেন,
أتسمعون يا معشر قريش اما والذى نفس محمد بيده لقد جئتكم بالذبح
‘হে কুরাইশগণ! শুনছ? সেই সত্ত্বার শপথ যার হাতে আমার জীবন, আমি তোমাদের নিকট কুরবাণীর পশু নিয়ে এসেছি।’
তাদের প্রতি নাবী (সাঃ)-এর এ সম্বোধন এবং কথাবার্তা তাদেরকে এতই প্রভাবিত করে ফেলল (তাদের উপর মূৰ্ছা পাওয়ার মতো অবস্থা এসে পড়ল) এবং এমন এক অনুভূতির সৃষ্টি হয়ে গেল যে তাদের মনে হতে লাগল যেন প্রত্যেকের মাথার উপর চড়ুই বসে রয়েছে। এমনকি ঐ দলের মধ্যে যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপর সব চেয়ে প্রতিহিংসাপরায়ণ ছিল সেও যেন খুব ভাল হয়ে গেল এবং পঞ্চমুখে তাঁর প্রশংসা শুরু করল। অত্যন্ত বিনীতভাবে সে বলতে থাকল, ‘আবূল কাশেম! প্রত্যাবর্তন করুন। আল্লাহর কসম! আপনি কখনই জ্ঞানহীন ছিলেন না।’
দ্বিতীয় দিনেও তারা সেখানে একত্রিত হয়ে তার সম্পর্কে আলাপ আলোচনায় রত ছিল এমন সময় তিনি সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তাঁকে এভাবে দেখে তারা সকলে সম্মিলিতভাবে তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার উদ্দেশ্যে তাকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ধরল। আমি লক্ষ্য করলাম তাদের মধ্য থেকে একজন তার গলার চাদর ধরে নিল এবং বল প্রয়োগ শুরু করে দিল। আবূ বকর (রা.) তাকে বাচানোর জন্য চেষ্টা করতে লাগলেন। তিনি
ক্ৰন্দনরত অবস্থায় বলছিলেন, اتقتلون رجلا ان يقول ربي الله
অর্থ : ‘তোমরা লোকটিকে কি এ জন্য হত্যা করছে যে, তিনি বলেছেন যে, আল্লাহ আমার প্রভু?’
এর পর তারা নাবী (সাঃ)-কে ছেড়ে দিয়ে স্বস্থানে প্রত্যাবর্তন করল। আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস বলেছেন যে, এটাই ছিল সব চেয়ে কঠিন অত্যাচার ও উৎপীড়ন যা আমি কুরাইশগণকে করতে দেখেছি।[3] (সার সংক্ষেপ শেষ হল)।
সহীহুল বুখারীতে উরওয়া বিন জুবাইর (রা.) হতে বর্ণিত এক বিবরণ থেকে জানা যায়, তিনি বলেছেন যে, আমি আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর বিন আসকে মুশরিকগণ নাবী (সাঃ)-এর উপর সব চেয়ে কঠিন যে নিপীড়ন চালিয়েছিল, তা আমার সামনে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করার জন্য প্রশ্ন করলাম। তিনি বললেন যে, একদা নাবী (সাঃ) কাবাহ গৃহের হাতীমে সালাত পড়ছিলেন এমন সময় উক্ববা বিন আবী মু’আইত্ব সেখানে আগমন করলেন। তিনি সেখানে উপস্থিত হয়েই নিজ কাপড় দ্বারা তাঁর গ্রীবা ধারণ করে অত্যন্ত জোরে চপেটাঘাত করলেন এবং গলা টিপে ধরলেন। এমন সময় আবূ বকর সেখানে উপস্থিত হলেন এবং উক্ববার দু’কাঁধ ধরে জোরে ধাক্কা দিয়ে তাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বললেন, اتقتلون رجلا ان يقول ربي الله
অর্থ : তোমরা লোকটিকে এ জন্যই হত্যা করছ যে, তিনি বলেছেন যে, আমার প্রভু আল্লাহ।[4] আসমার বর্ণনায় অধিক বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, আবূ বকরের নিকট যখন এ আওয়াজ পৌছল যে, ‘আপন বন্ধুকে বাঁচাও’ তিনি তখন অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে আমাদের মধ্য থেকে বের হলেন। তার মাথার উপর চারটি ঝুঁটি ছিল। যাবার সময় আবূ বকর বলতে বলতে গেলেন, اتقتلون رجلا ان يقول ربي الله
অর্থ : তোমরা লোকটিকে শুধু এ কারণে হত্যা করছ যে, তিনি বলেন যে, আমার প্রভু আল্লাহ।
এরপর মুশরিকগণ নাবী কারীম (সাঃ)-কে ছেড়ে দিয়ে আবূ বকরের উপর ঝাপিয়ে পড়েন। তিনি যখন ফেরৎ আসলেন তখন তার অবস্থা ছিল এরূপ যে, আমরা তাঁর চুলের মধ্য থেকে যে ঝুঁটিটাই ধরছিলাম সেটাই আমাদের টানের সঙ্গে সঙ্গে উঠে আসছিল।[5]
ফুটনোটঃ[1] শায়খ আবদুল্লাহ, মুখতাসারুস সীরাহ পৃঃ ১৩৫, ইস্তিয়ার, এসবাহ, দালায়েন নবুয়্যত, রওযুল আনাফ।
[2] প্রাগুক্ত/মুখতাসারুস সীরাহ ১১৩ পৃঃ।
[3] ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ২৮৯-২৯০ পৃঃ।
[4] সহীহুল বুখারী মক্কার মুশরিকগণের নবী (সা.)-এর প্রতি উৎপীড়ন অধ্যায় ১ম খণ্ড পৃঃ ৫৪৪।
[5] শাইখ আবদুল্লাহ মোখতাসারুস সীরাহ পৃঃ ১১৩।
বড় বড় সাহাবাদের ইসলাম গ্রহণ
হামযাহ (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণ (إِسْلَامُ حَمْزَةَ رَضِيْ اللهُ عَنْهُ):
মক্কার বিস্তৃত অঞ্চল অন্যায় ও অত্যাচারের ঘনকৃষ্ণ মেঘমালা দ্বারা আচ্ছাদিত ছিল। সেই মেঘ মালার মধ্য থেকে হঠাৎ এক ঝলক বিদ্যুত চমকিত হওয়ায় মজলুমদের পথ আলোকিত হল, হামযাহ মুসলিম হয়ে গেলেন। তাঁর ইসলাম গ্রহণের ঘটনা সংঘটিত হয় নবুওয়ত প্রাপ্তি ৬ষ্ঠ বর্ষের শেষভাগ। সম্ভবতঃ তিনি যুল হিজ্জাহ মাসে মুসলিম হয়েছিলেন।
আল্লাহ তা‘আলা যাঁর উপর রহম করেন তাঁর পক্ষেই ইসলামের অমিয় ধারা থেকে এক অাঁজলা পান করা সম্ভব হয়। যদিও হামযাহর ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারটিও আল্লাহর তা‘আলার খাস রহমতেরই ফলশ্রুতি তবুও তাঁর ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে একটি বিশেষ ঘটনার কথা উল্লেখ না করে পারা যায় না। ঘটনাটি হচ্ছে এরূপ, এক দিবসে আবূ জাহল সাফা পর্বতের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। নাবী কারীম (সাঃ) সেখানে উপস্থিত ছিলেন। নাবী (সাঃ)-কে দেখে অনেক কটু কাটব্য করল এবং অপমানসূচক কথাবার্তা বললে নাবী কারীম (সাঃ) তার কথাবার্তার কোন উত্তর দিলেন না। আবূ জাহল একটি পাথর তুলে নিয়ে নাবীজী (সাঃ)-এর মাথায় আঘাত করল। এর ফলে আঘাতপ্রাপ্ত স্থান হতে রক্তধারা প্রবাহিত হতে থাকল। তারপর সে ক্বাবা’হ গৃহের নিকটে কুরাইশগণের বৈঠকে গিয়ে যোগদান করল।
আব্দুল্লাহ বিন জুদয়ানের এক দাসী নিজগৃহ থেকে সাফা পর্বতের উপর সংঘটিত ঘটনাটি আদ্যোপান্ত প্রত্যক্ষ করছিল। হামযাহ (রাঃ) মৃগয়া থেকে প্রত্যাবর্তন করা মাত্রই (তখনো তাঁর হাতে তীর ধনুক ছিল এমতাবস্থায়ঃ) সে তাঁকে আবূ জাহলের অন্যায় অত্যাচার এবং নাবী (সাঃ)-এর ধৈর্য ধারণের ব্যাপারটি বর্ণনা করে শোনাল। ঘটনা শ্রবণ করা মাত্র তিনি ক্রোধে ফেটে পড়লেন। কুরাইশগণের মধ্যে তিনি ছিলেন মহাবীর এবং মহাবলশালী এক যুবক। এ মুহূর্তে বিলম্ব না করে তিনি এ সংকল্পবদ্ধ হয়ে ছুটে চললেন যে, যেখানেই আবূ জাহলের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ লাভ হবে সেখানেই তিনি তার ভূত ছাড়াবেন। তিনি তার খোঁজ করতে করতে গিয়ে তাকে পেলেন মসজিদুল হারামে। সেখানে তিনি তার মুখোমুখী দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললেন, ‘ও হে গুহ্যদ্বার দিয়ে বায়ূ নিঃসরণকারী! আমার ভ্রাতুষ্পুত্র মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে তুমি গালি দিয়েছ এবং পাথর দিয়ে আঘাত করেছ। অথচ আমি তার দ্বীনেই আছি।
এরপর তিনি কামানের দ্বারা তার মাথার উপর এমনভাবে আঘাত করলেন যাতে সে আহত হয়ে গেল। এর ফলে আবূ জাহলের বনু মখযুম ও হামযাহ (রাঃ)-এর বনু হাশিম গোত্রদ্বয় একে অপরের প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। কিন্তু আবূ জাহল এভাবে সকলকে নিরস্ত করল যে, আবূ উমারাকে যেতে দাও। আমি প্রকৃতই তার ভ্রাতুষ্পুত্রকে গালমন্দ এবং আঘাত দিয়েছি।[1]
প্রাথমিক পর্যায়ে হামযাহর ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারটি ছিল কিছুটা যেন ভ্রাতুষ্পুত্রের প্রতি আবেগের উৎস থেকে উৎসারিত। মুশরিকগণ ভ্রাতুষ্পুত্রকে কষ্ট দিত। এটা বরদাস্ত করা তাঁর পক্ষে খুবই কঠিন ছিল। কাজেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করলে হয়তো তার দুঃখ কষ্টের কিছু লাঘব হতে পারে এ ধারণার বশবর্তী হয়েই তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন।[2] পরে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর অন্তরে ইসলাম প্রীতি জোরদার করে দেয়ায় তিনি দ্বীনের রশি মজবুত করে ধরলেন। তাঁর ইসলাম গ্রহণের ফলে মুসলামানদের শক্তি এবং সম্মান দুই-ই বৃদ্ধি পেল।
ফুটনোটঃ[1] শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাবঃ মোখতারুস সীরাহ পৃঃ ৬৬, আল্লামা মানসুরপুরীঃ রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ৬৮ পৃঃ। ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ২৯১-২৯২ পৃঃ।
[2] শাইখ আবদুল্লাহ মুখতাসারুস সীরাহ পৃঃ ১০১।
উমার (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণ (إِسْلاَمُ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ):
অন্যায় অত্যাচারের বিস্তৃতি পরিমন্ডলে ঘনকৃষ্ণ মেঘমালার বুক চিরে আরও একটি জ্যোতিষ্মান বিদ্যুতের চমকে আরব গগণ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। আরব জাহানের অন্যতম তেজস্বী পুরুষ উমার বিন খাত্তাব ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন। তাঁর ইসলাম গ্রহণের ঘটনা সংঘটিত হয় নবুওয়ত ৬ষ্ঠ বর্ষে[1] হামযাহ (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণের মাত্র ৩ দিন পর। নাবী কারীম (সাঃ) উমার (সাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণের জন্য আল্লাহর সমীপে প্রার্থনা করেছিলেন।
ইমাম তিরমিযী আব্দুল্লাহ বিন উমার হতে এ বিষয়টি বর্ণনা করেছেন এবং একে বিশুদ্ধ হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। অনুরূপভাবে তাবারাণী ইবনে মাসউদ (রাঃ) এবং আনাসের মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন যে, নাবী (সাঃ) বলতেন :
اللَّهُمَّ أَعِزَّ الْإِسْلَامَ بِأَحَبِّ هَذَيْنِ الرَّجُلَيْنِ إِلَيْكَ بِعُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ أَوْ بِأَبِيْ جَهْلٍ بن هشام
‘হে আল্লাহ! উমার বিন খাত্তাব অথবা আবূ জাহল বিন হিশাম এর মধ্য হতে যে তোমার নিকট অধিক প্রিয় তার দ্বারা ইসলামকে শক্তিশালী করে দাও।’
(আল্লাহ এ প্রার্থনা গ্রহণ করলেন এবং উমার মুসলিম হয়ে গেলেন)। এ দু’জনের মধ্যে আল্লাহর নিকট উমার (রাঃ) অধিক প্রিয় ছিলেন।[2]
উমার (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কিত সমস্ত বর্ণনা একত্রিত করে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তাঁর অন্তরে ইসলাম ধীরে ধীরে স্থান লাভ করতে থাকে। ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কিত বিষয়াদির সার সংক্ষেপ তুলে ধরার পূর্বে তাঁর মেজাজ এবং আবেগ ও অনুভূতি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করা সঙ্গত বলে মনে করি।
উমার (রাঃ) তাঁর উগ্র মেজায, রূঢ় প্রকৃতি এবং বীরত্বের জন্য আরব সমাজে বিশেষভাবে বিখ্যাত ছিলেন। মুসলিমগণকে বেশ কিছুকাল যাবৎ তাঁর হাতে উৎপীড়িত ও নিগৃহীত হতে হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও একটি লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্যের আভাষ যেন প্রথম থেকেই তাঁর মধ্যে পরিলক্ষিত হতো। তাঁর হাবভাব দেখে মনে হতো যে, ভাবাবেগের দু’বিপরীতমুখী শক্তি যেন তাঁর অন্তর রাজ্যে পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত রয়েছে। একদিকে তিনি তাঁর পূর্ব পুরুষগণের অনুসৃত রীতিনীতি ও আচার অনুষ্ঠানের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং মদ্যপান ও আমোদ প্রমোদের প্রতি তাঁর যথেষ্ট আসক্তি ছিল। অন্যদিকে মুসলিমদের ঈমান ও আকীদা এবং বিপদ আপদে তাঁদের ধৈর্য ধারণের অসাধারণ ক্ষমতা দেখে তিনি হতবাক হয়ে যেতেন এবং সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাঁদের দিকে চেয়ে থাকতেন। অধিকন্তু কোন কোন সময় জ্ঞানী ব্যক্তিগণের মতো তাঁর মনে তত্ত্ব-চিন্তার উদ্রেকও হতো। তিনি আপন খেয়ালে চিন্তা করতে থাকতেন নানা বিষয়, নানা কথা। কোন কোন সময় এটাও তাঁর মনে হতো যে, ইসলাম যে পথের সন্ধান দিচ্ছে, যে পথের চলার জন্য উদাত্ত আহবান জানাচ্ছে সম্ভবতঃ সেটাই উত্তম ও পবিত্রতম পথ। এ জন্য প্রায়শঃই তিনি দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগতেন, কোন কোন সময় বিচলিত বোধ করতেন, কখনো বা নিরুৎসাহিত বোধ করতেন।[3]
উমার (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কিত বিবরণাদির সমন্বিত সার সংক্ষেপ হচ্ছে এক রাত্রি তাঁকে বাড়ির বাইরে অবস্থানের মধ্য দিয়ে রাত্রি যাপন করতে হয়। তিনি হারামে আগমন করেন এবং ক্বাবা’হ গৃহেরপর্দার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। নাবী কারীম (সাঃ) সেই সময় নামাযে লিপ্ত ছিলেন। নামাযে তিনি সূরাহ ‘আলহাক্কা’’ তিলাওয়াত করছিলেন। উমার (রাঃ) নীরবে গভীর মনোযোগের সঙ্গে তিলাওয়াত শ্রবণ করলেন এবং এর ঝংকার, বাক্য বিন্যাস ও সুর-মাধূর্যে মুগ্ধ, চমৎকৃত ও হতবাক হয়ে গেলেন।
উমারের বর্ণনা সূত্রে এটা বলা হয়েছে যে, তিনি বলেছেনঃ আমি মনে মনে করলাম, আল্লাহর কসম, কুরাইশরা যেমনটি বলে থাকেন তিনি হচ্ছেন একজন কবি। কিন্তু এ সময় নাবী (সাঃ) এ আয়াত পাঠ করেনঃ
{إِنَّهُ لَقَوْلُ رَسُوْلٍ كَرِيْمٍ وَمَا هُوَ بِقَوْلِ شَاعِرٍ قَلِيْلاً مَا تُؤْمِنُوْنَ} [الحاقة:40، 41]
‘‘যে, অবশ্যই এ কুরআন এক মহা সম্মানিত রসূল [জিবরীল (‘আ.)]-এর (বহন করে আনা) বাণী। ৪১. তা কোন কবির কথা নয়, (কবির কথা তো) তোমরা বিশ্বাস করো না।’ (আল-হাক্কাহ ৬৯ : ৪০-৪১)
উমার (রাঃ) বললেন, ‘আমি মনে মনে বললাম, আর এ তো হচ্ছে আমারই মনের কথা, সে কী করে তা জানল। নিশ্চয়ই মুহাম্মাদ (সাঃ) হচ্ছেন একজন মন্ত্রতন্ত্রধারী গনৎকার। আমার মনে এ ভাবের উদয় হওয়ার পর-পরই মুহাম্মাদ (সাঃ) তিলাওয়াত করলেনঃ
{وَلَا بِقَوْلِ كَاهِنٍ قَلِيْلًا مَا تَذَكَّرُوْنَ تَنزِيْلٌ مِّن رَّبِّ الْعَالَمِيْنَ} إلى آخر السورة [الحاقة:42، 43]
‘‘ এটা কোন গণকের কথাও নয়, (গণকের কথায় তো) তোমরা নাসীহাত লাভ করো না। ৪৩. এটা বিশ্ব জগতের প্রতিপালকের নিকট থেকে অবতীর্ণ।’ (আল-হাক্কাহ ৬৯ : ৪২-৪৩)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সালাতে সূরাহর শেষ পর্যন্ত তিলাওয়াত করলেন এবং উমার (রাঃ) তা শ্রবণ করলেন। এ প্রসঙ্গে উমার (রাঃ) বলেছেন যে, ‘সেই সময় ইসলাম আমার অন্তর রাজ্যে স্থান অধিকার করে বসল।[4]
প্রকৃতপক্ষে, উমার (রাঃ)-এর অন্তর রাজ্যে এটাই ছিল ইসলামের বীজ বপনের প্রথম সময়। কিন্তু তখনো তাঁর চেতানায় অজ্ঞতাপ্রসূত আবেগ, আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রতি প্রবল আকর্ষণ এবং পূর্ব-পুরুষগণের ধর্মীয় অনুভূতি ও বিশ্বাসের ঐতিহ্যগত প্রভাব জগদ্দল প্রস্তরের মতো তাঁর মন-মস্তিষ্ককে এতই প্রভাবিত করে রেখেছিল যে ইসলামের প্রাথমিক অনুভূতির কার্যকারিতা তেমন একটা ছিল না বললেই চলে। কাজেই, বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা সংস্কারকে জিইয়ে রাখার ব্যাপারেই তাঁর আগ্রহ ছিল ঐকান্তিক।
তিনি ছিলেন অত্যন্ত কঠোর প্রকৃতির লোক। তাঁর স্বভাবগত কঠোরতার কারণেই তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এবং মুসলিমদের অন্যতম বিপজ্জনক শত্রু। তিনি এতই বিপজ্জনক ছিলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে হত্যা করার উদ্দেশ্যে এক দিবসে তিনি উলঙ্গ তরবারি হাতে বহির্গত হন। রুদ্র মেজাজে তাঁর পথচলার এক পর্যায়ে আকস্মিকভাবে নঈম বিন আব্দুল্লাহ নাহহাম আদভী[5] কিংবা বনু যুহরা[6] কিংবা বনু মাখযুমের[7] কোন এক ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। তাঁর ভ্রূ-যুগল কুঞ্চিত অবস্থায় দেখে সেই ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, ‘হে উমার! কী উদ্দেশ্যে কোথায় চলেছ? তিনি বললেন, ‘মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে হত্যা করার উদ্দেশ্যে চলেছি।’
লোকটি বলল, ‘মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে হত্যা করে বনু হাশিম ও বনু যুহরা থেকে কিভাবে রক্ষা পাবে? উমার বলেলেন, ‘মনে হচ্ছে তোমরাও পূর্ব পুরুষগণের ধর্ম পরিত্যাগ করে বেদ্বীন হয়ে গিয়েছ।
লোকটি বলল, ‘উমার! একটি আজব কথা তোমাকে শোনাব না কি? তোমার বোন ও ভগ্নিপতিও তোমাদের ধর্ম পরিত্যাগ করে বেদ্বীন হয়ে গিয়েছে।’
এ কথা শুনে উমার প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুন্ডে ঘৃতাহুতি দেয়ার মতো ক্রোধাগ্নিতে দপ করে জ্বলে উঠলেন এবং সোজা ভগ্নীপতির গৃহাভিমুখে যাত্রা করলেন। সেখানে খাব্বাব বিন আরাত্ত একটি সহীফার সাহায্যে সূরাহ ত্ব-হা’র অংশ বিশেষ স্বামী-স্ত্রীকে তালীম দিচ্ছিলেন। খাব্বাব তাঁদের তালীম দেয়ার জন্য নিয়মিত সেখানে যাতায়াত করতেন। খাব্বাব (রাঃ) যখন উমার (রাঃ)-এর সেখানে গমনের শব্দ শ্রবণ করলেন তখন তিনি ঘরের মধ্যে গিয়ে আত্মগোপন করলেন এবং উমারের বোন ফাত্বিমাহ সহীফা খানা লুকিয়ে রাখলেন। কিন্তু উমার বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে খাববাবের কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিলেন। তাই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কার কণ্ঠে মৃদু মৃদু আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম যেন।’
তাঁর বোন উত্তর করলেন, ‘না তেমন কিছুই না। আমরাই পরস্পর কথাবার্তা বলছিলাম।
উমার (রাঃ) বললেন, ‘সম্ভবতঃ তোমরা উভয়েই বেদ্বীন হয়ে গিয়েছ?
ভগ্নিপতি সাঈদ বললেন, আচ্ছা উমার! বলত, তোমাদের ধর্ম ছাড়া অন্য কোন ধর্মে যদি সত্য থাকে তবে করণীয় কী হবে?
এ কথা শোনা মাত্র উমার তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে ভগ্নীপতিকে নির্মমভাবে প্রহার করতে শুরু করলেন। নিরুপায় ভগ্নী জোর করে ভ্রাতাকে স্বামী থেকে পৃথক করে দিলেন। এতে আরও ক্রুব্ধ হয়ে উমার (রাঃ) তাঁর বোনের গন্ডদেশে এমন এক চপেটাঘাত করলেন যে, সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মুখমন্ডল রক্তাক্ত হয়ে গেল। ইবনে ইসহাক্বের বর্ণনায় আছে যে, তিনি মাথায় আঘাত প্রাপ্ত হয়েছিলেন। ভগ্নী ক্রোধ ও আবেগ জড়িত কণ্ঠে বললেন,
يَا عُمَرُ، إِنْ كَانَ الْحَقُّ فِيْ غَيْرِ دِيْنِكَ، أَشْهَدُ أَنْ لاَّ إِلٰهَ إِلاَّ اللهُ ، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا رَّسُوْلُ اللهِ
‘‘উমার! তোমার ধর্ম ছাড়া অন্য ধর্ম যদি সত্য হয়, এ কথা বলে তিনি কালেমা শাহাদত পাঠ করলেন, ‘আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্যিকারের কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁর বান্দা ও রাসূল।’
শাহাদতের এ বাণী শ্রবণ করা মাত্র উমার (রাঃ)-এর ভাবান্তর শুরু হয়ে গেল। তিনি তাঁর বোনের রক্তাক্ত মুখমন্ডল দেখে লজ্জিত হলেন। তারপর তিনি বোনকে সম্বোধন করে দয়ার্দ্র কণ্ঠে বললেন, ‘তোমাদের নিকট যে বইখানা আছে তা আমাকে একবার পড়তে দাওনা দেখি।
বোন বললেন, ‘তুমি অপবিত্র রয়েছ। অপবিত্র লোকের এটা স্পর্শ করা চলে না। শুধু মাত্র পবিত্র লোকেরাই এ বই স্পর্শ করতে পারবে। তুমি গোসল করে এসো তবেই বই স্পর্শ করতে পারবে। উমার গোসল করে পাক-সাফ হলেন তার পর সহীফা খানা হাতে নিলেন এবং বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম পড়লেন। বলতে লাগলেন এ তো বড়ই পবিত্র নাম! তারপর সূরাহ ত্ব-হা হতে পাঠ করলেন :
طه (1) مَا أَنْزَلْنَا عَلَيْكَ الْقُرْآنَ لِتَشْقٰى (2) إِلاَّ تَذْكِرَةً لِمَنْ يَخْشٰى (3) تَنْزِيْلاً مِمَّنْ خَلَقَ الْأَرْضَ وَالسَّمَاوَاتِ الْعُلٰى (4) الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوٰى (5) لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا وَمَا تَحْتَ الثَّرٰى (6) وَإِنْ تَجْهَرْ بِالْقَوْلِ فَإِنَّهُ يَعْلَمُ السِّرَّ وَأَخْفٰى (7) اللَّهُ لا إِلَهَ إِلَّا هُوَ لَهُ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنٰى (8) وَهَلْ أَتَاكَ حَدِيْثُ مُوْسٰى (9) إِذْ رَأى نَاراً فَقَالَ لِأَهْلِهِ امْكُثُوْا إِنِّي آنَسْتُ نَاراً لَعَلِّي آتِيْكُمْ مِنْهَا بِقَبَسٍ أَوْ أَجِدُ عَلَى النَّارِ هُدىً (10) فَلَمَّا أَتَاهَا نُوْدِيَ يَا مُوْسٰى (11) إِنِّي أَنَا رَبُّكَ فَاخْلَعْ نَعْلَيْكَ إِنَّكَ بِالْوَادِ الْمُقَدَّسِ طُوىً (12) وَأَنَا اخْتَرْتُكَ فَاسْتَمِعْ لِمَا يُوْحٰى(13) إِنَّنِيْ أَنَا اللهُ لا إِلٰهَ إِلاَّ أَنَا فَاعْبُدْنِيْ وَأَقِمِ الصَّلاةَ لِذِكْرِيْ (14) (سورة طه 1-144)
‘‘১. ত্ব-হা-। ২. তোমাকে ক্লেশ দেয়ার জন্য আমি তোমার প্রতি কুরআন নাযিল করিনি। ৩. বরং তা (নাযিল করেছি) কেবল সতর্কবাণী হিসেবে যে ভয় করে (আল্লাহকে)। ৪. যিনি পৃথিবী ও সুউচ্চ আকাশ সৃষ্টি করেছেন তাঁর নিকট হতে তা নাযিল হয়েছে। ৫. ‘আরশে দয়াময় সুপ্রতিষ্ঠিত আছেন। ৬. যা আকাশে আছে, যা যমীনে আছে, যা এ দু’য়ের মাঝে আছে আর যা ভূগর্ভে আছে সব তাঁরই। ৭. যদি তুমি উচ্চকণ্ঠে কথা বল (তাহলে জেনে রেখ) তিনি গুপ্ত ও তদপেক্ষাও গুপ্ত বিষয় জানেন। ৮. আল্লাহ, তিনি ব্যতীত সত্যিকারের কোন ইলাহ নেই, সুন্দর নামসমূহ তাঁরই। ৯. মূসার কাহিনী তোমার কাছে পৌঁছেছে কি? ১০. যখন সে আগুন দেখল (মাদ্ইয়ান থেকে মিসর যাওয়ার পথে), তখন সে তার পরিবারবর্গকে বলল, ‘তোমরা এখানে অবস্থান কর, আমি আগুন দেখেছি, সম্ভবতঃ আমি তাত্থেকে তোমাদের জন্য কিছু জ্বলন্ত আগুন আনতে পারব কিংবা আগুনের নিকট পথের সন্ধান পাব। ১১. তারপর যখন যে আগুনের কাছে আসল, তাকে ডাক দেয়া হল, ‘হে মূসা! ১২. বাস্তবিকই আমি তোমার প্রতিপালক, কাজেই তোমার জুতা খুলে ফেল, তুমি পবিত্র তুওয়া উপত্যকায় আছ। ১৩. আমি তোমাকে বেছে নিয়েছি, কাজেই তুমি মনোযোগ দিয়ে শুন যা তোমার প্রতি ওয়াহী করা হচ্ছে। ১৪. প্রকৃতই আমি আল্লাহ, আমি ছাড়া সত্যিকারের কোন ইলাহ নেই, কাজেই আমার ‘ইবাদাত কর, আর আমাকে স্মরণ করার উদ্দেশে সলাত কায়িম কর’।’ (ত্ব-হা ২০ : ১-১৪)
বললেন, ‘এটা তো বড়ই উত্তম এবং বড়ই সম্মানিত কথা। আমাকে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর সন্ধান বল।’
উমারের এ কথা শুনে খাব্বাব (রাঃ) তাঁর গোপনীয় অবস্থান থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, ‘উমার! সন্তুষ্ট হয়ে যাও। আমার আশা যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বিগত বৃহস্পতিবার রাত্রে তোমার সম্পর্কে যে প্রার্থনা করেছিলেন (হে আল্লাহ! উমার বিন খাত্তাব অথবা আবূ জাহল বিন হিশাম এর দ্বারা ইসলামকে শক্তিশালী করে দিন) তা কবুল হয়েছে। এ সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সাফা পর্বতের নিকটস্থ গৃহে অবস্থান করছিলেন।’
খাব্বাব (রাঃ)-এর মুখ থেকে এ কথা শ্রবণের পর উমার (রাঃ) তাঁর তরবারিখানা কোষে প্রবেশ করিয়ে নিয়ে সেই বাড়ির বহিরাঙ্গনে উপস্থিত হয়ে দরজায় করাঘাত করলেন। দরজার ফাঁক দিয়ে এক ব্যক্তি উঁকি দিয়ে দেখতে পেলেন যে, কোষবদ্ধ তলোয়ারসহ উমার দন্ডায়মান রয়েছেন। ঝটপট রাসূলুল্লাহ (রাঃ)-কে তা অবগত করানো হল। উপস্থিত লোকজন যাঁরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন সকলেই সঙ্গে সঙ্গে কাছাকাছি অবস্থায় সংঘবদ্ধ হয়ে গেলেন। সকলের মধ্যে এ সন্ত্রস্ত ভাব লক্ষ করে হামযাহ (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ব্যাপার, কী এমন হয়েছে?’
লোকজনেরা উত্তর দিলেন, ‘উমার বহিরাঙ্গনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।’
হামযাহ বললেন, ‘ঠিক আছে। উমার এসেছে, দরজা খুলে দাও। যদি সে সদিচ্ছা নিয়ে আগমন করে থাকে তাহলে আমাদের তরফ থেকেও ইন-শা-আল্লাহ সদিচ্ছার কোনই অভাব হবে না। আর যদি সে কোন খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে আগমন করে থাকে তাহলে আমরা তাকে তার তলোয়ার দ্বারাই খতম করব। এ দিকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করছিলেন এবং তাঁর উপর ওহী নাযিল হচ্ছিল। ওহী নাযিল সমাপ্ত হলে তিনি উমারের নিকট আগমন করলেন বৈঠক ঘরে। তিনি তাঁর কাপড় এবং তরবারির কোষ ধরে শক্তভাবে টান দিয়ে বললেন,
(أَمَا أَنْتَ مُنْتَهِيًا يَا عُمَرُ حَتّٰى يَنْزِلَ اللهُ بِكَ مِنْ الْخَزِى وَالنِّكَالِ مَا نَزَلَ بِالْوَلِيْدِ بْنِ الْمُغِيْرَةِ؟)
‘‘উমার! যেমনটি ওয়ালীদ বিন মুগীরার উপর অবতীর্ণ হয়েছিল সেইরূপ আল্লাহর তরফ থেকে যতক্ষণ না তোমার উপর লাঞ্ছনা, অবমাননা এবং শিক্ষামূলক শাস্তি অবতীর্ণ না হচ্ছে ততক্ষণ কি তুমি পাপাচার থেকে বিরত হবে না?’
তারপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আল্লাহর সমীপে দু‘আ করলেন,
اللهم هٰذَا عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ، اللهم أَعِزِّ الْإِسْلاَمَ بِعُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ
‘‘হে সর্বশক্তিমান প্রভূ! তোমার ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছাই হচ্ছে চূড়ান্ত। এ উমার বিন খাত্তাবের দ্বারা ইসলামের শক্তি এবং সম্মান বৃদ্ধি করুন।’ নাবী (সাঃ)-এর প্রার্থনা শ্রবণের পর উমার (রাঃ)-এর অন্তরে এমন এক স্পন্দনের সৃষ্টি হতে থাকল যে, তিনি অস্থির হয়ে পড়লেন এবং পাঠ করলেন,
أَشْهَدُ أَن لاَّ إِلٰهَ إِلاَّ اللهُ ، وَأَنَّكَ رَسُوْلُ اللهِ
অর্থঃ ‘আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই এবং সত্যই আপনি আল্লাহর রাসূল।’
উমার (রাঃ)-এর মুখ থেকে তাওহীদের এ বাণী শ্রবণ মাত্র গৃহাভ্যন্তরস্থিত লোকজনেরা এত জোরে ‘আল্লাহ আকবর’ ধ্বনি উচ্চারণ করলেন যে, মসজিদুলু হারামে অবস্থানকারী লোকেরাও তা স্পষ্টভাবে শুনতে পেলেন।[8] আরব মুলুকে এটা সর্বজন বিদিত বিষয় ছিল যে, উমার বিন খাত্তাব ছিলেন অত্যন্ত প্রতাপশালী এবং প্রভাবশালী। তিনি এতই প্রতাপশালী ছিলেন যে, তাঁর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো সাহস সেই সমাজে কারোই ছিল না। এ কারণে তাঁর মুসলিম হয়ে যাওয়ার কথা প্রচার হওয়া মাত্র মুশরিক মহলে ক্রন্দন এবং বিলাপ সৃষ্টি হয়ে গেল এবং তারা বড়ই লাঞ্ছিত ও অপমানিত বোধ করতে থাকল। পক্ষান্তরে তাঁর ইসলাম গ্রহণ করার ফলে মুসলিমদের শক্তি সাহস ও মান মর্যাদা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়ে গেল এবং তাঁদের মধ্যে আনন্দের জোয়ার প্রবাহিত হতে থাকল। ইবনে ইসহাক্ব নিজ সূত্রের বরাতে উমারের বর্ণনায় উদ্ধৃত করেছেন যে, ‘যখন আমি মুসলিম হয়ে গেলাম তখন চিন্তা-ভাবনা করতে থাকলাম যে, মক্কায়, কোন কোন ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সব চাইতে প্রভাবশালী শত্রু হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। তারপর মনে মনে বললাম এ আবূ জাহলই হচ্ছে তাঁর সব চাইতে বড় শত্রু। ততক্ষণাৎ তার গৃহে গমন করে দরজায় করাঘাত করলাম। সে বাহির হয়ে এসে (খুশি আমদেদ, খুশ আমদেদ) বলে আমাকে অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে স্বাগত জানাল এবং বলল, ‘কিভাবে এ অভাগার কথাটা আজ মনে পড়ে গেল?’ প্রত্যুত্তরে কোন ভূমিকা না করেই আমি সরাসরি বললাম, ‘তোমাকে আমি এ কথা বলতে এলাম যে, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর দ্বীনে আমি বিশ্বাস স্থাপন করেছি এবং যা কিছু আল্লাহর তরফ থেকে তাঁর উপর অবতীর্ণ হয়েছে তার উপরও বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমার কথা শ্রবণ করা মাত্র সে সশব্দে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলল, ‘আল্লাহ তোমার মন্দ করুন এবং যা কিছু আমার নিকট নিয়ে এসেছ সে সবেরও মন্দ করুন।[9]
ইমাম ইবনে জাওযী উমার (রাঃ)-এর বর্ণনা উদ্ধৃত করে বলেছেন যে, যখনই কোন ব্যক্তি মুসলিম হয়ে যেত তখনই লোক তার পিছু ধাওয়া করত এবং তাকে মারধর করত। সেও তাদের পাল্টা মারধর করত। এ জন্য যখন আমি মুসলিম হয়ে গেলাম তখন আমার মামা আসী বিন হাশিমের নিকটে গেলাম এবং তাঁকে আমার মুসলিম হয়ে যাওয়ার খবর জানালাম। আমার কথা শোনামাত্রই সে গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করল। তারপর কুরাইশের একজন বড় প্রধানের বাড়িতে গেলাম (সম্ভবতঃ আবূ জাহলের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে) এবং তাকেও বিষয়টি সম্পর্কে অবগত করলাম কিন্তু সেও গিয়ে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করল।[10]
ইবনে ইসহাক্ব বর্ণনা করেছেন যে, ইবনে উমার বলেন, যখন ‘উমার (রাঃ) মুসলমান হলেন তখন তিনি বললেন কে এমন আছে যে কোন কথাকে খুব প্রচার কিংবা ঢোল শোহরত করতে পারে? লোকেরা বলল, জামীল বিন মা’মার জুমাহী। একথা শোনার পর তিনিস জামীল বিন মা’মার জুমাহীর নিকট গেলেন, আমি তার সাথেই ছিলাম। ‘উমার তাকে বললেন যে, তিনি মুসলিম হয়ে গিয়েছেন। আল্লাহর শপথ এ কথা শোনামাত্র অত্যন্ত উচ্চ কণ্ঠে সে ঘোষণা করতে থাকল যে, খাত্তাবের পুত্র উমার বেদ্বীন হয়ে গিয়েছে। উমার তাঁর পিছনেই ছিলেন, তৎক্ষণাৎ তিনি এ বলে উত্তর দিলেন যে, ‘এ মিথ্যা বলছে। আমি বেদ্বীন হই নি বরং মুসলিম হয়েছি।’
যাহোক, লোকজনেরা তাঁর উপর চড়াও হল এবং মারপিট শুরু হয়ে গেল। এক পক্ষে জনতা এবং অন্য পক্ষে উমার; মারপিট চলতে থাকল। এত সময় ধরে মারপিট চলতে থাকল যে, সেই অবস্থায় সূর্য প্রায় মাথার উপর এসে পড়ল। উমার ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লেন। লোকজন তাঁকে ঘিরেই দাঁড়িয়ে ছিল। উমার বললেন, ‘যা খুশী করো। আল্লাহর শপথ! আমরা যদি সংখ্যায় তিন শত হতাম তাহলে মক্কায় তোমরা অবস্থান করতে, না আমরা করতাম তা দেখাদেখি হয়ে যেত।[11]
এ ঘটনার পর মুশরিকগণ আরও ক্রোধান্বিত এবং সংঘবদ্ধ হয়ে উঠল এবং উমার (রাঃ)-এর বাড়ি আক্রমণ করে তাঁকে হত্যা করার এক গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হল। যেমনটি সহীহুল বুখারীর মধ্যে ইবনে উমার হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন যে, উমার ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় ঘরের মধ্যেই অবস্থান করছিলেন এমন সময় আবূ ‘আমর আস বিন ওয়ায়েল সাহমী সেখানে আগমন করল। সে ইয়ামান দেশের তৈরী নকশাদার জোড়া চাদর এবং রেশম দ্বারা সুসজ্জিত চমকদার জামা পরিহিত অবস্থায় ছিল। তার সম্পর্ক ছিল সাহম গোত্রের সাথে এবং জাহেলিয়াত যুগে এ গোত্র বিপদ-আপদে আমাদের সাহায্য করবে বরে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল।
সে জিজ্ঞেস করল, ‘কী ব্যাপার’?
উমার (রাঃ) বললেন, ‘আমি মুসলিম হয়ে গিয়েছি এবং এ জন্যই আপনার জাতি আমাকে হত্যা করতে ইচ্ছুক।
আস বলল, ‘তা সম্ভব নয়।’
আসের এ কথা শুনে আমি মনে কিছুটা শান্তি পেলাম, কিছুটা তৃপ্তি অনুভব করলাম।
তারপর আস সেখান থেকে ফিরে গিয়ে লোকজনদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করার উদ্যোগ গ্রহণ করল। তখন জনতার ভিড়ে সমগ্র উপত্যকা গিজ গিজ করছিল।
আমজনতার অগ্রভাগে অবস্থিত লোকজনকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমরা কোথায় চলেছ?’
উত্তরে তারা বলল, ‘আমরা চলেছি খাত্তাবের ছেলের একটা কিছু হেস্তনেস্ত করতে। কারণ, সে বেদ্বীন (বিধর্মী) হয়ে গিয়েছে।’
আস বলল, ‘না সে দিকে যাবার কোন পথ নেই।’
এ কথা শুনা মাত্রই জনতা আর অগ্রসর না হয়ে তাদের পূর্বের স্থান অভিমুখে ফিরে গেল।[12]
উমারের ইসলাম গ্রহণের কারণে মুশরিকগণের এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল যা ইতোপূর্বে আলোচিত হল। অপর পক্ষে মুসলিমদের অবস্থা সম্পর্কে অাঁচ-অনুমান কিংবা কিছুটা ধারণা লাভ করা সম্ভব হবে এর পাশাপাশি আলোচিত পরের ঘটনাটি থেকে। মুজাহিদ ইবনে আব্বাস হতে বর্ণনা করেছেন, আমি উমার বিন খাত্তাব (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম যে, কী কারণে লকব বা উপাধি ‘ফারূক’ হয়েছে। তখন তিনি আমাকে বললেন, ‘আমার তিনদিন পূর্বে হামযাহ (রাঃ) মুসলিম হয়েছিলেন, তারপর তিনি তাঁর ইসলাম গ্রহণের ঘটনা বর্ণনা করে শেষে বললেন যে, ‘আমি যখন মুসলিম হলাম তখন আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আমরা কি সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত নই, যদি জীবিত থাকি কিংবা মরে যাই?
নাবী (সাঃ) ইরশাদ করলেন, ‘অবশ্যই! সেই সত্ত্বার শপথ যাঁর হাতে আমার জীবন, তোমরা যদি জীবিত থাক কিংবা মৃত্যুমুখে পতিত হও হক বা সত্যের উপরেই তোমরা রয়েছ।’
উমারের বর্ণনা : ‘তখন আমি সকলকে লক্ষ্য করে বললাম যে, গোপনীয়তার আর কী প্রয়োজন? সেই সত্তার শপথ যিনি আপনাকে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন, আমরা অবশ্যই গোপনীয়তা পরিহার করে বাইরে যাব।
তারপর আমরা দু’টি সারি বেঁধে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে দু্’সারির মধ্যে নিয়ে বাইরে এলাম। এক সারির শিরোভাগে ছিলেন হামযাহ (রাঃ) আর অন্য সারির শিরোভাগে ছিলাম আমি। আমাদের চলার কারণে রাস্তায় যাঁতার আটার মতো হালকা ধূলি কণা উড়ে যাচ্ছিল। এভাবে যেতে যেতে আমরা মসজিদুল হারামে গিয়ে প্রবেশ করলাম। উমার (রাঃ) বলেছেন, ‘কুরাইশগণ যখন আমাকে এবং হামযাহকে মুসলিমদের সঙ্গে দেখল তখন মনে মনে তারা এত আঘাতপ্রাপ্ত হল যে, এমন আঘাত ইতোপূর্বে আর কখনো পায়নি। সেই দিনই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমার উপাধি দিয়েছিলেন ‘ফারূক’’[13]
ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেছেন যে, যতদিন পর্যন্ত উমার (রাঃ) ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেননি ততদিন পর্যন্ত আমরা ক্বাবা’হগৃহের নিকট নামায আদায় করতে সাহস করিনি।[14]
সুহাইব বিন সিনান রুমী বর্ণনা করেছেন যে, উমার (রাঃ) যে দিন ইসলাম গ্রহণ করলেন সে দিন থেকে ইসলাম তার গোপন প্রকোষ্ঠ থেকে বেরিয়ে এল বাইরের জগতে। সে দিন থেকে প্রকাশ্যে প্রচার এবং মানুষকে প্রকাশ্যে দ্বীনের আহবান জানানো সম্ভব হল।
পূর্বের সূত্র ধরেই বলা হয়েছে, ‘আমরা গোলাকার হয়ে আল্লাহর ঘরের পাশে বৈঠক করলাম এবং আল্লাহর ঘর প্রদক্ষিণ করলাম। যারা আমাদের উপর অন্যায় অত্যাচার করত আমরা তার প্রতিশোধ গ্রহণ করলাম এবং তাদের কোন কোন অন্যায়ের প্রতিবাদও করলাম।[15]
ইবনে মাসউদের বর্ণনাঃ ‘যখন হতে উমার (রাঃ) মুসলিম হয়েছিলেন তখন থেকে আমরা সমানভাবে শক্তিশালী হয়েছিলাম এবং মান-সম্মানের সঙ্গে বসবাস করতে পেরেছিলাম।’[16]
ফুটনোটঃ[1] ইবনুল জাওযী লিখিত তারীখে উমার বিন খাত্তাব পৃঃ ১১।
[2] তিরমিযী আরওয়াবুল মানাকের আবীহাফস উমার বিন খাত্তাব ২য় খন্ড ২০৯ পৃঃ।
[3] শাইখ মুহাম্মাদ গাযালীঃ ফিক্বহুস সীরাহ ৯২-৯৩ পৃঃ। তিনি উমার (রাঃ)-এর মানসিকতার দু’বিপরীতমুখী ধারা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
[4] ইবনে জাওযী তারীখে উমার বিন খাত্তাব ৬ পৃঃ। ইবনে ইসহাক্ব আতা এবং মোজাহেদ হতে একই রূপ বর্ণনা করেছেন। তবে তার শেষাংশ এটা হতে কিছুটা ভিন্ন। দ্রষ্টব্য সীরাতে ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৩৪৬ ও ৩৪৮ পৃঃ এবং ইবনে জাওযী নিজেও যাবের (রাঃ) হতে তাঁর মতই বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এর শেষাংশেও এ বর্ণনার বিপরীত আছে, দ্রঃ তারীখে উমার বিন খাত্তাব ৯-১০ পৃঃ।
[5] এ বর্ণনা হচ্ছে ইবনে ইসহাক্বের দ্রঃ ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৩৪৪ পৃঃ।
[6] এ বর্ণনা আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত দ্রঃ ইবনে জাওযী তারীখে উমার বিন খাত্তাব পৃঃ ১০ এবং মুখতাসারুস সীরাহ আবদুল্লাহ রচিত ১০৩ পৃঃ।
[7] এ বিষয়টি ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে, দ্রঃ মুখতাসারুস সীরাহ ১০২ পৃঃ।
[8] তারীখে ইবনে উমার পৃঃ ৭, ১০, ১১। শাইখ আবদুল্লাহ মুখতাসারুস সীরাহ পৃঃ ১০২-১০৩। সীরাতে ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৩৪৩-৩৪৬।
[9] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড পৃঃ ৩৪৯-৩৫০।
[10] তারীখ উমার বিন খাত্তাব পৃঃ ৮।
[11] তারীখ উমার বিন খাত্তাব পৃঃ ৮ ও ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৩৪৮-৩৪৯ পৃঃ।
[12] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৩৪৯ পৃঃ।
[13] ইবনে জাওযী- তারীখে উমার বিন খাত্তাব (রাঃ) ৬-৭ পৃঃ।
[14] শাইখ আব্দুল্লাহ – মুখতাসারুস সীরাহ পৃঃ ১০৩।
[15] ইবনে জাওযী, তারীখে উমার বিন খাত্তাব পৃঃ ১৩।
[16] সহীহুল বুখারীর উমার বিন খাত্তাবের ইসলাম গ্রহণ অধ্যায় ১ম খন্ড ৫৪৫ পৃঃ।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সমীপে কুরাইশ প্রতিনিধি (مُمَثِّلُ قُرَيْشٍ بَيْنَ يَدَي الرَّسُوْلِ ):
দু’জন সম্মানিত এবং প্রতাপশালী বীর অর্থাৎ হামযাহ বিন আব্দুল মুত্তালিব এবং উমার বিন খাত্তাব (রাঃ)-এর মুসলিম হওয়ার পর থেকে মুশরিকগণের অন্যায় অত্যাচার ও উৎপীড়নের মাত্রা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকে এবং মুসলিমদের সঙ্গে আচরণের ব্যাপারে পাশবিকতা ও মাতলামির স্থলে বিচার বুদ্ধির প্রয়োগ দৃষ্টিগোচর হতে থাকে। এ প্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে তাঁর প্রচার এবং তাবলীগের কর্ম থেকে নিবৃত্ত করার জন্য কঠোরতা এবং নিষ্ঠুরতা অবলম্বনের পরিবর্তে তাঁর সঙ্গে সদাচার করা এবং অর্থ, ক্ষমতা, নেতৃত্ব, নারী ইত্যাদি যোগান দেয়ার প্রস্তাবের মাধ্যমে তাঁকে প্রচার কাজ থেকে নিবৃত্ত করার এক নয়া কৌশল প্রয়োগের মনস্থ করে। কিন্তু সেই হতভাগ্যদের জানা ছিল না যে, সমগ্র পৃথিবী যার উপর সূর্য উদিত হয় দাওয়াত ও তাবলীগের তুলনায় খড় কুটারও মর্যাদা বহন করে না। এ কারণে এ পরিকল্পনায়ও তাদের অকৃতকার্য ও বিফল হতে হয়।
ইবনে ইসহাক্ব ইয়াযিদ বিন যিয়াদের মাধ্যমে মুহাম্মাদ বিন ক্বা‘ব কুরাযীর এ বর্ণনা উদ্ধৃত করেন যে, আমাকে বলা হয় যে, উতবাহ বিন রাবী’আহ যিনি গোত্রীয় প্রধান ছিলেন, একদিন কুরাইশগণের বৈঠকে বললেন- ‘ঐ সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মাসজিদুল হারামের এক জায়গায় একাকী অবস্থান করছিলেন, ‘হে কুরাইশগণ! আমি মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নিকট গিয়ে কেনই বা কথোপকথন করব না এবং তাঁর সামনে কিছু উপস্থাপন করব না। হতে পারে যে, তিনি আমাদের কোন কিছু গ্রহণ করে নিবেন। তবে যা কিছু তিনি গ্রহণ করবেন তাঁকে তা প্রদান করে আমরা তাঁকে তাঁর প্রচারাভিযান থেকে নিবৃত্ত করে দেব।’ এটা হচ্ছে সে সময়ের কথা যখন হামযাহ মুসলিম হয়ে গিয়েছিলেন এবং মুশরিকগণ দেখছিল যে, মুসলিমদের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মুশরিকগণ বলল, ‘আবুল ওয়ালীদ! আপনি যান এবং তাঁর সাথে কথাবার্তা বলুন। এরপর উতবাহ সেখান থেকে উঠে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট বসল এবং বলল, ‘ভ্রাতুষ্পুত্র! আমাদের গোত্রে তোমার মর্যাদা ও স্থান যা আছে এবং বংশীয় যে সম্মান আছে তা তোমার জানা আছে। এখন তুমি নিজ গোত্রের নিকট এক বড় ধরণের ব্যাপার নিয়ে এসেছ যার ফলে গোত্রভুক্ত বিভিন্ন লোকজনদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়ে গেছে। ওদের বিবেক-বুদ্ধিকে নির্বুদ্ধিতার সম্মুখীন করে ফেলেছ। তাদের উপাস্য প্রতিমাদের এবং তাদের ধর্মের দোষত্রুটি প্রকাশ করে মৃত পূর্ব পুরুষদের ‘কাফের’ সাব্যস্ত করছ। এ সব নানা সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে আমি তোমার নিকট কয়েকটি কথা পেশ করছি। তার প্রতি মনোযোগী হও। এমনটি হয়তো বা হতেও পারে যে, কোন কথা তোমার ভাল লাগবে এবং তুমি তা গ্রহণ করবে।’
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘আবুল ওয়ালীদ বল আমি তোমার কথায় মনোযোগী হব।’
আবুল ওয়ালীদ বলল, ‘ভ্রাতুষ্পুত্র! এ ব্যাপারে তুমি যা নিয়ে আগমন করেছ এবং মানুষকে যে সব কথা বলে বেড়াচ্ছ তার উদ্দেশ্য যদি এটা হয় যে, এর মাধ্যমে তুমি কিছু ধন-সম্পদ অর্জন করতে চাও তাহলে আমরা তোমাকে এত বেশী ধন-সম্পদ একত্রিত করে দেব যে, তুমি আমাদের সব চাইতে অধিক ধন-সম্পদের মালিক হয়ে যাবে, কিংবা যদি তুমি এটা চাও যে, মান-মর্যাদা, প্রভাব-প্রতিপত্তি তোমার কাম্য তাহলে আমাদের নেতৃত্ব তোমার হাতে সমর্পন করে দিব এবং তোমাকে ছাড়া কোন সমস্যার সমাধান কিংবা মীমাংসা আমরা করব না, কিংবা যদি এমনও হয় যে, তুমি রাজা-বাদশাহ হতে চাও তাহলে আমরা তোমাকে আমাদের সম্রাটের পদে অধিষ্ঠিত করে দিচ্ছি। তাছাড়া তোমার নিকট যে আগমন করে সে যদি জিন কিংবা ভূত-প্রেত হয় যাকে তুমি দেখছ অথচ নিজে নিজে তার কুপ্রভাব প্রতিহত করতে পারছ না, তাহলে আমার তোমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি এবং তোমার পূর্ণ সুস্থতা লাভ না হওয়া পর্যন্ত যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা প্রয়োজন আমরাই তা করতে প্রস্তুত আছি, কেননা কখনো কখনো এমনও হয় যে, জিন-ভূতেরা মানুষের উপর প্রাধান্য বিস্তার করে ফেলে এবং এ জন্য চিকিৎসার প্রয়োজনও হয়ে দাঁড়ায়।
উতবাহ এক নাগাড়ে এ সব কথা বলতে থাকল এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) গভীর মনোযোগের সঙ্গে তা শুনতে থাকলেন। যখন সে তার কথা বলা শেষ করল তখন নাবী কারীম (সাঃ) বললেন, ‘আবুল ওয়ালীদ! তোমার বলা কি শেষ হয়েছে? সে বলল, ‘হ্যাঁ’
নাবী (সাঃ) বললেন, ‘বেশ ভাল, এখন আমার কথা শোন।’
সে বলল, ‘ঠিক আছে শুনব।’
নাবী (সাঃ) বললেন,
{بسم الله الرحمن الرحيم حٰم تَنزِيْلٌ مِّنَ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ كِتَابٌ فُصِّلَتْ آيَاتُهُ قُرْآنًا عَرَبِيًّا لِّقَوْمٍ يَعْلَمُوْنَ بَشِيْرًا وَنَذِيْرًا فَأَعْرَضَ أَكْثَرُهُمْ فَهُمْ لَا يَسْمَعُوْنَ وَقَالُوْا قُلُوْبُنَا فِيْ أَكِنَّةٍ مِّمَّا تَدْعُوْنَا إِلَيْهِ}[فصلت:1: 5].
অর্থঃ হা’মীম, এ বাণী করুণাময় দয়ালু (আল্লাহ) এর তরফ থেকে নাজিলকৃ, এটা এমন একটি কিতাব, যার আয়াতগুলো বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, অর্থাৎ কুরআন যা আরবী ভাষায় (অবতারিত), জ্ঞানী লোকদের জন্য (উপকারী)। (এটা) সুসংবাদ দাতা ও ভয় প্রদর্শক কিন্তু অধিকাংশ লোকই মুখ ফিরিয়ে নিল। সুতরাং তারা শুনেই না। এবং তারা বলে, যে কথার প্রতি আপনি আমাদের ডাকেন সে ব্যাপারে আমাদের অন্তর পর্দাবৃত। (ফুসসিলাত ৪১ : ১-৫)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পাঠ করতে থাকেন এবং উতবাহ নিজ দু’হাত পশ্চাতে মাটির উপর রাখা অবস্থায় তাতে ভর দিয়ে শ্রবণ করতে থাকে। যখন নাবী (সাঃ) সিজদার আয়াতের নিকট পৌঁছে গেলেন। তখন সিজদা করলেন এবং বললেন, আবুল ওয়ালীদ তোমাকে যা শ্রবণ করানোর প্রয়োজন ছিল তা শ্রবণ করেছ, এখন তুমি জান এবং তোমার কর্ম জানে।
উতবাহ সেখান থেকে উঠে সোজা তার বন্ধুদের নিকট চলে গেল। তাকে আসতে দেখে মুশরিকগণ পরস্পর বলাবলি করতে থাকল, আল্লাহর শপথ! আবুল ওয়ালীদ তোমাদের নিকট সেই মুখ দিয়ে আসছে না যে মুখ নিয়ে সে গিয়েছিল, তারপর আবুল ওয়ালিদ যখন তাদের নিকট এসে বসল তখন তারা জিজ্ঞেস করল, ‘আবুল ওয়ালীদ! পিছনের খবর কি?’
সে বলল, ‘পিছনের খবর হচ্ছে আমি এমন এক কথা শুনেছি যা কোনদিনই শুনি নি। আল্লাহর শপথ! সে কথা কবিতা নয়, যাদুও নয়। হে কুরাইশগণ! আমরা কথা মেনে নিয়ে ব্যাপারটি আমার উপর ছেড়ে দাও। (আমার মত হচ্ছে) ঐ ব্যক্তিকে তার অবস্থায় ছেড়ে দাও। সে পৃথক হয়ে থেকে যাক। আল্লাহর কসম! আমি তার মুখ থেকে যে বাণী শ্রবণ করলাম তা দ্বারা অতিশয় কোন গুরুতর ব্যাপার সংঘটিত হয়ে যাবে। আর যদি তাকে কোন আরবী হত্যা করে ফেলে তবে তো তোমাদের কর্মটা অন্যের দ্বারাই সম্পন্ন হয়ে যাবে। কিন্তু এ ব্যক্তি যদি আরবীদের উপর বিজয়ী হয়ে প্রাধান্য বিস্তারে সক্ষম হয় তাহলে এর রাজত্ব পরিচালনা প্রকৃতপক্ষে তোমাদেরই রাজত্ব হিসেবে গণ্য হবে! এর অস্তিত্ব বা টিকে থাকা সব চাইতে বেশী তোমাদের জন্যই মঙ্গলজনক হবে।
লোকেরা বলল, ‘আবুল ওয়ালীদ! আল্লাহর কসম, তোমার উপরও তার যাদুর প্রভাব কাজ করেছে।’
উতবাহ বলল, ‘তোমরা যাই মনে করনা কেন, তাঁর সম্পর্কে আমার যা অভিমত আমি তোমাদের জানিয়ে দিলাম। এখন তোমরা যা ভাল মনে করবে, তাই করবে।[1]
অন্য এক বর্ণনায় এটা উল্লেখিত হয়েছে যে, নাবী কারীম (সাঃ) যখন তিলাওয়াত আরম্ভ করেছিলেন তখন উতবাহ নীরবে শুনতে থাকে। তারপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন এ আয়াতে কারীমা পাঠ করেন,
{فَإِنْ أَعْرَضُوْا فَقُلْ أَنذَرْتُكُمْ صَاعِقَةً مِّثْلَ صَاعِقَةِ عَادٍ وَثَمُوْدَ} [فصلت:13]
‘‘এরপরও তারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে বল- আমি তোমাদেরকে অকস্মাৎ শাস্তির ভয় দেখাচ্ছি- ‘আদ ও সামূদের (উপর নেমে আসা) অকস্মাৎ-শাস্তির মত।’ (ফুসসিলাত ৪১ : ১৩)
এ কথা শোন মাত্রই উতবাহ ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল এবং এটা বলে তার হাত রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মুখের উপর রাখল যে, আমি আল্লাহর মাধ্যম দিয়ে এবং আত্মীয়তার প্রসঙ্গটি স্মরণ করিয়ে কথা বলছি যে, এমনটি যেন না করা হয়। সে এ ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছিল যে প্রদর্শিত ভয় যদি এসেই যায়। এরপর সে সমবেত মুশরিকগণের নিকট চলে যায় এবং তাদের সঙ্গে উল্লেখিত আলাপ আলোচনা করে।[2]
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ২৯৩-২৯৪।
[2] তাফসীর ইবনে কাসীর ৬/১৫৯-১৬১।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সাথে কুরাইশ নেতৃবৃন্দের কথোপকথন (رؤساء قريش يفاوضون رسول الله):
কুরাইশগণ উক্তরূপ উত্তকে একেবারে নিরাশ হয়ে যায় নি কেননা তিনি (সাঃ) তাদেরকে স্পষ্ট করে কিছু বলেন নি, বরং উতবাহকে কয়েকটি আয়াত তেলাওয়াত করে শুনিয়েছেন মাত্র। অতঃপর ‘উতবাহ সেখান হতে ফিরে এসেছে। ফলে কুরাইশ নেতৃবৃন্দ পরস্পরে যাবতীয় বিষয়াদী সম্পর্কে পরামর্শ ও চিন্তা-ভাবনা করল।
অতঃপর একদিবসে তারা মাগরিবের পর কা’বাহর সম্মুখে একত্রিত হয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে ডেকে পাঠালে তিনি (সাঃ) দ্রুত সেখানে হাজির হলেন এমন মনে করে যে, তাতে হয়তো কোন কল্যাণ রয়েছে। যখন তিনি (সাঃ) তাদের মাঝে আসন গ্রহণ করলেন, তারা উতবাহর অনুরূপ প্রস্তাব পেশ করল। তাদের ধারণা ছিল যে, সেদিন ‘উতবাহ একা একা প্রস্তাব করাতে মুহাম্মাদ সম্মত হয়নি; তবে সবাই সম্মিলিতভাবে প্রস্তাব করলে তা মেনে নিবেন অবশ্যই। কিন্তু তাদের প্রস্তাব শোনার পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, তোমরা আমার ব্যাপারে এসব কি বলছ, আমি তোমাদের নিকটে কোন ধন-সম্পদ ও মর্যাদা চাই না। তোমাদের নিটক কোন রাজত্ব চাই না। তবে আল্লাহ তা’আলা আমাকে তোমাদের প্রতি রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছেন, তাঁর পক্ষ হতে আমার উপর কিতাব অবতীর্ণ করেছেন। আর আমাকে এ মর্মে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যেন আমি তোমাদেরকে ভাল কর্মের উত্তম ফলাফলের শুভসংবাদ দেই এবং অন্যায় ও পাপকর্মের শাস্তি সম্পর্কে ভীতি প্রদর্শন করি। সুতরাং আমি তোমাদের নিকট আমি রিসালাতের বাণী পৌছিয়ে দিচ্ছি এবং সৎ উপদেশ প্রদান করছি। আমি যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছি তা যদি তোমরা মেনে নাও তাহলো দুনিয়া ও আখিরাতে এর ভাল পরিণাম ভোগ করবে। আর যদি আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করো তবে আমার ও তোমাদের মধ্যে আল্লাহর ফায়সালা না আসা পর্যন্ত ধৈৰ্য্য ধারণ করে যাবো।
তারা ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে গিয়ে আরেক পদক্ষেপ গ্রহণ করলো। তা হলো তারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাজে দাবি জানালো যে, নাবী (সাঃ) যেন তাদের জমিন থেকে পাহাড়সমূহ দূরীভূত করে দেন, তাদের জমিন প্রশস্থ করে দেন। অতঃপর সেই জমিনে ঝর্ণা ও নদ-নদী প্রবাহিত করে দেন। আর তিনি (সাঃ) যেন তাদের মৃতদেরকে জীবিত করে দেন; বিশেষ করে কুসাই বিন কিলাবকে। তিনি (সাঃ) এসব কর্ম সম্পাদন করলেই কেবল তারা ঈমান আনবে। তাদের এ কথার জবাবে রাসূল (সাঃ) পূর্বের ন্যায় জবাব দিলেন।
এরপর তারা আবার অন্য একটি বিষয় উত্থাপন করলো- তারা বললো নাবী (সাঃ) যেন তার প্রভুর নিকট একজন ফেরেশতাকেও নাবী করে পাঠান যিনি মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর দাবীকে সত্যায়ন করবে। আর আল্লাহ তা’আলা যেন তাঁকে বাগ-বাগিচা, ধন-সম্পদ ও স্বর্ণের অট্টালিকা প্রদান করেন। এবারও রাসূল (সাঃ) একই জবাব দিলেন।
অতঃপর তারা চতুর্থ একটি বিষয় উপস্থাপন করলো- মুহাম্মাদ যেহেতু তাদের শাস্তির ভয় দেখায় সুতরাং কুরাইশরা নাবী (সাঃ) এর কাছে আযাব আনয়ন করার দাবি জানালো এবং এও বললো তাদের উপর যেন আকাশ হয়ে পড়ে। (আল্লাহ তা’আলা যথাসময়ে এটা সম্পাদন করবেন।)
শেষ পর্যায়ে তারা ভীষণ হুমকি দিল এমনকি তারা বললো, আমরা তোমাকে সহজে ছেড়ে দেবনা, এতে হয় আমরা তোমাকে শেষ করবো অথবা আমরা নিঃশেষ হবো। তাদের এ ধরনের ধমকি শোনার পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অত্যন্ত চিন্তান্বিত হয়ে স্বীয় পরিবারবর্গের নিকটে ফিরে গেলেন।
ফুটনোটঃ
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে হত্যার ব্যাপারে আবূ জাহলের অস্বীকার (عزم ابي جهل على قتل رسول الله):
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন কুরাইশ নেতৃবৃন্দের নিকট হতে ফিরে আসলেন তখন আবূ জাহল কুরাইশ নেতৃবৃন্দের মধ্যে ঘোষণা দিয়ে বললো, ‘কুরাইশ ভ্রাতৃবৃন্দ। আপনার সম্যকরূপে অবগত আছেন যে, মুহাম্মাদ (সাঃ) আমাদের ধর্মে কলঙ্ক রটাচ্ছে, আমাদের পূর্বপুরুষের নিন্দা করছে, আমাদের জ্ঞান বুদ্ধিকে খাটো বলে রটনা করছে এবং দেবদেবীগণের অবমাননা করছে। এ সব কারণে আল্লাহ তা’আলার শপথ করে বলছি যে, আমি এক খণ্ড ভারী এবং সহজে উঠানো সম্ভব এমন পাথর নিয়ে বসব এবং মুহাম্মাদ (সাঃ) যখন সিজদায় যাবে তখন সেই পাথর মেরে তার মাথা চূর্ণ করে ফেলব। এখন এ অবস্থায় তোমরা আমাকে এক অসহায় ছেড়ে দাও, আর না হয় সাহায্য কর। বনু আবদে মানাফ এর পর যা চাই তা করুক’। উপস্থিত লোকেরা বলল, ‘আল্লাহর শপথ! আমরা তোমাকে অসহায় ছেড়ে দিতে পারি না। তুমি যা করার ইচ্ছে করেছ তার করে ফেল।
সকাল হলে আবূ জাহল তার ঘোষণার অনুরূপ একখণ্ড পাথর নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর অপেক্ষায় বসে থাকল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যথা নিয়মে আগমন করলেন এবং সালাতে রত হলেন। কুরাইশগণও সেখানে উপস্থিত হয়ে আবূ জাহলের কথিত কাণ্ড দেখার জন্য অপেক্ষামান রইল। যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সিজদায় গমন করলেন তখন আবূ জাহল পাথর উঠিয়ে তাঁর দিকে অগ্রসর হল, কিন্তু নিকটে পৌঁছে পরাস্ত সৈনিকের মতো স্ববেগে পশ্চাদপসরণ করল। এ সময় তাকে অত্যন্ত বিবর্ণ এবং ভীত সন্ত্রস্ত দেখাচ্ছিল। তার দু’হাত পাথরের সঙ্গে শক্তভাবে চিমটে লেগে গিয়েছিল। পাথরের গা থেকে হাত ছাড়াতে তাকে যথেষ্ট কষ্ট করতে এবং বেগ পেতে হয়েছিল।
এ দিকে কুরাইশগণের মধ্য থেকে কিছু সংখ্যক লোক দ্রুত তার নিকট এগিয়ে আসে এবং বলতে থাকে, আবূল হাকাম! ব্যাপারটি হল কী? কিছুই যেন বুঝে উঠছি না।
সে বলল, ‘আমি রাত্রিবেলা যা বলেছিলাম তা করার জন্যই এগিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু যখন তাঁর নিকটে গিয়ে পৌঁছলাম তখন একটি উট আমার সামনে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াল। হায় আল্লাহ! কক্ষনো আমি এমন মস্তক, এমন ঘাড় এবং এমন দাঁতবিশিষ্ট উট দেখি নি। মনে হল সে যেন আমাকে খেয়ে ফেলতে চাচ্ছে।
ইবনে ইসহাক্ব বলেন, আমাকে বলা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, ‘উষ্ট্রের রূপ ধারণ করে সেখানে ছিলেন জিবরাঈল (আঃ)। আবূ জাহল যদি আমার নিকট যেত তাহলে তার উপর বিপদ অবতীর্ণ হয়ে যেত।[1]
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিলমা ১ম খণ্ড ২৯৮-২৯৯ পৃঃ।
সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা ও কিছু ছাড় দেয়া (مساومات وتنازلات):
কুরাইশগণ বিভিন্নভাবে চেষ্টা-প্রচেষ্টা, ভীতি প্রদর্শন, হুমকি-ধমকি দিয়েও ব্যর্থ হলো এবং আবূ জাহল যে ন্যাক্কারজনক সংকল্প গ্রহণ করেছিল তা বিফল হলো তখন তারা সমস্যা থেকে উত্তোরণের নতুন কৌশল অবলম্বনের চিন্তা-ভাবনা করলো। তাদের মনে এ ধারণা ছিল না যে, মুহাম্মাদ (সাঃ) সত্য নাবী নয় বরং তাদের অবস্থান সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, لَفِي شَكٍّ مِنْهُ مُرِيبٍ -তারা বিভ্রান্তিকর সন্দেহে রয়েছে। (সূরাহ শূরা : ১৪ আয়াত)
কাজেই তারা সিদ্ধান্ত নিল যে, দীনের বিষয়ে মুহাম্মাদের সাথে কিছু সমতা আনয়ন এবং মধ্যপন্থা অবলম্বনের। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে কিছু বিষয় পরিত্যাগ করতে বলার চিন্তাভাবনা করলেন। এতে তারা ধারণা করলো যে, তারা এবার একটা প্রকৃত সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছে যদিও রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সত্য বিষয়ের প্রতি আহবান করে থাকেন।
ইবনে ইসহাক্ব বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কাবাহ গৃহ ত্বাওয়াফ করছিলেন এমতাবস্থায় আসওয়াদ বিন মুত্তালিব বিন আসাদ বিন আব্দুল উযযা, ওয়ালীদ বিন মুগীরাহ, উমাইয়া বিন খালাফ এবং আস বিন ওয়ায়িল সাহমী তার সামনে উপস্থিত হলেন। এঁরা সকলেই ছিলেন নিজ নিজ গোত্রের প্রধান। তাঁরা বললেন, ‘হে মুহাম্মাদ (সাঃ) এসো। তুমি যে মা’বুদের উপাসনা কর আমরাও সে মা’বুদের উপাসনা করি এবং আমরা যে মা’বুদের উপাসনা করি তোমরাও সে মা’বুদের উপাসনা কর। এরপর দেখা যাবে, যদি তোমাদের মা’বূদ কোন অংশে আমাদের মা’বূদ চেয়ে উন্নত হয় তাহলে আমরা সেই অংশ গ্রহণ করব, আর যদি আমাদের মা’বূদ কোন অংশে তোমার মা’বূদ চেয়ে উন্নত হয় তাহলে সেই অংশ গ্রহণ করবে। এ প্রেক্ষিতেই আল্লাহ তা’আলা সূরাহ কূল ইয়া আইয়্যুহাল কাফিরুন সম্পূর্ণ অবতীর্ণ করেন। যার মধ্যে জলদগম্ভীর সূরে ঘোষণা করা হয়েছে যে,
قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ لَا أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُونَ
‘বল, ‘হে কাফিররা! ২. তোমরা যার ইবাদাত কর, আমি তার ইবাদাত করি না।’ (আল-কাফিরূন ১০৯ : ১-২)[1]
আবদ বিন হুমায়েদ ও অন্যান্য হতে একটি বর্ণনা এভাবে রয়েছে যে, মুশরিকগণ প্রস্তাব করল যে, যদি আপনি আমাদের মাবূদকে গ্রহণ করেন তবে আমরাও আপনার আল্লাহর ইবাদত কর।[2]
ইবনে জারীর এবং তাবারানীর এক বর্ণনায় রয়েছে যে, মুশরিকগণ নাবী কারীম (সাঃ)-এর নিকট প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন যে, যদি তিনি এক বছর যাবৎ তাদের মা’বূদের (প্রভুর) পূজা অৰ্চনা করেন তাহলে তারা নাবী (সাঃ)-এর প্রভু প্রতিপালকের ইবাদত (উপাসনা) করবে।
قُلْ أَفَغَيْرَ اللَّهِ تَأْمُرُونِّي أَعْبُدُ أَيُّهَا الْجَاهِلُونَ
“বল, ওহে অজ্ঞরা! তোমরা কি আমাকে আল্লাহ ছাড়া অন্যের ইবাদত করার আদেশ করছ?” (যুমার : ৬৪ আয়াত) আল্লাহ তা’আলা তাদের এহেন হাস্যকর কথার এমন স্পষ্ট ও দৃঢ় জবাব দেওয়ার পরও মুশরিকরা বিরত হলো না বরং আরো অধিক হারে এ ব্যাপারে প্রচেষ্টা করতে থাকল। এমনকি তারা এ দাবি করলো যে, মুহাম্মাদ যা নিয়ে এসেছে তার কিছু অংশ যেন পরিবর্তন করে। তারা বললো, ائْتِ بِقُرْآنٍ غَيْرِ هَٰذَا أَوْ بَدِّلْهُ
তারা বলে, ‘এটা বাদে অন্য আরেকটা কুরআন আন কিংবা ওটাকে বদলাও’। (সূরাহ ইউনুস : ১৫ আয়াত)
আল্লাহ তা’আলা নিম্নোক্ত আয়াত অবতীর্ণ করে তাদের দাবিকে প্রত্যাখ্যান করেন,
قُلْ مَا يَكُونُ لِي أَنْ أُبَدِّلَهُ مِنْ تِلْقَاءِ نَفْسِي إِنْ أَتَّبِعُ إِلَّا مَا يُوحَىٰ إِلَيَّ إِنِّي أَخَافُ إِنْ عَصَيْتُ رَبِّي عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيمٍ
আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন, বল, “আমার নিজের ইচ্ছেমত ওটা বদলানো আমার কাজ নয়, আমার কাছে যা ওয়াহী করা হয় আমি কেবল সেটারই অনুসরণ করে থাকি। আমি আমার প্রতিপালকের অবাধ্যতা করলে এক অতি বড় বিভীষিকার দিনে আমি শাস্তির ভয় করি”। (সূরাহ ইউনুস : ১৫ আয়াত)
আর এরকম কাজের মহাদুর্ভোগ সম্পর্কে সতর্ক করে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন,
وَإِنْ كَادُوا لَيَفْتِنُونَكَ عَنِ الَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ لِتَفْتَرِيَ عَلَيْنَا غَيْرَهُ وَإِذًا لَاتَّخَذُوكَ خَلِيلًا وَلَوْلَا أَنْ ثَبَّتْنَاكَ لَقَدْ كِدْتَ تَرْكَنُ إِلَيْهِمْ شَيْئًا قَلِيلًا إِذًا لَأَذَقْنَاكَ ضِعْفَ الْحَيَاةِ وَضِعْفَ الْمَمَاتِ ثُمَّ لَا تَجِدُ لَكَ عَلَيْنَا نَصِيرًا
“আমি তোমার প্রতি যে ওয়াহী করেছি তাথেকে তোমাকে পদস্থলিত করার জন্য তারা চেষ্টার কোন ত্রুটি করেনি যাতে তুমি আমার সম্বন্ধে তার (অর্থাৎ নাযিলকৃত ওয়াহীর) বিপরীতে মিথ্যা রচনা কর, তাহলে তারা তোমাকে অবশ্যই বন্ধু বানিয়ে নিত। – আমি তোমাকে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত না রাখলে তুমি তাদের দিকে কিছু না কিছু ঝুঁকেই পড়তে। – তুমি তা করলে আমি তোমাকে এ দুনিয়ায় দ্বিগুণ আর পরকালেও দ্বিগুণ আযাবের স্বাদ আস্বাদন করাতাম। সে অবস্থায় তুমি তোমার জন্য আমার বিরুদ্ধে কোন সাহায্যকারী পেতে না।” (সূরাহ বানী ইসরাঈল : ৭৩-৭৪ আয়াত)
ফুটনোটঃ[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৩৬২পৃঃ
[2] ফাতহুল ক্বাদীর, ইমাম শাওকানী, ৫ম খণ্ড ৫০৮ পৃঃ।
কুরাইশদের হতভম্বতা, প্রানান্তকর প্রচেষ্টা এবং ইহুদীদের সাথে মিলে যাওয়া (حيرة قريش وتفكيرهم الجاد واتصالهم باليهود):
কুরাইশদের সর্বপ্রকার উদ্যোগ যখন ব্যর্থ হলো তখন কুরাইশদের কাছে অন্ধকার নেমে আসলো। হতভম্ভ হয়ে গেল তারা। এমন অবস্থায় তাদের মধ্যেকার অন্যতম শয়তান নাযর বিন হারিস একদিন কুরাইশগণকে আহবান জানিয়ে বললেন, ‘ওহে কুরাইশ ভাইগণ। আল্লাহর শপথ তোমাদের সম্মুখে এক মহা দুর্যোগপূর্ণ সময় উপস্থিত হয়েছে, অথচ তোমরা আজ পর্যন্ত এর কোন প্রতিকার কিংবা প্রতিবাদ কোনটাই করতে পার নি। মুহাম্মাদ (সাঃ) যখন তোমাদের মধ্যে যুবক ছিল, তখন সকলের প্রিয় পাত্র ছিল। সবার চেয়ে সত্যবাদী ও বিশ্বাসী ছিল। এখন যখন তার কান ও মাথার মধ্যেকার চুল সাদা হতে চলল (অর্থাৎ বয়সবৃদ্ধি পেয়ে মধ্য বয়সে পৌঁছল) এবং তোমাদের নিকট কিছু বাণী ও বক্তব্য উপস্থাপন করল তখন তোমরা বলছ যে, সে একজন যাদুকর। না, আল্লাহর শপথ যে যাদুকর নয়। আমরা যাদুকর দেখেছি তাদের ঝাড় ফুঁক ও গিরাবন্দিও দেখেছি, কিন্তু এর মধ্যে সে রকম কোন কিছুই দেখছিনা’।
তোমরা বলছ যে, সে একজন কাহিন।
কিন্তু তাকে তো কাহিন বলেও মনে হয় না। আমরা কাহিন দেখেছি, দেখেছি তাদের অসার বাগাড়ম্বর, উল্টোপাল্টা কাজ কর্ম এবং বাক চাতুর্য। কিন্তু এঁর মধ্যে তেমন কিছুই দেখিনা।
তোমরা বলছ, সে কবি, কিন্তু তাঁকে কবি বলেও তো মনে হয় না। আমরা কবি দেখেছি এবং কাব্যধারা হাজয, রাজ